NB-7 - দীপান্বিতা দে রায়

কল্পবিজ্ঞানের গল্প

অলংকরণ - পিয়াল চক্রবর্তী

“একটা ভূত দেখতে চাই। সন্ধান থাকলে জানাবেন প্লিজ। বেগুনকোদড় কিম্বা রাইটার্স বিল্ডিং তো অনেক হলো। কার্শিয়াংয়ের ডাওহিলস কিম্বা রাজস্থানের কুলধারা নয়। সব ঘুরে ক্লান্ত আমি। কয়েকটা মশার কামড় আর বিনিদ্র রজনী ছাড়া কিছুই জোটেনি। তাই আস্ত অরিজিনাল ভূতের সন্ধান থাকলে জানাবেন।”

ফেসবুকের স্ট্যাটাস আপডেট করলো শেখর। পোস্ট করে ফেলুদা স্টাইলে ধরা গোল্ডফ্লেকে একটা লম্বা টান দিলো। বরাবর ডাকাবুকো স্বভাবের ছেলে। পেশায় সাংবাদিক। তাই পেশা ও নেশার সূত্রে পুরো ভারত চষে বেড়িয়েছে। নেশা ওই ভূত দেখা। অবশ্য রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের মুখটা আয়নায় দেখে বলেই হয়তো ভূতও ভয় পেয়ে দেখা দেয় না আর।

এমনিতেই লেখালেখি করার সুবাদে প্রচুর ফ্যান ফলোয়িং তাই পোস্টের আধ ঘন্টার মধ্যেই লাইক কমেন্টের বন্যা বয়ে গেলো। কেউ কেউ কমেন্ট করলো তাদের আদি বাড়িতে এক রাত কাটানোর নেমন্তন্ন জানিয়ে। কেউ কেউ গুগলবাবার ভরসা করে বিভিন্ন জায়গার নাম সাজেস্ট করতে লাগলো। অত্যন্ত ধৈর্যশীল হয়ে প্রতিটি কমেন্টের রিপ্লাই দিল শেখর। আসলে এই আ্যটেনশন সে বেশ উপভোগ করে।

অবশেষে টুকটাক কাজ গুছিয়ে রাত একটার পর ঘুমাতে যাবে ঠিক করলো। পরেরদিন আবার অফিস। ঠিক ঘুমাতে যাওয়ার আগেই আবার মাথাটা ধরলো। এই হয়েছে এক জ্বালা কয়েকদিন থেকে। সারাদিন ঠিক থাকে, রাত হলেই মাথাটা যন্ত্রণা করতে শুরু করে। ফ্রেশ হাওয়ায় যদি কিছুটা কমে এই ভেবে আরেকটা সিগারেট নিয়ে ব্যালকনিতে বসলো। আজকাল ডিস্প্রিন খেলেও ঠিক হচ্ছিল না। শেষে নিখিল জেঠুর কাছে যেতেই ঠিক হলো। ওনারই বাড়িতেই ভাড়া থাকে শেখর, জেঠু হোমিওপ্যাথির টুকটাক ওষুধ দেয়, আগেও দিয়েছে।

একটু সময় পরেই...

পিং শব্দে শেষ একটা নোটিফিকেশন এল ফোনে। “রাতের অতিথি” নামে একজন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। সারাদিন প্রচুর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পায় শেখর। মোটামুটি সবাইকে আ্যড করে নেয়। তাই ভালো করে প্রোফাইল ভিজিট না করেই আ্যড করে নিল শেখর।

শেখর আ্যন্ড রাতের অতিথি আর ফ্রেন্ডস নাও...

সকালে উঠেই মিষ্টি এক সুপ্রভাতের মেসেজ পেয়ে মন ভরে গেল। কাল রাতের নতুন বন্ধুটি যতই ফেক আইডি বানিয়ে আসুক সে যে তার প্রতি আকৃষ্ট সেটা বুঝতে বাকি রইলো না শেখরের। যেমন চলছে তেমন চলুক ভেবে প্রতি-সুপ্রভাত জানিয়ে দিল। তারপর অফিস যাওয়ার তাড়ায় প্রায় ভুলেই গেল ওর কথা। ভীড় মেট্রো ঠেলে অফিস পৌঁছাতেই দেখলো আরও অনেক মেসেজ পাঠিয়েছে সে। আপাতত ব্যস্ততা থাকায় সে দিকে মন না দিয়ে আর্টিকেল লিখতে বসে গেল। কাজের চাপে ফোন দেখার সময় পায়নি অনেকক্ষণ। লাঞ্চ ব্রেকে ফোন ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখে তার প্রচুর পুরোনো লেখা ও ছবিতে লাইক দিয়েছে নতুন বন্ধুটি। ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে শেখর।

