দ্য ব্ল্যাক মাস্ক - তানভীর মৌসুম

ভয়ের গল্প

নতুন বাসায় উঠার পরপর আমার বন্ধুদের বেসমেণ্টে যাওয়া আসা বেড়ে গেল। অনেক ধরনের জিনিসপত্র বেসমেণ্টে স্তূপাকারে পড়ে থাকে সবসময়। বাড়ির পুরানো মালিকদের জিনিস, যেসব নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি ওরা। অবশ্য বেজমেণ্টের এককোণে কিছুটা জায়গা আব্বু আমাদের জন্য খালি করে দিয়েছে।

একটা পিং-পং টেবিল নিয়ে আসা হয়েছে এই বেসমেণ্টে। আছে ছোট্ট একটা রেফ্রিজারেটর, যেটার ভিতরে সোডার বোতল ছাড়া আর কিছু নেই। এছাড়া একটা টিভি আছে, সেটার সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি আমার ভিডিও গেম প্লেয়ারটা।

অধিকাংশ বিকেলেই আমি, জুলি, ভ্যালেরি আর বিল থাকি এই বেসমেণ্টে।

বিল গায়ে গতরে বড়সড়, ওর চুলগুলো সোনালী রঙের। নিজের বাবার জিমনেশিয়ামে নিয়মিত ব্যায়াম করে ও।

ও যে কতটা শক্তিশালী সেটা সবাইকে দেখাতে পছন্দ করে বিল। কিন্তু বেচারার হাজার রকমের এলার্জি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে এলেই ও একের পর এক হাঁচি দেয়া শুরু করে।

জুলি আর ভ্যালেরি, এদের দেখলে দুই বোন বলেই মনে হবে। দু’জনই লম্বা এবং চিকন। উভয়ের চোখ আর চুলের রং বাদামি, দু’জনের চুলই ছোট করে ছাঁটা। ভ্যালেরি চশমা পরে, জুলি পরে না।

তবে শুধু চশমাই ওদের মধ্যকার একমাত্র পার্থক্য নয়। জুলি কিছুটা লাজুক। মৃদু গলায় কথা বলে মেয়েটা, শুনলে মনে হবে ফিসফিস করছে। আমাদের চারজনের এই দলটার মস্তিষ্ক বলা যায় জুলিকে। ওর হাতে সবসময় একটা বই নয়তো ম্যাগাজিন থাকবে।

ভ্যালেরি বেশিক্ষণ এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারে না, গল্পের বই কিংবা ম্যাগাজিন পড়া তো অনেক দূরের কথা। কথা বলায় ওর কোনও বিরাম নেই। একটা বিষয় নিয়ে বকবক শুরু করলে আর থামতে চায় না। সেই সঙ্গে হাসাহাসি, লাফালাফি তো আছেই। একের পর এক পরিকল্পনা করে যায় ও, আমাদের নানা রকমের পরামর্শ দেয়। কীভাবে আমরা টাকার পাহাড় গড়তে পারি তা নিয়ে উদ্ভট-উদ্ভট সব ফন্দি আঁটে।

আর আমি? আমাকে এই দলের বামন বলা যায়। যার উচ্চতা সবার থেকে কম। আমার চুলের রং বাদামি, মুখটা একটু গম্ভীর-গম্ভীর! মানুষজন সবসময় আমাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে বারণ করে, এমনকী মন যখন অনেক ভাল থাকে তখনও এই জ্বালাতন থেকে রেহাই পাই না।

বিল আর আমি বেসমেণ্টে অধিকাংশ সময় ভিডিও গেম খেলি।

চারপাশে পড়ে থাকে অসংখ্য পুরানো বই আর ম্যাগাজিন। জুলি সেখান থেকেই কিছু না কিছু বেছে নিয়ে পড়ে।

এখানে কাউচের পাশে পুরানো মডেলের একটা ফোন আছে। সেটা দিয়ে ভ্যালেরি ওর বন্ধুদের কল দেয় আর নিত্যনতুন সব পরিকল্পনা করে। আমার কাছে ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর মনে হয়। পরিকল্পনা করতেই ভ্যালেরির এত সময় যায় যে বেচারি আর অন্য কিছু করার সুযোগ পায় না!

যখন কোনও কিছুই আর ভাল লাগে না তখন স্টোরেজ রুমের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াই, ক্লজিটগুলো খুলে দেখি ভিতরে কী আছে। আমরা যে কত কিছু খুঁজে পাই জানলে সবাই অবাক হয়ে যাবে।

এক বিকেলে আমরা বেশ কিছু পুরানো ফুড মেনু ঘাঁটছিলাম, সবগুলোই কোনও না কোনও রেস্টুরেণ্টের।

‘রব, তোমার বাবা এতসব বাতিল জিনিসপত্র দিয়ে করবেটা কী?’ ভ্যালেরি জিজ্ঞেস করল।

‘বাবা তো সবকিছুই ঘাঁটাঘাঁটি করে দেখতে চায়।’ ওকে বললাম। ‘আসলে জানতে চায় এসব জিনিসের মধ্যে কোনওটা মূল্যবান কি না। কিন্তু এ ব্যাপারে জানতে হলে অনেক সময় লাগবে। এই বাড়িটার বয়স একশো বছরের চেয়েও বেশি। আর আমার মনে হয় এখানে আগে যারা থাকত তারা সবাই ছিল উদ্ভট প্রকৃতির লোক। কেউ একটা বাতিল জিনিসও ফেলে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি!’

জুলি কাউচে বসে পুরানো কিছু মুভি ম্যাগাজিন পড়ছে। ওগুলো এতই পুরানো যে হলুদ হয়ে গেছে সব কাগজ। ‘এগুলো অনেক আগের।’ ও বলল। ‘এখানে যাদের ব্যাপারে লেখা হয়েছে তাদের কাউকেই তো চিনি না। আগে কখনও নামও শুনিনি। জর্জ ব্রেণ্ট? রবার্ট টেলর? মনে হচ্ছে ইতিহাসের বই পড়ছি।’

‘এই এই! দেখো সবাই কী পেয়েছি!’ চেঁচিয়ে উঠল বিল। একটা বস্তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছিল ও। সেটার ভিতর থেকে চারকোণা আকৃতির কতগুলো বাক্স বের করল। ‘প্রাচীন আমলের বোর্ড গেম! স্টিপল চেস। কী ধরনের খেলা এটা? আর এটার নাম কী? পাহ-চিসি! সত্যিই অদ্ভুত!’

ও ফুঁ দিয়ে বাক্সের উপর বসে যাওয়া ধুলো সরাল। ফুঁ দিতে দেরী, কিন্তু হাঁচি দেয়ার ক্ষেত্রে এক মুহূর্তও দেরী হলো না! তৎক্ষণাৎ হাঁচি দেয়া শুরু করল বেচারা! ভ্যালেরি এগিয়ে এসে বাক্সগুলো দূরে সরিয়ে রাখল। তার আগ পর্যন্ত টানা অনেকগুলো হাঁচি দিল বিল।

‘এগুলো অনেক মূল্যবান হতে পারে!’ ভ্যালেরির কণ্ঠে উত্তেজনার আভাস পাওয়া গেল। ‘বাজি ধরে বলতে পারি এই গেমগুলো কমসে কম একশো বছরের পুরানো।’

‘ইয়াক!’ বিল টিস্যু দিয়ে নাক মুছল। ‘যেরকম গন্ধ বের হচ্ছে তাতে গেমগুলো একশো বছরের পুরানো হলেও অবাক হব না। কেমন যেন একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। একদমই সহ্য করতে পারি না।’

‘বোর্ড গেম থেকে কোনও গন্ধ আসছে না, ওটা তোমার শার্টের গন্ধ।’ আমি ওকে বললাম।

জুলি আর ভ্যালেরি আমার কথা শুনে হেসে উঠল। বিল লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল। আমার গলা টিপে ধরার ভান করল কাছে এসে। সে সবার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে পছন্দ করে, ওর অন্যতম শখ মানুষকে ঘুষি মারা। কিন্তু আমি ওর চেয়ে আকারে অনেক ছোট। আমাদের মধ্যে লড়াই হলে সেটা সমানে সমানে হবে না।

এরই মধ্যে ভ্যালেরি একটা ক্লজিট ঘাঁটা শুরু করেছে। হঠাৎ বলে উঠল, ‘ওয়াও। দারুণ জিনিস তো! দেখো সবাই!’

