বৈভব দত্তের ডায়েরি - বিভাবসু দে

রহস্য উপন্যাস

অলংকরণ - মিশন মন্ডল
(১)

‘বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, জানেন? বড় ক্লান্ত। ভালো মানুষ, ভালো ছাত্র, ভালো ছেলে, এমন আরও অনেক অনেক ভালো-র ভিড়ে কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল। বড্ড হাঁপিয়ে উঠছিলাম। তাই একদিন লোকটাকে খুন করে ফেললাম।’ লাইনটা পড়তে গিয়েই হাতদুটো কেমন যেন থিরথির করে কেঁপে উঠেছিল, আর সেই সঙ্গে ডায়েরিটাও। জানি না, হয়তো কোনওদিন কল্পনাও করতে পারব না, ঠিক কোন মনস্তাত্ত্বিক অন্ধকারে ডুবে গেল একটা মানুষের মন এমন অলীক চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আসে। একটা মানুষ অকারণে খুন করে ফেলতে চায় কাউকে।

ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগের, ২০১৪ সাল; গোটা শহর শিউরে উঠেছিল কয়েকটা নৃশংস খুনের ঘটনায়। আমি তখন ‘নিউজ আজকাল’ চ্যানেলে ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে কাজ করি। মাস ছয়েক আগেই ঢুকেছিলাম চাকরিতে, কিন্তু বেশ ক’টা ভালো ভালো প্রজেক্ট উতরে দেবার সুবাদে খুব তাড়াতাড়িই বসের নেকনজরে এসে পড়ি। মোটামুটি যেকোনও বড় ক্রাইম নিউজ কভার করার দায়িত্ব তখন আমার ওপরই থাকত। বয়স কম ছিল, আর উৎসাহটাও ছিল যথেষ্ট--- নাওয়া-খাওয়া ভুলে ছুটতাম স্টোরির পেছনে। এটাও তেমনই একটা দুর্দান্ত খুনের, কিংবা সত্যি কথা বলতে গেলে এক ভয়ংকর খুনির কাহিনি ছিল। একটা নাম, যা হঠাৎ করেই উঠে এসেছিল সমস্ত খবরের কাগজের ফ্রন্ট পেজে।

কিন্তু ... সব গল্প তো আর নিছক একটা ব্রেকিং নিউজ হয়েই ফুরিয়ে যায় না, কিছু কিছু গল্প থাকে যা অজান্তেই কুয়াশার মতো ঘনিয়ে ওঠে আমাদের চারপাশে, নিঃশব্দে জীবনের ভিতটাই নাড়িয়ে দিয়ে যায়; জীবনটাই হঠাৎ করে কখন যেন গল্পের ভেতর ঢুকে পড়ে।

আস্তে আস্তে আবার ডায়েরিটা হাতে তুলে নিলাম--- ‘নমস্কার, আমি বৈভব দত্ত। জীবনে কখনও প্রথম বৈ দ্বিতীয় হইনি। উচ্চমাধ্যমিক, বিএসসি, এমএসসি--- কলেজের ওয়াল অফ অনারে পিতৃদত্ত নামটা এখনও খোদাই করা আছে; গলায় সোনার মেডেল, ফাইল বোঝাই সার্টিফিকেটের বান্ডিল। কানের ভেতর এখনও ঝিঁঝির ডাকের মতো বাজে চারপাশের চেনা-অচেনা মানুষগুলোর প্রশংসা আর হাততালির শব্দ। হয়তো গ্রাফটা আরও অনেক ওপরে উঠতে পারত, কিন্তু ওই যে বললাম, ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বড্ড প্রেডিক্টেবল হয়ে যাচ্ছিল জীবনটা, কেমন যেন একঘেঁয়ে।

‘তাই একদিন ঠিক করলাম একটা খেলা খেলব, খুনের খেলা। ঠিক চারটে খুন--- একটাও বেশি বা কম নয়, ঠিক চারটে। প্রতিটা খুনের সঙ্গে থাকবে একটা করে চিঠি, পুলিশের জন্যে। দেখি, কে জেতে!’

একটা পাতা ফাঁকা রেখে পরের পাতায় আবার লেখা: ‘আজ ২১ জুলাই, ২০১৪। খেলাটা আজ থেকেই শুরু করলাম। ঘন্টা দুয়েক আগেই ফিরেছি খুনটা করে। লোকটা কে ছিল, জানি না; নামটা নাহয় কাল খবরের কাগজ থেকেই জেনে নেব। তবে তাতে কীই বা এসে যায়--- “What’s in a name? That which we call a rose / By any other name would smell as sweet.”

‘সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার ছিল, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বিকেল নাগাদ তো বেশ জোরেই একপশলা হয়ে গেল, রাস্তাঘাটে ভিড়টাও তাই একটু কমতির দিকেই। সন্ধের একটু পরই বেরিয়ে পড়েছিলাম গায়ে বর্ষাতি চাপিয়ে। জিনিসপত্র বলতে তেমন কিছু নয়, একটা আট ইঞ্চির ছুরি আর আরও কয়েকটা টুকিটাকি। মানে ওই একটা দারুণ, চমকে-দেওয়া খুনের জন্যে যা যা লাগে আরকী!

‘অনেকক্ষণ ধরেই এদিক-সেদিক ঘুরছিলাম শিকারের খোঁজে। অন্ধকার রাস্তা থেকে শহরের অলিগলি প্রায় অনেকগুলোই ঘোরা হয়ে গেল, কিন্তু কোথাও যেন ঠিক সুবিধে হচ্ছিল না। সময় তরতর করে এগোচ্ছে, রাত বাড়ছে একটু একটু করে। সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিটাও। রাস্তাঘাট প্রায় শুনশান, তবু কিছুতেই যেন সেই চরম মুহূর্তটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সেই চরম মুহূর্ত যখন কাউকে দেখে আপনা থেকেই জ্বলজ্বল করে উঠবে হাতের ছুরিটা, ভেতর থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসবে এক আসুরিক উল্লাস--- অট্টহাসি।

‘কিন্তু খুনটা তো আজকেই করতে হবে, আজকেই। নইলে যে খেলাটা শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে যাবে--- হেরে যাব আমি--- বৈভব দত্ত কোনওদিনও হারেনি।

‘তখনই হঠাৎ রাস্তার মোড়ে ফাঁকা অটোটা চোখে পড়ল। একটা অপূর্ব রক্তাক্ত দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের সামনে। আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলাম, “অঘোরপুরের শনিতলার দিকটায় যাবে?”

অটোওয়ালা তখন পেছনে আধশোয়া হয়ে বিড়ি টানতে ব্যস্ত। হয়তো না-ই করে দিত, তবু কিছুক্ষণ কী যেন ভেবে বলল, “রিজার্ভ। বৃষ্টি-বাদলার দিন, একশো বেশি লাগবে।”

বেশ বুঝতে পারছিলাম, আমার শিরায় শিরায় রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে। হয়তো লোকটা ভেবেছিল আমি না করে দেব, কিন্তু ঠাণ্ডা গলায় বললাম, “দেব। চলো।” লোকটাও আর কথা না বাড়িয়ে বিড়িতে শেষটান দিয়ে অটো স্টার্ট করল। আমি পেছনে উঠে পড়লাম। অঘোরপুর শনিতলার দিকটা শহর-লাগোয়া হলেও বেশ নির্জন। আমার মাথার ভেতর কালচে চিন্তাগুলো বিদ্যুতের মতো খেলে যাচ্ছিল বারবার। প্রতিমুহূর্তে শিকারের হিসেব কষছিল আমার মন। সামনে বসা লোকটাকে একটু একটু করে মেপে নিচ্ছিলাম, বুঝে নিতে চাইছিলাম তার প্রতিটা অসতর্ক পদক্ষেপকে। বর্ষাতির ভেতর আমার হাতের তালুতে ছুরির হিমেল ধাতব স্পর্শ।

‘একে খুন করাটা এই মুহূর্তে আমার পক্ষে কোনও ব্যাপারই নয়; মাঝপথে একটু থামতে বলে হঠাৎ পিঠে ছুরিটা বসিয়ে দিলেই তো হল। কিন্তু কেন জানি না, বারবার মনে হচ্ছিল খেলাটা ঠিক জমছে না। ভেতরটা কেমন খচখচ করছিল। সেই থ্রিলটা, সেই শিকারের উল্লাসটা যেন ঠিক পাচ্ছি না এভাবে। কিছু একটা মিসিং!

‘অটোর পেছনে বসে যখন নিজের মনেই বারবার উশখুশ করছি, ঠিক সেইসময়ই হঠাৎ দেখতে পেলাম... একটা লোকটা--- হাতে চিরকুট, চোখেমুখে বিরক্তি আর একরাশ চিন্তার ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গলির মুখটায়। অটো বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছিল; তাড়াতাড়ি থামালাম। “রাখ ভাই, এখানেই নামব।”

“এটা তো শিবপুর। অঘোরপুর তো আরও তিন কিলোমিটার।”

“জানি।” ভাড়ার পুরো টাকাটা এগিয়ে দিতেই সেই অটোওয়ালাও আর কিছু বলল না, চলে গেল। একটু হয়তো ঝুঁকি নিয়ে ফেললাম, কিন্তু আমার মুখ বেশ ভালোভাবেই বর্ষাতিতে ঢাকা ছিল, এই আবছা অন্ধকারে অটোওয়ালার খুব একটা চোখে পড়ার কথা নয়। অটোটা চলে যেতেই বেশ একটু পা চালিয়ে এগিয়ে গেলাম ফেলে আসা গলিটার দিকে। হ্যাঁ, আমার ধরতে ভুল হয়নি, লোকটা তখনও ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। বারবার তাকাচ্ছে হাতের চিরকুটটার দিকে, সম্ভবত কারও ঠিকানা খুঁজছে। কিন্তু চারপাশে দোকানপাট সবই বন্ধ, লোকজনও প্রায় নেই বললেই চলে। অগত্যা...

“দাদা, এই ঠিকানা একটু দেখবেন। বলেছিল তো এখানেই বাড়ি, কিন্তু ঠিক কোন গলিটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। ফোননম্বরটাও নেই যে ফোন করব।” অনুমান ভুল ছিল না, আমি কাছাকাছি যেতেই লোকটা এগিয়ে এল। মনে মনে হাসলাম, মাছ টোপ গিলেছে!

“হ্যাঁ, ১৭/১, এই তো এই গলিটার শেষ মাথায়।” বড় বড় বেশ ক’টা দোকানের পেছন দিয়ে এগিয়ে চলা এই সরু গলিটা আমি ভালোভাবেই চিনি, এর দুপাশে শুধুই দোকানের পেছন-দেওয়াল, বাড়িঘর নেই। এলাকার লোকজন কেবল ওপাশের বড়রাস্তায় যাবার শর্টকাট হিসেবেই ব্যবহার করে এই গলিটা, তবে আজ একেবারেই জনশূন্য। আর ওই ঠিকানাটা...হাঃ, ওটা এখান থেকে আধ-কিলোমিটার দূরের শিবপুর বাজার এলাকার, এদিককার মোটেই নয়।

“উফ, বাঁচালেন। অনেকক্ষণ ধরে খোঁজার চেষ্টা করছি, কিন্তু একটা লোকও নেই এদিকে যে জিগ্যেস করব।”

“আমিও ওদিকেই যাচ্ছি। চলুন।”

“অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা।” লোকটা ব্যাগ হাতে গলির ভেতর এগোতে লাগল। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, ভেতর ভেতর আমার স্নায়ুগুলো দপদপ করছে। চারপাশে একটা অদ্ভুত আবছায়া। পায়ের নিচে ভেজা রাস্তায় এদিকে-ওদিকে প্যাঁচপেঁচে কাদা জমে আছে। গলির মুখের স্ট্রিটলাইটটার গায়ে গায়ে জমে উঠেছে হলদে বাষ্প। একটু একটু করে আরও বেশি অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে লোকটা আর তার ঠিক পেছনে আমি। ম্লান হয়ে আসছে গলির মুখের হলুদ আলোটা। আমার ছায়ায় আস্তে আস্তে ঢেকে যাচ্ছে ওর শরীর, আরও কমে আসছে দূরত্ব।

“আক্!” ব্যস এটুকুই। পেছন থেকে শক্ত করে মুখটা চেপে ধরেছিলাম। আট ইঞ্চির ছুরিটা সোজা ঢুকে গেছিল ওর থুতনির নিচের নরম জায়গাটা দিয়ে ওপর দিকে, মগজ বরাবর। নাক, মুখ দিয়ে গলগল করে ঝরে পড়ছিল রক্তের ধারা। লালচে কালো রক্ত...আনন্দ, অদ্ভুত একটা আনন্দ মিশে যাচ্ছে আমার শিরায় শিরায়। বিষাক্ত কোনও নেশার মতো কিংবা ছুরির গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া গরম রক্তের মতো!

‘ওর শরীরটা কাঁপতে কাঁপতে থেমে গেছে। হাতে আর বেশি সময় নেই। পকেট থেকে প্লাস্টিকের ছোট্ট প্যাকেটে ভরা চিঠিটা বের করলাম। পুলিশকে তো জানাতে হবে, আমি কে! পেরেক আর ছোট একটা হাতুড়ি নিয়েই এসেছিলাম--- সেই পেরেক দিয়ে লোকটার কপালের ঠিক মাঝ-বরাবর গেঁথে দিলাম প্যাকেটটা --- ওর শেষ ললাটলিখন! হাসি পাচ্ছিল কথাটা ভাবতে গিয়েই।

‘লোকটার থেকে বেশি কিছু নিইনি, শুধু ঠিকানা-লেখা কাগজটা সরিয়ে নিয়েছিলাম। অত সহজে সবকিছু বলে দিলে খেলাটা জমবে কী করে?

‘ওই অন্ধকার গলিটা থেকে যখন বেরিয়ে আসছিলাম, তখন আবার সেই অনেকদিন আগের, বড্ড চেনা একটা অনুভূতি যেন একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছিল মনের আনাচে-কানাচে। অদ্ভুত একটা শিহরণ। সেই প্রথম যখন ক্লাসের সবাইকে টপকে ফার্স্ট হয়েছিলাম, ঠিক সেই উত্তেজনা। হ্যাঁ, এটাই তো ফিরে পেতে চাইছিলাম আমি, ঠিক এটাই। খেলা শুরু হয়ে গেছে, বৈভব দত্তের খেলা!

‘পেছনে আস্তে আস্তে অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল আমার প্রথম শিকারের রক্তাক্ত লাশটা--- এক নতুন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়। রক্তের মতো লাল একটা ভোরের অপেক্ষায়---

‘আজি এ প্রভাতে রবির কর

কেমনে পশিল প্রাণের পর,

কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!

না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।

জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,

ওরে উথলি উঠেছে বারি,

ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।’

(২)

খেলাটা বোধহয় সেদিন থেকে আমার জীবনেও শুরু হয়ে গেছিল।

রাত তখন প্রায় সাড়ে তিনটে, ইংরেজি মতে ২১ পেরিয়ে ২২-শে জুলাই শুরু হয়ে গেছে, হঠাৎ মোবাইলের শব্দে হকচকিয়ে উঠি। বসের ফোন। চাকরির প্রথম দিনই বলেছিলেন, “সাংবাদিকতায় দিন-রাত বলে কিছু হয় না, তাই মোবাইল কখনও সাইলেন্ট করে ঘুমোবে না।” লোকটার এই একটা গুণ প্রথমদিন থেকেই চোখে পড়েছিল আমার--- এত বড় নিউজ চ্যানেলের মালিক, তবু ভেতরের কাজ-পাগল জার্নালিস্টটাকে আজও মরতে দেননি। বয়স হয়তো চল্লিশের একটু ওপরের দিকেই হবে, কিন্তু তখনও কর্মদক্ষতায় তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে আমরা রীতিমত হিমশিম খেতাম। অফিসে সিনিয়র কলিগদের কাছে শুনেছিলাম কীভাবে এই অনিরুদ্ধ মুখার্জি প্রায় একলা-হাতে একটা ছোট্ট খবরের কাগজ থেকে নিজের সাংবাদিকতার জোরে এই বিশাল মিডিয়া-হাউজ খাড়া করেছেন। কয়েকদিনের মধ্যে এটাও বেশ বুঝে গেছিলাম যে ইনি তোষামোদখোর লোক নন, কাজের আর প্রতিভার দাম দিতে জানেন। জান লড়িয়ে কাজ করলে তাঁর সুনজরে আসতে বেশিদিন লাগবে না। আর তার প্রমাণ ইতিমধ্যে হাতেনাতে পেয়েও গেছিলাম। লোকটাকে যত দেখতাম, ততই অবাক হয়ে যেতাম। মনে হতো যেন কোনও হিন্দি সিনেমার কাল্পনিক চরিত্র! কিন্তু তাঁর এই হাজার গুণের মধ্যে একটা দোষও ছিল বটে--- কেউ মরুক বাঁচুক, চ্যানেলের স্বার্থ তাঁর কাছে সবার আগে। তবে জানি না, এটাকে ঠিক দোষ বলা যায় কিনা, হয়তো এই মানসিকতার জন্যেই নিউজ আজকাল এতটা ওপরে উঠতে পেরেছিল।

কিন্তু এই মাঝরাতে হঠাৎ বসের ফোনটা আমার কাছে একটু অপ্রত্যাশিতই ছিল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বেশ উত্তেজিত গলা ভেসে এল--- “সুবিনয়, কুইক, একটা দারুণ খুনের কেস আছে। সি.আই.ডি ডাকা হয়েছে, খুব সম্ভবত সাইকোকিলার। তুমি তাড়াতাড়ি আশীষকে নিয়ে স্পটে যাও। শিবপুর নিউমার্কেটের পেছনের সরু গলিতে খুনটা হয়েছে, পুলিশ এসে গেছে।”

আমার উত্তরের আর অপেক্ষা করলেন না, একশ্বাসে কথাগুলো বলেই ফোনটা রেখে দিলেন। সাইকোকিলারের ব্যাপারটা শুনে আমারও ঘুম উবে গিয়েছিল, তাই আর দেরি না করে আশীষকে, মানে আমার ক্যামেরাম্যানকে ফোন করলাম। “হ্যালো, আশীষ, একটা খুনের কেস আছে। এক্ষুনি যেতে হবে। তৈরী থাক, আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।”

ওপাশ থেকে আশীষের ঘুমজড়ানো গলা--- “কে? কার খুন?”

