নামকরণের সার্থকতা - ধূপছায়া মজুমদার

হাসির গল্প

অলংকরণ - কৃষ্ণেন্দু মন্ডল
(১)

শেষ কবে সূর্য ওঠা দেখেছি, অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারলাম না। সূর্যদেব ভদ্রলোক একটু একগুঁয়ে আছেন, রোজ অমন কাক ডাকা ভোরে উঁকিঝুঁকি মারার কী দরকার অ্যাদ্দিনেও বুঝে উঠতে পারলাম না।

এদিকে আবার আমাদের ফ্যামিলির প্রতিটি লোক, মায় কার্নিসে বসা কাক ভানু আর হাওয়াই চটি চিবিয়ে পাড়ার লোকের হাড়ে দুব্বো গজিয়ে দেওয়া নেড়ি দিনেশ অব্দি বেজায় সূর্যভক্ত। কাকের নাম ভানু আর কুকুরের নাম দিনেশ শুনে অমনি বত্রিশপাটি দাঁত বেরিয়ে পড়লো তো? হেসে নিন, যে নামগুলো রেখেছে তার কানে যাক একবার হাসির আওয়াজ, বুঝবেন কত ধানে কত চাল!

দিনেশ শুনে মনে পড়ল, জানেন, আমার মামারবাড়ির পাড়ায় এক মুচি আছে, দীনেশ। দিলদার লোক, জুতো সেলাই আর গলা ছেড়ে গান গাওয়া, এইই তার কাজ। তা, একবার চটি সারাতে গিয়ে কথায় কথায় তাকে বলে ফেলেছিলাম আমাদের বাড়ির পোষা নেড়িটার নাম দিনেশ। শুনে সে কী বলব মশাইরা, সেই দীনেশের সে কী হাঁক! ওপাশে গড়পার আর এপাশে বিদ্যাসাগর স্ট্রীট, এই চত্বরের যত নেড়ি আছে, সব সেই হাঁক শুনে দৌড়ে এসে আমায় ঘিরে ধরলো। ওরকম নিরীহ দেখতে একজন মানুষ যে এরকম একটা বাহিনী পোষে, সে আমি কেমন করে জানবো! হাফ সেলাই করা চটিই পায়ে গলিয়ে সরে আসছিলাম, সেখানা পুরো সেলাই না হওয়া অব্দি নেড়িবাহিনী আমায় নড়তে দিলো না, সমানে দাঁত খিঁচিয়ে গেল। সেদিনের পর থেকে মামারবাড়ি গেলে ব্যাগের কোণায় একসেট এক্সট্রা হাওয়াই চপ্পল ফেলে রেখে দিই, আর আমাদের বাড়ির সূর্যভক্ত মেম্বারদের গল্প বিশেষ কাউকে করি না। বেকার রিস্ক নিয়ে কী লাভ!

যেকথা বলছিলাম, সূর্যভক্তি। এ জিনিস আমাদের বংশের রক্তে রয়েছে, একমাত্র আমিই হংসমধ্যে বকোযথা, কিংবা আধঘণ্টা রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাঝে একখানা ভজগৌরাঙ্গ ট্র্যাক, কিংবা খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে একফোঁটা ভেজিটেবল অয়েল, যা বলবেন, তাইই। আমার প্রপিতামহ স্বর্গীয় আদিত্যজ্যোতি বসুরায় (নামের শেষ আর পদবীর শুরুর মিল নেহাতই কাকতালীয়) নাকি আজীবন শেষরাতে ঘুম থেকে উঠে ঘণ্টাখানেকের পথ হেঁটে গঙ্গা নেয়ে আবার ঘণ্টাখানেকের পথ হেঁটে বাড়ি ফিরে আসতেন। সেগল্প শুনিয়ে ছোট থেকেই আমার আর অংশুর মনে থ্রিল আর উদ্যমের বীজ বোনার অনেক চেষ্টা চলেছে, কিন্তু ভস্মে ঘি ঢালা ছাড়া আর কিছুই হয়নি। আদিত্যবাবু, মানে আমাদের সেই বড়দাবাবা, তাঁর হয়তো হবি ছিলো ভোরে ওঠা, তখন বাড়িতে কলের জলের লাইন আসেনি হয়তো, কিংবা হয়তো তিনি মানুষটা কিঞ্চিৎ মেছো ধরনের ছিলেন, তাই রাতে তিনঘণ্টা ঘুমিয়ে উঠে গঙ্গা নাইতে যেতেন। যেতেন বেশ করতেন, তাঁর মর্জি। আমরাও ভোরে উঠব না, বেশ করবো, আমাদের মর্জি। এরকম একটা ‘ডোণ্ট কেয়ার’ ভাব আমি আর অংশু বরাবর দেখিয়ে এসেছি সবাইকে, কিন্তু ক্যাচালটা রেগুলার আইটেম ছিলো। ইদানীং অংশুকে ভাগ্যের ফেরে একটা সোলার পাওয়ার জেনারেটিং ইউনিটের সাইট ইনচার্জ হতে হয়েছে, ওড়িশায় পোস্টেড, সাইটে পৌঁছাতে হয় সকাল সাড়ে ছ’টায়। কাজেই সূর্যোদয় দেখার দলে তাকেও ভিড়তে হয়েছে, যুঝছি কেবল আমি। এখনও আমি স্টুডেন্ট, পিএইচডি করছি, (কী নিয়ে, নিজেই আর মনে রাখার চেষ্টা করি না) যদ্দিন ছাত্রজীবন চলবে, তদ্দিন ভোরের বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকব, এই আমার প্ল্যান।

