বাসিতান পেনিনসুলা - রনিন

ফ্যান্টাসি উপন্যাস

অলংকরণ : সুমিত রায়

ঘোষণা: জলের তলায় লুকিয়ে থাকে প্রকৃতির সম্পদ। সেই সম্পদের হাতছানিতে সাড়া দিতে বহু মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সমস্ত বিপদকে অগ্রাহ্য করে, বছরের পর বছর অভিযান চালিয়েছেন এইসব দুর্গম জলজ এলাকায়। অনেকেই সফল হয়েছেন, ফিরে এসেছেন নতুন আবিষ্কারের আনন্দ নিয়ে। কেউ কেউ জীবনের সেরা অভিযানের রোমাঞ্চ নিয়ে দেশে ফিরেছেন। কিন্তু এদের মধ্যে অনেকেই চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছেন নীল মৃত্যুর অতলে। প্রতিবছর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অভিযাত্রীদের মৃত্যুর পরিসংখ্যান, যদিও অভিযানের উন্মাদনায় ঘাটতি পড়েনি কখনও। আধুনিক প্রযুক্তি বিপদ কমাতে সাহায্য করলেও, কোথায় কখন মৃত্যু হামলে পড়বে ডুবুরিদের ওপর তা অনুমান করা দুঃসাধ্য।

এই গল্পের অবতারণা সেই সব অসমসাহসী ডুবুরিদের অদম্য মনোবল আর কৌতূহলকে কুর্নিশ জানাতে।

এক

“বন্ধুরা, বিপদে পড়েছি...কেউ শুনতে পাচ্ছ?...বায়রন...লিন...কেউ আছো? ...সাহায্য চাই...এক্ষুনি!”

বেতার ভাষণে মার্টিনের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠলো শেষের দিকে। ও ভয় পেয়েছে। জিয়নের-ও হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো হঠাৎ করে। স্বাভাবিক। মার্টিন তার খুব কাছেই ছিল মিনিট খানেক আগে। তাই বিপন্নকে বাঁচাবার দায়িত্ব এখন তার ঘাড়েই বর্তায়।

“কেউ শুনতে পাচ্ছ?”

কথাগুলো যেন আতঙ্কের ভারে ন্যুব্জ, ভারী নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দে প্রায় দুর্বোধ্য সে শব্দ তরঙ্গ, “সাহায্য চাই, এই মুহূর্তে-” মার্টিনের করুণ আর্তি।

জিয়ন মাথা ঘোরায়, জলের মধ্যে ভাসমান তার চেহারা আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় দিকপরিবর্তন করে। কাজটা সহজ নয়, মাটির নিচে এই সুড়ঙ্গে নড়াচড়া করা পাকা ডুবুরিদের পক্ষেও কঠিন। জিওন পারে, কারণ তার ‘গুরু’ রে তাকে প্রতিমুহূর্তে শিখিয়েছেন, “সেই বাঁচবে, যে মরতে চায় না।”

মরতে চায় না সে, সহজে। তাই এই অদম্য জেদে ভর করে মাত্র আট মাসের প্রশিক্ষণেই জিয়ন এগিয়ে যায় সহযাত্রীর আবেদনে সাড়া দিতে।

সুড়ঙ্গপথে ঘোলা কাদা জল ধূসর কুয়াশার মত ভেসে আসছে তার দিকে। সে নিশ্চিত হয়, মার্টিনের নড়াচড়ায় এই ধুলোঝড় উঠেছে জলের নিচে। কপাল ভালো, আগেই অভিযানের নেতা বায়রন শক্ত নাইলনের তার বেঁধে দিয়েছিলেন গতিপথে, আঙুলের ফাঁকে সেই জীবনতন্ত্রীর স্পর্শ নিয়েই পিছন ফেরে জিয়ন।

এ কী? পাথরের চাঙড়? সুড়ঙ্গপথের ছাদ থেকে খসে পড়েছে প্রস্তর খণ্ড, তার নিচেই আপাতত চাপা পড়েছে মার্টিন।

দ্রুত সেদিকে এগোতে গিয়ে তরুণ অভিযাত্রী ঘোষণা করে, “জিয়ন বলছি। মার্টিনকে খুঁজে পাওয়া গেছে।”

“মার্টিনকে নিয়ে বেসে ফিরে যাও।” বেতারে লিনের নির্দেশ ভেসে এলো, বায়রনের পর সেই-ই অভিযানের নেত্রী।

মার্টিনের দিকে এগোতেই আবার বিপত্তি, তাড়াহুড়োয় পায়ের মোটা জুতো লতাগুল্মের ফাঁসে আবদ্ধ। মৃত্যুর কালো ভারী শরীরটাকেই যেন চারপাশে নিঃশব্দে অনুভব করলো জিয়ন।

“কেউ আছো? কেউ?” মার্টিনের আর্তনাদ মনে করিয়ে দেয় তাকে, হাতে সময় কম।

দলের সকলের কাছেই এসব পরিস্থিতি খুব স্বাভাবিক হলেও প্রত্যাশিত নয়। জিয়ন কাঁধের পাশ থেকে ছুরি বার করে, অনেক কষ্টে শরীরটাকে বেঁকিয়ে পায়ের কাছে জড়িয়ে থাকা লতাগুল্মের বেষ্টনী কাটতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না তার! ভারসাম্য রাখতে না পেরে হাতছাড়া করে ফেললো সে ছুরিটাকে। এবার হাত দিলো সে কোমরে, দু নাম্বার ছুরি। লতাগুল্মের ফাঁস থেকে মুক্তি পেয়ে সে দ্রুত গতিতে এগোলো মার্টিনের দিকে।

নেতা বায়রনের গলা শোনা গেলো, “আপডেট?” জিয়ন আপাতশান্ত গলায় ঘোষণা করলো, “বিপদ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে।”

আর দেরি নয়, সাঁতরে মার্টিনের কাছে পৌঁছায় সে, দুহাতে ঠেলা দেয় পাথরের টুকরোটাকে। “আরেকটা ধাক্কা...” মার্টিন যেন ধড়ে প্রাণ পেয়েছে।

জীবন মৃত্যুর এই সীমানায় সে যে একা নয় এই বোধটাই তার মধ্যে লড়াইয়ের ক্ষমতা ফিরিয়ে এনেছে আবার। দুজনের মিলিত ধাক্কায় পাথরটা সরে যায়, মুক্তি পায় মার্টিনের শরীর, “আহ, বেঁচে গেলাম এ যাত্রা!”

“শয়তানের দিব্যি!”

আঁতকে ওঠে মার্টিন আবার, তাদের নড়াচড়ায় যে আরো চাঙড় ভেঙে পড়ছে সুড়ঙ্গের ছাদ থেকে সেটা এবার সে দেখতে পেয়েছে পরিষ্কার। জিয়নের কঠিন হাতের টানে সরে যায় তার সম্মোহিত শরীর, প্রস্তর খণ্ডের গতিপথ থেকে। জলে পড়ে বিপুল বেগে ধাক্কা খায় প্রথমে, কয়েকটা টুকরো ভেঙে চুরমার হয়ে জলের মধ্যে তৈরী করে আলোড়ন। কিন্তু ততক্ষণে মার্টিনের হাত ধরে জিয়ন ভেসে চলেছে উপরের দিকে, যেখান থেকে সূর্যের উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি ভেসে আসছে। নীল জলের সীমানা ছাড়িয়ে, মৃত্যুর অন্ধকূপ পেরিয়ে।

জলতলের উপরে এসে মুখোশ খুলে ফেলে স্বস্তির শ্বাস নেয় মার্টিন, জিয়ন তাকে টেনে তোলে খাড়াই বেয়ে। তাদের সাহায্য করতে ছুটে আসে লেরয়, আমান্ডা এবং টোনি।

“মার্টিন নিরাপদ।” দলের সকলকে জানিয়ে দেয় সে।

অভিযান সফল হয়নি সে যাত্রায়, কিন্তু জিয়নের কপালে প্রশংসা জুটেছিল দেদার। সবথেকে বড় পুরস্কার ছিল নেত্রী লিনের মিষ্টি কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠের ঘোষণা, “ইউ আর এ টাফ গাই!”

***

“নীল অন্ধকার! মাটির নিচে জলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটুকরো ভয়ানক নরক যা শীতল কিন্তু অতল সুন্দর। ‘নীল গহ্বর’ প্রকৃতির হাতে তৈরী একখণ্ড ‘টাইম ক্যাপসুল’। যেখানে মায়ের মমতায় আমাদের সকলের অলক্ষ্যে পৃথিবী লুকিয়ে রেখেছে অগণিত রহস্যের চাবিকাঠি। যারা সেই গোলকধাঁধায় ঝাঁপিয়ে পড়তে চাও, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো লেকচারের শেষে। আমি নিশ্চিত, আমার মত তোমাদের রক্তেও আছে অভিযানের উন্মাদনা।”

কথাগুলো বলে মন্ত্রমুগ্ধ ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিলেন প্রাজ্ঞ অভিযাত্রী রে জর্জ। শ্রোতাদের অসাড় দৃষ্টিতে শুধুই শ্রদ্ধা। বিপদকে ছুঁয়ে দেখার মধ্যে যে মজা লোকটার প্রতিটা উচ্চারিত শব্দে ধ্বনিত হচ্ছিল তাতেই ছাত্রকুল একেবারে আটখানা। প্রৌঢ় ভদ্রলোকের ঋজু চেহারায় কেমন একটা মায়াময় প্রশান্তি।

লেকচার শেষ হলে একমাত্র জিয়ন এসেছিলো ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করতে। রে সানন্দে রাজি হয়েছিলেন এই নবীনকে নিজের দলে টানতে।

“বুঝলে, কঠিন অনুশাসন এবং নিয়মানুবর্তিতাই ‘আন্ডারওয়াটার কেভ ডাইভিং’-এ সাফল্য পেতে সাহায্য করবে। চলে এস একদিন আমাদের ডেরায়। অনুশীলন শুরু করতে হবে, সবকিছু ঠিক থাকলে পরের বছরের এক্সপিডিশনে তোমাকেও সঙ্গে নেওয়া যাবে।” হেসে বলেছিলেন তিনি।

সেই শুরু, রে-র নেতৃত্বে এবং প্রশিক্ষণে খুব অল্পদিনেই পটু হয়ে উঠেছিল সে ডাইভিংয়ে। পরবর্তী চারবছরে সাতখানা অভিযানে যোগ দিয়েছে সে।

গুরুকন্যা লিন প্রথম দিন থেকেই তাকে বন্ধু করে নিয়েছে। উত্তর দিয়েছে জিয়নের সবরকম বোকা বোকা কৌতূহলী প্রশ্নের, তার প্রতিটি পদক্ষেপে দিয়েছে তার সাবধানী দৃষ্টি।

এমন সময় একদিন রে পেলেন চিনহোই লেকে অভিযানের আমন্ত্রণ। সেমেস্টার পরীক্ষার জন্য সে অভিযানে যোগ দিতে পারেনি জিয়ন। যাবার আগে রয় মেসেজ পাঠিয়েছিলেন ছাত্রকে, “স্টাডি ওয়েল কিড, সি ইউ এট দ্য এন্ড অফ দ্য টানেল।”

না, দেখা হয়নি আর। রে হারিয়ে গেছেন অন্তহীন কোনো এক বিসর্পিল সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধায়। তাঁর মৃতদেহটা শেষ অব্দি খুঁজে না পেয়ে ফিরে আসে তার শিষ্যরা। লিন কিন্তু এখনও স্বপ্ন দেখে বাপের দেহটাকে অতল জলের ফাঁদ থেকে উদ্ধার করে সে ফিরিয়ে আনবে দেশের মাটিতে।

মেসেজটা এখনো ফোনে সেভ করে রাখা আছে জিয়নের। রে-র মৃত্যুর পর লিন নিয়েছিল একাডেমির দায়িত্ব, অনেকের আপত্তি সত্ত্বেও।

“বাবার মৃতদেহটা যদি কোনওদিন উদ্ধার করতে পারি তাহলেই একমাত্র অভিযান বন্ধ করবো, নচেৎ নয়।” কঠিনভাবে জানিয়েছিল লিন।

একাডেমি বন্ধ হয়নি, দলও ভাঙেনি। বরং তরুণীর হাত ধরে একাডেমি চলেছে মসৃণ গতিতে।

তাদের দু’জনের বন্ধুত্বও বেড়েছে সেই সঙ্গে।

সেই লিন-ই একদিন ওর হাতে তুলে দিয়েছিলো ছেঁড়াখোঁড়া বইখানা।

একজন প্রখ্যাত ডুবুরির ডাইরি। পিটার ম্যান্ডি--- নামটা শুনেই চমকে উঠেছিল জিয়ন। ভদ্রলোক ১৯৭২ সালে দক্ষিণ আমেরিকার এক জলে নিমজ্জিত গুহায় অভিযান চালান, সম্পূর্ণ একা। ফলাফল চমকে দেবার মত। তিনি ঘোষণা করেছিলেন পৃথিবীর সব থেকে গভীরে এই গুহার বিস্তার। কম করেও সাড়ে চারশো মিটার তো হবেই। সবাই হেসেছিলো তার দাবি শুনে। তাঁর মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছিল আপামর অভিযাত্রীরা। নিন্দুকদের জবাব দিতেই একের পর এক অভিযানে নেমে পড়েছিলেন পিটার। নীল অন্ধকার থেকে তুলে এনেছিলেন অসাধারণ সব দর্শনীয় সামগ্রী, জোর গলায় বলেছিলেন, মানুষের অস্তিত্ব ছিল একদিন সেখানে। কেউ বিশ্বাস করেনি তার কথা, হতাশায় বেপরোয়া পিটার সমালোচকদের জবাব দিতেই আবার ডুব দিয়েছিলেন অতলান্তে, আর ফিরে আসেননি কোনওদিন। যদিও সে কথা পৃথিবীর মানুষ জানতে পারে তাঁর অন্তর্ধানের তিন বছর পরে। অজ্ঞ সমালোচকদের জন্য অবশ্য পিটার রেখে গেছেন একখানা ডাইরি, দক্ষিণ আমেরিকার এই অন্ধকূপের নানা বিবরণী লিপিবদ্ধ আছে সে বইয়ে। অবশ্য সেখানেও বিফল তিনি, হাতেগোনা কিছু মানুষ সে বই পড়েছে, এমনকি বইটা “অতিরিক্ত গাঁজা ভাং খাবার ফল!”--- কেউ কেউ বলেছেন। লিনের হাতে বইখানা দেখে ঠিক সে কথাটাই প্রথমে মনে পড়েছিলো জিয়নের। সে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়েছিল বান্ধবীর দিকে। যে বই দেখলেই ভৌগোলিকরা উপেক্ষায় নাক সিঁটকান সেই বই কিনা পড়ছে লিন নিজে? বইখানা তার মুখের সামনে ঝাঁকিয়ে বলেছিলো কৈফিয়ত দেবার ঢঙে, “সত্যি মিথ্যে যাই হোক না কেন, বইটা পড়তে খাসা।”

“পড়া শেষ?” জিয়ন প্রশ্ন করেছিল।

“ঠিক পাঁচ ঘন্টা সাড়ে সতেরো মিনিটে।” লিন হেসে উত্তর দিয়েছিলো। তার হাত থেকে কেড়ে নিজের ব্যাগে বইখানা চালান করে দিয়েছিলো জিয়ন, “কাল বিকেলে পাবে।”

কথাটা বলে ক্যাফে ছেড়ে রাস্তায় পা দিয়েছিল সে।

রাত্রি নামার আগে পারির রাস্তা পরীদের মতো সেজে উঠেছে। পথে পথে মানুষের ভিড়। জিয়ন বাসে চেপে একটা বসার জায়গা দেখেই বই খুলে বসে, কানে হেডফোন গুঁজে ফোনে মিউজিক চালিয়ে দেয় সে। চাইনিজ ব্যাম্বু ফ্লুটের সুর চারিদিকের ভিড়কে হঠাৎ যেন অদৃশ্য করে দেয়। সব চেহারা, সব শব্দ তরঙ্গ বিলীন হয়ে যায়। শুধু সংগীতের শান্ত সুর আর বইয়ের ধূসর ছাপার অক্ষর, তাদের হাত ধরেই সে ডুবে যায় শব্দসমুদ্রে।

“ভয়ঙ্কর সমুদ্রকে ভয় পাই না, সেই কারণেই তো নৌকায় পাল খাটানো শিখেছি।” পিটার এই কথাগুলো দিয়েই শুরু করেছেন তার ডাইরি। অদক্ষ অপটু লেখা। তাঁর কৈশোর আর শিক্ষাদীক্ষা সম্পর্কে বিশেষ লেখা নেই বইয়ে। সবটা জুড়েই তার সমুদ্রের প্রতি ভালোবাসা, জলের প্রতি টান ব্যক্ত। প্রতি ছত্র জুড়ে শুধু একটাই কথা, “বাসিতান পেনিনসুলা” এবং সেখানকার নৈঃসর্গিক সৌন্দর্য।

পেনিনসুলা মানে ভূগোলের ভাষায়- ‘জলে ঘেরা একটুকরো ভূখণ্ড’। মেক্সিকো এবং কিউবার মাঝখানে উত্তর পূর্বদিকে ক্যারিবিয়ান সমুদ্র, ঠিক সেখানেই মেক্সিকোর ভূখণ্ড থেকে দেড়শো এবং কিউবা থেকে মাত্র আশি মাইল দূরে সমুদ্রের নীল জলরাশির মাঝখানে বাসিতান পেনিনসুলার অবস্থান। মাত্র ত্রিশ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে এই পেনিনসুলার বিস্তার। সবটুকু ভূখণ্ডে ঘন অরণ্য, মাঝখানে ছোট পাহাড়ের টিলায় ঘেরা বৃত্তাকার সুনীল গহ্বর। পিটারের দাবি, ওই মৃত্যগোলকের নিচেই আছে ভয়ানক সুড়ঙ্গ, সেপথেই যাত্রা করেছিলেন দুঃসাহসী অভিযাত্রী একদিন।

“...মৃত্যরূপী এক অনন্ত গুহাপথ। সর্পিল, সংকীর্ণ পথে ধীরগতিতে পৌঁছতে হয় সেখানে।এতো সংকীর্ণ সে পথ যে মাঝেমধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয়। কোনো মতেই একমুহূর্ত অক্সিজেন মুখোশ ছাড়া বাঁচা যাবে না, কারণ বৃষ্টির জল জমেই তৈরী হয়েছে এই মৃত্যগুহা। সেই একই কারণে এই জলপথ সম্পূর্ণ প্রাণহীন। না কোনো উদ্ভিদ আছে, না আছে কোনো জীবিত প্রাণী...”