“আমি, সুবিনয়দা বলছি। একটা খুন হয়েছে, এক্ষুনি যেতে হবে।”

প্রথমে কিছুক্ষণ ধানাই-পানাই করলেও যখন বললাম বসের হুকুম, সে-ও আর কথা বাড়াল না। ওই একটি লোকের নামে অফিসে সব বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়! অনিরুদ্ধ মুখার্জি নিজে যেমন কাজ করে তেমন অন্যকে দিয়ে কাজ করাতেও জানে।

 

আশীষকে নিয়ে যখন খুনের জায়গায় পৌঁছলাম, ততক্ষণে মোটামুটি জনাদশেকের একটা ভিড় জমে গেছে সেখানে; পুলিশ আর ফরেন্সিকের লোক তো আগেই এসে গেছিল। ঘড়িতে সময় দেখলাম, চারটে কুড়ি।

এখনও পরিষ্কার মনে আছে, ভিড় ঠেলে সামনে যেতেই একেবারে শিউরে উঠেছিলাম। এমনভাবে কাউকে খুন হতে এর আগে কখনও দেখিনি। ছুরিটা গলার নিচ দিয়ে সোজা ওপর দিকে ঢোকানো, আর কপালের ঠিক মাঝখানটায় একটা পেরেক গাঁথা, কিছু একটা আটকানো আছে ওখানে। চারপাশে বৃষ্টিভেজা মাটিতে কাদায় আর রক্তে মিশে থকথকে হয়ে জমাট বেঁধে আছে, লোকটার সারা শরীরে রক্তের দাগ। লাশটার একটু পাশেই একটা ব্যাগ, তবে সেটাতে তেমন কোনও রক্তের চিহ্ন চোখে পড়ল না।

নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে সবে ইন্সপেক্টরের সঙ্গে কথা বলতে এগোচ্ছিলাম এমন সময় হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখল। “তোমাদের আবার কে খবর দিল হে সুবিনয়? তুমি তো দেখছি পুলিশকেও হার মানাবে!”

পেছন ফিরতেই দেখি নিজের স্বভাবসিদ্ধ বাঁকা হাসি ঠোঁটে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সি.আই.ডি অফিসার মিত্র। আমিও হেসে বললাম, “আমাদের কোনও দোষ নেই হুজুর, বসের আদেশ, নইলে কে এই মাঝরাতে সুখনিদ্রা ছেড়ে খুনখারাপি ঘাঁটতে আসে বলুন!”

ভদ্রলোকের সঙ্গে আগের কয়েকটা কেসের সুবাদে আমার পরিচয়টা একটু ভালোই। অফিসার মিত্র গোয়েন্দা হিসেবে যেমন তুখোড়, মানুষ হিসেবেও তেমনই মিশুকে।

“হাঃ হাঃ, তা তো বটেই! এসো, এবার লাশটা একটু দেখি, এরা তো বলছে ব্যাপারটা কোনও পাগলা-খুনির কাজ হতে পারে।” বলতে বলতে লাশটার দিকে এগিয়ে গেলেন অফিসার মিত্র, সঙ্গে আমিও। আশীষকে ইশারায় ক্যামেরা অন রাখতে বলেছিলাম।

“খুব জঘন্যভাবে খুন করেছে স্যার। দেখে কিছু বুঝতে পারছেন?”

“হুম।” পুলিশ ইন্সপেক্টরের কথায় শুধু একবার মাথা নাড়লেন অফিসার মিত্র। “ফরেন্সিকের লোকেদের একটু ডাকুন তো, এই পেরেকটা তুলে প্যাকেটটা একবার বার করতে হবে। ভেতরে কিছু একটা কাগজ আছে বলে মনে হচ্ছে।”

আমি আর আশীষ ততক্ষণে একটু ওপাশে সরে গিয়ে জমা হওয়া লোকজনের থেকে যদি কিছু জানা যায় সেই চেষ্টা করছিলাম, হঠাৎ অফিসার মিত্র সামনে ডাকলেন। লাশের কপাল থেকে পেরেক উপড়ে সেই চিঠিটা বের করা হয়েছে; অফিসার মিত্র দস্তানা পরা হাতে সেটাই একবার আমাকে দেখিয়ে বললেন, “যা মনে হচ্ছে আসলেই সাইকো কেস।”

কাছে এগিয়ে গেলাম। “কী লেখা আছে স্যার? হুমকি?”

“না হে, কোবতে।” হাসলেন অফিসার মিত্র। “রবীন্দ্রনাথের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ থেকে ক’টা লাইন। ---

‘আজি এ প্রভাতে রবির কর

কেমনে পশিল প্রাণের পর,

কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!

না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।

জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,

ওরে উথলি উঠেছে বারি,

ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।

 

নমস্কার, আমি বৈভব দত্ত। আজ থেকে খেলাটা শুরু হল, এখনও আরও অনেক বাকি। ঠিক চারটে খুনের একটা খেলা, দেখি কে জেতে!’ ”

 

পড়া শেষে চিঠিটা ফরেন্সিকের লোকদের দিতে গিয়ে হঠাৎ পেছনটায় চোখ পড়ল অফিসার মিত্রের। “এদিকে আবার কী লিখেছে?”

আমিও ঝুঁকে পড়লাম দেখাবার জন্যে। চিঠিটা হাতে লেখা হলেও পেছনটায় কিছু টাইপ করা, কিন্তু লেখাগুলো প্রায় অস্পষ্ট, আবছা আর মাঝখান থেকে কাটা। অফিসার মিত্র বললেন, “সম্ভবত খুনি কোনও প্রিন্ট হওয়া বাজে কাগজের সাদা পিঠে চিঠিটা লিখেছে, তবে উল্টো পিঠের প্রিন্টটা থেকে কিছু লিংক পাওয়াও যেতে পারে।”

“কী মনে হচ্ছে স্যার? এই বৈভব দত্ত কি কোনও পুরোনো খুনে?”

আমার প্রশ্নে লাশটার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে তিনি বললেন, “উহুঁ! আমার যদ্দূর খেয়াল হচ্ছে, পুলিশ রেকর্ডে এমন কোনও নাম নেই আর এটা সম্ভবত খুনির আসল নামও নয়। ছদ্মনাম। চারটে খুনের খেলা...মানে এখনও আরও তিনটে খুন বাকি। কিন্তু... নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ থেকে হঠাৎ এই কোটেশনের কারণ কী?”

“খুন হওয়া লোকটার ব্যাপারে কিছু জানতে পারলেন?”

“হু, অখিলেশ তলাপাত্র। আইডি কার্ড পাওয়া গেছে, এখানকার লোক নয়, তিলজলিয়ার দিকে বাড়ি। খবর পাঠানো হয়েছে।”

“ব্যক্তিগত শত্রুতা থাকতে পারে কি?”

“দেখে তো মনে হচ্ছে না, তবে বাকিটা তদন্ত না করে কিছু বলা যাবে না।”

 

আরও আধঘন্টা মতন সেখানে ছিলাম আমরা। তারপর বডি আর বাকি জিনিসপত্র ফরেন্সিকে পাঠিয়ে অফিসার মিত্রও বেরিয়ে পড়লেন। পুলিশও ততক্ষণে জায়গাটা সিজ করে দিয়েছিল, লাশের পজিশনটা মার্ক করে দেওয়া হয়েছিল সাদা রঙে। আশীষ আর আমারও কাজ মোটামুটি শেষ, ছবি আর আশেপাশের লোকজনের কিছু বয়ান জোগাড় হয়ে গেছে।

ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে আস্তে আস্তে। কালকের টানা বৃষ্টির পর আজ দিনটা বেশ উজ্জ্বল হবে বলেই মনে হচ্ছে। হালকা হালকা হাওয়া দিচ্ছে চারপাশে, সঙ্গে পাখির ডাক। একটু একটু করে লাল হয়ে উঠছে পুবের আকাশ। সেই সুন্দর সকালটা দেখে একমুহূর্তের জন্যে যেন ভুলেই গেছিলাম যে একটু আগেই আমি আমার জীবনের নৃশংসতম খুনের সাক্ষী হলাম! কোথাও যেন বারবার শুধু ওই লাইনটাই ভেসে উঠছিল আমার মনের ভেতর--- ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর / কেমনে পশিল প্রাণের পর, / কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাতপাখির গান!’

তখনই হঠাৎ বসের ফোনে হুঁশ ফিরল। “হ্যাঁ স্যার, কাজ হয়ে গেছে, আমরা ফিরছি। ব্রেকিং নিউজ রেডি!” ব্যস, তড়িঘড়ি আমি আর আশীষও ছুটলাম অফিসের দিকে; আজ অনেক কাজ। কিন্তু কিছুতেই ওই নামটা মন থেকে সরাতে পারছিলাম না---বৈভব দত্ত--- কে এই বৈভব দত্ত? কীসের খেলা খেলতে চায় সে? কারা হবে তার পরবর্তী তিন টার্গেট? জানি না, কিছুই জানি না।

 

দিন তিনেক পর হঠাৎ অফিসার মিত্রের কাছ থেকেই খবরটা পেয়েছিলাম, যদিও সেইমুহূর্তে চ্যানেলে রিপোর্ট করতে বারণ করেছিলেন তিনি। বড় বড় সেয়ানা খুনিরাও কিছু না কিছু ভুল করেই ফেলে, এ-ও তেমনই একটা ভুল করে ফেলেছিল। আঙুলের ছাপ। ছুরির হাতলে না থাকলেও, সেই চিঠির গায়ে আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। অফিসার মিত্রের অনুমানই ঠিক ছিল, এই বৈভব দত্তের কোনও পুলিশ রেকর্ড নেই, অন্তত আঙুলের ছাপ তো তাই বলছে। তবে ওটা সেই মুহূর্তে একটা বড় ক্ল্যু ছিল পুলিশের কাছে। একদিকে খুনির আঙুলের ছাপ আর অন্যদিকে অন্ধকারের ওপারে একটা নাম---বৈভব দত্ত। খেলাটা সত্যিই জমে উঠেছিল।

(৩)

বৈভব দত্তের ডায়েরির পাতাটা উল্টাতে গিয়ে হঠাৎ পুরোনো কিছু স্মৃতি ছবির মতো ভেসে উঠল চোখের সামনে। আমি তখন কলেজে পড়ি, ফিজিক্স অনার্স। কলেজ থেকে বাড়ি আর বাড়ি থেকে কলেজ, পড়াশুনোর বাইরে কিছুতেই কোনওকালে খুব একটা আগ্রহ ছিল না। প্রেম জিনিসটা বরাবর সময় নষ্ট বলেই মনে হয়েছে, তাই যথাসম্ভব এড়িয়েই গেছি। অন্তত প্রাণপণে এড়িয়ে যেতেই চেয়েছিলাম।

কিন্তু কিছু কিছু মেয়ে থাকে যাদের দিকে না চাইলেও চোখ চলে যায়, বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। অনেক চেষ্টা করেও সেই চাউনি, সেই হাসির খিলখিল শব্দ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা যায় না। দৃষ্টি অবাধ্য হয়ে ওঠে। ভয় হয় পাছে কেউ দেখে ফেলে, তবু আড়চোখে শুধু আর একটি বার দেখতে ইচ্ছে করে।

শিপ্রাকে প্রথম দেখেছিলাম কলেজের ক্যান্টিনে। নাম জানতাম না তখন, কোন কোর্স সেটাও না, কিন্তু ওই যে বললাম, চোখ আর মন দুটোই অবাধ্য হয়ে উঠেছিল সেই প্রথম দেখাতেই। অসাধারণ সুন্দরী নয়, তবু কিছু একটা ছিল ওর মধ্যে--- চঞ্চল নদীর মতো কিংবা জলতরঙ্গের মিষ্টি শব্দের মতো একটা কিছু। এখনও মনে আছে, সেদিন বারবার ওকেই দেখছিলাম--- ওর উজ্জ্বল চোখদুটো, ওর হাসি, ওর আঙুলের প্রতিটা নড়াচড়া। হঠাৎ করেই সব কেমন যেন হয়ে গেছিল--- আপনা থেকেই। চারপাশে মায়াবী ধোঁয়ার মতো কিছু একটা যেন ছড়িয়ে পড়ছিল।

বাড়ি ফিরেও কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছিলাম না ওর মুখটা, যেন স্বপ্নের মতো ভাসছিল চোখের সামনে। অদ্ভুত একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে গেছিলাম সেদিন, কেমন আচ্ছন্নের মতো অকারণ আনন্দের বুদবুদ ভেসে উঠছিল মনের ভেতর।

সেই ঘোর আস্তে আস্তে নেশা হয়ে উঠল। খোঁজখবর শুরু করলাম। বেশিদিন লাগল না জানতে--- ওর নাম শিপ্রা চৌধুরী, ইংলিশ অনার্স ফার্স্ট ইয়ার।

প্রেমে পড়ছিলাম? হয়তো। কিন্তু কিছু লোকের দ্বারা প্রেম হলেও প্রেম-নিবেদন জিনিসটা কোনওকালেই হয় না। চিরকাল ওই ‘থাক থাক নিজমনে দূরেতে, / আমি শুধু বাঁশরীর সুরেতে’ হয়েই থেকে যায়। আমিও তাদেরই দলে। কলেজের তিনটে বছর দূর থেকেই শুধু শিপ্রাকে দেখে গেছি, মনে মনে হয়তো ভালোও বেসেছি কিন্তু মুখ ফুটে কোনওদিন আর বলা হয়নি, এমনকী সামান্য একটা কথাও না। সে-সময় তো আর হাতে হাতে ফেসবুক ছিল না, তবু ওর জন্মদিন থেকে শুরু করে বাড়ির ঠিকানা সব আমার মুখস্থ ছিল; কলেজ ক্যান্টিনে রোজ ওকে দেখতামও, কিন্তু এর বেশি আর এগোনো হয়নি। হয়তো সাহসটাই ছিল না আমার।

সে-ও হয়তো কখনও না কখনও দেখেছে আমাকে, চোখাচোখিও হয়েছে হয়তো কিন্তু সেটা শুধুই দেখা। একজন মানুষ যেমনভাবে তার চারপাশের আর পাঁচজন মানুষকে দেখে, ঠিক তেমনটাই। শিপ্রা কোনওদিন জানতেও পারেনি ওর এই গোপন প্রেমিকের খবর।

দেখতে দেখতে তিনটে বছর কেটে গেল, কে কোথায় চলে গেলাম আর কোনও খোঁজই পাইনি। জীবনের ভিড়ে ধাক্কা খেতে খেতে আমিও ভুলে গেছিলাম শিপ্রার কথা, কিন্তু হঠাৎ একদিন...

