ইবাইজা মেশিন ● রুশদী শামস


 

 

ক্রিরি তার হাতে একটি সোনালি রঙের হাতঘড়ি ধরে আছে। এখন দেখতে হবে তাদের পরীক্ষাটা ঠিকঠাক মতো হল কি না। যদি সবকিছু পরিকল্পনামাফিক হয়ে থাকে, তাহলে এই ঘড়িটি এরই মধ্যে ইতিহাসের পাতায় ঢুকে পড়েছে।

ঘড়িটির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে ক্রিরি। সত্যিই কি ঘড়িটি পৃথিবীর সর্বপ্রথম সফলতার সঙ্গে টেলিপোর্ট হওয়া জিনিস?

প্রাথমিক ঘোরটুকু কেটে যায় ক্রিরির। সে তার স্ত্রী শ্রারার দিকে ঘড়িটিকে এগিয়ে দেয়। শ্রারা উল্টে পাল্টে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘড়িটির সবকিছু দেখতে থাকে। ঘণ্টার কাঁটাতে কোয়ার্টজটুকু উঠে গেছে। ভেতরের ভেসে থাকা তারিখটি ঠিকই ফেব্রুয়ারির ঊনত্রিশ। বেল্টের একটা পাশে সামান্য চটা ওঠা, সোনালি রঙটা মলিন হয়ে উঠে গেছে সেখান থেকে। ঘড়িটির পেছনে মডেলের নামের বানানে সামান্য ভুলটাও দিব্যি আছে! নাহ, খালি চোখে দেখলে তাদের পরীক্ষায় কোনো ভুল নেই। শ্রারা ভেতরে ভেতরে দারুণ রোমাঞ্চিত হয়ে পড়ে। টেলিপোর্টেশানের পরীক্ষা করার জন্য তারা ইবাইজা মেশিনের ক্যাপসুল অংশের প্ল্যাটফর্মে অবিকল এরকম একটা ঘড়ি রেখে এসেছিল। সেখান থেকে ঘড়িটির চলে এসেছে তাদের সামনে রাখা টেবিলটার ওপরে। শ্রারা মোটামুটি নিঃসন্দেহ। দুটো ঘড়ি সত্যিই এক।

বিজ্ঞানী দম্পতি শ্রারা আর ক্রিরি সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। লক্ষ্য ছিল একটাই। টেলিপোর্ট করার একটি মেশিন আবিষ্কার করা। ইবাইজা মেশিন তাদের সেই পরিশ্রমের ফসল। আজ প্রথমবারের মতো তারা মেশিনটিকে নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে। মেশিনটির একটি অংশ হল সেটার কন্ট্রোল ডেক। কন্ট্রোল ডেকটি সাদা রঙের অজস্র সুইচ দিয়ে ভরে আছে। এক পাশে আছে বেশ কিছু ডায়ালযুক্ত বড় বড় দুটি পর্যবেক্ষণ মনিটর। কন্ট্রোল ডেকের পেছন থেকে অসংখ্য তার বেরিয়ে এসেছে। তারগুলো গিয়ে যুক্ত হয়েছে গবেষণাগারের এক কোণায় রাখা শক্তিশালী একটা মেইনফ্রেম কম্পিউটারের সঙ্গে।

