শতরঞ্জ - জাকিউল অন্তু

ফ্যান্টাসি উপন্যাস

অলংকরণ - মিশন মন্ডল

পুরান ঢাকার এক চিপাগলিতে এমন অসাধারণ একটা এন্টিক শপ খুলেছে দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না। এ যেন গোবরে পদ্মফুল। যদিও এন্টিক বা প্রাচীন শব্দটার সাথে পুরান ঢাকার পুরান শব্দটা খুব মানায়। তবু ঢাকার এইদিকটা পুরাতন রসনা বিলাস নিয়েই পড়ে আছে। আর আছে পুরাতন কিছু নোনা ধরা বিল্ডিং। অবশ্য এখানে আসার পেছনে মূল কারণ ঐ রসনা বিলাস।

শুক্রবারের দিন। আমি আর বন্ধু হিমেল শখ করে পুরান ঢাকায় এসেছিলাম হাজীর বিরিয়ানি খাবো বলে। খাওয়া শেষে একহাতে একটা কোল্ড ড্রিংক আর অন্য হাতে বেনসনের শলাকা নিয়ে বেশ কিছুদূর হাঁটবো বলে ভাবছি, এমন সময় চোখে পড়লো দোকানটা। একটা সাধারণ ভ্যানগাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে রাখা হচ্ছে মাটিতে। সেখান থেকে মালপত্রগুলো সামনের ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন এক ভদ্রলোক।

এমন সরু গলির শেষ মাথায় দোকানটার অস্তিত্ব জানতে হলে বড়মাপের বিজ্ঞাপন দরকার। আমার কিন্তু বিজ্ঞাপন লাগলো না। সিগারেটে দ্বিতীয় টানটা দিয়ে যেই ধোঁয়াটা ছাড়লাম ঠিক তখুনি সাদা ধোঁয়া ভেদ করে একটা আলোর ঝিলিক এসে পড়লো আমার চোখে। সূর্যের আলো পড়েছে কোন একটা ধাতব বস্তুর ওপর। সেখান থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে প্রতিফলিত জ্বলজ্বলে আলো। সেটাই আমার চোখে এসে লেগেছে।

ভ্যানগাড়িতে সব জিনিস মোটামুটিভাবে প্যাকেট করা থাকলেও এ জিনিসটায় নেই। জিনিসটা এমন আহামরি কিছু না। একটা পিতলের কলস। কিন্তু দূর থেকে ওটার গায়ের চকমকানি দেখলে স্বর্ণ বলে ভুল হয়। ঐ ভ্যান থেকে জিনিসগুলো নামিয়ে কোথায় রাখা হচ্ছে, কেনই বা রাখা হচ্ছে, কলস ছাড়া কী কী জিনিস আছে ঐ ত্রিচক্রযানের ওপর সেটা দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। নিজের শখের সাথে সামনের উপাদানগুলো প্রায় মিলে যাচ্ছে দেখে তর সইছিলো না। হিমেলের হাত ধরে টেনে নিয়ে চললাম গলির শেষ মাথায়। বেচারা এমন হ্যাঁচকা টানে অবাক হয়ে বললো

‘কোথায় চললি? মেসে ফিরবি না?’

‘হুম ফিরবো।’

আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম

‘কিন্তু আগে একটু দেখে নিই ওখানে হচ্ছেটা কী।’

‘ভ্যান থেকে জিনিসপাতি নামানো হচ্ছে। ঐ বিল্ডিঙয়ে নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে বোধহয়। স্পেশাল কিছু না।’

‘আছে আছে স্পেশাল অনেক কিছুই আছে। ওটা ভাড়াটিয়াদের মালপত্র না। দেখেই বুঝেছি। আগে চলতো। দেখিই না। ঐ যে ঐ লোকটা বোধহয় বলতে পারবে।’

‘দেখ আকাশে মেঘ করছে। এখন বাস না পেলে পরে পস্তাতে হবে। এসব পুরাতন মালামাল দেখে কী হবে?’

‘আমার শখের কথাটা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি?’

সত্যি সত্যি যদি এটা এন্টিক শপ হয় তবে এখানে হানা না দিয়ে আমি যাচ্ছি না। আমার আগে নিশ্চয়ই কেউ আসেনি। দেখছিস তো ওরা মাল নামাচ্ছে কেবল। আমার আন্দাজ কিন্তু ভুল হয় না। জানিস তো?’

ভ্যানের বিপরীতপাশে একটা মাঝারী আকারের দরজা। ভেতরের রুমটা বেশ বড়। দেয়ালের কালিঝুলি পরিষ্কার করে তেরপল দিয়ে ঢেকে পেরেক মেরে দেয়া হয়েছে। ভেতরে যে একজন মাত্র লোক ভ্যানচালকের কাছ থেকে মালামাল নিয়ে রুমের ভেতর সাজিয়ে রাখছেন, তিনিই মালিক। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, ‘ঠিকই ধরেছেন। এটা প্রাচীন জিনিসের দোকান। কিন্তু এখন তো কিছুই বিক্রি হবে না। সবে তো সব গোছাচ্ছি। তবে খাসা মাল আছে। আলাদিনের প্রদীপ, উড়ন্ত পাটি, শেবার রানীর আংটি, বাবরের জুতা আর আওরঙ্গজেব যে হাতিকে মেরেছিলো সেটার দাঁত আরো কত কী। বিকালে এলেই সব পাবেন। আমি সব সাজিয়ে রাখবো। পারলে আরো বন্ধুবান্ধব সাথে করে নিয়ে আসবেন। আমি বেশীদিন থাকবো না এখানে। যা মালামাল আছে সেগুলো বিক্রি হলেই চলে যাবো।’

শেষের কথায় একটা আনন্দ আর দুঃখের সংমিশ্রণ লক্ষ করলাম। সেটা সব মালামাল বিক্রি হওয়ার খুশীতে না সব হাতছাড়া হওয়ার দুঃখে সেটা স্পষ্ট বোঝা গেলো না।

তিনি যেসব জিনিসের বর্ণনা দিলেন সেসব জিনিসের সত্যিই যদি কোন কার্যক্ষমতা থাকতো তাহলে কিন্তু বেশ মজার হতো। আমি আলাদিনের প্রদীপ আর উড়ন্ত পাটিটা নিতাম। প্রদীপ ঘষে দৈত্যকে ডেকে এনে মনের অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো পূরণ করে নেওয়া যেতো। উড়ন্ত পাটি থাকলে হিমেলকে আর লোকাল বাসের সিট পাওয়ার জন্য এতো অপেক্ষা করতে হতো না। উড়ে উড়েই চলে যাওয়া যেতো মেসে কিংবা ভার্সিটিতে।

কী সব ছেলেমানুষি কথা ভাবছি। মনে মনে বেশ একচোট হেসে নিলাম। আসলে লোকটার কথার ভঙ্গীটাই এমন। সব বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়।

সাধারণত এধরনের দোকানের মালিক হন বৃদ্ধ কেউ। কিন্তু স্যান্ডো গেঞ্জি আর সাদা লুঙ্গি পরা এই দোকানের মালিকের বয়স মাঝামাঝি। ভারী কোমল তার চেহারা। কেমন একটা মায়া জড়ানো। চোখেমুখে ব্যবসায়ী ভাবটা নেই। যেন শখের বশে তার সংগ্রহে থাকা পুরাতন জিনিস বিক্রি করছেন। টাকাপয়সার দরকার তার নেই বললেই চলে। মানুষের মাঝে প্রাচীন ঐতিহাসিক সব জিনিসপত্র বিলিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত হতে চান। আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়। লোকটার ভাষা। উনি সম্ভবত এই এলাকার নন। পুরান ঢাকার আঞ্চলিকতার কোন টান নেই তার ভাষায়। একদম শুদ্ধ সাবলীল তার উচ্চারণ। কোন এলাকার মানুষ জেনে নিতে হবে একসময়।

আমি লোকটার কাছে এগিয়ে গিয়ে অনুরোধ করে বললাম, ‘বিকালে আমাদের কাজ আছে ভাই। আজ এখন যদি অন্তত একটা বস্তা খুলতেন তাহলে পছন্দমতো কিছু জিনিস নগদ টাকায় কিনে নিতাম। আমার খুব শখ এসব জিনিস জমানোর। প্লিজ না করবেন না। জিনিস পছন্দ হলে আমরা আবার আসবো। বলে হিমেলকে ইশারা দিলাম। ও আমার কথার পরপর বলে উঠলো, ‘হ্যাঁ আসবোই তো। আপনি খুলুন না দু একটা বস্তা!’ বলে দাঁত কিড়মিড় করে আমার দিকে একবার তাকালো। বিরিয়ানি খাবার পর ওর রুমে গিয়ে ঘুম দেবার কথা। আমার জন্য সেটা ভেস্তে যাচ্ছে দেখে ও মনে মনে ক্ষেপেছে। রুমে গিয়ে ওকে বোঝাতে হবে।

দোকানের মালিক বললো, ‘এই সোলেমানের একটা সমস্যা আছে জানেন। বয়সে ছোট কারো আবদার ফেলতে পারে না। আসেন। ভেতরে আসেন। দেখি কী করা যায় আপনাদের জন্য।’

বলে ভ্যানচালকের কাছ থেকে শেষ বস্তাটা নামিয়ে নিয়ে তার ভাড়া মিটিয়ে বিদায় করলেন।

রুমের ভেতর ভ্যাপসা গরম। কিছুক্ষণ আগে পেটে বিরিয়ানি পড়েছে। তাই গরমটা আরো বেশী অনুভূত হচ্ছে। হিমেল হাতদুটো ভাঁজ করে বুকের কাছে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ওর কটা দৃষ্টি আমার দিকে। ঘরের গরমের চাইতে ওর চোখের গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছি বলে মনে হলো। রুমের দক্ষিণে একটা ছোট জানালা আছে কিন্তু ওটা দিয়ে দক্ষিণা বাতাস আসার কোন নামগন্ধ নেই।

সোলেমান ভাই ইতিমধ্যে অনেকগুলো বস্তার মধ্যে একটা ছোট বস্তার মুখ খুলে ফেলেছেন। তারপর মেঝেতে বেছানো পাটির ওপর ঢেলে দিলেন বস্তার জিনিসপাতি। বলিষ্ঠ দেহ উনার। এসব ছোটখাটো কাজ উনার জন্য নস্যি। তবুও জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি একা সব কাজ করছেন যে? ছেলে ছোকরা কেউ নেই সাহায্য করার জন্য?’

উত্তর এলো, ‘অনেকেই তো ছিলো কিন্তু একে একে সবাই না বলে চলে গেছে। অথচ দেখুন না কত অল্প কাজ। শুধু জিনিসগুলো একটু দেখেশুনে রাখবে। ধুলো জমলে ঝাড়পোছ করবে। কাস্টমার এলে সেগুলো দেখিয়ে দেবে। দাম বলার দায়িত্ব তো আমার।

‘ওদের বেতন দিতে কোন কার্পণ্য করিনি আমি। কোনদিন না। বরং চাওয়ার আগেই সব দিয়ে দিয়েছি। তবু চলে গেলো। ভেবেছিলাম যাওয়ার সময় বোধহয় কিছু না কিছু চুরি করে পালিয়েছে প্রত্যেকে। কিন্তু না। সব জিনিস জায়গামতো আছে। কোন নড়চড় হয়নি। শুধু পালিয়ে গেছে ছোকরাগুলো। খুব কষ্ট পেয়েছি মনে। তাই এখন আর কাউকে রাখি না। একা কাজ করতে শিখে গেছি। তাছাড়া আমার জিনিসপত্রের যত্নআত্তি আমি ছাড়া কে ভালো করবে বলুন! যাই হোক বাদ দিন ওদের কথা।’

তারপর মেঝে থেকে একটা অসম্ভব সুন্দর মাঝারী আকৃতির পিতলের প্রদীপ বের করে সেটা উঁচিয়ে ধরে বললেন, ‘এই দেখুন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। আমার সংগ্রহের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর জিনিসগুলোর একটি এই প্রদীপ। প্রদীপের গা ঘষলে জ্বীন বেরোবে না ঠিকই। কিন্তু শো পিস হিসেবে চমৎকার একটা জিনিস। ইচ্ছা করলে কাউকে উপহার দিতে পারেন। আর এই দেখুন সেই আলাদিনের ব্যবহৃত আরেকটি বস্তু উড়ন্ত পাটি। এটাও আগের মতন আর কাজ করে না। কিন্তু হাত দিয়ে ধরে দেখুন,পায়ের পাতাগুলো পাটির ওপর রাখুন। দেখবেন মোলায়েম মখমলের পাটিতে আপনার পা ধীরেধীরে ডুবে যাচ্ছে।’ বলে মিটমিট করে হাসলেন দোকানী।

এভাবে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রত্যেকটা প্রাচীন বস্তুর এমন আকর্ষণীয় বর্ণনা দিতে লাগলেন যেটা শুনে মনে হলো সব জিনিস কিনে ফেলি। একটাও বাদ রাখবো না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো আমরা ছাত্রমানুষ। মেসে থাকি। এখানে যেসব জিনিস আছে তারমধ্যে বেশীরভাগ জিনিস বাসাবাড়ি সাজানোর জন্য। যেমন ফুলদানী, পুতুল, ওয়ালম্যাট, কলস পাতিল, পেইন্টিং, ইত্যাদি। খুব চোখে পড়ার মত কিছু নেই সেখানে। যা আছে তা নিয়ে মেসে রাখাটা বিলাসিতা হবে।

মনে মনে চলে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন চোখ আটকে গেলো একটা ধুলোমাখা ষড়ভূজাকার বাক্সের মতন জিনিসের দিকে তাকাতেই। বাক্সের ওপর বর্গের মতো দাগ কাটা। পরপর ছোট বড় মাঝারী অনেকগুলো বর্গ। সেগুলোর একটা বর্গ সাদা অন্যটা লাল।

আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেই প্রথমে হাতে নিয়ে ওটার ওপর জমে থাকা ধুলো ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিলেন সোলেমান ভাই। তারপর ঘরের এক কোণ থেকে একটা ন্যাকড়া নিয়ে এসে মুছতে লাগলেন সেটা।

মোছা শেষ হলে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা একটা দাবার বোর্ড। একদম কমপ্লিট সেট। বাক্সটা খুলে উপুড় করে খুলে রাখলেই দাবার ছক পেয়ে যাবেন। মজার ব্যাপার হলো এই দাবা একসাথে তিনজন মিলে খেলা যায়। ইংরেজরা এধরনের দাবার নাম দিয়েছে থ্রি-হ্যান্ডেড চেস। বাক্সের ভেতরে আছে ঘুটিগুলো।

‘এই একটা জিনিস সুদূর চীন থেকে আনানো। প্রমাণ দেখতে চান? এই দেখুন ওদের বিশপের ঘুটিদুটো দেখতে পৌরাণিক প্রাণী ড্রাগনের মতন! চীনে ড্রাগনকে পুজো করা হয় কিনা তাই দাবার বোর্ডেও তার ছাপ রয়েছে। আর একটা তথ্য জানিয়ে রাখি। এই ঘুটিগুলো কিন্তু প্লাস্টিক বা সিরামিক না সত্যিকার মানুষের হাড় দিয়ে তৈরি! চীনের মিং রাজাদের একটা ভয়ানক অভ্যাস ছিলো। ওরা যুদ্ধে জিতলে শত্রুপক্ষের সেনাপতির মাথা কেটে সেটাকে লাথি মেরে বিজয় উদযাপন করতো। আধুনিক ফুটোবলের প্রাচীন সংস্করণ বলতে পারেন। আর দেহের বাকি অংশ থেকে মাংস ছাড়িয়ে হাড় আলাদা করে নানান কাজে ব্যবহার করতো। তাদের মধ্যে হাড় দিয়ে দাবার ঘুটি বানানো ছিলো সেই পৈশাচিক কাজগুলোর একটি। যদিও এ ব্যাপারে অনেকেই জানে না। আপনাদের তেমন দাবার ঘুটিই দেখাচ্ছি। অনেকে মানুষের হাড় দিয়ে তৈরি বলে ভয়ে ঘেন্নায় অবহেলা করেছে জিনিসটাকে। অথচ এত দারুণ একটা দাবার সেট। সেটা কেউ দেখলোই না। ভালো জিনিসের কদর উঠে গেছে বুঝলেন ভাই।’

