পাঁতরের প্রতিশোধ - এস. সি. মন্ডল

ভয়ের গল্প

অলংকরণ - কৃষ্ণেন্দু মন্ডল

শীতকালের এক বিষণ্ণ কুয়াশামাখা সকালে আমি যাত্রা করলাম সমরদের জমিদার বাড়ির উদ্দেশে। বাস থেকে যখন নেমেছি তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। আশেপাশে জিজ্ঞেস করতে একজন লোক আমাকে বাড়ির পথটা দেখিয়ে দিল। লোকটার বিস্ময়মাখা দৃষ্টি আমার চোখ এড়াল না। হয়তো সমরদের এই বাড়িতে এখন আর কেউ আসে না তাই লোকটা অবাক হয়েছে, সমরও অবশ্য আমাকে তেমনটাই বলেছিল।

মিনিট দশেক হাঁটার পর দূরে গাছপালার মাথা ছাড়িয়ে জমিদার বাড়ির চূড়াটা দেখতে পেলাম। সমর আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু, এই জমিদার বাড়িটা ওদের পৈত্রিক বাড়ি। একটা ভৌতিক উপন্যাস লেখার জন্য উপন্যাসের পটভূমি হিসাবে একটা প্রাচীন জমিদার বাড়ির খোঁজ করছিলাম অনেকদিন ধরে। ছাত্র জীবনে সমরের মুখে ওদের এই বাড়ির অনেক রহস্যের কথা শুনেছি। এতদিন পর তাই সরাসরি সমরকে গিয়েই ধরলাম। সমর কোন আপত্তি করল না। ওর সাথে কথা বলে দিনতারিখ ঠিক করে একা একা চলে এসেছি কিছুদিন এই বাড়িতে থাকব বলে।

বাড়িটার কাছাকাছি আসতেই কেমন একটা শীত শীত করতে লাগল। সম্ভবত উত্তরের জমাট ঠাণ্ডা হাওয়াই এর কারণ হবে। পরিবেশের মতই মনের মাঝে কেমন একটা বিষন্নতা ভর করল। চারিদিকে পত্রহীন গাছের সারি আর নিচের কালচে মাটিতে জমে থাকা শুকনো পাতার স্তূপ যেন সতর্কবাণীর মত পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে, বলছে ফিরে যাও। কিন্তু এসবের কিছুই আমাকে দমাতে পারল না। আসলে এইসবের জন্যই তো এখানে আসা। বাড়ির সদর দরজায় আসতে বুড়ো মতো চাকর গোছের একজন লোক আমাকে দেখে এগিয়ে এল। বুঝলাম ইনিই রমেশ কাকা, এর কথাই আমাকে সমর বলেছিল। রমেশ কাকা সমরদের পুরোনো চাকর, ওদের অবর্তমানে উনিই এখন বাড়িটার দেখাশোনা করেন, পাহারা দেন। আমি যে আসব সেটা সমর ওনাকে আগেই জানিয়ে রেখেছিল, তাই কোন সমস্যা হল না। আমার থাকার জায়গা হল দোতলার পূর্ব পাশে একটা ঘরে।

সম্ভবত যাত্রাপথের ধকল আর শীতল পরিবেশের কারণেই ঘরে বিছানায় শুয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। ঘুম ভাঙতে দেখলাম প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রমেশ কাকা ফ্লাক্স ভর্তি গরম চা দিয়ে গিয়েছিল, সেই চা খেয়ে একা একাই বাড়িটার যতটুকু সম্ভব ঘুরে দেখলাম। সমরের কাছে ওদের পরিবার আর এই বাড়ির অনেক বিচিত্র ইতিহাস শুনেছি। বেশ কয়েক পুরুষ আগে গোড়াপত্তন হয় ওদের এই জমিদার বাড়ির। ওর পুর্ব পুরুষের অনেকেই জমিদারির পাশাপাশি গান বাজনা, শিল্প সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী ছিলেন শুনেছি। এমনকি ওর এক পিতামহ নাকি তন্ত্র সাধনাও করেছেন এই বাড়িতে।

এখন অবশ্য এই বাড়ি দেখে এর ঝলমলে অতীতের কথা মনে আসে না। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেক জায়গায় চুন সুরকি খসে পড়েছে, দেয়াল বেয়ে নেমে এসেছে বড় বড় কাল অন্ধকার ফাটল, কাঠের দরজা জনালাগুলো ঢাকা পড়েছে ফ্যাকাশে ধূসর শ্যাওলার নিচে, জানালার কার্নিশে শিকড় গেড়েছে বট পাকুরের দল। সন্ধ্যা হতেই কেমন একটা সাদা কুয়াশার চাঁদরে যেন পুরো বাড়িটা ঢাকা পড়ে গেল।

