অপদার্থ - পার্থ দে

কল্পবিজ্ঞানের গল্প

কাঁচুমাচু মুখে বুবলা মার্কশিটটা তার বাবার দিকে এগিয়ে দিল। দারোগা বজ্রনির্ঘোষ কর হাত বাড়িয়ে ছেলের ইস্কুলের রিপোর্টকার্ড পড়তে শুরু করলেন।

“অঙ্ক ৭৮, ফিজিক্স ৮১, কেমিস্ট্রি ২৩, বায়োলজি ১৯, ইংরেজী ২৭, বাংলা ১৬...গার্ডিয়ান কল...প্রোমোটেড উইথ ওয়ার্নিং—এগুলো কীইই? কী এগুলো?”

বুবলা নামের জীবটি একটু নির্জীব গোছের। তার কাছে দিনটা ২৪ ঘন্টার নয়, অন্তত তিরিশ কি ছত্রিশ ঘন্টার হবে। একটু ক্লান্তিতে সে ঘুমিয়ে পড়ে, আবার ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ক্লান্ত হয়ে সে জেগে উঠতে না উঠতেই ফের ঘুমিয়ে পড়ে। যতটুকু সময় জেগে থাকে সে ইউটিউবে বিদঘুটে জিনিস খুঁজে খুঁজে বের করে দেখে। অবশ্য রোজ দুচারটে অঙ্ক করে আর ফিজিক্সটা সে পড়তে ভালবাসে। এর বাইরে তার জন্য বিশ্বসংসারে আর কিছু একজিস্ট করে না।

বুবলা তার পুলিশ বাপের দিকে ভীত চোখে তাকায়। গালের নরম দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে বোঝার চেষ্টা করে তার ওপর ভারতীয় দণ্ডবিধির কত নং ধারা লাগু হতে চলেছে। পুরোটা বুঝে ওঠার আগেই তার গালে আড়াই কিলোর প্রকাণ্ড এক থাপ্পড় এসে পড়ে।

‘ঠাস’ নয় ‘ধড়াম’ করে একটা শব্দ হয়। বুবলার ঠাকুমা আর মা রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে দেখে বাপের এক চড়েই ছেলে মেঝেতে ধরাশায়ী। বুবলার মাথার চতুর্দিকে তখন চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র-নীহারিকা-কৃষ্ণগহ্বর সব একসঙ্গে পাক খেতে শুরু করেছে। তার মনে হচ্ছে বাবার হাতের চড় নয় যেন রাজধানী এক্সপ্রেস তাকে ধাক্কা মেরেছে।

“আমার নাতিটারে কি মাইরা ফ্যালাইবি, বেজো?” বুবলার ঠাকুমা মেঝেতে ধেবড়ে বসে বজ্রনির্ঘোষবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল। “অ বুবলা, ষাইট ষাইট, উইঠ্যা পর সোনা।”

“এই অপদার্থটাকে আর মাথায় তুলো না, মা। সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমোবে নয়ত ইউটিউব দেখবে। এবার ওকে ক্লাস টুয়েলভে তোলার জন্য ইস্কুলে গিয়ে ওর মাস্টারদের পা ধরতে হবে। এবার আমি পিটিয়ে অপদার্থটার ভূত ছাড়াব।” বজ্রনির্ঘোষবাবু উত্তর দেন।

তখনও বুবলার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করছে। মনে মনে সে ভাবছে, বাপরে বাপ! পুলিসের হাত তো নয়, হাতুড়ি! ঠাকুমার হস্তক্ষেপে বাবার নাগাল পেরিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে চিত্তির হয়ে শুয়ে পড়ল সে। মারের চোটে মাথাটা এখনও টনটন করছে। তার ওপর বাবা তাকে ‘অপদার্থ’ বলেছে। রাগে, দুঃখে, অভিমানে বুবলার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল।

খাটের ওপর পড়ে থাকা মোবাইলটা খুলে দেখল তার বন্ধু প্লুটো হোয়াটস্যাপে মেসেজ পাঠিয়েছে—‘কীরে, রেজাল্ট দেখে তোর বাবা কী বলল?’ মেসেজের সঙ্গে তিনটে চোখের-জল-বেরোনোর ইমোজিও পাঠিয়েছে।