ও কী খুঁজে পেয়েছে দেখার জন্য সবাই ঘুরে তাকালাম। একটা বড় ক্যামেরা।

‘আমার তো মনে হয় এটা বিক্রি করলে একশো ডলার পাওয়া যাবে।’ ভ্যালেরি মন্তব্য করল, ক্যামেরাটা মুখের উপর তুলে সমানে শাটার টিপছে। ‘রব, তোমার বাবার উচিত এসব জিনিস আমার মা-বাবাকে দেখানো। চাইলে এগুলো অ্যাণ্টিক স্টোরে বিক্রি করা সম্ভব। এই বেসমেণ্ট তো দেখছি মূল্যবান সব জিনিসে ঠাঁসা!’

আমি চারপাশে চোখ বুলালাম। কমপক্ষে বারোটার মত ক্লজিট আর স্টোরেজ রুম আছে। সব পুরানো জিনিসে ঠাঁসা। একটা ঘর আছে আবার তালা লাগানো, সেই তালায় জং ধরে গেছে। আমরা ঘরটা খুলতে পারিনি।

যে বস্তার ভিতর পুরানো বোর্ড গেম আছে সেটা এবার আমি ঘাঁটছি। একদম নিচে কালো রঙের কী যেন একটা চোখে পড়ল।

স্কার্ফ নাকি?

না। একটা মুখোশ।

তুলে নিলাম জিনিসটা, ঝেড়েঝুড়ে নিজের মুখে পরলাম। ‘দেখো সবাই! আমি বিখ্যাত বীর যোরো!’

‘যোরো? প্রশ্নই উঠে না!’ বলে উঠল বিল। ‘তোমাকে দেখতে ব্যাংক ডাকাতের মত লাগছে।’

মুখোশটা সোজা করে নিজের মুখে ভালভাবে বসিয়ে নিলাম যাতে ঠিকঠাক দেখতে পারি সবকিছু। দেখার যে ছিদ্রগুলো আছে সেগুলোতে চোখ রাখতেই আঁতকে উঠলাম। প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছি!

আমার বন্ধুরা! কোথায় ওরা? কেউ তো নেই! সবাই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি?

আমি মুখোশটা দিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন চারজনের দিকে তাকিয়ে আছি! ওরা সবাই মেঝেতে গোল হয়ে বসে আছে। দুটো ছেলে, দুটো মেয়ে। সবার পরনে কালো রঙের পোশাক। প্রত্যেকটা পোশাকই বেশ আগেকার আমলের।

ওরা বোর্ড গেম খেলছে। বস্তায় থাকা বোর্ড গেমগুলোর মতই। কারও মুখই স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না। সবার চেহারা উজ্জ্বল আলোর আভায় ঢাকা পড়েছে।

এক ছেলের পরনে কালো রঙের স্যুট। ওর বিপরীতে বসা ছেলেটার পরনে সাদা শার্ট আর বাদামি রঙের থ্রি কোয়ার্টার প্যাণ্ট। ওর জুতোজোড়াও বাদামি রঙের। চামড়ার তৈরি জুতো, আকারে বড়সড়, রীতিমত বেঢপ। ছেলেটার কাঁধ ঝুলে রয়েছে, কেন যেন একটু বিষণ্ণ মনে হলো ওকে। বাকিদের যথেষ্ট উৎফুল্ল মনে হলো। মেয়ে দুটো ওদের কালো চুল ঝুঁটি করে বেঁধে রেখেছে। একজনের পরনে সাদা ব্লাউজ, সেটার উপর কালো রঙের লম্বা জাম্পার। আরেকজনের পরনে ধূসর রঙের পোশাক। সেই মেয়েটা খুব সম্ভবত কিছু নিয়ে কৌতুক করছে। বাতাসে হাত নাড়াচ্ছে আর হাসছে অনবরত।

‘এই! হচ্ছেটা কী?’ চিৎকার দিয়ে উঠলাম। ‘তোমরা কারা?’

পুরানো আমলের পোশাক পরা চারজন সামান্য একটু নড়লও না। মেয়েটা কী নিয়ে কৌতুক করছে তা কানে আসছে না আমার। কালো স্যুট পরা ছেলেটা বোর্ড গেমের পাশা হাতে নিল।

‘এই!’ ওদের উদ্দেশে আবার হাঁক ছাড়লাম। ‘আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? এই! শোনা যায় আমার কথা?’

কেউ ফিরে তাকাল না। সবাই যার যার মত খেলছে আর কথা বলছে। এরকম কেন হচ্ছে? ওদের পরনে আগেকার দিনের পোশাক কেন সেটাও বুঝতে পারছি না।

জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি, বুকের খাঁচায় বাড়ি মারছে হৃৎপিণ্ড। এক ঝটকায় মুখোশটা খুলে ফেললাম।

‘এটা... এটা অসম্ভব!’ চেঁচিয়ে বলে উঠলাম।

‘তোমার সমস্যাটা কী রব?’ বিল জিজ্ঞেস করল, জোরে জোরে কাঁধ ঝাঁকাচ্ছে। ‘কিছু হয়েছে নাকি? তুমি ঠিক আছ?’

আমি বেশ কয়েকবার চোখ পিটপিট করলাম। তারপর চোখ বড় বড় করে তাকালাম আমার তিন বন্ধুর দিকে। জুলি, ভ্যালেরি, বিল। সবাই আমরা বেসমেণ্টে। একটু আগে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় ওরা, এখন আবার ফিরে এসেছে।

‘পাথরের মূর্তির মত জমে গিয়েছিলে তুমি, তারপর হঠাৎ চিল্লাচিল্লি শুরু করলে।’ ভ্যালেরি বলল। ‘কীসের দিকে তাকিয়ে ছিলে?’

সশব্দে ঢোঁক গিললাম। ‘মুখোশটা পরে দেখো।’ বিলের উদ্দেশে বললাম। ‘এইমাত্র এমন কিছু দেখেছি যার কোনও ব্যাখ্যা নেই। ভয় পেয়ে গেছি, এমন উদ্ভট কিছু আমার সাথে আগে কখনও ঘটেনি!’

‘নিশ্চয়ই কোনও আয়নার দিকে তাকিয়েছ!’ বিল কৌতুক করে বলল। তারপর হুট করে ঘুষি মেরে বসল আমার পেটে। ব্যথার চোটে চোখে সর্ষেফুল দেখতে লাগলাম। বিলের নিজের শক্তি সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। মুখোশটার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকাল ও। ‘এটা পরলে তো আবার হাঁচি শুরু হবে।’

আমি ওর হাতে মুখোশটা গুঁজে দিলাম। ‘দোহাই লাগে, একবার শুধু পরে দেখো এটা!’

মুখোশটা টেনে প্রসারিত করে মুখের ভিতর ঢোকাল সে। ওর চোখজোড়া ছিদ্রের বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে।

কয়েক সেকেণ্ড পর ও বলে উঠল, ‘আরে! এরা কারা?’