বলে বাক্সটা খুলে ঘুটিগুলো দেখাতে লাগলেন। মাঝারী আকারের প্রত্যেকটা ঘুটিই অনিন্দ্য সুন্দর। একেকটা ঘুটির আকৃতি তাদের স্ব স্ব নামের প্রতিনিধিত্ব করছে। রাজার জায়গায় ঠিক রাজার মতো মুকুটধারী;সীলমোহরযুক্ত তলোয়ারবাহী কেউ , রানীর জায়গায় অলংকারে সুসজ্জিত মুকুট পরিহিতা রানী, দুর্গের জায়গায় দুর্গ, পেয়াদার জায়গায় পেয়াদার মতন দেখতে ঘুটি দেখে জিনিসটার প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যাচ্ছিলো।

বিশপের জায়গায় সত্যিই ডানা মেলে থাকা দুটো ড্রাগনের ঘুটি দেখা গেলো, খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে ড্রাগনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ক্ষীণ আগুনের শিখাটা দেখা যাবে। আর একটা ব্যপার দেখে ভালো লাগলো। ঘোড়ার ঘুটিদুটোর জায়গায় ডানা মেলে থাকা দুটো ঘোড়া। গ্রীক দেবতাদের প্রধান জিউসের বজ্রফলা বহনকারী উড়ন্ত ঘোড়া পেগাসাসের মত দেখাচ্ছিলো ঘুটিগুলোকে। আমার কিশোর বয়সের দাবা খেলার নেশাটা কখন চাগাড় দিয়ে উঠেছে প্রথমে বুঝিনি। কিন্তু যখন দেখলাম কারুকাজ করা ঐ বাক্সের মতন দেখতে দাবার সেটটা দোকান থেকে না নিলে শান্তি পাচ্ছি না তখন নিশ্চিত হলাম যে আবার সময় এসেছে যান্ত্রিক জীবন থেকে বিরতি নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাবা খেলে কাটিয়ে দেবার। তাও আবার সম্পূর্ণ নতুন ধরনের দাবা। আমি আর হিমেল তো আছিই, মেস থেকে আর মাত্র একজন দাবাড়ু খুঁজে বের করা কঠিন কিছু নয়। সেই তালিকায় ইতিমধ্যে এক বন্ধুর নাম উঠে গেছে।

এই দাবার নিয়মকানুন জানা ছিলো না। সোলেমান ভাই বললেন, ‘বোর্ডের ভেতরে একটা কাগজের ওপর সব নিয়ম এঁকে দেখানো হয়েছে। যদিও ছবির নিচের বর্ণনাগুলো চাইনিজে লেখা। তবু ছবিগুলো এত সুন্দরভাবে আঁকানো যে আপনাদের বুঝতে কোন অসুবিধা হবে না। আরেকটা ব্যপার আগেই বলে দিচ্ছি। খবরদারী করে অন্য কোথাও থেকে এর নিয়ম বের করে খেলতে বসে যাবেন না। এমনকী আপনাদের ঐ ইন্টারনেট না কী যেন আছে না সেটাতেও কিন্তু আসল নিয়মটা দেয়া নেই। এই দাবা বোর্ডের বাক্সের ভেতরে দেয়া কাগজের নিয়ম মেনে খেলতে হবে। ভুলেও তিনজনের কম খেলোয়াড় নিয়ে খেলতে বসবেন না। নইলে দাবার দেবী ‘কেইসা’ রুষ্ট হবেন। আর ঘুটিগুলো স্থির হয়ে আটকে যাবে দাবার ছকে আঁকা যার যার বর্গে। ঘুটির নিচ থেকে বের হবে শিকড়, সেগুলো গেঁথে যাবে বোর্ডের ছকে। ওদের আর কোনমতেই সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারবেন না। এরপর আর কোন চাল দেয়ার সুযোগ নেই। আমি প্রথমে এই ব্যাপারগুলো বিশ্বাস করিনি। এখনো করি না। তবে যার কাছ থেকে বোর্ডটা সংগ্রহ করেছিলাম উনি এই অদ্ভুত সতর্কবাণী দিয়েছিলেন। আরেকটা কথা...না থাক!’ বলে আপনমনে কী যেন বিড়বিড় করতে লাগলেন।

আমি লোকটার আজগুবি কথা বিশ্বাস করিনি। পুরোটাই ‘প্র্যাক্টীক্যাল জোক’ ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু চোখেমুখে এমন একটা ভাব ফুটিয়ে তুললাম যেন ওনার সব কথাই বিশ্বাস করেছি আর মনে মনে ব্যপারটা নিয়ে আমি খুব ভীত এবং একইসাথে সাবধান।

গভীর আগ্রহভরে বোর্ডটার দাম জিজ্ঞেস করাতে লোকটা আমাদের এক কথায় অবাক করে দিয়ে বললো, ‘আপনি তাহলে জিনিসটা নিতে রাজি হলেন? মানুষের হাড় নিয়ে আপনার মধ্যে কোন শুচিবায়ু নেই তাহলে? ভুল চালে বিপদের সম্ভাবনা আছে জেনেও আপনার আগ্রহ দেখে ভালো লেগেছে ভাই। আপনি বোর্ডটা এমনিতেই নিয়ে যান। টাকা লাগবে না। এতদিন পর জিনিসটা কেউ পছন্দ করেছে শুনেই ভালো লাগছে। আগে যেই এই বোর্ডটা নিয়েছে তাদের কাছ থেকে ফিরে এসেছে আমার দোকানেই। বুঝতে পারছি আপনার দাবার নেশা আছে। এরকম একটা বুদ্ধির খেলা আপনার মতন বুদ্ধিমান ছেলেরই প্রাপ্য। তাই এটা আপনাকে উপহার দিলাম। কোন টাকা লাগবে না।’

লোকটা পাগল নাকি? এত সুন্দর একটা জিনিস এতদিন বিক্রি হয়নি বলে বিনা পয়সায় হাতছাড়া করছে! তাও আবার সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা ছেলের কাছে। এই বোর্ডে কোন ধাপ্পাবাজি নেই তো! হয়তো সাধারণ প্লাস্টিক ঘষেমেজে হাড়ের আদলে তৈরি করা হয়েছে। ঘুটিগুলোর যা আকৃতি তা দেখে শুরু থেকেই ওগুলো কে অন্য উপাদানে তৈরী বলে মনে হয়েছে। কারণ মানুষের হাড়ের ওপর অতো সূক্ষ কাজ করা প্রায় অসাধ্য ব্যাপার। হয়ত বস্তায় পড়ে থেকে অনেকদিনের ধুলাময়লা জমে এখন সে ঘুটিগুলো সত্যিকারের হাড়ের ঘুটির মতন দেখায়।

সত্যি বলতে কী এই ‘মানুষের হাড়ের তৈরি’ আর ‘ড্রাগনের মত দেখতে ঘুটি’ ব্যপার দুটো আমার মাথায় ঘুরছিলো। অন্যান্য ঘুটির গড়নও চমৎকার। এই দাবার সেট বাগাতে পারলে একইসাথে প্রাচীন বস্তুর সংগ্রহের তালিকায় একটা নাম যুক্ত হবে আবার খেলার উপকরণেও নতুনত্ব আসবে। শুধু খটকা লাগলো একদম বিনামূল্যে এমন অমূল্য বস্তু হস্তান্তরের ব্যপারটা। অবশ্য লোকটার বোর্ড সংক্রান্ত আবোলতাবোল কথাবার্তায় খানিকটা অবাক হইনি তা নয়। আচ্ছা ভদ্রলোক কোন চাল চালছেন না তো? চেহারা দেখে তো অমনটা মনে হয় না। আর আমাদের বিপদে ফেলে লোকটার লাভই বা কী? তাছাড়া বোর্ডে এমন কিছুই তো চোখে পড়ছে না যা দিয়ে কারো ক্ষতি করা সম্ভব।

এসব নানান চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো কিন্তু অবশেষে একটা অসাধারণ প্রাচীন চৈনিক দাবার বোর্ড দখলে আনবার লোভের কাছে সব চিন্তাভাবনা হার মানলো। সোলেমান ভাইয়ের হাত থেকে সন্তর্পণে বোর্ডটা আমার হাতে নিয়ে নিলাম। উনার মুখে স্মিতহাসি খেলা করছে। এই উপহার দানে তিনি সন্তুষ্ট। আমিও তার হাসির জবাবে হাসলাম। এই সমস্ত সময় হিমেলের মুখে কোন কথা ছিলো না। ও কোন কারণে গম্ভীর না ভীত তা বোঝার উপায় নেই। গম্ভীরতার কারণ অবশ্য আগেই বলেছি। এই দোকানে আসতে চায়নি ও। কিন্তু যে ভীতির সঞ্চার ওর চোখদুটোকে বড়বড় করে তুলছিলো সেটা আমার নজর এড়ায়নি। এই দিনেদুপুরে কী দেখে ভয় পেলো হিমেল?

সোলেমান ভাইয়ের কাছে দাবার বোর্ডটা নিয়ে তাকে বেশ কয়েকবার ধন্যবাদ জানিয়ে বের হলাম দোকান থেকে। আসার আগে কথা দিলাম সময় পেলে আবার আসবো এই দোকানে। একেবারে বন্ধুবান্ধব সহ। যাদের এধরনের প্রাচীন জিনিসপত্রের ওপর টান আছে তাদের আনবো। ওরা শখের জিনিসগুলো কিনে নেবে দোকান থেকে।

সোলেমান ভাই যেমন দিলদরিয়া মানুষ, দেখা যাবে সবাইকে কিছু না কিছু জিনিস উপহার দিয়ে বসে আছেন। এই সামান্য সময়ে উনার জন্য কৃতজ্ঞতায় মনটা ভরে উঠছিলো। দাবার বোর্ডটার দাম কমসে কম দশ হাজার টাকা হওয়া উচিত। ওরকম একটা প্রাচুর্যে ভরা দোকানের মালিক হলে আমি এমন দামই হাঁকাতাম। কাস্টমার নিলে নিক না নিলে না নিক। কারণ এ জিনিস সবার নজর কাড়বে। কাড়তে বাধ্য। এমনকী যারা দাবা খেলা পারে না তারাও মহা উৎসাহে বোর্ডটা কিনে নিয়ে যাবে শোকেজে রেখে ঘর সাজানোর জন্য।

বোর্ডটার দিকে যত চোখ পড়ছে তত বিমোহিত হয়ে যাচ্ছি।

বোর্ডটা আকারে দুই বিঘত পরিমাণ চওড়া। বাক্সের ভাঁজ খুললে সেটা চার বিঘত হবে। একদম নিখুঁত ষড়ভূজাকৃতির বোর্ড। দোকানের বাইরে আনার পর ওটার সৌন্দর্য যেন বহুগুণে বেড়ে গেছে। ঘুটিগুলো হাড়ের তৈরি হলেও বাক্সটা উজ্জ্বল, মসৃণ এবং চকচকে আবলুস কাঠে তৈরি। ইংরেজিতে এধরনের কাঠকে ‘ইবোনি’ বলে। কাঠের ওপর খোঁদাই করে বসানো হয়েছে খেলার ছক। সাধারণ দাবার বোর্ডের মত বোর্ডের ছকে সাদা কালো বর্গ নেই। কালো বর্গের বদলে রক্তাভ লাল বর্গ দেখতে পাচ্ছি। দোকানের ভেতরে খেয়াল করিনি। এখন রোদ পড়ে জমাট রক্তের মত লাগছে বর্গগুলোকে। সাদাকালোর বদলে সাদা লাল বর্গ বোর্ডটার মধ্যে একটা নতুনত্ব এনে দিয়েছে। ঘুটিগুলোর কথা আগেই বলেছি। সাদা, কালো আর লাল রঙয়ের ঘুটির তিনটি সেট, তার প্রত্যেকটা ঘুটি স্ব স্ব সৌন্দর্যে বলিয়ান।

ছকের ছয়টি কোণে চমৎকার কারুকার্য শোভা পাচ্ছিলো। যা বোর্ডের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। বাক্সের মাঝখানে ছোটছোট আংটা দিয়ে দুটো কপাটের মতন অংশ বানানো হয়েছে। কপাট খুলতে হয় বই খোলার মত করে। পাশাপাশি সংযুক্ত দুই কপাটের মাঝের ফাঁপা জায়গায় ঘুটিগুলো স্বাচ্ছন্দে রাখা যায়। সাদা, কালো আর লাল এই তিন রঙয়ের ঘুটির জন্য বাক্সের ভেতরে ছোট তিনটে খোপ রয়েছে।

কাছে আয়না নেই তবু আমার চোখেমুখে খেলে যাওয়া খুশির ঝলক আমি নিজেই দেখতে পাচ্ছি। সোলেমান ভাই সত্যি খাসা জিনিস দিয়ে দোকান সাজিয়েছেন। তার মধ্য থেকে সবচাইতে সুন্দর একটা বস্তু তিনি আমায় উপহার দিয়েছেন। লোকটা প্রথম পরিচয়ে এমন ঋণী করে দেবে কে জানতো।

একটা উদ্ভট চিন্তা সেই তখন থেকেই মাথায় ঘুরছিলো। যার বা যাদের দেহের হাড় দিয়ে ঘুটিগুলো তৈরি রাতেরবেলা তাদের আত্মা এসে ঘুটিগুলোর ওপর ভর করে বসবে না তো! হাহ!হাহ!

কী অদ্ভুত আমার চিন্তার ধরণ। বেশি বেশি হরর মুভি দেখার ফল এটা।

হিমেল বলেছিলো বাইরে নাকি মেঘ করেছে। কিন্তু আমি বাইরে এসে ঝকঝকে রোদ দেখছি। হয়তো দোকানে ঢোকার পর মেঘ কেটে গিয়েছে।

হিমেল দোকান থেকে সেই গম্ভীর মুখ নিয়েই বের হয়েছে দেখে প্রশ্ন করলাম

‘ তুই এখনো রাগ করে আছিস। দেখ তোর সামান্য একটু কষ্টের জন্য কত চমৎকার একটা জিনিস পেলাম। এটা তো শুধু আমার না তোর ও এর ওপর সমান অধিকার আছে। তুই তো বলেছিলি কম্পিউটারে বোর্ড গেমস খেলে পোষাচ্ছে না এখন সত্যিকারের খেলার বোর্ড কেনা চাই। সেটা ক্যারাম হোক, বাগাডুলি হোক বা দাবা। তাছাড়া চোখেরও ক্ষতি হচ্ছিলো। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও সময় করে উঠতে পারিনি দুজনের কেউই। আজ সে সময় সুযোগ দুটোই হয়েছে আর তোর মন খারাপ!’