এর মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। একটা নিউজ কভার করতে শেখর গেছিল ঝাড়গ্রাম। সেখানে নেট ভালো কাজ না করায় এ’কদিন ফেসবুক খোলার সুযোগ হয়নি ওর।

কলকাতায় ফিরেই সায়ন্তিকাকে ফোন করলো শেখর। একই অফিসে কাজ করে ওরা। সায়ন্তিকা ফটো জার্নালিস্ট। অনেক প্রজেক্টেই একসাথেই কাজ করেছে। এই অফিসে আসার পর ওর সাথেই প্রথম বন্ধুত্ব হয়। এখন বন্ধুত্বটা বেশ গভীর। তবে সেটা নিখাদ বন্ধুত্ব। শেখর জানে মেয়েটার মধ্যে অদ্ভুত এক জেদ আর দৃঢ়তা আছে।

“এই কদিন নেট না থাকায় একদিকে যেন শান্তি ছিল, সন্ধ্যে হলেই কেমন টুপ করে অন্ধকার হয়ে যেতো, সারাদিন নিউজ কভার করে হোটেলে ফিরেই শান্তির ঘুম। ওখানে বিট্টুর হাতের দেশি মুরগীর ঝোল মিস করছি। আর মাথা ব্যথাটাও হতো না।”

“মাথা ব্যথার আবার কী কেস?” ওপ্রান্ত থেকে সায়ন্তিকা জিজ্ঞেস করলো।

“আরে বলিস না, এখানে এত পলিউশন আর আওয়াজ, মাঝে মাঝেই মাথাটা ধরে যায়। ও কিছু না।”

“ডাক্তার দেখাস।”

“চাপ নিস না, ওষুধ খাচ্ছি, চল রে আজকে কাটি। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। কাল আবার অফিস আছে।” গুডনাইট বলে ফোন রেখে দিলো শেখর।

পরেরদিন অফিস থেকে ফিরে সময় নিয়ে বসলো ফেসবুক খুলে। নেটওয়ার্ক না থাকায় এই কদিনে কিছুই দেখা হয়নি।

অজস্র মেসেজ আর ভিডিওতে ভরে উঠেছে তার মেসেঞ্জার। এবং কিছু ছবি দেখে সে নিজে বেশ দ্বন্দ্বে পড়েছে। তার ঝাড়গ্রামের কিছু ছবি, এমন কিছু ছবি যা শুধুই তার ক্যামেরা বন্দী হয়ে আছে। এগুলোই তাকে পাঠিয়েছে “রাতের অতিথি”। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? যদিও সব ছবি তার নিউজ কভার আর প্রাকৃতিক দৃশ্য ঘিরেই তবু এই ছবি পাওয়া মানে সেও সেই সময়ে ওখানেই উপস্থিত ছিল। এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পেলো না শেখর। দ্রুত টেক্সট করলো “রাতের অতিথি’র” মেসেঞ্জারে। কিন্তু সব মেসেজ আনসিন হয়ে পড়ে রইলো। সেদিন রাতটা অপেক্ষাতেই কাটলো। সকালেও অচেনা একটা অস্বস্তিকে সঙ্গে নিয়েই বেরোলো অফিসের উদ্দেশে। কিন্তু মেট্রোতে বসেও সারাক্ষণ মনে হলো যেন কেউ তার অজান্তে তাকে লক্ষ করছে। অস্বস্তিটা রয়েই গেলো সারাদিন। কাজে কিছুতেই মন বসাতে পারছে না সে। সারাদিন প্রচুর ভুল হলো। চিফ এডিটর নিজে এসে একবার ধমক দিল একটা ভুল আর্টিকেলের জন্য। বারবার মনে হচ্ছে ওকে যেন কেউ ফলো করছে। অফিসের ক্যান্টিনেও মনে হলো কেউ দেখছে ওকে। আবার একটা নিউজ কভার করতে যেই অটোতে উঠতে যাবে ওমনি মনে হলো কেউ যেন টুক করে সরে গেলো। একটা চাপা অস্বস্তি থাকলো সারাদিন।