কয়েক মুহূর্ত বিরতি। তারপর সেও চেঁচিয়ে উঠল। ‘এই! কারা তোমরা? এখানে ঢুকলে কীভাবে?’

আমি বিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওকে জিজ্ঞেস করার লোভ সামলাতে পারছি না। ‘তুমিও ওদের দেখেছ?’

আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর দিল না বিল। মনে হয় না ও আমার কথা শুনতে পেয়েছে। হা হয়ে গেছে ওর মুখটা, মুখোশের ভিতর থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বড় বড় চোখে দেখছে সবকিছু, যে কোনও মুহূর্তে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারে চোখজোড়া।

‘কে তোমরা?’ আবার জানতে চাইল বিল, এখন রীতিমত চিৎকার করছে! ‘কারা তোমরা? আমার প্রশ্নের জবাব দাও!’

তারপর হঠাৎ মুখোশটা খুলে ফেলল সে। টকটকে লাল হয়ে গেছে বেচারার মুখ। জোরে জোরে মাথা নাড়ছে, যেন পরিষ্কার করতে চাইছে মগজের ভিতরটা।

আমি ওর কাঁধ আঁকড়ে ধরলাম। ‘তুমি চারজনকে দেখেছ? আমাদের মতই বয়স ওদের? দেখলে মনে হয় ওরা প্রাচীন আমলের মানুষ! তাই না?’

বিল সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। বেচারার মুখটা এখনও হা হয়ে আছে। ‘হ্যাঁ।’ অবশেষে মুখ দিয়ে কথা বের করতে পারল সে। ‘চারজনকেই দেখেছি। মনে হচ্ছিল ওরা অন্য কোনও শতাব্দীর মানুষ! ওদের... ওদের চেহারা স্পষ্টভাবে দেখতে পাইনি।’

জুলি নীরবে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছে সে, চেহারায় খেলা করছে ভয়ের অভিব্যক্তি।

ভ্যালেরি অন্যদিকে তাকিয়ে জোরে শ্বাস ছাড়ল। ‘রসিকতার ফন্দিটা দু’জনে মিলে বের করেছ?’ বুঝতে পারলাম ও আমাদের উপর বিরক্ত। ‘সত্যিই মনে করো এমন কিছু আমি আর জুলি বিশ্বাস করব?’

‘না, না! কোনও ফন্দি আঁটিনি আমরা!’ বিলি বলল। ‘এই মুখোশ পরলেই চারটা ছেলেমেয়েকে দেখতে পাবে!’

ঘোঁত করে উঠল ভ্যালেরি। ‘হ্যাঁ হ্যাঁ! তা তো বটেই!’

আমি বিলির হাত থেকে মুখোশটা ছিনিয়ে নিলাম। তারপর ওটা ঠেসে ধরলাম ভ্যালেরির মাথার উপর। ‘ঠিক আছে। বিশ্বাস না হলে মুখোশটা পরেই দেখো।’

একটু যেন ইতস্তত বোধ করল সে। ওর কালো চোখজোড়া চশমার অপর প্রান্ত থেকে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে।

‘একবার পরে দেখই না।’ এবার রীতিমত জোর দিয়ে বললাম। ‘আমরা রসিকতা করছি না।’

অতঃপর ভ্যালেরি মুখোশটা পরল। তারপর সেটা মুখের উপর চাপাল জুলি। দু’জনেই একই দৃশ্য দেখেছে।

আমাদের মত বয়সের চারজন, ওদের পরনে পুরানো আমলের পোশাক। আমরা যেখানে বসি ঠিক সেখানেই বসে রয়েছে ওরা, একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছে, খেলছে কী যেন একটা!

জুলি মুখোশটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমরা চারজনই এক অন্যের দিকে তাকিয়ে আছি। সবাই চুপ, কেউ কোনও কথা বলছি না।

আমি মুখোশটা চোখের সামনে এনে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলাম। উল্টেপাল্টে দেখছি জিনিসটা। মুখোশের ভিতরের দিকটা বাইরে আনলাম, খুঁজে দেখছি অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায় কি না। কিন্তু কই, সেরকম কিছু পেলাম না তো। কাপড়ের তৈরি একটা সাধারণ মুখোশ। আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই এর মধ্যে। নেই অস্বাভাবিক কোনও কিছু।

‘মুখোশটা পরলে কী দেখা যায় সেটা আমরা জেনে গেছি, তাই না?’ জুলি কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল। ‘আমরা অতীতের কয়েকজন মানুষকে দেখছি! হয়তো ওরা এমন কেউ যারা এই বেসমেণ্টেই ছিল আজ থেকে একশো বছর আগে!’

কালো রঙের পুরানো ফোনটা বেজে উঠল। আমি তাকিয়ে রইলাম ওটার দিকে। এবার কি অতীত থেকে কোনও ফোন কল এল নাকি?

কলটা রিসিভ করতেই আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। ফোন দিয়েছে জুলির মা, ওকে তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে বলেছে।

বিলি আর ভ্যালেরিও বাসায় ফেরার জন্য উঠল। আমি ওদের বিদায় জানাতে সিঁড়ি পর্যন্ত উঠে এলাম। তখনও মুখোশটা শক্ত হাতে ধরে রেখেছি।

‘তুমি আবার মুখোশটা পরে দেখবে?’ বিলি দরজার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল।

আমার মেরুদণ্ড বেয়ে যেন ভয়ের একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। ‘না।’ ওকে জানালাম। ‘প্রশ্নই উঠে না।’

 

কিন্তু বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কৌতূহলের কাছে ভয়ের পরাজয় ঘটল।

রাতের খাবার খেয়ে হোমওয়ার্ক করার কথা ছিল কিন্তু দেখা গেল তা না করে চোরের মত সন্তর্পণে বেসমেণ্টে নেমে গিয়েছি।

লুকানো জায়গা থেকে কালো রঙের মুখোশটা বের করে আনলাম। পুরানো স্ট্যাণ্ড আপ ডেস্কের নিচের ড্রয়ারে রেখেছিলাম ওটা। পা টিপে টিপে কাউচের কিনারে গিয়ে বসলাম।

মুখোশটা পরার সময় বুকের ধুকপুকানি আশংকাজনক হারে বেড়ে গেল।

ওটা মুখে দেয়ামাত্র ওদের আবার দেখতে পেলাম। সেই আগের চারজন। পা ভাঁজ করে মেঝেতে বসে আছে ওরা। বারবার ওদের পোশাকের দিকে চোখ যাচ্ছিল। পুরানো, অস্বস্তিকর ভারী পোশাক ওদের পরনে। সেই আগের দিনের বোর্ড গেম খেলতে ব্যস্ত সবাই।

‘এই যে! আমার কথা শুনতে পাচ্ছ তোমরা?’ ওদের না ডেকে থাকতে পারলাম না। ‘পিছনে ঘুরে তাকাও!’

ওদের খেলায় এক মুহূর্তের জন্যও সামান্য একটু ছেদ পড়ল না।

‘হ্যালো!’ এবার চিৎকার দিয়ে উঠলাম। ‘হ্যালো?’

কোনও প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল না ওদের মধ্যে। এক ছেলের মাথায় সোনালী চুল, সে হাতের মধ্যে বোর্ড গেমের পাশাগুলো ঝাঁকাচ্ছে। খানিক পর ওগুলো বোর্ডের মধ্যে ফেলল সে। দান অনুযায়ী এগিয়ে নিল গুটি। চারজন অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে বোর্ড গেমটা খেলছে।

নিজের হাত দুটো গোল করে মুখের সামনে ধরলাম, তারপর চেঁচিয়ে উঠলাম তারস্বরে। ‘এই যে! আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না? এদিকে তাকাও! তোমরা...’