বুবলা পাল্টা মেসেজ লিখল—‘উদুম কেলিয়েছে। অপদার্থ বলেছে। আরও বলেছে পিটিয়ে আমার বডি থেকে ভূত ছাড়িয়ে দেবে।’

জবাবে ওপাশ থেকে প্লুটো অন্তত দশটা দাঁত-ক্যালানোর ইমোজি পাঠাল। বুবলার আরও রাগ হয়ে গেল। বন্ধু হয়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিল! প্লুটো অবশ্য কোনো বিষয়েই পঞ্চাশের বেশি পায়নি, গড়ে পঁয়তাল্লিশ! কিন্তু, সে তো তবু ফিজিক্স আর অঙ্কে আশির কাছাকাছি নম্বর পেয়েছে!

গায়ে হাওয়াই শার্ট আর পায়ে হাওয়াই চপ্পল পরে বুবলা দুঃখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। আজ ছুটির দিন, বাবা সকালে বাজার থেকে মাংস এনেছিল। খাসির মাংস খেয়ে একটা লম্বা ভাতঘুম দেওয়ার প্ল্যানটাই বানচাল হয়ে গেল! হঠাৎ নজরে পড়ল, দুটো বাড়ি পরেই গলির মুখে বাঘা নামের খেঁকি নেড়িকুকুরটা বসে আছে। মহা বজ্জাত কুকুর, ওকে দেখলেই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে গরর গরর করতে শুরু করে।

তাহলে এখন সে গলিটা পেরোবে কী করে? এমনিতেই তার সাইনোফোবিয়া, মানে কুকুরে ভয় আছে। তার ওপর বুবলার এরকম প্যাংলা, ভীতু ভীতু চেহারাটা দেখলে কুকুরটা যেন আরও মস্তানি শুরু করে দেয়। মহা চিন্তায় পড়ে সে দাড়ি চুলকোতে শুরু করল।

“কীরে নেড়িটাকে ভয় পাচ্ছিস?” পাশ থেকে হঠাৎ কে যেন বলে উঠল।

বুবলা ঘাড় ঘুরিয়ে চমকে উঠল। একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, অবিকল তার মতোই দেখতে। অবিকল বলতে নাক চোখ মুখ সব তারই মতো, তবে অন্য সবকিছু বিপরীত, মানে যাকে বলে অ্যান্টোনিম! বুবলা কালো, ছেলেটা ফ্যাটফ্যাটে ফরসা। বুবলা রোগা ডিগডিগে, কিন্তু ছেলেটা একটু স্বাস্থ্যবান।

“অ্যাই, তুই কে রে? তোর নাম কী? আগে তো দেখিনি, কোন বাড়িতে থাকিস?”

ছেলেটা বুবলার সব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু বলল,“আমার নাম লাববু।”

“ফাজলামি হচ্ছে? আমার নামটা বুবলা জেনে তুই উল্টো দিক থেকে উচ্চারণ করে বললি, লাববু?" বুবলা রেগে গিয়ে বলল।

ছেলেটা কোনো উত্তর দিল না। শুধু নিজের হাতটা বাড়িয়ে বলল,“কুকুরটাকে ভয় পাচ্ছিস কেন? আয় আমার সঙ্গে একবার ‘হাই ফাইভ’ কর, দেখবি সব ভয় কেটে যাবে।”

বুবলা হাই ফাইভ কাকে বলে জানে। ইস্কুলে বন্ধুদের সঙ্গে হাতের তালুতে ঠোকাঠুকি করে মাঝেসাঝেই ওরা হাই ফাইভ করে। ছেলেটার বাড়ানো হাতে বুবলা নিজের হাতের তালুটা ঠুকতেই একটা সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে গেল। কাউকে বললে বিশ্বাস করবে না কিন্তু বুবলা স্পষ্ট দেখতে পেল এক মুহূর্তের জন্য আগুন জ্বলে উঠল।

