মৃন্ময়ী দেবীর মৃত্যুরহস্য - প্রলয় কুমার নাথ

রহস্য বড় গল্প

অলংকরণ - কর্ণিকা বিশ্বাস
(১)

কলকাতার নাম করা এক নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রের একতলার এই ঘরটা বড্ড ছোট এবং স্যাঁতসেঁতে। সকালেও সূর্যের আলো খুব একটা এসে পৌঁছয় না এই ঘরের ভেতর, আর এখন তো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। ঘরের মাঝে পাশাপাশি দুটো চৌকি, একটি ফাঁকা এবং অপরটিতে শায়িত এক মধ্যবয়সী মহিলা। তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে পড়লেও মহিলার চোখে ঘুম নেই। এই ঘরে তার অপর সঙ্গিনীটিকে শারীরিক অসুস্থতার কারণে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাই আজকে এই ছোট ঘরটিকেও বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে এই মহিলার। রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকারের মাঝে বাইরে থেকে ভেসে আসা কুকুরের চিৎকারগুলি কেমন যেন এক বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে চারিদিকে।

ঠক…ঠক…ঠক…

ঘরের বন্ধ দরজার বাইরে এই সময় কারোর করাঘাতের আওয়াজ শুনে সচকিত হয়ে বিছানায় উঠে বসলেন মহিলা। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে চিৎকার করে বলে উঠলেন, “কে…কে আছে বাইরে?”

প্রত্যুত্তরে আরো বেশ কয়েকবার শোনা গেল দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজ, তবে শোনা গেল না অপর কোনো মানুষের কণ্ঠস্বর। দ্বিধাগ্রস্ত মহিলাটি এবার উঠে পড়লেন বিছানা ছেড়ে, তারপর কম্পিত পদক্ষেপ ফেলে এগিয়ে গেলেন ঘরের আলো জ্বালানোর সুইচের দিকে। কিন্তু সুইচ টেপা সত্ত্বেও আলো জ্বললো না, লোড-শেডিং চলছে। কিছুক্ষণ আগেই যে ঘরের পুরোনো সিলিং ফ্যানটি বন্ধ হয়ে গেছে, এখন সেই কথা মনে পড়লো মহিলার।

আবার…আবার শোনা গেল দরজার বাইরের করাঘাতের আওয়াজ। এবার আর স্থির থাকতে পারলেন না মহিলাটি, তিনি “কে…কে…” বলে চিৎকার করে উঠে ছুটে গিয়ে খুলে দিলেন ঘরের দরজা। কিন্তু যারপরনাই বিস্মিত হয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলেন যে, কই…কেউ তো নেই দরজার বাইরে! তার মানে বোধহয় এই শব্দগুলি কোনো ইঁদুর বা বেড়ালের কাজ। এই ভেবে একটু স্বস্তি পেয়ে তিনি ঘরে ভেতর ঢুকে দরজা বন্ধ করতে যাবেন…এমন সময় অন্ধকার ঘরের ভেতরে কারোর পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে উঠলেন তিনি। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন এক অপার্থিব ছায়ামূর্তি যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার কাছে! শিহরণের একটি হিমেল স্রোত যেন বয়ে গেল তার সর্বশরীর দিয়ে, চরম আতঙ্কে কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেন না তিনি…শুধু নিজের কম্পমান দেহটির ভর পেছনের দেওয়ালের গায়ে চাপিয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন অশরীরিটির দিকে!

***

সেদিন সকালে সাউথ সিটি মলের সামনে দাঁড়িয়ে বিরক্তচিত্তে বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলো টুসু। টুসু ওরফে ঐন্দ্রিলা হল গোয়েন্দা গৈরিক সেনের একমাত্র সহযোগী তথা খুড়তুতো বোন। কলকাতা তথা তার বাইরেও বেশ কিছু রহস্যময় খুনের কেসের সমাধান করে পুলিশমহলের নজর কিনেছে এই জুটি। তাই আপনাদের কাছে আলাদা করে এই দুজনের পরিচয় দেওয়ার আর দরকার নেই।

ঠিক এমন সময় টুসুর বয়সী আরো একজন তরুণী অত্যন্ত অপরাধীচিত্তে ছুটে এসে টুসুকে বললো, “সরি রে, একটু দেরি হয়ে গেল…”

“শোন, তোদের সাথে শপিং করতে আসার এই এক জ্বালা,” রাগী গলায় বলে উঠলো টুসু, “তোরা কথা দিয়ে কখনো ঠিক সময়ে আসিস না, বুঝলি পাপিয়া…এখন আবার সহেলীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে!”

বেশ আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলো পাপিয়া নামক মেয়েটি, “সেকী! সহেলী তো আজ আসতে পারবে না, আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে কিছুক্ষণ আগেই জানালো। তোকে বলেনি বুঝি?”

টুসু হ্যান্ড-ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা বার করলো। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সে ফোনের ডাটা অন করেনি, এখন তা করতেই সশব্দে ঢুকলো সহেলীর হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ।

সহেলী লিখেছে: ‘কিছুক্ষণ আগেই খবর পেলাম যে গতকাল রাতে হঠাৎ করেই দিদির শ্বাশুড়ি মারা গিয়েছেন। ডাক্তার বলছেন ঘুমের মধ্যেই কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। আমরা সকলেই সেখানে যাচ্ছি রে। তাই আজকে আর শপিং করতে তোদের সাথে আসা হল না। কিছু মনে করিস না প্লিজ!’

মেসেজটা পড়ে কেমন যেন অপ্রস্তুত বোধ করতে লাগলো টুসু। আর দুদিন বাদেই মহালয়া, এদিকে এখনো পুজোর কত কেনাকাটা বাকি। তাই আজকের রবিবারের সকালটায় কলেজের এই তিন বান্ধবীর প্ল্যান ছিলো সাউথ সিটি মল থেকে চুটিয়ে কেনাকাটা করা, তারপর লাঞ্চ আর অবশেষে আইনক্স থেকে মুভি দেখা। কিন্তু হঠাৎ কারোর মৃত্যু সংবাদ শুনে আর আনন্দ ফুর্তি করার মানসিকতা থাকে না। তাই নিতান্ত অনিচ্ছুক হয়েই সামান্য কিছু কেনাকাটা করেই সেদিন বাড়ি ফিরে গিয়েছিলো দুজনে। লাঞ্চ আর সিনেমা দেখার প্ল্যান হয়েছিলো বাতিল।

(২)

পরদিন বিকালের দিকে কলেজ থেকে ফিরতি পথে টুসু পৌঁছে গিয়েছিলো রাসবিহারী মোড়ে অবস্থিত গৈরিকের “সেন’স আই” নামক প্রাইভেট ডিটেক্টিভ এজেন্সির ছোট্ট অফিসঘরটিতে। বেশ কিছুদিন ধরে গৈরিকের সাথে তেমন দেখা সাক্ষাৎই হচ্ছে না টুসুর। এর কারণ হল সম্প্রতি গৈরিকের হাতে কোনো উপযুক্ত কেসের অভাব। গোয়েন্দা হিসাবে খ্যাতি বাড়ার সাথে কেমন যেন একটু নাক-উঁচু স্বভাবের হয়ে উঠেছে গৈরিক, ওরফে টুসুর ‘গেরোদা’। ছোট খাটো চুরি ছিনতাই-এর মত কেসে হাত দিতে এখন সে নৈব নৈব চ।

টুসু গৈরিককে বলছিলো তাদের গতকালের ভেস্তে যাওয়া লাঞ্চ আর সিনেমা দেখার প্ল্যানের কথা। কিছুক্ষণ আগেই গৈরিকের অফিসের একমাত্র কর্মচারী রঘুদা তাদের দুজনের জন্য সামনের রেস্তোরাঁ থেকে নিয়ে আসা গরম গরম মিক্সড চাউমিন আর ঠান্ডা ঠান্ডা কোল্ড-ড্রিক্স পরিবেশন করে গিয়েছে। কাটা চামচের সাহায্যে চাউমিন থেকে একটি চিকেনের টুকরো মুখে পুরে টুসু বলে উঠল, “জানো তো গেরোদা, আজ সহেলী কলেজে আসেনি। এখনো বোধহয় ওর দিদির শ্বশুরবাড়িতেই আছে…সত্যিই হার্ট-অ্যাটাকের মত এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আজকাল কত কমন হয়ে উঠেছে, না? একটা জলজ্যান্ত মানুষ কাল অবধি সকলের সাথে হেসে খেলে কাটিয়েছে, কিন্তু আজ আর নেই!”

গৈরিক গম্ভীর মুখে শুনছিলো টুসুর কথাগুলো। কোল্ড-ড্রিংকসের গ্লাস থেকে এক ঢোক গলাধঃকরণ করে সে বলে উঠলো, “ওর দিদির শ্বশুরবাড়ি কোথায় জানিস?”

“বাগুইআটিতে…আরে, গত বছরই তো গিয়েছিলাম কুহেলীদি, মানে সহেলীর দিদির বিয়েতে…” চাউমিনে টমেটো কেচাপ মাখাতে মাখাতে বলতে শুরু করলো টুসু, “জানো গেরোদা কুহেলীদি ডাক্তার, এয়ারপোর্টের কাছে একটা নাম করা বেসরকারী হাসপাতালে কাজ করেন। আর ওর হাজব্যান্ড সোমেশদাও কী যেন একটা বড় কোম্পানির মালিক…”

টুসু যেন আরো কত কিছু বলতে চলছিলো, ঠিক এমন সময় সুর করে বেজে উঠলো ওর মোবাইল ফোনটা। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে যেন একটু বিস্মিত হল টুসু, তারপর ফোনটা গৈরিকের দিকে ঘোরাতেই সে স্পষ্ট দেখতে পেলো যে ফোন করছে স্বয়ং সহেলী।

টুসু ফোনের স্পিকার অন করে কলটা রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে বেশ ভয়ার্ত গলায় সহেলী বলে উঠলো, “ঐন্দ্রিলা শোন না…তুই একবার বলেছিলিস না, যে তোর কোন দাদা আছেন যিনি মস্ত বড় গোয়েন্দা…”

টুসু আরেকটু অবাক হয়ে গৈরিকের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো, “হ্যাঁ বলেছিলাম তো…গেরোদা…মানে গোয়েন্দা গৈরিক সেন…”

তার কথা শেষ না হতেই ফোনের ওপার থেকে সহেলী বলে উঠলো, “আমাকে একবার তার সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারবি রে…”

“তাকে হঠাৎ তোর এত দরকার কেন হল রে? যাই হোক গেরোদা এই মুহূর্তে আমার সামনেই আছে, তুই বল তোর কী দরকার…” বললো টুসু।