বাক্যটা শেষ করতে পারলাম না। কাউচের উপর জমে গেছি আমি! সম্পূর্ণ অপরিচিত এক লোককে বেসমেণ্টে দেখতে পেলাম! সব কিছু মুখোশ দিয়ে দেখছি তা তো বলাই বাহুল্য। ফার্নেসের ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা, অস্পষ্ট অবয়বের মত। বেশ লম্বা সে।

সম্পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষ! ফার্নেসের পিছনে লুকিয়ে আছে!

ব্যাটা এখানে করছেটা কী? ওই চারটা ছেলেমেয়ে কি জানে লোকটা ওদের পিছনে লুকিয়ে আছে? ছায়ার আড়ালে থেকে ওদের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করছে সেই লোক, ব্যাটার মতলবটা কী?

উত্তরটা সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেলাম। না, ওই চারজনের কেউই কিছু টের পায়নি। বোর্ড গেম থেকে নজর সরায়নি কেউ।

‘এই যে! ওদিকে তাকাও!’ আবার চিৎকার দিয়ে উঠলাম, ভয়ের চোটে আমার গলার আওয়াজ কর্কশ হয়ে গেছে। ‘ওখানে একজন লুকিয়ে আছে! তোমাদের পিছনে! এই যে!’

ওদের মধ্যে এক মেয়ে এবার বোর্ডে পাশা ফেলল, দান অনুযায়ী ঠেলতে লাগল ঘুঁটি।

আমি ভুরু কুঁচকে লোকটার দিকে তাকালাম। স্পষ্টভাবে দেখার চেষ্টা করছি ওই লোকের চেহারা। বয়স্ক একজন লোক, পরনে নীল ওভারঅল আর লাল শার্ট। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মাথায় চকচকে টাক। শুধু দুই কানের উপর শোভা পাচ্ছে সাদা চুলের গোছা।

লোকটার হাতে ওটা কী?

একটা রেঞ্চ টুল? হ্যাঁ! বিশাল আকৃতির ধাতব একটা রেঞ্চ টুল!

এই জিনিস দিয়ে ব্যাটা করবেটা কী? বোর্ড গেম খেলায় মগ্ন চারজনকে মারবে নাকি ওটা দিয়ে?

আমার শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী হয়ে এল, মনের অজান্তে নিজের হাত দুটো সজোরে চেপে ধরেছি মুখের সঙ্গে । ওদেরকে যে করেই হোক সাবধান করে দিতে হবে !

যদি সামনে গিয়ে ওদের স্পর্শ করতে চেষ্টা করি তাহলে কী হবে? মনস্থির করে ফেলেছি, যাই ঘটুক না কেন কাজটা করব ।

কিন্তু নড়াচড়া করার আগেই প্রচণ্ড জোরালো এক শব্দ কানে তালা ধরিয়ে দিল । পুরো বেসমেণ্ট থরথর করে কাঁপতে লাগল । আমি কাউচটা আঁকড়ে ধরলাম, ভারসাম্য রক্ষা করতে বেগ পেতে হচ্ছে।

কী হলো ? এভাবে পুরো বেসমেণ্ট কেঁপে উঠার কারণ কী ? বিস্ফোরণ ?

দেখলাম ওই চারজন উপুড় হয়ে পড়ে আছে !

এভাবে কেটে গেল কয়েক মুহূর্ত । খানিক পর সশব্দে কোনও কিছু ভাঙার আওয়াজ কানে এল ! বুঝতে পারলাম কাঠ ভাঙার আওয়াজ ওটা ।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আওয়াজটা জোরালো হচ্ছে । উচ্চরব যেন নারকীয় করে তুলেছে পরিবেশ !

‘নাআআআআআ!’ এক মেয়ে তারস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠল, ভয়ের চোটে ওর মুখ আপনাতেই খুলে গেছে । উফ, কী ভয়াবহ সেই চিৎকার!

‘কেউ সাহায্য করুন!’ গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল আরেক মেয়ে, উঠে বসার জন্য রীতিমত সংগ্রাম করতে হচ্ছে ওকে ।

কাঠ ভেঙে যাওয়ার তীব্র আওয়াজটা সারা বেসমেণ্টে ছড়িয়ে পড়েছে । এমন সময় মট করে আরেকটা শব্দ হলো । ওদের উপরে থাকা কাঠের বিমটা ফেটে যাচ্ছে ! খানিক পর ভারী সেই বিম ওদের মাথার উপর আছড়ে পড়ল ! পরক্ষণেই লাফিয়ে উঠল সেটা ! আবার ওদের উপর আছড়ে পড়ল । এমনটা ঘটল মোট দু’বার !

তারপরই পুরো সিলিং ধ্বসে পড়ল ওদের উপর ! বরফের ধবসের মত নেমে এল কাঠ আর পলেস্তেরা ।

থেঁতলে যাচ্ছে ওদের দেহ ! সবাইকে পিষে ফেলছে ওই ধ্বস ! চাপা পড়েছে সবাই, জ্যান্ত কবর দেয়া হলো যেন ওদের ।

‘নাআআআআআআ!’ প্রচণ্ড ভয়ে আমার বুক ফেটে বেরিয়ে এল চিৎকার ।

এই ভয়াবহ দৃশ্য সহ্য করতে পারছি না ।

চোখ বন্ধ করে ফেললাম । হাত দিয়ে খামচে ধরলাম মুখোশের প্রান্ত । ভয়াল জিনিসটা মুখ থেকে খুলে ফেললাম, ছুঁড়ে দিলাম মেঝেতে । হাঁটু ভাঁজ করে নিজেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম । আমার পেট সজোরে উঠানামা করছে । বমি আসছে, প্রচণ্ড কষ্টে সেটা আটকানোর চেষ্টা করছি ।

সাহস সঞ্চয় করে আবার চোখ খুলতে অনেক সময় লাগল । এবার চোখ খুলতেই দেখি পুরো বেসমেণ্ট সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় আছে ! কোথাও কোনও অঘটনের চিহ্ন নেই ! সবকিছুই একদম আগের মত, ঠিকঠাক । কোনও মৃত ছেলে কিংবা মেয়েকে দেখলাম না । কোনও বিম ভেঙে যায়নি, সিলিং থেকে সামান্য একটু ময়লাও খসে পড়েনি ।

‘এমন কিছু দেখার কারণটা বুঝতে পেরেছি ।’ জোরে জোরে বললাম কথাগুলো, হারানো সাহস ফিরে পাবার চেষ্টা করছি । একই সঙ্গে চেষ্টা করছি পুরো ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে । ‘আজ থেকে একশো বছর আগে ওই চারজন এই বেজমেণ্টে মারা যায় । এখানেই ওদের মৃত্যু ঘটে, চাপা পড়ে যায় ধ্বংসলীলার নিচে...’

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছি মুখোশটার দিকে, ভাঁজ হয়ে পড়ে আছে ওটা ।

কেন যেন আর এক মুহূর্তও এই বেসমেণ্টে থাকতে মনে চাইল না । সিঁড়ির কাছে গেলাম, উপরে চলে যাব । পা দুটো যেন জেলির মত নরম হয়ে গেছে, এখনও সেগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছি না । সমানে কাঁপছে দুই পা ।

আব্বু আর আম্মু বাইরে গেছে । কিন্তু তাও কেন যেন নিজেকে একা মনে হলো না । তবে যত যাই হোক, এমনিতেও আর একা থাকতে চাইছি না । কেউ সঙ্গে থাকলে বেশ ভাল হত।

বিলকে কল দিয়ে সব বলতে হবে । কিন্তু ফোনটা তুলতেই ডোরবেল বেজে উঠল ।

তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলাম । টান দিয়ে দরজা খুলতেই অপর প্রান্তে থাকা মানুষটাকে দেখে ভয়ের চোটে চেঁচিয়ে উঠলাম ।

মুখোশের কল্যাণে দেখা অতীতের সেই লোকটা ! সেই রহস্যময় টেকো লোক ! যে বেসমেণ্টে লুকিয়ে ছিল, হাতে ধরে রেখেছিল একটা রেঞ্চ টুল, হতভাগ্য চারজনের উপর লুকিয়ে নজর রাখছিল আমার সামনে থাকা এই লোকটাই!