পরমুহূর্তে তার শরীরের ভিতর যেন আগুনের হলকা বয়ে গেল। বুবলা প্রবল উত্তেজনা অনুভব করল, তার পা দুটো নিশপিশ করে উঠল। সে প্রকাণ্ড একটা লাফে ঘোষালদের বাড়ির রকটায় বাঁ পা রেখে চাপ দিয়ে ডান পা-খানা শূন্যে কারাটের স্টাইলে ছুঁড়ে মিত্রজেঠুদের পাঁচিলের ওপর গিয়ে দাঁড়াল। পাঁচিলের ওপর বসে থাকা দুটো কাক কা কা করে পালাল, গ্যাঁট হয়ে বসে থাকা মোটা বেড়ালটাও টুক করে লাফিয়ে চলে গেল।

পাঁচিলের ওপরে দাঁড়িয়ে বুবলা অবিশ্বাসী চোখে নিজের দিকে তাকাল। সাড়ে পাঁচ ফুট উঁচু দেয়ালে সে এক লাফে উঠে পড়ল! নিজেকে তার এখন সুপারহিরো মনে হচ্ছে! তাকিয়ে দেখল বাঘা নামের খেঁকি নেড়িটা তার কাণ্ড দেখে কুঁইকুঁই করে ল্যাজ গুটিয়ে পালাল। বুবলা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখল লাববু নামের ছেলেটা সেখানে আর নেই, যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

তার শরীরে তাহলে এখন অনেক শক্তি, আরেকটু পরীক্ষা করে দেখা যাক, বুবলা ভাবল। গলির মোড়ে নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠছে, রাস্তার ধারে পাঁজা করে ইঁট সাজানো। শক্তি পরীক্ষার জন্য রাস্তায় পড়ে থাকা একটা ইঁটে সে সজোরে লাথি কষাল।

লাথিটা মারতেই “আঁক! বাপরে মরে গেলুম।” বলে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল বুবলা। ইটটা এক ইঞ্চিও নড়ল না, উল্টে পা-খানা ব্যথায় টনটন করছে। যাচ্চলে, শক্তিটা গেল কোথায়, মহা চিন্তায় পড়ে গেল সে। ঠিক তখনই সে ফের লাববুকে দেখতে পেল।

“ঘাবড়াসনি। হবে, তবে ওভাবে নয়। হাই ফাইভ করতে হবে যে!” ছেলেটা বলল।

এবারও দুজনে হাই ফাইভ করার সময় বুবলা স্পষ্ট দেখল হাতে আগুন জ্বলে উঠল। তবে এক মুহূর্তের জন্য। তারপরেই বুবলার শরীরে অসীম শক্তির জোয়ার ফিরে এল। সামনে স্তূপাকার করে রাখা একটা ইঁটের পাঁজার ওপর সে হাতের তালুর পাশ দিয়ে ক্যারাটের মতো মারতেই মড়মড় করে পাঁজার একসারি ইঁট ভেঙে পড়ল। বুবলা চমকে উঠল, একী করল সে! অন্তত এক আঘাতে কুড়িটা ইট সে ভেঙে ফেলল! ঘাড় ঘুরিয়ে সে অবাক চোখে পাশে তাকিয়ে দেখে লাববু নেই। হাওয়ায় ভ্যানিশ হয়ে গেছে।

***

আরও এক সপ্তাহ ধরে বুবলার নানারকমের শক্তির পরীক্ষা চলল। ভরা গ্যাসের সিলিন্ডার তাকে অবহেলায় আঙুলে ধরে তিনতলায় তুলতে দেখে তার মা ঘাবড়ে গেল। আরেকদিন ঠিক তেরো সেকেন্ডে সে জেটগতিতে ছুটে ঠাকুমার জন্য বাজার থেকে পান-দোক্তা কিনে আনল। তবে সব ক্ষেত্রেই লাববু এসে হাই-ফাইভ করে তাকে শক্তি যুগিয়েছিল।

সমস্ত রকমের শক্তির পরীক্ষার শেষে সে নিশ্চিত হল যে লাববু আসলে ভূত। অথচ একটা ব্যাপারে তার মন খচখচ করছে, মানুষ মরে গেলে তো ভূত হয়, সে তো দিব্যি বেঁচে আছে! অথচ বুবলার বাবা বলেছিল মেরে তার ভূত ছাড়িয়ে দেবে? তাহলে কি...

