যোহন - অনিন্দ্য রাউত

ভৌতিক গল্প

অলংকরণ - প্রতিম দাস

ধুপ করে একটা আওয়াজ হলো। যোহন পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে পাঁচ নম্বরের নিভিয়ার বলটা লাল রঙের মেঝেতে পড়ে ড্রপ খেতে খেতে ওর পায়ের সামনে চলে এসেছে। হঠাৎ করেই চোখের সামনে সিনেমার রিল চলতে লাগলো। কোনো ছবি স্পষ্ট না হলেও ও ঠিক বুঝতে পারলো ওর মস্তিষ্কের কোষগুলো ওকে কোন ঘটনা মনে করিয়ে দিতে চাইছে। মাথাটা ধরে বসে পড়ে ও। এখন এই একভাবে দপদপ করতে থাকবে। কিছু বছর থেকে প্রায়ই হয় এটা। মাথার মধ্যে কে যেন কিছু বলতে থাকে ওকে। ইনার ভয়েস?

“মা, একটা কড়া লিকার চা,” বলে যোহন হাঁক দেয়। এক পা দিয়ে বলটা তুলে দুই পায়ের পাতার মাঝখানে রাখে। বাইরে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। ঘরের উত্তর দিকের জানালা থেকে সামনের পুকুর, পুকুর পেরিয়ে সরু মাটির রাস্তা আর ঐ রাস্তা পেরিয়ে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ দেখা যায়। এটা আমন ধানের সময়, গাছগুলো সবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, তাই সবুজের গাঢ় আভায় মাঠ ছেয়ে আছে। এইসময় বৃষ্টি হওয়া দরকার, বৃষ্টি হলে ধানগাছগুলো প্রাণ পেয়ে নিজের মতো বাড়তে থাকবে। যোহন তাকিয়ে থাকে, ওর দৃষ্টি কতদূর গিয়ে পৌঁছেছে ও জানে না, ঠিক একটা জিনিসের ওপর আবদ্ধ নেই যেন। পুকুরের ধারে দাদার লাগানো শিউলি গাছ না পুকুর না সবুজ মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে ও? ও আদৌ কিছু দেখছে কিনা বোঝা যায় না, হয়তো ছেড়ে যাওয়া স্মৃতির পাতাগুলো টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে ওর ভেতরে। যোহনের ভেজা চোখ দেখে অন্তত তাই মনে হয়।

***

“তুই কি উঠবি?”

“দাদা, আর কিছুক্ষণ, দাঁড়া না। এখনো তো সূর্যই ওঠেনি।”

“তুই কিন্তু কাল বলেছিলি।”

“হ্যাঁ দাদা, যাবো দাঁড়া।”

যোহন উঠতে পারে না। হাত পা ছড়িয়ে, মুখ সামান্য কুঁচকে থাকা যোহনকে দেখে রোহন হেসে ফেলে। রোহন জানে, সময় আছে এখনো, যোহন একদিন নিজেই সেই তাগিদ অনুভব করবে। ও আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়ে ফুটবলটা নিয়ে। মাঠে হয়তো কেউই আসেনি। এখনো ভোরের আলোই ফুটে বেরোয়নি। কিন্তু ও ওয়ার্ম আপ করে নিতে চায় সবাই আসার আগে। ওদের মাঠটায় পাঁচবার পাক দিলেই শরীরটা ঝরঝরে হয়ে যায়। সামনে 'নিমাই দে স্মৃতি ফুটবল প্রতিযোগিতা’। নিমাই দে ওদের মফস্বলের গর্ব। ওরকম দুর্দান্ত স্টপার খুব কম দেখা গিয়েছে সারা বাংলায়। কলকাতায় গিয়ে পোর্ট ট্রাস্টে খেলেছেন, খেলেছেন সন্তোষ ট্রফিতেও। গতবছর বার্ধক্যজনিত কারণে প্রয়াত হন। তাই তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে মফস্বলের সভ্যরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই প্রতিযোগিতার। জিতলে ভালো পুরস্কারও আছে। রোহনদের টিমে সবাই মোটামুটি খেললেও কোথাও যেন সেই এক্স ফ্যাক্টরটা নেই। একাই কেউ খেলা ঘুরিয়ে দেবে এরকম প্লেয়ারও কেউ নয়। তাই ওরা শেষ কিছুদিনে বেশ কিছু ছেলের ট্রায়াল নিয়েছে। যোহনকে বারবার বলা সত্ত্বেও আসেনি। ওর সামনে বাড়ির উঠোনে এত ঝলক দেখায় কিন্তু মাঠে আসতে বললেই অলসতা। কিছু বললে বলে, 'এত কষ্ট করে কেন একটা বলের পেছনে দৌড়তে যাবো? শুধু ব্যাট ঘোরাবো আর ছয়।' রোহন জানে যেকোনো খেলাই যোহন ওর থেকে ভালো খেলে, কিন্তু একাগ্রতা, অনুশীলনের অভাব যোহনের মধ্যে। ওর বারবার বলাতেও কিছু পাল্টাবে না, যদি না একদিন নিজেই যোহন বুঝতে পারে।

“এত ভোরবেলায় বেরিয়ে যাবি? কিছু খাবি না? ফিরবি তো সেই দুপুরে।”

“না মা, এখন আর কিছু খাবো না। মাঝে ব্রেকের সময় ঐ বেরিয়ে মঙ্গলদার থেকে পরোটা খেয়ে নেব।”

“এত কেন খাটছিস যোহন? কীসের জন্য? কলকাতার ক্লাব থেকে প্রতিবার ছুটি নিয়ে এসে উদয়াস্ত খেটে যাস, কিছুই তো হয় না। তোকে যদি ওখানকার ক্লাব থেকে তাড়িয়ে দেয়, দেখিস কিন্তু! হাতের লক্ষ্মীকে অবহেলা করতে নেই। এখনো তো কোনো খোঁজ পেলাম না বল। কী হবে এসব করে?”

