ফেরা - এরশাদ বাদশা

লৌকিক গল্প

কুয়াশার অবগুণ্ঠনে ঢাকা ধরিত্রী। সাদা চাদর যেন আবরণ হয়ে লেপ্টে আছে প্রকৃতির গায়ে। রাত্রির জঠরে প্রভাতের জন্ম; ফ্যাকাসে অন্ধকার কুয়াশার সাথে মিশে এক অপার্থিব রহস্যের অবতারণা চরাচর জুড়ে।

লগন সুবহে সাদিক। দিবসের সবচে শুদ্ধতম লগন। পাপিষ্ঠরা এখনো জাগেনি। এখনো তাদের পদভারে প্রকম্পিত হয়নি চরাঞ্চল। জেগেছে পুণ্যবানরা। তাদের উপাসনায় প্রীত হচ্ছে ধরিত্রী। প্রার্থনার শ্লোকগুলো ইথারে ভেসে বেড়াচ্ছে, পৌঁছে যাচ্ছে মহাপরাক্রমের নিকট।

ঠিক এ রকম একটা সময় বেছে নিয়েছি আমি প্রত্যাবর্তনের জন্য। প্রত্যাবর্তন বললে ভুল বলা হবে, আমি আসলে দেখতে চাই আমার স্বজনেরা কেমন আছে।

পদব্রজে যাওয়াটা অদ্ভুত এক শিহরণ জাগাচ্ছে মনে। এ পথ দিয়ে অনেক দিন গিয়েছি আমি, কিন্তু আজকের মতো এতোটা ভালো লাগেনি কখনই। শিশিরসিক্ত ঘাসের উপর দিয়ে নগ্ন পায়ে চলার অনুভূতি আমার রন্ধ্রে অনুরণন তুলতে লাগলো। বিহঙ্গদের সুললিত স্বরের গুঞ্জন যেকোন আবেগি কবিতার চেয়েও সরস। আর প্রকৃতি তো তার সবচে সুন্দরতম সাজে সজ্জিত। কুয়াশায় ঢাকা বসুন্ধরাকে মনে হচ্ছে ঘোমটায় ঢাকা নববধূর মতো।

প্রকৃতির এই রূপসুধা পান করতে করতে আমার মনে হলো—এই রূপনগর, মোহনীয় এই ধরা, সৃষ্টি হয়েছিলো একটি ভুলের কারণে। আদম-হাওয়ার লোভের কারণে। আর এর নেপথ্যে ছিলো ইবলিশ নামের এক পথভ্রষ্ট ফেরেশতা। সে যদি আদম-হাওয়াকে গন্ধম ফল না খাওয়াতো তাহলে হয়তো এই পৃথিবী সৃষ্টি হতো না। ভেবে আশ্চর্য লাগলো, তাহলে ইনসান নামে কোন জাতিই সৃষ্টি হতো না!

 

চলতে চলতে স্মৃতির দরজায় করাঘাত করতে লাগলো গুজরে যাওয়া সেই দিনগুলি। আমার বাবার কথা মনে পড়লো। জীর্ণ, শীর্ণকায় সেই বৃদ্ধ প্রাণশক্তিতে ভরপুর ছিলেন। সেই প্রথম থেকেই, যখন আমি ছোট ছিলাম। মধ্যবিত্ত জীবন-যাপনে মা হাঁপিয়ে উঠলেও বাবা সর্বদা অবিচল ছিলেন। মার সহস্র অভিযোগের মধ্যেও রা সরতো না তার মুখে। আর দশজন নীতিবান যেমন হয়, তিনিও তেমনই। তবে তাদের সাথে তার ফারাক হচ্ছে, দারিদ্র তাদের মুখের হাসি কেড়ে নিলেও আমার বাবার উপর সেটা কোন প্রভাবই ফেলতে পারেনি। খণ্ড খণ্ড অবসরগুলো আমার সাথে ভাগ করে নিতেন তিনি। বলতেন, ‘বাবু, কোন এক কবি বলেছেন—‘‘দারিদ্র মোরে করেছে মহান’’, না, দারিদ্র আমাকে মহান করেনি, করেছে চিন্তামুক্ত। যাদের ঐশ্বর্য আছে তারা সেটা রক্ষা করার চিন্তায় রাতে ঘুমাতে পারে না।’

অতি সাধারণ সেই মানুষটাকে আমি বড়ো বড়ো মনীষীদের কাতারে দাঁড় করাতাম। সবসময় চাইতাম আমি তার মতোই হবো। বাবা বলতেন, ‘তুই কী হবি সেটা সম্পূর্ণ তোর এক্তিয়ার। আমি সেখানে খবরদারি করতে চাই না। তবে একটা কথা সবসময় মনে রাখবি—মনের উপর জোর খাটাবি না, মন যেটা চাইবে সেটাই তাকে করতে দিবি।’