এবার বেশ উত্তেজিত গলায় সহেলী বলে উঠলো, “আসলে কিছুক্ষণ আগেই পুলিশ আমার দিদিকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়েছে তার শ্বাশুড়ি মৃন্ময়ী দেবীকে হত্যা করার অভিযোগে…কিন্তু আমি জানি আমার দিদি নির্দোষ…সে কিছুতেই কাউকে খুন করতে পারে না…কিছুতেই না…” কান্নায় ভেঙে পড়লো সহেলী।

বিস্ময়ের এমন পারদ চড়া পরিস্থিতিতে টুসুর মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোলো না। এতক্ষণ পর শোনা গেল গৈরিকের গম্ভীর পুরুষালি কণ্ঠস্বর, “সহেলী, তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার অফিসে এসে আমার সাথে যোগাযোগ করো…আমার অফিসের ঠিকানা হল…”

(৩)

সন্ধ্যার বেশ কিছু পরে গৈরিকের অফিসে উদ্ভ্রান্তের মত প্রবেশ করলো সহেলী। এক গ্লাস ঠান্ডা জল খেয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে সে বিন্দুমাত্র গৌরচন্দ্রিকা না করেই বলতে শুরু করলো, “খুব ধুমধাম করে গত বছরই দিদির বিয়ে হয় ওই বাড়িতে। দিদি বরাবরই পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো, ডাক্তারি পড়ে লাইফ-লাইন মাল্টি-স্পেশালিটি হসপিটালে কাজ করছিলো। জামাইবাবু, অর্থাৎ সোমেশদা বিদেশ থেকে এম.বি.এ করে এসে নিজেদের পৈতৃক ব্যবসা সামলাচ্ছিলেন। মোটের ওপর, ওদের পরিবারকে উচ্চবিত্তই বলা চলে। কিন্তু এত স্বচ্ছলতার মাঝেও দিদির বৈবাহিক জীবন ভালো ছিলো না।”

“কেন? তার বৈবাহিক জীবন খারাপ হওয়ার কারণ কী?” জিজ্ঞাসা করলো গৈরিক।

“তার কারণ হল দিদির শ্বাশুড়ি, মৃন্ময়ী দেবী…অত্যন্ত জাঁদরেল এবং দজ্জাল স্বভাবের ছিলেন ওই মহিলা। বিয়ের পর থেকে দিদিকে একটুও শান্তিতে থাকতে দিতেন না তিনি।”

“কিন্তু তোর দিদির তো দেখাশোনা করেই বিয়ে, তাহলে তাকে মৃন্ময়ী দেবীর অপছন্দ হওয়ার কারণ কী?” জানতে চাইলো টুসু।

“ওনার অপছন্দ দিদিকে ছিলো না…ছিলো দিদির চাকরিটাকে। বিয়ের আগে দিদি স্পষ্ট জানিয়েই দিয়েছিলো যে সে বিয়ের পর চাকরি ছাড়বে না, তখন কিন্তু ওরা সেই কথা মেনেই নিয়েছিলো। কিন্তু বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই পাল্টে গেল ওনার মানসিকতা। ওনার মতে ঘরের বৌদের চাকরি করাটা হল পরপুরুষদের সান্নিধ্যে আসার একটা অছিলা মাত্র! এই নিয়ে দিদির সাথে ওনার নিত্যদিন ঝগড়া-অশান্তি লেগেই থাকতো।”

“মৃন্ময়ী দেবীর মৃত্যুতে হাত আছে বলে পুলিশের তোমার দিদিকে সন্দেহ করার পেছনে শ্বাশুড়ি বৌমার এই বিবাদই কি দায়ী?” গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করে উঠলো গৈরিক।

“হয়তো কিছুটা, তবে বাকি কারণও আছে।” একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে উঠলো সহেলী, “গতকাল সকালে খবর পেয়ে আমরা দিদির শ্বশুরবাড়ি গিয়ে জানতে পারি যে আগেরদিন রাতেই মৃন্ময়ী দেবী হার্ট-ফেল করে মারা যান। সেই মত ডাক্তার এসে স্বাভাবিক মৃত্যু উল্লেখ করে ওনার ডেথ-সার্টিফিকেটও দিয়ে যান। সকলে ব্যস্ত হয়ে ওঠে ওনার মৃতদেহের দাহকার্য সমাপন করতে…কিন্তু…”

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে আবার বলতে শুরু করলো সহেলী, “কিন্তু ওনার দেহ শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেই বাধ সাধলো ওই বাড়ির এক পুরোনো চাকর, শতদল। সে বহু বছর ধরে মূলত মৃন্ময়ী দেবীরই সেবা-শুশ্রূষায় নিযুক্ত ছিলো। সে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করলো, আগত সকল অতিথিদের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে লাগলো যে তার মালকিনের মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়…তাকে নাকি দিদি খুন করেছে!”

“বাহ, একটা অশিক্ষিত চাকর কী বলতে কী বললো, আর পুলিশ কুহেলীদিকে গ্রেফতার করলো!” টুসুর গলায় বিস্ময়ের সুর।

“নারে ঐন্দ্রিলা, তেমনটা নয়, বলছি শোন,” অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো সহেলী, “সে বলছিলো যে বেশ কিছুদিন ধরে দিদির সাথে মৃন্ময়ী দেবীর সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিলো। দুদিন আগে নাকি দিদি রাগের মাথায় মৃন্ময়ী দেবীকে বলেই ফেলে, ‘এখন তো দেখছি আপনি না মরলে আমি এক দণ্ডও শান্তি পাবো না এই বাড়িতে!’…যেহেতু দিদি চাকরি করার সাথেই এম.ডি পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, তাই ওই বাড়িতে তার একটা নিজস্ব পড়ার ঘর ছিলো। ওই ঘরে অন্য কেউ তেমন একটা ঢুকতো না। শতদল বলে যে ওই বাড়িতে দিদির পড়ার ঘর পরিষ্কার করার সময় ডাস্টবিন থেকে একটা ইঞ্জেকশন দেওয়ার সুঁচ এবং কী যেন একটা ওষুধের কৌটো কুড়িয়ে পেয়েছে…সকলকে সেটা দেখাতেই আমরা দেখি যে সেটা হল ‘পটাশিয়াম ক্লোরাইড’!”

“মাই গড!” বলে উঠলো গৈরিক, “এই পটাশিয়াম ক্লোরাইড হল এমনই একটা কেমিক্যাল, যা বেশি মাত্রায় রক্তে ইনজেক্ট করলে সেই মানুষের হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য! আর দুঃখের বিষয় হল, যে শরীরে ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই এই পদার্থটি পটাশিয়াম এবং ক্লোরাইড আওনে বিভাজিত হয়ে যায়, যা একজন মানুষের শরীরে স্বাভাবিকভাবেই উপস্থিত। স্বাভাবিক কারণে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলেও মৃতের রক্তে এই দুটি আওনের পরিমাণ বেড়ে যায়, তাই পোস্ট-মর্টেম থেকে এই পদার্থটি দিয়ে হত্যা করার কথা প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভবই বলা চলে…যদি না মৃতের শরীরে ইঞ্জেকশন দেওয়ার কোনো সাইট পাওয়া যায়, কারণ এই পদার্থ দিয়ে কাউকে হত্যা করতে চাইলে এটিকে যেভাবে হোক সরাসরি মানুষটির রক্তে প্রবেশ করাতে হবে, খাওয়ালে চলবে না!”

সজল চোখে বলে উঠলো সহেলী, “হ্যাঁ গৈরিকদা, এরপর মৃন্ময়ী দেবীর লাশকে পোস্ট-মোর্টেম করে তার ডান হাতে এমনই একটি ইঞ্জেকশন দেওয়ার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়। সব প্রমাণই দিদির বিরুদ্ধে চলে যায়…ডাক্তারি পড়ার সুবাদে ওই কেমিক্যালটির সম্বন্ধে জানা বা ইনজেকশন দেওয়াও তার কাছে কোনো ব্যাপার নয়। তাই আজ সকালে পুলিশ এসে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যায় দিদিকে। কিন্তু আমি নিশ্চিত, যে দিদি এই কাজ কখনো করতে পারে না…তাকে ফাঁসানো হচ্ছে গৈরিকদা…ফাঁসানো হচ্ছে তাকে…”

ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সহেলী, টুসু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকে।

বেশ কিছুক্ষণের নীরবতা ভঙ্গ করে দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলো গৈরিক, “বেশ, আমি নিলাম এই কেসটাকে। তবে তোমার দিদি যদি সত্যিই নির্দোষ হয়ে থাকে, তবেই তাকে বাঁচাতে পারবো আমি…নচেৎ নয়!”

(৪)

পরদিন সকালে গৈরিক আর টুসু ঠিক সময়ে পৌঁছে গিয়েছিলো বাগুইআটি থানায়। কাজের সূত্রে এই থানার ও.সি সাহেবের সাথে গৈরিকের অনেক দিনের আলাপ। গতকাল রাতেই তাকে ফোন করে আজ সকালে কুহেলী দেবীর সাথে একবার দেখা করার অনুমতি পেয়েছে গৈরিক। পুলিশ মহলে গৈরিকের এখন যা নাম, তাতে যেকোনো থানায় এলেই তার আর টুসুর প্রতি খাতির যত্নের অভাব রাখেন না ইন্সপেক্টর সাহেবরা। এই ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি।

কুহেলী দেবীর গ্রেফতার হওয়ার ঘটনার কথা বলতে বলতে ও.সি সাহেব বলেই ফেললেন, “দেখুন গৈরিক বাবু, আপনি যদি এই কেসের মধ্যেও কোনো রহস্য খুঁজে পান, বা কুহেলী দেবীকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আমার থেকে খুশি বোধহয় আর কেউ হবে না। তার কারণ আমি নিজেও আপনার রহস্য উদ্ঘাটনের ক্ষমতার গুণমুগ্ধ ভক্ত। কিন্তু এই কেসে হয়তো তার চান্স খুব কম…”

টুসু যেন একটু আশাহত হল এই কথা শুনে, সে বলে উঠলো, “আপনার এমন কথা কেন মনে হচ্ছে স্যার?”

ম্লান হাসি হেসে বলে উঠলেন ও.সি সাহেব, “তার কারণ আজ সকালে ওই ওষুধের ভায়েল এবং ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জের গা থেকে তোলা ফিঙ্গার-প্রিন্টের রিপোর্ট চলে এসেছে, এবং বলা বাহুল্য সেখানে শুধুমাত্র কুহেলী দেবীরই আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে!”

টুসু একবার তাকিয়ে দেখলো অদূরে মাথা নত করে বসে থাকা কুহেলী দেবীর দিকে। এমন সংকটময় পরিস্থিতিও তার সুন্দর রূপের জোয়ারে কোনো ভাটা ফেলতে পারেনি। গৈরিক তাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো, “মৃন্ময়ী দেবীর মৃত্যুর পেছনে আপনার কি কোনো হাত আছে?”

