বাইপাসের পাশে খুন - ত্রিদিবেন্দ্র নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

রহস্য বড় গল্প

অলংকরণ - কর্ণিকা বিশ্বাস
১ (সৌমিলি খুন হল)

“দেখুন দিদি, আপনি এভাবে কান্নাকাটি করে গেলে আমার পক্ষে কিছুই বোঝা সম্ভব হবে না। আপনি একটু শান্ত হয়ে সব কথা খুলে বলুন।”

“ও কিছুতেই এই খুনটা করতে পারে না। পুলিশ বিনা কারণে ওকে অ্যারেষ্ট করেছে। ওর জামিনের ব্যবস্থা আপনাকে করে দিতেই হবে।”

“খুনের মামলায় কি অত সহজে জামিন হয় না কি? আমি উকিল, ম্যাজিশিয়ান তো নই। কিন্তু ও দাদা ওনাকে থামান না।”

যাকে দাদা সম্বোধন করা হল তার কান্না থামাবার বিশেষ কোন চেষ্টা দেখা গেল না। মিনিট খানেক ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে শেষে মেয়েটি নিজেই নিজের কান্না সম্বরণ করল। সমলয় বলল, “এবারে ঠান্ডা হয়ে বসে এক এক করে বলুন। আপনার নাম কী?”

“অনুশীলা ভাদুড়ি।” মেয়েটি জবাব দিল।

“আর আপনার সঙ্গে যিনি আছেন?”

“তনিষ্ঠ মজুমদার।” ছেলেটির উত্তর।

“যাকে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে তিনি আপনাদের কে হন?”

তনিষ্ঠ জবাব দিল, “আমরা তিনজনেই ডেটাপ্রো নেটওয়ার্ক সার্ভিসেসে কাজ করি।”

বৃদ্ধ উকিলের মত ভাব করে সমলয় বলল, “অ । তা একজন কলিগ সম্বন্ধে উনি এতটা নিশ্চিত কী করে হচ্ছেন?” অনুশীলা হঠাৎ টকটকে লাল হয়ে উঠল। মেয়েটি একটু বেশী রকমেরই ফরসা। তাই বলে এতটা ব্লাশ করা মোটেও স্বাভাবিক নয়। আমি একটু গভীরভাবেই অনুশীলার দিকে নজর করলাম। অনুশীলা বেশ রোগা এবং লম্বা। প্রায় পাঁচ চার হবে। বয়স ত্রিশের বেশ কিছুটা নিচেই হবে। মুখশ্রী সুন্দর বলা যায়, কিন্তু তারপরেও এমন একটা সরল ভালমানুষি ভাব মাখানো আছে যে দেখলেই মনে হয় এই মেয়েটা মিথ্যে কথা বলতেই পারে না। সঙ্গের ভদ্রলোক, মানে যার নাম তনিষ্ঠ, তার চেহারা খুবই বিশেষত্বহীন। অর্থাৎ সব কিছুই যেন ভীষণ মাঝারি। ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে দিলে আলাদা করে চেনা যাবে না।

সমলয়ের প্রশ্নে অনুশীলা এতটাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল যে সে সেই যে মুখ নিচু করেছে আর কোন কথা মুখে আসছে না। তনিষ্ঠ এবারে ব্যাপারটা নিজের হাতে নিল। বলল, “ব্যাপারটা একটু সেনসিটিভ কিন্তু ডাক্তার আর উকিলের কাছে নাকি কিছু লুকোতে নেই। তাই... বলেই দি অনুশীলা।” বলে তনিষ্ঠ একবার অনুশীলার দিকে তাকাল। অনুশীলা লাল হয়ে, মাথা নিচু করে, পারলে মাটির ভিতরেই ঢুকে যায় আর কি। অগত্যা তনিষ্ঠ বলতে শুরু করল। তনিষ্ঠর দেখা গেল গুছিয়ে কথা বলার অভ্যাস বিশেষ নেই। অনেক জড়িয়ে পেঁচিয়ে যা বলল তার সার নির্যাস হল এই। আসলে ঋতমকে দেখে প্রথম দর্শনেই অনুশীলা হেড টু হিল ওর প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু ঋতম অন্য একটি মেয়ের প্রতি দুর্বল ছিল। ইনফ্যাক্ট এই মেয়েটি অর্থাৎ সৌমিলি ভট্টাচার্যই খুন হয়েছে। সৌমিলি যাদবপুরের ছাত্রী ছিল এবং একটু অন্য ধরনের মেয়ে ছিল। তার অনেক বয়ফ্রেন্ড, সেসব বাদ দিয়ে কেবলমাত্র ঋতমের দিকে মন দেবার কোন ইচ্ছে তার ছিল না। এদিকে ঋতম আর অনুশীলা দুজনেই একেবারে একে চন্দ্র টাইপ একনিষ্ঠ প্রেমে বিশ্বাসী। কাজেই কেউই তার নিজের অবস্থান ছাড়তে রাজি নয়। এখন সৌমিলি খুন হওয়ায় পুলিশ ঋতমকে গ্রেফতার করেছে। অনুশীলা নিঃসন্দেহ যে ঋতম খুন করতেই পারে না। এখন ওরা চায় যে সমলয় ঋতমের পক্ষে দাঁড়াক।

আমি ভাবলাম বাবা এ তো পরশুরামের প্রেমচক্র গল্পের মত কেস। অনুশীলা ---> ঋতম ---> সৌমিলি ---> ? এদিকে আবার যদি দেখা যায় এই তনিষ্ঠ বাবাজি আবার অনুশীলার প্রেমে হাবুডুবু তাহলে তো খেলা জমে দই!

সমলয় এতক্ষণ চুপ করে বসে শুনছিল। এবারে বলল, “এবারে ঘটনার দিন কী হয়েছিল বলুন?”

তনিষ্ঠ বলল ঋতম সাড়ে পাঁচটা নাগাদ গাড়ি নিয়ে যাদবপুর থেকে সৌমিলিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সৌমিলি যদিও ঢাকুরিয়ার দিকে পেইং গেস্ট থাকে, কিন্তু ওদের প্ল্যান ছিল স্বভূমির পাশে একটা নুতন রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করে তারপর আবার ঢাকুরিয়ায় ফিরে আসবে। কিন্তু গাড়িতেই ওদের ঝগড়া শুরু হয়। সাইন্সসিটির থেকে একটু এগিয়ে যে জলা মত জায়গাটা আছে, তার ঠিক আগে যখন ওরা পৌঁছল তখন ওদের ঝগড়া সপ্তমে। রাগে গর গর করতে করতে নাকি সৌমিলি গাড়ি থামাতে বলে। ঋতম গাড়ি থামাতেই সৌমিলি নেমে যায়। ঋতমও রাগের মাথায় সাধ্যসাধনা না করে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি চলে যায়। পরদিন সৌমিলি যে বাড়িতে পি-জি থাকত তারা থানায় মিসিং ডায়রি করে। দিন তিনেক পর যখন বাইপাসের ধারে সৌমিলির পচা লাস উদ্ধার হয় তখনই পুলিশ তদন্ত শুরু করে এবং স্বাভাবিক ভাবেই ঋতমকে অ্যারেস্ট করে তার বিরুদ্ধে সরাসরি খুনের চার্জ আনে।

আমারও মনে পড়ে যায়। গতকালই বাইপাসের ধারে নিহত ছাত্রী এই রকম ক্যাপশানে খবর বেরিয়েছে। তবে অন্য বড় খবর থাকায় ওটা মাঝখানের কোন পাতায় বেরিয়েছিল। এটাও মনে আছে যে খুনি প্রবল আক্রোশে তার শিকারের মাথা পাথর দিয়ে চুরমার করে দিয়েছিল। কিন্তু আমার একটা কথা মনে হচ্ছিল, দেখলাম ঠিক একই সময় সমলয়ও প্রশ্নটা করল। “আচ্ছা জায়গাটা তো খুব একটা রিমোট নয়? তাহলে দুদিন ধরে লাস কেউ নজর করল না কেন?” তনিষ্ঠ বলল, “এখানে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়েছে। লাসের উপর একটা চটের বস্তা ফেলে তার উপরে দুটো মরা কুকুর ফেলে রাখা ছিল। তার ফলে গন্ধে গন্ধ চাপা পড়ে গিয়েছিল।”

সমলয় একটু হলেও নড়ে বসল। ওর এই মুভমেন্টটা আমি চিনি। এর অর্থ ও ইন্টারেস্টিং কিছু শুনেছে বা বুঝেছে। বলল, “পুলিশ কত ধারায় কেস দিয়েছে জানেন কি?” তনিষ্ঠ বলল, “না তা জানি না তবে জেনে এসে বলতে পারি।”

“তার এখন আর দরকার হবে না। বাকিটা আমিই করে নেব।”

ওদের অফিস যাবার তাড়া ছিল। এরপর যথাযথ ওকালতনামায় সই করে রিটেইনার দিয়ে (মানে কিছু অগ্রীম বুকিং ফি বলা যায়) ওরা চলে গেল।

সমলয় আমার দিকে ফিরে বলল, “বল তো মধুছন্দা, এই ইনভেস্টিগেশান ঠিক কোন জায়গা থেকে শুরু হওয়া উচিত?” আমি বললাম, “প্রথমে নিশ্চয়ই পুলিশের কাছে যাবি?”

“সে তো জামিনের জন্য আর কেসের কাগজপত্র দেখার জন্য। তার দেরি আছে। আগামি কাল বা পরশু ঋতমকে পুলিশ কোর্টে পাঠাবে। আমি জামিন চাইব, পুলিশ কাস্টডি চাইবে। জজসাহেব নিঃসংশয়ে পুলিসকে পাঁচদিন বা সাতদিন কাস্টডি মঞ্জুর করবেন। কিন্তু আমার কাজ হবে এর মধ্যেই বেশ কিছু সংশয়ের বীজ দুপক্ষের মনেই বুনে দেয়া। জজসাহেবকে এই মর্মে কনভিন্স করতে হবে যে কেস মোটেই ওপন অ্যান্ড শাট নয়। কাজেই পুলিস যেন আমাকে আগেই পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট বা অন্য সব কাগজপত্র দেখায়। আর পুলিসকেও বোঝাতে হবে যে আমার হাতে কিছু তাস অন্তত আছে। কাজেই আমাকে সাহায্য করলে আখেরে লাভ হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত যা দেখছি কেস আমার ক্লায়েন্টের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। একেবারে ওয়াটার টাইট সিচুয়েশান। কিন্তু এসব হল উকিলি প্যাঁচ। ইনভেস্টিগেশান শুরু হবে যাদবপুরে।”

“যাদবপুরে? সেখানে কী আছে?”

