উত্তম পুরুষ - সায়ন্তনী পলমল ঘোষ

রহস্য উপন্যাস

অলংকরণ - মিশন মন্ডল

আজ অমাবস্যা। আমার অমাবস্যা একদম ভালো লাগে না। আকাশটা কেমন কালো চাদর পেতে শুয়ে যায়! আমি ভালোবাসি চাঁদ। পূর্ণিমার দিন যখন আকাশের গোল থালার মত চাঁদটা থেকে জ্যোৎস্না চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে তখন আমি মাদুর পেতে ছাদের ওপর শুয়ে জ্যোৎস্না মাখি আর, আর তার কথা ভাবি। আমার নীলাঞ্জনের কথা। ওর আসল নাম নীলাঞ্জন নয়। এই নামটা আমার দেওয়া। আমার ভালোবাসার নাম। একান্ত গোপনে ওকে এই নামে ডাকতাম আমি। নীল রং আমার ভীষণ প্রিয়। এখন সবই অতীত হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ভীষণ ইচ্ছে করে আকাশের ওই পূর্ণিমার চাঁদটাকে সাক্ষী রেখে দুজনে দুজনের ওম নিতে নিতে; যদি পরস্পরের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতাম বেশ হত। কেউ কোনও দিন আমাদের আলাদা করতে পারত না। আমি ওকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি। ভালোবাসার মাপ তো বলে বোঝানো যায় না তাই আমিও বলতে পারব না কিন্তু এটুকু জানি এই বুকটায় যতটা ধরে ঠিক ততটাই ভালোবাসি। একটুও কম নয়। কতদিন হয়ে গেল ওকে দেখিনি। ভীষণ ভীষণ কষ্ট হয় আমার। জানি কেউ বিশ্বাস করবে না কিন্তু এটাই সত্যি ওই পঙ্গু মানুষটার জন্যই আমার আমার রাতের বালিশে বৃষ্টি নামে। আমার বুকে ধস নামে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আমি তোমাকে এক পৃথিবী ভালোবাসি। জানি সেও খুব কষ্টে আছে। আমায় ছেড়ে সে ভালো থাকতে পারে না। আমি এও জানি আমার গায়ে ছিটিয়ে দেওয়া কালির দাগগুলো ওর মনে অন্ধকার সৃষ্টি করতে পারেনি। ওর মনে আজও আমার জন্য প্রদীপ জ্বলে, কিন্তু ও নিরুপায়। ওর কিচ্ছু করার নেই।

***

পৌঁছে গেছি। এমনিতে আমার অমাবস্যা পছন্দ নয় ঠিকই কিন্তু আজ এই অপছন্দের রাতটাই আমাকে সাহায্য করবে। আমার সামনে এখন “শেষের কবিতা”। বাড়ীর পেছন দিকে আমি দাঁড়িয়ে আছি। এই বাড়িতে ঢোকার প্রতিটা রাস্তা আমার চেনা। পেছনের ছোট গেট দিয়ে ঢুকে পড়লাম আমি। এবাড়ীর কোনও গেটেই তালা থাকে না। বাড়িটার বয়স প্রায় পঞ্চাশ। পেছনের এই দরজার একটা ছিটকিনি নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যটা পাশের জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে সহজেই খুলে ফেলা যায়। ভেতরে ঢুকে পা টিপে টিপে দোতলায় উঠে এলাম। এসে দাঁড়ালাম বহু পরিচিত সেই ঘরটার সামনে। দরজাটা ঠেলে বুঝলাম ভেজানো আছে। বন্ধ থাকার তো কথা নয়। এই দরজা আমার জন্য চিরদিন খোলা আমি জানি। আস্তে করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম আমি। হালকা নীলচে আলো ছড়িয়ে আছে ঘরময়। মানুষটা একাই শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ঘরের একধারে হুইলচেয়ারটা রাখা। খাটের পাশে দুখানা ক্র্যাচ দাঁড় করানো আছে। ব্যাগ থেকে ক্লোরোফর্মের বোতলটা বের করে রুমালে ঢেলে নাকে চেপে ধরলাম। প্রথমে একটু ছটফট করে উঠলো তারপর শান্ত হয়ে গেল। আসলে আমি ওকে মৃত্যু যন্ত্রণার ভয়াবহ অনুভূতি অনুভব করাতে চাই না। আমি যে ওকে ভীষণ ভালোবাসি। ভালোবাসার মানুষকে কষ্ট দিতে কারই বা ভালো লাগে! নাহলে একটা পঙ্গু মানুষকে কব্জা করা কি খুব শক্ত কাজ? খাটের ছত্রীতে রাখা বড় তোয়ালেটা গায়ে জড়িয়ে নিলাম। জামাকাপড়ে রক্তের দাগ আমার একটুও পছন্দ নয়। ছুরির অগ্রভাগটা গভীরভাবে ঢুকে যাচ্ছে ওর গলায়। খুব যত্ন নিয়ে আমি ওর কণ্ঠনালিটা দুফাঁক করলাম। রক্তের ধারা সাদা বিছানার চাদরটাকে রঙ্গিন করে তুলছে। মানুষটার মুখের দিকে তাকালাম। নাহ, মৃত্যু যন্ত্রণার কোনও চিহ্ন নেই সেখানে। আমার ঠোঁট দুটো ওর কপালে একবার ছুঁইয়ে দিলাম। বড় ভালোবাসি যে। তারপর ওর বুকের ওপর আমার চিহ্ন রেখে বেরিয়ে এলাম ঘর ছেড়ে। মানুষটা একাই রইল, একদম একা।

***

দোতলা ছেড়ে নেমে এলাম নীচের তলায়। সিঁড়ির নীচে সবসময়ের কাজের লোক কমলার ঘরের দরজাটা আগেই আমি অতি সন্তর্পণে আটকে দিয়েছিলাম তাই আমি ভারী নিশ্চিন্তে নিজের লক্ষ্য পূরণের পথে এগিয়ে চলেছি। এবার আমি এসে দাঁড়ালাম একেবারে উত্তর দিকের বড় ঘরটার সামনে। এই ঘরের দরজাও ভেজানো ছিল। দরজা ঠেলে নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। খাটের ওপর শায়িত মানুষটির যা বয়স তাতে ঈশ্বরের কৃপা থাকলে এতদিনে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরপারে যাত্রা করতেই পারতেন কিন্তু দুর্ভাগ্য নিয়তি ওনার ললাটে লিখে রেখেছে চরম যন্ত্রণাময় মৃত্যু। নাইট ল্যাম্পের লালচে আলোয় শেষবারের মতো দেখলাম মানুষটাকে। নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে, জানেও না কী ভয়ানক মৃত্যু ওর জন্য প্রতীক্ষারত। ঘৃণা, চরম ঘৃণা উথলে উঠলো ভেতর থেকে। বিছানায় অতিরিক্ত যে বালিশটা ছিল সেটা তুলে নিলাম। চিত হয়ে থাকা বৃদ্ধ মানুষটার মুখে চেপে ধরলাম বালিশটা। পা ছুঁড়ছে, মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে কিন্তু অশীতিপর একজন বৃদ্ধের শরীরে কতই বা জোর আছে যে সাক্ষাৎ মৃত্যুর সঙ্গে ঝুঝবে। কিছুক্ষণের মধ্যে সব শান্ত হয়ে গেল। বালিশটা ছুঁড়ে ফেলে ছুরিটা বের করলাম। ওর বেঁচে থাকার নূন্যতম সুযোগটাও আমি রাখতে চাই না। সর্ব শক্তি দিয়ে ছুরিটা পেটে ঢুকিয়ে দিলাম। একবার, দুবার, তিনবার…বারবার। আমার মুখে তৃপ্তির হাসি। ক্ষতবিক্ষত পেটটার ওপর ছুঁড়ে দিলাম আমার আগমনের চিহ্ন। বড় শান্তি পেলাম আমি কিন্তু আরেকজন? তার কী মনের অবস্থা হবে?

***

“পৃথা, তুমি গোটা ঘটনাটা নিজের মতো করে বর্ণনা কর তো।” সাব ইন্সপেক্টর পৃথাকে নির্দেশ দেন বিক্রমজিৎ। তাঁর কন্যাসম এই মেয়েটির সাহস এবং বুদ্ধি দুটোর ওপরই তাঁর অগাধ ভরসা।

“স্যার, ‘শেষের কবিতা’ নামের একটি বাড়িতে দুজন খুন হয়েছে। বেশ বড়সড় পাঁচিল ঘেরা দোতলা বাড়ি। ভিক্টিম দুজন মানে অরুণোদয় সেন আর অপলেশ সেন সম্পর্কে বাবা-ছেলে। অরুণোদয়ের বয়স প্রায় আশি, আর অপলেশ গত মাসেই চুয়ান্ন পেরিয়েছিলেন। অপলেশ বিপত্নীক। বহু বছর আগেই ওনার স্ত্রী গত হয়েছেন। ওনার একটিই ছেলে স্বপ্ননীল। এম.বিয়ে কমপ্লিট করেছে। এবার নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করবে এইরকম একটা চিন্তা ভাবনা চলছিল।”

“এক মিনিট পৃথা, ওদের ব্যবসাটা কীসের?”

“সোনার দোকান স্যার। বেশ বড় ব্যবসা।”

“ওকে, ক্যারি অন।”

“বর্তমানে ওই বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন মোট পাঁচজন, অরুণোদয় সেন, তাঁর স্ত্রী সোমলতা সেন, তাঁদের ছেলে অপলেশ সেন, অপলেশের ছেলে স্বপ্ননীল আর সব সময়ের কাজের লোক কমলা। বিধবা কমলা বহু বছর ধরে ওই বাড়িতে আছে। মাঝে মাঝে তার গ্রামের বাড়িতে যায় সেখানে তার মা-বাবা আর ভাইয়ের সংসারের সাথেই তার ছেলে-বৌমাও থাকে। গতকাল রাতে ওই বাড়িতে অরুণোদয় আর অপলেশের সাথে শুধু মাত্র কমলা ছিল। সোমলতা তাঁর মেয়ে-জামাইয়ের সাথে দেওঘর গিয়েছিলেন আর স্বপ্ননীল তার এক বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে গিয়েছিল। সেখানে রাত হয়ে যাওয়ায় কাছেই ওর মাসী ঠাম্মার বাড়িতে মানে সোমলতা দেবীর দিদির বাড়িতে থেকে যায়।” দম নেওয়ার জন্য একটু থামে পৃথা।

“আচ্ছা, পৃথা দুটি খুনই স্ট্যাব করে হয়েছে তাই না?” বিক্রমজিৎ জিগ্যেস করেন।

“তা হয়েছে তবে স্যার, দুটো খুন যেন একরকম নয়।”

“মানে? কী বলতে চাইছ তুমি? ক্লিয়ারলি এক্সপ্লেন কর।”

“মানে স্যার, অপলেশকে খুন করা হয়েছে শুধু মাত্র তার কণ্ঠনালী কেটে আর কিচ্ছু করেনি অপলেশের সাথে কিন্তু অরুণোদয়কে খুন করা হয়েছে নির্মমভাবে। শ্বাসরোধ করা হয়েছে তারপর নৃশংসভাবে কোপানো হয়েছে। আততায়ীর সম্ভবত প্রবল আক্রোশ ছিল অরুণোদয়ের ওপর।”

“দুজনেই যে যার রুমে খুন হয়েছে তাই না?”

“হ্যাঁ, স্যার। আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি, অপলেশ হ্যান্ডিক্যাপড। ক্র্যাচ আর হুইলচেয়ার নিয়ে চলাফেরা করেন। অনেক বছর আগে একটা এক্সিডেন্টের ফলে হাঁটাচলার ক্ষমতা হারান অপলেশ তবে বাকি সব কিছু ঠিকই ছিল। বর্তমানে মূলত অপলেশই ওঁদের ব্যবসা দেখাশোনা করছিলেন।”

“হুম, বুঝলাম। একটা কথা, কমলা কিছুই বুঝতে পারেনি? বাড়িতে দু-দুটো খুন হয়ে গেল!” বিক্রমজিতের কপালে চিন্তার ভাঁজ।

“স্যার, কমলার রুমটা সিঁড়ির নিচে। অপলেশ খুন হয়েছেন দোতলায় আর অরুণোদয় যে রুমে খুন হয়েছেন তার দূরত্বও কমলার রুম থেকে অনেকটাই। তাছাড়া রাত্রিবেলা ঘুমাচ্ছিল তো। আর ওর রুমটা বাইরের দিক থেকে আটকে দিয়েছিল খুনী।”

“হুম।”

“একটা মোস্ট ইম্পরট্যান্ট কথা মিস করে গেছি স্যার।” কাঁচুমাচু মুখ করে বলে পৃথা।

পৃথাকে দেখে হেসে ফেললেন বিক্রমজিৎ,”বল, এখন তো মনে পড়েছে।”

“অপলেশের বুকের ওপর আর অরুণোদয়ের পেটের ওপর একটা করে রুপোর পায়েল রাখা ছিল।”

“পায়েল মানে?”

“স্যার, মেয়েরা পায়ে পরে...।” পৃথাকে কথা শেষ করতে দেন না বিক্রমজিৎ, “আরে, সে আমি জানি কিন্তু হঠাৎ পায়েল কেন? সত্যিই এটা ভীষণ ইম্পরট্যান্ট একটা সূত্র এই কেসে।”

“পায়েলগুলো কিন্তু পুরোনো স্যার।”

“পুরোনো পায়েল!”

