চক্রব্যূহ - অনন্যা দাশ

রহস্য গল্প

ফোনটা যখন এল তখন আমি স্ত্রী আর কন্যাকে নিয়ে রাজস্থানে বেড়াতে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছিলাম। অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসলে এমনিতে ধরি না কিন্তু এই নম্বরটা দেখি কী মনে করে ধরে ফেললাম। প্রথমে ওপাশ থেকে কেউ কথা বলছিল না। তিন চারবার হ্যালো হ্যালো করার পর অপর প্রান্ত থেকে মহিলা কণ্ঠে একজন বলল, “মিস্টার সেনগুপ্ত? ওসি প্রতাপ সেনগুপ্ত বলছেন কি?”

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “হ্যাঁ, আমি প্রতাপ সেনগুপ্ত বলছি। তবে পুলিশের চাকরি থেকে রিটায়ার করেছি বেশ কিছুদিন হল তাই ওই উপাধি আর ব্যবহার করি না। আপনি কে বলছেন?”

“জানি না আমাকে আপনার মনে আছে কি না। আমি মিসেস ভট্টাচার্য বলছি। সায়ন্তন মানে শানুর মা।”

আমার মাথায় বাজ পড়ল। পুরনো সিনেমার মতন আমার চোখের সামনে সব কিছু ভেসে উঠল। ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিল সায়ন্তন ওরফে শানু। মা-বাবার একমাত্র ছেলে। যাতে হাত দেয় তাতেই অসাধারণ। দারুণ ছবি আঁকে, গান গায়, আবৃত্তি করে আবার পড়াশোনাতেও খুব ভাল। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিল সে। ছুটিতে বাড়িতে এসেছিল আর মা-বাবার সঙ্গে দেশের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানেই হঠাৎ একদিন সে আত্মহত্যা করল প্রচুর ঘুমের ওষুধ খেয়ে। শানুর নিজের হাতের লেখা একটা চিঠিও পাওয়া গিয়েছিল যাতে সে লিখেছিল ‘মা-বাবি, আমাকে ক্ষমা করে দিও’। পোস্ট মর্টেমেও কনফার্ম হয় যে ঘুমের ওষুধ খেয়েই তার মৃত্যু হয়েছিল। কেসটা আমার আওতায় পড়েছিল তখন। ওর মা-বাবা ছেলের শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিলেন, কোন কথা বলছিলেন না প্রায়। কেন আত্মহত্যা করেছিল শানুর মতন ছেলে সেটাই তখন সবার কাছে একটা রহস্য।

সেই শানুর মা কিনা ফোন করেছেন আজ আমাকে!

“মিসেস ভট্টাচার্য! হ্যাঁ বিলক্ষণ মনে আছে! আপনাদের ভোলা আমার পক্ষে সহজ নয় মোটেই। কেন আশাকরি বুঝতে পারছেন। শানুর কেসটা আজও আমার কাছে একটা দুঃস্বপ্নের মতন।”

“ওসি সেনগুপ্ত, আমি সবই বুঝি...”

“মিসেস ভট্টাচার্য, আমাকে ওসি বলবেন না দয়া করে। বললাম না পুলিশের চাকরি থেকে রিটায়ার করেছি আমি।”

“আপনি আমার কাছে সব সময় ওসি সেনগুপ্তই থাকবেন। তা যেটা বলছিলাম, আপনি একবার আসতে পারবেন আমাদের এখানে? কিছু কথা ছিল।”

আমি ওনাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে আমার একটু কাজ আছে আমি যদি দিন দশেক পর যাই। কিন্তু উনি শুনলেন না, বললেন, “আমার হার্টের অবস্থা বেশ খারাপ ওসি। দশ দিন বেঁচে থাকব কিনা তার ঠিক নেই। ডাক্তাররা বাইপাস ইত্যাদি অনেক কিছু করতে বলেছেন কিন্তু আমি আর ওই সব দিকে যাইনি। শানুটা চলে যাওয়ার পর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই তো চলে গেছে। কার জন্যে বাঁচব? রাহুল এসেছিল। কয়েকটা কথা বলল যেগুলো আগে বলেনি। আপনাকে বলতে ভয় পাচ্ছিল। সেই কথাগুলোই আপনাকে বলতে চাই...কিছু সূত্র...” ভদ্রমহিলা কথাগুলো বলে হাঁপাতে লাগলেন।