আমার ঠাকুরদা দিবাকরজ্যোতি আর তাঁর ভাই প্রভাকরজ্যোতি সম্ভবত তাঁদের বাবার পথে হাঁটতে চেয়েও পারেননি, কারণ দাদুকে দু’ঘণ্টা ট্রেন বাসের রাস্তা উজিয়ে রোজ যেতে হতো অনন্তপুর কলেজে পড়াতে, আর ছোড়দাদু কলেজ পাশ করেই সরকারি চাকুরে হয়ে বিভিন্ন রাজ্যের জঙ্গল সাফ করে রাস্তা বানিয়ে বেড়িয়েছেন প্রায় তিরিশ বচ্ছর। অত হাঁটাহাঁটির সময় ওঁদের ছিলো না। তা’বলে ভোরে উঠে সূর্যপ্রণামে কোনওদিন ভুল হতো না ওঁদের। চিরকাল ভোরের জমাটি ঘুমটা দাদুর হাঁকাহাঁকিতে চমকে পালাতো, তাকে আবার তুতিয়েপাতিয়ে এনে কানে বালিশ দিয়ে আরও খানিকক্ষণ নাক ডাকিয়ে তবে শরীরটা একটু ঝরঝরে লাগতো। রোজই অবশ্য ফাইনালি ঘুম ভাঙতো মায়ের হাঁকড়ানিতে,

“বাড়িসুদ্ধু লোক, কুকুর বেড়াল, জলচৌকি সব উঠে যে যার কাজে লেগে পড়ল, দামড়া দুটো ছেলের আর ঘুম ভাঙে না!” আমরা যখন ক্লাস ওয়ান, তখন থেকেই আমরা ‘দামড়া’।

অংশু আবার একেকদিন দাঁত মাজতে মাজতে মাকে জিজ্ঞেস করতো,

“জেম্মা জলচৌকি আজ কখন উঠেছে গো?”

মা মুখে ফেনা নিয়ে কথা বলা দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না, বেলন নিয়ে তেড়ে যেতেন অংশুর দিকে, অংশু সুট করে বাথরুমে ঢুকে পড়তো।

(২)

আমি ময়ূখমালী, আর অংশু আমার খুড়তুতো ভাই, অংশুমালী। আমাদের জেনারেশন জ্যোতিহারা, তাই নামে মালী এনে আমাদের ফুলের মতো হাল্কা মনগুলোকে বাগে আনার চেষ্টা হয়েছে সম্ভবত। আমাদের প্রপিতামহ থেকে শুরু করে আমরা অব্দি, বংশের সবার নামগুলো যদি শোনেন, বুঝবেন সূর্যের তেজ কাকে বলে! কী ভাগ্যিস বংশে মেয়ে নেই, আমার চেয়ে তিন মিনিটের ছোট যমু ছাড়া। মেয়ে বেশি হলে সূর্যের নামে নাম রাখার প্যাশনটা বোধহয় মাঠে মারা যেতো এদের। যমু, মানে আমার যমজ বোন অর্যমা, তার বেজায় তেজ, জানেন? ভিটামিন ডি পাওয়ার জন্য ওকে বোধহয় একটু বেশিই রোদ খাওয়ানো হয়েছিল ছোটবেলায়, আমায় অতটা করেনি, সেজন্যই বোধহয় আমি কচি কলাপাতার মতো মোলায়েম, আর ও যাকে বলে দোর্দণ্ডপ্রতাপ। ইস্কুলে প্রথম যেদিন এই শব্দটার মানে জেনেছিলাম, যমুর মুখটাই ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে। কোন ক্লাসে যেন বাগধারা দিয়ে বাক্য রচনা থাকে না সিলেবাসে? ‘বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খাওয়া’ দিয়ে সেনটেন্স লিখতে গিয়ে আমি লিখেছিলাম ‘আমার বোন অর্যমার নাম শুনলে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়’। যমু গার্লস স্কুলে পড়তো, আমি বয়েজে, আমার বন্ধুরা তখনও ওকে চিনতো না ভালো করে, সেনটেন্সটা নিয়ে হাসির রোল উঠেছিল ক্লাসে, ইলেভেনে যখন দুজনেই এমকেবি মেমোরিয়ালে ভর্তি হলাম, সঙ্গে আমাদের বন্ধুদের গ্রুপটাও, তখন আস্তে আস্তে আমার বন্ধুরা একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিল যে বাগধারা প্রয়োগে আমি এক্কেবারে ফাস্টোকেলাস।

যমু যে হাতেপায়ে দুরন্ত ছিলো খুব, তা নয়, তবে ইনোভেটিভ ছিলো বেশ। ছোটবেলায় একবার অংশুকে টগবগি (কাঁচির মা নীতুপিসির পোষা ছাগল টগবগি) সাজিয়ে পেয়ারাপাতা খাইয়েছিল, অংশু তখন হামা দেয়, সেও মাড়ি দিয়ে পাকলে পাকলে চাট্টি পাতার কুচি গিলে নিয়েছিল। তারপর বমি হওয়ায় সব জানাজানি হয়েছিল। আরেকবার মায়ের পিটুনির ভয়ে চৌবাচ্চার ভেতরে লুকিয়ে বসেছিল। ভাগ্যে কাকীমা গা ধুতে বাথরুমে ঢুকেছিল, দেখেছিল এককাঁড়ি জল গিলে চৌবাচ্চায় হাতপা এলিয়ে পড়ে আছে যমু। তখন ডাক্তার রে, পেট চেপে জল বের করা রে, হইহই কাণ্ড। বরাতজোরে বেঁচেছিল মেয়েটা। এছাড়া আমার কম্পাস দিয়ে আমারই ফুটবল ফুটো করে দেওয়া, চায়ে ডিটারজেন্ট গুলে দেওয়া, বালিশের তুলো বের করে স্নোফলের আবহ তৈরি করা, এসব চলতেই থাকতো।