“একটা জিনিস খেয়াল করেছ পৃথা?”

“কী স্যার?”

“আততায়ী কত সহজে বাড়িতে ঢুকে পড়েছে।” সেন বাড়ির পেছন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন বিক্রমজিৎ।

“হুম। সে যেন জানত এই দরজাটা এভাবে খুলে যাবে। এবাড়ীর চেনা কেউ কি খুনী?”

“সেটা হওয়ার সম্ভবনাই তো খুব বেশি কারণ কোনও ডাকাতি বা লুটপাটের ঘটনা ঘটেনি অথচ খুব ব্রুটলি মার্ডার করা হয়েছে। কারণ ছাড়া তো কেউ কাউকে খুন করবে না। তাই চেনা হওয়ার সম্ভাবনাই খুব বেশি।”

“যাই বলুন স্যার, একজন সোনা ব্যবসায়ীর বাড়ীর পক্ষে নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই ঢিলেঢালা। সামনে-পিছনে কোনও গেটেই তালা নেই । সামনের গেটে একজন বুড়ো দারোয়ান যাকে একটা থাপ্পড় মারলেই অজ্ঞান হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।”

“সেই সুযোগটাই তো আততায়ী নিয়েছে। এখন চল সবার সঙ্গে কথা বলা যাক। ইন্টারোগেশনের মধ্যে কোনও নতুন তথ্য উঠে আসতে পারে।”

***

একটা ফাঁকা ঘরে বিক্রমজিৎ আর পৃথার মুখোমুখি কমলা, এবাড়ীর সব সময়ের কাজের লোক। জড়সড় হয়ে বসে আছে। স্বভাবতই চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। বয়স প্রায় পঞ্চাশের ওপর।

“কতদিন তুমি এবাড়িতে কাজ করছ?”

“প্রায় তিরিশ বছর।”

“সেদিন তুমি তো বাড়িতে ছিলে?”

“আমি কিছু জানি নি বাবু। আমি কিছু জানি নি। আমি গরীব খেটে খাওয়া মানুষ।” হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো কমলা। এমন যে ঘটবে সেটা আগেই জানতেন বিক্রমজিৎরা। এমন দৃশ্যের সাক্ষী তাঁদের বহুবার হতে হয়। পৃথা কমলার পিঠে হাত রেখে কোমল কণ্ঠে বলল, “কাঁদছ কেন মাসী? আমরা তো তোমায় কোনও দোষ দিচ্ছি না। দেখ সেদিন কী ঘটেছিল সেটা আমাদের জানাবার মত তুমি ছাড়া আর তো কেউ নেই। তুমি আমাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিলে আমাদের খুব সুবিধা হয়। আমাদের তো খুনিকে খুঁজে বের করতে হবে, তাই না?” কমলা কান্না থামিয়ে পৃথার দিকে ভরসার দৃষ্টিতে তাকালো,”আচ্ছা, কী জিগ্যেস করবে কর।” বিক্রমজিৎ প্রশংসার দৃষ্টিতে পৃথার দিকে তাকালেন। মেয়েটার এই একটা মস্ত গুণ প্রয়োজনে রনংদেহী মা চণ্ডিকার রূপ যেমন ধারণ করতে পারে তেমনি আবার কার্যসিদ্ধির জন্য মমতাময়ী মা অন্নপূর্ণাও হতে পারে। কমলাকে ইন্টারোগেশনের ভারটা পৃথার ওপরই ছেড়ে দিলেন বিক্রমজিৎ।

“আচ্ছা মাসী সেদিন সন্ধ্যে থেকে ঠিক কী কী ঘটেছিল মনে করে বল তুমি।” কমলা একটু যেন ভাবলো। তারপর বলতে আরম্ভ করলো,”সেদিন তো গিন্নীমা ছিল নি। সোঁনদাবেলা হরির মা মানে যে রান্না করে সে রান্না করে দিয়ে চলে গেল। তাপ্পর আমি সিরিয়াল দেকচিলাম। নীলু বিকালেই বন্দুর জন্মদিনে চলে গেছল। কত্তাবাবু আর দাদা দকান থেকে এই নটার দিকে ফিরল।” কমলাকে থামিয়ে দিয়ে পৃথা বলল,”অরুণোদয়বাবু দোকানে যেতেন?”

“সব দিন লয়। তবে মাঝে মাঝেই যেতেন। দাদাই যেত সবদিন। এখন নীলুও মাঝে মাঝে দকানে বসে।”

“আচ্ছা, তারপর বল।”

“দাদা আর বাবু চা খেলেন এককাপ করে। তাপ্পর দশটার পর রাতের খাবার খেলেন। আমি দুজনের বিছানা পত্তর ঠিক করে দিলুম। বাবু শুয়ে পড়লেন। একলা থাকলে দরজাটা খুলাই রাখতেন। যাতে কোনও অসুবিদা হলে ফোন করলেই আমরা ঘরে ঢুকতে পারি। দাদা রোজ খাবার পর ওই লাপটপ লিয়ে ব্যবসার কীসব কাজকম্ম করে। দাদা উপরে চলে গেল।”

“অপলেশ বাবু নিজেই ওপরে যেতে পারতেন?”

“হুঁ, ওই ক্যারাচ লিয়ে দাদা নিজেই সবকিছু করত। হুইল চিয়ারটা এমনিই রাখা থাকত। বড় ভালো মানুষ ছিল দাদা।” আঁচলের খুঁটে চোখ মুঝলো কমলা।

“আচ্ছা, মাসী তারপর কী হল?”

“আমি খেয়েদেয়ে বাবুর ঘরে উঁকি দিয়ে দেকলুম বাবু ঘুমি পড়েচে। তাপ্পর দাদার ঘরে গিয়ে দেকলুম দাদা কাজ কচ্চে। দাদার কিছু লাগবে নাকি জিগাস করে আমি এসে ঘুমি গেলুম। তাপ্পর সকাল বেলা দরজা খুলতে না পেরে ধাক্কাধাক্কি চেঁচামেচি কললুম কিন্তু কে খুলবে মানুষ দুটা তো তখন…। আমি দাদার ফোনে, কত্তা বাবুর ফোনে ফোন কললুম। তাপ্পর বিমলদা মানে আমাদের দারোয়ান যে তাকে ফোন কললুম। দরজা তো ভিতর থেকে বন্দ ছিল। বিমলদা ওই পিছনের দরজার দিকে এসে দেখে খুলা। তাপ্পর তো…।”

“আচ্ছা, মাসী রাত্রিবেলা তুমি অস্বাভাবিক কিছু বুঝতে পারনি মানে কোনও আওয়াজ বা অন্য কিছু? একটু ভালো করে মনে করে দেখ।”

কমলা বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর ইতস্তত করে বলল, “সেরকম কিছু না তবে মাঝরাতে একটা ছুনছুন আওয়াজ যেন কানে এসে লাগছিল একবার। ঘুমের ঘোরে আমি আর কিছু বুঝতে পারিনি।”

“আচ্ছা, মাসী তুমি তো অনেক দিন ধরে এবাড়িতে আছো। তোমার কি কাউকে সন্দেহ হয়? মানে এদের কোনও শত্রু...।”

“না গো দিদিমণি। তেমন কারুর কথা মনে পড়ে নি যে এক্কেবারে দু দুটা মানুষকে এমনি করে শেষ করে দিতে পারে।” আবার কমলার গলা ধরে এল।

“আচ্ছা, মাসী। তুমি এবার এসো।”

“কমলা, তুমি স্বপ্ননীলকে একটু ডেকে দাও।” বিক্রমজিৎ বললেন।

স্বপ্ননীলের নামটা সত্যিই সার্থক। ফর্সা কপালের নিচে ভাসা ভাসা চোখ দুটো বড় স্বপ্নময়। উস্কোখুস্ক চেহারা। অবিন্যস্ত চুল। গালে না কাটা দাড়ি। স্পষ্টতই বিধ্বস্ত। ছেলেটাকে দেখলেই কেমন মায়া লাগে। বিক্রমজিতের কঠিন পুলিশি হৃদয়ও আর্দ্র হয়ে উঠলো স্বপ্ননীলের জন্য। দোর্দণ্ডপ্রতাপ পুলিশ অফিসার হলেও বিক্রমজিতের বুকের এক চিলতে কোনা বড্ড নরম। মাঝে মাঝে বেশ ভাবুক হয়ে যান তিনি। স্বপ্ননীল ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে আর এখন তারুণ্যের দরজায় বাবা আর দাদুকে একসঙ্গে হারাল তাও আবার এমন নৃশংসভাবে।

“বসুন।” কঠিন পুলিশি গলায় বলল পৃথা। বিক্রমজিৎ আড়চোখে পৃথার দিকে তাকালেন। এইজন্যই এত স্নেহ করেন মেয়েটাকে। বেশিরভাগ এই বয়সী মেয়েই স্বপ্ননীলকে দেখে স্বপ্নের জগতে চলে যাবে কিন্তু পৃথা তার কর্তব্য বিষয়ে অবিচল। ইশারায় পৃথাকেই ইন্টারগেশন চালাতে বললেন বিক্রমজিৎ। তিনি শুধু চুপচাপ শুনতে শুনতে মস্তিষ্কের কোষগুলোকে জাগ্রত করতে চান।

“সেদিন রাতে আপনি কোথায় ছিলেন?”

“আমি এক বন্ধুর জন্মদিনে গিয়েছিলাম। সেখানে খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে বেশ রাত হল তাই আর বাড়ি ফিরলাম না। আমার বন্ধুর বাড়ির পাশের গলিতেই আমার মাসী ঠাম্মার বাড়ী। ওখানেই চলে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এই সুযোগে একবার মাসী ঠাম্মার সঙ্গে দেখাও হয়ে যাবে। মাসী ঠাম্মা দুদিন আগেই দেরাদুন থেকে ফিরেছে। তখন তো জানতাম না …।” স্বপ্ননীলের কণ্ঠস্বরটাও ভীষণ সুন্দর। ধীরে ধীরে থেমে থেমে কথাগুলো শেষ করল সে।

“ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া কেন এই ঘটনা ঘটল?”

স্বপ্ননীল নিঃশব্দে মাথা নাড়লো।

“আপনাদের কোনও বিজনেস রাইভ্যালরি?”

“না, যদিও আমি এখনও বিজনেসে পুরোপুরি ইনভলভড নই তবুও যেটুকু জানি তাতে আমাদের সাথে কারুর এমন শত্রুতা নেই যাতে করে…। প্রতিযোগিতা তো সব বিজনেসেই থাকে।”

“তাহলে আপনার বাবা-দাদু এভাবে খুন হলেন কেন?” পৃথার গলায় কাঠিন্য।

স্বপ্ননীল অসহায় দৃষ্টিতে পৃথার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি বলতে পারব না কেন এমন হল। আসলে আমি তো পড়াশোনা করার জন্য ব্যাঙ্গালোরে ছিলাম তারপর এই বছর দুয়েক হল বাড়ি ফিরেছি। মাঝে মাঝেই পাহাড়ে ট্রেকিং করতে চলে যাই। একটু আধটু ছবিও আঁকি সেই সূত্রেও বিভিন্ন জায়গায় যাই। বাড়িতে আসলে খুব কম থাকি তো...।”

“আচ্ছা, আপনি আপাতত আসতে পারেন।”

“স্বপ্ননীল আপনার ঠাকুমার কাছে নিয়ে চলুন আমাদের।”

নীরবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল স্বপ্ননীল।

***

সোমলতা দেবী খাটের ওপর বালিশে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। চেহারা থেকে আভিজাত্য এবং ব্যক্তিত্ব দুইই ঠিকরে পড়ছে। শোকগ্রস্ত, বোঝাই যাচ্ছে। ওনার একপাশে একজন বছর পঞ্চাশের মহিলা আর অন্যপাশে একজন বয়স্কা মহিলা।

“আমার ঠাম্মি, মাসী ঠাম্মা আর পিসিমনি।” প্রত্যেকের পরিচয় দিল স্বপ্ননীল।

“ঠাম্মি, এনারা তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চান।”

চোখ তুলে বিক্রমজিৎ আর পৃথাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করলেন সোমলতা। পৃথার দিকে একটু বেশিক্ষণই ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। পৃথার মনে হোল তার পুলিশের পোশাক পরা চেহারাটা বিশেষ পছন্দ হল না ভদ্রমহিলার।

“কী কথা বলতে চান আপনারা?” গলার স্বরের কাঠিন্য শুনে বোঝা মুশকিল যে ইনি সদ্য একই সাথে স্বামী এবং পুত্রকে হারিয়েছেন।

এবার হাল ধরলেন বিক্রমজিৎ কারণ এই ভদ্রমহিলা পৃথাকে মোটেও পাত্তা দেবেন না। জলদ গম্ভীর স্বরে বিক্রমজিৎ বললেন, “আপনার স্বামী এবং ছেলের খুনের তদন্তের ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আমাদের কথা বলা প্রয়োজন।”

“ওকে এই সময় বিরক্ত করা কি খুব প্রয়োজন?” স্বপ্ননীলের মাসী ঠাম্মা বললেন। ইনিও যে মেজাজের দিক থেকে বোনেরই অনুগামী, গলার স্বরেই তার প্রমাণ।

“হুম, একসাথে একই বাড়িতে দুটো খুন যে খুব সাধারণ ঘটনা নয় আশাকরি সেটা আপনাদের বলে বোঝাতে হবে না। ইনভেস্টিগেশনের কাজে আমাদের সাথে কোপারেট করলে আপনাদেরই লাভ।”

“মা, ওনারা কী জানতে চাইছেন একটু শোনই না।” সোমলতার মেয়ে অপালা বললেন।

“ঠিক আছে বলুন কী জানতে চান।”

“আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?”

