অব্যক্ত প্রেম - দেবদত্তা ব‍্যানার্জী

রহস্য উপন্যাস

অলংকরণ - মিশন মন্ডল
(১)

রাস্তাটা পাহাড়কে পাক খেয়ে উঠতে উঠতে, আসতে আসতে বেশ সরু হয়ে গেছিল। সামনেই একটা বেশ পুরানো কাঠের সেতু। গাড়িটা পার হওয়ার সময় মচমচ করে আওয়াজ করে দুলে উঠেছিল ভয়ংকরভাবে। জিনিয়া একটু চমকে উঠে বাইরে তাকিয়েছিল। কয়েক হাজার ফিট উপরে উঠে আসার পর হাওয়া বেশ ঠাণ্ডা, আশেপাশের পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফের আস্তরণ বলে দিচ্ছে আবহাওয়া বেশ হিমেল হবে। এই কোম্পানির তরফ থেকে স্যুটটার জন্য বেশ মোটা টাকা পাবে বলে ও আসতে রাজি হয়েছিল এই জনমানবহীন পাহাড়ে। অবশ্য ফ্রিতে একটা ছোট আউটিংও হয়ে যাচ্ছে ওর। তাছাড়া বছরের শেষটা ভালো কাটেনি এবার। এই অভিনয় জগতটা ভীষণ নোংরা, টিকে থাকতে হলে অনেককিছুই মানিয়ে নিতে হয়, জিনিয়ার অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে। ট্রেস কাটানোর জন্য একা কোথাও ঘুরে আসবে ভাবছিল । ঠিক তখনি এসেছিল অফারটা। পাহাড়ের মাথাটা অনেকটা টেবিল টপের মত চ্যাপ্টা। পাথরের বাংলোটা বেশ পুরানো। ব্রিটিশ শৈলীতে তৈরি, মনে হয় কোনও ইংরেজ সাহেবের অবসর যাপনের ব্যবস্থা ছিল এখানে। এরা প্রপার্টিটা কিনে রিসর্ট করেছে। ছোট ছোট কয়েকটা পাথরের কটেজ ঠিক উল্টানো ডিমের খোলার মত দেখতে। সিকিম আর বাংলার বর্ডারে জায়গাটা বেশ সুন্দর। তবে পথ বড্ড দুর্গম। পাশেই একটা ঝরনা লাফিয়ে লাফিয়ে নেমেছে, একটু দূরে রঙ্গিতে গিয়ে মিশেছে।

বিজনেস ডিলটা ক‍্যানসেল হয়ে গিয়ে মাথাটা গরম হয়ে গেছিল তাংশুর। বছরের শেষ দিন দুটো এভাবে নষ্ট হবে আগে বোঝেনি। কুর্চি ওর দাদার বাড়ি পুনে চলে গেছিল আগেই। তাংশু একবার ভাবল তবে কি ওখানেই চলে যাবে? সুর করে ফোনটা বেজে ওঠায় কলটা নিলো ও, “হ্যালো?”

ও পাশ থেকে সেই মিষ্টি গলাটা ভেসে এলো, “স‍্যার, আপনি আসছেন তো আমাদের স্বপ্ননীড়ে। গাড়ি ওয়েট করছে লবিতে।”

দু দিন আগে থেকেই এই ফোনটা বার বার আসছিল তাংশুর ফোনে। কোনও ফোন কোম্পানি লাকি ড্র করেছিল একটা রিসর্ট আর হোটেলের কোম্পানির সঙ্গে মার্জ হয়ে। ওর নম্বরটা সিলেক্টেড হয়েছে। পুরস্কার স্বরূপ ওরা দিচ্ছে বছর শেষের দু রাত তিনদিন ওদের রিসর্টে কাটানোর সুযোগ। নতুন ব‍্যবসা, এই ফিডব্যাকটাই ওরা কাজে লাগাবে। জায়গাটা সিকিম আর বাংলার বর্ডারে এক পাহাড়ি গ্রামে। কয়েকটা ছবি এসেছিল মেলে। সুন্দর জায়গা। ওদের তরফ থেকে নাকি নানারকম এডভেঞ্চার স্পোর্টস আর মজার সব ইভেন্ট থাকবে।

তাংশু হঠাৎ রাজি হয়ে যায়। বেশ অন্যরকম মজা হবে মনে হয়। একা একা বহুদিন কোথাও ঘুরতে যায়নি ও। সব সময় বিজনেস ট্যুর। ধীরে সুস্থে চেক আউট করে ওদের পাঠানো গাড়িতে উঠে বসে স্বপ্ননীড়ের উদ্দেশ্যে।

 

প্রফেসার মাইতি মাফলারটা ভালো করে জড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। আসল বড় রাস্তা ছেড়ে বেশ কিছুক্ষণ আগে এই সরু কাঁচা পথ ধরেছে গাড়িটা। একটানা নেপালি ফোক সং বাজছে, ড্রাইভার কথাই বলে না। তবে বেশ স্টাইলিস্ট ছেলেটা। আশেপাশের পাহাড়ে জনবসতি চোখে পড়ে না। রিসর্টটা নতুন হয়েছে নেটে দেখেছিলেন উনি। তারপর ওঁর আগ্রহ দেখে ওরাই ফোন করেছিল। একটা স্পেশাল অফার ছিল বর্ষশেষের। লাকি ড্র, দুটো প্রশ্নের সঠিক উত্তর। সহজেই জিতে নিয়েছিলেন প্রফেসার। বহুদিন একা কোথাও ঘুরতে যাননি উনি। তাই রাজি হয়ে গেছিলেন। তবে এদিকে যে নেটওয়ার্ক নেই, টাওয়ার থাকবে না ওরা আগে জানায়নি। তাতে অবশ্য তেমন অসুবিধা নেই ওঁর। মাঝে মাঝে এমন হারিয়ে যেতে ভালোই লাগে। বেশ একটা থ্রীল অনুভূত হচ্ছে প্রফেসরের।

রিশিপশনের সামনে গাড়ি থেকে নেমেই কাঁকনের চোখ জুড়িয়ে গেলো। সিসিটুতে কী একটা ফর্ম ভরেছিল কদিন আগে। বছর শেষে এই রিসর্টে কাটাবার একটা সুন্দর সুযোগ পেয়ে গেলো তাই। কাঁকনের কিটি পার্টির বন্ধুরা অবাক হয়েছিল শুনে। বলেছিল ভালো করে খোঁজ নিয়ে তারপর যেতে। কারণ এমন ফর্ম ওরাও বহুবার ভরেছিল, ফ্রিতে কোন অফার ছিল না, মেম্বার হতে বলেছিল কোন ক্লাব। রাজিত তো ঘুরতে যেতেই চায় না। ফ্রি বলে এসেছে এইবার। এত খোঁজ নিতে বললে ও আর আসত না এখানে। বহুবছর পর পাহাড়ে এলো ওরা। তবে এমন জনমানবহীন জায়গা কাঁকন আগে বোঝেনি। একটা শপিং মল বা বাজার নেই আশেপাশে। বন্ধুদের জন্য একটু কেনাকাটা করতে হত। তা শিলিগুড়িতে ফেরার দিন করে নেবে না হয়। আপাতত দুটো দিন এখানেই কাটাতে হবে।

শেষ মুহূর্তে নিতা আসতে রাজি হয়েছিল। সোম আর কিছু বলেনি। বহু বছর ওরা ঘুরতে যায়নি কোথাও। হঠাৎ করে ফ্রি অফারটা পেয়ে সোম ঘোরার প্ল্যানটা করেছিল। নিতাকে আজকাল মাঝে মাঝে অচেনা লাগে। কেমন যেন বদলে যাচ্ছে মেয়েটা। দু বছরের বিবাহিত জীবন মাঝে মাঝে কেমন দমবন্ধ লাগে। অথচ এই নিতাকেই এক সময় মনে হত এক ঝলক টাটকা বাতাসের মত। আর এখন... অবশ্য এই ট্যুরটা হয়তো ওদের সম্পর্কটাকে নতুন প্রাণ দেবে এই ভেবেই এসেছে সোম। দেখা যাক সম্পর্কটা ঠিক হয় কিনা।

শেষ মুহূর্তে ও এভাবে ছিটকে যাবে ঝনক কখনোই ভাবেনি। এই ধরনের রেকর্ডিং কোম্পানিগুলো ওর আগে পিছু ঘোরে সব সময়। ওর গানের গলা আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা, জন্মগত সুর রয়েছে ওর গলায়। কতগুলো রিয়ালটি শোয়ের উইনর ঝনক, সারা ভারতে ওর নাম ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এবার যে কী হল ও নিজেই বুঝল না! শেষ মুহূর্তে কিছু একটা হয়েছিল ভেতর ভেতর, তবে কে যে কলকাঠি নাড়ল, কী যে হল কে জানে! অবশ্য এমন কলকাঠি নেড়ে ও নিজেও বহুবার নিজের জায়গা পোক্ত করেছে। যাক, ভালোই হয়েছে। এই রিসর্টটা ফ্রিতে একটা ট্যুর দিচ্ছিল, একটা অ্যাড করে দিলে টাকাও দেবে বলেছিল। আসলে সেলেব্রিটিদের ফিডব্যাক চাই। নতুন ব্যবসা। ও না করে দেবে ভেবেছিল। কাজটা থেকে ছিটকে যাওয়ায় আচমকা ঘুরতে আসাটা হয়েই গেলো।

মেইন বিল্ডিংয়ে উত্তর দিকের কোণার ঘরটা পেয়েছিলেন ডঃ বৈদ্য। সামনের বারান্দায় বসে কফি খেতে খেতে বাকি বোর্ডারদের খেয়াল করছিলেন উনি। উনিও মালিক পক্ষের আমন্ত্রণ পেয়েই এসেছেন এই রিসর্টে। বেশ সুন্দর ছিমছাম রিসর্ট। একটা পাহাড়ি ঝরনা লাফাতে লাফাতে দিক ভুল করে ঢুকে পড়েছিল রিসোর্টের ভেতর, ঢেউ খেলানো লনের এক ধারে একটু নাচানাচি করে আবার বেরিয়ে গেছে ও ধার দিয়ে। কিছু রডোডেনড্রন ফুটেছে, তবে এই ঠাণ্ডায় সেগুলো বেশ নির্জীব। বোর্ডারদের ঘর দেখিয়ে দিতে ছুটোছুটি করছে রিসর্টের বাচ্চা ছেলে দুটো। ম্যানেজার সবাইকে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় হলে ডেকেছেন। কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়েন ডঃ বৈদ্য। উনি মনের ডাক্তার, মানুষকে পর্যবেক্ষণ করতে ভালবাসেন। আগত প্রতিটা বোর্ডারের মধ্যে একেক জন অভিনেতা অভিনেত্রীকে দেখতে পান উনি। হঠাৎ ওনার মনে হয় এক নতুন নাটক শুরু হতে চলেছে এই রিসর্টে।

হালকা সাতরঙা মায়াবী আলোয় ভেসে যাচ্ছিল বড় হল ঘরটা। ছটা বাজার আগেই অন্ধকার হয়ে গেছে বাইরে। কাঠের মেঝেতে দুটো বড় বাঘছাল ছড়ানো, বেশ পুরানো হলেও উজ্জ্বলতা কমেনি এখনো। দেওয়ালে কিছু জন্তুর মাথা আর কিছু সেকেলে অস্ত্র সাজানো। দুটো বড় বড় সৈনিকের বর্ম সাজানো রয়েছে। মিষ্টি মিউজিক বাজছে লুকানো স্পিকারে। একে একে সব অতিথিরাই এসে জড়ো হয়েছেন হলে।

ম্যানেজার ভত্রা সবার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, “স্বপ্ননীড়ে সবাইকে স্বাগত। আসতে অসুবিধা হয়নি নিশ্চই। কেমন লাগছে আমাদের এখানে এসে? আসুন সবাই পরিচিত হই। অবশ্য আমাদের আরেক বন্ধু এখনো রাস্তায় রয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পৌঁছে যাবে হয়ত। ওদের গাড়িটা খারাপ হয়েছিল পথে। বছরের শেষ দুটো দিন আমরা একসঙ্গে আনন্দে কাটাবো বলে এখানে জড়ো হয়েছি।”

একে একে সবাই নিজেদের পরিচয় দিচ্ছিল। পাঁচটা কটেজের মধ্যে তাংশু, রাজিত ও কাঁকন, সোম ও নিতা, জিনিয়া আর ঝনক উঠেছে। ডঃ বৈদ্য আর প্রফেসার মাইতি রয়েছেন মেইন বিল্ডিংএ। এরপর কেক কেটে ওঁরা নিজেদের বন্ধুত্বের সূচনা করলেন। নানা বয়সী লোকগুলো নিজেদের মত করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্পে মগ্ন।

বহুদিন পর নিতার বেশ ভালো লাগছিল। ব‍্যবসার বাইরে সোমের যে একটা জীবন আছে ও ভুলতেই বসেছিল। ওর বিজনেস পার্টি আর ঐ একঘেয়ে বন্ধু বান্ধবের হাত থেকে পালাতে চাইত নিতা। একেক সময় মনে হত সোমকে বিয়ে করাটাই জীবনের বড় ভুল। মাত্র দু বছরের বিবাহিত হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। কিন্তু এখানে এসে মনে হচ্ছে জীবনকে নিয়ে আরেকবার ভাবা যেতেই পারে।

