ক্যানভাস - সুমিত বর্ধন

কল্পবিজ্ঞানের গল্প

ইজিচেয়ারটাতে শরীরটা হেলিয়ে দেওয়ার আগে একবার খুঁটিয়ে দেখে নিই। স্টিলের ফ্রেম, রেক্সিনের গদী, পায়ের নিচে ফুট রেস্ট।

চারপাশে একবার চোখ বোলাই। আজকাল এটা কেমন যেন অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে।

আমার উলটো দিকে পালিশ করা টেবিল। টেবিলের ওপর কাচের ফুলদানীতে নীল ফুল, স্টিলের পেন স্ট্যান্ড, লাল কাচের জলের জাগ, গোটা চারেক লাল কাচের গেলাস।

টেবিলের পেছনে ডক্টর স্যানাল। সাইকিয়াট্রিস্ট। কালো ঘন চুল। নেভী ব্লু কোট, ক্রীম কালারের জামা, স্ট্রাইপ দেওয়া মেরুন রঙের টাই।

ডাক্তারের পেছনের দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। নীলের ওপর হলুদের ছোপ। ভ্যান গগের স্টারি নাইটস-এর সস্তা প্রিন্ট।

নিচের দিকে একবার তাকাই। গাঢ় সবুজ রঙের টালি বসানো মেঝে। একটা গোল জুটের কার্পেট বেছানো।

টেবিলের পেছন থেকে ডক্টর স্যনালের মৃদু গলা ঝাড়ার শব্দ আসে, “মিস্টার সরকার!”

পা দুটো ফুট রেস্টের ওপর তুলে শরীরটা পেছন দিকে হেলিয়ে দিই, “বলুন ডক্টর।”

হাতের ফাউন্টেন পেনটা দিয়ে প্যাডে খসখস করে কী লেখেন ডক্টর স্যনাল, “আপনার সমস্যাটা কী, আমাকে আস্তে আস্তে বলতে থাকুন মিস্টার সরকার। তাড়াহুড়ো করবেন না, ধীরেসুস্থে বলুন।”

আমিও একবার গলা ঝাড়ি, “আমার সর্বদা মনে হয় আমি একটা কাল্পনিক দুনিয়ায় বাস করছি। মানে কেমন মনে হয় এই দুনিয়াটার বোধহয় আসলে কোন অস্তিত্ব নেই।”

“একটু খুলে বলুন প্লীজ!”

“দেখুন ছোটবেলা থেকেই আমার কেমন মনে হত আমার চারপাশে নানা জিনিষ হঠাৎ করে কেমন পালটে যায়। কিন্তু এক আমি ছাড়া সেই পরিবর্তনটা কারোরই চোখে পড়ে না।”

“কীরকম?”

“এই ধরুন, যখন আমার দশ বারো বছর বয়স হবে, স্কুলে পড়ি, একদিন সকালে উঠে দেখলাম আমাদের বসার ঘরের দেওয়ালের রঙ পালটে গেছে। ছিল হলুদ, হয়ে গেছে নীল।”

“আপনি কাউকে বলেননি?”

“বলেছিলাম। আমার মাকে। কিন্তু মা হেসেই উড়িয়ে দিল। বললো, দেওয়ালের রঙ নাকি চিরকাল নীলই ছিল। আমি কীসব উল্টোপাল্টা বকছি!”

“আরো এরকম ঘটেছে আপনার সঙ্গে?”

“হ্যাঁ বহুবার। আমদের সামনের ফ্ল্যাটের মালহোত্রা সাহেবের একটা লাল রঙের সেডান ছিল। একদিন দেখলাম সেটা কালো হয়ে গেছে। তারপর মা বারন্দায় একটা হলুদ গোলাপের গাছ লাগিয়েছিল, একদিন দেখি সেটাতে সাদা গোলাপ ফুটছে।”

“আপনি লোককে বলতেন এসব কথা?”

