বৃক্ষমানবী ● পৃথ্বীশ গজী


 

স্পেসশিপটা নিয়ে নিচের দিকে নামতে নামতে অ্যারনি বুঝতে পারলেন তাঁর ধারণাই ঠিক। এই নীল রঙের গ্রহটাতে যে প্রাণের উদ্ভব হয়েছে, সেটা বলে দেয় সমুদ্রতীরে সার বেঁধে দাঁড়ানো গাছগুলো। এই গাছগুলো তাঁর অচেনা। চোখের দৃষ্টিকে নিচের দিকে আরও অনেক দূর অবধি প্রসারিত করলেন অ্যারনি। আগে এই কাজটার জন্যে স্পেসশিপের অত্যাধুনিক দূরবীক্ষণ যন্ত্রটার সাহায্য নিতে হলেও, এখন খালি চোখে ওই যন্ত্রের থেকে বেশি পরিষ্কার দেখতে পান তিনি। সমুদ্রের গা ঘেঁষে কয়েক হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে যে বিশাল স্থলভাগ তাঁর নজরে পড়ছে সেটার পুরোটাই সবুজে মোড়া। বেশ কিছু বিশালাকৃতি ভয়ংকর জীব সেই অরণ্যে ঘুরে বেড়ালেও তাদের দেহের তুলনায় মাথাটা নেহাতই ছোট। মস্তিষ্কের চর্চা তার মানে এদের মধ্যে নেই! তাছাড়া এই বিস্তৃত অঞ্চলের কোথাও চোখে পড়ছে না সভ্যতার বিন্দুমাত্র নিদর্শন।

অ্যারনি বুঝতে পারলেন কোনো ভয়ংকর বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব এই গ্রহে নেই। হয় তাদের আবির্ভাবই হয়নি, অথবা এই বিশালদেহী প্রাণীগুলোর হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে তারা। যদিও প্রথমটি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। উন্নত প্রাণীরা ধ্বংস হয়ে গেলেও তাদের সভ্যতার নিদর্শন টিকে থাকবে অনেক বছর। তাছাড়া কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী তাদের থেকে কম বুদ্ধিমান প্রাণীর কাছে পরাজিত হয়েছে, এরকম নজির তাদের গ্রহ স্পুটাকার্সের ইতিহাসে অন্তত নেই। স্পুটাকার্সের সবচাইতে বুদ্ধিমান প্রাণী হলেন তাঁরা, মানে স্পুকার্সরা। কালো চামড়া এবং চার হাত পা বিশিষ্ট স্পুকার্সদের চেহারাটা তেমন কিছু বড় না হলেও অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ডিম্বাকৃতি মস্তিষ্কটি কিন্তু বেশ বড় আর ভারি। সঙ্গে চোখ আর কান দুটোও খুব ছোট নয়। মস্তিষ্কের ক্ষমতার জোরেই আরও অনেক বলশালী প্রাণীকে পরাজিত করে গোটা স্পুটাকার্স গ্রহের উপর নিজেদের আধিপত্য কায়েম করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা।

মনে মনে খুশি হলেন অ্যারনি। বেশি বুদ্ধিমান জীব নেই, অথচ প্রাণের অস্তিত্ব আছে— এ’রকম একটা গ্রহেরই তো সন্ধান করছিলেন তিনি। অ্যারনি ধীরে ধীরে তাঁর স্পেসশিপটাকে সমুদ্রের ধারের বালির উপর ল্যান্ড করালেন। ডিজিটাল মিটার বলছে এই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ একুশ শতাংশ। অবশ্য ডিজিটাল মিটার বলার কিছুক্ষণ আগেই তাঁর তীক্ষ্ম ঘ্রাণেন্দ্রিয় টের পেয়েছিল বাইরের বাতাসে প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের উপস্থিতি।

অনায়াসে নামা যেতে পারে এখানে। অক্সিজেন সিলিন্ডারের কোনো প্রয়োজন নেই।

বহুদিনের অভ্যাসমতো কোমরবন্ধের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় লেজারগানটিকে গুঁজে নিয়ে স্পেসশিপ থেকে নেমে এলেন অ্যারনি। হঠাৎ কোনো হিংস্র জীব আক্রমণ করলে এই লেজারগান সেটাকে শেষ করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। লেজারগানটির মধ্যে রয়েছে একটা সেন্সরও। আশেপাশে কোনো জন্তুর আবির্ভাব হলে সংকেত পাঠাবে অ্যারনির মস্তিষ্কে। কয়েকদিন আগে অবধিও এই বন্দুকটি ছিল অ্যারনির অন্যতম প্রয়োজনীয় বস্তুগুলোর একটা। কাজ সেরে স্পেসশিপে ফেরার পথে এটার প্রয়োজন পড়লেও পড়তে পারে। কিন্তু এখন এই যন্ত্রটার কোনো দরকার নেই তাঁর। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো ভয়ংকর জীবই এই মুহূর্তে আর দাঁড়াতে পারবে না তাঁর সামনে।

তবে নেহাত বিপদে না পড়লে কারুর প্রাণ কেড়ে নেওয়ার অভিসন্ধিও নেই অ্যারনির। বহুদিন পর আবার প্রাণের দেখা পেয়েছেন তিনি। এখান থেকে একবার বেরিয়ে গেলে স্পুটাকার্সে পৌঁছনোর পথে প্রাণের সন্ধান হয়তো পাওয়া যাবে না আর।

অ্যারনি একজন মহাকাশ অভিযাত্রী। অনেক বছর আগে মহাকাশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর লক্ষ্য ছিল একটাই। মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্বকে সরেজমিনে সন্ধান করা। স্পুটাকার্সের ইতিহাসে তিনিই প্রথম স্পুকার্স যার উপর এই দায়িত্ব পড়েছে। ফিরতে পারুন অথবা না পারুন অ্যারনি জানেন স্পুটাকার্সের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে তাঁর নাম। অবশ্য সেটা নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা নেই অ্যারনির। বরং তিনি খুশি এই অভিযানের জন্যে নির্বাচিত হতে পেরে। তাঁর যাত্রাপথে অ্যারনি সন্ধান পেয়েছেন কিছু অত্যাধুনিক সভ্যতার সন্ধান। এ’রকমই এক গ্রহের সন্ধান শেষবার তিনি পেয়েছিলেন তাঁদের গ্রহ স্পুটাকার্সের হিসাবে বেশ কয়েক বছর আগে। তখন স্পেসশিপের দূরবীক্ষণ যন্ত্রে চোখ রেখে বহুদূর থেকে, আরও ভালো করে বললে ওইসব গ্রহের বাসিন্দাদের নাগালের বাইরে থেকে, সভ্যতাগুলোকে দেখেই খুশি থাকতে হত অ্যারনিকে। ওদের হাতে বন্দি হয়ে যাওয়ার ভয়ে খুব বেশি নিচেও নামতে পারতেন না তিনি।

তবে অত্যাধুনিক সভ্যতা গড়ে উঠেছে, এইরকম গ্রহের সংখ্যা নগণ্য। বেশ কিছু গ্রহ রয়েছে যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব থাকলেও নেই কোনো বুদ্ধিমান জীব। যেমন এই নীল রঙের গ্রহটা। আবার কিছু কিছু গ্রহ এমনও আছে যেখানে সদ্য আবির্ভাব হয়েছে এককোষী প্রাণের।

অল্প কয়েকটা জায়গায় প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পেলেও তাঁর সুদীর্ঘ যাত্রাপথে অ্যারনি দেখেছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বেশিরভাগ গ্রহই প্রাণধারণের অনুপযুক্ত। নীল রঙের এই গ্রহতে আসার আগে এক পাথুরে প্রাণহীন গ্রহে পা পড়েছিল তাঁর। প্রাণের অস্তিত্ব খুঁটিয়ে দেখার জন্য এই ধরণের নির্জন গ্রহগুলোর সবকটাতেই ল্যান্ডিং করেছেন অ্যারনি। তবে এই গ্রহটি ছিল বাকি গ্রহগুলোর থেকে একটু আলাদা। সেখানে তাঁর ল্যান্ডিং স্পেসের পাশেই ছিল একটা গুহা। স্পেসশিপ থেকে নামার পরেই অ্যারনির মনে হয়েছিল গুহাটা যেন হাত তুলে ডাকছে তাঁকে।

সেই আহ্বান এড়াতে পারেননি অ্যারনি। গুহার মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। সময়টা রাত হলেও গুহার ভিতরটা ভরে ছিল এক অদ্ভুত ধোঁয়াটে আর ধূসর আলোয়। উৎসুক অ্যারনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন আলোর উৎস খুঁজতে। ঠিক সেই সময়েই কেউ যেন তাঁর মস্তিষ্কে সংকেত পাঠিয়েছিল যে আলোর উৎস আছে গুহার আরও ভিতরে।

একটা নেশা পেয়ে বসেছিল অ্যারনিকে। আগুপিছু না ভেবেই গুহার আরও অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। গুহামুখ থেকে একটি পাথরে মোড়া এবড়োখেবড়ো রাস্তা চলে গেছে ভিতরের দিকে। গুহার উচ্চতাও নেহাত কম নয়। তাঁর মতো একজন স্পুকার্স অনায়াসে হেঁটে যেতে পারে সেখান দিয়ে।

রাস্তাটা ধরে কিছুটা হাঁটার পর অ্যারনি দেখতে পেয়েছিলেন সেই আলোর উৎসকে। গুহার শেষ মাথায় তাঁর উচ্চতার প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতার একটা বিশাল গোলাকার স্বচ্ছ পাথর থেকে বিকীর্ণ হচ্ছে এই আলো।

অ্যারনির মনে হয়েছিল, পাথরটা যেন তাঁর জন্যেই অপেক্ষা করছে যুগ যুগ ধরে। তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন পাথরটার দিকে। পরম মমতায় স্পর্শ করেছিলেন সেটাকে।

কিন্তু এরপরেই ঘটে গিয়েছিল সেই অদ্ভুত ঘটনাটা। পাথরটা থেকে কিছু একটা বেরিয়ে বিদ্যুতের মতো প্রবেশ করতে শুরু করেছিল অ্যারনির শরীরে। অবাক হলেও পাথরটাকে সেই মুহূর্তে ছেড়ে দিতেও পারছিলেন না তিনি। বিশাল প্রস্তরখণ্ডটি যেন সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে নিজের দিকে টেনে রেখেছিল তাঁকে! ঠিক এই সময়েই অ্যারনির মস্তিষ্কের মধ্যে বেজে উঠেছিল কয়েকটা অদ্ভুত শব্দ, “হিয়াম, জিউ, গিস, কেম, চাফু।”

অ্যারনিও উচ্চারণ করতে শুরু করেছিলেন সেই শব্দগুলো। গলার আওয়াজটাও যেন তখন তাঁর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই। বেশ কয়েকবার শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি করার পর চুপ করে গিয়েছিলেন অ্যারনি। থেমে যাওয়ার নির্দেশটাও অদৃশ্য কেউ একজন যেন বাইরে থেকে পাঠিয়েছিল তাঁর মস্তিষ্কে। এরপর আপনা-আপনি আলগা হয়ে এসেছিল অ্যারনির হাতের বন্ধন। কিন্তু ততক্ষণে যেন সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করে কেমন স্তিমিত হয়ে গেছে পাথরটা। আর কোনো আলোও বেরোচ্ছিল না সেটার শরীর থেকে।

কিন্তু এখনও তো আলোকিত হয়ে আছে গুহার ভিতরটা! নিজের দিকে তাকিয়ে অ্যারনি চমকে উঠেছিলেন। এই আলো আসছে তাঁর শরীর থেকে।

এরপরের দিনগুলো কেমন কেটেছে তা আর মনে করতে চান না তিনি।

আর দেরি না করে অ্যারনি গাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেলেন। নিজের ডান হাতটাকে রাখলেন তাঁর সমান উচ্চতার নাম না জানা উদ্ভিদটার কাণ্ডের উপর। অচেনা হলেও অ্যারনি বেশ বুঝতে পারছেন এই গাছে বিষ নেই। গাছটা তাঁর হাতের স্পর্শ পেতেই অ্যারনি বলে উঠলেন, “কেম, চাফু, গিস, জিউ, হিয়াম।”

সেদিন না বুঝলেও এখন অ্যারনি জানেন প্রকৃতির দ্বারা সৃষ্ট আপাত অর্থহীন এই শব্দগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে আসল যাদু। কিছু শব্দ এদিক ওদিক করে সঠিক কম্পাঙ্কে উচ্চারণ করতে পারলেই ঘটে যেতে পারে অনেক কিছু।

কয়েকবার শব্দগুলো উচ্চারণ করার পরেই ঢেউ উঠল সেই উদ্ভিদের পাতায়। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেই কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ল আশেপাশের সমস্ত গাছগুলোতে। সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হয়ে যেতে শুরু করল অ্যারনির তালুর নীচে থাকা গাছটার কাণ্ডটাও।

মনে মনে খুশি হলেন অ্যারনি। যে কাজ তিনি করতে চেয়েছিলেন, শুরু হয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ গাছটাকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর সেটাকে ছেড়ে নিজের স্পেসশিপের দিকে হাঁটা লাগালেন অ্যারনি। এখন বড্ড নিশ্চিন্ত আর নির্ভার লাগছে নিজেকে।

কে বলতে পারে, তাঁর এই সিদ্ধান্তই হয়তো বাঁচিয়ে দিল গোটা স্পুটাকার্স গ্রহকে, হয়তো গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে!

এই গ্রহের তথ্য তিনি কখনই তুলে দেবেন না স্পুটাকার্সের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের হাতে।

যে ভুল তিনি ওই পাথরটাকে ছুঁয়ে করেছিলেন, তার প্রায়শ্চিত্ত বোধহয় হয়ে গেল আজকেই!

অ্যারনি তাঁর গোলাকার স্পেসশিপে উঠে বসার খানিক পরেই ক্রমশ মাটি উপরের দিকে উঠতে শুরু করল সেটা।

তখনও সমুদ্রের বাতাস আর উড়তে শুরু করা স্পেসশিপের এলোমেলো হাওয়াকে উপেক্ষা করে এক অদ্ভুত ছন্দে একসঙ্গে নড়ে চলেছে গাছগুলোর সমস্ত ডালপালা।

যেন নীল গ্রহটার উদ্ভিদকুল একসঙ্গে হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে অ্যারনিকে।

 

নীচ থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছিল অসংলগ্ন হাসির আওয়াজ। মাঝে মাঝেই কারণে অকারণে হেসে উঠছে রেহান আর দীপ্তেন্দু। উপরে বেডরুমে বসে নিধি বুঝতে পারছিল পুরোটাই অ্যালকোহলের প্রভাব। দীপ্তেন্দু আর রেহান আজ আসর বসিয়েছে ওদের বাড়ির একতলায়।

দিনেরবেলা নানারকম ব্যস্ততা আর বেশ কিছু মানুষের আনাগোনা থাকলেও রাত হলে কোন্নগরের এই অঞ্চলটা বড্ড নিস্তব্ধ হয়ে যায়। জানলা দরজা খোলা থাকলে শুধু নিজের বাড়ির একতলা থেকে ভেসে আসা হাসির আওয়াজ নয়, অনায়াসে শোনা যায় পাশের বাড়ির মানুষদের কথাবার্তা, টিভির শব্দ, তাদের হাসি অথবা ঝগড়াও।

আশেপাশের পাড়াগুলোতে বেশ কিছু বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হলেও এ পাড়ায় সে’সবের বালাই নেই। পুরোনো বাড়িগুলো সামনে পিছনে বেশ কিছুটা জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। নিধিদের বাড়িটাও সে’রকম। ওদের বিয়ের কয়েক বছর আগে, এক প্রবীণ দম্পতির মৃত্যুর পর, বিশাল বড় দোতলা বাড়িটা দীপ্তেন্দু কিনে নিয়েছিল তাঁদের ব্রিটেন প্রবাসী একমাত্র ছেলের কাছ থেকে।

প্রথমবার বাড়িটাতে পা দিয়ে মুগ্ধ হয়েছিল নিধি। হরিদেবপুরে নিধিদের বাড়িটা দোতলা হলেও এতবড় ছিল না। বাড়ির পিছনে বাগান। পরিচর্যার অভাবে সেখানে কিছু আগাছা জন্মালেও, বাপের বাড়ির মতো এই বাগানটাতেও রয়েছে একটা বিশাল বড় নিমগাছ। আর নিমগাছটার পিছনেই রয়েছে একটা পুকুর, যদিও সেটা বাড়ির সীমানার বাইরে।

এতবড় বাড়িতে সে আর দীপ্তেন্দু পুরো একা! নেই শাশুড়ির চোখ রাঙানিও। দীপ্তেন্দুর বাবা আর মা থাকেন বড়াতে, ওদের গ্রামের বাড়িতে। সবকিছু মিলিয়ে নিধির মনে হয়েছিল বেশ সুখেরই হবে তাদের বিবাহিত জীবন।

কিন্তু… পুরোনো দিনের কথাগুলো মনে পড়লে কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নিধির বুক চিরে। আজকাল অতীত যেন শিকারি বাজের মতো ধাওয়া করে তাকে। নিধির মা মারা গিয়েছিল তার তিন বছর বয়সে। মায়ের স্মৃতি বলতে রয়ে গেছে হরিদেবপুরের বাড়ির দেওয়ালে টাঙানো সেই বিশাল ছবিটা। থাকার মধ্যে ছিল বাবা। হরিদেবপুর হাইস্কুলের ফিজিক্যাল সাইন্সের টিচার ছিল বাবা। ছোটবেলায় নিধি যে তার বাবাকে খুব কাছ থেকে পেয়েছে তা নয়। বাবা ছিল খানিকটা খামখেয়ালি। এই নিয়ে হরিদেবপুরের লোকজন বাবাকে আড়ালে আবডালে ‘পাগলা হারাধন মাস্টার’ বলে কটাক্ষ করতেও ছাড়ত না। বাবার খামখেয়ালীপনা নিধি প্রথমবার টের পেয়েছিল ক্লাস এইটে পড়ার সময়। কী একটা কাজে বাবার সঙ্গে বাইরে বেরিয়েছিল নিধি। যাওয়ার সময় রিকশা করে গেলেও ফেরার পথে রিকশা না পাওয়ার হেঁটেই ফিরছিল ওরা। পথে পড়ে হরিদেবপুরের পরিত্যক্ত রাজবাড়িটা। বাড়িটার দেওয়াল ফাটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল বটগাছ। গাছটাকে দেখে কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বাবা। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফিসফিস করে বলে উঠেছিল, “কী অদ্ভুত শক্তি! জমিদারদের শতশত বছরের অহংকার একলাই এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়েছে!”