নিউজ আজকালে রিপোর্টার হিসেবে জয়েন করেছি সবে দু’দিন হয়েছে, অফিসে বসে একটা খবরের আউটলাইন তৈরী করছি এমনসময় হঠাৎ বসের কেবিনের দরজায় চোখ পড়ল। বুকটা যেন ধক করে কেঁপে উঠল একমুহূর্তের জন্যে। শিপ্রা বেরিয়ে আসছে কেবিন থেকে। ওই মুখ চিনতে আমার কোনওদিন ভুল হতে পারে না। কিন্তু ও এখানে কী করছে? ও কি এখানেই চাকরি করে? রিপোর্টার? একঝাঁক প্রশ্ন ঝড়ের মতো আছড়ে পড়ছিল আমার মাথার ভেতর।

“কী সুবিনয়, দেখে যে একেবারে হাঁ হয়ে গেলে?” ঠোঁটের কোণে একটা ব্যঙ্গমাখা হাসি টেনে আমার দিকেই তাকিয়েছিলেন পরিমলদা। আমার পাশের টেবিলেই বসেন, বয়সে অনেকটাই সিনিয়র।

তাড়াতড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “না মানে, তেমন কিছু না। ভদ্রমহিলাকে একটু চেনা চেনা লাগছিল আরকী, তাই।”

“হে হে! শিপ্রাকে প্রথম দেখায় সবারই অমন চেনা চেনা লাগে! এত বছরে তো কম দেখলাম না বাপু। তবে বেশি এগিও না, লাভ নেই।”

হঠাৎ যেন অজান্তেই মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, “কেন? বিবাহিতা?”

পরিমলদার হাসিটা আরেকটু চওড়া হয়ে উঠল। “বিবাহিতা তো বটেই, কিন্তু তার বাইরেও উনার অনেক ব্যাপার-স্যাপার আছে।”

নিজের পুরোনো ক্রাশ সম্পর্কে হঠাৎ এমন কিছু মশলাদার খবর শুনলে কৌতূহলটা চড়চড় করে বেড়ে ওঠাই স্বাভাবিক, তবু সামলে নিয়ে চুপ করে যাওয়াটাই উচিত মনে হল। কিন্তু পরিমলদা নিজে থেকেই গলা নামিয়ে বলতে লাগলেন, “মেয়েটি বছর দুয়েক হল অফিসে ঢুকেছে, চাকরি বলতে অনিরুদ্ধবাবু মানে আমাদের বসের পি.এ। কাউকে বোলো না যেন,” গলাটা আরও একদাগ নামিয়ে আনলেন পরিমলদা। “অনিরুদ্ধবাবুর কাজের কিংবা বুদ্ধির যত তারিফ করি কম হবে, কিন্তু ওই চাঁদেও যেমন কলঙ্ক থাকে তেমনই ভদ্রলোকেরও একটু নারীঘটিত দুর্বলতা আছে। সেটা আগেও কখনও-সখনও দেখেছি, কিন্তু এই শিপ্রা আসার পর থেকে সেটা একেবারে দৃষ্টিকটুরকমভাবে খুল্লমখুল্লা হয়ে উঠেছে। শিপ্রারও যে এতে ভালোই উৎসাহ আছে, সেটা সবাই জানে। পোস্টে পি.এ কিন্তু বেতন আর উপরি সোহাগ মিলিয়ে আমার দ্বিগুণ পায় ওই মেয়ে!”

পরিমলদার কথাগুলোতে ব্যক্তিগত ঈর্ষার একটা স্পষ্ট গন্ধ পাচ্ছিলাম, তবে সেটা বসের প্রতি না শিপ্রার প্রতি, জানি না। একটু হয়তো বিরক্তও লাগছিল। তবু মুখে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থেকেই জিগ্যেস করলাম, “কিন্তু ভদ্রমহিলাকে দেখে তো তেমন মনে হয় না।”

“হুহ্! খোকা সবে তো ঢুকলে, ক’টা দিন সবুর করো, ধীরে ধীরে সব বুঝতে পারবে। শুধু চোখকান একটু খোলা রেখো।”

আমি আর কোনও জবাব না দিয়ে নিজের কাজে মন দিলাম। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলাম, শিপ্রাকে হঠাৎ এতবছর পর দেখতে পাওয়ার শিহরণটা কোথায় যেন পরিমলদার কথাগুলোকে বারবার ছাপিয়ে যাচ্ছিল। পুরোনো আবেগগুলো বোধহয় আবার রঙিন প্রজাপতির মতো ছড়িয়ে পড়তে চাইছিল মনের আনাচে-কানাচে।

(৪)

‘দোসরা আগস্ট, ২০১৪।’ স্মৃতির কুয়াশা কেটে গিয়ে ডায়েরিটা আবার একটু একটু করে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। ‘ট্রেনের ওই আবছা অন্ধকার কামরাটায় চড়েই সবার আগে চোখে পড়েছিল সেই লোকটা। জানালার কাছে চুপ করে বসে আছে, কোলে একটা অফিস-ব্যাগ আর চোখদুটো বাইরের দিকে--- যেন ওই অন্ধকারেও কিছু একটা দেখার অকারণ চেষ্টা করে চলেছে। বয়স ত্রিশের একটু ওপরের দিকেই হবে, গায়ে কেতাদুরস্ত শার্ট-পেন্ট, দেখে সরকারি চাকুরে বলেই মনে হল। আমি গিয়ে বসলাম ওর ঠিক উল্টোদিকের সিটটায়, জানালা ঘেঁষে। ট্রেনের খোলা জানালা দিয়ে হুঁ হুঁ করে বাতাস এসে ধাক্কা মারছে চোখেমুখে। বাইরে জ্যোৎস্না আর বহু দূরের কোনও অজানা উৎস থেকে ভেসে আসা বৈদ্যুতিক আলোর এক মায়াবী মিশেল। লোকটাও বোধহয় একবার আড়চোখে দেখল আমাকে।

‘আমি চড়েছিলাম রামেন্দ্রনগর স্টেশন থেকে, রাধারঘাটের ঠিক আগের স্টেশন। এটা লোকাল ট্রেন, রাধারঘাট অবধিই যায়, তবে অধিকাংশ লোক রামেন্দ্রনগরেই নেমে পড়ে--- রাধারঘাট অবধি শুধু সরকারি দায় রক্ষার্থে ছুটতে হয় এই বেচারাকে। ঠিক যেমন এতদিন আমাকে ছুটতে হয়েছে ভালোমানুষির দায় সামলাতে! কোথাও যেন একটা পড়েছিলাম, সম্ভবত ফেসবুকে, ‘দেবতা আরও বেশি করে দেবতা হতে হতে হঠাৎ কেমন যেন মানুষের মতো কেঁদে ফেললেন।’ কিন্তু আমি কাঁদিনি, শুধু দেবতার ভেতর থেকে টেনে বের করে এনেছি সেই চিরন্তন শয়তানটাকে--- যে নারকীয় আনন্দে সব ভুলে হাসতে জানে। এক পৈশাচিক উল্লাস, যার উৎকট মাদকতায় একদিন তিলে তিলে মিলিয়ে যাবে ওই ফ্যাকাশে জীর্ণ ভালোমানুষটা--- আমি শয়তানের মতো সত্য হয়ে উঠব।

‘আমার কামরাটাতেও ওই একটা লোক ছাড়া আর কেউ নেই, তবে পাশের কামরায় জনাতিনেক রয়েছে। এমনটাই তো চাইছিলাম।

“দাদা কি রাধারঘাট নামবেন?” প্রশ্নটা আমিই করলাম, যদিও জানি ওখানেই সবাইকে নামতে হবে।

লোকটা তাকাল আমার দিকে। বোধহয় ওই আবছা অন্ধকারেও মেপে নিতে চাইল একবার। “হ্যাঁ। আপনি?”

“আমিও ওখানেই।” একটু থেমে আবার জিগ্যেস করলাম, “বাড়ি?”

“না, সরকারি কাজে যেতে হচ্ছে। কাল থেকে ডেপুটেশন।”

“ওহ, আচ্ছা আচ্ছা। কোন ডিপার্টমেন্টে আছেন?”

“মেডিক্যাল।”

“ডাক্তার?” গলায় বিস্ময়ের আমেজটা হয়তো একটু বেশিই ঢেলে দিয়েছিলাম।

“হ্যাঁ।”

“বাহ্।”

‘তারপর কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপ করে রইলাম। ট্রেন চলার একটানা শব্দে কামরার নৈঃশব্দই যেন আরও ঘনিয়ে উঠছিল। শুধু মাঝে মাঝে পাশের কামরা থেকে ভেসে আসছিল কিছু কথাবার্তার শব্দ। আমি আর আমার মুখোমুখি সেই লোকটা--- মাঝে শ্মশানের মতো এক ধোঁয়াটে অন্ধকার। কখনও-সখনও কেঁপে উঠছে জানালা বেয়ে আসা আলোর ধাক্কায়।

‘এবার প্রশ্নটা ওপাশ থেকেই এল, “তা আপনার কি রাধারঘাটে বাড়ি?” বেশ বুঝতে পারছিলাম সেই লোকটা নেহাত ভদ্রতার খাতিরেই প্রশ্নটা করল, একজন অপরিচিতের সঙ্গে অন্ধকার কামরায় বসে খোশগপ্প করবার খুব একটা শখ তার নেই।

আমি বললাম, “না, এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।”

“ওহ।”

‘এরপর আর দু’জনেই কোনও কথা খুঁজে পেলাম না। ট্রেনের গতিটাও ততক্ষণে আস্তে আস্তে কমে আসছে, সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে থেমে থেমে ঝাঁকুনি দিয়ে আবার চলতে শুরু করছে। স্টেশনের কাছাকাছি চলে এসেছে হয়তো। টি-শার্টের ভেতর আমার পিঠটা ঘেমে উঠছিল একটু একটু করে, দমকে দমকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল এক অদ্ভুত উত্তেজনা। হাতে আর বেশি সময় নেই।

প্রায় আরও মিনিট কুড়ি ওই ঢিমে-তেতালা তালে এগিয়ে অবশেষে স্টেশনে ঢুকল ট্রেনটা। এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম--- এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে কিছু লোক, ভিড় তেমন নেই এখন। এটাই এই স্টেশনের শেষ ট্রেন, পরের ট্রেন আবার কাল ভোর ছ’টায়।

ট্রেনের কামরায় আলো না থাকলেও স্টেশনটায় আছে। প্ল্যাটফর্মের আলোতেই এতক্ষণে প্রথমবার সেই লোকটার মুখটা পরিষ্কারভাবে দেখতে পেলাম। হাতের ব্যাগ আর সিটের নিচ থেকে একটা মাঝারি সাইজের ট্রলিব্যাগ বের করে ধীরে ধীরে বেরোবার তোড়জোড় করছে। আমার শুধু কাঁধ থেকে ঝোলানো একটা সাইড-ব্যাগ--- নেমে পড়লাম।

‘মিনিট দুয়েক পর সেও নামল--- আমি দেখলাম কিন্তু সে আমাকে দেখতে পেল না। আমার স্নায়ুতে স্নায়ুতে যেন দামাল ঘোড়ার মতো ছুটছিল কিছু মনস্তাত্ত্বিক সমীকরণ--- ওর মনটা পড়তে চাইছিলাম।

‘রিক্সা-স্ট্যান্ডটা স্টেশনের ঠিক সামনে কিন্তু অটো আর বাস স্ট্যান্ড একটু বাইরের দিকে, খানিকটা হেঁটে যেতে হয়। দুটো রাস্তা আছে--- হয় স্টেশনের গেট দিয়ে সোজা পথ ধরে বেশ খানিকটা হেঁটে সেখানে যাওয়া অথবা স্টেশনের ওপাশের ভাঙা দেওয়াল লাগোয়া অন্ধকার জায়গাটা দিয়ে অনেকটাই কম সময়ে সেই অটো স্ট্যান্ডে পৌঁছনো। সে দ্বিতীয় রাস্তাটাই ধরল। আর আমিও মনে মনে হাসলাম--- ভাগ্য জিনিসটা বরাবরই আমার সঙ্গ দিয়েছে।

‘নিঃশব্দে ওর পিছু নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে লোকটা বুঝতেই পারল না কখন আমি ছায়ার মতো তার শরীরের সঙ্গে প্রায় মিশে গেছি। ভাঙা দেওয়ালটার কাছাকাছি এসে হঠাৎ কিছু একটা টের পেয়ে চমকে উঠল সে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পেছন ফিরতেই হাতের একটা ছুরি গেঁথে দিলাম তার পেটের ভেতর আর দ্বিতীয় ছুরির ঘায়ে চিরে ফেললাম তার গলার নলিটা। বেশি কষ্ট পেতে হয়নি তাকে, এক-আধমিনিট কাতরেই ওর সব নড়াচড়া থেমে গেছিল। নিথর, ঠিক একটা পাথরের মূর্তির মতো। চাঁদের জ্যোৎস্না আর স্টেশনের ক্ষয়াটে হলদে আলোয় একটু একটু করে রক্তে ভিজে যাচ্ছিল তার শরীরটা। আমি দেখছিলাম, গরম কালচে লাল রক্ত--- শেয়ালের চিৎকারের মতো একটা উল্লাস যেন ফেটে বেরোতে চাইছিল আমার ভেতর থেকে; একটা অকারণ অট্টহাসি।

কী অদ্ভুত না, একটু আগে এই লোকটাই বসেছিল ঠিক আমার মুখোমুখি; এখন সে শুধুই একটা লাশ। চোখদুটো এখনও বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আস্তে আস্তে একটা ছুরি ওর গলার নিচ বরাবর গেঁথে দিলাম--- আমার স্বাক্ষর!

‘এবার দ্বিতীয় কাজ--- চিঠি। প্রথম খুনটার মতোই এই লাশটার কপালেও পেরেক ঠুকে আটকে দিলাম চিঠিটা--- খেলায় এখন স্কোর ২ - ০! দেখি শেষ অবধি কে জেতে।’

(৫)

বৈভবের ডায়েরি থেকে চোখ তুলতেই মনে পড়ে গেল তেসরা আগস্টের সেই সকালটা। একটা খুন--- যার রক্তের কিছু ছিঁটে এসে ছড়িয়ে পড়েছিল আমার চারপাশেও। তবে সেই কালো সকালটা যে আস্তে আস্তে আমার গোটা জীবনটাকেই এক অন্য বাঁকে ঘুরিয়ে দিতে চলেছে, সেটা সেই মুহূর্তে মোটেও আঁচ করতে পারিনি। আসলে রক্ত আর ভালোবাসা, দুটোর রঙই তো লাল!

সেই প্রথমবার মনে হয়েছিল যেন ওই বৈভব দত্ত নামটা হঠাৎ করেই আমার বড্ড কাছাকাছি চলে এসেছে--- ঘাড়ের কাছে স্পষ্ট টের পাচ্ছি ওর গরম নিঃশ্বাসের ছোঁয়া। একটা ব্রেকিং নিউজ যেন আচমকা ঢুকে পড়েছে আমারই চেনা-জানা এক বৃত্তের গণ্ডিতে। ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে জীবনে অনেকবার অনেক অপরাধীর মুখোমুখি হয়েছি, অপরাধের শিকার মানুষদের সঙ্গেও কথা বলেছি, কিন্তু... নিজের ঠিক সামনে, এভাবে...

রোজকার মতো সেদিনও অফিসে বসে কাজ করছিলাম--- এক মন্ত্রীর বাড়িতে আগের রাতেই বেশ বড়সড় একটা চুরি হয়েছে, তারই একটা ছোট্ট খসড়া তৈরী করছিলাম। একটু পরেই চ্যানেলে দেখানো হবে। বাকিরাও যে যার কাজে ব্যস্ত। এমনসময় হঠাৎ প্রায় পুরো অফিস চমকে উঠেছিল এক নারীকণ্ঠের তীব্র উত্তেজিত চিৎকারে--- “কী আবোলতাবোল বকছেন আপনারা? হতে পারে না...ভুল হচ্ছে, ভুল হচ্ছে আপনাদের।” স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম চিৎকারটা আস্তে আস্তে বুকভাঙা কান্নায় বদলে যাচ্ছিল।

আমার ভেতরটা কেমন যেন ধড়াস করে উঠল--- ওই গলা তো...। সবার সঙ্গে আমিও তাড়াতাড়ি ছুটে গেলাম কী হয়েছে দেখবার জন্যে। কিন্তু সামনে যেতেই বুকের ধুকপুকুনিটা হঠাৎ করেই কেমন থমকে গেল, কেউ যেন হাতুড়ির ঘা মারল ভেতর থেকে--- শিপ্রা পাগলের মতো মাটিতে লুটিয়ে কাঁদছে। হাতের কাছে পড়ে আছে ওর মোবাইলটা।

আমরা ঘটনার আকস্মিকতা সামলে ওঠার আগেই, “কী হয়েছে? দেখি দেখি, সরুন একটু।” বলতে বলতে পেছন থেকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন অনিরুদ্ধবাবু। “একী শিপ্রা, এভাবে কাঁদছ কেন? কিছু হয়েছে?”