“সেখানে আছে সৌমিলি ভট্টাচার্যের বন্ধু বান্ধবীরা। তুই জার্নালিস্ট। মেয়েটার বন্ধুদের কাছে খোঁজখবর নেয়াটা তুইই ভাল পারবি।” আমি বললাম, “তোর হাতে যখন খুনের কেস, তখন একটা স্টোরি তো আমি এমনিই করতে পারি। সত্যি সত্যিই খোঁজখবর নিতে যাব।”

“তাহলে শুভস্য শীঘ্রম। চল বেরিয়ে পড়ি। মিনিট খানেকের মধ্যেই রেডি হয়ে আসছি।”

মিনিটখানেকের মধ্যেই মাসীমা অর্থাৎ সমলয়ের মার হৈ চৈ শোনা গেল, “দেখ দেখি কাণ্ড। বেলা বারোটার সময় না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস? খেয়ে বেরো আর মধুছন্দাকেও দুটো খাইয়ে দিই।” লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে আসতে আসতে সমলয় চ্যাঁচাল, “সময় নেই সময় নেই। আমরা বাইরে কোথাও খেয়ে নেব।” আমাকে বলল, “দেখছিস কী? চলে চল! ওল্ড লেডি ধরলে দুটোর আগে ছাড়া পাবি না।” আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেরোলাম। কারণ মাসীমার রান্না ফাটাফাটি রকমের ভাল। তাছাড়া আমি খেতে রাজি হলে চট করে আমার ফেবারিট দু একটা ডিসও রান্না হয়ে যেত। একটু দেরি হলে কী আর এমন ক্ষতি হত?

এবারে আমাদের পরিচয়টা দিয়েই দি। আমি মধুছন্দা পাল। বয়স ছাব্বিশ। অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজিতে এম-এস-সি করে এখন ফ্রি ল্যান্স জার্নালিস্ট। সমলয় হল ক্রিমিন্যাল লইয়ার। আমার সমবয়সিই হবে। বছরখানেক হল নিজের প্র্যাকটিস শুরু করেছে। এর মধ্যেই গোটাকয় কঠিন কেস জেতার দরুণ হাতে কেস আসতে শুরু করেছে। কিন্তু সমলয় আইনের থেকে অন্য নানা বিষয়ে বেশি আগ্রহী।

আমাদের সম্পর্ক নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। আমরা স্রেফ বন্ধু। তবে কখন কখন মনে হয় সমলয় সম্পর্কটাকে আর একটু গভীরে নিয়ে যাবার তালে আছে।

২ (যাদবপুরের অন্তঃপুরে)

যাদবপুরে বেঙ্গল ল্যাম্পের গেট দিয়ে ঢুকে আর্টস ফ্যাকাল্টির দিকে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল রিলেশানসের থার্ড সেমের স্টুডেন্টদের খুঁজে পেতে অনেক সময় লেগে গেল। তারপর তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে গেল আরো খানিকটা সময়। তারপর যখন ওরা দেখল আমরা ছবিও তুলব না বা টেপরেকর্ডারও আনি নি তখন একটু একটু মুখ খুলল। এদের মধ্যে উর্জিতা বলে একটা বেশ মোটাসোটা তড়বড়ে গোছের মেয়ে শেষ পর্যন্ত আমাদের কাজের কথা গুলো বলল। কিছু প্রাথমিক কথার পর প্রশ্ন করেছিলাম, “তোমরা ঋতমকে চিনতে?” উর্জিতা বলল, “খুব ভাল ভাবে যে চিনতাম তা নয়। ওকে সৌমিলি আড়ালে খোকাবাবু বলত এবং ওকে নিয়ে নানা রকম হাসিঠাট্টা করত। কিন্তু এলে আবার বেশ ঘনিষ্ঠতাও দেখাত। যাকে নাচানো বলে না? সৌমিলি ওকে তাইই করত।”

“আচ্ছা সৌমিলির কি অন্য কোন বয়ফ্রেন্ড ছিল?”

“অন্য মানে স্টেডি কেউ ছিল না। আসলে সৌমিলি স্টেডি রিলেশানে বিশ্বাস করত না, কিন্তু ছেলেগুলো টপাটপ ওর প্রেমে পড়ত।”

“এইসব ছেলেদের সৌমিলি কীভাবে হ্যান্ডেল করত?”

“পয়সাওয়ালা হলে অল্পবিস্তর প্রশ্রয় দিত। বাকিদের পাত্তা দিত না, কাউকে কাউকে বেশ অপমান করতেও দেখেছি। ঋতম যেমন ওর পিছনে পাগলের মত পয়সা খরচ করত। সৌমিলিও তাই সামনে গলে গলে পড়ত, ওর সঙ্গে এখানে ওখানে যেত। কিন্তু সিরিয়াসলি কাউকেই নেয়নি।”

“এইসব ছেলেরা ব্যাপারটাকে কীভাবে নিত?”

“গণ্ডগোল যে একেবারে হত না তা নয়। সেই তো সেই ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছেলেটা, রফিক নাম ছিল, মুসলিম, হিউজ বড়লোক। ওকে নিয়ে তো সৌমিলি খুব ঘুরত। তারপর একবার মন্দারমনি ঘুরে আসার পর একদিন বেদম ঝগড়া হয়ে গেল। তারপর সৌমিলি আর ওকে পাত্তাও দেয় না, ওর সঙ্গে কথাও বলে না। ছেলেটা কদিন পাগলের মত পিছন পিছন ঘুরল, তারপর বার দুয়েক সুইসাইডের চেষ্টা করে এখন পড়াশোনা ছেড়ে দেবদাস হয়ে গেছে। আমাদের এক বন্ধু নীতিকা বলে সৌমিলি ছেলেদের ভেড়া বানাবার মন্ত্র জানে। প্রাণে মায়াদয়া বলেও কিচ্ছু ছিল না।”

“এটা কবেকার ঘটনা?”

“ওই তো সেকেন্ড সেমের শেষের দিকের কথা, মাস তিনেক হবে।”

“এ ছাড়া আর কোন বড় ঘটনা?”

“সে রকম কিছু না। কেউ তো আর সত্যি ভেড়া নয়। সবাই জেনে গিয়েছিল যে সৌমিলি ফ্লার্ট টাইপের মেয়ে। তাই খুব সিরিয়াস কিছু আর হয়নি। তবে ছোটখাট ঝগড়া প্রায়ই হত। আর ওই রফিকের দলবল একবার নাকি ওকে থ্রেট করে, সেও মাসদুয়েক আগে। সৌমিলি ভীষণ ভয় পেয়ে ওর দেশ মালদায় পালিয়েছিল। মাসখানেক আগে ফিরেছিল।”

“আচ্ছা ঋতম সৌমিলিকে কেন খুন করল বলতে পার?”

“না। তা বলতে পারি না। কিন্তু ঋতমকে খুনি ভাবতে আমাদের খারাপ লাগছে।” এবারে আশপাশের অন্য মেয়েগুলোও সায় দিল। তাদের বক্তব্য ঋতম অত্যন্ত ভদ্র এবং ভাল ছেলে। ওকে নীতিকা একবার রফিকের ঘটনাটা বলে সৌমিলি সম্বন্ধে সাবধান করেও দিয়েছিল কিন্তু ঋতম ব্যাপারটা গ্রাহ্যও করেনি।

আমার শেষ প্রশ্ন ছিল, “তোমরা খুনের দিন সৌমিলিকে ঋতমের সঙ্গে বেরতে দেখেছ?” ওরা পরস্পরের সঙ্গে তাকাতাকি করল এবং বোঝা গেল কেউই দেখেনি।

ওদের ধন্যবাদ দিয়ে আমরা বেরিয়ে আসছি। তখন হঠাৎ উর্জিতা দৌড়ে এসে আমাদের একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। দেখি তাতে নিজের নাম আর ফোন নম্বর লেখা। বুঝলাম ও আড়ালে আমাদের কিছু বলতে চায়।

আর্টস ফ্যাকাল্টি থেকে বেরিয়ে আমরা এবার বিখ্যাত ব্রিজ পেরিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির দিকে হাঁটা মারলাম। কারণ হিসাবে সমলয় বলল ওর এক বন্ধু সাইদুল হক মেকানিকাল ইঙ্গিনিয়ারিং এর ফ্যাকাল্টি। সে নাকি যাদবপুর ইউনিভার্সিটির মাইনরিটি ওয়েলফেয়ার আর স্কলারশিপের ব্যাপারটা দেখাশুনা করে। ওর কাছে রফিক সম্বন্ধে একটু খোঁজ নেয়া যেতে পারে। চলতে চলতে সমলয়কে জিজ্ঞাসা করলাম, “তোর এখন কী মনে হচ্ছে?” সমলয় বলল, “দেখ খুনটা কিন্তু প্ল্যানড্‌, কারণ ডেডবডি রেখে তার উপর চট চাপা দিয়ে মরা কুকুর রেখে দেয়া যথেষ্ট ভাবনা চিন্তার ফল। এখন ঋতম সম্বন্ধে যেটুকু জেনেছি তাতে তার পক্ষে মাথা গরম করে হঠাৎ মার্ডার করা যদিও বা সম্ভব হয় কিন্তু এতটা প্ল্যান করে খুন? কেনই বা করবে? আমার মনে হয় এই রফিকের খোঁজটা ডিটেলে নিতে হবে কারণ এই ছেলেটা একে ক্ষেপে আছে। তায় এর একটা ঠান্ডা মাথায় প্রতিহিংসা নেবার ব্যাপার থাকতে পারে। আর ওর দলবল সৌমিলিকে থ্রেটও করেছিল। অবশ্য কোন সিদ্ধান্তে আসার ব্যাপারে এখনও পুরো ব্যাপারটা খুবই প্রাথমিক অবস্থায় আছে।”

হাঁটতে হাঁটতে আমরা ততক্ষণে মেকানিক্যালের বিল্ডিং এর সামনে পৌছে গেছি। সমলয় বলল, “সায়দুল এখানে বসে। চল তিনতলায় উঠতে হবে।” গিয়ে দেখি ঘর বন্ধ। জিজ্ঞাসা করে জানা গেল স্যার ওয়ার্কশপে আছেন। অগত্যা সমলয় মোবাইল বের করে খবর নিল। দু একটা কথার পর বলল, “আসছে।”

সায়দুল হককে দেখলে ছাত্র মনে হয়, এতটাই হাসিখুসি এনার্জেটিক চেহারা। ঘরে ঢুকে চা অর্ডার করে "বল কী দরকার। শালা দরকার ছাড়া উকিল কখনো দেখা করতে আসে?” দু একটা হিজিবিজি কথার পর সমলয় রফিকের কথা পাড়ল। সায়দুল বললেন, “ব্যাপারটা খুব স্যাড। রফিকুল সিদ্দিকি ইলেক্ট্রনিক্স পড়ত...।” বাধা দিয়ে সমলয় বলল, “ওরে বাবা সে তো তাহলে ভয়ংকর ভালো ছেলে!”

