দ্বৌসজ - দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়

ফ্যান্টাসি গল্প

অলংকরণ : সুমিত রায়

একটা আলতো আলো। পদ্মপাতার মতো নরম মখমলে। আমার মুখের ওপর যেন খেলা করছে আলোটা। এই আছে, এই নেই! বারবার যাচ্ছে কোথায়? ঘষা কাচের মতো একটা আবছায়া ধরে ফেলছে ওকে,আবার ঠিক এদিক ওদিক গলে ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে পড়ছে আলোটা। ভারী মজা তো! কিন্তু একী! ছায়াটা একটু একটু করে বড় হয়ে গপ্ করে গিলে ফেলল পুরো আলোটাকে... আর তারপর আমার গালে দুটো টোকা মেরে বলে উঠল, “আবার ঘুমের মধ্যে হাসা হচ্ছে! সেই কখন থেকে ডেকে চলেছি... আর কত ঘুমোবি পাগল?”

চটচটে আঠার মতো চোখদুটো একটু ফাঁক করলাম। গালে হাত দিয়ে বাবু হয়ে বসে আছে দাদা। ওর মাথার পেছনে দিয়ে ছোট্ট গোলাপি সূর্যটা ঠান্ডা ঠান্ডা আলো ছড়িয়ে সবে আড়মোড়া ভাঙছে আমার মতোই। মুখ কুঁচকে পাশ ফিরে বললাম, “এত সক্কাল সক্কাল উঠে কী করব? যা না, তুইও ঘুমোবি যা।”

“হুম,” ঠোঁট উলটে মুখটাকে বড়দের মতো করার চেষ্টা করল দাদা, “আমি তবে একাই যাই। হিরণ বিলে ঝাঁক বেঁধে ভেঁটুর ফল হয়েছে, যাই গিয়ে ওগুলো সাবাড় করি। বেলা বাড়লে দলে দলে বানর সেনারা এসে চড়ুইভাতি জমাবে, তার আগেই তো ওগুলোর ব্যবস্থা করতে হবে! আহ্... টকটক মিষ্টি মিষ্টি ভেঁটু...” সুরুৎ সুরুৎ করে নাল টানার আওয়াজ হল।

ভেঁটু ফল! চোখ খুলে তড়াক করে উঠে বসলাম। উফ্, এ বছর অনেক অপেক্ষা করতে হল ভেঁটু ফলের জন্য। বাবা বলেন ভেঁটু হল বসন্তের ফল, তা সেই বসন্ত যে কাকে বলে সেটা আজ অব্দি বুঝতে পারিনি আমি। বাবার ছোটোবেলায় নাকি বসন্ত কাল ছিল। তখন কৃষ্ণচূড়ার বন লালে লাল হয়ে থাকত, এই বড় বড় পাকা পাকা ভেঁটু ফলে জলকুমদি গুলো ভারী হয়ে থাকত, সন্ধ্যে বেলায় কাবেরীর জলে গা ধুয়ে উঠে আসত মিষ্টি বাতাস। সেসব অবশ্য গল্পে শোনা কথা। তবে বাবা যখন বলে তখন ছিল নিশ্চয়ই! সাত তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে গিয়ে উঠোনে রাখা ঘটি থেকে জল ছিটিয়ে নিলাম চোখে মুখে। তারপর উৎসুক গলায় হাত টানলাম দাদার, “যাবো না মানে! আগে বলবি তো! চল্ চল্! বাঁদর বাবাজীদের আগে পৌঁছাতে হবে!”

“কী ব্যাপার? মানিকজোড় মিলে কোথায় যাওয়া হচ্ছে সকাল সকাল?” ধুতির খুঁটে হাত মুছতে মুছতে পাশের বড় গুহাটা থেকে বেরিয়ে এলেন বাবা। এই সময়টায় প্রতিদিন বাবার সঙ্গে গাঁয়ের সব বড়রা মিলে খামার গুহায় ধান গাছের পরিচর্যা করেন, ধান ফলানোর চেষ্টা করেন। একটু পরেই ওই হামাগুড়ি দেওয়া ছোট্ট সূর্যটা একটু একটু করে আগুন ঝরানো রাক্ষস হয়ে উঠবে, তখন মাটির আরো নীচের দিকে নেমে যেতে হবে আমাদের। নাহলে গরম হলকায় নিঃশ্বাস নেওয়াই দায় হয়ে যায়! তাই এই ভোরের সময়টাই বাবা সবাইকে নিয়ে ধান গাছগুলোকে দেখাশোনা করেন। অনেক অনেক বছর আগে বাইরের মাঠেই ধান চাষ হত, কিন্তু এখন সব পুড়ে ছারখার হয়ে যায়... তাই ওপরের গুহা গুলোর ভেতরেই নরম মাটি দেখে ধান বীজ পুঁতেছেন বাবা। সেই ধান থেকে চাল হবে, চাল থেকে 'ভাত'। সেই 'ভাত'-এর মতো সুস্বাদু জিনিস নাকি আর কিছু নেই! ভেঁটু ফলের চেয়েও নাকি খেতে ভালো! যাই হোক, আপাতত আমাদের যেতে হবে হিরণ বিল। বাবাকে সে কথা বলা মাত্রই কেমন একটা কালো ছায়া পড়ল বাবার কালো মুখটায়। একটু চিন্তা করে বললেন, “চল, আমিও যাব সঙ্গে।”

কী মজা! তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম গুহা থেকে। আমাদের বেরোতে দেখে সূর্যটা যেন খানিক ভুরু কুঁচকে ভেবে নিল, তারপর মুখ লুকোলো একটা হালকা তুলতুলে মেঘের আড়ালে। এখন যতই লুকিয়ে থাকা, একটু পরেই যে সে দাঁত কিড়মিড় করে গরম হলকা ছাড়বে সেটা আমার ভালোই জানা আছে! তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছিলাম আমরা। হঠাৎ একটা বিকট “অ্যাঁও অ্যাঁও অ্যাঁও” শব্দে চমকে উঠে একটা বনমোরগ ঝটপট করে দৌড়ে পালাল গাছের ফাঁক গলে! হেসে ফেললেন বাবা। একটু দূরেই দু হাত পাশে ছড়িয়ে অ্যাঁও অ্যাঁও শব্দ করে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চলেছে দাদা। শকুনের ডাক খুব ভালো নকল করতে পারে ও। ওর ঘামে ভেজা বাদামি পিঠের ওপর ডানা ছড়ানো শকুনের উল্কিটা আলো পড়ে চকচক করছে। আমাদের সবার পিঠেই আঁকা আছে অমন কোনো না কোনো পাখির উল্কি। একদিন বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন এমনটা হয়। “পাখিই তো আমাদের পরম বন্ধু, আমাদের প্রাণের আত্মীয়,” চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলেছিলেন বাবা, “আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, যা আমাদের বাকিদের থেকে আলাদা করে রাখে। জন্মের পরে বুড়ো কিরুন সব্বার শরীরের সেই লক্ষণ চিনে নিয়ে তার পিঠে এঁকে দেয় উল্কি। আর মজার কথা হল, বুড়ো কিরুনের দূরদর্শীতা কখনো মিথ্যে হয় না। বড় হওয়ার পর সেই শিশুটির মধ্যে সত্যিই প্রকাশ পেতে থাকে সেই পাখির বৈশিষ্ট্য!”

“বুড়ো কিরুন কোথায় থাকে বাবা?”

“ওই যে দূরে পাহাড়ের শেষ কিনারায় যেখান থেকে সন্ধ্যের অন্ধকার উঠে আসে, সেই কালো জগতের সীমানায় আছে এক বিশাল বটগাছ। তারই কোটরে থাকে বুড়ো কিরুন। সে যে কত বছর ধরে সেখানে রয়েছে কেউ জানে না। শুধু কারো ঘরে নতুন অতিথি এলেই কীভাবে জানি খবর পেয়ে ঝরণা-জঙ্গল-পাহাড় উজিয়ে উড়ে আসে সে, আর সদ্যোজাতর শরীরে এঁকে দিয়ে যায় সেই অমোঘ চিহ্ন।”

“আমার পিঠেও অমন উল্কি আছে বাবা? কোন পাখির উল্কি আছে?”