নতুন কোন জায়গায় গেলে এমনিতেই আমার ঘুমের সমস্যা হয়, অতিরিক্ত হিসাবে সারারাত কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস ঝাপ্টা মেরে গেল জানালার কপাটে। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতেই কেটে গেল রাতের বেশির ভাগ সময়। সকালে ঘুম ভাঙল দেরিতে। চা নাস্তা শেষে বাড়ির ছাদটা একবার ঘুরে এলাম। ছাদটা অবশ্য বেশ ভালই লাগল। সকালের মিষ্টি রোদে দাঁড়িয়ে গতকালের সেই মনমরা বিষণ্ণ ভাবটা যেন একেবারেই কেটে গেল।

সমরের কাছে শুনেছিলাম তার সেই তান্ত্রিক পিতামহের কিছু পুঁথি আর তন্ত্র সাধনায় ব্যবহৃত মড়ার খুলি আর কিছু হাড়গোড় নাকি একটা ট্রাঙ্কে এখনও রাখা আছে। রমেশ কাকাকে ডেকে সেই ট্রাঙ্কের কথা জিজ্ঞেস করতে কাকা নিজেই খানিকপর ঘরে এসে সেটা দিয়ে গেল। সম্ভবত এটাও সমর আগেই বলে রেখেছিল। ট্রাঙ্কের ডালা খুলতে এই দুপুর বেলায়ও গা-টা কেমন ছমছম করে উঠল। এমন সত্যিকার তান্ত্রিকের ব্যবহার করা মড়ার খুলি হাড়গোড় দেখে গায়ে কাঁটা দেয়াটাই অবশ্য স্বাভাবিক।

ট্রাঙ্কের মাঝে আরও অনেক কিছুর সাথে পুরোনো হতে হতে হলদে হয়ে যাওয়া ভেড়ার চামড়ার উপর হাতে লেখা তিনখানা পুঁথিও পেলাম। হাতে নিয়ে দেখলাম সবকটা পুঁথিই সংস্কৃতে লেখা। অবশ্য আমার তাতে কোন সমস্যা হল না। সাহিত্যচর্চার প্রয়োজনে সংস্কৃত ভাষাটা অনেক আগেই শিখেছিলাম, এবারে সেটা কাজে লাগল। সবার প্রথমে সবচেয়ে হলুদ হয়ে যাওয়া পুঁথিটাই পড়ার জন্য বেছে নিলাম। পুঁথির বিষয় দেবতা পাঁতরের সাধনা। তন্ত্র মন্ত্রে কৌতুহল আমার চিরদিনের, তাই খুব আগ্রহ সহকারেই সেটাকে নিয়ে লেগে পড়লাম। পুঁথির একদম শুরুতেই দেবতা পাঁতরের পরিচয় আর বর্ণনা দেয়া। সেটা পড়ে জানলাম দেবতা পাঁতর থাকেন পাতালে। তার ভাল বা মন্দ দুই করার ক্ষমতাই অপরিসীম। পাঁতর যেমন দয়ালু তেমনই নিষ্ঠুর। মিশমিশে কাল রঙের শরীরে জোনাকি পোকার মত সহস্র চোখ আর বটের ঝুরির মত চুল দাঁড়িওয়ালা দেবতা পাঁতরের একটা হাতে আঁকা অস্পষ্ট ছবিও পুঁথিতে দেয়া আছে।

পুঁথির পরের অংশে পেলাম কীভাবে বিশেষ যজ্ঞের মাধ্যমে পশুবলি করে দেবতা পাঁতরের আহ্বান করতে হবে তার বর্ণনা। পাঁতর যেহেতু পাতালে থাকেন তাই তার আহ্বান যজ্ঞটা করতে হয় কোন গভীর কুয়োর পাড়ে, যজ্ঞ শেষে পশুবলি করে সেই পশুর মাথার আহুতি দিতে হয় কুয়োয়। পাঁতর খুশি হলে এরপর থেকে সেই কুয়োর মধ্য দিয়ে যোগাযোগ করা যায় তার সাথে। তবে পাঁতরকে আহ্বানের মন্ত্রটা পেলাম না, কারণ পুঁথির ঠিক এই অংশটা কেউ একজন ধারালো কিছু দিয়ে কেটে নিয়েছে।