“তুমি জানো না মা, সত্যিই জানো না প্রতিবার কেন আসি? আর চিন্তা কোরো না, ঐ দলে আমি পার্মানেন্ট প্লেয়ার। ওরা বোঝে ব্যাপারটা। কোনোদিন এই কারণে তাড়িয়ে দেবে না।”

যোহন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে। ভোরের আলো এখনো ফোটেনি ঠিক করে। কেমন যেন খাতায় ওল্টানো শুকিয়ে যাওয়া নীল কালির রঙের মতো হয়ে আছে আকাশটা। চারিদিক কিছুটা আবছাও, খুব দূরের কিছু ঠাহর হয় না। উঠোনটা পেরোতে গিয়ে খুব সুন্দর গন্ধে ওর শরীরের সমস্ত রোম শিহরিত হলো। শিউলি। ও ফিরে তাকানোর কিছু আগেই যেন একটা দমকা হাওয়া এলো কোত্থেকে আর গাছ থেকে ঝরে পড়লো অজস্র শ্বেতশুভ্র কমলা আভার ফুলগুলো। ও কাছে গিয়ে দুই হাতের মুঠোয় ভরে নিলো যতটা পারে। সুদীর্ঘ ঘ্রাণের সঙ্গে সঙ্গে ওর সমস্ত বিরক্তি চলে গেল। আসলে ও ঠিক বুঝতে পারে না, মা ওকে এখনো কেন এরকম প্রশ্ন করে? সবাই কি ভুলে গেছে? ভুলে যায় না ভুলে যেতে চায়? মানুষ এভাবে শান্তি পায়? নাঃ, ও আর এই কথাগুলো ভাববে না। ওর পুরো মনঃসংযোগ এখন শুধু প্র্যাকটিসের ওপর রাখতে হবে, আর কিচ্ছু নয়, কিছুই নয়।

***

আচ্ছা, টাকা থাকলেই সবটা করা যায়? টাকার সঙ্গে কীরকম অদ্ভুতভাবে সম্মান, খ্যাতি, প্রতিপত্তিও চলে আসে! যার টাকা আছে, সে ভাবে জীবনে সে যে কোনো কিছু চাইতে পারে, সবকিছুর ওপর তার অধিকার আছে। সবকিছু যেন তার জন্যই তৈরি। আর কোনোকিছু তার ইচ্ছেমতো না হলে সে সেটাকে খারাপ করে দিতেও ছাড়ে না। নাহলে আজ বলরাম দাস এসে কী করে ওদের হুমকি দিতে পারে? রাগে রোহনের মাথাটা দপদপ করতে থাকে। কী করে একটা মানুষ এরকম অপমান করেও পার পেয়ে যায়?

আজ আর তেমন প্র্যাকটিস হয়নি। কোথায় ভেবেছিল ম্যাচের আগেরদিন ভালো করে ট্রেনিং করবে, তা নয়। ওদের টিমের এক্স ফ্যাক্টর না থাকলেও ওরা প্রতিটা ম্যাচ একজোট হয়ে টিমের মতোই খেলেছে। নাহলে সেমিফাইনালে উঠতে পারতো না। এবারে নাকি যে টিম ‘নিমাই দে স্মৃতি ফুটবল প্রতিযোগিতা' জিতবে সেই দলের সবাইকে কলকাতায় অনুশীলনের সুযোগ করে দেওয়া হবে। আর কোনো পুরস্কার নয়, শুধু এটুকুকেই পাখির চোখ করে রেখেছে ওরা। জিততেই হবে এবারে। কিন্তু আজ প্র্যাকটিসের শুরুতেই বাগড়া। ওদের কোচ বাবলুদা একজন মোটাসোটা হোমড়া চোমড়া ধরনের লোককে নিয়ে মাঠে ঢুকে বললো,

“এই হচ্ছে টুর্নামেন্ট কমিটির প্রেসিডেন্ট বলরাম দাস। বলতে পারিস সর্বেসর্বা। এঁর নিজের দলও খেলছে, মানে তোরা জানিসই, গতবারের চ্যাম্পিয়ন আর সেমি ফাইনালে আমাদের অপোনেন্ট কাশীপুর বয়েজ ক্লাব। তোদের খেলা দেখে ইনি খুব প্রসন্ন। তাই তোদের সঙ্গে কিছু কথা বলতে চান।”

বলরাম দাসের গুটখা, পান, জর্দা খাওয়া লাল আর অত্যন্ত নোংরা দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়লো সঙ্গে সঙ্গে। “ঠিকই বলেছে বাবলু। তোমাদের খেলা দারুণ হচ্ছে। যেরকম খেলছো, তাতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া কে আটকায়!”

এটা শুনে রোহন এবং দলের সবাই খুশি হয়ে গেল। ভালো লাগে যখন কেউ ওদের হার্ডওয়ার্ককে সম্মান করে।

“কিন্তু এবারে সেমিফাইনালে এরকম খেলা আর চলবে না। আমাদের টিমের মেইন স্ট্রাইকার নেই, অসুস্থ। কিন্তু তাই বলে তো আমরা হেরে যাবো সেটা হতে পারে না। আমি অনেক কাঠখড় পুড়িয়েছি। সেখানে আমার টিম না গিয়ে অন্যরা কলকাতার বড় দলে গিয়ে প্র্যাকটিস করবে তা তো হয় না।”

“মানে? বাবলুদা এসব কী বলছেন উনি?”