‘মন খারাপ না রে। একটা ব্যপার নিয়ে চিন্তিত। তুই খেয়াল করেছিস সোলেমান যখন দাবার বাক্সের মুখটা খুলে দিলো তখন একটা স্পষ্ট চিৎকার আমি শুনেছি। যেন ভেতরের ঘুটিগুলো থেকে ভেসে আসছে সেই চিৎকার। আমার শুনতে ভুল হয়নি বন্ধু। এই দাবার বোর্ড একদম ফ্রিতে দেয়ার কারণটাও কিন্তু স্পষ্ট না।’ বললো হিমেল।

বললাম, ‘ধুর! কী সব আজেবাজে বকছিস। কই আমি তো ওরকম কোন চিৎকার বা আওয়াজ শুনিনি। হতে পারে আশেপাশের দালানে কোন বাচ্চা হয়তো খেলছিলো। সোলেমান ভাই বাক্সটা খোলার সময় সে হয়তো কোন কারণে ব্যথা পেয়ে চিৎকার করে উঠেছে। সেটাই কাকতালীয়ভাবে তোর কাছে ঘুটির চিৎকার বলে মনে হয়েছে। তাছাড়া শুরু থেকেই মানুষের হাড় থেকে তৈরি ঘুটির মত ভুতুড়ে ব্যপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে তুই ওরকম কল্পনা করে নিয়েছিস। এটাই স্বাভাবিক। আমারো শুরুর দিকে বিদঘুটে লেগেছে কিছু ব্যপার। কিন্তু সবই আসলে আমাদের রাত জেগে হরর মুভি দেখার ফল বুঝলি? ওসব কমাতে হবে।’

হিমেল আমার কথায় কতটুকু আশ্বস্ত হলো ঠিক বোঝা গেলো না। শুধু ঘাড়টা এদিক ওদিক করে নীরবে সম্মতি দিলো। ধরে নিলাম ও বুঝেছে।

সেদিন ঘরে ফিরে অদ্ভুত দাবার বোর্ডটা পড়ার টেবিলে রেখে যেমন ছিলাম ঠিক সেই অবস্থাতেই ঘুম দিলাম দুই বন্ধু। কাজকর্ম নেই, প্রেমিকা নেই, হতাশাগ্রস্থ জীবনে ঘুমটাই একমাত্র সম্বল। ঘুমালে কিছুক্ষণের জন্য হলেও হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এটা মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা। হিমেল বলে, ‘আমাদেরও তো সেই একই ধারণা। মনোবিজ্ঞানীদের মতের সাথে আমাদের মতের কত মিল দেখেছিস।’ বলে হাসতো হিমেল। আমিও যোগ দিতাম সেই হাসিতে।

আজ বাইরের রোদে পুড়ে ঘামে শরীর ভিজিয়ে মেসে ফিরতে হয়েছে। বাস পেয়েছি অনেক হাঁটার পর। কোন এক অদ্ভুত কারণে কোন বাস আমাদের ইশারায় থামছিলো না। শেষে হাঁটতে হাঁটতে একটা বাস স্টপে এসে লাফিয়ে উঠে পড়েছি বাসে। কন্ডাক্টর আমরা ছাত্র বলেই কিনা জানি না আমাদের কাছে কোনরকম ভাড়া রাখেনি। এমনকী একবার ভাড়ার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেনি। সিটের আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমাদের সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে চলে গেছে অন্যান্য সিটের দিকে। ভার্সিটির ছেলেদের কিছুদিন আগে এই রোডের বাসের কন্ডাক্টরদের সাথে ভাড়া নিয়ে গোলমাল হয়েছিলো। ছাত্ররা ক্ষেপে গিয়ে দু একটা বাস ভেঙ্গেছে। তারপর থেকেই সম্ভবত এরা কাছাকাছি দূরত্বে কোথাও গেলে ছাত্রদের কাছ থেকে ভাড়া নেয় না। আমরা সেই সুবিধা পাচ্ছি। এমন আহামরি কিছু নয়। মাত্র তিরিশ টাকা বেচে গিয়েছে দুজনের। ব্যাচেলর লাইফে এটাই অনেক। এ লাইফে প্রয়োজনের সময় তিরিশ টাকাই তিনশো টাকার সমান। তিরিশ টাকার সাথে তিন টাকা যোগ করে তেত্রিশ টাকায় তিন তিনটে বেনসন পাওয়া যাবে। একদিনের তিনবেলার সিগারেট খরচ বেচে যাওয়াটা কিছুটা আনন্দের তো বটেই।

ঘুম থেকে উঠতে উঠতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। গরমের দিনে ঘুমোলে ওঠার পর একটা অস্বাভাবিক ক্লান্তি কাজ করে আমার শরীরে। ঘুমটাও ফ্রেশ হয়নি। আজ গরমটা ভালোই পড়েছে। ফ্যান ছেড়েই ঘুমিয়েছিলাম কিন্তু তবুও ঘামে ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে শরীর। একটা ফ্রেশ গোসল দিতে হবে। তারপর এককাপ কফি নিয়ে আজকের বিশেষ সংগ্রহ দাবার বোর্ডটা নিয়ে বসবো।

কথামত কাজ শুরু করলাম। গোসল সেরে এসে দেখি হিমেলের ঘুম ভেঙেছে। ওকে বললাম তোর কফি রাখা আছে কফি মেকারে। যা হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে কফিটা ঢেলে নিয়ে আয়। দাবা খেলতে বসবো। আমি এই ফাঁকে রিফাতকে ফোন দিচ্ছি। তিনজনে মিলে একটা ম্যাচ হয়ে যাক।

হিমেলের মধ্যে দাবা খেলা নিয়ে তেমন একটা আগ্রহ দেখা গেলো না। তবে ও বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমের দিকে গেলো ফ্রেশ হতে। আমি ফোনটা হাতে নিয়ে ডায়াল করলাম রিফাতের নাম্বারে। কিন্তু বারবার রিং হওয়ার পরেও রিফাত ফোন ধরলো না। ও আমাদের মেসের দোতালায় থাকে। আমরা থাকি তিনতলায়। ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে হয়তো। এই সময় ওর রুমেই থাকার কথা। তাই ভাবলাম ওর রুমে গিয়ে ওকে ডেকে নিয়ে আসি। যাবার আগে মনে হল দাবার বোর্ডটা টেবিলে সাজিয়ে রেখে যাই। রিফাত এসে হুট করে দেখলে সারপ্রাইজড হবে। ওকে ডাকার সময় আগে থেকে কিছু বলবো না।

বোর্ডের বাক্সের কপাট খুলে ভেতরের কাগজে আঁকা ম্যানুয়াল বের করে সেই অনুসারে ঘুটিগুলো সাজালাম বোর্ডের ছকে। সোলেমান ভাই ঠিক বলেছিলেন। ম্যানুয়েলে সব সুন্দর করে এঁকে বর্ণনা করা হয়েছে, বুঝতে কোন সমস্যা হলো না।

এবার লক্ষ করলাম ছকের সব ঘর আসলে নিখুঁত বর্গাকার নয়। বেশ কিছু ঘর ষড়ভূজের কিনার ঘেঁষে সামান্তরিকের আকার নিয়েছে। বোর্ডের গড়ন যত দেখছি তত মুগ্ধ হচ্ছি। ষড়ভূজ বোর্ডের তিনদিকের ঘরে তিন রঙের আলাদা আলাদা ঘুটি সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে টেবিলের মাঝামাঝি রেখে দিলাম। তারপর ঘরের দরজা চাপিয়ে দিয়ে ছুটলাম রিফাতের রুমের দিকে। রিফাত যে শুধু আমার মেসমেট তা কিন্তু নয়। ও আর আমি একই ভার্সিটিতে পড়ি। শুধু ওর সাবজেক্ট আলাদা। দাবা খেলার ব্যপারে প্রথমে ওর নামটা মাথায় আসার কারণ একটাই--- ভার্সিটিতে ইনডোর গেমস ক্লাবের দাবার চ্যাম্পিয়ন রিফাত। পরপর তিনবার আন্তঃবিভাগীয় দাবার ট্রফি বগলদাবা করেছে ও। দাবা ওর কাছে নেশা পেশা ধ্যান জ্ঞান সবই। ওর প্যাশন দাবা। আমরা তো শখের দাবা খেলোয়ার। তাই থ্রি হ্যান্ডেড চেসের নাম শুনিনি কখনো। ও নিশ্চই আগে থেকে জানে। দেখা যাবে ওকে ম্যানুয়াল ঘেটে নিয়ম বলে দিতে হচ্ছে না।

সিড়ি ভেঙে রিফাতের রুমে পৌঁছতে সময় লাগলো আনুমানিক দু মিনিট। দরজা ভেতর থেকে ভ্যাজানো। ধাক্কা দিতেই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে ভেতরের দিকে চলে গেলো। এই দরজা ধাক্কা দিতে আমার বেশ ভয় করে। পুরনো আমলের এই দরজা যে কবে ধাক্কা দিতেই খুলে গিয়ে হাতলসমেত হাতে চলে আসে তার ভরসা নেই।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই রিফাতকে দেখলাম খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে মুখের ওপর মোটা একটা বই নিয়ে পড়ছে। ওটা যে পড়ার বই না সে ব্যপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত। রিফাতকে আমি খুব ভালো করেই চিনি। এই ভর সন্ধ্যা বেলায় ও পড়ার বই নিয়ে বসলে বুঝতে হবে বিশ্বব্রহ্মান্ডে কিছু একটা গোলযোগ ঘটেছে। নইলে রিফাত আর যাই হোক অন্তত পড়ার বই নিয়ে বসতো না। কাছে যেতে বুঝলাম আমার ধারণা আংশিক সত্য। আমি ভেবেছিলাম ওর হাতে গল্পের বই। কিন্তু ওটা আসলে বিখ্যাত দাবা গ্র্যান্ডমাস্টার গ্যারি ক্যাসপারভের লেখা একটা বিখ্যাত বই ‘চেকমেট’।

যাক, মজার পালা আসছে তাহলে। আমি যে রিফাতকে এই দাবার বই পড়ার সময় দাবা নিয়ে আরেকটা সুসংবাদ দিতে পারবো তা ভাবতেই ভালো লাগছে।

হাত বাড়িয়ে ওর মুখের সামনে মেলে ধরা ক্যাসপারভের বইটা সরিয়ে দিলাম। তারপর বললাম, ‘রুমে চল এক্ষুনি। তোকে একটা দারুণ জিনিস দেখাবো।’

‘কী জিনিস রে? দেখ ব্যস্ত আছি। বইতে দারুণ একটা তথ্য পেলাম। এতবছর থেকে দাবা খেলি অথচ বইটা পড়ে আজ প্রথম জানলাম শুধু দুজন নয় তিনজন এমনকী চারজন খেলোয়াড় নিয়ে একসাথে দাবা খেলা যায়! উপমহাদেশে দুজনের বেশি খেলোয়াড় নিয়ে দাবা খেলার প্রচলন নেই তাই ব্যপারটা এর আগে মাথায় আসেনি। দুজনের চেয়ে তিনজন বা চারজন মিলে খেলতে পারলে খেলাটা কত অসাধারণ হবে তোর ধারণা আছে?’

মনে মনে খুব অবাক হলাম, হাসিও পেলো বেশ। নিতান্তই কাকতালীয় ঘটনা। তবু রিফাতকে সারপ্রাইজ দিতে এসে আমি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেছি। কোনোমতে নিজেকে সামলে বললাম, ‘ আগে রুমে তো আয়, সব বলছি। ফ্রিতে কফির ব্যবস্থা আছে।’

আর কথা বাড়াতে হলো না। তড়াক করে এক লাফে বিছানা থেকে উঠে বসলো রিফাত। বললো, ‘ তাহলে আর দেরি কেন বন্ধু? বাকি কথা নাহয় তোর রুমে গিয়েই হবে।’

পুরো মেসে আমার হাতে বানানো কফির একটা সুনাম আছে। রিফাত সেটা মিস করতে চাইছে না বলেই এই তাড়াহুড়ো।

রুমের দরজা খুলে রিফাতই আগে ঢুকলো। আর ঢুকতেই খুব স্বাভাবিক কারণেই টেবিলে রাখা দাবার বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওর চোখেমুখে আনন্দ আর বিস্ময় লক্ষণীয়। বুঝলাম ও বিশ্বাসই করতে পারছে না কিছুক্ষণ আগে ক্যাসপারভের বইয়ে যা পড়ে এসেছে তার নমুনা তার চোখের সামনে বিদ্যামান।

বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই রিফাত প্রায় চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো, ‘ আচ্ছা, এই মারাত্মক সুন্দর জিনিসটা তোর মতন গবেটের কাছে কী করে এলো? আমি আজকেই ভাবছিলাম খেলাঘরে খোঁজ নেবো থ্রি হ্যান্ডেড চেসের ব্যপারে। তোর কাছে পেয়ে যাব ভাবতেই পারিনি।’

প্রশ্নের উত্তরে আজকের মজার ঘটনাটা খুলে বললাম।

রিফাত শুনছে আর ওর চোয়াল দেখতে দেখতে বুক পর্যন্ত ঝুলে যাচ্ছে। পারলে সে এখনি চলে যায় সোলেমান ভাইয়ের এন্টিক শপে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ‘তাই বলে ফ্রিতে দিয়ে দিলো? একটা টাকাও রাখেনি? কিন্তু ঘুটিগুলো দেখে কিন্তু সত্যিই হাড়ের তৈরি বলে মনে হচ্ছে। সেটা মানুষের না কোন জানোয়ারের তা অবশ্য বলতে পারছি না। হাড়ের ওপর এধরনের কাজ করা হতো ইউরোপ আমেরিকায়। বিভিন্ন জন্তু জানোয়ারের হাড় দিয়ে। চীনে করা হতো তা জানতাম না। তাও আবার মানুষের হাড় দিয়ে! তোর ভাগ্যটা খুব ভালো রে। আর শুধু তোর ভাগ্য বলছি কেন? দাবা তো আর তুই একলা খেলতে পারবি না; আগে দুজন লাগতো, এখন তিনজন লাগবে।

‘তুই তো বোর্ডে সব ঘুটি সাজাসনি। কালোটার কিছু ঘুটি এদিক ওদিক পড়ে আছে কেন? বাদ পড়েছে তো। আমি সাজিয়ে নিচ্ছি। তুই ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চা মানে আমাদের থার্ড প্লেয়ার হিমেলকে ডাক।’

আমার চোখ এবার দাবার বোর্ডের দিকে গেলো। আগে ভালোমতো খেয়াল করিনি। সত্যিই তো ষড়ভুজ বোর্ডের একপাশের ঘুটিগুলোর এই দশা কেন? তিন রাজ্যের একটি রাজ্য অর্থাৎ কালো রাজ্যের বেশ কয়েকটা ঘুটি এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে বোর্ডের ওপর। ভাগ্য ভালো নিচে পড়েনি। তাহলে আর খুঁজে পাওয়া যেতোনা। যা অগোছালো আমাদের রুম। প্রয়োজনের জিনিসই মাঝেমধ্যে খুঁজে পাই না। আর ছোট ছোট দাবার ঘুটি তো অনেক পরের কথা।

রিফাতকে দেখলাম মহানন্দে এলোমেলো হয়ে থাকা ঘুটিগুলো পাশে পেপারওয়েট দিয়ে চেপে রাখা ম্যানুয়াল দেখে সাজাচ্ছে। আমার বারবার মনে হচ্ছে আমি তো ঘুটিগুলো এলোমেলো করে রেখে যাইনি। তাহলে ওগুলো অমন এলোমেলো হলো কী করে? জানালাটা খোলা। সম্ভবত বাতাস ঢুকেই ঘুটিগুলোকে তছনছ করে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু পড়লে তো সব ঘুটিই পড়ার কথা। অবশ্য কালো ঘুটির অংশটা জানালার একদম কাছে ছিলো।

কফি মেকার থেকে মগে কফি ঢেলে সেটা রিফাতকে দিয়ে চেয়ার পেতে বসেছি। একদম টেবিল ঘেঁষে।

কফি খেতে খেতে ম্যানুয়ালের নিয়মগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো রিফাত।

আমি ভাবছি অন্য কথা। হিমেল কোথায় গেলো? এতক্ষণে তো ওর বাথরুম থেকে ফেরার কথা। বাথরুমের দিকে খোঁজ নিতে যাবো তখন দরজায় স্যান্ডেল দেখে অবাক হলাম। সেগুলো এখনো ভেজা। স্যান্ডেলজোড়া সদ্য বাথ্রুম থেকে ঘুরে এসেছে এবং বলাই বাহুল্য হিমেলের পায়ে পায়ে এসেছে।

ওর এক জোড়াই স্যান্ডেল। বাথরুম থেকে ভার্সিটি সবখানেই ওটা চলে। আর বাথরুমে স্যান্ডেল ছাড়া যাওয়া ওর জন্য অসম্ভব। কাজেই স্যান্ডেলের অবস্থান অনুযায়ী হিমেলের ঘরের মধ্যেই থাকার কথা। খালি পায়ে কোথায় বের হবে ও! কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। রিফাত আগের মতই মুগ্ধ চোখে দাবার সেটটা নেড়েচেড়ে দেখছে আর ম্যানুয়াল পড়ছে। ও বলেই ফেললো, ‘হিমেল হয়তো আশেপাশেই আছে। সময় হলেই আসবে। চল আমরা একদান দাবা খেলে নিই এইফাঁকে। আমার আর তর সইছে না।’

প্রস্তাবটা মন্দ নয়। এমনও হতে পারে হিমেল রুমেই কোথাও লুকিয়ে আছে। খেলা শুরু হতেই পেছন থেকে চিৎকার দিয়ে আমাদের চমকে দেবে যেকোন মুহূর্তে। ওর এই বদভ্যাসটা আছে। তাই শুরু করলাম খেলা। রিফাত সাদা ঘুটি নিয়েছে আর আমি লাল। কালো ঘুটিগুলোর চাল পালাক্রমে আমরাই দেবো। একবার রিফাত চাল দেবে একবার আমি। এইভাবে ম্যানুয়াল দেখে খেলা শুরু করতে যাবো তখন রিফাত বললো, ‘কফি মেকারে আরো এককাপের মত কফি আছে। ওটা ঝটপট গিয়ে নিয়ে আসি। তারপর খেলা শুরু।’

আমি মাথা কাঁত করে সম্মতি জানালাম।

আর ঠিক সেইমুহূর্তে আমার চোখ চলে গেলো দাবার বোর্ডের দিকে। একটা হাত আপনা আপনি চলে গেলো কালো ঘুটিগুলোর কাছে। যেগুলো বাতাসে পড়ে যায়নি সেই ঘুটিগুলোর স্ব স্ব অবস্থানে অনড় থাকার কারণ বুঝতে পারছি। সেগুলোর প্রত্যেকটির গোড়ায় শিকড়জাতীয় কিছু জন্মেছে যা ঘুটিগুলোকে বাতাসের ধাক্কায় পড়ে যেতে দেয়নি। আমার গাটা ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠছে। একটা ভয়ের চাদরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছি নিজের অজান্তেই। তাহলে কি সোলেমান ভাইয়ের কথাগুলোই সত্য? তা কী করে সম্ভব?