“নাহ।”

“আপনাদের কোনও রকম পারিবারিক বা ব্যবসায়িক শত্রু?”

“নাহ।”

“মনে করে দেখুন হয়ত কোনও সময় আপনার স্বামী বা ছেলে বলেছিলেন কারুর কথা।”

“দেখুন মনে করার কোনও দরকার নেই। এবাড়িতে মশা-মাছিও ওড়ে আমার পারমিশন নিয়ে। তাই কোনও শত্রু থাকলে সেকথা সবার আগে আমি জানব।” বিক্রমজিৎ মনে মনে ভাবলেন এত দাম্ভিক মহিলা বোধহয় আগে কখনও তিনি দেখেননি।

“আপনাদের সোনার ব্যবসা অথচ বাড়িতে সিকিউরিটি ব্যবস্থা তো সেরকম কিছুই নেই।”

সোমলতার ঠোঁটে বাঁকা হাসি, “আপনার কি ধারণা অফিসার আমরা সোনা, টাকা সব বাড়িতে স্টক করে রাখি! ওসব যেখানে থাকে সেখানে একটা পিঁপড়েও গলতে পারবে না। বাড়িতে যে এমন বিপদ ঘটতে পারে ভাবিনি কখনও।” এতক্ষণে সোমলতার গলাটা একটু নরম শোনালো।

“খুনি যে একটা করে পায়েল ফেলে গেছে এব্যাপারে কোনও আলোকপাত করতে পারেন?”

“নাহ। আর এসব খোঁজা তো আপনারদের কাজ শুধু শুধু আমাদের বিরক্ত করছেন কেন? দাদুভাইকে বেশি বিরক্ত করেননি তো? ও খুব নরম মনের ছেলে।”

বিক্রমজিৎ আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না সোমলতাকে। অপালা এবং সোমলতার দিদির সাথে কথা বলেও বিশেষ লাভ কিছু হলো না।

***

ফরেন্সিক রিপোর্টটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন বিক্রমজিৎ। সত্যি কথা বলতে গেলে দিন দশেক কেটে গেলেও এখনও তদন্ত একচুল এগোয়নি। ফরেন্সিক রিপোর্ট অনুযায়ী খুন দুটো রাত্রি একটা থেকে আড়াইটার মধ্যে হয়েছে। কোথাও কোনও ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া যায়নি। আততায়ী সম্ভবত গ্লাভস পরে এসেছিল। অকুস্থলে পাওয়া পায়েল দুটো রুপোর তৈরি এবং প্রায় তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের পুরনো। এই রকম ব্লাইন্ড কেস বিক্রমজিতের হাতে আগে কখনও আসেনি যেখানে তাঁর সামনে কোনও রকম সূত্র নেই। সেন জুয়েলারীতেও গিয়ে তদন্ত করেছেন তাঁরা। ম্যানেজার থেকে শুরু করে প্রতিটি কর্মচারীর সাথে কথা বলেছেন কিন্তু কোনও সূত্র মেলেনি। সবারই একই বক্তব্য সেনদের এমন কোনও ব্যবসায়িক শত্রু নেই যে এত ভয়াবহ কাণ্ড ঘটাতে পারে। কর্মচারীরা সকলেই অপলেশকে খুবই ভালোবাসতো একথাও স্পষ্ট। সোমলতা সেনের জামাইয়ের সাথেও কথা বলে দেখেছেন, কোনও লাভ হয়নি। একবারের জন্য বিক্রমজিতের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল যে কোনও সম্পত্তি জনিত কারণে সোমলতার মেয়ে-জামাই কোনওভাবে এই খুনের সঙ্গে যুক্ত নয় তো? কিন্তু খোঁজখবর করার পর সেই তত্ত্বও বাতিল করতে হয়েছে কারণ ওঁদের নিজেদের যা সম্পত্তি, ব্যবসা যে সেন বাড়ির দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন নেই ওঁদের। শুধু তাই নয় মানুষ হিসেবেও দুজনেই অত্যন্ত ভালো।

***

আকাশটাকে কালো মেঘের দল ঘিরে ধরেছে। রাতের আকাশটাকে আরও কালো করে দিয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে মাটির বুকে। আমি বৃষ্টি ভীষণ ভালোবাসি। টিনের চালে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ শুনলে আমি পাগল হয়ে যাই। ময়ূরের মত বৃষ্টিতে নাচতে ইচ্ছে করে আমার। নাহ, মনটা অন্যদিকে দিলে চলবে না । আমার সামনে এখন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। ওড়নাটা ভালো করে মাথায় জড়িয়ে নিলাম। এমনভাবে নিলাম যাতে মুখের অর্ধেকটা ঢাকা হয়ে যায়। আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি নীল রঙের দরজাটার সামনে। কলিং বেলের সুইচে হাত রাখলাম। মিষ্টি সুরে একটা পাখী বাড়ির বাসিন্দাকে জানান দিল দরজায় আগন্তুক প্রতীক্ষারত। বাড়ির বাসিন্দা নিশ্চয় দরজা খুলতে আসছে। সে জানেও না আজ মৃত্যু তার দ্বারে অতিথি হয়ে উপস্থিত। দরজা খুলে গেল। তাকে কিছু বলার সুযোগ দিলাম না আমি, গলাটা বহু কষ্টে আয়ত্তে এনে বলে উঠলাম, “প্রভা দেবী বাড়িতে আছেন? গার্লস স্কুলের হেড দিদিমণি ছিলেন যিনি।”

“আমিই প্রভাদেবী।” তার বলার মধ্যেই একটা ঔদ্ধত্য প্রকাশ পাচ্ছে। আজও মানুষটা পাল্টায়নি। বার্ধক্যও তাঁর দাম্ভিকতাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।

“আমি নিবেদিতা মহিলা আশ্রম থেকে আসছি। ওই যে সেদিন আমাদের দিদি ফোন করেছিলেন।”

“ও ও বুঝেছি। কালই তো ফোন করেছিলেন আর আজই …। আচ্ছা ঠিক আছে। ভেতরে এসে বস। তোমার মুখটা ঢেকে রেখেছ কেন?” বিরক্ত সুরে বললেন প্রভা।

“আমার মুখের ওই দিকটা পোড়া। শ্বশুরবাড়িতে পুড়িয়ে দিয়েছিল তারপর আশ্রমের দিদি...।”

“আচ্ছা, হয়েছে হয়েছে। তুমি বস। আমি আসছি।”

চরম অহংকারী মানুষটা ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলেন। আমি মুচকি হেসে চট করে নিঃশব্দে দরজাটা লাগিয়ে পৌঁছে গেলাম প্রভার শোবার ঘরের দরজায়। নিশ্চিন্ত মনে আলমারী খুলে টাকা বের করেছেন মহাশয়া। ক্লোরোফর্মে ভেজা রুমাল রেডি। শোবার ঘর থেকে বেরোনর সঙ্গে সঙ্গে প্রভাকে কব্জা করে ফেললাম আমি। সামান্য একটু সময় আমাকে বাধা দেওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে নিস্তেজ হয়ে গেলেন প্রভা। আমার নিজের প্রশংসা নিজেরই করতে ইচ্ছে করছে। এত তাড়াতাড়ি কোনও ঝামেলা ছাড়াই কাজ করে ফেললাম। এবার আর কী, প্রভার ওই ফর্সা গলা আর পেটটা একটু রঙিন করে দিয়ে আমি চলে যাব।

কাজ শেষ করে দরজাটা টেনে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মনটা ভালো হয়ে গেল। আরেকটা মানুষ যাকে আমি তীব্র ঘৃণা করতাম তাকে মুছে দিলাম এই পৃথিবী থেকে। আমার মনে একটা খুশির আমেজ ছড়িয়ে পড়ছে কিন্তু সেই শয়তান মানুষটার কী অবস্থা হবে এই খবরটা শুনে?

***

বিক্রমজিতের ফোনটা বেজে উঠলো। আহ্বানকারী পৃথা।

“হ্যালো।”

“স্যার, একটা খবর আছে।”

“কী?”

“সোমলতা সেনের দিদি প্রভাবতী দে, যাঁকে আমরা সেদিন “শেষের কবিতা” তে দেখেছিলাম তিনি খুন হয়েছেন আজ সন্ধ্যেবেলা।”

“কী!” চরম বিস্ময় বিক্রমজিতের কণ্ঠে।

“হ্যাঁ, স্যার।”

“খুনটা কোথায় হয়েছে?”

“ওনার নিজের বাড়িতে। আমি ওখানেই যাচ্ছি। ফরেন্সিকেও খবর দিয়ে দিয়েছি।”

“ওকে, ভেরী গুড। তুমি যাও, আমি আসছি।” ফোনটা রেখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বিক্রমজিত করুণভাবে হাসলেন, “বুঝলে, গিন্নী, যতদিন না রিটায়ার করছি এই পুলিশের চাকরি থেকে শান্তিতে একটু খাওয়াও জুটবে না কপালে। তুমি খেয়ে নিও। আমাকে বেরোতে হবে, পৃথা ফোন করেছিল।”

“সে তো বুঝতেই পারছি, কিন্তু হলো টা কী?”

“সেন বাড়ির কেস। অপলেশ সেনের মাসী খুন হয়েছেন।”

“হোয়াট!”

***

প্রভাবতী দে, বোনের মতোই ব্যক্তিত্বময়ী এবং মেজাজী মহিলা। নিজের জীবনটা নূন্যতম কারুর নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখতে রাজি নন বলে বিয়ে করেননি। ভাইদের সংসারের সাথে থাকবেন না বলে বাপের বাড়ি থেকে সরে এসে নিজের আলাদা বাড়ি বানিয়েছিলেন। একলাই থাকতেন। যথেষ্ট সাহসী মহিলা ছিলেন। বকুলতলা গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে নিজের চাকরী জীবন কাটিয়েছেন।

“কে প্রথম বডি দেখে?”

“স্যার, বকুলতলা স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির তিনজন সদস্য এবং বর্তমান হেডমিস্ট্রেস নীলিমা দেবী রাত সাড়ে আটটা নাগাদ এখানে আসেন স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে প্রভাদেবীকে নিমন্ত্রণ করতে। ওনারাই প্রথম বডি আবিষ্কার করেন। “

“ওনাদের স্টেটমেন্ট নিয়েছ?”

“হ্যাঁ স্যার, বিশেষ কিছু নেই। ওনারা প্রথমে বারবার কলিং বেল বাজান, তারপর খেয়াল করেন দরজাটা ভেজানো। কী ব্যাপার বুঝতে না পেরে ওনারা বসার ঘরে ঢোকেন। তারপর নীলিমা দেবী প্রভাদেবীকে ডাকতে ডাকতে ভেতরে ঢোকেন এবং বডি দেখতে পান। ওনার চিৎকারে বাকিরাও ছুটে যান।”

“হুম, বুঝলাম। এখানেও সেম প্রসেস। স্ট্যাব করে খুন। অরুণোদয়ের খুনের সাথে হুবহু মিল।”

“খুনী খুব চালাক স্যার, এখানেও একটা টাওয়েল দেখছি রক্তে ভেজা। নিজের গায়ে যাতে রক্ত না লাগে তার জন্য টাওয়েলটা ব্যবহার করেছে আর স্যার, এখানেও নিজের চিহ্ন ছেড়ে গেছে। একটা রুপোর পায়েল।”

“আশেপাশের লোকজন কিছু দেখেছে? যদিও এই পাড়াটা দেখছি ফাঁকা ফাঁকা তাও খুনটা তো সন্ধ্যেবেলা হয়েছে। কেউ কিছু দেখতেও পারে।” বিক্রমজিৎ আর পৃথার কথার মাঝেই কনস্টেবল অরুণ এসে ডাকে, “স্যার, এই ছেলেটি একটা মেয়েকে এ বাড়িতে ঢুকতে দেখেছেন।” অরুণের সাথে একটি বছর কুড়ির ছেলে।

“তুমি কী দেখেছ নির্দ্বিধায় বল আমাদের, কোনও ভয় নেই। আর তোমার নামটা কী?”

ছেলেটি বলতে শুরু করে,” আমার নাম কৌশিক দাস। এ বাড়ির কয়েকটা বাড়ি পরে আমাদের বাড়ি। আমি কলেজ স্টুডেন্ট। তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা মত হবে আমি সাইকেলে করে টিউশন থেকে ফিরছিলাম। আকাশে মেঘ জমেছিল বলে একটু স্পিডেই চালাচ্ছিলাম। এবাড়ীর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল একটি চুড়িদার পরা মেয়ে গেট খুলছে।”

“তুমি তার মুখ দেখেছ?” উত্তেজিত হয়ে পড়েছে পৃথা।

“না, সে তো পেছন ফিরে গেট খুলছিল আর এমনিতেই প্রভা দিদার অনেক এক্স স্টুডেন্ট আসে তাছাড়া দিদা বিভিন্ন মহিলা আশ্রমের সাথে যুক্ত বলেই জানি তাই কোনও কিছু অস্বাভাবিক মনে হয়নি আমার তাই আমি স্পিডেই পেরিয়ে যাই। ও হ্যাঁ, মেয়েটার মাথা ওড়নায় ঢাকা ছিল।”

“হুম।” হতাশ হয়ে পড়েছে পৃথা।

“আচ্ছা, তুমি এস। দরকার যদি হয় আবার ডাকবো।” বিক্রমজিৎ ছেলেটিকে ছেড়ে দিলেন। ছেলেটি দরজা পর্যন্ত গিয়েও হঠাৎ করে ফিরে দাঁড়ালো। একটু ইতস্তত করে বলল, “একটা কথা বলবো?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই বল।” বিক্রমজিৎ আশ্বাস দেন।

“এ বাড়ির প্রাচীরটা তো সোজা নয়, মানে এই জমিটা তো সোজা নয়। যেখানে প্রাচীরটা একটু ঢুকে গিয়ে একটু খাঁজ তৈরি হয়েছে ওইখানে একটা স্কুটির মত গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম।”

“নাম্বার বা কোন কোম্পানীর বলতে পারবে?”