অবশ্য অন্য আরেকটি মন্ত্র পুঁথিতে পেলাম। পুঁথি অনুসারে এটা পাঁতরকে আহুতি দেবার মন্ত্র। এই বিশেষ মন্ত্রটি পাঠ করে পাঁতরের কুয়োয় কোন বস্তু আহুতি দিলে পাঁতর সেই বস্তু দ্বিগুণ করে ফিরিয়ে দেন। মন্ত্রের শেষে অবশ্য সাবধান করা হয়েছে, যেন ভুলেও কোন জীবিত প্রাণী আহুতি দেয়া না হয়। কারণটাও পুঁথিতেই পেলাম, কোন ধরনের প্রাণকে দ্বিগুণ করার ক্ষমতা দেবতা পাঁতরের নেই। তাই জীবিত প্রাণী আহুতি দেবার অর্থ হল পাঁতরকে তার অক্ষমতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া। আর কেউ যদি এই কাজ যে করে, তবে পাঁতর তার উপর প্রতিশোধ নেবেই নেবে। আর প্রতিশোধ নেয়া শেষে সেই স্থান ছেড়ে চলে যাবে চিরকালের মত।

ভৌতিক আর রহস্য কাহিনীর লেখক হিসাবে নানান দেশের নানা রকমের দেবতা অপদেবতা তন্ত্র মন্ত্র নিয়ে আমার বেশ ভাল ধারণাই আছে বলতে হবে। কিন্তু আমিও এই দেবতা পাঁতরের নাম আগে কোনদিন শুনিনি। একে একে বাকি পুঁথিগুলোও পড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম, কে জানে আর কোন কোন দেবতার কথা লেখা আছে সেগুলোতে।

পাঁতরের পুঁথি আবিষ্কারের দিন তিনেক পর প্রথম ঘটনাটা ঘটল। কয়েকদিন অন্য পুঁথিগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত সেগুলোতে নতুন কিছু পাইনি। এমন নিরিবিলি স্যাঁতসেঁতে মনমরা পরিবেশে একদম একা একা থাকার ফলেই সম্ভবত বুকের মাঝে কেমন একটা দমবন্ধ ভাব অনুভব করছিলাম। তাই সেদিন দুপুরে খেয়েদেয়ে একটু ভাত ঘুম দিয়ে বিকালে বের হলাম বাড়ির চারপাশটা ঘুরে দেখতে। ঘুরতে ঘুরতে বাড়ির উত্তর দিকে মানে পিছনের দিকটায় এসে দেখি সেদিকটা পুরো ঝোপজঙ্গলে ঢাকা। ঘন ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে কিছু একটাকে ঘিরে রাখা পাথরের একটা দেয়ালের কিছুটা দেখা যাচ্ছিল। কাছে যেতে দেখলাম সেটা একটা পরিত্যক্ত কুয়ো। কাঁটা যুক্ত ডালপালা দিয়ে মুখটা ঢেকে রাখা, তাই ইচ্ছে থাকলেও উঁকি দিয়ে পানি আছে কিনা দেখতে পারলাম না। তবে কুয়োটা দেখে কেমন একটা অশুভ অনুভূতি হতে লাগল মনের ভিতর।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল, উত্তরের দিক থেকে আবার সেই কনেকনে বাতাস চলা শুরু হল, তাই ফিরে আসব এমন সময় দেবতা পাঁতরের পুঁথির কথাটা মনে পড়ল। কী যে হয়েছিল সেদিন কে জানে, অনেকটা কৌতুহলের বশেই পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করলাম। আহুতি মন্ত্রটা বেশ মনে ছিল। মনে মনে মন্ত্রটা পড়ে কয়েনটা ছুঁড়ে দিলাম কুয়োর ভিতর। তারপর আর না দাঁড়িয়ে সেখান থেকে চলে এলাম।

পরদিন সকাল বেলা উঠে জামা কাপড় পরে পকেটে হাত দিতেই চমকে গেলাম। হাতে করে বের করে দেখি দুটো পাঁচ টাকার কয়েন। অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে কাল পকেটের একমাত্র কয়েনটাই কুয়োতে ফেলেছিলাম। মনে বিভ্রান্তি বোধ হল, একবার মনে হল হয়ত কয়েন দুটো পকেটের কোন এক কোণে পড়েছিল, খেয়াল করিনি। চা নাস্তা খেয়ে এসে সেই পাঁতরের পুঁথিটা বের করে আবার মন দিয়ে পড়লাম। পুঁথিতে স্পষ্ট লিখেছে আগে পশুবলি করে পাঁতরের আহ্বান করতে হবে, তারপর পাঁতর তুষ্ট হলে তবেই বস্তু দ্বিগুণ করার ব্যাপারটা আসছে। সন্দেহ কিছুটা কাটল। পাঁতরের আহ্বান তো আর করিনি, সুতরাং বস্তু দ্বিগুণ হবার প্রশ্নই আসে না।

