ছায়াপথ - অভিষেক সেনগুপ্ত

ভৌতিক গল্প

(১)

পল্টু হ্যান্ডেলের বল বিয়ারিং চেক করে বলল, ‘নাহ্‌ দাদা, কোনও রকম গলদ তো খুঁজে পেলাম না। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?’

গতরাতের কথা মনে পড়লেই লাল পিঁপড়ের মতো একরাশ ভয় ছেঁকে ধরছে আমাকে। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এখনও টের পাচ্ছি আতঙ্কের গন্ধ।

পল্টুর কথায় চিন্তা হল। কোনও গোলমাল নেই তো ব্যাপারটা ঘটল কেন? যন্ত্র তো আর মানুষের শরীর নয় যে, কোনও রন্ধ্রে বা তন্তুতে সিঁধিয়ে থাকা সমস্যা মাথা না তুললে বোঝা যাবে না! অন্য একটা আশঙ্কাও কাজ করছে, আবার যদি এক কাণ্ড ঘটে?

পল্টুকে বললাম, ‘তুমি ঠিক করে চেক করেছো তো?’

পল্টু লালচে দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘দাদা, এই কাজই তো দিনরাত করছি। ভুল হবে না। এসব পেশেন্ট আমি ভালোই চিনি।’ পল্টু একটু থেমে বলল, ‘আচ্ছা দাঁড়ান। বলছেন যখন, একবার টেস্ট ড্রাইভ দিয়ে দেখছি। কোনও রোগ যদি থাকে, ঠিক ধরা পড়বে।’

কিক মেরে ও বাইকটা স্টার্ট করল। পুরোনো আমলের বুলেট। বিশাল ও ভারী চেহারা। কিন্তু ভীষণ মজবুত। এই গাড়ির বিকল্প হয় না। ডাবল স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকলেও ডিক... ডিক আওয়াজ তুলে গাড়িটা দুলছে। সাইলেন্সর পাইপ দিয়ে ইষৎ কালচে ধোঁয়া বের হচ্ছে। পুরোনো গাড়িতে ছুটকোছাটকা সমস্যা থাকেই। কিন্তু যেটা আমার সঙ্গে ঘটেছে, সেটা ক্রনিক প্রবলেম না থাকলে হয় না। পল্টু সিটে চেপে বসে বাঁ পায়ের চাপে ফার্স্ট গিয়ারটা তুলতেই গদাইলস্করি চালে চলতে শুরু করল বুলেটটা। রাজার গাড়ি, দেখলেই বোঝা যায়। সেলফটা নেই, এই যা। নরম হাতে এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল পল্টু।

সাতদিন হল এই পুরোনো বাইকটা কিনেছি। আমার অনেকদিনের শখ, এই রকম একটা বাইক চালাব। কলকাতা শহরে আজকাল বাইক চালানোই দুষ্কর। একহাত অন্তর অন্তর সিগনাল, রাস্তার ভিড়, বাস-ট্যাক্সি-প্রাইভেট কারের ক্যাঁচরম্যাচর। কিন্তু শখের সঙ্গে আপস করার বান্দা আমি নই। গড়িয়ায় আমাদের পাড়ার পিছনের কলোনিতে অনন্তবাবু নামে একজন ভাড়া থাকেন। ওঁর বাড়ির সামনের একফালি বাগানে বুলেটটা পড়েছিল। আমি বাজার যাওয়ার পথে ক’দিন ধরেই জিনিসটা দেখছিলাম। পুরোনো ইচ্ছেটা আমাকে ঠেলে পাঠিয়েছিল অনন্তবাবুর কাছে। উনি ইতঃস্তত করেছিলেন, গাড়িটা কিনতে চাই শুনে। এক সময়ের সঙ্গী তো, কাছছাড়া করতে চাইছিলেন না হয়তো। তা ছাড়া, পুরোনো জিনিস। ঠিকঠাক কতটা আছে, তা নিয়েও কিছুটা চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু আমি ঝুলে পড়েছিলাম। শেষমেষ বাধ্য হয়েই নামমাত্র টাকায় বাইকটা আমাকে বিক্রি করেছেন। একসময় সবুজ রং ছিল ওটার। জ্বলে গিয়ে মরা ঘাসের মতো হলদে দেখাত। কিন্তু সাড়ে তিনশো সিসির বাইক হঠাৎ পাওয়া কি মুখের কথা? তার ওপর জার্মান ইঞ্জিন। জবরদস্ত চিজ। একেবারে ভিন্টেজ জিনিস।

আমি কর্পোরেশনের ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টে চাকরি করি। গড়িয়া থেকে ধর্মতলায় অফিস যাতায়াতের জন্য এর থেকে ভালো বাহন হয় না। বুলেটটা কিনেই পুরোনো চেহারা ফেরাতে পাড়ার এক চেনা মিস্ত্রির হাতে সঁপে দিয়েছিলাম। সে দেখে আপ্লুত, ‘দাদা মাইরি বলছি, এ জিনিস আজকাল দেখা যায় না! কোত্থেকে জোটালেন বলুন তো?’ আমি ভ্রু পর্যন্ত তৃপ্তির দাঁত দেখিয়েছিলাম ওকে।

গত তিনদিন হল, অসংখ্য কৌতুহলী চোখের সামনে বাইকের ধুলো উড়িয়ে অফিস যাচ্ছি। সুন্দরী বউকে নিয়ে অনুষ্ঠানে গেলে যেমন আত্মীয়দের চোখ থেকে হতাশা গড়িয়ে পড়ে, আমার বাইক দেখে তেমন হচ্ছে। বন্ধুদের হিংসের পাহাড় বাঁকে মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত আমাকে অনুসরণ করে, বেশ বুঝতে পারি। কিন্তু গর্বের বেলুনটা যে এইভাবে চুপসে যাবে, বুঝতে পারিনি। গতরাতে আর একটু হলেই আমি শেষ হয়ে যেতাম। বাইকটা নিয়ে এই সকালে পল্টুর গ্যারাজে আসার বদলে কোনও মর্গে হয়তো ঘুমিয়ে থাকতে হত!