বাবা হাসেন। কিছু বলেন না। নদীর ওপারের আবছা আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে উদাস হয়ে যায় বাবার চোখ দুটো। আমি আরো একবারের জন্য দেখতে থাকি বাবার পিঠের অজস্র আঁকিবুকির মধ্যে ডানা মেলা সেই অদ্ভুত পাখিটাকে। তীক্ষ্ণ শিকারী ঠোঁট, তেজোময় দুটো ধারালো চোখ, সবল পেশীবহুল ছড়ানো দুই ডানা,পালক ফুলিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে তাকানোয় রাজঅহঙ্কার। কী নাম এই পাখির...?

“বুঝলি ভাই, শুখা পাহাড়ের শকুনরা বলল হিরণ বিলে নাকি এবারে অনেক ভেঁটু হয়েছে।” লাফাতে লাফাতে কখন আবার পাশে চলে এসেছে দাদা। দুহাত পাশে ছড়িয়ে বলল, “এই অ্যাঅ্যাঅ্যাত্তো! তুই আর আমি সাঁতরে গিয়ে বিলে যত ভেঁটুফল আছে সব তুলে আনব। তারপর আমরা তিনজনে মিলে পেট ভরে খাবো। আহ্,কতদিন পেট ভরে খাই না!”

“না!” দাদার কথা শেষ হওয়া মাত্র বাবার জলদগম্ভীর স্বর ভেসে এল। একটা জিওল গাছের শক্ত ডালকে ভেঙে লাঠির মতো বানিয়ে নিয়েছেন বাবা। সাবধানী দৃষ্টিতে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন। “শুধু আমরা? আর বাকিদের কী হবে? তারাও যে দিনের পর দিন আধপেটা খেয়ে কাটাচ্ছে, তাদের কথা ভাববে না? এই শিখিয়েছি তোমাদের?” তীব্র ভৎর্সনা বাবার চোখে।

মাথা নীচু করে ফেলেছে দাদা। আমি জানি,ওর মনটা খুব ভালো...আসলে ভেঁটু ফলের খবরে এতটাই উত্তেজিত হয়ে গেছে... “না বাবা। ভুল হয়ে গেছে। আমরা সব ভেঁটু তুলে গাঁয়ে নিয়ে যাবে, তারপর সবাই মিলে ভাগ করে খাব।” ছলছলে ধরা গলায় বলল। বাবার চোখ স্নিগ্ধ হয়ে এসেছে। দাদার কাঁধে হাত রাখলেন, “মনে রাখবে, একজন প্রকৃত দ্বৌসজ, প্রকৃত নেতা কখনো শুধুমাত্র আত্ম স্বার্থ চিন্তা করে না, নিজের জাতির প্রত্যেকটা প্রাণীর ভালো মন্দের প্রতি সম্পূর্ণ দায়বদ্ধতা থাকে তার। এগুলো তো তোমাদের বুঝতে হবে বাবা। নাহলে আমাদের সঙ্গে ওই মানুষদের পার্থক্য কোথায়?”

“আচ্ছা বাবা, মানুষেরা এত খারাপ হয় কেন? আমরা তো ওদের কোনো ক্ষতি করিনি, তাও কেন ওরা...” আমার বুকের ভেতর থেকে একটা চাপা ফিসফিসানি যেন ডুকরে উঠে এল।

থমকে গেলেন বাবা। দপ করে একবার জ্বলে উঠেই বিষণ্ণ হয়ে গেল তাঁর চোখ।

রোদ বেশ অনেকটাই মাথার ওপরে। পায়ের নীচটা গরম পাথরে ঘষা খেয়ে খেয়ে জ্বালা করছে। কোমরে বাঁধা কাপড় খানা খুলে আমাদের ঘামেভেজা মুখ মুছিয়ে দিলেন বাবা। কপালের ওপর হাত মেলে আকাশের দিকে চোখ কুঁচকে কী যেন দেখতে দেখতে ভাঙা গলায় বললেন, “জানি না বাবা। এটা বোধহয় ওদের কাছে খেলার মতো।” তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুই হাতে দু'জনকে নিয়ে মরা ডালপালা পেরোতে পেরোতে দ্রুত এগিয়ে চললেন, “ওই কাবেরীর ওপারে ওদের শহর...রূপকথার মতো। সেখানে নেই দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড়ের দুশ্চিন্তা, নেই সূর্যের প্রবল তাপ থেকে বাঁচার ভাবনা। প্রকৃতিকে আস্তে আস্তে ধ্বংস করে তার ওপর গড়ে উঠেছে ওদের ওই ইমারত, প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ওরা বানিয়েছে কত্ত কিছু! ঠান্ডার অদৃশ্য চাদরে মুড়ে ফেলেছে গোটা শহর, জমি থেকে ধাপে ধাপে উঠে গেছে শূন্যে ভাসমান সব বিশাল বিশাল রাস্তা,” একটু যেন দম নিলেন বাবা।

এ আমাদের বহুবার শোনা উপাখ্যান। তাও যেন আমার ভেতর থেকে একটা বোকা, লোভী ছেলে বিহ্বল চোখে বলে উঠল, “ওদের কোনো দুঃখ-কষ্ট নেই, না?”

আমাকে একঝলক দেখে নিয়ে আবার শুরু করলেন বাবা, “কিন্তু শহরের মানুষদের এই স্বার্থান্ধতার বলি হতে থাকল প্রকৃতির সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষ-পশু-পাখিরা। শহরের বাইরে লোকালয় ছাড়িয়ে যে অফুরান প্রকৃতির সম্ভার ছিল সব নষ্ট হয়ে যেতে লাগল, ধুঁকতে লাগল প্রাণীরা, ভেঙে পড়ল বাস্তুতন্ত্র। এমনকি বাদ যায়নি আমাদের বিন্ধ্য পাহাড়ও!” বলতে বলতে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সামনে অনেকটা নীচুতে এক বিশাল উপত্যকা, কিন্তু তাতে নেই সবুজের কোনো আভাস। কেবল জমির ওপর দেখা যাচ্ছে কালচে ছাই রঙ। “এইখানে ছিল বিশাল এক জঙ্গল।” বাবার অবরুদ্ধ গলা যেন হাহাকার করে উঠল, “দাবানলে সব শেষ হয়ে গেল। শুকিয়ে গেল ঝরনাগুলোও। এই যে মরা গাছপালার স্তূপ... ফুটিফাটা পাথর... এসব বুকে করে নিয়ে এখন একটা ন্যাড়া পাহাড় হয়ে কোনোমতে টিকে আছে বিন্ধ্য।”

থতমত মুখে দাঁড়িয়ে পড়েছে দাদা। আমারও সারা শরীরে কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষের গল্প বহুবার শুনেছি বাবার মুখে, কিন্তু আজ এই মৃত প্রান্তরের প্রতিটি কোণ থেকে যেন একটা বুকফাটা হাহাকার ছুটে এসে আমাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে আমার প্রিয় বন্ধুর কথা। “আমরা প্রায় এসে গেছি... পা চালিয়ে চল...” বাবা যেন হঠাৎ কথা ঘোরাতে চাইলেন। আবার শুরু হল পথচলা। চুপচাপ হাঁটছিলাম আমরা তিনজন। কিছু পরে দাদা অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, “আমরাও কি মানুষ নই, বাবা?”