বাস থেকে নেমে জিয়ন রাস্তায় নামে, দ্রুত পথ পেরিয়ে জনাকীর্ণ ফুটপাথ ধরে। চোখ কিন্তু নিবদ্ধ বইয়ের পাতায়।

“বোকা কোথাকার!” একজন মধ্যবয়স্কা ভদ্রমহিলা হাতের মুঠো তার মুখের সামনে ঘুরিয়ে চেঁচায়। কারণ জানা নেই। তবুও “দুঃখিত!” কথাটা চকিতে ছুঁড়ে দিয়ে ছেলেটা ভিড়ের দিকে এগিয়ে যায়। এক মুহূর্তও নষ্ট করা উচিত নয়। অন্তত যতক্ষণ বইটা তার হাতে আছে।

“...অনেকটা গুড়িপথ এগোনোর পর সামনে আসে বিস্তীর্ণ প্রান্তর, সেখানে আশ্চর্য দৃশ্য! মাটির ওপর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত প্রস্তরখণ্ড। সে প্রস্তরখণ্ডকোনো এক জাদুমন্ত্রে সজ্জিত একের পর এক, যেন কোনো এক সোপান শ্রেণী। প্রকৃতির এই স্থাপত্য চোখ জুড়িয়ে দেয়, চিত্তকে করে বিকল....”

এপার্টমেন্টের দারোয়ানকে মাথা নেড়ে সম্ভাষণ জানিয়ে জিয়ন লিফটে চেপেছিল। যদিও তার চোখ ডুবে ছিল বইয়ের পাতায়। পনেরোতলার বোতাম চেপে আবার সে হারিয়েছিল শব্দের আড়ালে। দরজা বন্ধ হয়ে যাবার আগে তার মনে হয় কোনো এক ভদ্রলোক ছুটে আসছিলেন এলিভেটরের উদ্দেশে, কিছু বলছিলেন কি?

শোনা হয়নি, জিয়নের মন জুড়ে এখন শুধু বাসিতানের নিষিদ্ধ সৌন্দর্য। কানের মধ্যে দিয়ে সুরের স্নিগ্ধতা চুঁইয়ে পড়ছে অন্তরে।

“...সেপথ ধরে কিছুটা এগোতেই সামনে এসে দাঁড়ালো একখানা প্রকাণ্ড সিংহদরজা। পাল্লা দুটো কবেই হারিয়ে গিয়েছে, এখন শুধু পড়ে আছে দরজার খাঁচাটা। দুপাশে দানবাকৃতির দুখানা ধাতু নির্মিত সিংহ। তাদের মুখ খোলা, মনে হয় কোনো এক সময় এই মুখগহ্বর থেকে নির্গত হত ঝর্ণার মত জলের ধারা। অসাধারণ সে স্থাপত্যকীর্তি, ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। মন অস্থির হয়ে ওঠে, এই অভূতপূর্ব সভ্যতার সৌন্দর্য আরো জানতে মন নেশাতুর হয়ে ওঠে। কিন্তু অক্সিজেন সিলিন্ডারের অবস্থা বিপজ্জনক, হাতে সময় খুব কম। তবুও আরো কিছুটা পথ না গিয়ে পারি না...”

জিয়ন বইটাকে বগলদাবা করে পকেট থেকে চাবি বার করে লক ঘোরাতে যায়, কিন্তু অবাক কাণ্ড, দরজা খুলে মায়ের মুখখানা উঁকি মারে, “এতো দেরি হলো?”

প্রশ্নটাও ছুটে এলো তৎক্ষণাৎ।

ঘরে ঢোকার অবকাশে ঘড়ির দিকে আড়চোখে তাকায় জিয়ন, “সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে? কখন?”

উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে না সে, কারণ সে জানে মা যখন ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি পৌঁছে গেছেন তখন নিশ্চয় ঘড়িটার সময় মাপার কোনো খুঁত নেই।

“ইন্টারভিউ দিতে গেছিলাম,” বইটাকে টেবিলের ওপর রেখে সে জলের বোতল খোঁজে।

“ব্যাংক?” মায়ের প্রশ্ন আবার।

“না, ইউনিভার্সিটি।” দ্বিধাজড়ানো গলায় বলে জিয়ন।

“ কর্পোরেট ছেড়ে একাডেমি? তা কী বললেন ওঁরা?” মায়ের গলায় উদ্বিগ্ন প্রশ্ন আবার।

“কর্তৃপক্ষ খুশি, ওঁরা বলেছেন কাগজপত্র নিয়ে দেখা করতে, তবে ডিন ফিরছেন আড়াই মাস পরে, ততদিন অপেক্ষা করতে হবে।”

ছেলের হাতে জলের বোতল ধরিয়ে দিয়ে মায়ের কড়া কণ্ঠ বেজে ওঠে, “এই সময়টায় একটু ঘুরে ফিরে নাও, এরপর আর সময় পাবে না কিন্তু।”

‘ঘোরা ফেরা’ বলতে ভদ্রমহিলা ঠিক কী বোঝাচ্ছেন সেটা জিয়ন ভালো করেই বোঝে বলেই চুপ করে ছিল।

“ওসব ‘লিভ টুগেদার’ চলবে না বলে দিলাম। একদম বিয়ে করা ভদ্র মেয়ে চাই বৌ হিসেবে। বাঙালি হলে সব থেকে ভালো। নিদেনপক্ষে ভারতীয় হলেও চলবে।” ভদ্রমহিলা বিড়বিড় করে ওঠেন।

“আজ বেরোব, একটু পরে।” জিয়ন বলে ওঠে। এমন আলোচনা থেকে দূরে পালানোর একটা পথ চাই তার।

মায়ের আশাবাদী চোখ চক চক করে ওঠে। ছেলের পশে গিয়ে দাঁড়ান।

“ডেট আছে আজ।” জিয়ন নিচু গলায় বলে। মায়ের গলা এবার আহ্লাদে আটখানা।

“কার সঙ্গে রে?” প্রশ্ন অবধারিত।

“বাবার সঙ্গে...” জিয়ন হাসে।

উত্তর শুনে ক্ষণিকের নিস্তব্ধতা।

“ওহ, বাপের সঙ্গে রোজ বুঝি লুকিয়ে দেখা সাক্ষাৎ চলছে?” মায়ের অভিমানী মুখ। জিয়ন ঠাট্টা করতে ভোলে না, “রোজ নয়, মাঝে সাঝে।”

“তা, বুড়োকে জিজ্ঞেস করেছিস আমার বেলায় ফোন বন্ধ রাখার কারণ কী?” ভদ্রমহিলার তিরিক্ষে গলা।

“হাঁ, বাবা বলেছে তুমি দিনে তিরিশবার ফোন কর, গতকাল নাকি এগারোটা মেসেজ পাঠিয়েছ।” ছেলে মুচকি হেসে চিমটি কাটে মাকে।

“ঠিক আছে... সে যাক গে, তোর বাপের সেই অমর মহাকাব্যের কতটা হলো? যেটা লিখে উনি নাকি কীসব পুরস্কার টুরস্কার জিতবেন বলে এই স্বেচ্ছা সন্ন্যাস নিয়েছেন?” ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন তিনি।

“দু সপ্তাহ এখনও, নাবিক এখন সবে মাঝ দরিয়ায়।” জিয়ন কাঁধ ঝাকিয়ে উত্তর দেয়।

“গল্পটা শুনলি? কেমন? ট্রাজিক নিশ্চয়?” উদ্বিগ্ন প্রশ্ন আবার এবং তারপরেই তাঁর মতামত, “তোর বাপের সবকটা গল্পই অমন দুঃখী দুঃখী।”

“শুনেছি, কিন্তু আমার ভালো লাগেনি। বাবা বলেছে, তোমাকে কিচ্ছুটি না বলতে। এও বলেছে, ‘পারি সবসময় আমার লেখাকে প্রভাবিত করতে চায়। কিন্তু এবার ওর কোনো কথা শুনবো না। সম্পূর্ণ নিজের মত করবো গল্পের শেষটা...”

পারি মানে পর্ণিকা রায়, এ কথা শুনে মুখ বেঁকান, বেশ ঝাঁঝালো গলায় ঝামটে ওঠেন, “বলে দিবি, ভদ্রলোকের যতটুকু নাম হয়েছে সবটুকুই আমার কল্যাণে। যতসব দুঃখী দুঃখী গল্প লিখতো এককালে। কেউ পড়েও দেখতো না সেসব। এবার দেখবো, কোন পুরস্কারটা জেতে তোর বাপের বই।”

কথাটা সত্যি বটে, ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন ফ্রেঞ্চ ভাষা, সেখান থেকে দূতাবাসে চাকরি, সেখানেই যোগাযোগ ফ্রেঞ্চ লেখক রেঁনের সঙ্গে। বয়সে বেশ খানিকটা বড়ই ছিলেন ভদ্রলোক, তবুও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তাঁকেই বিয়ে থা করে থিতু হলেন প্যারিস শহরে। এখনও ফ্রেঞ্চদের মাতৃভাষা শেখান তিনি, তবে প্যারিসে অবস্থিত মার্কিন ইউনিভার্সিটিতে। স্বামীকে খুব করে বাংলা ভাষা শিখিয়েছিলেন একসময়, রেঁনে অনেক কষ্টে বলতে শিখেছেন শুধুমাত্র হাতেগোনা কয়েকটা শব্দ, ‘ফাটাফাটি’ , ‘আমি বাঙালি’ , ‘কোথায় যাচ্ছ’ , ‘কী খাচ্ছ’ এবং নিশ্চিতভাবে “আমি তোমায় ভালোবাসি”।

অনেক সংঘর্ষের পর বিগত কয়েক বছরে লেখকের নামযশ বেড়েছে, ইদানিং খবরের কাগজে তাঁর বই নিয়ে আলোচনা হয় বেশ জাঁকজমক সহকারে। পর্ণিকা স্বামীর গর্বে শুধু গরবিনীই নন, তাঁর কড়া সমালোচনাই যে রেঁনের সাফল্যের চাবিকাঠি সে কথা সবাইকে জানাতেও ভোলেন না।

বাপকে মাতৃভাষা প্রায় ভুলিয়ে দিয়ে পারি মনের সুখে ছেলেকে শিখিয়েছেন বাংলা ভাষা, পড়িয়েছেন রবি ঠাকুর থেকে সুনীল গাঙ্গুলি। মিলিটারি শাসনে বাংলাকে চিনতে শিখিয়েছেন। চারদিকের বিদেশী মানুষগুলোকে তাদের ভাষা শিখিয়ে বাড়িতে ফিরে ছেলের সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা বলেন পারি। ফেলে আসা ঘরের দুঃখ কিছুটা হলেও মেটে তাতে। বিদেশটাকে একসময় সত্যিই নিজের ঘর মনে হয় তার। কারণে অকারণে রেঁনের লেখায় মাথা গলান তিনি বিশেষত গল্পের শেষটা সবসময় হওয়া চাই তার মনের মত। তা না হলেই পারির ঘ্যানঘ্যানানি। ফলত বাধ্য হয়েই সেটা পরিবর্তন করেন রেঁনে, মুখ গোমড়া করেই। এবার তাই ঠিক করেছেন, সম্পূর্ণ “স্বাধীনভাবে” তিনি তাঁর উপন্যাস শেষ করবেন, পত্নীর কাছে প্রমাণ করবেন তিনি একাই একশো, অন্তত সাহিত্যের ক্ষেত্রে তো বটেই। সেই বাসনাতেই একখানা ঘর ভাড়া নিয়েছেন দুটো গলি পরেই। পণ করেছেন উপন্যাস শেষ না করে বাড়ি ফিরবেন না। আর তাই নিয়েই চাপানউতোর চলছে বাপ আর মায়ের মধ্যে। মাঝখান থেকে যুযুধান দুপক্ষের হয়ে দৌত্য করতে হচ্ছে জিয়নকেই।

“আমি যাই, আজ আবার আদেলার বাড়িতে নেমন্তন্ন আছে, বাপের সঙ্গে দেখা করে খাবার খেয়ে নিস্।” পারি ছেলের জন্য পরবর্তী নির্দেশ জারি করে বান্ধবীর বাড়ির দিকে রওনা হন।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচে জিয়ন, তাড়াতাড়ি পিটারের বই তুলে নেয়।

“...কিছুটা এগোতেই চোখ জুড়িয়ে যায়। একমানুষ সমান পাথুরে আয়তক্ষেত্রগুলো মানুষের হাতে বানানো সিঁড়ির রূপ ধারণ করছে, ধাপে ধাপে উঠে গেছে উঁচুতে। এতো উঁচুতে যে ঘাড় তুলে মাথা উঠিয়ে দেখতে হয় সে শিল্পকার্য। মেগালিথ। কে বানিয়েছে এ সব? কাদের বাসস্থান ছিল এই নিমজ্জিত নগর, সভ্যতা? মায়া সভ্যতা? নাকি নাম না জানা কোনো জনগোষ্ঠী? প্রশ্নের পর প্রশ্ন। এমন সময় হঠাৎ বুঝতে পারি, সময় আসন্ন, সিলিন্ডারে অক্সিজেনের হিসাব আমার অভিযানের পরিপন্থী হয়। মনে অদম্য কৌতূহল নিয়েও ফিরতে হবে এবার...”

