সে জে মো - প্রতিম দাস

কল্পবিজ্ঞানের গল্প

আজ প্রফেসর ডেভিড সেন দারুণ খুশী। দীর্ঘদিনের গবেষণায় আজ সিদ্ধিলাভ হয়েছে। সফল হয়েছে এতদিনের ভাবনা চিন্তা খাটাখাটনি। ল্যাবরেটরির জানলা দিয়ে বাইরের জগতটাকে দেখতে দেখতে উনি ভেসে যাচ্ছিলেন ভবিষ্যত কল্পনার জগতে।

...আর বেশি দেরি নেই যখন মানুষ প্রফেসর ডেভিড সেনকে নিয়ে মাতমাতি শুরু করে দেবে... সেরা বিজ্ঞানীর তকমা জুটবে ওনার ঝুলিতে... সব সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল, ম্যাগাজিন এবং নানান গবেষণা সংস্থা আমার ভাবনা নিয়ে আলোচনা করবে...গ্লোবাল টিভি নেটওয়ার্ক এর সূত্রে গোটা পৃথিবী জানতে পারবে আমার নাম...আমার এই আবিষ্কারের কাছে তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী, নিউটন থেকে স্টিফেন হকিং, সবার কাজ নগণ্য হয়ে যাবে... এই সব ভাবনার স্রোতে ভাসতে ভাসতে প্রফেঃ সেন অনুভব করলেন এক পরম প্রশান্তি।

***

ল্যাবরেটরির মূল ঘরে একটা বড় টেবিলের ওপর রাখা আছে নতুন যন্ত্রটাকে। দেখতে অনেকটা বড়সড় ধরনের মাইক্রোস্কোপের মতো। ওটার ওপরে ঝুলছে আর একটা অদ্ভুত দর্শন আলোক বিচ্ছুরণকারী যন্ত্র। কাছেই একটা গোলাকৃতি পাত্রে কিছু ছোট ছোট উদ্ভিদ রাখা আছে।

ঘরের একদিকের দেওয়ালে অনেকগুলো তাক। যেখানে রাখা আছে বিভিন্ন মাপের সব কাঁচের বাক্স। সাধারণ মানুষের অজানা অদেখা অনেক বস্তু রাখা আছে ওগুলোর ভেতরে। ঘরের এক কোনে মেঝেতে রাখা আছে আর একটা কাঁচের বাক্স। ওটার ভেতরে রাখা আছে প্রায় চারফুট লম্বা তিন ফুট চওড়া গোলাকৃতি একটা বস্তু। দেখে ভুল হতেই পারে যে ওটা একটা ডাইনোসরের ডিম। কিন্তু কাঁচের বাক্সের গায়ে যে লেবেল লাগানো আছে তাতে লেখা আছে “সাধারণ মুরগীর ডিম”।

আরেকটা বাক্সের ভেতর একটা বিড়ালের মাপের পিঁপড়ে তার লম্বা শুঁড় নড়াচ্ছে আস্তে আস্তে। দেওয়ালের গায়ে ঝুলছে একটা ছবি। ফুট দশেক লম্বা একটা রুইমাছের ছবি। ঘরের হাল্কা আলোছায়ায় যেটাকে অদ্ভুত রকমের কিছু বলে মনে হচ্ছে।

টেবিলেও একটা বাক্স রাখা আছে। যার ভেতরে একটা দৈত্যাকার পামকিন বীটল মাঝে মাঝে নিজের লাল পাখনা কাঁপাচ্ছে আর তার মাপের সঙ্গে মানানসই একটা কুমড়োর টুকরো খাচ্ছে।