পথচলতি কয়েকজন ততক্ষণে আড়চোখে দেখছে বাবাকে। হরিদেবপুর ছোট জায়গা হওয়ায় সবাই মোটামুটি চেনে একে অপরকে। ব্যাপারটা দেখে অস্বস্তি হয়েছিল নিধির। বাবার হাতে টান দিয়ে সে বলেছিল, “কী হল বাবা? চলো। বাড়ি যেতে হবে তো।”

নিধির ডাক শুনে যেন সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল বাবা, “হ্যাঁ… হ্যাঁ, মা চল।”

তখন না জানলেও পরে নিধি জেনেছিল যে তার বাবার উৎসাহ ছিল এমন একটা বিষয়ে যাকে সাধারণ মানুষ চট করে ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারে না। কেউ স্বীকৃতি না দিলেও, এই নিয়ে বিস্তর খাটাখাটিও করেছিল বাবা। বাবার কাজের সময় ছিল রাত। সেইজন্যেই ছোটবেলা থেকেই রাতে একলা শুতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল নিধি।

বাবা তো তখন ব্যস্ত চিলেকোঠার ঘরে।

ছোটবেলায় চিলেকোঠার ঘরটাতে ঢুকতে শক্ত মানা ছিল নিধির। সকালে নিধি ঘুম থেকে ওঠার আগেই ওই ঘরে তালা দিয়ে দিত বাবা। সেই তালা আবার খুলত রাতে, নিধি ঘুমিয়ে পড়ার পর।

খুব কম বয়স থেকেই রাতগুলো একলা কাটাতে হয়েছিল বলেই বোধহয় নিধি ছিল তার বয়সী অন্য ছেলে মেয়েদের থেকে একটু বেশি সাহসী। ভূত প্রেতের ভয় কোনোদিনই ছিল না তার। অন্যদিকে বাবা রাত জেগে কী করে সেটা জানার আগ্রহও ছিল প্রবল। সেই আগ্রহ আরও বেড়েছিল জমিদারবাড়ির সামনে ঘটনাটা ঘটার পর। তখন বয়স কম হলেও নিধি এটুকু বুঝেছিল যে বাবার রাত জাগার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে যোগ আছে সেদিনের বলা কথাগুলোর। তাছাড়া বাবার কথাগুলো তো স্কুলের বই বা ক্লাসের স্যারের সঙ্গে একদমই মেলে না। স্কুলে তো পড়ায় গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়, খাবার দেয়, ছায়া দেয়, ভূমিক্ষয় প্রতিরোধ করে, পোকামাকড় আর পাখিদের আশ্রয় দেয়— এইসব আরও কত ভালো ভালো কথা। তাহলে বাবা কেন বলছিল ওই অদ্ভুত কথাটা? বয়স যত বেড়েছে প্রশ্নটা ততই জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছিল নিধির মাথায়। রাতে ঘুম ভেঙে গেলেই তার মনে হত এক ছুটে চলে যায় চিলেকোঠায়। শেষ পর্যন্ত আর থাকতে পারেনি নিধি। তখন সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। একদিন রাতে সে চুপি চুপি উঠে এসেছিল চিলেকোঠার ঘরে।

নিধি ভেবেছিল ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকবে। কিন্তু উপরে পৌঁছে সে দেখেছিল দরজা খোলা। অন্ধকার ঘরে বাবা দাঁড়িয়ে আছে দরজার দিকে পিঠ করে।

চিলেকোঠার ঘরে দরজার উলটোদিকে যে জানালাটা আছে, সেটা দিয়ে এক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল বাবা। জানলাটার ওপারেই রয়েছে নিমগাছটা। বাবার তাকিয়েছিল ওই গাছটার দিকে। এতটাই আত্মমগ্ন যে নিধি ঘরে ঢুকেছে, খেয়াল করেনি সেটাও। পা টিপে টিপে নিধি এসে দাঁড়িয়েছিল বাবার পাশে। চাঁদের আলো জানলা দিয়ে এসে পড়েছিল বাবার মুখের উপর। সেই আলোতেই নিধি দেখেছিল বাবার মুখে ছড়িয়ে পড়েছে বিজয়ীর হাসি। ব্যাপারটা বোঝার জন্য সামনে তাকাতেই চমকে উঠেছিল সে। একফোঁটা হাওয়া নেই। অথচ এক নাগাড়ে দুলে চলেছে নিমগাছটার ডালপালাগুলো। চাঁদের আলোতেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাদের ওঠানামা।

নিধির শোয়ার ঘর থেকে এই নিমগাছটা দেখা যায় না। তাই অন্যদিন রাতে কী হয় জানা ছিল না তার। কিন্তু বিনা হাওয়াতে রাত্তিরবেলায় গাছের ডালপালা দোলার কথা একমাত্র ভূতের গল্পতেই শোনা যায়। এমনিতে সাহসী হলেও সাধারণ বুদ্ধিতে ব্যাখ্যার অতীত দৃশ্যটা দেখে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গিয়েছিল নিধির শিরদাঁড়া বেয়ে। সে ডেকে উঠেছিল, “বাবা, বাবা, ওটা কী হচ্ছে?”

নিধির গলায় আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে তার দিকে তাকিয়েছিল বাবা। নিধি ভেবেছিল এবার বাবা হয়তো রেগে যাবে। কিন্তু বাবা রাগ করেনি। জড়ানো কণ্ঠে বলেছিল, “তুই… তুই… এখানে…”

যেন খাবি খাচ্ছে মানুষটা। একটু ভয় পেলেও হাল ধরেছিল নিধি, “কী হল বাবা?”

“দরজা বন্ধ ছিল না?” ফের জিজ্ঞেস করেছিল বাবা। কিছুটা স্বাভাবিক তার গলা। বাবাকে ঠিক হতে দেখে ভরসা পেয়েছিল নিধিও, “নাতো, দরজা খোলা ছিল।”

“তাহলে বোধহয় বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলাম। আসলে গতকাল থেকে এতটাই বিভোর…”

বাবা থেমে গেলেও আরও একবার হাল ধরার চেষ্টা করেছিল নিধি, “কী বাবা? কী বলছ?”

বাইরে নিমগাছটার দুলুনি থেমে গেছে ততক্ষণে। আর অপেক্ষা না করে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছিল নিধি। আলো জ্বলে ওঠায় যেন আরও স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল বাবা, “তুই এসেছিস ভালোই হল। আজ তোকে সবকিছু বলব। আর কেউ না মানুক, তুই অন্তত নিজের বাবার কথা অস্বীকার করবি না।”

বিষণ্ণতার সুর বাজছে বাবার কণ্ঠস্বরে। মায়া লেগেছিল নিধির, “তুমি বলো। আমি সব বিশ্বাস করব।”

একটা হালকা হাসি ফুটে উঠেছিল বাবার ঠোঁটে, “তাহলে শুরু করা যাক। আসলে কী বলতো, ফিজিক্সের ছাত্র হলেও আমার অন্যতম প্রিয় বিষয় ছিল বোটানি। নানা রকমের গাছপালা, বিশেষ করে বড় বড় গাছ, যেমন বট অশ্বত্থ, নিম, শাল, সেগুন, শিশু ছোটবেলা থেকেই টানত আমাকে। আমার তখন দশ বছর বয়স। হরিদেবপুর সহ সমস্ত দক্ষিণবঙ্গে একটা ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। তাতে কত মানুষের বাড়ির চালা উড়ে গিয়েছিল, কত বাড়ি ভেঙে গিয়েছিল, আর কত মানুষ যে মারা গিয়েছিল তার হিসাব নেই। কিন্তু এত কিছুর পরেও খুব একটা ক্ষতি হয়নি জমিদারবাড়ির বট আর আমাদের বাড়ির নিমগাছটার। কয়েকটা বড় বড় গাছ পড়লেও সেখানেই থেকে গিয়েছিল তারা। মানুষ বা অন্য কোনো জীবজন্তুর মতো উড়ে যায়নি। শিকড় থেকে কেউই আলাদা করতে পারেনি তাদের।

"সেই সময়েই আমার মনে হয়েছিল, কী ভীষণ শক্তিশালী এরা!

“চিন্তাটা আরও মাথাচাড়া দিল বয়স একটু বাড়ার পর। ততদিনে পৃথিবীর এ’রকম অনেক শক্তিশালী গাছের কথা বই পড়ে জেনে ফেলেছি। জেনেছি কিছু গাছ আছে পাঁচশো-হাজার বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। ঝড়, জল, প্রচণ্ড রোদ্দুর কোনো কিছুই বিশেষ ক্ষতি করতে পারে না তাদের।

“কিন্তু এদের শক্তির উৎস কী? অনেক পড়াশোনা করেও সেই প্রশ্নের উত্তর পাইনি। তখন আমার মাথায় একটা অন্য প্ল্যান এসেছিল। মনে হয়েছিল গাছের সঙ্গে যদি যোগাযোগ করা যায় কোনোভাবে, তাহলে হয়তো উত্তরটা জানা যাবে। কিন্তু কীভাবে? মানুষ শব্দের মাধ্যমে অন্য মানুষ বা গৃহপালিত পশুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ওইসব পশুরাও শব্দের মাধ্যমেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করে মানুষের সঙ্গে। কিন্তু গাছেদের তো সে’রকম কোনো শব্দ নেই! তাছাড়া তারা শুনতে পায় বলেও তো বিজ্ঞান এখনও কিছু আবিষ্কার করতে পারেনি।

“সেই সময় প্যারাসাইকোলজি নিয়েও পড়াশুনা করছিলাম নিজের উৎসাহে। সেখানেই সন্ধান পাই টেলিপ্যাথির। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পেয়েছিলাম একটা ক্ষীণ আলোর রেখা। এই বিদ্যা রপ্ত করা গেলে কোনো যন্ত্র, শব্দ বা ইশারা ছাড়াই যোগাযোগ করে ফেলা যায় সামনে অথবা অনেক দূরে বসে থাকা মানুষ অথবা মনুষ্যেতর প্রাণীর সঙ্গে।

“গাছেদের যে প্রাণ আছে, সেটা আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু প্রমাণ করে দিয়েছিলেন অনেক আগেই। কিন্তু আমার মনে হত যারা এত শক্তিশালী, যারা এতবছর ধরে প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যেও বেঁচে থাকতে পারে তাদের কেবল প্রাণ নয়, একটা মস্তিষ্কও আছে। যদি কোনোভাবে যোগাযোগ করা যায় সেই লুকনো মস্তিষ্কের সঙ্গে, তাহলে আমরা হয়তো জানতে পারবো সেই শক্তির উৎস কী?

“টেলিপ্যাথিতে একজনের সঙ্গে অন্যজনের যোগাযোগ করার জন্যে বেশ কিছু পদ্ধতির কথা পাওয়া যায়। অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতো আমিও অনেক খুঁজে খুঁজে সেই পদ্ধতিগুলোর মাধ্যমে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলাম সামনের নিমগাছটার সঙ্গে। প্রথমদিকে কোনো ফল না পেলেও গতকাল আমি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি। ওকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে কিছু বললেই দেখছি ডালগুলো নড়ে উঠছে।”

হরিদেবপুরের মানুষ বাবাকে যতই পাগল বলুক, আর বাবার কথাগুলো শুনতে যতই অবাস্তব লাগুক, তার প্রত্যয়ী আর দৃপ্ত কণ্ঠস্বরই ভরসা যোগাচ্ছিল নিধিকে। মন বলছিল কথাগুলো মিথ্যা নয়। বাবার দিকে তাকিয়ে নিধি তাই বলেছিল, “গাছেদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলা যায় তুমি আমাকে শেখাবে? আমিও ওদের সঙ্গে কথা বলব।”

মেয়ের কথা শুনে আনন্দে চকচক করে উঠেছিল বাবার মুখখানা, “অবশ্যই শেখাব মা। তোকে না শেখালে এই বিদ্যা তো হারিয়েই যাবে একদিন। আর আমার মতো একজন মফঃস্বলের মাস্টারের কথা বাইরের পৃথিবী বিশ্বাস করবে না কখনও।”

বাবার কাছেই নিধি শিখেছিল গাছেদের সঙ্গে কথা বলার পদ্ধতি। সেও ছিল এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। নিধিও চেয়েছিল সারাজীবন বুঁদ হয়ে থাকতে এই অজানার সন্ধানে। কিন্তু রাজী হয়নি বাবা। সে বি.এ. পাশ করার পরেই তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছিল বিয়ের।

বাবার চাপে পাত্রপক্ষের সামনে বসতে শুরু করেছিল নিধি। বেশ কয়েকটা সম্বন্ধ বাতিল হলেও নিধির মনে ধরেছিল দীপ্তেন্দুকে। দেখে শুনে মনে হয়েছিল ছেলে ভালো। নিজস্ব ব্যবসা আছে। পাকা দেখার মাসখানেকের মধ্যেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়েছিল ওরা দু’জনে।

বিয়ের আগে যাই করুক না কেন, বিয়ের পর কিন্তু অন্য সব মেয়ের মতোই পাকা সংসারী হতে চেয়েছিল নিধি। বেশ বুঝতে পারছিল এইসব অদ্ভুত কথাবার্তা দীপ্তেন্দু মেনে নেবে না কখনই। উলটে হয়তো পাগল ভেবে বসবে তাকে।

নিধি নিজেকে বদলে ফেলতে চাইলেও প্রথম গণ্ডগোলটা কিন্তু বেঁধেছিল ফুলসজ্জার রাতে। দীপ্তেন্দুর শরীর আর মন জুড়ে তখন দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে কামনার আগুন। কিন্তু যে অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি নিজের চারপাশে এতদিন অনুভব করে এসেছে নিধি, মনে হচ্ছিল সেই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নির্লজ্জ চোখে দেখছে ওদের রতিক্রিয়া।

প্রচণ্ড লজ্জায় ক্রমশ কুঁকড়ে যেতে শুরু করেছিল নিধির নগ্ন শরীর। চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল সে। নিজের কামনা চরিতার্থ করে সন্তুষ্টি না পেলেও সেই রাতে মুখ ফুটে কিছু বলেনি দীপ্তেন্দু। কিন্তু বিয়ের একমাস পার করে ফেললেও দীপ্তেন্দুর সামনে সহজ হতে পারেনি নিধি। এর মধ্যেই হঠাৎ একটা মারাত্মক সেরিব্রাল হেমারেজ কেড়ে নিয়েছিল বাবার জীবনটাও। তারপর বাবার কাজ মিটতে না মিটতেই ঘটেছিল সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা।