আমি দেখলাম আমাকে যেতেই হবে। ওঁর বাড়ি যেতে আমার ঘন্টা খানেক লাগবে। এখন দুপুর বারোটা। তিনটে নাগাদ আমাদের ফ্লাইট। সেটা ধরতে পারার কোন সম্ভাবনাই নেই। নন্দিতা তো আমার কথা শুনে বেদম ক্ষেপে গেল। সারা জীবনে যত ভুল আমি করেছি সেই সব তুলে চিৎকার করতে লাগল। রোশনি বরঞ্চ বেশ ম্যাচিওরভাবে মাকে বলল, “মা তুমি চিৎকার করে বাবাকে আটকাতে পারবে না। জানো তো ওই কেসটা নিয়ে বাবা কতটা ধাক্কা খেয়েছিল। যেতে দাও বাবাকে। রাজস্থান ক্যান ওয়েট।”

ওর কথা শুনে নন্দিতা থমকে গেল। আমি সেই সুযোগে বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে। ভাগ্য ভালো সুজয়, মানে আমাদের জন্যে যে গাড়ি চালায় সেই ছেলেটা এসে পড়েছিল। আমার মাথায় যখন রাজ্যের চিন্তা তখন আমার গাড়ি চালাতে একদম ভালো লাগে না। সুজয়কে মহিলার দেওয়া ঠিকানাটা দিয়ে আমি চোখ বুজে ভাবতে লাগলাম সেই কুড়ি বছর আগেকার ঘটে যাওয়া ঘটনা।

আমি তখন ওই জায়গার ওসি। বেশ কয়েকটা কেসে কিনারা করে ফেলে নিজেকে একেবারে কেউকেটা ভেবে বসে আছি এমন সময় একদিন সকাল দশটা নাগাদ শানুদের বাড়ি থেকে ফোন এল। শানু ঘুম থেকে উঠছে না দেখে ওদের কাজের লোক মহেশ চা নিয়ে শানুর ঘরে গিয়েছিল। সেই আবিষ্কার করে যে শানু মৃত।

আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার সহকারী রঘু আর অন্যান্যদের নিয়ে ওদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। ততক্ষণে ওদের বাড়িতে লোকেদের ভিড় জমা হয়ে গেছে। আন্দাজ করা হচ্ছিল যে ঘুমের ওষুধ খেয়েই আত্মহত্যা করেছে শানু। ওর বাবা শুধু এইটুকু বললেন যে ঘুমের অসুবিধা ছিল বলে ডাক্তার ওকে ঘুমের ওষুধ খেতে বলেছিলেন। বিছানার কাছের বেডসাইড টেবিলে ঘুমের ওষুধের খালি শিশি আর চিঠিটা পাওয়া গিয়েছিল। একটা অর্ধেক খাওয়া জলের বোতলও ছিল। ফোনেই ওদের বলেছিলাম কোন কিছুতে হাত না দিতে। জলের বোতল, ওষুধের শিশি সব কিছু আমাদের জিম্মায় চলে এল। বডি পোস্ট মর্টেমের জন্যে চলে গেল।

বাড়িতে লোক বলতে শানুর মা, বাবা, কাজের লোক মহেশ আর শানুর পুরনো বন্ধু তন্ময় আর তার বোন কল্পনা। ওর মা-বাবা তো এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে কোন কথা বলার মতন অবস্থায় ছিলেন না। যা বলার শানুর বন্ধু তন্ময়ই বলছিল। ওর কাছেই জানলাম যে ওর সঙ্গে শানুর খুব ছোটবেলা থেকে বন্ধুত্ব। প্রায়ই ছুটিছাটাতে দেখা হত ওদের।

রঘুই এর ওর সঙ্গে কথা বলে পরে আমার রিপোর্ট করতে এসেছিল। ওর কথাগুলো আমার আজও পরিষ্কার মনে আছে। রঘু বলেছিল, “বেশ অদ্ভুত ব্যাপার স্যার। ছেলেটার ব্যাপার স্যাপার দেখে কিন্তু একদম বোঝার উপায় ছিল না যে সে আত্মহত্যা করবে!”