“নাম্বার খেয়াল করে দেখিনি আর স্কুটিটা কোনও নতুন কোম্পানীর হবে কারণ উসুয়ালি যে সব স্কুটি রাস্তা-ঘাটে দেখি সেরকম লাগলো না।”

“ও আচ্ছা। কথাটা বলে খুব ভালো করলে তুমি।”

পৃথার মুখটা দেখে বিক্রমজিতের হাসি পেয়ে গেল। হতাশ হয়ে পড়েছে মেয়েটা। চাকরী জীবনে এইরকম কত চ্যালেঞ্জিং কেস আসবে যেখানে এমন ধুরন্ধর অপরাধীর সাথে মোলাকাত হবে যে একেক সময় নিজের ওপরই আস্থা চলে যাওয়ার উপক্রম হবে। এই কেসটা তো বিক্রমজিতকেও ধাঁধাঁয় ফেলে দিচ্ছে।

“পৃথা।”

“ইয়েস স্যার।”

“আমার মনে হয় প্রভা দেবীর কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করলেই উনি কোন কোন মহিলা আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত জানতে পারবে। সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখ সেখান থেকে কোনও মেয়ে প্রভা দেবীর কাছে এসেছিল কিনা আর প্রভাদেবীর কল লিস্টটাও চেক করো।”

“ওকে, স্যার।”

***

আমার আজকে ভীষণ গান গাইতে ইচ্ছে করছে। চূড়ান্ত অহংকারী, হৃদয়হীন প্রভাবতী দে কী রকম অসহায় আত্মসমর্পণ করল আমার কাছে! ও আবার বিভিন্ন মহিলা আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত! অসহায়, দুঃস্থ মহিলাদের সাহায্য করে! ফুহ! সব নাম কেনার জন্য আর খবরদারি করার জন্য। ওর ওই ফর্সা ধপধপে শরীরটা যখন রক্ত স্রোতে লাল হয়ে যাচ্ছিল তখন আমার এত আনন্দ হচ্ছিল, এত আনন্দ হচ্ছিল যে আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। তবে সেদিন নীলাঞ্জনের গলায় যখন ছুরিটা স্পর্শ করাই আমার মনে হচ্ছিল ছুরিটা আমার চামড়া ভেদ করছে আসলে ওকে যে আমি ভীষণ ভালোবাসতাম। আরে! বাসতাম কেন বলছি আজও বাসি, ভীষণ ভালোবাসি। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত, এই নীল আকাশের শেষ সীমা পর্যন্ত আমি ভালোবাসি, আমি ভালোবাসি, আমি ভালোবাসি আমার নীলাঞ্জনকে। ওই তো আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা ছিল। আমার ভালোবাসাকে ওরা পেতে দেয়নি। যদি পরের জন্ম বলে কিছু থাকে তাহলে আমরা দুজন পাখী হয়ে জন্মাব। দুজনে বাঁধব ছোট্ট একটা নীড়। আমরা, আমাদের ছোট্ট সংসার আর কেউ থাকবে না সেখানে, কেউ না, কেউ না। ওই খারাপ মানুষগুলো কেউ থাকবে না সেখানে।

***

“কী খবর পৃথা?”

“স্যার, প্রভাবতী তিনটে মহিলা আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কিন্তু কোনও মহিলা আশ্রম থেকে সেদিন কোনও মহিলাকে প্রভাবতীর কাছে পাঠানো হয়নি।”

“আর ইউ শিওর।”

“হ্যাঁ, স্যার। আমি ওদের কাউকে বলিনি যে সাস্পেক্ট একজন মহিলা। আমি শুধু জিগ্যেস করেছি যে ওই দিন কেউ গিয়েছিলেন কিনা। যদি কেউ গিয়ে থাকেন প্রভাবতী তাঁর কাছে নিজের সম্ভাব্য কোনও বিপদ সম্পর্কে কোনও আভাস দিয়েছিলেন কিনা। আমি এমন ভাব করেছি যেন জাস্ট কোনও সূত্র যদি পাওয়া যায় সেই আশায় গিয়েছি।”

“ওয়েল ডান। কল লিস্টের কী খবর?”

“না, স্যার। সন্দেহজনক কিছু নেই। ম্যাক্সিমাম কথা হয়েছে সোমলতার সাথে। বাকি কথাও আত্মীয়স্বজন, পুরোনো কলিগ, মহিলা আশ্রম এইসব।”

“হুম, ফরেন্সিক রিপোর্টেও নতুনত্ব কিছু নেই। সেই অরুণোদয় আর অপলেশের মতই। শুধুমাত্র এখানে খুনটা হয়েছে সন্ধ্যে সাতটা থেকে নয়টার মধ্যে তবে রিপোর্টের দরকার নেই আমরা এমনিতেই জানি খুন হয়েছে রাত্রি সাড়ে আটটার আগে। “

“পায়েলটাও একই রকম পুরোনো।”

“আচ্ছা, পৃথা, এস তো আমরা এই কেসটা নিয়ে একটা আলোচনায় বসি। আমি একটা পয়েন্ট বলব, তুমি একটা পয়েন্ট বলবে। এই ভাবে এগোতে এগোতে যদি কোনও টার্গেটে পৌঁছনো যায়।”

“ওকে স্যার।”

“অরুণোদয়, অপলেশ আর প্রভাদেবীর খুনি একজনই। ডু ইউ এগ্রি উইথ মি?”

“ইয়েস স্যার, খুনগুলো সিরিয়াল কিলিং এর ধাঁচে হচ্ছে এবং ভিক্টিম একই পরিবারের বা বলা যেতে পারে আত্মীয়তার সম্পর্কে জড়িত। তিনটে খুন থেকেই, বিশেষত অরুণোদয় আর অপলেশের খুন থেকে আমার মনে হচ্ছে খুনি ওই বাড়ি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। যেভাবে অন্ধকার রাত্রে ওই বাড়িতে ঢুকে স্মুদলি খুন দুটো করেছে।”

“ইউ আর অ্যাবসলিউটলি রাইট। প্রভাদেবীর খুনের পর একটা জিনিস পরিষ্কার খুনগুলো হচ্ছে কোনও ব্যক্তিগত আক্রোশবশত, সেনদের ব্যবসায়িক শত্রুর তত্ত্ব সম্পূর্ণ রূপে বাতিল কারণ ওদের ব্যবসার সাথে প্রভাদেবীর নূন্যতম সম্পর্কও ছিল না।”

“রাইট স্যার, আমার মনে কিন্তু একটা প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে স্যার, খুনি অরুণোদয় আর প্রভাদেবী দুজনকেই নৃশংসভাবে খুন করেছে কিন্তু অপলেশকে শুধু মাত্র কণ্ঠনালী ছিন্ন করেই রেহাই দিল কেন? সে ভর সন্ধ্যেবেলা অত্যন্ত রিস্ক নিয়ে প্রভাদেবীকে খুন করতে এল তাও সময় নিয়ে তাকে বারংবার কোপাল অথচ প্রায় ফাঁকা বাড়িতে গভীর রাতে অপলেশকে খুন করার সময় শুধু গলা কেটে ক্ষান্ত দিল! শুধু কি অপলেশ হ্যান্ডিক্যাপেড বলে দয়া হয়েছে? নাকি পরবর্তী খুন করার তাড়া ছিল বলে? যদিও কে আগে খুন হয়েছে সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়নি। ফরেন্সিক রিপোর্ট অনুযায়ী দুটো খুনের টাইম স্প্যান একই।”

“এই প্রশ্নটা আমাকেও ভাবিয়েছে যদিও উত্তর পাইনি। এবার আসা যাক পায়েলের কথায়। আমার ধারণা খুনী প্রতিটা খুন করে নিজেকে চিনিয়ে দিতে চাইছে। পায়েলগুলোর যা বয়স সেই থেকে আমার ধারণা হচ্ছে এই খুনগুলোর শেকড় প্রোথিত আছে অতীতের গর্ভে। খুনী কাউকে একটা চ্যালেঞ্জ করে বলছে দেখো আমি এসেছিলাম। আমি শেষ করে দিলাম এই মানুষগুলোকে। পায়েলগুলো অবশ্যই বিশেষ কোনও ঘটনা বা বিশেষ কোনও মানুষের প্রতি নির্দেশ করছে।”

“ঠিক বলেছেন স্যার, আর প্রভাদেবীর খুনের ক্ষেত্রে কিন্তু একজন মহিলার অস্তিত্ব উঠে আসছে। কৌশিক একটা কম বয়সী ছেলে, কাছাকাছি একটা ল্যাম্প পোস্টও আছে তাই ওর দেখার ভুল হবে না।”

“এগেইন ইউ আর রাইট পৃথা বাট এই পায়েল বা এই মহিলার সম্বন্ধে আমরা জানব কী ভাবে? কোনও সূত্রই নেই আমাদের কাছে। খুনি যে আবার একটা খুনের প্ল্যান করছে না তারও কোনও গ্যারান্টি নেই। আর সত্যিই যদি খুনী মহিলা হয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে সে খুবই ভয়ংকর, কারণ মেয়েরা এখন সব কিছুই করতে পারে ঠিকই কিন্তু এভারেস্টের চূড়ায় ওঠা কিংবা স্পেসশিপ চালানো আর রাতের অন্ধকারে নৃশংস ভাবে মানুষ খুন করা এক নয়। আমার ধারণা এখানেই শেষ নয়। আটকাতেই হবে পৃথা, আটকাতেই হবে। এমনিতেই প্রভাদেবীর খুনের পরই ওপর থেকে চাপ আসছে। পরপর তিনটে খুন হয়ে গেল।”

“স্যার, আমার মনে হয় এব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন সোমলতা বা তাঁর মেয়ে-জামাই কারণ স্বপ্ননীলকে যা দেখলাম বা ওর সম্বন্ধে যা খোঁজখবর পেয়েছি শান্তশিষ্ট ছেলে, নিজের পড়াশোনা, ছবি আঁকা আর ট্রেকিং করতে যাওয়া এসবের মধ্যেই ডুবে থাকে। ইদানীং নিজেদের ব্যবসায় গয়নার নতুন নতুন ডিজাইন তৈরির ব্যাপারে কাজ করছিল। তাছাড়া ওর বয়স আর পায়েলগুলোর বয়সের তুলনা করে আমার মনে হচ্ছে সেন পরিবারের কোনও অতীত ইতিহাস থাকলেও সেটা ওর পক্ষে জানা সম্ভব নয়। একই কারণে ওর পিসি অপালার মেয়ে আরিশাকেও আমি হিসেবের বাইরে রাখতে চাই। তাছাড়া সে পড়াশোনা করে ও হোস্টেলে থাকে। বাকি তো রইল সোমলতা, অপালা আর অপালার হাজব্যান্ড দীনেশ। আমার মনে হয় এদের সাথে বিশেষ করে সোমলতা দেবীর সাথে আগে কথা বলা উচিত। কোনও কাজ না হলে তখন সোমলতা আর প্রভাবতীর বাপের বাড়ির লোকদের সাথে কথা বলতে হবে। তবে আমি নিশ্চিত স্যার, তার দরকার হবে না।” পৃথার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস।

বিক্রমজিতের ঠোঁটের কোণে হাসির ঝলক।

“স্যার, হাসছেন কেন?” পৃথা অবাক।

“মনে হচ্ছে একদিন তুমি আমার মাথার ওপর বসবে।”

“কী যে বলেন স্যার।” পৃথা লজ্জা পেয়ে গেল।

***

“দেখুন, সোমলতা দেবী, আমাদের সাথে যদি আপনি কোপারেট না করেন তাহলে আমরা খুনিকে খুঁজবো কী করে?” পরপর তিনজন কাছের মানুষকে হারিয়ে সোমলতা স্পষ্টতই বিধ্বস্ত কিন্তু সেইসাথে কোথাও একটা সোমলতা ভীষণই কঠিন। প্রথমে কথা বলতেই রাজী ছিলেন না পরে মেয়ে-জামাইয়ের কথাতে রাজী হলেও বিক্রমজিতদের বিশেষ লাভ হচ্ছে না। সোমলতা বোধহয় ইচ্ছে করেই মুখটাকে অভিব্যক্তিহীন করে রেখেছেন। ওনার মনের গহনে হয়ত ঝড় উঠছে কিন্তু বাইরে একটা পাতাও কাঁপছে না।

“আবার জিগ্যেস করছি আপনাদের পরিচিত এমন কোনও মহিলা আছেন কি যিনি পায়েল পরতে খুব ভালোবাসেন? আপনি কি এমন কোনও মহিলার কথা মনে করতে পারছেন?”