সেদিন ফিজিক্স টিউশন পড়তে গিয়ে বুবলা বোরস্যারের হাতে ধরা পড়ে গেল। পদার্থবিদ্যার জলধর দত্ত ওরফে জেডি-কে ক্লাসের ছাত্ররা বোরস্যার বলে ডাকে। নামটা বিজ্ঞানী নিলস বোরের থেকে নেওয়া হলেও নামকরণটা হয়েছে খ্যাপাটে স্যারের ক্লাসে বোর করার কারণে। বোরস্যার অবশ্য বুবলার বেশ প্রিয় শিক্ষক।

সেদিন টিউশন শেষে ছাত্রছাত্রীরা যখন বাড়ি যাবে বলে উঠছিল তখন বোরস্যার বললেন,“এই বুবলা, তুই একটু থেকে যাবি, দরকার আছে।”

সবাই চলে যাওয়ার পর বোরস্যার বললেন,“তোর ব্যাপারটা কী রে বুবলা? তোর শরীর ঠিক আছে তো?”

“কেন স্যার?”

“একটু আগে আমি যা দেখলাম সেটা সত্যি?” বুবলার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে বোরস্যার বললেন।

অবাক হওয়ার ভান করে বুবলা বলল,“আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না স্যার।”

“মিছে কথা বলিস না, বুবলা। একটু আগে তুই বাথরুমে যাওয়ার নাম করে বাইরে গিয়ে হনুমানের মতো লাফিয়ে বাগানের আম গাছটার মগডালে চেপে টপাটপ করে আম পাড়লি সেটা আমি দেখিনি ভেবেছিস?”

“আপনি দেখে ফেলেছেন স্যার?” বলে বুবলা মাথা নিচু করল।

“হুঁ। দেখেছি তো বটেই, এখন রহস্যটা কী সেটাও শুনতে চাই। কোনো মানুষের পক্ষে দশ-পনেরো ফুট লাফিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।”

“হ্যাঁ স্যার, আপনি ঠিকই দেখেছেন, তবে সেগুলো সব ভূতের কীর্তি। অবিকল আমার মতো দেখতে একটা ভূত আমাকে দিয়ে এসব করাচ্ছে।” কাঁচুমাচু মুখ করে বুবলা বলল। ধীরে ধীরে সে বোরস্যারের কাছে সমস্ত ঘটনা জানাল। তার বাবার আড়াই কিলোর থাপ্পড়, লাববুর সঙ্গে দেখা হওয়া, তার চেহারার বর্ণনা দেওয়া, দুজনের তালুতে ঠুকে হাই ফাইভ করা আর হাই ফাইভের পর তার শরীরে কেমন অদম্য শক্তির জোয়ার বয়ে যায়, তখন সে ইচ্ছেমতো যা খুশি করতে পারে— সবকিছু জানাল সে, কিচ্ছু গোপন করল না।

সব শুনেটুনে বোরস্যার বলল,“ধুস্ ভূতটুত নয়। ভূত বলে কিছু নেই। অবিশ্বাস্য হলেও সব কিছুরই একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে।” কথাগুলো বলেই স্যার গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন।

বুবলা বোরস্যারের কাছে কোনো ব্যাখ্যা না পেয়ে বাড়ি ফিরে এল। এখন সে বেশ ফুর্তিতেই আছে। গলির নেড়ি বাঘা তাকে দেখলেই ল্যাজ গুটিয়ে পালায়। পাড়ার ইয়ং ফাইটার্স ক্লাবের ছেলেগুলো তাকে আগে পাত্তাই দিত না, কিন্তু ছবিটা একদিনের মধ্যেই বদলে গেল। সেদিন বাড়ির পাশের মাঠেই ক্রিকেট ম্যাচ চলছিল। ওদের দলে বঙ্কা নামে একটা মারকুটে ব্যাটসম্যান খেলছিল। ছেলেটা ম্যাচের সময় প্রচণ্ড জোরে একটা বল হুক করল। মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে বুবলা দেখল বলটা উঁচু হয়ে তাদের বাড়ির দোতলায় বাবার ঘরের দিকে যাচ্ছে। বুবলা ভাবল, জানলার কাচ ভাঙলে আবার সে বাবার কাছে ঠ্যাঙানি খাবে। যেই না ভাবা অমনি কোত্থেকে লাববু এসে তার হাতের তালুতে তালি বাজিয়ে দিল। ব্যস্, অমনি বুবলা পঁচিশ ফুটের একটা হাইজাম্প মেরে ক্যাচটা ধরে ফেলল। ক্লাবের ছেলেগুলো ওর দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। বঙ্কা বলে ছেলেটাও ঘাবড়ে গিয়ে পরের বলেই আউট হয়ে গেল।