“না।” অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন কুহেলী দেবী।

“তাহলে পটাশিয়াম ক্লোরাইডের ওই কৌটো আর ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ আপনার পড়ার ঘরে এলো কী করে?”

“জানি না।” বললেন কুহেলী দেবী।

“ওই সিরিঞ্জ আর কেমিক্যালের কৌটোর গায়েই বা আপনার ফিঙ্গার-প্রিন্ট এলো কী করে?” পাল্টা প্রশ্ন টুসুর।

“জানি না।” এক উত্তর কুহেলী দেবীর।

“এই কথা কি ঠিক, যে আপনার সাথে মৃন্ময়ী দেবীর সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিলো না? আপনি বলেছিলেন যে তার মৃত্যু না হওয়া অবধি আপনি শান্তি পাবেন না?” আবার জিজ্ঞাসা করলো টুসু।

“হ্যাঁ।” নতমুখে বললেন কুহেলী দেবী।

“অন্য কাউকে কি কোনো সন্দেহ হয় আপনার?” জিজ্ঞাসা করলেন ও.সি সাহেব।

“না।” ফের সংক্ষিপ্ত উত্তর কুহেলী দেবীর।

টুসু যেন আবারও খুব আশাহত হল এই কথাবার্তাগুলি শুনে। কেন জানি না কুহেলীদিকে বাঁচাবার খুব একটা আশার আলো তার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। তাছাড়া কুহেলীদিও যেন খুব একটা সাহায্য করতে চাইছেন না তাদের। এরপর আর বেশি দাঁড়ায়নি তারা থানায়। সেখান থেকে দুপুরের খাবার খেতে সোজা চলে গিয়েছিলো থানার নিকটবর্তী একটা রেস্টুরেন্টে। টুসু লক্ষ করলো যে কেমন যেন গম্ভীর হয়ে উঠেছে গেরোদা। তবে রেস্টুরেন্টের এসি ঘরে বসে ফ্রাইড-রাইসের সাথে চিলি-চিকেনের গ্রেভিটা চামচের সাথে মাখাতে মাখাতে একটা কথাই সর্বদা ঘুরপাক খাচ্ছিলো টুসুর মাথায়…কেউ কি নিজে হাতে কারোর শরীরে বিষাক্ত ইঞ্জেকশন দিয়ে সেই সিরিঞ্জ কৌটো ইত্যাদি নিজের ঘরের ডাস্টবিনে ফেলে রাখার মত নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেবে, তাও আবার নিজে একজন ডাক্তার হয়ে!

(৫)

বাগুইআটিতে অবস্থিত মৃন্ময়ী দেবীর বাড়িটি সত্যিই দেখার মত। আধুনিক ধাঁচে গড়া তিনতলা বিশাল বাড়ি, তার চারিদিকে ফুলের বাগান, মাঝে জলের ফোয়ারা, গেটে নিযুক্ত দারোয়ান। সহেলীর কথামত ওরা যে সত্যি উচ্চবিত্ত সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মৃন্ময়ী দেবীর স্বামী স্বর্গীয় অনিরুদ্ধ বসু ছিলেন বসু ইলেক্ট্রিক্যালস লিমিটেড নামক কোম্পানির কর্ণধার। হাওড়ার ডোমজুড়ে অবস্থিত তাদের ফ্যাক্টরি। মৃত্যুর আগে অবধি এই সমস্ত সম্পত্তির মালকিন ছিলেন মৃন্ময়ী দেবী, তবে বাবার অসম্ভবে ব্যবসার দেখাশোনা বরাবরই করে আসছেন তাদের একমাত্র ছেলে সোমেশ বসু।

চোখ ধাঁধানো আসবাসপত্রের সরঞ্জামের মাঝে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ড্রইং রুমের সোফার ওপর বসেছিলো গৈরিক আর টুসু। যদিও বা তারা আসায় খুব একটা খুশি হয়নি এই বাড়ির লোকজন, তবুও মিষ্টি সমেত নানাবিধ সুখাদ্য ইতিমধ্যেই পরিবেশন করা হয়েছে তাদের সামনে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সোমেশবাবু এসে নমস্কার জানিয়ে বসলেন তাদের সামনে। খুব সুদর্শন না হলেও, তার চেহারার মধ্যে বেশ একটা পুরুষালি গাম্ভীর্যের মাধুর্য আছে যা যে কোনো নারীর পক্ষে কম আকর্ষণীয় নয়। এর মধ্যেই তিনটে গরম কফির মাগ নিয়ে হাজির হল একটি চাকর গোছের লোক…এই কি তবে শতদল, ভাবলো টুসু।

“মায়ের সাথে ওর ছোটখাটো কথাকাটাকাটি প্রায়শই চলতো…তা সে কোন বাড়িতে হয় না বলুন…” শোকস্তব্ধ কণ্ঠস্বরে বলে চলেছিলেন সোমেশবাবু। গৈরিক কফিতে চুমুক দিয়ে তাকে সামনে রাখা প্লেট থেকে মিষ্টি অফার করলে তিনি বলে উঠলেন, “নো থ্যাংকস মিস্টার সেন…জাস্ট এ মিনিট, আমি একটু টয়লেট থেকে আসছি।” কিছুক্ষণ পর তিনি ফিরে এসে আবার আগের অসমাপ্ত কথাটি বলতে শুরু করলেন, “কিন্তু ও যে মায়ের এই পরিণতি ঘটাবে, তা কে জানতো বলুন!”

টুসু জিজ্ঞাসা করলো, “তার মানে আপনি মেনেই নিয়েছেন যে আপনার স্ত্রীই আপনার মাকে খুন করেছেন?”

“কথাটা না মানতে পারলেই বোধহয় স্বস্তি পেতাম, কিন্তু সব প্রমাণই যে কুহুর বিরুদ্ধে!” বললেন সোমেশবাবু।

“বিয়ের আগে নিশ্চয় কুহেলী দেবী আপনাদের জানিয়েছিলেন যে তিনি চাকরি ছাড়বেন না, তখন তো মেনে নিয়েছিলেন তার কথা। তাহলে এখন তাকে চাকরি ছাড়ার কথা বলছিলেন কেন আপনার মা?” জিজ্ঞাসা করলো গৈরিক।

“দেখুন গৈরিকবাবু, মা কিন্তু ওকে কখনই বলেননি নিজের কেরিয়ার বিসর্জন দিতে। ওই হাসপাতালের চাকরি আর পাঁচটা চাকরির মত দশটা-পাঁচটার কাজ নয়, বেশিরভাগ দিনই ও বেশ রাত করে বাড়ি ফিরতো। সংসার বা আমার প্রতি খুব একটা সময় দিতে পারতো না। এই সব কথা তো আর বিয়ের আগে বোঝা যায়নি। তাই ওকে মা বলেছিলেন ওই চাকরি ছেড়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে, আমরা সমস্ত ব্যবস্থা করে দিতাম। কিন্তু ও কানে নিলে তো আমাদের কোনো কথা!” সোমেশবাবুর গলায় আক্ষেপের সুর।

“যে রাত্রে আপনার মায়ের মৃত্যু হয়, কুহেলী দেবী নিশ্চয় আপনার সাথেই বেডরুমে শুয়েছিলেন সেই দিন। আপনি কি তার কোন গতিবিধি টের পেয়েছিলেন সেই রাতে?” দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো গৈরিক।

“না, সেদিন খুব ক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ফিরেছিলাম, তাই বিছানায় পড়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়ি…” স্পষ্ট গলায় বললেন সোমেশবাবু।

“ঠিক আছে, আমি একটু মৃন্ময়ী দেবীর ঘরটা দেখতে চাই, আর শতদলের সাথেও কথা বলতে চাই।” বললো গৈরিক।

সোমেশবাবু তৎক্ষণাৎ শতদলকে সেই ব্যবস্থা করতে বললেন, তারপর আরেকবার টয়লেট যাওয়ার কথা বলে কিছুক্ষণের জন্য অব্যাহতি চেয়ে নিলেন। তিনি চলে গেলে টুসু মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলে উঠলো, “ওনার তো একটু বেশিই পায় দেখছি, তাই না গেরোদা!”

(৬)

নিতান্ত জড়সড় হয়েই গৈরিক আর টুসুর সামনে হাত জোড় করে এসে দাঁড়ালো বাড়ির চাকর শতদল। বয়শ আন্দাজ পঞ্চাশের ওপর, টাক মাথা, স্বাস্থ্য ভালো, গায়ের রং কালোর দিকেই। চোখে মুখে শোক আর আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। সরাসরি তাকে প্রশ্ন শুরু করলো গৈরিক, “কতদিন ধরে আছো তুমি এই বাড়িতে?”

“আজ্ঞে বাবু, প্রায় দশ বছর হল।” আড়ষ্ট কণ্ঠে জানালো শতদল।

“তোমার সেদিন কেন মনে হল যে কুহেলী দেবীই মৃন্ময়ী দেবীকে খুন করে থাকতে পারেন?” পাল্টা প্রশ্ন টুসুর।

“বৌমণির সাথে মা ঠাকরুনের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না বাবু। রোজ ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকতো। একদিন তো উকিলবাবুর সামনেই বৌমণি মা ঠাকরুনকে বলে দিলেন যে তিনি না মরলে বৌমণি এক দণ্ডও শান্তি পাবেন না। তারপর সেদিন সকালে ওনার পড়ার ঘর ঝাঁট দেওয়ার সময় ওই ওষুধের কৌটো আর ইনজেকশন...” শতদলের কথা শেষ হওয়ার আগেই টুসু বলে উঠলো, “এই উকিলবাবুটি কে?”

“আজ্ঞে, ওনার নাম শ্রীকান্ত শ্রীমানি। মা ঠাকরুনের অনেক দিনের চেনা মানুষ তিনি। মা ঠাকরুনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজে নানা পরামর্শ দিতে আসতেন তিনি।” বলে উঠলো শতদল।

এবার আরও আশ্চর্য হওয়ার পালা টুসুর। সে বললো, “এতক্ষণ তো জানতাম যে মৃন্ময়ী দেবীর মালিকানা ছিল বসু ইলেক্ট্রিক্যালস লিমিটেড কোম্পানির ওপর... এখন যে শুনছি ওনার কোন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও আছে!”

