চিড়িয়াখানা - মোঃ ফুয়াদ আল ফিদাহ

কল্পবিজ্ঞানের গল্প

আগস্ট মাস শুরু হওয়া মাত্র বাচ্চা-কাচ্চারা একদম ফেরেশতার অবতার বনে যায়। আর তেইশ তারিখ কাছিয়ে আসলে তো কথাই নেই...একদম দেবদূত মনে হয় ওদের। কেন না প্রফেসর হিউগোর বিখ্যাত ‘আন্তঃগ্রহ চিড়িয়াখানা’ যে সেদিনই আসে শিকাগোতে। ছয় ঘণ্টার জন্য বিশাল সেই রূপালি মহাকাশযানকে যেন ভিন্ন কোন জগত বলে মনে হয়!

সূর্য্যি-মামা আকাশে উঁকি দেবার আগেই জমে যায় লম্বা একটা লাইন। তাতে বাচ্চারা যেমন দাঁড়ায়, তেমনি দাঁড়ায় বড়রাও। সবার হাতে থাকে এক ডলারের একটা নোট। প্রফেসর নতুন কোন জন্তু আনলেন, সেটা দেখার জন্য আর তর সয় না তাদের।

অতীতে রহস্যময় এই ভদ্রলোক যেমন ওদেরকে দেখিয়েছেন ভেনাস থেকে নিয়ে আসা তেপায়া জন্তু, তেমনি দেখিয়েছেন মঙ্গলের লম্বা, ঠিঙঠিঙ্গে মানুষদের। একবার তো আরও দূরের কোন এক গ্রহ থেকে তুলে এনেছিলেন জীবন্ত এক বিভীষিকা...সাপের মত দেখতে ছিল সেই প্রাণী।

এ বছর, বিশাল ওই গোলাকার মহাকাশযান এসে থেমেছে শিকাগোর ঠিক বাইরের পার্কিং এরিয়াতে। লাইন জমে গিয়েছে আগেই। হাঁ করে তারা দেখেছে আস্তে আস্তে যানটার চারপাশের দেয়ালের উঠে যাওয়া। ভেতর থেকে, শিকের ওপাশ থেকে উঁকি দেয়া জন্তুদের দেখে হয়েছে হতবাক। এবারে প্রফেসর যে জন্তুগুলো দেখেছেন তার সঙ্গে পৃথিবীর ঘোড়ার একটা সাদৃশ্য আছে। তবে খুব দ্রুত ওগুলো, আকারে ছোট আর সারাক্ষণ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে কিচির-মিচির করতে থাকে। প্রফেসর হিউগোর কর্মচারীরা টাকা নিতে এলে আর দেরি করেনি পৃথিবীবাসী, দ্রুত নোট তুলে দিয়েছে তাদের হাতে।

অল্প কিছুক্ষণের মাঝে দেখা দিলেন খোদ প্রফেসর হিউগো! পরনে তারা নানা রঙের রঙধনু মার্কা আলখাল্লা আর উঁচু হ্যাট। ‘পৃথিবীর মানুষ,’ মাইক্রোফোনে বললেন তিনি।

তার কণ্ঠ শোনা মাত্র থেমে গেল জনতার চিৎকার চেঁচামেচি। তাই আবার শুরু করলেন প্রফেসর। ‘পৃথিবীর মানুষ, এবার এক ডলারের বিনিময়ে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন অভাবনীয় এক দৃশ্য। আপনাদের সামনে আজ আমি উপস্থাপন করছি, মহাকাশে লক্ষ-লক্ষ মাইল দূরের গ্রহ কান থেকে আসা, প্রায় সবার অজানা--- ঘোড়-মাকড়সা প্রজাতির সদস্যদের! আসুন, সবাই। দেখুন ওদের, দেখে নিজের চক্ষুভঞ্জন করুন। দেরি করবেন না, মাত্র ছয় ঘণ্টা এখানে থাকবে আমার মহাকাশ যান!’