“এই শেখর, কী রে কখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছিস না?” হঠাৎ সম্বিত ফিরলো ওর, ফিরে দেখে সায়ন্তিকা ডাকছে ওকে।

“কী রে ঝাড়গ্রামের খবরটা কদ্দূর? বস রিভিউ চাইছিল। তোকে অনেকক্ষণ ধরে খুঁজছে আর তুই এখানে দাঁড়িয়ে ধোঁয়ায় দম দিচ্ছিস।” সায়ন্তিকা কথাগুলো বলেই নিজের ডেস্কে চলে গেলো।

শেখর ভাবলো একবার ওর প্রবলেমটা আলোচনা করে দেখবে কিনা সায়ন্তিকা’র সাথে, তারপর ভাবলো থাক। যদি পাত্তা না দেয়, হয়তো ওরই মনের ভুল হচ্ছে তাই আর কয়েকদিন দেখাই যাক।

কিন্তু এমনকিছু হলো কয়েকদিনের মধ্যে যে ঘটনার কিনারা করা তো দূর, সে যেন আরও গভীর চোরাবালিতে ডুবে যেতে লাগলো।

ঝাড়গ্রামের আর্টিকেলটা অর্ধেক লিখেই শুয়ে পড়েছিল রাত্রে। সকালে উঠে মেল চেক করতে গিয়ে দেখে এডিটরকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আ্যটাচমেন্ট খুলে দেখে পুরো আর্টিকেল কম্পলিট। কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো শেখর। বেশ বুঝতে পারছে একটা কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। তবে কি কেউ তাকে ফলো করছে? তার আইডিটাও হ্যাক হয়েছে। আপাতত এছাড়া আর কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না জার্নালিস্ট শেখর। নাহ! এতদিন যেমন সবকিছুতে যুক্তি দিয়েই সমাধান করেছে এবারও তাই করবে। চিফ এডিটরকে দু’দিনের জন্য ছুটির আবেদন মেল করে দিলো।

আজ ওকে অফিসে আসতে না দেখে সায়ন্তিকা ফোন করলো বেলার দিকে। ওকেও কাজের অজুহাত দিয়ে কাটিয়ে দিলো। এই মিশনটা সে একাই করবে।

-----------------------------------

আজ কপাল করে মেট্রোটা ফাঁকা পেলো শেখর। উঠেই একটা সিট পেয়ে গেলো। মাথাটা এমনিতেই ভারি হয়ে থাকে এখন, একটু এসিতে বসতে পারলে শান্তি পাওয়া যায়। পাশে একটা মেয়ে এসে বসলো, পনেরো ষোলো হবে, পিঠে স্কুল ব্যাগ। হয়তো টিউশন পড়তে যাচ্ছে। কোলের ওপর একটা রিসনিং আ্যন্ড লজিকের বই। একটা জায়গায় এসে থেমে গেছে মেয়েটা। পেন চিবোচ্ছে একমনে।

“উত্তরটা কিন্তু ভুল।” শেখর কিছুক্ষণ মেয়েটাকে লক্ষ করে বললো।

“তাহলে? ধুর আমি পারছিই না, আর স্যার আজকেই পরীক্ষা নেবে।” বিরক্ত হয়ে বইটা গুটিয়ে ব্যাগে ঢোকাতে গেলো মেয়েটা, শেখর হাত বাড়িয়ে বইটা চেয়ে নিল তখন।

1x5 = 6

2x4 = 10

3x3 = 12

4x2 = ??

“এই দেখো, যেখান থেকে শুরু করেছ সেখানেই খুঁজে পাবে তোমার উত্তর।”

যদি 2×4=10

4×2=10 ই হবে।

“ধন্যবাদ আংকেল।” উত্তরটা ঠিক করতে পেরে উজ্জ্বল হলো মেয়েটার মুখ।

“আংকেল এটা তো লাস্ট স্টেশন... আপনি নামবেন না?” এবার সেই কিশোরীর প্রশ্নে সম্বিত ফেরে শেখরের। সত্যি তো মেট্রো এসে দমদমে দাঁড়িয়ে আছে, অংকের মধ্যেই হারিয়ে গেছিল তবে সে?