বাবা আমার উপর নির্ভর করতেন। যখন তিনি সারাজীবনের জন্যই অবসরে গেলেন, তার সাহারায় পরিণত হলাম আমি। বাবা আমাকে সুশিক্ষা এবং স্বশিক্ষা দুটোই বেশ ভালোভাবেই দিতে পেরেছিলেন। তবে বলাই বাহুল্য, আমি তার মতো হতে পারিনি। পৃথিবীতে দু’ধরনের মানুষ থাকে। নীতিবান এবং নীতিহীন। বাবা প্রথমটার দলে। যার কারণে তাকে সারাজীবন ক্লেশ-এর মধ্যে কাটাতে হয়েছে। আমি স্বচক্ষে তার দুরবস্থা দেখেছি বলেই নিজেকে তার মতো হতে দেইনি।

আমার অবস্থান ছিলো নীতিবান এবং নীতিহীনের মাঝামাঝি কোন জায়গায়। সেটা কী রকম? পারতপক্ষে কোন পাপ আমার দ্বারা হতো না। যেমন আমি কর্মজীবনে কোনদিন অন্যয্য পারিতোষিক প্রদানও করিনি, এবং গ্রহণও করিনি। তবে ভালোভাবে বাঁচার জন্য আমি চাকরির পাশাপাশি ব্যবসাও করতাম। বলাই বাহুল্য ‘ওজনে কম দেওয়া গর্হিত কাজ,’ ব্যবসার নীতিবাক্য এটা হলেও আদতে এটা মেনে চলার মতো লোকের বড়োই অভাব। তবে পাপ থেকে দূরে থাকার জন্য আমি নিজে ব্যবসা পরিচালনা না করে লোকজনের হাতে ছেড়ে দিতাম। আর আমার ব্যবসা মুদি দোকান ছিলো না, ছিলো গার্মেন্টস এর কারবার। সেখানে অনেকে অনেক অসুদুপায় অবলম্বন করেছে, ব্যবসা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। যে কারণে ব্যবসাটা আমার, সেহেতু আমি এ অপরাধে অপরাধী।

এখানেই বাবার সাথে আমার তফাৎ; সামান্যতম গর্হিত কাজ করতে হবে জানলে বাবা কখনোও সে পথ মাড়ান না। আমার অতি প্রিয় বাবার নিত্য দিনের সূচীর মধ্যে প্রথমেই ছিলো খুব ভোরে নিদ্রাত্যাগ। দাওয়ায় বসে ফজরের আজান শোনা। তিনি মন দিয়ে শ্রবণ করতেন আহ্বানের সেই মধুর বাণী—‘নিদ্রা হতে প্রার্থনা উত্তম।’

আমি অত ভোরে উঠতে পারতাম না। তবে মাঝে মাঝে তিনি আমাকেও জাগিয়ে তুলতেন। তারপর বাপ-বেটা একত্রে নামাজ আদায় করতাম। প্রার্থনায় বাবা কখনোই আত্মকেন্দ্রিক ছিলেন না। দেখেছি জগতের সকল মানুষের জন্য তার দোয়া। চেচনিয়া, বসনিয়া, ফিলিস্তিন, ইরাক, সিরিয়া, মায়ানমার, গুজরাটে নির্যাতিত মুসলমানের জন্য তার চোখের পানি আমাকে অবাক করতো। আবার দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্যও তাকে হাহাকার করতে দেখেছি। এমনই আমার বাবা।

খুব ভোরে আমাদের বাড়ির আঙিনায় কবুতরের মেলা বসতো। ছেলেবেলায় শুনেছি কবুতর পাপীদের ধারে আসে না। অনেক সময় দেখেছি বাবা সেই কবুতরগুলোকে নিজহাতে চাউল খাওয়াচ্ছেন। গেঞ্জি গায়ে টুপি মাথায় বাবাকে তখন আমার ওপারের মানুষ মনে হতো।

 

বর্ষণমুখর এক সকালে আমি অফিসে যাবার জন্য বেরুচ্ছিলাম, বাবা বললেন, ‘সারা বছর টাকার পিছে ছুটবি, এটা কেমনতরো কথা; দেখ—আজ এমনদিনে তারে বলা যায় ধরনের বর্ষণ হচ্ছে। তুই যদি কাউকে সেই ধরনের কিছু বলতে চাস, তাহলে কোন কথা নেই, আর সেরকম কেউ যদি না থাকে তাহলে চল বাপ-বেটা মিলে বৃষ্টিতে ভিজি। নিজেদের শুদ্ধ করার জন্য এরচে’ ভালো কিছু আর হতে পারে না।’

আমাদের বাড়ির সামনের লনে দুজনে মিলে বৃষ্টিতে ভিজলাম। বাবাকে তখন এতো সুখী দেখাচ্ছিলো, তিনি আমাকে বললেন, ‘বাবু, জীবনটা খুব সোজা, আমরাই তাকে জটিল করে ফেলি। আমি চাইবো, তুই যেন তোর নিজের জীবনটাকে জটিল না করিস।’