শিপ্রা চোখ তুলে তাকাল, কিছু একটা বলতেও চাইল কিন্তু বোধহয় বলতে পারল না--- কান্নাটাই শুধু আরও গভীর হয়ে উঠল। মেঝে থেকে মোবাইলটা তুলে বসের দিকে এগিয়ে দিল শিপ্রা। পরিষ্কার দেখতে পেলাম ওর হাতদুটো থরথর করে কাঁপছে।

মোবাইলের ওপারে তখনও কারও গলা শোনা যাচ্ছে, হ্যালো হ্যালো করে চিৎকার করে চলেছে লোকটা। অনিরুদ্ধবাবু ফোনটা ধরলেন--- “হ্যালো, কে বলছেন?”

ফোনের ওপাশ থেকে কিছু একটা উত্তর এল। বসের কোঁচকানো ভুরুদুটোও সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে গেল, সম্ভবত পরিচিত কেউ। “হ্যাঁ, অফিসার মিত্র, আমি অনিরুদ্ধ মুখার্জি বলছি; নিউজ আজকাল। কিছু হয়েছে?”

কিন্তু একটু পরেই অনিরুদ্ধবাবুর মুখটা যেন কালো হয়ে গেল, আর চোখদুটো শিকারী বাঘের মতো ধারালো--- যেন মাথার ভেতর অনেকগুলো ছক কষা হয়ে যাচ্ছে একই সঙ্গে। অনিরুদ্ধবাবু বললেন, “হ্যাঁ আসলে শিপ্রা আমাদের অফিসেই চাকরি করে, বেচারি খুব শকড হয়ে পড়েছে ব্যাপারটায়। আমি ওকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।” ওদিক থেকে বোধহয় কিছু একটা বললেন অফিসার মিত্র। অনিরুদ্ধবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “আচ্ছা, শিপ্রার সঙ্গে আমি সুবিনয় আর আশীষকেও একটু পাঠাচ্ছি...আপনি তো আছেনই?”

অফিসের আরও কয়েকজন মহিলা কলিগ ততক্ষণে শিপ্রাকে ধরাধরি করে চেয়ারে বসালেন, জল-টল খাইয়ে কিছুটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করা হচ্ছিল ওকে। আমরা কেউই তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি ব্যাপারটা কী হয়েছে। কিন্তু কেন জানি না, অফিসার মিত্রের নামটা শোনার পর থেকে একটা চিন্তাই আমার মাথায় কালো মেঘের মতো ঘুরপাক খাচ্ছিল। তবে কি সত্যিই...

“সুবিনয়...” বসের ডাকে ফিরে তাকালাম। ইশারায় একটু ওপাশে ডাকলেন আমাকে।

“স্যার, ব্যাপার কী?”

“সেই সাইকো খুনি, বৈভব দত্ত।”

“কিন্তু শিপ্রার...”

“ওর হাজবেন্ড। হুম, ওর হাজবেন্ডই দ্বিতীয় ভিকটিম। অফিসার মিত্র বলছেন খুনটা কাল রাতের দিকে হয়েছে, রাধারঘাট স্টেশনে, তবে বডি আপাতত সিটি হাসপাতালে আছে। মিত্রও আছেন ওখানে।”

“মাই গড!” বসের কথাগুলো, পেছন থেকে ভেসে আসা শিপ্রার কান্নার শব্দ সবই কেমন যেন একটা দুঃস্বপ্নের মতো লাগছিল তখন। “আমি তো ভাবতেই...”

কথাটা ফুরোবার আগেই আমায় থামিয়ে দিয়ে অনিরুদ্ধবাবু অদ্ভুত নির্লিপ্ত গলায় বললেন, “শিপ্রা একটু সামলে উঠলে তুমি আর আশীষ ওকে নিয়ে সিটি হাসপাতাল যাবে; কোনও একজন মহিলা স্টাফকেও সঙ্গে নিয়ে নিও, দরকার পড়তে পারে। লাশটা শনাক্ত করার একটা ব্যাপার আছে, হয়তো তখন শিপ্রার সঙ্গে কাউকে থাকতে হবে। তবে তোমাদের পাঠানোর আরেকটা কারণও আছে, আশা করি বুঝতে পারছ, অন্য কোনও চ্যানেলের আগে এই ঘটনা সব ডিটেইলস এবং ভিডিও ফুটেজসহ আমাদের চ্যানেলে থাকা চাই। অফিসার মিত্রের সঙ্গে আমার কথা বলা আছে, বাকিটা তুমি সামলে নিতে পারবে।”

একটানা কথাগুলো বলে বস চলে গেলেন শিপ্রার কাছে, হয়তো কিছু সান্ত্বনাবাক্য শোনাতে--- কিংবা সান্ত্বনার ছলে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যাবার জন্যে তাগাদা দিতে! মাঝে মাঝে অবাক লাগে, এই লোকটার মন বা অনুভূতি বলে আদৌ কি কিছু আছে! এই মিডিয়ার দুনিয়ায় যেন সত্যিই একটা পাথুরে স্তম্ভ ওই অনিরুদ্ধ মুখার্জি--- পাথরের মতোই আবেগহীন।

 

প্রায় আধঘন্টা পর শিপ্রাকে গাড়িতে বসানো হল--- পেছনের সিটে। সঙ্গে পারমিতাদি আর আশীষ। আমি সামনে বসলাম ড্রাইভারের সঙ্গে। জীবনে প্রথমবার আমার কলেজ-দিনের ক্রাশ আর আমি একই গাড়িতে, কিন্তু কী অদ্ভুত না এই মুহূর্তটা? রেয়ার ভিউ মিররে বারবার আড়চোখে দেখছিলাম শিপ্রাকে--- কাঁদতে কাঁদতে প্রায় অবশ হয়ে পড়েছে, চোখদুটো ফোলা। চোখের নিচে, গালে এখনও জলের দাগ--- কান্না থামেনি, হয়তো চোখের জল শুকিয়ে গেছে! ওর মুখটা যতবার চোখে পড়ছিল, একটা অজানা ব্যথা যেন আমার ভেতরেও ঘূর্ণির মতো পাক খেয়ে উঠছিল বারবার। অনেককিছু বলতে চাইছিলাম, কিন্তু...

 

গাড়িটা হঠাৎ ব্রেক কষে থামল--- হাসপাতাল এসে গেছে। নামতে গিয়েও আরেকবার চোখ চলে গেল শিপ্রার দিকে, এখনও চাউনিতে কেমন যেন একটা আচ্ছন্নভাব। চোখের কোলদুটো ফুলে উঠেছে। পারমিতাদি আর আশীষ ধরে-টরে ভেতরে নিয়ে গেল ওকে। পেছন পেছন আমিও যাচ্ছিলাম; অফিসার মিত্রকে একবার ফোন করতে হবে।

“হ্যালো স্যার, আমরা এসে গেছি। বডিটা কি মর্গে?”

“হ্যাঁ, চলে এস। থার্ড ফ্লোর। আমি ওখানেই আছি।”

মোবাইলটা রেখে দেখলাম আশীষ এগোতে এগোতে বারবার আমার দিকেই তাকাচ্ছে, জিজ্ঞাসাটা স্পষ্ট। বললাম, “থার্ড ফ্লোর।” মর্গ শব্দটা শিপ্রার সামনে আর উচ্চারণ করতে ইচ্ছে হল না।

ওপরে যেতেই করিডোরের একেবারে শেষ মাথায় দেখতে পেলাম অফিসার মিত্রকে, সঙ্গে জানাতিনেক পুলিশও রয়েছে। আরও কিছুটা এগোতেই চোখে পড়ল মর্গের দরজাটা।

“আপনিই মিসেস শিপ্রা চৌধুরী?” অফিসার মিত্র সামনে এসে দাঁড়ালেন।

শিপ্রা শুধু একবার চোখ তুলে তাকাল, বোধহয় মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলারও চেষ্টা করল একটু।

“প্রেমেশ, ভেতরে নিয়ে যাও এঁদের।” অফিসার মিত্রের ইশারায় একজন পুলিশ আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে দিল। শিপ্রাকে তখনও পারমিতাদি ধরে আছে একপাশ থেকে। আমি আর ভেতরে ঢুকলাম না, শুধু দরজার ফাঁক দিয়ে একবার তাকালাম--- একটা ধোঁয়াটে হিমশীতল ঘর। অন্ধকার আর টিমটিমে টিউবের ফ্যাকাশে আলো যেন কেমন অদ্ভুতভাবে মিলেমিশে এক প্রাণহীন ধূসরতায় জমাট বেঁধে আছে। একটু একটু করে আবছা অন্ধকারটা আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল শিপ্রার চারপাশে। কেন জানি না, অকারণেই বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল ওর সেই উজ্জ্বল চোখদুটো, সেই ক্যান্টিন, বহুবছর আগের সেই লুকিয়ে দেখা... ভেতর থেকে একটা অবশ কান্নার শব্দ গোঙানির মতো ভেসে আসছিল।

“ভদ্রমহিলা তোমাদের অফিসে চাকরি করেন?”

অফিসার মিত্রের কথায় যেন আমার চমক ভাঙল। বললাম, “হ্যাঁ, বসের পি.এ। বছর দুয়েক আছেন বোধহয়।”

“হুম।”

“খুনটা কি...”

“হ্যাঁ, সেই বৈভবেরই কাজ। তবে এবার পেটে আর গলার নলিতেও ছুরি চালিয়েছে।”

“আর কোনও চিঠি...” আবার আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন অফিসার মিত্র। “যদি তেমন অসুবিধে না হয়, তবে একবার আমার সঙ্গে অফিসে আসতে পারবে? হয়তো তোমাদের একটা সাহায্যের দরকার পড়বে।”

অফিসার মিত্রের সরু চোখদুটো তখনও স্থির হয়ে আছে মর্গের দরজাটার দিকেই, যেন ভেতর ভেতর কোনও পোড়খাওয়া শিকারী শিকারকে ফাঁদে ফেলবার জাল বুনছে। এতটা গম্ভীর ওঁকে এর আগে দেখিনি--- বৈভব দত্ত যে সত্যিই একটা বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে, সেটা বেশ পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম।

(৬)

শিপ্রাকে আশীষ আর পারমিতাদির দায়িত্বে রেখে আমি বেরিয়ে পড়লাম অফিসার মিত্রের সঙ্গে। সারাটা রাস্তা কেমন যেন থমথমে হয়ে ছিল তাঁর মুখটা--- ঠিক যেন একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর! অনেকগুলো প্রশ্ন মাথায় ঘুরছিল--- কিছুটা পেশাদারি তাগিদে কিছুটা স্বাভাবিক কৌতূহলবশেও, কিন্তু ওঁর ওই রুক্ষ পাথুরে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আর সাহস করে উঠতে পারছিলাম না জিগ্যেস করবার। কে জানে, কী সাহায্য চান উনি আমাদের কাছ থেকে!

গাড়িটা যখন সি.আই.ডি হেডকোয়ার্টার্সের সামনে এসে থামল, তখন বেলা প্রায় সাড়ে বারোটা। অফিসার মিত্রের পেছন পেছন আমিও গিয়ে ঢুকলাম ওঁর দোতলার কেবিনে।

“বসো।” একটা চেয়ার আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজে আমার মুখোমুখি বসলেন অফিসার মিত্র। “সিগারেট চলে?”

“না স্যার।”

সিগারেটটা ধরাতে ধরাতে তিনি বললেন, “এই কেসটায় তোমাদের সাহায্য লাগবে।”

“হ্যাঁ, বলুন না।”

“আসলে আমি চাইছিলাম না যে এই দ্বিতীয় খুনের খবরটা মিডিয়া জানুক, হয়তো লক্ষ করেছ যে এখনও অন্য কোনও চ্যানেল বা খবরের কাগজের লোক আসেনি। তোমাদেরও জানাতে চাইছিলাম না, কিন্তু শিপ্রা চৌধুরী যে তোমাদেরই অফিসে কাজ করেন সেটা তো আর আমার জানা ছিল না।” বাঁকা হাসলেন অফিসার মিত্র--- এতক্ষণে এই প্রথমবার। আমিও যেন একটু স্বাভাবিক হয়ে বসলাম; বললাম, “মানে... আপনি না চাইলে আমরা চ্যানেলে দেখাব না।”

“হুম, আগে সেটাই প্ল্যান ছিল।” একটু সময় চুপ থেকে অফিসার মিত্র আবার বললেন, “তবে এখন যেহেতু তোমরা এসেই পড়েছ, তখন প্ল্যানটা একটু পাল্টে ফেললাম।”

“কীরকম?”

“আচ্ছা, আগে একটা জিনিস বলো তো, শিপ্রা চৌধুরীর স্বামী খুন হয়েছেন, এই ব্যাপারটা তোমাদের অফিসে কে কে জানে?”

“প্রায় সবাই।”

“বেশ।” চোখদুটো আবার সরু হয়ে উঠল অফিসার মিত্রের। “আর সেটা যে বৈভব দত্ত নামক সেই সাইকো খুনির হাতে হয়েছে, এটা ক’জন জানে?”

“আপাতত আমি, শিপ্রা, পারমিতাদি, আশীষ আর আমাদের বস, মানে অনিরুদ্ধবাবু। হ্যাঁ, বস যদি অফিসে কাউকে কিছু বলে-টলে থাকেন তবে রাষ্ট্র হতে বেশিক্ষণ লাগবে না।”

“অনিরুদ্ধ মুখার্জিকে যতদূর চিনি, সে এসব ব্যাপারে ঢাক পেটানোর লোক নয়।” চেয়ারে পিঠ এলিয়ে বসলেন অফিসার মিত্র। “এবার আসল কথায় আসি। বৈভব দত্তের মানসিক অবস্থা আন্দাজ করতে যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে, তবে সে কাউকে বিশেষভাবে টার্গেট করে মারছে না। হয়তো হঠাৎ একদিন আঁটঘাট বেঁধে বেরোচ্ছে আর সুবিধেমত যাকে পাচ্ছে তাকেই খুন করছে। অন্তত এই দুটো খুনের অভিজ্ঞতা থেকে তো তা-ই মনে হচ্ছে। কারণ যে দু’জন এখনও অবধি বৈভবের হাতে খুন হয়েছে তাদের মধ্যে এমন কোনও যোগসূত্র নেই যা দিয়ে একটা সুনিশ্চিত সমীকরণ খাড়া করা যায়। প্রথম যে-লোকটা খুন হয়েছে সে তিলজলিয়ায় একটা স্কুলে পড়াত; আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এখানে এসেছিল নেহাত একটা কাজে কিন্তু কাজ সারতে সারতে অনেকটা রাত হয়ে যাওয়ায় শিবপুরের এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকতে গেছিল। কিন্তু বাড়ি অবধি পৌঁছনোর আগেই গলিতে খুন হয়। দ্বিতীয় খুন, মানে কাল যেটা হল, মিসেস শিপ্রার হাজবেন্ড, রণতোষ সেন--- পেশায় সরকারি ডাক্তার ছিলেন, ডেপুটেশনে রাধারঘাট ডিস্পেনসারিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু স্টেশনের পাশেই এক অন্ধকার জায়গায় তাঁকে খুন করা হয়।”

“হুম। কিন্তু তাতে কী দাঁড়াল?”

“খেলা! বৈভব দত্ত চারটে খুনের একটা খেলা খেলছে আমাদের সঙ্গে। মানে মোদ্দা কথা লোকটা পাগল এবং যেকোনও চারটে মানুষকে মেরে এক উদ্ভট খেলা খেলতে চায়। প্রথম চিঠিটা তোমার মনে আছে আশা করি?”

“হ্যাঁ। আচ্ছা, এবাৱও কি কোনও চিঠি দিয়ে গেছে?”