“হ্যাঁ, এই তো নামবো।” তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে হাতের মোবাইলটাও পড়ে গেলো। যে বইটা খুলে অঙ্কটা করছিল সেটা সামলাতে গিয়েই মোবাইলটা পড়ল। বইটার সামনের পাতায়, বইটার নামে এসে চোখ আটকে গেলো শেখরের।

ইয়োর মাইন্ড ইজ দ্য কী টু এভরি লক।

নাহ! মাথাটা আবার ধরে গেছে। আজকাল প্রায় সারাদিনই ধরে থাকে। নিখিল জেঠুর ওষুধও খাচ্ছে, উনি টুকটাক হোমিওপ্যাথি ওষুধ দেন পাড়ার সবাইকে। একদম বাড়ির ছেলের মতোই ভালোবাসেন, ওনাদের সন্তান নেই সম্ভবত। দেখেনি তো কাউকে। ওষুধটা খেলে সাময়িক একটু রিলিফ পায়। আর এই প্রবলেমটা মাথা ব্যথা হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে। ওষুধ খেলেই বেশ ঘুম আসে, কিন্তু তারপর আর কিছু মনে থাকে না, এখন মনে হয় যেন নিজের মধ্যেই হারিয়ে যায় সে। তবে সব কেমন যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে, কোথায় পাবে এর উত্তর... ধুর, ভালো লাগছে না কিছু।

তাড়াতাড়ি ট্রেন থেকে নেমে পড়ল শেখর।

তবে কী ওর উত্তরটাও যেখানে শুরু হয়েছিল সেখানেই পাবে।

“এই ট্যাক্সি, যাবে? সিঁথির মোড়। তাড়াতাড়ি চলো।”

-----------------------------------

“নিখিল জেঠু, ভেতরে আসতে পারি। কথা ছিল আপনার সাথে। মাথা ব্যথাটা কিন্তু সারছেই না, আপনি যে টেস্টগুলো করবেন বলেছিলেন, তার রিপোর্ট কিছু এসেছে?”

“না, শেখর, একটু সময় লাগবে। মাথা ব্যথা কি কমেনি এতটুকু?”

“প্রায় হচ্ছে কিন্তু।”

“আচ্ছা তুমি বসো আমি দেখছি। একটা অন্য ওষুধ চেঞ্জ করে দিচ্ছি।”

ড্রইংরুমে অপেক্ষা করছিল শেখর। জেঠুর ফোনটা বেজে যাচ্ছে ক্রমশ। ফোনটা ভাইব্রেশনে আছে, শুনতে পাচ্ছে না তাই জেঠু। শেখর উঠে গিয়ে দেখলো জেঠিমার ফোন। ভাবলো ধরবে, কিন্তু ধরতে গিয়েই কেটে গেলো। ফোনটা লক ছিল না তাই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো ফেসবুকের পেজ।

শেখরের মুঠোয় নিখিল জেঠুর ফোন...শক্ত করে ধরে আছে শেখর। হাতটা কেঁপে উঠলো, কেউ যেন চাবুক মেরেছে ওকে। স্ক্রিনে একটা মেয়ের ছবি। প্রোফাইলের নাম...

রাতের অতিথি!

দরজায় দাঁড়িয়ে আছে নিখিল জেঠু। হাতে একটা হোমিওপ্যাথির শিশি। শেখরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

“কেন? জেঠু, কেন?”

“আমার সাথে এসো, তোমার উত্তর পাবে।”

ধীর পায় নিখিল জেঠুকে অনুসরণ করলো শেখর, নীচে যে একটা ছোট ঘর আছে, আগে দেখেনি। সিঁড়ি দিয়ে খানিকটা নেমেই একটা ঘর, ঘর বললে ভুল হবে....একটা ল্যাবরেটরি। জেঠুর বাড়িতে ল্যাবরেটরি? নাহ! অনেক কিছু জানার আছে আজ তার।

“আচ্ছা শেখর তুমি যেটা করনি তার শাস্তি পেয়েছ কখনো?” জেঠুর মুখে হাসিটা এই প্রথম বিরক্তিকর লাগলো শেখরের।

“প্লিজ জেঠু এসবের সময় নেই আমার। আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিন আপনি।”

“না,আগে তুমি উত্তর দাও।”

“খুব পুরোনো জোক্স জেঠু। হোম ওয়ার্ক না করলে তার শাস্তি পেয়েছি। এসব ছাড়ুন। আগে বলুন...”

“তাহলে হোম ওয়ার্ক করে এলে না কেন শেখর? তাহলে তো উত্তর পেতে সহজ হতো আরও।” হাসিটা আরও ক্রূর হলো, না অল্প আলোয় ভুল দেখলো শেখর!