আমি বলেছিলাম, “কী রকম?”

রঘু বলল, “আরে দুদিন আগেই প্রতিবেশী শঙ্কর পালের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল শানুর।”

“ও, তাই নাকি। কী নিয়ে?”

“শঙ্কর পাল ওদের জমি আর বাড়িটা কিনতে ইচ্ছুক ছিল কিন্তু শানুরা বেচতে চায়নি। শঙ্কর পালের বক্তব্য ওরা বছরে একবার কী দুবার আসে আর বাকি সারাটা বছর বাড়ি জমি এমনি পড়ে থাকে। শঙ্কর পালের জমির দরকার অথচ এরা কিছু না করেও জমি আঁকড়ে বসে রয়েছে কিন্তু বিক্রি করবে না। সেই নিয়েই শানুর সঙ্গে প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল ঝামেলা। তন্ময় শেষমেশ শানুকে টেনে সরিয়ে নিয়ে যায় ওখান থেকে।”

আমি বললাম, “আচ্ছা এই তন্ময়ের ব্যাপারটাও একটু কেমন কেমন, সে বোনকে নিয়ে কেন এসেছিল?”

রঘু হেসে বলল, “সেটা খুব সহজ স্যার। তন্ময় আশা করছিল ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে শানু যখন চাকরি করবে তখন কল্পনাকে বিয়ে করবে!”

“ও বাবা! প্রেমও রয়েছে ইকুয়েশানে!”

“না তবে শানু স্মার্ট ছেলে, ওর কল্পনাকে পছন্দ ছিল কি না জানা যায়নি।”

“আচ্ছা মহেশের সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার?”

“মহেশ পঁচিশ বছর ধরে কাজ করছে ওদের সঙ্গে। সে হয়তো অনেক কিছুই জানে কিন্তু তার পেটে বোমা মারলেও সেই সব কথা বেরোবে না। সে বলল দরজা ভেজানো ছিল কিন্তু ছিটকিনি দেওয়া ছিল না। সে কয়েকবার টোকা দিতেও যখন শানু জবাব দেয়নি তখন সে দরজা ঠেলে খুলে ভিতরে ঢুকে দেখে ওই কান্ড। শানুর ঘরে একটা সিঙ্গেল বেড খাট ছিল, ও ওই ঘরে একাই শুত। বিশেষ করে ওর ঘুম আসে না বলে মনে হয়। তন্ময় শানুর বাবার সঙ্গে শুচ্ছিল আর কল্পনা শানুর মার সঙ্গে। ওরা কেউই কিছু দেখতে বা শুনতে পারেনি।”

এর পর শ্রাদ্ধের কাজকর্ম ইত্যাদি সেরে শানুর মা-বাবা বাড়ি বন্ধ করে শহরে ফিরে গেলেন।

তারপর যেটা ঘটল সেটাতে আমার সব ধারণা উল্টো পালটা হয়ে গেল। একদিন দুপুরবেলা আমি যখন অন্য কাজে ব্যস্ত তখন রামরতন এসে বলল, “স্যার, একজন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে।”

আমি সময় নেই বলে কাটিয়ে দিতে চাইছিলাম তখন রামরতন বলল, “বলছে শানু ভট্টাচার্যকে নিয়ে কিছু কথা ছিল।”

আমার কী মনে হল আমি তাকে আসতে দিলাম। বছর কুড়ির একজন যুবক এসে ঘরে ঢুকল।

“স্যার আমার নাম রাহুল।”

“কী বলবে তাড়াতাড়ি বলো, আমার হাতে বেশি সময় নেই!” আমি অন্য কাজ করতে করতেই ওকে বললাম।

“স্যার শানু আত্মহত্যা করেনি। ও আত্মহত্যা করতে পারে না স্যার।”

“কেন?”