কাছেই একটা পচা পাউরুটির ওপর জন্ম নিয়েছে অ্যালগীর দঙ্গল। পাতাবিহীন উদ্ভিদগুলো উচ্চতায় তিন ফুট লম্বা। দরজার কাছে একটা ভাঙা কাঠের কুকুর যার ওপর জন্মেছে বৃহদাকৃতি ছত্রাক। এক একটা পাঁচ ফুট করে লম্বা। মোদ্দা কথা হলো এই ল্যাবের ভেতরে যা যা দেখা যাচ্ছে সবই স্বাভাবিক আকারের তুলনায় অনেকটাই বড় মাপের। দেখে যা মনে হচ্ছে অতিরিক্ত আকার বৃদ্ধিতে ওদের জীবনযাত্রায় কোনও পরিবর্তন আসেনি। অবশ্য ওরা আদপেই সেটা অনুভব করতে পেরেছে কিনা সেটা আর এক গবেষণার বিষয়। তবে হ্যাঁ এটা বলতেই হবে প্রফেঃ সেন ওদের দেখভাল যত্ন নিয়েই করেন।

***

২১৯০ সাল। পৃথিবীর জনসংখ্যা ২০০ বিলিয়ন। জনসংখ্যার এই অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে বেড়েছে খাদ্যের সমস্যা। আর গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া এইডস। না একে সমূলে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। বিগত পঞ্চাশ বছরে এর আধিক্য আরো বেড়েছে।

২১ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্ব জুড়ে “সেফ সেক্স” এর প্রচার চালিয়ে এইডস রোগকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। কিন্তু ২২ শতকে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। এক ড্যানিশ বিজ্ঞানী এক ধরনের “নেগেটিভ” ড্রাগ আবিস্কার করেন। যার সেবন এক ভয়ানক রকমের পরিবর্তন এনে দেয় মানব সভ্যতায়। মানুষের অস্তিত্বই সঙ্কটে পড়ে যায়।

“নেগেটিভ” ড্রাগটির নাম রিজুভেনল। মানুষের জীবনের আয়ু বাড়িয়ে দেয়। ওই ড্রাগ খেলেই বয়স বৃদ্ধির স্বাভাবিক পদ্ধতি থমকে যায়। মাত্রা অনুসারে খেলে ফিরে পাওয়া যায় যৌবনের স্বাভাবিক ক্ষমতা। বৃদ্ধাবস্থা এবং মৃত্যু নামক শব্দ দুটোই ভুলে যেতে শুরু করে মানুষ।

আবিষ্কারের দু বছরের মধ্যেই রিজুভেনলের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। দীর্ঘ জীবন আর নতুন করে ফিরে পাওয়া যৌবনের উচ্ছ্বাসে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বাড়তে থাকে চড়চড়িয়ে। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় খাদ্য সমস্যা। সাথেই সাথেই বাসস্থান চাকরী ইত্যাদিতেও সঙ্কট বাড়ে। ছোটোখাটো অসহায় দেশগুলো নানান কলাকৌশল করে চেষ্টা করে একে আটকানোর। ওই ড্রাগব্যবহার না করলে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়ার লোভ যেমন দেখায় সাথেই ভয় দেখায় আগামীদিনের দুরাবস্থার ছবি তুলে ধরে। রিজুভেনল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে অনেক দেশ।

যদিও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। বেআইনি চালান পথে ঠিক মানুষের কাছে পৌঁছে যায় রিজুভেনল। বোঝাই যায় মরার ইচ্ছে কারোরই নেই। সে খেতে পাক আর না পাক। খাদ্য সহ নানা সমস্যা মেটাতে না পেরে কিছু কিছু ছোট দেশ জোট বেঁধে আক্রমণ করে বড় দেশের নানান প্রান্তে। টুকটাক যুদ্ধ চলতেই থাকে পৃথিবীর এখানে সেখানে।

এইসব সমস্যার সমাধানের চাবি কাঠি এখন প্রফেসর ডেভিড সেনের হাতে।

***

সাতাশী বছরের ছোটখাটো চেহারার মানুষ প্রফেসর সেন। যদিও দেখে সাতাশি মনে হয় না মোটেই। সদ্য তিরিশ পেরোনো যুবক যেন। নিয়মিত রিজুভেনল সেবনের ফল। বছর তিরিশেক আগে বাড়ীর ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে উনার স্ত্রী মারা যান। দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা সেটা আজো জানা যায়নি। তবে এটা অনেকেই জানতো যে উনি এইডস রোগে ভুগছিলেন।