“জানি না বাবা। তবে ওরা বোধহয় ঠিক মানুষ হয়ে উঠতে পারেনি,” তিক্ততা ঝরে পড়ল বাবার গলায়, “আমার দাদুর মুখে ছোটোবেলায় শুনেছিলাম অনেক বছর আগে নাকি মানুষ এমনটা ছিল না, প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ জীব হওয়ার মতো তখন সব গুণ ছিল তার মধ্যে... অথচ এখন এরাই অন্য কাউকে মানুষ বলে মনে করে না! ওদের চোখে আমরা শুধুমাত্র পাহাড়ের জঙ্গলে থাকা এক আদিবাসী, নীচু জাত! আমাদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকারই নেই! বরং আমরা নাকি ভাগ বসাচ্ছি প্রকৃতির হাওয়া, জল,খাদ্যে! তাই আমাদেরকে যখন খুশি মেরে ফেলা যায়! ওই কৃত্রিম সুখ-নগরে থাকতে থাকতে যখন একঘেয়ে হয়ে যায় সবকিছু... তখন খেলার ছলে আমাদের হত্যা করে নিজের মন ভরিয়ে ওরা! বিনোদনের জন্য!”

টপটপ করে আমার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনতা জলের ধারা। দাঁতে দাঁত চেপেও আটকাতে পারলাম না সেই স্রোতকে, গলার কাছে একটা শক্ত ডেলা ভেঙে দিচ্ছিল আমার সমস্ত প্রতিরোধ। মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই রিনরিনে স্বর, ডাগর চোখদুটোকে। আমার বন্ধু পারাবত। ওর পিঠে আঁকা পায়রার উল্কিটার মতোই নরম শান্ত একটা ছেলে, আমার খেলার সাথী। দিন কয়েক নিখোঁজ থাকার পর যখন পাহাড়ের খাঁজে খুঁজে পাওয়া গেল তার ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত শরীরটা, তখন গাঁয়ের বড়রা বলল মানুষ “শিকার” করেছে ওকে! ওর বুকে-পেটে গেঁথে থাকা সেই বড় বড় বাঁকানো নখের মতো তীর আজও যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে আমার সামনে... ঘিরে ধরছে চারদিক থেকে... মাথার ভেতর ভীমরুলের গোঁ গোঁ শব্দ...উহ্,শরীর দুর্বল হয়ে আসছে... চোখ বুঁজে মাটিতে আছড়ে পড়লাম হাঁটু মুড়ে...এমন সময় একটা সবল ঠান্ডা হাতের পরশ জাপটে ধরল আমাকে। দুই হাতে মুছিয়ে দিল গাল দুটো। জলভরা চোখ মেলে দেখলাম স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন বাবা। তাঁর চোখে এক অদ্ভুত আলো। স্নিগ্ধ অথচ দৃঢ় গলায় বলে উঠলেন, “এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না বাবা। তোমাকে যে বড় হতে হবে! অনেক বড়! রুখে দাঁড়াতে হবে এই বর্বর অত্যাচারের বিরুদ্ধে, বাঁচাতে হবে নিজের জাতিকে!” বাবার চোখের আলোটা তখন হিরের টুকরোর দ্যুতি ছড়াচ্ছে, “একদিন এই সমগ্র উপত্যকার রাজা হবে তুমি! জয়ী হবে! জয়ী যে হতেই হবে! কারণ আমরা যে দ্বৌসজ! আর দ্বৌসজ মানে... আঃ!”

ধনুকের ফলার মতো বেঁকে গিয়ে হঠাৎ লুটিয়ে পড়লেন বাবা! আমার চারদিকে আবার সেই বাঁকানো নখের মতো ধারালো তীর গুলো ঘিরে আসছে... ভীমরুলের মতো একটা শব্দ সমানে বাড়ছে... হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। এই স্বপ্নদৃশ্য আমার খুব চেনা। পারাবতের মৃত্যুর পর বহু রাত চমকে চমকে জেগে উঠেছি এই স্বপ্ন দেখে দেখে। একটু আগেও তো.... কিন্তু না! এ তো স্বপ্ন নয়! কারণ আমার চোখের সামনে একটা চকচকে ধাতব নখরযুক্ত ফলা সুতীব্র বেগে এসে গেঁথে গেল বাবার তলপেটে! বিস্ফারিত চোখে দেখলাম মাটিতে পড়ে কাতরানো বাবার উরুতে আটকে আছে আরো একটা তীর! আমার শরীর পাক দিয়ে উঠছে, মাথার ভেতরে যেন ছোটাছুটি করছে রক্তরা, তাও আমি একচুল নাড়াতে পারলাম না হাত-পা। শরীরটা পাথরের মূর্তির মতো মাটিতে আমূল গেঁথে থাকল। শুধু প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে আসা দুচোখ দিয়ে দেখতে থাকলাম তলপেটের আঘাত সত্ত্বেও ঝলসে উঠল বাবার দুই চোখ! ঘাড় বেঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রবল ক্রোধে যেন ফুলে উঠতে লাগল শরীরের প্রত্যেকটা পেশী! ঠিক যেন পিঠে আঁকা সেই নাম-না-জানা পাখিটা! তাঁর ঠোঁট ছুঁচলো হয়ে তখন বেরিয়ে এসেছে এক ভয়ঙ্কর গর্জন! যেন যুদ্ধের আগের রণহুঙ্কার! বাবার দৃষ্টি অনুসরণ করে তখন আমার মাথাও উঠে গেছে আকাশের দিকে। সারা আকাশ ছেয়ে ফেলেছে বিরাট বিরাট কালো বাদুড়ের মতো কিছু প্রাণী। হয়তো বেশ কিছুক্ষণ থেকেই আমাদের লক্ষ্য করেছে ওরা, কিন্তু কথায় ব্যস্ত বাবা সতর্ক হওয়ার সময় পাননি। বাদুড়ের মতো দেখতে হলেও মাথার ওপর স্বচ্ছ আবরণের আড়ালে যে মুখটা দেখা যাচ্ছে তাতে চোখ-নাক-কান বসানো ঠিক আমাদের মতোই! আজ একসঙ্গে এতগুলো “শিকার” পেয়ে যেন উল্লাসে মেতে উঠেছে মানুষের দল! আমাদের ঘিরে গোল করে ঘুরতে লাগল ওরা। দাদাও ঠিক আমার মতোই একপাশে দাঁড়িয়ে বাঁশ পাতার মতো কাঁপছে। ততক্ষণে একঝটকায় উঠে দাঁড়িয়েছেন বাবা। হ্যাঁচকা টানে তলপেট থেকে টেনে বের করে ফেললেন ধারালো নখরটা, এতটুকু বিকৃত হল না মুখ। তারপর শরীরটা বাঁকিয়ে কোমরে বাঁধা কাপড়ের গেঁজে থেকে বের করে আনলেন একটা চকচকে ছোরা আর এক নিমেষে ছুঁড়ে দিলেন ওপরের দিকে।

ঠং! ওদের ওই কৃত্রিম উড়ান-পোশাকে ধাক্কা খেয়ে ধাতব শব্দ করে কোথায় যেন হারিয়ে গেল ছোরাটা। শুকনো নিভে যাওয়া মুখে আমাদের দিকে তাকালেন বাবা। এক পরাজিত রাজার মতো ক্লান্ত কণ্ঠে কোনোমতে বললেন, “পালাও। তোমরা পালাও। গাঁয়ে ফিরে যাও। সবার মঙ্গল চিন্তা কোরো।”

নিজের দুচোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমি। চারদিকে কেমন অন্ধকার হয়ে আসছিল, বুকের ভেতর থেকে ফেটেফুটে যেন বেরিয়ে আসবে সবকিছু। ঘোলাটে চোখে দেখলাম আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে তীর এসে ফুঁড়ে ফেলছে বাবার শরীর, গরম রক্তে ভিজে উঠছে বহুদিন তৃষ্ণার্ত থাকা রুক্ষ জমি। কিন্তু বাবার যেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই, তাঁর চোখে তখন জমা হয়েছে একরাশ আতঙ্ক। নিজের জন্য নয়, আমাদের জন্য। শুকনো ঠোঁট চেটে শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে পাগলের মতো চেঁচিয়ে উঠলেন, “দাঁড়িয়ে আছো কেন? পালাও! দৌড়াও! বাঁচতে হবে তোমাদের! আমি থাকি না থাকি... বাঁচতে হবে তোমাদের...এভাবে সবকিছু শেষ হয়ে যেতে পারে না... পালাও...” আস্তে আস্তে জড়িয়ে আসতে লাগল বাবার স্বর, বাসাভোলা পাখির মতো ধাক্কা খেয়ে ফিরতে লাগল পাহাড়ে পাহাড়ে। আমার ওপর যেন একটা পাথর গড়িয়ে এনে ফেলল সেই আওয়াজ। আর বইতে পারছিলাম না বুকের ভার, একটু একটু করে ঝুঁকে পড়ছিলাম সামনের দিকে... এমন সময় এক প্রবল ধাক্কা মেরে কে যেন ঠেলে তুলল আমাকে! তারপর ভীষণ জোরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে কানের কাছে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, “চল্ ভাই! পালাতে হবে! চল্! দৌড়তে থাক! আমার হাত ছাড়বি না একদম!” বলতে বলতে আমার হাত শক্ত করে মুঠোর মধ্যে নিয়ে দৌড়তে শুরু করল গলাটা। কী এক অবশ টানে আমিও পেছন পেছন দৌড়তে শুরু করলাম।