“না, অফিসার, আমার মনে হয় আপনি অযথা আমাকে বিরক্ত না করে খুনিকে ধরার চেষ্টা করুন। আমি আমার সবচেয়ে কাছের তিনজন মানুষকে হারিয়েছি। আপনি কি ভাবছেন খুনি ধরা না পড়লে আমি আপনাকে ছেড়ে দেব? আপনার ওপর মহলে জানাব। বুঝেছেন?” সোমলতা ক্রুদ্ধ সর্পিনীর মত ফুঁসে উঠলেন।

“বয়সটা আমারও কম হয়নি ম্যাডাম। এই ধরনের ফাঁকা ধমক চাকরী জীবনে বহুবার শুনেছি। একটা কথা জেনে রাখুন যে সত্যিটা আপনি গোপন করার চেষ্টা করছেন সেটা তো যেকোনো উপায়ে আমি জানবোই আর আপনার কোপারেশন ছাড়াই খুনী পর্যন্ত পৌঁছবই। একটা ব্যাপারই বিস্ময়কর আপনার তিনজন কাছের মানুষ চলে গেলেন তারপরও আপনি এভাবে মুখ বন্ধ করে আছেন। নিজের বা বাকিদের অর্থাৎ আপনার মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনির সেফটির কথা ভাবছেন না।”

“আমার দাদুভাইয়ের কিছু হবে না, কিচ্ছু হতে পারে না।” ছটফট করে উঠলেন সোমলতা।

“তাহলে মুখ খুলেছেন না কেন?” বিক্রমজিতের প্রশ্নের উত্তরে সোমলতার মুখের কাঠিন্য আবার ফিরে এল। বিক্রমজিৎ দ্বিরুক্তি না করে বেরিয়ে এলেন। এই গোটা প্রশ্নোত্তর পর্বে পৃথা নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল। গাড়ীতে উঠে বিক্রমজিৎ নিজের মনেই বললেন, “ভেরি, ভেরি হার্ড নাট টু ক্র্যাক।”

“আপনি নিশ্চিত স্যার, সোমলতা এই পায়েলের সমন্ধে কিছু জানেন বা অতীতের কোনও কথা গোপন করছেন?”

“এখানে আসার আগে পর্যন্ত সন্দেহ ছিল কিন্তু এখন আমি নিশ্চিত।”

“বুঝলাম না স্যার।”

“তোমার না বোঝারই কথা। যখন আমি জেরা করছিলাম তখন সোমলতার চেহারা ছিল এক্সপ্রেশন বিহীন। এরকম পরিস্থিতিতে আমি আগে বহুবার পড়েছি যখন অপরাধী কিংবা তোমার উল্টো দিকে থাকা ব্যক্তিটি তোমার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য নিজের মনের ছবি চেহারায় ফুটে উঠতে দেয় না। এইরকম সময় যখন চেহারা দেখে কিছু বোIঝা যায় না তখন চোখটা লক্ষ্য করতে হয়। খুব পাকা অভিনেতা ছাড়া চোখের ভাষা গোপন করা সম্ভব নয়। চিন্তা নেই আস্তে আস্তে তুমিও শিখে যাবে।”

“হুম।”

সারাটা পথ পৃথার মাথায় একটা কথাই ঘুরছে, “ভেরি ভেরি হার্ড নাট টু ক্র্যাক।”

***

বিক্রমজিতের সামনে ফরেন্সিক রিপোর্টগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। সোমলতাকে চ্যালেঞ্জ তো করে এলেন কিন্তু কোন পথে এগোবেন। সোমলতার মেয়ে-জামাইকে ওদের বাড়িতে গিয়ে ধরতে হবে। তাতে যদি কিছু সত্যি বেরিয়ে আসে। সোমলতার সামনে ওরাও মুখ খুলবে না। পৃথার আসতে দেরী হচ্ছে কেন?

“স্যার।” বিক্রমজিৎ মুখ তুলে দেখেন যুদ্ধজয়ের হাসি নিয়ে পৃথা দাঁড়িয়ে।

***

সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে কমলা “সুস্বাদু কেবিন”-এর ভেতরে উঁকি দিল। পৃথার হাতছানিতে আশ্বস্ত হয়ে ভিতরে ঢুকলো। নীল জিন্স আর ফ্লোরাল টিশার্ট পরিহিতা পৃথার মধ্যে এখন পুলিশ সুলভ কোনও আচরণ নেই।

“এস মাসি, বস।”

কমলা ভয়ে ভয়ে পৃথার মুখোমুখি বসল, “এভাবে গোপনে কেন ডাকলে গ?”

“দরকার আছে মাসী। তোমার ভালোর জন্যই দরকার আছে।” ফিসফিস করে বলল পৃথা।

“মানে?” কমলা আতঙ্কিত।

“দেখ মাসী সেদিন বাড়িতে তিনজন মানুষ ছিল তার মধ্যে তুমি একলা বেঁচে আছ। বাকি দুজন খুন হয়ে গেছে ব্যাপারটা কিন্তু তোমার পক্ষে মোটেই ভালো নয়।”

“আমি কিছু করিনি গো, আমি কিছু জানি নি গো।” হাউমাউ করে উঠলো কমলা।

“চুপ, একদম চুপ। লোকে দেখছে।” পৃথার ধমকে কমলা থামল।

“শোনো, মাসী। একমাত্র আমি তোমাকে বাঁচাতে পারি কিন্তু তার জন্য তোমাকে আমার সব প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিতে হবে তাহলে আমি আসল খুনিকে ধরে ফেলব আর তোমারও কোনও ঝামেলা থাকবে না। রাজী কিনা বল?”

“রাজী মানে একশ বার রাজী। তুমি আমাকে বাঁচাও পুলিশ দিদিমণি।”

“ঠিক আছে তুমি খেতে খেতে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।” বেয়ারার দিয়ে যাওয়া কচুরি, আলুরদমের প্লেটটা কমলার দিকে ঠেলে দেয় পৃথা।

কচ্চুরি ছিঁড়ে মুখে ভরে কমলা বলে, “বল কী জানতে চাও।”

“আচ্ছা, মাসী, তুমি তো বহুবছর ও বাড়িতে আছো। বলতে পারবে ওদের এমন কোনও আত্মীয় বা চেনাশোনা মেয়ে আছে যে পায়ে পায়েল পরতে খুব ভালোবাসে। যেমন পায়েল তোমার দুই মালিকের লাশের সাথে পাওয়া গেছল?”

“সে তো বৌদিমনিই পরত। যেমন নাম ছিল নূপুর তেমনি পায়েও নূপুর পরতে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু সে তো কবেই সবাইকে ছেড়ে চলে গেল।”

“বৌদিমনি মানে অপলেশ সেনের স্ত্রী? ওনার নাম ছিল নূপুর?”

“হ্যাঁ গো। বৌদিমনির মা নাম রেখেছিলেন। ছোট থেকেই মেয়ের পায়ে সবসময় নূপুর পরিয়ে রাখতেন। মেয়ে রুনঝুন করে সারা ঘরে ঘুরবে বলে। সেই থেকে বৌদিমনিরও নূপুরের প্রতি কেমন একটা ভালোবাসা হয়ে গেছল।”

“আচ্ছা, মাসী, উনি কীভাবে মারা গেলেন? শুনছি অনেক বছর আগে মারা গেছেন?”

কমলার মুখে বিষণ্ণতার ছায়া, “বৌদিমনি আত্মহত্যা করেছিল গো।”

“আত্মহত্যা!” পৃথা চমকে উঠল।

“হুম গো।” কমলার চোখের কোণে এত বছর পরেও এক ফোঁটা জল জমা হয়েছে।

“উনি আত্মহত্যা করলেন কেন?”

“সে অনেক কথা দিদিমণি। কোথা থেকে যে বলি।”

“ওনাদের বিয়ে কি তুমি এবাড়িতে আসার পর হয়েছিল?”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা, তাহলে তুমি ওদের বিয়ে থেকেই শুরু কর। মনে করে সব কথা বল।”

কমলা শুরু করল, “বৌদিমনি আর দাদা কলেজ থেকে বন্ধু। ওদের মধ্যে ভালোবাসাবাসি ছিল। বাড়ির কেউ জানত নি। একদিন সব জানাজানি হই গেল। সে কী অশান্তি। বৌদিমনির বাবা সরকারী আপিসে চাকরি করত। এবাড়ীর মত বড়লোক নয়। তাছাড়া জানো তো গিন্নীমা বোধহয় তার মত না নিয়ে দাদা কাউকে বিয়ে করার কথা ভাবচে এটাই সজ্জি করতে পারছিল নি। তাপ্পর অনেক ঝামেলার শেষে দাদা আর বৌদিমনির বিয়ে হল। বৌদিমনি ভারী ভালো মানুষ ছিল কিন্তু গিন্নীমা আর কত্তা বাবু একদম সজ্জি করতে পারত নি বৌদিমনিকে। কথায় কথায় অপমান করত। ঝামেলা করত। তবে অপু দিদি কিন্তু খুব ভালোবাসত বৌদিমনিকে। বৌদিমনি কিন্তু কোনও দিন কারুর মুখের উপর কথা বলত নি। হাসিমুখে সব সজ্জি করত। দাদা চিরকালই শান্ত মানুষ। ব্যবসাপত্তর নিয়েই থাকত। দাদা কারুর মুখের উপর কতা বলত নি কুনো দিন; বিশেষ করে মায়ের। জানো দিদিমণি দাদা আর বৌদিমনি যেন রাধা-কিষ্ট ছিল। দুজনের মধ্যে যে কী ভালবাসা ছিল আমি তোমাকে বুঝাতে পারব নি। তাপ্পর অপু দিদির বিয়ে হই গেল। বৌদিমনি একলা হই গেল কিন্তু তাপ্পর বৌদিমনির কোল আলো করে নীলু এল। গিন্নীমা এত শক্ত জানো তো নীলু একটু বড় হতেই নীলুকে বৌদিমনির কোল থেকে প্রায় কেড়েই লিল। মায়ের অন্তর কাঁদলেও সংসারে শান্তি রাখতে বৌদিমনি মুখ ফুটে কিছু বলল নি। গোপনে আমার কাছে কাঁদত। অপু দিদি অনেকবার গিন্নীমার সাথে ঝগড়া করেছে কিন্তু কিচ্ছু লাভ হয়নি। শুধু কি বাবু আর গিন্নীমা তাদের সঙ্গে যোগ দিত গিন্নীমার পেয়ারের দিদি পভা মাসী। বৌদিমনিকে সেও কম জ্বালায়নি, কম কথা শোনায়নি। তাপ্পর একদিন দাদা আর বৌদিমনি গাড়ি নিয়ে বৌদিমনির বাপের ঘর থেকে ফিরছিল, নীলুকে বেশি মামাঘর যেতে দিত নি গিন্নীমা। তো সেদিনকে গাড়ি এক্সিডেন্ট করে দাদার পায়ে খুঁত হয়ে যায়। তাপ্পর থেকে বৌদিমনির উপর কী অত্যাচার শুরু হল কী বলব। তাপ্পর একদিন কী যে হল বৌদিমনিকে ঘর থেকে তাড়ি দিল গিন্নীমা। দাদা তখন অসুস্থ মানুষ কিচ্ছু করতে পারল নি। তাপ্পর জানো তো দিদি কীসব যে হল আমি ঠিক বুজতে পাললুম নি। কাজের লোক তো আমি। শেষে একদিন খপর এল বৌদিমনি গলায় ফাঁসি লিয়েছে। দাদা কীরকম চুপচাপ হয়ে গেল। কতা বন্দ হয়ে গেল। দাদাকে জামাইবাবু ডাক্তারের কাছে লিয়ে গেল তাপ্পর একটু ঠিক হল। শান্ত মানুষ ছিল কিন্তু তাপ্পর থেকে কেমন যেন অন্য জগতের মানুষ হই গেল।”

“আচ্ছা, মাসী। তুমি আমার অনেক উপকার করলে। তবে তুমি কিন্তু তোমার আমার কথা কাউকে বলো না।” কমলার কাছ থেকে আর বিশেষ কিছু জানা যাবে বলে পৃথার মনে হল না।

“আমাকে তুমি কিন্তু রক্ষা কোরো গো দিদিমণি।”

“হ্যাঁ গো হ্যাঁ।” উঠে পড়ল পৃথা। তার এখন ভীষণ তাড়া।

***

“ব্রাভো পৃথা ব্রাভো। তুমি একলাফে আমাদের অনেকটা পথ পার করে দিয়েছ বলে আমার ধারণা। এবার তোমার নেক্সট টার্গেট কে? অপালা?”