একটা লার্জ পেগ ভদকা শেষ করে ঝনকের হঠাৎ মনে হচ্ছিল হলটা বড্ড গুমোট। বাইরের চাঁদের আলোয় গিয়ে বসা যায়। যদিও ঠাণ্ডা লাগার ভয়ে ঠিক সাহস পায় না। ঠাণ্ডা যদি একবার গলায় লাগে আগামী রেকর্ডিং গুলো সব নষ্ট হবে। বাধ্য হয়ে কাঁচের জানালার ভেতর দিয়েই বাইরের পাহাড় দেখছিল ও।

আড়চোখে ওকেই লক্ষ করছিল জিনিয়া। বাংলা সিনেমায় উঠতি অভিনেত্রী এখানে এসেছে এদের স্বপ্ননীড়ের জন্য একটা ছোট্ট আ্যড শ্যুট করতে। ঝনককেও কি ওরা একই কারণে ডেকেছে? সিঙ্গার হলেও মেয়েটা টুকটাক আ্যড করে। আজকাল পর্দার পেছনে থেকে কেউ কিছু করতে চায় না। সবাই লাইম লাইটের মাঝে প্রচার চায়। কলকাতায় দুটো বড় প্রপার্টি ডিলার ঝনককে দিয়ে গান গাওয়ানোর পাশে ওকে দিয়ে অ্যাড করিয়ে নিয়েছে।

তাংশু হুইস্কিটায় একটা চুমুক দিয়ে একটা পোর্ক কাবাব তুলে নেয়। জিনিয়া আর ঝনকের মত আইটেম যেখানে আছে সেখানে দিন দুটো ভালোই কাটবে। ভাগ্যিস কুর্চিকে আনেনি ও। এই মেয়ে দুটোর মার্কেটে ভালো নাম আছে। আপাতত প্রথম কার দিকে এগুবে ভাবতে ভাবতে গ্লাসে চুমুক দেয় তাংশু।

কাঁকন, প্রফেসার মাইতি ও ডঃ বৈদ্যর সঙ্গে গল্পে জমে গেছিল। রাজিত আর সোম ওধারে বিলিয়ার্ড টেবিলে মনোনিবেশ করেছিল।

হঠাৎ করে ঝুপ করে সব আলো নিবে যেতেই ম্যানেজারের গলা শোনা গেল ,”কেউ ভয় পাবেন না, এটা লোডশেডিং। আমাদের ব্যাকআপ আছে, এখনি জেনারেটর চালু হবে। ধৈর্য ধরে বসুন সবাই।”নেটওয়ার্ক নেই বলে অনেকেই ফোন ঘরে রেখে এসেছিল। কয়েক মিনিটকে মনে হচ্ছিল কয়েক যুগ, বাইরের জ্যোৎস্নামাখা কুয়াশা বড় বড় কাচের জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে এক আলো আঁধারীর পরিবেশ তৈরি করেছে। বাইরে শুরু হয়েছে তুষারপাত। পেঁজা তুলোর মত তুষার বাতাসে ভাসছে। কয়েকটা কালো অবয়বের নড়াচড়া পরিবেশকে বেশ ভৌতিক করে তুলেছে। কিন্তু হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ চিৎকারে সবাই চমকে উঠল, কয়েক সেকেন্ডের ভেতর আলো জ্বলতেই দেখা গেল সবাই যে যার জায়গায়, শুধু তাংশু লুটিয়ে পড়ে রয়েছে মেঝেতে। আর একটা কালচে লাল রক্তের ধারা ওর শরীরের নিচ থেকে বেরিয়ে আসছে ধীরে।

বিস্ফারিত চোখে সবাই তাকিয়ে ছিল সেদিকে। ঠিক তক্ষুনি বড় গেট খুলে আরেকটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো গাড়ি বারান্দায়। নেমে এলো আলোক আর সাহানা।

(২)

বছর শেষের আনন্দ যে এভাবে আতঙ্কে বদলে যাবে কেউ ভাবেনি। আলোক আর সাহানা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই পরিস্থিতি এমন হবে কে জানত! সব আনন্দ ভয়ে আতঙ্কে বদলে গেছিল। গেস্টরা সবাই হতবাক। কয়েকঘন্টা আগেই ওরা সবাই এসেছিল বর্ষবরণের আনন্দ নিতে।

সবার অনুরোধে ডঃ বৈদ্য এগিয়ে গেলেন তাংশুর দিকে, ওকে সোজা করতেই দেখা গেল একটা লোহার বর্ষার ফলা ওর বুকের বাঁদিকে আমূল গেঁথে বসেছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে দরজার পাশে দাঁড় করানো লোহার বর্মটার হাতের দিকে তাকাল আলোক। বর্ষার লোহার শলাকার উপর থেকে ফলাটা খুলে নিয়েছিল আততায়ী।

ম্যানেজার ভত্রা অনেক চেষ্টা করেও ফোনে যোগাযোগ করতে পারলেন না পুলিশের সঙ্গে। ফ্যাঁকাসে মুখে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনারা কেউ কোথাও যাবেন না। আমি থানায় খবর দিচ্ছি কোনোভাবে।”

“আপনি আমাদের এভাবে আটকে রাখতে পারেন না। কেন শুনব আপনার কথা?” ঝনক বলে ওঠে।

“আমরা সবাই আনন্দ করতে এসেছিলাম, কেউ কাউকে চিনি না। একজন এভাবে খুন হল... এখানে কে ওঁর শত্রু কিছুই বুঝতে পারছি না।” জিনিয়া ঝনকের পাশে এসে দাঁড়ায়।

“ডেড বডিতে কেউ হাত দেবেন না । সবাই যে যার ঘরে যেতে পারেন। কিন্তু রিসর্টের বাইরে নয়।” আলোক গম্ভীর গলায় বলে ওঠে।

নিতা সোমের হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিল। চোখে আতঙ্ক।

কাঁকন রাজিতকে বলে, “আমার শরীরটা খারাপ করছে, ঘরে যাবো।”

আলোক মন দিয়ে তাংশুর বডিটা দেখছিল। আচমকা ঘটেছে ঘটনাটা, ও নিজেও বোধহয় বোঝেনি কী হতে চলেছে। ধারালো ফলাটা হৃৎপিণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে গেছে।

ম্যানেজার বললেন, “ওঁর নাম হিতাংশু মণ্ডল। বড় রিয়েলেস্টেট ব‍্যবসায়ী। কলকাতায় বাড়ি। আমাদের কনটেস্ট জিতে এসেছিলেন এখানে।”

“আপনাদের রিসর্টের মালিক কে? আর কী কী হোটেল বা রিসর্ট আছে আপনাদের?” সাহানা প্রশ্ন করে।

“আমাদের মালিক এক অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তারের মেয়ে। আপাতত ওঁরা শিলিগুড়িতে আছেন। এটাই ওঁদের প্রথম হোটেল ব‍্যবসা। ডাক্তারের নাম মিসেস কৌশিকি পাইন। ওনার মেয়ে কৌশানি।'”

“আমরা কি ঘরে যেতে পারি?” সোম প্রশ্ন করে।

ভত্রা ঘড়ির দিকে তাকায়, আটটা বেজে দুই, বলে, “সাড়ে আটটায় খাবার লাগাচ্ছি ডাইনিং এ, ডিনার খেয়ে নেবেন সবাই। আমার আর মাথা কাজ করছে না।”

আলোক আর সাহানা লাগেজ নিয়ে মেইন বিল্ডিং দক্ষিণের শেষের ঘরটায় চলে যায় ড্রাইভার ত্যাগবাহাদুরের সঙ্গে। সাহানা জিতেছিল এই কনটেস্টটা কয়েকদিন আগে। তাই হঠাৎ করে ওদের এই ঘুরতে আসা।

খাওয়ার দিকে কারোর আর মন ছিল না। সাহানাদের দুপুরে ভালো করে লাঞ্চ হয়নি। নান আর কড়াই চিকেন নিয়ে সাহানা এসে বসেছিল একধারে। জিনিয়া একটা স‍্যুপের বোল নিয়ে নেড়েই যাচ্ছে। নিতা ভাত নেই দেখে একটু বিরক্তি প্রকাশ করতেই সোম ওকে একটা ধমক দিয়েছিল। আপাতত নুডুলস নিয়ে এক গাদা সস মাখিয়ে ও খাচ্ছিল আপন মনে। দুটো চিকেন ড্রাম স্টিক আর স্যলাড নিয়ে প্রফেসার মাইতি জানালার পাশে এসে বসলেন। আবার উঠে গেলেন ভত্রাকে ডেকে একটু ড্রিঙ্কসের কথা বলতে। ঝনক রুটি আর ডাল নিয়ে সাহানার পাশে এসে বসল।

হঠাৎ সাহানার মনে হল চিকেনে কামড় দেওয়ার পর প্রফেসার মাইতিরর মাথাটা যেন ঝুঁকে পড়ল বুকের উপর। প্লেটটা তখনো কোলের ওপর। আলগা হাতে আধ খাওয়া ড্রাম স্টিক।

ঘরের অন‍্যদিকে রাজিত, ঝনক আর আলোক টুকটাক কথায় ব্যস্ত। সাহানা নিজের প্লেট রেখে মাইতির দিকে দু পা এগিয়ে গেছিল, তারপর ওর গলা দিয়ে একটা চিৎকার বেরিয়ে এলো, “আলোক...”

ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সবাই তাকিয়েছে ততক্ষণে প্রফেসারের দিকে। ভদ্রলোকের মাথাটা কেমন ঝুলে পড়েছে বুকের কাছে। আলগা হাতে ঝুলছে একটা ড্রামস্টিক।

ডঃ বৈদ্য ছুটে এসে ওঁর নাকের সামনে হাত দিলেন। তারপর ওর ঠোঁটটা লক্ষ করে বিস্ফারিত চোখে ওর প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, “খবরদার কেউ খাবার খাবেন না, বিষ রয়েছে খাবারে।”

ঝনঝন করে কাঁচের বাসন ভাঙার আওয়াজ পেয়ে সাহানা ঘুরে তাকিয়েছিল পেছনে। কাঁকনের হাতের প্লেট পড়ে গেছে মেঝেতে। আতঙ্কে নীল চাহনি। বোধহয় ভয়ে বমিই করে ফেলবে মনে হচ্ছিল।

“কোনও একটা খাবারে বিষ ছিল। মনে হয় ড্রাম স্টিকেই। বাকিরা ভয় পাবেন না। আমিও রুটি খেয়েছি একটা, কিছু হয়নি।” আলোক ভরসা দিতে চেষ্টা করে তাড়াতাড়ি।

“কিন্তু কেন? কে আমাদের এভাবে মারতে চাইছে? কী লাভ হবে তার...” কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ঝনক।

ভত্রার দিকে তাকিয়ে আলোক বলে, “আপনার কুক কোথায়?”

“কুক পাশের গ্রামে থাকে, ও কেন করবে এসব! তাছাড়া সব খাবারে তো বিষ নেই, অনেকেই তো খেলো! কুক জানেও না কে কী খাবে!” ভত্রা বলে।

“খাবার সাজানোর পর অনেকেই এদিকে এসেছিল, যে কেউ মেশাতে পারে।" বলে ওঠে সাহানা। “উনি প্লেট রেখে উঠে গেছিলেন, তখন যদি কেউ মেশায়?”

“প্রথমে বুকে ছোরা বসিয়ে খুন, এখন খাবারে বিষ... ফ্রি বলে ডেকে এনে আমাদের মারছে কেন এরা?” রাজিত বলে।

“সেটাই রহস্য। আচ্ছা আপনাদের ব্যক্তিগত জীবনে কোনও শত্রু আছে কি? এই রিসর্টের মালিককে কে কে চেনেন?” আলোকের চোখ ঘোরে সবার উপর।

সবাই মাথা নেড়ে বলে যে রিসর্টের মালিককে কেউ চেনে না। “আর শত্রু?”

আলোকের কাটকাট কথায় চমকে ওঠে জিনিয়া। বলে, “প্রফেশনালদের শত্রুর অভাব থাকে না? আপনার জীবনে শত্রু নেই?”

আলোক হেসে ফেলে, বলে, “আমার যা প্রফেশন চারদিকেই শত্রু। কিন্তু আমাদের সবার শত্রু যদি আলাদা কেউ হয় আমাদের এখানে এনে জড়ো করল কে? এই রিসর্টের মালিক কি তবে সুপারি কিলার? আমাদের সবাইকে মারবে বলে এখানে এনেছে?”

“সেটাই রহস্য!! আপাতত খাওয়া মাথায় উঠেছে, যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। সকালে পুলিশ এলে কিছু একটা ব্যবস্থা হবে।” ডঃ বৈদ্য বলেই নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন।

“হলে একটা বডি, ডাইনিং এ একটা, আমি তো ভয়েই মরে যাবো সারা রাত একা থাকতে হলে!” ভত্রা কাঁদো কাঁদো হয়ে বললেন।

“বডি তো নাড়ানো যাবে না। আমরা একটা বা দুটো ঘরে রাতটা কাটাতে পারি সবাই মিলে। তবে হলে থাকাই ভালো। লাশও তো পাহারা দিতে হবে।” আলোক বলে।

“আমি রুমে যাবো।” কাঁকন কাঁপা গলায় বলে।

“আমিও...” জিনিয়া এসে দাঁড়ায়।

“মহিলারা একটা ঘরে থাক তাহলে।” আলোক ভত্রার দিকে তাকিয়ে বলে।

“আমি আমার ঘরেই যাবো, ফ্রেস হতে হবে।” ঝনক চাবি হাতে উঠে দাঁড়ায়।

“সাবধানে থাকবেন।” আলোক বলে।

কাঁকন রাজিত নিতা আর সোম ও নিজেদের ঘরের দিকে এগিয়ে যায় এবার। জিনিয়া বলে, “আমি হলেই থাকব ভাবছি।”

“যা ইচ্ছা", আলোক সবার সঙ্গে হলে এসে বসে। কারোর আর খাওয়া হয় না। ভত্রা সবাইকে রুমে পৌঁছতে গেছিল। ফিরে এসে সোফাতে বসে, দু হাতে মাথার চুল খিমচে ধরে বলে, “ভূত আছে এখানে। নাহলে এমন হয় কখনো? পূজাটাও ঠিক করে করলেন না ম‍্যাডাম। কী যে রয়েছে কপালে কে জানে?”