একশো বছর আগের অতীত থেকে আগত এক লোক...

ঠিক আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে !

‘আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল, দুঃখিত।’ লোকটা বলল, আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

‘অ্যাঁ! দেরি! ন-না...’ তোতলানো শুরু করলাম। ‘না, এমনটা হতেই পারে না...’

লোকটা সাদা চুলের গোছা চুলকানো শুরু করল। ‘তোমার বাবা বাসায় আছে? আমাকে কল করে সে, বাসায় এসে ফার্নেসটা দেখতে বলে। আমি ক্যালভিন রেইমার। অন্য আরেকখানে কাজে আটকা পড়েছিলাম। নইলে আরও আগেই চলে আসতাম।’

হচ্ছেটা কী আসলে? কিছুই তো মাথায় ঢুকছে না!

আমি লোকটাকে মুখোশের ভিতর দিয়ে দেখেছিলাম, একশো বছর আগের কোনও এক পটভূমিতে। কিন্তু এখন লোকটাকে দেখে হুবহু একই রকম লাগছে! মুখোশে যেমনটা দেখেছিলাম তার সঙ্গে কোনও পার্থক্য নেই!

ও ভূত নাকি?

‘ভিতরে আসতে পারি?’ জিজ্ঞেস করল লোকটা। হাতে একটা বড় টুলবক্স ধরে রেখেছে, উঁচু করে সেটাই দেখাল। ‘ফার্নেসটা ঠিক করতে এসেছি।’

মুখোশে দেখা দৃশ্যগুলোর কথা ভাবলাম। লোকটা রেঞ্চ টুল হাতে বিমের পিছনে লুকিয়ে আছে। কী সাংঘাতিক!

ওকে বাসায় ঢুকতে দেয়া যাবে না! এই চিন্তাটাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মুখোশটা পরতেই যে টেকোকে দেখি আর এখন সামনে যে ব্যক্তি দণ্ডায়মান তারা দু’জন একই মানুষ!

‘মা-বাবা বাসায় নেই।’ লোকটাকে ফেরত পাঠানোর প্রয়াস পেলাম।

সে যেন আমার কথা শুনতেই পায়নি! দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ল, এক হাতে আমাকে সরিয়ে দিয়ে সোজা চলে গেল লিভিং রুমে।

‘কোনও সমস্যা নেই।’ সে বলল। ‘কোথায় কী আছে সব আমার জানা।’ এই বলে বেসমেণ্টের সিঁড়ি দিয়ে নামা শুরু করল।

আমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে, নীরবে অনুসরণ করছি লোকটাকে। ‘আপনি এই এলাকায় অনেক আগে থেকেই বাস করেন?’ কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম।

লোকটা খলখলিয়ে হেসে উঠল। ‘একদম ঠিক ধরেছ, বাছা! বিশ্বাস করো আর না-ই করো, আমি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে এই বাড়িটার দেখভাল করছি।’

লোকটার কথা শুনে তো আমি অবাক। ওকে অনুসরণ করে বেসমেণ্টের নিচে গেলাম। সে ফার্নেস খুলেই কাজে নেমে পড়ল।

পকেটে হাত ঢুকিয়ে রেইমার সাহেবের কাজ দেখছি। স্বাভাবিক থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। মাথার ভিতর তোলপাড় চলছে। কীভাবে সমগ্র ব্যাপারটার যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায় সেই চিন্তায় ব্যস্ত আমার মগজ। কিন্তু একটু পরপরই চিন্তার সুতো ছিঁড়ে যাচ্ছে। চার হতভাগ্য বন্ধু সিলিঙের নিচে চাপা পড়েছে- দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে বারবার।

‘মিস্টার রেইমার, নিচের এই জায়গাটায় কখনও ভয়ংকর কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছিল?’ কোলাব্যাঙের মত আওয়াজ বের হলো মুখ দিয়ে। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি তা তো বলাই বাহুল্য।

চশমার অপর প্রান্ত থেকে সে আমার দিকে তাকাল।

‘সবাই আমাকে ক্যাল বলে ডাকে।’ এই বলে সামান্য বিরতি দিল সে। ‘হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করলে কেন?’

এমনভাবে শ্রাগ করলাম যাতে মনে হয় শিশুসুলভ কৌতূহল থেকে এমনি একটা প্রশ্ন করেছি, কোনও ব্যাপারে জেনে-বুঝে প্রশ্নটা করা হয়নি। ‘এমনিই। বেসমেণ্টে তো কত দুর্ঘটনাই ঘটে। ভাবলাম এ বাড়িতেও অতীতে তেমন কোনও অঘটন ঘটে থাকতে পারে, বলা তো যায় না।’

এই শুনে ক্যাল ওর নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। ‘আসলেই এই বেসমেণ্টে ভয়ানক এক দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনাটাকে ট্র্যাজেডি বললেও কম হয়ে যায়। পঞ্চাশ বছর আগের ঘটনা সেটা। কিন্তু তোমার বয়স কত? এগারো? বারো? মনে হয় না এমন ভয়ংকর কাহিনী শুনতে চাইবে তুমি।’

‘হ্যাঁ!’ সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। উত্তেজনার চোটে স্বাভাবিক থাকার কথা ভুলে গেছি। ‘প্লিজ! আমি শুনতে চাই!’

স্ক্রু ড্রাইভারের ব্লেড দিয়ে ক্যাল নিজের সাদা চুলগুলো খোঁচাতে লাগল। ‘প্রচণ্ড শীত তখন। ওই সময়ে এখানে থাকত অ্যাণ্ডারসন পরিবার। ওদের ফার্নেসটা ছিল আগের আমলের কয়লা জ্বালানো ফার্নেসের মত।’

এই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ‘সেই দুর্ঘটনার পর ওদের পরিবার এখান থেকে চলে যায়। ওদের ছোট বাচ্চাটার নাম ছিল অ্যামেলিয়া। ও এই বেসমেণ্টে ছুটে বেড়াত। তো সেদিন কীভাবে যেন মেয়েটা ওর নানুর চোখ এড়িয়ে এই বেসমেণ্টে চলে আসে। খুব সম্ভবত জোরে দৌড় মেরেছিল মেয়েটা। হঠাৎ ও হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়।’

এই বলে আবার থামল ক্যাল, আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল। ‘তুমি নিশ্চিত? ঘটনাটা শুনতে চাও?’

আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। ‘জ্বী। পুরোটা বলুন। শুনব আমি।’

কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল সে। ‘কী আর বলব! সে এক বিরাট ইতিহাস। সংক্ষেপে বললে কেউ একজন ফার্নেসের দরজা খুলে রেখেছিল। অ্যামেলিয়া সেটার ভিতর পড়ে যায়, ঠিক উত্তপ্ত কয়লাগুলোর মাঝখানে! পুড়ে যায় ওর শরীর। এমনকী পুড়ে যায় শরীরের হাড়ও! সম্ভবত পুড়ে ছাই হতে মেয়েটার বেশি সময় লাগেনি। কেউ কোনও শব্দ পায়নি, শোনা যায়নি অ্যামেলিয়ার সামান্য একটু চিৎকার। অনেক অনেক পরে শুধু পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া ছোট একটা কংকাল খুঁজে পাওয়া যায়।’

এই বলে ক্যাল মাথা নাড়ল। লোকটাকে আফসোসে পেয়ে বসেছে মনে হয়। ‘এই মর্মান্তিক ঘটনার পরপরই অ্যাণ্ডারসন পরিবারের বাকি সদস্যরা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। অবশ্য অনেকেই মনে করে অ্যামেলিয়ার ভূত এ বাড়িতে রয়ে গেছে। কেউ কেউ তো বলে অ্যামেলিয়ার কারণেই এ বাড়ির বেসমেণ্টটা এখন ভূতুড়ে।’

আমার মুখটা যে কখন হাঁ হয়ে গেছে তা নিজেও জানি না। বুঝতে পারছি না কী বলা উচিত।

কী সাংঘাতিক এক অতীত বয়ে বেড়াচ্ছে এই বেসমেণ্ট! কিন্তু আমি যে চারজনকে মুখোশের ভিতর দিয়ে দেখলাম তাদের সঙ্গে এই দুর্ঘটনার সম্পর্ক কী? আর এতগুলো বছর অতিবাহিত হবার পরও ক্যালের চেহারায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি কেন?

‘আশা করি আমার কথা শুনে ভয় পাওনি।’ ক্যাল সঙ্গে আনা টুলবক্সটা বন্ধ করল। ‘নিছকই একটা গল্প। এর বেশি কিছু না।’

‘সমস্যা নেই, ভয় পাইনি।’ তাকে আশ্বস্ত করলাম। ‘কিন্তু অ্যামেলিয়ার মৃত্যু ছাড়া আর কোনও দুর্ঘটনা এখানে ঘটেনি?’

এক মুহূর্ত ভাবল লোকটা, তারপর মাথা নাড়ল। ‘না। আর কোনও দুর্ঘটনার কথা মনে করতে পারছি না।’ ফার্নেস পর্যবেক্ষণে মনোযোগ দিল সে। ‘নিচের পাইপটা বদলাতে হবে। তোমার বাবাকে বোলো আমি কাল আসব।’

সিঁড়ি বেয়ে ওর পিছন পিছন উপরে উঠে এলাম। লোকটা বেরিয়ে যেতেই দরজা বন্ধ করলাম। তৎক্ষণাৎ ছুট দিলাম ফোন করতে। আজকের পুরো ঘটনা বন্ধুদের জানাতে হবে।

***

পরের দিন বিকেল। আমরা চারজন লিভিং রুমে বসে আছি। কেউই বেসমেণ্টে যেতে আগ্রহী না।

‘একশো বছর আগের সেই লোকটা এ বাড়িতে এসেছিল?’ ভ্যালেরির চোখেমুখে ফুটে রয়েছে ভয় আর অবিশ্বাস। ‘একটুও ভয় করল না? লোকটাকে ভিতরে ঢুকতে দিলে?’

‘আর কিছু করার ছিল না।’ ভ্যালেরিকে পরিস্থিতিটা বোঝানোর প্রয়াস পেলাম। ‘লোকটা আমাকে ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ে। বলেছিল ফার্নেস ঠিক করতে এসেছে। আজ আবার আসবে লোকটা।’

‘আমরা আর ওখানে যেতে পারব না।’ বিল বেসমেণ্টের দরজা নির্দেশ করে বলল। ‘নতুন একটা জায়গা খুঁজে বের করতে হবে।’

‘না। নিচে আমাদের যেতেই হবে।’ জোর দিয়ে বললাম কথাটা। ‘ব্যাপারটা নিয়ে আজ সারাদিন ভেবেছি। রহস্য সমাধানের একটা উপায় এসেছে মাথায়।’

‘কী সমাধান?’ বিল জিজ্ঞেস করল।

‘কেন আমরা মুখোশ পরলেই চারজনকে দেখছি সেই রহস্যের সমাধান। আমার মনে হয় ওদের সাহায্যের প্রয়োজন। বিশেষ করে আমাদের সাহায্য। আমরা যদি কোনওভাবে সিলিং ধ্বসের ব্যাপারে জানিয়ে দিতে পারি, তাহলে ওদের আর এভাবে মরতে হবে না।’

‘কিন্তু রব, ওরা তো আমাদের দেখতে কিংবা শুনতে পায় না!’ জুলি আপত্তির সুরে বলে উঠল। ‘তাহলে কীভাবে ওদের সিলিং ধ্বসের ব্যাপারে সাবধান করব?’

‘একটা না একটা উপায় তো থাকবেই।’ আমি হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নই। ‘ওদের সাথে যোগাযোগের একটা উপায় খুঁজে বের করতে হবে।’

হঠাৎ একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল মাথায়, সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলাম। ‘নিচে এসো। ওদের আমরা বাঁচাতে পারব। কী করতে হবে সেটা বেসমেণ্টে গেলেই বুঝতে পারবে।’

বন্ধুদের রীতিমত জোর করে সিঁড়ি দিয়ে নামাতে হলো।

বেসমেণ্টে প্রবেশ করেই থমকে দাঁড়ালাম চারজন। একটা শব্দ কানে আসছে!

মৃদু একটা শব্দ ভেসে আসছে শেষ প্রান্ত থেকে! যেন দেয়ালে ঘষা খাচ্ছে কিছু একটা।

কারও পায়ের শব্দ নাকি?

ঘষর ঘষর ঘষর ঘষর।

আগের চেয়ে জোরালো হয়েছে আওয়াজটা।

‘ওই ছোট বাচ্চাটার ভূত!’ চিৎকার দিয়ে উঠল ভ্যালেরি।

‘হায় হায়!’ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল আমার। তাও যতটা সম্ভব সাহস সঞ্চয় করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম।

ঠিক তখনই ফার্নেসের পিছন থেকে ক্যাল ওর মাথাটা বের করল। হাতে থাকা রেঞ্চটাকে সে পাইপের সঙ্গে চেপে ধরে রেখেছে। রেঞ্চ ঘোরানোর কারণেই ঘর্ষণের শব্দটা ভেসে আসছিল।

‘চমকে গিয়েছিলে নাকি?’ ক্যাল জিজ্ঞেস করল।

রেঞ্চ মাটিতে রেখে আমাদের দিকে এগিয়ে এল সে। ওর পরনে আজও গতকালকের পোশাক। লাল শার্ট আর ডেনিমের ওভারঅল।

লোকটা এখানে এল কী করে? কিছুই তো বুঝতে পারছি না। বাসায় ঢুকল কেমন করে এই লোক?

‘একটা ভালভ কিনতে হবে।’ সে বলল। ‘এক ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসব।’ এই বলে ক্যাল আমাকে ইশারায় ডাক দিল।

‘গতকালকের ব্যাপারটার জন্য আমি লজ্জিত।’ ফিসফিস করে বলল সে। ‘অ্যামেলিয়া নামের এক বাচ্চা মেয়ের কথা বলেছিলাম না? পুরোটাই বানানো গল্প। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছিল ভৌতিক গল্প শুনতে চাইছ। তাই...’