“ততটা নয়। প্রথমত এই মুহূর্তে ইলেক্ট্রনিক্সের চাহিদা তত বেশী নয়। দ্বিতীয়ত ও ওবিসি এ ক্যাটাগরিতে ঢুকেছিল। ও অবশ্য স্কলারশিপের জন্য অ্যাপ্লাই করেনি। ওরা বিরাট বড়লোক।”

“ওর বাবা কী করেন।”

“বাবার খবর কে রাখে ভাই। ও হল জাভেদ সিদ্দিকির ছোটভাই।”

“জাভেদ সিদ্দিকি! সে আবার কে?”

“যা ব্বাবা! তুই ক্রিমিনাল লইয়ার হয়েছিস আর জাভেদ সিদ্দিকির নাম শুনিসনি?”

“দাঁড়া দাঁড়া, পোর্টের জাভেদ ভাই নাকি?”

“ইয়েস স্যার।”

সমলয় চেয়ারে এমনভাবে এলিয়ে বসল যেন গুলি খেয়েছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলল, “কী কাণ্ড! এ তো সাংঘাতিক কেলো। সৌমিলি মেয়েটা এতদিন বেঁচে ছিল কী করে?”

“আমরাও তাইই ভাবছিলাম। রফিকের কেরিয়ার পুরো শেষ হয়ে গেছে। ও ছিল ওদের গুষ্ঠির একমাত্র শিক্ষিত ছেলে। দাদা ওকে ভয়ানক ভালবাসে। ওর উপর দাদার অনেক আশা ভরসা ছিল। এত সহজে ছেড়ে দেবার পার্টি আর যেই হোক, জাভেদ সিদ্দিকি নয়।”

আরো দু একটা কথার পর আমরা উঠে পড়লাম। মোটামুটি যা জানার ছিল জানা হয়ে গেছে। অটোয় চড়ে ফিরতে ফিরতে সমলয় বলল, “কলকাতার সবচেয়ে হিংস্র এবং ক্ষমতাশালী ডন হল জাভেদ সিদ্দিকি। তার ভাইয়ের দুর্দশার বদলা নিতে একটা কেন দশটা খুন হওয়াও কোন ব্যাপার নয়। এধরনের খুনের পিছনে জাভেদ সিদ্দিকি থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে খুনের কিনারাও হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু একটা খটকা। খুনটা হতে এতদিন দেরি হল কেন? আর দু নম্বর খটকা হল জাভেদের লোকজন কীভাবে আগে থেকে জানতে পারবে যে ওইদিন ওইখানে ঋতম সৌমিলির ঝামেলা হবে?”

আমি বললাম, “যদি জাভেদ সিদ্দিকির লোকজন খুনটা করে থাকে এবং সেটা প্রমাণ না করা যায়, তাহলেই বা ঋতমকে কীভাবে বাঁচানো যাবে?”

“দেখ এটা যদি ঠান্ডা মাথা খুনের কেস হয় তাহলে ৩০২ ধারার মামলা। এই মামলা সবসময় এস্পার নয় ওস্পার। এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষদর্শী নেই। তাই যদি অন্য কেউ খুনটা করে থাকতে পারে এরকম সামান্য কিছু প্রমাণও পাওয়া যায়, বেকসুর খালাস হয়ে যাবে। কিন্তু ৩০৪ ধারা হল উত্তেজনার বসে খুন। সে কেসে শাস্তি সাধারণত কম কিন্তু শাস্তি হবার সম্ভাবনা বেশী। দেখি পুলিশ কী কেস দেয়। আপাতত আমাদের ঋতমের অফিসের লোকজনের কাছ থেকে ঋতম সম্বন্ধে খোঁজ নিতে হবে।”

“এই খোঁজ কিন্তু এত সহজে নেওয়া যাবে না। এইসব বড়ো আইটি কোম্পানির ভিতরে ঢোকা খুব ঝামেলা। ওরা বাইরের লোক সহজে ঢুকতেই দেবে না জিজ্ঞাসাবাদ তো দূর অস্ত।”

“ও বাবা! তাহলে কী করবো রে?”

আমার একটা কথা মনে হল বললাম, “আচ্ছা ওই অনুশীলার কাছ থেকে যদি ওদের যে প্রোজেক্ট লিডার আছে, তার ফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করলে হয় না? ওদের স্টাফকে পুলিশে ধরেছে, ওরা নিশ্চয়ই তার উকিলকে সাহায্য করবে।”

সমলয় মাথা দুলিয়ে বলল, “গুড আইডিয়া। তাহলে এখনি অনুশীলাকে ফোন করি।”

৩ (উকিল আর এইচ-আর ম্যানেজার)

যে কোন বড় কোম্পানিতে যারা প্রোজেক্ট লিডার হয় তাদের একটা বড় কাজ হল বিভিন্ন ধরনের মানুষ চরানো। স্বভাবতই এই চাকরিতে যারা থাকেন তাদের আগের কালের জমিদারের নায়েবদের মত ঘোড়েল প্রকৃতি হয়। ঋতমের প্রোজেক্ট লিডারের নাম কৃশানু অধিকারী। ফোন করে পরিচয় দেবার সাথে সাথেই প্রশ্ন হল, “আপনারা আমার কাছে ঠিক কী চান?” সমলয় বলল, “আমি ঋতমের উকিল। ঋতমকে বাঁচানোই আমার ওয়ান অ্যান্ড ওনলি মিশন।” কৃশানু বললেন, “অফিসিয়ালি যদি আমার বক্তব্য দরকার হয় তাহলে লিখিত লিস্ট মেল করে দেবেন। আমি একেবারে এক দুই করে লিস্ট মিলিয়ে উত্তর মেল-ব্যাক করে দেব।” সমলয় বলল, “আর যদি আনফিসিয়ালি আপনার সঙ্গে একটু গল্প করতে চাই?” কৃশানুর হাসি শোনা গেল। বললেন, “সৌজন্য সাক্ষাতেও রাজি আছি। আজই সন্ধ্যা সাড়ে আটটা থেকে নটার মধ্যে বাগবাজারে চলে আসুন। নিবেদিতা পার্কের পুবে দেখবেন একটা পতঞ্জলীর দোকান হয়েছে। ওখানে এসে আমাকে ফোন করবেন।”

নর্থ ক্যালকাটা যদিও আমি একেবারেই চিনি না, কিন্তু সমলয়ের অনেক বন্ধু ওখানে থাকার দরুন ও মোটামুটি চেনে। কাজেই বাড়ি খুঁজে পেতে বিশেষ অসুবিধা হল না। কৃশানু অধিকারি বেশ লম্বা ফর্সা সুদর্শন এক যুবক। বয়স পঁইত্রিশ ছত্রিশ হবে। চোখ তীক্ষ্ণ। মনে হয় এর কাছে কোন কথা লুকোন খুব শক্ত। আমাদের ঘরে বসিয়ে প্রথম প্রশ্নই হল, “কিছু মনে করবেন না, আপনি যে ঋতমের উকিল এ বিষয়ে কোন প্রমাণ কি আপনার কাছে আছে?” সমলয় হেসে বলল, “মনে তো করবই না, বরং খুশি হলাম। কিন্তু আপনি আগে বললে আমি ওকালতনামাটা নিয়ে আসতাম। এখন যদি আপনাদের অনুশীলাকে ফোন করি আর ও আমাদের সার্টিফাই করে তাহলে চলবে? আমার ফোন থেকে ফোন করি?” আবার সেই তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ তারপরই হঠাৎ কৃশানুকে যেন একটু রিল্যাক্সড লাগল। বললেন, “না তার দরকার নেই। বলুন কী জানতে চান?” সমলয় বলল, “প্রথমে বলুন কর্মী হিসাবে ঋতম হালদার কতটা ভাল বা খারাপ?”

কৃশানু মাথার চুলের মধ্যে দিয়ে একবার হাত বুলিয়ে আনল। তারপর বলল, “কীভাবে বোঝাব! আপনারা তো আই-টির ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানেন বলে মনে হয় না। এই মুহূর্তে আমাদের একটা আট কোটি ডলারের প্রোজেক্ট শুধু ওর ভরসায় রয়েছে। ওকে যদি দিন কয়েকের মধ্যে জামিন দিয়ে বার করে আনতে পারেন তাহলে আপনার পুরো ফি কোম্পানী মিটিয়ে দিয়ে আরো পুরস্কার দেবে এ গ্যারান্টি আমিই দিতে পারি।”

সমলয় বলল, “প্রোজেক্টটা কি একা ঋতমই দেখছে নাকি?”