এতক্ষনে সোমেশবাবু আবার চলে এসেছেন তাদের কাছে। শতদলের হয়ে তিনিই বলে উঠলেন, “ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নাম হল ‘স্পন্দন’... মূলত সমাজের পিছিয়ে পরা মেয়েদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে ওই সংস্থা। আসলে ওটা ঠিক মায়ের কোম্পানি নয়...মা ছিলেন ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বার। অপর মেম্বার হলেন মায়েরই প্রিয় বান্ধবী আরতি দেবী।”

“ওই সংস্থার সম্বন্ধে আমার সমস্ত ডিটেল চাই, মিস্টার বসু... আর এখন আপাতত মৃন্ময়ী দেবীর ঘরটি দেখতে চাই।” বলে উঠলো গৈরিক।

কুহেলী দেবীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে মৃন্ময়ী দেবীর বেডরুমকে সিল করেছে পুলিশ। তবে বাগুইআটি থানায় ফোন করে গৈরিককে নিয়ে সেই ঘরে ঢোকার অনুমতি খুব সহজেই পেলেন সোমেশবাবু। সাজানো-গোছানো সুদৃশ্য ঘরটি, রয়েছে দামি কাঠের গদিওয়ালা বিছানা, নানা বইপত্র এবং শো-পিসে ঠাসা শো-কেস, একটি পড়ার টেবিল এবং বিছানার সামনে দেওয়ালে আটকানো বিশাল সাইজের এল.ই.ডি টিভি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঘরের নানা জায়গা পর্যবেক্ষণ করে গৈরিক এলো টেবিলের কাছে। সেখানেও রয়েছে বেশ কিছু বই, একটি ডায়েরি, টেবিল ল্যাম্প এবং একটি প্লাস্টিকের ট্রের ওপর রাখা বেশ কয়েকটা ওষুধের স্ট্রিপ।

গৈরিক একটি ওষুধের প্যাকেট তুলে নিয়ে দেখলো যে সেটার প্রধান উপকরণ হল ‘লোপেরামাইড’। বেশ আশ্চর্য হয়ে গৈরিক জিজ্ঞাসা করলো, “মৃন্ময়ী দেবী কি খুব পেটের সমস্যায় ভুগতেন...যেমন লুজ মোশন?”

পাশে দাঁড়ানো সোমেশবাবু বলে উঠলেন, “আসলে মাস ছয়েক আগে মায়ের গল-ব্লাডারে স্টোন ধরা পরে, তাই সার্জারি করে ওই অঙ্গটি শরীর থেকে বাদ দিতে হয়। এরপর থেকে মাঝে মাঝেই মা ডায়েরিয়ায় ভুগতেন। তাই ওই ওষুধ, আর কী...”

এবার গৈরিক তুলে নিলো পাশে রাখা মৃন্ময়ী দেবীর ডায়েরিটা। বেশির ভাগই ব্যাবসার নানা হিসাব নিকাশ, কিছু মানুষের নাম সহ ফোন নাম্বার, কিছু অ্যাপয়েন্টমেন্টের তারিখ এবং সময়, কয়েকটি রান্নার রেসিপি এবং ইংরাজি হরফে লেখা বেশ কিছু কবিতা রয়েছে তার পাতায়। গৈরিক বেশ উৎসাহিত হয়ে বলে উঠলো, “বাহ, মৃন্ময়ী দেবী আবার লেখালিখি করতেন বুঝি?”

ম্লান হেসে সোমেশবাবু বললেন, “হ্যাঁ, বেশিরভাগই ইংরাজিতে লিখতে পছন্দ করতেন। আসলে ওনার ছোটবেলাটা কেটেছিল বেশ দারিদ্রের মধ্যে, বেশি দূর পড়াশোনাও করতে পারেননি। ওনার খুব ইচ্ছা ছিল ইংরাজি সাহিত্য নিয়ে পড়ার, কিন্তু তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই বোধহয় সেই সাধ মেটাতেই এই লেখালিখি...”

“আপনার মায়ের বাপের বাড়ি কি কলকাতাতেই?” জিজ্ঞাসা করলো টুসু।

“না, মায়ের মুখে শুনেছিলাম ওনাদের বাড়ি ছিল কাটোয়ার দেবগ্রামে। তার খুব অল্প বয়সেই আমার দাদু দিদা মারা যান। পেটের টানে তিনি খুব অল্প বয়সেই কলকাতায় চলে আসেন, একটা ছোটোখাটো চাকরি পান আমাদের কোম্পানিতে। সেই সূত্রেই বাবার সাথে আলাপ, প্রেম এবং অবশেষে বিয়ে।” শেষ কথাগুলো বলতে গিয়ে যেন দুই চোখ ছলছল করে উঠলো সোমেশবাবুর।

“এই ডায়েরিটা কি আমি কিছুদিনের জন্য রাখতে পারি?” জিজ্ঞাসা করলো গৈরিক।

“শিওর,” জানালেন সোমেশ বাবু।

(৭)

বসু-বাড়ির সকলকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলো গৈরিক আর টুসু। বাইরে এখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়েছে। বাড়ির সুবিশাল গেটের কাছে আসতেই ওরা দেখলো যে বাড়ির দারওয়ানটি নিজের জায়গায় বসে ঘুমে ঢুলছে।

“এই ভর সন্ধ্যা বেলাতেই যদি এত ঘুম পায়, তাহলে রাতে কী করো, হ্যাঁ? “, গৈরিকের দৃঢ় কণ্ঠস্বর শুনে তন্দ্রাচ্যুত হয়ে ধড়মড়িয়ে সচকিত হল দারওয়ানটি। সে করুণ সুরে হাত জোড় করে বলে উঠলো, “আজ্ঞে বাবু, কিছুদিন থেকে মেয়ের জ্বরটা একদম কমছে না…সকালে ডাক্তার বাড়ি করতে যা পরিশ্রম হল, তাই চোখটা একটু লেগে এসেছিলো…নাহলে বাবু আমার মত পাহারা আর এই তল্লাটের কোনো দারোয়ানই দেয় না!”

টুসুর বেশ মজা লাগছিলো দারওয়ানটির অঙ্গভঙ্গি দেখে। সে তাকে আরো চটানোর জন্য বললো, “এই বাজে কথা রাখো তো…নাম কী তোমার? তুমি যে কত ভালো পাহারা দাও তা বোঝাই যাচ্ছে!”

“আমার নাম বিমল দিদিভাই...বিমল দাস।” বেশ রাগী সুরে বললো লোকটা, “আর বাজে কথা আপনি বলছেন! একদিন একটু ঢুলতে দেখে রোজ ডিউটিতে ঘুমোয় তা বুঝে গেলেন!”

“ও আচ্ছা, ঘুমাও না বুঝি? তা বলুন তো বিমল বাবু, এই বাড়ির লোকেরা বাদে আর কাউকে কখনো আসতে যেতে দেখেছেন এখানে?” আবারও টুসুর গলায় কৌতুকের সুর।

এবার যেন কেমন গম্ভীর হয়ে উঠলো বিমল, তারপর একটা ঢোক গিলে বললো, “হ্যাঁ, একজন মুসলমান মহিলা প্রায় আসতো মা ঠাকরুনের সাথে দেখা করতে!”

“সে কী! কে সে?” টুসুর গলায় কৌতুক কেটে গিয়ে এখন অপার বিস্ময়ের সুর।

“জানি না দিদি…সবসময় কালো বোরখায় নিজের সমস্ত চেহারা ঢেকে আসতো। তাই তার মুখ দেখতে পাইনি কখনো। প্রায় দিন সন্ধ্যার দিকেই বেশিরভাগ আসতো।” অস্ফুট কণ্ঠে বললো বিমল।

“শুধু তোমার মা ঠাকরুনের সাথেই সে দেখা করতে আসতো, নাকি বাড়ির অন্য কারোর সাথেও…” বলে উঠলো গৈরিক।

“না বাবু, সে সন্ধ্যার দিকে আসতো…তখন মা ঠাকরুন একা থাকতেন। দাদাবাবু আর বৌদিমণি তো সেই সময় নিজের কাজের জায়গায় থাকেন, আর শতদল তো কাজ শেষ করে দুপুরের একটু পরেই বেরিয়ে যায়!”

এবার সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো গৈরিক, “যেদিন রাতে মৃন্ময়ী দেবী খুন হন, সেদিন সন্ধ্যাতেও নিশ্চয় তুমি ডিউটিতে ছিলে?”

“হ্যাঁ বাবু।” বলে উঠলো বিমল।

“ঠিক কে কে এসেছিলো সেদিন এই বাড়িতে?” পাল্টা প্রশ্ন গৈরিকের।

“সেদিন সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ মা ঠাকরুন আমাকে বেশ কিছু ছোট বড় কাজের জিনিস কিনে আনতে বললেন…এই যেমন কিছু আনাজ-পত্র, মশলাপাতি, কাপড় কাচার সাবান, ওনার কিছু কসমেটিকস সামগ্রী ইত্যাদি…ইদানিং শতদল বাইরের কাজ করতে চাইতো না, তাই আমাকেই এইসব করতে হত। এই দোকান সেই দোকান করতে করতে আমার ফিরে আসতে সাড়ে নটা বেজে গিয়েছিলো।”

“তারপর?” জিজ্ঞাসা করলো গৈরিক।

“আমি ফিরে গেটের কাছে আসতেই মা ঠাকরুন তিনতলায় ওনার শোয়ার ঘরের বাইরের রেলিং-এ এসে বললেন, ‘জিনিসপত্র সব স্টোররুমে রেখে ডিউটিতে বসে যাও। কাল সকালে আমি সব হিসাবপত্র বুঝে নেবো’…আমি জিনিসগুলো রেখে এসে আবার গেটের বাইরে বসে পড়লাম। তার কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম সেই মুসলমান মহিলা তড়িঘড়ি বাড়ির বাইরে এসে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল।” উত্তেজিত কণ্ঠে বললো বিমল।

টুসু দেখলো গৈরিকের মুখটা ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে উঠলো, সে বললো, “একটা শেষ প্রশ্ন…সেই সময় কি সোমেশবাবু বা কুহেলী দেবী বাড়ি ছিলেন?”

“না বাবু, শুনেছিলাম যে দাদাবাবুর অফিসের কোনো পরিচিত লোক বেশ কিছুদিন বৌদিমণির হাসপাতালে ভর্তি থেকে সেদিন রাতেই মারা যান। তাই সেদিন রাতে দুজনেই একসাথে বেশ দেরি করে হাসপাতাল থেকে ফেরেন…ওই সাড়ে দশটা নাগাদ!” উত্তর দিলো বিমল।

(৮)

এরপর প্রায় দুইদিন গৈরিকের সাথে তেমন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি টুসুর। হঠাৎ করেই গৈরিকের মায়ের ব্লাড-প্রেসারের সমস্যা দেখা দেয়, তাই তাঁকে নিয়েই খুব ব্যস্ত হয়ে পরে সে। বন্ধ হয়ে যায় তদন্তের কাজ, আর তার সাথেই বিনিদ্র রজনী কাটায় টুসু। কেসটা প্রথম থেকে মনে হচ্ছিল ওপেন অ্যান্ড শাট, সমস্ত সন্দেহ জাগছিলো কুহেলীদির ওপরই। কিন্তু বোরখা-ধারী মুসলমান রমণী ফিল্ডে নেমেই রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে টুসুর! কে এই মহিলা? তার সাথে কি কোনো সম্পর্ক আছে মৃন্ময়ী দেবীর মৃত্যুর?