তাই করল সবাই। দেখে যেমন মুগ্ধ, তেমনি ভয়ও পাচ্ছে। দেখতে অবিকল ঘোড়ার মত হলেও, খুব দ্রুত গতিতে উঠে যাচ্ছে দেয়াল ঘেঁষে...ঠিক যেন মাকড়সা! ‘এক ডলার সার্থক,’ বলল এক লোক। ‘যাই, বউটাকে নিয়ে আসি।’

এভাবেই চলল সারাদিন। কমপক্ষে হাজার দশেক লোক এসে দেখল চিড়িয়াখানার নতুন আকর্ষণ। তারপর, ছয় ঘণ্টা শেষ হয়ে গেলে, আরেকবার মাইক্রোফোন হাতে তুলে নিলেন প্রফেসর হিউগো। ‘আমাদের এখন যেতে হবে। তবে আগামী বছর ফিরব, আজকের তারিখেই...নতুন কোন প্রাণীকে নিয়ে। আগামীকাল কিন্তু নিউইয়র্কে পাওয়া যাবে আমাদের। তাই আপনাদের বন্ধুদের ফোন করে জানিয়ে দিন। আর সামনের সপ্তাহে পা রাখব লন্ডন, প্যারিস, রোম, হংকং আর টোকিয়োতে। তারপর? চলে যাব জন্য কোন গ্রহে।’

হাত নাড়িয়ে বিদায় জানালেন তিনি জনতাকে। আস্তে-আস্তে মাটি ছেড়ে উঠতে লাগল চিড়িয়াখানা, হারিয়ে গেল অচিরেই। উপস্থিত সবাই একমত- আজকের এই চিড়িয়াখানা ছিল ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ!

 

আরও দুই মাস এবং তিনটি গ্রহ পরের কথা। প্রফেসর হিউগোর রূপালি মহাকাশযান স্পর্শ করেছে কানের রুক্ষ ভূমি। অদ্ভুত দর্শন ঘোড়-মাকড়সারা বেরিয়ে আসছে পিল-পিল করে, তাদের খাঁচা থেকে। বিদেয় নেবার আগে কিছু কথা বললেন প্রফেসর হিউগো। তারপর যার-যার বাড়িতে ফিরতে লাগল প্রাণীগুলো।

ওগুলোর একটায় অপেক্ষা করছে এক মাদী। স্বামী-সন্তানকে ফিরতে দেখে খুশি হয়ে গেল সে। ওদেরকে আলিঙ্গন করতে করতে মানুষের অচেনা ভাষায় বলে উঠল, ‘অনেক দিন কাটিয়ে দিলে বাইরে। কেমন লাগল?’

জবাবে কেবল মাথা নড়ল মদ্দা। ‘বাচ্চাটা খুব মজা করেছে। আট-আটটা গ্রহ ঘুরেছি আমরা, দেখেছি অনেক কিছু।’

এদিকে বাচ্চাটা তো বাচ্চাই। আর অন্য সব বাচ্চার মত সেও স্থির থাকতে জানে না। গুহার দেয়াল ধরে উঠতে উঠতে মাকে বলল, ‘তবে পৃথিবী নামের জায়গাটা সবার সেরা। ওখানকার অধিবাসীরা দেহ ঢেকে রাখে...আর হাঁটে দুই পায়ে!’

‘বলো কী?’ জিজ্ঞেস করল মাদী। ‘যদি কোন বিপদ হতো?’

‘সে সম্ভাবনা ছিল না।’ জবাব দিল তার স্বামী। ‘আমাদেরকে রক্ষা করার জন্য শিক ছিল আলাদা। আর আমরা জাহাজেই ছিলাম, নিচে নামিনি। পরের বার তোমাকে সঙ্গে নেব ভাবছি। উনিশ কম্মোক খরচ করা একদম সার্থক।’

মাথা নেড়ে সায় জানাল ওদের বাচ্চা। ‘আসলেই... এটাই আমার দেখা সেরা চিড়িয়াখানা।’