দরবারি দাওত ● কর্ণ শীল


 

 

সে এক যুগ ছিল বটে! আমিনুল্লাদাদু দাড়ি নেড়ে নেড়ে দাওতের গল্প বলতো। কানাইয়ের সন্ধ্যাবেলার কাজগুলির মধ্যে প্রধান ছিল আমিনুল্লাদাদুর তামাক সেজে দেওয়া। তারপর সে দেউড়ির বাতিগুলি জ্বেলে, কাশীদাসি নিয়ে বসতো। যে চশমাটি এঁটে নিত চোখে, তার একটিতে আবার কাচ ছিল না। তার নাকি একচোখোমি আছে, মানে এক চোখেই কম দেখে।

অতশত বুঝতাম না। তখন আমিনুল্লা বুড়ো ঝাঁপি খুলেছে বসেছে আর তার ভেতর থেকে ভুরভুর করে জাফরানি পোলাও, গোলাপ পাপড়ি দেওয়া পায়েস আর রামকৃষ্ণ ঘোষের হাঁড়ি - দইয়ের গন্ধ বেরোতে লেগেছে। 

আমি, নিত্য, গৌরীদিদি ইত্যাদি কচিরা গোল হয়ে বসেছি। কেঁচেগন্ডুষের দলও কিছু এসেছেন আসরে, বিশ -পঁচিশ বছর আগের যৌবনকে ঝালিয়ে নিতে। সে দলে ছোটখুড়ি সর্বাগ্রে।

বুড়োর সাদা দাড়ি, সাদা আলখাল্লা আর আলবোলার সাদা ধোঁয়ায়, শাঁখারির হাতের মতো জ্যোৎস্না আলগোছে ঘাপটি মেরে রয়েছে। মনে হচ্ছে যেন তারাই রয়েছে, আমরা নেই বা যাত্রামঞ্চের মরা সৈনিক।

“আমার তখন দশ কি এগারো বছর বয়স।” আমিনুল্লা বললেন, “তিন কোশ দূরে পদ্মপুকুর গ্রামের জমিদার বাড়ির দাওত। দাদা সে বাড়ির বড়তরফের বন্ধু। নিমন্ত্রণ একটি পাওয়া গেল। দু তিনবার আড়চোখে তাকানোর পর দাদা, আম্মিকে বললে, ‘বিটি, এ ইবলিশকে সঙ্গে না নিলে, আমার কপালেও তোর মায়ের কচুসিদ্ধই লেখা আছে বোধ হচ্ছে।’

মা আমাকে লাল শেরওয়ানি, ঘিয়ে রঙের চোস্তা আর কালো ওড়নি দিয়ে সাজিয়ে দিলেন। চোখে সুর্মা, গায়ে কস্তুরিবাস আতর। ...”

বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন আমিনুল্লা। ছোটখুড়ি বলল,

“আব্বাজান, আম্মির কথা ভাবো?”

আমিনুল্লা স্বপ্নোত্থিতের মত ছোটখুড়ির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর প্রাণখোলা অম্বুরি হাসি হেসে বললেন, “দুর্ বিটি, সে তো তুই…!”

তারপর আবার শুরু করলেন, “জমিদারের কেচোয়ান ছপাট ছপাট করে এক্কা ঘোড়াকে চাবকাতে চাবকাতে নিয়ে চললো। বাবলাগাছে ফিঙে দেখলেই মনে পড়ে, ‘মাছল্যাজানি /ক্যানকিজানি’। দাদা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘মিঞা, তোমার চাবুকের কি জান আছে নাকি?  এত তড়পায় কেন?’ সে দেহ কাঁপিয়ে হেসে উঠে বলল, ‘জনাব, চাবুকেই ব্যাটাচ্ছেলে বোঝে আমি আছি। নয়তো বাপ মা হারা’র মতো পদ্মপুকুরের জায়গায় শালুকদহ’তে গিয়ে উঠবে।’