এখন অবশ্য সুস্থ আছেন গৈরিকের মা। তাই পরের দিন আবার পুরো উদ্যমে কেস নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করে সে, তার আর টুসুর আজকের গন্তব্যস্থল হল ‘স্পন্দন’ নামক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। তারাতলার ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট ছাড়িয়ে আরও ভেতরের দিকে অবস্থিত একটি অতি পুরনো আমলের বাড়িতে স্থাপিত এই দুস্থ নারীদের পুনর্বাসন কেন্দ্রটি। বাড়িটির আশেপাশে তেমন অপর কোনও বাড়ি ঘর বা জনবসতি নেই। ঝোপঝাড়ে ভরা জঙ্গলাকীর্ণ জমি চারপাশে। বাড়িটির তিনতলার অফিসঘরটি মোটামুটি যুৎসই। সেখানেই আরতি দেবীর বসার জায়গা। তবে দিনের খুব বেশিরভাগ সময় তিনি এখানে কাটান না।

মাঝারি চেহারার মাঝবয়সী সদা হাস্যময়ী আরতি দেবী গৈরিক আর টুসুর জন্য চা বা কফি আনাতে চাইলে, তারা বিনম্রভাবে মানা করলো। মৃন্ময়ী দেবীর সম্বন্ধে আরতি দেবী বলে চলেছিলেন, “ভাবতেই পারছি না যে মিনু (মৃন্ময়ী দেবী) আর আজ আমাদের মধ্যে নেই! বৌমার হাতে শ্বাশুড়ি খুন, কী ভয়ানক ব্যাপার বলুন তো মিস্টার সেন! বিগত দশ-বারো বছর ধরে মিনু আমাদের আরেকজন ট্রাস্টি...আর আজ তার এই পরিণতি...”

আরতি দেবীর কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে সেই ঘরে প্রবেশ করলো একজন মহিলা। চেহারা দেখে মনে হল, যে সে হয়তো এখানকার কোনও পরিচারিকা হবে। আরতি দেবী তার এই আচরণে বিরক্তি ভরে কিছু একটা বলতে চলেছিলেন, কিন্তু তার আগেই উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো সেই মহিলা, “ক্ষমা করবেন দিদি, আপনার অনুমতি না নিয়েই এখানে চলে এলাম...আসলে আজ সকাল থেকে আমিনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!”

“সে কী!” চিৎকার করে উঠলেন আরতি দেবী, “তোমরা ঠিক করে খুঁজে দেখেছ তো সব জায়গা...”

অপর মহিলার উত্তর দেওয়ার আগেই টুসু বলে উঠলো, “এই আমিনাটা কে?”

উৎকণ্ঠার সাথে বলে উঠলেন আরতি দেবী, “আসলে কয়েক মাস আগে সোনাগাছির একটি রেড-লাইট এলাকায় পুলিশে রেড করে বেশ কিছু মহিলাকে থানায় তুলে নিয়ে যায়। তারা ছাড়া পাওয়ার পর আমাদের সংস্থা তাদের দিকে সাহায্যের হাত বারিয়ে দেয়। এই মেয়েগুলির মধ্যেই একজন ছিল আমিনা...মানে আমিনা খাতুন। মুসলমান মেয়ে, পেটের দায়ে এই লাইনে আসতে বাধ্য হয়েছে। এই কেসটা নিয়ে প্রধানত মিনুই কাজ করেছিলো, ওর কথামত আমিনাকে এখানেই থাকতে দেওয়া হয়!”

উত্তেজনায় টুসুর বুক দুরুদুরু করে উঠলো, সে বললো, “আর এই আমিনা নিশ্চয় সবসময় বোরখা ব্যবহার করতো...আপনারা নিশ্চয় কেউ তার মুখ দেখেননি, তাই তো?”

বিস্মিত হয়ে আরতি দেবী বলে উঠলেন, “হ্যাঁ ঠিক...কিন্তু তুমি কী করে জানলে ভাই?”

টুসু কোনো উত্তর দিলো না সেই প্রশ্নের, শুধু বিস্ফারিত চোখে গৈরিকের দিকে চেয়ে দেখলো যে তার কপালে দেখা দিয়েছে চিন্তার ভাঁজ!

(৯)

হাওড়ার ডোমজুড়ে অবস্থিত মাঝারি আয়তনের কারখানাগুলির মধ্যে একটি হল বসু ইলেক্ট্রিক্যালস লিমিটেড। পরদিন সকালে এখানেই এসেছে গৈরিক আর টুসু। কারখানার গেটের ভেতরে প্রবেশ করতেই সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের এক কর্মচারী তাদের পৌঁছে দিয়ে গেল সুসজ্জিত রিসেপশনে। টুসু এখনো বুঝতে পারছিলো না, যে এই স্থানে গৈরিক কীসের তদন্ত করতে এসেছে। অতিরিক্তি প্রসাধনীতে বেষ্টিত চটকদার চেহারার রিসেপসনিস্ট-এর দিকে দৃষ্টি আকর্ষিত হল টুসুর। সিকিউরিটি গার্ডটির কাছেই তারা জেনেছে যে এই মেয়েটির নাম হল রুমেলা মজুমদার।

গৈরিক রুমেলাকে বললো, “আমরা মিস্টার সোমেশ বসুর সাথে দেখা করতে চাই…একটু ইনফর্ম করে দিন প্লিজ…”

মেয়েটি বেশ আশ্চর্য হয়ে গৈরিককে বলে উঠলো, “আজকে তো স্যার ছুটিতে আছেন…আজ কী করে ওনার সাথে আপনাদের দেখা হবে!”

হতাশ গলায় গৈরিক বলে উঠলো, “আসলে আমরা একটা কনসালটেন্সি থেকে আসছি, আমরা বিভিন্ন কোম্পানিতে কর্মচারী সাপ্লাই করে থাকি। গতকাল খবরের কাগজে দেখলাম যে মিস্টার বসু ওনার পি.এ নিযুক্ত করার জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, সেই বিষয়েই ওনার সাথে কথা বলার ছিলো…”

“আসলে সোমেশ স্যার কয়েক মাস ধরে কিছু উরিনারি সমস্যায় ভুগছেন, আজ ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন চেক-আপ করাতে…আপনারা বরং কালকে একবার আসুন, তবে অবশ্যই ওনাকে ফোন করে আসবেন!” মিষ্টি হেসে বললো রুমেলা। তারপর সোমেশ বাবুর একটা কার্ড তুলে দিলো গৈরিকের হাতে।

টুসু মুচকি হেসে নিজের মনেই বলে উঠলো, “সোমেশ বাবুর এই সমস্যার কথা তো সেদিন ওনার বার বার টয়লেট যাওয়া দেখেই বুঝতে পেরেছি!”

“ওকে থ্যাংকস ম্যাডাম।” হাসিমুখে বললো গৈরিক, “তবে একটা কথা…আগের পি.এ হঠাৎ করে চাকরি ছাড়তে গেলেন কেন…মানে কোনো স্যালারি রিলেটেড ইস্যু ছিলো কি?”

“এ বাবা, না না,” জিভ কেটে বলে উঠলো রুমেলা, “সোমেশ স্যারের আগের পি.এ শুভঙ্কর বাবু এখানকার অনেক বছরের কর্মচারী ছিলেন…দুর্ভাগ্যজনকভাবে বার্ধক্যজনিত কিছু সমস্যা নিয়ে বেশ কিছু দিন ভুগে তিনি মারা গেলেন ঠিক সেই দিনই যেদিন রাতে মৃন্ময়ী ম্যাডাম মারা যান। সোমেশ স্যারের বড্ড কাছের মানুষ ছিলেন তিনি, ভর্তিও ছিলেন সেই হাসপাতালে যেখানে কুহেলী ম্যাডাম কাজ করতেন। স্যার খুব চেষ্টা করেছিলেন ওনাকে বাঁচানোর, কিন্তু…”

“ওহ, আই অ্যাম সো সরি। আচ্ছা চলি তাহলে…” এই বলে নমস্কার জানিয়ে টুসুকে নিয়ে রিসেপশন থেকে বেরিয়ে গেল গৈরিক। এতক্ষণ পর টুসুর মনে পড়লো যে তাহলে এই শুভঙ্কর বাবুই হলেন সোমেশ বাবুর অফিসের সেই কর্মচারী যার মৃত্যুর কথা তাদের আগেই দারোয়ান বিমল বলেছে!

ফ্যাক্টরির গেট থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে টুসুর মাথায় যেন সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগলো। কত অসংখ্য চরিত্র ধীরে ধীরে যুক্ত হয়ে উঠেছে একটি মৃত মানুষকে কেন্দ্র করে। শেষমেষ গেরোদা পারবে তো এই কেসটার কোন একটা সুরাহা করতে? সত্যি বাবা, গোয়েন্দা হওয়া যে মুখের কথা নয়!

(১০)

শোভাবাজার জেটির কাছে রেল-লাইন টপকে পুতুলবাড়ির সামনে দিয়ে এগিয়ে চলছিলো গৈরিক আর টুসু। সময়টা পরের দিন সকালবেলা। এদিকে বেশ কিছু পুরোনো আমলের বাড়ি চোখে পড়ে। তেমনই একটি বাড়ির কাছে এসে বহু পুরোনো কলিং বেলের সুইচে আঙুলের চাপ দিলো গৈরিক। বাড়ির ভেতরে থেকে দরজা খুলে, একজন চাকর গোছের লোক গৈরিক আর টুসুকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালো একটি বৈঠকখানার ঘরে। ঘরটির চারিপাশে সো-কেসে ঠাসা আইনের বই, কারণ বাড়িটির মালিক হলেন অ্যাডভোকেট শ্রীকান্ত শ্রীমানি। তার সাথে দেখা করতে আসার কথা আগেই জানিয়ে রেখেছিলো গৈরিক।

একটি অল্প বয়সী ছেলে শ্রীকান্তবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করে। তার সাথে কথা বলে টুসু জানলো যে তার নাম হল মৈনাক মিত্র। ছেলেটি সদ্য ওকালতি পাশ করেছে এবং কাজে কর্মে বেশ দক্ষ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধবধবে পাঞ্জাবী পাজামা পরিহিত শ্রীকান্ত বাবু প্রবেশ করলেন ওনার অফিস ঘরে। লোকটির বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হলেও তাকে অপূর্ব সুন্দর দেখতে। যেমন শরীরের গঠন, তেমন উচ্চতা আর তেমনই গায়ের রঙ। তার মানে শতদলের কথামত ইনিই হলেন মৃন্ময়ী দেবীর পরিচিত ‘উকিল বাবু’, ভাবলো টুসু। তিনি ঘরে প্রবেশ করলেই মৈনাক বললো, “আপনারা কথা বলুন, আমি একটু বাইরে থেকে আসি…” এই বলে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

খুব বেশি গৌরচন্দ্রিকা না করে গৈরিক শ্রীকান্তবাবুকে বলে উঠলো, “সেদিন কোন প্রসঙ্গে কুহেলী দেবী বলেছিলেন যে মৃন্ময়ী দেবী মরলে তিনি বাঁচেন?”