বাবলুদা মুখে একটা হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

“তোমাদের বাবলুদা আর কী বলবেন? কিছু না করারও একটা দাম থাকে, আমি সেই দাম চুকিয়েছি বাবলুকে। ও একটা কথা বললে ওর জিভ ছিঁড়ে নেব না! যাইহোক, বেশি ভাটাবো না। খেলার একটু নাটক করে ম্যাচটা জাস্ট ছেড়ে দিও। তোমরাও কিছু না কিছু পাবে।”

সবাই রাগে ফুঁসতে থাকে। “বাবলুদা বিকিয়ে যেতে পারে, আমরা নয়।”

“আরে তোরা এরকম করছিস কেন বলতো? পাড়ার ক্লাবের কথা একবার ভাববি না! এই টাকাগুলো পেলে ক্লাবের পরিকাঠামো উন্নত হবে, আর তোদের ব্যক্তিগত লাভ তো আছেই।”

রোহন ঝেঁঝিয়ে ওঠে, “চুপ বাবলুদা। তুমি আর কিছু বলবে না। ঘেন্না হচ্ছে তোমার ওপর। আমি আজই বলে তোমায় দল থেকে বের করবো। তুমি থাকো টাকা নিয়ে। তোমাকে লাগবে না। আমরা নিজেরাই ভালো খেলবো।”

ক্রুর একটা হাসি খেলে গেল বলরাম দাসের মুখে। “আচ্ছা, তাই করো। অল দ্য বেস্ট। পরে আবার বলতে এসো না, সাবধান করিনি।”

সাইকেলটার কটা স্পোক ভেঙে গেছে। তাই আজ আর মাঠে নিয়ে যেতে পারেনি। তবে সাইকেল না নিয়ে আসায় একটা সুবিধা হয়েছে, ও ঘুরপথে রাস্তা দিয়ে না গিয়ে চাষের জমির আলপথ ধরে ধরে মাঠে পৌঁছেছিল, এখন সেই পথ দিয়েই ফিরছে। ওর মনে আছে, দাদা আর ও এভাবেই ছোটবেলায় মাঠের আলপথ ধরে ঘুরতে বেরোত। যখন ধান কাটা হয়ে যায় তখন দিগন্ত বিস্তৃত শূন্য মাঠ দেখে বোঝা যায় না এর শেষ কোথায় বা কোনটা কার জমি। শুধু এই উঁচু আলপথগুলো বিচ্ছিন্ন করে রাখে জমিগুলোকে। একবার মনে আছে এক কালবৈশাখীর দিনে ঝড় দেখার আনন্দে যোহন দৌড়েছিল ফাঁকা জমির উপর দিয়ে, ও বুঝতে পারেনি দাদাও সেটা দেখে ওর পেছনে দৌড়েছিল। দুই ভাই জগৎ সংসার ভুলে শুধু দৌড়ে যাচ্ছিল। অনেকটা দূর গিয়ে যখন দম শেষ হয়, যোহন হাঁপাতে হাঁপাতে টের পাচ্ছিল ওকে ঘিরে পাক খাচ্ছে ধুলো, ভীষণ জোরে ঝড় আসছে। প্রচণ্ড ঝড়ে দূরের তালগাছগুলো এমন দুলছিল যেন এক্ষুণি সব মটমট করে ভেঙে পড়ে যাবে। ঝড়ের বেগ বাড়তে, ধুলোর আঘাত থেকে মুক্তি পেতে ও মাটিতে শুয়ে পড়েছিল উপুড় হয়ে, দেখেছিল কোত্থেকে আরেকটা মানুষও উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েছে ওর পাশে, ওর দাদা। দুজনে বেদম হাসিতে ফেটে পড়েছিল নিজেদের পাগলামি দেখে। যোহন বুঝেছিল, ওর যেকোনো বিপদের সময় দাদা ঠিকই থাকবে ওর সঙ্গে।

আজ কোথায় দাদা? দাদা ভীষণ চাইতো, ও ফুটবল খেলুক, ও তো খেলছে। কিন্তু দাদা কোথায়? বাড়ির উঠোনে দাদার নিভিয়ার ঐ পাঁচ নম্বর বলটা নিয়ে নানারকম করতে ভালোবাসতো। কখনো জাগলিং, পায়ে নাচানো, মাথায়, বুকে, পিঠে সবজায়গায় বল রেখেও মাটিতে পড়তে না দেওয়া বা কখনো দাদার সঙ্গে মাঠে গিয়ে শট মারতো ও, গোলে কখনো কেউ ওর কোনো শট সেভ করতে পারেনি। তাই দাদা ভীষণভাবে চাইতো দাদার সঙ্গে ও খেলুক ওদের ক্লাবের টিমে। কিন্তু ওর ইচ্ছে হয়নি তখন।

‘নিমাই দে স্মৃতি ফুটবল প্রতিযোগিতা' শুরুর সময় থেকে দাদা খুব এক্সাইটেড থাকতো। বলতো, “জিতলেই কলকাতার দলগুলোর সঙ্গে প্র্যাকটিস করার সুযোগ পাবো।” দাদার ভীষণ প্যাশনের জায়গা ছিল এই ফুটবল টুর্নামেন্ট। দাদা খুব চাইতো কলকাতায় খেলতে যেতে, পারেনি কোনোদিন। দাদার সেই স্বপ্নপূরণ করে আজ যোহন কলকাতার একটি দলের নিয়মিত ফরোয়ার্ড, দাদার প্যাশনের এই টুর্নামেন্টে আজ প্রথমবার ওদের ক্লাব ফাইনালে। গত চারবার চেষ্টা করেও ও দলকে ফাইনালে তুলতে পারেনি, কিন্তু এবার পেরেছে।

যোহন বাড়ির উঠোনে পা দিতেই ওর চোখ চলে গেল পুকুর ধারের পাশে থাকা শিউলি গাছটার দিকে। হঠাৎ ওর দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। কোথায় শিউলি ফুলগুলো? গাছের ডালে, তলায় কোথাও নেই। আরে এখন তো বর্ষাকাল, শিউলি আসবে কোত্থেকে? কিন্তু তাহলে সেইদিন ভোরবেলায়? ওর মুঠোভরে শিউলি কুড়োনো? ও তাড়াতাড়ি ওর ব্যাগটা খোলে, ব্যাগে রেখেছিল সেদিন ফুলগুলো। কিন্তু ব্যাগ খুলে ও হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, ওর কিটস ছাড়া আর কিছুই নেই।