“মানে?” শেখর চমকে উঠলো জেঠুর কথায়।

“চা খাবে?”

“না, খাবো না।”

“তুমি খুব ক্লান্ত। এটা খাও।” বলে জলের গ্লাস এগিয়ে দিলেন নিখিল জেঠু।

হ্যাঁ সত্যি ক্লান্ত। গলাটা তেষ্টায় বুজে আসছে ওর।

জলের গ্লাসটা নিয়ে এক চুমুকে শেষ করলো শেখর।

“সময়টা নব্বইয়ের দশক। চেন্নাইতে পোস্টেড। নিউরোলজিকাল সাইন্স নিয়ে গবেষণা করছি আমি।”

নিখিলের কথাগুলো শুনতে পাচ্ছিল শেখর। কিন্তু ধীরে ধীরে শরীরটা কেমন যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছিল। চোখ দুটো খোলা, মাথাটা এলিয়ে পড়ল চেয়ারে।

তবে কি জলেই...

নিজের জীবনের গল্প বলতে শুরু করলেন নিখিল।

“বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে বরাবরই ভালো নাম্বার পেয়েছি। তাই চান্সও পেয়েছিলাম সবচেয়ে বিখ্যাত নিউরোসাইন্সের প্রফেসরের সাথে কাজ করার। ওনার প্রিয় ছাত্র ছিলাম, হাতে ধরিয়ে শিখিয়েছেন কত কিছু। ওনার কাছেই জানতে পারলাম মানুষের মনের খবর। আমাদের মস্তিষ্কের এমন কিছু ক্ষমতা আছে যা সাব-কন্সাস পার্টে স্টোর থেকে যায়, অথচ তার বিকাশ ঘটাতে পারলে মানুষ অনেকগুণ শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। ব্রেন ম্যাপিং অপরাধ তত্ত্বের জগতের এক নতুন দিশা দেখাতে পারে। অবশেষে আমি এমন একটা কিছু আবিষ্কার করলাম যা কিনা বিজ্ঞানের জগতে চূড়ান্ত এক আবিষ্কার।

“এই দেখো শেখর। দেখো, তাকিয়ে, ঘুমিও না। তোমায় শুধু সিডেটিভ দিয়েছি একটা। তুমি সব শুনতে পাবে। শুধু নড়াচড়া করতে পারবে না। চিন্তা নেই, এর প্রভাব কয়েক ঘন্টা থাকে, তার মধ্যেই অবশ্য আমার কাজ হয়ে যাবে। আমার কথাগুলো শোনা খুব দরকার তোমার।

“হ্যাঁ, যা বলছিলাম। আমার ন্যানো বটস। NB-7 তোমার রক্তে মিশলে আমি তোমাকে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে পরিচালনা করতে পারি। তোমার আগে আরও ছয়’জনের উপর করেছি আমার এক্সপেরিমেন্ট, সফল হইনি, শুনতে পাচ্ছো শেখর? দেখো তোমার সামনে গ্রেট সায়েন্টিস্ট নিখিল দাশগুপ্ত দাঁড়িয়ে। তোমার মনে আছে যেদিন তুমি প্রথম মাথা ব্যথা হচ্ছে বলে এসেছিলে আমার কাছে আমি তোমাকে ওষুধ দিয়েছিলাম। সেদিনই মনে হয় আমার অসম্পূর্ণ এক্সপেরিমেন্ট করার উপযুক্ত মানুষ তুমি। পরের দিন তোমার ব্লাড স্যাম্পেল নিয়েছিলাম। তোমাকে বলেছিলাম, রুটিন টেস্ট করিয়ে নেবো। তোমার কাজের চাপে তুমি আর না করোনি। সেদিনই তোমার শরীরে ন্যানোবটস ইঞ্জেক্ট করি আমি। আমি তোমাকে কন্ট্রোল করতাম ঘরে বসেই কিন্তু তুমি বাইরে চলে গেলে আর পারতাম না। তুমি নিজেই নিজেকে ফেসবুকে ফলো করতে, মানে আমিই করাতাম, তুমি নিজেই ল্যাপটপে কাজ করতে, আমি করাতাম এই ল্যাবে বসেই। কিন্তু আমার এক্সপেরিমেন্টটা ঠিক এখানেই এখনো সফল হচ্ছে না। একটা ছোট অপারেশন করতে হবে খালি। মস্তিষ্কের মধ্যে ইঞ্জেক্ট করতে হবে আমার আবিষ্কার করা একটা চিপ। এক্সপেরিমেন্ট সফল হলেই দুনিয়ায় সব প্রান্ত থেকেই কন্ট্রোল করা যাবে মানুষকে। ভাবো এতে কত উপকার হবে। পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই হিংসা মারামারি থাকবে না। সবাইকে অনুশাসনে রাখা যাবে। আমি হয়ে উঠবো সর্বশক্তিমান।” নিখিলের হাসিটা ভাঙা কাচের মতো ছড়িয়ে পড়ল ল্যাবের প্রতিটা কোণে, তারপর প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এলো শেখরের কানে।