মাঝে মাঝে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হতো, এরকম একজন মানুষ আমার বাবা। যে কিনা আমাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। সব বাবাই তার ছেলেকে ভালোবাসেন, তবে আমার কাছে বাবাকে সম্পূর্ণ অন্যরকম মনে হতো।

আমার ভিতরে তাকে দেখার জন্য এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। কেমন আছে আমার বাবা? নিশ্চয়ই প্রিয় সন্তানের জন্য তার মনটা উতলা হয়ে আছে। আমি জানি বাবা আমাকে ছাড়া সম্পূর্ণ ভেঙে পড়বেন। তার নিজ হাতে গড়া জগতে বাসিন্দা ছিলাম আমরা দুজনই। একা সেই জগতে বাস করা তার পক্ষে খুবই দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে।

আর আমার মা, অসুখে-বিসুখে তাকে আমার শিয়রের পাশে বসে রাত জাগতে দেখেছি। আমার দুঃখে তাকে ব্যথিত হতে দেখেছি, আর আমার আনন্দে তাকে উদ্বেলিত হতে দেখেছি। মা তো মাই। পৃথিবীর তাবৎ মায়েদের মতো তিনিও মমতার আধার ছিলেন।

পারিবারিক বৃত্তের বাইরে আরো একজন মানুষ ছিলো যে আমার অসম্ভব প্রিয় ছিলো। বলা উচিত আমি তার অসম্ভব প্রিয় ছিলাম।

সে বৃষ্টি দেখে না, সে কবিতা পড়ে না, সে ছবি আঁকে না। আমার আর তার মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। পেশায় সে ছিলো ডাক্তার। কাটাকুটি আর জোড়া লাগানোর মধ্যে সে শিল্প খুঁজে পেতো। অবসরে ডাক্তারি বইয়ের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকতো।

তার সাথে আমার পরিচয় খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনার মধ্য দিয়ে। ছোট-খাট একটা স্ট্রোক এর মতো হয়েছিলো। আর দৈবক্রমে আমার চিকিৎসক ছিলো সেই। নরমাল অবস্থা ফিরে পাওয়ার পর এক অবকাশ মুহূর্তে আমার চিকিৎসক কেবিনে এসেছিলো আমার খবর নেওয়ার জন্য। তখনই তাকে আমি ভালো করে দেখি। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো, মেয়েদের দিকে গভীরভাবে তাকানোর মতো সময় বা ইচ্ছে কোনটাই আমার কোনকালেই ছিলো না। তাই তার চেহারার বর্ণনা দেওয়া আমার জন্য বেশ কঠিন কাজই বটে।

 

তার চেহারায় কী ছিলো আমি জানি না যা আমাকে খুব টানতো। হতে পারে প্রথমবার ভালোভাবে দেখেছিলাম বলেই। অথবা তার কাটা চিবুকটাই হয়তো আমার ভালো লেগেছিলো, কিংবা তার দু’গালে গভীর টোল। হাসার দরকার হতো না, কথা বললেই তার দু’গালে পাগল করা টোল পড়তো।

 

তার দিকে অপলক তাকিয়েছিলাম। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার আমার উৎসুক দৃষ্টি সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলো। সবকিছু চেক করার পর সে রায় দিলো, ‘আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ, বাসায় যেতে পারেন।’

শুনেছিলাম ডাক্তাররা নাকি পেশেন্টদের বন্ধু হয়। ওর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হলো কথাটা ডাহা মিথ্যা। এমন নিরাসক্ত গলায় কথাটা বলা হলো যে আমার মনে হলো আসলে কথাটা এরকম, ‘‘আপনার সব কল-কব্জা নষ্ট হয়ে গেছে, উপরে যাবার সময় সন্নিকটে।’’

 

এরপর আমার ক্ষেত্রে যা বেমানান তাই হতে লাগলো। ডাক্তারনির কথা বারবার মনে পড়তে লাগলো। সবকিছু ভেবে-চিন্তে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম। অতি সাধারণের প্রতি আমার মোহই ওকে ভালোলাগার প্রধান কারণ। পাশাপাশি ওর সাদাসিধে চেহারার আড়ালে অনন্য সুন্দর একটা মুখাবয়ব।

 

এক বিকেলে হাজির হলাম হাসপাতালে। ওকে খুঁজে পেতে সময় লাগলো না, সামনাসামনি বসে ও যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলো কেন এসছেন, তখন আমি বিচলিত বোধ করলাম। কারণ আমি নিজেই তো জানি না আমার এখানে আসার হেতু কী। যুতসই একটা কারণ তো দেখাতে হবে। ভাবতে ভাবতে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। সবশেষে যে কথাটা আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো তার জন্য ও কেন আমি নিজেও প্রস্তুত ছিলাম না। ‘‘আপনার গালের টোলটা না, অসাধারণ!’’ বলা বাক্যটা এরকমই ছিলো।

কোথায় যেন শুনেছিলাম প্রশংসাসূচক যে কোন বাক্যই অমৃতের মতো, বিশেষ করে মেযেদের কাছে। তবে এ ক্ষেত্রেও আমাকে বিস্মিত হতে হলো। কারণ ডাক্তারনির চেহারায় পরিবর্তন লক্ষ করা গেলো না। ততোধিক নিরাসক্ত গলায় সে বললো, ‘আমি জানি। আর কিছু?’