হঠাৎ ফিরে আসেন ডঃ বৈদ্য, বলেন –“ঘুম আসছে না, তাই চলে এলাম।"

“তোমার ম‍্যাডাম মানুষ কেমন গো? নামটা আগে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। উনি কীসের ডাক্তার ছিলেন?” ভত্রাকে জেরা শুরু করে আলোক। দূরে কোথাও কোনও গির্জার ঘড়িতে বারোটা বাজার আওয়াজ ভেসে আসে। পাহাড়ে পাহাড়ে অনুরণিত হয় সেই ঘন্টাধ্বনি।

টুকটাক গল্প করছিল ওরা কয়েকজন। হঠাৎ সোম এসে ঢোকে সেখানে। ও ঘরে চলে গেছিল আগেই। এত রাতে বাইরে যখন হার কাঁপানো ঠাণ্ডা ও এসে বলে, “আমার পাশের কটেজটা তো জিনিয়া ম‍্যাডামের। ও শুতে গেছিল, কিন্তু ওর কটেজের বাথরুম দিয়ে এক ভাবে জলের আওয়াজ আসছে, এই ঠাণ্ডায় মাঝরাতে কেউ তো চান করবে না! তবে কি কল বন্ধ হচ্ছে না? একটু জানাতে এলাম।”

স্প্রিং এর মত ছিটকে ওঠে আলোক। ওর পেছন পেছন ভত্রা, সাহানা, ঝনক, ডঃ বৈদ্য সবাই ছুটে আসে কটেজ তিনে। সোম পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। বাথরুমের নালা দিয়ে জল পড়ছে, আলোও জ্বলছে বাথরুমে। দরজা ধাক্কিয়েও কেউ খুলল না যখন ভত্রা ওর অফিস থেকে অন্য চাবি এনে ঘর খুলে ফেলল। ছিমছাম সাজানো ঘর, টেবিলে সুটকেস খুলেছিল জিনিয়া, বিছানায় উলিকোটের রাত পোশাক, মেঝেতে যে গাউনটা ও পরে ছিল রাতে সেটা গড়াগড়ি যাচ্ছে। বাথরুমের দরজা আধ খোলা। সবাই এ ওর মুখের দিকে চাইছে। আলোক দু বার ডাকতেও যখন সারা দিল না কেউ ও ডঃ বৈদ্যকে নিয়ে ঢুকল বাথরুমে, গোলাপি বাথ রোবে জড়ানো জিনিয়ার শরীরটা উল্টো হয়ে পড়ে রয়েছে বাথটাবের ভেতর। মাথাটা জলের বালতিতে চুবানো। বালতি উপচে জল বেরিয়ে যাচ্ছে বাইরে। ধস্তাধস্তির তেমন চিহ্ন নেই। ও বোধহয় বাথটাবে বালতি বসিয়ে তাতে জল ভরতে দিয়ে জামাকাপড় বদলাচ্ছিল। খুনি পেছন থেকে ওর মাথাটা বালতিতে চুবিয়ে ধরেছিল। জলে দম বন্ধ হয়ে শেষ।

(৩)

বহু দূরে কোথাও দুটো ঘণ্টার আওয়াজ নির্জন পাহাড়ের বুকে ইকো হতে হতে মিলিয়ে গেলো হিমালয়ের গহীনে। ব্রিটিশ শৈলীতে তৈরি কোঠা বাড়ির হল ঘরে জেনারেটরের আলোয় বসে রয়েছে অবয়বগুলি। বড় সোফায় ডঃ বৈদ্য আলোক ও সাহানা। পাশের সিঙ্গেল কৌচে ঝনক, ওধারে রাজিতের ঘাড়ে মাথা রেখে কাঁকন, পাশে সোম আর নিতা। একটা কাঠের চেয়ারে ম্যানেজার ভত্রা আর ডাইনিং এর দরজার পাশে একটা চেয়ারে ওর দুই সহকারী । কিচেনে রয়েছে কুক আর তিন জন ড্রাইভার। কিচেনটা ডাইনিং এর লাগোয়া।

কাঁপা গলায় ঝনক বলে ওঠে, “কে এই অদৃশ্য শত্রু? কেন সে আমাদের ডেকে আনল। মিসেস পাইন বা ওনার মেয়েকে আমি চিনি না। আমার শত্রু আমার গানের জগতের লোকেরা। এই মুহূর্তে নিশা আর অবন্তিকা আমার বড় শত্রু। নিশা গেছে মালদ্বীপ আর অবন্তিকা ইউরোপ। তবে ওরা যদি কাউকে ভাড়া করে লাগায় এখানে...”

“জিনিয়াকে চিনতেন?”

আলোকের প্রশ্নে চমকে ওঠে ঝনক, বলে, “ভালো অভিনেত্রী, উঠছিল বেশ... দু একবার পার্টিতে দেখেছি। কথা হয়নি কখনো।”

“হিতাংশু বাবুকে চিনতেন?”

“ন...না... মানে সেভাবে কখনো পরিচয় ছিল না। তবে পার্টিতে দেখেছি আগেও।”

“প্রফেসার মাইতিকে চিনতেন?”

“প্রথম পরিচয়। দেখিনি আগে কখনো। নামও শুনিনি।” ঝনক দু হাতে মাথা টিপে ধরে।

“এদের সবার মধ্যে কিছু তো একটা কমন ছিল। যেটা হয়তো আমাদের সঙ্গেও কমন। আর না হলে খুনি সাইকো। সেলেব্রিটিদের সঙ্গে সবাইকে মারতে চায়। তবে এত ঝুঁকি না নিয়ে খাবারে বিষ দিলে সবাই এক সঙ্গে মরত। ফুড পয়জনিং এর কেস হত। দোষী ধরা পড়ত না। কিম্বা দুর্ঘটনা, আমাদের সবাইকে একটা গাড়িতে তুলে খাদে ফেলে দিত। তাও করল না। নিমন্ত্রণ করে এই নির্জন রিসর্টে এনে একে একে মারছে! কারণ তো একটা কিছু আছে। নেটটা নেই। তথ্য পাচ্ছি না তাই। সবার অতীতে হানা দিতে হবে। খুনি লুকিয়ে আছে আমাদের এই কয়জনের ভেতরেই। আমি আর সাহানা আসার আগেই প্রথম খুন হয়। আপনাদেরকে আমাদের একটা পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন। আমি একজন আইবি অফিসার ছিলাম। কাজ ছেড়ে নিজেদের ইনভেস্টিগেশন ফার্ম খুলেছি। আমরাও কনটেষ্ট জিতে এই অফারটা পেয়েছিলাম ছুটি কাটাবার। এবার বলুন তো আপনাদের ব্যক্তিগত শত্রুরা কারা এবং কী ধরনের?” আলোক একটানা বলে সবার দিকে তাকায়। অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব নিয়েই ওর পড়াশোনা। অভিব্যক্তি চোখের চাহনি গলার স্বরের তারতম্য দিয়েও ও অপরাধীকে ধরতে পারে।

“আমি ডাক্তার, পেশেন্ট মরে গেলে তার বাড়ির লোক আমায় শত্রু ভাবত। তেমন শত্রু অবশ্য কেউ নেই। একাই থাকি, এখন আর তেমন প্র্যাকটিস করি না। কলকাতাতে বাড়ি।”

“আমি একটা আ্যড এজেন্সি চালাই, কাঁকন আমার সঙ্গেই কাজ করে। দু বছর হল বিয়ে করেছি। আ্যডের দুনিয়ায় টুকটাক শত্রু তো আছেই।” রাজিত বলে ওঠে।

“আমি আইটি সেক্টরে আছি, নিজের ব্যবসা, কয়েকটা বড় কোম্পানিতে সফটওয়্যার সাপোর্ট দেই। এই লাইনে প্রচুর প্রতিদ্বন্দ্বী আছে, কিন্তু খুন করার মত কেউ নেই। পুরানো শত্রুও তেমন কেউ নেই।” সোম বলে।

“আমি এক সাধারণ গৃহবধূ। সোমকে ভালবেসে বিয়ে করার সময় দু একজন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল, তাই বলে খুন... না , না । তেমন কেউ নেই। সোমও খুব ভালো।” কেঁদে ফেলে নিতা।

“এই চাকরি সবে পেয়েছি, পনেরো দিন হবে। তার আগে গোয়াতে ছিলাম, সিকিমে ছিলাম। বাড়ি শিলিগুড়িতে। এই আ্যডটা দেখে যোগাযোগ করেছিলাম। মালকিন সব আমার হাতেই ছেড়েছিলেন। ওনার মেয়ে অসুস্থ, মেয়ের নামেই ব্যবসা। উনি মেয়ে নিয়ে একাই থাকেন। দু বার দেখেছি। ফোনেই কথা হয়। এর বেশি জানি না আর। আমি আমার মত করে সব সাজিয়েছি এখানে। অবশ্য স্টাফ সব ম‍্যাডামের। গেস্ট লিস্টও উনি দিয়েছিলেন।”

“তার মানে উনিই আসল লোক। কাল সকালেই ওনার খোঁজে যাবো। আপাতত রাতটুকু সবাই এখানে একসঙ্গে কাটাবো। আর কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। তবে ওঁর ব্যক্তিগত শত্রু কেউ থাকতে পারে যে ওঁদের ব্যবসাকে বদনাম করতে চাইছে।” আলোক বলে।

বাইরে হঠাৎ বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টি নামে। এ যেন এক মহা প্রলয়। আকাশ ভেঙ্গে পড়বে মনে হচ্ছে। পাথরের কোঠা বাড়ি তাসের ঘরের মত কেঁপে কেঁপে উঠছে মুহূর্তে মুহূর্তে। চারদিকে জলের আওয়াজ। আলোক জানে পাহাড়ে বৃষ্টি হলেই নিত্য নতুন ঝরনা তৈরি হয়। কাঁচের বড় জানালা দিয়ে প্রকৃতির রুদ্ররূপ দেখতে দেখতে ও ভাবছিল এবার কার পালা?

অভিশপ্ত রাতটা শেষ হলেও ওদের জন্য বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। সকালে জানা গেল রাতের তাণ্ডবে তিন কিলোমিটার আগের কাঠের ব্রিজটা ভেঙ্গে পড়েছে। আপাতত সবাই এখানে বন্দী। দুজন ড্রাইভার হাঁটা পথে পুলিশ চৌকির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল সকালেই।

“এভাবে তিনটে মৃতদেহর সঙ্গে আমাদের কতক্ষণ থাকতে হবে?” ঝনকের গলার আওয়াজে নড়ে বসে আলোক। বলে, “অন্য কোনও উপায় আছে কি ম‍্যাডাম? অবশ্য মৃতদেহর থেকেও ভয়ঙ্কর একটি সাইকো খুনি রয়েছে এখানে। সেটা ভাবুন!”

জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওকে দেখতে দেখতে ঝনক বারান্দায় বেরিয়ে যায়। একটা পটে লাল চা আর কুকিজ সাজাতে ব্যস্ত ভত্রা। অন্য ড্রাইভার ছেলেটা ওকে সাহায্য করছে। জলখাবারের ব্রেড ডিম সেদ্ধ হচ্ছে কিচেনে। যদিও খাওয়ায় মন নেই কারোর।

সাহানা বহুক্ষণ ধরে ফোনে নেটওয়ার্ক খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। লাইন পেয়েছে। ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে আলোক প্রথমেই কলকাতায় ফোন করে। এত বড় ঘটনা প্রথমেই গোয়েন্দা বিভাগে জানানো প্রয়োজন। এই জায়গাটা বেঙ্গল পুলিশের আওতায়। হয়তো এখনি এসে পড়বে তারা। কিন্তু এ গভীর ষড়যন্ত্রর জাল বোনা হয়েছে অন্য কোথাও বসে। আপাতত মিসেস পাইন ও তার মেয়েকে দরকার। দরকার প্রচুর ইনফরমেশন।

কিন্তু হঠাৎ আবার চিৎকার, এবং এ বার সোমকে লুটিয়ে পড়তে দেখে ছুটে গেছিল আলোক। সোম একটা কলা খাচ্ছিল। কয়েক কামড় খেয়েই লুটিয়ে পড়েছিল বারান্দায়।

“আবার বিষ। এবার কলায়।” ওর ঠোঁটটা লক্ষ করে আলোক বলল, “সায়ানাইড।”

একটু খুঁজতেই সিরিঞ্জটা পাওয়া গেল বাথরুমের পাশের বাস্কেটে। একটা টিস্যু দিয়ে জড়িয়ে ফেলেছিল কেউ। আলোক জানে হাতের ছাপ থাকবে না। কিন্তু কে? আর কেন?