তারপর থেকে এই বিশাল বাড়িটায় একাই থাকেন। নিঃসন্তান। ডুবে যান জিটা রে বিষয়ে বিশ্লেষণ মূলক গবেষণায়। আজ থেকে ৪৫ বছর আগে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের এই ক্ষেত্রটায় উনি গবেষণা শুরু করেছিলেন। নিউক্লিয়নদের আচরণ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে করতে আচমকাই খোঁজ পান জিটা রশ্মির। তখন ওর বয়েস ৭২। এর পরের ১৫ বছরে চরম গোপনতা অবলম্বন করেন এ বিষয়ে কাজের এবং গবেষণার ক্ষেত্রে। নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করে একাধিক বার সাফল্য লাভ করতে করতে আজ তার চরম পরীক্ষাটাও সফল হয়েছে।

গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে জিটা রশ্মির বিভিন্ন উপাদানগুলো আবিষ্কার ও বিশ্লেষণ করেন। এই রশ্মি আলোর চেয়েও দ্রুত বেগে একস্থান থেকে অন্যস্থানে গমন করতে সক্ষম। আর সেই গতিকে আলোর গতিতে নামিয়ে আনতে পারলে ঘটে কিছু অসাধারণ ঘটনা। তার থিয়োরী অনুসারে ওই সময়ে ওই রশ্মি যার ওপরে পড়বে তার আকার বেড়ে যাবে কয়েকগুন।

আর এটাই হাতে কলমে সফল করার জন্য তিনি অতিগোপনে চালিয়ে যান তার সাধনা। জিটা রশ্মি বানাতে সক্ষম এমন একটি যন্ত্র বানানো হয় তার প্রথম লক্ষ্য। সফল হোন সেই কাজে। তারপর সেই রশ্মিকে বড় আকারে বিচ্ছুরিত করার মতো যন্ত্র নির্মাণ করেন এবং সবশেষে ওই রশ্মির গতিকে আলোর গতিতে নামিয়ে আনার যন্ত্রটির নির্মাণ করে ফেলেন। নাম দেন “সেজেমো”। সেন্স জিটা-রে মডিউলেটর।

আপাতত সেই যন্ত্রের পরিমার্জিত রূপ তৈরী সর্ব সমক্ষে প্রদর্শিত হওয়ার জন্য। প্রফেঃ সেন আত্মবিশ্বাসী এই যন্ত্রই ওকে “জিনিয়াস” বলে পরিচিত করে দেবে।

ভবিষ্যতের সুখ কল্পনার জগতে বিচরণ করতে করতে প্রফেঃ সেন নিচু হয়ে এক মাত্র সঙ্গী পোষা কুকুর টেরীর গায়ে হাত বোলাতে শুরু করলেন। দোআঁশলা টেরীর বয়েস চল্লিশ পেরিয়েছে। তবে প্রভুর মতোই রিজুভেনলের পরশে ওর বয়েসও আটকে আছে ২২ এর খাঁচায়।

***

ইন্টার ন্যাশন্যাল কংগ্রেস ফর সারভাইভাল অফ হিউম্যানিটির পঞ্চম অধিবেশন হতে চলেছে নিউইয়র্কে। এই সুযোগে নিজের কাজটা দেখানোর একটা ব্যবস্থা উনি করলেন চেষ্টা চরিত্র করে। আগেভাগে যাবেন না। অধিবেশন শুরু হওয়ার আধ ঘণ্টা আগে উনি ওখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কোনোভাবেই এ গবেষণার বিন্দুমাত্র ফাঁস হোক এটা উনি চাইছেন না। বিশ্বকে চমকে দেবেন উনি।

নিজের মিনি জেটপ্লেনে চেপে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছালেন অধিবেশনের জায়গায়।

মঞ্চে উপস্থিত বিশ্বের নানান দেশ থেকে আগত খ্যাতনামা বিজ্ঞানী গবেষকেরা। সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে আছে সুপার কম্পিউটার পরম-টোয়েন্টি।

অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণ দিলেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি মিঃ র‍্যালফসন। উপস্থিত অভ্যাগতদের উনি জানালেন গত কয়েক বছরে প্রযুক্তিগতভাবে আমাদের দারুণ রকমের উন্নতি সাধন হয়েছে। যার উদাহরণ, অন্য গ্রহে বসতি স্থাপনের প্রাথমিক পর্যায় সুসম্পন্ন । মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিতে খুব শীঘ্র ইচ্ছুক মানুষদের পাঠানো হবে নতুন জগতে মানব সভ্যতা স্থাপনের জন্য। পরবর্তী লক্ষ্য ইউরেনাস ও নেপচুন। মিলিটারি ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু উনি দুঃখের সাথে জানাতে বাধ্য হচ্ছেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যের যোগান এবং এইডস এর মোকাবিলায় প্রযুক্তি কোন নতুন পথের দিশা দেখাতে পারেনি।

মহাকাশ প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি গ্রহের বুকে নতুন বসতি স্থাপন করে হয়তো জনসংখ্যার চাপ কমাতে সক্ষম হবে। কিন্তু বাকি দুটো সমস্যা তবুও থেকেই যাবে। উনি আশা করছেন উপস্থিত বিজ্ঞানীরা এর আশু সমাধান বার করতে সক্ষম হবেন।

এরপর আগত প্রতিনিধিরা পেশ করলেন তাদের বক্তব্য। ওইসব সমস্যা সমাধানের কোনো কথা সেখানে ছিল না।

এবার সময় বিজ্ঞানী গবেষকদের নতুন নতুন আবিষ্কার বিষয়ে বক্তব্য রাখার। পরম-টোয়েন্টি এক এক করে বিজ্ঞানীদের ডাকতে থাকলো। সময় এলো প্রফেসর ডেভিড সেনের বক্তব্য পেশ করার।

‘মাননীয় সভাপতি, মঞ্চে এবং অধিবেশনে উপস্থিত বন্ধুগণ। যে সমস্যার সমাধানের প্রয়োজন এই মুহূর্তে আমি আজ সে নিয়েই কথা বলতে এবং প্রমাণ দেখাতে এই মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছি। মানব প্রজাতির অস্তিত্ব বাঁচাতে আমার একমেবঅদ্বিতীয়ম আবিষ্কারের কথা আপনাদের জানাতে চাই।

‘এই বাক্সটার দিকে তাকান!’ ইশারা করতেই দুজন মানুষ সাবধানে বয়ে নিয়ে এলো একটা ধূসর কাপড়ে ঢাকা বাক্স। রাখলো টেবিলের ওপর। সরিয়ে দিলো ঢাকনা। ‘আপনারা যা দেখতে পাচ্ছেন সেটা একটা মুরগীর ডিম।’

মঞ্চের পেছনের জায়ান্ট থ্রিডি স্ক্রিনে ফুটে উঠলো বিশাল ডিমটার ছবি। সকলে হতবাক। কয়েক মিনিট চরম নীরবতা, তারপর শুরু হলো ফিসফিসানি। ভেসে আসতে শুরু করলো নানা মন্তব্য। ‘অদ্ভুত!’... ‘দারুণ ব্যাপার!’... ‘অসাধারণ!’... ‘অবিশ্বাস্য!’

সাথে সাথে ব্যঙ্গাত্বক মন্তব্য যে ছিল না তাও নয়।

‘দেখে তো মনে হচ্ছে ডাইনোসরের ডিম।’

‘কিন্তু ডাইনোসর তো কবেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তার ডিম কোথা থেকে আসবে?’ কেউ একজন প্রতিমন্তব্য করলো।

‘মুরগীর বলে লিখে দিলেই বিশ্বাস করতে হবে ওটা মুরগির ডিম! ফাইবারের বানানো বলে মনে হচ্ছে।’

এরকম ছুটকো ছাটকা কথাবার্তায় চাপা পড়ে যাচ্ছিল প্রফেসর সেনের বক্তব্য। সেটা লক্ষ্য করে পরম-টোয়েন্টি অতিথিদের অনুরোধ করলো কথা থামানোর এবং প্রফেঃ সেনকে বলতে দেওয়ার।