‘না, তেমন কিছু না।’ কুঁকড়ে গিয়ে বললাম।

‘তাহলে আপনি এখন আসতে পারেন। আমার কাজ আছে।’

যেতে যেতে অনেক কথাই আমার মনের অলিন্দে অনুরণন তুলতে লাগলো। হতে পারে সে একটা রোবট। তবে গ্রেডের হিসাবে খুব নিম্নমানের। মানবিক অনুভূতিহীন তো বটেই, এমনকি ন্যূনতম সৌজন্যবোধেরও দারুণ কমতি। কিংবা হতে পারে ভিনগ্রহের কেউ। মানুষের মতোই, তবে মানবিক গুণাবলীহীন।

 

এতোকিছুর পরেও আমার আটপৌরে মনে তার জন্য একটা জায়গা পয়দা হয়ে গেলো। কায়িক পরিশ্রম হলে না হয় একটা কথা ছিলো। কিন্তু মনের উপর তো আর জোর চলে না।

হাসপাতালে আবার গেলাম। এবার পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়েই। প্রস্তুতি বলতে ছাত্ররা পরীক্ষার জন্য যেভাবে রাত জেগে পড়ালেখা করে ঠিক সেভাবেই ঠিক করা কথাগুলো বলার প্র্যাকটিস।

আমাকে দেখে ডাক্তারনির চেহারা ঠিক আগের মতোই ফ্যাকাসে রঙ ধারণ করলো।

‘কী, আপনার কথা ভুলতে পারছি না, রাতজাগা পাখির মতো আমিও নিশাচর হয়ে গেছি। আপনাকে ভালোবাসি, আপনাকে ভালো লাগে… এসব বলতেই যদি এসে থাকেন, প্লিজ আপনি আসতে পারেন। আমার অনেক কাজ আছে।’ আমি কিছু বলার আগেই সে গড়গড় করে বলে গেলো।

‘চোখের উপর ঝুলে থাকা দাদার আমলের ওই চশমার মতো আপনার আচরণ। আসলে দোষ আপনার না, দোষ হচ্ছে ওই চশমাটার। যেটা আপনার চোখের উপর কালো একটা পর্দা ঝুলিয়ে রেখেছে। দেখতে দিচ্ছে না আপনাকে এই চিরহরিৎ বসুন্ধরা। একবার ওই চশমাটা সরান চোখের উপর থেকে, দেখবেন আপনার কল্পনার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর এই ধরা।’ কথাগুলো আমার রিহার্সেলের মধ্যে ছিলো না মোটেও। ওর যান্ত্রিক ব্যবহারের কারণেই হয়তো মুখের আগল খুলে গেলো।

ক্ষণিক নীরবতা; মনে হলো ডাক্তারনি কথাগুলো হজম করার চেষ্টা করছে। এও মনে হলো, আমার ছুঁড়ে দেওয়া তির ওর বুকে গিয়েই বেঁধেছে।

তবে আমার ধারণা যে কতোখানি ভুলে ভরা সেটা ওর পরের কথাতেই বোঝা গেলো।

‘ইনিয়ে-বিনিয়ে যে কথাটা বলার চেষ্টা আপনি করছেন, তার মর্মার্থটা আমি ভালো করেই বুঝি। আমার চশমাটা খোলার কষ্ট আপনাকে করতে হবে না। আপনি যে অনেক সুন্দর তা আমি দিব্যি চশমার ভেতর দিয়েই দেখতে পাচ্ছি। আপনার কথা শেষ হয়ে থাকলে আপনি এখন আসতে পারেন।’

এবার আর দ্বিধা বা দ্বন্দ্বের দোলাচলে দুলতে হলো না; স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম- ডাক্তারনি একটা রোবট। এদের দিয়ে ক্যালকুলেটিভ কোন কাজ নির্ভুলভাবে করা সম্ভব হলেও, প্রেম বা ভালোবাসার মতো আবেগসর্বস্ব কোনকিছু চিন্তা করাও অসম্ভব। তাই যেতে যেতেই ঠিক করলাম, জীবনেও আর এমুখো হচ্ছি না।

 

এর ঠিক একমাস বারো দিনের মাথায় আমার অফিসে ডাক্তারনি ফোন করলো। ওকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। যখন ওপাশ থেকে ওর পরিচয় জানালো, আমার তখন ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।

‘আপনার কি সময় হবে?’ কুশলাদির ধার দিয়েও গেলো না ডাক্তারনি।

‘কেন?’