ইয়ার এন্ডিংয়ের সময় ট্যাক্স ডিপার্টমেন্টের ঝামেলা বেশি। অফিস থেকে বেরোতে দেরি হয়। কাল রাতে হাতের কাজ মেটাতে মেটাতে দশটা হয়েছিল। অন্যরা বাড়ির ফেরার জন্য উদ্বিগ্ন হলেও আমি জানি, কর্পোরেশনের পার্কিং লটে আমার বাহন অপেক্ষা করছে। কাজ সেরে পার্কিং লটে এসে বুলেটটার মাথায় আদুরে চাপড় মেরে স্টার্ট দিলাম। নিউ মার্কেট ফাঁকা। ডিক... ডিক আওয়াজ তুলে রওনা দিলাম বাড়ির দিকে।

রাতের কলকাতা জ্যামমুক্ত। পার্ক স্ট্রিট ভেঙে ক্যামাক স্ট্রিট ধরে ছিলাম। এলগিন রোডে গোঁত্তা খেয়ে শরৎ বোস রোড ধরে লেক ক্রসিংয়ে চলে এলাম দিব্যি। লেকের ব্রিজ ক্রস করে লর্ডসের মোড় থেকে গল্ফ গ্রিনে ঢুকব। রাত দশটার পর কলকাতার রাস্তায় লরি চলাচল শুরু হয়। লেকের ব্রিজ উঠতেই দেখলাম, উল্টো দিকের রাস্তা ধরে একটা লরি আসছে। মন্থর গতি। খুব একটা আমল দিইনি। রাস্তা ফাঁকা। আমি ডাউনে আছি। লরিটা আপে। এত ভাবারও কিছু নেই। ধীরেসুস্থেই চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হল, লরিটা যেন স্পিড বাড়িয়েছে। দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। লালচে পলিথিন ডিভাইডার আছে। দূর থেকে ওগুলোর সাদা ফ্লোরেশন কালার দেখা যায়। ফলে আমার দিকের রাস্তায় লরিটার উঠে পড়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু কয়েক মিটার এগোতেই দেখলাম, লরিটা একটু বেশিই যেন ডানদিক ঘেঁষে চলছে। বাঁদিকে সরে যাব। ভেবে, বুলেটটা কাত করতেই বুঝলাম, হ্যান্ডেলটা স্টিফ হয়ে গেছে। আমি চাইলেও বাঁ দিকে সরতে পারছি না। বুলেটটার ঝোঁকও যেন কিছুটা ডানদিকেই। লরিটা গোঁগোঁ করে তেড়ে আসছে। ভাবলাম ব্রেক মেরে দাঁড়িয়ে যাব। ডান পা-টা মারতেই বুঝতে পারলাম, ব্রেক বলে কোনও বস্তুই নেই! পা পিছলে যাচ্ছে। কিন্তু ব্রেক ধরছে না। এক অজানা আতঙ্ক চেপে ধরল। ডানহাতের ব্রেক মারতেই পারি। সেটা আত্মহত্যার সামিল হবে। ছিটকে পড়ব চলন্ত বাইক থেকে। ডানদিকে যদি পড়ি, লরিটা আমার ওপর দিয়ে নির্বিবাদে চলে যাবে। আর একবার প্রাণপণে ডান পায়ের ওপর পুরো শরীরের ভর দিয়ে পিছনের ব্রেকটা মারার চেষ্টা করলাম। অবাক হয়ে দেখলাম, বুলেটটা আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। ওটা নিজের খেয়ালে চলছে! লরিটার গোঁগোঁ আওয়াজটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো তেড়ে আসছে ওটা। হেডলাইটের গনগনে আলো নিয়ে ওটা এগিয়ে আসছে মৃত্যুদূতের মতো। বুঝতে পারছি, আমার কিছু করার নেই। স্রেফ কিছু সেকেন্ড আছে হাতে। তারপর লরির কোনও একটা চাকায় আমার হৃদপিণ্ড থেঁতলে যাবে। কী করব, বুঝতে পারছি না। মাথাও কাজ করছে না। কোনও কিছু না ভেবে, ডানহাতের ব্রেকটাই সজোরে মারলাম। কিন্তু একী, সামনের ব্রেকটাও রেসপন্স করছে না। একটু আগেও ওটা দিব্যি ছিল। এখন কী হল? আতঙ্কে চোখ বুজে ফেললাম। থরথর করে কাঁপছে আমার শরীর। হাতের রোম বাড়ির পাঁচিলে লাগানো পেরেকের মতো উঠে দাঁড়িয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত। ওই প্রবল মৃত্যু ভয়ই বাঁচিয়েছে আমাকে। কোনও উপায় না দেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম বাঁ দিকের রাস্তায়। পেছন থেকে একটা প্রাইভেট কার আসছিল। কালো অ্যাম্বাসাডার। ওটার মরিয়া ব্রেক মারার ক্যাঁঞঞঞঞচ্‌ আওয়াজটাই শুধু শুনতে পেয়েছিলাম। লরিটা হইহই করে পেরিয়ে গেল সামান্য দূর দিয়ে। না হলে মৃত্যু এতক্ষণে তছনছ করে ফেলত আমাকে। বুলেট থেকে সজোরে লাফিয়ে পড়ার জন্য, পিচ রাস্তার কামড়ে আমার বাঁ দিক ছিঁড়েখুড়ে একাকার। অ্যাম্বাসাডারের ড্রাইভার আমাকে তুলল। তখনও আমি কাঁপছি। হাড়গোড় ভাঙেনি। তবে বাঁ হাঁটু আর কনুইয়ে প্রবল চোট পেয়েছি। হেলমেটটা খুলে দেখলাম, ওটা আড়াআড়ি ফেটে গেছে। হেলমেট না থাকলে মাথা ফেটে ঘিলু বেরিয়ে যেত। ড্রাইভার ভদ্রলোকই জলটল দিলেন। কিছুটা ধাতস্ত হলাম।