“ইয়েস স্যার।”

“ওকে, গো আহেড।” পৃথা বেরিয়ে গেল।

***

পৃথাকে দেখে অপালা বিশেষ অবাক হল বলে মনে হলো না। পৃথা অপালার শ্বশুরবাড়িতে এসেছে। অপালা ওকে নিয়ে একটা ব্যালকনির মত জায়গায় গিয়ে বসল। অপালার মুখের দিকে তাকিয়ে পৃথার মনে হল তার মনের ভেতর অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব একসাথে জট পাকিয়ে অনেক জটিলতার সৃষ্টি করছে।

পৃথাই শুরু করে, “দেখুন অপালা দেবী, আপনার মা আমাদের সঙ্গে কোপারেট করছেন না। আশা করি আপনি একই ভুল করবেন না কারণ আপনার মাসীর মৃত্যুর পর আপনারা মানে আপনার মা, ভাইপো, আপনারা দুজন, আপনার মেয়ে কেউই যে সুরক্ষিত নন সেটা নিশ্চই বুঝতে পারছেন।”

“বলুন, কী জানতে চান।” ধীর কণ্ঠে বললেন অপালা।

“আপনার বৌদি সুইসাইড করলেন কেন? আপনার মা-বাবা, মাসী আপনার বৌদিকে এত অপছন্দ করতেন কেন? আপাতত এই দুটো প্রশ্নের উত্তর দিন।”

অপালা স্থির দৃষ্টিতে পৃথার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দুচোখে বিস্ময়।

“আপনি আমার বৌদিকে…।”

“হ্যাঁ জানি। আপনার মাকে যে প্রশ্নটা করা হয়েছিল তার উত্তর যে নূপুর সেন, আপনার বৌদি সেটা আমরা জেনে গেছি।”

অপালা একটু ভেবে বললেন, “আপনি আমার চেয়ে অনেক ছোট, তুমি বলতে পারি?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চই। আমার নাম পৃথা।”

“দেখো, পৃথা, তোমার প্রশ্নের উত্তর এককথায় বোধহয় দেওয়া সম্ভব নয়। তোমাকে ধৈর্য্য নিয়ে শুনতে হবে কিন্তু তার কি কোনও প্রয়োজন আছে? সে মানুষটা তো বহু আগেই অনেক দূরে চলে গেছে আর তোমরা নিশ্চই আত্মা-ফাত্তা এসব থিওরি খাড়া করার চেষ্টা করছ না। তাহলে?”

“দেখুন, একটা কথা আছে যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন। কী, কেন আপনি ওসব নিয়ে ভাববেন না। আপনি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। আমার তাড়া নেই আমি সব শুনব।”

“ঠিক আছে। তবে একটা কথা জানো পৃথা আমার বৌদি যদি বেঁচেও থাকত আর যাকেই খুন করুক আমার দাদাকে খুন করতে পারত না। বৌদিকে যখন জিগ্যেস করতাম যে দাদাকে কতটা ভালোবাসে। বলত এক আকাশ ভালোবাসি। কথাটা সত্যিই বলত। একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে কতটা ভালোবাসতে পারে না দেখলে কারুর বিশ্বাস হবে না।”

“তাহলে আপনার বৌদিকে অপছন্দ…।” পৃথার কথা শেষ হওয়ার আগেই অপালা আবার শুরু করলেন, “পৃথা, আমার মা সোমলতা সেন অত্যন্ত স্বৈরাচারী, প্রভাবশালী, ব্যক্তিত্বময়ী, অহংকারী এবং কিছুটা বোধহয় মানসিক বিকৃতিসম্পন্ন মহিলা। তুমি হয়ত অবাক হচ্ছ মেয়ে হয়ে আমি নিজের মাকে এত সুন্দর সুন্দর বিশেষণে ভূষিত করছি বলে, কিন্তু এটাই সত্যি পৃথা। আমাদের বাড়িতে চিরকালই আমার মায়ের কথাই শেষ কথা। আমার মায়ের এমনই ব্যক্তিত্ব যে বাবাও অন্ধের মত মায়ের প্রতিটা কথায় সমর্থন করতেন। মায়ের ঠিক-ভুল বলার সাহস কারুর ছিল না। মায়ের চরিত্রের আরেকটা দিক ছিল দাদার প্রতি ভয়ঙ্কর এক অপত্য স্নেহ। হ্যাঁ, পৃথা, আমি ভয়ঙ্কর শব্দটাই ব্যবহার করছি। প্রথম সন্তানের প্রতি সব মায়ের আলাদা দুর্বলতা থাকে কিন্তু আমার মা দাদাকে নিয়ে যেন পুতুল খেলত। দাদার প্রতিটা নিঃশ্বাস যেন মায়ের ইচ্ছে অনুযায়ী চলত। কলেজে পড়ার সময়ও কোন জামা কবে পরবে, কোন পেনে পরীক্ষা দেবে সব মা নিয়ন্ত্রণ করত। এ ব্যাপারে মায়ের দোসর ছিল বড় মাসী। নিজে সংসার না করলেও সন্তানের ওপর আধিপত্যের সুখটা দাদার ওপর কড়ায় গণ্ডায় উসুল করে নিত। আমার দিকে ওদের অতটা নজর ছিল না তাছাড়া আমি বিদ্রোহ ঘোষণা করতাম অনেক সময়। কিন্তু আমার দাদা খুব নরম মনের মানুষ ছিল তো তাই মা-মাসীর সমস্ত কথা মুখ বুজে মেনে চলত। এভাবেই চলছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন শান্ত নদীতেও জোয়ার এলো। কলেজে দাদার সঙ্গে বৌদির আলাপ হল, প্রেম হলো। মা-মাসীর এত নজর সত্ত্বেও ওদের প্রেমটা কীভাবে যেন গোপন রেখেছিল দাদা। তারপর একদিন বাড়িতে ঝড় উঠলো। জানা গেল দাদা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে নিয়েছে। বৌদিদের মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি ছিল। মা-মাসীর অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও দাদা অদ্ভুতভাবে নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলো। বাবাও মা-মাসীর দলেই ছিল। শেষমেশ বৌদি আমাদের বাড়ির বউ হয়ে এল। কিন্তু মা তার হাতের পুতুলের জীবনে অন্য একজনকে মেনে নিতে পারলো না। বৌদির ছবি আঁকা, এমনকি পায়ে নুপুর পরা নিয়েও সমস্যা ছিল মায়ের।”

“আপনার বৌদির বিয়ের পর থেকে কিছু কথা আমি জানি। আপনার দাদার এক্সিডেন্টের পর থেকে কী হলো?”

“কার কাছে জানলে?”

“সেটা গোপনই থাক না।”

“ওকে। দাদার এক্সিডেন্টের জন্য মা ক্রমাগত বৌদিকে দায়ী করে যেতে লাগলো যেহেতু বৌদির বাপের বাড়ির পথে এক্সিডেন্ট ঘটেছিল। বৌদিও জখম হয়েছিল কিন্তু সেটা মারাত্মক কিছু ছিল না। মায়ের শত গঞ্জনা সত্ত্বেও বৌদি নিজের জীবন দিয়ে দাদার সেবা করে গেল কিন্তু দাদার পা-টা ঠিক হচ্ছিল না। আমি আর আমার হাজব্যান্ড দাদাকে নিয়ে বাইরে চিকিৎসার জন্য যাই। মায়েরা এই সুযোগটা কাজে লাগালো। বৌদিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল। বাইরে গিয়েও লাভ হল না, দাদার পা ঠিক হলো না। আমরা ফিরে আসার পর নতুন নাটক শুরু হলো। মা-মাসী আর বাবা বৌদির বিরুদ্ধে চরিত্রহীনতার অভিযোগ আনলেন। কলেজে কোনও একটি ছেলে দাদার মতই বৌদিকে পছন্দ করত। তার বাড়ি আবার বৌদিদের পাড়াতেই ছিল। বৌদি নাকি দাদা পঙ্গু হয়ে গেছে বলে তার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। বৌদির বাবা-মাকেও যাচ্ছেতাইভাবে অপমান করা হল। দাদা বিশ্বাস করেনি মায়ের কথা কিন্তু তখন হঠাৎ করে পঙ্গু হয়ে গিয়ে দাদা মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। বৌদিও কাছে নেই। মা একদিন বৌদির কাছে ডিভোর্স পেপারে সই করার জন্য পাঠালো। বৌদির সেদিন রাতেই সুইসাইড করে। দাদাকে ছাড়া বাঁচার কথা বৌদি ভাবতেও পারত না। আর নীলকে তো মা কবেই বৌদির কোল থেকে কেড়ে নিয়েছিল। বৌদিকে পছন্দ না করলেও নাতি মায়ের জীবন। জানো পৃথা, আমার মা এত হৃদয়হীন বৌদির মৃত্যুর পর দাদাকে যখন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে চিকিৎসা করাতে হল তখনও মায়ের কোনও অনুতাপ ছিল না। ছোট্ট নীল আমার বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলত, “পিসিমনি, আমার মাকে একবার এনে দেবে। আমি যে সব সময় মা মা গন্ধ পাই। নীলকে মা বোধহয় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, মায়ের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা নীল, কিন্তু মা ওর কথাও ভাবেনি।” অপালার দু চোখ দিয়ে শ্রাবণের ধারা।

“আপনার বৌদির বাপের বাড়ির ঠিকানাটা মনে আছে?”

অবাক হলেও অপালা ঘাড় নাড়লেন তারপর একটা কাগজে ঠিকানাটা লিখে পৃথার হাতে দিলেন। কাগজটার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল পৃথা। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তার চোখমুখ।

***

ছোট দোতলা বাড়ি। জায়গায় জায়গায় রং খসে পড়ে প্রায় হতশ্রী দশা। পাঁচিলের গেট খুলে ভেতরে ঢুকলো পৃথা। বাগান ঝোপঝাড়ে ভর্তি। যত্নের কোনও ছাপই নেই। মূল দরজায় পৌঁছে হতাশ হতে হল তাকে। মস্ত বড় এক তালা ঝুলছে। বাড়ির চারিদিকে একবার ঘুরল পৃথা। সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ। হতাশ পৃথা বাইরে বেরিয়ে গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো। শেষ বারের মতো বাড়িটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কী মনে হতেই পাশের বাড়িতে গিয়ে কলিং বেল বাজলো পৃথা। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দরজা খুললেন।

“আচ্ছা, আপনাদের পাশের বাড়ি মানে সোমেন দত্তদের বাড়িতে এখন কি কেউ থাকেন না?”

“আপনি?” প্লেন ড্রেসে থাকার দরুণ পৃথাকে নিজের আই কার্ড বের করতে হলো।

“কী ব্যাপার?”

“দরকার আছে।”

“ওনারা দুজনেই মারা গেছেন । বাড়িটা বোধহয় বিক্রি হয়ে গেছে। একজন দেখি মাঝে মাঝে আসে।”

এক মুহূর্ত ঠোঁট কামড়ে কী যেন একটা ভাবলো পৃথা, “আচ্ছা, ওনাদের কোনও আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধব কারুর সন্ধান জানা আছে আপনার?”

“সোমেন বাবুর এক ভাইপো স্টেট ব্যাংকে চাকরী করে। কাছেই ব্রাঞ্চটা।”

“ওহ, গ্রেট। আপনি ওনার নাম আর কোন ব্রাঞ্চ একটু বলুন আমাকে।”

হাতটা উল্টে ঘড়ি দেখলো পৃথা সাড়ে পাঁচটা বাজতে যায়। অফিসিয়ালি পাঁচটায় ছুটি হলেও দিনের সমস্ত কাজকর্ম মিটিয়ে ব্যাংক কর্মীদের বেরোতে বেরোতে প্রায় সাড়ে পাঁচটা বেজে যায়। স্পিডে গাড়ি চালিয়ে গেলে এখনও ধরা যাবে। আজ পৃথাকে এর শেষ দেখতেই হবে। তার সিক্সথ সেন্স বলছে তার এত ছোটাছুটি ব্যর্থ হবে না।

***

“এক গ্লাস জল হবে?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ।”

পৃথা প্রায় উর্দ্ধশ্বাসে পিছু নিয়ে সোমেন দত্তর ভাইপো নয়ন দত্তকে ব্যাংকের বাইরে ধরেছে। কথা বলার জন্য নয়ন পৃথাকে বাড়িতেই নিয়ে এসেছেন। পৃথা ঢকঢক করে জলটা শেষ করল। নয়নের স্ত্রীও এসে বসেছেন।

“আপনাকে তো আমি তখনই আমার আসার উদেশ্য জানিয়েছি।” পৃথাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে নয়ন বলে উঠলেন, “দেখুন আজ থেকে আঠারো বছর আগে আমার বোনের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ওই বাড়ির সঙ্গে আমাদের সমস্ত সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। ওরা তো অপলেশ আর নীলের সঙ্গেও আমাদের কোনও যোগাযোগ রাখতে দেয়নি। তাহলে ওদের বাড়ির খুনের ব্যাপারে আপনারা আমাদের কাছে এসেছেন কেন?” নয়ন যথেষ্ট বিরক্ত।

“দেখুন তদন্তের স্বার্থে আমাদের সব রকম সম্ভাবনাই খতিয়ে দেখতে হয়।”

“সব রকম সম্ভাবনা মানে! ও তার মানে আপনার বক্তব্য আমার বোনের গায়ে যখন মিথ্যে কলঙ্ক লাগানো হল আমরা চুপ থাকলাম, আমার বোনকে নিঃস্ব করে তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হল আমরা কিছু করলাম না আর এতদিন পর যখন আমার কাকু-কাকিমাও মারা গেছেন আমরা ওদের খুন করে প্রতিশোধ নিচ্ছি!” রাগে ফুঁসছেন নয়ন।

পৃথা শান্ত কণ্ঠে বলল, “আমি কিন্তু তা বলিনি। আপনি অযথা রাগ করছেন।”