‘প্রশ্ন করবেন না। সময় হবে কিনা বলুন।’

‘আসলে আমার হাতে অনেক কাজ। এক কাজ করুন না, আমার অফিসে চলে আসুন। ওখানেই...’

‘আমি ফোন রাখছি।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ তাড়াতাড়ি বললাম, ‘কোথায় আসতে হবে বলুন।’

‘আমার হাসপাতালে।’

যাবার সময় দশটা তরতাজা গোলাপ কিনলাম ওর জন্য। খানিক পরে একটা ডাস্টবিনে আবার সেগুলো ফেলেও দিলাম। রোবট নিশ্চয়ই গোলাপ ভালোবাসবে না।

এবার ডাক্তারনির চেহারা আগের চেয়েও বেশি অনুজ্জল। মুখের উপর বিষন্নতার একটা আবরণ। মনে হলো ওই আবরণটা ওর নিজেরই আরোপিত। তবে সেটা আমাকে তেমন প্রভাবিত করলো না; হতে পারে ওর আচরণ আমার পরিচিত বলে। কিংবা এও হতে পারে এবার আমার স্বেচ্ছাগমন ঘটেনি বলে।

‘কী যেন বলছিলেন আপনি; আমার দৃষ্টির সামনে কালো পর্দার কথা।’ মনে করিয়ে দেয়ার সুরে বললো ডাক্তারনি।

যুগপৎ বিস্ময় ও কৌতুক বোধ করলাম। আজ হতে একমাস বারো দিন আগের কথার রেশ টানা হচ্ছে এমনভাবে যেন মাঝখানের এতো লম্বা সময়টা কোন ফ্যাক্টরই নয়। ওর বলার ধরনটা এমনই।

‘দৃষ্টির সীমানায় যা আসে তাই দেখার চেষ্টা করুন। কোনকিছুই ফেলে দেবার নয়। অনুভব করুন বিধাতা যাকে দেখার শক্তি দেননি তার কষ্টটা। ফুল, পাখি, বৃষ্টি, কবিতা। আর মানুষের মন।’

‘সে সব দেখার জন্য কী করতে হবে আমাকে?’

‘রাজপথে খালি পায়ে হাঁটতে হবে, বর্ষায় এলোচুলে ভিজতে হবে, মধুমাসে শিউলির খোঁপা করতে হবে আর শীতের সকালে খুব ভোরে সাদা কুয়াশায় হারিয়ে যেতে হবে; কী, পারবেন?’ চোখ নাচিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্নটা এঁকে দিলাম নিজের মুখের উপর।

ডাক্তারনির মুখে রা সরে না। কিছুটা মুগ্ধ, কিছুটা দ্বিধান্বিত মনে হলো ওকে।

‘আর,’ আবার শুরু করলাম, ‘আমি জানি এর কোনকিছুই আপনার দ্বারা হবার নয়। কারণ... আমি নিজেও কোনসময় এতো কষ্ট স্বীকার করিনি।’ বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।

ডাক্তারনির চোখে চশমা ভেদ করে ফুটে উঠলো দারুণ ভর্ৎসনা, এড়িয়ে গেলাম। ‘আর নিতান্তই যদি এসব করতে ব্যর্থ হন তাহলে বিকল্প উপায়ও আছে।’ বললাম।

‘সেটা কী রকম?’ ওর চোখের তারায় ঝিলিক দিয়ে উঠলো কৌতুহল।

‘আমার মতো কাউকে ভালোবাসতে হবে।’ আমার বলার স্বরে স্পষ্ট ধরা পড়লো কম্পন। সেখানে কতোটা আবেগ আর কতোটা ভয় মিশ্রিত ছিলো তা নির্ণয় করা আমার পক্ষে অসম্ভব ছিলো।

এ কথাটা ডাক্তারনিকে বলার আগে ওর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে অনেক ভেবেছিলাম। তবে সেটা যে আমার কল্পনার সীমানা থেকে হাজার ক্রোশ দূরে তা অবলোকন করে যারপরনাই বিস্মিত হলাম। ডাক্তারনি আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, ‘আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না; ভালোবাসা নামের চিরন্তন সত্যটাকে অনুভব করার জন্য দশজনের মতো আমিও ব্যকুল ছিলাম। হাজার মানুষের ভীড়ে আলাদা একজন, যে শুধু আমাকে নিয়ে ভাববে, তার মুখায়বয়বটা সারাক্ষণই চোখের সামনে খেলা করতো।

‘তাকে চিনে নেয়ার জন্য আমি নিজেই নিজের চারপাশ ঘিরে একটা দেয়াল তৈরী করি। সেই দেয়াল যে ভেদ করতে পারবে সেই হবে আমার ভালোবাসার পাত্র। এমন একটা ধ্যান আমার মনের মধ্যে ছিলো। অনেকেই আমার সান্নিধ্যে আসতে চেয়েছে, কিন্তু সেই দেয়ালের পুরুত্ব আর উচ্চতা তাদের বাধ্য করেছে ফিরে যেতে। কিছুদিন থেকে মনে হচ্ছে সেই দেয়ালটা একটু একটু করে সরতে শুরু করেছে। এবং সেটা আপনাকে দেখার পর থেকেই।