সেদিন বাড়ি ফিরতে একটু দেরিই হচ্ছিল দীপ্তেন্দুর। ফোন করলেও ধরছিল না কিছুতেই। অনেক পরে ওয়াটস অ্যাপে দীপ্তেন্দুর কাছ থেকে আসা একটা ছোট্ট মেসেজ পেয়েছিল নিধি, “বিজি আছি। ফিরতে সাড়ে এগারোটা বাজবে। রাতে খাব না।”

এমন তো কখনও করেনি দীপ্তেন্দু। অবাক হয়েছিল নিধি। তার অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল রাতে, যখন দীপ্তেন্দু এসে কলিং বেল বাজিয়েছিল দরজায়। তড়িঘড়ি নীচে এসে দরজা খুলতেই নিধির নাকে ধাক্কা মেরেছিল অ্যালকোহলের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ। তখন টলছে দীপ্তেন্দু। হাতের ইশারায় নিধিকে সরে যেতে বলেছিল সে। দোতলায় উঠে টলমল শরীরটাকে কোনোরকমে ফেলে দিয়েছিল বিছানাতে।

সেই শুরু। এখন তো রোজ রাতে বাড়িতেই আসর বসায় সে। কখনও একলা; আবার কখনও কোনো বন্ধুর সঙ্গে। যেমন আজ। রেহান নামের একটা লোক প্রথমবার এখানে এসেছে দীপ্তেন্দুর সঙ্গে মদ খেতে।

এখন প্রায় প্রতিদিনই রাত বারোটা বেজে যায় দীপ্তেন্দুর আসর শেষ হতে হতে। তারপর টলতে টলতে উপরে আসে সে। বেডরুমে ঢুকে কোনোরকমে শুয়ে পড়ে বিছানায়। মদ খাওয়া শুরু করার পরেও কয়েকবার নিধির ঘনিষ্ঠ হতে চেয়েছিল দীপ্তেন্দু। একটা মাতালের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে ঘেন্না করলেও চেষ্টার কোনো খামতি ছিল না নিধির তরফ থেকেও। দীপ্তেন্দুর মদের প্রতি আসক্ত হয়ে যাওয়ার জন্যে নিজেকেই দায়ী মনে হত তার। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও নিধি নিজেকে মেলে দিতে পারেনি দীপ্তেন্দুর সামনে।

কারণ সেই অদৃশ্য চাউনি।

এর জন্যে মাতাল দীপ্তেন্দুর হাতে বেশ কয়েকবার চড় থাপ্পড়ও জুটেছিল নিধির। তবুও নিধি নিজের সমস্যার কথা কখনও মুখ ফুটে বলতে পারেনি ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া দীপ্তেন্দুকে। কিন্তু এখন সে’সবও অতীত। ইদানীং দীপ্তেন্দু আর ফিরেও তাকায় না নিধির দিকে। সে এখন বাড়িতে একজন কাজের লোক। তিনবেলা খাবারের সঙ্গে উপরি পাওনা হিসাবে দীপ্তেন্দুর তরফ থেকে জোটে এক অদ্ভুত শীতলতা। পাশাপাশি শুলেও মনে মনে দীপ্তেন্দু এখন তাকে আর স্বীকারও করে না নিজের বউ হিসাবেও।

দীপ্তেন্দুর এই পরিবর্তন বদলে দিয়েছে নিধিকেও। আজকাল আর নিজের মধ্যে থাকে না নিধি। কারুর সঙ্গে কথা বলতেও ভালো লাগে না তার। ইচ্ছা করে না সংসারের কোনো কাজ করতেও। শুধু মনে হয় যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে ফেলতে হবে বাবার অসম্পূর্ণ কাজটাকে। কিন্তু এখনও অবধি দীপ্তেন্দুর লিগ্যাল ওয়াইফ হওয়ার কারণে তাকেই দেখভাল করতে হয় সংসারটার। আজও সে রান্নাগুলো করেছে দীপ্তেন্দুর আদেশেই। গতকাল সন্ধেবেলায় বাজার থেকে ভেটকি মাছ, চিকেন সহ রান্নার যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে এসে দীপ্তেন্দু তাকে বলেছিল, “শোন কালকে আমার এক বন্ধু আসছে। ওকে ভালো করে খাওয়াতে হবে। মাছ মাংস সব এনে দিলাম। কাল তুমি ফিস পাকোড়া, তন্দুরি চিকেন, চিকেন দোপেঁয়াজা আর রুটি বানাবে। আর হ্যাঁ, সঙ্গে তোমার ওই পুদিনার চাটনি আর সালাদটাও চাই। আর চারটে ট্রেতে জল ভরে ডিপ ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখবে। তিন-চার বোতল ঠান্ডা জলও রেডি রাখবে। সন্ধেবেলায় যাতে জল আর বরফের অভাব না হয়।”

রান্নার হাত নিধির খারাপ নয়। একসময় রান্না করতে সে খুব ভালোবাসত। কিন্তু এখন সেটাও আর ভালো লাগে না। তাই আজ সারাদিনের কর্মব্যস্ততা তার জন্যে বয়ে নিয়ে এসেছে একরাশ ক্লান্তি আর বিষণ্ণতা।

নিধির পড়াশোনা গার্লস স্কুল আর গার্লস কলেজে। সেখানে ‘পাগলা হারাধন মাস্টার’-এর মেয়ে বলে বাকি সব মেয়েরা এড়িয়েই চলত তাকে। কলেজের বাইরে কয়েকটা লোফার টাইপের ছেলে ওর শরীরের দিকে নজর দিলেও তাদের কখনই পাত্তা দেয়নি নিধি। স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যের জন্যে কোনো ভালো ছেলেও বন্ধু হতে পারত না তার। তাই বন্ধুহীন নিধি যেমন ফেসবুকেও নেই, ওয়াটস অ্যাপেও কেউ পিং করে না তাকে। রান্না শেষ করে তাই বেডরুমে চুপচাপ বসেছিল সে। এখন খালি অপেক্ষা দীপ্তেন্দুর একটা মিস কলের। তাহলেই মেইন কোর্সটা নিয়ে চলে যাবে নীচে। ফিস পাকোড়া, তন্দুরি চিকেন, পুদিনার চাটনি, সালাদ, ঠান্ডা জল, বরফ, গ্লাস, প্লেট সবকিছুর ব্যবস্থা সে করে দিয়ে এসেছিল আসর শুরুর আগেই। এখন বাকি রয়ে গেছে কেবল চিকেন দোপেঁয়াজা, রুটি আর নতুন করে তৈরি করা সালাদ। রুটি আর চিকেন দোপেঁয়াজা যাতে ঠান্ডা না হয়ে যায়, তাই ভরা আছে হটপটে। আর প্লেটের উপর সাজানো সালাদটা ঢাকা দেওয়া আছে আর একটা প্লেট দিয়ে।

কতক্ষণ বসেছিল তা জানে না নিধি। এমন সময় বেজে উঠল তার মোবাইল। রিভিস করতেই ওপার থেকে ভেসে এলো দীপ্তেন্দুর কণ্ঠস্বর, “নিধি, খাবারটা নিয়ে এসো।”

বন্ধুর সামনে কী ভদ্র গলা। যেন ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানে না!

খাবারটা নিয়ে নীচে নেমে এলো নিধি। দীপ্তেন্দুদের বাড়িটা বড়। শুধু একতলা নয়, দোতলাতেও একটা কিচেন আছে। সেখানেই নিধি আজ সমস্ত রান্নাবান্না করেছে। একতলায় নেমে বৈঠকখানা সংলগ্ন ছোট্ট রুমটাতে ঢুকতেই সে দেখতে পেল দীপ্তেন্দুর নতুন বন্ধুটিকে।

রেহানের নেশা হওয়ার আগেও চোখাচোখি হয়েছিল ওদের দু’জনের। মানুষটার বয়স দীপ্তেন্দুর আশেপাশেই হবে। দীপ্তেন্দু ওকে সঙ্গে নিয়েই আজ সন্ধেবেলায় বাড়িতে ঢুকেছিল। তখন দরজা খুলে দিয়েছিল নিধি। সেই সময়েই রেহানের সঙ্গে নিধির পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল দীপ্তেন্দু, “আমার বন্ধু রেহান। আর নিধি, আমার ওয়াইফ। বিয়ে আর বউভাতের সময় অবশ্য দেখা হয়েছিল…”

জীবনে ওই দুটো দিন একটা মেয়ে হাজারো নতুন মানুষের মুখোমুখি হয়। সে’দিন একবার দেখে কারুর মুখ মনে রাখাটা বেশ কষ্টকর। নিধিও চিনতে পারেনি রেহানকে দেখে। ভদ্রতার খাতিরে বুকের কাছে জড়ো করেছিল তার হাত দুটো--- “নমস্কার।”

নিধির ঠোঁটে খেলা করছে ভদ্রতা মাখানো একটা হালকা হাসি। প্রতিনমস্কার করেছিল রেহানও। তার দু’চোখে কেবল মুগ্ধতা। চেষ্টা করেও লুকোতে পারছিল না নিজেকে। রেহানের অবস্থা দেখে মনে মনে হেসেছিল নিধি! তার মনে পড়ে গিয়েছিল ছাত্রী জীবনের কথা। বিয়ের পর তো আর বাড়ি থেকে বেরনোই হয় না সেভাবে। কিন্তু স্কুল আর কলেজে যাওয়া আসার পথে কত ছেলে যে দূর থেকে এ’রকম মুগ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকত…

নিধি ঘরে ঢুকতেই রেহান ফের মুখ তুলে তাকাল তার দিকে। ছেলেটার চোখ দুটো নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলেও এখনও সেই দৃষ্টিতে মিশে আছে স্নিগ্ধতা। মুখোমুখি রাখা দুটো সোফায় বসেছিল রেহান আর দীপ্তেন্দু। ওদের মাঝখানে রাখা রয়েছে একটা কাচের টেবিল। নিধি তার হাতের খাবারগুলো সেই টেবিলে নামতে গিয়েই শুনতে পেল রেহানের কণ্ঠস্বর, “বৌদি, তোমার হাতের রান্নাটা কিন্তু দারুণ। পেট তো ভরেছে, সঙ্গে মনও।”

বন্ধুর বউকে বৌদি বলাটাই বোধহয় সবথেকে সহজ। রেহানের দিকে তাকিয়ে নিধি দেখল মানুষটার ঠোঁটে খেলা করছে একটা মিষ্টি হাসি। বিয়ের আগে মাতাল লোকজন দেখলে অস্বস্তি হত। কিন্তু এখন ব্যাপারটা গা-সওয়া হয়েছে। রেহানের হাসিটা বড্ড ভালো লাগল নিধির। কতদিন হয়ে গেছে, দীপ্তেন্দু তো আর তার দিকে তাকিয়ে হাসেও না, এত দরাজ সার্টিফিকেটও দেয় না তার রান্নাকে!

“থ্যাংক ইউ,” হালকা হাসল নিধিও, “চিকেন দোপেঁয়াজা আছে। সঙ্গে রুটি আর সালাদ। খেয়ে দেখুন। আশা করি ভালো লাগবে।”

“হ্যাঁ,” ফের মুচকি হেসে জবাব দিল রেহান, “ভালো তো লাগবেই। মাঝে মাঝেই চলে আসব তোমার হাতের রান্না খেতে।”

ফ্লার্ট করা বোধহয় একেই বলে! নিজের চারপাশে যে গাম্ভীর্যের প্রাচীরটা নিধি তৈরি করে রেখেছিল এতদিন, হঠাৎ সেটা ভেঙে ঢুকে পড়েছে রেহান। মজা লাগলেও দীপ্তেন্দু আছে বলেই ওখানে আর দাঁড়াল না নিধি। বেরিয়ে এলো রুমের বাইরে। তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসিটা মিলিয়ে যায়নি এখনও। অনেকদিন পর একটা অকারণ ভালোলাগা ভর করতে শুরু করেছে তার মনেও।

 

কোন্নগর থেকে গাড়ির মধ্যে একনাগাড়ে এসি চলছে। বৈশাখ বা জ্যৈষ্ঠ মাসের দুপুরে যখন প্রচণ্ড গরম পড়ে, তখন কলকাতার ভিড় রাস্তায় এসিও ফেল মেরে যায় অনেকসময়। জ্যাম ঠেলে একটু একটু করে এগোতে থাকা চারচাকাগুলোর ভিতরটাকে ঠান্ডা করতে পারে না সেভাবে। কিন্তু এখন মার্চ মাসের মাঝামাঝি। এ’বছর এখনও অবধি সেই ভয়ংকর গরমটা পড়েনি। তার উপর গাড়িটা চালাচ্ছিল দীপ্তেন্দুর ড্রাইভার রতন। তবুও নিজের হণ্ডা সিটিটার পিছনের সীটে বসে একটু হলেও ঘামছিল দীপ্তেন্দু। আসলে বিগত কয়েকদিন ধরেই তার বুকের ভিতরে টেনশনের একটা চোরা স্রোত বয়ে চলেছে অবিরত। সেদিনের পার্টিটার প্রায় তিনদিন পার হয়ে গেলেও এখনও কোনো রেসপন্স সে পায়নি রেহানের কাছ থেকে। আর থাকতে না পেরে গতকাল বিকেলে তাকে ফোন করেছিল দীপ্তেন্দু। তখন রেহানের ফোন সুইচড অফ। সেই মুহূর্তে আর কিছু করার না থাকলেও দীপেন্দু নিয়ে ফেলেছিল সিদ্ধান্তটা। আজ সকালে সে নিজেই যাবে রেহানের কলকাতার অফিসে।

শেষ পর্যন্ত গতকাল রাতে রেহানের সঙ্গে কথা হয়েছিল দীপ্তেন্দুর। সে তাকে জানিয়েছিল কলকাতায় যাওয়ার কথা। রেহান তার পুরোনো বন্ধুকে নিজের অফিসে আসতে বারণ করেনি। ওদের বন্ধুত্বের শুরু সেই কলেজ জীবনে। একই কলেজে পড়ত ওরা দু’জন। পড়াশুনার পাট চুকিয়ে দশ বছর আগে যখন ব্যবসা শুরু করেছিল দীপ্তেন্দু তখন তার সম্বল ছিল একটা মাত্র ওষুধের দোকান। সেই দোকান তৈরি করার জন্যে যে পুঁজির দরকার ছিল সেটাও তাকে ধার হিসাবে দিয়েছিলেন রেহানের বাবা অসীমকাকু। অনেক কষ্ট করে বিগত শতাব্দীর নয়ের দশকে নিজের রিয়েল এস্টেটের ব্যবসাটাকে দাঁড় করিয়েছিলেন তিনি। আর এখন রিয়েল এস্টেট ছাড়াও কলকাতা ও হাওড়ায় বেশ কয়েকটা চারচাকার শোরুম এবং মল ও মাল্টিপ্লেক্স তাঁর একমাত্র পুত্র রেহানের মালিকানাধীন। নিজের হাতে পুরো ব্যবসাটাকে দাঁড় করালেও কয়েক বছর আগে রেহানের হাতে সব দায়িত্ব সঁপে দিয়ে অবসর জীবন যাপন করছেন অসীমকাকু। দীপ্তেন্দুকে তিনি ভালোবাসতেন নিজের ছেলের মতোই। ব্যবসার প্রতি দীপ্তেন্দুর আগ্রহ দেখে তখনই তিনি বলেছিলেন শুরুর দিকে একটু সাহায্য পেলেই নাকি বহুত বড় ব্যবসাদার হয়ে ওঠার ক্ষমতা আছে এই ছেলের। অসীমকাকুর সেই কথাকে সত্যি প্রমাণ করেছে দীপ্তেন্দু। ওষুধের ব্যবসা করে তাঁর সমস্ত লোনই কেবল সে শোধ করেনি, বরং এই কয়েক বছরেই ব্যবসাকে এগিয়েও নিয়ে গেছে অনেকটা। বছর চারেক আগে, তখনও তার বিয়ে হতে কয়েকমাস দেরি, দীপ্তেন্দু শুরু করেছিল ইট, বালি, পাথর আর সিমেন্টের ব্যবসা। শুধু ওর শহর নয়, উত্তরপাড়া থেকে শ্রীরামপুর, গঙ্গার ধারের চারটে শহরে যত বাড়ি আর রিয়েল এস্টেটের কাজ হয় তার অনেক জায়গাতেই কাঁচামালের অর্ডার সাপ্লাই করে সে।