জিয়ন চোখ বন্ধ করে। মনের দৃষ্টিতে ফুঁটে ওঠে পিটারের বর্ণিত নগরখানা, শরীরে জাগে শিহরণ। ভদ্রলোক যে ফিরে আসতে পেরেছিলেন তার প্রমাণ এই বইখানা। কিন্তু কী ঘটেছিলো তার পরবর্তী অভিযানে? জানতে মন ছটফট করে ওঠে তার তরুণ হৃদয়। এমন সময় হঠাৎ ঘড়ির দিকে নজর যায়, রেঁনের সঙ্গে দেখা করার সময় এখন, সে বই রেখে উঠে পড়ে ডিভান থেকে।

Ça va?” রেঁনের প্রশ্নের উত্তরে কাঁধ ঝাকিয়ে উত্তর দেয় জিওন, “Comme d’hab!!” ফ্রেঞ্চ ভাষায় সাধারণ সৌজন্য বিনিময় শেষ করে ছেলে বসে পড়ে বাপের কাছ ঘেঁষে। পার্কের বেঞ্চে বাপ ছেলে বসে অনেকক্ষণ মশগুল হয়ে পড়ে কথোপকথনে।

“লিন কেমন আছে?” মুচকি হেসে হঠাৎই ছেলেকে প্রশ্ন করেন রেঁনে।

“ভালোই, কেন?” জিয়ন অবাক হয়।

এসব ব্যাপারে ছেলে যে কথা বলতে পছন্দ করে না বিশেষ সেটা বাপের অজানা নয়, কথা ঘোরাতেই তিনি বলে ওঠেন, “এমনিই, যাই হোক, রিসার্চের সুযোগ পেলে ছাড়িস না কিন্তু। মেরিন বায়োলজি এখন বেশ একটা উত্তেজক ব্যাপার।”

“দেখি, সব কিছুই নির্ভর করছে ডিনের সঙ্গে সাক্ষাতের ওপর। আমি ওসব নিয়ে বেশি ভাবছি না এখন। কোনো কিছু না হলে জীবন ভর জলের নিচে গুহায় গুহায় ঘুরে বেড়াব।” জিয়ন বলে ওঠে, তার স্বপ্নালু চোখে দুরাশার ছায়া।

ছেলের এলোমেলো ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দেন রেঁনে, “সেটাও মন্দ নয়, তবে কিনা কলেজের প্রতিযোগিতায় সাঁতারে পদক পাওয়া এক ব্যাপার আর ওরকম বিপজ্জনক অবস্থায় ঘুরে বেড়ানো আরেক ব্যাপার। তরুণ জীবনে উত্তেজনার খোঁজ সবাই করে, কিন্তু ভুলে গেলে হবে না আমাদের জন্য তোর ভালো থাকাটা কতটা দরকারি।”

বাপের দাড়ি গোঁফে ঢাকা বয়স্ক মুখে কি মায়া-মমতার অভিব্যক্তি দেখা যায়? স্বভাব বাউন্ডুলে লোকটার মনে তার জন্য এতটা স্নেহ?

জিয়ন হাসে, “মা কিন্তু তোমার ওপরে খাপ্পা হয়ে আছে। পারলে একবার ফোন করে নিও। চলি এবার?” রেঁনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জিয়ন দৌড় লাগায় লাইব্রেরির দিকে।

বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে, লাইব্রেরি আর স্টাডি থেকে বেরতে পারেনি জিয়ন। তার মনের মধ্যে এক আশ্চর্য চাঞ্চল্য কাজ করছে, পিটারের বইখানা থেকে নোটস নিচ্ছে সে, মন দিয়ে হিসেব নিকেশ করছে। মাঝে মাঝে সে সব বন্ধ করে চোখ বুজে ভাবছে আবার হিসেবে কষছে। সপ্তাখানেক এভাবে চলার পর একদিন সে সবকটা কাগজ ছিঁড়ে ফেললো, বইটা ব্যাগে নিয়ে লিনকে মেসেজ পাঠালো, “ক্যাফে? চারটে?”

চটজলদি উত্তর এলো, “পাঁচটা।” জিয়ন হাসলো, একঘন্টা কাটাবার ব্যবস্থাও ভেবে রেখেছে সে আগে থেকে।

“সব মিলিয়ে কত খরচ?” সে হাতের লিস্ট স্থুলাকৃতি মধ্যবয়স্কা ভদ্রমহিলার হাতে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো। গভীর বিষণ্ণ চোখে ভদ্রমহিলা তালিকা খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই ফাঁকে দোকানের চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নেয় জিয়ন, ডুবুরিদের প্রয়োজনীয় সব রকম জিনিসপত্রে ঠাঁসা জায়গাটা।

“আমাদের কাছে রিব্রিদার আছে, কোনো চিন্তা নেই।” মহিলার গলা শুনতে পেয়ে চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায় জিয়নের, খুশি হয় সে। যাক, পিটারের মত অক্সিজেন নিয়ে অসুবিধা হবে না তার। সিলিন্ডারে জমানো অক্সিজেন বারবার ব্যবহার করা যাবে, যতক্ষণ খুশি। যদিও তারও একটা সময়সীমা আছে তবুও সেটা তার একার জন্য যথেষ্ট।

“মোটামুটি হাজার ত্রিশেক মতো...” মহিলার দ্বিধা এটা পরিষ্কার করে দেয় খরচের মাত্রা আরও বাড়তে পারে।

“আমি আবার আসবো, ধন্যবাদ।” কোনোরকমে মুখ লুকিয়ে ছিটকে দোকান থেকে বেরিয়ে আসে জিয়ন। তার একাউন্টে স্ট্রাইপেন্ডের টাকা সব মিলিয়ে হাজার দশেক, বাকিটা আসবে কোথা থেকে? হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে গতিপথ পরিবর্তন করে, ক্যাফের দিকে।

“বইটা অসাধারণ, ধন্যবাদ।” লিনের হাতে বইখানা সমর্পণ করে বলেছিলো জিয়ন।

লিন জানে না, বইয়ের একটা ফটোকপি এখন সাজানো আছে জিয়নের স্টাডিতে।

“দুপুরে বেরিয়েছিলাম, নতুন অভিযানের প্রস্তুতি নিতে। নেক্সট অক্টোবর আমরা যাচ্ছি বাহামা,” উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে লিন।

“স্পনসর পাওয়া গেলো শেষ অব্দি তাহলে? অভিনন্দন।” হাসিমুখে বলে জিয়ন।

“ওসব সোজা ব্যাপার, অনেক সংস্থা আছে এখন, সবাই অর্থের পরিবর্তে চায় একটুখানি খ্যাতি আর লাভের বখরা। সেটুকু পেলেই ওরা খুশি।” হাসির ঝর্ণা লিনের চোখে মুখে।

হাসে জিয়নও, কিন্তু আত্মগতভাবে।

“আচ্ছা, বাসিতান...” সাবধানে থেমে থেমে সে উচ্চারণ করে।

“একদম নয়। আরেকবার নামটা উচ্চারণ করলে সপাটে ঘুষি মারবো মুখে। তোমার নিরীহ মুখের ভূগোল পাল্টে দেব এক নিমেষে!” লিনের মুখ গম্ভীর। এমন প্রতিক্রিয়া সেই-ই দিতে পারে যে নিজে ওখানে পা রাখার কথা আগেই ভেবেছে এবং সমস্ত প্রতিকূলতার কথা ভেবে অনেক দুঃখে পিছিয়ে এসেছে। লিন এই অভিযানকে সমর্থন করবে না। জিয়ন নিশ্চিত হয়।

বাধ্য হয়েই সে কথা ঘোরায়, “আরে না না, আমি শুধু ভাবছিলাম একবার ওখানকার ব্যাপারে সিরিয়াস রিসার্চ করলে হতো না?”

লিন চোখ ছোট করে আবার আক্রমণ করে, “আবার বলছি, স্বপ্নেও নয়। ওসব ছেঁদো গল্প বইয়েই পড়তেই ভালো লাগে, বুনো হাঁসের পিছনে ছুটে বেড়ানোর ইচ্ছে অথবা উৎসাহ দুটোর কোনোটাই নেই আমার। আর যদি ওসব ব্যাপার নিয়ে তোমার বেশি উৎসাহ দেখি তাহলে---” নিজের মুষ্টিবদ্ধ হাতটা তার মুখের সামনে ধরে নাচায় লিন। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখে হাসি টেনে এনেছিল ছেলেটা, “ধুর, ওসব ছাড়ো। আচ্ছা শুনলাম তুমি ফাবিওর সঙ্গে ডেট মারতে গেছিলে, তার কী হলো?”

সঙ্গে সঙ্গে মুখের ভাব পরিবর্তন হয় লিনের, “ফাবিও ভালো ছেলে, বেশি ভাবে না, কথা বলতে শুরু করলে থামে না। অবশ্য আমার নিজেরও বই মুখে নিয়ে ঘোরা অন্তর্মুখী ছেলেপিলে বিশেষ একটা পোষায় না।”

সূক্ষ খোঁচার হুল বিরস মুখে হজম করে জিয়ন উত্তর দেয়, “ভালো, আশা করি তোমাদের সময় ভালো কাটবে। এবার চলি।” ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে পড়ে সে।

তার যাত্রাপথের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে লিন, মুখে গভীর চিন্তার ছাপ।

রাত গভীর, পাশের ঘরে পারি ঘুমোচ্ছে অঘোরে।

জিয়ন দ্রুত খাটে উঠে বসে, ল্যাপটপের আলো জ্বলে ওঠে নিঃশব্দে। মেলবক্স খুলে অধৈর্য দুটো চোখ রাখে নতুন মেলগুলোর দিকে।

“লুই পেটিট” - নামটা দেখে উত্তেজনায় চকচক করে ওঠে তার চোখ দুটো।

“আগামী কাল ছটায়, ক্যাফে ‘ডি ফ্লোরে।” মেলে লেখা বাক্যদুটো বারবার করে পড়ে সে।

লোকটা ভালো নয়, সবরকম বেনামি ভয়ানক কাজে লিপ্ত তার সংগঠন। কিন্তু বাসিতানের দরজা খুলে যেতে পারে একমাত্র ওদেরই সাহায্যে। অনেক কষ্টে গোপনে শুধু ইমেইল আইডিটুকুই জোগাড় করতে পেরেছিল জিয়ন, কোটি টাকার লাভের হিসেব দেখিয়ে টোপ ফেলেছিল সে, তাতে যে কাজ হয়েছে সেটা তার উত্তরেই পরিষ্কার। এরপরে দরকার ছিল শুধু একটা বিশ্বাসযোগ্য অভিনয়।

দুই

মানচিত্রে ‘মেরিদা’ শহরটা মেক্সিকোর একদম পূর্বদিকে।

তিনদিন আগেই সোজা পারি থেকে আমেরিকার মাটি ছুঁয়ে MCRI বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে ফ্লাইট। মাতৃভূমি ছেড়ে জিয়ন নেমেছে মেক্সিকোর মাটিতে। সঙ্গে একটা ব্যাগ ভর্তি দরকারি জিনিসপত্র-ভিসা, পাসপোর্ট, জামা কাপড়।

জলে নামার জন্য দরকারি জিনিপত্র পৌঁছে গেছে গতকাল সকালে, সবকিছুর মধ্যে আছে গভীর গোপনীয়তা। বাসিতান আসলে মেক্সিকো আর কিউবার ঠিক মাঝখানে অবস্থিত দ্বীপ। ছোট্ট এই দ্বীপের অধিকার নিয়ে দুদেশে ভয়ানক টানাপোড়েন। মানুষ বাস করে না এখানে, তাহলে কী গুরুত্ব এই দ্বীপটার?

দ্বীপের উত্তর প্রান্তে আছে ঘন জঙ্গল, বাকিটা ঊষর পাথুরে উপত্যকা। জঙ্গলে আছে স্নায়ু চিকিৎসার জন্য দরকারি ভেষজ, অমূল্য সে বনজ সম্পদের অধিকার নিয়ে রক্তের খেলায় মেতেছে দুদেশ। কিউবা চিকিৎসা শাস্ত্রে ধূমকেতুর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের নিজেদের গবেষণায় এই ভেষজ আনতে পারে বৈপ্লবিক অগ্রগতি। ওদিকে আবার মেক্সিকোর সরকারি মহলে রয়েছে এই বহুমূল্য জীবনদায়ী ভেষজ দুনিয়াকে বেঁচে হাজার কোটি টাকার সম্পদ হজম করার উচ্চাশা। সে সব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই জিয়নের। তার লক্ষ্য ওই ঊষর পাথুরে উপত্যকা, যেখানে আছে বাসিতানের নীল গহ্বরের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য্য, সেখানে যেভাবেই হোক অভিযান চালানো। মাসে দুবার মেক্সিকোর ওষুধ কোম্পানি দাভিটা মেডিকোর লোকেরা বাসিতানের জঙ্গলে প্রবেশের অনুমতি পায়। সেটাও হেলিকপ্টারে চড়ে, ওষুধি জোগাড় করে দুদিন পরেই তারা ফেরে আবার মেক্সিকো।

এই হেলিকপ্টারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে সে, শরীর জুড়ে নতুন অভিযানের আনচান অনুভূতি। এসব ব্যবস্থা করে দিয়েছে লুই, এমনকি হেলিকপ্টারের মালিক হুয়ান ও তারই লোক, অবশ্যই পয়সার বিনিময়ে। বাসিতান থেকে যদি কোনো বহুমূল্য জিনিস আবিষ্কৃত হয় তাহলে তার চল্লিশ শতাংশ ফেরত দিতে হবে লুইকে। প্রথমে অবশ্য সে শুরু করেছিল ষাট শতাংশ দিয়ে, জিয়ন উঠে পড়েছিল চেয়ার ছেড়ে, “৪০%, টেক ইট ওর লিভ ইট।” সে বুকে পাথর রেখে বলেছিলো।

খুব সংক্ষেপে লুই বলেছিলো, “তুমিই জিতলে ছোকরা,” তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলো, “মনে রেখো কোনো চালাকি নয়, একটু বেচাল দেখলেই ড্রাগ চালানকারী বলে হাজতে পাঠিয়ে দেব। কেউ জানতেও পারবে না মেক্সিকোর এক প্রত্যন্ত গ্রামে আজীবন পচবে নরকের জীবের মত।” ঢোক গিলে রাজি হয়েছিল জিয়ন। তারপর আর কোনো চিন্তাই করতে হয়নি তাকে, সবকিছু এগিয়েছে মসৃণভাবে। বন্ধুর বাড়িতে ছুটি কাটাতে যাচ্ছি বলে বাড়ি ছেড়েছিল সে, লিনকেও মুখ দেখায়নি সে, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় ছিল। ভয় ছিল এতবড় একটা অভিযানের পরিকল্পনা বিফল হয়ে যাবারও। কিন্তু কী অপেক্ষা করে আছে এই অভিযানের শেষে? মৃত্যু না কি পড়ে পাওয়া গুপ্তধন? জীবন নাকি মেক্সিকোর জেল?