পাহাড়ের খাঁজে নিজেদের আড়াল করে, মরা গাছের ফাঁক গলে পাগলের মতো দৌড়োচ্ছিল দাদা, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি। সামনে ঢালু হয়ে গেছে জমি, তারপর এক বিশাল প্রান্তর। সেই মাঠ পেরোতে পারলেই শুরু হয়েছে অল্পস্বল্প কিছু গাছের জটলা। সেই জঙ্গল পেরিয়ে বেশ কিছুটা চড়াই উঠলে গাঁয়ের সীমানা, আমাদের গুহা। মাথার ওপর থেকে যেন গলন্ত লাভা ঢালছে সূর্যটা, গলা শুকিয়ে কাঠ, ফুসফুসটাও ফেটে যাবে মনে হচ্ছে। তা সত্ত্বেও নিজেদের নিংড়ে দিয়ে প্রাণভয়ে দৌড়োচ্ছি আমরা। কারণ পিছনেই চওড়া ইস্পাতের ডানা মেলে উড়ে আসছে মানুষের দল। মাত্র একটা তরতাজা প্রাণ শিকার করে তাদের খিদে মেটেনি! বাবার রক্তাক্ত মুখটা সামনে চলে আসছিল বারবার, ঘামের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল কান্না। টলতে টলতে কোনোমতে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম শরীরটাকে... সামনে দেখতে পাচ্ছি গাছগুলোকে...কিন্তু ঝাপসা হয়ে আসছে সব কিছু...শুধু খুব কাছে চলে এসেছে যান্ত্রিক গোঁ গোঁ শব্দটা...ওরা ধরে ফেলেছে আমাদের... এই বোধহয় শেষ... আর পারছি না...দম ফুরিয়ে গেছে...একটা ছোট্ট হোঁচট খেয়ে আছড়ে পড়লাম পাথরের ওপর। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার হাতটা আলগা হয়ে গেল দাদার হাত থেকে।

উফ্! গোড়ালির কাছে কিছুটা মাংস চিরে কী যেন বেরিয়ে গেল! প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে মাথাটা তুলে দেখলাম একটু দূরেই মাটির ওপর পড়েছে একটা বাঁকানো তীর। গোড়ালি ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু তার ঠিক পরেই এমন একটা ঘটনা ঘটল যে বিস্ময়ে আতঙ্কে পাথর হয়ে গেলাম আমি।

উল্টো দিক থেকে পাগলের মতো আমার দিকে ছুটে আসছে দাদা, চোখ আকাশের দিকে। একদম কাছে এসে হঠাৎই থেমে গিয়ে দু হাত ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ল আমার ওপর। আর সঙ্গে সঙ্গেই একঝাঁক তীক্ষ্ণ ফলা এসে বিঁধে গেল ওর সারা শরীরে।

চিৎকার করে উঠলাম আমি! এ কী করলো দাদা! আমাকে বাঁচাতে গিয়ে এভাবে... বুক ফাটা হাহাকার করে দুহাতে জড়িয়ে সরাতে গেলাম ওকে, কিন্তু বুঝতে পারলাম বিশেষ লাভ নেই। “দাদা! এই দাদা!” বলে চিৎকার করতে করতে ওকে সরানোর চেষ্টা করতেই থাকলাম, কিন্তু অসহায়ের মত ব্যর্থ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না আমার। ওর টাটকা রক্তে ভেসে যাচ্ছিল আমার সারা গা। এক একটা ফলা এসে গেঁথে যাচ্ছিল ওর কচি শরীরে আর মরণ আর্তনাদ করে উঠছিল দাদা! হাউ হাউ করে কাঁদছিলাম। তার মধ্যেই টকটকে লাল জলভরা চোখ মেলে শান্ত গলায় দাদা বলে উঠল, “পালা ভাই! এই সুযোগে পালা! আমার নীচে তোকে দেখতে পাচ্ছে না ওরা! পালিয়ে যা!

গোঙাতে গোঙাতে দুহাতে ওর মুখটা ধরে বললাম, “কিছুতেই না! তোকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না দাদা! এখানেই থাকব আমি... তোর সঙ্গে।”

“সোনা ভাই আমার...” দুর্বল গলায় হাঁফাতে থাকল দাদা, “আমার কথাটা শোন... গাঁয়ে ফিরে যা... ওদের তোকে খুব প্রয়োজন... মনে আছে, বাবা বলতেন দিন পাল্টাবেই? তোকে আনতে হবে সেই গৌরবের দিন! তুই পালা ভাই! পিছন ঘুরে আর দেখিস না... যা...” বলতে বলতেই আঁক্ করে থেমে গেল দাদা। কারণ একটা তীক্ষ্ণ ফলা ওর মাথা ভেদ করে এসে দাঁড়ালো আমাদের মাঝে।

আমার চারপাশে সব কেমন তরল আলকাতরা হয়ে গলে পড়তে থাকল। কষ্ট যন্ত্রণা আতঙ্ক আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অচেতনতার গভীর অন্ধকারে। তাও আমার ভেতরের কোন এক লুকিয়ে থাকা শক্তি চেতনার শেষ সীমাতে এসেও জাগিয়ে রাখছিল আমাকে। এভাবে কতক্ষণ কাটল জানি না। একসময় কমতে কমতে দূরে মিলিয়ে গেল গোঁ গোঁ আওয়াজ। দাদার ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখদুটো তখনো দেখছে আমাকে। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের ওপর ভনভন করে উড়ে বেড়াচ্ছে গোটা কতক মাছি। তিরের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে বেরিয়ে এলাম কোনোমতে। এখানে ওখানে কেটে গিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে, দাদার শরীর ভেদ করে আমাকেও খোঁচা মেরেছে বেশ কটা তির। কিন্তু কোনোরকম ব্যথার অনুভব হচ্ছে না। আমার সব বোধ বুদ্ধি কোনো এক ভোঁতা হাতুড়ির বারবার আঘাতে গুঁড়িয়ে গেছে। টলতে টলতে কোনদিকে এগিয়ে চললাম নিজেই জানি না। আজ আমার কেউ নেই, কিছু নেই। যে দুজনকে ঘিরে ছিল আমার গোটা জগত তারা অনেক কষ্টে দগ্ধে দগ্ধে ছেড়ে গেছে এ পৃথিবী। অথচ আজ সকালটাও কত অন্যরকম ছিল! বাবার স্নেহভরা হাতটা যেন আলতো হাওয়ায় ভেসে এসে মাথার ওপর বুলিয়ে দিয়ে গেল। আর দাদা? দুহাতে আমাকে কোলে জড়িয়ে ধরে ঘুমোনো দাদা, একখানা পেয়ারা আধাআধি করে খাওয়া দাদা, “তুই তো আমার প্রাণের বেশী” বলে গলা জড়িয়ে ধরা দাদা... সবাই একে ভিড় জমাতে লাগল আমার সামনে। অন্ধকার নেমে আসছিল।

***

একটা আলতো আলো। পদ্মপাতার মতো নরম মখমলে। আমার মুখের ওপর যেন খেলা করছে আলোটা। এই আছে, এই নেই! বারবার যাচ্ছে কোথায়? ঘষা কাঁচের মতো একটা আবছায়া ধরে ফেলছে ওকে, আবার ঠিক এদিক ওদিক গলে ঠিক ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে পড়ছে আলোটা। ভারী মজা তো! কিন্তু একী! ছায়াটা একটু একটু করে বড় হয়ে গপ্ করে গিলে ফেলল পুরো আলোটাকে... আর...