“প্রথম প্রথম বলতাম। কিন্তু সবাই হাসতো, আমাকে নিয়ে মজা করত। তারপর থেকে বলা ছেড়ে দিই। আর রঙ পাল্টালে কীই বা আসে যায়। কাজ তো চলে যেত।”

“অসুবিধে হত না?”

ডাক্তারের টেবিলে রাখা গোলাপী ফুলগুলোর দিকে কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থেকে একটা লম্বা নিশ্বাস নিলাম।

“হত। ধরুন আমার ছাতার রঙ ছিল সবুজ, কখন অজান্তে হয়ে গেছে মেরুন। এবার ভুল করে আমি হয়ত নিজের বদলে অন্যে কারুর একটা সবুজ ছাতা তুলে নিলাম। কিম্বা অফিসে কাউকে দেখলাম সকালে নীল জামা গায়ে দিয়ে এসেছে। এবার বিকেলে নীল জামা গায়ে দেওয়া একজনকে ডাকতে গিয়ে দেখি সে অন্য লোক।”

“ম্যানেজ করতেন কী ভাবে?”

“সত্যি কথা বলব?”

গলার কালো টাইয়ের নটটা বাঁহাত দিয়ে সামান্য সরালেন ডক্টর সান্যাল, “নিশ্চিন্ত মনে বলুন। এ ধরণের সমস্যায় যারা পড়েন সমাজে মানিয়ে নেওয়ার জন্যে তাদের অনেক কিছু করতে হয়। এতে লজ্জার কিছু নেই।”

“সত্যি বলতে কী ডক্টর, স্রেফ অ্যাক্টিং করতাম। কখনো লজ্জা লজ্জা মুখ করে ভাব করতাম যেন অন্যমনস্ক হয়ে ভুল করে ফেলেছি। কখনো এমন ভান করতাম যেন চোখের সমস্যা আছে।”

সবুজ কাচের জগ থেকে গ্লাসে জল ঢালেন ডক্টর সান্যাল, “আপনার কি সত্যিই চোখের সমস্যা আছে?”

“একদমই না। ছোটবেলায় মা অনেকবার ডাক্তার দেখিয়েছে, কিচ্ছু পায়নি। চোখের সব নর্মাল।”

“তবে...?”

“চোখের চশমাটার কথা বলছেন? ওটা জিরো পাওয়ারের। বললাম না অ্যাক্টিং করতে হয়। ওঃ আপনি বোধহয় আমাকে ঠগ জোচ্চর মনে করছেন!”

নীল রঙের জলের গ্লাসটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরেন ডক্টর সান্যাল, “না না। একদমই না। দেখুন, আমাদের চারপাশের সমাজটা খুব একটা সংবেদনশীল নয়। তাই যাঁদের এধরণের সমস্যা আছে সমাজের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলার জন্যে তাঁদের অনেকসময় নানান ছলচাতুরির আশ্রয় নিতে হয়। এতে অন্যায়ের কিছু নেই।”

ডাক্তারের হাত থেকে জলের গ্লাসটা নিই, “তাহলে বলছেন আমি লোক ঠকাইনি?”

“সমাজে থাকার জন্যে যা দরকার তার বেশী আপনি কিচ্ছু করেননি। বরং এই যে আপনি সমাজের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে একটা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পেরেছেন এটাই বড় কথা।”

ধূসর টালি বসানো মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে আবার একটা লম্বা নিশ্বাস নিই, “আশ্বস্ত করলেন ডক্টর। নইলে নিজেকে সবসময় কেমন একটা চিটিংবাজ মনে হয়।”

ব্রাউন রঙের কোটের হাতার তলা থেকে উঁকি মারা নীল জামার অংশটা একটু টানেন ডক্টর সান্যাল, “একদম ওইরকম ভাববেন না। নিজের সমন্ধে সবসময়ে পজিটিভ চিন্তা করুন। এবার অন্য কথায় আসি। আপনি কি কখনো পরীক্ষা করে দেখেছেন এটা আপনার মনের ভুল কি না? মানে ধরুন হয়ত মোবাইলে ছবি তুলে রাখলেন, তারপর যখন আপনার মনে হল কোন কিছুর রঙ পালটে গেছে, মোবাইলে তোলা ছবিটা একবার মিলিয়ে দেখে নিলেন?”