লাল সাদা ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে বাড়ির সামনের উঠোন আর ছাদে। একপাশে সারি সারি উনুন। কোথাও হান্ডি বসেছে বিরিয়ানির। আরেকদিকে হালুইকর চিনির গরম শিরায় ছানার গোলা ছেড়ে দিচ্ছে। বড় বড় কাঠের তেলালো পাটাতনে পাতক্ষীর সন্দেশ, বাতাসাভোগ পাকানো হচ্ছে। পেঁড়ায় গাওয়া ঘিয়ের প্রলেপ দিচ্ছে ভুঁড়িয়াল ময়রার দল। বাতাসে জিন পরীহুরীরা হাতে ল্যাজে পিঠে করে জন্নতের খুশবুঁ বিলি করে বেড়াচ্ছে।

ভেতরমহলে চকমিলানো মেঝেতে খাওয়ার ব্যবস্থা। উর্দি পরা খানসামার দল খাবার পরিবেশন করছে। 

কড়াইশুঁটির গরম গরম কচুরি পড়লো কাঁসার পাতের পাতলা রেকাবিতে। সঙ্গে আলুর কাশ্মীরি দম। পুদিনা চাটনির সঙ্গত। মুখের ভেতর বন্দিশ গেয়ে উঠল গরম খাদ্যমণ্ড। কড়াইশুঁটির রেশমি আস্তরণে এমারেল্ড সিটির গালিচা দেখলাম যেন। বিটি, বিশ্বাস করবি না, সে আমার প্রথম দাওত। তাতেই কুপোকাত। এখনও তার দোসর মিলল না। ওয়াজিদ আলির খাস চামচা নিয়ে এসেছিলেন জমিদারদাদু দর্জিপাড়ার খাসতালুক থেকে শুধুমাত্র বাদশাহী পোলাও রাঁধতে!”

আমি আর নিত্য মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। নিত্য বলল, “দাদু, সে জিনিস আপনি বানাতে পারেন? “

আমিনুল্লা বুড়ো খিঁচিয়ে উঠল। “তোদের দুনিয়ায় কিছু পাওয়া যায় নাকি? আজরাইলের পথ্য রাঁধে হতচ্ছাড়া রাঁধুনির দল। ছোঃ, কোথায় লাগে মিঞাসাহেবের কাছে? কলকাতার ভিয়েনে ভিয়েনে তখন প্রথম হান্ডি বসছে। ফিরনি, বেরেস্তা, খোয়াক্ষীর, আতর, জাফরান, চারমগজের গন্ধ অলিগলি ছেড়ে আলোকিত রাজপথে, প্রাসাদে ছড়িয়ে যাচ্ছে পরীস্তানের খোশবাই হয়ে। সে তোদের কপালে নেই ভাই। তোরা এ যুগের অশ্বত্থামার হয়ে পিটালিগোলায় দুধ ভেবে শান্ত থাক।

তোরা তো ভাই স্কেল, পেনসিল দিয়েও সোজা দাগ টানতে গিয়ে পাঁচমুড়ো পাহাড় এঁকে রাখিস। ইলিশ পাতুড়ির চারকোণা কলাপাতা দেখলে তোদের তাক লেগে যেতো। আড়ে দিঘে সমান! একটা করে ভাঁজ খুলছি আর রাইসর্ষেবাটা, ঘানির খাঁটি সর্ষের তেল আর ফালি করে দেওয়া কাঁচামরিচের গন্ধ এসে নাকে আরবি ফারসির বয়েৎ শুনিয়ে যাচ্ছে। 

তা বাদশাহী পোলাও অবধি বেশ ভালোই চলল। বাসমতী, ছানাভাজার টুকরো, কস্তুরির জলের সুবাস। জিভ যেন উলু দিয়ে উঠছি পৈটিক মঙ্গলেচ্ছায়। 