“দাদা!” চিৎকার করে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। একটা তীব্র গোল আলো, তার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক যেন আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ছে তার মাথা থেকে। এটা কোন জায়গা? কোনো গুহা মনে হচ্ছে, কিন্তু আশেপাশে সব কিম্ভূত কিমাকার যন্ত্রপাতি ছড়ানো। একটা মারাত্মক সম্ভাবনা বিদ্যুৎ গতিতে আমার মাথায় ঝলসে উঠল! এটা কি মানুষের ডেরা? আমি কি ধরা পড়ে গেছি? ওরা কি আমাকে নিয়ে এসেছে ওদের শহরে আরো ভয়ঙ্কর কিছু করবে বলে? আমার সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। মুখ দিয়ে একটা আর্তনাদ ছিটকে আসবে, এমন সময় আলোর সামনে থেকে সরে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো মানুষটা। আর আমার চোখ যেন ধাঁধিয়ে গেল।

হ্যাঁ, মানুষই বটে। এমন অদ্ভুত সুন্দর মানুষ আমি আগে দেখিনি। আমাদের মতো থ্যাবড়া নাক, পুরু ঠোঁট নেই, নেই কুচকুচে কালো শরীরও। দীর্ঘ পেটানো শরীর, লম্বা নাক, চোখ দুটি টানা টানা... ভীষণ মায়া মাখানো। শরীরের রঙ ঘন নীল, চামড়া ভেদ করে যেন সেই শরীর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে এক নরম আভা। পাতলা ঠোঁটে ফুটে উঠল মিষ্টি হাসি, আর তার পরেই ভেসে এল এক ঠান্ডা সুরেলা স্বর, “ভয় পেয়ে না। আমি তোমার শত্রু নই।”

আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না। কে এই লোকটা? আমাদের একজন এ নয়। তবে কি শহরের মানুষ? তাই যদি হবে তাহলে আমাকে অত্যাচার করার বদলে এত ভালো করে কথা বলছে কেন? কী এক অদ্ভুত শান্তি, ভরসা আছে লোকটার গলায়...বড় আপন মনে হচ্ছে ওকে। একটা সোনালী তরল ভরা স্বচ্ছ পাত্র আমার মুখের সামনে ধরল লোকটা, “এটা খেয়ে নাও। শরীর অনেকটা ভালো লাগবে।”

এটা কী দিচ্ছে লোকটা? বিষ? আমি পাত্রটা হাতে নিয়ে সন্দেহের গলায় বললাম, “এটা কোন জায়গা? আপনি কে?”

বেশ গুছিয়ে বসল নীল মানুষ। তারপর মুচকি হেসে স্নেহমাখা গলায় বলল, “আমি? আমি অনেক দূরে থাকি। মাঝে মাঝে এখানে আসি, কিছু জিনিসপত্র জোগাড় করে নিয়ে যাই আমার গবেষণাগারের জন্য। গতকাল তেমনই মতলবে আদাড়ে বাদাড়ে ঘুরছিলাম, দেখতে পেলাম রক্তমাখা অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছো তুমি। তাই তুলে নিয়ে এলাম আমার এই অস্থায়ী ডেরায়।” একটু ঝুঁকে পড়ে ঘন হয়ে এল লোকটা, চোখে চোখ রেখে নরম গলায় বলল, “কী হয়েছিল তোমার?”

সেই স্বর যেন আমার বুকের গভীরতম কোণটায় গিয়ে ধাক্কা মারল। একদৃষ্টে ওই হরিণ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একসময় আমার দুচোখও ভরে উঠল জলে। গলা বেয়ে আমার বুক ভাসিয়ে নিয়ে গেল সেই গরম নোনতা স্রোত। মনে পড়ে গেল বাবা আর দাদার মুখ দুটো, যে মুখ দুটো আর কোনোদিন দেখতে পাবো না। কোনোদিন শুনতে পাবো না সেই হাসি, আদর। হঠাৎই কেমন শীত করে উঠল আমার। কেন আমিই হতভাগ্যের মতো একা রয়ে গেলাম এই পৃথিবীতে? চুপ করে আমাকে দেখছিল সেই মানুষ, আচমকা দুই হাতে আমার গাল দুটো মুছিয়ে দিয়ে হাত রাখল মাথায়। গাঢ় স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল, “খুলে বলো আমাকে। আমি তো তোমার বন্ধু!”

কোথায় যেন ভেসে গেলাম আমি। খুলে গেল আমার বুকের সব আগল, বাঁধ ভাঙা কান্নায় তার কাঁধের ওপর আছড়ে পড়লাম। শুধু সমব্যথী দুই হাত শান্ত ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল আমার পিঠের ওপর। এইভাবে কেটে গেল মুহূর্তের পর মুহূর্ত। একসময় নিজেকে কিছুটা সামলে উঠতে পারলাম। যেন সেই ক্ষণেরই অপেক্ষায় ছিল সে, দুই কাঁধে হাত রেখে বলল, “কেন এত কষ্ট পাচ্ছ বন্ধু? কোথায় তোমার বাড়ি, পরিবার? কী হয়েছিল খুলে বলো? “

“পরিবার!” শোকের পাথর ঠেলে হাহাকার ঠিকরে এল আমার গলা দিয়ে, “যে দুজন ছিল আমার সবকিছু, তাদেরই তো মেরে ফেলেছে ওরা!”

“ওরা কারা?”

“মানুষেরা।”

স্তম্ভিত মুখে তাকাল লোকটা। তিনটে ভাঁজ খেলে গেল চওড়া নীল কপালে। কাঁপা কাঁপা গলায় আচ্ছন্নের মতো বলতে শুরু করলাম আমি, “আমাদের জাতির নাম দ্বৌসজ। ওই বিন্ধ্য পাহাড়ের ওপর আমাদের গাঁ। আমার বাবা ছিলেন গাঁয়ের মোড়ল...।” এরপর একে একে বাবার কথা, দাদার কথা, খিদে-তেষ্টা-তাপের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা দিনগুলো এবং মানুষদের নৃশংস হত্যালীলা কীভাবে কেড়ে নিল আমার প্রিয়জনদের... সে সমস্ত যন্ত্রণার উপাখ্যান আগলহীন বন্যার মতো ঠেলে উঠে আসতে লাগল আমার ভেতর থেকে। কান্না-চিৎকার মিলেমিশে একটা অদ্ভুত গোঙানি বেরোচ্ছিল! বুকের ভেতরের সমস্ত ক্ষতর মুখ যেন খুলে গেছে... কিন্তু একই সঙ্গে বুঝতে পারছিলাম একটু একটু করে একটা ঠান্ডা নরম প্রলেপ পড়ছে আঘাতগুলোর ওপরে। আত্মহারার মতো নিজেকে উজাড় করে বলে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ নীল মানুষের দিকে চোখ পড়তেই আমার খেই হারিয়ে গেল।

আমার সামনে বসে যেন সম্পূর্ণ অন্য একজন মানুষ! কোথায় সেই মধুর কোমল হাসি, টলটলে দীঘল দুই চোখ? তার জায়গায় ঠোঁট-চাপা কঠিন চোয়ালে ফুটে উঠছে চরম ক্রোধ আর চোখ দুটোয় যেন ধিকিধিকি জ্বলছে নরকের অগ্নিকুণ্ড! হাত দুটো মুঠো পাকিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দপদপ করে ফুলে উঠল তার শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরা! আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলে উঠল, “এরা কোনোদিন শুধরোবে না! এর আগেও কালে কালে বহুবার এখানে এসেছি আমি... সবকিছু ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছু সময় যেতে না যেতেই নিজের আদিম বর্বর খোলসটার মধ্যে বারেবারে ঢুকে পড়ে এই মানবজাতি!” মাথা নীচু করলাম। একটা ফুটন্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠছে আমার ভেতরেও, কিন্তু... কানে এল এক বজ্রনির্ঘোষ, “এই বর্বরতার শেষ হবে এবার! তুমিই শেষ করবে এই নৃশংস অত্যাচারের রীতিকে! তোমার বাবা-দাদা, তোমার গাঁয়ের প্রত্যেকটা 'শিকার' হওয়া মানুষের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে তুমি!”