সোলেমান ভাই বলেছিলেন এই দাবার বোর্ডে তিনজনের কম খেলোয়াড় দাবা খেলতে বসলে দাবার দেবী কেইসা রুষ্ট হবেন। আর ঘুটিগুলোর নিচে শিকড় গজিয়ে আটকে যাবে ছকে। কালো ঘুটিগুলোর ক্ষেত্রে এখন যেটা হয়েছে। তার মানে আমার আর রিফাতের রুমে আসার আগে কেউ কালো ঘুটি দিয়ে চাল দেবার চেষ্টা করেছিলো। সেটা কে হবে তা ভাবতেই গায়ের রক্ত ঠান্ডা হয়ে গেলো। হিমেল!

সোলেমান ভাই আর কী যেন বলতে গিয়েও বলেননি।

কী সেই গোপন কথা? হিমেলের সাথে দেবী কেইসা ঠিক কী আচরণ করেছেন কে জানে।

মাথাটা বোর্ডের কাছাকাছি আনতেই চক্ষুস্থির হয়ে গেলো। বোর্ডের ঠিক মাঝখানে একটা কালো গর্ত দেখা যাচ্ছে। সেই গর্তের ভেতর থেকে ক্ষীণ অথচ তীক্ষ্ণ একটা শব্দ ভেসে আসছে। কেউ যেন গর্তটা থেকে ডাকছে আমায়। খুব পরিচিত একটা কণ্ঠস্বর কিন্তু আমি চিনেও চিনতে পারছি না। আমি নিশ্চই ভুল দেখছি। ভুল শুনছি। সব ভুল। সব ভ্রম। বিকেলের ঘুমটা ক্লিয়ার হয়নি। চশমাটা ঠিক করে নাকের ডগায় বসিয়ে আরো এগিয়ে গেলাম বোর্ডটার দিকে। আর ঠিক তখুনি ঘটলো বিপত্তি। একটা অদমনীয় আকর্ষণ আমাকে যেন টানতে লাগলো গর্তের ভেতরের দিকে। আমি সেই আকর্ষণ এড়াতে পারছি না। গর্তের উপস্থিতি আমার কাছে একবার মনে হচ্ছে হ্যালুসিনেশনের ফল আরেকবার মনে হচ্ছে বাস্তব। রিফাত টেবিলের উল্টোদিকে রাখা কফি মেকারের কাছে উবু হয়ে সেই কখন থেকে কফি ঢেলেই যাচ্ছে। আমার দিকে খেয়ালই করছে না। কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো সময় একদম থেমে গিয়েছে। রিফাতকে কিছু বলার জন্য মুখ খুললাম কিন্তু কোন আওয়াজ বেরুলো না। ওদিকে দাবার বোর্ডে সৃষ্ট গর্তের ভেতর থেকে আসা শব্দের তীক্ষ্ণতা বেড়েছে। কানে তালা লেগে যাচ্ছে, মাথা ভারী হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে সেই কালো গহ্বর। যেন আমাকে গ্রাস করার জন্য এগিয়ে আসছে। আমি তলিয়ে যাচ্ছি থ্রি হ্যান্ডেড চেসের বোর্ডে আঁকা ছকের গহীনে। শব্দটা রিফাতের কানে যায়নি তাহলে? গেলে ও পেছনে ফিরে তাকাতো। দেখতে পেতো বন্ধুর শোচনীয় অবস্থা।

হঠাৎ চারদিকে অন্ধকার নেমে এলো। আমি তলিয়ে যেতে লাগলাম সেই অন্ধকারে। শেষবারের মত রিফাতকে ডাকার চেষ্টা করলাম কিন্তু ও শুনলো না। ঠিক শুনলো না নাকি শুনতে দেওয়া হলো না তা জানি না।

যখন জ্ঞান হলো তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা শক্ত পাথুরে জায়গায়। চারদিকে তাকাতেই সব অপরিচিত মনে হতে লাগলো। কী হয়েছিলো মনে করার চেষ্টা করছি। এটা কোন জায়গা কে জানে। কোনমতে উঠে দাঁড়ালাম। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলাম একটা বিরাট পাকা করা একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। শুধু পাকা করা নয়। যেন দু রকমের টাইল বসানো রয়েছে মেঝেতে। সাদা আর লাল। নিখুঁত কারিগরি দক্ষতার ছাপ সর্বত্র। দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু এই জায়গায় কী হয় জানবো কী করে!

চারপাশে যতদূর চোখ যায় সবুজ গাছগাছালি দেখা যাচ্ছে। গাছেগাছে নতুন পাতার কচি সবুজ রঙ মন ভরিয়ে তুলছে। দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে বিদঘুটে রকমের কয়েকটা বড় ভবন দেখা গেলো। আমি সেদিকে এগুতে লাগলাম। মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে। একটা অসাধারণ ঘ্রাণ সেই হাওয়ায় মিশে আছে। শরীর মন ফুরফুরে হয়ে যাচ্ছে। মনেই হচ্ছে না যে কিছুকাল আগেও আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলাম শক্ত পাথরের ওপর।

কিন্তু আমি এখন কোথায়? আমার মেসের আশেপাশে এমন সুন্দর কোন জায়গা তো নেই। আমি কি তাহলে স্বপ্ন দেখছি? হয়তো। কিন্তু স্বপ্ন এতো বাস্তবের মতন হয়? এই যে মিষ্টি হাওয়া, বাতাসে সুঘ্রাণ এসব স্বপ্নের ভেতর এত ভালোভাবে অনুভব করা যাবে কীভাবে?

কোথাও একটা গোলমাল হচ্ছে। আমি কাঠেরপুতুলের মতন এগিয়ে চলেছি ভবনগুলোর দিকে। যত কদম এগিয়ে যাচ্ছি ততটাই সতেজ হচ্ছে মস্তিষ্ক। আর ধীরেধীরে মনে পড়ে যাচ্ছে ঠিক কী ঘটেছিলো আমার সাথে। হ্যাঁ! সব মনে পড়ে যাচ্ছে। মাথার ওপরে ঘন নীল আকাশে যেন কেউ লিখে দিচ্ছে আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। আমি বাধ্য ছাত্রের মতন পড়ে যাচ্ছি সব। ঘটনার সূত্রপাত আমার মেসের রুমে। আমি আর রিফাত থ্রি হ্যান্ডেড দাবা নিয়ে খেলতে বসেছিলাম। খেলা শুরুর আগে রিফাত কফি আনতে যায় আর আমি দাবার বোর্ডে দেখতে পাই ভয়ানক এক কালো গর্ত।

তারপর কী হয়েছিলো ঠিক মনে নেই। কিন্তু এটা বুঝতে পারছি যাই ঘটুক না কেন সেই ঘটনা আমাকে এই অপরিচিত জায়গায় এনে ফেলেছে।

এই জায়গা থেকেই আমাকে রুমে ফিরে যাওয়ার পথের ব্যপারে জানতে হবে। রিফাতের কী হয়েছে কে জানে! ও যখন কফি নিয়ে উল্টোদিকে ঘুরেছে তখন আমাকে দেখতে পায়নি। নিশ্চই খুব ভয় পেয়েছে তখন। একই ঘরে বসে ছিলাম দুজন। সেখান থেকে একজনের হুট করে গায়েব হয়ে যাওয়াটা ভয়ের তো বটেই। খুব করেও খুঁজেও আমাকে পাবে না রিফাত। মনে মনে ভাববে কোথায় গিয়েছি আমি। ঠিক এমনভাবেই আমি হিমেলকে খুঁজেছিলাম। আমার সব অগোছালো অবান্তর প্রশ্নের উত্তর সামনে পাওয়া যাবে বোধহয় কারণ হাঁটতে হাঁটতে টাইল করা মেঝে ছাড়িয়ে ভবনগুলোর কাছে চলে এসেছি। এসেই আমার একটা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। বুঝতে পারছি আমি কোথায় আছি। কিন্তু ভেবে উঠতে পারছি না যে এরকম ঘটনা ঘটাও সম্ভব! চোখের সামনে পরপর চারটে ভবন। দুই প্রান্তে দুটো দুর্গ দেখা যাচ্ছে। মাঝখানের ভবনদুটো ড্রাগনের আদলে গড়া। তাদের মুখের ভেতরে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রত্যেকটা ভবনের নিচেই প্রবেশপথ দেখা যাচ্ছে। ভেতরে লোকজন আছে নিশ্চই! এই ভবনগুলো আসলে আর কিছুই নয় দাবার ঘুটি মাত্র!

আমি আর কোথাও নেই, আছি সোলেমান ভাইয়ের এন্টিক শপ থেকে উপহার পাওয়া দাবার বোর্ডের ভেতরে। এই জগত দাবার জগত, দাবার ঘুটিদের জগত! এই সাম্রাজ্য দাবার সাম্রাজ্য।

লাল সাদা টাইলের যে মেঝে পেরিয়ে আমি এই ভবনগুলোর কাছাকাছি চলে এসেছি সেটা মূলত বোর্ডের ওপর আঁকা ছক। আমার সামনের সাদা রঙের ভবনরূপী ঘুটিগুলো এখন কোন কারণে বোর্ডের বাইরে অবস্থান করছে।

আমি অপেক্ষা করছি ভবন থেকে কেউ বের হয় কিনা সেটা দেখার জন্য। এসব অসম্ভব ব্যাপার দেখে আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছিলো। একজন সঙ্গী থাকলে তারসাথে কথা বলে মাথাটা হালকা করা যেতো। এসব ভাবছি কখন যেন একটা মোলায়েম হাত আমার কাধে এসে পড়েছে টের পাইনি। হাতটা কাধে মৃদু একটা ধাক্কা দিতেই পেছনে ঘুরে তাকালাম। ঘুরেই বিমোহিত হয়ে গেলাম। একজন অপরূপা সুন্দরী দাঁড়িয়ে আছে। তার রূপের বর্ণনা সঠিকভাবে দিতে পারবো না আমি। যারা রূপকথায় পরীদের চেহারার বর্ণনা দেন তারা পারবেন হয়তো। ভারী মায়াবী তার চেহারা। চোখে কাজল পরা। টানা টানা চোখে সেই কাজল দারুণ মানিয়েছে। প্রতিটা চোখের পলক পড়ছে ধীরগতিতে। যেন সময়ের গতি হঠাৎ ই মন্থর হয়ে গেছে।

মেয়েটার পরনে মিশমিশে কালো গাউন। মাথায় চকচকে একটা অনিন্দ্য সুন্দর মুকুট। মুকুটের ঠিক মাঝখানে একটা বড় স্বচ্ছ পাথর বসানো। সেই পাথরের দু দিকে একইরকম পাথর পর্যায়ক্রমে ছোট হতে হতে বৃত্তাকারে মাথার পেছনে গিয়ে ঠেকেছে। পাথরগুলো সম্ভবত হীরে।

মেয়েটাকে প্রথম দেখাতে মুখ থেকে একটা কথাই বের হবে। সেটা হলো, ‘রানী’! আমার দৃষ্টিতে ‘রূপের রানী’! মুগ্ধতার ঘোর কতক্ষণে কেটেছে জানি না। মেয়েটার কথায় চমক ভাঙলো। আলতো করে ঠোঁট ফাঁক করে মেয়েটা কিছু একটা বলে যাচ্ছে। কিন্তু আমি তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। এই দাবার রাজ্যে নিজস্ব ভাষা আছে মনে হয়। মেয়েটা সেই ভাষাতেই কথা বলছে। আমি তার অর্থ বুঝবো কী করে! আমি শুধু তার কথা বলার ভঙ্গী দেখতে লাগলাম। অনেকক্ষণ ধরে বিদঘুটে এক ভাষায় কথা বলে চলেছে, ‘রানী’! তার মুখভঙ্গি ক্ষণেক্ষণে পরিবর্তিত হচ্ছে। কখনো ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে, কখনো মিষ্টি হাসিতে ভরে যাচ্ছে। একদম অপরিচিত একটা ছেলের সাথে কী বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছে এই ‘রানী’? হয়তো জিজ্ঞেস করতে চাইছে আমি কে! কোথা থেকে এই দাবার রাজ্যে এলাম! অথবা অনধিকার প্রবেশের জন্য শাসাচ্ছে।

হঠাৎ পেছনের ভবনগুলো থেকে ভারী কোন বস্তু সরিয়ে নেয়ার মতন ঝনঝন শব্দ হলো। কেউ ভবনের প্রবেশপথের শিকল খুলে দিচ্ছে। সরসর শব্দে সরে যাচ্ছে ভারী লোহার শিকল। আমি অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছি ভবনের ভেতর থেকে কে বের হয় সেটা দেখার জন্য। একবারের জন্যেও মাথায় এটা আসেনি যে অমন ড্রাগনের মতন ভবন থেকে ভয়ানক কিছু বের হওয়া অসম্ভব নয়। এমনকি দুপাশের দুটো দুর্গ থেকে যারা বের হবে তারাই বা আমাকে কেমন চোখে দেখবে।

দরজা খুলতে কিছু সময় লাগলো। ধীরে ধীরে কপাট খুলে যাচ্ছে ড্রাগনের মতন দেখতে ভবনের প্রবেশদ্বারের। কিন্তু ওগুলো সম্পূর্ণরূপেখোলার আগেই হাতে একটা হ্যাঁচকা টান অনুভব করলাম। কারা বেরোচ্ছে দেখার সুযোগ হলো না। মুহূর্তেই অনুভব করলাম আমার ডান হাত ধরে আমি যেদিক থেকে এসেছিলাম ঠিক সেইদিকে প্রায় হাওয়ার বেগে ছুটে চলছে ‘রানী’! যেন দৌড়ে নয় উড়ে চলেছি আমরা। এই আকস্মিক ঘটনায় আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি। কী হলো হঠাৎ করে। আমাকে নিয়ে এভাবে পালানোর কী দরকার ছিলো! ঐ ভবনগুলো থেকে কি বিপদজনক কেউ বের হচ্ছে?

এই প্রশ্নের উত্তর কাউকে বলতে হলো না। নিজেই বুঝে গেলাম। বুঝেই ভিরমি খেতে হলো।কারণ পেছন থেকে একটা প্রকাণ্ড আগুনের গোলা ছুটে আসছে। আকাশে দুটো ধবধবে সাদা ড্রাগন উড়ছে। এই আগুনের গোলা উৎস তাদের মুখ। তারা আমাদের লক্ষ করে আগুনের গোলা ছুঁড়ছে আর প্রচণ্ড শব্দে চিৎকার করছে। আগুনের গোলা একটুর জন্য আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। তার তাপ পাচ্ছি। ড্রাগনের চিৎকারে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে।

আমরা ওদের কী ক্ষতি করেছি জানি না। অবশ্য এখানে তো আমি একা নই। হয়তো ওরা মেয়েটার ক্ষতি করতে চাইছে। ক্ষতি বলছি কেন? এতো সরাসরি হত্যার চেষ্টা। বেচারা আমি ফেঁসে গেছি এই বিপদে। অবশ্য মেয়েটার সামনে এগিয়ে যাওয়ার গতি দেখে মন কিছুটা সান্ত্বনা পাচ্ছি। ও বোর্ডের টাইলগুলো ধরে কখনো সোজাসুজি কখনো পাশাপাশি কখনো কোণাকুণিভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ড্রাগনগুলো আক্রমণ করছে দুই কোণা থেকে। তারা কোণাকুণিভাবে একজন আরেকজনকে টপকে এগিয়ে আসছে আমাদের পিছুপিছু। সোজাসুজি আসলে আমাদের নাগাল পেতো সহজে। ভয় পাচ্ছি কখন ওরা সোজাসুজি আক্রমণ করে বসে। কিন্তু সে লক্ষণ দেখা গেলো না। ওরা কেন সোজাসুজি আসছে না ব্যপারটা বুঝলাম খানিক বাদে। বুঝতে পেরে এই বিপদের মধ্যেও কিছুটা স্বস্তি পেলাম। ওরা মূলত বিশপের ঘুটি। চাইনিজ বলে ওদের ড্রাগনের আদলে তৈরি করা হয়েছিলো কিন্তু স্বভাব তো আর বদলায়নি। কাজেই দাবার নিয়ম অনুযায়ী ওরা সোজা আক্রমণ করতে পারবে না। কোণাকুণিভাবেই এগোতে হবে।

আর আমরা সোজাসুজি, কোণাকুণি, পাশাপাশি সব দিকেই যেতে পারবো। কারণ যে আমার হাত ধরে আছে সে রানী। দাবার বোর্ডের একমাত্র অংশগ্রহনকারী যার অবাধ বিচরণ পুরো বোর্ড জুড়ে। আর আমার যদি ভুল না হয় তবে এই রানী কালো ঘুটির রাজ্যের। ওর পরনের কালো গাউন দেখে আন্দাজ করছি। কালো ঘুটির রানীকে ওদের রাজ্যে অনুপ্রবেশ করতে দেখে আক্রমণ করেছে সাদা রাজ্যের ড্রাগনঘুটি। দাবা খেলায় এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ওরা কি নিজে থেকেই চালিত হচ্ছে না কেউ সত্যি সত্যি এই বোর্ডে দাবা খেলছে!

