রত্নপুরীর গোলাপবাগান - সুস্মিতা কুণ্ডু

ফ্যান্টাসি গল্প

অলংকরণ - পিয়াল চক্রবর্তী
(১)

রত্নপুরীর রাজপ্রাসাদ সত্যি সত্যিই যেন রত্নে গড়া। দিনের বেলায় যখন সূর্যের আলো পড়ে, সোনার নক্সা করা বড় বড় থামগুলো ঝিকমিক করে। সোনার জাফরি গলে রোদ এসে পড়ে রাজার নবরত্নখচিত সিংহাসনের ওপর। ন’রকমের রঙ ঠিকরে পড়ে লাল রেশমের গালচের ওপর। রাতের বেলায় কালো আকাশের গায়ে গোলপানা সাদা ফুটোটা দিয়ে রুপোলী আলো, গলা মোমের মত, দুধসাদা শ্বেতপাথরের প্রাসাদের গায়ে পিছলে যায়। স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে পড়ে রাজপুরীর মাথার গম্বুজের চুড়োয় বসানো রুপোর কলসগুলোর ওপর। এদিক ওদিকে গাঁথা হীরের টুকরোগুলোর রোশনাই দেখে মনে হয় আকাশের তারাগুলোই যেন নেমে এসে খানিক জিরোতে বসেছে প্রাসাদের গায়ে।

তবে রত্নপুরীর আসল সৌন্দর্য কিন্তু তার প্রাসাদে নয়, প্রাসাদকে গোল করে বেড় দিয়ে ঘিরে থাকা বাগানে। সে যে কী বাগান, চোখে না দেখলে বুঝবে না গো। শুধু কি চোখে দেখা? থাকত যদি পাখির মত দু’টো ডানা তাহলে সোজা উড়ে গিয়ে, ওই উঁচু নীল আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দেখতে পেতে! একটা সবুজ মখমলের জাজিম যেন গোল করে কেউ পেতে দিয়েছে প্রাসাদের ধার বরাবর। যেদিকে প্রাসাদে ঢোকার সিংহ তোরণ সেদিকের জাজিমে যেন কেউ লাল সুতো দিয়ে গোলাপ ফুলের নকশা তুলেছে। কত রকমের লাল, আগুনে লাল, আলতা লাল, রক্ত লাল, কুসুম লাল, সূয্যি লাল, চেরী লাল! লালের যে এত রকমফের কেই বা জানত। তারপর যদি যাও বাঁদিকপানে, যেদিকে রাজামশাই আর রাণীমার মহল, সেদিকে শুধুই নীল গোলাপ। আশমানী নীল, ময়ূরকণ্ঠী নীল, সমুদ্র নীল, নয়ন নীল! আর যদি যাও ডাইনে রাজকুমার রত্নদীপ আর রাজকুমারী রত্নাবলীর মহলের দিকে সেখানে সব হলুদের রাজত্ব! সর্ষে হলুদ, দুপুর হলুদ, পরাগ হলুদ, কিরণ হলুদ, আরও কত কী!

মোদ্দা কথায় রত্মপুরীর বাগানে বছরভর সবরকম রঙের সবরকম প্রজাতির গোলাপফুল ফোটে। দেশ বিদেশ থেকে, দূরদূরান্ত থেকে রাজাপ্রাসাদের প্রধান মালীর অনুচররা নতুন নতুন দুষ্প্রাপ্য সব বীজ, গাছ, কলম, সংগ্রহ করে আনে। প্রধান মালীর হাতের যশ এমনিই যে কোনও গাছের চারা মরে না তার হাতে। কোনও বীজ ফোঁপরা বাঁজা বেরোয় না। হরেক কিসিমের, হরেক বর্ণের, মনমাতানো গন্ধের সব গোলাপ ফোটায় মালী, রত্নপুরীর বাগানে। একমাত্র স্বর্গের পারিজাতের সাথেই তার তুলনা মেলে। নিজের হাতে গাছের ডাল ছাঁটে, কলম করে, সার মিশিয়ে দেয় মাটিতে, রুপোর ঝাঁঝরিতে করে জল ঢালে গাছের গোড়ায়, সবুজ মখমলি পাতায়।