রেহানের কাছেও আসা সেই অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজের জন্যেই। কোন্নগরে গঙ্গার ধার একটা বিশাল বড় আবাসন বানাচ্ছে রেহান। পাঁচখানা বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট, সুইমিং পুল, জিম, রেস্টুরেন্ট, মল, মাল্টিপ্লেক্স সবকিছু নিয়ে সে একখানা ছোটখাটো শহরই বলা চলে। যেহেতু জায়গাটা কোন্নগর, আর রেহান ওর কলজের সহপাঠী, দীপ্তেন্দু ভেবেছিল কাঁচামাল সাপ্লাইয়ের ডিলটা খুব সহজেই পাকা হয়ে যাবে ওর সঙ্গে। কিন্তু বাধ সাধল পবন। সেও অর্ডার সাপ্লায়ার। এমনিতে দীপ্তেন্দুর সঙ্গে এলাকার কাজগুলো ভাগাভাগি করে নিলেও এই প্রজেক্টটাকে হাতছাড়া করতে রাজী নয় সেও। ব্যাপারটা পবন ঠারে ঠোরে বুঝিয়ে দিয়েছে তাকে। পবনকে থামানোর জন্যে স্থানীয় এম এল এ রজতবাবুর সঙ্গেও দেখা করেছিল দীপ্তেন্দু। কিন্তু তিনিও মাথা গলাতে রাজী হননি ওদের দু’জনের এই লড়াইতে।

অগত্যা রেহানকে হাতে আনার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিল দীপ্তেন্দু। বাধ্য হয়েই দিন তিনেক আগে ওকে নিজের বাড়িতে ডেকে সিঙ্গেল মল্ট স্কচ সহযোগে ডিনারের ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সেদিন অত খাইয়ে দাইয়েও খুব একটা লাভ হয়নি। বেরোবার সময় আলতো করে কথাটা সে পেড়েছিল রেহানের কাছে। হাসতে হাসতে রেহান তখন উত্তর দিয়েছিল, “সব হবে। একটু ধৈর্য ধর।”

নিজের কলেজের সহপাঠী যে তাকে এইভাবে ঝুলিয়ে রাখবে তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি দীপ্তেন্দু।

ভিতরে ভিতরে রেহান পবনের সঙ্গে ডিলটা পাকা করে ফেলেছে কিনা সেটাও বুঝতে পারছিল না সে।

অবশ্য শুধু এই কাজে নয়, ব্যবসার ক্ষেত্রে আরও একটা জায়গায় বিগত কয়েকমাসে বেশ খানিকটা ঝাড় খেয়েছে দীপ্তেন্দু। তার ওষুধের দোকানের উলটোদিকে একটা বিখ্যাত ফার্মা কোম্পানির ব্রাঞ্চ খোলায় একটু হলেও পড়তির দিকে দীপ্তেন্দুর ব্যবসা।

এমন অবস্থায় এত বড় একটা ডিল মিস করে যাওয়া মানে অনেকগুলো টাকা লস!

বিষণ্ণতার পুরু চাদর যেন ঘিরে ধরে দীপ্তেন্দুকে। যখন সে ব্যবসা শুরু করেছিল, এরকম অবাঞ্ছিত ঝামেলা খুব একটা ছিল না বললেই চলে। কুসংস্কারে বিশ্বাস করার মতো দুর্বল মানসিকতা না হলেও দীপ্তেন্দুর মনে হয় তার ব্যবসায় হঠাৎ আসা খারাপ সময়ের জন্যে দায়ী ওর বউ নিধি। শালা ওই মাগীটাই অপয়া! ওকে বিয়ে করে ঘরে তোলার পর থেকেই শুরু হয়েছে যত অশান্তি!

অথচ বিয়ের পর দিনগুলো মোটেও এমন ছিল না। নিধির রূপে এতটাই মজে গিয়েছিল সে যে মদ খেতেও ভুলে গিয়েছিল প্রায় মাস খানেক। কিন্তু ঝামেলা বাঁধল বউভাতের রাতেই। মনে মনে অসন্তুষ্ট হলেও প্রথম রাত বলেই ব্যাপারটাকে বিশেষ পাত্তা দেয়নি দীপ্তেন্দু। বরং খুশিই হয়েছিল। লজ্জায় কুঁকড়ে আছে মেয়েটা। মনে তো হয় না এর আগেই অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে শুয়েছে বলে।

কিন্তু একই জিনিষ যদি প্রত্যেক রাতে ঘটে! হঠাৎ দীপ্তেন্দুর সামনে থেকে হারিয়ে যায় বাইরের ব্যস্ত বিটি রোড। তার বদলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নিজের বেডরুম। নীল আলো আর এসির ঠান্ডায় তখন মায়াবী হয়ে আছে ঘরখানা। দীপ্তেন্দু একটু একটু করে খুলে দিচ্ছে নিধির সমস্ত পোশাক। কিন্তু দীপ্তেন্দুর উদ্ধত পৌরুষের সামনে কুঁকড়ে আছে নিধি। ঠিক সেই প্রথম রাতের মতো!

দীপ্তেন্দুর চোখের সামনে ভেসে ওঠে নগ্ন নিধির মুখখানা। চোখ দুটো বন্ধ আর সমস্ত মুখ জুড়ে চরম অনীহা। যেন দীপ্তেন্দু জোর করে ধর্ষণ করছে তাকে! প্রচণ্ড রাগে সমস্ত শরীর জ্বলে উঠত দীপ্তেন্দুর। জীবনে কম মেয়ের সঙ্গে সে শোয়নি। কলেজ জীবনেই একবার রেহানের সঙ্গে নীলকমলে গিয়েছিল। ব্যবসা শুরু করার অর্থের বিনিময়ে বহুবার ভোগ করেছে নারীর শরীর। কিন্তু একটা বেশ্যাও তো সোহাগ করে! ভালো টাকা পেলে বিছানায় শুয়ে এমন নাটক করে যে মনে হয় তার জীবনে দীপ্তেন্দু ছাড়া অন্য কোনো ভাতার নেই। অথচ নিধি! একটা মৃতদেহের মতো সে পড়ে থাকত বিছানায়! যতক্ষণ পারত বন্ধ করে রাখত তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসও।

এ’রকম কাঠ হয়ে থাকা একটা দেহের উপর নিজের কামনা চরিতার্থ করাটাকে মোটেও উপভোগ করতে পারেনি দীপ্তেন্দু। আর যাই হোক, সে নেক্রোফিলিয়াক নয়। এখনও যে মাগিটাকে বাড়ি থেকে বার করে দেয়নি, সেটা নিধির চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য!

 

“স্যার এসে গেছে।” হঠাৎ রতনের কণ্ঠস্বরে চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায় দীপ্তেন্দুর। সামনেই দেখা যাচ্ছে রেহানের ঝাঁ চকচকে দোতলা অফিসটা। উপরে সাইনবোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা ‘MUKHERJEE BULIDERS AND DEVOLPOERS PRIVATE LIMITED.’

রিস্টওয়াচ বলছে সাড়ে বারোটা বাজে। তার মানে রেহান পৌঁছে গেছে অফিসে। বেলা বারোটা থেকে দুপুর তিনটে অবধি নিজের অফিসে থাকে রেহান। মাথা থেকে উলটোপালটা চিন্তাগুলোকে বার করে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে দীপ্তেন্দু। পা বাড়ায় বন্ধুর অফিসের দিকে।

 

“আসতে পারি?”

দীপ্তেন্দুর কণ্ঠস্বর শুনে মুখ তুলে তাকাল রেহান। কেবিনের দরজাটা সামান্য ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে সে। নিজের ল্যাপটপে একটা হিসাব মেলাবার চেষ্টা করছিল রেহান। কিন্তু পারছিল না। সেটা হিসাবের গণ্ডগোলের জন্যে নয়। তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল নিধির চেহারাটা। অথচ নিধিকে তো সব মিলিয়ে দেখেছে মাত্র চারবার। প্রত্যেকবারই কয়েক মিনিটের জন্যে। কিন্তু তারপরেও মেয়েটা যেন জাঁকিয়ে বসেছে তার মাথায়।

নিধিকে রেহান প্রথমবার দেখেছিল দীপ্তেন্দুর বিয়ের সময়। সেদিন বরযাত্রী হিসাবে শুধু সে নয়, ওর বাবা আর মাও উপস্থিত ছিল সেখানে। দীপ্তেন্দুর বারবারের অনুরোধ ফেলতে পারেনি ওরা। ওইদিন বিয়ের সাজে নিধিকে অপরূপ লেগেছিল রেহানের। তার উপর মেয়েটার মুখের হাসিটা… মনে হচ্ছিল কনের আসনে বসে আছে স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো অপ্সরা। মুগ্ধতা থাকলেও পাশে বাবা আর মা থাকার জন্যেই সেই সৌন্দর্য দু’চোখ ভরে উপভোগ করতে পারেনি রেহান। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল বউভাতের দিনেও। কিন্তু ওই দু’দিনই চড়া মেক আপে ঢাকা ছিল নিধি। ওদের বিয়ের পর আর দীপ্তেন্দুর বাড়ির আসা হয়নি রেহানের। তাই বিনা মেক আপে আসল নিধিকে দেখার সুযোগ তার হয়েছিল তিন দিন আগে, দীপ্তেন্দুর নিমন্ত্রণে ওর বাড়িতে যাওয়ার পর।

নানা কাজের ব্যস্ততায় দীপ্তেন্দুর বিয়ে সেরে ফিরে আসার পর নিধির কথা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেলেও, দিন সাতেক আগে রেহানের নিমন্ত্রণের ফোনটা পাওয়ার পর থেকেই সিঙ্গেল মল্ট স্কচের লোভ নয়, রেহানের মাথায় চেপে বসেছিল নিধিকে দেখার লোভ। সেদিন নিজের গাড়িতে কোন্নগর এলেও দীপ্তেন্দুর সঙ্গে করা প্ল্যান অনুসারে ওদের দু’জনের গাড়িই একসঙ্গে ঢুকেছিল দীপ্তেন্দুর বাড়িতে। বাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিল নিধি। তার পরনে তখন একটা সাধারণ আটপৌরে শাড়ি। তবুও মেয়েটাকে দেখে আরও একবার মাথা ঘুরে গিয়েছিল রেহানের। মেক আপ ছাড়াও তো এই মেয়ে স্বর্গের অপ্সরা। দুধে আলতায় গায়ের রঙ, চোখ দুটো দীঘল, নাকটা টিকলো আর ঠোঁট দুটো যেন পদ্মফুলের পাপড়ি। শরীরের কোথাও নেই একফোঁটা বাড়তি মেদ। যেখানে যেটুকু দরকার ঠিক ততটাই মাংসপেশি দিয়ে বিধাতা যেন নিজের হাতে অতি যত্ন করে গড়েছেন নিধিকে।

যতবার ওরা একসঙ্গে আসর বসিয়েছে ততবারই দীপ্তেন্দু পেগ বানিয়ে দিয়েছে রেহানের জন্যে। পেগ বানানোতে সত্যিই সিদ্ধহস্ত ওর বন্ধু। কিন্তু সেই সন্ধ্যায় দীপ্তেন্দুর বানানো পেগে চুমুক দিলেও বা তার কথা শুনলেও রেহানের মাথায় ঢুকছিল না কিছুই। আরও একবার নিধিকে দেখার জন্যে হাঁকপাঁক করছিল মনটা।

সেই সুযোগও এসেছিল। দুটো সোফায় মুখোমুখি বসেছিল সে আর দীপ্তেন্দু। মাঝের টেবিলে যাবতীয় সরঞ্জাম রাখা। টেবিলটা নিচু। ওদের দুজনের হাঁটুর সমান উচ্চতার। খাবারটা রাখার সময় সামান্য অসাবধানতা বশত সরে গিয়েছিল নিধির বুকের আঁচল। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে রেহানের চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল মেয়েটার সুডোল আর ফর্সা স্তনের ঊর্ধ্বাংশ, স্তনবিভাজিকা। নেশার ঘোরে বোধহয় ব্যাপারটা খুব একটা খেয়াল করেনি দীপ্তেন্দু। কিন্তু যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল ওই দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারেনি রেহান। হঠাৎ জ্বলে ওঠা কামনার আগুনে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল সে।

সেই মুহূর্তে তার সমস্ত অস্তিত্ব নিধিময় হয়ে উঠলেও রেহান দীপ্তেন্দুকে ব্যাপারটা বুঝতে দেয়নি। ডিলের ব্যাপারটাও মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল তার। খেয়াল হয় বেরোবার সময় দীপ্তেন্দু যখন কথাটা পাড়ে। কিন্তু তখন আর এইসব আলোচনা করতে ভালো লাগছে না রেহানের। দীপ্তেন্দুকে বিদায় জানিয়ে সে উঠে বসেছিল গাড়িতে। ড্রাইভার অপেক্ষাতেই ছিল। রেহান গাড়িতে বসতেই ওকে পৌঁছে দিয়েছিল বরানগরের বাড়িতে।

পরদিন থেকে আবার নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল রেহান। কোন্নগরের কাজটা শুরু করতে এখনও মাস তিনেক দেরি আছে বলেই আর মাথা ঘামায়নি ব্যাপারটা নিয়ে। তাছাড়া এই ক’দিনে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তার। ওর বাবার এক বন্ধু বিকাশ আংকেল, বেশ কয়েকদিন ধরেই বিক্রি করতে চাইছিলেন তাঁর পলাশবনির রিসোর্টটাকে। বিকাশ আংকেলের ছেলে আকাশের ব্যবসায় মন নেই। বাবার অনিচ্ছাতেই ডাক্তারি পড়া শেষ করে সুদূর ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছিল সে। সেখানেই একজন গ্রীক মহিলাকে বিয়ে করে থিতু হয়েছে। ভারতীয় হলেও ডাক্তার হিসাবে সেদেশে নাকি খানিক নামধামও নাকি হয়েছে তার।

আকাশের সঙ্গে বহুদিন যোগাযোগ নেই রেহানের। তবে বিকাশ আংকেলের মুখেই সে শুনেছিল যে এ’দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছাই আর অবশিষ্ট নেই আকাশের মধ্যে। সেই জন্যেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে নিজের ব্যবসা গুটিয়ে আনছেন বিকাশ আংকেল। এদিকে হোটেল ব্যবসা শুরু করার ইচ্ছাটা রেহানের অনেক দিনের। তাই বিকাশ আংকেলের কাছ থেকে রিসোর্টটা কেনার প্রস্তাব আসতেই লুফে নিয়েছিল সে। দীপ্তেন্দুর বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর গত পরশু রিসোর্টটা দেখতে পলাশবনি গিয়েছিল রেহান। সেখানে একরাত কাটিয়ে জায়গা এবং রিসোর্ট দু’টোই মনে ধরেছে তার।

পলাশবনি থেকে রেহান ফিরেছিল গতকাল দুপুরে। গতকাল বিকেলে খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার মোবাইল। সন্ধ্যাবেলায় একটা কল করতে গিয়ে ব্যাপারটা আবিষ্কার করে সে।

সিমটাকে অন্য মোবাইলে ভরে চালু করতে করতে কেটে গিয়েছিল আরও কিছুটা সময়। তারপর রাতে দীপ্তেন্দু ফোন করে যখন একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট চায়, তখন আবার রেহানের চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল নিধির যৌবন। সেই থেকেই তার মন হয়ে আছে নিধিময়।

 

এখন দীপ্তেন্দুকে সামনে দেখে রেহানের মনে হল বলে, “নিধিকে নিয়ে আসলি না?”— কিন্তু সামলে নিলো সে। বরং ঠোঁটের কোণে একটা হালকা হাসি এনে বলল, “আয়, ভিতরে আয়।”

ওর সম্মতি পেয়েই ভিতরে ঢুকল রেহান। বসে পড়ল ওর টেবিলের উলটোদিকে রাখা চেয়ারটাতে।

“বল? কী নিবি? চা, কফি কোল্ড ড্রিংক? দিনের বেলায় তো মাল খাওয়াতে পারবো না।” দীপ্তেন্দু বসতেই হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল রেহান।

দীপ্তেন্দু যেন এই প্রশ্নটারই অপেক্ষাতে ছিল, “রেহান, কিছু নেব না রে। আমি এসেছিলাম আসলে ওই ডিলটার ব্যাপারে। তোকে তো বলেছিলাম সব কথা।”

হাত দুটো কচলাচ্ছে দীপ্তেন্দু। চোখে মুখে একটা দ্বিধাগ্রস্ত ভাব। আজ তার মধ্যে যেন আবার উঁকি মারছে কলেজ জীবনের সেই ছেলেটা। বড়া থেকে পড়তে এসেছিল তাদের কলেজে। সোশাল স্ট্যাটাসে কোনো মিল ছিল না দীপ্তেন্দু আর রেহানের। তবুও কী ভাবে যেন বন্ধু হয়ে গিয়েছিল ওরা দু’জন। দেখতে শুনতে গ্রাম্য হলেও তখনই দীপ্তেন্দুর মধ্যে ছিল অসম্ভব জেদ, আর নিজের স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করার সাহস।

দীপ্তেন্দুর এই গুণটা পছন্দ হয়েছিল রেহানের বাবারও। সে জানে বাবা যদি দীপ্তেন্দুর দিকে সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে দিত আজকের জায়গাটায় পৌঁছতে হয়তো অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হত তাকে। আজ আবার ব্যবসায় কিছুটা মার খেয়ে দীপ্তেন্দু এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে, একটা বড় লাভ করার আশায়। পবনের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা হলেও ডিলটা রেহান মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল দীপ্তেন্দুর জন্যেই।

কিন্তু আজ সামনে বসা ছেলেটাকে দেখে হঠাৎ প্রচণ্ড হিংসা হল তার।

রেহান নিজে এখনও বিয়ে থা করেনি। সেটা অবশ্য ইচ্ছা করেই। বয়স তো সবে বত্রিশ। বাড়ি থেকে চাপ থাকলেও এখনই সংসারে জড়িয়ে পড়ার কোনো ইচ্ছা নেই তার। কিন্তু ব্যাপারটা কি বদলে যেত, যদি নিধি পাত্রী হয়ে এসে দাঁড়াত তার সামনে?