‘বানানো গল্প?’ চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।

সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল সে। ‘বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলাটা আমার এক ধরনের শখ বলতে পারো। আমি গল্প বলতে ভালোবাসি। হয়তো বা কোনও একদিন তোমাকেও ভৌতিক গল্পের চরিত্র বানিয়ে দেব!’ এই বলে সে চোখ টিপল।

বেসমেণ্টের সিঁড়ি দিয়ে লোকটাকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলাম। এদিকে আমি তো দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে গেছি।

লোকটা কি আসলেই গল্পটা বানিয়ে বলেছে? ভাবতে ভাবতে আবার বন্ধুদের কাছে ফিরে গেলাম।

বিল আমার হাতে কালো মুখোশটা ধরিয়ে দিল। ‘এখন কী করবে?’ ও জিজ্ঞেস করল।

‘ওই চারজনের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করব।’ ওকে জানালাম। ‘চেষ্টা করব ওদের সতর্ক করে দিতে।’

মুখোশটা মাথার উপর চাপিয়ে টেনে নামালাম। ছিদ্র দুটোকে নিয়ে এলাম চোখ বরাবর।

হ্যাঁ! ওই তো ওরা! প্রাচীন আমলের চারটা ছেলে মেয়ে। মেঝেতে একটা বোর্ড গেম রাখা, সেটাকে ঘিরে বসে রয়েছে ওরা চারজন।

‘তোমাদের নাম কী?’ তারস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। ‘হ্যালো? শোনা যাচ্ছে আমার কথা? নাম কী তোমাদের?’

ওদের একজনের মুখও স্পষ্টভাবে দেখতে পারলে হত। কিন্তু চারজনের অবয়বই সম্পূর্ণ ঝাপসা। উজ্জ্বল আলোর আভায় চারজনের চেহারাই অস্পষ্ট হয়ে আছে।

‘তোমাদের চারজনের নাম কী? শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?’

নাহ। ওদের কাছ থেকে কোনও সাড়াশব্দই পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকী সামান্য একটু প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হলো না ওদের মধ্যে।

ওরা পাশাটাকে বারবার ঘুরিয়ে চলছে, সেই অনুযায়ী দিচ্ছে ঘুঁটির চাল।

ওদের ডাকতে ডাকতে সামনে এগিয়ে গেলাম। চলে গেলাম রুমের অপর প্রান্তে। সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলাম এক হাত। বসে থাকা এক ছেলের কাঁধ স্পর্শ করতে চাইছি।

আমার বাড়িয়ে ধরা হাতটা ওই ছেলেকে ভেদ করে চলে গেল।

ছেলেটা সামান্য একটু কাঁপলও না।

ওখানে থাকা এক মেয়ের চুল ধরে টানার চেষ্টা করলাম। কিন্তু লাভ হলো না। আমার হাত ওদের ভেদ করে চলে যাচ্ছে। মেয়েটার চুলের ছোঁয়াও অনুভব করতে পারছি না।

প্রচণ্ড বিরক্তি আর হতাশার চোটে মুখোশটা একটানে খুলে ফেললাম। ‘ওদের ধারে-কাছে যাওয়াই যাচ্ছে না!’ বন্ধুদের জানালাম নিজের ব্যর্থতার কথা।

‘এটা দিয়ে কাজ হয় কি না দেখো।’ এই বলে জুলি আমার হাতে এক টুকরো কাগজ ধরিয়ে দিল। ‘ওরা যেন তাড়াতাড়ি বেসমেণ্ট ছেড়ে বেরিয়ে যায় সেটা কাগজে লিখেছি।’

আমি জুলির দিকে মুখোশটা এগিয়ে দিলাম। ‘তুমি ওদের কাগজটা দেয়ার চেষ্টা করো।’

খানিক ইতস্তত করে সে মুখোশটা পরে নিল।

ভ্যালেরি, বিল আর আমি জুলিকে এগিয়ে যেতে দেখলাম।

সে ওই চারজনকে কাগজটা দেয়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। কিন্তু লাভ হচ্ছে না কোনও। কাগজটা জুলির হাতেই পড়ে রয়েছে। কেউ সেটা তুলে নেয়নি।

একসময় সেও মুখোশটা খুলে আমার দিকে ছুঁড়ে মারল। ‘নাহ, অসম্ভব।’ সে মন্তব্য করল। ‘কোনও কিছুই ওদের নজরে পড়ছে না।’

‘মারা যাবে! সিলিঙের নিচে চাপা পড়বে সবাই।’ ফুঁপিয়ে উঠল ভ্যালেরি। ‘কী ভয়ংকর!’

‘ওদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের একটা না একটা উপায় তো থাকবেই!’ আমি এই ব্যর্থতা কিছুতেই মানতে পারছি না। ‘কোনও একটা গুপ্ত উপায়। সম্পূর্ণ গোপন কিছু। যার সাথে এই বেসমেণ্টের সংযোগ আছে। থাকার তো কথা! কোনও একটা গুপ্ত উপায়ে...’

খুব সম্ভবত আমরা চারজন একসঙ্গে ক্লজিটটার দিকে তাকাই।

গোপন কিছু... একটা গোপন ক্লজিট... এই বেজমেণ্টের একমাত্র ক্লজিট যেটা বন্ধ করে রাখা হয়েছে!

‘ক্লজিটটা খুলতে হবে।’ ভ্যালেরি বলল। ‘আমি নিশ্চিত ক্লজিটটা খুললে সমাধান একটা পাওয়া যাবেই!’

‘দাঁড়াও।’ ওদের উৎসাহে পানি ঢেলে দিলাম। ‘আমার মনে হয় ক্লজিটের সাথে অশুভ কোনও ব্যাপার জড়িয়ে আছে। ক্লজিটের দরজা খোলা উচিত হবে কি না বুঝতে পারছি না। হয়তো দরজাটা কোনও সঙ্গত কারণেই বন্ধ করে রাখা হয়েছে।’

কিন্তু এত কিছু বলে কোনও লাভ হলো না কারণ দেরি হয়ে গেছে। আমার তিন বন্ধুই চলে গেছে ক্লজিটের সামনে, বন্ধ দরজাটা পিছনের দিকে ঠেলছে সবাই।

‘দোহাই লাগে তোমাদের!’ চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। ‘আমার অনেক ভয় করছে। দরজাটা খোলা...’

বিলের গায়ে প্রচণ্ড শক্তি। গায়ের জোরে দরজার ছিটকিনিটা টান দিয়ে খুলে ফেলল সে। অনেক দিনের পুরানো ছিটকিনি বিনা প্রতিবাদে বিলের হাতে চলে এসেছে। জিনিসটা মেঝেতে ফেলে দিল সে।

ভ্যালেরি মুখ বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকাল। ‘ক্লজিটের ভিতর কী আছে সেটা দেখতে হবে রব।’ সে মৃদু কণ্ঠে বলল। এরপর আর কথা না বাড়িয়ে দরজার হাতল ধরে টান দিল। ভারী দরজাটা অনেক দিনের পুরানো, খোলার সময় ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে উঠল।

আলো পড়ল ক্লজিটের ভিতর। চারজন দরজার সামনে গিয়ে জড়ো হলাম। কয়েক মুহূর্ত পর আঁতকে উঠলাম সবাই।

***

‘পুরানো কাপড়চোপড়! সব প্রাচীন আমলের!’ ঘোষণা দেয়ার ভঙ্গীতে বলে উঠল জুলি, এক হাতে ধরে রেখেছে লেসযুক্ত কলারের রং চটা ব্লাউজ। ‘ক্লজিট তো দেখছি পুরানো কাপড়ের আস্ত একটা গুদাম!’

বিল হাঁচি দেয়া শুরু করল। ‘জুতোগুলো খেয়াল করেছ?’ পালোয়ান সাহেব এক জোড়া কালো জুতো উঁচু করে ধরল। জুতোর মধ্যে কোনও ফিতে নেই, তার বদলে আছে বোতাম। ফুঁ দিয়ে জমে থাকা ধুলো সরাল বিল, পরক্ষণেই আরও একটা হাঁচি দিয়ে উঠল।

জুলি একটা কালো রঙের করডুরয় জাম্পার সামনে মেলে ধরল। ‘ওয়াও! এই পোশাকটা তো দারুণ! এমন পোশাকই তো অতীতের সেই ছেলেমেয়েদের পরনে ছিল।’

ওর কথা শুনে শিউরে উঠলাম। ‘আমার মনে হয় না এসব ধরা ঠিক হচ্ছে।’

কিন্তু এরই মধ্যে জুলি লেসযুক্ত ব্লাউজটা টি শার্টের উপর দিয়ে পরে ফেলেছে।

বিল সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে একটা স্যুট জ্যাকেটের দিকে। পোশাকটার কলার আর নিচের ভাঁজের অংশটুকু বেশ প্রশস্ত।

‘থামো তোমরা!’ ওদের কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে অনুরোধ করলাম। ‘এই পোশাকগুলো সম্ভবত অতীতের সেই মৃত ছেলে মেয়েদের!’