মাধ্যমিকে যমু বাংলায় লেটার পেয়েছিল। ইলেভেনের নবীনবরণের দিন ‘বাংলা : একটি মৃতপ্রায় ভাষা’ বিষয়ক বিতর্কসভায় বিপক্ষে বক্তব্য রেখে সক্কলকে মুগ্ধও করে দিয়েছিল। মুগ্ধতা যে কোথাও কোথাও একটু বেশিই, বোঝা গিয়েছিল দিনসাতেক পর।

একদিন ছুটির পর টুয়েলভের সাত্যকিদা যমুকে ডাকলো ওদের ক্লাসে। আমি তো শুনে ঘাবড়ে গেলাম,

“চ’ আমিও যাই সঙ্গে।”

“না, তুই ব্যাগগুলো ধরে দাঁড়া, আমি যাবো আর আসবো।” বলে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়েছিল। কে যে তিন মিনিটের বড়, সন্দেহ হয় মাঝেমাঝে। মায়েরা নির্ঘাৎ গুলিয়ে ফেলেছিল।

পিঠে নিজের ব্যাগ আর কোলে বোনের ব্যাগ ধরে দাঁড়িয়ে আছি হাঁ করে, ক্লাসের মেয়েগুলো যেতে যেতে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করলেও মনে হচ্ছে আমায় দেখেই হাসছে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই যমু নিচে নেমে এলো, মুখে অচেনা একটা হাসি। জিজ্ঞেস করলাম কী বলল সাত্যকিদা, প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো।

পরে শুনেছিলাম সেদিনের পর সাত্যকিদা নাকি মাসখানেক একটা বাংলা অভিধান নিয়ে স্কুলে আসতো, রাতে অভিধানে মাথা রেখে ঘুমোতো, চা জলখাবার অভিধানে রেখেই খেতো। স্পণ্ডিলোসিসের লক্ষণ দেখা দেওয়ায় অভ্যেসটা তাকে ছাড়তে হয়।

শুনেই যমুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ব্যাপারটায় ওর হাত আছে কিনা। লাজুক মুখে যমু সব খুলে বলেছিল সেদিন।

সাত্যকিদা নাকি যমুকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছিল নবীনবরণের দিন ওর পারফরম্যান্স দেখে। এই প্রাণঢালা ভালোবাসার যুক্তিসম্মত কারণগুলো একটা চিঠিতে লিখে সাত্যকিদা যমুকে দিয়েছিল, আর অল্প কথায় ‘ভালোবাসি’ বলেছিল। হাঁটু গেড়ে বসে ‘বলি হে ও মাধবী...’ গাওয়ার ইচ্ছেও ছিলো হয়তো, কিন্তু তার আগেই নাকি যমু চিঠিতে চোখ বুলিয়ে নিয়েছিল। সাত্যকিদার ভাষাজ্ঞানে মুগ্ধ যমু ওকে কতগুলো শব্দের মানে জিজ্ঞেস করে। মানেগুলো তক্ষুনি বলতে পারলেই যমু সাত্যকিদার ডাকে সাড়া দেবে, এই নাকি ছিলো যমুর ইচ্ছে।

“কী কী ওয়ার্ড দিয়েছিলি?”

“প্রাবৃট, প্রাবৃড়ত্যয়, নিষ্যন্দ, ন্যগ্রোধ, অকূপার।”

অভিধানের ট্রমা থেকে সাত্যকিদা আজও বেরোতে পারেনি, আমি শিওর।

আমি যে যমুকে যমু বলি, সেটা বাড়ির কারও পছন্দ নয়। আমার সিম্পল লজিক, আমাদের বাবা ভাস্কর, মানে সূর্য, জ্যোতি সবার নামেই কমন, তা সূর্যের ছেলেমেয়ে, তাদের নাম যম আর যমী ছাড়া আর কিছু মানায়, বলুন? এই যুক্তি কেটে সবাই বলে, সূর্য তো বসুরায়বাড়ির সকলেই, তাহলে তাদের সবার ছেলের নামই যম রাখা উচিত! আমি বলি, তা কেন, যমজ ছেলেমেয়ে তো কেবল আমরাই। কাজেই ওদুটো নাম শুধুমাত্র আমাদেরই প্রাপ্য। আমার কথা কেউই শোনেনি, ছেলেকে যম বলে ডাকতে কাদের আর ভালো লাগে, ওদের সেন্টিমেন্টটাও বুঝি। নিজেকে তো আর নাম ধরে ডাকা যায় না, অগত্যা বোনকেই যমী, আর আদর করে যমু বলে ডাকি। আদর যদিও সেভাবে করা মুশকিল, ছোটবেলায় মনে আছে গাল টিপতে গেলেই ঘ্যাঁক করে কামড়ে দিতো। বড় হয়ে যাওয়ার পর তো আর সেভাবে গালে গাল ঘষে দেওয়া, চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকানো, শীতকালে ঘাড়ে আলতো করে হিমঠাণ্ডা হাত বোলানো, এগুলো করা যায় না, আদর করে ডাকনাম ধরে ডাকাটুকুই হয় শুধু। ক’দিন আগে অব্দিও আদর করে যমু বলে ডাকলে হেঁড়ে গলায় “কী চাই?” বলে তেরছা চোখে তাকাতো, যেন এমকেবির হেডস্যার ব্রজবাবু। বোন হেডস্যারের মতো করে তাকালে ভালো লাগে? এখন ফোনে ডাকি, তেরছা চাউনিটা চোখে পড়ে না, কিন্তু মেঘগুমগুমে ভাবটা ঠিক একই রকম আছে। মাঝেমাঝে অনিন্দ্যদার জন্য মায়া হয়, নিরীহ ছেলেটা ছোট থেকে নামের ভার বইছে, এবার বাকি দিনগুলো চাউনির ভারও বইতে হবে।