“ও আমাকে বলেছিল ও চোদ্দ তারিখে ফিরবে। পনেরো তারিখে আমাদের যে একটা বড়ো পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল। ও খুব এক্সাইটেড ছিল স্যার সেটা নিয়ে। কাউকে বলিনি আমরা কারণ কর্তৃপক্ষ বলেছিল ব্যপারটাকে গোপন রাখতে। যেন সেদিনই জানতে পারলাম পুরস্কার পাওয়ার সময় এমন ভান করতে। কেন ও সুইসাইড করবে আপনি বলতে পারেন? হি হ্যাড এভরিথিং টু লিভ ফর! হি ওয়াস সো ফুল অফ লাইফ!”

“ও তো ঘুমের ওষুধ খেতো, ওর ডিপ্রেশান হতেই পারে...!”

“ঘুমের ওষুধ? আপনার কি মাথা খারাপ? ওর ঘুমের কোন সমস্যাই ছিল না! বরং খুব নাক ডাকত বলে আমরা ওকে ক্ষেপাতাম। আমার রুমমেট ছিল ও। যেখানে সেখানে যখন তখন ঘুমোতে পারত! ঘুমের কোন সমস্যাই ছিল না।”

আমি ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বললাম, “তাহলে ও অতগুলো ঘুমের বড়ি একসঙ্গে পেল কী করে?” আমার সব থিওরি গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। ওর বাবা বলেছিলেন ও ঘুমের ওষুধ খেত! আমরা অবশ্য প্রেসক্রিপশান চেক করনি!

“সেটা জানি না। তাছাড়া ওর একজন গার্লফ্রেন্ডও ছিল। তার নামটা আমাকে বলেনি কিন্তু ইঙ্গিত করেছিল যে বিয়ে করবে। এই অবস্থায় ও আত্মহত্যা করতেই পারে না! আপনাদের কিছু ভুল হচ্ছে স্যার!”

রাহুল চলে যাওয়ার পর পরীক্ষায় দেখা গেল জলের বোতল আর ঘুমের বড়ির শিশিতে কোন হাতের ছাপ নেই। অর্থাৎ কেউ মুছে সাফ করে দিয়েছে! আমার মাথা ততক্ষণে ভোঁ ভোঁ করছে। আমার ভুলে তদন্তটা মাঠে মারা গেল! আমি সেই রকম তৎপর ছিলাম না। কেসটাকে আত্মহত্যা বলেই ধরে নিয়েছিলাম! কী হয়েছিল সেদিন রাতে আমি আজও জানি না। রাহুল চলে যাওয়ার পর অনেক খুঁজেও আমি শানুর মা-বাবাকে খুঁজে পাইনি। কিন্তু আমার জীবনের সমাধান না করতে পারা কেসগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল শানু ভট্টাচার্যের মৃত্যুর কেসটা। এর পর বহুদিন ধরে মাথার চুল ছিঁড়েছি কিন্তু ওই কেসের সমাধান আমরা করতে পারিনি।

তারপর এতদিন পর শানুর মার ফোন!

আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে শানুর মার দেওয়া ঠিকানাটায় পৌঁছে গেলাম। একটা বহুতল ফ্ল্যাট বাড়ি। আনন্দ অ্যাপার্টমেন্টস। ফ্ল্যাট নং ৭০২ সাত তলার একটা ফ্ল্যাট। সুজয়কে নিচে গাড়ি নিয়ে থাকতে বলে লিফটে করে সাত তলায় গিয়ে হাজির হলাম। দরজার বেলটা টিপতে এক ভদ্রমহিলা এসে দরজা খুললেন।

তাঁকে দেখে আমি চমকে উঠলাম! শানুর মা। কিন্তু একী চেহারা হয়েছে তাঁর! একেবারে হাড়জিরজিরে। চোখগুলো কোটরে বসা, ফর্সা চামড়ায় তামাটে ছোপ।

“ওসি সেনগুপ্ত! এতদিন পরও আপনি আমার কথা শুনে আসবেন সেটা আমি ভাবতে পারিনি! এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি এসেছেন! আমাকে কেমন দেখছেন? অনেকটাই বদলে গেছি তাই না? শোক, বুঝলেন তো, শোক সব কিছু বদলে দেয়। আসুন, বসুন। আপনি কিন্তু চুল পাকা ছাড়া একই রকম আছেন।”