রোজ বিকেলে রাজামশাই আর রাণীমা আসেন গোলাপবাগানে বেড়াতে। রাজামশাইয়ের সারা দিনের রাজকার্য সামলানোর ধকল নিমেষে মিলিয়ে যায় যখন দখিনা বাতাস বেয়ে ফুলের গন্ধ টেনে নেন বুকভরে। রাণীমা যখন কোমল আঙুলে ছুঁয়ে দেন গোলাপের আলতুসকি পাপড়ি, সব ক্লান্তি হারিয়ে যায়। রাজপুত্র রত্নদীপ আর রাজকন্যা রত্নাবলী হইহই করে খেলে বেড়ায় ফুলবাগানে। ফুলে ফুলে উড়তে থাকা প্রজাপতির সাথে ওরাও যেন পাখা লাগিয়ে উড়তে থাকে। এভাবেই দিনগুলো আনন্দে কাটতে থাকে রত্নপুরীতে।

(২)

তারপর একদিন হ’ল কী, পাশের রাজ্য থেকে এক দূত এল। রাজামশাই আর রাণীমাকে যেতে হবে পাশের রাজ্যে গুরুগম্ভীর রাজনৈতিক সব আলোচনায় অংশ নিতে। তা সেখানে ছোটো ছোটো ছেলেমানুষরা গিয়ে, খেলাধুলো করতে না পেরে বেজায় রকমের হতাশ হবে তাই তাদের প্রাসাদেই রেখে যাওয়া স্থির হ’ল। মোটে তো তিন দিনের ব্যাপার। তাছাড়া প্রাসাদে তো দেখাশোনা করার লোকের অভাব নেই! সেপাই সান্ত্রী দাসদাসী ধাইমা সক্কলে আছে। সকালবেলায় যাওয়ার সময় রাণীমা রত্নদীপ আর রত্নাবলীকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে চুমো দিয়ে বললেন, “বাছারা সাবধানে থাকবে, একদম দুষ্টুমি করবে না। ধাইমা যা বলবে শুনবে, সোনামুখ করে সব খাবার খেয়ে নেবে আর সময়ে ঘুমোবে। পণ্ডিতমশাইয়ের কাছে পড়তে বসা যেন কামাই না হয়, কেমন?

"আর মনে থাকে যেন, প্রাসাদের পেছনের বাগানে একদম যাবে না, যত রাজ্যের ঝোপঝাড় ওদিকে। পাঁচিলের ওপারে আবার মরা নদী! কী না কী বিষাক্ত সাপখোপ উঠে আসবে নদী থেকে আবার!”

রাজামশাইও বাছাদের মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ মায়ের কথাটি মনে রাখবে! খেলতে খেলতে হেথা হোথা চলে যাওয়া মোট্টে ভালো কথা নয়।”

রত্নদীপ আর রত্নাবলী বলে উঠল, “মা, বাবা! তোমরা কিচ্ছু চিন্তা কোরো না! আমরা খুউউব লক্ষ্মী হয়ে থাকব। কোনও দুষ্টুমি করব না। সবার কথা শুনব। চোখের আড়াল হ’ব না। মোটে তো তিনদিনের ব্যাপার। আমরা ঠিইইক থাকতে পারব।”

রাজামশাই আর রাণীমা খানিক আশ্বস্ত হয়ে সৈন্য সামন্তসহ রথে চড়ে যাত্রা করলেন পাশের রাজ্যের উদ্দেশে। সব দেশের রাজা-রাণীরাই আসছেন আলোচনাসভায়। দেশের দশের কী করে মঙ্গল করা যায়, প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর সাথে কীভাবে সুসম্পর্ক বজায় রাখা যায় তাই নিয়েই সব বৈঠক করবেন ওঁরা।