(৩)

অনিন্দ্যদা যমুর বর, ভূতপূর্ব জমিদারবংশের সন্তান, আমাদের বাড়ির তিন পুরুষে একমাত্র জামাই। জামাই-আদরে নাভিশ্বাস ওঠা কাকে বলে, ওকে আমাদের বাড়িতে দেখলে বোঝা যায়। প্রথমবারের জামাইষষ্ঠীর পর রীতিমতো শকড দেখাচ্ছিল ভদ্রলোককে। পুজোয় এবাড়ি আসার আগে নাকি লিভারের প্রব্লেম দেখা দিয়েছিল, ডাক্তারের সার্টিফিকেট এনেছিল ওয়ালেটের মধ্যে। আমার আর অংশুর অবশ্য সন্দেহ হয়েছিল একটু, তবে আমরা অনিন্দ্যদাকেই সাপোর্ট করেছিলাম। জামাই, না বলির পাঁঠা? ডিমের ডেভিল, কাতলার কালিয়া, মাছের ডিমের বড়া, চিকেন কষা, মাটন কোর্মা, চিংড়ির কাটলেট সর্বস্ব যদি একটা লোককে একদিনে খেতে হয়, তার লিভার, স্টমাক, ক্ষুদ্রান্ত্র বৃহদন্ত্র সব তাকে ত্যাগ দিয়ে পালাতে চাইবে। জামাইষষ্ঠীর আগে কানাঘুষোয় শুনেছিলাম জমিদারবাড়ির ছেলের উপযুক্ত আপ্যায়ন না হলে বসুরায়বাড়ির সম্মান থাকবে না। আপ্যায়নের ধাক্কায় জমিদারবাড়ির সুস্থ ছেলে অসুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে বাড়ির সম্মান থাকবে কিনা কে বলে দেবে?

অনিন্দ্যদার বাড়ি থেকে যেদিন যমুকে দেখতে এসেছিল, মনে আছে সেদিনের কথা। হবু কনের দাদা হিসেবে আমি সেদিন বাড়াবাড়ি রকমের সম্মান পেয়েছিলাম ওদের বাড়ির লোকের কাছে, লাইফটাইম অ্যাচিভমেণ্ট অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার মতো অনুভূতি হচ্ছিলো। কিন্তু তবুও যখন বাড়ির হবু জামাইয়ের নাম শুনলাম “অনিন্দ্যসুন্দর রায়চৌধুরী”, আর তার বাবার নাম “সর্বাঙ্গসুন্দর রায়চৌধুরী”, ফ্যাক করে অসভ্যের মতো হেসে ফেলেছিলাম আমি আর অংশু, বাবা কাকাদের কটমটে দৃষ্টি আর হবু ভগ্নীপতির মন খারাপ করা চোখ দেখেও কন্ট্রোল করতে পারিনি নিজেদের। পরে অবশ্য দাদার কষ্টটা বুঝেছি। অক্ষরপরিচয়ের দিনগুলোতেই বলো, আর পরীক্ষার ফর্ম ভরার দিনগুলোতে, কত কষ্ট পেয়েছে ছেলেটা, আহা! নিজে ভাস্করজ্যোতির ছেলে ময়ূখমালী হয়ে বুঝি সেটা। এই কষ্টে একাত্ম হয়ে যাওয়ার ফলেই বোধহয় যমুর বিয়ের পর থেকে আমার সঙ্গে অনিন্দ্যদার বেশ একটা ইয়ে জমে উঠেছে। মানুষটা এমনিতে মুখচোরা, এখন উঠতে বসতে যমুর কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে আরও মিতবাক হয়ে গেছে, তবে আমার কাছে মন খোলে। এই তো, ক’দিন আগে, কথায় কথায় বেশ খোশমেজাজে বলে উঠলো,

“আহা, অর্যমা ব্রিটিশ আমলে জন্মালে রায়বাহাদুর শিওর শট পেতোই পেতো।”

“রায়বাহাদুর কি মেয়েদের দিতো দাদা? টাইটেলটার মধ্যেই একটা পুরুষালী ভাব রয়েছে না?”