“না। তা কখনো হয় না। ছজনের একটা টিম আছে কোলকাতায় যাকে আমরা বলি অফ্‌শোরে আছে, আর তিনজনের একটা টিম আছে অনসাইটে মানে ক্যালিফোর্নিয়ায়। কিন্তু মানে...আচ্ছা আপনাদের যা বলব গোপন থাকবে তো?” সমলয় একটা উকিলি হাসি দিয়ে বলল, “এবারে আমিও বুঝতে পারছি ওকালতির ব্যাপারে আপনি কিছু জানেন না। গোপনীয়তাই হল ওকালতির ওয়াচওয়ার্ড। ক্লায়েন্টের সঙ্গে আমাদের কথাবার্তা আইনত এতটাই গোপনীয় যে কেউ তা আমাদের জিজ্ঞাসা করতে পারে না। এমনকি কোর্টও না।”

“ইন্টারেস্টিং! পরে একদিন এই নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলব। ঠিক আছে তাহলে শুনুন। আমাদের প্রজেক্টটা হল একটা ব্যাংকের ডেটাবেস তৈরি এবং সেটা অ্যাকসেস করার ব্যাপারে। এখন এই জাতীয় সফটওয়্যারের আসল জায়গাটা হল তার সিকিউরিটি। যাতে তৃতীয় কোন ব্যক্তি যেন সেই ডেটাবেস হ্যাক করতে না পারে সেই ব্যবস্থা করা। এই আসল কাজটা করা হচ্ছে একটা অত্যন্ত অপ্রচলিত ভাষায় যার নাম LISP। সাধারণত এই ভাষাটা অন্য কাজে লাগানো হয়। ঋতম আসলে এই ভাষাটা ভালভাবে শিখেছে। প্রজেক্টের শতকরা পঁচানব্বই ভাগ কাজ হয়ে গেছে। কিন্তু ঋতম না থাকলে বাকি কাজটুকু করা প্রায় অসম্ভব।”

“কেন, বাকি পাঁচজন?”

“ওদের মধ্যে তনিষ্ঠ ছাড়া কেউই LISP জানে না। তনিষ্ঠ আপ্রাণ চেষ্টা করছে ঠিকই, কিন্তু একে তো ছেলেটা নেহাতই মিডিওকার, তারপর অন্যের করা কাজ বুঝে নিয়ে সেটাকে ফিনিশিং টাচ দেয়া একটা অসম্ভব কঠিন কাজ। কী ফাঁসা যে ফেঁসেছি উকিলবাবু।”

“আপনাদের প্রোজেক্ট শেষের ডেডলাইন আছে নাকি কিছু?”

“আছে না! আই-টি তে ওটাই তো সব। আর মাত্র একমাস চারদিন সময় আছে। ঋতমকে পেলে দিন দশেকের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এখন যা দাঁড়াল! আমাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। প্রোজেক্ট তো শেষ হবেই না, ওদিকে বাজারে বিরাট বদনাম হয়ে যাবে।”

“আপনাদের কোন রাইভ্যাল কনসার্ন আছে না কি?”

“থাকবে না? এই প্রোজেক্টে কলকাতার একটা আর ব্যাঙ্গালোরের দুটো কোম্পানি বিড করেছিল। আমরা ঝুললে ওরা কেউ প্রোজেক্টটা পাবে। কিন্তু একথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?” কৃশানুর ভুরু হঠাৎ কুঁচকে গেল।

“মানে আট কোটি ডলারের জন্য খুনখারাপি হতে পারে কি না তাই ভাবছিলাম।”

“বলছেন ঋতমকে ফাঁসানোটাই এই সৌমিলি হত্যার উদ্দেশ্য?”

“বলছি না। কিন্তু সম্ভবনা কি নেই?”

“এরকম কখনো হয়েছে বলে শুনিনি, কিন্তু প্রোজেক্ট ডিস্টার্ব করার জন্য ছোটখাট ঘটনা তো ঘটেই থাকে।”

“যাকগে এসব কথা, আপনি সৌমিলি মেয়েটিকে চিনতেন?”

“চিনতাম বলা ভুল, কিন্তু ঋতমের সঙ্গে সোসাল গ্যাদারিং এ দুচারবার দেখেছি। বাজে ফ্লার্ট টাইপ মেয়ে। ঋতমকে দুএকবার বারনও করেছি ওর সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে। কিন্তু ঋতম যাকে বলে প্রেমে সম্পূর্ণ অন্ধ ছিল।”

“এবারে ফ্র্যাংকলি বলুন তো আপনার কী বিশ্বাস, ঋতম কি সৌমিলিকে খুন করেছে?”

“অসম্ভব!”

“কেন অসম্ভব বলছেন?”

“দেখুন ঋতম হল অত্যন্ত স্ট্রেট ফরোয়ার্ড, পড়ুয়া ভাল ছেলে। ওর মূল্যবোধ হল শরৎচন্দ্রের সময়কার। ও সৌমিলিকে প্রায় পুজো করত বলা যায়। ওকে যদি সৌমিলি ভাগিয়েও দেয় ও সারা জীবন অবিবাহিত থাকতে পারে, কিন্তু খুন? অবিশ্বাস্য।”

“বুঝলাম। এবারে বলুন তো অনুশীলার ব্যাপারটা কী?”

“অনুশীলা মেয়েটা নেহাতই একটা ভাল মেয়ে। কাজে কর্মেও ভাল। কথা শোনে, ভীষণ ওবিডিয়েন্ট। ঋতমটা নেহাতই একটা গাধা। এই মেয়েটাকে বিয়ে করলে ও সারাজীবনের মত একটা প্রেমময়ী, অনুগতা, লয়াল অথচ বুদ্ধিমতী বৌ পেত, এমন একটা কম্বিনেশান যা লোকে সারা জীবনে তপস্যা করেও পায় না। আসলে গাধাগুলো মজে তো খালি মেয়েদের সেক্স অ্যাপিলে। যাক গে এসব কথা।”

“আমি জানতে চাইছি অনুশীলার পক্ষে কি সৌমিলিকে খুন করা বা করানো সম্ভব?”

“আপনার উকিলের বুদ্ধি কী বলবে জানি না, কিন্তু আমার ম্যানেজারি বুদ্ধি বলে অসম্ভব টু দি পাওয়ার টু।”

“ঋতমের বন্ধুদের মধ্যে এমন কি কেউ থাকতে পারে যে সৌমিলিকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। তারপর ল্যাং ট্যাং খেয়ে রেগেমেগে খুন করেছে?”

“এত কাণ্ড হলে কিছুটা জানতে পারতাম। আফটার অল আমার চাকরিটা তো এই সব খবর রাখারই চাকরি!”

“আর কোন ইনফরমেশান?”

“নাঃ। তবে আপনার সন্দেহটা আমাকে ভাবাচ্ছে। এটা যদি ঋতমকে ফাঁসিয়ে কোম্পানির বদনাম করার চেষ্টা হয়...। আমি খোঁজ নিচ্ছি। ও ভাল কথা আপনাদের ফোন নম্বরটা দিয়ে যান। কিছু জানতে পারলে জানাব।”

আমরা ফোন নম্বর দিয়ে চলে এলাম। ফিরতে ফিরতে সমলয় বলল, “এবারে অপারেশান জাভেদ সিদ্দিকি।”

৪ (পোর্টের জাভেদভাই)

সমলয় যাই বলুক না কেন জাভেদ সিদ্দিকির সঙ্গে দেখা করাটা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। কারণ অপরাধ জগতের যে সব লোকের সঙ্গে সমলয় যোগাযোগ করতে পারল, তাদের কারোর দৌড়ই অত উঁচু পর্যন্ত নয়। ইতিমধ্যে পুলিশ একবার ঋতমকে কোর্টে প্রোডিউস করেছে। সমলয় জামিনের চেষ্টা করা সত্ত্বেও জজসাহেব জামিন মঞ্জুর করেননি। কিন্তু পুলিশকে মাত্র তিনদিনের কাষ্টডি দিয়েছেন। আর অবিলম্বে সমলয়কে এককপি পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট দিতে বলেছেন। কোর্টে আমি যাইনি। শুনলাম সমলয় নাকি খুব ভাল সওয়াল করে জজসাহেবের মনে অনেকগুলো সন্দেহ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

সমলয় যখন কোর্ট থেকে বার হচ্ছে তখন একটা লোক ওকে জিজ্ঞাসা করে যে ও ঋতমের উকিল কি না। সমলয় হ্যাঁ বলাতে লোকটি ওর ফোন নম্বর চায়। ফোন নম্বর কেন দরকার তা লোকটি বলতে চায়নি। সমলয় অবশ্য নম্বর দিয়েই দিয়েছে।

ওই দিন সন্ধ্যার দিকে আমি সমলয়ের বাড়ি গেছি। এই কেসেরই খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। এমন সময় ওর একটা ফোন এলো। ওর ফোন বাড়িতে সাধারণত লাউডস্পীকারে থাকে।

“হ্যালো। সমলয় বসু বলছি।”

“নমস্তে ওকিলসাব। আপ ঋতম হালদারকে কেস লড় রহে হে না?”

“জি।”

“ক্যা আপ ইস সিলসিলে মে জাভেদ ভাই সে মিলনা চাহে থে?”

“হাঁ। জরুর।”

“আপ কাল সাম সাড়ে সাত বাজে আনসার রেস্টুরেন্ট আ সকতে হে?”

“ও জো ফ্যান্সি মার্কেটকে বগলওয়ালে আনসার...।”

“হাঁ হাঁ ওহি। পাক্কা সাড়ে সাত বাজে আ জাইয়ে।”

সমলয় ফোন রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী অদ্ভুত ব্যাপার! মেঘ না চাইতেই জল। একেবারে খোঁজ নিয়ে, ফোন করে আমন্ত্রণ। এ লোক তো একেবারে ডকের ডন! কী মতলব কে জানে?”