‘হ্যাঁ, ঠিক তাই!’ জুলি তৎক্ষণাৎ সম্মতি জানাল, ভারী পোশাকটা উল্টেপাল্টে দেখছে। ‘এসব পোশাকই ওদের পরনে ছিল!’

‘তার মানে এই প্রাচীন পোশাক নিজেদের গায়ে চাপাতে হবে।’ ভ্যালেরি বেশ জোরের সঙ্গে কথাটা বলল। ‘এখনও বুঝতে পারছ না রব? খুব সম্ভবত এই পোশাকগুলোই বেসমেণ্টের সেই গোপন জিনিস। যা আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি। এগুলো একবার পরতে পারলে হয়তো ওদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ! ঠিক তাই!’ সোৎসাহে সম্মতি জানাল বিল। ‘এগুলো সব ওদের জামা। এই জামাগুলো আমাদের গায়ে থাকলে হয়তো ওরা আমাদের কথা শুনতে পাবে। একবার কথা বলতে পারলেই হয়, দুর্ঘটনার ব্যাপারে জানিয়ে দেব তখন।’

জামা গায়ে দিলেই যে কাজ হবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু আর কিছু না বলে ওদের সঙ্গে যোগ দিলাম। একটা টাইট শার্ট পরে নিলাম, ওটার কলার সাদা রঙের। বস্তার মত একটা টুইড প্যাণ্ট পরলাম, সেটা আমার হাঁটু পর্যন্ত ঢাকতে পারল শুধু।

প্রাচীন পোশাক গায়ে চাপানোর পরবর্তী কয়েক মিনিট আমরা একে অপরকে দেখার পিছনে ব্যয় করলাম। সবাইকে দেখতে উদ্ভট আর হাস্যকর লাগছে। আমরা প্রত্যেকেই স্বীকার করলাম কাপড়গুলো পরতে খুবই অস্বস্তিকর। আগের আমলে আমাদের বয়সী ছেলে মেয়েরা অত স্মার্ট ছিল না সে বিষয়ে একমত হলাম সবাই।

‘এবার মুখোশটা পরা যেতে পারে।’ ভ্যালেরি পরামর্শ দিল। ‘দেখা যাক ওদের এবার স্পর্শ করা যায় কি না।’

‘না, না! আরও একটা জিনিস বাকি আছে।’ জুলি বলে উঠল। ‘সবকিছু ঠিকঠাক মতই করা উচিত। ওটা না করলে পুরো ব্যাপারটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।’

এই বলে সে বেসমেণ্টে থাকা কাঠের বাক্স থেকে পুরানো একটা বোর্ড গেম বের করল। তারপর মেঝেতে এনে রাখল পাহ-চিসি নামের সেই বোর্ড গেম। ‘ঠিক আছে, এবার বসে পড়ো সবাই।’ নির্দেশ দিল সে। ‘এসো, বোর্ড গেমটা খেলা শুরু করি। ঠিক যেভাবে অতীতের ওই চারজন খেলছিল।’

আমরা সবাই বোর্ডটাকে ঘিরে মেঝেতে বসে পড়লাম।

‘এবার কাজ হোক। অনেক আশা নিয়ে এসব করছি।’ আমি বললাম। ‘ওদের কাছে পৌঁছতে পারলেই হয়।’

খেলা শুরুর পর কেটে গেল কয়েক মিনিট। আমি মুখোশটা নিয়ে পরতে যাব এমন সময় থমকে গেলাম। সিঁড়ির কাছে ধপধপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে শব্দটা। ভারী এবং ধীরগতির পদশব্দ, সঙ্গে যোগ হয়েছে সিঁড়ির ক্যাঁচকোঁচ।

আমরা সবাই ঘাড় ঘোরাতেই ক্যাল নামের সেই লোকটাকে দেখতে পেলাম। ‘ড্রেস আপ গেম? যেমন খুশি তেমন সাজো?’ সে জানতে চাইল। ‘বাহ, বেশ স্বাভাবিকভাবে খেলছ খেলাটা। মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ বাস্তব। যাই হোক, খেলো তোমরা। আমার কারণে খেলা বন্ধ করার কোনও দরকার নেই।’ এই বলে ফার্নেসের পিছনে চলে গেল সে, রেঞ্চ দিয়ে পাইপ ফিটিঙের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

উপলব্ধি করলাম পুরো ব্যাপারটা রীতিমত শতভাগ নিখুঁত হয়েছে! ক্যাল এখন পিছনে থাকায় মুখোশে দেখা দৃশ্যটাই হুবহু অনুকরণ করতে সক্ষম হয়েছি আমরা।

কিন্তু ওই হতভাগ্য চারজনের সঙ্গে কি কথা বলতে পারব? পারব ওদের সতর্ক করে দিতে?

আবার কালো মুখোশটা হাতে নিলাম। কিন্তু এবার আর সেটা পরার সময় পেলাম না।

‘ফার্নেস!’ ক্যাল পিছন থেকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল। ‘এই ফার্নেস... ফার্নেসটা যে কোনও সময় বিস্ফোরিত হবে!’

ক্যালের কথা শুনেই যেন কেঁপে উঠল সমগ্র ধরণী, বিস্ফোরণটা ঘটতে বেশি সময় লাগেনি। চারজনের কেউই আর বসা অবস্থায় থাকতে পারলাম না, প্রচণ্ড কাঁপুনির চোটে উল্টে পড়ে গেলাম সবাই।

আমার ফুসফুস সম্পূর্ণ বায়ুশূন্য হয়ে গেছে, শ্বাস নেয়ার জন্য ডাঙায় উঠা মাছের মত খাবি খাচ্ছি। প্রচণ্ড যন্ত্রণা গুলির মত আঘাত করল শরীরে। মাথার উপর থেকে আকস্মিক তীব্র এক শব্দ নিচের দিকে নেমে এল! সবকিছু বোধহয় ভেঙে পড়ছে!

অতি কষ্টে উপরের দিকে তাকালাম। দেখলাম সিলিঙের বিম ভেঙেচুরে দুই ভাগে বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে!

আমরা চারজনই চিৎকার শুরু করে দিয়েছি।

চিৎকার করছি তো করছি, করছি তো করছি। একটানা করেই চলছি। থামাথামির কোনও নাম নেই।

বিম ভেঙে নিচের দিকে নামতেই সমগ্র সিলিং ধ্বসে পড়তে শুরু করল।

জীবনের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে ভয়াল মুহূর্তে এসে আমি পুরো ব্যাপারটার ভয়াবহতা বুঝতে পারলাম!

আমি এই সর্বনাশা কালো মুখোশের মূল তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম হয়েছি!

আমরা সবাই ভুল ভেবেছিলাম! ও খোদা! কী মারাত্মক এক ভুল করে বসে আছি!

মুখোশে দেখা ওই চারজন ছেলে মেয়ে আর কেউ না, স্বয়ং আমরা!

ওই চারজন মূলত আমরাই ছিলাম!

মুখোশটা কখনওই আমাদের অতীত দেখায়নি! ওটা আমাদের ভবিষ্যৎ দেখিয়েছিল!