শ্রীকান্তবাবু কিছু বলার আগেই চায়ের ট্রে হাতে সেখানে প্রবেশ করলেন এক মাঝ-বয়সী সুন্দরী মহিলা। তার দিকে ইঙ্গিত করে শ্রীকান্তবাবু বলে উঠলেন, “আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, ও হল আমার স্ত্রী, তাপসী।”

তাপসী দেবী গৈরিকদের নমস্কার জানিয়ে সবাইকে চায়ের কাপ পরিবেশন করে সেখান থেকে বিদায় নিলেন। তারপর পূর্বেকার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য শ্রীকান্তবাবু বলে উঠলেন, “সেদিন মৃন্ময়ী দেবী আমাকে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বেশিরভাগ দিন তিনি ওনার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নানা কাজেই আমাকে ডেকে পাঠান। তবে সেদিন একটি সম্পূর্ণ অন্য কথা জানতে চাইলেন!”

“কী কথা?” টুসুর কণ্ঠে কৌতূহল।

“তিনি বলেছিলেন যে তিনি চান না যে তার সম্পত্তির কানাকড়িও তার বৌমা কুহেলী পাক। অথচ সোমেশকে সম্পত্তির অধিকারী করলে, স্বাভাবিকভাবেই তার স্ত্রী হিসাবে কুহেলী এর উত্তরাধিকারী হবে। তাহলে শুধু সোমেশকে সম্পত্তির মালিক করে, কুহেলিকে কোনো ভাবে বঞ্চিত করার কোনো পন্থা আছে কি না!”

“মাই গড, উনি এতটা অপছন্দ করতেন কুহেলীদিকে!” বলে উঠলো টুসু।

“আমি ওনাকে বলতেই চলেছিলাম যে এর খুব একটা সুরাহা আমার জানা নেই…ঠিক এমন সময় কুহেলী সেখানে উপস্থিত হল। সে বোধহয় দরজার পর্দার আড়াল থেকে শুনছিলো সব কথা। রাগের মাথায় সে চিৎকার করে উঠলো মৃন্ময়ী দেবীর ওপর…আর তখনই সে বলে ওই কথাগুলো।” বললেন শ্রীকান্তবাবু।

“কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর মৃন্ময়ী দেবীর মনোবাসনা পূরণ হল কই!” আক্ষেপের গলায় বললো গৈরিক।

“কিছুটা হলেও কিন্তু হয়েছে, এখন আর কুহেলী ওনার সম্পত্তির কোনো ভাগ পাবে না…” সকলকে অবাক করে বলে উঠলেন শ্রীকান্তবাবু, “কারণ মৃত্যুর আগে তিনি আরেকবার এসেছিলেন আমার কাছে। আর উইল করে তার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি তিনি দিয়ে যান আমার নামে!”

এই কথা শুনে টুসুর বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার মত অবস্থা। গৈরিক অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বলে উঠলো, “ব্যাপারটা খুব আশ্চর্যজনক নয় কি?”

প্রত্যুত্তর দেওয়ার আগে শ্রীকান্তবাবু উঠে গিয়ে পাশের একটি দেরাজ খুলে একটি উইল বার করে গৈরিকের সামনে রেখে বললেন, “অফ কোর্স, আমিও চমকে উঠেছিলাম ওনার এই প্রস্তাব শুনে…কিন্তু এই বয়সে তিনি যখন বললেন যে আমার থেকে বেশি আপন ওনার আর কেউ নেই, তখন…মানে হয়তো ওনার মনে হয়েছিলো সোমেশও বোধহয় কুহেলীকে প্রশ্রয় দেয়…”

গৈরিক শ্রীকান্তবাবুর অনুমতি চেয়ে নিজের মোবাইলে উইলটার প্রতিটা পাতার ফটো তুলে সেটাকে শ্রীকান্তবাবুকে ফেরত দিয়ে দিলো। এদিকে টুসু চিন্তিত গলায় বলে উঠলো, “তার মানে তো এমনটা হতেই পারে যে এই রাগেই কুহেলীদি মৃন্ময়ী দেবীকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছে!”

“তা বলতে পারবো না।” বললেন শ্রীকান্তবাবু, “কে জানে মৃন্ময়ী দেবী ওদের এই উইলের কথা বলেছিলেন কি না, আমি কিন্তু এর ব্যাপারে এখনো ওদের কিছু বলিনি।”

হঠাৎ গৈরিক শ্রীকান্তবাবুর টেবিলে রাখা পেন-স্ট্যান্ড থেকে তুলে নিলো একটি ঝকঝকে সোনালী রঙের পেন, তারপর বললো, “বাহ! পেনটা দারুণ তো!” এই বলে পেনটির ঢাকনা খুলে নিজের রাইটিং প্যাডে কয়েকটা আঁকিবুকি কেটে বলে উঠলো, “এমন ফাউন্টেন পেন কিন্তু আজকাল খুব একটা দেখা যায় না, কী বলেন!”

শ্রীকান্তবাবু একগাল হেসে বললেন, “ওটা মৈনাক আমার জন্মদিনে আমাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলো!”

ওরা শ্রীকান্তবাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে দেখলো মৈনাক বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। গৈরিক তার কাছে গিয়ে সহাস্য মুখে বলে উঠলো, “তোমার বসের ভাগ্য তো খুলে গেল হে!”

মৈনাকও বেশ উচ্ছসিত কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো, “ওনার কপালটা সত্যিই খুব ভালো জানেন। শুধু ওই সম্পত্তির জন্য নয়, প্রায় দুই বছর ধরে ওনার স্ত্রী তাপসী ম্যাডাম ক্যান্সারে ভুগছেন। কয়েকদিন আগে তো যায় যায় অবস্থা, ডাক্তারেরাও হাত তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু স্যার ঠিক ওনাকে সুস্থ করে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে আনলেন!”

“বাহ, স্বামী হিসাবে যে কোনো পুরুষের এটাই তো কর্তব্য!” মুগ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলো গৈরিক, “রাজত্ব আর রাজকন্যা…তিনি দুটোই লাভ করলেন।”

(১১)

এরপরের তিন চারদিন আর গৈরিকের সাথে তেমন দেখা সাক্ষাৎ হয়নি টুসুর। আসলে পুজোর ছুটির আগে টুসুর কলেজের কিছু ক্লাস টেস্টের জন্য গৈরিকের পেছন পেছন টোটো করে ঘোরা থেকে কিছুদিনের জন্য অব্যহতি নিতে হয়েছে তাকে। কে জানে এর মধ্যে কোথায় কোথায় গেল গেরোদাটা আর কেসটাই বা কতদূর এগোলো, শেষ পরীক্ষা দিয়ে এসে রাতে এসব কথাই ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো টুসু। পরদিন সকালে বেশ দেরি করেই ঘুম ভাঙ্গলো তার। ঘুম থেকে উঠে সাইলেন্ট করা মোবাইলের স্ক্রিনটা আনলক করতেই দেখলো জ্বলজ্বল করছে গৈরিকের দুটো মিসড-কল! তার কিছুক্ষণ আগেই এসেছে তার মেসেজ: “আমি এই কেসটা সলভ করে ফেলেছি। ঝটপট চলে আয় বাগুইআটি থানায়।”

ব্যস আর টুসুকে পায় কে। সকালের খাওয়ার না খেয়েই দুরুদুরু বুকে সে পড়ি কি মরি করে ছুটে গিয়েছিলো বাগুইআটি থানার উদ্দেশে। তার আসার আগেই সেখানে গৈরিকের নির্দেশ মত পুলিশের ডাকে উপস্থিত হয়েছে সকলেই: সহেলী, সোমেশবাবু, শতদল, বিমল, আরতি দেবী, রুমেলা, শ্রীকান্তবাবু, তাপসী দেবী এবং মৈনাক। এছাড়া সেখানে আনা হয়েছে কুহেলী দেবীকেও। তবে আরেকজন অপরিচিত ব্যক্তিকেও মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো টুসু, তার চেহারায় দারিদ্রের চাপ। এ আবার কে? তবে সেই মুসলমান মহিলাকে তো দেখা যাচ্ছে না, তার মানে কি তাকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি?

এমনই সব প্রশ্নে যখন জর্জরিত টুসুর মস্তিষ্ক, তখন সকলের মধ্যমণি হয়ে বলতে শুরু করলো গৈরিক, “দেখুন, এই কেসে প্রথম থেকেই আমরা একটা মস্ত বড় ভুল করে এসেছি। মৃতার হার্ট-ফেল করে মৃত্যু, পটাশিয়াম ক্লোরাইডের ইঞ্জেকশনে কুহেলী দেবীর হাতের ছাপ, মৃতার হাতে ইঞ্জেকশনের চিহ্ন, কুহেলী দেবীর সাথে মৃন্ময়ী দেবীর বচসা ইত্যাদি এমন সকল প্রমাণের দিকে আমরা এতটাই বেশি দৃষ্টিপাত করে এসেছি, যে আমরা পোস্ট-মোর্টেম উল্লিখিত মৃত্যুর সময়টাকে সেইভাবে গুরুত্ব দিতে ভুলেই গিয়েছি!”

সকলে এর ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখলো, গৈরিক কিছুক্ষণ থেমে আবার বলে উঠলো, “পোস্ট-মোর্টেম রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে ভিকটিমের হার্ট-ফেল করে মৃত্যুটা ঘটেছে পৌনে আটটা থেকে আটটার মধ্যে…এবার বিমলের কথা অনুযায়ী সেই রাত্রে সাড়ে দশটা নাগাদ হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন সোমেশবাবু আর কুহেলী দেবী, আর আমিও খোঁজ নিয়ে দেখেছি যে এই কথা সত্যি। তাহলে এবার বলুন, বাড়ি থেকে দূরে সম্পূর্ণ অন্য একটি স্থানে থেকে কুহেলী দেবীর পক্ষে কি মৃন্ময়ী দেবীকে ওই ইনজেকশন দেওয়া সম্ভব?”