বিকেল হতে হতে কিন্তু মনের মাঝে সন্দেহটা আবার ফিরে আসল। ভেবে দেখলাম এমনও তো হতে পারে আমার আগে, হয়তো সমরের সেই তান্ত্রিক পিতামহের আমলে পাঁতরের আহ্বান করা হয়েছিল। সেই থেকে হয়ত পাঁতর ঐ কুয়োর মাঝে ঘাঁটি গেড়ে আছে। কুয়োর কাছে গেলেই যে অশুভ অনুভূতিটা হচ্ছে সেটাও ওই পাঁতরের প্রভাব হতে পারে। আমার ঘরের টেবিলের উপর একটা সুন্দর কাঁচের পেপার ওয়েট পড়ে ছিল। সেটাকে তুলে নিয়ে গেলাম কুয়োটার কাছে। গতদিনের মত সেই অশুভ অনুভূতিটা আজকেও হল। ইচ্ছে করতে লাগল কাঁটা সরিয়ে কুয়োর ভিতর উঁকি দিয়ে দেখতে। কিন্তু ইচ্ছেটা বাড়তে দিলাম না। মনে মনে মন্ত্রটা পড়ে পেপার ওয়েটটা ফেলে দিলাম কুয়োতে।

সেদিন রাতে ঘুম আর আসতেই চায় না, তাও শেষপর্যন্ত বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি। সকালে পুবের জানালার ফাঁকা দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভেঙে টেবিলের দিকে তাকাতেই কিন্তু চমকে গেলাম। এতটাই চমকে গেলাম যে অনড় অবস্থায় বিছানায় বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। টেবিলের উপর অবিকল একই রকম দেখতে দুটো পেপার ওয়েট।

এবারে আর মনে কোন সন্দেহ থাকল না। বিশ্বাস করি বা না করি, অদ্ভুত রহস্যময় কিছু একটা যে আমার সাথে ঘটছে আর তার সাথে যে দেবতা পাঁতর আর ঐ পরিত্যক্ত কুয়োটার যোগাযোগ আছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গেলাম। তবে এই রহস্যের যে এমন বিয়োগান্তক সমাপ্তি হবে সেটা তখনও ভাবতে পারিনি।

সেদিনের পর আরও দুদিন পাঁতরকে আহুতি দিলাম। একদিন দিলাম আমার লেখালেখির কলমটা আর একদিন দিলাম হাতের ঘড়িটা। যথারিতি রাতের পর সকাল বেলা দুটোই ফিরে ফেলাম দ্বিগুণ হয়ে। এবার আমার মনে খানিকটা লোভ জন্মাল। মনে হল যদি দামি কিছু আহুতি দেয়া যায়, তবে তো রাতারাতি বড়লোক হতে পারব। কে জানে, সমরদের এত এত টাকা পয়সা হয়ত এভাবেই হয়েছিল। নিজের মনকে বোঝালাম; ভাগ্যগুণে একবার যখন এমন সুযোগ পেয়েছি তখন সেটার সর্বোচ্চ ব্যবহার না করাটা বোকামিই হবে।

কাছে নগদ টাকা পয়সা বেশি ছিল না। আর তাছাড়া চিন্তা করে দেখলাম টাকা দ্বিগুণ হলে একটা অসুবিধা আছে। টাকার গায়ে নম্বর থাকে, একই নম্বরের একাধিক টাকা চালাতে গিয়ে ধরা পড়লে মানুষ জাল টাকার কারবারি ভেবে জেলে দেবে। ভিন্ন ভিন্ন অনেক দিক চিন্তা করে বুঝলাম সোনা আহুতি দেয়াটাই সবচেয়ে লাভজনক হবে।