‘আমি বলছি না যে আপনিই সেই, তবে মনে হচ্ছে আপনাকে একটা সুযোগ দেয়া যেতে পারে। আপনার বলা কথাগুলো কিতাবি ভাষার মতো মনে হলেও আমার ভালো লেগেছে। মুখনিঃসৃত কথাগুলোকে যদি বাস্তবে রূপ দিতে পারেন তাহলে আমি আপনার পথ চলার সাথী হতে মোটেও আপত্তি করবো না।’

সেদিনই ডাক্তারনির নাম জানতে পারি। ওর নাম তন্দ্রা।

এরপরের দিনগুলো আমার পরীক্ষার দিন ছিলো। ওকে নিয়ে আমি বাইরে ঘুরতে বেরুতাম। তবে স্থান কখনোই পার্ক বা রেস্টুরেন্ট নয়। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে গিয়েছি আমরা। যেখানে লুকায়িত আছে এদেশের ইতিহাস, কৃষ্টি ও কালচার।

নগরে যতোগুলো যাদুঘর আছে সবখানেই আমরা ঢুঁ মেরেছি। বৃহস্পতিবারে মহিলা সমিতিতে নাটক দেখেছি। এদেশের সাহিত্যকে যারা সমৃদ্ধ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত, তাদের সাথে তন্দ্রার পরিচয় করিয়ে দিয়েছি।

তারপর ও একদিন আমাকে বললো, ‘তোমার রুচি, তোমার মননশীলতা যেকোন নারীর জন্য আরাধ্য। তোমার সাথে কাটানো এই দিনগুলো আমার নিজের কাছে নিজেকে ছোট করে দিয়েছে। কেবলি মনে হচ্ছে এতদিন আমি সত্যিই অন্ধ ছিলাম। আমার দেশ যে এতবড়ো, এতো সমৃদ্ধ সে সমন্ধে আমি একেবারেই অজ্ঞ ছিলাম।’

তন্দ্রার সাথে আমার বিযে হয়ে গেলো। আমি চাইলাম অনুষ্ঠানটা খুব জাঁক-জমক হোক। কিন্তু ও কিছুতেই করতে দিলো না। প্রয়োজনের চেয়ে এক পয়সাও বাড়তি খরচ করতে দিলো না। বললো, ‘অপচয় না করে সেগুলো তুমি এসিড ভিকটিম, পয়সার জন্য যাদের চিকিৎসা হচ্ছে না তাদের দিয়ে দাও। অন্তত একজনও যদি চিকিৎসা পায় তারচে ভালো কিছু আর হতে পারে না।’

জানলাম ডাক্তারি শাস্ত্রকে ও মনে-প্রাণে ভালোবাসে আর সেই সাথে অসহায় মানুষকেও।

তবে ওকে চিনতে যে আরো অনেক বাকি ছিলো সেটা আমার জানা ছিলো না।

 

তন্দ্রা ভালোবাসতে জানে। ও জানে কী করে মন-প্রাণ সঁপে দিতে হয়। বিয়ের পর আমার জীবনটাকে রঙিন ঘুড়ি বানিয়ে দিলো। তবে নাটাইটা ওর হাতেই থাকলো। ও নাচায় আমি নাচি।

বাবা-মার প্রতি ওর সীমাহীন দায়িত্ববোধ আমাকে আনন্দিত এবং বিস্মিত করতো। মাঝে মাঝে বিভ্র্রান্ত হয়ে যেতাম। তন্দ্রা আমার চাইতেও কি বেশি ভালোবাসে ওনাদের?

বাবার প্রত্যুষে উঠার আনন্দটা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিলো তন্দ্রা। ওনাকে অবাক করে দিয়ে ও তার আগেই নিদ্রাত্যাগ করতো। আর কড়া লিকার দিয়ে বানানো এক কাপ চা বাবার হাতে দিতো। উনি এতো আনন্দিত হতেন যে বলার মতো নয়। আমাকে প্রায়ই বলতেন, ‘বাবু, আমি আমার জীবনে বিরাট কোন পুণ্য করেছি, নয়তো এই পদ্মিনী আমার ঘর আলো করবে কেন?’