আকাশ থেকে ফটফট করে শব্দ ভেসে আসে, দুশ্চিন্তার কালো অন্ধকার সরিয়ে জিয়ন মাথা তুলে তাকায়। হেলিকপ্টার নামছে হাওয়ার ঝড় তুলে, সে ঝড়ের ছোয়া তরুণ অভিযাত্রীর ধমনীতেও। মাটি স্পর্শ করে হেলিকপ্টার, একজন মজবুত মানুষ নেমে এগিয়ে আসে তার দিকে, হাত বাড়িয়ে ধরে, “হুয়ান। তুমি জিয়ন?” ভাঙা ইংরেজি তার মুখে। সম্ভাষণ শেষ করে হুয়ান হাসিমুখে ঘোষণা করে, “রানী অপেক্ষা করছেন, আর দেরি করা ঠিক হবে না।”

বলাই বাহুল্য, হেলিকপ্টারের নাম, ‘দ্য ক্যুইন’। দুটো মুশকো চেহারার তাগড়াই যুবক জিয়নের যন্ত্রপাতি ভর্তি বাক্স আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় হেলিকপ্টারে তুলে দেয়।

“Viaje Seguro!” গলা ছেড়ে ঘোষণা করে হুয়ান। ‘দ্য ক্যুইন’ মাটি ছেড়ে আকাশের দিকে উড়তে শুরু করে।

হেলিকপ্টার বাসিতানের নীল গহ্বরের ওপরে পাক খাচ্ছে ছোট্ট একখানা পাখির মত।

শ’দুয়েক ফুট নিচে সম্পূর্ণ গোলাকার গর্ত, তারও শ’খানেক ফুট নিচে গভীর নীল জল। শান্ত, সমাহিত সে জলের রাশি। হুয়ান চরকি কেটে হেলিকপ্টারটাকে নামিয়ে আনছে জলের কাছে, তার মুখে থমথমে গাম্ভীর্য। সূর্যের আলো আড়াল করে পাহাড়ের প্রাচীর দুপাশে, সে মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে আছে জলরাশির দিকে।

“...যখন মনে হবে, এটা তোমার কম্ম নয়, তখনি মিশন বাতিল করবে। এই চিন্তাকেই বলে ইনস্টিংক্ট। বুঝলে?” রে বলতেন তাকে।

আচ্ছা, চিনহোই লেকে যখন ডুব দিয়েছিলেন রে, তখন কী বলেছিলো তাঁর ইনস্টিংক্ট? এ মুহূর্তে জিয়নের খুব জানতে ইচ্ছে করছে।

“এতদূর ঠিক আছে?” হুয়ান শঙ্কিত গলায় জানতে চাইছে।

জিয়ন নির্বাক থাকে, শুধু তার হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ ওপরের দিকে ওঠে। সে প্রস্তুত।

হুয়ানের নিয়ন্ত্রণে হেলিকপ্টার ভাসতে থাকে নির্দিষ্ট উচ্চতায়। দড়ি নামিয়ে দেয় জিয়ন, সেটা বেয়ে সাবধানে নামতে থাকে সে, হেলিকপ্টারের ব্লেডের ধাক্কায় বিক্ষুব্ধ হাওয়ায় দুলছে সে শুন্যে। একসময় দড়ির দৈর্ঘ শেষ হলো।

আর কোথাও যাবার নেই।

চেনা জানা পৃথিবীর সঙ্গে এই দড়ির প্রান্তটুকুই শেষ সংযোগ তার।

হাতের মুঠো আলগা হয়, হাওয়ায় ভাসতে থাকে তার শরীর, ভারশূন্য। তারপর শুধু গতি, জিয়নের ডুবুরির পোশাক পরা শরীরটা পৃথিবী টেনে নিচ্ছে দুর্বার গতিতে। নীল জলের ঢেউ চোখে পড়ছে, বাসিতান এগিয়ে আসছে হাওয়া কেটে তারই দিকে। এভাবে জলে পড়লে শরীরে দুর্দান্ত অভিঘাত ঘটবে, সিলিন্ডার ফেটে যেতে পারে সে ধাক্কায়। হাওয়ায় দ্রুত নিজের শরীরকে দুমড়ে নিয়ে অভিমুখ পরিবর্তন করে সে। গতি এবার আরও তীব্র।

জলের তলে শব্দ হয়, ‘ঝপাৎ’।

বাড়িয়ে ধরা দুহাত ঢেউ কেটে জলের গভীরে নিয়ে যায় জিয়নকে, তারপর আবার ঠেলে ভাসিয়ে দেয় ওপরের দিকে। যেদিকে দুচোখ যায়, শুধু সুনীল জলরাশি। জনপ্রাণী বিহীন, নিস্প্রাণ। আকাশে এখনো হুয়ানের কপ্টারের অপসৃয়মান শরীর।

জলে ভাসতে ভাসতেই শেষ প্রাণীটাকেও বিদায় নিতে দেখলো জিয়ন।

সব চিন্তা ঝেড়ে ফেললো সে। জলের শান্ত ঢেউ সামলে, দুহাত ছড়িয়ে দেহটাকে উল্টোমুখী করে ডুব দিলো সে অতলে। হাতের ‘ওমেগা’ ঘড়ি জানান দিচ্ছে দিন ক্ষণ এবং উষ্ণতার হিসেব। জল কেটে নিচে নামতে নামতে সে ঘড়ির ডায়ালে ফুঁটে উঠছে সবুজ রঙের সংখ্যা যুগল, উপরিতল থেকে তার গভীরতা বোঝাচ্ছে সংখ্যাটা। “১৩০মিটার”।

‘ওয়েটস্যুটে’ আছে অজস্র পকেট। তার মধ্যে একটা থেকে সেলোফিন কাগজে আঁকা নকশা বার করে মুখোশের কাঁচের চশমার সমানে ধরে জিয়ন। এর আরো তিনটে প্রতিলিপি আছে তার কাছে, দুটো লুকোনো আছে স্যুটের পকেটে, তৃতীয়খানা মগজে। শেষেরটা একদম চরম মুহূর্তের জন্য।

“ব্যাক আপেরও ব্যাক আপ দরকার।” রে বলতেন।

পিটারের কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে এই কূপের উত্তর-পূর্ব দিকেই আছে সেই গোপন সুড়ঙ্গের গুহাপথ। সে জল সরিয়ে এগিয়ে যায় সেদিকে। এতো উচ্চতা থেকেও জলাধারের নিচে জমা পলির স্তর দেখা যাচ্ছে। কত হাজার বছর ধরে জমেছে সে পলি তার ইয়ত্তা নেই। একটাও জলজ প্রাণী নজরে আসে না তার। পিটারের কথা সত্যি, অক্সিজেন নেই এ জলে। বছরের পর বছর বৃষ্টির জল জমে তৈরী হয়েছে বাসিতানের জলজ সমাধি। নিজের হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানির শব্দ শুনতে পায় জিয়ন, তার শরীর থেকে কয়েক হাত দূরেই একখানা চার-মানুষ চওড়া অন্ধকার হাঁ পথ, তার ওধারে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।

তার শরীর জুড়ে তোলপাড়, এই সেই গুহাপথ, পিটার যার কথা উল্লেখ করে গেছেন তার বইয়ে। এই অতলে হারিয়ে যাবার আগে, জিয়ন নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে, চোখ বন্ধ করে রক্তপ্রবাহের গতি কমাতে চায়।

“ধীর, স্থির, শান্ত।” সে উচ্চারণ করে।

জলের নিচে বেশি নড়াচড়া করলে কিংবা শারীরিক কসরত করলে, রক্ত থেকে অক্সিজেন খরচ হবে বেশি। আর সেই সঙ্গে বাড়বে সিলিন্ডারে জমা কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ, যা এমুহূর্তে একদম কাম্য নয়। গুহাপথের মুখ থেকে ভিতরের দিকে কৌতূহলী চোখ রাখে সে, বাইরে থেকে অন্ধকার দেখালেও, জলের মধ্যে আছে হালকা আলোর ছোঁয়া। কিন্তু কোথায় সে সুড়ঙ্গপথ? এ তো সম্পূর্ণ আলো আঁধারিতে ঢাকা! বিস্তীর্ণ প্রশস্ত গুহা? তবে কি পিটারের বক্তব্য মিথ্যে? জিয়ন প্রবেশ করে হাঁ-পথে। হঠাৎ শরীরের ভার আরো কমে যায়। আশ্চর্য মায়াময় এ জগৎ। সে এবার মুখোশের মাথায় লাগানো টর্চটা জ্বালায়। চারিদিকের দেওয়াল পর্যবেক্ষণ করে মনোযোগ দিয়ে। নিরেট পাথরের বেষ্টনী সর্বত্র। উপায়ন্তর না দেখে আরো নিচে নামতে থাকে সে।

কোথায় এর তল? জিয়নের ঘড়িতে জলের গভীরতার মাত্রা বেড়েই চলেছে। ২৫০, ৩০০, ৩৫০ সংখ্যা পরিবর্তিত হচ্ছে নিঁখুত হিসাবে। ৩৮০ তে গিয়ে থামতেই মাটির সন্ধান মিললো। তার অনুসন্ধিৎসু চোখ চারিদিকে খুঁজতে থাকে সুড়ঙ্গের গোপন পথ। হতাশ মন যখন সবে আশা ছেড়ে দিয়েছে তখন হঠাৎ জিয়ন অনুভব করে তার শরীর খুব ধীর গতিতে নিস্তরঙ্গ জলপ্রবাহে ভেসে চলেছে। জলের টান? তার মানে জল প্রবাহিত হচ্ছে, কোনও এক স্থান থেকে অন্য কোথাও। ওটাই জলের ধর্ম।

নিঃসাড়ে সেই চোরাগতিকে লক্ষ করে গা ভাসিয়ে দেয় সে। ক্রমশ একমানুষ চওড়া একটা অন্ধকার খোঁদল লক্ষ করে তার চোখ। এই কি তবে পিটারের গুপ্তসুড়ঙ্গ? তবে প্রস্তুতি নিতে হবে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করতে। ওয়েটস্যুটের পকেট থেকে নাইলনের দড়ি বার করে সুড়ঙ্গের মুখে বাঁধে সে। পথ হারালে এই দড়ি তাকে ফিরিয়ে দেবে নিরাপদ গন্তব্যে। মাথায় লাগানো টর্চ দিয়ে অন্ধকার গলিপথে আলো ফেলতে মেরুদণ্ড বেয়ে হিমেল স্রোত বয়ে যায় তার। এ যেন কোনো ঘুমন্ত দানবের পাকযন্ত্র। কোনোভাবে যদি জমে থাকা পলি নড়ে ওঠে তাহলে এই টর্চের আলোতেও কিছুই দেখা যাবে না সামনে। আলো থাকতেও অন্ধ হয়ে পড়বে সে, একমাত্র দড়িপথই ভরসা তখন, যদি সেটা হাতছাড়া হয় কখনও তাহলেই সব শেষ।

জিয়ন এগিয়ে যায়, ভয় পাওয়ার সময় সে কাটিয়ে এসেছে, এখন শুধু ভয়কে জয় করার নেশা পেয়ে বসেছে তাকে। পিটারের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এই সুড়ঙ্গপথ প্রায় সাড়ে চারশো ফুট লম্বা। সেটা কি সম্ভব? পিটার যখন সেকেলে যন্ত্রপাতি নিয়ে পেরেছে এপথ পেরোতে তখন সেও নিশ্চয় পারবে। শুধু প্রয়োজন ধৈর্যের। শরীর প্রায় অসাড়, ঘড়ি বোঝাচ্ছে বাইরের পৃথিবীতে এখন বিকেল নেমেছে। সুড়ঙ্গ শেষ হচ্ছে না, খুব ধীর গতিতে যদিও সে চলেছে, তবুও মন জুড়ে অস্থিরতা কাজ করছে। এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে পেশীতে টান পড়তে পারে, আর তাহলেই বিপদ। এককথায় যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু।

“ধৈর্য্য ধরো জিয়ন।” নিজেকে বোঝায় সে।

এমন সময় হঠাৎ তার শরীরটা ছোট্ট ঝাঁকুনিতে দুলে ওঠে, ঘুরে যায় তার গতিপথের অভিমুখ, সংকীর্ণ গলিপথ চওড়া হয়ে যায়। তার থেকেও আশ্চর্য ব্যাপার, তার শরীর ছুটে চলে গোপন স্রোতের টানে। কোন দিকে টেনে নিচ্ছে তাকে এই চোরাস্রোত? ভাবার সময় নেই, টান আরো বাড়ছে, দুর্দান্ত বেগে জলের স্রোত চলেছে অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে। প্রবল অসুবিধার মধ্যেও জিয়ন হাতের ঘড়ির দিকে তাকাতে চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়। অবস্থা বিপজ্জনক, পাথরের দেওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে শরীর চুরমার হয়ে যাবে, যে কোনো মুহূর্তে। হাতে ধরা নাইলনের দড়ির সংঘর্ষে দস্তানা ছিঁড়ে যাবার জোগাড়। হঠাৎ তার শরীর শূন্যে ভাসমান থাকে কিছুক্ষণ, তারপর গড়িয়ে পড়ে নিচের দিকে।

‘ছপাস!’

জল থেকে গড়িয়ে আবার জলের মধ্যে পতন। মাথার ওপরে শূন্যতা, মানে ‘এয়ার পকেট’?

পিটার নির্ভুল। হিসেব মিলে যাচ্ছে, হুবহু। সুড়ঙ্গের ছাদ থেকে নেমে এসেছে পাথরের লম্বা থাম, বালিপাথরের তৈরী সুপ্রাচীন স্তম্ভ, সুতরাং বিশ্বাসযোগ্য। জিয়ন সেটাকেই বেড় দিয়ে বাঁধে দড়ির সাহায্যে তারপর ডুব দেয় আবার। হ্যাঁ, পাওয়া গেছে, অন্ধকার জলরাশির এক প্রান্তে পাথরের খিলান, তার ওধারে হালকা আলোয় উদ্ভাসিত সুনীল জলরাশি। অপার্থিব। নিষ্প্রাণ। ধীর লয়ে দুহাতে জলের অস্তিত্বকে ঠেলে সরিয়ে জিয়ন প্রবেশ করে সেই আশ্চর্য দুনিয়াতে।

ওয়াটস্যুটের নিচেও শরীরে শিহরণ জাগে তার। পিটারের বর্ণনা পিথাগোরাসের সূত্রের মতো সঠিক। তার চোখের সামনেই পড়ে আছে চৌকোণা পাথরের খণ্ড, দুই সারিতে সাজানো। এগিয়ে গেছে সে পথ সামনের দিকে। ভবিষ্যতের মানুষকে যেন আহ্বান জানাচ্ছে মৃত নগরী। সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি প্রাজ্ঞ ডুবুরি, জিয়নও পারলো না। ভাসমান শরীর আর রোমাঞ্চিত মন নিয়ে এগিয়ে যায় সে-ও। ক্রমে প্রস্তরপথ শেষ হল, সিংহদ্বার দৃষ্ট হল। সে স্পর্শ করতে চায় তাদের, দস্তানা ভেদ করে যেন তাদের মসৃণ ধাতব শরীরের শীতল স্পর্শ তার চেতনাকে নাড়িয়ে দেয়। সুবিশাল খিলান পেরিয়ে এগোতেই নজরে পড়ে সমতল সমুদ্রগর্ভ। বালি আর পলির স্তরে ঢাকা এক মৃত জনবসতি। চারকোণা ছোট ছোট খুপরি। ঘর? বাসস্থান? এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ভগ্ন মৃৎপাত্র, ধাতব ধারাল ত্রিকোণাকৃতি ফলা, সেসব পেরিয়ে আরেকটু এগোতেই তিন-মানুষ উঁচু একখানি মূর্তির ছিন্ন মুণ্ড পড়ে আছে অবহেলা ভরে। চোখ মুদিত, মুখে ভয়াল হাঁ। তার পাশেই লাল নীল সবুজ নুড়ি পাথরে সাজানো বিচিত্রদর্শন স্থাপত্য। পলির আস্তরণ সরাতেই তাদের ঝকমকানি চোখে পড়ে। আরো খানিকটা এগোতেই নারীমূর্তি। এটিও আকারে প্রকারে বিশাল। তিনি এখন আপাতত শায়িত জমাট পলি আর বালির বিছানায়। মূর্তির চারধারে ভেঙে পড়া প্রস্তর স্তম্ভ। অজস্র। দেবী? তাঁকে ঘিরে বানানো মন্দির? জিয়ন অনুমান করে। সময়ের খেলাঘর, মানুষের চোখের আড়ালে পড়ে আছে যুগ যুগান্ত ধরে। আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়ে জিয়ন, কিন্তু পিটারের বর্ণনা যদি নির্ভুল হয় তাহলে কোথায় সেই পাথুরে সিঁড়ি? যে সিঁড়ির গোড়া থেকে ফিরে গেছিলেন তিনি? অধৈর্য হয়ে সামনের দিকে এগুতে থাকে সে।

সন্দেহ দূর হলো। অপেক্ষা শেষ।

প্রায় কুড়ি ফুট উঁচু দুখানা স্তম্ভের মাঝখান দিয়ে সিঁড়ির ধাপ উঠে গেছে। কোথায়? কতদূর? এই মায়াবী হালকা নীল আলোয় দেখা যায় না তার বিস্তার। জিয়ন সিঁড়ি লক্ষ করে এগোতে থাকে, মনে হাজার প্রশ্নের ভিড় নিয়ে। আশ্চর্য ব্যাপার, এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়ে আছে ভেঙে ফেলা মূর্তির টুকরো। জিয়ন তাদের একখানা তুলে ধরে চোখের সামনে, খেলনা? সে বুঝতে চায়। একটা নয়, সংখ্যায় তারা অনেক। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পড়ে আছে তারা অবহেলায়। তার মনে বিশ্বাস দৃঢ় হয়, এগুলো সবকটি একই মানুষের প্রতিকৃতি। শরীরের গঠন, অলংকার, মুখের ভাব সবকিছুই এক। ফেলে আসা শায়িত দেবীমূর্তির সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে এদের অবয়ব। এ কী? সোপান শ্রেণী ধরে এগোতে এগোতে হালকা আলোর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে যে? তবে কি...? জিয়ন আত্মহারা হয়ে পড়ে।