“নইলে আর বলছি কী! ঠিক সেই একইভাবে, কপালের মাঝখানে পেরেক পুঁতে আটকে রেখেছে। আসলটা ফরেন্সিকে পাঠিয়েছি, আপাতত এটা দেখতে পারো।” অফিসার মিত্র নিজের মোবাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন, চিঠিটার একটা ছবি ভাসছে তার পর্দায়।

‘সজনি সজনি রাধিকা লো

দেখ অবহুঁ চাহিয়া,

মৃদুলগমন শ্যাম আওয়ে

মৃদুল গান গাহিয়া।

 

স্কোর এখন ২ - ০! কী ইনসপেক্টর সাহেব, জলদি করুন নইলে হেরে যাবেন তো। তৃতীয় খুনটা এই মাসেই করব, পারলে আটকান।

ইতি,

আপনার একান্ত অনুগত,

বৈভব দত্ত’

 

মোবাইলটা থেকে চোখ সরিয়ে আবার ফিরলাম অফিসার মিত্রের দিকে। “আচ্ছা, স্যার এই রবীন্দ্রসংগীতগুলোর কোনও মানে আছে কি? কোনও কোড বা ইশারা যে পরবর্তী টার্গেট কে হতে পারে।”

“জানি না, তবে এখনও অবধি তেমন কোনও অ্যাঙ্গেল তো আমার মাথায় আসছে না। হয়তো প্রথম খুন বলে সেটা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ ছিল, এখানে দ্বিতীয় খুনে আবার হতে পারে একটা অভিসারের ব্যাপার কল্পনা করেছে!” বলতে বলতে একটুকরো কৌতুক ঝিলিক দিয়ে উঠল অফিসার মিত্রের ঠোঁটে।

আমিও হালকা হেসে বললাম, “মানে বলতে চাইছেন যে রবি ঠাকুর আজকাল খুনিদেরও ইনস্পায়ার করছেন?”

“হেঃ হেঃ! মন্দ বলোনি। তবে এবার কিন্তু চিঠি ছাড়াও আরেকটা জিনিস পেয়েছি লাশের কাছাকাছি; যদি আমার অনুমান ভুল না হয় তবে খুনিকে ধরতে এর চেয়ে মোক্ষম প্রমাণ আর কিছু হতে পারে না।”

“কী জিনিস? খুনির কিছু?” পিঠ টানটান করে সোজা হয়ে বসলাম।

কিন্তু অফিসার মিত্র ঠোঁটের কোণে তেরছা হাসি টেনে বললেন, “সময় এলে সব জানতে পারবে সুবিনয়। আপাতত ব্যাপারটা গোপনই থাক।” একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন, “এখন আসল কথায় আসি। তোমাদের চ্যানেলে একটা ভুয়ো খবর ছড়াতে হবে যে বৈভব দত্তের আক্রমণে রণতোষ সেন নামক জনৈক চিকিৎসক গুরুতর আহত অবস্থায় আছেন কিন্তু তাঁর জীবন সংকট এখন কেটে গেছে। হাসপাতাল সূত্রের খবর যে হয়তো আর এক দেড় সপ্তাহের মধ্যেই তিনি খানিকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেন।”

“কিন্তু...”

“আমি জানি, হয়তো আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছি। কিন্তু ওই বৈভব দত্ত যদি একবার এই ফাঁদে পা দেয় তাহলে বাছাধনের খেলা আমি ঘুচিয়ে দেব।”

“সে নাহয় হল স্যার, কিন্তু বসের সঙ্গে তো একবার...”

“কথা বলতে হবে, এই তো? ফোন করো, আমি নিজেই কথা বলে নিচ্ছি।”

আমি মোবাইলে বসের নম্বরটা বের করে অফিসার মিত্রের দিকে এগিয়ে দিলাম।

“হ্যালো, অনিরুদ্ধবাবু, আমি অফিসার মিত্র বলছি। সুবিনয় আমার এখানেই আছে।”

ওপাশের কথাগুলো শুনতে না পেলেও আঁচ করতে পারছিলাম।

“আচ্ছা, আপনাদের থেকে একটা ছোট্ট সাহায্য চাই। প্রথমত, শিপ্রা চৌধুরীর স্বামীর খুনটা যে সেই বৈভব দত্তের সঙ্গে লিংকড, সেটা যেন অফিসে আর কেউ জানতে না পারে। শিপ্রা এবং ওঁর সঙ্গে যারা ছিলেন হাসপাতালে, তাঁদেরও বলে দেবেন। সুবিনয়কে তো আমি বলেই দিয়েছি।” একটু থেমে ওপাশের জবাব শুনে অফিসার মিত্র আবার বললেন, “এবার দ্বিতীয় কথায় আসি। আপনাদের চ্যানেলে একটা সাজানো খবর দেখাতে হবে। বেশি কিছু নয়, শুধু এইটুকুই যে বৈভব এবার যাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল সে মারাত্মকভাবে জখম হলেও এখন সংকটমুক্ত, এরকম একটা কিছু। সুবিনয়কে আমি ডিটেইলস বুঝিয়ে দেব। আর শিপ্রার স্বামীর সৎকার খুব গোপনে পারলে আজকেই সারতে হবে। সেগুলো আমরা দেখে নিচ্ছি।”

বস কী বললেন জানি না, কিন্তু অফিসার মিত্রের মুখে একটা ছোট্ট হাসির রেখা বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিয়ে গেল। বেশ রসালো গলায় বললেন, “চিন্তা নেই অনিরুদ্ধবাবু, আপনি আমাদের সাহায্য করুন, আপনার টি.আর.পি বাড়ানোর ব্যবস্থা আমরা করে দেব।”

(৭)

ডায়েরির আরেকটা পাতা উল্টালাম। প্রায় ফাঁকা, শুধু ক’টা লাইন লেখা--- ‘ভালো ছেলে--- ব্যাপারটা খুব বিরক্তিকর বুঝলেন, খুব একঘেঁয়ে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব ছিঁড়েছুড়ে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যাই, সবার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে হাসি, চুরমার করে দিই চারপাশের মানুষগুলোর আমাকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের দমবন্ধ-করা প্রাচীরটা। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি, ঠিক কোনও পৌরাণিক অসুরের মতো। কিন্তু পারি না--- আমি তো ভালো ছেলে!’

অকারণেই যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক ঠেলে। কোথাও বোধহয় ওর ভেতরের মানসিক যন্ত্রণাটা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিলাম আমি। একটা পাঁজর-ফাটা হাহাকার ছিল ওর মধ্যে, যা হয়তো হঠাৎ করেই একদিন এক বীভৎস মূর্তিতে আছড়ে পড়েছিল সমাজের ওপর। কে জানে, হয়তো সে কবি হতে চেয়েছিল, কিংবা অন্যকিছু--- কিন্তু নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছিল একটা দানব। স্বপ্ন বড় বিষাক্ত জিনিস--- মরেও মরে না, প্রেতাত্মা হয়ে ফিরে ফিরে আসে। স্বপ্নিল সুরগুলো তখন সদ্যবিধবার বুকভাঙা বিলাপের মতো শোনায়।

দ্বিতীয় খুনের পর প্রায় দেড় সপ্তাহ পেরিয়ে গেছিল। অফিসার মিত্রের কথামতো আমাদের চ্যানেলসহ আরও প্রায় সব ডিজিট্যাল ও প্রিন্ট মিডিয়াতেই এই ভুয়ো খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে বৈভবের প্রত্যক্ষদর্শী এখনও জীবিত আছে এবং খুব শিগগিরই বৈভবের চেহারার বিবরণ পুলিশ পেয়ে যাবে তার কাছ থেকে। পুলিশ আশা করছিল যে বৈভব যেভাবেই হোক নিজের আধমরা দ্বিতীয় শিকারকে মারবার জন্যে আবার আক্রমণ করবেই, তাই হাসপাতালের আনাচে-কানাচে সিভিল ড্রেসে পুলিশের লোক ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে পুরো হাসপাতালে জায়গায় জায়গায় প্রায় আরও দেড়শোখানা সিসি ক্যামেরা। বাইরে খোঁজাখুঁজি তো চলছিলই।

এর মধ্যেই একদিন একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটে গেল আমার জীবনে, অনেকটা স্বপ্নের মতোই। দিনটা ছিল তেরোই আগস্ট। দু’দিন পর স্বাধীনতা দিবস। অফিসেই যাচ্ছিলাম, এমনসময় হঠাৎ বসের ফোন এল।

“হ্যালো সুবিনয়, তুমি কি বেরিয়ে গেছ?”

“হ্যাঁ, এই বেরোচ্ছি আরকী।”

“আচ্ছা, একটা কাজ করতে পারবে? শিপ্রার বাড়িতে একটু যাও, আর ওকে বোলো যে পরশু স্বাধীনতা দিবসে অফিসে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান আছে, সম্ভব হলে যেন আসে। আমি নিজেই যেতাম, কিন্তু একটা কাজে আটকে গেছি। পরে একবার ফোন করে নেব আমি। আসলে দেড় সপ্তাহ তো হয়ে গেল, আমি চাই আস্তে আস্তে ও আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুক। কাজে ফিরলে মনও ভালো থাকবে।”

বুকটা কেমন যেন ধুকপুক করে উঠল আমার--- শিপ্রার বাড়ি! শিপ্রা! গলাটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখেই বললাম, “হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কিন্তু উনার ঠিকানাটা?”

বস ঠিকানা বলে দিলেন। আমিও আর দেরি না করে তখনই বেরিয়ে পড়লাম। ভেতর ভেতর যে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা হচ্ছিল, বেশ টের পাচ্ছিলাম। ঠিক সেই কলেজের দিনগুলোর মতো--- ক্যান্টিনে যখন সবার চোখে এড়িয়ে বারবার তাকাতাম ওর দিকে। ভালো লাগত, আবার একটু ভয়ও হতো, কেউ দেখে না ফেলে।

৪০৫ নম্বর ফ্ল্যাট, ১০/২-এ চন্দন অ্যাপার্টমেন্টস, রামনগর-২। শিপ্রার ঠিকানা। গাড়িতে মিনিট চল্লিশের মতো লাগল পৌঁছতে। লিফট নেই অগত্যা সিঁড়ি ভেঙেই চারতলায় উঠলাম। বেল বাজাতেই কিছুক্ষণের মধ্যে দরজা খুলে গেল। শিপ্রাই খুলল।

“নমস্কার। আমাকে অনিরুদ্ধবাবু পাঠালেন।”

“আচ্ছা। আসুন, ভেতরে আসুন।” গলায় একটা ম্লানভাব থাকলেও অনেকটাই সামলে উঠেছে ও।

বেশ সাজানো-গোছানো ঘর। সোফায় গায়ে বসলাম আমি। মাঝখানে একটা কাচের টেবিল আর তার ওপারে শিপ্রা। দূরত্বটা হঠাৎ করে যেন অনেকটাই কমে গেছিল! নিঃশব্দে একটা লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে বললাম, “কেমন আছেন এখন?”

“এই চলছে আরকী। কিছুদিন মা-র কাছে ছিলাম, দু’দিন আগেই ফিরলাম।”

“ও, আচ্ছা।”

তারপর কিছুক্ষণ বোকার মতো চুপ করে বসে রইলাম। আসলে ওর সামনে সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছিল। এরপর কী বলব, খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এমনসময় শিপ্রা বলল, “চা খাবেন তো একটু? আমি নিয়ে আসছি।”

আমি কোনও জবাব দেবার আগেই ও উঠে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। আমিও যেন একটা হাঁপ ছেড়ে নিজের মনে নিজেকেই গোছাতে বসলাম। বেশ বুঝতে পারছিলাম মনের ভেতরে সেই পুরোনো আবেগগুলো আবার শিরশির করে জেগে উঠছে।

কয়েক মিনিট পর দু’কাপ চা নিয়ে এসে বসল শিপ্রা। আমি চায়ে একটা হালকা চুমুক দিয়ে বললাম, “আসলে বস বলছিলেন পরশু অফিসে একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান আছে। আপনি যদি আসতেন তাহলে আপনারও ভালো লাগত, মনটাও হালকা হতো একটু। মানে...”

“পরশু হয়তো যাওয়া হবে না,” শিপ্রার ঠোঁটের কোণে একটা ক্লান্ত হাসির রেখা। “তবে অনিরুদ্ধবাবুকে বলবেন আমি খুব সম্ভবত পরের সোমবার থেকে কাজে আসব।”

বুকটা যেন আরও জোরে ধুকপুক করে উঠল আমার। মুখে বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ভালো। অনিরুদ্ধবাবু হয়তো নিজেই ফোন করবেন আপনাকে।”

“হুম।”

আবার যেন হঠাৎ করে কথা ফুরিয়ে গেল আমার। আমি কি সত্যিই ওকে এখনও ভালোবাসি? সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল--- বারবার ভুলে যাচ্ছিলাম যে ও সদ্য একটা বড় আঘাত থেকে উঠেছে, এখনও ঘা ভরেনি। জোর করে থামাতে চাইছিলাম নিজের লাগাম-ছাড়া চিন্তাগুলোকে, কিন্তু কল্পনার রং চারপাশে যেন আরও ছড়িয়ে পড়ছিল। একটা অকারণ আনন্দের ঢেউ তিরতির করে বয়ে যাচ্ছিল আমার শিরায় শিরায়। আমি আর আমার কলেজজীবনের ভালোবাসা--- মাঝখানে শুধু ক’টা হাতের দূরত্বমাত্র।

“আচ্ছা, আপনি কেশব কলেজে পড়তেন না?” নিজের অজান্তেই যেন বলে ফেললাম কথাগুলো।

কয়েক সেকেন্ডের একটা বিস্ময় ঝিলিক দিয়ে উঠল শিপ্রার চোখে। “হ্যাঁ, আপনি কী করে জানলেন?”

“আমিও ওই কলেজেই পড়তাম। ২০০৯-এ পাস আউট।”

“ওহ, আমি ২০১০। আপনার কোন স্ট্রিম ছিল?”

“ফিজিক্স। আপনার?” উত্তরগুলো জানা, তবু...

“ইংলিশ অনার্স।”

“আচ্ছা। আসলে অফিসে তো কখনও কথা হয়ে ওঠেনি, তবে চেহারাটা খুব চেনা-চেনা লাগছিল। কলেজে কখনও দেখেছিলাম হয়তো।”

ছোট্ট একচিলতে হাসি খেলে গেল ওর মুখে। চোখদুটো আপনি নেমে গেল ঘরের পাথর-বাঁধানো মেঝের দিকে। আর তখনই হঠাৎ আমার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠল।

(৮)

ডায়েরির পরের দুটো পাতা ফাঁকা। তারপর তৃতীয় পাতায় লেখা--- ‘তারিখটা কী লিখব বুঝতে পারছি না। হিন্দুমতে এখন বারোই আগস্ট কারণ সূর্যোদয় হয়নি আর ইংরেজি মতে তেরো। সময় ভোর চারটে পনেরো--- ব্রাহ্মমুহূর্ত!