মেশিনটির আরেকটি অংশ হল একটি ক্যাপসুল। স্বচ্ছ্ব কাঁচের তৈরি। চারকোণা আকৃতির। বাইরে থেকে তাকালে ক্যাপসুলটার ভেতরের পুরোটাই পরিষ্কার দেখা যায়। ক্যাপসুলের ভেতরে একটা নিরীহ দর্শন ঘন আকৃতির ছয় শক্তিমাত্রার চারটি গ্র্যাভিটি ইঞ্জিন রাখা। এই ইঞ্জিনগুলোই হল ইবাইজা মেশিনের মূল অংশ। ইঞ্জিনগুলোর প্রতিটি আলাদা আলাদাভাবে শ্রারা আর ক্রিরির আবিষ্কার করা বহুমাত্রিক ক্ষেত্র সমীকরণগুচ্ছ মেনে চলে। গ্র্যাভিটি ইঞ্জিনগুলোর মূল কাজ একটি কৃত্রিম ওয়ার্মহোল তৈরি করা। তবে এই ওয়ার্মহোলটা অন্য যেকোনো ওয়ার্মহোল থেকে ভিন্ন। ওয়ার্মহোলটি তার ভেতরে সময়ের কোনো পরিবর্তন হতে দেবে না। তবে স্থানকে আগে থেকে নির্দিষ্ট করে রাখা একটি স্থানাঙ্ক বরাবর বাঁকিয়ে ফেলবে। অভিকর্ষের টানে এর ভেতরে কোনো কিছু ঢুকে পড়লে, সেটা চোখের পলকে সেই পূর্বনির্ধারিত স্থানাঙ্কে চলে যাবে।

প্রতিটি গ্র্যাভিটি ইঞ্জিন থেকে মোটা কয়েকটা ফাইবার তন্তু বেরিয়ে এসেছে। ক্যাপসুল থেকে সেগুলো বেরিয়ে এসে মিলেছে কন্ট্রোল ডেকটির সঙ্গে গিয়ে। ইঞ্জিনগুলো বাদে ক্যাপসুলের ভেতরে আরো আছে ছোট আকারের সমতল একটি প্ল্যাটফর্ম। বিজ্ঞানী দম্পতি পরীক্ষার জন্য ঘড়িটিকে এই প্ল্যাটফর্মের ওপরেই রেখে এসেছিল। ক্যাপসুলটির মাথার একদম ওপরের দিকে স্থাপন করা আছে ‘ভি’ আকৃতির দুটো এন্টেনা। এন্টেনা দুটো শক্তিশালী এবং স্থিতিশীল একটি তড়িৎচুম্বক ক্ষেত্র তৈরি করতে সাহায্য করে।

শুধুমাত্র চোখ দিয়ে ঘড়িটাকে দেখে টেলিপোর্টের ব্যাপারটি প্রমাণ করা যাবে না। শ্রারা প্রথমে তার নিজের ঘড়ির কাঁটা সোনালি হাতঘড়িটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে। পরীক্ষাটা শুরু করার আগে এই দুটো ঘড়িকে ন্যানোসেকেন্ড পর্যায়ে এক সঙ্গে মেলানো ছিল।

‘ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ,’ শ্রারা বলে ওঠে।

‘কেন, কী হয়েছে?’

‘ন্যানসেকেন্ড পর্যায়ে আমার ঘড়ি আর এই ঘড়ির সময় এখনো একই,’ শ্রারা ক্রিরিকে উত্তর দেয়। ‘প্ল্যাটফর্ম থেকে ঘড়িটা ওয়ার্মহোলের ভেতরে ঢুকেছে। এরপরে সেটার মধ্যে দিয়ে টেবিলের ওপরে চলে এসেছে। স্থান পরিবর্তন হলেও ঘড়িটার সময় একটা সেকেন্ড সময়ও হেরফের হয়নি।’

ক্রিরির মুখে হাসি ফুটল। তার মানে ওয়ার্মহোলটা স্থানকে বাঁকিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু সময়কে পরিবর্তন হতে দিচ্ছে না। যেমনটা ভাবা হয়েছিল। অবশ্য আরো বড় একটা প্রমাণ বাকি আছে।

‘আরেকটা জিনিস দেখতে হবে,’ ক্রিরি বলল। ‘এমনও হতে পারে যে ঘড়িটা আসলে টেলিপোর্টেড হয়নি। ঘড়িটার একটা কোয়ান্টাম ক্লোন তৈরি হয়েছে। আমাদেরকে প্রমাণ করতে হবে যে ব্যাপারটা আসলে কোয়ান্টাম ক্লোনিং নয়।’