ঘরে আসবাবপত্র খুব কম, প্রায় নেই বললেই চলে। তিনটে কাঠের চেয়ার আর একটা টেবিল। টেবিলের ওপর দুটো জলের গেলাস। ঘরের একটা দেওয়ালে শানুর একটা বাঁধানো ছবি। তাতে চন্দনের ফোঁটা দেওয়া।

আমি আর ভণিতা না করে সোজা দরকারি কথায় চলে গেলাম, যদি তাড়াতাড়ি বেরোতে পারি এখান থেকে তাহলে ফ্লাইটটা... “কেন ডেকেছেন আমাকে বলুন তো?”

একটা শুকনো হাসি হাসলেন মিসেস ভট্টাচার্য, “কেন আবার? সেদিন রাতের ঘটনাটার রহস্যভেদ করতে।”

“ও, তা শানুর বাবা কোথায়?”

“উনি একটু বেরিয়েছেন। সেই জন্যেই আপনাকে ডেকেছি। উনি থাকলে তো আর কথা বলা যেত না! বকেঝকে শেষ করে দিতেন একবারে!”

“আচ্ছা, আপনি যে ফোনে বলছিলেন রাহুল এসেছিল, সে কিছু কথা বলেছে। কী কথা?”

“বলছি। আপনি চা জল কিছু খাবেন?”

“না, না, ওসবের প্রয়োজন নেই। আপনি যা বলার বলুন।”

ভদ্রমহিলার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাম মুছে চেয়ারে বসে বললেন, “ঘটনাটার সূত্রপাত আমাদের দেশে যাওয়ার কিছুটা আগে থেকেই। শানুর কলেজে ছুটি হওয়ার পর ওর বাবার ওকে নিতে যাওয়ার কথা ছিল। তার প্রধান কারণ গাড়িটা সঙ্গে থাকলে জিনিস নিয়ে আসতে সুবিধা হয়। শানুর বাবা ছেলেকে নিয়ে আসার উত্তেজনায় আগের দিন রাতেই রওনা হয়ে খুব ভোরে ওদের বাড়িতে পৌঁছে গেলেন। একটা ছোট বাড়ি ভাড়া নিয়ে রাহুল আর শানু থাকছিল। কবে যে শানু আমাদের একটা চাবি দিয়েছিল বাড়ির আমার মনেও নেই কিন্তু শানুর বাবার মনে ছিল। সেই চাবিটা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। ছেলেকে সারপ্রাইজ দেবেন বলে খুব ভোরে চাবি খুলে ওদের বাড়িতে এবং ঘরে ঢুকে পড়েন। তারপর যা দেখেছিলেন তাতে নিজেই খুব সারপ্রাইজ...না সারপ্রাইজ কথাটা তো মনে হয় ভাল অর্থে ব্যবহার হয়, উনি শক পেয়েছিলেন। চিন্তাধারা খুব সেকেলে ছিল। শানুর দাদু, তাঁর বাবা সব পুরোহিতগিরিও করেছিলেন। শানুর বাবা তাই একমাত্র ছেলের সমকামিতা ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারলেন না। উনিই তন্ময় আর কল্পনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন দেশের বাড়িতে। উদ্দেশ্য ছিল শানুকে কল্পনার সঙ্গে বিয়েতে রাজি করানো। উনি মনে করেছিলেন বিয়ে দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে! কিন্তু শানু ঘোর আপত্তি করে। সে স্পষ্ট বলে দেয় যে কল্পনাকে সে বিয়ে করবে না। একটা নিরীহ মেয়ের জীবন নষ্ট করার কোন ইচ্ছে তার নেই। রাহুলকে সে ভালোবাসে এবং তার সঙ্গেই জীবন কাটাতে চায়! যে চিঠিটাকে সুইসাইড নোট বলে চালানো হয় শানু সেই চিঠিটা লিখেছিল কল্পনাকে বিয়ে করতে পারবে না বলে ক্ষমা চেয়ে। কিন্তু ওর বাবার রাগ কমল না। বললেন, ‘ওই রকম ছেলে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো!’ ঘুমের ওষুধ আমি খেতাম। আমার থেকে নিয়ে শানুর জলের বোতলে মিশিয়ে দিলেন। ও প্রচুর জল খেত। রাতে ঘুমের মধ্যেই যে পুরো বোতলটা খালি করে দেবে সেটা আমরা জানতাম। পরদিন ভোরে শুধু অন্য একটা বোতল আর ওষুধের খালি শিশিটা রেখে দেওয়া হয় ওর ঘরে। আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল কিন্তু কিছু বলতে পারিনি আমি। যেমন বলতে পারেনি মহেশ। সেও সব জানত কিন্তু শানুর বাবাকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করত তাই চুপ করে থেকেছে। ওই ঘটনাটার কিছুদিন পরই মারা যায় সে।” এতটা বলে মিসেস ভট্টাচার্য থামলেন। দরদর করে ঘামছেন তিনি।

