কেন লাভক্র্যাফট পড়ব - বিশ্বদীপ দে

প্রবন্ধ

১৯৩৭ সালের ১৫ মার্চ। অন্ত্রের ক্যানসার ও কিডনির অসুখে ভুগে মারা যাচ্ছেন হাওয়ার্ড ফিলিপস লাভক্র্যাফট। সেদিন হাসপাতালের বিছানায় অসহায় ও নিঃসঙ্গ (যেমনটা সব মানুষকেই হতে হয় মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে) লাভক্র্যাফট কি ভাবতে পেরেছিলেন তাঁর মৃত্যুর আশি বছর পরেও তাঁকে নিয়ে চর্চা হবে সারা বিশ্ব জুড়ে? তিনি হয়ে উঠবেন পপ সংস্কৃতির এক অনিবার্য মুখ?

এত বছর পেরিয়ে গিয়েছে। পৃথিবী বদলে গিয়েছে আমূল। তবু আজও তাঁর লেখা পড়তে শুরু করলে মনের মধ্যে জেগে উঠতে থাকে এক ভিন্নতর দুনিয়ার আহ্বান। মানুষ তার অবস্থান বদলে ঝলমলে নক্ষত্রের রাতের নীচে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। নক্ষত্র থেকে নক্ষত্র বেয়ে ভেসে বেড়াতে থাকে এক মহাজাগতিক সুর। আর কসমসের অসীম বিস্তারের সঙ্গে যোগসূত্র বুনতে থাকে। জীবন, বেঁচে থাকা ক্রমে প্রসারিত হয়ে স্থান-কালের সীমারেখা পেরিয়ে এক দূরবর্তী চেতনায় লীন হয়ে যেতে থাকে।

বেঁচে থাকার সময় সাহিত্য জগতের মূল ধারা তাঁকে পাত্তা দেয়নি একেবারেই। কেবল শখের সাংবাদিকতা ও পাল্প ফিকশনের জগতে খানিক নামডাক হয়েছিল মাত্র। অথচ তাঁর মৃত্যুর পর কল্পবিজ্ঞান ও হরর সাহিত্যের দুনিয়ায় তো বটেই, ধীরে ধীরে পপুলার সংস্কৃতিরও অঙ্গ হয়ে পড়েন লাভক্র্যাফট। সিনেমা, টিভি, কমিক্স, গেমস হয়ে ক্রমশ বেড়েই চলেছে ব্র্যান্ড লাভক্র্যাফটের চাহিদা। কিন্তু এসবের আড়ালে রয়েছে লাভক্র্যাফটের রচনার আসল পাঠক। যাঁরা আজও সময়ে অসময়ে দ্বারস্থ হন তাঁর। নতুন কোনও লেখকের বই না খুলে বইয়ের তাক থেকে নামিয়ে পড়তে বসেন কবেকার এক মানুষের রেখে যাওয়া রচনাসম্ভার। কিন্তু কোন জাদুতে? কেনই বা আজও নতুন এক পাঠক হাতে তুলে নেবেন লাভক্র্যাফটের বই? কেন পড়ছি, কেন পড়ব আমরা তাঁর লেখা?

একটা উত্তর দেওয়া যাক। বাংলা ভাষায় প্রথম লাভক্র্যাফট অনুবাদ করেছিলেন অদ্রীশ বর্ধন। ‘কেস অফ চার্লস ডেক্সটার ওয়ার্ড’। কিংবদন্তি সাহিত্যিকের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। সেই বইয়ের শুরুতে লেখক সম্পর্কে ছোট্ট একটি রচনাও লেখেন অনুবাদক। আর সেই লেখার একেবারে শেষে এসে তিনি জানান, ‘‘লাভক্র্যাফট পাঠকের মন ছুঁয়ে যায় জমিয়ে আনন্দ দিতে পারেন বলেই। সব পপুলার ফিকশন কিন্তু এই কষ্টিপাথরে যাচাই হয়, তাই নয় কি?’’