দিনতিনেক পর ইস্কুলে কে এসে যেন বলল বোরস্যারের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সাইকেলে চেপে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, পেছন থেকে বাস এসে ধাক্কা মেরেছে, ভাগ্য ভাল ছিল তাই প্রাণে বেঁচে গেছেন। এখন হাত-পা ভেঙে স্যার গৃহবন্দী। আপাতত স্যারের ইস্কুলের ক্লাস, টিউশন সব বন্ধ।

শুনে বুবলার মন খারাপ হয়ে গেল। ইস্, তাহলে বোরস্যারের কাছে এখন পদার্থবিদ্যা পড়া বন্ধ! ওই একটা বিষয়ই যে সে পড়তে ভালবাসে! রবিবার সকাল ন’টা নাগাদ বুবলা সাইকেল নিয়ে বোরস্যারের বাড়ির দিকে রওনা দিল। বোরস্যার বিয়ে থা করেননি, বৃদ্ধা মাকে নিয়ে শরৎপল্লীর একটা বাড়িতে থাকেন।

বাড়ির সামনের বড় বাগান পেরিয়ে বুবলা বোরস্যারের বাড়ির দরজায় এসে বুঝতে পারল দরজাটা আলতো করে লাগানো, ঘরে কেউ নেই। কিছুটা অবাকই হল সে, হাত-পা ভাঙা মানুষ ঘর ছেড়ে বেরোল কী করে! বুবলা দেখল অগোছালো ঘরটায় এখানে ওখানে রাশি রাশি কাগজ পড়ে আছে, তাতে কত বিদঘুটে ডায়াগ্রাম আঁকা, পদার্থবিদ্যার দুর্বোধ্য সব সমীকরণ লেখা! কাগজগুলো হাতে নিয়ে বুবলা বিক্ষিপ্তভাবে পড়ল, কিছু কিছু শব্দ তার ইলেভেন ক্লাসের বিদ্যেতে চেনা মনে হল, তবে নব্বই শতাংশই মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল।

যে লেখাগুলো চেনা মনে হল বুবলা পড়তে শুরু করল— সার্ন…লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার...হাই এনার্জি কলিশন… অ্যান্টিপ্রোটন… ম্যাগনেটিং ফিল্ড… পজিট্রন...অ্যান্টিম্যাটার...

“কীরে কী করছিস?"

আচমকা পিছন থেকে বোরস্যারের গলা শুনে বুবলা চমকে উঠল। সে দেখল স্যারের বাঁহাত আর ডানপায়ে প্লাস্টার, তবু যেন তাকে বেশ সতেজ আর চনমনে দেখাচ্ছে। বুবলা কাগজগুলো দেখিয়ে বলল,“স্যার, এগুলো কী?”

“অপদার্থ কী, জানিস?” বোরস্যার বললেন।

“হ্যাঁ স্যার, বাবা আমাকে রোজ বলে।” বুবলা বলল।

“তোকে ঠিক অপদার্থ বলা যাবে না,” বোরস্যার বলতে শুরু করলেন,“আমি অ্যান্টিম্যাটার অর্থাৎ প্রতিপদার্থ...না থাক... অপদার্থটাই ভাল...তার কথা বলছি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিরহস্য জানিস তো, বিগ ব্যাং থিয়োরি?”