“না। মোবাইলে বা ক্যামেরায় তোলা ছবিতে কাজ হয় না। কোন কিছুর রঙ পাল্টালে তার তোলা ছবির রঙগুলোও পালটে যায়।”

“তার মানে আপনার নিজের ভুল হচ্ছে কিনা চেক করার কোনও উপায় নেই!”

টেবিলের হলুদ ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ি, “না। আমার নিজের স্মৃতি ছাড়া এই পরিবর্তনের আর কোন প্রমাণ আমি কোনওদিন রাখতে পারিনি। এমনকী আমি ডাইরিতেও লিখে রেখে দেখেছি। কোন কিছুর পরিবর্তন হলে তার পুরনো রেকর্ডও পালটে যায়।”

“ধরুন মেনেই নিলাম আপনার কথা সত্যি। চারপাশের জগতে জিনিষের রঙের পরিবর্তন হয় এবং আপনার ছাড়া অন্য কারোর চোখে সে সব ধরা পড়ে না। কিন্তু এটা কেন ঘটছে সে ব্যাপারে আপনি কী ভাবেন?”

“শুরুতেই বলছিলাম না যে আমার মনে হয় আমি একটা কাল্পনিক জগতে বাস করছি।”

মাথার কাঁচাপাকা চুলের ওপর দিয়ে একবার হাত ফেরান ডক্টর সান্যাল, “এটা একটু বুঝিয়ে বলবেন?”

“একটু অন্য জায়গা থেকে শুরু করি? একটু ধৈর্য ধরে শুনবেন প্লীজ।”

“অবশ্যই! আমি তো আপনার কথা শুনতেই চাই। নিশ্চিন্ত মনে বলুন।”

“দেখুন ছোটবেলায় আমার একটা পেন্টিং বুক ছিল।”

“পেন্টিং বুক। মানে ছবি আঁকার খাতা?”

“না, না। ওই যে বাচ্চাদের বই হয় না? যাতে ছবি আঁকা থাকে, সেগুলো রঙ করতে হয়?”

“ও হ্যাঁ আচ্ছা, আচ্ছা। বুঝেছি। বলুন, বলুন।”

এক চুমুকে জল শেষ করে সবুজ কাঁচের গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখি, “আমার এই পেন্টিং বইটা একটু অন্যরকম ছিল। মানে সাধারণতঃ এই ধরণের বইগুলো কাগজে ছাপা হয়, রঙ করা হয়ে গেলে তারপর সেগুলো আর কাজে লাগে না, ফেলে দিতে হয়। আমারটা কিন্তু প্লাস্টিকের ছিল।”

“প্লাস্টিকের? ইন্টারেস্টিং!”

“হ্যাঁ। এতে সুবিধে ছিল, একবার রঙ করা হয়ে গেলে ধুয়ে ফেলে আবার রঙ করা যেত। মানে বইটা বারবার ব্যবহার করা যেত। আপনার বোধহয় মনে হচ্ছে আমি ভুলভাল বকছি!”

লাল টাইয়ের নটটা ফের ঠিক করেন ডক্টর সান্যাল, “একদম নয়। আপনি বলতে থাকুন।”

“বইটা আমার খুব প্রিয় ছিল। কারণ ছবিগুলোকে এক একবার এক একরকম রঙ করা যেত। ধরুন একটা বাড়ির ছবি আছে। একবার বাড়ির দেওয়ালগুলো নীল রঙ করলাম, জানলাগুলোকে হলুদ, মাথার চালটা লাল, তারপর ধুয়ে ফেলার পর হয়ত চালটা কমলা, দেওয়ালটা আকাশী আর জানলাগুলো পিঙ্ক রঙ করলাম। মানে প্রত্যেকবার নতুন একটা কিছু। ছেলেমানুষী মনে হচ্ছে, না?”