বুলেটটা রাস্তার একপাশে কাত হয়ে পড়েছিল। আমি বাইক থেকে যখন লাফিয়ে পড়েছিলাম, তখন লরিটার থেকে মিটারখানেক দূরত্ব হবে আমার। লরির তলায় বাইকটার চাপা পড়ার কথা। কিন্তু ওটা অক্ষত! এমনকি, স্টার্টও বন্ধ হয়নি। তা হওয়ার কথা নয়। থার্ড গিয়ারে ছিল গাড়িটা। নিউট্রাল তো করিনি। আমি একটু খুঁড়িয়ে গিয়ে বাইকটাকে তোলার চেষ্টা করলাম। ভারী গাড়ি। সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনায় আমার শরীর কাঁপছে। সমস্ত স্নায়ু বিহ্বল হয়ে পড়েছে। ভারসাম্যও যে কারণে হারিয়ে ফেলেছি কিছুটা। ড্রাইভারসাহেব আমাকে সাহায্য করলেন। সাইড স্ট্যান্ডে বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে দেখলাম, রাস্তায় ছেঁচড়ে পড়া সত্ত্বেও বিপুল চেহারার বুলেটের গায়ে একটিও আঁচড় লাগেনি। অ্যাম্বাসাডারের ড্রাইভার আমাকে জিজ্ঞেস করল, যেতে পারব কিনা। আমি একটু হেঁটে-চলে, ফিটনেস টেস্টের মতো কাঁধ-কবজি-হাঁটু সহ শরীরের যাবতীয় মালপত্র চেক করে বললাম, পারব।

ধীরে ধীরে বাইক চালিয়ে গতকাল রাতে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। সোনালিকে পুরো ব্যাপারটা চেপে গিয়েছি। আমি বুলেটটা কিনি, ও চায়নি। অ্যাক্সিডেন্ট করেছি জানলে, চালানোই বন্ধ হয়ে যাবে। যন্ত্রের দোষ কী! যে কোনও সময় বিগড়োতে পারে। কিন্তু সোনালিকে বোঝানো মুশকিল। সকাল হতেই পাড়ার মেকানিকের ওপর আর ভরসা না রেখে রাসবিহারীতে পল্টুর কাছে ছুটে এসেছি। জটিল রোগ মনে হচ্ছে। একজন ভালো ডাক্তারের পরামর্শ দরকার।

পল্টু হাসিমুখে বুলেটটা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘নাহ্‌ দাদা, কোনও সমস্যা নেই। আপনি অকারণেই ভয় পাচ্ছেন।’

(২)

বাগানঘেরা যে দোতলা বাড়ির নীচেতলায় অনন্তবাবু ভাড়া থাকেন, তার দরজায় তালা দেওয়া। একা মানুষ বলে শুনেছি। কোথাও বেড়াতে গেছেন হয়তো। দোতলা থেকে এক বয়ষ্ক মহিলা মুখ বাড়িয়ে জানতে চাইলেন, কাকে খুঁজছি। অনন্তবাবুর কথা বললাম। উনি জানালেন, অনন্তবাবু বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। কোথায় গেছেন, জানেন না। অবাক হলাম। অনন্তবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। বুলেটটা কেনার সূত্রে আলাপ। কেনার পর একবার এসেছিলাম ওঁকে বাইকটার নতুন চেহারা দেখাতে। কিন্তু দশদিনের মধ্যে তিনি বাড়ি পাল্টে ফেলবেন, জানা ছিল না। ওই রাতের ঘটনাটার পর খচখচ করছিল মনটা। তার মধ্যে গতকাল আর একটা ঘটনাটা ঘটেছে। গুরুতর না হলেও এড়িয়ে যেতে পারছি না।

সপ্তাহ দুয়েক পর পয়লা বৈশাখ। ছেলেমেয়ের জন্য নতুন জামাকাপড় কিনে কর্পোরেশনের পার্কিং লটে এসে দেখলাম, গাড়িটার গায়ে একরাশ ধুলো। ওটা কেনার পর সাদা রং করিয়েছি। গ্ল্যামার বেশ খুলেছে। সেই সাদা রং ধূসর করে ওটার গায়ে কেউ মুঠো মুঠো ধুলো লেপে দিয়ে গেছে! শখের জিনিস। মনটা হুহু করে উঠল। কর্পোরেশনের কর্মী ছাড়া এই জায়গাটায় কেউ গাড়ি রাখে না। এই পার্কিং লটের চার্জে থাকে যে সিকিউরিটি, তার সঙ্গে কথা বললাম। সে বলল, দেখেনি।

পুরো চত্ত্বর জুড়ে সবসময় লোকে লোকারন্য থাকে। তাই পার্কিং লটে সিকিউরিটি রাখা হয়েছে। আর পার্কিংয়ে ঢুকতে হলে সিকিউরিটির গেট সামনে দিয়েই যেতে হবে। অন্য কোনও রাস্তা নেই। তা হলে কেউ গাড়ি রাখতে এসে এই কাণ্ড করেছে? হাবাগোবা সিকিউরিটি গার্ডটা একটা কাপড় জোগার করে গাড়িটা মুছে দিল।

কাজ শেষ করে মাথা চুলকে সে বলল, ‘স্যর আমার কোনও দোষ নেই। কাউকে ঢুকতে দিই না এখানে।’

আমি কথা বাড়ালাম না। বললাম, ‘ঠিক আছে। নজর রেখো। এরকম যেন না হয় আর।’