দ্রুত জল ঠেলে সিঁড়ির কৌণিক গতিপথ ধরে উপরে ওঠার চেষ্টা করে। অবশেষে জলতল ফুঁড়ে মাথা তোলে সে। মুখের মাস্ক খুলে চিৎকার করে ওঠে নবীন অভিযাত্রী, অপার আনন্দে। মুক্ত পৃথিবী! কিন্তু কোথায় সে এখন? চারিদিকে তো শুধু সমুদ্রের নীল জল? একমাত্র সেই সিঁড়িগুলো সমুদ্রের ঘেরাটোপ ছেড়ে উঠে গেছে ওপরে। জিয়ন মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করে, কোথায় এদের শেষ? এখন আর ভাসলে চলবে না, খটখটে শুকনো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে ওপরে। দেখতে হবে কী আছে সেখানে।

প্রথমে পা থেকে ব্যাঙের পায়ের মতো দেখতে “ফিন” খুলতে হলো। খালি পায়ে পাথরের স্পর্শে শরীরে কেমন যেন শিহরণ জাগলো তার। কত বাজে এখন? হাতের ঘড়িতে চোখ রাখতেই হৃদপিণ্ড থমকে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। ডায়াল সম্পূর্ণ সংখ্যাহীন, নিস্তব্ধ, মৃত। দুচারবার হাত দিয়ে চাপড় মেরেও কোনো কাজ হলো না। যদিও তার অনুভূতি বলছে এখন সন্ধ্যা হয়ে যাবার কথা তবুও এখানে তো দিনের আলো দেখা যাচ্ছে।

অনুভূতি ভুল হতে পারে, সে নিজেকে বোঝায়। সিঁড়ির দুপাশে পাথরের কারুকার্য, জিয়ন তাতে হাত বোলায় সাবধানে।

“অসমান, অমসৃণ...নিশ্চয় হাতুড়ি দিয়ে নির্মিত...ফুল, লতাপাতার কাজ...খুব সাধারণ, কিন্তু খুব পরিষ্কার...” এবার তার হাত থেমে যায়।

এখানেও সেই নারীর অবয়ব খোদিত। সেই একই গঠন, একই অলংকার। প্রতিকৃতি থেকে বেরিয়েছে ফুল আর লতাপাতার জালিকা, কিছুদূর যেতেই আবার সেই মুখ। জিয়ন হাসে...”গার্ল, ইউ আর পপুলার!” সে বলে ওঠে।

এরপর কখনও হেঁটে, কখনও দৌড়ে সিঁড়ি চড়তে থাকে সে। কিন্তু তার আঙ্গুল ছুঁয়ে থাকে প্রস্তর গাত্রের স্থাপত্য জালিকা, দেবীর অবয়ব।

কতক্ষণ এভাবে সে চলেছে বোঝা মুশকিল, একসময় থামতেই হয়। কোমরে দুহাত দিয়ে ঝুঁকে পড়ে ঘন ঘন শ্বাস নেয় সে।

“এটা যদি কোনো রাজাগজার প্রাসাদ হয় তাহলে মানতে হবে রাজার ফুসফুসে জোর ছিল!” ঠাট্টা করে নিজের সঙ্গেই।

আবার দৌড়, বেশ খানিকটা যেতেই তার গতি রুদ্ধ হলো। তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে এক সুবিশাল মূর্তি। বালিপাথরে নির্মিত মুণ্ডহীন মূর্তি। দুহাতের মুষ্টি একসঙ্গে ধরে আছে একখানা তরবারি।

জলের নিচে পড়ে থাকা হাঁমুখ কদাকার মুণ্ডটা তাহলে এই ভদ্রলোকের? একাকিত্বের জন্যই বোধহয় জিয়নের মাথায় পাগলামি ভর করলো। হাঁটু

মুড়ে মূর্তির সামনে বসে মাথা নিচু করে সে ঘোষণা করলো নাটকীয়ভাবে, “মৃত নগরীর ভুলে যাওয়া রাজা, কোনো ভুল করে থাকলে নিজগুণে মাফ করে দিন। তবুও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই আপনার মুখটা কদাকার এবং তার থেকেও ভয়ানক আপনার এই মুণ্ডহীন দেহটি।”

কথাগুলো শেষ হতেই তার অনুভূতি জানান দেয় সে একা নয় আর। কাদের ফিসফিসানি শোনা যায় তার চারপাশে? কেউ কি লুকিয়ে দেখছে তাকে? ঝটপট মাথা তুলে দেখে জিয়ন। কই, কেউ তো নেই! সব নিস্প্রাণ, নির্জীব হয়ে পড়ে আছে চারধারে।

জিয়ন উঠে দাঁড়ায়, অনেক কাজ বাকি আছে এখনও। প্রথমে কিছু খেতে হবে, তারপর জায়গাটা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে ছবি তুলতে হবে।

তাই দ্রুত বাকি কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে সমতল জায়গায় এসে পৌঁছায় সে। বেচারা পিটার, সে জানলে দুঃখ পেত, একখানা প্রাচীন জনগোষ্ঠীর রাজপ্রাসাদের দোরগোড়া থেকে ফিরে যেতে হয়েছিল তাকে। জিয়নের সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছে একচালা পাথরের ভগ্ন দেওয়ালের শ্রেণী, তাদের গায়ে মানুষের প্রতিকৃতি।

শোভাযাত্রা, শিকার, পূজা-উপাচার, প্রাণী ও অতিপ্রাণীদের অবয়ব। কারো চোখ নেই, কারো নাক খসে পড়েছে, কোথাও কয়েকজনের হাত পায়ের কিছুটা উধাও। তবুও সুন্দর তারা। জিয়ন ঘুরে ঘুরে দেখে সে শিল্পকার্য। এই শিল্পকার্যে ঘেরা দেয়ালগুলো পেরোলেই অন্দরমহল। সেখানে ছোট বড় চতুস্কোণ অন্ধকার ঘর। সে নিশ্চিত হয়, জলের নিচের ঘরবাড়িগুলো যদি কোনো জনপদের হয়, এই অট্টালিকা তাদের দেবতার মন্দির অথবা রাজার প্রাসাদ। প্রাসাদ হওয়াটাই বেশি সম্ভবপর মনে হয় তার কাছে।

কোনও কোনও ঘর অক্ষত, আবার কোনোটার কয়েকটা দেয়াল সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে গেছে। নাকি কেউ ভেঙে ফেলেছে? সর্বত্র, এলোমেলো আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট। সেসব ঘর আর অলিন্দের বেড়াজাল পেরোলে বিস্তীর্ণ উঠোন। তার ঠিক মধ্যিখানে চতুস্কোণ জলাধার। সেখানে ওঠানামা করার জন্য পাথর কেটে বানানো সিঁড়ি। জলাধারে এখনো সবুজ জল, ঠিক মাঝখানে একখানি জলদানবের প্রতিকৃতি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে জিয়ন বসে পড়ে জলাধারের পাশে। ব্যাগটা সিঁড়ির ওপর ফেলে দিয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে চায় সে। প্রথমে ব্যাগ থেকে শুকনো খাবার প্যাকেট বার করে, জলের বোতলও। ঘটনার ঘনঘটায় শরীরের দাবিগুলো চাপা ছিল অনেকক্ষণ, এখন সবাই একসঙ্গে ডালপালা মেলে ধরেছে।

ক্লান্ত লাগছে, প্রাণ খুলে স্নান করতে ইচ্ছে করছে। খাওয়া শেষ হতেই হাত এবং মুখ ধুতে সামনের জলাধারের দিকে পা বাড়ায় সে।

জলের দিকে তাকিয়ে দ্বিধা অনুভব করে সে, কত দিনের পুরোনো জল কে জানে। বিষাক্ত নয় তো?

“সস্তার মিনারেল জল!” ঠাট্টা করে ভয়ভাবনা ঝেড়ে ফেলে জলে হাত ডোবায় জিয়ন।

কী ঠান্ডা!

চোখে মুখে জলের ঝাপ্টা দেয় সে। কী আরাম! আবার জল ছেটাবার জন্য হাতের আঁজলা জলে ডোবাতেই যেন কোনো এক নারকীয় গভীরতা থেকে রাক্ষুসে তিমি মাছকে জল ঠেলে উঠে আসতে দেখলো সে। জলে ডোবানো হাতটাই তার লক্ষ্য? ভয়ে অস্থির জিয়ন ঝাঁপিয়ে পড়ে পিছন দিকে। এক্ষুনি তিমি মাছটার শরীর জল ছেড়ে নিশ্চয় হাওয়ায় ভাসবে! শ্বাসরোধ করে সেই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করে জিয়ন।

এদিকে করা যেন একসঙ্গে হেসে উঠলো। ছায়া মানুষদের ফিসফিসানি আবার।

জিয়ন এবার কাঁপছে, ভয়ে। তার জিজ্ঞাসু চোখ একবার জলের দিকে আরেকবার তার চারপাশে ঘোরাফেরা করতে থাকে। সাহস জোগাড় করে সে সিঁড়ি বেয়ে আবার ওপরে উঠে যায়। সব মিথ্যে। সব তাঁর ক্লান্ত মস্তিষ্কের কল্পনা। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে সে। কিন্তু রাক্ষুসে মাছটার ছায়া? সে তো একদম পরিষ্কার! আর হাসির শব্দ? নাহ, দ্রুত নিজের কাজ শেষ করে পালতে হবে এখন থেকে। জিয়ন ব্যাগ থেকে ভিডিও ক্যামেরা বার করে, গলা খাঁকারি দিয়ে প্রস্তুতি নেয়। বোতাম চেপে অপেক্ষা করে সেটার চালু হবার জন্য।

কিন্তু এতো সময় নিচ্ছে কেন যন্ত্রটা? সবুজ আলোটাও জ্বলছে না যে? বিস্মিত এবং অধৈর্য জিয়ন অনেকক্ষণ ধরে খোঁটাখুঁটি করে সবকটা বোতাম। কিন্তু সেটা নিস্প্রাণ।

আস্তে আস্তে একদম চুপিসাড়ে তার তলপেট থেকে একটা ভয়ের কুণ্ডলী উঠে আসছে যেন। ঘড়ি গেছে, ক্যামেরা কাজ করছে না। এখন একমাত্র সহায় ফোন। সেটা খারাপ হলে...ভাবতেই চোখের দৃষ্টি কেমন ঘোলাটে হয়ে যায় তার। কোনোরকমে ব্যাগ হাতড়ে ফোন বার করে ‘অন/অফ’ বোতামে মৃদু চাপ দেয় সে।

হাত দুটো কাঁপছে তার, চোখ চেয়ে আছে ফোনের ফাঁকা স্ক্রিনের দিকে। কাঁপুনি বাড়ছে, হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানির শব্দ লাগামছেঁড়া।

অপেক্ষাটা সেকেন্ডের সময়সীমা পেরিয়ে মিনিটের ঘরে পা দিতেই জিয়ন কাঁপা কাঁপা গলায় চিৎকার করে ওঠে, “হতে পারে না---”

তারপর ফোনের পিছনে আলতো চাপ দিয়ে ব্যাটারি বার করে নেয়, হাত দিয়ে ঘষে সেটাকে প্রাণপণে।

“এমন কিছু নয়...সব ঠিক হয়ে যাবে...” বিড়বিড় করে নিজেকে বোঝায় সে। এবার বোতাম টেপার আগে খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করে জিয়ন, অতি সাবধানে আবার বোতামে চাপ দেয়।

“শান্ত হও...সব ঠিক হয়ে যাবে...” কথাগুলো সে মন্ত্রের মত জপতে থাকে। ফোন নির্বাক হয়ে শূন্য স্ক্রিনটাকে বুকে নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।

কাঁপতে থাকা হাতের তালু থেকে ফোনটা পড়ে যায় পাথরের সিঁড়িতে। দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে জিয়ন।

এবার? ফোনও অকেজো। বাইরের জগতের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করবে সে? হুয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ না করলে সারাজীবন পড়ে থাকতে হবে এই জনশূন্য প্রস্তরপুরীতে।

প্যারিস ছাড়ার আগে ফোনের সিম সে লুকিয়ে রেখেছিলো আলমারিতে। কিন্তু তার আগেই জরুরি ফোন নম্বরগুলো সরিয়ে রেখেছিলো ডাকে আসা মেক্সিকোর সিমে। এখন সবকিছুই যে অকেজো।

জিয়ন নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে, মনে মনে ঠিক করে নেয়, যেকরেই হোক সবকিছু শেষ করে আগামীকাল সকালেই এখন থেকে রওনা দেবে বাসিতানের নীলগহ্বরের উদ্দেশে। তরপর সেখানেই অপেক্ষা করবে হুয়ানের। সব চিন্তা দূরে সরিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে প্রাসাদের দিকে পা বাড়ায় সে।

আলো কমে আসছে, সমুদ্রের ওপর থেকে ঠান্ডা হাওয়ার শিরশিরানি বয়ে আসছে শরীরে। ঠান্ডা না ভয়? ঠান্ডাই হবে বোধহয়। একটা রাত, যে করেই হোক নিরাপদে কাটাতে হবে। সকাল হলেই মুক্তি। জিয়ন একখানা অক্ষত ঘরে ঢোকে, ভেতরে অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে আছে বহুযুগ ধরে।

ব্যাগ থেকে টর্চ বার করে দেখে নিতে হবে চারদিকটা, সাপখোপ থাকতেই পারে। সেই এক ঘটনা। টর্চের বোতামও অবাধ্য। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার দিকের দেওয়ালে ব্যাগ রেখে সে ঘুমোবার ব্যবস্থা করে। যাই হোক পালাবার রাস্তা হাতের কাছে থাকাই শ্রেয়। ব্যাগটাকে বালিশ করে তার ওপর মাথা রেখে মেঝেতে এলিয়ে পড়ে সে। চোখ বন্ধ করে ঘুমের অপেক্ষায়।

তিন

কোনো উৎসব নাকি? প্রচুর মানুষের কোলাহল শোনা যাচ্ছে। দূরে কোথাও কেউ যেন ভেরি বাজাচ্ছে। কেমন ফাঁপা দীর্ঘ শব্দ। কোনো প্রাগৌতিহাসিক জন্তুর কান্নার আওয়াজ যেন। জিয়ন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে, সামনের অলিন্দে এসে দাঁড়ায়।

হ্যাঁ, উৎসবই বটে।

দল বেঁধে মানুষগুলো চলেছে সিঁড়ি বেয়ে, উঠে আসছে তারা নিচের জনপদ থেকে। আবাল বৃদ্ধ বনিতা। সকলের পরনে রং বেরঙের বস্ত্র। মাথায় বাঁধনি, উড়নি। কানে বড় বড় কারুকার্যখচিত অলংকার। নারী পুরুষ নির্বিশেষে অলংকৃত। কারো কারো মুখে খড়িমাটির কারুকার্য। কারো মাথায় পাখির পালকের সজ্জা। জিয়ন চাপা হাসির শব্দে মাথা ঘোরায়, একদল মহিলা চলেছে হাসির ফোয়ারায় সবাইকে ভাসিয়ে। তাদের কারো চপল চোখের চাহনি গোপনে তাকে ছুঁয়ে যায়। কয়েকটি শিশু এসে জোটে, হাত ধরে টান মারে তার।

তাদের চোখের ভাষা বলছে যেন, “একা দাঁড়িয়ে কেন? আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়।”

এগিয়ে যায় জিয়ন, কোথাও যেন চাপা সুরে গান গাইছে কেউ বা কারা। সেই গানের উৎসমুখ লক্ষ করে শিশুরা টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে।

নিজেদের মধ্যে অচেনা কোনো ভাষায় কথা বলে তারা। হাসতে থাকে, কেউ গানের সুরে সুর মেলায়, কেউ বা ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে কথা বলে একে অপরের কানে।

জিয়ন মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে যায়। গানের শব্দ আরো পরিষ্কার হচ্ছে, যদিও কথাগুলো অচেনা। শিশুরা তাকে একখানা ঘরে এনে দাঁড় করায়। সে ঘরের আকৃতি লম্বাটে হলঘরের মতো। দুপাশে মানুষে ভিড়, মাঝখানের প্রশস্ত ফাঁকা জায়গা ঘিরে বাদ্যকারেরা বসে আছে। গম্ভীর মুখে হাতে ধরা ভারী ডাণ্ডা তুলে আঘাত করছে চামড়া দিয়ে বাঁধানো যন্ত্রে। একসঙ্গে, নির্দিষ্ট সময় পরে পরে। তাতে যে শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে তাতে হৃদপিণ্ডেও যেন কম্পন ধ্বনিত হচ্ছে।

তাদের পিছনেই দাঁড়িয়ে আছেন মহিলারা, সকলের চোখ বন্ধ, একযোগে কোনো এক অজানা ভাষায় কিছু বলছেন তারা সুর করে।

গান? স্তোত্র? মন্ত্র? কী আশ্চর্য বিষণ্ণ সে সুর। জিয়ন নিজের রক্তে চাঞ্চল্য অনুভব করে, অনুভব করে সে একা নয়, ভিড় জমেছে তার চারপাশেও।

সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে ঘরের মাঝখানে পড়ে থাকা ফাঁকা স্থানটুকুর দিকে। ওটাই অনুষ্ঠানের মঞ্চ। ওখানেই অনুষ্ঠিত হতে চলেছে কোনও অজানা খেলা।

জিয়নের চোখ থমকে যায়, তার ঠিক বিপরীত দিকে, ঘরের অপর প্রান্তে একখানি সিংহমূর্তি খচিত সিংহাসন।

কেউ সেখানে বসে আছে, কিন্তু আশ্চর্য আলো আঁধারির মধ্যে রহস্যময় ভাবে লুকিয়ে আছে তার বুকের ওপরের অংশটি, যদিও দুখানা সবল সক্ষম পা দেখা যাচ্ছে এতো দূর থেকেও।

ভদ্রলোকটি কি রাজা?