এদিকে বাবা মা রাজপ্রাসাদের চৌহদ্দির বাইরে পা রাখতেই রত্নদীপ আর রত্নাবলী ভুলেই গেল বাবা মাকে দেওয়া সব কথা।

শুরু হ’ল দুষ্টুমি! ধাইমা দুধের পেয়ালা নিয়ে ছুটল ভাই বোনের পেছু পেছু প্রাসাদময় সারা সকাল ধরে। পণ্ডিতমশাইও পুঁথিপত্তর নিয়ে অপেক্ষা করে করে ফিরে গেলেন। স্নানের গরম জল, ক্ষার, সুগন্ধী নিয়ে দাসী বসেই রইল স্নানঘরে, ভাই বোনের দেখা নেই। ভুলিয়ে ভালিয়ে যাও বা স্নান করানো হ’ল কিন্তু দুপুরের খাবার খাওয়াতে সবার গলদঘর্ম অবস্থা। বাঁশকাঠি চালের সরু সরু লম্বা লম্বা ফর্সা ফর্সা ভাত পাতেই পড়ে রইল, রাজকন্যে আর রাজপুত্তুর খেলেন পেটপুরে কুলের আচার। ধাইমা যত বলেন ‘পেটব্যথা হবে!’ তত খিলখিলিয়ে হাসে ভাইবোনে। শেষমেষ বহু সাধ্যসাধনা করে ধাইমা রত্নদীপ আর রত্নাবলীকে পালঙ্কে শুইয়ে ঝালর দেওয়া পাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে গল্প শোনাতে শুরু করলেন। গল্প বলতে বলতে ধাইমার তন্দ্রা এসে গেল কিন্তু দুই ভাইবোনের চোখে ঘুম নেই। ধাইমা ঘুমোতেই দু’জনে পা টিপেটিপে সোজা প্রাসাদের বাইরে গোলাপ বাগানে ছুট ছুট।

(৩)

এই ভরদুপুরে গোলাপবাগান একেবারে শুনশান। শুধু নানা রঙের ফুলগুলো বাতাসের হালকা দোলায় অল্প অল্প মাথা নাড়ছে। এমনিতে বাবা মায়ের সাথে বিকেলে বাগানে আসে রোজ রত্নাবলী আর রত্নদীপ। তখন বাগানময় মালীরা দাসদাসীরা থাকে। কেউ গাছে জল দেয়, কেউ ডাল ছাঁটে, কেউ মাটি কোপায়, কেউ বীজ ছড়ায়। কিন্তু আজ দুপুরবেলা, তাই কেউ কোত্থাও নেই। দু’জনে খানিক প্রজাপতির পেছনে ছোটে, কখন গিয়ে কাঠবেড়ালীর সাথে গাছে ওঠে।

এইভাবে খেলতে খেলতে রাজকন্যা রত্নাবলী কখন যেন হলুদ গোলাপের এলাকা পেরিয়ে রাজপ্রাসাদের পেছন দিকে চলে যায়। ভারী সুন্দর একটা রামধনু রঙ প্রজাপতির পেছু ধাওয়া করতে করতে খেয়ালই করেনি যে কোথায় এসেছে। প্রজাপতিটা উড়তে উড়তে গিয়ে একটা গোলাপের ওপর বসল। ভারী অবাক হয়ে রাজকন্যা রত্নাবলী দেখল গোলাপ ফুলটার রঙ কালো! এরকম কুচকুচে কালো গোলাপ তো আগে কখনও দেখেনি বাগানে। এদিক ওদিক চেয়ে দেখল, এইরে! প্রাসাদের একদম পেছনদিকে চলে এসেছে প্রজাপতিকে ধাওয়া করতে গিয়ে।

এদিকপানে তো আসা বারণ! আগে তো কক্ষণও আসেনি এদিকে। মা বাবাও পাশের রাজ্যে যাওয়ার আগে পইপই করে বারণ করে গেছিলেন। রাজকন্যার একটু গা ছমছম করে।