“হ্যাঁ স্যার, একটু আধটু শুনেছি।”

“বিগ ব্যাং হয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির প্রথম ১০০ সেকেন্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তখন সমপরিমাণে পদার্থ আর অপদার্থ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এই পদার্থ আর অপদার্থ অতি উচ্চ তাপে পরষ্পর সংঘর্ষ করে ভেঙে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে শক্তি উৎপন্ন করে। কিন্তু, মজার কথা হল, আজকের পৃথিবীতে শুধুমাত্র ম্যাটার অর্থাৎ পদার্থ পড়ে রয়েছে, অপদার্থগুলো কোথায় যে চলে গেল কেউ জানে না! বিজ্ঞানীদের ধারণা প্রায় একশ কোটির মধ্যে একটি করে ম্যাটারের কণার রয়ে গিয়েছিল, যা আজকের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চেহারা নিয়েছে। তাই আজকের ব্রহ্মাণ্ডে শুধু ম্যাটার রয়ে গেছে, বাকি সব অ্যান্টিম্যাটার ধ্বংস হয়ে গেছে। কীরে তোকে বোর করছি না তো? তোরা তো আবার আমার জলধর নামটা বদলে ‘বোরস্যার’ বানিয়ে দিয়েছিস।”

“কিন্তু স্যার, অ্যান্টিম্যাটার কী আর বানানো যায় না?”

“হুম। কণা পদার্থবিদ্যার সবচেয়ে বড় গবেষণাকেন্দ্র জেনিভার কাছে সার্ন। সেখানে লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে বিজ্ঞানীরা কণার সংঘর্ষের মাধ্যমে যে শক্তি উৎপন্ন হয় তা থেকে সমপরিমাণ পদার্থ আর অপদার্থ তৈরি করেছে। তবে অপদার্থের পরিমাণ নগণ্য, ১০ ন্যানোগ্রামেরও কম। মানুষের শরীরেও পটাশিয়াম-40 তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ থাকে যা ভেঙে প্রতিঘন্টায় ১৮০ টা পজিট্রন বের হয়। পজিট্রনকে আমরা অ্যান্টিইলেকট্রন বা ইলেকট্রনের অপদার্থ বলতেই পারি। এই অপদার্থ আবার সুস্থিত নয়, পদার্থের সঙ্গে সংঘর্ষে নষ্ট হয়ে শক্তিতে পরিণত হয়। অবশ্য চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে রেখে অপদার্থকে সংরক্ষণ করা সম্ভব!

"তোর ক্ষেত্রে পুলিশ-বাবার উচ্চশক্তিসম্পন্ন আড়াই কিলো ওজনের চড় খেয়ে ভেতরের অপদার্থটাও বেরিয়ে এসেছে। ওই লাববু নামের ছেলেটা হল তোর অপদার্থ! ভেবে দেখ ওর সবকিছু কিন্তু তোর বিপরীত, ঠিক অ্যান্টিম্যাটারের মতো।”

“স্যার, বিশ্বাসই হচ্ছে না যেন,” ভ্যাবলাকান্ত মুখ করে বুবলা বলল।

“আমারও বিশ্বাস হচ্ছিল না রে। হপ্তাদুয়েক আগে আমার সাইকেলের সঙ্গে বাসটার সংঘর্ষের পর থেকে আমার বিশ্বাস আর ভাবনাগুলোও কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে।”

“কেন স্যার?”

“তুই হয়ত দেখতে পাচ্ছিস না, কিন্তু এই মুহূর্তে আমার অপদার্থটা শরীর থেকে বেরিয়ে ঠিক আমার বাঁপাশে দাঁড়িয়ে আছে, আর ও আমার সঙ্গে হাই ফাইভ করতে চায়,” বোরস্যার বলে উঠলেন।

“সেকী!” বুবলার মুখ থেকে অস্ফুট আর্তনাদের মতো শব্দ বেরিয়ে এল।

“হ্যাঁ রে, বাগানের মগডালে অনেক হিমসাগর আম পেকেছে, চল পেড়ে আনি,” বলে বোরস্যার একটা বিশ ফুট উঁচু হাইজাম্প দিয়ে বাগানের আমগাছের মগডালে উঠে পড়ল।

বুবলাও বোরস্যারের পিছু নিয়ে গাছে চড়বে বলে তার চারপাশে চোখ বোলালো।

তার অপদার্থ লাববু-টা কোথায় যে গেল, কাজের সময় ব্যাটাকে দেখা যায় না!