“তুমি একটু শান্ত হও।” পাশ থেকে বললেন নয়নের স্ত্রী।

একটু দম নিয়ে নয়ন একটু শান্ত হয়ে বললেন, “হয়ত আমি ওভার রিয়াকট করে ফেলেছি। আসলে জানেন তো আমরা দুই ভাই আর কাকুর ছিল ওই এক মেয়ে নূপুর, আমাদের সকলের চোখের মণি। ওর এই পরিণতি আমাদের পুরো পরিবারের পক্ষে কতটা যন্ত্রণাদায়ক কেউ বুঝবে না তবে কী জানেন নূপুরের মৃত্যুর সুবিচার তখনই পাইনি। সেনদের ক্ষমতার কাছে হেরে গেছি তো এখন আর। আপনারা হয়ত আমাদের সন্দেহ করছেন তাই বলছি আমার কাকু সাত বছর আগে মারা গেছেন আর কাকিমা ছ মাস আগে। আমার বাবা-মা প্রায় অথর্ব। দাদা বিদেশে থাকে আর ঘোরতর সংসারী মানুষ। আমি বোনের জন্য আজও অন্তরটা হু হু করে কেঁদে উঠলেও খুন করে প্রতিশোধ নেবার মত শারীরিক-মানসিক কোনও ক্ষমতাই আমার নেই।” নয়নের গলাটা যেন ধরে এল।

“আচ্ছা, নয়নবাবু আপনার বোনের সাথে যে ছেলেটির নাম জড়িয়ে...।”

“মারা গেছে। প্রথমত ওই অভিযোগটাই সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এককালে হয়ত সতীশের নূপুরকে একটু আধটু ভালো লেগেছিল কিন্তু নূপুরের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সেসবের ছিটেফোঁটাও আর ছিল না। হিমাচল প্রদেশে বেড়াতে গিয়ে বাস খাদে পড়ে সতীশ আর ওর বউ দুজনেই প্রায় বছর পনের আগে মারা যায়।”

“ওহ।” আবার একটুখানি হতাশা পৃথাকে ঘিরে ধরল।

“সোমেন বাবুর বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেছে তাই না?” সোফা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে পৃথা।

“না তো। ওটা তো এখন...।”

“তুমি থামবে?” নয়ন স্ত্রীকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে পৃথার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হ্যাঁ, বিক্রি হয়ে গেছে।”

***

আজ আমি খুব সাজবো। আমার পছন্দের আসমানী রঙের চুড়িদারটা পরলাম। চোখে সুন্দর করে কাজল লাগাবো। আমি কাজল পরলে আমার নীলাঞ্জন খুব খুশি হত। আজ আর মানুষটা পৃথিবীতেই নেই। তাকে আমি নিজের হাতে…। আমার উপায় ছিল না। আমাকে করতেই হত। আমি না রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ছায়াপথ দেখি। ওই ছায়াপথেরই একটি তারা হয়ে গেছে আমার নীলাঞ্জন। আমার ছবিটাও না আজ আঁকা শেষ হয়ে গেল। আমার স্বপ্নের ছবি। আমার ভালোবাসার ছবি। নাহ, আজ আমার হাতে সময় নেই একদম। খুব ব্যস্ততা আমার। আজই আমার সর্বশেষ লক্ষ্য পূরণ। আজ আর ছুরি নয়। স্পেশাল মানুষের জন্য স্পেশাল ব্যবস্থা। ছোট্ট কালো এই যন্ত্রটা একজন মানুষের যন্ত্রণা শেষ করার জন্য যথেষ্ট।

***

অন্য একটা কেসের ব্যাপারে সারাদিন ব্যস্ত ছিলেন বিক্রমজিৎ। এতক্ষণে একটু ফুরসৎ পেয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে পৃথাকে ফোন করলেন। সেই যে বেরোল মেয়েটা সারাদিন আর কোনও খবর নেই।

“হ্যালো স্যার।”

“কী খবর?”

“আমি একটু টিফিন করছি স্যার। একটু পরেই ঢুকছি।”

“ওকে।”

খানিক পরেই পৃথা ঢুকলো। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখেই বিক্রমজিৎ বুঝলেন সে বেশ হতাশ।

“বল কী খবর?”

“লাভজনক কিছু নয় স্যার।”

“তাও শুনি বল।”

পৃথা তার সারাদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে চলেছে। চোখ বন্ধ করে শুনে চলেছেন বিক্রমজিৎ। শেষের দিকে হঠাৎই সোজা হয়ে বসলেন বিক্রমজিৎ।

“পৃথা, তুমি নূপুরের বাপের বাড়ির চাবি এনেছ?”

“না তো স্যার।”

“ঠিক আছে দরকার নেই। অরুণকে একটা হাতুড়ি নিতে বল।”

“কিন্তু স্যার...।”

“কোনও কথা নয়। ফাস্ট, ভেরি ফাস্ট।”

***

আজকের মরা চাঁদটার মতই দশা করব তোমার। ক্ষয়ে যেতে চাইবে তবুও পারবে না। একটু পরেই তোমাকে একটা কৃষ্ণগহ্বর গ্রাস করবে। তুমি তলিয়ে যাবে তার নিঃসীম অন্ধকারে। আলোয় ফেরার জন্য আর্তনাদ করবে কিন্তু আমি তো তোমাকে ফিরতে দেব না। আজ আমার দিন। কী ভাবছো, তুমি খুব সুরক্ষিত। না গো, না। আজ যে আমি অপ্রতিরোধ্য। পৃথিবীর কোনও শক্তির ক্ষমতা নেই আজ তোমার আমার মধ্যে আসে। তৈরী থাকো। আসছি, আমি আসছি।

***

সুইচ টিপতেই আলো জ্বলে উঠলো।

“বাড়ির ইলেকট্রিক বিল ঠিকঠাক মেটায়।” পৃথার কথায় বিক্রমজিৎ কর্ণপাত করলেন না। অস্থিরভাবে সারা ঘরে ঘুরছেন তিনি। ধুলো, ঝুল, ফাঁদ সাক্ষ্য দিচ্ছে এ বাড়ী বড্ড একলা। কেউ থাকে না তার সাথে। ভেতরের ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে সামান্য হলেও চমকে উঠলেন তাঁরা। দেওয়াল থেকে হাসি ছড়াচ্ছে যে তার মুখটা যে তাঁদের ভীষণ চেনা। তাকে না দেখলেও তাঁর আত্মজ তাঁদের চেনা। নূপুরের মুখটা যেন কেটে বসানো স্বপ্ননীলের মুখে।

“মাতৃমুখী পুত্র নাকি সুখী হয় কিন্তু যে অকালে মা হারা হয় সে?” নিজের মনেই বিড়বিড় করলেন বিক্রমজিৎ। নিচের ঘরগুলো দেখা হয়ে গিয়েছিল। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন দোতলায়। দোতলার পূর্ব দিকের ঘরে পৌঁছে বিক্রমজিৎ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর পুলিশি অনুমান মিথ্যে নয় কিন্তু মিথ্যে হলেই বোধহয় মানুষ বিক্রমজিৎ খুশি হতেন।

এই ঘরে যে মানুষের যাতায়াত আছে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। ঘরের সাজ-সজ্জা বলে দিচ্ছে এটাই হতভাগিনী নূপুরের কামরা ছিল এককালে। এত বছরেও তার ঘরটা একই রকম আছে। হয়ত মেয়ের স্মৃতি এভাবেই আগলে রেখেছিলেন তার হতভাগ্য পিতা-মাতা। আলমারীর তাকে নূপুরের ডায়েরীরা তার সুখ-দুঃখ, মান-অভিমান নিয়ে শুয়ে আছে। একটা ডায়েরী হাতে নিয়ে খুললেন বিক্রমজিৎ।

“পূর্ণিমার দিন যখন আকাশের গোল থালার মত চাঁদটা থেকে জোৎস্না চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে…।”

তার রং বেরঙের শাড়ি, চুড়িদারগুলো আপন মনে ঝুলছে। ড্রেসিং টেবিলে লিপস্টিক, কাজল। চারিদিকে ছড়ানো মলিন হয়ে যাওয়া অনেক ছবির মাঝে একটা নতুন ক্যানভাস আর তাতে একটা সুখী পরিবার, মা-বাবা আর তাদের কোলে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে একটি শিশু। এ ছবি যেন ছবি নয় একটা স্বপ্ন।

“স্যার।”

“তাড়াতাড়ি খোঁজো। আমার মন বলছে মার্ডার ওয়েপন এ ঘরেই পেয়ে যাবো।”

বিক্রমজিতের অনুমান অব্যর্থ। আলমারীর লকার থেকে আবিষ্কৃত হল রক্ত ছোপানো ছুরিগুলো। আর আলমারীর মধ্যেই এক বাক্স বিভিন্ন রকমের পায়েল।

“স্যার, আমি তো ভাবতেই পারছি না!”

“আর ভাবার সময় নেই পৃথা। আশা করি নেক্সট টার্গেট কে বুঝতে পারছ। বাঁচাতে হবে তাকে।”

***

কুকুরটা তারস্বরে চিৎকার করছে। ওকে চুপ করানোর মন্ত্র আমার জানা আছে কিন্তু দারোয়ানটা এদিকে আসছে। ওকে সামলাতেই হবে। তৈরি হলাম আমি। পারতে আমাকে হবেই।

“কে? কে?”

ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি। তীব্র ক্লোরোফর্মে ভেজা রুমালটা ঠেসে ধরলাম ওর নাকে। প্রবলভাবে ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল। দ্রুত গতিতে ওর হাত-পা বেঁধে ফেললাম। কুকুরটা ছুটে আসছে। ও আমার কাছে পৌঁছনোর আগেই কাজ সারতে হবে। ঘড়ির কাঁটা ছুটছে। আমার হাতে সময় খুব কম। আমি এগোলাম কুকুরটা ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর কিন্তু আমি ওর সাথে লড়াই করলাম না। ওকে আদর করতে লাগলাম। ভালোবাসার দাম মানুষের কাছে না থাকতে পারে কিন্তু পশুদের কাছে আছে। ও আমাকে ছেড়ে দিল। আমি আমার লক্ষ্যের দিকে আরেক কদম এগিয়ে গেলাম। পেছন দিকে চলে এলাম।

***

“কী বলল কমলা?”

“স্যার, এই মুহূর্তে ওবাড়িতে কেউ নেই। সোমলতা মেয়ের বাড়িতে। আজ অপালার মেয়ে বাড়ি আসছে তাই গিয়েছেন।”

“আর স্বপ্ননীল?”

“বাড়িতে নেই।”

“সোমলতাকে ফোন কর। হার লাইফ ইজ ইন ডেঞ্জার।”

“হুঁ।”

বাহ, সেফ ল্যান্ডিং। এবাড়ীর ডিজাইনটা সত্যিই দারুণ! কী সুন্দর ব্যালকনিতে উঠে এলাম। নীচের তলায় টিভি দেখতে ব্যস্ত কাজের লোকেরা টেরই পেল না। সত্যিই ভাগ্য আজ আমার সঙ্গে। সোমলতা সেনের নিয়তি আজ শুধু আমার হাতে, শুধু আমার। কত সহজে পৌঁছে গেলাম সোমলতা সেনের ঘরের সামনে। গুরুদেবের ছবির সামনে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করছে! কী দুর্দিন এল তোমার সোমলতা সেন! রাত সাড়ে দশটার সময় না ঘুমিয়ে প্রার্থনা করছ! শ্বাপদের গতিতে এগিয়ে গেলাম আমি। ক্লোরোফর্মে গন্ধ মাখা রুমালটা অচিরেই সোমলতাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। এবার বাকি কাজ।

***

“স্যার, ফোন কেটে দিলেন সোমলতা।”

“সোমলতা নিজেই কাটলেন তো? পৃথা কুইক অপালাকে ফোন কর।”

“ওকে, স্যার।”

“স্যার, ফোন লাগছে না।”

“ট্রাই এগেইন এন্ড এগেইন। পৃথা আর্জেন্সিটা বুঝতে পারছ?” উত্তেজিত বিক্রমজিৎ।

“অরুণ, স্পীড বাড়াও আরো।”

পৃথা বার কয়েক চেষ্টার পর অপালা ফোন ধরলেন। কথা শেষ করল পৃথা।

“স্যার, অপালার হ্যাজব্যান্ডকে ব্যবসার কাজে বাইরে যেতে হয়েছে আর অপালা মেয়েকে আনতে স্টেশনে গেছেন, মেয়ের ট্রেন লেট তাই দেরী হচ্ছে। ওনার বাড়িতে দুজন কাজের লোক আছে আর ওনার শ্বশুর মশাই আছেন তবে তিনি বিছানায় শয্যাশায়ী। ওদের বাড়িতে দারোয়ান আছে।”

“দারোয়ান, শেষের কবিতাতেও ছিল।”

“একটা ভালো কথা স্যার, ওদের বাড়িতে কুকুর আছে।”

“বোকার মতো কথা বোলো না পৃথা। কুকুর তাকে আটকাতে পারবে?” ধমকে উঠলেন বিক্রমজিৎ। পৃথারও মনে হল সত্যিই তো সে বোকার মতো কথাটা বলেছে।

***

“উঁ উঁ।” এক মগ জল এসে আছড়ে পড়লো সোমলতার চোখে-মুখে। হালকা ক্লোরোফর্মের প্রভাব কেটে আচ্ছন্ন ভাবে চোখ মেলে তাকালেন সোমলতা। পর মুহূর্তেই আঁতকে উঠলেন। একটা চেয়ারের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা তিনি। রুনঝুন, রুনঝুন শব্দটা সোমলতাকে সামনে তাকাতে বাধ্য করল। ঘরের মধ্যে শুধু মাত্র একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বলছিল। সোমলতার আচ্ছন্নতা পুরোপুরি কাটেনি। ঝাপসা দৃষ্টিতে আলো-আঁধারীর মধ্যে দাঁড়ানো অবয়বটা দেখে তাঁর শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতলদেহ সরীসৃপ কিলবিল করে নেমে গেল। মাথায় ওড়না ঢাকা থাকলেও চিনতে অসুবিধা হল না। এই অবয়বটা তো পৃথিবীর ক্যানভাস থেকে বহু বছর আগেই মুছে গেছে। নিজের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে তার ভালোবাসার মানুষের দেওয়া লাল সিল্কের শাড়ীটাই সে তার শেষ যাত্রায় নিজের গলায় বেঁধেছিল। অস্ফুট একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল সোমলতার গলা থেকে। সারা শরীর কাঁপছে সোমলতার। আপু অনেক বলেছিল সর্বক্ষণ একজন কাজের লোককে তাঁর কাছে রাখতে। তিনিই জীদ করে মেয়েটাকে নিচে পাঠিয়ে দিলেন।

“এ কী! সোমলতা সেন ভয়ে কাঁপছে! সোমলতা সেন তো শুধু অন্যকে কষ্ট দিতে পারে। নিজে কষ্ট পায় নাকি? কী সোমলতা সেন কেমন লাগছে এই অসহায়তা?”