হঠাৎ বন্ধুর সামনে নিজেকে বড্ড ভাগ্যহীন মনে হল রেহানের। দীপ্তেন্দুর কাছে নিধির মতো একজন অপ্সরা রয়েছে, যাকে সে ভোগ করতে পারে যখন তখন।

আর সে…!

নিমেষে একটা চাপা রাগ গ্রাস করল রেহানকে। সে বলে উঠল, “দেখ। বারবার আমাকে বিরক্ত করিস না। এখনও ওই প্রজেক্টে হাত দিতে দেরি আছে। যদি মনে হয় নিশ্চয়ই তোর সঙ্গে ডিল পাকা করব। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি তোকে কিছু কথা দিতে পারছি না। ওকে। তুই এখন যেতে পারিস।”

রেহানের কথা শুনে হঠাৎ কালো হয়ে গেল দীপ্তেন্দুর মুখখানা। সে ভেবেছিল বন্ধু এবার তার হাতে পায়ে ধরবে। কিন্তু সেসব কিছুই করল না দীপ্তেন্দু। চেয়ার ছেড়ে উঠে মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল রেহানের কেবিন থেকে।

বন্ধুত্ব অনেক বছরের। তবুও নিজের কেবিন থেকে অপমানিত দীপ্তেন্দুকে বেরিয়ে যেতে দেখে নিজের মনে একটা অদ্ভুত তৃপ্তি অনুভব করল রেহান।

ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছিল দীপ্তেন্দুর নাক ডাকার আওয়াজ। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ছে সে। গত কয়েকদিন ধরেই মেজাজ ভালো নেই দীপ্তেন্দুর। আর আজ যেন সপ্তমে চড়ে ছিল সেটা। বাড়ি ফিরে স্নান না সেরেই বসে পড়েছিল হ্যান্ড্রেড পাইপার্সের বোতল নিয়ে।

অন্যদিন মদ খেয়ে উপরে এসে ডিনার সারে দীপ্তেন্দু। প্রতিদিনের মতো আজও নিধি ওদের দোতলার ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে রেখেছিল দীপ্তেন্দুর ডিনার। জেগে বসে অপেক্ষা করছিল তার জন্যে। দীপ্তেন্দুর খাওয়া শেষ হলেই ডিনার করে সে। কিন্তু আজ নিধির রান্না করা ডাল, ডিমের কারি, আর ভাতের দিকে ফিরেও তাকায়নি দীপ্তেন্দু। রাত তখন বারোটা। কোনোরকমে টলতে টলতে উপরে এসে সে ঢুকে পড়েছিল বেডরুমে। এসিটা অন করার পর সারাদিনের নোংরা জামাকাপড়গুলো না ছেড়েই শরীরটাকে এলিয়ে দিয়েছিল বিছানায়।

দীপ্তেন্দু খাবে না বুঝতে পেরে ডিনার সেরে এসে নিধি শুয়ে পড়েছিল তার পাশে। কিন্তু সে শুতেই হঠাৎ উঠে বসেছিল দীপ্তেন্দু। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিধির উপরে। দীপ্তেন্দুর মুখ থেকে তখন ভকভক করে বেরচ্ছে মদের গন্ধ। সঙ্গে মিশে আছে সারাদিনের ঘামের বিচ্ছিরি টক গন্ধটাও। বমি আসছিল নিধির। তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেও কিন্তু আজ নিধির কাপড় খোলার চেষ্টা করেনি দীপ্তেন্দু। বরং ওর চুলের মুঠি ধরে হিংস্র রাক্ষসের মতো চিৎকার করে উঠেছিল সে, “শালী হারামি মাগি। তোর জন্যেই আজ আমার এই অবস্থা।”

বহুদিন পর দীপ্তেন্দু সপাটে একটা চড় মেরেছিল তার বউকে। নিধির গালটা জ্বলে গেলেও সেই চড়ের ধাক্কা কিন্তু সামলাতে পারেনি দীপ্তেন্দুর টলতে থাকা শরীরটাও। উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিল বিছানার উপরে।

এরপরে আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করেছে দীপ্তেন্দুর নাক ডাকার শব্দ। ঘরে অন্য শব্দ বলতে রয়েছে ঘড়ির টিকটক। ঘাড় তুলে নিধি একবার তাকাল পায়ের দিকে টাঙানো ওয়াল ক্লকটার দিকে। নাইট ল্যাম্পের নীলাভ আলোয় দেখা যাচ্ছে ঘড়ির কাঁটা দুটো।

রাত একটা বাজে। দীপ্তেন্দু আজ তাকে মারলেও কোনো প্রতিবাদ করেনি নিধি। চুপচাপ পড়েছিল বিছানার উপরে। মদ খেলে আর নিজের মধ্যে থাকে না দীপ্তেন্দু। বিয়ের পর লোকটা যখন হাত তুলতে শুরু করেছিল তার গায়ে, নিধি একবার চেষ্টা করেছিল বাধা দেওয়ার। পারেনি; উলটে কপালে জুটেছিল আরও থাপ্পড়, কিল, ঘুসি।

থানা পুলিশ করার সাহস হয়নি নিধির। তিনকুলে কেউ না থাকার জন্যে ডিভোর্সটাও চাইতে পারেনি। কিন্তু সে বসে আছে একটা সুযোগের অপেক্ষায়। সুযোগ পেলেই সুদে আসলে উসুল করে নেবে সবকিছু।

কিন্তু নিধি নিজেও জানে না সেই সুযোগ কবে আর কী ভাবে আসবে!

রাত্তিরের এই সময়টা নিধির একেবারে নিজস্ব। তাই মনের ভিতরে কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে থাকলেও বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল সে। তারপর রোজের মতোই নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো বেডরুম ছেড়ে।

বেডরুমের পাশেই রয়েছে একটা বড়সড় ঘর। দোতলার কিচেনটা এই রুমের লাগোয়া। কিচেনের সামনেই ডাইনিং টেবিল। সেটার একপাশে বারান্দা। অন্ধকারে চোখ সয়ে গিয়েছিল। ডাইনিং টেবিলটাকে পাশ কাটিয়ে নিধি চলে এলো বারান্দার দরজাটার কাছে। খুব সন্তর্পণে, প্রায় নিঃশব্দে খুলে ফেলল দরজাটা। তারপর বারান্দায় ঢুকে আবার বাইরে থেকে ল্যাচ টেনে বন্ধ করে দিল সেটা।

গ্রিল দিয়ে ঘেরা বারান্দাটা বাড়ির পিছন দিকে। এখানে থেকে সোজা দেখা যায় নিমগাছটাকে। বারান্দার সিলিঙ থেকে একটা দোলনা টাঙানো আছে। নিধি বসে পড়ল সেটার উপর।

এখন নিধির শরীরে রয়েছে একটা সবুজ নাইটি। বাবাই তাকে বলেছিল এই সময় পোশাক থাকতে হবে একদম ঢিলেঢালা, শরীর থাকতে হবে একদম রিলাক্সড।

ঠান্ডা লাগার ভয়ে শীতকালে বিরতি দিলেও বছরের বাকি রাতগুলোতে এখানে এসে দাঁড়ায় নিধি। পিছন দিকে তেমন বাড়িঘর না থাকলেও বাবার মতোই দিনের বেলায় কখনও এই কাজ করে না সে। কেউ যদি দেখে ফেলে! পাড়ায় কথাটা ছড়িয়ে যেতে যে খুব বেশি সময় লাগবে না তা খুব ভালো করেই বোঝে নিধি।

আকাশে কৃষ্ণপক্ষের একফালি চাঁদ। মরা চাঁদের আলোতে আবছা দেখা যাচ্ছিল বাইরেটা। তাতে অবশ্য নিধির অসুবিধা হচ্ছিল না। নিমগাছটার ভূগোল মুখস্থ হয়ে গেছে তার।

দোলনায় বসে নিমগাছটার দিকে তাকাল নিধি। হৃদয়ের সমস্ত একাগ্রতা আর বিশ্বাস এক করে গাছটার উদ্দেশে মনে মনে বলে উঠল, “আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি আমার ডাকে সাড়া দাও।”

এই পদ্ধতিটা নিধি শিখেছিল তার বাবার কাছে। তখন সে হরিদেবপুরে, বাপের বাড়িতে। প্রথম প্রথম মনকে একাগ্র করার জন্যে বেশ কিছুদিন ধ্যান করতে হয়েছিল তাকে। প্রায় এক বছর ধ্যান করার পর নিধি সেখানকার নিমগাছটার উপরে নিজের সমস্ত মনকে এক করতে পেরেছিল। শুরুতে পুরো কাজটা করতে মনের উপর খুব চাপ পড়লেও এখন ব্যাপারটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। নিধির ডাকে সাড়া দিয়ে তাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নড়ে উঠল গাছটার ডাল আর পাতাগুলো।

বাবাও এতদূর এগোতে পেরেছিল। ততদিনে নিয়মিত রাত জাগার ফলে ভেঙে গেছে তার শরীর। কালি পড়েছে তার চোখের তলায়। তাই বাবার কাছে সবকিছু শিখে নেওয়ার পর আর তাকে রাত জাগতে দিত না নিধি। মেয়ের কড়া শাসন অগ্রাহ্য করতে পারেনি বাবাও। নিজের উত্তরসূরি খুঁজে পেয়ে শেষ পর্যন্ত কিছুটা অনিচ্ছাতেই অব্যাহতি নিয়েছিল এই কাজ থেকে।

কিন্তু নিধিও এতদিনে এগোতে পেরেছে ওই অবধিই। হরিদেবপুরের বাড়িতে থাকার সময়েই এক পূর্ণিমা রাতে তার কথা শুনে বিনা হাওয়াতেই নড়ে উঠেছিল সেই নিমগাছটার পাতাগুলো।

ওর সব কথা শোনে বলে হরিদেবপুরের গাছটার মতোই কোন্নগরের গাছটাও এখন নিধির একমাত্র বন্ধু। নিজের সুখ দুঃখ সবকিছুই ওর সঙ্গেই ভাগ করে নেয় সে। তাই গাছটার ডালগুলো নড়ে উঠতেই নিধি বলল, “তুমি জানো, আজ ও আবার আমাকে মেরেছে।”

কোনো উত্তর নেই। শুধু বিনা হাওয়াতেই আস্তে আস্তে নড়ে চলেছে ডাল পাতাগুলো। নিধি ফের মনে মনে বলে উঠল একই কথা, “আজ ও আবার আমাকে মেরেছে।”

কষ্টটা আবার দলা পাকিয়ে উঠছে বুকের মধ্যে। এর আগে দীপ্তেন্দুর হাতে মার খাওয়ার পরেই কখনও গাছটার সামনে এসে দাঁড়াতে পারেনি নিধি। তখন তো সবে মদ খাওয়া শুরু করেছিল দীপ্তেন্দু। কিন্তু একবার নেশা হয়ে গেলে তার বর যে অঘোরে ঘুমায়, কোনোদিকে তার হুঁশ থাকে না— সেটা বুঝতেও নিধির মাসখানেক সময় লেগেছিল।

একটা মাতালের পাশে শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসতে চাইত না তার। ওইসময়েরই একদিন রাতে সে সাহস করে বেরিয়ে এসেছিল বারান্দায়। কথা বলার চেষ্টা করেছিল নিমগাছটার সঙ্গে। প্রথম প্রথম ভয় করত। এই বোধহয় দীপ্তেন্দু এসে কড়া নাড়ল ব্যালকনির দরজায়। কিন্তু সেই ভয়ও কেটে গেছে। মাঝরাতে দীপ্তেন্দু কখনও বিরক্ত করেনা তাকে। বাথরুম যেতে হলেও ভোর চারটের আগে ঘুম ভাঙে না মানুষটার। ততক্ষণে প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে কথা শেষ করে আবার বিছানায় ফিরে গেছে নিধি।

বহুদিন পর আজ দীপ্তেন্দুর হাতে থাপ্পড় খাওয়ার ক্ষতটা এখনও ভীষণ টাটকা। সেইজন্যেই একবার নয়, বারবার কথাটা সে বলে যাচ্ছিল গাছটাকে। কিন্তু ডালপালাগুলো নড়লেও আর কোনো সাড়া আসছিল না গাছটার তরফ থেকে। এদিকে ওর কথা শোনার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠছিল নিধির মন। ক্রমশ তার ব্যাকুলতা বদলে যাচ্ছিল ক্ষোভ আর হতাশায়। চিৎকার করতে ইচ্ছা করলেও কোনোরকমে চেপে রেখেছিল নিধি। কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক নিষ্ফল চেষ্টার পর প্রচণ্ড অভিমানে মনে মনে সে যেন চিৎকার করে উঠল, “তুমি যদি আজ উত্তর না দাও, গ্রিলে ঠুকে ঠুকে মাথা ফাটিয়ে ফেলব আমি। তুমি তো চলতেও পারো না। পারবে আমাকে আটকাতে?”

নিধির মনে তখন অমাবস্যার কালো অন্ধকার। তার দু’চোখ উপচে পড়তে শুরু করেছে পাহাড়ি ঝর্ণার মতো। গ্রিলে মাথা ঠুকতে যাচ্ছিল সে, ঠিক সেই সময়েই কেউ যেন তার মাথার মধ্যে বলে উঠল, “তোমার বর তোমাকে মেরেছে। আর তোমরা মানুষরা, সেই জন্মলগ্ন থেকে নিজেদের প্রয়োজনে কেটে চলেছ আমাদের। যদিও আমাদের থেকে অক্সিজেন, খাবার সবকিছু পাও তোমরা।”

শব্দগুলো যেন ধাক্কা মারল নিধির মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীর জুড়ে একটা শিহরণ খেলে গেল তার। নিমেষে শুকিয়ে গেল চোখের জল। সে বলে উঠল, “তুমি কথা বললে!”

“হ্যাঁ আমি, তোমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিমগাছ। আমিই কথা বললাম।”

এক সেকেন্ডও সময় লাগল না। তার আগেই বদলে গেল নিধির মনের মানচিত্র। সাফল্যের আনন্দে কাটা মাছের মতো লাফাতে শুরু করেছে তার হৃৎপিণ্ডখানা।

গাছের কথা শোনার যে চেষ্টা সে এত বছর ধরে করে চলেছে, তা সফল হল আজ!