ইকবালপুর থেকে খিদিরপুরের মোড়ে এসে বাঁদিকে একটু গেলেই ফ্যান্সি মার্কেট। আর একটু এগোলে ওই একই ফুটে আনসার রেস্টুরেন্ট। বেশ বড় এন্ট্রান্স। কি বাইরে কি ভিতরে ভিড় গিজগিজ করছে। ভিতরে ঢুকেছি কি ঢুকিনি, একটা ছোকরা এসে জিজ্ঞাসা করল, “ওকিলসাহাব?” তারপর উত্তর না শুনেই বলল, “ইধার আইয়ে।” আগেকার দিনে রেস্টুরেন্টগুলোতে পর্দাঢাকা খোপ থাকত। এখানে দেখি এখনো আছে। এমনই একটা খোপের দিকে ছোকরা আমাদের নিয়ে গেল। তারপর খোপের পর্দা সরিয়ে "ওকিলসাব" ঘোষণা করেই কেটে পড়ল। ভিতরে বসা লোকটা সমলয়ের দিকে একটা মুচকি কিন্তু দিলখোলা হাসি দিয়ে বলল, “পাধারিয়ে।” পরক্ষণেই আমাকে দেখে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে চেয়ার সরাতে সরাতে বলল, “আইয়ে আইয়ে দেবীজি, তশরিফ রাখীয়ে।” আমরা দুজন বসার পরে লোকটা খুব আড়ম্বর সহকারে সমলয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “নাচিজকা নাম জাভেদ সিদ্দিকি। হুকুম ফরমাইয়ে। বান্দা হাজির হ্যায়।” মুখে কিন্তু দুষ্টু মিষ্টি হাসি। এই মোগলাই অভ্যর্থনার ধাক্কা সামলাতে আমাদের একটু সময় লাগছিল। ততক্ষণে জাভেদভাই হাঁক দিয়ে তিনটে ‘ইস্পেশাল’ চায়ের অর্ডার দিয়ে ফেলেছেন।

জাভেদ সিদ্দিকির হাইট, রঙ, সবই মাঝারি। ছাঁটা গোঁফ, দাড়ি নেই। কাঁচা পাকা একমাথা চুল, খুব একটা যত্ন করে আঁচড়ানো নয়। মুখের চেহারাও সাধারণ। সামান্য কটা চোখ। কিন্তু চোখের দৃষ্টি ভীষণ চঞ্চল। লোকটাকে দেখলেই মনে হয় যেন একটা বিরাট এনার্জির পাওয়ার হাউস। এখন মনে হচ্ছে আমাদের দেখে ভারী খুশি হয়েছে।

আমারা কিছু বলছি না দেখে জাভেদভাই হাসলেন। একেবারে বাবা বাবা টাইপ ভরসার হাসি। বললেন, “আপনারা সৌমিলি ভট্টাচার্যের খুনের তদন্ত করছেন?” সমলয় আপত্তি জানাল, “মোটেও নয়। তদন্ত করছে পুলিশ। পুলিশ আমাদের শত্রুপক্ষ। আমরা স্রেফ ঋতম হালদারের ফরে কেস লড়ছি।” জাভেদ ভাই বললেন, “ঠিক ঠিক। তো আপনারা আমার কাছে কী জানতে চান বলুন?” আমাদের তখনো চুপ করে থাকতে দেখে বললেন, “দ্বিধা করবেন না। আপনাদের প্রশ্নের জবাব দেব বলেই দেখা করতে চেয়েছি।” সমলয় বলল, “সৌমিলির সঙ্গে আপনার ভাইয়ের কতদিনের রিলেশান ছিল?”

জাভেদভাই হাওয়ায় হাত নাড়িয়ে সমলয়ের প্রশ্নটাকেই যেন উড়িয়ে দিলেন। বললেন, “করিব ছে মাহিনা। ওসব ফালতু কথা না বাড়িয়ে আমি যা বলি শুনুন। তারপর যদি কোন প্রশ্ন থাকে করবেন। কেমন?” আমরা একমত হলাম। জাভেদ ভাই বলতে শুরু করলেন, “দেখুন ওকিলসাব আনপড় আদমি আছি। সিধা কথা সিধা বলি। মাফ কিজিয়ে দেবিজি লেকিন ওই সৌমিলি মেয়েটা পুরা রেন্ডি ছিল। আমার ভাইটা নাদান। জিন্দেগিতে কোন লেড়কির দিকে কোনদিন শির উঠাকে দেখেনি। সৌমিলিকে দেখে ওর পুরো মাথা ঘুরে গেল। রেন্ডিটাও ওর মাথা খেতে কোই কসর ছাড়ল না। এখানে ওখানে বহুত ঘুরল। ওর থেকে কম সে কম লাখো রুপিয়ার গিফট নিয়েছে। ক্যাশও নিয়েছে নিশ্চয়ই, তবে কত তা রফিক বলেনি। তারপর প্ল্যান করে মন্দারমনি নিয়ে গেল। তিন রোজ ওখানে গ্রীন বীচ রিসর্টের সুইটে থাকল। তারপর কোলকাতায় এসে অচানক একদিন অপমান করে পুরা ভাগিয়ে দিল। দেখা পর্যন্ত করত না, ফোন ভি ধরত না। রফিকের এটাই পহেলা প্যার, সিধাসাধা লেড়কা, এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে পুরো মজনুন বনে গেল।”

জাভেদ ভাই কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, “ওকিলসাহাব। এই একটাই ভাই আমার। ছোটবেলা থেকেই লিখাপড়ির দিকে ঝোঁক। আমি ভাবলাম কি আমার পুরা খানদান তো আনপড় গাঁওয়ার, তো তুই কত পড়বি পড় না! পাশ করে ইঞ্জিনিয়ার বনলে আমি ওকে স্টেটসে ভেজে দিতাম। যত চায় পড়ে প্রফেসার উফেসার যা বনতে চায় আমি ওকে বনিয়ে দিতাম। খর্চে কা ক্যা পরোয়া! ফির শাদি উদি...সব পানিমে চলা গিয়া। ওকিলসাব! ছেলেটা খায় না, স্নান করে না, সারাদিন ঘরে বসে বিড়বিড় করে, রাতে ঘুমায় পর্যন্ত না। সব, সব আমার পাপের ফল।” জাভেদ ভাই চোখের জল মুছলেন।

আমি বললাম, “মাফ করবেন জাভেদ ভাই, কিন্তু ওর ইলাজের কী করেছেন?” জাভেদ ভাই ম্রিয়মাণ গলায় বললেন, “আমাদের ফ্যামিলি ডক্টর ইমতিয়াজ সাহেব বললেন কি পাগলের ডাক্তার দেখাতে হবে, পাগলাগারদে দিতে হবে। ও মুঝসে নেহি হোগা।”

আমি বললাম, “পাগলের ডাক্তারে কী খারাবি আছে?” জাভেদ ভাই উত্তেজিত হয়ে বললেন, “ওরা রফিককে গারদে বেঁধে রাখবে, ফির ইলেকট্রিক শক দেবে। এত কষ্ট আমি রফিককে দেব? তার থেকে ঘরে অন্তত আরামে থাকুক।”

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। এত বড় ডন! এত বড়লোক! এত কানেকশান! অথচ অশিক্ষার এই লেভেল? চোখের সামনে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। বললাম, “জাভেদ ভাই। রফিকের বয়স কত হবে?”

“করিব বিশ সাল, লেকিন...”

আমি বাধা দিয়ে বললাম, “ধরুন আমার নিজের ভাইএর যদি এরকম ঘটনা ঘটত, ঘটতেই পারত, তাহলে আমি কিন্তু সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে যেতাম। আর তিনি ওকে মোটেও পাগলাগারদে রাখতেন না। ভাই আমার সঙ্গেই থাকত। ডাক্তারের দাবাই নিয়ম করে খাওয়াতাম। মাসে একবার বা দুবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম। একবছরের মধ্যেই অনেকটা সেরে যেত। দু বছরের মধ্যে পুরো ইলাজ হয়ে যেত।”

জাভেদ ভাই হঠাৎ সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, “ইধার দেখিয়ে।” দেখলাম ওনার চোখ দুটো স্থির আমার চোখের দিকে। চোখ দেখে এবারে বুঝলাম লোকটা কেন এতটা শক্তিমান আর কেনই বা লোকে একে এত ভয় পায়। বললেন, “দেবীজি! আপ হামে ঝুটি তসল্লি তো নেহি দে রহি হ্যায়?”

আমিও ইমোশানাল হয়ে যাচ্ছিলাম বললাম, “আপনি কিচ্ছু চিন্তা করবেন না। আমার চেনা খুবই ভাল সাইক্রিয়াটিস্ট আছেন। আমার জানা অন্তত দুটো এরকম প্রেম ঘটিত ডিপ্রেশানের কেস ভালো করেছেন। রফিককে শুধু ওঁর কাছে নিয়ে যেতে হবে। আর ঠিক যে নিয়মে দাবাই খাওয়াতে বলবেন সেই নিয়মে দাবাই দিতে হবে। বেঁধে রাখা, ইলেকট্রিক শক দেয়া, ওসব মধ্যযুগে হত। রফিক নিজের বাড়িতেই আরামে থাকবে। আর আমার কথা বিশ্বাস করুন, আল্লা চাইলে নিশ্চয়ই আপনার ভাই ভাল হয়ে যাবে, আবার পড়াশুনা করবে, ওই যাদবপুর থেকেই ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার হয়ে আমেরিকার ভাল ইউনিভার্সিটিতে পড়ে প্রফেসার হবে। তারপর ভাল মেয়ে বিয়ে করে ঘরসংসার করবে।”

জাভেদ ভাই হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। এতবড় একজন লোককে এইভাবে কখনো কাঁদতে দেখিনি। এইভাবে যে কেউ অপরিচিতের সামনে কাঁদতে পারে আমার ধারণা ছিল না। প্রায় মিনিটখানেক পর উনি সামলে উঠলেন। আমায় বললেন, “মা তোমাকে আল্লা পাঠিয়েছেন। আর আমি নিশ্চিত যে তোমার মুখ দিয়ে আল্লাই কথা বলছেন। তুমি যা বলবে তাইই করব। পাঁচ বছর লাগুক, দশ বছর লাগুক পরোয়া নেই, কিন্তু আমার ভাই সেরে যাবে তো?”

আমি বললাম, “আল্লার মরজি। নিশ্চয়ই সেরে যাবে।”

জাভেদ ভাই একটু গুছিয়ে বসলেন। বললেন, “একটা কথা জেনে রাখ। রফিক সেরে যাক বা না যাক, এই মুহূর্ত থেকে জাভেদ সিদ্দিকি তোমার বেটা। যখন যা দরকার হবে স্রেফ ছেলেকে হুকুম করবে। করবে তো?”