রানীর হাত ধরে পালানোর পর্ব শেষ হলো অচিরেই। ড্রাগনের ঘুটিগুলো বেশীদূর এগোতে পারলো না। কারণ আশেপাশে তাকিয়ে দেখি তলোয়ার হাতে কালো পোশাক পরিহিত পেয়াদারা একঘর একঘর করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদের রানীর ওপর হামলা হয়েছে। তাই ওরা পালটা আক্রমনের জন্য প্রস্তুত।

আমার বুঝতে বাকি রইলো না যে আমরা এখন কালো ঘুটির রাজ্যে চলে এসেছি।

রানী এখনো আমার হাত ছাড়েনি। বিপদ কেটে যাওয়ার পর থেকেই আবার শুরু হয়েছে তার অচেনা ভাষায় বকবক করা। ও কি শত্রুপক্ষকে গালাগাল করছে নাকি! আচ্ছা এদের কি শুধু রানী বলে ডাকতে হয় নাকি নিজস্ব নাম আছে।

আমাকে নামকরণ করতে দিলে ওর নাম রাখতাম ‘কথার রানী’ অথবা ‘কথা’! মনে মনে ঠিক করলাম যদি কথা বলার সুযোগ সুবিধা হয় তবে ওকে ‘কথা’ বলেই ডাকবো। কিন্তু সে সুযোগ আসবে বলে মনে হচ্ছে না।

এই কঠিন ভাষা আমি শিখবো কী করে! এই রাজ্যে আমি শুধু দর্শকের মত সব দেখে যাবো। প্রত্যেকটা ঘটনার কারণ পর্যবেক্ষণ করবো। প্রত্যেকটা ঘটনার পেছনে কোন না কোন কারণ থাকে। অপেক্ষা করবো আমার এই রাজ্যে উপস্থিতির সেই কারণ জানতে।

রানীর পিছুপিছু একটা কালো ভবনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। ভেতর থেকে কপাট খোলার শব্দ আসছে। অল্প সময়ের মধ্যেই কপাট খুলে গেলো কিন্তু কে বা কারা খুললো তা বোঝা গেলো না।

আমি মনোযোগ দিয়ে কালো ভবনটা নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। একটা মুকুটে পরিহিত মানুষ ডানহাতে তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভবনটা সেই আদলেই গড়া। অর্থাৎ এটা কালো রাজ্যের রাজার ভবন। রাজমহল বললেই নিষেধ করছে কে! প্রবেশদ্বার খুলে যাওয়ার কিছু সময় পর ভেতরে প্রবেশ করলাম আমরা। রানী এরমধ্যে আমার হাত ছেড়ে দিয়েছে। অন্দরমহলে ঢুকে নির্বাক হয়ে যেতে হলো। দারুণ কারুকার্যময় ভেতরটা। মেঝেতে একটা মখমলের লাল গালিচা পাতা। সেই গালিচা সোজাসুজি চলে গিয়েছে সামনের দিকে। সেটা গিয়ে ঠেকেছে তিন ধাপের সিঁড়িতে। সিঁড়ির ওপর সমতল জায়গা। সেখানে একটা সিংহাসন বসানো। রাজা পায়ের ওপর পা তুলে রাজকীয় ভঙ্গীতে বসে আছেন সিংহাসনে। দূর থেকে তার চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। এই পুরো মহলে অন্য কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। অন্য কারো জন্য কোন আসনের ব্যবস্থাও নেই। এই রাজমহলে সভাসদ থাকার নিয়ম নেই বোধহয়। আমরা আরো একটু এগিয়ে গেলাম। রানী ঝুঁকে কুর্নিশ করলেন রাজাকে। তার দেখাদেখি আমিও কুর্নিশ করলাম। রানী এখনো সোজা হয়ে দাঁড়াননি তাই আমিও দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে যেতে হলো। কেউ বলছে, ‘থাক তোকে আর কুর্নিশ করতে হবে না। উঠে দাঁড়া।’

আমি এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াতেই অবিশ্বাস্য একটা ঘটনা ঘটলো। রাজার সিংহাসনে যে বসে আছে সে আর কেউ নয়, আমারই বন্ধু হিমেল!

ও এখানে কীভাবে এসেছে তা আন্দাজ করতে পারছি। ঠিক আমার মতন অবস্থা হয়েছে ওর। কিন্তু এসেই এখানকার রাজা বনে গেছে কীভাবে?

সে যাই হোক। কাছের মানুষকে পেয়ে মনটা হালকা হয়ে গেছে। এখন আর আমি একা নই। আমাকে আর রানীর বিদঘুটে ভাষা শুনতে হবে না।

হিমেল সিংহাসন থেকে নেমে এলো। ও কিছু বলার আগেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, ‘তোর জন্য আমি কত দুশ্চিন্তা করেছি জানিস না। তোকে খুঁজে পেয়ে শান্তি লাগছে। এখন বল তুই এখানে এসেছিস কীভাবে? আমার মতন করে? বলে আমার এই জগতে প্রবেশের ঘটনাটা সংক্ষেপে জানালাম।’

হিমেল বললো, ‘তোর সাথে যেরকম ঘটনা ঘটেছে আমার সাথেও অনেকটা সেরকম ঘটনাই ঘটেছে। কিছুটা ভিন্নতা আছে। আমি বাথরুম থেকে রুমে ফিরে দেখি তুই নেই। টেবিলের ওপর রাখা দাবার বোর্ডে ঘুটিগুলো সাজানো দেখে মনের খেয়ালে এমনিতেই কালো ঘুটিগুলো সামনে পেছনে এগিয়ে দেখছিলাম। কিন্তু দু একবার ওরকম করার পরেই ঘুটি বোর্ডের সাথে আটকে গেলো। সামনেও আগানো যাচ্ছে না পেছানোও যাচ্ছে না। আঠা দিয়ে বোর্ডের সাথে লাগিয়ে দিলে যেরকম অবস্থা হবে ঠিক সেইরকম অবস্থা হয়েছে। ঠিকমতন খেয়াল করে দেখি ওগুলোর তলা দিয়ে শিকড় বেরিয়ে বোর্ডে গেঁথে গেছে। আমি তো ভড়কে গিয়ে পিছিয়ে এলাম। কিন্তু লাভ হলো না। সেই একই শিকড় বোর্ড থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে আঁকড়ে ধরলো। নিয়ে এলো এই রাজ্যে।’

‘হুম। বুঝলাম! কিন্তু তুই এই কালো রাজ্যের রাজা হলি কীভাবে?’ দ্বিতীয় দফায় প্রশ্ন করলাম আমি।

‘সেটাও অদ্ভুত এক ঘটনা। আমি যখন নিজেকে আবিষ্কার করেছি এই রাজ্যে তখন তুমুল যুদ্ধ চলছে সাদা রাজ্যের সাথে। তুই বোধহয় জানিস না যুদ্ধ শুরু হবার আগে বোর্ডের মাঝখানে একটা বড় প্রাচীন চৈনিক মুদ্রা দেখা যায়। কিন্তু এ মুদ্রা বৃত্তাকার নয় ত্রিভূজাকৃতির।

ত্রিভূজের তিনটে কোণায় তিন রাজ্যের চিহ্ন অঙ্কিত আছে। সময় হলেই সাদা লাল আর কালো রাজ্যের ঘোড়াদের পাঠানো হয় হয় সেই মুদ্রা কে উপরের দিকে ছুড়ে দেয়ার জন্য। ওরা ডানায় ভর করে ধাক্কা দিয়ে মুদ্রাটিকে ওপরে ছুড়ে দেয়ার পর সেটা ওলটপালট হতে হতে নিচে এসে পড়ে। যদি বোর্ডে অবস্থিত রাজ্যের দিকে মুদ্রায় অঙ্কিত রাজ্যের কোনা মিলে যায় তবেই সেই রাজ্যের ঘুটি প্রথম চাল দেয়া বা আক্রমণ করার সুযোগ পায়। গত কয়েকটা যুদ্ধে শুধু সাদারাই মুদ্রা টস করে জিতে এসেছে। ফলে প্রথম আক্রমনের সুযোগ পেয়ে আমাদের আর লাল ঘুঁটির রাজ্যের অনেক ক্ষতি করে ফেলেছে। অনেকের ধারণা ওরা মন্ত্রবলে মুদ্রার দিক পরিবর্তন করতে পারে। তাই ইচ্ছা করেই প্রথম আক্রমনের সুযোগ নেয়।

‘শুনেছি ইদানীং সাদা ঘুটির রাজ্যে কালোজাদুর প্রভাব ভালোভাবেই বিস্তার লাভ করেছে। আমি যেদিন রাজ্যে আসি ঠিক সেইদিনই সাদা রাজ্যের নির্মম আক্রমনে কালো রাজা মারা যান। পেয়াদারা দিশেহারা হয়ে যায়। রানী হয়ে যান বিমর্ষ। এই যুদ্ধে রাজার ভূমিকায় কাকে বসাবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। ইচ্ছে করলেই পেয়াদাকে তো আর রাজা করে দিতে পারেন না। অথচ যুদ্ধে একজন সেনাপতি চাই।

‘ঘোড়া বা ড্রাগন অবলা জীব। বাকি থাকলো দুর্গের সেনা। দুর্গসেনাদের কাউকেই রাজ্যের ভার দেয়া যাবে না। তাই শেষে যুদ্ধক্ষেত্রে আমাকে পড়ে থাকতে দেখে রানী তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেন এই বহিরাগতকেই রাজা বানাবেন। সেই থেকে আমি এই কালো রাজ্যের রাজা। ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতন। সেদিনের সেই সংকটময় পরিস্থিতিতে আমি একা কীভাবে রাজ্যকে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করেছি সেটা শুধু আমি জানি।

‘প্রতিবেশী লাল ঘুটির রাজ্য আমাদের একমাত্র বন্ধুরাজ্য। ওরাও সাদা রাজ্যের আক্রমনের শিকার হয় বারবার। ভুল নিয়ম, ভুল চালে ওদের ঘুটিগুলোকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে সাদা দল। একমাত্র শত্রুরাজ্য ঐ সাদা ঘুটির রাজ্য। কারণ ওরা সৎ খেলায় বিশ্বাসী না। আমরা বা লাল রাজ্যের যদি ভুল চাল দিই তবে ঘুটিগুলো শিকড় গজিয়ে আটকে যাবে বোর্ডে। কিন্তু একমাত্র কালোজাদুর বলে ওদের ঘুটি প্রতি দানে যত ঘর ইচ্ছা এগোতে পারে। এই সুযোগ নিয়ে ওরা লাল ঘুটির রাজাকে মারাত্মকভাবে ঘায়েল করেছে। উনি এখন মৃত্যুশয্যায়।

‘আর শুনে অবাক হবি, আমাদের জগতে যেমন সাদা কালোয় বিভেদ করা হয়, কালোকে হেয় করা হয় গায়ের চামড়া দেখে মানুষের মূল্যায়ন হয় এই খেলনা রাজ্যে ঠিক তেমনটাই চলে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় জানিস।’

‘সবই বুঝলাম কিন্তু তুই তো আমার চাইতে একটু আগে এসেছিস। এরমধ্যে এতকিছু ঘটে গেলো?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।

হিমেল বললো, ‘এই দাবার রাজ্যে সময়ের হিসেবটা একটু অন্যরকম। পৃথিবীর সময়ের চাইতে তিনগুণ বেশী দ্রুত এখানকার সময়ের গতি। অর্থাৎ পৃথিবীতে যখন একটা দিন শেষ এখানে তখন তিনদিন কেটে যায়। কিন্তু তুই ভুল করে শত্রুরাজ্যে চলে যাওয়ায় সময়ের সাথে একটা বড় গোলমাল হয়ে গেছে। তাই আমি সম্পূর্ণ তিনদিন এগিয়ে আছি আর তোর মাত্র একদিন কেটেছে এ জগতে। তাও আবার পুরোটাই রানীর হাত ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে !’ বলে চোখ টিপলো হিমেল। ওর চোখে দুষ্টুমির হাসি।

ওর খোঁচার উত্তরে বললাম, ‘কিন্তু রানী তো তোর। তুই তো রাজা। আমার কোন সুযোগ নেই তো এখানে।’

‘আরে শোন এখানে রানী আমার ত্রাণকর্তা। যুদ্ধক্ষেত্রে আমার প্রাণ তো বাঁচিয়েছেন তার ওপর আবার রাজা বানিয়ে দিয়েছেন। আমি উনার প্রতি কৃতজ্ঞ। উনার ভালোবাসা আমার দরকার নেই। তবে তুই চাইলে তোর জন্য একটা ব্যবস্থা নিতে পারি।’ বলে হো হো করে হেসে উঠলো হিমেল।

আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘তোর রানী এই রাজ্যে ঢোকার আগ পর্যন্ত বকবক করে গেছে। আমি তো ওর নামই দিয়েছি ‘কথা’! যদিও ওর ভাষার কিছুই বুঝিনি। ধর আমি ওকে জানালাম যে আমি ওকে ভালোবাসি। তখন না ও আমার কথা বুঝবে না আমি ওরটা। কিছুতেই কিছু হবে না রে।’

রানী এতক্ষণ আমাদের কথাবার্তা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। অর্থ বুঝতে পারলে আমাদের দুই বন্ধুর খবর হয়ে যেতো। কিন্তু অর্থ বুঝতে না পারায় ভেবেছে জরুরি আলাপ হচ্ছে দুই বন্ধুর মধ্যে। তাই আমাদের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দিচ্ছে। হিমেল একদিনে ভাষা রপ্ত করে ফেলেছে এই দাবার রাজ্যের। তাই ও সবার কথা বোঝে, বলতেও পারে। ও বলেছে আজ রাতের মধ্যে আমাকে সব শিখিয়ে দেবে।

ইতিমধ্যে রানীকে জানানো শেষ যে আমি ওর বন্ধু। রানী চলে গেলো আমার থাকার ব্যবস্থা করতে। আর আমরা দুই বন্ধু মহল থেকে বেরিয়ে খোলা বোর্ডের বাইরে কিনারের দিকে একটা গাছের ছায়ায় আড্ডায় বসলাম।

ভিন্ন জগতের সময়ের গতি অতি রহস্যময় একটা বস্তু। এদিকওদিক হেরফের হতে হতে দুই বন্ধুর মধ্যকার পাঁচমিনিটের দূরত্বকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। তাই আড্ডা দিতে গিয়ে মনে হচ্ছে অনেকদিন কথা হয়নি হিমেলের সাথে। অথচ ও আমার চাইতে বড়জোর পাঁচ দশমিনিট আগে এই রাজ্যে পৌঁছেছে।

আমার বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দ্বিধা ছিলো। আড্ডার ফাঁকে সেগুলোর সমাধান দিলো হিমেল।

প্রথম দ্বিধা ঘুটি আর ঘুটির বাসিন্দাদের নিয়ে। যুদ্ধের সময় আসলে কারা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়তে যায়? ভবনের মতন দেখতে ঘুটিগুলো নিজেই না ওর ভেতরে বসবাস করা বাসিন্দা?

উত্তর এলো, ‘দুটোই। ভবনের মত ঘুটিগুলো বোর্ডের ছকে নিয়মানুযায়ী বসাতে হয়। চাল দেবার সময় হলে রাজার নির্দেশ অনুযায়ী সেগুলো আপনা আপনি সামনে এগিয়ে যায়। আর তখন শুরু হয় মূল যুদ্ধ। ঘুটির মতো দেখতে ভবনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে আসল ঘুটিগুলো।

‘মূলত ওরাই আসল ঘুটি। সহজ করে বলতে গেলে ভবনগুলো হচ্ছে একাধারে প্রত্যেকটা ঘুটির আশ্রয়স্থল এবং বাহন। এক রাজা আর রানীর ভবনেই একজন করে সদস্য বিদ্যমান। পেয়াদা, ঘোড়া ড্রাগন বা দূর্গে কতগুলো ঘুটি আছে তা বলে শেষ করা যাবে না।’

‘আর এদের ক্ষমতা?’