‘মাননীয় অভ্যাগতবৃন্দ আমি মোটেই আপনাদের ঠকাচ্ছি না। এটা সত্যি সত্যিই মুরগীর ডিম। ডাইনোসরের ডিম নয়। ফাইবার দিয়ে বানানো নয় আমার যন্ত্র সেজোমো একে আকারে বড় করেছে। আমি আরো কিছু নমুনা আপনাদের সামনে পেশ করতে চলেছি। আশা করছি সেগুলো দেখার পর আপনাদের মনের সংশয় দূর হবে। এর পর একে একে প্রফেসর সেন একটি করে কাঁচের বাক্স আনালেন এবং চালিয়ে গেলেন নিজের বক্তব্য।

স্ক্রিনে দেখা গেলো একটি কাঁচের বাক্সে বর্ণহীন তরলে কিছু অজানা প্রাণী ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ভাবে তাদের আকৃতির বদল ঘটিয়ে চলেছে। ওদের শারীরিক বৃদ্ধি, দ্বিধা বিভক্ত হওয়া এবং নতুন জন্মলাভ দেখা গেল।

‘আশা করি এদের চিনতে অসুবিধা হয়নি। হ্যাঁ এরা অ্যামিবা। সাধারণ জলের ভেতরে। আমি ওদের আকৃতি কয়েক বিলিয়ন গুন বাড়িয়ে দিয়েছি। যে কারণে খালি চোখেই ওদের দেখতে পাচ্ছেন আপনারা।’ এবার আর কোন মন্তব্য ভেসে এলো না। সবাই বিস্ময়ে হতবাক।

আবার একটি বাক্স এলো টেবিলের ওপর। স্ক্রীনে ফুটে উঠলো ছবি। এক দলা নল আর বালার আকৃতির প্রাণী। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বাক্সের লেবেলে লেখা “ভাইরাসেস”। কয়েক মিলিয়ন গুন বড় করা হয়েছে ওদের। দেহগঠন বুঝতে কোনও সমস্যাই হচ্ছে না।

প্রফেসর সেন বললেন, ‘সেজেমোর সহায়তায় যে কোন বস্তু, গাছ বা প্রাণীকে লক্ষাধিক গুন বড় করা যাবে। যন্ত্রটি আকারে যথেষ্টই বড়। তাই সেটাকে এখানে আজ আমি সঙ্গে করে নিয়ে আসিনি। তবে আপনারা চাইলে আমি ওটা আপনাদের যে কোনোদিন দেখাতে পারি। ওই যন্ত্র আমার গত পনেরো বছর ধরে নিরলস পরিশ্রমের ফসল।’ প্রফেসর সেন একটু থামলেন। সম্ভবত বিষয়টিকে শ্রোতা দর্শকদের মননে জারিত হওয়ার সু্যোগ দেওয়ার জন্য। উনি বুঝতে পারছেন মঞ্চে উপস্থিত আছেন যারা এবং সমানে বসে আছেন যারা সকলে উদগ্রীব এ বিষয়ে আর জানার জন্য।

এমতাবস্থায় পরম-টোয়েন্টির কাছ থেকে প্রশ্ন এলো। ‘সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই যে আপনার আবিষ্কার আমাদের চমকে দিয়েছে। কিন্তু আপনি আমাদের এবারে বলুন এই আবিষ্কার মানব প্রজাতির সমস্যা সমাধানে কীভাবে সহায়তা করবে?’

‘ধন্যবাদ, প্রশ্নটা উত্থাপন করার জন্য,’ মৃদু হেসে হাসলেন প্রফেঃ সেন। ‘আমরা সকলেই জানি পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়েই চলেছে। সে তুলনায় খাদ্যের উৎপাদন না হওয়ায় ঘাটতিও বাড়ছে তাল মিলিয়ে। আগত ভবিষ্যতে কী হবে সেটা এক চিন্তার বিষয়। আর এই সমস্যার সমাধানের সহজ উপায় আমার হাতে। আমার পরিকল্পনা অতি সহজ। আমার আবিষ্কার করা যন্ত্র সেজেমোকে ব্যবসায়িক স্তরে সহজলভ্য করার ব্যবস্থা করতে হবে। এই যন্ত্রের ব্যবহার করে প্রতিটি খাদ্যকনাকে কয়েকশ গুন বড় করে নেওয়া সম্ভব। একটি রুটি বানিয়ে এক সাথে একাধিক মানুষের খাদ্য চাহিদার সমাধান করা সম্ভব হবে।