আজ সকালে আবার এক ঘটনা। এবার আমার বাড়ির গ্যারাজেই। সকালে অফিস যাওয়ার জন্য স্নান-খাওয়ার আগে বুলেটটা মুছি। গতকাল ধুলো মেখে পড়েছিল। ঠিক করেছিলাম, আজ গাড়িটা ধোব। গ্যারাজ খুলে বাইকটা বের করতে গিয়ে অবাক হলাম। সিট কভার, অয়েল ট্যাঙ্কে মুঠো মুঠো ধুলো। যেন কেউ রসিকতা করছে! গতকাল কর্পোরেশনের পার্কিং লটে যা ঘটেছে, একটা যুক্তি ছিল। কিন্তু এখন? কাল সিকিউরিটি গার্ডটাকে ধমকেছিলাম। আজ কাকে বকাবকি করব? দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে পলির বয়স চার, চিন্টুর এক। ওদের কারও পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। সোনালিও করবে না। বাইরের কেউ? গ্যারাজে বুলেটটা ঢুকিয়ে তালা মেরে দিই রোজ। গতকাল রাতেও তাই করেছি। তা হলে? বাঁদিকে মাথা হেলিয়ে জোড়া পায়ে দাঁড়ানো বাইকটাকে দেখতে দেখতে অনন্তবাবুর কথা মনে পড়েছিল। ভদ্রলোকের সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার।

(৩)

আমাকে দেখে সন্দীপ ভ্রুটা এমন নাচাল, যেন গোপন কিছু জানতে পেরেছে! সব অফিসেই বন্ধুদের একটা সার্কেল থাকে। আমারও আছে। যে জনাচারেক অফিস কলিগের সঙ্গে মাখামাখি, সন্দীপ তাদের একজন। ওর আবার কী হল! এখন রাজ্যের কাজ। অফিসে সারাক্ষণ ফাইল চাপা পড়ে থাকি। একটা শেষ করতে না করতে আর একটা জুটে যায়। সন্দীপের সঙ্গে ব্রেকে কথা বলব। নিজের টেবলের দিকে হাঁটা লাগালাম। আজ আবার সৌরভের বিয়ে। ছেলেটা নতুন জয়েন করেছে। নেমন্ত্রণ রয়েছে আমাদের সবার। সন্ধের মধ্যে বেরিয়ে যাব। সেই বারাসাত যেতে হবে। আমি বাইক নিয়েই যাব। কতটুকু আর পথ।

সৌরভের রিসেপশনে জব্বর খাওয়াদাওয়া হল। আজকাল বিয়ে বাড়িতে মাটনের রেওয়াজটা ফিরেছে। মাটন বিরিয়ানি আর চিকেন চাঁপ খেয়ে পেট আইঢাই। এগারোটা নাগাদ সৌরভের বাড়ি থেকে বেরোলাম। এয়ারপোর্ট হয়ে বাইপাস ধরে নিলে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাব। রাস্তা এই সময় ফাঁকা থাকে। হাওয়া খেতে খেতে রওনা দিলাম। গাড়িটা নিয়ে আর কোনও অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেনি। তবে ইদানীং বেশি চালাচ্ছি না। আজ সৌরভের বিয়ে অ্যাটেন্ড করে বারাসাত থেকে রাতবিরেতে কী ভাবে ফিরব ভেবে বুলেটটা নিয়ে এসেছি। এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে কিছুটা এগোনোর পর সন্দীপের কথা মনে পড়ল।

একসঙ্গে খেতে বসেছিলাম দু’জন। সন্দীপ ঠেলা মেরে বলল, ‘কী রে পরশু রাতে কার সঙ্গে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলি?’

সন্দীপ মজা করছে ভেবে হাসিমুখে তাকালাম ওর দিকে। সন্দীপের বাড়ি পার্ক সার্কাসে। ও গতকাল গড়িয়া গেছিল। পার্ক সার্কাসের বাস ধরার জন্য রাত দশটা নাগাদ গড়িয়া মোড়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন আমাকে দেখেছে। আমি নাকি এক মহিলাকে বাইকের পিছনে চাপিয়ে কোথাও একটা যাচ্ছিলাম। দ্রুত বেরিয়ে গেছিলাম বলে ও ডাকার সুযোগ পায়নি। কাল অফিস থেকে ফিরে কুঁদঘাটে একবন্ধুর বাড়ি গেছিলাম। অ্যানিভার্সারির নিমন্ত্রণে। সোনালি দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বাপেরবাড়ি গেছে। তাই একাই গেছিলাম। সন্দীপ হয়তো ওখান থেকে ফেরার সময় দেখেছে। কিন্তু বাইকের পিছনে কোন মহিলাকে দেখল? কেউ তো ছিল না!

আমি হাসতে হাসতে ওকে বললাম, ‘তুই তোর চোখটা দেখা। সঙ্গে মাথাটাও। কী দেখতে কী দেখেছিস!’

সন্দীপ সিরিয়াস গলায় বলল, ‘বিশ্বাস কর অরূপ, আমি মিথ্যে বলছি না। তুই চলে যাওয়ার পর ভাবলাম, তোর পরিচিত কেউ হবে। ভুলও দেখিনি। ওটা তুই-ই ছিলিস। মোবাইল চার্জ আউট হয়ে গেছিল বলে তোকে আর ফোন করতে পারিনি।’

গাড়ি চালাতে চালাতে সন্দীপের কথা মনে পড়তে হেসে উঠলাম। পাগল! সোনালি কাল ফিরবে বাপেরবাড়ি থেকে। ওর ভাইয়ের বিয়ে সামনে। শেষ পর্বের শপিং দিদি নিজে হাতে সারছে। এখন সাড়ে এগারোটা বাজছে। রাস্তা অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি ফাঁকা। আমি ধীরে বাইক চালাচ্ছি। তাড়াহুড়ো নেই। গিয়ে শুয়ে পড়ব। কাল রবিবার। ফলে সকালে ওঠার তাড়াও নেই।