“দিতো না, না? তাহলে রায়বাঘিনী। হ্যাঁ, ঠিক। রায়বাঘিনী ওয়ার্ডটা উচ্চারণ করে দ্যাখ ময়ূখ, ওর মুখটাই চোখে ভাসবে।”

বুঝলাম যমু এবাড়িতে যা যা এক্সপেরিমেন্ট আমায় নিয়ে করতো, ওবাড়ি গিয়ে সেগুলো সব অনিন্দ্যদার ওপর চালাচ্ছে।

শুনেছি সে ওবাড়ি গিয়ে ভানু আর দিনেশকে খুব মিস করে। ওদের খুব ভালোবাসতো, বিয়ের পর ওদের নিয়েই শ্বশুরবাড়ি যাবে বলেছিল। সেই

পুরাকালের রাজকন্যেরা বাপের বাড়ি থেকে চাট্টি গরু-ঘোড়া-হাতি নিয়ে যেতো না উপহার হিসেবে? সেইরকম। কিন্তু ভূতপূর্ব জমিদার কুটুম, ওসব হ্যাপা যদি তাঁরা পছন্দ না করেন? সেই ভেবে যমুকে বুঝিয়েসুজিয়ে থামানো হয়েছিল। তাইতে তার কান্নার বেগ বেড়ে গিয়েছিল শুনেছি আরও। আমি দেখিনি, আমি আর অংশু তখন বউভাতের তত্ত্ব গোছাচ্ছিলাম চিলেকোঠার ঘরে বসে, দরজা জানলা বন্ধ করে, দুজন দুজনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে। ওসব কান্নাফান্না বড় ইয়ে জিনিস, পোষায় না। তবে হার হাইনেসের মতো মেজাজওয়ালা একজন মানুষ যে ডাক ছেড়ে কাঁদতে পারে, শুনলেও বিশ্বাস হয় না ঠিক।

ভানু আর দিনেশও যমুর বিয়ের পর ক’দিন উদাস হয়ে রইলো। পাড়ার লোকের চটি চিবোনোর কমপ্লেন কম এলো ক’দিন। পাশের বাড়ির আদ্যাঠাকুমা ছাদে বড়ি শুকোতে দিলেই ভানু উড়ে গিয়ে কপাকপ বড়ি গিলে আসতো, ঠাকুমা তেড়ে আসতেন লাঠি হাতে,

“অলপ্পেয়ে খেঁকুড়ে, পাজির পা-ঝাড়া হতভাগা কাকের পো, যেগুলো খাবে না সেগুলোকেও ছরকুটে রেখে যাবে! কালই কাগমারাদের যদি না ডাকি আমার নামে কুকুর পুষিস।”

দুটো প্রশ্ন মাথায় আসতো এসব শুনে। এক, ভানু যে কাকের পো, ঝি নয়, এতটা কনফার্মড আদ্যাঠাকুমা কী করে হতে পারেন? আমি অবশ্য বায়োলজিতে খুবই কাঁচা, জানি না কাক দেখেই মেল ফিমেল বোঝা যায় কি না। নিশ্চয়ই যায়, যমু জুলজি নিয়ে পড়েছে, ও সব জেনেশুনেই নিশ্চয়ই কাকের নাম ভানু রেখেছে, সবিতা রাখেনি। দু’নম্বর প্রশ্ন, কুকুরের নাম দিনেশ, এই অব্দি মেনে নেওয়া যায়, কুকুরের নাম আদ্যাশক্তি হলে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে না? পশুক্লেশ নিবারণী সংস্থা বা আদ্যাপীঠের ট্রাস্টে খবর গেলে দুদিক থেকেই হল্লা হতে পারে।

যমুর বিয়ের পর ক’দিন আদ্যাঠাকুমাও বিরক্ত হতেন। ছাদ, চাদরে শুকোতে দেওয়া বড়ি, ঠাকুমার হাতের লাঠি সবই আছে, ভানুও আছে আমাদের বাড়ির ছাদে, কিন্তু বড়ি নিয়ে অশান্তি বন্ধ। কিছুদিন এভাবে চলার পর ঠাকুমা একদিন হাতে দুটো কাঁচা বড়ি তুলে নিয়ে কার্নিসের কাছে এসে “আঃ আঃ, আয় বাপ ভানু, দুটো মুখে দে যা, লক্ষ্মী ছেলে আমার!” বলে ডেকেছিলেন নাকি। এসব অবশ্য শোনা কথা, আমি তখন কলেজে, কাঁচির মা নীতুপিসি ছাদে কাপড় মেলতে উঠে শুনে ফেলেছিল। ভানু নাকি একবার নীতুপিসির দিকে তাকিয়ে খানিক ভরসা পেয়ে উড়ে গিয়েছিল আদ্যাঠাকুমাদের ছাদে। ঠাকুমা বিড়বিড় করছিলেন,

“শুকিয়ে আধখানা হয়ে গেছে গা ছেলেটা। মান্তুটা ওবাড়ি গিয়ে থেকে এদুটোর দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না।”

(৪)

যমুটা এমনিতে খ্যারখেরে নারকেল ঝাঁটা টাইপের মেজাজওয়ালা হলে কী হবে, ওর ভেতরটা আসলে কিন্তু ভিজে তোয়ালের মতো।

ছোট থেকেই দেখে আসছি, জন্মদিনের দিন আমাদের দুজনের বাটিতেই সমান মাপের পায়েস দিয়ে মা আসন পেতে ঠাকুরঘরের সামনে বসাতেন। আর কী কারণে জানি না, প্রতি বছরই যমুর মনে হতো ওর বাটির চেয়ে আমার বাটিতে অন্তত একচামচ পায়েস বেশি আছেই। প্রথমেই আমার বাটি থেকে একচামচ পায়েস খপাৎ করে তুলে মুখে পুরতো। আমি হাত পা ছুঁড়ে নালিশ করতাম,

“মাআআ, যমু এবারও আমার থেকে খেয়ে নিলো!”