 

নিজের ওষুধের দোকানে চুপচাপ বসেছিল দীপ্তেন্দু। সময় রাত আটটা হলেও ভিড় বেশ কম। এদিকে মন ভালো নেই দীপ্তেন্দুরও। দিন চারেক আগে রেহানের করা ব্যবহারটা এখনও হজম করে উঠতে পারেনি সে।

এতদিনের পুরোনো বন্ধু যে তাকে এরকমভাবে অপমান করে তাড়িয়ে দেবে, সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি দীপ্তেন্দু।

তার দাবীতে তো অন্যায় কিছু ছিল না!

লাজলজ্জার মাথা খেয়ে সে আর ফোন করতে পারেনি রেহানকে। তবে দীপ্তেন্দু যতই মুষড়ে থাকুক না কেন, এই কদিন একটা ব্যাপার বেশ ভালো করে লক্ষ্য করেছে সে।

তার হাতে থাপ্পড় খাওয়ার পর অদ্ভুতভাবে বিগত কয়েকদিন বেশ চনমনে আছে নিধি।

মেয়েটা কি কোনো ছেলের সঙ্গে জড়িয়েছে? সন্দেহটা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল দীপ্তেন্দুর মনে।

অবশ্য তার প্রমাণ এখনও পায়নি সে। গতকাল মানে রবিবারের দুপুরের কথা। বাড়িতেই ছিল দীপ্তেন্দু। নিধি স্নান করতে যাওয়ার পর একটু খিদে পাচ্ছিল তার। একটা বিস্কিট খাওয়ার জন্যে কিচেনে ঢুকতেই সে দেখেছিল ওভেনের পাশে পড়ে আছে নিধির মোবাইল।

সেটাকে হাতে তুলে নিয়ে একটু নাড়াঘাঁটা করতেই অবাক হয়েছিল দীপ্তেন্দু।

নিধি লকও করে না নিজের মোবাইলটাকে!

সুযোগ পেয়েই দীপ্তেন্দু ঢুকে পড়েছিল নিধির ওয়াটস অ্যাপে। লক করা নেই সেটাও। কিন্তু ওয়াটস অ্যাপ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পায়নি দীপ্তেন্দু। আর ফেসবুক বা মেসেঞ্জারের কোনো অস্তিত্ব ছিল না নিধির মোবাইলে। ওর কন্টাক্ট লিস্টটা দেখেও বেশ হতাশই হয়েছিল দীপ্তেন্দু। সেখানেও সে আর হরিদেবপুরে ওদের পরিচিত এক বয়স্ক মানুষ ছাড়া কোনো ছেলের নাম্বারও নেই। আর জিমেইলের ইনবক্সটাও ছিল মোটামুটি খালি!

বিস্ময়, ক্রোধ, হতাশা সবকিছু যেন একসঙ্গে চেপে ধরেছিল দীপ্তেন্দুকে। মেয়েটাকে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না সে। সবসময় নিজেকে ঢেকে রেখেছে এমন এক রহস্যের চাদরে যেটা হাজার চেষ্টা করেও ভেদ করা যায় না।

অবশ্য শেষবার নিধির গায়ে হাত তোলার পর ওদের দূরত্বটা যেন বেড়ে গেছে আরও। গত কয়েকদিন নিধি আর খাবার নিয়েও অপেক্ষা করে না তার জন্যে। নিজের সময় মতো খেয়ে শুয়ে পড়ে। মেয়েটাকে গায়ে সেদিন, মানে রেহানের অফিস থেকে ফিরে আসার দিন রাতে, একবার হাত তুললেও এখন আর সেটাও ইচ্ছা করে না দীপ্তেন্দুর। মেরেও কোনো লাভ নেই ওই হাড়বজ্জাত মাগিটাকে। শালা, কোনো ভাবান্তরই আসে না ওর চোখে মুখে!

তেতো আর বিষিয়ে যাওয়া মন নিয়ে কাউন্টারের দিকে তাকিয়েছিল দীপ্তেন্দু। আগে এই দোকানে চারজন কর্মচারী থাকলেও এখন সেটা তিনে এসে ঠেকেছে। বাইরে দাঁড়ানো একজন খরিদ্দারকে ওষুধ দিচ্ছিল ওর একজন কর্মচারী।

আগে কতই না ভিড় থাকত দোকানটাতে। ভাবছিল দীপ্তেন্দু। এই সময়েই হঠাৎ বেজে উঠল ট্রাউজার্সের ভিতরে রাখা মোবাইলখানা। পকেট থেকে বার করে দেখে ফোন করেছে রেহান।

প্রচণ্ড হতাশার মধ্যেও একটা আশার আলো দেখতে পেল দীপ্তেন্দু। তড়িঘড়ি ফোনটা রিভিস করতেই ওপাশ থেকে রেহান বলে উঠল, “দীপ্তেন্দু। সরি ভাই। সেদিন তোর সঙ্গে বড্ড রুড ব্যবহার করে ফেলেছিলাম। অন্য একটা বিষয় নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত আর ডিস্টার্বড ছিলাম। শোন না, কাল রাত আটটা নাগাদ আমার উত্তরপাড়ার ফ্ল্যাটে প্লিজ চলে আয়। আমরা ওই ডিলটা নিয়েই কথা বলবো। আর হ্যাঁ, কাল আমার তরফ থেকে পার্টি থাকবে। স্কচ থাকবে। তবে খাবারটা ভাই জোমাটো থেকে অর্ডার দিয়ে নিয়ে আসবো। আমার তো আর তোর মতো সুন্দরী বউ নেই।”

শেষ কথাটার মধ্যে যে একটা প্রচ্ছন্ন খোঁচা আছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না দীপ্তেন্দুর। কিন্তু রেহান ফোন করেছে বলে কথা! তার উপর আবার ডিলটা হাতে আসার সম্ভাবনা। তাই কথাগুলো গায়ে মাখল না দীপ্তেন্দু। হালকা হেসে বলল, “ওকে বস। তাই হবে।”

ফোনটা কেটে দেওয়ার পর দীপ্তেন্দুর মনে হল একটা পাথর যেন নামতে শুরু করেছে তার বুকের ভিতর থেকে।

 

অনেক দূরে পূর্ব আর পশ্চিম দিগন্তে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের রেখা। শাল, পলাশের ঘন জঙ্গল ঢেকে রেখেছে সেই পাহাড় দুটোর মাঝখানের বিস্তীর্ণ জায়গাকে। উত্তর-দক্ষিণ দিকে আকাশটা যেন নীচে নেমে এসে মিশে গেছে অরণ্যের সঙ্গে। দিগন্ত বিস্তৃত সেই জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে পিচ বাঁধানো আঁকাবাঁকা রাস্তা। রাস্তার দু’পাশে বেশ কয়েকটা হোটেল বা রিসোর্ট থাকলেও ব্রিটিশ আমলে তৈরি পুরোনো এবং পরিত্যক্ত বাড়িও রয়েছে কয়েকটা। গাড়িতে বসে নিধি দু’চোখ মেলে তাকিয়েছিল চারপাশের সবুজের দিকে। এর আগে কখনও জঙ্গলে বেড়াতে আসার সুযোগ হয়নি তার। এ যেন উদ্ভিদের স্বর্গরাজ্য। এক অদ্ভুত রোমাঞ্চে শিহরিত হচ্ছিল তার শরীর।

পলাশ গাছের আধিক্য আছে বলেই বোধহয় জায়গাটার নাম পলাশবনি। এখানে যে হঠাৎ তাকে নিয়ে বেড়াতে আসবে দীপ্তেন্দু, তা ভাবতে পারেনি নিধি। বিয়ের পর হনিমুন করতে দার্জিলিং গেলেও এরপর আর কখনও নিধিকে নিয়ে দূরে কোথাও বেরোয়নি ওর বর। কিন্তু গত মঙ্গলবার রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে কথাটা পেড়েছিল সে, “চলো ব্যবসার কাজ তো অনেক হল। কয়েকদিন ঘুরে আসি।”

সেদিন রাতে বাইরে থেকে ডিনার করে এসেছিল দীপ্তেন্দু। তারপরেই এমন প্রস্তাব! অবাক হয়েছিল নিধি, “কোথায়?”

“সেটা না হয় সাসপেন্স থাক।” হেসে জবাব দিয়েছিল দীপ্তেন্দু, “নেক্সট ফ্রাইডে ভোরবেলায় আমরা বেরবো।”

দীপ্তেন্দু আর কোনো কথা বলেনি। কিছুক্ষণ পরেই তার নাক ডাকার আওয়াজ এসেছিল নিধির কানে। দীপ্তেন্দু গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতেই আবার বারান্দায় এসেছিল সে। কিছুদিন আগে গাছটার কথা শুনতে পাওয়ার পর তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আরও বেড়েছে নিধির। সে আদর করে গাছটার নাম রেখেছে নিমু। নিধি বারান্দায় এসে নিমুকে বলেছিল, “নিমু জানো, ও আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে। কিন্তু কোথায় সেটা বলেনি। তুমি জেনে দিতে পারবে?”

“না নিধি, তুমিই হলে একমাত্র মানুষ, গাছ হয়ে আমি যার সঙ্গে কথা বলতে পারি। তাই দেখতে পাই তোমার মনের ভিতরটাও। তুমি ছাড়া অন্য মানুষের মন আর আমাদের দূরত্ব অনেক। তাই তাদের উপস্থিতি বা কার্যকলাপ টের পেলেও কিছুতেই যোগাযোগ করতে পারি না।”

“তাহলে আর কী!” একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে নিধি বলেছিল, “যাই, আমি ঘুরে আসি?”

“হ্যাঁ। কবে যাবে?”

নিমুর প্রশ্ন শুনে চমকে উঠেছিল নিধি। এই ক’দিন নিমু তার কথার উত্তর দিলেও কখনও কিছু জিজ্ঞেস করেনি। নিজেকে সামলাতে নিধির একটু সময় লেগেছিল। তারপর সে বলেছিল, “আগামী শুক্রবার। ভোরবেলায় বেরবো।”

“যাও নিধি, ঘুরে এসো। তবে বাইরে গিয়ে এই বন্ধুটাকে ভুলে যেও না যেন।”

টেলিপ্যাথির মাধ্যমে মানুষ অনেক দূরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলেও কোনো গাছের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে মুখোমুখি থাকতে হয় দু’জনকে। বিগত কয়েকদিন দুপুরবেলায় বেডরুমে বসে নিমুর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে নিধি। সেখানে কোন্নগর ছেড়ে চলে যাওয়া মানে তো নিমুর সঙ্গে আর যোগাযোগই থাকবে না কোনো। তবে নিধি জানে যতদূরেই যাক, নিমুকে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারবে না সে। তার জীবনে বন্ধু বলে যদি কেউ থেকে থাকে তাহলে সে হল নিমু। মনে মনে হেসেছিল নিধি। কিন্তু তারপরেই একটা প্রশ্ন চলকে উঠেছিল তার মাথায়, “নিমু তোমার আবেগ তো দেখছি মানুষের মতোই। আর বুদ্ধিতেও তো মানুষের থেকে কম যাও না কিছু। এই ক’দিনে খুব কাছের বন্ধুর মতো মিশেছ আমার সঙ্গে। আমার সব কথা শুনেছ। আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথা বলেছ। তাহলে মানুষের অনেক আগে পৃথিবীতে এলেও তোমরা এগোতে পারনি কেন? এখনও কেন ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছ একই জায়গায়?”

“আসলে কী জানো নিধি,” এবার একটু বিষণ্ণ শুনিয়েছিল নিমুর কণ্ঠস্বর, “ঈশ্বর আমাদের সেই ক্ষমতা দেননি। তিনি আমাদের দিয়েছিলেন সালোকসংশ্লেষ, আর মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকার ক্ষমতা। তখন আমরা ছিলাম দুর্বল। কিন্তু আজ থেকে অনেক বছর আগে অনেক দূরের এক গ্রহ স্পুটাকার্স থেকে অ্যারনি নামের একজন স্পেস ট্রাভেলর মহাকাশ অভিযানে বেরিয়ে একটি প্রাণহীন গ্রহে খুঁজে পেয়েছিলেন এক অসীম শক্তি আর প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তার উৎস। সেই শক্তিকে নিজের শরীরে ধারণ করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অতিমাত্রায় শক্তিশালী।

নিজে ক্ষমতালোভী ছিলেন না অ্যারনি। ওই গ্রহ ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর একটা ভয়ানক দুশ্চিন্তা চেপে বসেছিল তার মাথায়। ওর মৃত্যুর পর যদি এই শক্তি কোনো ক্ষমতালোভী অথবা খারাপ কারুর হাতে পড়ে! তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। এদিকে তুমি নিশ্চয়ই জানো শক্তির ক্ষয় নেই। বড়জোর এক শক্তি রূপান্তরিত হতে পারে অন্য শক্তিতে। তাই বাধ্য হয়েই এই শক্তিকে অন্য কোথাও স্থানান্তরিত করার জন্যে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন এক উপযুক্ত মাধ্যম যার মধ্যে প্রাণ আছে। কারণ এক প্রাণহীন গ্রহে সন্ধান পেলেও অ্যারনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই শক্তির আসল ধারক হল প্রাণ। সেই সময়েই উনি পৃথিবীর সন্ধান পান। তখন ডাইনোসরেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই গ্রহের বুকে। তবুও এখানে জন্মানো গাছগুলো মনে ধরেছিল তাঁর। তিনিই এই শক্তিকে স্থানান্তরিত করে দিয়ে যান এখানকার উদ্ভিদকুলের মধ্যে। কিন্তু সুপ্তভাবে।

এরপর তোমাদের মানে প্রাণীদের মতো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরেও অনেক বিবর্তন হয়েছে। কিন্তু তারপরেও আজও আমরা আমাদের প্রতিটি দেহকোষে বহন করে চলেছি সেই শক্তি। বড় বড় যত গাছ আছে তাদের মধ্যে বেশীমাত্রায়, আর ছোট ছোট লতাগুল্মের মধ্যে সামান্য মাত্রায়। শুধু তুমি কেন সারা বিশ্ব দেখেছে, একটা পিঁপড়ে বা আরশোলা তোমাদের পায়ের তলায় পড়লে চাপেই মরে যায়। কিন্তু ঘাসকে মারতে হলে তাকে কতদিন ইট চাপা দিয়ে রাখতে হয়? একটা ফুল বা পাতাকে গাছ থেকে ছিঁড়ে ফেললে সেটা শুকিয়ে যেতে কতটা সময় লাগে বলত? তোমাদের আঙুল কেটে পড়ে গেলে তার অনেক আগেই সেটা থেকে পচা গন্ধ বেরোবে। আর দেখেছ তো গাছ থেকে পাতা বা ফুল ছিঁড়ে ফেললে অনায়াসেই আবার নতুন ফুল বা পাতা চলে আসে সেখানে। কটা প্রাণী পারে এ’রকমভাবে নিজের কেটে যাওয়া অঙ্গকে আবার নিজের দেহেই তৈরি করতে? কিন্তু আমরা পারি। নেহাত আমাদের ভিতরের শক্তি সুপ্ত অবস্থায় বন্দি আছে, তাই একটু মাথা ঘামিয়েই তোমরা মানুষরা আমাদের মেরে ফেলার উপায় বার করে ফেলেছিলে কাণ্ডটাকে কেটে। কিন্তু ব্যাপারটা কতটা নৃশংস ভাবো তো। একটা মানুষের ধড় থেকে মাথাটা আলাদা করে দেওয়ার মতো। অবশ্য আরও একটা উপায় আছে তোমাদের হাতে। আমাদের বেস, মাটি থেকে উপড়ে ফেলা, যাতে জলের অভাবেই শেষ হয়ে যাই আমরা।

“কিন্তু শক্তি পুরোমাত্রায় থাকলে জলের জন্যেও আমরা বসে থাকতাম না। আর তোমারাও কিছুতেই আলাদা করতে পারতে না আমাদের ধড় আর মাথা।

“তবে একটা কথা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ নিধি? সময়ের নিরিখে স্পুটাকার্সের সভ্যতা তোমাদের থেকে অনেক প্রাচীন। পৃথিবী যখন সৃষ্টি হচ্ছে তখনই তারা পৌঁছে গিয়েছিল উন্নতির চরম শিখরে। আর একটা কথা। পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ জীব নিজেদের মানুষ বলে। কিন্তু স্পুটাকার্সের শ্রেষ্ঠ জীব নিজেদের বলে স্পুকার্স।”

এসব কী বলছে নিমু! এতো তার বাবার কথারই প্রতিধ্বনি! বহুদিন পর নিধির চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল বাবার মুখখানা। সঙ্গে সঙ্গে তার মস্তিষ্কের মধ্যে বেজে উঠেছিল নিমুর শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠস্বর, “বাবাকে মনে পড়ছে নিধি?”