‘বলছি। সবার চালের ধরন স্বাভাবিক দাবার মতন হলেও কিছু বিশেষ ক্ষমতা আছে কয়েকটি ঘুটির। এদের মধ্যে ড্রাগন উড়তে পারে। মুখ দিয়ে আগুনের গোলা ছুড়তে পারে। ফলে শত্রুপক্ষের ঘুটি আগুনের জালে বন্দি হয় এক দানের জন্য। অর্থাৎ একবার ড্রাগনের আগুনের গোলা দিয়ে আঘাতপ্রাপ্ত হলে ঐ ঘুটি পরের চালে এগোতে পারবে না। পুড়ে গলে গিয়ে নিজের ছকেই আটকে থাকবে। জন্তুদের মতো দেখতে ঘুটির মধ্যে ঘোড়াও উড়তে পারে এবং গলা থেকে একধরনের তীক্ষ্ণ তরঙ্গ প্রয়োগ করে শত্রুপক্ষের ঘুটিকে একঘর করে পিছিয়ে দিতে পারে।

‘বাকি ঘুটিগুলোর মধ্যে দূর্গের ক্ষমতা একটু অন্যরকম। শত্রুপক্ষের ঘুটিকে অপহরণ করে নিজের দুর্গে বন্দী বানিয়ে রাখার নিয়ম রয়েছে। ধরা যাক শত্রুপক্ষের কোন ঘুটি আমার দূর্গের ঘুটির একদম কাছে চলে এসেছে। তখন দূর্গসেনারা গিয়ে সেই ঘুটিকে বন্দী বানিয়ে নিতে পারবে। কিছুক্ষণ দুর্গে বন্দী হয়ে থাকলে ঘুটিগুলো আমাদের আধিপত্য স্বীকার করে নিয়ে আমাদের দলে যোগ দেবে।

‘শুধু পেয়াদা বাদে সব ঘুটিতেই অদ্ভুত সব ক্ষমতা রয়েছে। সাধারণ পেয়াদা সারাজীবন সাধারণই থেকে যাবে। সেই ঘুটিভবন থেকে বের হওয়া। একঘর করে এগোনো আর কোণাকুণিভাবে আক্রমণ। অনেক বেশী বকে ফেলেছি না? আর কিছু জানতে চাস?’

‘ হুম। আমরা মেসে ফিরবো কবে? আর কীভাবে? ওদিকে নিশ্চয়ই আমাদের নিয়ে হইচই শুরু হয়ে গেছে?’

‘না হয়নি। সবেমাত্র একদিন কেটেছে। রিফাত তোকে রুম থেকে গায়েব হয়ে যেতে দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। বাইরে কাউকে বলার সুযোগ পায়নি। আমি পেয়াদা পাঠিয়ে সব খোঁজ নিয়েছি। আমার এ রাজ্যে কাজ শেষ। রানীকে বলবো নতুন করে কাউকে রাজা করে দিতে। তারপর তোকে নিয়ে ফিরে যাবো রুমে। কীভাবে যাবো সেটা রানীর কাছে জেনে নিতে হবে।’

এরপর আরো নানা বিষয় নিয়ে কথা হলো। একটা সম্পূর্ণ নতুন জগতে এরকম রোমাঞ্চকর সফর কয়জনের ভাগ্যে জোটে। কথায় কথায় জানতে পারলাম ঘুটিগুলোর জন্ম এবং মৃত্যু আছে। কিন্তু ক্ষুধা তৃষ্ণা কিছু নেই। এমনকী এ রাজ্যে আসার পর থেকে হিমেলের ক্ষুধা তৃষ্ণা পর্যন্ত মিটে গেছে। খেয়াল করে দেখলাম আমি নিজেও এই রাজ্যে কয়েক ঘন্টা কাটিয়েও দুর্বল অনুভব করছি না।

হিমেল না থাকলে এই নতুন এবং অস্বস্তিকর পরিবেশে আমি এমনি দম বন্ধ হয়ে মারা পড়তাম। প্রথমদিকে রানীর কথা শুনে যা অস্বস্তি বোধ করেছিলাম। ভেবেছিলাম যতক্ষণ এখানে থাকবো ততক্ষণ সেই অদ্ভুত ভাষা শুনে যেতে হবে। যার অর্থ বের করা আমার জন্য অসম্ভব।

হিমেল ইতিমধ্যে আমাকে ভাষাজ্ঞান দেওয়া শুরু করেছে। খুব সহজ নয় সে ভাষা অথচ হিমেল দক্ষ শিক্ষকের মতন ভাষা শিখিয়ে দিতে লাগলো। যখন সন্ধ্যা নেমে এলো তখন কাজে লাগার মতন দু-একটা শব্দ বলতে শিখে গেছি। আজ রাতের মধ্যেই আসা করি নিতান্ত প্রয়োজনীয় বাক্যগুলো বলতে পারবো। রানীর প্রেমে পড়ে গেছি প্রথম দেখাতেই। পরিস্থিতি কেমন হবে জানি না। এই জড়বস্তুর মতন ঘুটিগুলোর মধ্যে কতটুকু আবেগ আছে তাও জানা নেই। আর আমিই বা হঠাৎ করে কেন রানীকে প্রেম নিবেদন করে বসবো? তবুও বোকার মতন কোন বাক্য উচ্চারণ করলে রানী আমার মনের কথা বুঝবে সেটা শিখে নিলাম। যদি কাজে লাগে। আমি যে রানীর নাম দিয়েছি ‘কথা’! অন্তত এ কথাটা তো জানাতে পারবো। তাই অনেক।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হচ্ছে। আড্ডা জমে ওঠায় বোঝা যাচ্ছে না। কোনরকম ক্লান্তি বোধ করছি না। এর কারণ একটাই। এই রাজ্যের আরেকটি উদ্ভট নিয়ম। এ সাম্রাজ্যে যেমন ক্ষুধা তৃষ্ণা নেই, তেমনি নেই ঘুম। এখানে অবস্থানরত কাউকেই ঘুম স্পর্শ করতে পারে না। নিদ্রার জগত এদের কাছে অপরিচিত। কাজেই দিনের পর দিন আড্ডা দিলেও বিশ্রামের প্রয়োজন হবে না।

সমস্ত রাজ্যের ঘুটিগুলো ঘুটিভবনে গিয়ে পরবর্তী যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করে। একটা নির্দিষ্ট চক্রে বাঁধা পড়ে আছে প্রত্যেকটা ঘুটির জীবন। এই চক্র থেকে এরা কোনদিন বের হতে পারবে না। এই রাজ্যে শুধুমাত্র দুজন রক্তমাংসে গড়া মানুষ রয়েছে। আমি আর হিমেল। রানী মানুষের মত দেখতে। পেয়াদা বা দূর্গসেনারাও তাই। কিন্তু প্রকৃত মানুষ নয় এরা। মিং রাজাদের নির্মমতার শিকার সেনাপতিদের হাড় থেকে তৈরিকৃত ঘুটিমাত্র। তবুও কত ব্যস্ততায় কাটে ওদের জীবন। আচ্ছা ওরা কি জানে ওদের এই দাবার সাম্রাজ্যের বাইরেও একটা দুনিয়া আছে। যেখানে সাধারণ মানুষজন ঘুরে বেড়ায়। ওদের সাম্রাজ্য তাদের কাছে নিছক খেলার সামগ্রী! মানুষের রাজ্যে ক্ষুধা তৃষ্ণা ঘুম সবই আছে। তারা হাসে, কাঁদে, গান গায়। শুধু যুদ্ধ নিয়েই পড়ে থাকে না। আসলে কি তাই! যুদ্ধ তো হয়। মানুষ মরে লাখে লাখে। এই একটা দিক থেকে সত্যিই মিল আছে এই সাম্রাজ্যের।

একটা প্রশ্ন সেই কখন থেকেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। হিমেলকে অনেক বিরক্ত করেছি।

তাই জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছি না। হিমেল আর আমাকে এই রাজ্যের বাসিন্দারা বিশেষ করে রানী কথা কোন চোখে দেখছে? তাদের মতো ঘুটি হিসেবে না মানুষ হিসেবে! ওদের সাথে কি হরহামেশাই এমন হয়? বাইরে থেকে এসব নানা চিন্তায় মগ্ন হয়ে ছিলাম, তখন পেছন থেকে কুচকাওয়াজ এর আওয়াজ পাওয়া গেলো। একদল অস্ত্রসজ্জিত পেয়াদা পেছনে এসে কুর্নিশ করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পরনের পোশাকে লাল রঙের বাহার দেখে বোঝা গেলো এরা কালো রাজ্যের না লাল ঘুটির রাজ্যের পেয়াদা। কিন্তু এরা এখানে কী করছে!

হিমেল উঠে দাঁড়িয়েছে। পেয়াদাদের দিকে তাকিয়ে স্থানীয় ভাষায় জিজ্ঞেস করলো, ‘কী চাই?’

উত্তরের বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘আপনার জন্য দুঃসংবাদ আছে হে রাজাধিরাজ। আপনার বন্ধুরাজ্যের রাজা আমাদের প্রভু আর জীবিত নেই। কিছুক্ষণ আগে মারা গেছেন। কালকের যুদ্ধের জন্য আমরা প্রস্তুত নই। কে আমাদের নির্দেশনা দেবে? আমাদের রাজ্য খুব সংকটে আছে রাজাধিরাজ। সাদা রাজ্যে রাজার মৃত্যুর খবর চলে গেছে। ওরা সোৎসাহে কাল আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা খবর পেয়েছি আপনার সাথে এইমুহূর্তে একজন অতিথি রয়েছেন। তিনি কোথা থেকে এলেন কীভাবে এসেছেন সেটা আমাদের জানার দরকার নেই। তবে তাকে আমাদের চাই। আজ থেকে উনি আমাদের রাজা হবেন।’

এরা বলে কী? আমি হবো লাল রাজ্যের রাজা? পাগল হয়ে গেছে নাকি এরা। যদিও পাগল হওয়ার জন্যেও মাথার ভেতর মস্তিষ্ক থাকতে হয়। সেটা এই পেয়াদা ঘুটিগুলোর মাথায় আছে কিনা সন্দেহ। নইলে আমাকে রাজা হতে বলে! হ্যাঁ, আমি দাবা বুঝি। তাই বলে এত কঠিন খেলা খেলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া ব্যপারটা তো আর নিছক খেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটা জীবনমরনের খেলা। দুর্ধর্ষ, ভয়ানক যুদ্ধ।

হিমেল আমার মুখের দিকে তাকালো সম্মতি নেয়ার জন্য। আমি ডানেবামে মাথা নাড়িয়ে না করে দিলাম। কিন্তু হিমেল যখন হাতে ধরে অনুরোধ করে বসলো তখন রাজি হতে হলো। এখন আমি যদি লালের পক্ষ নিয়ে ওর সাথে না লড়ি তাহলে সাদা রাজ্য একলা রাজ্য কালো রাজ্যের ওপর আক্রমণ করে বসবে। ওদের দৃষ্টিতে রাজাহীন লাল রাজ্য তো নিষ্ক্রিয়। ওদিকে কালো রানী নাকি কথা দিয়েছে আর একটা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিলেই যেখান থেকে এসেছে সেখানে ফেরত পাঠানো হবে হিমেলকে। ওর সাথে নিশ্চয়ই আমিও ফিরে যেতে পারবো।

রানী লাল পেয়াদাদের দেখতে পেয়ে এদিকে ছুটে এসেছে। তাকে তাদের ভাষায় অভিবাদন জানালাম। বুঝলো মনে হয়। আমার ভাষা ঠিক আছে তাহলে।

তারপর হিমেল আর রানীকে সেইরাতের মত বিদায় জানিয়ে নিয়ম মেনে লাল পেয়াদাদের সাথে ওদের রাজ্যের দিকে চললাম।

এরা খুব ধীরগতিতে একঘর একঘর করে সামনে এগোয়। আমি অবশ্য যেকোন ঘরের ওপর দিয়ে হাঁটতে পারছি। কিন্তু ওদের গতির সাথে তাল মেলাতে গেলে পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে।

লাল রাজ্যে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগলো। সবচেয়ে অবাক হলাম যখন দেখলাম লাল রাজ্যে প্রবেশের সাথে সাথে রাতের অন্ধকার ধীরে ধীরে কেটে গিয়ে আলো ফুটে উঠছে। তার মানে এই গবেট পেয়াদার দল আমাকে সারারাত ধরে হাঁটিয়ে এনেছে। ভাগ্য ভালো যে এ রাজ্যে কোন ক্লান্তি নেই। থাকলে এতক্ষণে আমায় হাঁটু ভেঙে পড়ে থাকতে হতো।

ভোরের আলো ফুটে ওঠার সাথে সাথে লাল রাজ্যের ঘুটিভবনগুলোর অপরূপ রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। আমি অভিভূত হয়ে যাচ্ছি। বারবার মনে হচ্ছে ক্ষণিকের জন্য হলেও এই লালিমায় ভরা রাজ্য আমার। এখানকার সবাই আমার অধীন।

সেদিন সারাদিন মহলের সিংহাসনে বসে বসে যুদ্ধের নিয়মকানুন মনে মনে ঝালিয়ে নিলাম। রাজমহলে ঢোকার আগে প্রাক্তন রাজার লাশ দেখেছি। তার মুখ মলিন। রাজমহলের ঘুটিভবনের মাথার অংশটা রাজার মাথার আদলে তৈরি করা হয়েছে। রাজার মৃত্যুর পর মৃত রাজার মুখের আদলে গড়তে হয় তার রাজমহল বা ঘুটিভবনের বাইরের অংশ। এটাই এখানকার নিয়ম। জীবিত রাজাদের মুখের আদলে ঘুটিভবন গড়া নিষেধ।

রাজার লাশের সৎকারে আমিও ছিলাম। অদ্ভুত সে সৎকার পদ্ধতি।

রাজাকে প্রথমে শুইয়ে দেয়া হলো। তার দেহ জীর্ণ। তারপর পেয়াদারা সম্মানসূচক ভঙ্গীতে সবার তলোয়ার রাজার লাশের ওপর রেখে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে গেলো। তাদের ঘিরে দ্বিতীয় বৃত্তে দাঁড়ালো রানী আর দুর্গসেনারা। ঘোড়া আর ড্রাগনদুটো উড়ে চলে গেলো লাশ বরাবর আকাশের দিকে। ড্রাগন মুখ উঁচিয়ে আগুনের গোলা ছুঁড়ে সম্মান জানালো। ঘোড়া বিকট শব্দে চিঁহি করে উঠলো। তারপর রাজাকে ঘিরে রাখা অন্যান্য ঘুটিদের বলয় ধীরে ধীরে আলাদা হতে শুরু করলো। সবাই আলাদা হয়ে যেতেই বৃত্তের কেন্দ্রে পড়ে থাকা রাজার লাশ বালির মত ঝুরঝুরে হয়ে বোর্ডের ছকে মিশে যেতে লাগলো।

দাবার সাম্রাজ্যে দুঃখবোধের চাইতে দায়িত্ববোধকে বোধহয় বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। নইলে রাজার মৃত্যুতে আনুষঙ্গিক অনেক দায়িত্ব পালন করতে দেখলেও কাউকে শোকাহত হতে দেখলাম না। বিকেল থেকেই ওরা আগামীকালের যুদ্ধ নিয়ে প্রস্তুতি নিতে লাগলো। আমিও অপেক্ষায় থাকলাম আমার জীবনের প্রথম যুদ্ধের জন্য। ঘুমের কোন বালাই নেই তাই সারারাত সব ঘুটির সাথে বৈঠক চললো। চরম ব্যস্তাতায় নিজ রাজ্যের রানীর সাথে দেখা করার সুযোগ পেলাম না।

সকালে যথারীতি ত্রিভুজাকৃতির চৈনিক মুদ্রার উপস্থিতি দেখা গেলো বোর্ডের ঠিক মাঝখানে। তিন রাজ্যের ঘোড়ার ঘুটি সেটাকে ওপরের দিকে ছুঁড়ে দিলো। সবাই মনে মনে আশা করছে সাদা রাজ্য যেন আগে আক্রমণ করার সুযোগ না পায়। হলোও তাই। প্রথমবারের মত মুদ্রায় অঙ্কিত লাল রাজ্যের মুখ ঘুরে গেলো আমার লাল রাজ্যের দিকে। অর্থাৎ প্রথম আক্রমণ করার সুযোগ পাবে আমার ঘুটিগুলো।