‘ক’দিন ধরেই সব কাগজেপত্রে একটা খবর দেখতে পাচ্ছি যে আমার দ্বিতীয় শিকার নাকি বেঁচে আছে! সিটি হাসপাতালেই। অগত্যা এই আধোঅন্ধকারে এসে দাঁড়ালাম হাসপাতালের গেটে। ভোরের সময়--- ঘুম বড় গাঢ় হয়ে আসে। মেইনগেটের গার্ডটা বসে ঢুলছে। ভেতরে এখানে-ওখানে ঘুম-ঘুম চোখে বসে আছে কিছু রোগীর আত্মীয়স্বজন। ভিড় তেমন নেই। ভেতরে হয়তো থাকবে--- ডাক্তার, নার্স সবই থাকবে। গায়ে একটা খয়েরি চাদর জড়িয়ে এসেছিলাম, মুখটাও খানিক ঢাকা। সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়লে পুলিশের বড্ড বেশি নাগালে এসে পড়ব--- সেটা তো আর হতে দেওয়া চলে না।

‘সামনেই হাসপাতালে ঢোকার মুখ--- পুলিশের লোক যে ওঁৎ পেতে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে সেটা ভালোভাবেই জানি। তাই সোজা না এগিয়ে পার্কিং এরিয়ার পেছন দিকেই পা বাড়ালাম। এদিকে লোকজন তো প্রায় নেইই, এমনকী সিসি ক্যামেরাও নেই। শুধু একটা গার্ড একেবারে পেছনদিকের ঝুপসি জায়গায়টায় বসে ঝিমোচ্ছে। নাইট-ডিউটি, বড় বিরক্তিকর জিনিস! আস্তে আস্তে তার সামনে গিয়ে হালকা করে ডাকলাম--- “দাদা, শুনছেন?” আরও বারদুয়েক ডাকার পর ধীরে ধীরে আড়মোড়া ভেঙে চোখটোখ রগড়ে তাকাল লোকটা। জিগ্যেস করল, “কী চাই?” কাঁচা ঘুম ভেঙে যাবার রাগটা গলায় বড্ড স্পষ্টই শোনাচ্ছিল।

‘চাদরের আড়ালে একটু হাসলাম আমি। আর তারপর... ছুরিটা গেঁথে দিলাম ওর গলার নিচ বরাবর। আজকাল নিজের দক্ষতায় মাঝে মাঝে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাই। এক সেকেন্ডের চেয়েও কমে কী নিখুঁতভাবে ছুরিটা চালিয়ে দিলাম। ঠিকমত ঘুমভাঙার আগেই লোকটার চিরনিদ্রা ঘটে গেল! কেমন যেন অদ্ভুত মজা লাগছিল, নিজেরই পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছে করছিল নিজের পারফেকশন দেখে। জানেন, গ্রাজ্যুয়েশনে যখন প্রতিটা পরীক্ষায় প্রতিটা উত্তর নিখুঁতভাবে লিখে বেরোতাম, ঠিক এমনই গা-শিরশিরে আনন্দ হতো। রাজা মনে হতো নিজেকে।

‘লোকটার নিথর শরীরটা এলিয়ে আছে চেয়ারের গায়ে, বুক বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ছুরির হাতল বেয়ে টপটপ করে নামছে লালচে-কালো রক্ত--- ঠিক যেন কার্নিশ থেকে চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির ধারা। সত্যিই যদি রক্তবৃষ্টি হতো, আমি ভিজতাম তাতে--- পাগলের মতো, ময়ূরের মতো; ভিজে ভিজে নাচতাম আর হারিয়ে যেতাম এই পৃথিবী থেকে অনেকদূরে কোথাও।

‘আস্তে আস্তে আকাশ ফর্সা হয়ে আসছে। হাতে সময় আর তেমন নেই। চাদরের ভেতর থেকে বাকি জিনিসগুলো বের করলাম। লোকটার কপালটা বেশ চওড়া--- পেরেক ঠুকবার জন্যে একেবারে আদর্শ! হাতুড়ির দু-তিন ঘায়ে পেরেকটা গেঁথে দিলাম ওর কপালে, সঙ্গে চিঠিটাও। এটাই আমার শেষ চিঠি।

‘দূরে কাক ডাকতে শুরু করেছে একটু একটু করে। আর দেরি করা যাবে না। হাসপাতাল জেগে উঠছে। আমিও একটু তাড়াতাড়িই পা চালিয়ে এগিয়ে গেলাম বাইরের গেটের দিকে। চাদরটা আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে নিলাম মুখে।

‘সিটি হাসপাতাল, হাসপাতালের গেট, আর একটা রক্তাক্ত লাশকে পেছনে ফেলে যখন রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম তখন ভোরের রং ধরেছে পুবের আকাশে। পাখি ডাকছে। একটা লম্বা শ্বাস বুকে টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম নিজের পথে। স্কোর এখন ৩-০!’

 

ডায়েরিটা নামিয়ে রাখতেই আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল তেরোই আগস্ট সকালের সেই দৃশ্যটা। আমি, আমার মুখোমুখি শিপ্রা আর আমার হাতে ভাইব্রেট করতে থাকা একটা ফোন। অফিসার মিত্রের নম্বর। তবে কি বৈভব ধরা পড়েছে? কিন্তু ফোনটা রিসিভ করতেই ওপার থেকে অফিসার মিত্রের উত্তেজিত গলা ভেসে এল। আর সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা বিদ্যুতের ঝলকানিতে শিপ্রার ওই হাসিমুখটা মিলিয়ে গেল আমার চোখের সামনে থেকে। আবার একটা খুন! হাসপাতালেই এসেছিল সে। জাস্ট একটা ফাটাফাটি ব্রেকিং নিউজ!

তড়িঘড়ি শিপ্রার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা এসে পৌঁছলাম সিটি হাসপাতালে। গেটের মুখ দিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই পুলিশের দুটো গাড়ি চোখে পড়েছিল। একটা অফিসার মিত্রের। একজন হাবিলদারই ইশারায় বলে দিল হাসপাতালের পেছনদিকে চলে যেতে, ওখানেই খুনটা হয়েছে।

গাড়িটা পার্কিং এরিয়ায় ঢুকিয়ে সোজা সেদিকেই ছুটলাম। আশীষকেও ফোন করে দিয়েছি আসার পথেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবে হয়তো।

পার্কিং এরিয়া পেরিয়ে পেছনের একটা ঘিঞ্জি মতো জায়গায় ঢুকতেই চোখে পড়ল বেশ কয়েকজন উর্দিপরার জটলা। আর একেবারে সামনে সাধারণ পোশাকে অফিসার মিত্র। আমাকে আসতে দেখেই মুখটা যেন আরও গম্ভীর হয়ে উঠল তাঁর। বললেন, “কেসটা যত সোজা ভেবেছিলাম ততটা নয়। বহুত চালাক মাল ওই বৈভব দত্ত।”

আরেকটু এগিয়ে দেখলাম হাসপাতালেরই একজন গার্ড খুন হয়েছে। খুনের ধরণ সেই একই। গলায় ছুরি, মাথায় পেরেক। “কখন হল খুনটা?”

“সম্ভবত ভোরের দিকে। সময়টা ফরেন্সিকেই ধরা পড়বে।”

“কিন্তু হাসপাতালে ঢুকে এভাবে মেরে দিল, কেউ দেখতে পেল না?”

“আমাদের সঙ্গে খেলছে ওই হারামজাদা।” হঠাৎ গলাটা চড়ে উঠল অফিসার মিত্রের। “আমরা খবর ছড়িয়েছিলাম যে ওর দ্বিতীয় শিকার জীবিত, হাসপাতালেই আছে। কিন্তু লোকটা জানত যে আমাদের ছড়ানো খবর ভুয়ো, আর সেটা আমাদের মধ্যেই কেউ ওর কাছে পাচার করেছে। তবু সে বেছে বেছে এই হাসপাতালেই এল। খোলাখুলি থাপ্পড় মেরে গেল আমাদের! সমস্ত পুলিশ, সিসি ক্যামেরা হাসপাতালের ভেতরে সজাগ বসে রইল আর সে বাইরে খুন করে চলে গেল।”

“আমাদের কেউ! কিন্তু...”

“কে সেই বেইমান না, তবে ধরা পড়বেই।” একবারের জন্যে তো মনে হল যেন আমার দিকেই কেমন শ্যেনদৃষ্টিতে তাকালেন অফিসার মিত্র।

“কিন্তু খবরটা গুজব, এটা যে বৈভব জানত তা কী করে বুঝলেন?”

“নিজেই বলে গেছে!” বলতে বলতে বৈভবের এবারের চিঠিটা আমার চোখের সামনে মেলে ধরলেন অফিসার মিত্র। হাতে দিলেন না--- আমার তো আর গ্লাভস পরা ছিল না। একটু দূর থেকেই পড়তে লাগলাম---

 

‘ঝরঝর বরিষে বারিধারা

হায় পথবাসী, হায় গতিহীন, হায় গৃহহারা।

ফিরে বায়ু হাহাস্বরে, ডাকে কারে

জনহীন অসীম প্রান্তরে---

রজনী আঁধারা।

 

ইনস্পেক্টর সাহেব,

এত কাঁচা খেললে কী করে চলবে বলুন? হেরে যাবেন তো। মিডিয়ায় খবর ছড়ালেন যে আমার দ্বিতীয় শিকার নাকি বেঁচে আছে! খুব বাচ্চামো হয়ে গেল। প্রথম কথা, গলায় ছুরি আর কপালে আস্ত পেরেক পুঁতে দিলে কেউ বাঁচে না। তবু নাহয় মেনে নিলাম যে লোকটার প্রতি ভগবানের অসীম করুণা--- বেঁচে গেছে। কিন্তু ব্যাপারটা হল শর্ষের মধ্যেই যদি ভূত থাকে তাহলে আপনি কীই বা করতে পারবেন! লোকটা যে মারা গেছিল এবং সেদিন রাতেই তার সৎকার করা হয়েছিল, সেটা আমি জানি। তবু আপনারা যখন এত করে চাইছেন যে আমি হাসপাতালে আসি, তখন কী করে ফেলি বলুন? অগত্যা এলাম, খুন করলাম, চলেও গেলাম। এখন স্কোর হল ৩ - ০। গোহারান হারবেন দেখছি!

যাই হোক, এখন কাজের কথায় আসি। প্রথমেই বলেছিলাম আমি ঠিক চারটে খুন করব; এটা ছিল তৃতীয়। তাহলে বাকি রইল আর একটা। কিন্তু সেটা আমি করব না। আহা, অত খুশি হবেন না; আমি শুধু বলেছি যে আমি করব না। কিন্তু খুনটা ঠিকই হবে। খুব তাড়াতাড়িই হবে। পারলে আটকান।

 

ধন্যবাদান্তে,

আপনার দাসানুদাস,

বৈভব দত্ত।’

 

“পেছনে আর কিছু আছে?” আমিই জিগ্যেস করলাম।

একমুখ বিরক্তি নিয়ে অফিসার মিত্র বললেন, “কী আবার, ওই অকাজের প্রিন্ট।” বলে চিঠিটা একবার উল্টো করে আমাকে দেখালেন আর সেই এক ঝলকেই মনে হল কী একটা যেন চিড়িক করে উঠল আমার মাথার ভেতর। উত্তেজিত গলায় বলে উঠলাম, “এটা তো আমার লেখা।”

কেমন যেন হকচকিয়ে গেলেন অফিসার মিত্রও। “তোমার লেখা মানে? কী আবোলতাবোল বকছ?”

“মানে স্যার, এই পেছনের প্রিন্টে যেটা লেখা সেটা আমি টাইপ করেছিলাম। গতকালকের একটা রিপোর্টের জন্যে।”

চোখদুটো চকচক করে উঠল তাঁর। জিগ্যেস করলেন, “তুমি শিওর?”

“হ্যাঁ স্যার, নিজের হাতে টাইপ করা জিনিস। আর এই পাতাটা বিশেষভাবে মনে থাকবার আরেকটা কারণও আছে।”

“কী?”

“আমাদের অফিসের সাদাকালো প্রিন্টারটার প্রিন্ট খুব বাজে আসে। আমার জানা ছিল না, তাই আমি আর্টিকেলটা টাইপ করে সেখান থেকেই প্রিন্ট নিয়ে বসের কাছে দিয়ে আসি।”

“তারপর?” অফিসার মিত্রের গলায় উত্তেজনার পারদ চড়ছিল।

“আধঘন্টা পর বস আবার আমার ডেস্কে ফোন করে বলেন এই পাতাটার আরেকটা প্রিন্ট রঙিন প্রিন্টার থেকে করে দিতে, আগেরটা প্রায় পড়াই যাচ্ছে না। সেই মতো করেও দিয়েছিলাম আমি।”

“তার মানে এই পাতাটা শেষ অবধি অনিরুদ্ধ মুখার্জির কাছে ছিল?”

“হ্যাঁ।”

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন অফিসার মিত্র। তাঁর চোখে কেমন যেন একটা হিংস্র হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল একটু একটু করে। ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বললেন, “এখনই একবার তোমাদের অফিসে যাব। চলো।”

বুকটা থরথর করে কাঁপছিল আমার। তাহলে কি...

(৯)

যখন আমরা অফিসে পৌঁছলাম তখন এক শিপ্রা বাদে প্রায় সবাইই উপস্থিত। আশীষও আমার ফোন পেয়ে মাঝরাস্তা থেকেই গাড়ি ঘুরিয়ে অফিসে চলে এসেছিল। ঠিক একটা ছোট্ট ঝড়ের মতো দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন অফিসার মিত্র। সঙ্গে দু’জন খাকিপরা পুলিশ আর একেবারে পেছনে আমি। ভয়ে আর উত্তেজনায় যেন মাথা কাজ করছিল না আমার। ক্রাইম রিপোর্টার হিসেবে অপরাধ, অপরাধী, পুলিশ অনেক ঘাঁটিয়েছি, কিন্তু সবসময় বাইরে থেকেই। কোনওদিন যে সেটা আমারই জীবনবৃত্তের এত কাছে চলে আসতে পারে ভাবিনি। যেই বৈভব দত্তকে নিয়ে দিনের পর দিন শহরের প্রতিটা নিউজ চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ দেখানো হচ্ছে, অফিসার মিত্রের মতো পোড়খাওয়া লোকের কালঘাম ছুটে যাচ্ছে, সে কি তবে আমাদের অফিসেই বসেছিল এতদিন ধরে? হয়তো আমার ঠিক পাশেই!

“কী ব্যাপার অফিসার, হঠাৎ আপনারা?” অফিসার মিত্রের দিকে এগোতে এগোতে জিগ্যেস করলেন অনিরুদ্ধবাবু। পুলিশকে অফিসে ঢুকতে দেখে নিজেই বেরিয়ে এসেছিলেন কেবিন থেকে।

আমি পাশ থেকে যেন পরিষ্কার দেখতে পেলাম অফিসার মিত্রের ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি খেলে গেল। বললেন, “তেমন কিছু না, তদন্তের ব্যাপারেই একটু আসা।”

“ওহ, আচ্ছা। তা আসুন না, আমার কেবিনে চলুন। বসে কথা বলি।”

“না, আজ থাক। আজ দাঁড়িয়েই কথা হোক।”

খানিকটা যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন অনিরুদ্ধবাবু। একবার আড়চোখে আমার দিকেও তাকালেন। এই লোকটা কি সত্যিই...বুঝতে পারছিলাম না। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হয়তো সবটা আমারই দেখার ভুল ছিল। হয়তো ওটা অন্য কাগজ ছিল। আরেকবার অফিসার মিত্রকে বললে যদি...

কথাগুলো ভাবছিলাম তখনই হঠাৎ ফরেন্সিকের দু’জন লোক এসে ঢুকল। অফিসার মিত্র ওদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এসে গেছেন। নিন, কাজ শুরু করে দিন। প্রথমে এই কাগজটায় যেই আঙুলের ছাপগুলো আছে সেগুলো কালেক্ট করুন, তারপর অফিসের সবার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে।” স্যাম্পল প্যাকে রাখা আজকের চিঠিটা ওদের দিকে এগিয়ে দিলেন অফিসার মিত্র। “আগের চিঠিগুলোর রেকর্ডও তো নিশ্চয়ই রয়েছে আপনাদের কাছে?”