***

সবাইকে কাটিয়ে বিজু পৌঁছে গেছে ডি বক্সের ভেতরে, শেষ ডিফেন্ডারকে কাটাতে পারবে? রোহন সাপোর্টের জন্য দৌড়োতে থাকে সামনে। আর তখনই ও দেখলো বিজু মুখ থুবড়ে পড়লো মাটিতে, শেষ ডিফেন্ডারটিকে প্রায় কাটিয়ে নিয়েছিল কিন্তু পেছন থেকে পায়ের হিল বরাবর পা চালায় ওদের আরেকটা প্লেয়ার, বিজু মাটিতে পড়ে আর বলটা ওর পায়ে লেগে পোস্টের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। ক্লিয়ার ফাউল, ক্লিয়ার পেনাল্টি। অন্তত ওরা গোল শোধের সুযোগ পাবে এই শেষ মুহূর্তে। রেফারি বাঁশি বাজায়, কিন্তু এ কী? গোলকিক! সত্যি? হাত দিয়ে গোলকিকের ইশারা করে রেফারি পেছনে সরতে থাকে। বিজু এখনো পড়ে আছে গোলপোস্টের সামনে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ওরা সবাই বিজুর দিকে দৌড়োতে থাকে। রোহনের মাথার শিরা ছিঁড়ে যাবে মনে হচ্ছে। এটা পেনাল্টি না? এটা পেনাল্টি না! একটা বাচ্চা ছেলেও বলে দেবে এটা ফাউল। সব বিক্রি হয়ে গেছে? রেফারিও? তাহলে কেন এই টুর্নামেন্ট করছে এরা? আর এর জন্য ওরা এত স্বপ্ন দেখেছে? এত পরিশ্রম? যোহনকেও খেলাতে চেয়েছিল, ভাগ্যিস রাজি হয়নি। এই পাঁকে ঢোকার জন্য জোর করছিল?

বাকিরা রেফারিকে ঘিরে ফেলেছে। জবাব চাইছে। ও জানে, কোনো লাভ নেই, শুধু এক তীব্র রাগ পাকিয়ে উঠছে শরীরে। লাইনের পাশে দাঁড়ানো বাবলুদার মাথায় হাত। এই নাটকটা করছে কেন মালটা? বলরাম দাস বাইরে থেকে হাত নাড়ছে, চিৎকার করছে। মেরে সবার মুখ ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে ওর। এতটা কষ্ট, চেষ্টা, পরিশ্রমের ফল এইভাবে কেউ অন্যায্যভাবে ছিনিয়ে নেবে? ওদের প্লেয়াররা সরে আসছে রেফারির পাশ থেকে। কেউ কেউ মাঠ ছাড়তে চাইছে। না, বোঝাতে হবে সবাইকে, ওরা মাঠ ছেড়ে পালিয়ে যাবে না যাই হয়ে যাক। ও দৌড়ে এগিয়ে যায়, দেখে বিজু উঠে দাঁড়াচ্ছে খোঁড়াতে খোঁড়াতে। তখনই পেছন থেকে কাশীপুর বয়েজের কেউ ওকে ল্যাং মারে।

“কীরে? এইভাবে পড়ে যাচ্ছিস, গোল করবি কীভাবে?”

রোহন জানে না ওর কী হয়, কোথায় যেন কীসের একটা বিস্ফোরণ ঘটে, শব্দটা কানে বাজতে থাকে, আর ও সজোরে দুটো ঘুষি চালায় ছেলেটার নাক আর চোয়াল বরাবর।

“এই নে দুটো গোল।”

বিজুকে ছেড়ে, রেফারিকে ছেড়ে সমস্ত ফোকাস চলে যায় রোহনের ওপর। ডিরেক্ট রেড কার্ড। মাঠের চারপাশে সবাই হল্লা করতে শুরু করে। মাঠের মধ্যে বাইরের লোকরা ঢুকে পড়ছে। চরম বিশৃঙ্খলা শুরু হয়, আয়োজক কমিটির লোকরা সামলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছে, রেফারি ঘন ঘন বাঁশি বাজাচ্ছে। রোহনের বন্ধুরা ওকে ধরে মাঠের বাইরে নিয়ে আসে। রোহনের রাগ কমে যাচ্ছে, বদলে জায়গা নিচ্ছে তীব্র অপরাধবোধ। ছেলেটার জন্য একটু খেয়াল হলো ওর। ছেলেটা ঠিক আছে? ওর হাতে এখনো রক্ত লেগে। নিশ্চয়ই নাক, মুখ ফেটে গেছে। একবার ক্ষমা চাইতে পারলে ভালো হতো। তেমন দোষ নেই ছেলেটার। আসল কলকাঠি ওপরের লোকগুলো নেড়েছে। কী থেকে যে কী করলো ও? খারাপ লোকগুলো যেরকম চেয়েছিল সেরকমই হয়ে গেল ও? নিজে হাতে ম্যাচটা শেষ করে দিল। হয়তো শেষ দুই তিন মিনিটে একটা সুযোগ পেত। রোহন বাইরে ছাউনিতে এসে বসে পড়ে। ওর কানের পাশে বিভিন্নজন নানারকম কথা বলতে থাকে। কিছুই কানে আসছে না ওর। ও শুধু দেখে, ওর স্বপ্ন ভেঙ্গে যাচ্ছে, ছোটবেলা থেকে যে স্বপ্ন দেখেছে সেটা ধরা দিয়েও ওর থেকে এভাবে ছিনিয়ে নিলো কিছু খারাপ মানুষ? কলকাতায় খেলার ইচ্ছে আর কোনোদিন পূরণ হবে না?