সে কণ্ঠস্বরে এমন এক আদেশ মিশে ছিল যে ভয়ে যেন থরথরিয়ে কেঁপে উঠল গুহার সমস্ত জিনিসপত্র! ভীত হয়ে পড়েছিলাম আমিও। আমার দিকেই আঙুল নির্দেশ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। কোনোমতে আমতা আমতা করে বললাম, “কিন্তু আমি তো খুবই ছোট...আর ওদের অনেক শক্তি...ওদের সঙ্গে কি আমি...”

“কে বলেছে তুমি ছোট?” আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দুহাতে আমার কাঁধ চেপে ধরল সে, “একজন প্রকৃত যোদ্ধার ক্ষমতা নির্ণয় হয় তার সাহস আর মনের জোর দিয়ে। সেই সাহসই তোমার শক্তি হয়ে উঠবে বন্ধু! আমি তোমাকে সাহায্য করব!”

একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, যেন পড়ে নিচ্ছে মনের ভেতর পর্যন্ত। ও কি বুঝতে পারছে আমার মনের টানাপোড়েন? যা বলছে এই লোকটা তা কি সত্যিই সম্ভব? এমন ক্ষমতা আছে এর যে তার সাহায্যে আমি হারিয়ে দেব ওই মহাশক্তিশালী মানুষ গুলোকেও? নাকি এ ওদেরই একজন? আরো বড় কোনো জালে জড়িয়ে ফেলছে আমাকে? এই কয়েক ঘন্টায় যা যা ঘটে চলেছে আমার সঙ্গে, তার পুরোটাই আমার কাছে কিছু দিন আগেও ছিল কল্পনাতীত। আর এইসমস্ত ভয়াবহ অভিজ্ঞতা যেন একলাফে কয়েকগুণ বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে... কোথায় হারিয়ে গেছে সেই ছোট্ট ছেলেটার সহজ-সরল মনটা। কোনো কিছুই আর সহজে বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না। তবুও যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে ওর কথা গুলো... ও যেন আমার বহুদিনের চেনা... আমার চিরসখা...

“এই নাও,” আমার হাত থেকে ফাঁকা পাত্রটা নিয়ে অন্য একটা পাত্র ধরিয়ে দিল লোকটা। তাই তো! কথার ফাঁকে কখন যেন খেয়ে ফেলেছি সেই সোনালী তরল! আর সত্যিই বেশ ঝরঝরে লাগছে শরীরটা, ব্যথা বেদনাগুলো অনেকটাই কম। তাহলে কি মিথ্যে সন্দেহ করছি আমি? উল্টোদিকে ঘুরে কিছু যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করছিল লোকটা, পেছন না ফিরেই মৃদু গলায় বলল, “খেয়ে নাও ওটা। ঘুমের খুব প্রয়োজন তোমার।” দোলাচলে দুলতে দুলতে একসময় আমিও ঠোঁট ঠেকালাম মিষ্টি স্বাদের ওই ঝাঁঝালো সবুজ তরল ভরা পাত্রটাতে।

***

ট্যাঁ ট্যাঁ ট্যাঁ করতে করতে একঝাঁক বনটিয়া উড়ে গেল। আমাদের গুহার সামনেও রোজ আসত একদল। আমি আর দাদা খুব খেলা করতাম ওদের সঙ্গে। ছোট্ট ছোট্ট লাফ দিয়ে ওরা হেঁটে চলে বেড়াত, খাবার খেত আমাদের হাত থেকে। রোজ একই দল আসে কিনা দেখার জন্য একবার একটার গলায় আলতো করে রঙিন সুতো বেঁধে দিয়েছিল দাদা। ওমা, পরেরদিনই সেই পাখি হাজির! দুটো দিন হয়ে গেল ফাঁকা পড়ে আছে আমাদের ঘর। ওরা কি এসে ডেকে ডেকে ফিরে গেছে? চোখের ভেতরটা জ্বালা করে উঠল। আর কোনোদিন খেলা হবে না দাদার সঙ্গে। ঘরেও কি আর ফেরা হবে কোনোদিন? অবশ্য ফিরেই বা কী করব? কে আছে আমার সেখানে? গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়া ফোঁটা দুটোকে মুছলাম। সামনেই দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলেছে নীল মানুষ। ভোরের লালচে গোলাপি আলো ওর চওড়া নীল পিঠটার ওপর পড়ে কী সুন্দর বর্ণচ্ছটা তৈরী করেছে! হাঁটাটা যেন বাবার মতো লাগে, সেই ভয়ডরহীন বড় বড় পা ফেলে বুক চিতিয়ে এগিয়ে চলা। গতকাল সেই সবুজ মিষ্টি মিষ্টি জিনিসটা খাওয়ার একটু পরেই ঘুম পেয়ে গেছিল আমার। তারপর কী হয়েছিল জানি না, ভোরে যখন একটা ঠান্ডা পরশে ঘুম ভাঙল, তখন দেখি একটা নরম বিছানায় শুয়ে আছি আমি, আর আমার মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে। এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম সবকিছু, আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নীল হাতটা জড়িয়ে। একটুও বিরক্ত হয়নি সে, সরিয়ে নেয়নি হাতটা। শুধু স্নিগ্ধ গলায় ফিসফিসিয়ে বলেছিল, “এবার যে উঠে পড়তে হবে বন্ধু! ভোর হয়ে এল। আমাদের বেরোতে হবে। আজ বড় গুরুত্বপূর্ণ দিন। আজ তোমার অভিষেক।”

তার পরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম আমরা। জানি না কোথায় যাচ্ছি। শুধু এটুকু মনে হচ্ছে এখন আমি আর একেবারে একা নই। কেউ রয়েছে আমার পাশে পাশে, আমার হাত ধরে, আমার সাহস হয়ে! তাই গতকালের সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে বেরিয়ে পড়েছি ওর পেছন পেছন। শরীর এখন একেবারে চনমনে! কী আশ্চর্য ওষুধ দিয়েছে কে জানে, পায়ের ঘা-টাও শুকিয়ে আসছে দ্রুত! শুধু কাঁধের কাছটা কেমন সুড়সুড় করছে। একখানা সাদা কাপড় চাদরের মতো আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়েছে সে। হাবেভাবে সত্যিই মনে হচ্ছে আজ বুঝি কোনো বিশেষ দিন!

আপনমনে আবোলতাবোল ভাবতে ভাবতে জঙ্গলের পথ পেরোচ্ছিলাম। এতক্ষণ খেয়াল করিনি, নীল মানুষ হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়তেই আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরের ভেতর দিকে প্রচন্ড গতিতে যেন একটা বিদ্যুতের স্রোত বয়ে গেল!