হঠাৎ দাদার চিৎকারে আমার হাত থেকে রেশমি কাবাবের টুকরোটি পড়ে গেল। শুনলাম, দাদা বলছে,

‘হতচ্ছাড়া! ইবলিশের ছা, পাতের মধ্যে কাটা নারকেল দিয়েছ! চাবকে তোমার পিঠে খড়ম ভাঙবো হতচ্ছাড়া। অ্যাই, দুর্লভ কোথায় রে? ...এদিকে আয়। দ্যাখ্ কান্ড।’

দুর্লভদাদু ধুতির কোঁচা দুলিয়ে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন। তা দাদুকে তো সমীহ করতেই হবে। অমন দরবারি কানাড়ার ওস্তাদ কোথায় পেতেন তিনি আর? তদুপরি বাল্যবন্ধু তো বটেই।

তা তিনিও হাঁকডাক শুরু করে দিলেন। খানসামা চাকরের দল তো ভয়ে কাঁটা। দুই বুড়োকে তো আর ঠান্ডা করাই যায় না। শেষে ভয়ে ভয়ে নায়েবমশাই জমিদারদাদার কাছে এসে জনান্তিকে বললেন, “কর্তা, ওটি যে ডাব চিংড়ি। উপরের কাটা অংশ দিয়ে চিংড়ি বার করে খেতে হয়। “

দুর্লভদাদু তাও চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘অপদার্থের দল, এটুকু বুদ্ধি নেই, যে কোকিলকে ডাব দিতে নাই। ডাব থেকে শুধু পোকাগুলো বার করে দিলে ব্যাটা পাখি ঠিক গিলে নিত।’

কিছুক্ষণ ছুঁচপড়া নিস্তব্ধতা। তারপর বয়ে গেল দমফাটা হাসির ঝড়। 

দুর্লভ দাদুকে একবার চোখ টিপে মুচকি হেসে দাদাও আবার খাওয়া শুরু করে দিল। কি ভয়ানক বুড়ো রে বাবা! 

***

সেদিন একথালা পায়েসের মত চাঁদ উঠেছিল। ফুটবল মাঠের মত বড় ছাদ। তরঙ্গায়িত প্রাচীর ছুঁয়ে আছে দূরের বনের আবছা ছায়াপট।

দাদা’র গান। রাতের অন্তিম প্রহর। নিম্ন মধ্য অষ্টকে আরোহ। অবরোহ তে গান্ধার কোমলের আন্দোলন। 

জগত জননী

আয় আয় আয়…

আলুলায়ী চুলে চুলে

বিশাল আঁখি ভূমে মেলে

আয় আয় আয়..

জগত জননী, আয়…

তখন তো ছোট। কিছুই বুঝিনি। জ্যোৎস্নায় জমাট বেঁধে কুমারী প্রহর কখন যেন সর্বাঙ্গিনী শর্বরী হয়েছে, বোঝেনি কেউ। বাহ্যজ্ঞানহীন দাদা গেয়ে চলেছে। কেঁদে চলেছে। ক্ষয়ে যাচ্ছে কুয়াশার মত। বেঁচে উঠছে ষোলকলার মত। দুমড়ে মুচড়ে,  রক্তাক্ত হয়ে, ভেসে কোন অনিন্দ্যসুন্দরী আদ্যাশক্তি কে ডেকে চলেছে বুঝিনি, আমার বড়  মায়ের কথা মনে পড়ছিল।

আলাপের শেষে কেউ কোনো কথা বলেনি। দাদা মাথা নীচু করে বসে রইলো। দুর্লভ দাদু চোখ তুললে চাঁদে তা টলটল করে উঠল। 

একপাশে পূর্ণ বাঁশিটি শুয়ে রইলো স্বয়ম্ভূনাথের মত। দুর্লভদাদু আমাকে বলল, “বক্র সম্পূর্ণতে এ দাওত সম্পূর্ণ হল।”