জিয়ন ভালো করে দেখার জন্য এগোতে চায়, শিশুরা হাত ধরে বাধা দেয়, জিয়ন থমকে যায়।

জনতার কোলাহল বাড়ছে, বাড়ছে সুরের মাদকতাও। দু’দলে ভাগ হয়ে হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো রমণীর দল। তাদের চোখে কালো কাজল, মুখে কারুকার্য। দৃষ্টিতে চাপল্য, ঠোঁটের কোণে মাদক হাসি। পায়ের তালে আশ্চর্য নাচের ভঙ্গি।

হঠাৎ তারা সরে যেতে থাকে মাথা নিচু করে। জিয়ন অনুভব করে কিছু একটা হতে চলেছে, সময় যেন আগাম জানান দিচ্ছে তাকে।

হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি বাড়ছে ক্রমাগত।

সহসা দেখা গেলো সেই নর্তকীকে যিনি এতক্ষণ বাকিদের আড়ালে ছিলেন।

জিয়ন থমকে যায়। এ কী? নর্তকীর চেহারা তার খুব চেনা!

সেই দেবী মূর্তি। যার মূর্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মৃতনগরীর আনাচে কানাচে। যার মূর্তি ছুঁয়েই নিচের জনপদ ছাড়িয়ে এই মৃত্যু উপত্যকায় এসে পৌঁছেছে সে। বাদ্যের তীব্রতা যেন আর তার কানে পৌঁছায় না। থেমে গেছে সময়ও যেন। দেবী? মানুষ তো তিনি নন। হতেই পারেন না। সে আবিষ্কার করে দেবীর চাহনি চুম্বকের মতো ন্যস্ত তার দিকেই। কী তীক্ষ্ণ সে দৃষ্টি! কৌতূহল? নাকি মুগ্ধতা?

সে বুঝতে পারে তার ধমনীতে রক্তের বেগ বাড়ছে , মস্তিষ্কে কেমন যেন ঘোরলাগা মত্ততা। এমন সময় হঠাৎ বাদ্য থেমে যায়, কার অদৃশ্য ইশারায়। ভীতচকিত মানুষের কোলাহল শোনা যায়।

জিয়ন লক্ষ করে দেবী উধাও, উধাও বাদ্যকার আর নর্তকীর দলও।

শুধু মুখোমুখি সে আর অন্ধকারে ঢাকা সিংহাসনে আরূঢ় মানুষটি।

ভয় নয়, তীব্র কৌতূহল। পায়ে পায়ে এগোতে থাকে তরুণ অভিযাত্রী। অন্ধকার থেকে যেন খুঁজে পেতে চায় মানুষটার পরিচয়। ধীর পদক্ষেপে সে এগোয়। নীরব নির্বাক নিস্তব্ধ মানুষটি।

জিয়ন আরও এগোয়, বেশ কাছাকাছি এখন তারা। এমন সময় হঠাৎ, অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে দুখানা আগুনে চোখ। দুহাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে ওঠে জিয়ন।

ধড়ফড় করে উঠে বসে সে। ঘর্মাক্ত শরীর, গলা শুকিয়ে কাঠ। এদিকে মনের কোণে স্বপ্নের স্মৃতি এখনো টাটকা। কী ভীষণ সে চাহনি, দৃষ্টির আগুনে যেন নরকের উত্তাপ। জিয়ন দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকে। নানা চিন্তার জালে বাঁধা পড়ছে সে। কৌতূহল চেপে ধরছে তাকে। কে ওই দেবী? কে সেই প্রবল প্রতাপ রাজা? কী কাহিনী এই প্রেতপুরীর? অন্ধকারে ঢাকা ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে সে, একমনে। এভাবে কতক্ষণ কেটেছে সে জানে না। কিন্তু অন্ধকার কেটে সকাল হয়েছে একসময়। চারিদিক শান্ত, সমাহিত। তার চোখ পড়লো ছাদের দিকে, সেখানে লাল রঙের আঁচড়ে আঁকা ছবির দিকে নিবদ্ধ তার দৃষ্টি। গতরাতে ঘটে যাওয়া নাটকের স্মৃতি কেউ এঁকে রেখে গেছে যেন। হুবহু, অবিকল। এখানেও দেবীমূর্তির দৃষ্টি নিবদ্ধ মেঝেতে বসে থাকা জিয়নের দিকে। সে দৃষ্টির মাদকতা মন্ত্রমুগ্ধের মত অনড় করে রেখেছে তাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।

সময় হয়েছে, ঘরে ফিরতে হবে এবার। উঠে দাঁড়ায় সে, শেষবারের মত তাকিয়ে দেখে নেয় দেবীকে। দেবী না মানুষ? তিনি যেই হন না কেন, সে রহস্য উন্মোচনের দায় নয় তার।

দ্রুত ওয়েটস্যুট পরে নেয় সে, পিঠে বাঁধে রিব্রিদার, মুখোশ পরে জোরে শ্বাস নেয়। হঠাৎ যেন অবশ হয়ে যায় তার শরীর। এ কী? রিব্রিদার থেকে অক্সিজেন বেরোচ্ছে না তো? বারবার চেষ্টা করে সে। এখন সে ঘামছে।

জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়ছে তার, এবার? সমুদ্র থেকে হাওয়ার ঘূর্ণি উড়ে আসছে যেন, পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে কেমন যেন করুণ কান্নার মত শব্দ তুলছে। ঠিক যেমন বিষণ্ণ ছিল গত রাতের গায়িকাদের গান। হতাশ হয়ে জিয়ন তাকায় দেবীমূর্তি আঁকা ছাদের দিকে। প্রেতপুরী? নাকি কারাগার? সে বসে পড়ে মেঝেতে, ভেঙে পড়া মানুষের মত।

এরপর কতদিন কেটে গেছে সেটা বোঝা মুশকিল। অলৌকিক এই রাজপ্রাসাদে জিয়নের রূপান্তর ঘটে গেছে নিঃশব্দে। তার বাহ্যিক চেহারাটা ভেঙেচুরে গেলেও চেনা যায় হয়ত কিন্তু মনের ভিতরটা কেমন যেন আমূল পাল্টে গেছে কখন।

সে দিনের বেলায় পলায়নে উৎসুক কিন্তু সন্ধ্যার অন্ধকার যখন একটু একটু করে ঘিরে ধরে এই প্রেতপুরীকে সে বিচারবুদ্ধি হারাতে থাকে ক্রমশ।

রাত বাড়তেই অন্ধকারের চাদর যেন সরে যায়, কোনো ফেলে আসা অতীতের মর্মান্তিক একটা নাটক মঞ্চস্থ হয় প্রতিদিন। জিয়ন সেখানে একাধারে দর্শক ও অভিনেতাও বটে।

এই অলিন্দের গোলক ধাঁধায় ঘুরে ঘুরে সে খুঁজে ফেরে সেই দেবীকে। মাঝে মধ্যেই তার ছায়ামূর্তি দেখতে পায় সে। আবিষ্কার করে, তার দৃষ্টি সর্বদাই ন্যস্ত তার দিকে। অদৃশ্য হয়েও তার উপস্থিতি অনুভব করে সে। কখনও দেবী আসেন মাঝরাতে, কখনও লুকিয়ে থাকেন স্তম্ভের আড়ালে।

কাছে গেলেই হাওয়ায় মিলিয়ে যান দেবী। প্রতি রাতেই নতুন নাটক, প্রতিদিনই নতুন চমক। অথচ দিনের আলো ফুঁটলেই সবকিছু ভোজবাজির মত উবে যায়। প্রাণহীন এই পাথরের প্রাসাদ পড়ে থাকে জিয়নকে অদৃশ্য কারাগারে ফেলে রেখে। সকাল হলেই তার নেশা কেটে যায়। মন্ত্রের বাঁধন আলগা হয় যেন। মাথার মধ্যে পালাবার পোকাটা আবার নড়েচড়ে ওঠে।

অনেক কষ্টে খুব যত্ন নিয়ে প্রাসাদের পিছনে অযত্নলালিত জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে দড়ি দিয়ে ডিঙি বানাচ্ছে সে এখন। পালতে চায় সে। দিনের বেলাতেই। রাত হলেই সে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। হাল ছেড়ে দিয়ে অজান্তেই কখন যেন সে মিলে মিশে যায় এই ভৌতিক নাটকের চরিত্রের ভিড়ে। মাদকাসক্ত মানুষের মত স্বপ্ন আর বাস্তবের ছায়ায় হারিয়ে ফেলে নিজেকে।

দিনের অবসরে সে স্বপ্ন দেখে বাড়ি ফেরার। ফেলে আসা সেই একলা ঘরখানার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে তার। নীল সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়। রেনেঁর উপন্যাসের সেই নাবিকের মত কম্পাস ছাড়াই দিক হারানোর যাত্রায় নামতে মন ব্যগ্র হয়ে ওঠে। সে দ্রুত নৌকা তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু কোন ঘটনাটা আগে ঘটবে তার জীবনে- নৌকোটা নাকি উন্মাদনা?

হঠাৎ হাত দুটো থেমে যায় তার।

হ্যাঁ ‘তিনি’ এসেছেন। মাথা ঘোরাতে ভয় হয়, অদৃশ্য হয়ে যাবেন না তো আবার? জিয়নের ঠোঁটে পাগলাটে হাসি ফুঁটে ওঠে।

হ্যাঁ, মূর্তিরূপী দেবী এসেছেন, নিশ্চিত হয় সে।

মন্ত্রমুগ্ধের মত উঠে দাঁড়ায় তরুণ অভিযাত্রী, হাত থেকে ফেলে দেয় দড়ির বাঁধন। কাঠের টুকরোগুলো মেঝেতে ছত্রখান হয়ে পড়ে যায়। অদৃশ্য কাউকে অনুসরণ করে এগোতে থাকে সে। শুধু রাত্রি নয়, এখন দিনের আলোতেও ‘তিনি’ আসেন। মন আনন্দে ভরে যায় তার। এ কী! কোথায় গেলেন দেবী মূর্তি?

সে ছুট লাগায় অলিন্দপথে। হাঁপাতে হাঁপাতে সে এসে দাঁড়ায় চতুস্কোণ জলাধারের কাছে, সেখানে এখন যেন মেলা লেগেছে। বিভিন্ন বয়সের মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে ভিড় করে। সকলের ভয়ার্ত চোখ চেয়ে আছে সামনের দিকে। তার দিকে। না, ঠিক তার দিকে নয়। তার সমানেই উঁচু বেদিতে বসা একজনের দিকে।

সেই মানুষটির দিকে তাকিয়ে আছে জমায়েতের সকলে, যিনি এখন তার দিকেই পিঠ করে বসে আছেন ধ্যানমগ্ন হয়ে। দুজন মানুষ মৃৎপাত্রে কিছু নিয়ে আসছে, সাতজন পুরুষ অজানা ভাষায় মন্ত্র পড়ছেন। ওঁরা কি পুরোহিত? বাহকেরা মৃৎপাত্র অনেক কষ্টে মানুষটির মাথার ওপরে তোলে। জিয়নের বিস্ফারিত চোখের সমানে সেই মৃৎপাত্র থেকে গড়িয়ে পড়ে রক্তের ধারা, ভিজিয়ে দেয় ধ্যানমগ্ন মানুষটিকে।

পুরোহিতের মন্ত্রের সঙ্গে যোগ হয় জমায়েতের গলার স্বরও। এক আশ্চর্য অনুভূতি। জিয়ন ছুটে যায় কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে হঠাৎ। সব কিছু বাতাসে মিলিয়ে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে দেওয়ালে হেলান দিয়ে তাকিয়ে থাকে সে। বুঝতে পারে, উন্মাদনা বাড়ছে। হাতে সময় খুব কম।

চার

অবশেষে একদিন নৌকা তৈরী শেষ হলো। নৌকা? হাসি পায় জিয়নের। নৌকার হাল তার শরীরের অবস্থার থেকেও খারাপ। দড়ির বাঁধন তার মনে জ্বলতে থাকা আশার আলোর থেকেও ক্ষীণ। তবুও এটাই তার শেষ হাতিয়ার। জিয়ন ধীরে সুস্থে সিঁড়ি বেয়ে নামে, কাঠের হালকা ভেলাটা হাতে ধরে। অন্যহাতে আরেকটা কাঠের টুকরো। এটা তার পালহীন নৌকোর ভাঙা বৈঠা। জলের ওপরে ফেলতেই ভেসে ওঠে ভেলাটা, সাবধানে সেটার ওপরে এক পা দিয়ে আরেকটা পা ফেলতেই শরীরটা দুলে ওঠে তার। কোনো রকমে ভারসাম্য সামলে নিয়ে এবার লাফ দিয়ে চেপে পড়ে পাটাতনে। অবাক ব্যাপার, প্রথমে টলমল করে উঠলেও ভেলাটা দিব্যি ভেসে ওঠে জিয়নকে নিয়ে।

এটুকু পরিশ্রমেই হাঁপিয়ে পড়েছে সে, ঘামের ধারা গড়িয়ে পড়ে মাথা থেকে কাঁধে। শেষবারের মত পাথরের চাতলাটার দিকে তাকায় সে। কাদের ছায়ামূর্তি যেন সব দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে- প্রেত? মানুষ? তার বিষণ্ণ দৃষ্টি সেই ভিড়েও কাউকে খুঁজে ফেরে। মন ফিরতে চায় না, তবুও দাঁতে দাঁত চেপে হাতে ধরা কাঠের টুকরো দিয়ে ধাক্কা মারে সিঁড়ির গায়ে, ভেলা এগিয়ে যায়।

“বিদায় বন্ধুরা!” জিয়ন বিষণ্ণভাবে বলে ওঠে।

শান্ত ঢেউয়ের ছপাৎ ছপাৎ শব্দ পেরিয়েও হাওয়ায় ভেসে আসা সমবেত সংগীতের সুর তাকে ঘিরে ধরে যেন। অচেনা ভাষার মায়াবী মন্ত্র যেন তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে চায়। একসময় সে সুরও আবছা হয়ে আসে।

জিয়ন বুক ভরে শ্বাস নেয়, “আহ, মুক্তি!”