“ছোটবেলায় সবাই ছেলেমানুষ থাকে আর ছেলেমানুষীই করে থাকে। আপনি আলাদা কিছু নন। আপনি আপনার কথা বলুন।”

“হ্যাঁ আমার এই সমস্যা, মানে এই যে আমি দেখতাম আশেপাশের রঙ আপনাআপনি পালটে যাচ্ছে, আমার মনে হত...।”

“আপনার মনে হত?”

মেঝের টালির রঙবেরঙের জ্যামিতিক নক্সাগুলোর দিকে তাকিয়ে মনের ভেতরে জমে থাকা শব্দগুলোকে একের পর এক সাজাই। ধীরে ধীরে, থেমে থেমে বলি, “আমার মনে হত আমরা একটা কাল্পনিক দুনিয়ায় বাস করছি। দুনিয়াটা আসলে একটা ক্যানভাস। অনেকটা আমার ওই পেন্টিং বইয়ের মতন। আর এই ক্যানভাসের অলক্ষ্য চিত্রকর খেয়াল খুশী মতন ক্যানভাসের নানান জিনিষের রঙ পালটে দেয়।”

“কিন্তু কেন?”

“তা ঠিক বলতে পারি না। হয়ত তার কাছে এটা একটা খেলা।”

“এই সমস্যাটা তো আপনার ছোটবেলা থেকে আছে, তাই না?”

মাথা নাড়ি, “হ্যাঁ একদম ছোট বয়েস থেকে।”

“কিন্ত আপনি এই সমস্যা সত্ত্বেও খুব সুন্দর সমাজের মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন।”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, এতদিন বাদে আপনার হঠাৎ সাইকিয়াট্রিস্টের প্রয়োজন হল কেন?”

ডাক্তারের পেছনের দেওয়ালে টাঙানো গগ্যাঁর ছবির হলুদ যীশুর দিকে তাকাই, “দুটো কারণে ডক্টর। প্রথমতঃ আজকাল এই পরিবর্তনগুলো খুব ঘনঘন হচ্ছে। অ্যাডজাস্ট করতে খুব অসুবিধে হচ্ছে। আর দ্বিতীয়তঃ এখন আর কেবল রঙ পাল্টাচ্ছে না, জিনিষের চেহারাও পালটে যাচ্ছে।”

“জিনিষের চেহারা পালটে যাচ্ছে! কী রকম?”

চেয়ারের কাঠের হাতলের ওপর ভর দিয়ে শরীরটাকে সোজা করি, “এই ধরুন আমার কলিগ নীলাদ্রি। এতদিন জানতাম ও একটা হন্ডা বাইক চালায়। কয়েকদিন আগে দেখি ও একটা এনফিল্ড বুলেট চড়ে অফিসে এসেছে। নতুন বাইক কিনেছে কিনা জিজ্ঞেস করতে আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে বললো, ও নাকি পাঁচ বছর ধরে এনফিল্ড বুলেটই চালাচ্ছে। তারপর আমার বাড়ির কাছে রাস্তার মোড়ে একটা ওষুধের দোকান ছিল। হঠাৎ একদিন দেখি সেটা একটা মুদীর দোকান হয়ে গেছে।”

হাতের রোলার পেন দিয়ে ডাইরিতে কয়েক লাইন লেখেন ডক্টর স্যানাল, “হয়ত পুরনো দোকান উঠে গিয়ে নতুন দোকান হয়েছে। এরকম তো আজকাল আকছারই হয়।”

“আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু দোকানীকে জিজ্ঞাসা করতে সে অবাক হয়ে বলল তাদের দোকান নাকি বহু পুরনো।”

“হুঁ।” টেবিলের পেতলের ফুলদানীর দিকে তাকিয়ে কী ভাবেন ডক্টর সান্যাল, “আপনার কী মনে হয়? আপনার এই সমস্যা আরো বেড়ে যাওয়ার কারণ কী?”