মা চোখ পাকিয়ে আমাকেই বকতেন মিছিমিছি,

“খাক গে, বোন হয় না? তোকে একচামচ বাড়তি দেবখন।”

“আমাকেও আমাকেও” বলে যমু হুড়মুড় করে এগিয়ে যেতো মায়ের দিকে।

প্রতি বছরের একই দৃশ্য।

এবার জানতাম পায়েস-টায়েস কিছু হবে না, হলেও গলা দিয়ে নামবে না। আমাদের জন্মদিনের আসল যিনি কারিগর, আমাদের মা, এই পৃথিবীটা তাঁর কাছে বড্ড পুরনো আর একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিল। তাই মাসআষ্টেক আগে হুট করে একদিন বিনা নোটিশে দেওয়ালের ছবি হয়ে গেলেন তিনি, পৃথিবীতে আর কোনও চিহ্ন রইলো না তাঁর। কীসের যে এত তাড়া থাকে মানুষের সব ছেড়ে চলে যাওয়ার, কে জানে! ক’মাস পরেই নাতিনাতনি আসছে, তার জন্য ঘরদোর গোছাও, মেয়েটার যত্ন-আত্তি করো, তা না, কাজটাজ ফেলে উনি চললেন পরজন্মের খোঁজে!

মা চলে যাওয়ার পর লোকে আমায় বলতো, “তুই শক্ত হ’। বোনের এই অবস্থায় মা চলে গেল, তুইই তো আগলাবি ওকে।”

আমি আর কী আগলাবো, আমি যে সত্যিই বড্ড মোলায়েম! ওই যমুই আমার খেয়াল রেখেছে, ওবাড়ি থেকে অনিন্দ্যদাকে পাঠিয়েছে রেগুলার, ওই শরীরে ওর বারবার আসা হয়ে উঠতো না তো।

যমুর যেদিন ছেলে হলো, তার দু’দিন পরে বিকেলে নার্সিংহোমে গেছি গুঁড়োকে আর তার মাকে দেখতে, তার মা দেখি অনিন্দ্যদার হাত থেকে একটা টিফিনকৌটো খুলে আমার দিকে বাড়িয়ে ধরেছে।

“পায়েস কেন রে? কে আনলো?”

“আজ কত তারিখ দাদা, মনে নেই?”

“হ্যাপি বার্থডে ময়ূখ অ্যাণ্ড অর্যমা! মাকে ও বলে রেখেছিল, মা করে পাঠিয়েছে। একটু করে মুখে দাও দুজনেই।” অনিন্দ্যদার বাড়িয়ে ধরা চামচটা মুখে পুরলাম, চোখ ঝাপসা, লোনা জল মেশানো পায়েসও এবারেই প্রথম খাচ্ছি, তবে যমুর ভেতরের সেই ভিজে তোয়ালের ভাবটা চিনতে ভুল হলো না।

আসার আগে আমায় যমু বলল,

“দাদা, তোর ভাগ্নের জন্য একটা ভালো দেখে নাম বাছবি? বেশ ব্যক্তিত্বপূর্ণ রাশভারী নাম হয় যেন! আমি আসলে এত অপশন পাচ্ছি, কোনটা ছেড়ে কোনটা রাখি বুঝতে পারছি না।”

যমু আমায় নাম রাখার দায়িত্ব দিচ্ছে!

“আমার কোনওকিছুই তো তোর পছন্দ হয় না। নাম পছন্দ হবে তো? বেকার খাটতে পারবো না।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ পছন্দ হবে। তোর দেওয়া নামই ফাইনাল হবে, পাক্কা!”

একটু আগের দমচাপা ভাবটা কেটে যাচ্ছে। উঁকি মেরে বেবিকটে ঘুমন্ত গুঁড়োকে দেখে বেরিয়ে এলাম কেবিন থেকে। একটা সর্বজনগ্রাহ্য সরল সুন্দর নাম রাখতে হবে ভাগ্নের, বেচারাকে দশমণি নামের ভার থেকে বাঁচানো অবশ্য কর্তব্য। বাবা মামার পথে ওকে কিছুতেই হাঁটতে দেবো না।

নার্সিংহোম থেকে যমু আর গুঁড়ো এবাড়ি এসেই উঠলো। মা নেই তো কী হয়েছে, কাকিমা তো আছেন। আসার পর থেকে কাকিমা মা-ছেলেকে চক্ষে হারাচ্ছেন, গুঁড়োকে তো পারলে সবসময় কোলেই রাখেন! থেকে থেকেই গলা ধরে যাচ্ছে বাবা-কাকাদের, ঈশ্বর যে কেন সব সুখ একসঙ্গে দেন না কে জানে? তবে গুঁড়োর তেজের সামনে আবহাওয়া বেশিক্ষণ ভারি হয়ে থাকতে পারছে না। ভাগ্নের গলাখানা সরেস। ভানু দিনেশ সবারই হার্টের ব্যামো ধরে যাবে আর কিছুদিন এই পরিত্রাহি কান্না চললে।

আমি সব দেখছি শুনছি আর ভেতরে একটা সর্বত্যাগী অনুভূতি হচ্ছে। যে বোমাটা ফাটাবো, তারপর বোধহয় যমুর তেজ পুঞ্জীভূত হয়ে বিস্ফোরণ ঘটবে, তার ঠ্যালায় বিবাগীই হয়ে যেতে হবে হয়তো আমায়। গুঁড়োটার মুখের দিকে বেশি তাকাচ্ছি না। মায়া পড়ে গেলে যেতে কষ্ট হবে। অনিন্দ্যদা যে কী করবে!