মাকে কোন কাজে হাত লাগাতে দিতো না ও। ‘মেয়েটা আমাকে একেবারে কুঁড়ের রানী বানিয়ে দিলো।’ মায়ের মন্তব্য।

বিয়ের আগে ওকে বলা কথাগুলো সত্যি হয়ে এসেছিলো আমাদের জীবনে। প্রভাত ফেরিতে খালি পায়ে রাজপথ দিয়ে হেঁটে শহীদ বেদিতে ফুল দিয়েছি। ঘোর বরিষায় প্রমত্ত হাওয়ায় পাল তোলা নৌকার মতো ছুটে বেড়িয়েছি। বসন্তে শিউলির খোঁপা করে সবুজ শাড়িতে ও আমার সামনে দাঁড়াতো আর আমি অপলক নেত্রে তাকিয়ে দেখতাম।

শীতের সকালে হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় সফেদ কুয়াশায় শিশির ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে গেছি অনেকদূর।

সত্যিকার অর্থেই জীবনের আসল স্বাদ পেয়েছিলাম সেই দিনগুলোতে।

ভাবনার রাজ্যে বিচরণ করতে করতে কবে যে বাড়ির সামনে চলে এসছি টেরই পাইনি। দূর থেকে চিরচেনা ‘আপন-ভিলা’-কে দেখে বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। আমার শৈশব, কৈশোর এবং যৌবন যেখানে অতিক্রান্ত হয়েছে সেই আপন ভিলা ঠিক আগের মতোই আছে। পাঁচতালা দালানটা নীল রঙের। কালো লোহার বেড় দেয়া বেলকনি, তাতে পরিচ্ছন্নতার সাথে লাগানো অর্কিড। বাড়ির সামনে সুবিশাল লন। তার মধ্যিখানে সুইমিং পুল। একপাশে সবুজ ঘাসের উপর সাদা চেয়ার টেবিল।

সবকিছু ঠিক আগের মতো। কোন কিছুই পাল্টায়নি। বাড়ির বাসিন্দারা কেমন আছে?

নীরবতা বিরাজ করছে চারিদিকে। জানি, আমি যাওয়ার পর যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে এ তারই নিদর্শন। গেট পেরিয়ে সামনে এগোলাম। সদর দরোজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই উচ্চকণ্ঠে হাসির আওয়াজ কানে এলো।

‘জানো, রবিউলের মতো কমেডিয়ানরা একবারই জন্মায়। ছবিটা যতোবারই দেখি, হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হয়ে যায়।’ বাবার গলা; বাবা কৌতুকে মেতে আছেন! বিশাল একটা ধাক্কা খেলাম।

‘হ্যাঁ, আজকালকার ছবির কমেডিয়ানরা যা করে না! স্রেফ ভাঁড়ামি।’ মাও আছেন বাবার সাথে!

সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটা পরিবেশের মুখোমুখি হয়ে আমি বিলকুল থ’ মেরে গেলাম। এ কী করে সম্ভব! মাত্র তিনমাসও হয়নি, এরমধ্যেই মা-বাবা আমাকে ভুলে গেছেন!

আমার বিশ্বাস ছিলো আমি ছাড়া এই আপন ভিলার পরিবেশ থাকবে শোকাবহ। কারণ আমাকে ছাড়া এই ঘর একদমই শূন্য। কিন্তু দেখছি তার উল্টো। আমার জন্মদাতা এবং জন্মদাত্রী, দুজনেই খোশগল্পে মত্ত!

অন্দরমহলে ঢোকার আগে একবার চিন্তা করলাম। তন্দ্রা কোথায় থাকতে পারে। এ সময়টা ওর প্রার্থনায় কাটে। বাবার পরে ওই এ ঘরে আর্লি রাইজার। বাবার প্রার্থনা শেষ করার পর ও ইবাদতঘরে ঢোকে। অনেকক্ষণ ধরে প্রার্থনায় রত থাকে।

আমি জানি আর সবাই ভুলে গেলেও তন্দ্রা আমাকে ভুলতে পারবে না। তিনমাস কেন তিনযুগ পেরিয়ে গেলেও তার মনে আমিই বিরাজমান থাকবো।

ইবাদতঘরে যাবার জন্য পা বাড়াবো, ঠিক তখনই ও বসার ঘরে প্রবেশ করলো। বাবা, মার জন্য চা করে নিয়ে এসছে। দেখলাম ওকে। পায়ের পাতা থেকে মস্তক পর্যন্ত আগাগোড়া পবিত্রতায় মোড়া এক মানবী। আটপৌরে একটা শাড়ি জড়িয়েছে গায়ে। সেটা তার সৌন্দর্যকে ম্লান করতে পারেনি মোটেও। বরং সেই কাপড় ভেদ করে ঠিকরে বেরুচ্ছে ওর রূপের ছটা। সদ্য প্রার্থনাস্নাত তন্দ্রাকে এতটাই মোহনীয় লাগছে যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা বেশ দুরূহ হয়ে দাঁড়ালো আমার জন্য। মনে হলো অনন্তকাল ধরে ওই মানবীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আর সে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সে যখন আমার সামনে এলো তখন পৃথিবী বিস্মৃত হয়ে তাকে আলিঙ্গনে জড়ানোর জন্য আমার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন বিদ্রোহ করতে চাইলো।

 

আমার সীমাবদ্ধতাকে ভুলে ছুটে যাবার জন্য পা বাড়াবো ঠিক তখনই কথা বলে উঠলেন বাবা, ‘মা, তন্দ্রা, রাগীবের সাথে কী কথা হলো গতকাল? ওকে কি পছন্দ হয়েছে তোমার?’