ঘাড় নেড়ে সায় দিল তাদের একজন। অফিসেরই একটা টেবিল খালি করে কাজ শুরু দিল তারা।

“আঙুলের ছাপ মানে? কী ব্যাপার একটু খুলে বলবেন অফিসার?” আরেকটু সামনে এগিয়ে এলেন অনিরুদ্ধবাবু। গলাটা একটু উত্তেজিতই শোনাল তাঁর।

“বলব, সব বলব মিস্টার মুখার্জি, একটু ধৈর্য ধরুন। আসলে বৈভব দত্ত কেসটার কিছু সূত্র আপনার অফিসের দিকেই ইশারা করছে।”

“বৈভব দত্ত!” গলাটা হঠাৎ কেমন যেন নেমে গেল বসের। চারপাশে অদ্ভুত একটা থমথমে পরিবেশ। সবার চোখ অফিসার মিত্রের দিকেই।

“স্যার, চিঠিটা হয়ে গেছে। দু’জনের আঙুলের ছাপ আছে।” মিনিট পাঁচেক পর ফরেন্সিকের একজন বলে উঠল। অফিসার মিত্র বললেন, “গুড। তাহলে এবার বাকি কাজ শুরু করে দিন। প্রত্যেকের আই-কার্ড দেখে নাম আর আঙুলের ছাপ তুলে নিন।”

তারপর অফিসের সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভয় পাবার কিছু নেই। শুধু আমাদের কাজে একটু সাহায্য করুন। ফরেন্সিকের লোকেদের নিজের নামটা বলবেন আর আঙুলের ছাপগুলো একটু দিয়ে দেবেন। প্যানিক করার কোনও কারণ নেই।”

এক এক করে আঙুলের ছাপ নেওয়া শুরু হল। সবার প্রথমেই নেওয়া হল বসের। তারপর বাকিদের। আমারও। প্রায় এক-দেড়ঘন্টা লেগে গেল এতেই। সারাটা অফিস জুড়ে যেন এক রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। ভয়ে মুখগুলো সব পাথরের মতো জমাট বেঁধে আছে। সেন্ট্রাল এসিতেও দরদর করে ঘাম ঝরছে কারও কারও কপাল বেয়ে।

ফরেন্সিকের একজন অফিসার মিত্রের দিকে ফিরে বললেন, “স্যার, হয়ে গেছে। ম্যাচ করেছে।”

চোখদুটো হঠাৎ যেন জ্বলজ্বল করে উঠল অফিসার মিত্রের। এনালাইসিস রিপোর্টটা হাতে নিয়ে বললেন, “এবার সবকিছু খুলে বলছি আপনাদের। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন যে বৈভব দত্ত নামের ওই সাইকো খুনি প্রতিটা খুনের পর একটা করে চিঠি লাশের কপালে গেঁথে দিয়ে যেত। সেই চিঠিগুলো লেখা হতো ফেলে দেওয়া প্রিন্টেড কাগজের সাদা পিঠে। আজ যেই চিঠিটা ছিল সেটা দেখে সুবিনয় চিনতে পারে যে এটা এই অফিসেরই কাগজ, ওরই টাইপ করা। তাই আপনাদের অফিসে এই অতর্কিত হানা দিতে হল। আর ফলটাও হাতেনাতে পেলাম।

“ফরেন্সিক রিপোর্ট বলছে, প্রথম চিঠিটায় যে আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছিল তা অনিরুদ্ধবাবুর সঙ্গে ম্যাচ করছে।”

“কী উল্টোপাল্টা বকছেন অফিসার?” চিৎকার করে উঠলেন অনিরুদ্ধবাবু। গোটা অফিস যেন হঠাৎ করেই শ্মশানের মতো নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

“দাঁড়ান, দাঁড়ান। আরও বাকি আছে। দ্বিতীয় চিঠিতে আমরা দুটো আঙুলের ছাপ পাই। একটা রুদ্রনীল দাসের সঙ্গে ম্যাচ করছে, আরেকটা অনিরুদ্ধবাবুর সঙ্গে।”

রুদ্রনীলদা আমাদের অফিসের একজন সিনিয়র রিপোর্টার। সবার চোখ বসের থেকে সরে গিয়ে পড়ল তাঁর দিকে। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলেন, “আমি কিচ্ছু করিনি স্যার।”

অফিসার মিত্র বললেন, “দেখুন, আমি শুধু আঙুলের ছাপের কথা বলছি। কে কী করেছে তা সময় বলবে।” একটু থেমে আবার শুরু করলেন, “তারপর আসি তৃতীয় মানে আজকের চিঠিটার কথায়। এটাতেও দুটো আঙুলের ছাপ। একটা সুবিনয়ের আরেকটা অনিরুদ্ধবাবুর।”

বুকটা একটু ধক করে উঠলেও এটা আমার কাছে প্রত্যাশিতই ছিল, কারণ কাগজটা প্রিন্ট করে আমিই বসের কাছে দিয়ে এসেছিলাম। হয়তো দ্বিতীয় চিঠির ক্ষেত্রে রুদ্রনীলদার ব্যাপারটাও এরকমই।

“কিন্তু অফিসার, আমি সত্যিই...” কিছু একটা বলতে গিয়েও যেন থেমে গেলেন অনিরুদ্ধবাবু।

একটু হাসলেন অফিসার মিত্র। “আচ্ছা অনিরুদ্ধবাবু, যদি কিছু মনে না করেন তবে অফিসটা আর স্পেশালি আপনার কেবিনটা একটু সার্চ করা যেতে পারে কি? মানে আমাদের কাছে আপাতত ওয়ারেন্ট নেই, তাই আইনত আপনি অনুমতি না দিলে করতে পারব না।”

“করুন।” অনিরুদ্ধবাবুর গলাটা কেমন যেন অবশ শোনাচ্ছিল।

পুলিশের একজনকে সঙ্গে নিয়ে সোজা অনিরুদ্ধবাবুর কেবিনে গিয়ে ঢুকলেন অফিসার মিত্র। আমার ইচ্ছে করছিল গিয়ে দেখি--- রিপোর্টার হিসেবে নয়, আসলে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিবশতই হচ্ছিল ইচ্ছেটা। কিন্তু ওই মুহূর্তে আমি নিজেও একজন সাস্পেক্ট! অগত্যা অফিসের আর বাকি সবার মতো নিজের জায়গায় মূর্তি হয়েই বসে রইলাম।

প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিট ধরে কেবিনের আবছা কাচে দুটো ছায়ার ক্ষিপ্র নড়াচড়া দেখবার পর হঠাৎ একটা ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম সবাই। অফিসার মিত্রের গলা। পরিমলদা, আশীষ, পারমিতাদি আরও কয়েকজন ছুটে গেল কেবিনের দিকে ব্যাপারটা কী দেখার জন্যে। আমিও আর কৌতূহল চাপতে না পেরে উঠে গিয়ে সেখানে দাঁড়ালাম।

অফিসার মিত্রের হাতে একটা ডায়েরি। কড়া গলায় অনিরুদ্ধবাবুর দিকে তাকিয়ে বলে চলেছেন, “খুনগুলো যদি আপনি না করে থাকেন তবে এটা কী মিস্টার মুখার্জি? ডায়েরির প্রথম পাতায় বৈভব দত্ত লেখা আর ভেতরে প্রতিটা খুনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ। কোথা থেকে এল অনিরুদ্ধবাবু?”

“আমি কিচ্ছু জানি না স্যার। এই ডায়েরি আমার নয়, বিশ্বাস করুন।”

“সরি মিস্টার মুখার্জি, আপনাকে আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে।” কথাটা বলেই হনহন করে বেরিয়ে এলেন অফিসার মিত্র। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “সুবিনয় আর রুদ্রনীলবাবুকেও একটু আসতে হবে আমাদের সঙ্গে। আপনাদের খানিকটা ব্লাড স্যাম্পল লাগবে। আর অফিসের বাকিদের বলছি, আমাদের না জানিয়ে কেউ শহর ছেড়ে বাইরে যাবেন না।”

“ব্লাড স্যাম্পল কেন স্যার?” আমিই জিগ্যেস করলাম।

“তোমাকে বলেছিলাম না, দ্বিতীয় লাশটার পাশে একটা মোক্ষম জিনিস পেয়েছিলাম। একটা রক্তলাগা টিস্যু পেপার পড়েছিল। তাতে দু’জনের রক্ত পাওয়া গেছিল, একটা ভিকটিমের মানে শিপ্রা চৌধুরীর হাজবেন্ডের আর দ্বিতীয়টা খুব সম্ভবত খুনির মানে ওই বৈভব দত্তের। এটাও যদি তোমাদের বসের সঙ্গে মিলে যায় তবে এঁকে বাঁচানোর সাধ্য কোনও উকিলের বাবারও নেই!”

“কিন্তু আমাদের...”

“হ্যাঁ, তোমাদেরটাও নিতে হবে। যেহেতু তোমাদের আঙুলের ছাপও পাওয়া গেছে তাই তোমরাও সন্দেহের বাইরে নও। তবে এই ডায়েরিটা... অনিরুদ্ধ মুখার্জি ইজ ইন এ বিগ ট্রাবল।”

আর দাঁড়ালেন না অফিসার মিত্র, ডায়েরিটা হাতে নিয়ে সোজা বেরিয়ে গেলেন। পেছন পেছন পুলিশের একজন লোক অনিরুদ্ধবাবুকে নিয়ে চলল, আর তার পেছনে আমি আর রুদ্রনীলদাও।

অফিসের ভেতর থেকে একগাদা থমথমে মুখ আমাদের দিকেই তাকিয়েছিল। একটা ঝড় যেন হঠাৎ করেই নিউজ আজকালের পুরো অফিসটাকে একঝটকায় তছনছ করে চলে গেল। সব থেমে গেল একমুহূর্তে।

(১০)

ডায়েরির বাকি পাতাগুলো ফাঁকা--- সেটাই স্বাভাবিক। অনিরুদ্ধবাবুর কেবিনের একটা আলমারি থেকে পুলিশ এই ডায়েরিটা পেয়েছিল। বৈভব দত্তের ডায়েরি! হাসপাতালের সেই গার্ড অবধি প্রতিটা খুনের সুস্পষ্ট বিবরণ লেখা। আর তারপর শুধু অনেকগুলো সাদা পাতা--- শূন্যতা।

 

হপ্তা দেড়েক পর হঠাৎ একদিন বিকেল নাগাদ অফিসার মিত্র ফোন করলেন। সেদিন থানায় আমাদের তিনজনকে নিয়ে যাওয়া হলেও আমাকে আর রুদ্রনীলদাকে শুধু ব্লাড স্যাম্পল নিয়েই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। যদিও অফিসার মিত্র বলে দিয়েছিলেন যে যেকোনও সময় ডাকলে থানায় হাজির হতে হবে আমাদেরও, অন্তত যতদিন সবকিছু না মিটে যাচ্ছে। কিন্তু অনিরুদ্ধবাবুকে তখনই অ্যারেস্ট করেছিল পুলিশ। জামিন-অযোগ্য ধারা।

আমাদের চ্যানেলের কাজকর্মও সেদিন থেকেই বন্ধ। অনিরুদ্ধবাবু গ্রেপ্তার হবার সঙ্গে সঙ্গেই চ্যানেলের শেয়ার পড়ে গেছে, এইমুহূর্তে সত্যি বলতে গেলে নিউজ আজকালের লালবাতি-অবস্থা! স্টাফরাও প্রায় সব এখন বাড়িতে বসে। কেউ কেউ তো শুনলাম এর মধ্যেই নতুন কাজ খুঁজতে শুরু করে দিয়েছে। আমার অবশ্য আপাতত হাতে কোনও কাজ নেই, শুধু অপেক্ষা করছি কোনও একটা নতুন খবরের--- ভালো না খারাপ জানি না! খবর খুঁজতে খুঁজতে নিজেই একটা খবরের জালে এমনভাবে জড়িয়ে গেছি যে এখন শুধুই খবরের অপেক্ষা! অনিরুদ্ধবাবু যদি ফিরে এসে আবার চ্যানেলের কাজ শুরু করেন তবুও কতদূর আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন, কে জানে। আর ক’জন স্টাফই বা আবার আগের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে সেই অফিসে কাজ করতে পারবেন তাও জানি না। হয়তো প্রতিমুহূর্তে মনে হবে চারপাশে একটা অদৃশ্য কালো ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে--- কিংবা বৈভব দত্ত!

ফোনটা তুললাম--- “হ্যালো।”

“সুবিনয়, একবার একটু আমার অফিসে আসতে পারবে?”

“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কিন্তু মানে...কিছু...”

“না না, তেমন কিছু না। এমনই একটু কথা ছিল।”

“আচ্ছা, আসছি আমি।”

ভেতর ভেতর যে রক্তচাপ খানিকটা বেড়ে গেছে, ভালোই টের পাচ্ছিলাম। আমার বাড়ি থেকে সি.আই.ডি হেডকোয়ার্টার্স পৌঁছতে মিনিট চল্লিশেক লাগল। অফিসার মিত্রের রুম আমার চেনা, আগেও এসেছি। বাইরে প্রেসের আইকার্ড দেখিয়ে সোজা ওঁর দরজায় গিয়ে নক করলাম। “আসতে পারি স্যার?”

“ওহ, সুবিনয়। হ্যাঁ, এসো এসো।”

গিয়ে বসলাম টেবিলের সামনে রাখা একটা চেয়ারে। ওপাশে নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন অফিসার মিত্র। আমিই আস্তে করে জিগ্যেস করলাম, “কিছু পেলেন?”

“হুম।” একটু যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন তিনি। “ডি.এন.এ টেস্টের রিপোর্ট এল ঘন্টাখানেক আগেই। ওই টিস্যু পেপারে লাগা একটা রক্তের ডি.এন.এ তোমাদের বসের সঙ্গে ম্যাচ করছে। অতএব তুমি আর ওই কী যেন নাম ভদ্রলোকের--- রুদ্রনীলবাবু, আপাতত নিশ্চিন্ত।”

“মানে অনিরুদ্ধবাবুই সেই বৈভব দত্ত?”

“প্রমাণ তো তাই বলছে সুবিনয়।”

“কিন্তু এমন একজন সাকসেসফুল মানুষ হঠাৎ এরকম একটা সাইকো হয়ে উঠল কেন?”

“জানি না। তবে দুটো জিনিস মনের মধ্যে বড় খচখচ করছে।”

আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম অফিসার মিত্রের দিকে।

“প্রথম সম্ভাবনাটা হল অনিরুদ্ধ মুখার্জি সাইকো নয়। ওর টার্গেট ছিল দ্বিতীয় ব্যক্তি, মানে শিপ্রা চৌধুরীর হাজবেন্ড ড. রণতোষ সেন। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাকে একটা সাইকো-কিলিং এর রূপ দেবার জন্যে বাকি খুনগুলো করা, যাতে সন্দেহের তির সহজে ওর দিকে না ঘোরে। আর যদি কোনও কারণে ধরা পড়েও যায় তাহলে যাতে আদালতে নিজেকে মানসিক রোগী সাব্যস্ত করে অন্তত ফাঁসির হাত থেকে বেঁচে যায়।”

“কিন্তু রণতোষ সেনকে অনিরুদ্ধবাবু কেন মারতে চাইবেন?”

“একটা কারণ তো শিপ্রা চৌধুরী হতেই পারেন। এদিক-ওদিক থেকে কিছু কথা আমার কানে এসেছে যে এই শিপ্রা চৌধুরীর ওপর অনিরুদ্ধবাবুর একটু নজর ছিল।”

“কে, পরিমলদা বলেছে?” হঠাৎ যেন একটু উত্তেজিতই হয়ে পড়েছিলাম। ভেতরে কিছু একটা দপ করে জ্বলে উঠেছিল শিপ্রার ব্যাপারে এই গুজবগুলো শুনে।

আমার গলার স্বরে খানিকটা অবাক চোখে তাকালেন অফিসার মিত্র। বললেন, “হ্যাঁ। তুমি কিছু জানো নাকি এব্যাপারে?”

এবার সামলে নিয়ে বললাম, “আমার যতদূর মনে হয় এগুলো শুধুই বানানো অফিস-গসিপ। শিপ্রা এধরণের মেয়ে নয়।”

একটু সময় চুপ করে রইলেন অফিসার মিত্র। তারপর বললেন, “হুম, সে হতেই পারে। কিন্তু আমাদের তো সব সম্ভাবনাই নজরে রাখতে হয়।” কিছুক্ষণ থেমে আবার বলতে লাগলেন, “যাই হোক, এটা তো গেল একটা পসিবিলিটি। এবার দ্বিতীয় যেই ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে, সেটা হল হয়তো অনিরুদ্ধ মুখার্জি সত্যি কথাই বলছে। সে নির্দোষ।”

“তাহলে...”

“তাহলে আঙুলের ছাপ, টিস্যু পেপারে রক্ত এসব এল কী করে, এই তো?”

“হ্যাঁ!”

“এই উত্তরটাই তো নেই আমার কাছে সুবিনয়। কিন্তু একবার ভেবে দেখ, প্রতিটা খুনের সঙ্গে কী সুন্দরভাবে প্রমাণগুলো ছড়ানো। যেন কেউ ইচ্ছে করেই সাজিয়ে রেখেছিল আমাদের জন্যে। ছুরির হাতলে, লাশে কোথাও খুনির আঙুলের ছাপ নেই শুধু চিঠিতে! আর তোমার কি মনে হয় যে অনিরুদ্ধ মুখার্জির মতো ধারালো মাথার লোক এমন কাঁচা কাজ করবে?”

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। “হুম, হয়তো ঠিকই বলছেন আপনি। কিন্তু...”

“ওই কিন্তুতেই তো আটকে গেছি ভায়া। সব প্রমাণ লোকটার বিরুদ্ধে। হাজতে তো আর এমনি এমনি বসিয়ে রাখতে পারব না, কোর্টে অলরেডি কেস উঠে গেছে। প্রমাণ আমাকে পেশ করতেই হবে। তবে সুবিনয়, তদন্তটা আমি চালিয়ে যাব। যদি সত্যিই অনিরুদ্ধ মুখার্জি নির্দোষ হয় তবে অকারণে ওকে মরতে দেব না আমি।”

বেশ খানিকটা সময় দু’পক্ষই চুপচাপ বসে রইলাম। একটা অস্বস্তিকর নীরবতা। অফিসার মিত্র আস্তে আস্তে বললেন, “তুমি এই কেসে একটা বিশাল সাহায্য করেছ, চিঠিটা তুমি চিনতে না পারলে হয়তো এখনও অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতাম আমরা।”

ম্লান হাসলাম আমি। বুঝতে পারছিলাম, অফিসার মিত্র নিজেই ভেতরে ভেতরে একটা গভীর দ্বন্দ্বে ভুগছেন, কিন্তু এখানে কারও কিছু করার নেই। অফিসার মিত্রেরও না। আরও মিনিট দুয়েক কথা খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করার পর বললাম, “এখন তাহলে উঠি স্যার?”