আমরা দাঁড়িয়ে আছি বিরাট এক প্রান্তরের সামনে, যার কোনো এক প্রান্তে ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের বলি দিয়ে দিয়েছিল আমার দাদা। হয়তো এখনও দূরের কোনো কোণায় পড়ে আছে তার মৃতদেহ।

মুহূর্তের মধ্যে যেন জমে পাথর হয়ে গেলাম আমি। হাত-পা গুলো অসাড় হয়ে অনুভূতিহীন অথচ বুকের ভেতর থেকে একটা বিষমাখা যন্ত্রণা উঠে এসে ছড়িয়ে যাচ্ছে আমার প্রত্যেকটা কোষে, আর তার ছোবল আছড়ে পড়ছে শরীর জুড়ে। এ কোথায় নিয়ে এল আমাকে ওই লোকটা! চোখের মধ্যে যেন সূচের মতো ফুটছে এক গোছা মর্মান্তিক দৃশ্য... তীব্র বেগে এক গোছা তির এসে ফালাফালা করে দিল বাবার পেট... ঢলে পড়ছেন বাবা... মুখ দিয়ে ভলকে ভলকে বেরোচ্ছে রক্ত... আমরা ছুটছি... আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল দাদা... বৃষ্টির মতো তির আসছে... দাদার মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে এল একটা চকচকে ফলা... তার মধ্যেই শুনতে পেলাম কানের কাছে কে যেন খসখসে স্বরে বলে উঠল, “চিনতে পারছ জায়গাটা?”

“কেন?” প্রবল ঘৃণাভরে চেঁচিয়ে উঠলাম, “কেন এনেছেন এখানে? কী চান আপনি?”

আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো সেই নীলবর্ণ জীব। তার চোখ দুটো জ্বলছে ধকধক করে। আমার চোখে চোখ রেখে যেন খানিক বিদ্রুপ করেই বলল, “কেন, ভয় করছে?”

বিশ্বাসঘাতক! এই লোকটাকে এতটা আপন ভেবেছিলাম আমি! ভেবেছিলাম এই একলা পৃথিবীতে আমার আশ্রয় হয়ে দাঁড়াবে এই লোকটা! প্রচণ্ড রাগে ইচ্ছে করছিল আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে দিই... কিন্তু মনে হল...ভীমরুলের মতো একটা তীব্র গোঁ গোঁ আওয়াজ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। এসে গেছে মানুষের দল!

মুহূর্তের মধ্যে চোখ-মুখ পাল্টে গেল লোকটার। সাবধানী চোখে চারদিক দেখতে দেখতে বিড়বিড় করল, “আমি জানতাম! আমি জানতাম ওরা আসবেই!” তারপর চট করে আমার হাত ধরে টানতে টানতে এগিয়ে চলল, “গতকাল ওরা খুঁজে পায়নি তোমাকে, তাই আজ আবার এসেছে! আমি জানতাম এমনটাই হবে! তাই তোমায় নিয়ে এলাম এখানে...”

মাথার ভেতর ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। কী করতে চাইছে লোকটা? ও আসলে কাদের দলে? কিন্তু আর কিছু ভেবে ওঠার আগেই দেখলাম আমরা গিয়ে দাঁড়িয়েছি একটা মস্ত উঁচু গাছের নীচে। “তাড়াতাড়ি করো,” বলেই লোকটা হঠাৎ তরতর করে উঠতে শুরু করল গাছটায়! ওদিকে ক্রমশ এগিয়ে আসছে ভীমরুলের ডাক... দূর আকাশ প্রান্তে দেখা যাচ্ছে কালো কালো সারিবদ্ধ কিছু উড়ন্ত বস্তুকে... আর সময় নেই... “কী হল! এসো?” বলে ওপর থেকে ডাক আসতেই আমার অবচেতন মন থেকে কেউ যেন একটা জোর ধাক্কা মারল, আর গাছে উঠতে শুরু করলাম আমি। হাঁচোড়পাঁচোড় করে কোনো মতে মগডালে উঠে তার পাশে যেতে দেখলাম কপালের ওপর হাত ভাঁজ করে দূর দিগন্তের দিকে কী যেন দেখছে সে। একটা আবছা ধূসর আকাশ, লালের ছোপ লেগেছে এখানে ওখানে... তার নীচ দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে মানুষেরা। যাদের একমাত্র লক্ষ্য বাকি সব জীবিত প্রাণীকে ধ্বংস করা। আমাকে একটা শক্তপোক্ত ডালে বসিয়ে আমার মুখোমুখি বসল সে। চোখেমুখে এক অদ্ভুত কাঠিন্য, শরীরের সমস্ত পেশী টানটান... যেন এক যোদ্ধা প্রস্তুত যুদ্ধক্ষেত্রে নামার জন্য! আমার চোখে চোখ রেখে বরফের মতো ঠান্ডা গলায় বলল, “আমার দিকে তাকাও। যে কথাগুলো এখন বলছি সেগুলো ভালো করে শোনো।”

আমি মোহগ্রস্তের মতো তাকিয়ে থাকলাম। দূর থেকে ভেসে আসা মানুষদের উড়ান পোশাকের কৃত্রিম আওয়াজটা যেন একটা ঘোরের মধ্যে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। গম্ভীর গলায় সে বলতে থাকল, “একটু পরেই এই জায়গাটা ঘিরে ফেলবে মানুষেরা। গাছে থাকলেও সহজেই আমাদের দেখতে পাবে ওরা। ওরা যখন গাছের কাছাকাছি চলে আসবে, তখন এগিয়ে যাবে তুমি। ভয় পাবে না একদম! ওরা তোমাকে ঘিরে ফেলতে চাইবে, তখন তুমি সোজা লাফ দেবে এই ডাল থেকে।”

“ককীইই? লাফ?” এরকম একটা অদ্ভুত কথার জন্য একেবারেই তৈরী ছিলাম না! উত্তেজনায় জড়িয়ে গেল আমার জিভ!

“তোমার ইচ্ছে করছে না ওদের শেষ করে দিতে?” আমার কথার উত্তর না দিয়ে চাপা চিৎকার করে উঠল সে, “ইচ্ছে করছে না ওদের ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দিতে? মনে করো... কতটা কষ্ট দিয়ে, কতটা নৃশংসভাবে খুবলে খুবলে ওরা মেরে ফেলল তোমার বাবা আর দাদাকে! ওদেরকেও ওরকম ভাবে মারবে না তুমি?”

“মারব! মারব!” হঠাৎই আমার ভেতর থেকে একটা উন্মাদ চিৎকার করে উঠল, “কুটি কুটি করে ফেলব ওদের! আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে ওরা! কী ক্ষতি করেছিল বাবা, দাদা? কী দোষ করেছিল পারাবত? কেন মরতে হল ক্রৌঞ্চ, পরাভৃৎ, পেখমের মতো পাহাড়ের নিরীহ মানুষদের?” আমার ভেতর থেকে যেন লাভা উদগিরণ হচ্ছিল!

“এদের সবার প্রতিশোধ নেওয়ার দায়িত্ব আজ তোমার কাঁধে।” আমাদের গাছটা ঘিরে ফেলেছে মানুষেরা, কানফাটানো শব্দের মধ্যে শক্ত করে ধরে আমাকে এগিয়ে দিল নীল মানুষ। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, “যাও... ওদের শেষ করে এসো। আমি তোমার পাশেই আছি বন্ধু।”

গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালটায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বিশাল বিশাল পোকার মতো আমার চারদিকে উড়ছে মানুষ গুলো। নীল মানুষের দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই ওদের, যেন একমাত্র লক্ষ্য আমিই! আমাকে দেখে কি আনন্দ হচ্ছে ওদের? গতকালের ফসকে যাওয়া শিকারকে আজ আবার বাগে পেয়েছে... নিশ্চয়ই উল্লসিত ওরা! কিন্তু এই মুহূর্তে আমি যেন সমস্ত আবেগ অনুভূতির উর্দ্ধে পৌঁছে গেছি। একটুও ভয় করছে না আমার। কী হবে? লাফ দিলে নীচে পড়ে মরে যাবো, কিংবা ওদের তিরে? মরতেই তো চাই আমি... কিন্তু যদি না মরি, তবে ওদের নিকেষ করেই ছাড়বো!