‘একইভাবে একটি ফল বা একটি সবজি বা এক টুকরো মাংস এই যন্ত্রের আওতায় এলেই বেড়ে যাবে আকারে। সবচেয়ে বড় কথা আমি একাধিক পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হয়েছি আকারের বৃদ্ধির ফলে কোন কিছুই তার নিজস্ব গুণাগুণ হারায় না। আশা করছি আপনাদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না এই যন্ত্র কীভাবে খাদ্য সমস্যা মেটাবে। আর সেটা মিটলেই বিলুপ্ত হবে দারিদ্র, মজুত করে রাখার সমস্যা এবং চুরি ডাকাতি। সর্বোপরি থেমে যাবে দেশে দেশে যুদ্ধবিগ্রহ।’

পিন ড্রপ সাইলেন্স অধিবেশন কক্ষে।

‘এবারে এটা দেখুন,’ ইশারা করতেই আবার একটা বাক্স আনা হলো। স্ক্রিনে দেখা গেল একটি এক কোষী প্রাণীর বিবর্ধিত রূপ। ওটার নড়তে থাকা নিউক্লিয়াস ক্রোমোজোম এবং জিন সহজেই দেখা যাচ্ছিলো। ‘এটি একটি অ্যামিবা। খুব সহজেই ওর প্রতিটি গতিবিধি আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারছি। আমার ধারণা এইচ আই ভি ভাইরাসকে এরকম বিবর্ধিত রূপে দেখতে পাওয়া গেলে গবেষকদের পক্ষে খুব একটা সমস্যা হবে না প্রতিষেধক নির্মাণের ক্ষেত্রে। আর এভাবে শুধু এইডস নয় এ পৃথিবী থেকে নিমূল করা সম্ভব হবে যে কোনও রকম মারণব্যাধিকে।’ কথা থামাতেই উচ্ছসিত করতালির জোয়ারে ভেসে গেল এবার অধিবেশন কক্ষটি।

শব্দ স্তিমিত হলে প্রফেঃ সেন বললেন, ‘কেবলমাত্র এ দুটো ব্যাপার নয় আমার যন্ত্রের সম্ভাব্য উপযোগিতার আমি আর অনেক নমুনা দিতে পারি যা এই জগতের যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। যদি আমার ভাবনার সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয় আমি নিশ্চিত একদিন বদলে যাবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা।’ বক্তব্য শেষ করে সামান্য ঝুঁকলেন সামনের দিকে প্রফেসর ডেভিড সেন। এরপর প্রায় এক মিনিট ধরে চললো করতালি বর্ষণ।

উচ্ছাস কমে এলে পরম-টোয়েন্টি বললো, ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান ! প্রফেসর সেন উনার গবেষণার কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা এবং নমুনা প্রমাণ আমাদের সামনে পেশ করলেন। কোনও সন্দেহ নেই যে ওনার বক্তব্য অতি অসাধারণ এবং অভূতপূর্ব। আর সেকারণেই এই ব্যবস্থা বাস্তবে চালু করার আগে পৃথিবীর সব দেশের উচ্চস্তরীয় একটা বিশেষ অধিবেশন করার দরকার আছে। সেসব পরে ভাবা যাবে। আপাততঃ প্রফেসর সেনকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে আগামীকাল তার যন্ত্রের একটি লাইভ ডেমো দেখানোর জন্য।’ একটু থেমে পরম-টোয়েন্টি বললো, ‘ আজকের মতো সভা এখানেই সমাপ্ত। আগামীকাল আবার আমরা এখানে উপস্থিত হবো।‘

ইতিমধ্যে বাক্সগুলো তুলে নিয়ে চলে গেছে সেনের ভাড়া করা কর্মচারীরা। ওদের সাথেই সবার অলক্ষ্যে অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেছেন প্রফেঃ সেন।