এ বই কিশোরবেলায় পড়া। সেই সময় ওঁর অন্য রচনা পড়ার প্রশ্নই নেই। পরে বড় হয়ে দেখি গুগলে পুরো রচনাসমগ্রই রয়েছে। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখেছি, হোঁচট খেতে খেতে পড়তে হচ্ছে। দু’লাইন পড়ার পর থমকে গিয়ে আবার আগের চার লাইন পড়া। বিশেষণ, বিশেষণের বিশেষণ, টানা চলতে থাকা বাক্য— এক কথায় পাঠককে যেন টেনে এনে এক ঘূর্ণির মধ্যে ফেলে দেওয়া। তখন অদ্রীশের ওই লাইনগুলোর কথা মনে পড়েছিল। আর মনে হয়েছিল, কই আমি তো আনন্দ পেতে পারছি না।

ক্রমে সময় যায়। বেছে বেছে তাঁর ছোট লেখা পড়ি। যাতে বেশিক্ষণ শব্দের জাগলারির মধ্যে না থাকতে হয়। তারপর আস্তে আস্তে রসাস্বাদন শুরু। আর মুগ্ধ হওয়াও। এই কয়েক বছরের পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, তাঁর লেখাপাঠে যে আনন্দ লাভের কথা লিখেছিলেন অদ্রীশ বর্ধন তা আসলে সময়সাপেক্ষ। লাভক্র্যাফট পড়বারও একটা অনুশীলন আছে। ধীরে ধীরে সেটা আয়ত্ত করতে হবে পাঠককে। আর একবার তাঁর অদ্ভুত রচনাশৈলীর সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করলে তখন ব্যাপারটা বদলে যেতে থাকে। মনে হয়, এই যে বিশেষণের ছড়াছড়ি, বহু লেখার মধ্যে একটা কুয়াশা জড়ানো— এসবই তাঁর লেখার মধ্যে ছড়িয়ে রাখা আসল মণিমুক্তো।

তবে লাভক্র্যাফটের লেখা সম্পর্কে একটা বড় অভিযোগ, তাঁর লেখার স্টাইল বড় একঘেয়ে। ফ্র্যাঙ্ক এইচ উডওয়ার্ড পরিচালিত ‘লাভক্র্যাফট: ফিয়ার অফ দ্য আননোন’ তথ্যচিত্রটির কথা মনে পড়ল। সেখানে বহু বিখ্যাত মানুষদের লাভক্র্যাফট সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে। তারই মধ্যে বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক নিল গেইম্যান এক জায়গায় বলেছেন, কেউ যদি প্রথমবার লাভক্র্যাফট পড়তে বসেন, তাঁকে শিখে নিতে হবে পড়ার কৌশল। কেননা সেই অর্থে লাভক্র্যাফটের ভাষা কোনও ভাবেই আধুনিক নয়। যে কোনও লাভক্র্যাফট-অনুগত পাঠকই গেইম্যান সাহেবের এই কথার সঙ্গে একমত হবেন।

আরও একটা ব্যাপার। লাভক্র্যাফটের অধিকাংশ রচনাই প্রথম পুরুষে। যেন উন্মত্ততার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠায় ছটফট করতে করতে কেউ লিখছেন তাঁর কাহিনি। মানুষ যখন সেই রকম অবস্থায় পড়ে, তার মধ্যে একটা ঘোর কাজ করে। আর ঘোরের মধ্যে চেনা দুনিয়ার সামান্যতম শব্দ, চিরচেনা দৃশ্যও হয়ে উঠতে থাকে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। সবকিছুতেই সে খুঁজে পায় গোপনীয়তার অনুপম সঙ্কেত। এই অবস্থায় সত্যিই সে কিছু লিখলে বা বললে সেটাও চেনা গদ্যের স্টিরিওটাইপকে ছেড়ে অন্যতর হয়ে উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক।

অন্য মহৎ লেখকদের মতোই লাভক্র্যাফটের লেখাতেও ছিল সেই অমোঘ দর্শন, যা শেষ পর্যন্ত কালকে জয় করে চিরকালীন হয়ে উঠতে পারে। তাঁর কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে আবেগ, তার নাম ভয়। এবং তার পাশাপাশি যে জিনিসটা চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকে পড়তে থাকে তা হল বিষাদ। তাঁর সমস্ত ভয়ের মধ্যেই এই বিষাদও অনিবার্য ভাবে ঢুকে পড়েছে।