নিতা পাথরের মত বসে ছিল। থেকে থেকেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। সাহানা ওকে সামলাতেই ব্যস্ত। খিদা পেলেও খাবারের দিকে যাচ্ছে না কেউ। সবাই সবাইকে সন্দেহ করছে।

“কলাটা আমিই খাবো বলে নিয়েছিলাম। উনি বললেন ফল তো সেফ নিশ্চই। আমিই এগিয়ে দিলাম। আরেকটা কলা আনতে টেবিলের দিকে যাচ্ছিলাম। চা এসেছে দেখে ভাবলাম আগে চা খাই। না হলে হয়তো এতক্ষণে আমি...”, ডঃ বৈদ্য আপন মনেই বললেন। মৃত্যুকে এত সামনে থেকে বোধহয় আর কেউ দেখেনি। বছর শেষের সুন্দর ঝকঝকে দিনটি কেমন রহস্যঘেরা মৃত‍্যুদূতের মত এসে উপস্থিত সকলের কাছে। নেটওয়ার্ক আবার চলে গেছে। জানা গেছে মিসেস পাইন মেয়ে নিয়ে কোথায় গেছেন কেউ জানে না।

নিতা একটু সামলেছে, ও কাঁকন আর ঝনক বারান্দায় বসে ছিল। আলোককে লনের টি টেবিলে একা বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে সাহানা, বলে, “ভয়ে কেউ জলও খাচ্ছে না, এভাবে আমরা এমনিই মারা পড়বো। খিদায় মাথা কাজ করছে না আর।”

আলোক নিজের ব‍্যাগপ‍্যাক থেকে রাস্তাতে কেনা একটা সিল্ড জলের বোতল ও কেকের প্যাকেট বের করে এগিয়ে দেয় নিজের অর্ধাঙ্গিনীর দিকে। ভয়ে ভয়ে কেক খুলে মুখে দেয় সাহানা। একটা স্লাইস আলোকের মুখে গুঁজে দেয়।

নিতা দূর থেকে তাকিয়ে ছিল ওদের দিকে। হঠাৎ জোরে পাগলের মত বলে ওঠে, “আমি বোধহয় বুঝতে পেরেছি। কে করছে এসব। এসব আমাদের পাপের ফল। কিন্তু সে তো... না, না, পত্রালী তো মরে গেছে বহু আগে। কে ওর হয়ে প্রতিশোধ নেবে?”

“কে পত্রালী?” আলোক খাওয়া থামিয়ে নিতার সামনে এসে দাঁড়ায়।

“সোমের প্রিয় বান্ধবী। ছোটবেলার বন্ধু। একটু সাইকো ছিল। সোমকে ভীষণ ভালোবাসতো। ওর পড়ার পেছনে অনেক খরচ করেছিল মেয়েটা। বড় লোকের মেয়ে ছিল, বাবা মা মারা গেছিল কলেজে থাকতেই। সোম একটা সময় অতিষ্ঠ হয়ে পালিয়ে যেতে চাইছিল। আসলে ওর ভালোবাসার অত্যাচার... এই যে তোমায় ও কেক খাওয়াল... জল খাওয়াল... সোম পড়াশোনা করত। ও এভাবে বসে খাওয়াত। সব সময় চোখে চোখে রাখত। কিন্তু সোম পারেনি ঐ সম্পর্ক বয়ে বেড়াতে।”

“তার জন্য এভাবে খুন?” সাহানা অবাক হয়ে বলে।

“ও যে কেমন মেয়ে ছিল... মানসিক রুগী একটা! শেষের দিকে পাথরের মত তাকিয়ে থাকত শুধু। কখনো প্রশ্ন করত না। আর সোম ওকে দেখিয়ে আমার সঙ্গে সময় কাটাত। ওকে রাগাত।”

“তারপর...?”

“আমরা বিয়ে করার আগে শুনেছিলাম ও পাগল হয়ে গেছে। মানসিক হাসপাতালে আছে। তারপর গতবছর শুনেছিলাম হাসপাতালে আগুন লেগে মারা যায়।” নিতা চুপ করে যায়।

সাহানা হঠাৎ বলে, “আচ্ছা কয়েক বছর আগে একটা মেয়ে এসেছিল না আমাদের কাছে, পত্রালী কিনা মনে নেই। তখন আলোক আমাদের নতুন অফিস। ও ওর বয়ফ্রেন্ডের সম্পর্কে ইনভেস্টিগেশন করাতে চায় বলেছিল। ও নাকি পড়ার খরচ দিত বলেছিল। আমরা ঐ সব কাজ করি না বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। মনে পড়ছে একটু একটু।”

“হ্যাঁ, শ্যামলা করে লম্বা মত মেয়েটা। বাবা মা কেউ নেই বলেছিল। নামটা কী যেন... আসলে ঐ বয়ফ্রেন্ডকে ফলো করতে হবে শুনেই ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই রাগে আমাদের মারবে বলে ডেকে এনেছে এটা জমল না ঠিক। কাকতালীয় হলেও হতে পারে। কিন্তু এর জন্য খুন!”

“সাইকোরা অনেক কিছুই পারে। ওদের আণ্ডার এস্টিমেট করবেন না। পত্র আমার দূর সম্পর্কের বোন! ও সাইকো ছিল! শত্রু? কী জানি? ও হয়তো আমাদের শত্রু ভাবত। তবে ও তো নেই আজ একবছর হল। ওদের হাসপাতালে আগুন লেগেছিল।” রাজিত এগিয়ে আসে।

“ওয়েট, ওয়েট, আমিও এবার বুঝতে পারছি। পত্রালী রায়। আমার পেশেন্ট ছিল কিছুদিন। আস্তে আস্তে পুরো অবাস্তব জগতে চলে যাচ্ছিল। আমিই ওকে আরও ভালো সাইকো ডাক্তার দেখাতে বলেছিলাম। শিলিগুড়ির একটা ভালো হোমে পাঠিয়েছিলাম। বছর খানেক আগে বোধহয় দেখেছিলাম শেষ।" ডঃ বৈদ্য একটা রুমাল বার করে মুখ মোছেন।

“তাহলে এতক্ষণে আমরা একটা অদৃশ্য শত্রুর অবয়ব পেলাম। কয়েকজনের সঙ্গে এই মেয়েটার পরিচয় ছিল।” আলোক বলে।

(৪)

“পত্রালী রায়, ২০১৪র সুরের সাগরের সেকেন্ড রানার আপ। আমি উইনর, তারপর গান ছেড়ে অভিনয়ে ঝুঁকেছিল। বোধহয় জিনিয়ার সঙ্গে ঐ অভিনয় নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল দু বছর আগে। ভুলও হতে পারে আমার। সাইকো ছিল শুনেছিলাম।” ঝনক আস্তে আস্তে বলে।

“প্রফেসার মাইতির নামটা ভীষণ শোনা লেগেছিল। একসময় ওনার আণ্ডারে পিএইচডি করতে গেছিল পত্র। কিন্তু হঠাৎ সব ছেড়ে দেয়। আর হিতাংশুর সঙ্গে অভিনয়ের ব্যাপারে যোগাযোগ ছিল। দুটো পার্টিতে ওদের খুব ঘনিষ্ঠ দেখেছিলাম। হিতাংশুর একটা প্রোজেক্টের আ্যডে পত্র ছিল সে সময়। আমি ভাবতেও পারছি না।” রাজিত বলে ধীরে ধীরে।

“অর্থাৎ পত্রালীর ভূত আমাদের এখানে টেনে এনেছে। ডিসগাস্টিং। যা তা। মেয়েটা মরে গেছে বলছেন আপনারা। তাহলে...” কাঁকন চেঁচিয়ে ওঠে।

“ওর হয়ে কেউ বদলা নিচ্ছে।” সাহানা বলে ওঠে।

“ওর কেউ ছিল না। ও মারা যেতেই ওর সম্পত্তি পেয়েছিল রাজিত।” আচমকা বলেই চুপ করে যায় কাঁকন। বেফাঁস মন্তব্য করে ফেলেছে বুঝতেই পারে।

“তাহলে রাজিতবাবু পেয়েছিল সেই অগাধ সম্পত্তি।” একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বলে আলোক।

“ওতে আমার কোনও হাত নেই। ও আমার খুড়তুত বোন ছিল। ও মারা যেতে সম্পত্তি আমার হয়েছে নিয়মমত। খোঁজ নিতে পারেন। তাছাড়া ও মানসিক হাসপাতালে ছিল। সেখানে আগুন লেগে মারা যায়।” রাজিত বলে ওঠে।

“ঠিক কী ভাবে হয়েছিল ওর মৃত্যুটা?”

“শিলিগুড়ির কাছে বাউল মন বলে একটা মানসিক রুগীদের হোম ছিল। খুব ভালো ব্যবস্থা। ও ঠিক পাগল ছিল না। একাকিত্বে ভুগছিল। সেরে উঠছিল ধীরে ধীরে। হঠাৎ গত শীতে ফায়ার প্লেস থেকে আগুন লেগে প্রায় তিন জন আবাসিক মারা যায়। দেহগুলো ঝলসে কয়লা হয়ে গেছিল। আমিই এসেছিলাম সে সময়। ঐ রুমের কেউ বাঁচেনি। ঐ হোমটাও বন্ধ হয়ে যায় এরপর।” রাজিত অসহায় চোখে তাকায় সবার দিকে।

“কিন্তু তাহলে এই বদলা কে নিচ্ছে? কেনই বা নিচ্ছে? কিছুই বুঝতে পারছি না। দুপুর হতে চলল। পুলিশ কোথায়?” আলোকের আর ভালো লাগছিল না।

এমন সময় গেট ঠেলে দুজন পুলিশ অফিসার, দুজন মহিলা পুলিশ আর গোটা ছয়েক কনস্টেবল এলো ভেতরে। পেছনে ড্রাইভার দুজন। সবাই উশখুশ করছিল বাড়ি ফেরার জন্য। জানা গেল ব্রিজ ঠিক হয়নি। পুলিশ ওপারে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে এসেছে।

রুটিন মাফিক সবার বয়ান নিলো অফিসার। ফটো তুলে বডিগুলো বাঁশের মাচাতে তুলে নিয়ে গেলো পুলিশের লোক। ওপারে গাড়ি রয়েছে। পোস্টমর্টমে পাঠাতে হবে। তবে এখানে ফরেনসিকের কেউ আসেনি। কলকাতা থেকে ফোন এসেছিল বলে অফিসার দুজনেই বেশ তৎপর। তাছাড়া আলোকের নাম ওরা আগেও শুনেছে। আলোক পত্রালীর ব্যাপারটা খুলে বলল ওদের। মিসেস পাইনের কথাও বলল।

হঠাৎ আবার একটা প্রবল চিৎকারে সবাই ছুটে গেল ওধারে ঝনকের কটেজের কাছে। খোলা দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঝনক উল্টে পড়ে রয়েছে ওর ঘরের ভেতর। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও স্বাভাবিক নয়।

কাঁকন আর রাজিত নিজেদের কটেজে ঢুকতে গিয়ে দৃশ্যটা দেখে। চিৎকার করেছিল কাঁকন।

ঘরে ঢুকে দেখা গেল একটা ভোজালি আমূলে বেঁধানো ঝনকের কাঁধে, ঘাড় থেকে মাথা ঝুলে পড়েছে প্রায়। ওর সাদা সোয়েটার রক্তে লাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়েছে ঘটনাটা। চিৎকার করার সময় পায়নি মেয়েটা।

অফিসার দুজন হতভম্ব। ওদের স্যাটেলাইট ফোন থেকে জেলা সদরে যোগাযোগ করল ওরা। আরও লোক পাঠাতে বলল। প্রয়োজনে মিলিটারিরা যেন বাকি পর্যটকদের উদ্ধার করে সদরে নিয়ে যায় তাও উল্লেখ করল। পুরো রিসর্ট জুড়ে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। খিদা তেষ্টা বোধ আগেই উড়ে গেছিল। এখন সবাই সবাইকে সন্দেহ করে চলেছে। রাঁধুনে পুলিশ দেখেই পালিয়ে যেতে চাইছে নিজের গ্রামে। সহকারী ছোট ছেলে দুটোও পালাতে পারলে বাঁচে। ডঃ বৈদ্য, রাজিত, কাঁকন, নিতা সবাই বারান্দায়। সাহানা আর আলোক অফিসারদের সঙ্গে আলোচনায় মগ্ন।

ভত্রাকে ওদিকে আসতে দেখে হঠাৎ আলোক বলে, “আসুন ভত্রাজি। বলে ফেলুন তো পত্রালীকে কী করে চিনতেন?”

“ক… কে পত্রালী? আমি তো ঠিক...!” ঢোক গেলে ভত্রা।

“সবাই চিনত। আপনিও চিনতেন। মনে করুন একটু কষ্ট করে।” আলোক বলে।

“না , আমি ঠিক...” তোতলাতে থাকে ভত্রা।

“আলবত চিনতেন। বলুন বলুন। নয়ত কয়েক ঘণ্টার ভেতর আপনার সব খবর পেয়ে যাবো আমি। তখন আর কেউ বাঁচাবে না।”

আলোকের এই ধমক খুব কম লোক খেয়েছে। অপরাধীদের মানসিকতা বিচার করে ও জানে ঠিক কী ধরনের চাপে ওরা ভেঙ্গে পড়ে।

“ সিকিমেই পরিচয়। আমার হোটেলে এসেছিল। ম‍্যাডামজি একা ঘুরত। কয়েকবার এসেছিল। এতটুকুই।” ও কেঁদে ফেলে।

“আপনার সঙ্গে শত্রুতা নেই বলছেন। তার মানে আপনি খুন হবেন না। স্ট্রেঞ্জ।”

“ না, মানে... ঐ আমি চিনতাম আরকী। তবে রাগ ছিল ওঁর আমার ওপরেও। আমায় এমন একটা রিসর্টের দায়িত্ব নিতে বলেছিল দেড় বছর আগে। উনি রিসর্ট দেখতে নিয়ে গেছিলেন উত্তরের কাছে একটা গ্রামে। আমি সে সময় ওনার কাজটা করিনি। ম‍্যাডাম একটু কেমন যেন ছিল।”

“এই কাজটা কী করে পেয়েছিলেন?”