দাদা বলতো, বল নিয়ে এগোনোর সময় চোখ বলের দিকে থাকলেও খেয়ালটা সবকিছুর রাখতে হয়। বিপক্ষের প্লেয়ার, নিজের টিমের প্লেয়ার ঠিক কোন পজিশনে আছে সেটা চোখে না দেখতে পারলেও বুঝে নিতে হয় সবসময় আর সেই বুঝে পাস দেওয়া, থ্রু বাড়ানো। ঠিক যেন মাথার পেছনদিকে দুটো চোখ রাখতে হয় সবসময়। পেরিফেরাল ভিশন এটাই, সবার এটা স্ট্রং হয় না, কিন্তু যার এটি স্ট্রং সে বিপক্ষের কাছে ত্রাস। খেলতে খেলতে এখন যোহন এটা খুব ভালো বোঝে। মাঠে ওর পায়ে বল থাকুক আর না থাকুক কে কোথায় থাকতে পারে তার ধারণা ওর থাকে।

ফাইনাল শুরু হয়ে গেছে। এই প্রথমবার ওরা ফাইনাল খেলছে। হাফটাইম পেরিয়ে বেশ কিছু মিনিট অতিক্রান্ত হলেও গোল হয়নি কোনো দলের। বিপক্ষে কাশীপুর বয়েজ। এই টুর্নামেন্ট যবে থেকে শুরু হয়েছে তবে থেকে শুধু এরাই চ্যাম্পিয়ন। অনেকে অনেকরকম কথা বলে, কেউ বলে এরা অনেক টাকা ঢালে, রেফারি, লাইনসম্যান, বিপক্ষের প্লেয়ার সবাইকে কিনে নেয়, নাহলে খেলা ভণ্ডুল করে দিয়ে ট্রফি নিজেদের কাছে রেখে দেয়। গত সাত বছরে তাই নাকি শুধু ওরাই জিতেছে। যোহন বুঝলেও এটা মাথায় রাখতে চায় না। ওর কাছে ভালো খেলাটা আসল। ভালো খেললে ঠিকই পুরস্কার পাবে, ও জানে।

কাশীপুর বয়েজ বেশ জাঁকিয়ে বসেছে, মুহুর্মুহু আক্রমণ করছে। যোহনরা বল ধরতে পারছে না।

শেষ কিছু মিনিট বাকি, গোল না হলে পেনাল্টি শুট আউট। এক্সট্রা টাইম নেই। পড়ন্ত বিকেল, তার ওপর মেঘ করেছে। সবটাই যেন একটু বেশি অন্ধকার, যদিও খেলতে অসুবিধা কিছু হচ্ছে না। যোহন দেখলো ওদের কোনো ডিফেন্ডার বলটা পেয়ে একটা লং বল বাড়ালো সামনে, কে ওটা ঠিক চিনতে পারলো না, বাম দিকে তখন আরেকজন বলটা নিয়ে এগোচ্ছে, এবারও ও চিনতে পারলো না এই ছেলেটাকে। কিন্তু ও সময় নষ্ট না করে ডানদিক থেকে উঠতে থাকলো, যদি ক্রস বাড়ায়। একবার ক্ষণিকের জন্য ও পেছনে তাকালো, আর দেখলো বিশু, পটলা, বোম, লক্ষী সবাই পেছন থেকে উঠছে। তাহলে এই ছেলেটা কে? ছেলেটার পেছনে ওদেরই দলের জার্সিতে আরো চার পাঁচটা ছেলে? রিজার্ভ বেঞ্চের রতন, গুলি এরা মাঠে নেমে পড়লো নাকি? বিপক্ষের কেউ অলরেডি লাইনসম্যানের কাছে পৌঁছে গিয়ে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে হাত নেড়ে কীসব যেন বলছে। ছেলেটা এতক্ষণে বামদিক থেকে পেনাল্টি বক্সের কাছে চলে এসেছে, ওর কাছে আসামাত্র দুজন ডিফেন্ডার দুদিকে ছিটকে চলে গেল, হতভম্ব হয়ে মাটিতে বসে পড়েছে তারা। ছেলেটার চেহারা যেন খুব চেনা, যোহন বুঝতে পারে না কী হচ্ছে। ছেলেটা বলটা চিপ করে শূন্যে ভাসিয়ে দিলো, যোহন ছাড়া এদিকে কেউ নেই। যোহন দ্রুত বলটা বুকে রিসিভ করে নামিয়ে সামান্য এগিয়ে বলটা ডজ করে আবার শূন্যে তুললো যাতে সামনের ছেলেটি বলের নাগাল না পায়। কিন্তু সামনের ছেলেটি ওর সামনে এসেই থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল। “তুই? কীভাবে? তুই তো…! তোকে তো…!” কথা শেষ করতে পারে না সে, যোহনের এসব ভাবার সময় নেই, সামনে শুধু গোল দেখতে পাচ্ছে ও। বলটা একবার টাচ করে সামান্য এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ডানদিক দিয়ে কোণাকুণি শট মারলো বামদিকের পোস্টের গা বেয়ে। গোলকিপার ওকে দেখে নড়লো না অব্দি। শুধু জাল কাঁপিয়ে বলটা বেশ কিছুবার পাক খেয়ে গোলেই থেকে গেল। রেফারি বাঁশি বাজালো। গোওওওওল। যোহন শেষ মুহূর্তে গোল করে দিয়েছে। ও দুইহাত মুঠো করে শূন্যে তোলে। ওরা জিতবে আজ, ওরাই জিতবে, ওর দাদা জিতবে আজ।

রেফারিকে ঘিরে বিপক্ষের কিছু প্লেয়ার জটলা করছে। তাদের বক্তব্য এগারো জনের অনেক বেশি প্লেয়ার মাঠে খেলছে যোহনদের হয়ে। রেফারি ওদের দাঁড় করিয়ে গুনলো। কিন্তু না, এগারো জনই আছে। যোহনের যে এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয়নি এই কথা, তা নয়, কিন্তু ও কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। হয়তো ওর চোখের ভুল, কিন্তু বাকি এদেরও চোখের ভুল? কিন্তু রেফারি আর অপোনেন্টের কেউ প্রমাণ করতে পারলো না।