কেউ কোনো কথা বললো না, শুধু সহেলী ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো কুহেলী দেবীকে, তারপর হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বললো, “আমি জানতাম…আমি জানতাম যে তুই নির্দোষ, দিদি…তুই কখনো কাউকে খুন করতে পারিস না!”

“তাহলে তো সন্দেহের তির শুধু কুহেলীদির ওপর থেকে নয়, সোমেশবাবুর ওপর থেকেও উঠে যায়, কারণ তিনিও সেই সময় ওই স্থানে ছিলেন না!” বলে উঠলো টুসু, “তাহলে মৃন্ময়ী দেবীকে খুন করলো কে?”

“সেদিন রাতে মৃন্ময়ী দেবী খুন হননি রে টুসু।” মুচকি হেসে বলে উঠলো গৈরিক, “ইন ফ্যাক্ট, তিনি খুন করেছিলেন অন্য কাউকে!”

গৈরিকের এই কথা শুনে যেন সকলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ঠিক সেই সময় হঠাৎ যেন সচকিত হয়ে সেখান থেকে পালাতে উদ্যত হলেন শ্রীকান্তবাবুর স্ত্রী তাপসী দেবী। গৈরিক ছুটে গিয়ে তার হাত ধরে এক ঝটকায় তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বললো, “কোথায় যাচ্ছেন ম্যাডাম, সকলকে নিজের আসল রূপটা না দেখিয়েই পালাচ্ছেন!” এই বলে গৈরিক তাপসী দেবীর গলার নিচের চামড়া ধরে দিলো এক টান, আর সকলকে অবাক করে একটি মাস্ক খুলে এলো তার মুখের ওপর থেকে। সকলে বিস্ফারির চোখে দেখতে লাগলো যে তাপসী দেবীর ছদ্মবেশে যিনি এতক্ষণ তাদের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তিনি আর কেউ নন…স্বয়ং মৃন্ময়ী দেবী!

(১২)

শ্রীকান্তবাবুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন মৃন্ময়ী দেবী। এমন সময় সোমেশবাবু চিৎকার করে বলে উঠলেন, “এ কী করে সম্ভব! তাহলে ওটা কে ছিলো যে খুন হয়েছিলো? যাকে আমরা মা মনে করে নিজে হাতে শ্মশানের চিতায় দাহ করে এলাম?”

“ওটা ছিলেন মৃন্ময়ী দেবীর যমজ বোন চিন্ময়ী দেবী, যার চেহারা একেবারে মৃন্ময়ী দেবীর নকল, যিনি মুসলমান মহিলার ছদ্মবেশে বোরখা পড়ে নিজের চেহারা লুকিয়ে রাখতেন!” বলে উঠলো গৈরিক।

“মানে আইডেনটিক্যাল টুইন, তাই তো গেরোদা?” টুসুর যেন উত্তেজনা ধরে না।

“রাইট টুসু।” বলতে শুরু করলো গৈরিক, “কাটোয়ার দেবগ্রামে একটু খোঁজখবর নিয়েই জানতে পারলাম মৃন্ময়ী আর চিন্ময়ী দেবীর অতীত জীবনের কথা। ওদের দুজনের জন্ম হয় ওই গ্রামের একটি নিষিদ্ধ-পল্লীতে, সেখানকার এক যৌন-কর্মীর কোলে। তাই ওদের কোনো সঠিক পিতৃপরিচয় ছিলো না। যৌবনে পদার্পণ করে দুই বোনই প্রথামত নেমে পড়েন দেহ-ব্যবসায়। এরই মধ্যে এইডস রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন ওদের মা। চিন্ময়ী দেবী এই জীবনকেই নিজের ভবিতব্য বলে মনে করলেও, মৃন্ময়ী দেবীর ছিল এই নারকীয় জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছা…বাকিটা না হয় আপনার মুখ থেকেই শুনি, কী মৃন্ময়ী দেবী?”

আরেকবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন মৃন্ময়ী দেবী, তারপর অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, “একদিন সুযোগ বুঝে কলকাতায় পালিয়ে এলাম ওখান থেকে। তারপর নেহাৎ ভাগ্যের জোরে আর ভুয়ো মার্কশিট দেখিয়ে একটা চাকরি জোগাড় করলাম আমার স্বামীর কোম্পানিতে। এরপর তার সাথে প্রেম এবং অবশেষে তাকে বিয়ে করে এই বিপুল সম্পত্তির মালকিন হলাম। নিজের পূর্বপরিচয় গোপন করার সাথে সাথেই আর কোনো সম্পর্ক রইলো না গ্রামের সাথে, চিনুর (চিন্ময়ীর) সাথে। এদিকে সময়ের স্রোতে ভেসে একদিন চিনুর ঠিকানা হল সোনাগাছির এক পতিতা-পল্লী। সেখানে রেড করলো পুলিশ, অন্যান্য মেয়েদের সাথে ধরা পড়ে গেল সে…তারপর ছাড়া পাওয়ার পর আমরা ‘স্পন্দনের’ তরফ থেকে তাদের সাহায্য করতে চাইলাম। সেই এত বছর পর তার সাথে আমার প্রথম দেখা!”

মৃন্ময়ী দেবী থামলে গৈরিক বলে উঠলো, “সেই সময় আপনারা একে অপরকে যে মুহূর্তে চিনতে পারলেন, সেই মুহূর্তে আপনি চিন্ময়ী দেবীকে শর্ত দিলেন যে মহিলা পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকতে হলে বোরখার আড়ালে মুসলমান হওয়ার ছদ্মবেশে তাকে নিজের চেহারা এবং আসল পরিচয় সকলের থেকে গোপন রাখতে হবে। কিন্তু সে আপনার পূর্ব জীবনের আসল পরিচয় সবাইকে জানিয়ে দেওয়ার কথা বলে আপনাকে ব্ল্যাক-মেল করতে লাগলো, তাই তো? সেই জন্যই সে আমিনা সেজে বার বার দেখা করতে আসতো আপনার সাথে। আর তাই আপনি তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করতে লাগলেন!”

কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন মৃন্ময়ী দেবী, “ছোটবেলা থেকেই চিনুর খুব ভূতের ভয় ছিলো। পরে ও জানিয়েও ছিলো যে ওর হার্টের সমস্যা আছে। এটাকেই কাজে লাগলাম আমি। বিমলকে সেদিন কেনাকাটার বাহানায় বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে, গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম ‘স্পন্দন’-এ। সেখানে পৌঁছে সুযোগ বুঝে বন্ধ করে দিলাম বাড়ির মেন-সুইচ। আমি জানতাম যে সেই সন্ধ্যায় চিনু ওর ঘরে একা আছে। তাই নিজে অশরীরীর বেশে ওর ঘরের দরজায় কড়া নাড়ি আমি, তারপর লুকিয়ে পড়ি দরজার পাশের দেওয়ালের এক কোণে। ও বাইরে আসার সাথে সাথেই অন্ধকারের মধ্যে ওর চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে যাই ওর ঘরের ভেতর। তারপর ওকে ভয় দেখিয়ে ওর হৃদ-যন্ত্রকে বন্ধ করতে খুব একটা সময় লাগে না আমার!”

সকলে স্তব্ধ হয়ে শুনছিলো মৃন্ময়ী দেবীর কথা। তিনি থামলে গৈরিক বলে উঠলো, “তারপর বিমল ফিরে আসার আগেই আপনি গাড়ি করে চিন্ময়ী দেবীর লাশটা নিজের বাড়িতে নিয়ে এলেন। সেই সময় বাড়িতে আর অন্য কেউ ছিলো না। এরপর বিমল ফিরে এলো। আপনি ততক্ষণে নিজে পড়ে নিলেন চিন্ময়ী দেবীর বোরখা, তার মৃতদেহে পরিয়ে দিলেন নিজের নাইট-ড্রেস। তারপর আপনি বিমলের সামনেই আমিনা সেজে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে, ও ভাবলো হয়তো সেদিনও আমিনা দেখা করতে এসেছিলো আপনার সাথে।”

(১৩)

“এরপরের ঘটনার খলনায়ক হলেন সোমেশবাবু।” সোমেশবাবুর দিকে চেয়ে বলে উঠলো গৈরিক, “ওই হাসপাতালে একটু খোঁজ নিয়েই জানতে পারলাম যে সোমেশবাবুর যে রেচনতন্ত্র সম্বন্ধিত রোগটি হয়েছিলো তার নাম হল ‘ডায়াবিটিস ইনসিপিডাস’ (Diabetes Insipidus)। এই রোগে অত্যাধিক প্রস্রাব হওয়ার কারণে শরীরের রক্তে দেখা যায় পটাশিয়ামের অভাব, যাকে বলা হয় ‘হাইপোক্যালেমিয়া’ (Hypokalemia); খুব গম্ভীর আকার ধারণ করলে, কোনো খাবার ওষুধ এই রোগে কাজ করে না। রোগীকে সরাসরি নিজের রক্তে নিতে হয় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ড্রাগের ইঞ্জেকশন…যা হল ‘পটাশিয়াম ক্লোরাইড’!…এবার পরের ঘটনা আপনার মুখ থেকেই শুনি মিস্টার বসু!”

করুন কণ্ঠে বলে উঠলেন সোমেশবাবু, “হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় আমার পি.এ শুভঙ্করবাবু আমাকে জানালেন একটি ভয়ঙ্কর কথা…আমি বসু পরিবারের বায়োলজিক্যাল সন্তানই নই! ইন ফ্যাক্ট শুভঙ্করবাবুই হলেন আমার বাবা, আমার জন্মের পরই তার স্ত্রী মারা যান। সন্তানের জন্ম দিতে অক্ষম অনিরুদ্ধ বসু এবং তার স্ত্রী মৃন্ময়ী দেবী আমাকে গোপনে দত্ত্বক নিতে চান তার কাছ থেকে, তিনিও আমার ভালো ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজি হয়ে যান তার প্রস্তাবে। এতদিন ধরে গোপন করে রাখলেও, নিজের মৃত্যু আসন্ন জেনে শুভঙ্করবাবু আর চেপে রাখতে পারেননি এই কথা। এই কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য আমি ওনার এবং আমার রক্তের ডি.এন.এ টেস্টও করাই ওই হাসপাতাল থেকে, সেখান থেকেও প্রমাণিত হয় যে এই কথা সত্যি!”