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁর লেখায় লিখেছিলেন, ‘‘আমি ও আমার গল্প একই।’’ লাভক্র্যাফট তেমন কিছু কোথাও লিখেছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু তাঁর লেখার মধ্যেও তাঁর জীবন ছায়া ফেলে গিয়েছে। কিশোর বয়সে পৌঁছে বারবার আঘাত পেতে পেতে এমন অবস্থা হয়েছিল আত্মহননের চিন্তা ঘুরতে শুরু করেছিল মাথার মধ্যে। তিন বছর বয়সে বাবা অপ্রকৃতস্থ হয়ে গেলেন। মারাও গেলেন কয়েক বছর পরে। এখন পরিষ্কার যে, তাঁর সিফিলিস হয়েছিল। কিন্তু সেই সময় সেই অসুখের কোনও চিকিৎসা ছি‌ল না। তিনি পাগল হয়ে গেলেন। জীবনের শেষ পাঁচ বছর কাটল পাগলাগারদে। সেই ঘটনার কুড়ি বছর পরে লাভক্র্যাফটের মাকেও সেখানে ভর্তি হতে হয়েছিল। কিন্তু লাভক্র্যাফটকে সবথেকে বড় আঘাত দিয়েছি‌ল শিল্পপতি দাদুর মৃত্যু। তাঁর মৃত্যুর পরে ৪৫৪ অ্যাঞ্জেল স্ট্রিটের বিশাল বাড়ি ছেড়ে উঠে আসতে হল ৫৯৮ অ্যাঞ্জেল স্ট্রিটের একটা ছোট বাড়িতে। সেটার সঙ্গে আগের বাড়িটার তুলনাই হয় না। আগের বাড়ির বিরাট লাইব্রেরিতে নানা বিষয়ের বই পড়ে পড়ে সময় কাটত তাঁর। নতুন বাড়িটা ওই এলাকাতেই। কিন্তু তাঁর কাছে মনে হয়েছিল সুদূর! জীবনটাও বদলে গেল আমূল। দারিদ্র এসে দাঁড়িয়েছিল ঘরের কোণে। সাইকেল চালিয়ে বহু দূর চলে যেতেন কিশোর লাভক্র্যাফট। ব্যারিংটন নদীর স্থির ও গভীর জলের দিকে তাকিয়ে সেই বিষণ্ণ কিশোরের মনে হয়েছিল জীবনটাকে এবার শেষ করে দিলেই হয়!

১৯০৪ সাল থেকে একেবারে একলা হয়ে যান তিনি। মায়ের সঙ্গে সম্পর্কও একেবারে তিক্ত হয়ে উঠেছে। অনটন তখন চেপে বসেছে সংসারের ভরকেন্দ্রে। নিজের ছেলের মুখ মায়ের কাছে ‘অশুভ’ বলে মনে হত। সেই সময় লাভক্র্যাফট হয়ে পড়েছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ। বছর কয়েক চলার পর ধীরে ধীরে শখের সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ করেন তিনি। ধীরে ধীরে আবার খানিক স্বাভাবিক জীবনে ফেরেন। কিন্তু কৈশোর ও তারুণ্যের ওই বছরগুলোর কালো ছায়া তাঁর বাকি জীবনে গাঢ় ছাপ ফেলে গেছে। ‘আউটসাইডার’ কাহিনিতে যেন সেই জীবনই উঠে আসে। এই গল্পের কথক এমন একজন যে বছরের পর বছর পৃথিবীর আলো দেখেনি। এক অন্ধকার দুর্গের মধ্যে কেটে গিয়েছে দীর্ঘ দীর্ঘ সময়। তারপর একদিন সে বেরিয়ে পড়ল রোদ্দুর-হাওয়াময় জীবনের আঙিনায়। কিন্তু সেই পৃথিবীতে কেউ তাঁকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। তাঁদের সকলের কাছে সে এক এলিয়েন। মানুষের পৃথিবীতে এক বিকট দানব।

হয়তো এই বিচ্ছিন্নতাই তাঁকে কসমসের কথা ভাবিয়েছে। মানব জীবনকে আতস কাচের তলায় না রেখে তিনি তাঁর দূরবিন তাক করেন আরও দূরে। সময়-স্থান ব্যতিরেকে মহাশূন্যের অসীম বিস্তারের দিকে।