আমি দেরি না করে একটা ঘোড়ার ঘুটিভবনকে সামনে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দিলাম। কথামতো পেয়াদাদের টপকে ঘোড়ার ঘুটিভবন আড়াই ঘর সামনে এগিয়ে গেলো। আর ভবনের দরজা খুলে শত শত ঘোড়া ডানা মেলে আকাশে উড়ে গিয়ে মুখ থেকে তীক্ষ্ণ শব্দতরঙ্গ ছুঁড়ে সাদা রাজ্যের পেয়াদার ঘুটিভবনগুলোকে প্রায় ধ্বসিয়ে দেয়ার মত অবস্থা করলো।

আমার দেখাদেখি কালো ঘুটির রাজ্যের রাজা হিমেল ওর ঘোড়ার ঘুটিভবন আড়াইঘর সামনে এগুনোর আদেশ দিলো। শত শত কালো ঘোড়া বেরিয়ে লাল ঘোড়াদের মতন একই ক্ষিপ্রতায় আক্রমণ করলো সাদা রাজ্যে। সামনে থাকা পেয়াদাদের একটা ঘুটিভবনের ছাদ উড়ে গেছে।

প্রথমবারের আক্রমণ এতটা ক্ষতি করতে পারবে তা আমার ধারণার বাইরে ছিলো। সাদা রাজ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। আর আমাদের মনে আত্মবিশ্বাস। কিন্তু সেই আত্মবিশ্বাস নিমেষেই উবে গেলো কর্পূরের মতন।

কারণ সাদা রাজ্য তাদের প্রথম চালটাই দিয়েছে নিয়মের তোয়াক্কা না করে। ওরা প্রথম পাঠিয়েছে ড্রাগনদের। পেয়াদাকে সামনে না পাঠিয়ে ড্রাগন সামনে পাঠানোর কোন উপায় নেই। সাদারা নিঃসন্দেহে কালোজাদুর সাহায্য নিচ্ছে। ঝাঁকে ঝাঁকে ড্রাগন এসে আগুনের গোলা ছুঁড়তে ছুঁড়তে আক্রমণ করে বসলো কালো আর লাল রাজ্যের ঘুটিভবনে। প্রচুর ক্ষতি হয়ে গেলো। অর্ধশতের মত পেয়াদা মরার সাথে সাথে ঘোড়ার ঘুটিভবনের নকশা বিগড়ে গেছে। চিন্তিত হয়ে পড়লাম। হিমেলের মুখটাও ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। পাশাপাশি দুটো রাজ্যে আসন্ন দুর্যোগের কালো ছায়া পড়েছে। কালো ছায়ার পেছনে কলকাঠি নাড়ছে কালোজাদুর বলে বলীয়ান ঠকবাজ সাদা রাজ্যের ঘুটিগুলো। যে করেই হোক ওদের আজ হারাবোই। মিথ্যে দম্ভ চুরমার করে দেবো। সেটা নিয়মের মধ্যে থেকেই। আমরা সংঘবদ্ধ দুটো দল একটা ধুর্ত দলের সাথে পারবো না?

মনোবল হারাইনি এখনো। ঘুটি চালাচালি হচ্ছে। আক্রমণ পালটা আক্রমণ চলছে। আমাদের দুই দলের তুলনামূলক বেশি ক্ষতি হয়েছে। তবে দুই বন্ধুর সুচিন্তিত আক্রমণের ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাশা উলটে গেলো। আমরা দুর্গের ঘুটিভবনকে এগিয়ে দিয়েছি ওদের আক্রমনের ফাঁকে। ওরা আক্রমনের নেশায় এতটা মত্ত হয়ে পড়েছিলো যে কখন আমাদের দুর্গ সেনারা ওদের বেশীরভাগ ঘুটিকে অপহরণ করে এনে আমাদের দলভুক্ত করে ফেলেছে ওরা টেরই পায়নি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের সব ঘুটিভবনেই ঘুটির ঘাটতি দেখা গেলো। নতুন ঘুটি তৈরি হতে কমপক্ষে একদিন লাগবে। এইমুহূর্তে ওদের কিছুই করার নেই। এবার আমাদের পালা। আমরা ঘোড়ার ঘুটিভবনকে এগিয়ে দিলাম আড়াই ঘর করে। দুই দলের চারটে ঘোড়ার ঘুটিভবন দুর্বার গতিতে আড়াই ঘর করে এগিয়ে গেলো আর সেগুলোর ভেতর থেকে অগণিত ঘোড়া উড়ে গিয়ে কানে তালা লাগিয়ে দেয়ার মতন তীক্ষ্ণ শব্দতরঙ্গ ছুঁড়ে আক্রমণাত্মক সাদা ঘুটিগুলোকে একঘর করে পিছিয়ে দিতে লাগলো। পালটা আক্রমণ হিসেবে হাজার হাজার পেয়াদা এসেছিলো। কিন্তু তার পরের চালেই আমাদের ড্রাগনের ছোড়া আগুনের গোলায় পুড়ে একদানের জন্য যার যার ঘরে আটকে গেলো। ওরা কী করবে ভেবে না পেয়ে দুর্গসেনাদের পাঠালো। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। আমাদের পেয়াদার ঘুটিভবন অনেক আগেই এগিয়ে ঢুকে পড়েছে ওদের রাজ্যে।

তারপর সেগুলো থেকে বেরুনো পেয়াদারা কোণাকুণি আক্রমণ করে ঘায়েল করতে লাগলো শত্রুপক্ষের ঘুটিগুলোকে। ওরা পরবর্তী চাল দিলো প্রায় না ভেবেই। আর এগোনোর আগেই সাদা রাজার রাজমহলে ঘিরে ফেলেছে আমাদের লাল আর কালো ঘুটিগুলো। আমাদের কৌশলের কাছে ওদের যাচ্ছেতাই চাল আর কালোজাদু দুটোই হার মেনেছে।

যাক! অবশেষে চেকমেট !

সাদা রাজাকে হত্যা করা বা বন্দী করার কোন ইচ্ছেই নেই আমাদের। শুধু ওকে সতর্ক করে দেয়া হলো যেন পরবর্তীতে যুদ্ধে নামলে সব নিয়ম মেনে চলে। এরপর আর কোন ছলচাতুরীকে প্রশ্রয় দেয়া হবে না। দুই রাজ্যের ক্ষিপ্ত পেয়াদারা সুযোগ পেলে ওকে হত্যা করতেও দ্বিধা করবে না সেটাও বলে দিলাম।

তারপর বীরবিক্রমে ফিরে এলাম আমার লাল রাজ্যে। হিমেল ওর রাজ্যে ফিরেছে। ঠিক হলো যার যার রাজ্যে বিজয় উদযাপন করে আমরা আমাদের জগতে ফিরে যাওয়ার ব্যপারে জানবো। অনেক তো হলো। এই রাজ্যে আর না।

অনেকদিন পর বিজয় লাভ করেছে দুটো রাজ্যই। খুশির জোয়ারে ভাসছে অর্ধেক দাবা সাম্রাজ্য। বাকি অর্ধেক অংশে নিশ্চই শোকের মাতম চলছে। অথবা প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ছে সবাই।

লাল কালো দলের জয়ের আনন্দে সামিল হয়েছে দু-দলের ঘুটিগুলো। এদের আনন্দ প্রকাশের ভঙ্গী মর্ত্যের মানুষদের মতই। কেউ গাইছে কেউ নাচছে। বহুদিন পর আকাঙ্ক্ষিত বিজয় পেলে যা হয়। আমি কিন্তু ভাবছি অন্য কথা। লাল রাজ্যের রানীর সাথে আমার কথা হয়েছিলো একফাঁকে। জিজ্ঞেস করেছিলাম আমরা আমাদের জগতে ফিরে যাবো কীভাবে? উনি কোন উত্তর না দিয়ে শুধু মুচকি হেসেছিলেন। কিন্তু সেই হাসিতে কোন প্রাণ ছিলো না। এই রানীর চেহারা কালো রাজ্যের রানীর মতই সুন্দর। অথচ কী নিষ্প্রাণ নির্জীব তার হাসি--- যে হাসি মনকে উৎফুল্ল না করে বিষাদগ্রস্ত করে দেয়। মনে হয় হাসির আড়ালে ভয়ানক কিছু লুকাচ্ছেন তিনি।

একটা অজানা আশঙ্কায় মনটা ভরে উঠলো। কোন উত্তর না দিয়ে হাসলেন কেন রানী?

হিমেলের সাথে বিকেলে দেখা হলো। ওকেও চিন্তিত দেখাচ্ছে। ওর রাজ্যের রানীও ওকে ফেরত পাঠানোর ব্যপারে কিছু জানায়নি। কোথাও একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা এই জগতে আটকা পড়ে যাবো না তো! এমন যদি হয় যে এই রাজ্যের ঘুটিগুলো আমাদের আর নিজেদের জগতে ফিরে যেতে দেবে না! অনেকদিন পর ওরা জয় পেয়েছে। দক্ষ হাতে রাজ্য সামলানোর মত রাজা পেয়েছে। যুদ্ধের কৌশল জানা সেনাপতি পেয়েছে। আমাদের ওরা ছাড়বে কেন?

ওদের তো দৈনন্দিন কাজই যুদ্ধ। আমরা চলে গেলে ওরা এত তাড়াতাড়ি দক্ষ রাজা পাবে কোথায়? রাজা ছাড়া তো কাল যুদ্ধে নামা যাবে না। দাবার সাম্রাজ্যের নিয়ম ভঙ্গ হবে।

কীসব অলক্ষুণে কথা ভাবছি আমি! এরকম সত্যি সত্যি ঘটে গেলে তো মহাবিপদ।

হিমেলকে এই সম্ভাবনার কথা জানালাম। ও আমার কথায় একমত হলো। রানীদের অস্বাভাবিক আচরণ দেখে ওর মনেও সন্দেহ দানা বেঁধেছে। কেমন যেন তাচ্ছিল্য ফুটে উঠছে রানীদের ব্যবহারে।

হিমেল প্রস্তাব দিলো, ‘আমাদের সুযোগ বুঝে আগে থেকেই এখান থেকে পালানোর পথ খুঁজে বের করতে হবে। ওরা যদি সত্যিই আমাদের আটকানোর চেষ্টা করে তাহলে যেন কিছু করে ওঠার আগেই পালাতে পারি।’

‘তাই হোক! সবাই এখন বিজয় উৎসব নিয়ে ব্যস্ত। এই তো সুযোগ।’

আমরা বেরিয়ে পড়লাম। মনে সন্দেহ ঢুকেছে। চারপাশের সবাই আর কিছু সময় আগেও বন্ধুর মত ছিলো কিন্তু এখন সবাইকে চরম শত্রু বলে মনে হচ্ছে। ক্ষণিকের ব্যবধানে কত বড় পরিবর্তন।

তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলাম রুমে ফেরার পদ্ধতি। হিমেল বলেছিলো রুমে পেয়াদা পাঠিয়ে রিফাতের খবর নিয়েছে। কিন্তু পেয়াদারা কোন পথে গিয়েছে সেটা তার জানা নেই। জানা থাকলে আমরাও সে পথেই ফিরে যেতাম আপন দুনিয়ায়। সন্দেহের ভারে ন্যুব্জ হয়ে গেছি। বুক ভারী হয়ে গেছে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। যদিও নিশ্চিত নই তবুও শুধু মনে হচ্ছে একটা অজানা অচেনা জায়গায় সারাজীবন বন্দী হয়ে থাকতে হবে পুতুলরাজার মতন। একঘেয়ে যুদ্ধ করে কাটিয়ে দিতে হবে বাকিজীবন। ক্ষুধা তৃষ্ণা ঘুমের মতন প্রয়োজনীয় অনুভূতিগুলোকে আর ফিরে পাবো না কোনদিন। পৃথিবীর আত্মীয়রা কোনদিন জানতেও পারবে না যে আমরা কোথায় হারিয়ে গেছি। আমাদের নিয়তি কী সেটা জানি না। তবে যেমনটা আশঙ্কা করছি তেমন হলে নিয়তি হবে নিষ্ঠুর।

প্রথমদিকে ভালো লাগা জগতটা এত দ্রুত ভয়ানক হয়ে উঠবে কেউ কি জানতো?

একটিবারের জন্যেও মনে হলো না যে আমরা যেসব নেতিবাচক দিক ভাবছি হয়তো সেসবের কোন ঘটনাই ঘটবে না। স্বয়ং রানী আমাদের নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছে দেবেন। বরং উলটো ভাবনাগুলোর মধ্যেই যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি। আমাদের ধারণাকে আরো পাকাপোক্ত দিলো রাজ্যের চারপাশে শক্ত পাথরের চাই বসিয়ে করা দেয়ালগুলো। কখন যে লাল কালো রাজ্যের চারদিকে নিরাপত্তার নামে অস্থায়ী সীমানা করে দেয়া হয়েছে বুঝিনি। সেটা কেবল নজরে এলো। আমাদের বন্দী করার প্রথম ধাপ এটা। সীমানার বাইরের অংশ থেকে সাদা রাজ্য অর্থাৎ শত্রুদের রাজ্য শুরু। আমরা নিশ্চই পালানোর জন্য ঐ রাজ্যে যাবো না। গেলে সেটা হবে সাক্ষাত মরণ। সাদা রাজা নিশ্চই ক্ষেপে আছে আমাদের ওপর। একলা পেলে তলোয়ারের এক কোপে শেষ করে দেবেন আমাদের।

এখন উপায়? রাজ্যের অস্থায়ী সীমানায় বিভিন্ন অংশে পাহারার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তার মানে আমাদের যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। সব জায়গায় পাহারা বসার আগেই। হিমেলের মাথায় হাত। আমিও কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো। বুদ্ধিটা আত্মঘাতী। কিন্তু কাজ হলে এই দাবার জগত থেকে মুক্তি পেলেও পেতে পারি। একটা বড় ঝুঁকি নিতে হবে। সবখানে পাহারা বসার আগেই রাজ্য থেকে বেরিয়ে সাদা রাজ্যের দিকে এগোতে হবে। সরাসরি গিয়ে ঢুকতে হবে রাজমহলে। রাজা নিশ্চই এখন একা রয়েছে।

আজ আমাদের দুই বন্ধুর দয়ায় সে বেঁচে গেছে। রাজ্যে আক্রমণ করলেও শেষে ওর প্রাণভিক্ষা দিয়েছি আমরা। আমাদের ওর প্রতি একটা অধিকার জন্মে গেছে। সেই অধিকারের জোরে এই সাম্রাজ্য থেকে পালানোর পদ্ধতি জানতে চাইবো রাজার কাছে। সে মানবে কিনা জানি না। কারণ মর্ত্যের আবেগ এই দুনিয়ায় তেমন একটা চলে না। হয়তো বোঝাবার সুযোগই দেবে না, তার আগেই পরাজিত হওয়ার প্রতিশোধ নিয়ে বসবে। তবু চেষ্টা করতে দোষ কী! হিমেল সম্মতি জানালো।

যেই ভাবা সেই কাজ। তবে আগে সবার মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে হবে। নইলে রাজ্যের বাইরে পা রাখা গেলেও দ্রুত ধরা পড়ে যেতে হবে।

হিমেল বললো, ‘একটা কাজ করতে হবে। দাঁড়া আমি আসছি।’ বলে এক দৌড়ে পেয়াদাদের ঘুটিভবনের দিকে চলে গেলো তারপর কিছু সময় যেতে না যেতেই হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো কাজ হয়েছে।

দেখলাম কোন কারণে হঠাৎ করেই পেয়াদাদের মধ্যে হইচই পড়ে গেছে। মারাত্মক শোরগোল শুরু হয়েছে। সবাই ড্রাগনের ঘুটিভবনের দিকে দৌড়চ্ছে। আমি এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। হিমেল বললো, ‘আগে পালাই এই রাজ্য থেকে পরে সব বলছি।’ বলে আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললো রাজ্যসীমার বাইরে যেখানে সাদা ঘুটিদের বসবাস।

পালাতে পালাতে কী হয়েছে শুনলাম। হিমেলের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। ও গিয়ে পেয়াদাদের মধ্যে গুজব ছড়িয়েছে যে ড্রাগনের ঘুটিভবনে আগুন লেগেছে। অসাবধান অবস্থায় ওদের মুখ থেকে ছোঁড়া আগুনের গোলা থেকেই এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। আর গাধা পেয়াদাগুলো সেটা বিশ্বাস করেই ড্রাগনদের আশ্রয়স্থলের দিকে ছুটেছে।

এই সুযোগটা নিয়ে আমরা প্রায় অর্ধেক রাস্তা চলে এসেছি। আর কিছুক্ষণ হাঁটলেই সাদা রাজমহলে পৌঁছাতে পারবো। এই অন্ধকারেও দূর থেকে রাজমহল দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণে আমাদের খোঁজ শুরু হয়ে গেছে সম্ভবত। রাজমহলে নিরাপদে পৌঁছাতে পারবো কিনা সন্দেহ। অবশ্য ওরা ভাবতেই পারবে না যে আমরা শত্রুরাজ্যের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে যাচ্ছি।