কিন্তু সমস্যা হল আমার কাছে সোনার জিনিসও কিছুই নেই। হাতের আংটি বা গলার চেইন কিছুই না। ব্যাংকের লকারে আমার কিছু সোনা রাখা আছে বটে কিন্তু সেতো আর এখানে না। এই সমস্যার খুব সহজ সমাধান হল, দুপুরবেলা বাজারে গিয়ে পকেটের টাকা দিয়ে একটা চার আনির সোনার আংটি কিনে নিয়ে আসলাম। হিসাবমতে দুই দিন আহুতি দিলেই এই চার আনি থেকে এক ভরি হয়ে যাবে। এরপর আর দুদিন আহুতি দিলে হবে চার ভরি।

হিসাবটা বুঝতে পেরে মনে মনে ভীষণ উত্তেজিত অনুভব করলাম। তবে লোভটা যে কমিয়ে রাখতে হবে সেটা বুঝতে পারছিলাম। হুট করে বেশি বেশি অর্থ সম্পদের মালিক হলে মানুষের সন্দেহ হবে, পিছনে লাগবে। চিন্তা করে দেখলাম হয়ত এই কারণেই সমরের পুর্বপুরুষেরা জমিদার হয়েই ছিলেন, রাজা বাদশা নয়। সেদিনটা আকাশে মেঘ করেছিল। তাই সন্ধ্যা হতেই দেরি না করে চলে গেলাম কুয়োর কাছে। আজকে যেন সেই অশুভ ভাবটা অনেক বেশি মনে হল। তাড়াতাড়ি মন্ত্র পাঠ শেষ করে পকটে হাত দিয়ে সদ্য কিনে আনা আংটিটা বের করতে গিয়ে দেখি সেটা নেই। দুপুরে বালিশের নিচে আংটি রেখে ঘুমিয়েছিলাম, সেটা যে সেখানেই রয়ে গেছে সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। সাথে সাথেই নিজের ঘরে রওয়ানা দিলাম আংটি নিয়ে আসতে।

বাড়ির পিছন থেকে সামনে যখন এসেছি, দেখলাম রমেশ কাকা নেমে আসছেন দোতলা থেকে। কাকার হাতে একটা সরু লোহার খাঁচায় মধ্যে বিশাল এক ধেড়ে ইঁদুর। আমাকে দেখে বললেন ভাঁড়ার ঘরে ধরা পড়েছে, এখন ফেলে দিতে নিয়ে যাচ্ছেন। আচ্ছা বলে আমি নিজের ঘরে চলে গেলাম। সেখান থেকে আংটি নিয়ে আবার কুয়োর কাছে ফিরে আসতেই বুকটা ধ্বক করে উঠল। কুয়োর পাড়ে রমেশ কাকা দাঁড়িয়ে। প্রথমে ভাবলাম কাকা বুঝি কুয়ো আর আমার ব্যাপারটা জেনে ফেলেছেন। পরমুহূর্তেই খেয়াল করে দেখলাম তার হাতের খাঁচাটা ফাঁকা। বুঝলাম ধেড়ে ইঁদুরটাকে ফেলার জন্যই কাকা এখানে এসেছেন। কাকা চলে যেতে আংটিটা কুয়োয় ফেলে আমিও চলে আসলাম।

রুমে ফিরে আসার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হল। নিজের রুমে বসে চা খেতে খেতে আচমকা একটা চিন্তা মাথায় এল আর সাথে সাথে ভয়ের একটা শিহরণ বয়ে গেল মাথা থেকে পা অবধি। আচ্ছা কাকা কি জ্যান্ত ইদুরটা কুয়োতে ফেলেছেন? যদি তাই করেন তবে তো আমার সর্বনাশ নিশ্চিত। কারণ আমি মন্ত্র পড়ে আংটি নিতে যখন রুমে এসেছি, সেই মুহূর্তেই কাকা ইঁদুরটা কুয়োতে ফেলেছেন। সেই হিসাবে ইঁদুরটাই হবে পাঁতরের আহুতি। কী করা উচিৎ হবে বুঝতে পারছিলাম না। পুঁথিটা বের করে আবারও ভাল করে পড়লাম, ক্ষমা চাওয়ার কোন উপায় যদি থাকে সেই আশায়। কিন্তু চূড়ান্ত সর্বনাশের ভবিষ্যবাণী ছাড়া কিছুই পেলাম না।