“আ্যড এসেছিল। আমার এক বন্ধু দেখিয়েছিল।”

“বন্ধুর নাম কী, সে কী করে?”

আবার চোখ মুখ মোছে ভত্রা, তারপর বলে, “ড্রাইভার বাহাদুর বলেছিল। ও আমার বন্ধু।” ত‍্যাগবাহাদুর মেনে নেয়।

অফিসার দু জন বলে আপাতত সবাইকে শিলিগুড়ি সদরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মিসেস পাইনের খোঁজ চলছে। এই রিসর্ট সিল করে দিচ্ছে পুলিশ। ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছিল বাইরে। দুপুরের পর পাহাড়ে হঠাৎ হঠাৎ আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেলো। শেষ বডিটাও পাঠিয়ে দিয়েছিল ওরা গাড়ির দিকে। আলোক তারা দিচ্ছিল। কিন্তু নিচের দিকে নাকি বৃষ্টি হচ্ছে। হেলিকপ্টার আসতেই পারছে না আর।

অবশেষে বিকেল চারটায় ঠিক হল পায়ে হেঁটেই ওরা ব্রিজ অবধি যাবে। ব্রিজ পার করে গাড়িতে শিলিগুড়ি যাবে। কিন্তু আততায়ীর বোধহয় এত সহজে ওদের বিদায় দিতে রাজি ছিল না। জানা গেল ধ্বসে রাস্তা বন্ধ হয়ে আছে। সুতরাং গাড়ি নিয়েও এগোনো যাবে না।

মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আগে কখনো দেখেনি সাহানা। আলোকের সঙ্গে বড় বড় অপরাধীর সামনে দাঁড়িয়েও এমন ভয় ও পায়নি এর আগে। সবাই হল ঘরে বসেছিল। আলোক নিজে উঠে গিয়ে একবার চা বানিয়ে এনেছে। প্যাকেট খুলে বিস্কুট দিয়েছে সবাইকে। ভয়ে ভয়ে সেই চা খেয়েছে সকলে। জেনারেটরের তেল ফুরিয়ে গেছে। কয়েকটা কাঁপা কাঁপা মোমবাতি ভরসা। অবশ্য অফিসার দুজন ও তিনটে কনস্টেবল থেকে গেছে রাতের জন্য। কনস্টেবলরা রাতে খিচুরি রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে। বাকিদের কিচেনে যাওয়া বারণ। বিশেষ করে রাঁধুনে, হেল্পার, ভত্রা বা ড্রাইভার তিন জনকে আর কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। ওরা মুখ কালো করে হলের কোণায় বসে রয়েছে।

নিতা দুপুরের পর থেকে আর একটাও কথা বলছে না। ওর চোখের জল শুকিয়ে গেছে। পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে মেয়েটা। বাইরে বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। হঠাৎ নিতা হাসতে শুরু করে। হাসতে হাসতে বলে, “একটা মৃত মেয়ের ভয়ে আধমরা আমরা। সত্যি! কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে পার্থক্যটা কেউ ধরতে পারছে না। কেন মারবে আমাদের পত্রালী? কী করেছি আমরা? ঝনক বা জিনিয়া ওর প্রতিদ্বন্দ্বী হতেই পারে। হিতাংশু ওকে ঠকাতে পারে, রাজিত ওর সম্পত্তি নিয়েছে, মাইতি রিসার্চের সময় ওকে বিরক্ত করত আমিও শুনেছিলাম। কিন্তু আমরা বাকিরা কী করেছি। সোম আমায় ভালোবেসে ওকে ভুলে বিয়ে করেছিল। কাঁকনের কোনও দোষ নেই রাজিতের স্ত্রী হওয়া ছাড়া। ডাঃ বৈদ্যর কী দোষ বলুন ডাক্তারবাবু? আমরাও শুনি একটু। আপনি কী করেছিলেন ওর সঙ্গে? আর আপনারা ওর কেস নেননি তাই তো? এগুলো কারণ হতে পারে না। আমরা ভুল করছি। আমরা অনেকেই ওকে শিখণ্ডী বানিয়ে নিজেদের কোনও কাজ হাসিল করছি বোধহয়। একটু অন্যভাবে ভাবুন একবার। এত মৃত্যুতে কার কী লাভ? কে ঘটাচ্ছে এসব?” হাসতে হাসতে ক্লান্ত হয়ে চোখ বোঁজে মেয়েটা। মোমের আলোয় ওর আলুথালু বেশ আর অসংলগ্ন কথায় ওকে অপ্রকৃতস্থ মনে হচ্ছিল।

সাহানার মনে হয় এই মেয়েটাই সাইকো নয় তো। প্রতিটা খুনের সময় ও সামনে ছিল। মাইতিকে চিনত এখন বলছে। আর কাকে কাকে চিনত কে জানে?

(৫)

গরম গরম খিচুরির গামলা নিয়ে এসেছিল পুলিশের লোক। অফিসার দুজন দাঁড়িয়ে থেকে সবাইকে খাওয়াল। ভয়ে ভয়ে ঐ রানিং খিচুরি প্রায় সবাই খেয়ে নিলো। না, আর কিছুই হয়নি নতুন করে।

খাওয়ার পর আলোক ডাক্তার বৈদ্যকে বলল, “আপনার সঙ্গে শত্রুতার কারণটা একটু খুলে বলা যাবে কি?”

“আমি ওর ডাক্তার ছিলাম। ও প্রথম প্রথম ডিল‍্যুশন আর ইনসমনিয়ায় ভুগত। তারপর এলো হ‍্যালুশিনেশন। ও একাকীত্বে ভুগত। তাই কল্পনার জগতে থাকত, ভালবাসতে চাইত। আঁকড়ে ধরতে চাইত। কিন্তু সবাই ছিটকে যেত। ওর প্রেমিক পালিয়ে বেঁচেছিল। আমি ওর কথা না মানলেই ও আমায় শত্রু ভাবত। ও একা থাকত বলে দিন দিন ওর রোগ বাড়ছিল। বাউল মনের খবর আমিই দিয়েছিলাম। ও যাবে বলেছিল। এখন এই ধরনের মেয়েরা তো নিজেদের একটা আলাদা দুনিয়া তৈরি করে নেয়, ও তেমন একটা দুনিয়াতে থাকত। ওখানে কে ওর শত্রু আর কে আপন ও নিজেই ঠিক জানত না। এখানে এসে আপনাদের বিশ্লেষণে জানলাম আমি ওর শত্রু।”

“আমি তো ওর কোনও ক্ষতি করিনি কখনো। দেখা হয়েছে সাকুল্যে আট দশ বার। মিষ্টি ব্যবহার করেছি সব সময়।” কাঁকনের উত্তর শুনে রাজিত রুমাল দিয়ে মুখ মোছে। বলে”ও তো বহুদিন থেকে ভুগছিল। শেষ বছরটা তো হোমেই ছিল, মরেই গেল গত বছর। কাঁকনের সঙ্গে দেখা কম হত তাই।”

“আপনাদের লাভ ম‍্যারেজ? কত দিনের?” সাহানা প্রশ্ন করে।

পাশের টেবিল থেকে একটা আধ খাওয়া জলের বোতল টেনে নেয় রাজিত। ঢকঢক করে বেশ কিছুটা জল খায়। হঠাৎ বোতলটা ছিটকে পড়ে, দুবার কেঁপেই স্থির হয়ে যায় রাজিত।

কাঁকন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। সবাইকে খাইয়ে অফিসার দুজন খাচ্ছিল। খাওয়া ফেলেই ছুটে এসেছিল ওরা।

“জলে সায়ানাইড, অর্ধেকের কম জল ছিল বোতলে। আমাদের মধ্যে কেউ মিশিয়েছে বিষটা।” আলোক প্রবল আক্রোশে নিজের বাঁহাতে ঘুসিটা মারে। ভত্রা বা ওর ড্রাইভাররা ভয়ে কাঁপছে। জলের বোতলগুলো ওদের একদম সামনে ছিল।

নিতা হাসতে থাকে পাগলের মত, বলে ওঠে, “কেউ বাঁচবে না, কেউ না।”

“বাকি থাকলাম আমরা এই ছ জন। আমাদের মধ্যেই কেউ...” নিতার অট্টহাস্য ছাপিয়ে কাঁকন বলে ভয়ার্ত কণ্ঠে। ও কাঁদতেও ভুলে গেছে যেন।

পুলিশ অফিসার ভার্মা ফোনে সব জানায় আবার, তারপর বলে সবাইকে একসঙ্গে হলে বসে রাত কাটাতে। নিতা হেসেই চলেছে। মাঝে মাঝে বলছে –“পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে, সবাই মরবে। কেউ বাঁচবে না আর।"

ডঃ বৈদ্য কাঁকনের হাতে একটা ওষুধ দিয়ে বলে, “এটা ওঁকে খাইয়ে একটু শুইয়ে দিন, ওঁর একটা ঘুম দরকার।” কাঁকন ওষুধটা টেবিলে রেখে বলে –“জলেও তো বিষ! কী হবে আর ঘুমিয়ে, আর কে কে মারা যাবে কে জানে! রাতটা কাটলে হয়।”

সবাই হলে বসেছিল, ঘুম পেলেও ভয় সবাইকে ঘিরে ধরেছে। হঠাৎ ডঃ বৈদ্য উঠে পড়লেন।

বললেন, “না, আমি ঘরে ঘুমাতে যাচ্ছি। আর পারছি না এই চাপ নিতে, হয়তো ওখানেই শেষ হয়ে যাবো, ছুরি, ভোজালি, বিষ সব আয়োজন রয়েছে। বেঁচে থাকলে কাল দেখা হবে।”

“দাঁড়ান ডাক্তারবাবু। আপনার সঙ্গে কথা ছিল।” আলোক পথ আটকায়। বলে, “আপনার অতীতটা জানতে চাই। কী করতেন, কোথায় বাড়ি, এখন কোথায় আছেন?”

“আমি সামান্য ডাক্তার। কলকাতায় প্র্যাকটিস করতাম। বিয়ে করেছিলাম। আমার বৌ ডাক্তার ছিল। মেয়েকে নিয়ে আমায় ছেড়ে বিদেশে চলে গেছিল। এই তো গল্প। আপাতত একটা চ্যারিটেবল হাসপাতালে রুগী দেখি। হঠাৎ করে এই ঘুরতে আসার অফারটা পাই। এসেছিলাম আনন্দ করতে।” উনি উঠে দাঁড়ালেন।

“আপনার স্ত্রী মেয়ে এখন কোথায়?”

“যোগাযোগ নেই তেমন। এ দেশেই আছে ।”

“নামটা...”

“আমার ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে। আসছি ভাই। বেঁচে থাকলে নতুন বছরে আবার কথা হবে।” ডঃ বৈদ্য এগিয়ে গেলেন নিজের ঘরের দিকে। আলোক ঘড়িতে দেখল রাত সাড়ে দশটা।

পুলিশ অফিসার ভার্মার স্যাটেলাইট ফোনে রাত সাড়ে এগারোটায় খবর এসেছিল আলোকের জন্য। দুপুরেই কিছু খোঁজ করতে বলেছিল গোয়েন্দা দপ্তরের এক বন্ধুকে। কয়েকজনের অতীত ও বর্তমান জেনে একটা কিছু খুঁজতে চাইছিল আলোক। ফোনে কথা বলতে বলতে চমকে উঠছিল আলোক।

হঠাৎ ফোনটা ফেলে ছুটে গিয়ে নিতাকে ধাক্কা দিল আলোক। ডঃ বৈদ্যর দেওয়া ওষুধটা পাশের ঘরের টেবিল থেকে নিয়ে কাঁকন ওকে বলেছিল ওটা খেয়ে সোফাতে একটু শুয়ে নিতে। নিতা ওষুধটা খাচ্ছিল সাহানাও দেখেছিল, কাঁকন সঙ্গেই ছিল। কিন্তু আলোক ধরতে ধরতে ও লুটিয়ে পড়ল নিচে। ওর ঠোঁটটা শুঁকে আলোক বলল, “প্রুসিক অ্যাসিড। শিট... এটা তো ডঃ বৈদ্য দেননি মনে হয়।”

অফিসার ভার্মা আর প্রধান ছুটে এসেছিল। কিন্তু প্রুসিক অ্যাসিড ভীষণ দ্রুত কাজ করে। সেকেন্ডের ভগ্নাংশের ভেতর বন্ধ হয় হৃদযন্ত্র।

“ডঃ বৈদ্যকে এখনি ডেকে আনুন। কুইক অফিসার।”

নিতার শরীরটা সোজা করতে করতে আলোক চিৎকার করে ওঠে। সাহানা নিতার বুকে চাপ দিয়ে দেখছিল, যদি কৃত্রিম ভাবে পাম্প করে কিছু হয়... নিচু হয়ে ওর মুখে বাতাস সরবরাহ করতে ঝুঁকতেই আলোক ওকে টেনে ধরে। বলে, “পাগল নাকি, প্রুসিক অ্যাসিড ও সায়ানাইড। ওর ঠোঁটে এখনো লেগে রয়েছে।”

ছিটকে সরে যায় সাহানা।

কাঁকন কাঁপছিল থরথর করে। বলে, “কেউ কি আর বাঁচবে না? আমি এবার পাগল হয়ে যাবো বোধহয়। ডঃ বৈদ্য দিলেন ওটা, সবাই দেখেছিল।” সাহানা ওর পাশে এসে বসে।

আলোক রাংতার মোড়কটা তুলে বলল –“এটাই কি উনি দিয়েছিলেন! স্ট্রেঞ্জ!”