জমায়েতে ভীতিপ্রদ ফিসফাস, কানাকানি। গুনগুন গুঞ্জন। একমাত্র জিয়ন নির্বাক।

আধো অন্ধকার ঘরে মশালের আলোর দপদপানি। ঘরের মাঝখানে উঁচু বেদির ওপরে একজন পুরুষ মানুষ শায়িত, মৃত? নাকি জ্ঞানহীন? তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আরো কয়েকজন পুরুষ। কোনও এক অজানা উৎস থেকে আসছে কটু ধূমের গন্ধ। মাথা ঝিম ঝিম করছে যেন সেই গন্ধের প্রভাবে। জিয়ন মাথা ঘুরিয়ে ভিড় দেখে। দৃষ্টি থমকে যায়, ঘরের অন্যপ্রান্তে সুসজ্জিত আসনে আসীন দুটি মূর্তি। তারা বসে আছেন পাশাপাশি। অন্ধকারে ঢাকা একজনের শরীর অন্যজন সেই দেবী মূর্তি। ঠোঁটের কোন রহস্যময় হাসি, প্রতিবারের মতোই তার দৃষ্টি জিয়নের দিকে।

চিন্তার জাল ছিন্ন হয়ে গেলো, সবাই মিলে বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছে। শায়িত পুরুষকে ঘিরে ধরা পুরুষদের সকলের হাতে ধারালো ছুরি, আকাশের দিকে অস্ত্র তুলে তারাই মন্ত্র আওড়াচ্ছে। জিয়ন মাথা ঘোরায়, শুধু তারাই নয়, মন্ত্র আওড়াচ্ছে জমায়েত নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলে।

সুর চড়ছে, গম্ভীর উচ্চারণের সঙ্গে যোগ হয়েছে গম্ভীর দ্রিম দ্রিম শব্দও।

জিয়ন কয়েক পা পিছিয়ে আসে, অজানা ভয় তাকে সাবধান করছে। পুরোহিতদের ছুরি নেমে আসছে শায়িতের দিকে, জিয়ন মাথা ঘুরিয়ে ভিড় সরাতে চেষ্টা করে। মানুষটা মৃত হতে পারে তবুও তার শরীর নিয়ে লোকগুলো বীভৎসতা করবে সেটা চোখ খুলে দেখার কোনও মানে হয় না।

কিন্তু উপায় নেই, পিছোতে গেলেও ভিড় নড়ে না, তাদের দেহ প্রস্তরমূর্তি যেন। একটা বীভৎস চিৎকার ভেসে আসে, আর্তনাদ, গোঙানি।

বিস্ফারিত চোখে জিয়ন মাথা ঘুরিয়ে দেখে পুরোহিতদের একটা হাত শক্ত করে ধরে আছে পুরুষটিকে, তাদের রক্তাক্ত অন্য হাত ব্যস্ত কিছু খুঁজতে।

যন্ত্রনায় মানুষটি ছটফট করছে, তার গোঙানি দেওয়ালে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরছে। মৃত নয়? শায়িত মানুষটা তাহলে জীবন্ত ছিল এতক্ষণ?

একজন জীবন্ত মানুষের অঙ্গচ্ছেদ হতে দেখলো সে নিজের চোখের সামনে? জিয়ন দুহাতে চোখ ঢাকে।

মন্ত্রের গুঞ্জন এখন লাগামছাড়া, পাশবিক চিৎকার বিবেকের ওপর চাবুকের আঘাত হানছে। হঠাৎ সবকিছু কেমন স্তব্ধ হয়ে যায়, এমনকী আহত মানুষটির গোঙানিও। জিয়ন চোখ খোলে, পুরোহিতদের মধ্যে একজনের হাত উঁচু করে তোলা আকাশের দিকে, হাতের মুঠোয় ধরা রক্তাক্ত হৃদপিণ্ড!

জিয়নের ঘুম ভেঙে যায়।

না, সে পালাতে পারেনি। কিছুদূর পর্যন্ত যেতে পেরেছিলো হয়তো, কিন্তু মুক্তি জোটেনি। ঢেউয়ের ধাক্কায় ছিঁড়ে গেছিলো লতার বাঁধন, সলিলসমাধি হয়েছিল তার ভেলাটার। প্রথমে কিছুটা সাঁতরাবার চেষ্টা করেছিল নির্ভীক তরুণ। কিন্তু আদিঅন্তহীন এই সমুদ্রে কোথায় যাবে সে? তাই আবার ফেরত আসতে হয়েছে তাকে। রিক্ত, নিঃস্ব পরাজিত সৈনিকের মত। ফিরে আসতে হয়েছিল নিস্প্রাণ এই পাথরের কারাগারে।

জিয়ন অনুভব করছে ছায়ারা সবাই তার দিকে তাকিয়েছিল শীতল দৃষ্টি মেলে। ‘তিনি’-ও ছিলেন তাদের মধ্যে। জিয়ন অনুভব করেছে তাঁর অস্তিত্ব।

কী ছিল সেই দৃষ্টিতে? ক্রোধ? ঘৃণা? হতাশা? নাকি শুধু যন্ত্রণা? ভাবতে চায় না জিয়ন। কী চায় তারা? কী অধিকারে তাকে এভাবে বন্দি করে রেখেছেন এই প্রেতপুরীর দেবীমূর্তি? ভাবতেই রাগে হতাশায় ডুবে যায় তার মন, চরম অসহায়তায় সে দুহাতে মাথা ঢেকে চিৎকার করে ওঠে।

বোবা গোঙানির মত সেই চিৎকারের প্রতিধ্বনি বারেবারে ফিরে আসে তার-ই কাছে।

জিয়ন যখন বাসিতানের নীল গহ্বরে ঝাঁপ দিয়েছিলো তার সঙ্গে ছিল নাইলনের দড়ি। পথের প্রতিটা বাঁকে বাঁধা আছে দড়িখানা। শেষ প্রান্তটা বাঁধা আছে প্রেতপুরীর সিঁড়ির ধারে। পাথরের স্তম্ভের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে। বন্ধন আজও অটুট। জিয়ন শেষ ধাপে বসেছিল হতাশ হয়ে, চোখদুটো মৃত মানুষের মত চেয়ে আছে দড়ির বন্ধনের দিকে। মন কিন্তু ভাবছে অন্যকথা। সেই সুন্দর জীবিত পারি শহর। বাউন্ডুলে লেখক বাপ আর স্নেহময়ী বাঙালি মায়ের স্মৃতি, ঘোরাফেরা করছে তার ঘোলাটে মগজের অন্দরমহলে। আর লিন? কী করছে সে এখন? কতদিন হল সে নিজে ঘরছাড়া?

মনটা হু হু করে ওঠে তার। ‘আমার আর ফেরা হলো না!’ সে বলে ওঠে মৃদুস্বরে। সে জানে একটি ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক পিছনেই, কথাটা তাঁর উদ্দেশেই বলা। ছায়ামূর্তি সরে যায়, কিন্তু চলে যায় না বরং পাশে এসে বসে। নিঃশব্দে। জিয়ন অবাক হয় কিন্তু মাথা তুলে চায় না। তার চোখে চোখ রাখতে ভয় হয় তার। জীবনের তৃষ্ণা আকুল করেছে আজ তাকে। সে ফিরতে চায়।

দেবীমূর্তি স্পর্শ করে তাকে, হাত ধরে তার। জিয়নের শরীর শিহরিত হয়, শীতল প্রাণহীন সে পরশে। তাদের দুজনের হাত স্পর্শ করে স্তম্ভের গায়ে বাঁধা দড়ির প্রান্তকে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে সে তাকায়, দেবীর মুখে কি হাসির রেখা? বোঝা যায় না। কিন্তু তার চোখে এ কেমন দৃষ্টি? যন্ত্রণা নাকি করুণা? যে দেবীকে সে এতদিন নিজের দুর্ভাগ্যের কারণ মনে করে এসেছে সেই তিনিই আজ তাকে মুক্তির পথ দেখাচ্ছেন? নাকি এর পিছনে আছে কোনও অন্য ষড়যন্ত্র?

তারপরেই হল শব্দটা। জিয়ন দুহাতের তালুতে কান চেপে ধরে যন্ত্রণায়। পরকালের ওপার থেকে যেন ভেসে আসছে একটা দানবীয় গর্জন। হিংস্র, বন্য, নারকীয়। অভিশাপের মতই অভিঘাত তার।

দেবী মূর্তি বিলীন সে শব্দের তাড়নায়। মাথা ঘুরিয়ে দেখে সে, সিঁড়ির প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন অন্ধকারাবৃত মানুষটি জ্বলন্ত চোখ মেলে। এই অমানবিক শব্দ তাহলে তারই হুঙ্কার? বোঝার উপায় নেই, তার ছায়ামূর্তিও বিলীন। জিয়ন দৃষ্টি ফেরায় দড়িটার দিকে।

পাঁচ

অসম্ভব! অক্সিজেন ছাড়া কোনো মতেই ওই মরণকূপ পেরিয়ে বাসিতানের লেকে পৌঁছানো যাবে না। জিয়নের মস্তিস্ক বিদ্রোহ করে ওঠে। পারতেই হবে, এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মন তবুও গর্জে ওঠে। যা কিছু জাগতিক যা কিছু সম্ভব তার কোনও অবস্থানই নেই এই অলীক প্রেতপুরীতে। বাঁচার একমাত্র উপায়, পাগলামি। আর কীই বা হবে মারা গেলে? এখানে সারা জীবন বন্দি হয়ে বেঁচে থাকার থেকে মুক্তির চেষ্টায় মৃত্যুই শ্রেয়। জিয়ন নিজেকে বোঝাতে সচেষ্ট হয়। যাত্রাপথের ঠিক মাঝখানে একখানা এয়ার পকেট ছিল, সে অব্দি একবার পৌঁছতে পারলেই...

সে নিজেও বোঝে অসম্ভব। তবুও শেষ চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?

মনস্থির করে নিয়েই জিয়ন উঠে দাঁড়ায়, তার মানসিক দুর্বলতা ক্রমশ একটা সংকল্পের আকার নিচ্ছে। নিশ্চিত পদক্ষেপে পিছন দিকের জঙ্গলের দিকে ছুট মারে সে। কেন? কারণ খিদে বড় বালাই।

গাছে গাছে পাকা ফল ঝুলছে। সরেস, পরিপক্ক। না, ফ্রান্সের অতি অভিজাত দোকানেও এসব ফল মেলে না। যদিও এদের মধ্যে একটি ফল সে আগে দেখেছে, ইংরেজিতে নাম ড্রাগন ফল, বাইরেটা কারুকার্যময় শক্ত খোলা, তার ভিতরে নরম সাদা শাঁস। মিষ্টি খেতে। মেক্সিকোতে পথে ঘটে সে দেখেছে এদের বিক্রি হতে। কিন্তু বাকিরা সব অচেনা। দুহাতে সে যখন ফল জোগাড় করতে ব্যস্ত, হঠাৎ তখনি ঝোপের মধ্যে চোখ গেলো তার।

উজ্জ্বল কমলা রঙের কিছু উঁকি মারছে সেখান থেকে। দৃষ্টি সংকুচিত করে সে ভাবে, এ জিনিস তো প্রাচীন জনপদের নয়। কৌতূহলী হয়ে ঝোপ ঠেলে এগোতেই সে চমকে ওঠে।

‘এয়ার ব্যাগ’? জলে ভাষার জন্য এ জিনিসের ব্যবহার এখনো আছে বাইরের দুনিয়ায়।

কিন্তু এটা তো তার নয়? আরেকটু এগোতেই দুখানা ছড়িয়ে থাকা পা দেখা দিল।

কৌতূহল চেপে ধরে তাকে, মানুষটার উর্ধাংশ ঝোপে ঢাকা। কাঁপা কাঁপা হাতে ডালপালা সরাতেই একখানা নরকরোটি আবিষ্কৃত হলো। অন্ধকার চোখের খোঁদল মেলে সে তাকিয়ে আছে মহাশূন্যের দিকে। জিয়ন মাটিতে বসে পড়ে। পিটার? তাহলে জিয়ন শুধু একাই নয়, পিটারও শেষ অব্দি পৌঁছেছিল এই পাষাণপুরীতে? তারপর? বার্ধক্য শেষ করেছিল তাঁকে? মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সে যে পালানোর চেষ্টা করেছিল, এয়ার ব্যাগটাই তা প্রমাণ করে দিয়েছে। সে বুঝতে পারে, এই জীবন্ত মৃত্যপুরীর মায়ায় জড়িয়েছিল পিটার-ও।

জিয়ন উঠে দাঁড়ায়, উজ্জ্বল কমলা রঙের এয়ার ব্যাগ হাতে নিয়ে সে ফেরে। পিটার পারেনি। মৃত্যুর কাছে হার মেনেছে সে, কিন্তু জিয়নের হাতে তুলে দিয়েছে পালানোর হাতিয়ার।

পেটপুরে খেয়ে নিয়ে এয়ার ব্যাগে ফুঁ দেয় জিয়ন। না, কোনো অসুবিধা হয়নি এবার। সব ঠিকঠাক। লতা দিয়ে এয়ার ব্যাগ কোমরে বেঁধে সে এসে দাঁড়ায় সিঁড়ির প্রান্তে। সমুদ্রের নীল জলে গা ভাসিয়ে দেয়।

“ভয়ঙ্কর সমুদ্রকে ভয় পাই না, সেই কারণেই তো নৌকায় পাল খাটানো শিখেছি।”

পিটারের কথাগুলো উচ্চারণ করে জিয়ন ডুব দেয় গভীর অতলে।

কোমরে বাঁধা এয়ার ব্যাগ ওপরের দিকে টানছে তাকে, তবুও বলপ্রয়োগ করে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে সে, দড়ির গতিপথ ধরে ডুবতে থাকে আরো গভীরে। এক মুহূর্ত থামা যাবে না। যতক্ষণ ফুসফুসে জমা অক্সিজেন আছে, ঠিক ততক্ষণই সংগ্রাম। তারপর? ভাবার সময় নেই। তার আগেই পৌঁছতে হবে এয়ার পকেটের সামনে। দ্রুত, আরও দ্রুত।

জিয়ন দুহাতে জল ঠেলে চলেছে। সুড়ঙ্গের মুখ দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আর পারা যাচ্ছে না। ফুসফুস যেন ফেটে যাবে। মাথা ঝিম ঝিম করছে তার। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। আর একটু...

সুড়ঙ্গের মুখে এসে চোরা স্রোতের বিপরীতে সাঁতরাতে থাকে সে। কিন্তু হাত আর নড়তে চাইছে না, শরীর অসাড় হয়ে আসছে এবার।

জিয়ন কোনোরকমে এয়ার ব্যাগ বন্ধনমুক্ত করে, একধারে ফোলানো জায়গাটার মুখে মুখ ঠেকিয়ে অক্সিজেন টেনে নেয়। কিছুক্ষনের জন্য মুক্তি।

আবার স্রোতের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ। এ সর্পিল নরকের পথ কখন শেষ হবে? ভাবার সময় নেই। মরিয়া হয়ে সে হাত চালায়। জল কেটে সে এগোচ্ছে যদিও, কিন্তু থামতে হবে আবার। আগের মতোই দ্বিতীয় প্রকোষ্ঠ থেকে হওয়া টেনে নেয় পলাতক অভিযাত্রী। হাতে ধরা দড়ির ঘষটে যাওয়ার ব্যথা অনুভব করে সে।

রক্ত পড়ছে? পড়ুক। থামা যাবে না। সময় বেশি নেই। অবশেষে পথ থামলো, তার শরীর ভেসে উঠলো একসময়। মরিয়া আবেগে বুক ভরে শ্বাস নিলো সে। আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। মাথার ওপরে এখনো পাথরের দেওয়াল, বিন্দুমাত্র অসাবধান হলে মাথা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। অতি সাবধানে আবার হাওয়া টেনে বুকে জমিয়ে রেখে শরীরটাকে জলের মধ্যে ডুবিয়ে দেয় জিয়ন।

শেষ চেষ্টা।

জল সরিয়ে শরীর ভাসতে থাকে মুক্তির সন্ধানে। কিন্তু আর যে পারা যায় না। শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি হচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাতে পায়ে খিচ ধরছে। সব শেষ। তার মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ ফাঁকা, শরীর ভরশূন্য। একটু নড়াচড়া, তারপরেই তার শরীর নিস্তব্ধ হয়ে যায়।

শেষবারের মত চোখবন্ধ করার আগে তার ঘোলাটে দৃষ্টি দেখতে পায় জল ঠেলে এগিয়ে আসছে কেউ, তারই দিকে। জ্ঞান হারানোর আগে জিয়ন অনুভব করে কেউ শক্ত হাতে ধরেছে তার হাতের কব্জিখানা।

সে কে?