টেবিলের জলের গেলাসের একটা তুলে নিয়ে কিছুটা খেয়ে মিসেস ভট্টাচার্য বললেন, “শানুর বাবাও গত হয়েছেন আজ এক মাস হল। বেশ কিছুদিন ধরে প্যারালিসিস হয়ে বিছানায় ছিলেন। আমাকে দিব্যি দিয়েছিলেন যে উনি বেঁচে থাকতে আমি কাউকে কিছু বলব না। এখন তো আর মানুষটাই নেই তাই দিব্যি তো থাকার কথা নয়! হিরের টুকরো ছেলেটাকে আমার মেরে ফেললেন ওই একটা দোষের জন্যে! এখন তো অনেক উদার হয়েছে সমাজ এবং লোকে কিন্তু ওর বাবা সেদিন উদার হতে পারেননি। আমারই কপাল, কপালে দুঃখ থাকলে খণ্ডায় কে! দেশের বাড়ি ছেড়ে আমরা যখন অজ্ঞাতবাসের পথে গেলাম তখন শানুর বাবা বলেছিলেন, ‘কিছু ভেবো না সুরমা, সব ঠিক হয়ে যাবে’। কিন্তু আমি জানতাম আর কোনদিন কিছু ঠিক হবে না। হয়ওনি কোনদিন। আমরা দুঃখের কুয়াশার মধ্যে কাটিয়েছি বাকি জীবনটা। শানুর বাবা চেয়েছিলেন শানু যেন একেবারে নিখুঁত হয়। এতটুকু খুঁত পেয়েছেন মনে করেই ওকে শেষ করে দিলেন। আর আমি হতভাগী কিছু বলতেও পারলাম না। যাক, আপনাকে খুব ঝামেলায় ফেলেছিলাম তখন আমরা তাই সত্যটা বলে দিতে চেয়েছিলাম চলে যাওয়ার আগে।”

ওঁর কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম, “আপনি কী...?”

“হ্যাঁ, ওই দিকের জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। আপনাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে ওটা খেলাম। আমি মনে করি যে খুন করে আর যে খুন করতে সাহায্য করে তাদের অপরাধ সমান ওসি সেনগুপ্ত। শানুকে মেরেছিলাম আমরা সবাই মিলে। শুধু শানুর বাবা নয়, আমরা সবাই সমান দোষী।”

এর পর ডাক্তার, অ্যাম্বুলেন্স অনেক কিছুই ডেকেছিলাম আমি, কিন্তু কিছুই করা যায়নি। বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছিল। শানুর বাবার মিথ্যে গোঁয়ারতুমির জন্যে এতগুলো জীবন নষ্ট হয়ে গেল। হোয়াট আ ওয়েস্ট!

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে ছিলাম। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠতে ধরলাম। রোশনির ফোন, “বাবা আমি এয়ারলাইন্সের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে ঝগড়া করে রাত নটার ফ্লাইটে সিট জোগাড় করেছি। সেটা ধরতে পারা যাবে তো?”

বিষাদমগ্নতাটাকে ঝেড়ে ফেলে আমি উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ মা, আমি আসছি।”