“আমার একটা থিওরী আছে। তবে আপনি সেটা ঠিক বিশ্বাস করবেন কি না জানি না।”

“আপনি বলুন না।”

“দেখুন, একটা কারণ হতে পারে এই যে অজ্ঞাত চিত্রকর, তার হয়ত খেলাটা বহুদিন খেলে খেলে একঘেয়ে লাগছে, তাই আজকাল তার ক্যানভাসে পরিবর্তনগুলো সে খুব তাড়াতাড়ি করছে। মানে অনেকটা মোবাইলে অ্যাপ গেম খেলার মতন।”

হাতের পেন্সিল দিয়ে নোটবইতে খসখস করে লেখেন ডক্টর স্যানাল, “একটু বুঝিয়ে বলবেন?”

“ধরুন একটা গেম আছে আপনার। অনেকটা আমার ওই প্লাস্টিকের পেন্টিং বইয়ের মতন। গেমে একটা ছবি আছে, এবার ছবিগুলোর বিভিন্ন অংশে আঙুল দিয়ে ট্যাপ করলে সেগুলো পালটে যায়। হয়ত একবার ট্যাপ করলে রং পাল্টায়, দুবার ট্যাপ করলে জিনিষটাই পালটে যায়।”

“বেশ।”

মেঝের সিল্কের কার্পেটের ওপর পাটা লম্বা করে ছড়িয়ে দিই, “হ্যাঁ। ধরুন একটা ছবিতে নানা জিনিষের মধ্যে একটা গাড়ি আছে। গাড়িটাতে আপনি একবার ট্যাপ করলেন, রঙটা লাল হয়ে গেল। আর একবার করলেন নীল হয়ে গেল। এবার একবারের বদলে টক টক করে ডাবল ট্যাপ করলেন, গাড়ি পালটে স্কুটার হয়ে গেল। আর একবার ডাবল ট্যাপ করলেন, স্কুটার পালটে সাইকেল হয়ে গেল। আমার কথাগুলো পাগলের প্রলাপ মনে হচ্ছে না তো?”

গায়ের লেদার জ্যাকেটের জিপটা একবার ওপর নিচে করেন ডক্টর সান্যাল, “আরে না না। আপনি নিশ্চিন্তে বলতে থাকুন।”

“হ্যাঁ মানে এই কাল্পনিক অ্যাপে একটা ছবির রঙ আর রূপ দুটোই পালটে ফেলা যায়। হয়ত ছবি প্রথমে ছিল বাড়ির সামনে দাঁড়ানো বাইক, হয়ে গেল ধানের গোলার সামনে দাঁড় করানো সাইকেল। আমি বোঝাতে পারছি তো?”

“একদম। বুঝতে কোন অসুবিধে হচ্ছে না। আপনি বলে যান।”

ডাক্তারের পেছনে দেওয়াল জোড়া বত্তিচেল্লির ভেনাসের ছবিতে চোখ রেখে বুক ভরে নিশ্বাস নিই, “থ্যাঙ্কস ডক্টর। মানে পাছে লোকে আমাকে পাগল ভাবে আমি এমন খোলাখুলি এর আগে কখনো এ-সমস্ত কথা বলিনি।”

পাঞ্জাবীর হাতাদুটো টেনে কনুইয়ের ওপর তোলেন ডক্টর সান্যাল, “আপনাকে খোলাখুলি বলতে দেওয়ার জন্যেই তো আমাদের বসা। বলুন, বলতে থাকুন।”