(৫)

হাওয়া খুব গোলমেলে। বাগানের গাছগুলোও পাতা নাড়াতে ভুলে গেছে ভয়ে, দিনেশ একটু আগে চটি শুঁকতে এসেছিল, গণ্ডগোলের আঁচ পেয়ে সরে পড়েছে। ঝড় থামার পর আদ্যাঠাকুমা একবার এবাড়ির উঠোনে এসে হাঁক পেড়েছিলেন, “অ মান্তু, অত চেঁচামেচি হলে কচিটা তরাসে কেঁপে উঠবে যে!”

তাঁর আদরের ‘মান্তু’ গনগনে চোখে তাকিয়েছিল জানলা দিয়ে ঠাকুমার দিকে, আদ্যাঠাকুমা তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গিয়েছিলেন।

হয়েছে কি, আজ সকালে অনিন্দ্যদা এসেছিল, ওবাড়ি থেকে একটা ব্রাউন খাম হাতে নিয়ে। দাদার আরেক বগলে ছিল সাদা রঙের একটা খাম। ব্রাউন খামে যমুর শাশুড়িমা কী একটা যেন খুব বিশেষ কাগজ পাঠিয়েছেন, বোধহয় কুলগুরুর গণনা করে বের করা গুঁড়োর নামের আদ্যাক্ষর। তা, অনিন্দ্যদা যমুর চোখের দিকে তাকিয়ে হিপনোটাইজড হয়ে, নাকি গুঁড়োর মুখের দিকে তাকিয়ে স্নেহে অন্ধ হয়ে কোনোমতে একটা খাম তুলে দিয়েছিল যমুর হাতে। খামের কাগজ বের করে উল্টেপাল্টে দেখে যমু প্রায় অজ্ঞান হওয়ার দশা! সবাই ভাবছে গুঁড়োর লাকি নামের প্রথম অক্ষর ৎ বা ং বেরুলো বুঝি গণনায়! আমি আর অনিন্দ্যদা চোখাচোখি করে মুচকি হাসতে যাব, তখনই দাদার খেয়াল হলো, “এই যাঃ! ব্রাউনটা তো হাতেই আছে। সাদাটা কই? কেলো করেছে রে! সর্বনাশ হয়েছে!”

“কী হলো? কী হলো?” হল্লা উঠল চারপাশে। এদিকে জামাই কপাল চাপড়াচ্ছেন, ওদিকে মেয়ে এলিয়ে পড়েছেন। সকাল সকাল এ কী ঝকমারি!

“দাদা!”

সারা ঘরে পিন ড্রপ সাইলেন্স। এমকেবির হেডস্যারকেও ছেলেপুলে অত মানে না, যমুকে আমাদের বাড়ির লোকেরা যত মানে। তবুও আমি বুক ঠুকে এগোলাম। সত্যির সামনে দাঁড়াতে হবেই।

“এটা কী করলি দাদা? একটা দায়িত্ব দিলাম, এইভাবে ডোবালি? দশটা নয় পাঁচটা নয়, একটাই ভাগ্নে, তার পার্সোনালিটি গড়ে ওঠার প্রথম স্টেপটাই এভাবে ভেঙে নষ্ট করে দিলি!”

সবাই তো শুনে হাঁ! অবাক হয়ে বিষম খাওয়ার জোগাড়। যমু আমায় কোনও কাজের দায়িত্ব দিতে পারে, কথাটা হজম করা সত্যিই মুশকিল। তবে দিয়েছিল, এটা সত্যি। কিন্তু পার্সোনালিটি, ফার্স্ট স্টেপ ভাঙা, কেস বুঝলাম না। অনিন্দ্যদার দিকে তাকালাম জিজ্ঞেস করব বলে, দেখি দাদা ইশারায় থামতে বলছে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমার চোখকে ফলো করে যমু দাদার দিকে তাকালো, ব্যস, ঘটলো বিস্ফোরণ।

“আমি খুব ভালো করে জানি তোমরা দুজনে মিলে ষড় করে এটা করেছ। নিজেদের নামগুলোকে নিয়ে তোমাদের বরাবরের সমস্যা রয়েছে, ছোট থেকে দেখছি।”

“আমায় তুমি ছোট থেকে দেখছ?”

আরিব্বাস! অনিন্দ্যদা এক্কেবারে আমার মনের কথা জিজ্ঞেস করেছে! তার চেয়েও বড় কথা, যমুর কথা কেটে কথা বলেছে! সাহস আছে ভদ্রলোকের।

“বিয়ের পর থেকে তো দেখছি। ওতেই বুঝে গেছি। নিজেদের নামগুলোর চেহারা বদলাতে পারোনি, আমার ছেলেটার নামের বারোটা বাজিয়ে ছাড়লে সেজন্য। ওম, ওম একটা নাম হলো? ওম রায়চৌধুরী! কানে মিছরির পানা ঢেলে দিচ্ছে উচ্চারণ করলেই! আর নাম ছিল না কোনও?”