আমার চোখেও জল এসে গিয়েছিল মুছে নিয়ে বললাম, “করবো। আর আমি বলছি, রফিক এক বছরের মধ্যেই সেরে যাবে। নিশ্চয়ই যাবে। সেরে গিয়ে আবার পড়াশুনা শুরু করবে।”

জাভেদ সিদ্দিকি প্রার্থনার ভঙ্গিতে একবার আকাশে হাত তুলে বললেন, “শুক্‌র অলহমদুলিল্লাহ।” তারপর প্রায় মিনিটখানেকের নীরবতা। ইতিমধ্যে তিনকাপ ঘন দুধের চা আমাদের সামনে রাখা হয়েছিল। জাভেদ ভাই চোখ মুখ মুছে বললেন, “চায় পিজিয়ে, ঠান্ডি হো রহি হ্যায়।” আমরা চা খেতে লাগলাম। সহসা জাভেদ ভাই সমলয়কে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ওকিলসাব আপনি তো জানতে চান কি আমার আদমিরা ওই রেন্ডিটাকে মেরেছে কি না? না মারেনি। কসম্‌সে বলছি। প্রচণ্ড ইচ্ছা হয়েছিল মেরে দিতে। কিন্তু রফিক আমার পায়ে পড়ে বলল আমি যেন ওকে কিছু না করি। আমি রফিককে কথা দিয়েছি কিছু করব না। তবে আমার এক চাচেরা ভাই আছে ইকবাল। ওর আদমিরা একবার রেন্ডিটাকে তড়পেছিল। তারপর আমি মানা করে দিয়েছিলাম।”

সমলয় বলল, “আচ্ছা রফিক জানে যে সৌমিলি মারা গেছ?”

“না, জানে না। আমি জানতে দিইনি।”

আমাদের আর বিশেষ কিছু বলার ছিল না। আমি আমার এবং সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর উপাসনা চৌধুরির ফোন নম্বরটা জাভেদ ভাইকে দিলাম। উনি কথা দিলেন আজ রাত্রেই ফোন করবেন।

আমরা উঠে পড়ছিলাম। গেটের সামনে জাভেদ ভাই সমলয়কে বললেন, “আমি ওই রেন্ডিটাকে মারিনি। কিন্তু আপনার ক্লায়েন্ট যদি মেরে থাকে বেশ করেছে। আপনি কলকাতার বেস্ট লইয়ার লাগান। তাঁর আর আপনার দুজনের ফিই আমি দেব।” সমলয় বলল এ ব্যাপারে ও ক্লায়েন্টের সঙ্গে কথা বলবে। এবারে জাভেদ ভাই বিদায় নিয়ে একটা স্করপিওতে উঠে চলে গেলেন। বাইরে বেরিয়ে দেখি আমাদের জন্য একটা কালো হোন্ডা সিটি দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ি পর্যন্ত ড্রপ করে আসবে!

ফিরতে ফিরতে সমলয় বলল, “এই কেসের আর কিছু হোক বা না হোক, জাভেদ ভাইয়ের বন্ধুত্ব একটা ক্রিমিনাল লইয়ার বা সাংবাদিকের কাছে সোনার চেয়েও দামী।”

৫ (ঘটনা জটিলতর)

“তাহলে, এখন কেসের অবস্থা কী দাঁড়ালো?”

“খুব আশা-ব্যাঞ্জক না। ঋতমকে শেষ পর্যন্ত খালাস করা যাবে মনে হয়, কিন্তু তাতে যদি মাস তিনেক কেটে যায় তাহলে ওর কোম্পানী তো ঝুলে যাবে। সেক্ষেত্রে ঋতমের চাকরিও থাকা শক্ত।”

“আচ্ছা, পুলিসের হাতে কোন প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও ওরা ঋতমকে ধরে রেখেছে কেন?”

“অন্য কোন সাসপেক্ট নেই বলে। খুনের মামলা হলে পুলিসের পিছনে মিডিয়া থেকে শুরু করে নিহতর বাড়ির লোকজন সবাই প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। তাই পুলিশ যার বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রমাণ পায় তার বিরুদ্ধেই কেস শুরু করে। ধর এই কেসেই পুলিসের হাতে কোন ডিরেক্ট এভিডেন্স নেই। কেউ ঋতমকে খুন করতে দেখেনি বা মার্ডার ওয়েপন ঋতমের কাছে পাওয়া যায়নি। আছে কি? না সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স। মানে খুনের সময়, খুনের স্পটের কাছে, ঋতম সৌমিলিকে শেষ দেখেছিল। আর কী? না দুজনের ঝগড়া হয়েছিল। সেটাও ঋতমই বলেছে। এক্ষেত্রে নতুন কোন প্রমাণ না পেলে শেষ পর্যন্ত পুলিসের পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভবই না যে ঋতমই সৌমিলির খুনি।”

“তাহলে পুলিশ কেস দিয়েছে কেন?”

“ওই যে বললাম যতক্ষণ অন্য কারো বিরুদ্ধে বেটার প্রমাণ না পাচ্ছে ততক্ষণ একটা কেস চালিয়ে যেতেই হবে। আমরা যদি এখন কেসের আসামী কে বার করে পুলিসকে জানাই তাহলে পুলিস এখনই ঋতমকে ছেড়ে তাকে ধরবে।”

“তাহলে বল সন্দেহজনক কে কে আছে?”

“এখন পর্যন্ত যা জেনেছি তাতে সৌমিলিকে খুন করার ডিরেক্ট মোটিভ আছে দুজনের। এক -রফিকুল অ্যান্ড কোং, কারণ প্রতিহিংসা। দুই -অনুশীলা, কারণ প্রেম। এছাড়া এই খুনের উদ্দেশ্য যদি স্রেফ ঋতমকে ফাঁসানো হয় তাহলে সাসপেক্ট নম্বর এক হল তনিষ্ঠ। কারণ ঋতম না থাকলে প্রজেক্টের দায়িত্ব ওর, না পারলে কেউ কিছু বলবে না কিন্তু একবার পেরে গেলে কোম্পানীর নয়নের মণি হয়ে উঠবে। দু নম্বর -অন্য কোম্পানি থেকে ঘুষ খাওয়া যে কোন লোক। তিন নম্বর -কৃশানু অধিকারি।”

“কৃশানু কেন?”

“দেখ ওই কৃশানুর অনুশীলা সম্বন্ধে কী গদগদ ভাব দেখলি তো? যদি ঋতম সিন থেকে মাইনাস হয়ে যায় তাহলে ও অনুশীলাকে বাগাবার একটা চেষ্টা করতে পারে।”

আমার চমক লাগল। সত্যি তো, এ লাইন দিয়ে তো ভাবিইনি! এই উকিলগুলোর কী প্যাঁচালো বুদ্ধি রে বাবা। বললাম, “তাহলে এই সাসপেক্টদের মধ্যে কাকে টার্গেট করবি?”

“টার্গেট করা তো পরের কথা। আগে এই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, যদি ঋতম ছাড়া অন্য কেউ খুনটা করে থাকে, সে আগে থেকে কীভাবে জানবে যে ঋতম সৌমিলিকে বাইপাসের ধারে নামিয়ে দেবে? কারণ খুনটা তো প্ল্যানড। অনেক যোগাড় যন্ত্র করতে হয়েছে।”

“ও বাবা। তাহলে কি ঋতমই?”

“মোটিভ কী? ঝগড়ার ফলে মাথা গরম করে খুন করলে মরা কুকুর বা চটের বস্তা কোথা থেকে আসবে?”

“আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে।”

“আমারও যাচ্ছে। ইনফ্যাক্ট এ সবের কী দরকার ছিল? এ তো আমাজনের অরণ্য নয়! আজ নয় কাল, বাইপাসের ধারে লাস তো উদ্ধার হতই। তাহলে তিন চার দিন পরে উদ্ধার হলেই বা খুনির কী লাভ? যাক এ নিয়ে এখন মাথা ঘামিয়ে ব্যাঙ হবে। আজ বিকেলে পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা পাওয়া যাবে মনে হচ্ছে। পেলে হয়ত একটু এগোনো যাবে।”

হঠাৎ আমার একটা কথা মনে হল। উর্জিতা বলে যাদবপুরের মেয়েটা তার ফোন নম্বর আমাকে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল ও সকলের আড়ালে আমাদের কোন কথা বলতে চেয়েছিল। মনে হচ্ছে ওকে ফোন করার এটাই সব থেকে উপযুক্ত সময়।

ফোন ধরার পর একটু ইতস্তত করে উর্জিতা বলল, “তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি দিদি। আসলে কথাটা সবার সামনে বলতে ইচ্ছে করছিল না। দেবযানী বলে একটা মেয়ে এখানে কেমিস্ট্রি পড়ে। ও সৌমিলির মতই মালদার মেয়ে। ওর সাথে সৌমিলির খুব ভাব ছিল। এখন সৌমিলির সঙ্গে ঋতমদার ভাব হবার সঙ্গে সঙ্গে ওই দেবযানীও ঋতমদাদের সঙ্গে খুব মেলামেশার চেষ্টা করত। ওর নাকি খুব ইচ্ছে গ্র্যাজুয়েশানের পরে আই-টিতে চাকরি করবে। তাই ওদের কোম্পানীর যাকে পেত তার সঙ্গেই ভাব জমাবার চেষ্টা করত।”

“ও তাই? আর কিছু?”

“সৌমিলি খুন হবার দিন দুয়েক আগে, দেবযানী মেস থেকে পালায়। এই খবরটা পেয়ে সৌমিলি ভয়ংকর ভয় পেয়ে গেছিল। বার বার বলছিল, “ওরা আমাকে বাঁচতে দেবে না!” কিন্তু কোন কথা খুলে বলেনি। যে দিন সৌমিলি খুন হয় তার পরদিন সকালেই ওর কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে মালদা পালানোর টিকিট কাটা ছিল।”

“দেবযানী ফিরে এসেছে কী?”