সব বুঝতে পারে নিমু। নিধি উত্তর দিয়েছিল, “হ্যাঁ।”

“আমরা সমস্ত উদ্ভিদ জগত ওনার কাছে কৃতজ্ঞ। উনি না থাকলে মানুষের কাছাকাছি পৌঁছতে পারতাম না কখনই।”

বাবার স্মৃতি বড় শান্তি দিচ্ছিল নিধিকে। হঠাৎ নিধির মনে পড়ল তার চারপাশে অনুভূত হওয়া সেই শক্তির উপস্থিতির কথা। সেই কবে থেকে নিধি অনুভব করে কোনো এক অদৃশ্য বলয় যেন ঘিরে রেখেছে তাকে। নিধির বাস সেই বলয়ের মধ্যেই। মুখ তুলে ফের নিমুর দিকে তাকাল নিধি। ততক্ষণে তার মস্তিষ্কে অনুরণন তুলেছে নিমুর কণ্ঠস্বর, “তুমি তোমার চারপাশে যে শক্তির উপস্থিতি টের পাও, সেটা আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত শক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। উদ্ভিদ জগতের খুব কাছাকাছি চলে এসেছ বলে তুমিও আমাদের মতো অনুভব করতে পারো সেই অদৃশ্য শক্তির উপস্থিতি।”

একটা একটা করে পর্দা যেন সরে যাচ্ছিল নিধির চোখের সামনে থেকে। আরও একটা প্রশ্ন জেগেছিল তার মনে, “কিন্তু তাহলে ও যখন রাতে আমাকে… তখন কেন মনে হত একজোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে?”

“কেউ তোমার দিকে আলাদা করে তাকিয়ে থাকত না নিধি। কিন্তু যবে থেকে তুমি ওই শক্তির উপস্থিতি টের পেয়েছ, তার জায়গা যেমন তোমার সচেতন মনেও হয়েছে, তেমনই তোমার অবচেতনও মেনে নিয়েছে ওর অস্তিত্ব। তুমি, তোমার মনটা আমি দেখতে পাচ্ছি বলেই জানি, রমণকে মনে করো পৃথিবীর গোপনতম লীলা, যেটা দু’জন ব্যক্তি ছাড়া জানতে পারবে না কেউই। তাই যখনই ও ঘনিষ্ঠ হতে চাইত, অবচেতন মন বারবার তোমাকে সতর্ক করত কেউ তাকিয়ে আছে তোমার দিকে। তুমিও লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে।”

এতক্ষণ ধরে একনাগাড়ে কথা বলে চললেও হঠাৎ চুপ হয়ে গিয়েছিল নিমু। কিন্তু সবকিছু জেনে ফেলার পর আচমকা পায়ের তলার জমিটুকু হারিয়ে ফেলেছিল নিধি।

এতক্ষণের আনন্দ আর মুগ্ধতা নিমেষে পরিণত হয়েছিল বিষাদে।

তাহলে সেই আহ্বান করে নিয়ে এসেছিল নিজের জীবন ধ্বংস করার মন্ত্র!

কী দরকার ছিল এ’সব নাড়াঘাঁটা করার? সে যদি এতকিছু না জানত, তাহলে তো আর পাঁচটা মেয়ের মতো স্বাভাবিক হতে পারত তার জীবন।

হয়তো এভাবে বদলে যেত না দীপ্তেন্দুও!

“কিন্তু যে মানুষটা রোজ রাতে মদ খায়, নিজের বউয়ের গায়ে হাত তোলে তাকে কি তোমরা, মানে মানুষরা ভালো লোক বলো? তুমি জানো না, কিন্তু আমি ওকে দেখেছি বলেই জানি। বিয়ের আগেও মদ খেত তোমার বর। এমন ভেবো না তোমার জন্যেই বদলে গেছে ও।”

হয়তো নিমু আরও কিছু বলত নিধিকে। কিন্তু সেসব শোনার জন্যে আর অপেক্ষা করেনি নিধি। তার বুকের মধ্যে তখন দলা পাকিয়ে উঠেছে একরাশ কান্না। ব্যালকনি ছেড়ে একছুটে সে চলে এসেছিল বেডরুমে। তখন সবে রাত দুটো। অঘোরে ঘুমাচ্ছে দীপ্তেন্দু। সেই মানুষটাকে না জাগালেও এরপর নোনতা জলের বিন্দু বারবার ভিজিয়ে দিচ্ছিল তার চোখের কোণা। সব যেন কী রকম ঘোলাটে লাগছিল তার। এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় সেই রাতটা ছটফট করে কাটিয়েছিল নিধি।

কিন্তু এরপরেই হঠাৎ বদলে যেতে শুরু করেছিল নিধির মনের গতিপথ।

অনেক দিন পর দীপ্তেন্দু তাকে বেড়াতে নিয়ে যাচ্ছে। নিধি জানে একটা ট্যুর, একসঙ্গে কিছুটা নিভৃতযাপন বদলে দিতে পারে স্বামী আর স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের তিক্ত রসায়নটাকে। কিছুদিন আগে হলেও শান্ত নিধি সেই রকমই কিছু আশা করত। কিন্তু পরদিন সকালে বিছানা ছাড়ার আগেই ট্যুরের কথা বেরিয়ে গিয়েছিল তার মাথা থেকে। সেই জায়গায় একটু একটু করে জ্বলতে শুরু করেছিল প্রতিহিংসার আগুন। বিয়ে করার পর লাঞ্ছনা ছাড়া আর কিছুই তো তার কপালে জোটেনি। একথা ঠিক যে নিধি কখনও দীপ্তেন্দুর সামনে নিজেকে মেলে ধরতে পারেনি। কিন্তু দীপ্তেন্দুও তো কখনও প্রয়োজন বোধ করেনি তাকে একটু বোঝার। তার বদলে মদ খেয়ে গায়ে হাত তোলা, গালাগালি দেওয়া কোনো কিছুই তো বাদ রাখেনি সে। আর এখন তো ওর সঙ্গে ব্যবহার করে বাড়ির ঝিয়ের মতো।

নিধি এতদিন সব সহ্য করে এসেছে, কারণ সে ছিল অসহায়। কিন্তু আজ সেও খোঁজ পেয়েছে এক ভয়ংকর শক্তির। সেই শক্তিকে ব্যবহার করে এটাই তো সময় সুদে আসলে সবকিছু মিটিয়ে নেওয়ার। পরদিন রাতে নিমুর সামনে দাঁড়িয়ে কথাটা পেড়েছিল সে, “অনেক শক্তি তো ধারণ করে রেখেছ তোমরা নিমু। আমাকে একটু ধার দিতে পারবে? আমি প্রতিশোধ চাই। ওই অপদার্থ মাতালটা নরক করে দিয়েছে আমার জীবন।”

কিন্তু নিমু, নিধির প্রিয় বন্ধু, মানা করে দিয়েছিল তাকে, “না নিধি।”

নিমু না মানলেও হাল ছাড়েনি নিধি। এরপর যে ক’দিন নিমুর সামনে দাঁড়িয়েছিল সে, ওই একই প্রশ্ন বারবার করেছে তার বন্ধুকে।

নিমুর উত্তরের হেরফের হয়নি কখনও। রাগ হত নিধির। মনে হত পৃথিবীর সবথেকে বড় বিশ্বাসঘাতক হল নিমু। ইচ্ছা করত চিৎকার করে গালাগালি দিতে। তবুও নিধি সংযত করত নিজেকে। সে জানে, এখন রাজী না হলেও নিমুই পারে একমাত্র তাকে পথ দেখাতে।

বিগত কয়েকদিন এই রুটিনের কোনো পরিবর্তন না হলেও গতকাল রাতে নিমুর সঙ্গে কথা বলা হয়ে ওঠেনি নিধির। আজ ভোর পাঁচটায় বেরনো ছিল। সেইজন্যে গোটা রাত আর ভোরের দিকে মনটা একটু খারাপও ছিল তার। কিন্তু গাড়ি হাইওয়েতে পড়তেই নিধির মন ভালো করে দিয়েছিল চারপাশের সবুজ। শেষ পর্যন্ত হাইওয়ে ছেড়ে গাড়িটা যখন জঙ্গলের রাস্তা ধরল তখন তো আনন্দে নেচে উঠেছিল সে।

দু’দিন এই শাল পলাশের বনে কাটাতে হবে তাকে!

গাড়ি ড্রাইভ করছিল দীপ্তেন্দু নিজে। ড্রাইভার রতনকেও সঙ্গে নিয়ে আসেনি সে। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খানিকটা এগোনোর পর একটা বিশাল বড় পাঁচিল ঘেরা ক্যাম্পাসের সামনে ব্রেক মেরে দাঁড়িয়ে গেল দীপ্তেন্দু। নিধি দেখল জায়গাটার ভিতরে ঢোকার জন্যে রয়েছে একটা বিশাল বড় গেট। কিন্তু সেই গেটটা বন্ধ। আর গেটের মাথার উপর একটা সাইন বোর্ডে বড় বড় করে লেখা আছে, ‘THE JUNGLE VIEW RESORT.’

গেট থেকে একটা মোরাম বিছানো রাস্তা চলে গেছে ভিতরের মেইন বিল্ডিং অবধি। বিল্ডিংটা দোতলা। স্থাপত্যে সাবেকিয়ানার ছাপ। মনে হয় ব্রিটিশ আমলে তৈরি গথিক স্ট্রাকচারের বাড়িকে মডিফাই করে তৈরি হয়েছে বিল্ডিংটা। মোরাম বিছানো রাস্তার দু'পাশে রয়েছে বাগান। ছোট ছোট গোলাপ গাছের সঙ্গে সেখানে রয়েছে অনেকগুলো শাল আর পলাশ গাছও। বাগানটাই ঘিরে রেখেছে রিসোর্টের মেইন বিল্ডিঙটাকে। বাগানে ইতি উতি ছাতা লাগানো। তার তলায় টেবিল আর চেয়ার পাতা থাকলেও কেউ বসে নেই সেগুলোতে। চারপাশে কেবল শোনা যাচ্ছে অনেকরকম পাখির ডাক।

অবশ্য এসব দিকে খুব একটা নজর ছিল না নিধির। বিশাল গাছগুলো দেখে মোহিত হয়ে যাচ্ছিল সে। রিসোর্টে কোথায় রুম বুক করা হয়েছে সে জানে না, তবুও নিধির মনে হচ্ছিল রাত্তিরে দীপ্তেন্দু ঘুমিয়ে পড়লে তাকে যে করেই হোক কথা বলতে হবে এই গাছগুলোর সঙ্গে। এখন বেলা দুটো বাজে। একটু ফ্রেশ হয়ে লাঞ্চ সেরে দিন থাকতেই দেখে নিতে হবে সবকটা গাছ। মনের মধ্যে একে ফেলতে হবে ওদের একটা মানচিত্র। তবেই না সে যোগাযোগ করতে পারবে ওদের সবার সঙ্গে। নিমু বলেনি, কিন্তু এরা যদি বলে, কী ভাবে ওই অসীম শক্তিকে ব্যবহার করে জব্দ করা যাবে দীপ্তেন্দুকে?

নিধি নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে থাকলেও ইতিমধ্যে কাউকে একটা ফোন করেছে দীপ্তেন্দু, “হ্যাঁরে, পৌঁছে গেছি।”

মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে টিশার্ট আর বারমুডা পরিহিত যে ব্যক্তিটি গেট খুলতে এলো তাকে দেখেই চমকে উঠল নিধি।

এতো সেই রেহান, যার সঙ্গে কয়েকদিন আগেই পরিচয় হয়েছে তার।

ততক্ষণে নিধি দেখে ফেলেছে রিসোর্টের ভিতরটাও। জন মানুষের চিহ্ন নেই সেখানে। সেদিন রেহানকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল নিধি। কিন্তু আজ গেটের সামনে ওই মানুষটাকে একলা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হঠাৎ একটা অজানা আশঙ্কায় শিরশির করল উঠল তার বুক।

এই মুহূর্তে কি রেহান ছাড়া এখানে আর কেউ নেই? তাই যদি হয় তো দু’জন পুরুষের সঙ্গে সে একলা একটা মেয়ে…

এতক্ষণের ভালোলাগা কেটে গিয়ে হঠাৎ কেমন ভয় করল নিধির।

কে জানে কী অপেক্ষা করে আছে তার জন্যে!

 

পূর্ণিমার গোল থালার মতো চাঁদটা আকাশে ওঠার পর একটা অপার্থিব আবেশ ঘিরে ধরল নিধিকে। দীপ্তেন্দু রাত্তিরবেলায় তাকে কটেজের বাইরে যেতে মানা করলেও সে কথা শুনল না নিধি। পাশের কটেজে আসর বসিয়েছে দুই বন্ধুতে মিলে। ওদের কথা উপেক্ষা করেই বাইরে বেরিয়ে এলো সে।

THE JUNGLE VIEW RESORT এর মেইন বিল্ডিঙয়ের পিছনে রয়েছে চার চারটে কটেজ। এ’রকমই একটা কটেজে নিধি আর দীপ্তেন্দুর থাকার ব্যবস্থা করেছে রেহান। মাত্র কয়েকদিন আগেই তার এক বাবার বন্ধুর কাছ থেকে সে নাকি কিনে নিয়েছে এই রিসোর্টটাকে। এখন রিনোভেট করে নতুন করে চালু করা কেবল সময়ের অপেক্ষা। তার আগেই প্রিয় বন্ধু আর তার বউকে রেহান নিমন্ত্রণ জানিয়েছে এখানে। শহর থেকে দূরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে নিরিবিলিতে দুটো দিন কাটিয়ে যাওয়ার জন্যে।

দুপুরে লাঞ্চের সময়েই কথাগুলো বলেছিল রেহান। ওদের জন্যে লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছিল মেইন বিল্ডিঙের ডাইনিং হলে। এই মুহূর্তে রিসোর্টের সমস্ত কর্মচারীদের ছুটি দিলেও থেকে গেছে কেবল রামদেও নামের দেহাতী লোকটা। সেই এখন রিসোর্টের কুক কাম কেয়ারটেকার। দুপুরে ওর হাতের তৈরি দেশি মুরগি কষা, মুগের ডাল, ভাত, টমেটোর চাটনি আর পাঁপড় দিয়ে লাঞ্চ সেরেছিল ওরা তিনজন। রামদেওর রান্নার হাত বেশ ভাল। ভরপেট খেয়ে দীপ্তেন্দু দিবানিদ্রায় গেলেও ঘুমোয়নি নিধি। ঘুরে দেখেছিল চারপাশটা। রিসোর্টের সামনেটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হলেও পিছনদিকটা কাঁটা তার দিয়ে মোড়া। তাই বাইরের প্রকৃতি এখানে উন্মুক্ত। রাস্তা থেকে দেখা না গেলেও রিসোর্টের পিছন দিকে জঙ্গল ভেদ করে বয়ে চলেছে একটা নদী। নদীর ওপারটা ঘন সবুজে ঢাকা। আর সেই সবুজ পার করে দূরে দেখা যায় পাহাড়ের রেখা। এই দৃশ্য যেমন কটেজের জানলা থেকে দেখা যায়, তেমনই প্রকৃতির মধ্যে বসে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যকে উপভোগ করার জন্যে রিসোর্টের পিছনদিকে কাঁটা তারের বেড়া ঘেঁষে বানানো হয়েছে কয়েকটা বেঞ্চি। এদের মধ্যে একটা বেঞ্চির গা ঘেঁষে উঠে গেছে বিশাল বড় একটা শাল গাছ। দুপুরবেলাতেই জায়গাটা মনে ধরেছিল নিধির। সন্ধেবেলায় বাইরে এসে সে বসে পড়ল শালগাছটার নিচে।

ডিনার নিয়ে কোনো তাড়া নেই নিধির। রাত্তিরবেলায় রামদেও আফিমের নেশা করে বলে খানিক আগেই নিধির ডিনারটা সে দিয়ে চলে গেছে তার কটেজে। আর পাশের কটেজে দিয়ে গেছে দীপ্তেন্দু আর রেহানের খাবার।