“হ্যাঁ ডক্টর। এই যে ক্যানভাস অ্যাপটা, ধরুন এটা কেউ অনেকদিন ধরে খেলছে। প্রথম দিকে তার হয়ত বেশ মজা লাগত। ছবিগুলো নানা ভাবে চেঞ্জ করে করে দেখত। কিন্তু অনেকদিন ধরে খেলে তার হয়ত আজকাল ইন্টারেস্ট চলে গেছে। সে হয়ত অনেকটা বিরক্ত হয়ে তাড়াতাড়ি ছবি পালটে পালটে দেখছে আর কী কী করা যায়।”

হাতের হাইলাইটার দিয়ে সামনে রাখা ফাইলে কিছু দাগ টানেন ডক্টর সান্যাল, পেছনের দেওয়ালের স্টেইন্ড গ্লাসের জানলার কাঁচের পেছন থেকে রঙীন আলো এসে পড়ে তাঁর ওপর, “আচ্ছা। মানে আপনি বলতে চাইছেন যে আপনার কাল্পনিক দুনিয়ার যে চিত্রকর তার এই খেলার নেশাটা প্রায় কেটে আসছে।”

“হ্যাঁ। আর এইটা মনে হওয়া থেকে আমার মনে একটা ভয় ঢুকে গেছে।”

“কী রকম ভয়?”

“ডক্টর আমাদের প্রয়োজন না থাকলে আমরা যেমন একটা অ্যাপ মোবাইল থেকে সরিয়ে দিই, সেইরকম এই অজানা চিত্রকর তার এই ক্যানভাসটাকে যদি পুরোটা সাদা করে দেয়? আমাদের অস্ত্বিত্ব থাকবে তো?”

মাথা নাড়েন ডক্টর সান্যাল, “আপনার কথাগুলো সব শুনলাম। এবার আমি কয়েকটা কথা বলি? আপনিও মন দিয়ে শুনবেন। কেমন?”

“অফকোর্স ডক্টর। প্লীজ বলুন।”

টি-শার্টের কলারটা একবার দুহাতে টানেন ডক্টর স্যনাল, “দেখুন আমরা সবসময় আমাদের এই চারপাশের এই পৃথিবীটার কার্য কারণ ব্যাখা করতে পারি না। এতে সাধারণত বেশীরভাগ সময়ে আমাদের কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু কারোর কারোর ক্ষেত্রে তার অজান্তেই মন কিছু কাল্পনিক সমাধান সূত্র তৈরি করে ফেলে।”

ডাক্তারের পেছনের দেওয়াল জোড়া লম্বা কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরে তাকাই। ঝকঝকে আকাশে ডানা মেলে পাক খায় চিলের ঝাঁক। নীচে কমলা হলুদ বালিয়াড়িতে ধীরে ধীরে হাঁটে উটের ক্যারাভান।

“মানে আপনি বলতে চাইছেন এগুলো সব আমার কল্পনা? ডক্টর আমি পেশায় ট্যাক্স কনসাল্টান্ট। আমাকে আইনের বহু খুঁটিনাটি জিনিষ মাথায় রাখতে হয়। আমার স্মৃতিশক্তি এত দুর্বলও নয় যে যা দেখেছি মনে রাখতে পারব না।”

“দেখুন এটা স্মৃতিশক্তির সমস্যা নয়।” চকচকে যান্ত্রিক হাতদুটো দুপাশে ছড়িয়ে দেন ডক্টর সান্যাল, “এই মন জিনিষটা বড়ই গোলমেলে। নানা রকম প্রতারণা করে। আপনাকে সে যদি আজ বোঝায় যে গতকাল আপনি কিছু দেখেছেন, আপনি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারবেন না যে আপনি সে রকম কিছু দেখেননি।”

“কিন্তু ডক্টর আমার মন এই রকম কল্পনার জাল বুনবেই বা কেন?”