“হ্যাঁ। কখনও দরকার পড়লে আবার যোগাযোগ করব। আর জার্নালিজমে যদি থাকো তাহলে মোলাকাত তো হবেই।”

“শিওর।” হাসতে-না-চাওয়া হাসিটাকে আরেকটু চওড়া করে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। অনিরুদ্ধবাবু জেলে--- চ্যানেলে অচিরেই পাকাপাকিভাবে তালা ঝুলবে যদি অন্য কোনও সংস্থা অনিরুদ্ধবাবুর কাছ থেকে মালিকানা কিনে না নেয়। সেক্ষেত্রেও কাকে রাখবে কাকে ফেলবে, সে কেউ জানে না।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গন্তব্যহীন এক রাস্তার মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম। কোথায় যাব নিজেই জানি না! একবার শিপ্রার বাড়ি গেলে কেমন হয়?

(১১)

তদন্তটা চালিয়ে গেছিলেন অফিসার মিত্র। কিন্তু প্রায় তিন বছর ধরে অনেক খোঁজাখুঁজি আর আদালতের অনেক তারিখ পেরিয়ে যাবার পরেও অনিরুদ্ধবাবুর সপক্ষে কোনও প্রমাণই জোগাড় করতে পারলেন না। আঙুলের ছাপ, ডি.এন.এ রিপোর্ট থেকে শুরু করে তাঁর আলমারি থেকে পাওয়া এই ডায়েরি, এ-সবকিছুই অনিরুদ্ধ মুখার্জির বিপক্ষে একেকটা মারণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সব প্রমাণ এটাই বলছিল যে উনিই বৈভব দত্ত--- সেই সাইকো খুনি যে নৃশংসভাবে তিন-তিনটে লোককে খুন করেছিল।

একসময় অফিসার মিত্রও হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। অনিরুদ্ধবাবুর টাকার অভাব ছিল না, তাই কেসটা সুপ্রিমকোর্ট অবধি উঠেছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। জেলা আদালত যে রায় দিয়েছিল, সেটাই বহাল রইল--- মৃত্যুদণ্ড। অনিরুদ্ধবাবুর উকিল ওঁকে মানসিকভাবে অসুস্থ প্রমাণ করারও অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মেডিক্যাল রিপোর্ট বলল তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। এই কেস অনেকদিন ধরে পাবলিকের কাছে একটা দারুণ খোরাক ছিল; প্রতিটা শুনানিতে আদালতের বাইরে বেনামি খবরের কাগজ থেকে শুরু করে জায়েন্ট মিডিয়া হাউসগুলো অবধি হুমড়ি খেয়ে পড়ত। বাংলার বেশ কিছু নিউজ চ্যানেলে তো প্রথম প্রথম রীতিমত বিতর্কসভা বসানো হয়েছিল এই ব্যাপারটা নিয়ে--- টি.আর.পি একেবারে তুঙ্গে।

গতবছর ফেব্রুয়ারি নাগাদ সুপ্রিমকোর্টের রায়ে অনিরুদ্ধ মুখার্জিকে ফাঁসি দেওয়া হল। খবরের কাগজেই পড়েছিলাম।

আমার জীবনেও অনেককিছু পাল্টে গেছে। অনিরুদ্ধবাবু গ্রেপ্তার হবার পর থেকে সেই যে নিউজ আজকাল বন্ধ হয়ে গেছিল, আর খোলেনি। কিছুদিন অপেক্ষা করে সবাই যে যার মতো এদিক-সেদিক কাজের চেষ্টায় লেগে পড়ল। বেশিরভাগ স্টাফই অন্য নিউজ চ্যানেল বা নামি প্রিন্ট মিডিয়াতে ঢুকে গেল, আমি কিছুদিন সিনেমা-সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লিখে কাটালাম। নেট ক্লিয়ার করা ছিল, বছর দেড়েক আগে কলেজের চাকরিটা জুটে গেল--- সরকারি চাকরি, একটু বোরিং, তবু সরকারি তো!

আর শিপ্রা? সে এখন একটা ব্যাংকে চাকরি করে। আগামী মাসের শুরুতেই আমাদের বিয়ে। চ্যানেলটা বন্ধ হয়ে গেছিল ঠিকই কিন্তু দু’জনের মধ্যেকার দূরত্বটা একটু একটু করে আরও কমে এসেছিল এই ক’টা বছরে। কলেজজীবনের না-বলা কথাগুলো হয়তো আজও বলা হয়নি, তবু সম্পর্কটা কেমন করে যেন নিঃশব্দেই গড়ে উঠেছে।

সুন্দর চলছিল সবকিছু, ঠিক একটা সিনেমার গল্পের মতো। কিন্তু আজ সকালে কাগজের প্রথম পাতায় একটা খবর চোখে পড়তেই মনে হল হঠাৎ স্বপ্নের মতো সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। খুব গভীরে কোথাও একটা যেন চিড় ধরল। অফিসার মিত্র গতরাতে আত্মহত্যা করেছেন।

মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন প্রায় দু’মাস ধরেই, আর তার কারণটাও আমার অজানা ছিল না। কিন্তু তাঁর শেষ পরিণতি যে এটা হতে পারে, কখনও ভাবতেই পারিনি। আসলে বৈভব দত্তের কাহিনিটা হয়তো অনিরুদ্ধবাবুর ফাঁসির সঙ্গেই শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু কিছু কাহিনি থাকে অনেকটা রক্তবীজের মতো--- যেখানে শেষ হয় সেখান থেকেই আবার নতুন করে শুরু!

সত্যি বলতে গেলে মাস তিনেক আগে অফিসার মিত্রের ফোন পেয়ে একটু অবাকই হয়েছিলাম। অনিরুদ্ধবাবু গ্রেপ্তার হবার পর কয়েকবার আদালতে বয়ান দেবার জন্যে যেতে হয়েছিল, তা ছাড়া এত বছরে আর অফিসার মিত্রের সঙ্গে কোনও দেখাসাক্ষাৎ বা যোগাযোগ হয়নি।

ফোনটা রিসিভ করলাম। ওপার থেকে তাঁর গলা ভেসে এল, “সুবিনয়, ভালো আছ?” কথার সুরে খুব ক্লান্ত লাগছিল তাঁকে।

বললাম, “হ্যাঁ স্যার। আপনি?”

কোনও জবাব না দিয়ে তিনি বললেন, “যদি ব্যস্ত না থাকো, তাহলে একবার আসতে পারবে?”

“হ্যাঁ, আসছি। কিন্তু আপনার গলাটা এমন...”, কথাটা আর শেষ করতে পারলাম না, ফোনটা কেটে দিলেন অফিসার মিত্র।

 

তাঁর অফিসে গিয়ে যখন ঢুকলাম, সত্যিই কেমন যেন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। জিগ্যেস করলাম, “স্যার, আপনার শরীর ঠিক আছে তো?”

কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মতো অফিসার মিত্র বলে উঠলেন, “তোমার বৈভবের শেষ চিঠিটা মনে আছে সুবিনয়? সে বলেছিল, চতুর্থ খুনটা সে করবে না তবু খুনটা কিন্তু হবে।”

“হ্যাঁ, কিন্তু...”

“আমি হেরে গেছি সুবিনয়। আমার জন্যেই অনিরুদ্ধ মুখার্জির ফাঁসি হল। সে নির্দোষ ছিল। চতুর্থ খুনটা বৈভব আমার হাত দিয়েই করালো।”

“কী বলছেন স্যার? কিন্তু কীভাবে?”

“এটা খেয়াল আছে?” বৈভব দত্তের ডায়েরিটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন অফিসার মিত্র।

“হ্যাঁ, এটা সেই ডায়েরিটাই যেটা অনিরুদ্ধবাবুর আলমারি থেকে পাওয়া গেছিল।”

“সব উত্তর এটাতেই লুকোনো ছিল, কিন্তু আমি ধরতে পারিনি। যখন পারলাম, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।” শেষের কথাগুলো কেমন হাহাকারের মতো শোনাল। অফিসার মিত্র যেন আচ্ছন্নের মতো বলে চললেন, “অনিরুদ্ধের ফাঁসি হয়ে যাবার পরেও এই কেসটা নিজের মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না, হিসেবগুলো মিলছিল না কিছুতেই। কাল এভিডেন্সগুলো আবার ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎ এই ডায়েরিটার কথা মনে পড়ল, রাতেই নিয়ে বসলাম। শুরু থেকে পুরোটা পড়ছিলাম আবার, যদি কোনও ক্ল্যু পাওয়া যায়, আর তখনই হঠাৎ মনে হল পেছনদিকে মলাটের একটা জায়গা যেন একটু অসমান ঠেকছে।

“ডায়েরির পেছনে মলাটের ভেতর কিছু একটা ছিল। ছুরি দিয়ে ওপরের পাতলা কাগজটা চিরতেই একটা চিরকুট বেরিয়ে এল; তাতে লেখা, ‘অস্পষ্ট অক্ষরের মধ্যেও অনেক স্পষ্ট কথা লুকিয়ে থাকে ইনসপেক্টর সাহেব।’

“চমকে উঠলাম। মাথার ভেতর যেন বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। পাগলের মতো ছুটে গিয়ে পুলিশ-ফাইল থেকে ওই তিনটে চিঠি নিয়ে এলাম। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, চিঠিগুলোর পেছনে প্রিন্টগুলো আবছা ছিল; আমরা ফেলে দেওয়া প্রিন্টের কাগজ বলেই ধরে নিয়েছিলাম, অথচ সেখানেই সব লিখে রেখেছিল সেই বৈভব দত্ত। সে একটা বিরাট খেলা খেলেছিল আমাদের সঙ্গে। এই ডায়েরিতেই লুকিয়ে রেখেছিল এমন একটা সূত্র যা অনায়াসে কেসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারত, কিন্তু সময় থাকতে জিনিসটা খুঁজে পেলাম না। একটা নির্দোষ লোক শুধু আমার অকর্মণ্যতার কারণে ফাঁসিতে ঝুলে গেল!”

“কী লেখা ছিল সেই চিঠিতে?”

আমার প্রশ্নটা অফিসার মিত্র আদৌ শুনতে পেলেন কিনা জানি না; আগের মতোই শূন্য দৃষ্টিতে বলতে লাগলেন, “চিঠিগুলো নিয়ে বসলাম। পেছনের সেই আবছা লেখাগুলোর মধ্যে সত্যিই কিছু কিছু অক্ষর একটু গাঢ় কালিতে ছাপা ছিল। মাথাটা কেমন ঝিনঝিন করছিল আমার।

“চিঠিগুলো থেকে এক এক করে সেই স্পষ্ট অক্ষরগুলো বেছে নিয়ে একটা কাগজে লিখে সাজালাম। একেকটা শব্দ গড়ে উঠল, শব্দ থেকে লাইন--- একটা সম্পূর্ণ চিঠি! বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়--- ‘নমস্কার, আমি বৈভব দত্ত। তবে এটা যে আমার আসল নাম নয়, সে তো আপনারা এতদিনে বুঝেই গেছেন। অনিরুদ্ধ মুখার্জি নির্দোষ, কিন্তু সে-ই ছিল আমার চতুর্থ শিকার। আমার হয়ে কাজটা আপনারা করে দিলেন; ধন্যবাদ।

‘হয়তো এতক্ষণে আপনার সব হিসেব গুলিয়ে গেছে, তাই না? তাহলে খুলে বলি--- অনিরুদ্ধ মুখার্জির কেবিনের পেপার বাস্কেট থেকে ফেলে দেওয়া কাগজ, যাতে ওর আঙুলের ছাপ আছে, সেটা জোগাড় করা আমার পক্ষে কোনও কঠিন কাজ ছিল না। রক্ত-লাগা টিস্যু পেপারটাও ওভাবেই পাওয়া। পেপার নাইফ লেগে আঙুল কেটে গেছিল অনিরুদ্ধ মুখার্জির। ওর আলমারিতে ডায়েরিটাও আমিই রেখেছিলাম। আশা করি এটুকু তো নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে আমি ওই অফিসেরই একজন--- কিন্তু আপাতত আপনার ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনিরুদ্ধ মুখার্জির সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা নেই, আসলেই আমি চারটে খুনের একটা খেলা খেলছিলাম। কিন্তু চতুর্থ খুনটা আপনাদের দিয়ে করাতে হলে কাউকে না কাউকে তো বৈভব দত্ত সাজাতেই হতো, তাই অনিরুদ্ধ মুখার্জিকেই বেছে নিলাম। অন্য কেউও হতে পারত, কিন্তু অনিরুদ্ধ মুখার্জির ভাগ্যটা বোধহয় একটু খারাপ ছিল।

‘যাই হোক, এই চিঠি যদি আপনি অনিরুদ্ধ মুখার্জির ফাঁসির আগে পেয়ে যান তাহলে আপনি জিতলেন আর যদি ফাঁসির পরে পান বা কখনও না পান তাহলে আমি জিতলাম। খেলাটা ভালোই জমেছে, কী বলেন!’ “

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো চুপ করে রইলেন অফিসার মিত্র। তারপর কেমন যেন একটা করুণ দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে; গলাটা কেঁপে উঠল। “বৈভব দত্ত জিতে গেল সুবিনয়, আমিই হেরে গেলাম।”

সেই মুহূর্তে আমি কী বলব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অফিসার মিত্র অবশ হাতে ডায়েরি আর চিঠিগুলো আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, “নিয়ে যাও, এগুলো। ফেলে দাও, যেখানে খুশি নিয়ে ফেলে দাও।”

“কিন্তু স্যার...”

শেষ করতে পারলাম না, অফিসার মিত্র হঠাৎ বিড়বিড় করতে করতে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তারপরও বেশ কিছুক্ষণ বসেছিলাম আমি। শেষে শুধু এই ডায়েরিটা সঙ্গে নিয়ে চলে আসি; চিঠিগুলো সেখানেই পড়েছিল।

 

তারপর তিনটে মাস পেরিয়ে গেল। ডায়েরিটা এতদিন আমার আলমারিতেই রাখা ছিল, কিন্তু আজ সকালে অফিসার মিত্রের আত্মহত্যার খবরটা দেখার পর কেন জানি না এই ডায়েরিটা নিয়ে বসলাম আবার। হয়তো প্রতিটা পাতায় আবার খুঁজে দেখতে চাইছিলাম সেই বৈভব দত্তকে--- যে পাঁচ বছর আগে হঠাৎ একটা ঝড়ো হাওয়ার মতো এসে ছড়িয়ে পড়েছিল আমার আর আরও অনেকের জীবনে--- নাড়িয়ে দিয়ে গেছিল সবকিছু।

আচ্ছা, বৈভব তো বলেছিল সে ঠিক চারটে খুন করবে, বেশিও না কমও না। ঠিক চারটে খুনের একটা খেলা। তাহলে অফিসার মিত্রের মৃত্যুটা--- তার জন্যেও তো পরোক্ষভাবে বৈভবই দায়ী। কিন্তু খেলাটা তো ছিল কেবল চারটে খুনের! বৈভব কি তবে জিতল না হারল?

একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। ঘড়িতে এখন সন্ধে সাতটা। কিছুক্ষণ পরে শিপ্রা আসবে--- বিয়ের কেনাকাটায় বেরোনোর কথা ছিল আজ। কিন্তু শরীরটা কেমন যেন বড্ড অবশ লাগছে। ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়ালাম আয়নার সামনে। চারপাশে একটা অদ্ভুত আবছায়া। কোনও এক মায়াবী অন্ধকারের আবেশে যেন থমকে গেছে সময়। আয়নার ওপারে একটু একটু করে একটা ধূসর কুয়াশা ঘনিয়ে উঠছিল। ঘরের আলো-আঁধারিতে কেমন একটা মৃত্যুশীতল হাহাকার--- কিংবা হয়তো বিদ্রূপের অট্টহাসি! স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি চারপাশ থেকে কারা যেন হাসছে। বৈভব দত্ত হেরে গেছিল--- জীবনে প্রথমবার।

আয়নাটার দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম। ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার ঠোঁটে কেমন একটা বাঁকা হাসি। আমি চিনি, চিনি আমি ওকে--- বৈভব দত্ত! ওইতো ওর হাতে আস্তে আস্তে উঠে আসছে আট ইঞ্চির ধারালো ছুরিটা। আমার গলার দিকে এগিয়ে আসছে ওর হাত। অদ্ভুত একটা মাদক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে আমার শিরায় শিরায়--- গরম, লাল রক্তের মতো।

বৈভব দত্ত কখনও হারতে পারে না।