“ডঃ বৈদ্য দরওয়াজা নেহি খোল রহা হ‍্যায় সার।” ড্রাইভার ত্যাগবাহাদুরের কথায় প্রধান আর আলোক উঠে পড়ে।

ভত্রাকে বলে, “চলুন দেখি, চাবি দিয়ে খোলা যায় কিনা? না হলে ভাঙতে হবে।”

“মানে... ডঃ বৈদ্য... উনিও...” ভত্রার দুচোখে বিস্ময়।

সবাই ছুটে যায় ওনার ঘরের সামনে। চাবি দিয়েই খুলে যায় দরজা। ঘুমিয়ে রয়েছেন ডঃ বৈদ্য। চির নিদ্রায় শায়িত, মুখে লেগে রয়েছে পরিতৃপ্তির হাসি। আলোক ধপ করে বসে পড়ে একটা সোফায়। সাহানা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে।

“বাকি আমরা এই কয়জন!” নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কাঁকনের গলার স্বর।

“না, আর কেউ মনে হয় না মরবে। গেম ওভার। আপনি খেলার বাইরে ছিলেন। দর্শক। আর আমরা রেফারি।” আলোক ধীরে ধীরে বলে।

“মানে?”

“একটু সময়ের গণ্ডগোলে দুজনে চলে গেলো। আমার বোকামিতেই এটা হল। অন্তত ডঃ বৈদ্যকে আটকাতেই পারতাম।” আলোকের গলায় আফসোসের সুর।

“এটা কি আত্মহত‍্যা?” অফিসার প্রধান বলেন।

আলোক ডঃ বৈদ্যর খাটের পাশে রিডিং টেবিল থেকে একটা ডাইরি তুলে নেয়। ভেলভেটে বাঁধানো ডাইরির প্রথম পাতায় ঝকঝক করছে একটা নাম, পত্রালিকে ডাঃ বৈদ্য। আস্তে আস্তে পাতা উল্টায় আলোক, ঠিক দিন লিপি নয়, অনেকটা জীবনীর মতো করে লেখা। মুক্তার মত হাতের লেখায় ফুটে উঠেছে এক মনোরোগীর উপাখ্যান। তার জীবনের কথা।

“ডঃ বৈদ্য কি এতগুলো খুন করলেন? কিন্তু মোটিভটা কী?” অফিসার ভার্মা প্রশ্ন করেন।

“উত্তর রয়েছে এই ডাইরির পাতায়। এটাই আসল ক্লু, সব লেখা আছে এতে। কিন্তু...” আলোক ডাইরির পাতা উল্টায়।

বহুদূরের পাহাড়ে বাজি ফাটার আওয়াজ ভেসে আসে। একটা বছর শেষ হল, শুরু হল নতুন বছর। তাকে বরণ করে নেওয়া হচ্ছে বাজি ফাটিয়ে, পাহাড়ে পাহাড়ে সেই উৎসবের অনুরণন। আলোক পত্রালীর ডাইরিটা নিয়ে বসে টেবিলে। বছর শেষে শেষ হল এক মৃত্যু মিছিল। কিন্তু কেন এত মৃত্যু?

(৬)

শিলিগুড়িতে পুলিশের সদর দপ্তরে বসেছিল সবাই। নতুন বছরের প্রথম দিন সকালে সবাইকে হেলিকপ্টারে করে নামিয়ে আনা হয়েছে। অবশ্য জীবিত ফিরেছে মাত্র কয়েকজন। বাকিরা বডি হয়ে মর্গে চলে গেছে। ভত্রা আর কাঁকন যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

সারা রাত ডাইরি পড়ে আলোকের চোখ লাল। এক রাউন্ড চা খেয়ে ও বলল, “পত্রালী রায়, একটা মিষ্টি মেয়ে। কিন্তু খুব দুঃখী। খুব ছোটবেলা মাকে হারিয়েছিল। তারপর বাবাকে। সম্পত্তি ছিল। অভিভাবক ছিল না। এক জেঠুর ছেলে ছিল। পত্রালী জীবনে প্রথম ভালবেসেছিল এই দাদাকে। নির্ভর করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওর দাদা সে সুযোগ নিয়েছিল। শুধু টাকা নয় ওর কিশোরী মন ও শরীর নিয়েও খেলেছিল রাজিত।”

“আপনি আমার মৃত স্বামীর নামে যা তা বলছেন। রাজিত ওকে ছোট বোনের মত ভালোবাসতো...” কাঁকন রেগে গিয়ে চিৎকার করে ওঠে।

“আমি নয় ম‍্যাডাম। এই ডাইরি বলছে। ডাইরি ভুল বলবে না। এটা পত্রালীর জীবনী। চুপ করে বসুন আপনি। ও লিখেছে রাজিতের সঙ্গে ওর সম্পর্কর কথা। একটা সদ্য অনাথ মেয়ে কীভাবে প্রতারিত হয়েছিল সে কথা। সমাজের ভয়ে রাজিত পালিয়ে বেঁচেছিল।” আলোকের কথায় কাঁকন বসে পড়ে আবার।

“এরপর আসে সোমরাজ, ওর বন্ধু। গরীব ঘরের ভালো ছেলে। পত্রালী ওকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিল। ওর পেছনে খরচ করত। বই থেকে টিচার, খাওয়া পড়া সব দায়িত্ব নিয়েছিল। কিন্তু ওর এই বেশি জাপটে ধরা স্বভাবের জন্য সোম ছিটকে যায়। আর প্রচণ্ড আঘাত দিয়ে বসে নরম মনের মেয়েটাকে। ও ডক্টর বৈদ্যকে দেখাতে শুরু করে। একটু স্থিতিশীল হয় ওঁর চিকিৎসায়। এরপর ও পিএইচডি করতে গিয়ে প্রফেসার মাইতির হাতে নির্যাতিত হয়। খোঁজ নিয়ে দেখেছি মাইতির রেকর্ড খারাপ ছিল। মেয়েদের ডক্টরেটের লোভ দেখিয়ে বিছানায় টেনে নিত। ইউজ করে ছুঁড়ে ফেলে দিত। এবার একটা বড় ধাক্কা খেয়ে পড়া ছেড়ে দেয় মেয়েটা। গানের দিকে ঝুঁকেছিল। ভালোই গাইত। কিন্তু ঝনক ওকে টপকে এগিয়ে যায়। পত্রালী ততদিনে শামুকের মত গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখেছি পত্রালীরও ট্যালেন্ট ছিল। ঝনকের লবি বেশি শক্ত ছিল বলে ও এগিয়ে যায়। আবার ভেঙ্গে পড়ে পত্রালী।

এরপর মেয়েটা অভিনয়ের দিকে যায়। জন্মগত ট‍্যালেন্টেড ছিল ও, কিন্তু এই পথে প্রচুর অদৃশ্য শত্রু রয়েছে। জিনিয়ার সঙ্গে অদৃশ্য লড়াই শুরু হয়, এদিকে হিতাংশুবাবু ওকে ইউজ করেন। নিজের ব‍্যবসায় ওকে মডেল করেন। সব লেখা আছে ওর ডাইরিতে। কীভাবে সবাই ওকে ঠকায়, যাকেই মেয়েটা নিজের ভেবেছে তার থেকেই আঘাত পেয়েছে চরম। আস্তে আস্তে ডঃ বৈদ্যর ওপর নির্ভর করতে শুরু করে মেয়েটা। ডঃ বৈদ্য চিকিৎসার সুবিধার জন্য ওকে ওর মনের কথা খুলে ডাইরিতে লিখতে বলেছিল। ও তাই করত। নিতাকে ও অপছন্দ করত কারণ সোমকে কেড়ে নিয়েছিল নিতা। কাঁকন দেবীর কথা বেশি নেই। কারণ রাজিতের ঘটনাটা বহু পুরানো। বাকি সবার কথা আছে।

এমনকি আমাদের কাছে এসে সাহায্য পায়নি তাও লেখা আছে। লেখা শেষ হয়েছে দু বছর আগে। তারপর ও বাউল মনে চলে যায়। লাস্ট জানুয়ারির বাইশ তারিখ আগুন লাগে বাউল মনে। রাজিতবাবুর কথা মত পত্রালী মারা যায় পুড়ে। উনি সনাক্ত করে এসেছিলেন। ফল স্বরূপ এক বিশাল সম্পত্তির মালিক হলেন। তাই তো কাঁকন দেবী?”

আলোক তাকায় কাঁকনের দিকে। ও ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে আছে।

প্রধানের ফোনটা বেজে ওঠে। ও বারান্দায় গিয়ে কথা বলে, তারপর ঘরে ঢুকে বলে, “মিসেস পাইন আর ওঁর মেয়েকে পাওয়া গেছে। ওনারা জলপাইগুড়ি রামকৃষ্ণ মিশনে গেছিলেন। এত ঘটনা কিছুই জানতেন না। ওঁরা এসে গেছেন নিচে। ডাকবো?”

“নিশ্চই, এখুনি নিয়ে এসো।”

মিসেস পাইনকে দেখলে বোঝা যায় এক সময় অসামান্য সুন্দরী ছিলেন। তবে ওনার মেয়ে একটা নীল শরীর ঢাকা পোশাকে আবৃত। মুখটিও কেমন আড়াল করা।

আলোক অবাক হয়ে দেখছিল, হঠাৎ বলে উঠল, “আপনার মেয়ে কি পুড়ে গেছিল?”

“হ্যাঁ, আমি একটা ছোট হোমের দায়িত্বে ছিলাম। সেখানে আগুন লেগে গেছিল... কয়েকজন পেশেন্ট মারা যায়। আমার মেয়ে সাংঘাতিক পুড়ে গেছিল। বহু চিকিৎসার পর আপাতত একটু সুস্থ।”

“বাউল মন, তার মানে পত্রালী আপনার হোমেই ছিল।” আলোক বলে।

“হ্যাঁ, আপনি চিনতেন? পুওর চাইল্ড, ডঃ বৈদ্য পাঠিয়েছিলেন। তবে মেয়েটা সুস্থ হয়ে উঠছিল ধীরেধীরে। সাইকো মানেই পাগল নয়, মানসিক গঠনে একটা কিছুর অভাব... কিছুর শূন্যতা, যেমন পত্রালীর ছিল নিজের লোকের ভালোবাসার অভাব। ও আমার মেয়ের বন্ধু ছিল। শেষের দিকে ওরা এক ঘরে থাকতো। পত্রালীও সেই আগুনেই পুড়ে মারা যায়।”

“আপনার স্বামী?”

“আমি ডিভোর্সি, মেয়েকে নিয়ে বহুদিন বাইরে ছিলাম, আপাতত শিলিগুড়িতে থাকতাম। বাউল মন ঠিক হোম নয়, আমার স্বপ্ন ছিল। ওটাই আমাদের বাড়ি ছিল।”

“যোগাযোগ ছিল না বাবা মেয়ের? কী নাম ছিল ওনার?” আলোক ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠছিল।

“এই কেসের জন্য কি ওটা জানা দরকার?”

“আপনাদের রিসর্টে আপনাদের আমন্ত্রণে ঘুরতে এসে এতজন মারা গেল, অনুসন্ধানের জন্য সব জানাটা জরুরি। কারণ অতীতের কোন ঘটনার থেকেই হয়ত কোন ক্লু পাওয়া যাবে।” আলোক বলে।

“আমরা সবে একটা রিসর্ট কিনেছিলাম, তাতে কে আসলো, গেলো, বুক করল কিছুই জানতাম না। সেখানে কিছু হলে স্টাফদের ধরুন। আমরা এখনো রিসর্টটাতে যাইনি। ম্যানেজারের উপর ভার ছিল।"

“কিন্তু অতিথিরা তো নিজের ইচ্ছাতে আসেনি, সবাইকে আপনারা এনেছিলেন।”

মিসেস পাইন আকাশ থেকে পড়লেন মনে হল, বলে উঠলেন, “বিশ্বাস করুন, রিসর্ট কেনার পর কিছু স্টাফ রেখেছিলাম । দায়িত্ব সব তাদের দিয়েছিলাম। কে বুক করেছে, কে আসছে কিছুই জানতাম না। পুরো দায়িত্ব দেওয়া ছিল একটা এজেন্সিকে,ওরা সব ব্যবস্থা করেছিল। গেস্ট লিস্টটা আমায় মেইলে দিয়েছিল। আমি আবার ম্যানেজার ভত্রাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম।”

“আপনি জানেন না এই ইয়ার এন্ডিং আপনাদের রিসর্টে কাটানোর জন্য লাকি ড্র হয়েছিল। আমরা অনেকেই সেভাবে ফ্রিতে এটা বুক করেছি!”

আলোকের কথায় মিসেস পাইনের মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেলো। এত অবাক উনি কখনো হননি। বললেন, “আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না, আমি কিন্তু সব কটা ঘরের দুদিনের ভাড়া এডভান্স পেয়েছিলাম। এজেন্সি থেকে পাঠিয়েছিল ব্যাঙ্কে। ফ্রিতে কেন থাকতে দেবো!”