“ত-তুমি কে?”

“আচ্ছা আমাকে চিনতে পারছেন না? না পারারই কথা। আমি সামান্য মেয়ে, আপনার মত দামী, অভিজাত মহিলা আমাকে আবার চিনতে পারেন! আচ্ছা, আমি আপনার একটা ইন্টারভিউ নিই। কেমন? বলুন, নিজের স্বামীর মৃতদেহ দেখে কেমন লেগেছিল আপনার? বুকটা কি একটু চিনচিন করছিল? আমার না খুব কষ্ট হয়েছিল। বুকটা রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল যখন আপনি আমাকে আমার ভালোবাসার মানুষটার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। আর আপনার ছেলের দেহটা দেখে কেমন লাগছিল? আপনার মাতৃহৃদয় কি একটুও কেঁদেছিল? আমি কাঁদতাম, রোজ কাঁদতাম আমার সন্তানকে একবার চোখের দেখা দেখার জন্য। আমার নীল, আমার স্বপ্ন, আমার নাড়িছেঁড়া ধন, আমার বুকের পাঁজর তাকেও আমার থেকে কেড়ে নিলেন। সেদিন আমি হেরে গেছলাম--- আমার সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষগুলোকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন কিন্তু দেখুন আজ আমি এক এক করে আপনার সব প্রিয় মানুষগুলোকে আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছি।” কথা বলতে বলতে সে এগিয়ে আসছে সোমলতার দিকে। সোমলতার আচ্ছন্ন ভাবটাও উধাও হয়ে গেছে আতঙ্কে। সে এসে দাঁড়ালো টেবিল ল্যাম্পের আলোক বৃত্তের মধ্যে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে সোমলতা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। কিছু বলতে চাইলেন কিন্তু চরম বিস্ময়ে মুখ দিয়ে একটা শব্দও বাইরে এল না।

***

“স্যার, অপালা ফোন করছেন।”

“তাড়াতাড়ি ধর।”

অপালার সাথে কথা শেষ করে পৃথা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, “স্যার, অপালাদের, দোতলায় ওঠার মুখে একটা দরজা আছে। সেটা কেউ লাগিয়ে দিয়েছে। কাজের লোকেরা সোমলতার কাছে পৌঁছতে পারছে না।”

“ওহ, শিট। সোমলতার কিছু হলে সেটা আমাদের চরম ব্যর্থতা হবে পৃথা।”

“আমার না পুরো ব্যাপারটা এখনও যেন ধোঁয়াশা লাগছে ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।”

“অবিশ্বাসের তো কিছু নেই পৃথা। প্রথমত মানুষের মনের অলিগলি অনেক রহস্য, অনেক গোলকধাঁধায় ভরা। তার সঠিক হদিস সবসময় পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, পৃথিবীতে একটাই সম্পর্ক আছে মানুষের সৃষ্টি থেকে যার উৎপত্তি, মা আর সন্তানের সম্পর্ক। ঠাকুমা জোর করে মায়ের থেকে দূরে রাখলেও স্বপ্ননীল প্রতি মুহূর্তে মাকে কাছে চেয়েছে। তার চেহারা অবিকল তার মায়ের মত আর স্বভাব বাবার মত। অপলেশের মত জোর গলায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা বা সাহস কোনটাই নেই। অত্যন্ত চাপা স্বভাবের সে। মায়ের মৃত্যু তার মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে কিন্তু সেই রক্তক্ষরণ সে বাইরে প্রকাশ করেনি। এত বছর নিজের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল। ঠাকুমার প্রতাপে বেশি যাওয়ার সুযোগ না পেলেও মামাবাড়ির সকলকে সে খুব ভালোবাসতো কিন্তু তার মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকেও ভুলে যেতে হয় তাকে। এদিকে তার মামা নয়নবাবু সত্যিই অত্যন্ত ভালো মানুষ। কাকা-কাকিমার সম্পত্তিতে কোনও রকম লোভ না করে একলা, অসহায় অসুস্থ কাকিমার সেবাই শুধু করেননি, মৃত্যু পথযাত্রী মানুষটাকে একটু শান্তি দেবার জন্য গোপনে ফেসবুকের মাধ্যমে স্বপ্ননীলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তোমাকেই তো নয়নবাবু সব বলেছেন। এদিকে স্বপ্ননীলও পড়া শেষ করে ফিরে আসে। আবার সে তার হারানো শৈশব, তার মায়ের সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষগুলোর দেখা পায়। গোপনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। তোমাকেই তো নয়ন বাবু বলেছেন যে তার দিদা মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত সে তার দিদার কাছে মায়ের ছেলেবেলার গল্প শুনত। এখনও মাঝে মাঝে নয়নবাবুদের বাড়িতে যায় তার মায়ের গল্প শোনে। এরই সঙ্গে আরেকটা ব্যাপার ঘটে, তার দিদা মারা যাওয়ার আগে তাকে বাড়ির চাবি দিয়ে যান। আইনত সেই তো এখন মালিক। স্বপ্ননীল নতুন করে আরও গভীর ভাবে তার মায়ের স্মৃতিতে ডুবে যেতে লাগলো। তার মায়ের ডায়েরিগুলো তার মায়ের সঙ্গে হওয়া সমস্ত অত্যাচারের সাথে তার পরিচয় ঘটায়। মায়ের ভালোলাগা, ভালোবাসা, সমস্ত অনুভূতি গভীর ভাবে ছুঁয়ে যেতে থাকে তাকে। ওই ঘরটা তো দেখলে এখনও নূপুরের স্মৃতি জড়ানো আছে।”

“কিন্তু স্যার, পায়েল, মহিলা...।”

হাত তুলে পৃথাকে থামালেন বিক্রমজিৎ।

“বলছি, আমি বেরোবার আগেই আমার এক মনোবিদ বন্ধুকে ফোন করে সংক্ষিপ্তভাবে সব জানিয়েছিলাম। আমি স্বপ্ননীলকে সন্দেহ করছি একথাও জানিয়েছিলাম। সেই বন্ধু মেল করেছে। তার বক্তব্য স্বপ্ননীলের শিশুমনে ওর মায়ের অভাব, মায়ের মৃত্যু গভীর প্রভাব ফেলেছিল। এত বছর নিজের ভেতরে গুমরে কেঁদেছে সে। তারপর যখন ওর হাতে আসে মায়ের ব্যবহৃত জিনিস পত্র, ও সেইসব ঘাঁটতে থাকে। এবার দিনের পর দিন মায়ের ঘরে মায়ের ডায়রি, মায়ের জিনিসপত্র সব কিছু ওর মধ্যে এক দ্বৈত সত্তার সৃষ্টি করেছে। সেই সত্তাই আপাত শান্ত ছেলটিকে দিয়ে তার মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়াচ্ছে। স্বপ্ননীলের আঁকা ছবিটা দেখলে তো ওর বাবা-মা আর ও। ওর অধরা স্বপ্নের ছবি। শুধু মায়ের মুখ নয় মায়ের মত আঁকার হাতও পেয়েছে ছেলেটা।” একটু থেমে বিক্রমজিৎ বললেন, “এ সমস্তই অনুমানের কথা। সবকিছু মিলিয়ে আমি এই গল্পটা খাড়া করেছি। স্বপ্ননীলকে হাতেনাতে ধরতে পারলেই সব রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে পৃথা। কুকুরের কথা বলছিলে না? অপালার বাড়ির কুকুর তো স্বপ্ননীলকে চেনে। কুকুর মানুষের গন্ধ চেনে। স্বপ্ননীল অন্য গেটআপে থাকলেও ওর গন্ধ তো ওরা চেনে। স্বপ্ননীল ওকে ম্যানেজ করে ফেলবে বলেই আমার ধারণা।”

“কিন্তু স্যার, খুনগুলো স্বপ্ননীল করল কী করে আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”

“তোমার মনে আছে কৌশিক বলেছিল একটা অন্য ধরনের স্কুটি দেখেছিল?”

“হুম।”

“সেন বাড়ির ছোট গ্যারেজে নতুন একটা ইলেকট্রনিক স্কুটি দেখেছি। এই ধরনের স্কুটির আওয়াজ ভীষণ কম। আমার ধারণা স্বপ্ননীল ওটা ব্যবহার করে। প্রভাদেবীর ড্রয়ারে আমি ঘুমের ওষুধ দেখেছি। আমার ধারণা উনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোতেন। তাই সেই রাতে ওনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাবা-দাদুর খুন দুটো করে স্বপ্ননীল। একটা ব্যাপার পৃথা, সেন বাড়ি, প্রভাদেবীর বাড়ি আর স্বপ্ননীলের মামাবাড়ি তিনটে জায়গার দূরত্ব এমন কিছু বেশি নয়। স্কুটি ব্যবহার করে যাতায়াত এমন কিছু কঠিন নয়। আর প্রথম খুনের ক্ষেত্রে সারারাত হাতে পেয়েছে স্বপ্ননীল। আর প্রভাদেবীর খুন তো ভর সন্ধ্যেবেলায় করেছে।”

পৃথার বুকটা হঠাৎ করে স্বপ্ননীলের জন্য মুচড়ে উঠলো।

“এসে গেছি স্যার।” গাড়ি থামালো অরুণ।

***

“দাদুভাই! তুমি!”

“সোমলতা সেন, একটা বাচ্চা কি একসাথে মা-ঠাকুমার আদর, ভালোবাসা পেতে পারে না? আমাকে আপনি মেনে নিতে পারেনি অথচ আমরা গর্ভের সন্তান হয়ে উঠলো আপনার বংশের বাতি! তাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলেন নিজের হাতে, নিজের মতো মানুষ করবেন বলে। আমি আপনার চোখের বালি অথচ আমার সন্তান নাকি আপনার সবচেয়ে দুর্বল জায়গা!”

“তুমি এসব কী বলছ? এসব কী করছ? কেন করছ? তুমি কি আমাকেও খুন করবে?” সোমলতা পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলেন।

“আমি আপনাকে খুন করব না সোমলতা সেন। আপনি যেমন আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছিলেন। আমার ভালোবাসার মানুষগুলোকে কেড়ে নিয়েছিলেন তেমনি আমি আপনার ভালোবাসার মানুষগুলোকে আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছি। আজ আপনার সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে স্নেহের মানুষটাকে চিরদিনের মতো আপনার কাছ থেকে কেড়ে নেব।”

“কী যা তা বলছ তুমি?”

“অপলেশকে খুন করতে যেমন কষ্ট হয়েছিল তেমনি আমার নীলকে খুন করতেও আমার খুব কষ্ট হবে কিন্তু তাও আমি করব। আপনার কাছ থেকে আমি সব কেড়ে নেব।”

“কী যা তা বলছ! দাদুভাই তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?” সোমলতা নিজের বাঁধন খোলার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে চলেন।

“পাগল? হ্যাঁ, আমি পাগল। যার সব কিছু শেষ হয়ে যায় সে পাগলই হয়ে যায়। আমি হয়েছিলাম, আপনিও হবেন। আচ্ছা, আমার নীল কোথায়? তাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন আপনি?”

“দাদুভাই আমার কথা শোনো।” কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন সোমলতা।

“তোমার হাতে ওটা কী? ওটা তো তোমার দাদুর পিস্তল!”

“এটাই তো আজ আমি ব্যবহার করব। বলুন আমার নীল কোথায়?”

“দাদুভাই, তুমি কেন এমন মেয়ের মত সেজেছ? কীসব বলছ আ-আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। তোমার কী হয়েছে দাদুভাই?” সোমলতার কথায় কর্ণপাতও করছে না সে।

“ধুর, আমি কী বোকা! নীলকে আমি কোথায় খুঁজছি। সন্তান তো থাকে মায়ের বুকে, মায়ের অস্তিত্বে মিশে।”

“না, দাদুভাই না আ আ আ।” সোমলতার আর্তনাদ সারা বাড়িময় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

একই সাথে দুটো আওয়াজ হলো। ঘরের দরজা ভেঙ্গে ঢুকলেন বিক্রমজিৎরা আর একজনের তর্জনী টেনে ধরল পিস্তলের ট্রিগার।

সোমলতা নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে আছেন মেঝের দিকে যেখানে তাঁর সবচেয়ে আদরের মানুষটা, তাঁর দাদুভাইয়ের নিঃস্পন্দ শরীরটা শুয়ে আছে।