যমুর ঝড় থামতে রয়েসয়ে সবার মাথায় ঢুকলো ঘটনাটা। আমার দায়িত্ব ছিল গুঁড়োর নাম ঠিক করার। আমি ভেবেচিন্তে সর্বজনগ্রাহ্য সরল সুন্দর একখানা নাম রেখেছি, ‘ওম’। মহিমময় নাম। মন্ত্রোচ্চারণের পুণ্য ও শান্তি যেমন আছে, তেমনই আছে উষ্ণ আরামের অনুভূতি। শীতকালে লেপের ওম, আহা! একটা সর্বভারতীয় সাম্যও রয়েছে। অনিন্দ্যদাকে বলেছিলাম, সে খুশিতে উছলে উঠলো শুনে। তক্ষুনি ডিসিশন নিয়ে ফেলল বার্থ সার্টিফিকেট বানিয়ে ফেলবে। সার্টিফিকেটে একবার ‘ওম’ নামটা লেখা হয়ে গেলে আর কেউ আপত্তি জানাতে পারবে না। একটা চিন্তা ছিল, ওদের ফ্যামিলিতে সবাই ‘সুন্দর’, ‘ওমসুন্দর’ হয়ে যাওয়ার চান্স কতটা। তবে আশা ছিল বার্থ সার্টিফিকেট কেউ নিশ্চয়ই এডিট করতে চাইবে না। অনিন্দ্যদা ক’দিনের মধ্যেই গুঁড়োর বার্থ সার্টিফিকেট জোগাড় করে ফেলল। আজ এনেছিল সেটা যমুকে দেখাবে বলে। বিস্ফোরণের জন্য আমরা তৈরিই ছিলাম।

“ও মা, ওম তো খুব মিষ্টি নাম! শুনলেই কোলে নিয়ে দোলাতে ইচ্ছে করে।” কাকীমা নাতি আসার আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছেন। নইলে যমুর অপছন্দের কোনও কিছুকে উনি ভালো বলবেন, এ ঘটনা আশাতীত। ওঁর কথা শুনে যমুর মেজাজের আগুনে ঘি পড়ল।

“হ্যাঁ, তোমাদের ছেলেকে আর জামাইকে কোলে তুলে বেশ করে দোলাও। হিরের টুকরো ছেলে তো সব!”

“হ্যাট! এদের আর সে বয়স আছে নাকি?”

“শোনো কাকিমা, বাজে কথা রাখো। আমি এফিডেভিট করিয়ে নাম চেঞ্জ করাবো। আমার ছেলের কিছুতেই এরম একটা ব্যক্তিত্বহীন জঘন্য ছোট্ট নাম রাখতে দেব না।”

“না!”

বজ্রনির্ঘোষ বলে একটা শব্দ শুনেছিলাম ইলেভেনের বাংলা ক্লাসে। কথাটা মনে পড়ে গেল। এটাকেই বজ্রনির্ঘোষ বলে বোধহয়। গলাটা চেনা লাগল না? এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি সবাই হাঁ করে অনিন্দ্যদার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, যমুও।

“আমার ছেলের নাম যা রাখা হয়েছে তাইই থাকবে। চেঞ্জফেঞ্জের কথা বললে কেলেঙ্কারি বাধিয়ে ছাড়ব। নামের পাহাড় গলায় ঝুলিয়ে আমার লাইফটা হেল করে ছেড়েছে সবাই মিলে, শান্তি হয়নি! এবার গুঁড়োকে নিয়ে পড়েছে! বাড়ি ছেড়ে চলে যাব এই নিয়ে আর একটাও কথা হলে! নীলেশ হৃষিকেশে পোস্টেড, সব ব্যবস্থা করে দেবে। গুহা-টুহা না হোক, একটা গাছতলা জুটে যাবে।”

“গুঁড়ো কে?” যমুর প্রশ্ন। অনিন্দ্যদার ফর্ম দেখে যমুর গলার তেজ মনে হলো একটু কমেছে।

তবে আমি আর ওসবে কান দিচ্ছিলাম না। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম দাদার দিকে। আহা! এই আমাদের সেই মিতবাক নিরীহ অনিন্দ্যসুন্দর দাদা? কী গমগমে গলা! কী দৃপ্ত ভঙ্গি! একেই বলে পুরুষসিংহ! হুঁ হুঁ বাবা, জমিদারবংশের রক্ত, তেজ যাবে কোথায়! কালে কালে ঠিক ফুটে বেরুলো তো! ব্রিটিশ আমল হলে বসুরায়বাড়ির জামাইয়ের কপালে খানদুয়েক ‘রায়বাহাদুর’ খেতাব নিশ্চিত জুটেই যেতো।

চেনা জামাইয়ের অচেনা তেজিয়ান চেহারাখানা সবারই মনে ধরেছে বোধহয় বেশ। ‘বসো বাবা, জল খাও, বাতাস খাও’ নানাভাবে আপ্যায়ন চলতে লাগল। কেবল যমু দেখলাম খাটের ওপর গ্যাঁট হয়ে বসে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে অনিন্দ্যদার দিকে। তাকানোটা কেমন পাঁচমিশেলি টাইপের। খড়্গহস্ত গোছের চেনা দৃষ্টিটা তো রয়েছেই, তার সঙ্গে একটা অচেনা, নরম আলোমাখা দৃষ্টিও মিশে রয়েছে মনে হলো। ছোটবেলা থেকে হেব্বি ভয় পাই মেয়েটাকে, তবে তিন মিনিটের ছোট বোন তো, ওর চোখমুখের সব ভাবই মুখস্থ আমার, এই আলোমাখা তাকানোটা কিন্তু চিনি না। গমগমে গলা আর দৃপ্ত ভঙ্গির ছোঁয়া লাগল কি দোর্দণ্ডপ্রতাপ চোখদুটোয়? কে জানে!