এয়ারপোর্ট থেকে উল্টোডাঙ্গার রাস্তাটা ঝাঁচকচকে। বাঁদিকে খালের ধারে মর্নিং ওয়াকারদের জন্য পার্ক হয়েছে। ডান হাতে লন্ডনের বিগ বেনের আদলে স্মল বেন। রাস্তার আলোগুলো শুধু জ্বলছে না। তাতে অবশ্য সমস্যা হচ্ছে না। কারণ, মাথার ওপর একথালা চাঁদ উঠেছে। আর একটু এগোলেই একটা ব্রিজ পার করে বাইপাসে পড়ব। এই জায়গাটায় রাস্তা সারাইয়ের কাজ চলছে। তিন-চারটে রোডরোলার দাঁড় করানো। তবে লোকজন নেই। বাঁ দিকের লেনটা ধরে বাইক চালাচ্ছি। চাঁদের তীর্যক আলোয় গাড়ির ছায়া দেখতে পাচ্ছি। আমাকে পিঠে নিয়ে মসৃণ চলেছে একটা ছায়া। কিন্তু আমার চেহারাটা বেঢপ লাগছে। একটা বাইক আর তার চালকের মতো নয়। বরং ছায়াটা যেন একটু বেশিই চওড়া, ছড়ানো। যেন পিছনে কেউ বসে রয়েছে। চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম। কই, কেউ নেই তো!

আমি হেসে ফেললাম। সন্দীপের কথাগুলো নিশ্চয় মাথায় ঘুরছিল। মনোবিদরা বলেন, মানুষ যা ভাবে গভীরভাবে, তাই অনেক সময় চোখের সামনে দেখে সে। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।

উল্টোডাঙ্গার বাইপাস কানেকটিং ব্রিজে উঠে পড়েছি এখন। পাওয়ার ফল্ট হয়েছে মনে হয় এলাকাটা জুড়ে। ব্রিজে আলো জ্বলছে না। এখান থেকে পূর্ব কলকাতাটাকে পুরোপুরি দেখা যায়। বাঁদিকে সল্টলেক। ডানদিকে উল্টোডাঙ্গা, কাঁকুরগাছি। আলোরমালা ভাসে চোখের সামনে। এখন সে সব দেখা যাচ্ছে না। উল্টোডাঙা গভর্মেন্ট হাউজিংটাকে ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। ফুরফুরে হাওয়ায় ভর করে উড়ে চলেছি। ব্রিজের মাঝামাঝি আসতে আবার পিছন থেকে এসে পড়ল চাঁদের আলো। সেই আগের মতো ব্রিজের রেলিংয়ে বাইকের ছায়াটা দেখতে পেলাম। এবারও ছায়াটা একটু বেশিই চওড়া যেন। তবে আগের মতো ছড়ানো নয়। অনেক ঘনিষ্ঠ। আমার গায়েগায়ে লেপ্টে চলেছে আরও একটা অবয়ব। মেয়েলি আকৃতির একটা ছায়া! মুখের অবয়ব পর্যন্ত স্পষ্ট। ছায়াটার একরাশ খোলা চুল উড়ছে হাওয়ায়। তার মুখ যেন ঠিক আমার মুখের পাশেই রেখেছে। ভালো করে ছায়ার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কেউ আমাকে জাপ্টে ধরে বসেছে বাইকের পিছনের সিটে। তার একটা আমার বুকের ওপর। আর একটা হাত কাঁধে। দুটো ছায়াকে বয়ে নিয়ে এগিয়ে চলেছে বুলেটটা। চমকে পিছন ফিরে দেখলাম, কেউ নেই। তাহলে এই যে ছায়াটা দেখতে পাচ্ছি, এটা কার? মুহূর্তে অনুভব করলাম, ছায়াটাকে এখন অনুভব করতে পারছি। বাইকে আমি সত্যিই একা নই। পিছনের সিটে আর একজন আছে! তার তপ্ত নিঃশ্বাস, শরীরের মৃদু কম্পন অনুভব করছি। নরম একজোড়া স্তন আমার পিঠে লেপ্টে রয়েছে। আমার বুকের ওপর রাখা তার হাতের ছোঁয়া পাচ্ছি। পাঁচ আঙুলের নড়াচড়ার স্পর্শ পাচ্ছি। তার এলোমেলো চুল এসে পড়ছে আমার মুখে।

আমার হাতটা কেঁপে উঠল। ব্রিজের ঢালে গাড়ি নামছে। প্রাণপণে লেগব্রেক মারলাম। আতঙ্কের তীব্রতায় আমার ডান পা হড়কে গেল। আর তখনই বুঝতে পারলাম, ব্রেকটা কাজ করেছে না। সেই রাতের মতো। অসহায়তা আর আতঙ্ক মিশে গেলে মানুষ ভারসাম্য হারায়। ব্রেকটা ফেল করা মাত্র আমারও তাই হল। আমার শরীরের প্রতিটা সেন্সর বলছে, পেছনে বসে থাকা মহিলা ক্রমশ নিবিঢ় হয়ে আসছে। মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করলাম। গাড়িটা যে ভাবে হোক থামানো দরকার। এক্সেলটর কমানোর চেষ্টা করলাম। চেষ্টা করলাম ফোর্থ থেকে গিয়ার ডাউন করে নিউট্রাল করার। কিন্তু গাড়িটা বিকল হয়ে গেছে। সামনে-পেছনের ব্রেক মারছি বারবার। তবুও গাড়িটা ছুটে চলেছে। নিজের খেয়াল মতো!

আমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে বাইকের অয়েল ট্যাঙ্কিতে উঠে এগোনোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু মেয়েলি ছায়াটার সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে পারছি না। ওটা এই মুহূর্তে আমার শরীরের অংশ হয়ে গেছে। চেষ্টা করেও তাকে ছাড়াতে পারছি না। পোশাকের মতো সেঁটে রয়েছে গায়ের সঙ্গে। তার বাঁ হাত ক্রমশ চেপে বসছে আমার কাঁধে। বুকের ওপর রাখা তার পাঁচটা আঙুল আরও জোরে আঁকড়ে ধরছে। চামড়ার ভেদ করে সরুসরু আঙুলগুলো যেন ঢুকে যেতে চাইছে আমার ফুসফুসে। দমবন্ধ হয়ে আসছে। গাড়ির গতি ক্রমশ বাড়ছে। চোখে-মুখে ছিটকে এসে লাগছে রাতের কলকাতার ঠান্ডা ফ্রেশ হাওয়া। তবু নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

বাইকটা এখন নিজের মতো চলছে। আমি জানি ওটার পিঠে বসে থাকাই আমার একমাত্র কাজ। হ্যান্ডেল ছেড়ে দু’হাত দিয়ে শক্ত করে ধরলাম মেয়েটার দুটো হাত। গায়ের সমস্ত শক্তি জড়ো করে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম নিজেকে। নড়াতে পারলাম না। নড়ানো যাচ্ছে না। আবার চেষ্টা করতে একটা সুর মতো শুনতে পেলাম। পিছন থেকে ভেসে মেয়েলি কণ্ঠের গান, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়…’

আমার কানের দু’পাশ দিয়ে শনশন উড়ছে হাওয়া। তার তোড়ে গানের শব্দ ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে শুধু সুরটুকু। নেশা ধরানো সুর। এইরকম সুর আমি আগে কখনও শুনিনি। যেন একটা মোহ। এই গান, এই সুর কি আমার চেনা? যে কণ্ঠস্বর আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে কান, হৃদয়, শরীর— সেই মিষ্টি গলার গান কি আগেও শুনেছি?

সে গাইছে, ‘…তবে কেমন হত তুমি বলো তো?’ ‘অর্জুন… তুমিই বলো?’

বুলেটটা এখন বাইপাসের রেলিংয়ের গা দিয়ে রূদ্ধশ্বাসে দৌড়চ্ছে। বিপজ্জনকভাবে কাঁপছে গাড়িটা। সত্তরেরও বেশি স্পিড। আমি শিউরে উঠলাম। হ্যান্ডল দুটো প্রাণপণে চেপে ধরার চেষ্টা করলাম। তবু, কানে এসে ঝাপটা মারল নামটা। আমি চমকে গেলাম। এই নাম তো কারও জানার কথা নয়! আমার অনেক অনেক পিছনে পড়ে রয়েছে এই নাম। যে নাম আমি নিজেই ভুলে গেছি, সেই নাম ধরে ডাকছে একটা ছায়ামূর্তি? এ কে!

‘ক্‌কে তুমিইইই?’ প্রচণ্ড ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলাম।

‘অর্জুন, লং ড্রাইভে এসে কী ভালো লাগছে তাই না?’ বলেই আবার গান গাইতে শুরু করল ছায়ামূর্তি। সেই মিষ্টি সুরের আবেশে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে আমার ভাবনা। আমার বোধ, বুদ্ধি। খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছি আমি।

আমার মাথার ওপর একথালা চাঁদটা যেন আরও খানিকটা নেমে এসেছে। পূর্ণিমার চাঁদ ধুয়ে দিচ্ছে সারা পৃথিবী। একফালি রাস্তা ধরে চলছে বাইকটা। ডিগডিগ আওয়াজ তুলে। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এক অজানা দুনিয়া। কিন্তু চেনা লাগছে। বহুদিন আগে যেন দেখেছি। ডানদিকে বয়ে যাচ্ছে দামোদর। নদীর কালচে জল ছলাৎ ছলাৎ করে ঝাপটা মারছে বোল্ডারে। এখন বর্ষা নয়। তবু দামোদর ফুলফেঁপে উঠেছে। বিধ্বংসী রূপ। ড্যাম থেকে কি সন্ধেয় জল ছাড়া হয়েছে? বাঁধ ধরে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। আর আমার পিছনে বসে রয়েছে ঐন্দ্রিলা।

দুটো হাতে ও আমাকে জড়িয়ে ধরেছে পেছন থেকে। ওর হাতের সোনালি ব্রেস্টলেটটা চাঁদের আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে। ডান হাতটা খেলা করছে আমার বুকের ওপর। সরুসরু আঙুলগুলো খামচে ধরছে আমার টি-শার্ট। তপ্ত নখ বসে যাচ্ছে শরীরে। কুচিকুচি চুল উড়ে এসে পড়ছে আমার মুখে। মাথাটা পিছিয়ে নিজের গাল দিয়ে এক-একবার ছুঁয়ে দিচ্ছি ওর গাল। আর ঐন্দ্রিলা খিলখিল করে হাসছে। হাসছি আমিও। এই মুহূর্তে হাসিটাই আমার মুখোশ। এই হাসির কোণে কোণে লুকিয়ে রেখেছি তিরতির করে বয়ে চলা উত্তেজনা। আমার উদ্দেশ্য, আমার লক্ষ্যকে।

ঐন্দ্রিলা গাইছে, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়… তবে কেমন হত, তুমি বলো তো?’ ঐন্দ্রিলা হাসছে খিলখিল করে। হাসতে হাসতে বলছে, ‘প্লিজ, অর্জুন বলো না গো?’