এবার আলোকের অবাক হওয়ার পালা। পরিষ্কার মনে আছে ফ্রি তে দুরাত তিনদিনের বুকিং হয়েছিল। কোনও লাকি ড্রয়ের কথা বলেছিল একটা মেয়ে ফোনে। ও সাহানার দিকে তাকায়।

আলোকের মনে হয় কেসটা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। নতুন করে ভাবতে হচ্ছে আবার, ডঃ বৈদ্য যদি খুনি হয়, কেন? ডাইরিটা পড়ে জানা গেলো পত্রালীর এদের সবার উপর রাগ ছিল। ও ভেবেছিল এমন একটা রিসর্ট কিনে সবাইকে ডেকে এনে মারা যেতেই পারে। সাহানা আর আলোকের কথাও আছে ডাইরিতে। কিন্তু ডঃ বৈদ্য একজন সুস্থ মানুষ, উনি এমন করবেন কেন? আর এতো সহজ সমাধান! সব যেন সাজানো খেলার মত।

আলোকের এখন ভত্রা থেকে শুরু করে মিসেস পাইন সবাইকে সন্দেহ হচ্ছে নতুন করে। খুনের মেইন মোটিভ যদি বদলা নেওয়া হয়, কে নিচ্ছে?

সবচেয়ে বড় কথা খুনি ওখানেই ছিল এটা পরিষ্কার। কিন্তু কে সেই খুনি।

যে কোনও খুনের পেছনে যদি মোটিভ খুঁজে পাওয়া যায়, খুনিকে খুঁজে পাওয়া সহজ হয়ে যায়। কিন্তু মোটিভ যদি পত্রালীর প্রতিশোধ হয় ওর হয়ে নিচ্ছে কে এই প্রতিশোধ? ডঃ বৈদ্য প্রতিশোধ নিলে নিজে মরলেন কেন?প্রাশচিত্ত! এতোগুলো খুনের দায়ে জেল হবে জানতেন। তাই কি ইচ্ছা মৃত্যু?

“ওকে মিসেস পাইন এই এজেন্সিটার কী নাম? ওদের থেকেই শুনবো বাকিটা। কারণ যে আটটা পরিবার এসেছিল সবাই আমন্ত্রণে বা লাকি ড্র জিতে এসেছিল। কেউ টাকা দিয়ে থাকতে আসেনি।” প্রধান জিজ্ঞেস করে।

“হিল ভিউ ট্রাভেলস।”

তাদের ফোন করে জানা গেলো একটা বড় গ্রুপ পুরোটা অন লাইনে বুক করে নিয়েছিল এক মাস আগে। চার দিন আগে গেস্ট লিস্ট মেইল করেছিল গ্রুপটা। ওদের কোনও ইভেন্ট হবে বলেছিল।

“ফোনে যে কেউ এভাবে বুক করতে পারে। শিট। আর শপিং মলে এই ধরনের লাকি ড্র সবসময় হয়। তাই কারো সন্দেহ হয়নি। তারপর বলেছিল পুরোটা ফ্রি।” আলোক বলে।

সবাই চুপ, ফ্রি শুনেই কেউ আর খোঁজ নেয়নি।

“যে দিন বাউল মনে আগুন লাগে ঠিক কী হয়েছিল?” আলোক প্রশ্ন করল মিসেস পাইনকে।

“গত জানুয়ারির ঘটনা। রাতে খাওয়ার পর সবাই শুয়ে পড়েছিল। ঐ ঘরটায় চারজন থাকতো। রেবেকা, মলি, ইলোরা আর কাকলী। ফায়ার প্লেস থেকে আগুন লাগে, কাঠের পার্টিশন, আসবাব সব ধরে নেয় দ্রুত। প্রথমেই পাশের ঘর থেকে পত্রালী আর আমার মেয়ে ছুটে গেছিল। মলি আর ইলোরাকে তোষক জড়িয়ে বার করে দিয়েছিল। রেবেকাকে নিয়ে আমার মেয়েও বেরিয়ে এসেছিল। চারটেই তোষক ছিল, পত্রালী আর কাকলি ঐ আগুনের লেলিহান শিখার থেকে বার হতে পারেনি। পরে রেবেকাও মারা যায়, আশি শতাংশ পুড়ে গেছিল। আমার মেয়েও পঞ্চাশ শতাংশ পুড়েছিল। পত্রালী আর কাকলি স্পট ডেড, কয়লা হয়ে গেছিল পুরো।”

“এই মলি আর ইলোরা এখন কোথায়? ওদের কী অবস্থা?”

“মলি আর ইলোরা প্রায় সেরে উঠেছিল। ওদের বাড়ির লোক এসে নিয়ে যায়। একজন বর্ধমান, একজন কলকাতা। এদেরকেও ডঃ বৈদ্য পাঠিয়েছিলেন এখানে।”

“ডঃ বৈদ্যকে আপনি কতদিন চিনতেন?”

“ডঃ বৈদ্য আমার বাবা।” ঘরের মধ্যে যেন বোম পড়ল। এই প্রথম কথা বলল কৌশানি। “রিসর্টটা বাবাই কিনে দিয়েছিল আমায়। আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে।”

“আপনারা গেস্টের লিস্ট দেখেছিলেন? কে কে খুন হয়েছে জানেন?” পুলিশ অফিসার বলেন।

“গেস্ট লিস্ট সেভাবে দেখিনি। খুনের খবর শুনেই তো এলাম, সবে তো খবরটা পেলাম। কেন?” মিসেস পাইন বলেন।

“ডঃ বৈদ্যর নামটাও লিস্টে রয়েছে। তবে ওঁকে নিয়ে সন্দেহ দানা বেঁধেছে।” অফিসার কথাটা বলতেই সবাই চুপ।

“আ… আমি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না। বাবা ওখানে কী করছিল?” মিস পাইন বলে।

“হয়তো গেস্টদের দেখতে গেছিলেন। উনিই প্রথম পৌঁছেছিলেন ওখানে।”

“আপাতত আপনারা শহর ছেড়ে কোথাও যাবেন না, গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। সাবধানে থাকবেন।” প্রধান বলে।

“ম‍্যাডাম আপনার আর ডঃ বৈদ্যর ব‍্যপারটা একটু... মানে কবে ডিভোর্স...” আলোক ইতস্তত করে প্রশ্নটা করেই ফেলে।

একটা রুমাল দিয়ে চোখ মুছলেন মিসেস পাইন। বললেন, “আমি বরাবর বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, আর ও এদেশে থাকতে চাইত। কলকাতা ছেড়ে নড়বে না। কৌশানির একটা হার্টের প্রবলেম ছিল। যার চিকিৎসা এদেশে থাকলেও আমি বিদেশ যেতে চেয়েছিলাম। ও রাজি হয়নি। আমি ডিভোর্স নিয়ে চলে যাই মেয়ে নিয়ে। দশ বছর পর দেশে ফিরি। কিন্তু ঐ সম্পর্ক আর জোড়া লাগেনি। আমি শিলিগুড়ি চলে আসি। আমি বরাবর নিজের পদবী ব্যবহার করতাম, মেয়ের পাসপোর্টে পাইন লিখেছিলাম। ও অবশ্য ইদানীং আসত মেয়েকে দেখতে, বাবা মেয়ের দেখা হত। কথাও হত।"

“আচ্ছা, বাউল মনের বাকি মেয়েরা? তাদের কী হল? হোমটা তো বন্ধ শুনলাম।"

“আর তিনটে মেয়ে ছিল, ওদেরও বাড়ির লোক নিয়ে গেছে, পায়েল, শুভা, রিয়া। রিয়া পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছিল। শুভা একটা ছেলের প্রতারণার শিকার। পায়েল সেরে গেছিল, ওর ধর্ষণের পর মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিল। ওরা সবাই ভালো আছে, কৌশানির সঙ্গে যোগাযোগ আছে, কথা হয়।"

“ডঃ বৈদ্যর ঘরে আমরা পত্রালীর একটা ডাইরি পেয়েছিলাম।"

“ওকে তো কখনো লিখতে দেখিনি। তবে আগে লিখত শুনেছিলাম। বাবাই ওকে লিখতে বলেছিল। কিন্তু আমার বাবা কেন খুন হল এটাই বুঝলাম না?” মেয়েটার চোখে জল।

“ঐ ডাইরি পড়ে যা বোঝা গেছে পত্রালীর সঙ্গে যাদের শত্রুতা ছিল তাদের ওখানে ডেকে নিয়ে পর পর খুন করা হয়েছে, কিন্তু কে করল কাজটা?কেন করলো? পত্রালীর জন্য এত দরদ কার? ওর কোনও বয় ফ্রেন্ড?”

“ও যখন আমাদের ওখানে এসেছিল বহু ঘা খাওয়া, কাউকে আর বিশ্বাস করত না, নতুন করে প্রেম... হতেই পারে। কিন্তু আমাদের বলেনি কখনো। ও তো বিশ্বাস হারিয়েছিল ভালোবাসার উপর।”

“কতদিন ছিল আপনাদের ওখানে?”

“প্রায় এক বছর।”

“ঘুরে আবার সব সন্দেহ ডঃ বৈদ্যর উপর আসছে।” প্রধান বলে।

“আমি একটু সময় চাই। আমাদের ডেকে খুনি ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ওভারকনফিডেন্ট... ভালো। তবে সব সময় ভালো নয়।” আলোক জোর গলাতে কথাগুলো বলে বেরিয়ে যায়।

(৭)

সদর থানার পাশেই একটা ছোট হোটেলে আপাতত আলোকদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। পোষ্টমর্টম রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত ওরা সবাই একরকম নজরবন্দী। কাঁকনকে অবশ্য হসপিটালে দিতে হয়েছে, ও রাজিতের ঘটনাটা শোনার পর মাঝে মাঝেই ভুলভাল বকছিল। এতবড় একটা ট্রমা, রাজিতের মৃত্যু, নিতাকে ওষুধটা খাওয়ানো! এতো দ্রুত এতগুলো মৃত্যু দেখে যে কেউ মানসিক ভারসাম্য হারাবে।

“আচ্ছা, যদি কাঁকন থাকে এর পেছনে!” সাহানা বলে।

“মোটিভ কী? পত্রালীর সঙ্গে কীসের এতো প্রেম যে ওর হয়ে খুন করবে ও মারা যাওয়ার পর?”

“যদি এমন হয়, পত্রালীর কোনও প্রেমিক ছিল? যে আড়াল থেকে করছে এসব। অথবা সেই প্রেমিক কাউকে দিয়ে করাচ্ছে।” সাহানা আবার বলে।

আলোক এক মনে আঁকিবুঁকি কাটছে খাতায়, হঠাৎ বলে, “যদি ধরে নিই ডঃ বৈদ্য খুন করেছেন তবে একটাই প্রশ্ন উনি কেন এ কাজ করলেন? অথচ প্রতিটা খুনের সময় উনি ছিলেন। সুযোগ ওঁর সব চেয়ে বেশি ছিল। অন্ধকারে নিপুণ ভাবে হিতাংশুর বুকে চাকু মারা ওঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল। মাইতি প্লেট রেখে ড্রিঙ্কের কথা বলতে উঠেছিল, তখন সায়ানাইড মিশিয়েছিলেন হয়ত। জিনিয়ার ঘরে গিয়ে ওকে চেপে ধরেছিলেন, হয়তো চাবি ছিল ওঁর কাছে কারণ রিসর্ট ওঁর কেনা। বহুবার এসেছেন।

"মিঃ সোমকে কলাটা উনি দিয়েছিলেন। ঝনককে ভোজালি মারাও ইজি, ঘাড়ে অমন আঘাতে মেয়েটা চিৎকারও করেনি। রাজিতের জলের বোতলেও ছিল সায়ানাইড। সুযোগ তো ওঁর ছিলই। আর নিতাকে ওষুধটা সবার সামনেই দিয়েছিলেন। নিজেও একটা খেয়েছিলেন ঘরে গিয়ে।

"কিন্তু কেন? পত্রালীর জন্য নিজের মেয়েকেই ফাঁসিয়ে দিচ্ছিলেন। একটু এদিক ওদিক হলে পুলিশ মা মেয়েকে তুলে নেবে। কারণ ওরাই মালিক। পুলিশ বলবে মা মেয়ে মিলে সব করেছে। ভত্রা বা কোনও স্টাফকে দিয়ে খুন করিয়েছে।

শিট... ভত্রা!"

“কী হল?”

“মিসেস পাইন কী বললেন? উনি জানতেন না যে আমরা ফ্রি তে থাকতে এসেছি, কন্টেন্টের কথা উনি শোনেননি, গেস্ট লিস্ট উনি দিয়েছিলেন ভত্রাকে, অথচ নিজের স্বামীর নাম দেখেননি! কিন্তু ভত্রা জানত কন্টেন্টের কথা, আমাদের ও বলেছিল হিতাংশু মারা যাওয়ার পর, মনে পড়ছে। ও তবে কী করে জানলো লাকি ড্রয়ের খবর?” আলোক উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

“ঠিক, ও বহুবার বলেছে।”

“কিন্তু ভত্রা এখন কোথায়? সেম ভাবে প্রতিটা সুযোগ ওর ছিল।” আলোক ফোন করে ভত্রার নম্বরে । সুইচ অফ।

“এই ভত্রার ব্যাক গ্রাউন্ড চেক করা হয়নি। ও এর আগে কোথায় ছিল?”

আলোক ছুটে বেরিয়ে যায়, থানায় তখনো প্রধান আর ভার্মা বসেছিল পোস্টটমর্টম রিপোর্ট নিয়ে। ওকে দেখে ভার্মা বলে, “এই রিপোর্টে এসেছে ডঃ বৈদ্য নিজের রোজকার প্রেশারের ওষুধ খেয়েছিলেন, বিষ ছিল সেই জলেই। ওটাও খুন মনে হচ্ছে। নিজে বিষ খেলে জলে মিশিয়ে খাবে কেন?”

“ভত্রার হোয়ের এবাউট চেক করুন এখনি। আর ছেলেটা কোথায় গেলো?”