“ঠিক জানি না, ইউনিভার্সিটিতে তো দেখিনি। রাখি দিদি।” উর্জিতা ফোন ছেড়ে দিল।

ফোন লাউডস্পীকারে রেখেছিলাম। সমলয় ক্লান্ত ভাবে বলল, “এতো দেখছি মিসিং মেয়েদের মেলা লেগে গেছে। দেবযানী আবার কোন খানায় খুন হয়ে পড়ে আছে কে জানে?”

আমি বললাম, “কারো সঙ্গে পালিয়ে গিয়েও তো থাকতে পারে।”

সমলয় বলল, “তা নিশ্চয়ই পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে সৌমিলি এত ভয় পাবে কেন? ওরা মানে কারা যারা সৌমিলিকে বাঁচতে দিতে চায় না?”

"এবারে কী করবি?”

“ধুর বাবা আরো গুলিয়ে যাচ্ছে। এখন শুধু পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা পাবার জন্য অপেক্ষা করব। যা ভাবা সে তারপর।”

এরপর আমি বাড়ি ফিরে চান খাওয়া সেরে একটু লেখা নিয়ে বসেছিলাম। কলকাতার ব্রাহ্ম-ধর্মাবলম্বিরা এখন কীরকম আছে এই নিয়ে একটা স্টোরি করছিলাম। বেশ লেখায় মনটা বসে আসছিল। সহসা সমলয়ের ফোন "শিগগির আয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা পেয়েছি।”

“নতুন কিছু পেলি।”

“আরে ব্যাঙ! তুই আয় তো! সব গোলমাল হয়ে গেছে।”

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমলয়ের বাড়িতে উপস্থিত হলাম। দেখি ও সর্বহারার মত সোফায় লটকে পড়ে আছে। মুখের ভাব এমন যেন ওর সব শখের জিনিষ চুরি হয়ে গেছে। আমায় দেখে বলল, “আয়। এই দেখ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট।” আমি পড়তে গিয়ে দেখি যদিও রিপোর্টটা ইংরেজিতেই লেখা কিন্তু একটা শব্দও চেনা ঠেকছে না। বললাম, “এই মেডিকো-লিগ্যাল ভাষা দিয়ে আমায় ভয় দেখাচ্ছিস কেন? বাংলা করে বল।” সমলয় বলল, “তিনটে ইম্পর্টেন্ট কথা আছে। সৌমিলির খুনের টাইমটা আর ঋতম ওকে যখন বাইপাসে ছেড়ে দিয়েছিল এই টাইমটা মোটামুটি ম্যাচ করছে। যেহেতু লাস দিন তিনেকের পুরোন তাই টাইমটার মধ্যে ঘন্টা চারেকের অনিশ্চয়তা থাকবে। দু নম্বর সৌমিলিকে আগে একটা মোটা তার দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে মারা হয়েছে। তার পর ভারি কিছু দিয়ে মাথাটা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে।”

“সে আবার কী? দুবার মারার মানে কী?”

“জানি না। এবং তৃতীয়ত" বলে সমলয় একটা নাটকীয় পজ দিল। আমি অধীর হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “তৃতীয়ত কী?”

“সৌমিলি সম্পূর্ণ কুমারী ছিল!”

“অ্যাঁ! বলিস কীরে!!”

“হ্যাঁ। একেবারে নিঃসন্দেহ।”

“তাহলে! তাহলে! এই যে সবাই বলছে...” আমি থই পাই না।

“হয় ভুল বলছে, নয় মিথ্যা বলছে।”

“কী সর্বনাশ! কিন্তু ও যে রফিকের সঙ্গে তিন রাত্তির মন্দারমনিতে একঘরে...”

“সেটা বলেছে কে? জাভেদ সিদ্দিকি তো! সে কি যুধিষ্ঠির না কি? পোর্টের মাফিয়া মিথ্যে বলতে পারে না?”

আমার চোখের সামনে জাভেদ ভাইয়ের চেহারাটা ভেসে উঠল। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যে লোকটা আমাদের ওরকম একটা মিথ্যেকথা বলেছে। কিন্তু সমলয় বলছে পোস্টমর্টেম রিপোর্টকে বিশ্বাস করতেই হবে। এই এক জিনিষ যা কখনও মিথ্যা বলে না।

কিছুক্ষণ হতাশ এলোমেলো কথার পর সমলয় বলল, “এ রহস্য সমাধান আমার ক্ষমতার বাইরে। কেস হয়তো জিততে পারি কিন্তু কী হয়েছিল সঠিক বলা অসম্ভব।” তারপরেই সিদ্ধান্ত নেবার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল।”

“কোথায়?”

“বিগ বসের কাছে।”

৬ (বৃদ্ধ উকিলের বুদ্ধি)

আমরা যখন নিউ আলিপুর থেকে বুড়োশিবতলার মোড় ছাড়িয়ে এস এন রায় রোড ধরে একটু এগিয়ে একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সমলয়ের বিগ বস হলেন একজন বৃদ্ধ উকিল। বয়স সত্তর প্লাস। নাম প্রমথকৃষ্ণ রায়। সমলয়ের মুখে এনার গল্প অনেক শুনেছি তবে চাক্ষুস দেখা এই প্রথম হবে। এঁকে নাকি কলকাতার সমস্ত উকিল চেনেন এবং সমঝে চলেন। ইনি নাকি যেমন বুদ্ধিমান, তেমন খেয়ালী আবার ততোধিক দুর্মুখ। সমলয় কেমন করে জানি এঁর কাছে খানিকটা প্রশ্রয় পায়।

দরজা খুলেছিলেন এক সুদর্শনা ভদ্রমহিলা। মনে হল ছেলের বউ। সমলয়কে দেখে পরিচয়ের হাসি হেসে বললেন, “বাবা পাশের ঘরে। সোজা চলে যাও।” আমরা যখন পাশের ঘরে ঢুকছি তখন দেখলাম ভদ্রমহিলা আড়চোখে আমাকে মাপছেন।

ঘরে ঢুকে যেটা প্রথম নজরে পড়ে সেটা হল বই। দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ঝোলানোর জায়গাও নেই। সমস্তটা বইয়ের র‍্যাক এবং বইয়ে ঠাসা। ঘরের মাঝখানেও লাইব্রেরির মত গোটা চারেক লোহার র‍্যাক আছে আর সেগুলোও ভর্তি। একপাশে একটা বড় টেবিলে স্তূপাকৃতি বইএর পাশে কোনমতে একটু লেখার জন্য ফাঁকা জায়গা আছে। টেবিলটার এপাশে গোটাচারেক শক্তপোক্ত লোহার চেয়ার। ওপাশে একটা পিঠ উঁচু কাঠের চেয়ারে বসে বৃদ্ধ উকিল রায়সাহেব। সমস্ত ঘরটাই যেন তার মালিকের মত বলছে এখানে কাজের কথা ছাড়া কিচ্ছু চলে না।

সমলয় ঘরে ঢুকে না কোন শিষ্টালাপ না কোন ইনট্রোডাকশান প্রথমেই বলল, “প্রচণ্ড প্যাঁচে পড়ে গেছি স্যার।”

প্রমথবাবুও একেবারে সোজা পয়েন্টে চলে এলেন, “ঐ বাইপাসের ধারে মেয়ে খুনের কেসটা তুমি ডিফেন্ড করছ না?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“কমপ্লিকেটেড মনে হয়েছিল। এনিওয়ে, ফাইন্ডিংস বল।”

ভদ্রলোককে আমারও অদ্ভুত মনে হচ্ছিল। ভূতের মত কালো রঙ। মাথায় মসৃণ টাক। অনেকটা তুলসি চক্রবর্তি যদি সাদা কলারওয়ালা গেঞ্জি আর সাদা পাজামা পরতেন তাহলে এরকম দেখাত। তফাতের মধ্যে চোখদুটো একেবারে ভাবলেশশূন্য। মুখের ভাবও তাই। আর সেটাই এনার চেহারার সাথে তুলসি চক্রবর্তির চেহারার আকাশ পাতাল ফারাক এনে দিয়েছে। আকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে প্রকৃতি। চেনা কেউ এলে লোকে তো একবার বলে ‘কেমন আছো?’ বা ‘আসো না কেন?’ বা ‘কাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলে?’ এসব কথা বাদ। শুধুমাত্র কাজের কথা এবং আর কিচ্ছু না।

সমলয়ও দেখলাম যত কম কথায় সম্ভব সমস্ত কথাটা গুছিয়ে বলে হাতে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ধরিয়ে দিল। রিপোর্টটা হাতে নিয়ে যেন বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে সমস্তটা কয়েক মিনিট ধরে গিললেন। তারপর হঠাৎই যেন খুব রিল্যাক্সড হয়ে গিয়ে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট টেবিলের উপর রেখে দিলেন।

সমলয় বলল, “কী বুঝলেন স্যার?”

প্রমথবাবুর মুখে আস্তে আস্তে একটা হাসি ফুটে উঠল। চোখ দুটোও কেমন যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এইবার যেন বোঝা যাচ্ছে লোকটা রোবট নয়। বস্তুত অসাধারণ বুদ্ধিমান কোন সত্তা। বললেন, “তিনটে খবর চাই। এক সৌমিলির ডেডবডির খবর কে পুলিসকে দেয়? দুই সৌমিলির ডেডবডি কবে আইডেন্টিফায়েড হয়, কে করে এবং তাকে কে খবর দিল? তৃতীয়ত সৌমিলির খুনের পরদিন সৌমিলির টিকিটে কে মালদা গেছে?”

সমলয় ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলল, “তৃতীয় খবরটা দিয়ে কী হবে? পাবোই বা কোথা থেকে?”

“শিয়ালদহের ঐ দিন কাঞ্চনজংঘার টিটির সঙ্গে কথা বল। কিন্তু সমলয়, তুমি কি এখনো কেসটার কিছু বোঝনি?”

সমলয় ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে বলল, “আপনি সলভ করে ফেলেছেন স্যার? আমি জানতাম! ঠিক জানতাম!”

“শতকরা নব্বইভাগ অতি পরিষ্কার। বাকি দশ শতাংশ নির্ভর করছে ঐ খবর তিনটের উপর।”

আমি আর থাকতে না পেরে বললাম, “দু একটা ক্লু দিন না স্যার!”