আমার নাম অরূপ। অর্জুন বলে ডাকে ঐন্দ্রিলা। আমরা দু’জন কমার্স নিয়ে রাজকলেজ নাইটে পড়ি। কলেজের প্রথম দিন থেকে ঐন্দ্রিলার প্রতি আমার টান। তুখোড় দেখতে মেয়েটাকে। জোড়া ভ্রুর তলায় টানাটানা গভীর চোখ। গোলাপি ঠোঁটের এককোণে কালচে তিল। হাসলে ওর গালে টোল পড়ে। এমন মেয়ের জন্য মাতাল হবে যে কেউ। থার্ড ইয়ারে উঠে আমাদের প্রেমটা জমেছে। শুধু জমেনি, সীমাহীন প্রেম বলা যেতে পারে। ওর আগুন আমাকে গলিয়েছে, জ্বালিয়েছে। আমরা একে অপরের কাছে উজাড় করে দিয়েছি নিজেদের।

ঐন্দ্রিলাদের বাড়ি ঝাড়খণ্ডের রাঁচিতে। বর্ধমানে মামারবাড়িতে মানুষ। ওর বাবা-মার আসার কথা ক’দিন পর। ঐন্দ্রিলা আমাকে বলেছে, বাবা-মাকে আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে এবার সব জানাবে। বড্ড তাড়াহুড়ো করছে মেয়েটা। সামনে লম্বা জীবন পড়ে। চাকরিবাকরি করি, একটু গুছিয়ে নিই। তবে না এসব নিয়ে ভাবব।

গতকাল বিকেলে কলেজে যাওয়ার পর থেকে ঐন্দ্রিলাকে চুপচাপ দেখেছিলাম। যেন কিছু ভেবে চলেছে। অ্যাকাউন্টেন্সির ক্লাসটা শেষ হওয়ার পরই ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কী হয়েছে তোমার?’ ও যা বলেছিল, তার জন্য আমি তৈরি ছিলাম না। অনেক চেষ্টা করলাম ওকে বোঝানোর। কিন্তু ঐন্দ্রিলা মানতে চাইল না। নিরুপায় হয়েই আমাকে আজ…

বাঁধের রাস্তাটা সোজা চলে যাচ্ছে সাইফিনাস ড্যামের দিকে। ড্যামের কাণা ছুঁয়ে ফেলেছে জল। ক’দিন ধরে নিম্নচাপ। ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে। আজ বিকেলের পর দু’জন বেড়িয়েছি। আমার কোনও বাইক নেই। এই বুলেটটা ঐন্দ্রিলার বাবার। মামারবাড়িতেই পড়ে থাকে এটা। ওদের গ্যারাজটা বাড়ির বাইরের দিকে। এর আগেও আমরা এই বুলেটটা নিয়ে চুপিচুপি বেড়িয়েছি।

আজ পূর্ণিমা। আকাশের দুধসাদা চাঁদটা যেন অনেকটা নেমে এসেছে মাটির কাছাকাছি। আমি বাইকের গতি বাড়ালাম। ঐন্দ্রিলা আমাকে চেপে ধরল। ওর গায়ের গন্ধে একাকার হয়ে যাচ্ছি। এই অন্ধকার বাঁধের রাস্তায় আসতে আসতে ঐন্দ্রিলাকে বুঝিয়েছি, আমি ওর সঙ্গে আছি। ওকে কোনও চাপ নিতে হবে না। সব সমস্যা মিটিয়ে দেব আমি। মেয়েটা একটু শান্ত হয়েছে।

ঐন্দ্রিলা আমার কানের কাছে মুখ এনে ও বলল, ‘ও যদি ছেলে হয়?’

আমি তেতো ভাবটা চেপে রেখে বললাম, ‘তা হোক না। ছেলে হলে হবে, মেয়ে হলে হবে। যা হবে, আমাদেরই তো।’

ঐন্দ্রিলা ওর ঠোঁট আমার কানে ছুঁইয়ে বলল, ‘ছেলে হলে কী নাম রাখব, জানো? অভিমন্যু। অর্জুনের ছেলে অভিমন্যু।’

ঐন্দ্রিলা খিলখিল করে হাসছে। ওর হাসি যেন আছড়ে পড়ছে আমার শরীরে। রাগটা আবার ফিরে আসছে আমার শিরায় শিরায়। ঐন্দ্রিলা প্রেগনেন্ট। তাতে হয়েছেটা কী? এই বয়সেই তো ভুল হয়! তাই বলে এটা বয়ে বেড়াতে হবে? এখনই বিয়ে করতে হবে? আমার ভেতরে এতক্ষণ চেপে রাখা রাগটা উঠে এসে ধাক্কা মারছে বুকের কাছে। ধীরে ধীরে যেন দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। যে কোনও সময় বিস্ফোরণ হবে। রাগই বোধহয় পিকআপ বাড়িয়ে দিল গাড়িটার। স্পিড মিটারে দেখতে পাচ্ছি, সত্তর পেরিয়ে গেছে বুলেটের গতি। আর কিছুটা। আর কিছুটা গেলেই সাইফিনাস ড্যাম।

ওই অবস্থায় আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর মেয়ে হলে কী নাম রাখবে?’

আমার কথা বোধহয় শুনতে পায়নি ঐন্দ্রিলা। পাবেই বা কি করে? হাওয়ার তোড়ে শব্দ ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। বুলেটের ডিগডিগ আওয়াজটা দামোদরের নীরবতা ভেঙে দিচ্ছে। মিহি দানার বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বাঁধের রাস্তায় কোথাও নিশ্চয় জলডোবা গর্ত ছিল। টাল সামলাতে পারলাম না আমি। ঝাঁকুনি খেয়ে বুলেটটা পাল্টি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে নদীতে। বোল্ডারে ধাক্কা খেতে খেতে তছনছ হয়ে যাচ্ছে আমার শরীর। মাথা, হাত, বুক, হাঁটু অবশ হয়ে আসছে। অবর্ণণীয় যন্ত্রণায় টুকরো টুকরো যাচ্ছে সারাটা শরীর।