দু-একটা আলোর ফুলকি টপটাপ জ্বলে নেভে ডক্টরের সাইবারনেটিক চোখে, “দেখুন ‘কেন’ প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া কঠিন। নানা কারণ থাকতে পারে। কোন হেড ইঞ্জুরি, বা কোন সিভিয়ার মেন্টাল ট্রমা থেকে হতে পারে। বা কাজের প্রেসার জনিত ডিপ্রেসন। অ্যালকোহলিসম বা ড্রাগ এবিউজ থেকেও হতে পারে।”

“ডক্টর, বিলিভ মি, এগুলোর একটাও আমার জীবনে ঘটেনি। আমি মাথায় আজ পর্যন্ত কোন চোট পাইনি। শোকে দুঃখেও কখনো সেভাবে ভেঙে পড়িনি। আমি নেশাভাঙ করি না, প্রফেশানালি আমি অত্যন্ত সাকসেসফুল, ডিপ্রেসানের প্রশ্নই ওঠে না।”

পেছনের খোলা ব্যলকনি থেকে আসা এক ঝলক বাতাস বয়ে আনে বুনো ফুলের গন্ধ। দূরে সবুজ গাছের সারির ওপর দিয়ে উড়ে যায় রঙবেরঙের পাখির ঝাঁক।

“বললামই তো এর কারণ বের করা খুব খুব মুস্কিল। তবে আপনার ক্ষেত্রে যদি একটা আন্দাজ আমাকে করতে হয়, তাহলে বলব এর কারণ খুব সম্ভব নিঃসঙ্গতা।”

“নিঃসঙ্গতা!” অনিক্স পাথরে কোঁদা চেয়ারের কারুকার্য করা হাতলদুটো সজোরে আঁকড়ে ধরি আমি।

“হ্যাঁ আপনার ফাইলটা আমি দেখছি। খুব ছোটবেলায় আপনি বাবাকে হারিয়েছেন। আপনার মা আপনাকে একা হাতে মানুষ করেছেন।”

“কোন রকমের নিঃসঙ্গতা আমার ছিল না ডক্টর, আমার মা আমাকে কোনদিন বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি। সত্যি বলতে কী ছোটবেলাটা আমার খুব আনন্দে কেটেছে।”

“তারপর আপনি বিয়ে করেননি।” ডক্টর স্যানালের লোমশ হাতের লম্বা আঙুলগুলো টেবিলের ওপর টকটক আওয়াজ তোলে।

সামনের আকাশে পাক খায় টেরোডাক্টাইল জাতীয় কোন প্রাণী, তৃণভূমিতে মন্থর গতিতে চলে বেড়াই স্টেগসরাসের পাল। সেদিকে তাকিয়ে আচ্ছন্ন গলায় বলি, “প্রেম করেছিলাম কিছুদিন। টেকেনি। তবে তার জন্যে কোন আক্ষেপ নেই ডক্টর। আমার কাজ আর বইপত্র নিয়ে দিব্যি সময় কেটে যায়।”

“তাহলেও আপনার মনের কোন গোপন কোণে একটা নিঃসঙ্গতা বোধ লুকিয়ে আছে। নাহলে ওয়ার্হুম জয়ল্টেন জিশ ডিসেন প্রব্লেম স্টেল্লেন?”

“ডক্টর আমি আপনার কথা বুঝতে পারলাম না।”

“লা তুয়া সলিটুডিনে তি স্তা ফাচেন্দো ইমাজিনারে লে কসে।”

“ডক্টর! ডক্টর, মনে হচ্ছে এই ক্যানভাসে শুধু রঙ আর রূপ নয় ভাষাও পালটে দেওয়া যায়। আপনার কথা আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না!”

“দে আলগুনা মানেরা নেসেসিতারাস সুপেরার তু সলেদাদ।”

“ডক্টর! ডক - আনাতা ওয়া মাইকাই কোতোনারু গেংগো ও হানাশিতে ইরু তো ওমোইমাস। ওতাশি ওয়া আনাতা ও রিকাই দেকিমাসেন, ইশি! ইশি! ইশি সান!”