মিনিট কুড়ি বাদে তাকে আকাশপথে দেখা গেল প্রাইভেট জেটের ভেতর। চলেছেন বাড়ীর পথে।

***

ল্যাবে ঢোকার সময় মনে মনে খুবই উত্তেজনা অনুভব করছিলেন প্রফেঃ সেন। খুব শিগগিরি তার এতদিনের লালনপালন করা স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে।

আপাতত কালকে লাইভ ডেমো দেওয়ার আগে সেজেমোটাকে শেষবারের মতো চেক করে নেওয়া দরকার।

ফ্রিজ খুলে একটা ছোট্ট মাংসের টুকরো বার করে রাখলেন টেবিলের ওপর। যন্ত্রটি ভালো করে চেক করে নিয়ে কন্ট্রোল প্যানেল ডিভাইসে দশগুন মাপে বাড়ানোর প্রয়োজনীয় সেট আপ করে চাপ দিলেন মূল স্যুইচে।

সহসা একটা প্রাণীর ছায়া পড়লো দরজায়। টেরী। দেখতে পেয়েছে মাংসের টুকরোটাকে। লাফ দিলো ওটাকে ধরার জন্য। ঘটনার প্রেক্ষিতে সেজেমোর স্যুইচ অফ করতে কয়েক সেকেন্ডের দেরি হয়ে গেল প্রফেসর সেনের। আর তাতেই যা না ঘটার তাই ঘটে গেল।

এক ঝটকায় ক্ষুদ্র টেরী পরিণত হল এক দানবাকৃতি প্রাণীতে। রক্ত চক্ষু এবং ভয়াল দন্ত বিস্তৃত হাঁ মুখ ... সে এক গা শিউরানো দৃশ্য। দাঁতের ফাঁকে ধরে আছে প্রায় কেজিখানেক ওজনের একটা মাংসের টুকরো। শ্বাদন্তগুলো বেরিয়ে আছে বিকট ভাবে। রক্তমাখা লালা টপ টপ করে ঝরে পড়ছে। কচ কচ করে মাংসের টুকরোটা চিবিয়ে নিয়েই লাফ মারলো প্রফেসরের দিকে। সম্ভবত আদর পাওয়ার আকাঙ্খায়। কিন্তু হতভম্ব প্রফেসর সেন ভয় পেয়ে চেষ্টা করলেন পালানোর। তাড়াহুড়োতে পা পিছলে গেল। আছড়ে পড়লেন মেঝের ওপর। মাথা ঠুকে গেল একটা কাঁচের বাক্সের গায়ে। ফেটে গেল জায়গাটা। বেরিয়ে এলো রক্ত। তারই গন্ধে দানবাকৃতি কুকুরটার মধ্যে জেগে উঠলো আদিম বুনো চাহিদা। জ্ঞানহারা প্রফেসরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো টেরী।

***

এরপর আর কেউ প্রফেসর ডেভিড সেনের খোঁজ পায়নি।

ল্যাবরেটরির বেশীর ভাগ নমুনা ক্ষিধের জ্বালায় উদরস্থ করে টেরী।

প্রফেসরের দিকে ঝাঁপ মারার সময়েই ওর পায়ের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল সেজেমো।

দিন পনেরো পরে প্রফেসরের খোঁজে এসেছিল আন্তর্জাতিক তদন্তকারী দল। পেয়েছিল বিরাট এক মরা কুকুরের দেহ।

রিজুভেনল সেবন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দ্রুত বার্ধক্য নেমে আসে টেরীর শরীরে। সাথেই খাদ্য না থাকায় হার্টফেল করে মারা গিয়েছিল টেরী।

সময় বয়ে চললো তার নিজের খাতে। ফাঁকা বাড়ী দখল করলো গৃহহীন মানুষের দল। সেজেমো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল ওদের হাতে। হতভাগ্যের দল জানতেও পারলো না এক সাধারণ কুকুরের লোভের কারণে ওদের সমস্যার চিরতরে সমাধানের অসাধারণ পদ্ধতি হারিয়ে গেছে এ পৃথিবী থেকে।

[D P Singh এর লেখা The Ultimate solution এর অনুবাদ। গল্পটি নয়ের দশকে Science Reporter পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।]