তারপর কী হয়েছিল? ষোলো বছর আগের ঘটনা। সাড়ে তিনমাস কোমায় ছিলাম আমি। জ্ঞান ফেরার পরও অনেকদিন আমার কোনও বোধ ছিল না। প্রায় বছরখানেক পর আমি সুস্থ হয়েছিলাম। তারপর আর বর্ধমানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখিনি। কখনও যাইওনি। ওই ঘটনার জন্য লোকে আমাকে দায়ী করেনি। ভেবেছিল নিছক একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু আমি জানি, এসব মিথ্যে। জ্ঞান ফেরার পর থেকে একটাই প্রশ্ন খুঁজেছিলাম, ঐন্দ্রিলা কোথায়? শুনেছিলাম, ওর বডি নাকি পাওয়া যায়নি। নদীতে ভেসে গিয়েছিল কি মেয়েটা? হবে হয়তো। একটা আতঙ্ক আমাকে ঘিরে ধরেছিল, কেউ জানুক না জানুক, আমি ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে চেয়েছিলাম ঐন্দ্রিলাকে। বাইকটা অ্যাক্সিডেন্ট না করলে সাইফিনাস ড্যামে নিয়ে গিয়ে ওকে খুনই করতাম। করতাম কেন, করেইছিলাম তো। জেনে শুনেই তো তীব্রগতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম।

একথালা চাঁদটা আজ অনেকখানি নেমে এসেছে। যেন মাটিতে জ্যোৎস্না তার নিজের ডানা খুলে রাখবে। আমি বাইক নিয়ে ছুটে চলেছি বাইপাস ধরে। আমার পিছনের সিটে কি তাহলে ঐন্দ্রিলা বসে?

ঐন্দ্রিলা ওর বাঁ হাত দিয়ে আমার পিঠে কিছু একটা লিখছে। এটা আমাদের একটা খেলা ছিল। ও কিছু লিখলে চোখ বুজে অনুভব করতাম। উত্তর সঠিক হলে ও চুমু দিত। আহ্‌, নরম একজোড়া গোলাপি ঠোঁটের পরশ!

এই বাইপাস, তীব্র গতিতে ছুটে চলা বুলেট— সব যেন ভুলে গেছি এখন। ঐন্দ্রিলা আমার পিঠে আঙুল বুলিয়ে যা লিখছে, তা বলে উঠলাম, ‘জে… এইচ… জিরো… ওয়াই… টু… ফাইভ… ফোর… সিক্স!’

হাসিমুখে ঐন্দ্রিলাকে বললাম, ‘মিলেছে তো?’ ঐন্দ্রিলার উত্তর পাওয়ার আগেই নাম্বার প্লেটটা ভেসে উঠল। জেএইচ, মানে ঝাড়খণ্ডের নাম্বার প্লেট। এই গাড়িটার নাম্বার তো তাই! হ্যাঁ-হ্যাঁ, জিরো, ওয়াই, টু ফাইভ ফোর সিক্স! এই গাড়ির নম্বর ঐন্দ্রিলা কী করে জানল? অনন্তবাবু ওর কে?’

ঐন্দ্রিলা সরু আঙুল চলছে আমার পিঠে, ‘এফ… এ… টি… এইচ… ই… আর!’

ফাদার! বাবা! মানে, অনন্তবাবু ঐন্দ্রিলার বাবা?

‘ওয়াই… ই… এস!’ ঐন্দ্রিলার আঙুল ফুটিয়ে তুলল আমার প্রশ্নের উত্তর!

আমি থমকে গেলাম নিমেষে। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ভয়, একরাশ আতঙ্ক এখন আমাকে ঘিরে ফেলা উচিত ছিল। সীমাহীন আশঙ্কা আমাকে ফালাফালা করে দেবে! কিন্তু কোথায়? কিছু হচ্ছে না তো!

কাদাপাড়া সিগনালটায় লাল আলো জ্বলছে। দেখতে পাচ্ছি, দুটো লরি গায়েগায়ে সিগনালে দাঁড়িয়ে। দুটো লরি বোঝাই লোহার রড। অসংখ্য রডের সূচালো মাথা বেরিয়ে রয়েছে লরি থেকে। যে গতিতে বুলেটটা এগোচ্ছে, না থামাতে পারলে অ্যাক্সিডেন্ট অনিবার্য।

আমি বুঝতে পারছি সবই। কিন্তু এইসময় মৃত্যুভয় চেপে ধরছে না আমাকে। আমার আর ভয় লাগছে না! বরং আমি কানখাড়া করে শুনছি মোলায়েম গলার গান। পেছন থেকে ঐন্দ্রিলা আমার কানে মধু ঢেলে দিচ্ছে। যেন সন্মোহনী মন্ত্র!

‘এই পথ যদি না শেষ হয়… তবে কেমন হত তুমি বলো তো?’

বুলেটটার দুটো হ্যান্ডেল ছেড়ে শরীরটা অর্ধেক ঘুরিয়ে ঐন্দ্রিলাকে বললাম, ‘তুমিই বলো?’

খিলখিল হেসে উঠল ঐন্দ্রিলা। যেন একসঙ্গে অনেক উইন্ডচাইম বেজে উঠল। আমিও হাসলাম। কতদিন এমন প্রাণ খুলে হাসিনি আমি। আমার এই হাসিটা ঐন্দ্রিলার খুব পছন্দ ছিল। আমার হাসিতে নাকি মন ভালো হয়ে যায় ওর। আমি হাসলাম। আরও চওড়া করে। যন্ত্রণা ভোলানো হাসির মধ্যেই দেখতে পেলাম, আমার শরীর ভেদ করে একে একে ঢুকে যাচ্ছে অসংখ্য রড। ফালাফালা করে দিচ্ছে আমার হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, বুক, গলা, চোখ। তবু আমার কষ্ট হচ্ছে না।

ঘাড় না ঘুরিয়েই ঝলসানো চাঁদের আলোয় হাসিমুখে ঐন্দ্রিলাকে বললাম, ‘যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়?’