এবার গৈরিক বলে উঠলো, “ওই ডি.এন.এ টেস্ট-এর রিপোর্ট এখন আমার কাছে... যাই হোক, মনে অভিমান আর বিতৃষ্ণার ঝড় নিয়ে আপনি সেদিন বাড়ি ফিরে এলেন। আপনার মনে হল রাতে কুহেলী দেবী ঘুমিয়ে পড়লে আপনি মৃন্ময়ী দেবীর কাছ থেকে জানতে চাইবেন, যে তিনি কেন এত বছর ধরে এই কথা আপনার কাছ থেকে গোপন করে রাখলেন!…এদিকে সেই সময় মৃন্ময়ী দেবীর বেডরুমে রাখা ছিলো তার বেশে চিন্ময়ী দেবীর লাশ। কিন্তু আপনি সেই কথা জানতেন না। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি বুঝতে পারলেন যে মৃন্ময়ী দেবীর (আসলে চিন্ময়ী দেবীর) শরীরে কোনো প্রাণ নেই। সেই সময় কুহেলী দেবীকে মৃন্ময়ী দেবীর খুনের অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেওয়ার একটা চমৎকার প্ল্যান আপনার মাথায় এলো।”

অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন সোমেশবাবু, “হ্যাঁ, যেহেতু আমি ওই কেমিক্যালের ইঞ্জেকশন নিতাম, তাই ওটার অপকারিতা সম্বন্ধেও জানতাম। জানতাম যে বেশি পরিমাণে কোন সুস্থ মানুষের রক্তে ওটা ইনজেক্ট করলে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী! এদিকে ডাক্তার হওয়ার সুবাদে, কুহুই (কুহেলী দেবী) আমাকে ওই ইঞ্জেকশন দিতো। সেদিনও দিয়েছিলো, ওর হাতের ছাপ থাকা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ এবং কৌটো পড়েছিলো আমার বেডরুমেই। আমি হাতে রুমাল জড়িয়ে ওই ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ দিয়েই চিন্ময়ী দেবীর মৃতদেহের হাতে ইঞ্জেকশন দেওয়ার চিহ্ন করলাম, তারপর ওই সিরিঞ্জ এবং কেমিক্যালের কৌটো ফেলে দিলাম কুহুর পড়ার ঘরের ডাস্ট-বিনে!”

“কিন্তু আপনি দিদিকে এভাবে কেন ফাঁসালেন, জামাইবাবু?” চিৎকার করে উঠলো সহেলী।

“এখানে আছে তোমার প্রশ্নের উত্তর, সহেলী।” এই বলে গৈরিক নিজের সামনে টেবিলের ওপর থেকে একটি কাগজের খামের ভেতর থেকে বেশ কিছু ছবি বার করে সকলের সামনে মেলে ধরলো। সেগুলিতে ফুটে উঠেছে সোমেশবাবু আর রুমেলার শারীরিক মিলনের বেশ কিছু দৃশ্য। লজ্জায় ঝুঁকে গেল সোমেশবাবুর মাথা, চোখ বন্ধ করে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন কুহেলী দেবী। গৈরিক বলে উঠলো, “রুমেলার সাথে আপনি কোন কোন হোটেলে গিয়ে অফিসিয়াল টুরের নাম করে রাত্রিবাস করে এসেছেন, তা আমার নখদর্পণে, সোমেশবাবু। কিন্তু আপনি রুমেলাকে ভালোবেসে কুহেলী দেবীকে ফাঁসিয়ে নিজের কাছ থেকে বিদায় করতে চাইলেও, রুমেলা কিন্তু আপনাকে কখনো ভালোবাসেনি। তার প্ল্যান ছিলো আপনার সাথে তার মিলনের এই ছবিগুলো কোনোভাবে তুলিয়ে নিয়ে, পরে এগুলোর সাহায্যে আপনাকে ব্ল্যাক-মেল করা!…কারণ এই ছবিগুলো পুলিশ উদ্ধার করেছে রুমেলার জিম্মা থেকেই!”

মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো রুমেলা, বিদ্বেষ ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন সোমেশবাবু। এবার গৈরিক কুহেলী দেবীকে জিজ্ঞাসা করলো, “ওই ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ দেখে আপনি প্রথম থেকেই বুঝেছিলেন যে আপনার স্বামী আপনাকে ফাঁসাতে চেষ্টা করছে, তবুও আপনি মুখ খুললেন না কেন…বলুন কেন?”

কান্নায় ভেঙে পড়লেন কুহেলী দেবী, শুধু অস্ফুট স্বরে বললেন তিনি, “ওর সাথে রুমেলার যে একটা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে তা আমি কিছুদিন আগে ওর মোবাইল ঘেঁটেই বুঝেছিলাম…ও আমাকে ফাঁসিয়ে রুমেলাকে কাছে আনতে চাইছে জেনেও আমি চুপ করে ছিলাম কেন জানেন…কারণ আমি ওকে ভালোবাসি বলে! নিজে সারা জীবন জেলের অন্ধকারে থাকতে রাজি আছি, শুধুমাত্র ও সুখে থাকবে বলে…”

“এবার বুঝতে পারছেন তো সোমেশবাবু, যে আপনাকে যদি সত্যি কেউ ভালোবেসে থাকে তাহলে সে হল আপনার স্ত্রী কুহেলী দেবী …রুমেলা নয়।” সোমেশবাবুকে বলে উঠলো গৈরিক।

সোমেশবাবু ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন কুহেলী দেবীকে, তাকে ঝাঁকিয়ে পাগলের মত বলে উঠলেন, “বড্ড ভুল করে ফেলেছি আমি…ক্ষমা করে দাও…ক্ষমা করে দাও আমাকে, কুহু…”

কুহেলী দেবীও তাকে জড়িয়ে ধরে ভেঙে পড়লেন কান্নায়।

(১৪)

গৈরিক আবার বলে উঠলো, “এদিকে বেশ কিছুদিন আমিনার ছদ্মবেশে স্পন্দনে থেকে, মৃন্ময়ী দেবী পালিয়ে এলেন তার প্রেমিক শ্রীকান্তবাবুর কাছে। আমি গোপনে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম যে ক্যান্সারে আক্রান্ত শ্রীকান্ত বাবুর স্ত্রী তাপসী দেবী কিছুদিন আগেই মারা যান ঠাকুরপুকুরের ক্যানসার হাসপাতালে। এই সুযোগটা নিলেন মৃন্ময়ী দেবী আর শ্রীকান্তবাবু, তারা জোগাড় করলেন এক মেক-আপ ম্যানকে…” এই বলে গৈরিক আঙ্গুল দিয়ে ইঙ্গিত করলো সেই অপরিচিত লোকটির দিকে, তারপর আবার বলে উঠলো, “তার সাহায্যে এরা তৈরি করলো মৃতা তাপসী দেবীর চেহারার অনুরূপ এই মাস্ক, যা নিজের মুখে পড়ে মৃন্ময়ী দেবী হয়ে উঠলেন তাপসী দেবী। এরপর তো বসু পরিবারের সম্পত্তিটা উইল করে শ্রীকান্ত বাবুর নামে ট্রান্সফার করেই কেল্লা ফতে!”

ওদিকে টুসু বলে উঠলো, “এবার বলো তো তুমি এত সব কথা জানলে কী করে গেরোদা?”

“অল্প কিছু সূক্ষ্ম তথ্য পর্যবেক্ষণ করে।” বলতে শুরু করলো গৈরিক, “প্রথমত মৃন্ময়ী দেবীর গল-ব্লাডার সার্জারি হয়েছিলো, কিন্তু মৃতদেহের শরীরের অটোপসিতে ওই অঙ্গটি অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়, এর থেকেই মৃন্ময়ী দেবীর কোনো যমজ বোন থাকতে পারে, এই সন্দেহ আমার মাথায় আসে। লাশের পোস্ট-মর্টেমে উল্লিখিত মৃত্যুর সময়ের পরেও বিমল নাকি মৃন্ময়ী দেবীকে জীবিত অবস্থায় তার সাথে কথা বলতে দেখেছে! এছাড়া সেদিন শ্রীকান্তবাবুর সেই উইলে মৃন্ময়ী দেবীর হস্তাক্ষরটি তার বাড়ি থেকে নেওয়া ডায়েরির পাতায় তার লেখা থেকে মেলানোর চেষ্টা করলাম। হ্যান্ড-রাইটিং এক্সপার্ট বললেন যে দুটো লেখাই এক মানুষের। এটাও লক্ষ্য করেছিলাম যে সেই উইলে সই করা হয়েছে ওই ফাউন্টেন পেন দিয়েই। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, যে দুদিন আগেই শ্রীকান্ত বাবুর জন্মদিন ছিলো। সেদিন নিশ্চয় ওই পেন মৈনাক তাকে গিফট করেছে। কিন্তু এটা হল মৃন্ময়ী দেবীর মৃত্যুর বেশ কিছু দিন পরের কথা, তাহলে মৃত্যুর পরেও ব্যাক-ডেটে ওই উইলে কে সই করলো…মৃন্ময়ী দেবীর ভূত!…বুঝতেই পারলাম যে মৃন্ময়ী দেবী বেঁচে আছেন, এবং শ্রীকান্ত বাবুর খুব কাছাকাছিই আছেন। পরে অবশ্য মৈনাকও স্বীকার করেছে, যে ওই উইলের ড্রাফটিং সেই করেছে, এবং বলা বাহুল্য, তা মৃন্ময়ী দেবীর মৃত বলে ঘোষিত হওয়ার বেশ কিছুদিন পরে। বাকি তথ্য পেয়েছি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে যা আগেই বলেছি। অবশ্য আমার নির্দেশে শ্রীকান্তবাবুর মোবাইল ট্র্যাক করে এই মেক-আপ আর্টিস্টের নাম্বার জোগাড় করে তাকে ধরা বা চাপ দিয়ে সকল সন্দিগ্ধদের মুখ থেকে কথা বার করার অনেকটা কৃতিত্ব কিন্তু পুলিশের!”

সেইদিনই চিন্ময়ী দেবীর হত্যার অপরাধে গ্রেফতার করা হল মৃন্ময়ী দেবীকে। তাকে সাহায্য করার জন্য আটক করা হল শ্রীকান্তবাবু আর ওই মেক-আপ আর্টিস্টকেও। মুক্তি পেলেন কুহেলী দেবী। তার অনুরোধে এই যাত্রায় পার পেয়ে গেলেন সোমেশবাবু এবং চাকরিও বজায় রইলো রুমেলার। তাদের দুজনকেই পুলিশের তরফ থেকে সতর্ক করে দেওয়া হল, যে অপরকে ফাঁসানোর এই ধরণের কুটিল পন্থা তারা যেন আর কখনো অবলম্বন না করে।

থানার ওসি সাহেবের অভিনন্দন গ্রহণ করে বাইরে বেরিয়ে এলো গৈরিক আর টুসু। হঠাৎ কী মনে হতে টুসু মুচকি হেসে গৈরিককে বলে উঠলো, “আচ্ছা গেরোদা, তোমার আবার কোনো যমজ ভাই-টাই নেই তো!” তবে গৈরিকের সেই কথায় ভ্রুক্ষেপ নেই, সে এখন মন খুলে সিগারেটে সুখটান দিতে ব্যস্ত।