প্রমথবাবু আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, “তুমি তো মধুছন্দা? সমলয়ের জার্নালিস্ট বান্ধবী? তুমি একটু ভাবতে চাও? বেশ। প্রথম কথা --- হয় ঋতম খুনটা করেছে নয় করেনি, তাই তো? যদি করে থাকে মোটিভ কী? ঝগড়া মোটিভ হলে প্ল্যান্‌ড খুন সম্ভব নয় এবং এই খুনটা সন্দেহাতীত ভাবে প্ল্যান্‌ড। আর যদি অন্য কেই করে তাহলে সে কী করে জানবে যে ঋতম সৌমিলিকে ঠিক ওখানেই নামিয়ে দেবে?”

আমি অসহিষ্ণু গলায় বললাম, “সেটাই তো গোড়া থেকে প্রবলেম!”

প্রমথবাবু বললেন, “ভেবে দেখ, ওটাই সলিউশান নম্বর এক। দ্বিতীয় কথা সৌমিলির স্বভাব চরিত্র নিয়ে সবাই একই কথা বলছে। আর সবাই একসঙ্গে ভুল করতে পারে না। ওদিকে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে সম্পূর্ণ অন্য কথা। সেটাও ভুল হতে পারে না। দুটোই সত্যি। কিন্তু কীভাবে সম্ভব?”

আমি বললাম, “হতে পারে না তো।”

প্রমথবাবু একটু অধৈর্য হয়ে বললেন, “যুক্তি দিয়ে ভাবো না রে বাবা।”

আমি আরো অধৈর্য গলায় বললাম, “যুক্তি বলছে ক যদি ঠিক হয় তাহলে ক কখনই ভুল হতে পারে না।”

প্রমথবাবু আগ্রহের গলায় বললেন, “রাইট। আর যদি হয় তাহলে?”

আমি বললাম, “তাহলে সেটা যুক্তিগ্রাহ্য হবে না।”

প্রমথবাবু বললেন, “হোপলেস। কিছুতেই যুক্তি বুঝবে না। আচ্ছা, তৃতীয় কথা --- দেবযানী কোথায় গেল?”

আমি বললাম, “আচ্ছা মুশকিল তো। আমরা কী করে জানব? ও তো কাউকেই বলে যায়নি।”

প্রমথবাবু আমার সম্বন্ধে পুরোপুরি হতাশ হয়ে সমলয়কেই বললেন, “কী হে তুমি কিছু বুঝলে? যদি না বোঝ তো এটা ভাবো, গলায় তার পেঁচিয়ে খুন করে আবার ভারী কিছু দিয়ে মাথা ভাঙ্গা দরকার হল কেন? কেনই বা এমন ব্যবস্থা করা হল যাতে লাস উদ্ধার হতে দিন তিনেক দেরী হয়?”

এবার আমার মনে হতে শুরু করছিল যে আমাদের কেসের মধ্যে কোথাও একটা বিরাট ধোঁকা দেবার ব্যাপার রয়েছে। সহসা সমলয় চিৎকার করে উঠল, “বুঝেছি স্যার! যদি আপনার ধারণা ঠিক হয় তবে পুলিসকে খবর দিয়েছে কোন অজ্ঞাতপরিচয় ফোন। সৌমিলির বডি আইডেন্টিফাই করেছে ওর বাবা বা মা। তাকে মেয়ের মৃত্যুসংবাদ যদি পুলিশ দিয়েও থাকে দেখা যাবে তার কয়েকদিন আগেই বাবা বা মার কলকাতা আসার রিজার্ভেশান করা ছিল। আর কাঞ্চনজঙ্ঘার টিটির মেমরি যদি ভাল হয় তবে তাকে সৌমিলির ছবি দেখালে বলবে এই মেয়েটাই মালদা পর্যন্ত গিয়েছিল। আর, আর দেবযানীকে কোনদিনই পাওয়া যাবে না। ঠিক না স্যার?”

প্রমথবাবু একগাল হেসে বললেন, “রাইট। কিন্তু এই বোকা মেয়েটা এখনো কিছুই বোঝেনি। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ওকে সব বুঝিয়ে বোলো। এখন কেটে পড় দেখি। আমার অনেক কাজ।”

সমলয় প্রমথবাবুর পায়ের কাছে ঝুঁকে প্রায় একটা সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করল। উনি ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে নিজের কাগজে ফিরে গেলেন। সমলয় আমাকে ইশারায় বলল, “চল বেরোই।”

আমি একটু একটু বুঝতে শুরু করেছিলাম কিন্তু সবটা আমার কাছে তখনও ক্লিয়ার হয়নি। হাঁটতে হাঁটতে নিউ আলিপুর পেট্রল পাম্পের দিকে যেতে যেতে সমলয় বলল, “সবটা বুঝিসনি তো?” আমি বললাম, “না তোদের ওই সুপার কম্পিউটার ব্রেন আমার নেই।” সমলয় তোয়াজের গলায় বলল, “রাগ করিস না। ওনার কাছে তুইইও যেখানে আমিও সেখানে। আসলে পুরো কেসটাই একটা মাত্র পয়েন্টের উপর দাঁড়িয়ে। সেটা হল সৌমিলি খুন হয়নি।” আমি আঁতকে উঠে বললাম, “তাহলে বডিটা কার?”

“খুব সম্ভব দেবযানীর।”

“কিন্তু দেবযানীকে কে খুন করল?”

“সৌমিলিই। সঙ্গে অবশ্য অন্য লোক ছিল। কে সেটা পুলিশ বার করে নেবে। তবে এমন কেউ যার ঋতমকে ফাঁসানো দরকার ছিল। খুব সম্ভব তনিষ্ঠ।

“কিন্তু দেবযানীকে খুন করে সৌমিলির কী লাভ?”

“এটাই হল আসল কথা। রফিকের ঘটনার পর সৌমিলি ভীষণ ভয়ে ভয়ে থাকত। তারপর ইকবালের লোকেরা ওকে থ্রেট করার পরে ও ভয়ে আধামরা হয়ে যায়। তখনই ও ঠিক করে যে নিজের মৃত্যু সংবাদ রটিয়ে দিতে পারলে প্রাণটা বেঁচে যাবে। অতএব দেবযানীকে খুন করে মাথা থেঁতলে দিয়ে সৌমিলির পোষাক পরিয়ে এমন ব্যবস্থা করা হল যাতে দিন তিনেক পর একটা পচা গলা লাস সহজে কেউ চিনতে না পারে। ইতিমধ্যে সৌমিলি মালদা পালিয়ে গেল। ওর বাবা চলে এল কোলকাতায়, কারণ মেয়ে মিসিং। কিন্তু আসলে সৌমিলির বাবা সবই জানত। কাজেই দেবযানীর বডিকে সৌমিলির বডি বলে আইডেন্টিফাই করে দিল। কিন্তু পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দেখেই বিগ বস ঠিক বুঝে গেল যে বডি বদল হয়েছে। গুরুদেব লোক।” সমলয় একবার কপালে হাত ছোঁয়াল।

“কিন্তু রিজার্ভেশান, টিকিট, টিটি এসব...”

“মালদা থেকে কলকাতা আসার রিজারভেশান দিনে দিনে পাওয়া যায় না। তাই সৌমিলি টিকিটটা নষ্ট না করে সেই টিকিটেই মালদা চলে যাবে অথবা ওর বাবাও দিন দুয়েক আগে রিজার্ভেশান করবে এটাই স্বাভাবিক।”

“সৌমিলি কি খুনটা একা করেছিল?”

“নিশ্চয়ই না। সঙ্গে কেউ একজন ছিল। খুব সম্ভব তনিষ্ঠ। তবে সেটা পুলিশ বার করবে। আমার কাজ হল, পিপি মানে পুলিসের পক্ষের উকিল সুকান্তদাকে সব বলে ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলা। সেক্ষেত্রে পরশুর মধ্যে ঋতমকে পুলিশ ছেড়ে দেবে।”

এর পর আর বেশী কিছু বলার নেই। মালদা জেলা পুলিশ ওই দিন মাঝরাত্রে সৌমিলিকে তার মালদার এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। আসলে আজন্ম মিডিওকার তনিষ্ঠকে সৌমিলি সম্পূর্ণ নিজের প্রভাবে এনে ফেলেছিল। ঋতমকে না সরালে যে ওর উন্নতি হবে না এটা সৌমিলিই ওর মাথায় ঢোকায়। সৌমিলির সেক্স অ্যাপিলের কাছে তনিষ্ঠ সম্পুর্ণ আত্মসমর্পণ করে বসে। জানা যায় সৌমিলি আর তনিষ্ঠই প্ল্যান করে তনিষ্ঠর ভাড়া করা ফ্ল্যাটে দেবযানীকে খুন করে একটা দশ কেজির বাটখারা দিয়ে মাথা থেঁতলে দেয়। সন্ধ্যার দিকে নিজের গাড়িতে লাস নিয়ে তনিষ্ঠ বাইপাসের পাশে ফেলে। সঙ্গে চট আর দুটো মরা কুকুর। এদিকে সৌমিলি ঋতমের গাড়িতে উঠে ঝগড়া শুরু করে ঠিক ওই জায়গায় নেমে পড়ে এবং ঋতম চলে গেলে তনিষ্ঠর গাড়িতে চলে যায়, এবং তনিষ্ঠর বাড়ি রাত কাটিয়ে পরদিন ভোরে কাঞ্চনজঙ্ঘা ধরে মালদা ফিরে যায়।

এই কেসে সমলয়ের নাম খুব একটা হয়নি কারণ ডিটেকশানের কৃতিত্ব সবই পুলিশ নিয়েছে। তবে আর্থিক লাভ প্রচুর হয়েছে। ডেটাপ্রো ওকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছে, সেই সঙ্গে ওর যা ফি। জাভেদ ভাইও ওর ফি দিতে চেয়ে প্রচুর ঝোলাঝুলি করেছেন তবে এক মামলায় দুবার ফি নেওয়া যায় না বলে ওঁকে নিরস্ত করা হয়েছে। রফিক মাসদুয়েকের মধ্যেই প্রচুর উন্নতি করেছে। তবে ঋতম অনুশীলার ব্যাপারটা এখনো ফাইনাল হয়নি।