শেষপর্যন্ত বিনা বাধায় রাজমহলে পৌঁছানো গেলো। আমাদের ভাগ্য অত্যন্ত সুপ্রসন্ন। নইলে রাজমহলের দরজা অমন হাট করে খোলা অবস্থায় পেতাম না। আশেপাশে বেশ কয়েকবার তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে এক দৌড়ে ঢুকে পড়লাম মহলে। দেখলাম রাজা সিংহাসনে বসে ঝিমুচ্ছে। ভেতরে ঢুকে প্রবেশদ্বার শিকল তুলে আটকে দিলাম। শিকলের ঝনঝনানি শুনে রাজার তন্দ্রা ভাঙলো। ধড়মড় করে উঠে অবাক দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকালো সে। যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। ওর চেহারায় ভয়ের ছাপ ফুটে উঠছে। ও হয়তো ভেবেছে আমরা দিনেরবেলা মহত্ব দেখিয়ে ওকে ছেড়ে দিলেও রাতের বেলা সুযোগ পেয়ে ওকে খুন করতে এসেছি। এটা ভাবাই স্বাভাবিক। হাজার হলেও আমরা শত্রুদলের প্রধান।

রাজার হাল দেখে এই বিপদের মধ্যেও মনে মনে হাসি পেলো। কিন্তু সময় নষ্ট করার মতন সময় আমাদের হাতে নেই। তাই ঝটপট রাজাকে সব খুলে বললো হিমেল। সব শুনে সহজেই আশ্বস্ত হলো রাজা। বুঝেছে আমরা ওকে বিপদে ফেলতে আসিনি। বরং নিজেরা বিপদে পড়ে সাহায্য চাইতে এসেছি। তাছাড়া আমরা পালালে ওর যুদ্ধে জিততে সুবিধাই হবে। তাই দেরি না করে আমাদের এই দাবার সাম্রাজ্য থেকে পালানোর পথের হদিস দিতে লাগলো। কিন্তু সে পথ তো লাল আর কালো রাজ্য পার হয়ে যেতে হবে। সেপথে এতক্ষণে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার কথা।

কিন্তু সাদা রাজা বললো, ‘আপনাদের দুটো ঘোড়া দিয়ে দিচ্ছি। ওরা আপনাদের উড়িয়ে নিয়ে রাজ্যের ওপারে পৌঁছে দিয়ে আসবে। রাজ্যের কিনারে যে গাছপালা আছে সেটা পার করতে পারলেই আপনারা নিজেদের ভুবনে ফিরে যেতে পারবেন।’

রাজার কথায় অবাক হতে হলো। এত কাছে মুক্তির পথ ছিলো আর আমরা কিনা এতদূরে চলে এসেছি মুক্তির খোঁজে। সে যাই হোক যা করার দ্রুত করতে হবে।

তাই ঝটপট বিদায় নিলাম রাজার কাছে। তারপর ধন্যবাদ দিয়ে বাইরে চলে এলাম। রাজা এলো পিছে পিছে। সে নির্দেশ দিতেই ঘোড়ার ঘুটিভবন থেকে দুটো ঘোড়া উড়ে এসে আমাদের ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো। ঘোড়ায় চড়ার পর আমাদের খুব কাছাকাছি এসে শেষবেলায় একটা মারাত্মক সত্য প্রকাশ করলেন সাদা রাজা। বললেন, ‘আপনারা বোর্ডের বাইরে গিয়েই বোর্ডটা পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলবেন। নইলে যার কাছ থেকে কিনেছেন তাকে ফেরত দিয়ে দেবেন। যার কাছ থেকে বোর্ডটা পেয়েছিলেন তার দোকানের ছোট ছোট কর্মচারীরা আপনাদের মতই নিজের অজান্তে এই দাবার জগতে ঢুকে পড়েছিলো কিন্তু তাদের ফিরে যাওয়ার ভাগ্য হয়নি। এক এক করে যুদ্ধে মারা পড়েছে সবাই। আমি চাইবো আমাদের জগতের আর কোন দুর্ভাগা বহিরাগত যেন না আসে। ভালো থাকবেন। বিদায়।’

রাজার অত্যদ্ভুত কথা শুনে অনেকগুলো প্রশ্ন পাক খেয়ে দানা বেঁধে উঠছিলো মনের ভেতর। কিন্তু সময় নেই। সুযোগও হলো না। প্রশ্ন করার আগেই রাজা ইশারা দিলেন দুই উড়ুক্কু ঘোড়াকে। ওরা ইশারা পেতেই আমাদের নিয়ে উড়ে চললো গন্তব্যে।

আমার মনে সবচেয়ে বেশী যে প্রশ্নটা উঁকি দিচ্ছিলো সেটা হলো, ‘বোর্ডটা পুড়িয়ে ফেললে এই দাবার সাম্রাজ্যের কোন ক্ষতি হবে কিনা!’ কোনদিন এই প্রশ্নের উত্তর জানতে পারবো কিনা জানি না। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে এই রাজ্য থেকে বেরিয়ে যাওয়া।

ঘোড়াগুলোর গতি বেশ ভালো। এই গতি অব্যাহত থাকলে লাল কালো রাজ্যের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজ্যের ধারঘেঁষা গাছপালা পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব। কিন্তু উড়তে উড়তে রাজ্যের উপরে এসে পড়তেই ঘোড়াগুলোর মুখ থেকে বেশ জোরে একটা চিঁহি শব্দ বের হয়ে পড়লো। ঠিক নিচেই ড্রাগনের ঘুটিভবন ছিলো। ঘোড়ার শব্দ শুনে দরজার কাছে পাহারারত ড্রাগন ওপরের দিকে উঠে এলো আর শত্রুপক্ষের ঘোড়া দেখামাত্র আগুনের গোলা নিক্ষেপ করা শুরু করলো। ইতিমধ্যে নিচে হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেছে। সবাই বুঝতে পেরেছে অন্ধকার আকাশে কিছু একটা ঘটছে। বিশেষ করে পেয়াদারা ধরতে পেরেছে কী হয়েছে। তাই তারা একে একে ঘোড়া বা ড্রাগনের পিঠে চড়ে উপরে উঠে আসছে। ড্রাগনরা এরইমধ্যে আগুন ছুড়ে আমাদের ভূমিসাৎ করার চেষ্টায় লিপ্ত। এদিকে আমাদের ঘোড়া প্রায় গাছগুলোর কাছে চলে এসেছে। এখন লাফ দিয়ে গাছের ওপারে পৌঁছুতে পারলেই কেল্লা ফতে।

আমার ঘোড়া সামনে। হিমেলের ঘোড়া একটু পেছনে।

এই পেছনে থাকাটাই ওর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো। আমি ভেবেছিলাম ও আমার দেখাদেখি ঘোড়ার পিঠ থেকে গাছগুলোর ওপারে লাফ দেবে। কিন্তু ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিতে গিয়ে আমি যখন শূন্যে উঠে গেছি সেই সময় বিদ্যুতের ঝলকের মতন একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেলো। আমার দেহ গাছগুলোকে তখনো পার করেনি, বিস্ফারিত চোখে দেখলাম পেছন থেকে আক্রমণকারী ড্রাগনের আগুনের গোলা আঘাত হেনেছে হিমেলের ঘোড়ার পেছনে। সেই আঘাতের ফলে টাল সামলাতে না পেরে ঘোড়াসমেত নিচে পড়ে যাচ্ছে হিমেল। ও লাফ দেবার সুযোগটা পায়নি। আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে শেষবারের মত ডাকলাম, ‘হিমেএএল!’

ও আমার আওয়াজ শুনতে পেয়েছে কিনা জানি না।

নিজেকে যখন রুমে আবিষ্কার করলাম তখন মাথা ব্যাথায় কাতরাচ্ছি। চোখের সামনে বিছানা দেখে মনে হলো কতকাল ঘুমাইনি আমি। কখন যে ধপ করে বিছানার ওপর পড়ে গেছি বলতে পারবো না।

ঘুম ভাঙলো রিফাতের ডাকে।

‘শান্ত ওঠ! শান্ত। বেলা হয়ে এসেছে। আর কত ঘুমাবি?’

আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। বেশ ভালো ঘুম হয়েছে। মাথাটা ঝরঝরে হয়ে গেছে।

ধীরে ধীরে মনে পড়ে যাচ্ছে কাল রাতের ঘটনা। হিমেলের কথা মনে হতেই বুকটা হু হু করে উঠলো। ওর শেষপর্যন্ত কী হয়েছে জানি না। আমার ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। ঘুটিগুলো ওর সাথে কেমন আচরণ করেছে কে জানে। দাবার সাম্রাজ্যে বিস্বাসঘাতকতার শাস্তি কী সেটা ঘুটিগুলোই বলতে পারবে।

হিমেলকে ঐ ভয়ানক আবেগহীন দাবার রাজ্য থেকে কি উদ্ধার করতে পারবো কোনদিন? তাহলে তো আবার ফিরতে হবে দাবার সাম্রাজ্যে। সেটা কি আদৌ সম্ভব। সম্ভব হলে আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো। ফেরার পথ তো জানাই আছে।

বিছানা থেকে উঠে বসলাম। বসতেই চোখ চলে গেলো টেবিলের দিকে। সেদিকে চোখ যেতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হলো। সেখানে একটা দাবার বোর্ডের ওপর সামনাসামনি দুই সারি দাবার ঘুটি সাজানো রয়েছে। দুজন খেলার জন্য স্বাভাবিক একটা দাবার সেট। কিন্তু ঘুটিগুলো তো সোলেমান ভাইয়ের এন্টিক শপ থেকে কেনা চাইনিজ দাবা বোর্ডের ঘুটিগুলোর মতন।

তারমানে শুধু নিচের বোর্ডটা পরিবর্তন করা হয়েছে। সম্ভবত রিফাতের কাজ। ওকে বললাম, ‘আমার থ্রি হ্যান্ডেড চেসের নিচের বোর্ডটা কোথায় রেখেছিস? আর লাল রঙের ঘুটিগুলোই বা কোথায়? টেবিলে শুধু সাদা আর কালো ঘুটি কেন? এই নতুন বোর্ডটাই বা কার?’

রিফাত বিরক্ত হয়ে বললো, ‘কীসের কথা বলছিস। কাল কোথা থেকে যেন এই বোর্ডটা কিনে এনেছিলি। আমরা রাতে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়লাম মনে নেই? এরমধ্যে থ্রি হ্যান্ডেড চেস আর লাল ঘুটি এলো কোত্থেকে? কী আবোলতাবোল বকছিস?’

রিফাতের কথায় থ মেরে গেছি। কী বলছে ও?

‘তুই কি মজা করছিস আমার সাথে? আমি মোটেই মজা করার মতো অবস্থায় নেই। দেখ, হিমেলকে ফিরিয়ে আনতে হলে বোর্ডটার দরকার হবে। তাড়াতাড়ি বের কর ওটা!’ বললাম আমি।

রিফাত এবার রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলো। ঝাঁঝালো গলায় বললো, ‘সকাল সকাল আমার কম দায় পড়েনি যে তোর সাথে মজা করবো। প্রথমে লাল ঘুটি পরে থ্রি হ্যান্ডেড চেসের পর এখন আবার হিমেল নামের লোকটা এলো কোথা থেকে? আর কোথা থেকেই বা তাকে ফিরিয়ে আনতে চাইছিস?’

‘হিমেল কে চিনতে পারছিস না! আচ্ছা তুই কি পাগল হয়ে গেলি? হিমেল আমার রুমমেট! আমদের বন্ধু।’

‘পাগল আমি হইনি। তুই হয়েছিস। তোর রুমে তো দূরে থাক এই পুরো মেসে হিমেল বলে কেউ থাকে না। আমাদের বন্ধুমহলেও হিমেল নামে কেউ নেই। তোর কী হয়েছে বলতো! বাজে স্বপ্ন দেখেছিস?’

রিফাতের কথা শুনে আমি সত্যি সত্যি পাগল বোধ করতে লাগলাম। মনে হতে লাগলো সত্যিই সবকিছু দুঃস্বপ্ন ছিলো বোধহয়। নইলে যা যা দেখেছি, অনুভব করেছি তা বাস্তবে ঘটা তো আসলেই অসম্ভব! কী অদ্ভুত ব্যাপার। একদম বাস্তবের মতন শিহরণ জাগানো স্বপ্ন। যেন সব সত্যি সত্যি ঘটেছে। ঘোরলাগা একটা পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। ঘোর কাটতে সময় লাগবে। তোয়ালেটা নিয়ে দ্রুত বাথরুমে চলে গেলাম। ফ্রেশ একটা গোসল দিলেই মাথার ভেতরের দুঃস্বপ্নের রেশ কেটে যাবে। গেলোও তাই। গোসল সেরে এসে টেবিলের পাশে বসলাম। রিফাত ওর রুমে ফিরে গেছে। দাবার সেটটা আগের মতোই টেবিলে সাজানো। ওদিকে তাকাতেই কেন জানি ঘুটিগুলো ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করতে লাগলো। ডান হাতটা কখন বোর্ডের দিকে চলে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি। হঠাৎ কালো ঘুটির রাজার দিকে চোখ পড়তেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো। সেটা হাতে তুলে মুখটার দিকে তাকাতেই চোখ কপালে উঠে গেলো। এই মুখটা হুবুহু আমার স্বপ্নে দেখা হিমেল নামক ছেলেটির মতন দেখতে। এর একটা ব্যাখ্যাই হতে পারে। নিমেষে আমার মস্তিষ্কে বিদ্যুতের ঝলকের মতন তড়িৎগতিতে সব পরিষ্কার হয়ে যেতে লাগলো। আমি ছিলাম লাল ঘুটির রাজা। আমি দাবার সাম্রাজ্য থেকে পালিয়ে আসায় রাজ্য থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে সব লাল ঘুটি অথবা সাদা রাজ্যের আক্রমনে ধ্বংস হয়ে গেছে ওগুলো।

কারণ রাজা না থাকলে যুদ্ধ হবে না। তাই গতরাতে টেবিলে রাখা থ্রি হ্যান্ডেড চেসের বোর্ড বদলে গিয়ে সাধারণ টু হ্যাণ্ডেড চেসের বোর্ডে পরিণত হয়েছে। কারণ দাবার সাম্রাজ্যে টিকে আছে শুধুমাত্র সাদা আর কালো রাজ্যের ঘুটিগুলো। পরিশেষে একটা অশুভ ঘটনার আশঙ্কা আমার হৃদকম্পন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। হৃদযন্ত্রের প্রতিটা স্পন্দন প্রবল বেগে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে আমাকে। সেই স্পন্দনে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছি আমি।

আমার যদি ভুল না হয় তবে একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে কালো ঘুটির রাজ্যের রাজা হিমেলের সাথে।

আগেই বলেছি রাজার ঘুটিভবনের আকৃতি তখনই রাজার মুখের আদলে তৈরী করা হয় যখন সেই রাজা আর জীবিত নেই। রাজার ঘুটিভবন শুধুমাত্র প্রাক্তন রাজার স্মৃতিচিহ্ন বহন করে।

আমি যদি সোলেমান ভাইয়ের কাছ থেকে ঐ প্রাচীন দাবার বোর্ডটা না নিতাম তাহলে হয়ত আজ হিমেল এভাবে হারিয়ে যেতো না। ও শুরু থেকেই বোর্ডটা নিয়ে আশঙ্কা করেছিলো। ওর কথা শুনলে হয়তো এতসব ঘটনা ঘটতো না। কিন্তু সবই নিয়তির খেলা।

সাদা রাজা মর্ত্যে ফিরে আসবার পর আমাকে দাবার বোর্ডটা পুড়িয়ে ফেলতে অথবা সোলেমান ভাইয়ের কাছে ফেরত দিতে বলেছিলো। কিন্তু দুটোর কোনটাই আমি করবো না। কারণ এখনো আমার মনের গহীনে কোন এক কোণায় বিশ্বাসের দীপশিখা জ্বলছে। হয়তো আমার জীবদ্দশায় অথবা আমার মৃত্যুর পর কোন একদিন দাবার জগত ছেড়ে হিমেল পুনর্জীবিত হয়ে ফিরে আসবে এই চেনা পৃথিবীতে। দাবার সাম্রাজ্যে মৃত হিমেলকে তখন নতুন করে চিনতে পারবে মানুষেরা। আচ্ছা নতুন জীবন নিয়ে ফেরার পর হিমেল কি আমায় চিনতে পারবে? সেটা নাহয় ফিরে আসার পর ওর কাছেই জেনে নেবো।