অথচ জীবনের সামান্য সময়ই তিনি কাটিয়েছেন প্রভিডেন্সের বাইরে। তাঁর কবরেও লেখা ‘আই অ্যাম প্রভিডেন্স’। এ এক আশ্চর্য প্যারাডক্স। নিজের স্থানিক অবস্থান আঁকড়ে থাকা এক মানুষ নিজের চেতনাকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ব্রহ্মাণ্ডের সুদূর কোণে। আসলে ‘সাধারণ মানুষে’র সঙ্গে সংযোগবিহীন লাভক্র্যাফট বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর লেখার বিষয় তাঁরা হতে পারেন না। ‘ডিফেন্স রিমেইনস ওপেন’ প্রবন্ধে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘‘আমি ‘সাধারণ মানুষে’র কথা লিখতে পারি না কেননা আমি তাদের ব্যাপারে সামান্যতম আগ্রহীও নই। আগ্রহ ছাড়া কোনও শিল্প হতে পারে না। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক আমার কল্পনাকে আকর্ষণ করে না। করে মানুষের সঙ্গে কসমসের সম্পর্ক— অজানার সঙ্গে । যেটা একাই আমার মধ্যে সৃজনশীল কল্পনার স্ফুলিঙ্গ জাগিয়ে তোলে। মানবকেন্দ্রিক গদ্য আমার পক্ষে অসম্ভব। কেননা আমি সেই আদিম মায়োপিয়া অর্জন করতে পারিনি যা পৃথিবীটাকেই বিরাট করে দেখায় কিন্তু তার পশ্চাদপটকে অবহেলা করে।’’

১৯২৬ সালে তিনি লেখেন ‘দ্য কল অফ খথুলু’। যা পরবর্তী সময়ে জন্ম দেবে ‘খথুলু মিথোজ’-এর। খথুলু এক অতিজাগতিক মহা-অস্তিত্ব। মানবসভ্যতার চেয়ে তার বয়স ঢের ঢের বেশি। আক্ষরিক অর্থেই রাজা মান্ধাতাও তার কাছে সেদিনের ছোকরা। যার নামটা পর্যন্ত আমাদের জিভ উচ্চারণ করতে পারে না। সে এক অনন্ত নিদ্রায় নিমজ্জিত। কিন্তু একবার যে জেগে উঠলে যে নিতান্ত অবহেলায় গুঁড়িয়ে দিতে পারে গোটা মানবসভ্যতাকে। এই যে মানুষের পৃথিবীর নাগালের বাইরের এক মহাচেতনার কল্পনা তাঁকে অনুপ্রাণিত, বলা যায় তাড়িতও হয়তো করেছে, সেই কল্পনা আসলে কসমসের সঙ্গে যুক্ত হতে চাওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন। লাভক্র্যাফটের সেই কল্পনার জোর এত বেশি যে তার মধ্যে ডুবে গিয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। কেবল পাঠক নয়। লেখকও। তাঁরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ‘খথুলু মিথোজ’-কে। আর কালক্রমে লাভক্র্যাফট হয়ে উঠছেন এক রহস্যময় চরিত্র। যিনি পৃথিবীর বুকে লুকিয়ে থাকা এক প্রাচীন রহস্যের সন্ধান জেনে গিয়েছেন।

‘নেক্রোনমিকন’ নামক এক আশ্চর্য গ্রন্থের খোঁজ পেয়েছেন তিনি। লাভক্র্যাফট নিজে জানিয়ে গিয়েছেন, এই নাম তিনি স্বপ্নে পেয়েছেন। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত ‘দ্য হাউন্ড’ গ্রন্থে প্রথম উল্লেখ মেলে এই বইয়ের। মহাজগতের সব রহস্য লুকিয়ে আরবি ভাষায় লিখিত এই বইয়ের মধ্যে। যে বই পুরোটা আজ পর্যন্ত কেউই চাক্ষুষ করেনি। এই বইয়ের এক কাল্পনিক ইতিহাস লিখে ফেলেছিলেন লাভক্র্যাফট। ক্রমে বহু মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে দেন এই বই সত্যিই আছে!

আর এভাবেই নিজের সৃষ্টির সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছেন লাভক্র্যাফট। বহু মানুষের চোখে হয়ে উঠেছেন অতিপ্রাকৃত চর্চাকারী!

২০১২ সাল থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করা জাপানি মাঙ্গা ও অ্যানিমে ‘বাঙ্গো স্ট্রে ডগস’-এ একটি চরিত্রের নাম হাওয়ার্ড ফিলিপস লাভক্র্যাফট। সেই চরিত্রের ‘সুপার পাওয়ার’ হল সে ন‌িজেকে অক্টোপাস-সদৃশ এক মনস্টারে পরিণত করতে পারে। ‘খথুলু মিথোজ’-এর ছায়ায় এইভাবে স্রষ্টা নিজেই হয়ে উঠেছেন এক অতিজাগতিক প্রাণী!