এরপরে সেন্টার করতেই বাঁশি বেজে উঠলো। খেলা শেষ। গণিপুর চ্যাম্পিয়ন, ওদের ক্লাব চ্যাম্পিয়ন। প্রথমবার। সবাই একে অপরকে কোলাকুলি করছে। ওকে কাঁধে তুলে নিয়ে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। কাশীপুর বয়েজের কেউ কেউ এসে অভিনন্দন জানালো। বয়েজের গোলকিপার ভোলা এসে ইতস্তত করতে করতে বললো, “তুই রোহনের ভাই না? তোর মাথায় ঐ কাটা দাগটা...”

“কাটা দাগ?” যোহন মাথায় হাত দিয়ে দেখে। “কই না তো! নেই কিছু।”

ছেলেটা আর দাঁড়ায় না। তাড়াতাড়ি পালিয়ে যায়।

***

আজ যেন বাড়ির পথটা অনেক লম্বা হয়ে গেছে। রোহনের ইচ্ছেও করছে না বাড়ি যেতে। কী করবে বাড়ি গিয়ে? মুখ লুকিয়ে শুয়ে থাকবে? কাল থেকে ও কী নিয়ে থাকবে? আবার পরের বছরের প্রস্তুতি? কিন্তু পরের বছর আজকের মত কিছু হবে না কী গ্যারান্টি? রোহন গোলদীঘির পাশে ইউক্যালিপটাস গাছের সারির মধ্যে এসে বসেছে ঘন্টাখানেক হলো। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে, ঘামে জবজবে ওর শরীরটা হালকা লাগছে, ঘুম পাচ্ছে ওর, আজ একবার মাকে জড়িয়ে ধরে বলবে ছোটবেলার মতো ঘুম পাড়িয়ে দিতে? সূর্য অস্ত গেছে, একটু পরেই ঝুপুস অন্ধকারে ঢেকে যাবে সব। না, তার আগেই উঠে পড়া ভালো। মায়ের, ভাইয়ের চিন্তা হবে। শুধু শুধু অন্যকে টেনশন দেওয়া ভালো নয়। রোহন ঠিক করে, ও আর এই টুর্নামেন্টে খেলবে না পরেরবার থেকে, এর থেকে ও গোপাল কাকুকে ধরে কলকাতার দলগুলোতে ট্রায়াল দেওয়ার চেষ্টা করবে। গোপাল কাকু বেশ কিছু দলে মালির কাজ করে। কিছু না কিছু ব্যবস্থা ঠিক হবে। ভাইটাকে আর জোর করবে না এখানে খেলতে, তার থেকে তাকে নিয়েও গোপাল কাকুর কাছে যাবে। রোহন উঠে পড়ে নরম ঘাসের উপর থেকে। ফিরতেই দেখে পাঁচ ছয়জন ছেলে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে। নিজের ভেতরের চিন্তায় এতই মগ্ন ছিল বুঝতেই পারেনি এরা কখন এসেছে। কাশীপুর বয়েজের ছেলে এরা। দুই এক জনের মুখ চিনতে পারছে, আজকের বিজয়ী দলের প্লেয়ার, বাকিরা হয়তো সাপোর্টার। কিন্তু এখানে কেন?

“রোহন, না? উঠে যাচ্ছ?”

“হ্যাঁ, বাড়ি ফিরতে হবে।”

“এত তাড়া কীসের? বলছিলাম, যাকে মেরেছো তার ঠোঁটে দুটো সেলাই পড়েছে, নাকের হাড় ভেঙেছে, একটা দাঁত পড়েছে। ভালো জোর আছে তোমার হাতে মাইরি।”

রোহন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। “ক্ষমা করে দেবেন, প্লিজ। রাগের মাথায় কী যে হলো? আসলে পেনাল্টিটা...”

“হ্যাঁ, পেনাল্টি ছিলো। কিন্তু কাশীপুর না জিতে অন্য দল জিতবে কী করে? তাই … যাইহোক, তোমার সঙ্গে যে হিসেব বাকি। তুমি ম্লেচ্ছ, তাই না?”

রোহন অবাক হয়। এটা কী প্রশ্ন? হ্যাঁ, ওর দোষ ছিল, একদম বুঝতে পারেনি, মারা উচিত হয়নি, কিন্তু এটা কীরকম প্রশ্ন। “আমি বাঙালি, আর ক্রিশ্চান, তবে আগে বাঙালি। আর আমি ঘটনাটির জন্য সবরকমভাবে ক্ষমা চাইতে রাজি।”

“হাহাহাহাহাহা। এখন এতজন দেখে প্যান্ট হলুদ হয়ে গেল? ঠিক আছে, ক্ষমা চাইছো যখন, যাও তাহলে।”

রোহনের বুকের থেকে একটা ভার নেমে যায়। এরা অন্তত ক্ষমা করতে রাজি। ও এই বাজে অধ্যায়টা ভুলে যেতে চায়। ওকে এগোতে হবে ভাঙ্গনের পরের অধ্যায়ে। সবাই সরে দাঁড়ালে ও সাইকেলটা নিয়ে এগোতে থাকে।

প্রবালের হাতটা থরথর করে কাঁপছে এখনো। বিশ্বাস করতে পারছে না ও। কেউই কি পারছে ওরা? ছয় বছরে কতটা পাল্টাতে পারে সব? নাকি কিছুই পাল্টায়নি?