আঘাত হেনে দিয়েছে ওরা। চোখের কোণ দিয়ে দেখলাম আমার দিকেই উড়ে আসছে একটা চকচকে ধারালো তির। ঠিক সেই সময়ে দু হাত ছড়িয়ে লাফ মারলাম নীচের দিকে আর এরপর যে ঘটনা ঘটল তেমন কিছু যে ঘটতে পারে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি! আমার শরীরটা নীচের দিকে নামতে শুরু করা মাত্রই আমার পিঠের ওই উল্কির জায়গাটা থেকে দুপাশে খুলে গেল বিশাল দুটো ডানা! আর সঙ্গে সঙ্গেই আবিষ্কার করলাম নীচের দিকে আর পড়ছি না আমি, বরং ডানা দুটো খুলে যাওয়া মাত্রই অদ্ভুত এক প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় সে দুটো নাড়তে শুরু করেছি... যেন জন্ম থেকেই আছে আমার এই ডানা দুটো! মানুষগুলো স্বভাবতই ঘাবড়েছে, এই দৃশ্য দেখে ভয়ে আতঙ্কে বিস্ময়ে কিছুটা দিশেহারা হয়ে গেল তারা। আর এই সুযোগটুকুই দরকার ছিল আমার। কারণ ততক্ষণে আমি খেয়াল করেছি আমার মনে জেগে ওঠা প্রচণ্ড রাগ-দুঃখ-যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গেই ডানা দুটোর শেষ প্রান্তে জোড়ায় জোড়ায় জেগে উঠেছে অসংখ্য ধারালো নখ। সেই নিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সবথেকে কাছে থাকা মানুষটার ওপর। শেষ মুহূর্তে আর কিছু না পেরে দুহাত দিয়ে আমাকে ঠেকানোর চেষ্টা করল সে, কিন্তু ওই ধারালো নখের আঘাতে হাত দুটো কনুই থেকে ছিঁড়ে দেওয়ার পর আর বেশীক্ষণ যুঝতে পারল না। পাশের মানুষটা মনে হয় তাকে বাঁচাতে খানিক কাছাকাছি এসে গেছিল, সব কটা নখ তার বুকে ঢুকিয়ে পূর্ণ শক্তিতে দু দিকে টেনে দিলাম। বাবুই পাখির ছেঁড়া বাসার মত নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে আসা শরীরটা আছড়ে পড়ল নীচের পাথুরে মাটির ওপর। একজন তার হাতের অস্ত্রটা তাক করেছিল আমার বুকের দিকে, প্রবল আক্রোশে বিশাল বাদামি ডানার এক ঝাপটা মারলাম তার গলা বরাবর। মাথাটা ধড় থেকে আলাদা হয়ে যখন ছিটকে পড়েছিল দূরে, তখনও তার খুলে থাকা বিস্ফারিত চোখে লেগেছিল চরম অবিশ্বাস! বাকিরা ততক্ষণে পালাতে শুরু করেছে, কিন্তু বাবা আর দাদার মৃত্যুতে আমার মধ্যে জন্ম নেওয়া রাগ আর কান্না তখনো শেষ হয়নি। সেটাকে সম্বল করে যখন ঝাঁপিয়ে পড়লাম পালাতে থাকা মানুষগুলোর ওপরে, তখন আমার চোখ দিয়ে বইতে শুরু করেছে নোনতা জলের ধারা।

রক্তে ভেজা উপত্যকা, এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা নাড়িভুঁড়ি-মাংসের টুকরোর মধ্যে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম আমি। দূরের পাহাড় থেকে ছুটে আসা ঠান্ডা বাতাস যেন বয়ে আনছিল বাবার কথাগুলো... “একদিন আসবে যেদিন একজন মাথা তুলবে এর বিরুদ্ধে... হত্যাকারী অপরাধীদের চরম শাস্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করবে সাম্যের, ন্যায়ের...আর হয়ে উঠবে প্রকৃত দ্বৌসজ!”

পিঠের ওপর কে যেন হাত রাখল। পেছন ফিরলাম। হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে সে। নিঃশব্দে জড়িয়ে ধরলাম নীলবর্ণ শরীরটা, আমার কান্নার দমকে ভিজে যেতে থাকল তার কাঁধ। আলতো হাত খেলা করতে লাগল আমার পিঠের ওপর, আর কানের কাছে ফিসফিস করে উঠল একটা অপার্থিব কণ্ঠস্বর, “কেঁদো না, বন্ধু। শক্ত হও। তোমার সামনে এখন অনেক কাজ, অনেক বড় দায়িত্ব। এই অন্যায়ের শেষ করতে হবে, শুরু করতে হবে এক নতুন যুগের। এক নতুন পৃথিবীর রাজা হওয়ার জন্যই তুমি জন্মেছ। দ্বৌসজ মানে কী,জানো? যারা দ্বৌস পিতা অর্থাৎ আকাশের দেবতা ও জননী ভূমির সন্তান। তাই তারা যেমন বিচরণ করে আকাশে তেমনি নিজবলে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে এই ভূমির বুকে। এই যুদ্ধে আমি এক নিমিত্ত মাত্র, নিজের কারিগরী বিদ্যার সাহায্যে শুধু মাত্র জাগিয়ে তুলেছি তোমার মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা তুমিকে। কিন্তু বাকি লড়াইটা তোমাকে একাই লড়তে হবে। আমার ভূমিকা এটুকুই ছিল, এবার আমার বিদায় নেওয়ার পালা।”

চমকে উঠলাম আমি, “মানে? এই অবস্থায় আমায় একা ফেলে কোথায় যাবে তুমি?”

“কে বলেছে তুমি একা?” কাঁধে হাত রাখল সে, “গোটা গাঁয়ের লোক যে অপেক্ষা করছে তোমার জন্য! তাদের নতুন রাজার জন্য! কিন্তু ফিরে তো আমাকে যেতেই হবে বন্ধু।”

আমার মাথার ওপর থেকে যেন একটা আশ্রয় সরে যাচ্ছিল... হারিয়ে যাচ্ছিল খুব দামী কোনো কিছু। মরিয়াভাবে আঁকড়ে ধরলাম তাকে, “কোথায়? কোথায় চলে যাবে তুমি? আর আসবে না?”

অল্প হাসল সে। দূরের আকাশের দিকে চোখ মেলে বলল, “আমাকেও যে ফিরতে হবে আমার ঘরে। সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে আমার লোকেরা, আমার পরিবার। হয়তো এখনি কিছুদিন আসতে পারবে না... আসলে অনেক দূরে তো আমার ঘর...”

“কত দূরে?” উদগ্রীব হয়ে বললাম, “আমি নাহয় চলে যাবো সেখানে... এই ডানা মেলে!”

“উঁ?” অন্যমনস্ক গলায় একটু হাসল সে, “অনেক দূরে... ওই আকাশের ওপারে সরযূ নক্ষত্র মণ্ডলীতে।”

আকাশের ওপারে! সেটা যে কতদূর ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারছিলাম না। আমার জগত তো এই বিন্ধ্য পাহাড় জুড়েই... তার বাইরে কোনোদিন যাইনি আমি... আমার দোলাচলটা বোধহয় ধরতে পারল সে। দুই হাতে আমার হাত ধরে বলল, “তবে তোমায় কথা দিলাম ভবিষ্যতে আমাদের আবার দেখা হবে। আবার তোমাদের দুনিয়ায় ফিরে আসব আমি। সেদিন হয়ত আমার তোমার সাহায্যের প্রয়োজন হবে। তখন হাত বাড়িয়ে দেবে তো বন্ধু?”

কিছু বলতে পারলাম না। বাবা-দাদাকে হারানোর পর আবার যেন খুব কাছের কাউকে নতুন করে হারাচ্ছিলাম আমি। এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছিল ভেতরটা। শুধু শক্ত করে ধরে থাকলাম ওর হাতদুটো, চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল।

সদ্যজাত সূর্যের দিকে তাকালে সে। দূর পাহাড়ের চূড়ায় দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “যাও বাজ, ফিরে যাও নিজের গাঁয়ে...নিজের লোকেদের কাছে। ফিরিয়ে দাও তাদের অধিকার। এখন তুমি আর সেই ছোট্ট ছেলেটি নেই, তোমার মধ্যে জন্ম হয়েছে এক নতুন রাজার। তাই যাওয়ার আগে এই নতুন রাজার নামকরণ নাহয় আমিই করে গেলাম! আজ থেকে তোমার নাম... জটায়ু!”