কোন প্রতিক্রিয়া আমার মধ্যে কাজ করার আগেই দ্রুত তন্দ্রার মুখের দিকে তাকালাম। দেখলাম ওর মুখে সম্মতিসূচক মুচকি হাসি। আমার বিশ্বাস হলো না, স্বচক্ষে দেখার পরও। ধক করে উঠলো বুকের ভেতরটা!

তন্দ্রার বিয়ের কথা হচ্ছে!

‘ছেলেটা খুবই ভালো, আমার বন্ধুর ছেলে। আমেরিকা থেকে এসছে। আমার পুত্রবধূ জেনেও সে যে তোমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে, এটা অত্যন্ত আনন্দের।’ মোলায়েম গলা বাবার।

তন্দ্রার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমার বাল্যবন্ধু রাগীবের সাথে। বাবা-মা, আমার স্ত্রীর বিয়ে ঠিক করেছেন। আমার যাওয়ার তিনমাসের মাথায়। সবকিছুই মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু তন্দ্রা? তিনমাসেই আমি তার মন থেকে মুছে গেলাম!

আমার সমস্ত অনুভুতি ভোঁতা হয়ে গেলো। মাত্র নব্বুই দিনেই একটা মানুষের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে পারে! পৃথিবী থেকে, মানুষের মন থেকে?

আমার জন্মদাতা-জন্মদাত্রী; যাদের ছায়াতলে কাটিয়েছি এতোগুলো বছর, সেই বাবা-মা খুব সহজেই তাদের সন্তানকে ভুলে গেছেন।

আর যার চোখে পৃথিবীর আর এক রূপ প্রত্যক্ষ করেছিলাম, যে কিনা হাতে হাত রেখে বলেছিলো, ‘নিঃশ্বাসের কাছে থাকো কিংবা মেঘের আড়ালে, চোখের মনিতে থাকো কিংবা দৃষ্টির সীমানা থেকে যোজন যোজন দূরে, জেনো তোমারই আছি, তোমারই থাকবো।’

‘না, খুব সহজেই অন্যের হয়ে গেছো। পর করে দিয়েছো আমায়।’ বুকের ভেতর গুমরে উঠা এক দলা যন্ত্রণা যেন বলে উঠলো চিৎকার করে।

লাজুক হাসি ঠোঁটের আগায় ধরে রেখে নিজের ঘরে চলে গেল তন্দ্রা। পিছু নিলাম ওর, বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে মুঠোফোনে ছবি দেখছে রাগীবের। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাচ্ছে ওর চেহারার রঙ, খেলা করছে সেখানে রক্তিম আভা। বোঝার বাকি থাকে না, পূর্ন যৌবনা তন্দ্রার তনু-মন সমাগত ভালোবাসার কল্পনায় বিভোর!

 

এখানে এখন এক মুহূর্তও থাকাটা অর্থহীন। আপন ভিলায় এখন আমি পর, অবাঞ্চিত কিংবা অনাহুত। বুকের কাছে দলা পাকানো কষ্টটা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অপার্থিব এক ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বেরিয়ে এলাম ও বাড়ি থেকে। ফিরে চললাম, যেখান থেকে এসেছি সেখানে। বাড়ির লন পেরিয়ে সরু রাস্তাটা যেখানে গিয়ে মূল সড়কের সাথে মিশেছে, ঠিক সেখানটায় হাতের বাঁ পাশে আমাদের পারিবারিক কবরস্থান। কোমর সমান উঁচু বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতরে জায়গাটা একদম সুনসান, শান্ত-নিস্তরঙ্গ। জাগতিক কোলাহল থেকে মুক্ত। মুক্ত সকল লৌকিক বন্ধন থেকেও। চারিদিকে নানান প্রজাতির গাছগুলো অকৃপণ হাতে বিলাচ্ছে ফুরফুরে বাতাস। কবরস্থানে জমে থাকা ঝরা পাতাগুলো থেমে থেমেই নিজেদের জায়গা বদল করছে। পারিবারিক কবরস্থান যেহেতু, খুব বেশি সংখ্যক কবর নেই এখানে। পূর্বদিকে অপেক্ষাকৃত নতুন একজন বাসিন্দার কবর চোখে পড়ছে। খেজুর গাছের একটা শাখা, যেটার উপরিভাগে একটা ঠুকরি রাখা আছে। মাটি চাপা দেয়া কবরটার উপরে শোভা পাচ্ছে নানান রঙের এবং নানান কথার পুষ্পাঞ্জলি। পাথরে খোদাই করা নাম এবং মৃত্যুতারিখ লেখা হয়েছে। “মরহুম রাইয়ান আহমেদ (বাবু)’’, মৃত্যু- মার্চ-০২, ২০১৯।

 

সময়টা আজ থেকে নব্বুই দিন আগের...