“বাড়ি যাচ্ছে বলে বেরিয়েছিল। কেন?”

“ওর ফোন বন্ধ, ওকে এখনি ট্র্যাক করুন। আমাদের বোকা বানিয়ে এভাবে... হি ইজ দা মেইন কালপ্রিট।”

“হোয়াট... ম্যানেজার ভত্রা!”

“ইয়েস ভত্রা। ওটা হয়তো ওর আসল নাম নয়। ত্যাগবাহাদুরকে ফোন করুন। ও হয়তো কিছু জানে। আরেকটু হলে ভত্রা মিসেস পাইনদেরও জেলে ভরার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। কিন্তু ঐ ডাইরিতে ভত্রার নাম কোথাও নেই। ও শত্রু নয়। অথচ ও পত্রালীর পরিচিত। ওকে চাকরী মিসেস পাইন দিয়েছিল। ও বলেছিল পত্রালী ওকে নিজের রিসর্টের ম্যানেজার রাখতে চেয়েছিল। তার মানে ওকে বিশ্বাস করত। ভালোও বাসত। পত্রালীর ডাইরিটা এই হোমে আসার আগে লেখা। কারণ হোমের কারোর গল্প নেই। ও ডাইরিতে লিখেছিল এমন একটা রিসর্টে সবাইকে ডেকে এনে মেরে দেবে। ডাইরিটা হয়ত ও ভত্রাকে দিয়েছিল। ওকে পরিকল্পনার কথাও বলেছিল। এসব হোমে আসার আগে। ভত্রা ভয় পেয়েছিল। রাজি হয়নি। তারপর পত্রালী হোমে চলে যায়। ও রিসর্ট কিনতে চায় গল্প করেছিল কৌশানির কাছে। হয়তো ডঃ বৈদ্যকেও বলেছিল। রিসর্টের ব‍্যবসা এদিকে ভালোই চলে। ডঃ বৈদ্য পরে মেয়েকে কিনে দিলেন রিসর্টটা। ভত্রা জানতে পেরে প্ল্যানটা ছকে ফেলল। পত্রালী পুড়ে মরেছে যাদের জন্য তাদের ও শাস্তি দেবে ভাবল। প্রতিটা খুনের সময় ভত্রা ছিল। ওর পক্ষে সম্ভব ছিল খুন করা।”

“কিন্তু প্রমাণ করবে কী করে? আইন তোমার এই গল্প শুনবে?” সাহানা বলে।

“একমাত্র ডঃ বৈদ্য জানত পত্রালীর কোন প্রেমিক ছিল কি না, মিসেস পাইনও জানেন না।” আলোক ঠোঁট কামড়ায়।

থানার বাইরে রিপোর্টারদের ভিড় শুরু হয়েছে। দুটো ওবি ভ্যান চলে এসেছে। আটটা খুনের খবর ভাসছে বাতাসে। ভার্মা বললেন, “আমাদের এখনি প্রেস কনফারেন্সে বসতে হবে। ওখানে বলব...”

“বলবেন, ডঃ বৈদ্য খুনি, নিজে আত্মহত‍্যা করে নিয়েছেন শেষে।”

“হোয়াট! এই বলছেন ভত্রা! আবার...” প্রধান রেগে ওঠে।

“এটা বললে ভত্রা নিশ্চিন্ত হবে যে ওর দিকে সন্দেহ যায়নি। তখন ওকে ধরা সহজ হবে। ওর ছবি ছড়িয়ে দিন চারদিকে।” আলোক বলে।

আধ ঘণ্টার মধ্যে টিভিতে ব্রেকিং নিউজ আসে আটটি খুনের নেপথ্যে। চ্যানেলগুলো আরও রঙ চড়াচ্ছে, কেউ বলছে পত্রালীর সঙ্গে ডঃ বৈদ্যর সম্পর্ক কি রহস্যে মোড়া? কেউ বলছে ডঃ বৈদ্য কি পত্রালীর কেউ হয়? এসব খবর দেখলে জট আরও পাকিয়ে ওঠে।

আলোক আবার মিসেস পাইনকে নিয়ে বসেছে, ওঁদের ডেকে আনা হয়েছে থানায়। “ভত্রা সম্পর্কে কিছু বলুন। কীভাবে পেলেন?”

“লোক খুঁজছিলাম। পেপারে দিয়েছিলাম। ত্যাগী এনেছিল ওকে।”

“ত্যাগী??”

“আমার হোমের ম্যানেজার ছিল। ছেলেটা ফার্মাসি পড়তে পড়তে পড়া ছেড়ে দিয়েছিল অভাবে। আমার ডান হাত, অ্যাসিস্টেন্ট, হোম বন্ধ হওয়ার পর ও আমাদের বাড়ির... বলতে গেলে আমার হেল্পিং হ্যান্ড সব ও।”

“ত্যাগ বাহাদুর, ঐ ড্রাইভার!!”

“আমাদের গাড়ি চালালেও ওকে ড্রাইভার বলিনি কখনো। আপনি চেনেন নাকি?”

“রিসর্টের একজন ড্রাইভার তো ত্যাগ বাহাদুর?” আলোক বলে।

“ত্যাগী রিসর্টে গাড়ি চালাচ্ছিল! ও তো চারদিন ছুটি নিয়েছিল। আজ অবধি ছুটিতে।”

“ফটো আছে ওর?”

“আছে তো, কিন্তু কেন?”

“ফোন করুন দেখি।”

কৌশানি ফোন থেকে ফটো বার করে দেয়। মিসেস পাইন কানে ফোন চেপে ট্রাই করতে থাকে। লাগে না।

“ইয়েস, এটাই, ওর বাড়ি কোথায়?” ফটো দেখে লাফিয়ে ওঠে আলোক। বলে, “ও তো রিসর্টে ছিল। ড্রাইভার বলছি কারণ গাড়ি চালাত। অবশ্য আরও দুটো ড্রাইভার ছিল ও ছাড়া।”

ভার্মার ফোনে একটা কল এসেছিল। ও আলোককে বলল, “ভত্রার বাড়ি শিলিগুড়িতেই। বৌ বাচ্চা আছে। আগে সিকিমে কাজ করত। ও বাড়িতে গেছিল। আসছে এখনি থানায়।”

আলোক দু হাতে মাথা চেপে ধরে। বলে, “এতো মুরগি জীবনে হইনি। এভাবে ঘোল খাওয়াল আমাদের। মানতেই হবে।”

প্রধান আর ভার্মার মুখ চাওয়া চাওয়ি দেখে সাহানা মাথা চুলকায়। ওর মাথায় আসে না ভত্রার বৌ বাচ্চা কোথা থেকে এলো? তাহলে ও আর পত্রালীর প্রেমিক কি আলাদা?

“ত্যাগীকে ধরুন। এবার প্রমাণ সহ ওকে জেলে ঢোকাবো। ত্যাগ বাহাদুর, আমাদের পত্রালীর নীরব প্রেমিক। সবচেয়ে বেশি সুযোগ ছিল ওর, কারণ কেউ ওকে লক্ষ্য করছিল না। ভত্রা বেশিরভাগ সময় আমাদের চোখের সামনে ছিল। তাও খুন হচ্ছিলো! কী কৌশানি ম‍্যাডাম? ত্যাগী আর পত্রালী... ঠিক তো? আপনার বাবার খুনিও এই ত্যাগী।”

“ত্যাগী ওকে ভালোবাসতো ঠিকই কিন্তু পত্রালী তো ওকে ভালোবাসতো না, তবে পছন্দ করত। পত্রালী কাউকেই ভালোবাসত না আর।” কৌশানি বলে।

“ঠিক, পত্রালী যদি ওকে ভালবাসত মিসেস পাইন বা ডঃ বৈদ্য জানতে পারতেন। ডঃ বৈদ্যর সঙ্গে পত্রালীকে নিয়ে এত আলোচনা হয়েছিল, উনি বলেননি ওর প্রেমিক ছিল বলে। ত্যাগী ওর ডাইরি চুরি করেছিল হয়ত ওকে জানবে বলে। ওর রিভেঞ্জের কথা জেনেছিল। ওকে তবু ভালোবাসত। ওর মৃত্যুর পর প্রেমে অন্ধ হয়ে ভেবেছিল ওর শেষ ইচ্ছা পূরণ করবে। রিসর্টে সর্বক্ষণ ছিল ত্যাগ বাহাদুর। ভত্রাকে ও কাজে ঢুকিয়েছিল নিজের সুবিধার জন্য। ও বলেছিল কনটেস্টের কথা ভত্রাকে। ও নিজেই ঐ ভাবে প্ল্যান করে আমাদের ডেকে এনেছিল। ফ্রিতে রিসর্টে কাটানোর অফার কেউ ফেরায়নি।"

“কিন্তু ফোন তো সব মেয়েদের গলাতে আসত!” সাহানা বলে।

“এমন অনেক ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানি আছে যাদের ফোন নম্বরের লিস্ট দিয়ে এ ধরনের কাজ করানো যায়। দেখো ঝনক আর জিনিয়াকে অ্যাডের কথা বলে ডেকেছিল, মহিলাদের শপিং মলের কন্টেন্টের কথা বলে, নানা রকম ট্রিক নিয়েছিল খুনি। যে ভাবেই হোক আমাদের সবাইকে ওখানে নিয়ে তুলেছিল। বাউল মনের ম্যানেজার, ফার্মাসির ছাত্র, কিছু ম‍্যাডিকেল সাইন্স জানত নিশ্চই। তাই বুকে ছুরির ফলা মারা বা দ্রুত কলায় ইনজেকশন ও দিতেই পারত। ডঃ বৈদ্যর দেওয়া ঘুমের ওষুধ বদলে সায়ানাইড দিয়েছিল ও। ডঃ বৈদ্যর ঘরেও সায়ানাইড ওয়াটার দিয়েছিল। বাকিটা রিপোর্ট এলে জানা যাবে। তাছাড়া ও র‍্যানডাম খুন করছিল। যাকে যেভাবে পারছিল, কারণ ওর উদ্দেশ্য ছিল সবাইকে মারা। আর পত্রালী লিখেছিল আমরা দুজন ওর প্রেমিকের কেসটা নেইনি, তাই ত্যাগী আমাদের এই কেসটায় এমন ভাবে জড়াতে চেয়েছিল যে যদি বেঁচে যাই ভাগ্যের জোরে সারাজীবন এই রহস্যর পিছনেই পড়ে থাকবো। ওর প্রেমিকের কেসটা না নেওয়ায় ও রেগে গেছিল। আমাদের এইভাবে ঘোরাবে ভেবেছিল। কাঁকন দেবী বেঁচে গেছিল ভাগ্যের জোরে। ডাইরিটা ডঃ বৈদ্যর ঘরে রেখে ওঁকে ফাঁসাতে চেয়েছিল এতগুলো খুনের দায়ে। যদি ডঃ বৈদ্য আগে মরে যেতেন ঐ ডাইরি রাজিতের ঘরে রেখে দিত, আমরা ভাবতাম রাজিত বোনের হয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে।”

“সব বুঝলাম, ত্যাগ বাহাদুর কোথায় এখন?”

“এটা খোঁজা পুলিশের কাজ। তবে ও ওভারকনফিডেন্ট তো। ব্যাপারটা লিক না হলে ও কাল কাজে যোগ দেবে।”

“মানে?” কৌশানী বলে।

“মানে আমরা যে ওকে সন্দেহ করছি এটা যেন ও না জানতে পারে। আপনারা রাতটা আজ থানায় কাটান। টিভিতে খবর হবে ডঃ বৈদ্যর বৌ ও মেয়েকে সারা রাত থানায় আটকে জেরা। ও সকালে নিজেই থানায় আসবে। এটুকু ডঃ বৈদ্যর জন্য করুন প্লিজ।”

“আপনি যখন বলছেন, তখন ঠিক আছে।” মিসেস পাইন মাথা নাড়ে।

পরদিন সকাল দশটায় ব্রেকিং নিউজ চ্যানেলে চ্যানেলে। আট খুনের নেপথ্যে নতুন মুখ। অবশেষে ধরা পড়ল এক নীরব প্রেমিক, যে পূর্ণ করেছিল প্রেমিকার শেষ ইচ্ছা। মিসেস পাইন ও ওনার মেয়েকে সসম্মানে ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশ।

ফেরার পথে ফ্লাইটে বসে তিনটে খবর কাগজ ঘেঁটে দেখছিল আলোক, সব কাগজেই বেরিয়েছে খবরটা। লকআপে আত্মহত‍্যা ত‍্যাগবাহাদুরের। তবে সে স্বীকার করেছে অপরাধ। পত্রালীর কাছে যাচ্ছে বলে লিখিত মুচলেকা দিয়ে গেছে নিজেই। একটা ছোট্ট সায়ানাইড পিল ছিল ওর লকেটে, আর ছিল পত্রালীর হাসি মুখের একটা ফটো। বেচারা পত্রালী, একটু ভালবাসার কাঙাল ছিল, একটু ভালোবাসা না পেয়ে সাইকো হয়ে গেছিল ধীরে ধীরে। অথচ চিনতে পারেনি আসল ভালোবাসার মানুষটিকে। আর সেই ভালবাসার দাবিতেই ওর মৃত্যুর পর প্রতিশোধ নিতে আজ এতগুলো মৃত্যু মিছিল। পাগল কত রকমের হয়, ত্যাগ বাহাদুর ছিল ওর প্রেমে পাগল। এটাও এক ধরনের সাইকো কেস, আমাদের সবার অবচেতন মনেই হয়তো এমন কিছু রয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আলোকের মুখ দিয়ে।