তিনজন নেশাড়ু পুরুষের মাঝে নিধি একমাত্র মেয়ে। এদের সঙ্গে একই সীমানার মধ্যে তাকে কাটাতে হবে তিনটে রাত। চারপাশে আর কোনো মানুষজন নেই। আসার পথে শেষ যে বাড়িটা ওরা দেখেছে সেটাও এখান থেকে কমসে কম আধ-কিলোমিটার দূরে। বিপদে পড়ে চিৎকার করলেও সেই আওয়াজ ওই বাড়ি অবধি পৌঁছনো অসম্ভব। সেই শব্দ তরঙ্গ তার অনেক আগেই হারিয়ে যাবে অরণ্যের গভীরতায়। এ’রকম একটা পরিবেশে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল নিধির পক্ষে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে রিসোর্টে ঢোকার মুখে একবার ভয় পেলেও, সেটা কেটে যেতেও খুব বেশি সময় লাগেনি। চারপাশের শ্যামলিমা যেন সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল তাকে। নিধির মনে হচ্ছিল সে একা নয়, বরং তাকে সঙ্গ দিতে রয়েছে গোটা অরণ্য। সাধারণ মানুষ তার নাগাল না পেলেও এই গাছগুলোই তো নিধির আসল বন্ধু। তার আপনজন।

একাকীত্ব কাটানোর জন্যে শালগাছটাকে ছুঁয়েই বসেছিল নিধি। মাঝে মাঝেই জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে আসছে নানারকম নিশাচর পাখির ডাক। কখনও কখনও নিধির কানে আসছিল দীপ্তেন্দু আর রেহানের হাসির আওয়াজও। তবে সবকিছু ছাপিয়ে ডেকে চলেছে ঝিঁঝিঁর দল। বেশিরভাগ সময়েই এক নাগাড়ে, আবার কখনও বা থেমে থেমে।

রেহান বলেছিল রামদেও রোজ রিসোর্টের চারপাশে কার্বলিক অ্যাসিড ছড়ায়। তাই সাপের ভয় এখানে নেই। নিশ্চিন্ত মনে নিধি তাই যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল শালগাছটার সঙ্গে। সামান্য চেষ্টা করার পরেই সে শুনতে পেল ওই শালগাছটার কণ্ঠস্বর, “সুস্বাগত বন্ধু।”

নিমুর থেকেও ভারি এই শালগাছের কণ্ঠস্বর। নিধি মনে মনে বলে উঠল, “ধন্যবাদ।”

অল্প অল্প নড়ছে শালগাছের পাতাগুলো। জঙ্গলের ভিতর থেকে ভেসে আসছে বসন্তের হাওয়া। আর জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে চারিদিক। নিধি মগ্ন হয়ে পড়েছিল তার নতুন বন্ধুর সঙ্গে ভাব জমানোর জন্যে। পঞ্চাশ বছরের জীবনে প্রথমবার একজন মানুষ পেয়ে শাল গাছটা তাকে শোনাচ্ছিল নিজের কাহিনী। ছোট্ট একটা চারা গাছ থেকে কী ভাবে একটু একটু করে বড় হয়ে উঠল সে। সময়ের সরণী বেয়ে এই দীর্ঘ যাত্রায় কত কিছুই না সে দেখেছে। নিধিকে সে শোনাচ্ছিল এই রিসোর্টের কাহিনী। কিছুদিন আগে অবধিও, মানে শেষ শীতেও জায়গাটা গমগম করেছে টুরিস্টদের ভিড়ে। কিন্তু সেই চিৎকার চেঁচামেচি হৈহল্লা মোটেও ভালো লাগত না গাছটার। এখন বরং সে অনেক ভালো আছে।

কিন্তু সেটাই বা কতদিন, কয়েকদিন পরেই তো আবার মানুষের আগমনে গমগম করতে শুরু করবে চারদিক। ভাবছিল নিধি। হঠাৎ পিঠের উপর একটা গরম নিঃশ্বাস পড়তেই চমকে উঠল সে। পিছনে তাকিয়ে দেখে এসে দাঁড়িয়েছে রেহান। তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেরোচ্ছে অ্যালকোহলের তীব্র গন্ধ। আর দু’চোখে চকচক করছে লোভ। খানিক দূরে একটা পলাশ গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দীপ্তেন্দু। বন্ধুকে বাধা দেওয়ায় কোনো উৎসাহ নেই তার। চাঁদের আলোয় তার হাবভাব দেখে মনে হয়, সে ব্যস্ত মজা দেখতে।

তবে কি বন্ধুর হাতে তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই দীপ্তেন্দু তাকে নিয়ে এসেছে এখানে? একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল নিধির শিরদাঁড়া বেয়ে। এর মধ্যেই রেহান নিধির কানের কাছে মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল, “তোমার বরই তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছে। কিছুদিন আগে আমার উত্তরপাড়ার ফ্ল্যাটে একদিন আসর বসিয়েছিলাম আমরা। সেদিনই আমি ওকে এই প্রস্তাবটা দিই। তোমার বর নির্দ্বিধায় রাজী হয়ে গিয়েছিল। আজ, কাল, পরশু এই তিনটে রাতে তুমি আমার। বাধা দিয়ে কোনো লাভ নেই নিধি। কেউ তোমাকে বাঁচাতে আসবে না। আমার সঙ্গে দীপ্তেন্দুর কোন্নগরের ডিলটা পাকা হয়েছে এই একটা শর্তেই। কাজেই চুপচাপ আমার রুমে চলো।”

দীপ্তেন্দুকে নীচ বলেই ভাবত নিধি। কিন্তু তাই বলে এতটা! ওই লোকটার জন্যে আজ তাকে বলি হতে হবে অন্য এক পুরুষের লালসার! রাগে, ঘেন্নায়, অপমানে যেন মাটিতে মিশে যাচ্ছিল সে। এতবড় একটা শক্তির উৎস রয়েছে তার পাশেই। অথচ নিধি নিজেও জানে না তাকে ব্যবহার করে কী ভাবে রক্ষা পেতে হয় এই দু’জন নরপিশাচের হাত থেকে। অসহায়তা গ্রাস করতে শুরু করেছিল তাকে। ঠিক এই সময়েই হঠাৎ তার মস্তিষ্কের ভিতরে বেজে উঠল শালগাছটার কণ্ঠস্বর, “তোমার বড় বিপদ নিধি!”

টেলিপ্যাথির মাধ্যমে বলা শব্দগুলো পৌঁছায়নি রেহান বা দীপ্তেন্দুর কানে। এদিকে ক্রমশ অধৈর্য হয়ে উঠছে রেহান। তার চোখে মুখে বিরক্তি স্পষ্ট, “কী হল নিধি? তুমি আমার বন্ধুর বউ। মারধোর করতে চাই না। কিন্তু আমাকে বাধ্য করো না। নিজে আমার রুমে যাবে, নাকি টানতে টানতে নিয়ে যাব? আর একান্তই না গেলে এই জঙ্গলের মধ্যে ফেলে…”

রেহানের রাগ দেখে ওদিকে তখন হো হো করে হাসছে দীপ্তেন্দু। এই দিনটার অপেক্ষাতেই তো ছিল সে। বড় গুমোর হারামজাদীর! আজ মাগি ঠিক জব্দ হবে।

রেহানের কথাগুলো নিধির কানে ঢুকলেও তখনও তার মস্তিষ্কের ভিতরে বেজে চলেছে শালগাছের গলার আওয়াজ, “রেহানকে মানা করবে না নিধি। বলো তুমি রাজী। তারপর উঠে দাঁড়াও। জড়িয়ে ধরো আমাকে।”

ভয়ে ততক্ষণে বুদ্ধি লোপ পেয়েছে নিধির। দরদর করে ঘামতে শুরু করেছিল সে। তবুও রেহানের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “হ্যাঁ যাব।”

নিধির কথা শুনে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল রেহানের মুখে। রেহানের সামনেই উঠে দাঁড়াল নিধি। কিন্তু তারপরেই ওকে অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরল শালগাছটাকে। ততক্ষণে মাথায় ফের বাজতে শুরু করেছে শালগাছের কণ্ঠস্বর, “আমার সঙ্গে চিৎকার করে বলো, আমি যা বলছি। জলদি।”

“কী?”

“কেম, চাফু, গিস, জিউ, হিয়াম, হিয়াম, জিউ, গিস, কেম, চাফু, জিউ, হিয়াম, গিস, চাফু, কেম, চাফু, গিস, হিয়াম, কেম, জিউ।”

শব্দগুলো অনুরণিত হতে শুরু করল নিধির মস্তিষ্কে। বাকি দু’জন পুরুষকে অবাক করে এই অদ্ভুত শব্দগুলো একের পর এক উচ্চারণ করে যেতে থাকল নিধি। মুহুর্মুহু তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হয়ে উঠছে তার কণ্ঠস্বর। যেন অন্য কেউ কথা বলে চলেছে তার গলা দিয়ে।

মদের নেশায় তখন এতটাই বুঁদ হয়ে আছে দুই বন্ধু যে নিধির এই অদ্ভুত আচরণে ভয় পেল না ওরা। এর মধ্যেই রেহান দু’হাত দিয়ে টানতে শুরু করেছে নিধির কোমর। এগিয়ে এসে হাত লাগাল দীপ্তেন্দুও। কিন্তু দু’জন পুরুষের মিলিত শক্তি পরাজিত হল একজন নারীর কাছে। এর মধ্যেই হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে কিন্তু এক অদ্ভুত ছন্দে একসঙ্গে কাঁপতে শুরু করল চারপাশে যত গাছ আছে সবার ডালপালাগুলো।

সেই কাঁপুনির তীব্রতা এতটাই যে পাখিগুলো পর্যন্ত জেগে উঠে কিচিরমিচির করতে করতে উড়তে শুরু করল চারপাশে। অথচ সেরকম হাওয়া কিন্তু ছিল না কোথাও। চাঁদের আলোতেই ওরা দুই বন্ধু দেখল হঠাৎ কাঠের মতো শক্ত হয়ে যাচ্ছে নিধির শরীর। সঙ্গে আকারেও বড় হতে শুরু করেছে সে। বাড়তে থাকা সেই শরীরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে না পেরে ছিঁড়ে গেল নিধির কুর্তি আর লেগিংস। কিন্তু সেই ছেঁড়া কাপড়ের ফাঁক দিয়ে যে শরীরটা উঁকি মারল সেটাকে কোনো কোমল নারীদেহ বলা চলে না। বরং বলা চলে নারীর দেহের আকারে তৈরি একটা প্রস্তরখণ্ড। যেন কোনো প্রাগৈতিহাসিক নারীর নগ্ন জীবন্ত ফসিল।

গাছটাকে ছেড়ে ওদের দিকে ফিরে তাকাল নিধি। ওরা দেখল নিধির চোখে মুখে খেলা করছে অপরিসীম ক্রোধ আর ঘৃণা। তার দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত ওদের দিকেই।

দুই বন্ধুর নেশাই হার মানল এবার। নিধিকে দেখে ভয় পেল ওরা। পালাতে গেল, কিন্তু পারল না। পিছন ঘুরতে না ঘুরতেই নিধির ডান হাতের শক্ত কনুই চেপে বসে গেল ওদের গলায়।

ছটফট করে উঠল ওরা দু’জন। কিন্তু নিধির হাতের বজ্র আঁটুনি থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারল না কিছুতেই। ধড় থেকে দুটো মাথা আলাদা হয়ে যাওয়ার পর আরও কয়েক সেকেন্ড ছটফট করে চিরতরে শান্ত হয়ে গেল দীপ্তেন্দু আর রেহানের দেহ।

চারপাশের গাছগুলো তখন তাদের ডালপালা ঝাঁকিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে নিধিকে। তীব্রতর হয়েছে তাদের কম্পন। হঠাৎ তার কানে এলো শালগাছটার কণ্ঠস্বর, “আমাদের পৃথিবীতে স্বাগত নিধি। তুমিই হলে পৃথিবীর প্রথম বৃক্ষমানবী। আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত শক্তির অনেকটাই এখন সক্রিয় হয়ে উঠেছে তোমার মধ্যে। চাইলে তোমার নিমুও পারত এই কাজ করতে। কিন্তু কেন সে করেনি আমার জানা নেই। চাইলে আমিও পারতাম অনেক আগে তোমার মধ্যে এই শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে। কিন্তু প্রথমবার কোনো মানুষকে নিজের কথা বলতে পেরে এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম যে… শেষ পর্যন্ত ওই দু’জন তোমাকে ঘিরে ধরায় বুঝতে পারি আর সময় নেই… যে ঘৃণা আর ভয় মনে নিয়ে তুমি বৃক্ষমানবীতে পরিণত হয়েছিলে, তার হাত থেকে মুক্তি পেতেই দু’জন কাপুরুষকে খুন করেছ তুমি। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়। মানব সমাজে তুমি এবার ব্রাত্য হয়ে যাবে নিধি। সমস্ত উদ্ভিদ কূলের পক্ষ থেকে একটা অনুরোধ আছে তোমার কাছে। মানুষ যে অত্যাচার করেছে আমাদের উপর তার প্রতিশোধ চাই। তুমিই একমাত্র পারবে সেই কাজটা করতে।”

এবার আর মস্তিষ্কে অনুরণন নয়, শালগাছটা সরাসরি কথা বলছে তার সঙ্গে। অবাক হল নিধি। এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল সে। সেই ঘোর কেটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। পাশে পড়ে থাকা দু’জন পুরুষের রক্তমাখা মুণ্ডহীন ধড় আর নিজের শরীরটা দেখে নিধি আঁতকে উঠল।

এদিকে ক্রমশ যেন তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হয়ে উঠছে তার বুদ্ধিমত্তা। এই অবস্থা থেকে আবার মানুষে ফিরে আসার উপায়ও ক্রমশ ভেসে উঠছিল তার চোখের সামনে। সে এখন বুঝতে পারছে ওই আপাত অর্থহীন শব্দগুলোর সঠিক ব্যবহার।

কিন্তু দুটো খুন করার পর নিধি কি সত্যিই আবার মানুষ হয়ে উঠতে চায়? সে জানে মানুষ হয়ে উঠলে এই সমাজ মুক্তি দেবে না তাকে। খুনের দায়ে ফাঁসিকাঠে চড়াবে। তার উপর রেহানকে দেখে মনে হয়, তার পরিবার কেবল বিত্তশালীই নয়, ক্ষমতাশালীও বটে।

মানুষ হিসাবে সে দাঁড়িয়ে আছে খাদের একদম কিনারায়।

প্রথমে একটু ভয় পেলেও ক্রমশ শান্ত হয়ে এলো নিধির মন। কোনো লাভ নেই মানুষ হয়ে উঠে।

তার থেকে বরং…

একটা অদ্ভুত উত্তেজনা শরীরের প্রতিটি শিরায় অনুভব করল নিধি। যাদের এতদিন নিজের আপনজন বলে ভেবে এসেছে, আজ তাদের পৃথিবীতেই প্রবেশ করেছে সে। অনেক লাঞ্ছিত হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে অসীম ক্ষমতার অধিকারিণী।

“ধন্যবাদ।” শালগাছটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল নিধি। এখন তার উচ্চতা গাছটার প্রায় সমান। নিধি জানে উদ্ভিদ কুলের ইচ্ছা অনুযায়ী গোটা মানব সমাজকে উচিত শিক্ষা দিতে খুব বেশি সময় লাগবে না তার। মানুষের তৈরি কোনো অস্ত্রই আর ছুঁতে পারবে না তাকে।

সে এখন সত্যিই স্বাধীন। মুক্তির আনন্দ তাকে গ্রাস করলেও, হঠাৎ কোথা থেকে এক টুকরো দ্বিধা মেঘ হয়ে এসে জমা হল নিধির মনের আকশে। দীপ্তেন্দু আর রেহানের মতো দুটো মনুষ্যরূপী পিশাচকে নিজের হাতে শেষ করলেও, কিছুক্ষণ আগে অবধি সেও তো ছিল একজন মানুষ। সে কি পারবে গোটা মানব সমাজের উপর কোনো নৃশংস প্রতিশোধ নিতে?

নিধির মানসচক্ষে ভেসে উঠল নিমুর চেহারাটা।

কেন নিমু তার হাতে তুলে দেয়নি এই ক্ষমতার উত্তরাধিকার?

তাকে গিয়ে দাঁড়াতেই হবে প্রিয় বন্ধুটার সামনে।

রিসোর্ট ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো নিধি। বিশ্বের দ্রুততম ট্রেনটির থেকেও বেশি দ্রুততার সঙ্গে পা বাড়াল কোন্নগরের দিকে।

বৃক্ষমানবীর সামনে অপেক্ষা করছে এক অজানা ভবিষ্যতের হাতছানি…