রাত বাড়ল আর ধীরে ধীরে বাইরের ঝড় বৃষ্টি বেড়ে উঠল। তেমন ভয়ংকর রাত আমার জীবনে আর আসেনি, আসুক তাও আর চাই না। এতদিন পরেও বেশ মনে আছে সে রাতের কথা। বাইরে ঝড়ো হাওয়া যেন পাক খেয়ে খেয়ে আছড়ে পড়ছে জানালায়, দরজায়। বিদ্যুৎ চমকের সাদা আলো জানালার রঙিন শার্শিতে পড়ে রংধনুর রঙে ভাসিয়ে দিচ্ছে ঘরের দেয়াল। ঝড়ো বাতাসে জানালা দরজা কেঁপে ওঠে আর আমার মনে হয় এই বুঝি অশুভ কিছু ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার উপর। পুঁথিতে দেখা পাঁতরের সেই ছবিটা বারবার ভেসে উঠতে লাগল চোখের সামনে।

কিন্তু সবকিছুরই অবসান আছে, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে একসময় রাত শেষ হয়ে সকাল হয়ে এল। শুনেছি অতিরিক্ত আতঙ্কিত হলে নিজেকে রক্ষা করার জন্য মানুষের মস্তিষ্ক মানুষটাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। আমিও তীব্র আতঙ্ক আর ভয়ের মাঝে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তা টের পাইনি। ঘুম ভাঙতে বহাল তবিয়তে আছি দেখে কী যে খুশি লাগল। ঠিক করলাম এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত নয়। আজই ফিরে যাব। একবারে ব্যাগ গুছিয়ে রেখে নিচে নেমে রমেশ কাকাকে ডাকতে গিয়ে ব্যাপারটা প্রথম টের পেলাম।

রমেশ কাকার ঘরটা নিচতলার সদর দরজার একদম পাশে। এখানে আসা অব্দি দেখেছি প্রতিদিন সকালে আমার অনেক আগেই কাকা ঘুম থেকে উঠে পড়েন। আজকে যখন ডাকতে গেছি তখন প্রায় নয়টা বাজে। গিয়ে দেখি কাকার রুমের দরজা তখনও ভিতর থেকে বন্ধ। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি, দরজায় ধাক্কাধাক্কি করেও যখন তার কোন সাড়া পেলাম না, তখন বাড়ি থেকে বের হয়ে আশেপাশের কিছু লোকজন ডেকে আনলাম। কিছু একটা হয়েছে বুঝতে পেরে কীভাবে যেন আরও অনেক লোকজন জমায়েত হয়ে গেল, গ্রাম দেশে যেমন হয় আরকী।

লোকজনের মাঝে বয়স্ক মাতব্বর গোছের একজন লোকের নির্দেশে দরজা ভাঙ্গা হল। প্রথম যে ছেলেটা দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকল, সে প্রায় সাথে সাথেই চিৎকার করে টলতে টলতে বাইরে বেরিয়ে এল। এরপর আমরা যারা ভেতরে গেলাম সবারই কমবেশি একই প্রতিক্রিয়া হল। ঘরে ঢুকতে দেখলাম সবকিছু যেমন ছিল তেমনই আছে, শুধুমাত্র নিজের বিছনায় হাঁ করে মরে পড়ে আছেন রমেশ কাকা। তার মাথাটা ঘাড়ের উপর থেকে একদম উল্টো দিকে ঘোরানো। যেন কেউ প্রবল আক্রোশে এক হ্যাচকায় ঘাড়টা মুচড়ে দিয়েছে। মৃত্যুর আগে তীব্র আতঙ্কের ছাপ ছিসাবে কাকার চোখ জোড়া ঠিকরে বের হয়ে আছে। তারপর আর কী, বাতাসের বেগে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। লোকজন নিজের মত করে ঘটনার নানান রকম কার্যকারণ দাঁড় করাল। অপঘাতে মৃত্যুর জন্য একটা পুলিশি মামলা হয়েছিল বটে কিন্তু তার আর কোন সমাধান হয়নি।

সত্যিটা ঘটনাটা আমিও আর কাউকে বলিনি। আসলে বলেও কোন লাভ হত না। এই ঘটনার পর সমরদের ওই বাড়িতে আর যাইনি। কিন্তু সেদিন রমেশ কাকার ঘরে দেখা সেই বিভীষিকাময় ভয়ানক স্মৃতি এখনও তাড়িয়ে ফেরে। এখনও ঝড় বৃষ্টির রাতে আমার ঘুম আসে না। নিজের কল্পনায় দেখতে পাই কীভাবে রমেশ কাকার মাথাটা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছিল পাঁতর। চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাঁতরের বটের ঝুরির মত চুল দাঁড়ি আর কালো শরীর জুড়ে সহস্র চোখের সারি। মনে মনে ভাবি, এই অপরাধবোধ আর বিভীষিকা সাথে করেই হয়তো বাকি জীবন কাটাতে হবে।