কিন্তু কালো গোলাপফুলের ওপরে বসা রামধনুরঙ ডানাওয়ালা প্রজাপতিটা যেন টানছে রত্নাবলীকে। হঠাৎ প্রজাপতিটা গোলাপের গা থেকে খসে নিচের মাটিতে টুপ করে পড়ে গেল। রাজকন্যা তো ব্যগ্র হয়ে এগিয়ে গেল দেখতে, কী হ’ল! গাছটার সামনে গিয়ে দেখে প্রজাপতিটা ডানা ছড়িয়ে মাটিতে পড়ে, কয়েক মুহূর্তেই ডানার রঙ কেমন ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে গেছে। রাজকন্যের নাকে কেমন একটা গন্ধ এসে লাগল। কালো গোলাপটা থেকে আসছে, কটু গন্ধ। গোলাপফুলের সুবাসের লেশমাত্র নেই। কয়েক মুহূর্ত গন্ধটা নেওয়ার পর রাজকন্যার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে লাগল। চোখের সামনে অন্ধকার ঝেঁপে আসতে লাগল। পায়ে যেন আর বল নেই, রাজকন্যা টলে পড়ে গেল মাথা ঘুরে মাটির ওপরেই। পড়ে যাওয়ার আগে গলা দিয়ে একটা চিৎকার বেরলো শুধু, “দাদাআআ!”

রাজপুত্র ওদিকে একটা কাঠবেড়ালীর সাথে বন্ধুত্ব করার জন্য বাগানের কোণের একটা বটগাছ বেয়ে উঠছিল। বোনের চিৎকার শুনতে পেয়ে তড়িঘড়ি নেমে এসে দৌড় লাগাল। কিন্তু কোথায় বোন? সারা বাগানময় ছুটোছুটি করে শেষে প্রাসাদের পেছনে দিয়ে দেখল, বোন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। আর বোনের পাশে অদ্ভুত কালো রঙের গোলাপফুল ফুটে থাকা একটা গোলাপগাছ। রাজপুত্র রত্নদীপ বারবার ঝুঁকে পড়ে বোনকে ডাকতে লাগল, কাঁধ ধরে ঝাঁকাল কিন্তু কোনও সাড়া নেই বোনের। পাশের গাছটা থেকে বিশ্রী একটা দমবন্ধ করা গন্ধও নাকে আসছে। রাজপুত্র গাছটাকে ধরে উপড়ে ফেলে দিতে গেল। কিন্তু একটা কাঁটা কুট করে বিঁধে গেল রাজপুত্রর হাতে। সঙ্গে সঙ্গে রাজপুত্রর মনে হ’ল যেন বিষাক্ত কোনও সাপ দংশন করল। কেউ যেন রক্তে বিষ ঢেলে দিল, জ্বলে উঠল যেন শিরা উপশিরা। ছোট্ট রাজপুত্রও কষ্টে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল বোনেরই পাশে।

(৪)

ওদিকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে, সূয্যি পাটে বসতে চলল। ধাইমা ঘুম চোখ খুলে রত্নদীপ আর রত্নাবলীকে দেখতে না পেয়ে চিৎকার করে দাস দাসী সেপাই সান্ত্রীদের জমা করেছে। সকলে মিলে সারা রাজপ্রাসাদ এমাথা থেকে ওমাথা চষে ফেলল তবু ভাইবোনের দেখা আর মেলে না। শেষমেষ সবাই প্রাসাদের বাইরে খুঁজতে বেরলো। খুঁজতে খুঁজতে ময়না দাসী শেষ অব্দি প্রাসাদের পেছনে ময়লা ফেলতে গিয়ে, রাজপুত্র রাজকন্যাকে অচৈতন্য অবস্থায় দেখে তো ডাক ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল। শিগগিরই ওঁদের তুলে এনে পরিষ্কার করে পালঙ্কে শোয়ানো হ’ল। রাজবৈদ্যর কাছে খবর গেল, পাশের রাজ্য রাজামশাই রাণীমাকে খবর দিতে দূত ছুটল।