“কেউ কি কিছু বলবি? আমার আর এই সাসপেন্স ভালো লাগছে না। এখানে কেন ডেকেছিস?” তন্ময় ঝাঁঝিয়ে ওঠে।

“সত্যি! বেকার লাগছে। এই অভিশপ্ত জায়গাতেই কেন ডাকলি? ভোলাদা বলো কিছু।” চিরো বলে।

জোরে হাওয়া বইছে। গোলদীঘির পাশে ইউক্যালিপটাস গাছগুলো যেন বেশিই নড়ছে। ঠান্ডা হাওয়াতে ওদের সবার গা শিরশির করে ওঠে।

প্রবাল কেমন যেন একটা ভয়ার্ত গলায় হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, “চল না ভাই, যাই এখান থেকে। পালাই।”

তুহিন প্রবালের হাত শক্ত করে ধরে বলে, “তুই ঠিক বলছিস? এটা কী করে হয়?”

প্রবাল কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, “আমায় ছাড় ভাই, সেদিনও বলেছিলাম। আজও বলছি। তোদের জন্য আমি মরতে চাই না। আর আমার কথা বিশ্বাস না হলে ভোলাকে জিজ্ঞেস কর।”

ভোলা ধীর গলায় এই প্রথম কথা বলে, “হ্যাঁ, আমি স্পষ্ট দেখেছি। ওর মাথায় সেই ব্যাটের আঘাতের লম্বা গভীর ক্ষত অব্দি ছিল।”

“কিন্তু তা কী করে হয়? আমরা সেদিন সবাই পরীক্ষা করে দেখেছিলাম কোনো সাড় ছিল না দেহে। তাই আমরাই জলে ফেলে দিই। আর পরে তার দেহের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।”

“কী দরকার ছিল তোদের? ক্ষমা তো চাইছিল বারবার। যখন চলে যেতে চাইলো, তখন কী না বাকি রেখেছিলিস! ব্যাট, রড, সাইকেলের চেন, শাবল, হাতুড়ি … তারপর আবার নাটক করে বলিস যে, ভাবতে পারিসনি ও মরে যাবে! ওর বাঁচার জন্য কী করেছিলিস? শরীরের কোন অংশটাকে আঘাত করা থেকে বাদ দিয়েছিলিস? এতটাই খারাপ অবস্থা ছিল যে চেনা যাচ্ছিল না। শুধু মাথার ঐ লম্বা গভীর ক্ষতটা চোখে পড়ছিল সবচেয়ে বেশি। আর সেই একই ক্ষত আমরা আজ যোহনের মাথায় দেখেছি। নিখুঁত, একইরকম। ভোলা নড়তে অব্দি পারেনি যোহন গোলে শট নেওয়ার সময়। কিছু তো মানে আছে না, এটার। ওদের টিমে এগারো জনের পরিবর্তে যেন ষোলো-সতেরোজন খেলছিল শেষ তিন চার মিনিট। অবশ্য রেফারি যখন গুনতে গেল, শুধু ওরা এগারো জনই ছিল। এখনো কিছু বুঝতে পারছিস না তোরা? সাধারণ বুদ্ধিতে মানে খুঁজছিস!” প্রবাল একনাগাড়ে এতটা বলে চুপ করে।

তুহিন কেমন জানি বিড়বিড় করতে থাকে। “তাহলে কি যোহন সব জানে? ওকেও যদি আমরা শেষ করে দিই? ও কাউকে কিছু বলতে পারবে না।”

ভোলা বলে, “আমি জানি না ওটা আদৌ যোহন ছিল কিনা! না ওর দাদা রোহন এসে …?”

“কী আজগুবি …?”

তুহিনের কথা মুখেই থেকে যায়। একজন ছিপছিপে তরুণ হঠাৎ কোত্থেকে যেন ওদের সামনে দাঁড়িয়ে। “তোমরা বুঝি আমায় খুঁজছো?”

ওরা সবাই ভীষণ চমকে ওঠে। ওদের সামনে যোহন। পরনে বিকেলের ম্যাচের ড্রেস। যোহন শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে আবার বলে উঠলো, “হারাতে পারলে না এবার বুঝি? যেমন আমাদের হারিয়েছিলে ছয় বছর আগে।”

কে কী করবে বুঝতে পারে না। সবাই একদৃষ্টে চুপ করে যোহনকে দেখতে থাকে। যোহনের মুখটা কেমন যেন ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। একটা সুশ্রী মুখ ধীরে ধীরে কেমন যেন বীভৎস হয়ে যাচ্ছে। প্রবালের সারা শরীর কাঁপতে থাকে, আর ও দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।

এই অচেনা রূপান্তরিত দেহটির ঠোঁট নড়ে ওঠে, “এখন যোহনকে মারার প্ল্যান করছো বুঝি? যোহনের যে কোনো ক্ষতিই আমি হতে দেব না। ওর জন্য ওর দাদা সবসময় আছে। ওর এই শরীরের ভেতরে।”

কারোর মুখে কোনো কথা নড়ে না। এখন আর কারোর চিনতে অসুবিধা নেই। এই বীভৎস ক্ষতবিক্ষত মুখটা ওদেরই যে তৈরি করা। ব্যাট, শাবল, হাতুড়ি, চেন দিয়ে ওরাই পিটিয়ে একটা শরীরের এই অবস্থা করেছিল। কোনো জায়গা থেকে মাংস ঝুলছিল, কোথাও বা হাড় দেখা যাচ্ছিল, কোথাও থেঁতলে ঢুকে গিয়েছিল, শরীরের কোনো অংশ বাদ ছিল না যেখান থেকে রক্ত ঝরছিল না। ওরা এখন চোখের সামনে সেই একই বীভৎসতা দেখে নিজেরা তাকাতে পারছে না। দীঘির জলে ভাসিয়ে দেওয়া লাশটা যেন হঠাৎ ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তখন অনেক খোঁজাখুঁজি হয়েছিল। কিন্তু মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

“রোহন, আমাদের ক্ষমা করে দে।”