“তাই আবার মায়ের কোল খালি করে দেবে তুমি। দা গ্রেট সায়েন্টিস্ট নিখিল দাশগুপ্ত।”

“একী মনি, তুমি এখানে ল্যাবে কেন এসেছ? তোমাকে বলেছি না এখানে আসবে না। আমাকে কাজ করতে দাও। সামান্য একটা সার্জারি করবো। এবার ঠিক সফল হবোই, দেখো তুমি।” নিখিল ওনার স্ত্রী মনিকে দেখে চমকে উঠলেন।

“আগেরবারও বলেছিলে এই কথাই। আমার ছেলে আমার বাবাই, যে কোনোদিন তোমার কথায় না করেনি স্বেচ্ছায় এসে শুয়েছিল অপারেশন টেবিলে। কিন্তু ফিরিয়ে দিতে পারোনি একটা মা’কে তার সন্তান।” মনি জেঠিমা আরও এগিয়ে এলেন, নিখিল জেঠুর মুখোমুখি একেবারে।

“চুপ করো মনি চুপ করো। সেদিন একটা সায়েন্টিস্ট হেরে গেছিল একটা বাবার কাছে। হাত কেঁপেছিল আমার। আজ কোনো ভুল হবে না দেখো।” নিখিল হাতে অপারেশন গ্লাভস পরলো।

শেখরের জ্ঞান আছে, পুরোপুরি অজ্ঞান হয়নি। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে সব। শুধু নিথর হয়ে চেয়ারে শুয়ে আছে ওর অসাড় দেহটা।

 

“তুমি ফিরে যাও মনি, আজ কোনোকিছুই আর বাধা দিতে পারবে না আমাকে। অনেক সময়, অনেক সাধনার পর আজকে আমি সফল হবোই। হতেই হবে আমাকে।” বলেই আবার হেসে উঠলো নিখিল। শেখরের অসার দেহটাও সেই অট্টহাসি অনুভব করলো।

সারা শরীরে ভয়ের স্রোত বয়ে গেলো ওর। কোন উপায় কী নেই, আজই কি তবে শেষ...

পা দুটো কেউ যেন পাথর দিয়ে গেঁথে দিয়েছে তার। নড়ার শক্তিটুকুও নেই। নিখিল জেঠু ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। মুখে একটা সাদা মাস্ক। হাতে স্ক্যালপেল।

হঠাৎ…

ধাম...

মুহূর্তে বদলে গেলো ল্যাবটা। এমনিতেই ল্যাবটা খুব ছোট। বেসমেন্টের মধ্যে। ল্যাবের ঠিক মাঝে একটা কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে আর সেই আলোয় শেখর দেখতে পাচ্ছে ঠিক জেঠুর পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে মনি জেঠিমা। পরনে একটা সাধারণ সুতির শাড়ি, মাথার ওপর চুড়ো করে বাঁধা চুল, এখন এলোমেলো। মুখের ওপর পড়ে আছে অবিন্যস্ত হয়ে।

চোখের সামনে লুটিয়ে পড়ছে নিখিল জেঠু। মাথার পেছনে ভারি কিছু দিয়ে আঘাত পেয়েছে। শেখর দেখলো একটা বুনসেন বার্নার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনি জেঠিমা।

কতটা সময় পেরিয়ে গেছে বুঝতে পারেনি শেখর। কিন্তু ধীরে ধীরে অনুভব করছে হাতে পায়ে সাড় ফিরে আসছে। মাথাটা যদিও ভারি হয়ে আছে, তবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পা’টা টলে গেলো একবার, চেয়ার ধরে আবার বসে পড়ল শেখর। সামনে বসে আছে মনি জেঠিমা। হাতে ধরা সেই বার্নার, জেঠুর শরীরটা প্রাণহীন।