রাজামশাই আর রাণীমা ছেলেমেয়ের এই অবস্থার খবর পেয়ে মধ্যরাত্রেই ছুটে এলেন। দৌড়ে প্রাসাদে ঢুকে ছেলেমেয়েকে দেখলেন পালঙ্কে শোয়ানো। দুজনেরই শরীর কেমন নীলচে হয়ে গেছে। রাণীমা তো আছড়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করলেন, বারবার বাছাদের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু তারা চোখও মেলল না, সাড়াও দিল না। রাজামশাই আকূল হয়ে রাজবৈদ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন, “রাজবৈদ্য, আমার রাজকন্যা আর রাজপুত্রকে বাঁচানোর কি কোনও উপায় নেই?”

রাজবৈদ্য বললেন, “এ তো আমার সাধ্যের বাইরে তবে এই রাজ্যের শেষপ্রান্তে থাকেন এক সন্ন্যাসী সাধকপুরুষ। তিনি সকলের থেকে দূরে নির্জন প্রকৃতির বুকে একাকী সাধনায় মগ্ন থাকেন, তিনি হয়তো কিছু উপায় করতে পারেন।”

এই শুনে রাজামশাই নিজে ঘোড়া ছুটিয়ে চললেন সেই মহান সাধককে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসতে। দুই ছোট্ট শিশুর বিপদের কথা শুনে সন্ন্যাসী রাজী হলেন রাজপ্রাসাদে আসতে। শান্ত সৌম্যদর্শন গেরুয়াধারী বৃদ্ধ সন্ন্যাসী, এসে পৌঁছলেন ভোরবেলায় রাজামশাইয়ের সাথে। এসে সব শুনলেন দাস দাসীদের মুখে। তারপর বললেন, "আমি সেই জায়গাটা একবার দেখতে চাই যেখানে এই ঘটনাটি ঘটেছে।”

সন্ন্যাসীকে প্রধান মালী নিয়ে গেল রাজপ্রাসাদের পেছনের দিকে সেই কালো গোলাপের গাছের কাছে। সেই জায়গাটিতে পৌঁছতেই সন্ন্যাসীঠাকুর অনুভব করলেন প্রকৃতির বুকে বিষ জমা হয়ে আছে। সেই বিষই প্রবেশ করেছে রাজকন্যা আর রাজপুত্রর শরীরে। অদ্ভুতদর্শন কালো গোলাপের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে বিষ বয়ে চলেছে তা তিনি বুঝতে পারলেন। রাজপ্রাসাদের পেছনের পাঁচিলের ওপারে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন সন্ন্যাসী। অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজামশাই দাস দাসী সহ তাঁকে নিয়ে গেলেন।

রাজপ্রাসাদের পেছন দিয়ে বয়ে চলা রত্না নদীর তীরে পৌঁছলেন সবাই। নদীর জলে রাজ্যের নোংরা, দূষণে নদীর জল নষ্ট হয়ে গেছে। নদীর তীরের সমস্ত গাছপালা কেমন শুকনো আর তাতে দু’চারটে যা ফুল ধরেছে সবই কালো, ঠিক ওই বিষাক্ত গোলাপফুলগুলোর মত। সন্ন্যাসীঠাকুর বললেন, “রাজামশাই! প্রকৃতি মা রুষ্ট হয়েছেন। তাঁর বুকে বয়ে চলা নদীকে রাজ্যের মানুষ দূষিত করেছে। সেই বিষ ছড়িয়ে পড়েছে বৃক্ষের শাখা প্রশাখা দিয়ে। ফুলের সুবাস হয়েছে কটু। গাছের কোমল স্পর্শ হয়েছে মৃত্যুবাণ। আমি তপস্যা করব প্রকৃতি মাকে সন্তুষ্ট করার কিন্তু আপনাকে এবং রাজ্যের সকলকেও কথা দিতে হবে যে আপনারা স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার করবেন রাজ্যের মাঠ ঘাট জঙ্গল নদ নদীকে।”