“ক্ষমা চাইছো যখন ঠিক আছে। যেতে পারো তোমরা। আর আমি রোহন ছিলাম, এখন নই। এখন আমার ভাইই আমার পরিচয়। যোহন। একই শরীরে দুইজনের বাস।” বলে আকাশ কাঁপিয়ে হাসতে থাকে।

ওদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। এক্ষুণি ওদের পাঁচজনকে পালাতে হবে, নাহলে আর ওরা বাঁচতে পারবে না। সেদিন সত্যিই শুধু রাগের বশে একটা জীবনকে শেষ করে দিয়েছিল। সবাই পালাতে উদ্যত হলেই ওরা দেখলো, ওদের পা নড়ছে না। রোহন চিৎকার করে হেসে যাচ্ছে সামনে, হাসিটা যেন ঠিক হাসি নয়, অট্টহাসি আর আর্তনাদের মিশেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা হঠাৎই টুপটুপ করে যেন ঝরে পড়লো মাটিতে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, যেন কেউ গলা কেটে উড়িয়ে দেওয়ার পর দেহগুলো একসঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল।

অন্ধকার নামছে, অমাবস্যার অন্ধকার। গোধূলির শেষ আলোয় খুব আবছাভাবে দেখা যায়, এদিক ওদিক থেকে কিছু দেহ কেউ একসঙ্গে টেনে হিঁচড়ে দীঘির জলে ফেলে দিচ্ছে।

***

“আমার ভাইয়ের সঙ্গে একবার...”

আকাশ থেকে আবার ভীষণ জোরে ব্যাটটা নেমে এসে আঘাত করে মুখে। ক্ষীণ গলায় বলা কথাগুলো মুখের কাছে গজিয়ে ওঠা ঘাস অব্দি গেল না। রক্তে ভেসে যাচ্ছে ও।

দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে শরীর। রোহন মুঠোভরে কী যেন ধরতে যায়? পাহাড় না নদী না ঘুড়ি? পুকুরের জলের জ্যান্ত মাছ না একমুঠো শিউলি? না ফুটবল? না ভাইয়ের হাতটা?

ওর শরীরটাকে কারা যেন শূন্যে তুলে নিল। ও সত্যিই এবার উড়তে পারছে। শরীর সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়েছে। রোহন ভালো করে অন্ধকারে কিছু দেখতেই পাচ্ছে না, ও চোখ বন্ধ করে। দেখতে পায়, বাড়ির উঠোনে যোহন পায়ে বল নাচাচ্ছে। বল নাচাতে নাচাতে শিউলি গাছের দিকে যাচ্ছে। রোহনকে মাঝে মাঝে বল দিচ্ছে। রোহনের মুখে শুধুই হাসি। তার ভাই বল নিয়ে যা খুশি করতে পারে। ও কি আর এগুলো দেখতে পাবে না? কেন এত কষ্ট ও পেতে যাবে? কেন এত কষ্ট পেল ও? সত্যির সঙ্গে দাঁড়িয়েছিল বলে? মিথ্যে টিটকিরিকে যোগ্য জবাব দিয়েছিল বলে? সারা শরীর ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে, যেন শেষ রক্তবিন্দুও বেরিয়ে যাবে।

রোহন বুঝতে পারে ও আর বেঁচে নেই, ঐ ওর প্রাণহীন শরীরটাকে ওরা নিয়ে গিয়ে ঝুপ করে জলে ফেলে দিলো। সত্যিই ও বুঝি মরে গেল? না, ও মরবে না, কোনোভাবে মরবে না। রোহন জানে ও এখনো বেঁচে আছে। ও একমাত্র ওর ভাইয়ের মধ্যেই বাঁচবে, ভাইয়ের সমস্ত ইচ্ছা পূরণ করবে, ভাইকে সবসময় রক্ষা করে যাবে।

ধুম জ্বর থেকে উঠে দাঁড়াতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছিল যোহনের। কেন কে জানে ম্যাচের পর থেকে কিছু মনে নেই ওর, সারা শরীরে শুধু ব্যথা ছিল, কিন্তু আর ঠিক কী কী হয়েছিল ও এখনো জানে না। ও হাজারবার চেষ্টা করেও যখন কিছু জানতে পারেনি, কিছু মনে পড়েনি, তখন একপ্রকার ও চেষ্টাই ছেড়ে দিয়েছে। আজকাল যেন আরো বেশি করে দাদার কথা মনে পড়ে ওর। কত জায়গায় ওরা খোঁজ লাগিয়েছে, কতজনকে খবর জোগাড় করার জন্য অনুরোধ করেছে, কিন্তু কোনো খোঁজ পায়নি। ও মানতে রাজি নয় দাদা মারা গেছে, মানতে রাজি নয় দাদা ওদের ছেড়ে চলে গেছে, হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে, হয়তো কোন কাজে আটকে আছে, কাজ শেষ হলেই ফিরে আসবে। 'নিমাই দে স্মৃতি ফুটবল প্রতিযোগিতা'-এর এরকমই এক সেমিফাইনালে ক্লাব হারার পর থেকে দাদার খোঁজ নেই। ছয় বছর পরও নেই।

যোহন বাইরে তাকায়, অনেক শিউলি হয়েছে আবার, বর্ষাকাল শেষ হওয়ার আগেই। ওর আর ভাবতে ইচ্ছে করে না যে শরৎকাল নয় বলে গাছে শিউলি থাকতে পারে না। আলবাৎ পারে। যখন খুশি পারে। জীবনের ভালোলাগাগুলো যখন খুশি আসতে পারে, শিউলি ফুলগুলো যেন মনে করায় দাদা আশেপাশেই কোথাও আছে। মিষ্টি গন্ধটা ধীরে ধীরে আরো গাঢ় হতে থাকে। ‘ওকে এবার কলকাতা ফিরতে হবে, এখানের কাজ শেষ,’ কে যেন মাথার মধ্যে বলে ওঠে।