বাসিতানের নীল গহ্বরে পাঁচজন ডুবুরি, তাদের একজনের হাতে ধরা অচেতন জিয়নের শরীর। আকাশে চরকি কাটছে দুখানা হেলিকপ্টার। জিয়নের রক্ষাকর্তা মাস্ক খুলে আকাশের দিকে ইশারা করে, “অক্সিজেন সিলিন্ডার চাই, এক্ষুনি!”

নারীকণ্ঠের ঘোষণা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার হয়ে আসে চারদিক। নিস্তব্ধতা গ্রাস করে জিয়নের চেতনাকে।

ছয়

কেউ যেন গল্প বলছে। হ্যাঁ গল্পই মনে হয়।

“...বাসিতানে যাওয়ার আগে মেক্সিকো নিয়ে একটু পড়াশোনা করতেই হয়েছিল। কয়েকটা চমকপ্রদ উপকথা চোখে পড়ল। সব থেকে আশ্চর্য যেটা সেটা আসলে ওদের উৎপত্তির কাহিনী। মেক্সিকোর আদিম অধিবাসীদের ধারণা তাদের পূর্বপুরুষ ‘ওলমেক’-দের বাস ছিল বাসিতান দ্বীপে। তাদের দাবি এইরকম যে, বহু হাজার বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন স্বর্গের দেবদেবী।

‘ইটজিমনা’ ছিলেন তাদের স্রষ্টা, মহাপরাক্রমশালী তিনি। ভয়ানক তার আকৃতি প্রবৃত্তি। শোনা যায় তিনিই নাকি সর্বপ্রথম জীবন্ত মানুষকে ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদনের প্রথা চালু করেছিলেন। তিনি নিজেও নাকি জীবন্ত মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আহার্য হিসাবে গ্রহণ করতেন। আধুনিক মানুষদের কাছে সেসব কল্পকথা, কিন্তু খ্রিস্টের জন্মের সাত হাজার বছর আগে অনেক দেশেই নানা রকম রোমহর্ষক ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। সে যাই হোক, আমরা ফিরে আসি ইটজিমিনার কাহিনীতে।

তাঁর খাদ্য হতেন অসূর্যস্পর্শা রূপসী যুবতীরা।

অবশেষে একদিন চাঁদ থেকে নেমে এলেন দেবী ‘ইক্সচেল’, যাকে অনেকে ‘নোনি’ বলেও জানে। ওলমেকরা তাঁকে বন্দি করে পেশ করলো রাজার সামনে।

কিন্তু ইটজিমিনার মন তখন বিদ্রোহ করে উঠেছে, অসামান্যা রূপসী ইক্সচেলকে তিনি প্রাণে মারতে পারলেন না। কিন্তু ছেড়েও দিলেন না তাকে। বন্দি করে রাখলেন তাকে, দেবদাসী করে। তাঁর এই পদস্খলনে বিক্ষুব্ধ প্রজাদের বোঝালেন, ইক্সচেল কোনো সাধারণ মানবী নন, তিনি জন্মের দেবী। এনসিয়েন্ট পার্ভার্শন আর কী। সেভাবেই চলছিল বেশ কিছুদিন।

এমন সময় একদিন শহরে এসে উপস্থিত হলেন একজন ‘অতিথি’। হ্যাঁ, শুধুই অতিথি, কোনো নাম খুঁজে পাওয়া যায় না তার।

‘কাকালান’ প্রাচীন ওলমেক ভাষায় বোঝায় অতিথিকে। তা সেই অতিথি আসতেই শান্তির শহরে বাঁধলো বিপত্তি। দেবী ইক্সচেল তার প্রেমে পড়লেন, ‘অতিথি’ নিজেও রাজার রক্তচক্ষুকে ভয় না পেয়ে দেবীর প্রেমে মশগুল হলেন। কিন্তু গোপন কথাটি রইলো না আর গোপনে। বন্দি করা হলো প্রেমিক এবং প্রেমিকাকে। যদিও শেষ অব্দি নাকি ইক্সচেল প্রেমিককে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু রক্ষা পাননি নিজে। কঠিন শাস্তি জুটেছিল তার কপালে। পুরানো নিয়ম মেনে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছিলেন রাক্ষস ইটজিমিনা। কিন্তু তাতেও ক্ষুব্ধ প্রজারা শান্ত হল না, তাদের ধারণা বদ্ধমূল হলো দেবীর রূপে ভুলে ইটজিমিনা নিজের দেবত্ব হারিয়েছেন। মানবীকে দেবীর আসনে বসিয়ে পাপ করছেন। ক্রমবর্ধমান ঝড় ঝঞ্ঝা আর বৃষ্টির তীব্রতা তাই শাস্তি হিসাবে আছড়ে পড়ছে তাদের ওপরে। ক্রোধ থেকে আগুন জ্বলতে দেরি হল না। বিদ্রোহী প্রজারা ইটজিমিনাকে আক্রমণ করলো, বন্দি করে তার মাথা কেটে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হলো।

যে নারকীয় বীভৎসতা ছিল ইটজিমিনার প্রজাপালনের অস্ত্র সেই আগুনেই মরলেন তিনি অবশেষে। তারপর? শোনা যায় মৃত্যুর আগে রাক্ষস ইটজিমিনা ভয়ঙ্কর অভিশাপ দিয়েছিলেন প্রজাদের। অভিশাপ একসময় সত্যিই বন্যার জল হয়ে আঘাত হানলো ওলমেকদের ওপর। সাজানো নগর জনপদকে ভাসিয়ে নিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিলো বিক্ষুব্ধ ঝঞ্ঝা।

সব শেষ হয়েও নাকি শেষ হয় না। শয়তানের অভিশাপ এড়িয়ে কিছু মানুষ এসে জোটেন মেক্সিকোর মূল ভূখণ্ডে। বর্তমান মেক্সিকোর মানুষরা তাদেরই বংশধর। ওদের দাবি সেরকমটাই...”

লিনের গলা না? জিয়ন তাকে দেখতে চায়। হ্যাঁ, লিনই বটে। একখানা চেয়ারে বসে আয়েশ করে গল্প শোনাচ্ছে তার বাপ এবং মাকে। বাসিতানের পেনিনসুলায় ডাইভ দেবার আগে সে ভূগোল পড়েছিল মন দিয়ে, লিন পড়েছে সে জায়গাটার ইতিহাস-ও।

“ইন্টারেষ্টিং!” রেঁনে দাঁড়ি ঝাঁকিয়ে বলেন। “বীভৎস!” এটা জিওনের মায়ের মতামত।

“এই দেখ, খোকার ঘুম ভাঙলো।” লিনের ঠাট্টা মেশানো তরল ঘোষণায় দুজনেই চমকে তাকায় সন্তানের দিকে।

কান্নার দমকে কেঁপে ওঠেন পারি, বাপের চোখেও কি জলের বাষ্প?

“আ-আ--মি দুঃখিত!” জিয়ন কোনোক্রমে বলে ওঠে।

লিন মাথা ঝাঁকায়, “শুধু দুঃখিত বললে হবে না, অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে তোমায়।”

“মেয়েটা না থাকলে...” কান্নার অভিব্যক্তি চেপে পারি কোনোরকমে বলেন। “ধন্যবাদ।” জিয়ন লিনকে উদ্দেশ্য করে বলে।

“ধন্যবাদ প্রাপ্য একাডেমির সবার। ওরা না থাকলে আমি একা পারতাম না বোধহয়। আর সেখানেই তোমার কৃতিত্ব, মিস্টার টাফ গাই!” লিনের গলায় রাগের রেশমাত্র নেই। আজ সে বোঝে, তার থেকেও অনেক বেশি শক্ত ঐটুকু মেয়েটার অন্তর। “শুধু একটাই প্রশ্ন, এক মাস কী করে কাটালে জলের নিচে?” প্রশ্নটা তাকেই।

“জলের নিচে? আমি তো...” জিয়নের মুখে বাক্য অসমাপ্ত, চোখ দুটো সিলিঙের দিকে আবদ্ধ। ওরা কি বিশ্বাস করবে এমন ভৌতিক আখ্যানে? ইটজিমিনা আর ইক্সচেলকে নিয়ে যে মহানাটক অভিনীত হচ্ছে জলের নিচে প্রতিনিয়ত সেই নাটকের যে একটি বেশ চরিত্রে অভনয়ের সুযোগ সে-ও পেয়েছিল, কেমন ভাবে সবাইকে জানাবে সে? আচ্ছা, ওই খুনে প্রাসাদটা এমন কত ‘অতিথি’-কে টেনে এনেছে তার অন্ধকূপে?

“নিশ্চই জলের মধ্যে, ওখানে শুধু জল আর জল, অবশ্য অভিযাত্রীদল বেশিদূর এগোতে পারেনি। সবার ইলেকট্রনিক ডিভাইস খারাপ হয়ে গেছে, তীব্র চৌম্বক প্রবাহে। কিন্তু ভালো খবরও আছে।” লিন থামে।

সবার জিজ্ঞাসু মুখের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা নাটকীয়ভাবে মুচকি হাসে, “আজ সকালে অভিযাত্রীদল আবার নেমেছিল বাসিতানে, এক বহু পুরানো জনপদ আবিষ্কার হয়েছে। প্রাচীন মূর্তি, ভাঙা পাত্র, বল্লমের টুকরো ইত্যাদি। সেই সঙ্গে আবিষ্কার হয়েছে দুখানা সিংহদরজা, সুবিশাল খিলান। যেন একখানা রাজপ্রাসাদের প্রবেশপথ। আর সেই সঙ্গে আবিষ্কৃত হয়েছে বাক্সভর্তি সোনার অলংকার।” লিন হাসে।

জিয়ন চোখ বড় বড় করে তাকায়। “সিংহদরজার ওপারে কিছু ছিল না?”

লিন কাঁধ ঝাঁকায়, “নাহ, ঐটুকুই তো। খুশি হওয়ার আগে জানাই, আবিষ্কৃত সম্পদ নিয়ে যথারীতি টানাপোড়েন শুরু হয়েছে মেক্সিকো এবং কিউবা সরকারের মধ্যে।”

জিয়ন আবার হতাশ হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ে। হেসে ওঠে সকলে।

“তবে কিনা, সন্ধ্যাবেলায় পারি থেকে ফোন এসেছে, সব থেকে গভীর আন্ডারওয়াটার কেভ আবিষ্কারের কৃতিত্ব তোমার কপালে জুটছে। গভীরতা পনেরোশো ফুট।”

“উফ, অসাধারণ!” রেঁনে উচ্ছসিত হয়ে ওঠেন।

“সব কৃতিত্ব পিটারের।” জিয়ন বলে।

“নিশ্চই, তার নামও জোড়া হয়েছে তোমার সঙ্গে।” লিন জানায়।

“ফ্রেঞ্চ সরকার তোমার কাজের জন্য পুরস্কারমূল্য ঘোষণা করেছেন আশি হাজার ডলার এবং সঙ্গে জুটছে তোমার গবেষণা করার যাবতীয় খরচ।” এবার পারি বলে ওঠেন।

“একদম তাই, আশা করি লুইএর টাকাটা ফেরত দেওয়া যাবে সহজেই।” হাসে লিন।

সর্বনাশ! লুই? তার নাম জানলো কী করে মেয়েটা?

“আচ্ছা আমার হদিস পেলে কীভাবে?” জিয়ন গলার স্বরটাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে।

“যখন ওঁরা হন্যে হয়ে তোমাকে খুঁজছিলেন, ঠিক তখনই আমার মাথায় আসে তুমি বাসিতানের গল্পে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলে। আমি পাত্তা দিইনি, কিন্তু গত চারবছর তোমাকে জানার জন্য যথেষ্ট ছিল। আমি নিশ্চিত ছিলাম তোমার অন্তর্ধানের সঙ্গে বাসিতানের যোগাযোগ আছে কিছু। তাই প্রথমেই তোমার ইমেল খুলি। সেখানেই তোমার এবং লুইএর পত্রবিনিময় দেখতে পাই। এরপর ওকে চেপে ধরতেই সবকিছু খুলে বলে সে।”

লিন ব্যাখ্যা দেয়।

“কিন্তু...” জিয়নের মনে আরেকটা প্রশ্ন উঁকি মেরে যায়, “আমার মেইল খুললে কীভাবে? পাসওয়ার্ড তো তোমার জানার কথা নয়!”

লিন হাসে, কোনও কথা বলে না। রেঁনের দাড়িগোঁফে ঢাকা মুখটাও ভেঙেচুরে যাচ্ছে হাসির দমক চাপতে। পারির মুখেও হাসি, চোখ দুটো দেওয়ালের দিকে নিবদ্ধ। তবে কি ব্যাপারটা সবাই জেনে ফেলেছে?

“মাত্র কুড়ি মিনিট চিন্তা করতে হয়েছে তারপর মাত্র একবার পাসওয়ার্ড টাইপ করেছি। তারপরেই ব্যাস...” তুড়ি মেরে বলে ওঠে লিন।

ধরণী দ্বিধা হও, জিয়ন মাথা নিচু করে ভাবে।

“যাই হোক, সেরে ওঠো আগে, ফুসফুসের অবস্থা খারাপ, রক্তে বিষক্রিয়া হয়েছে অতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড জমায়। সেরে উঠলে মেক্সিকো থেকে পারি যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে...অনেক আইনগত অসুবিধা আছে...সেগুলো নিয়ে ভাবতে হবে।” লিন বলে।

“রোগীকে একা থাকতে দিন এবার। সময় শেষ।” একজন নার্সকে ঘরে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়ায় সকলে।

অপেক্ষা করে জিয়ন, বাপ মা ঘর ছাড়তেই মৃদু স্বরে ডাকে সে, “লিন...”

ধীর পদক্ষেপে ফিরে আসে মেয়েটা।

তার হাত চেপে ধরে জিয়ন কাঁপা কাঁপা হাতে, “ধন্যবাদ। আমি---” তার গলা কাঁপতে থাকে।

“জানি।” লিন হাসে, “কোনো ধেড়ে ছেলের ইমেইল পাসওয়ার্ড যদি কোনো মেয়ের নামে হয়, তাহলে ব্যাপারটা বুঝতে না পারার কোনো কারণ নেই।” হাসে লিন।

নির্বাক জিয়ন।

“তাড়াতাড়ি সুস্থ হও, একাডেমি অপেক্ষা করে আছে তোমার জন্য। তাছাড়া চিহ্নই লেকেও অভিযানের অনুমতি মিলেছে। সেখানে তুমিই হবে আমাদের নেতা। মাটির নিচে সবথেকে গভীর সুড়ঙ্গে একা যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের মধ্যে একমাত্র তোমারই আছে।” তার হাতে মৃদু চাপড় মেরে লিন বলে। “গেট ওয়েল সুন।” লিন বিদায় নেয়।

সিলিঙের দিকে তাকিয়ে বিগত দিনগুলোর কথা মনে পড়ে তার। ঠিক কী হয়েছিল সিংহদ্বার পেরোনোর পর? যা ঘটেছিল সে সবই কি মিথ্যে? কিন্তু তার অনুভূতিগুলো? কে সেই দেবীমূর্তি? ‘নোনি’? চন্দ্র থেকে নেমে আসা অপরূপা দেবী ‘ইক্সচেল’? কে ছিল সেই ‘অতিথি’ যার আগমনে ধ্বংসের গান বাজতে শুরু করেছিল প্রাচীন জনপদের পথে ঘাটে? অতিথির সঙ্গে তারই বা কী সম্পর্ক?

প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে, জিয়ন জোর করে তাদের দূরে সরিয়ে ফেলতে চায়। অতীত থাক জলের তলায়, ভবিষ্যৎ আসুক সোনালী সম্ভাবনা নিয়ে। জিয়ন লিনের কথাগুলো মনে করে, চিহ্নই হ্রদে অভিযানের অনুমতি মিলেছে তাদের। সব বিষণ্ণতা ঝেড়ে ফেলে উঠে বসে সে।

জিয়নের চোখ দুটো জ্বলতে থাকে, তার রক্তে লেগেছে দামামার সুর, নতুন অভিযানের নেশা ছড়িয়ে পড়ছে তার শিরায় উপশিরায়।

“ওল্ড ম্যান, দ্য গ্যাং ইজ কামিং ফর ইউ...” জিয়ন মৃদুস্বরে বলে।