সন্ন্যাসীঠাকুর বসলেন গভীর তপস্যায় জঙ্গলের মধ্যে। আর রাজামশাই দাস দাসী এবং সারা রাজ্যের প্রজারা চললেন নদী জঙ্গল সাফাই করতে। সূর্য যখন ঠিক গাছের মাথায় উঠল নদীর জলও ঝকঝকে তকতকে হয়ে গেছে ততক্ষণে সকলের সহযোগিতায়। বিষাক্ত গাছগুলিও সমস্ত উপড়ে ফেলে দেওয়া হ’ল। চারপাশের পরিবেশেও আর নোংরার লেশমাত্র নেই। সবাই রাজপ্রাসাদে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন সন্ন্যাসীঠাকুর তপস্যা সেরে আসবেন।

কিছুক্ষণ পর সন্ন্যাসী এলেন, হাতে একটা গোলাপফুলের চারা, আর দুটি সাদা গোলাপের ফুল। মালীর হাতে গাছটি দিয়ে সেটি রোপণ করতে বলে সন্ন্যাসী সাদা ফুলদুটি নিয়ে গেলেন রাজকন্যা আর রাজপুত্রের কাছে।

“প্রকৃতি মা তুষ্ট হয়ে এই গোলাপের চারাটি দিয়েছেন এবং এই দুটি সাদা গোলাপ। রাজকন্যা আর রাজপুত্রকে এর মাধ্যমেই সুস্থ করতে হবে।” এই বলে একটি গোলাপ রাখলেন রাজকন্যার কপালের ওপর এবং অন্যটি রাখলেন রাজপুত্রের আঙুলের ক্ষতস্থানের ওপর। ধীরে ধীরে সাদা গোলাপদুটি শিশুদুটির শরীর থেকে সমস্ত বিষ শুষে নিয়ে কালো হয়ে গেল। রত্নাবলী আর রত্নদীপ চোখ মেলে ‘মা’ বলে ডেকে উঠলেন।

রাণীমা আর রাজামশাই বুকে তুলে নিলেন পুত্র আর কন্যাকে। শঙ্খধ্বনি পুষ্পবৃষ্টি করে উঠল সকলে। রাজ্যবাসী মঙ্গলগান গেয়ে উঠল। ওদিকে প্রধান মালী ছুটতে ছুটতে এসে সংবাদ দিল সদ্য রোপণ করা গোলাপচারাটিতে প্রকৃতিমায়ের জাদুবলে রামধনুর মত সাতরঙা পাপড়িওয়ালা গোলাপফুল ফুটেছে। সন্ন্যাসী বললেন, “এটাও প্রকৃতিমায়ের আশীর্বাদ। যতদিন এই রাজ্য দূষণমুক্ত থাকবে, পরিবেশ সুরক্ষিত স্বচ্ছ থাকবে ততদিন ঐ গাছে রামধনু রঙ গোলাপ ফুটবে। আর তার অন্যথা হলেই ঐ আশীর্বাদের গাছ শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। রাজামশাই! আমাদের সকলের দায়িত্ব একে রক্ষা করা।”

রাজামশাই বললেন, “অবশ্যই সন্ন্যাসীঠাকুর। আমাদের রাজ্যকে তো আমরা পরিচ্ছন্ন রাখবই, সাথে সাথে প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকেও আমরা সতর্ক করব। যে বৈঠক অসম্পূর্ণ ছিল সেই বৈঠক হবে রত্নপুরীতে এবং প্রকৃতিমায়ের আশীর্বাদস্বরূপ এই রামধনু গোলাপের গাছ দেখিয়ে আমরা সবার কাছে তাঁর বার্তা পৌঁছে দেব।”

রাজকন্যা রত্নাবলী আর রাজপুত্র রত্নদীপ বলে উঠল, “আমরাও আমাদের সব বন্ধুদের বলব প্রকৃতিমায়ের কথা।”

রাজপ্রাসাদে সকলে আনন্দে হেসে উঠল। সন্ন্যাসীঠাকুর প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন দুই শিশুকে।