“জানো শেখর আমার ছেলে, বাবাই, সৌরদীপ দাশগুপ্ত, ওর খুব ইচ্ছে ছিল বাবার মতোই সায়েন্টিস্ট হবে। মাত্র বাইশ বছর বয়স বয়স ছিল... আমার বাবাই। ওর বাবাকে টুকটাক সাহায্য করতো ল্যাবের কাজে। কিন্তু সেদিন নির্ভীক হয়ে অপারেশন টেবিলে এসে শুয়েছিল... তারপর আর ফিরে আসেনি। আমরা কোনোমতে চেন্নাই থেকে পালিয়ে আসি এখানে। আমি স্কুলের চাকরিটা পেয়ে যাই, তোমার জেঠু আর চাকরি করতে ইচ্ছুক ছিল না। আমিও জোর করিনি কোনোদিন। ভেবেছি থাক, কিন্তু বুঝতে পারিনি এখনো ও নিজের অনুসন্ধানের জন্য নতুন শিকারের খোঁজ করছে। মানুষ যখন সর্ব শক্তিমান হতে চায়, তার চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছু নেই যে... তোমাকে একটাই অনুরোধ, ঘটনাটা যেন প্রকাশ না পায়, লোকটাই যখন আর নেই, কী হবে বলো... মিথ্যেটা নাহয় সত্যিই হলো।”

“আপনি ভাববেন না জেঠিমা, আপনার সব দায়িত্ব আমার। আমি তো আপনার বাবাইয়ের মতোই। আমি সব সামলে নেবো।” শেখর এগিয়ে এসে হাঁটু মুড়ে বসলো জেঠিমা সামনে।

“ঠিক আছে বাবা, এখন তুমি ঘরে যাও, বড্ড ধকল গেলো তোমার। আমাকে সামনের দোকান থেকে একটু ফিনাইল এনে দিতে পারবে, জানি খুব কষ্ট হবে, তাও একটু এনে দাও, জায়গাটা পরিষ্কার করে নেবো। তোমার জেঠু একদম নোংরা পছন্দ করতো না, জানো তো। একটু পরেই ওরা এসে পড়বে হয়তো। আমি খবর দিয়েছি। তারপর আমিও একটু বিশ্রাম নেবো।” কথাটা বলে চুপ করে চোখ বন্ধ করলেন মনি জেঠিমা, ক্লান্ত লাগছিল ভীষণ ওনাকে। শেখর আর না দাঁড়িয়ে বাইরে এলো। একটু দূরেই একটা দোকানে গেলেই ফিনাইল পেয়ে যাবে। আগে জেঠিমা’কে এনে দিয়ে তারপর ঘরে ফিরবে।

কিছুটা এগোতেই শুনতে পেলো পাড়ার লোকেরা এদিকেই এগিয়ে আসছে। শেখরের পায়ে এখনো বিশেষ জোর নেই। হাঁটার মধ্যে তাল কেটে যাচ্ছে বারবার। হঠাৎ শুনতে পেলো একটা চিৎকার, তার দিকেই এগিয়ে আসছে শব্দটা। পেছন ফিরে দেখলো বাড়িটার থেকে ঘন কালো ধোঁয়া এই রাতের বেলাতেও চারিদিক আচ্ছন্ন করেছে। আগুনের লেলিহান শিখা জানলার বন্ধন ছিন্ন করে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। তবে কি জেঠিমা... কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারলো তার আশংকাই ঠিক। পুলিশে খবর দিয়েছিল ঠিকই তবে আর কোনো চিহ্ন রাখেনি মনি জেঠিমা। আগুনে শুদ্ধ হয়েছে জেঠুর শেষ চিহ্নটাও। আর দাঁড়ায়নি শেখর, একবার ফোন করবে সায়ন্তিকা’কে। আজকের মতো একটু আশ্রয় চাইবে।

পরেরদিন খবরের কাগজে দেখলো বুনসেন বার্নারের সিলিন্ডার লিক করে মৃত্যু হয়েছে এক বয়স্ক দম্পতির। কাগজটা বন্ধ ভাঁজ করে রাখলো। মাথা ব্যথাটা আর নেই। কিন্তু ক্লান্তি আছে। আজও অফিসে ছুটি নেবে। একটু ঘুমনোর প্রয়োজন।