এ এক ট্র্যাজেডিই বটে। খ্যাতি থেকে অতি-খ্যাতির আবহে আজও তিনি অতি-জীবিত। আর সেই বেঁচে থাকার আড়ালে রয়ে গিয়েছে তাঁর অমোঘ দর্শন। তাঁর রচনার ‘বিটুইন দ্য লাইনস’-এ থেকে যাওয়া অকথিত সেই দর্শনকে বুঝতে তাই তাঁর লেখার গভীরে নামতে হবে।

আসলে কসমসের বিপুল অস্তিত্বের মাঝে মানুষের অবস্থান কতটা সামান্য, মানুষের আবেগ ও তথাকথিত মানবিক মূল্যবোধ কতটা অর্থহীন, এটা বোঝাতে চেয়েছিলেন লাভক্র্যাফট। তাঁর লেখা চিঠিতে এবিষয়ে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন। আর এই জায়গা থেকেই তাঁর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল মেটাফরের। সেই মেটাফরই খথুলুর রূপ ধরে বইয়ের পাতায় জেগে ওঠে মহানিদ্রা ভেঙে। কেবল খথুলুই তো নয় আরও আছে। ঘাটানোথোয়া, ইগ, নিয়ারলাটহোটেপ... মানুষের চেতনার স্থান-কালের কাছে তারা সকলেই ‘আউটসাইডার’।

সারা জীবন ‘ফিয়ার অফ দ্য আননোন’-কে বুঝতে চেয়েছেন তিনি। তাঁর মতে মানবসভ্যতার সবচেয়ে পুরনো ও সবচেয়ে শক্তিশালী আবেগ হল ভয়। আর সবচেয়ে পুরনো ও সবচেয়ে শক্তিশালী ভয় হল অজানার ভয়। সেই অজানাকেই তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বত্র। মানুষের মনের অন্ধকারে ছায়া ফেলে যায় কোন মহাজগতের ধারণা? অজানা, অসীম সেই ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ ‘হিপনোস’ গল্পের দুই স্বপ্নদর্শী খুঁজতে বেরিয়েছিল। বিনিময়ে পেয়েছিল ঘন আতঙ্কের ঠাসবুনোট অনুভূতি।

লাভক্র্যাফটের লেখায় প্লট ও ঘটনার ঘনঘটার আতিশয্যের গভীরে লুকিয়ে রয়েছে এই অনন্তের খোঁজ। মনে পড়ছে, বহু বছর আগে অদ্রীশ বর্ধন এক আলাপচারিতায় লাভক্র্যাফটের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তিনি তাঁর লেখায় অনন্তকে ধাওয়া করেছিলেন।

সেই অনন্তের খোঁজ পেতেই আমাদের তাঁর লেখার কাছে ফিরে যেতে হবে। যদিও আশ্চর্যজনক ভাবে বাঙালি পাঠকের কাছে সেভাবে পঠিত নন তিনি। কেন কে জানে! সে হয়তো এক অন্য লেখার বিষয়। এখানে এইটুকুই বলা যেতে পারে, লাভক্র্যাফটের ‘মেন্টর’ এডগার অ্যালান পো-র কিছু রচনা বাঙালি পাঠকের অত্যন্ত পরিচিত। কিন্তু লাভক্র্যাফট নন। যদিও গত কয়েক বছরে ছবিটা বদলেছে। লাভক্র্যাফট অনূদিত হচ্ছেন। দুই বাংলার পাঠকের তাঁকে ঘিরে আগ্রহ বাড়ছে।

আশি বছর পেরিয়ে শতবর্ষের দিকে ধাপে ধাপে এগোচ্ছেন এইচপি লাভক্র্যাফট। একশো বছর পরেও তাঁকে আমাদের প্রয়োজন পড়বে। পড়বেই। অনন্তের যাত্রাপথে একশো বছর যে একটা বুদবুদের মতোই ক্ষণস্থায়ী।

 

ঋণ: ১) লাভক্র্যাফটের একটি সংকলনে এস.টি যোশীর লেখা ভূমিকা।

২) তথ্যচিত্র ‘লাভক্র্যাফট: ফিয়ার অফ দ্য আননোন’।