ক্রিরির কথায় সম্মতি জানিয়ে শ্রারা মাথা ঝাঁকালো। ক্রিরির কথাটাকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। কোয়ান্টাম ক্লোনিং তো এখন আর কেবল তাত্ত্বিক কোনো ব্যাপার না। রীতিমতো এর প্রয়োগ শুরু হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা এখন কোয়ান্টাম ক্লোন করে দিব্যি পৃথিবী থেকে মহাকাশ স্টেশনে ছোটখাটো অনেক জিনিস পাঠাচ্ছে। কোয়ান্টাম ক্লোনিং ব্যাপারটাকে অনেকটা অতীতকালে কাগজপত্রের ফ্যাক্স কপি পাঠানোর সঙ্গে তুলনা করা যায়। ফ্যাক্স মেশিনের দুইপাশের কাগজে অবিকল একই জিনিস লেখা থাকত। সে যতই থাকুক, তাতে তো আর কাগজ দুটো এক হয়ে গেল না। কোয়ান্টাম ক্লোনিং এই ধারণাটাকে পরে আরেকধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় । এই পদ্ধতিতে কিছু যন্ত্র তৈরি হল। এই যন্ত্রগুলোতে একপাশ থেকে যদি কিছু ঢোকানো হতো, তাহলে যন্ত্রগুলোতে আগে থেকে ঠিক করে রাখা একটা স্থানাঙ্কে জিনিসটার একটা ক্লোন তৈরি হবে। তবে টেলিপোর্টেশানের সঙ্গে পার্থক্য হল এই যে টেলিপোর্টেশানে একপাশ থেকে পাঠানো জিনিসটাই অন্যপাশে চলে যাবে, সেটার কোনো ক্লোন নয়।

‘তাহলে আমাদেরকে দেখতে হবে যে প্ল্যাটফর্মের ঘড়িটি ওয়ার্মহোলে ঢুকে পড়ার আগের মুহূর্তে কোনো ধরণের কোয়ান্টাম জট তৈরি হয়েছে কি না,’ বলল শ্রারা।

‘ঠিক,’ সায় দিয়ে বলল ক্রিরি। ‘ওই সময়টাতে কোয়ান্টাম জট তৈরি হয়ে যাওয়া মানেই সব শেষ! পুরো ব্যাপারটাকে তখন টেলিপোর্টেশানের মতো মনে হলেও কোয়ান্টাম জটের উপস্থিতির কারণে সেটা হয়ে যাবে কোয়ান্টাম ক্লোনিং।’

শ্রারা ব্যাপারটা নিরীক্ষার জন্য কন্ট্রোল ডেকের একটি পর্যবেক্ষণ মনিটরের সামনে গিয়ে বসলো। মনিটরের পর্দায় অসংখ্য তথ্য ঝুলে আছে। সে গভীর মনোযোগের সঙ্গে সেগুলোকে যাচাই করতে থাকে।

‘প্ল্যাটফর্মের ঘড়ির প্রতিটা ফোটনের কোয়ান্টাম তরঙ্গদৈর্ঘ্য আর টেবিলের ওপরের এই ঘড়ির প্রতিটা ফোটনের কোয়ান্টাম তরঙ্গদৈর্ঘ্য সম্পূর্ণ এক,’ দীর্ঘ বিরতির পর শ্রারা জানাল।

ক্রিরি ঘাবড়ে যায়। শ্রারা যেটা বলছে সেটা কোয়ান্টাম জট হওয়ার একটি পূর্বলক্ষণ। ক্রিরি হঠাৎ লক্ষ্য করে যে তার নিশ্বাসের গতি হঠাৎ অনেক বেড়ে গেছে। একধরণের তীব্র অস্থিরতা নিয়ে সে ঘরটাতে পায়চারি করতে থাকে।

শ্রারা ভুরু কুঁচকে আবার দীর্ঘক্ষণ মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা সময় পর শ্রারার চোখ মুখ প্রশান্তিতে ভরে যায়। তার মুখে হাসি ফুটে উঠতে থাকে। সে বলল, ‘তবে—’

ক্রিরি ততক্ষণে তার পায়চারি থামিয়ে দিয়েছে। ‘তবে?’ ক্রিরি জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে শ্রারার দিকে তাকিয়ে থাকে।

ক্রিরির অস্থিরতা দেখে শ্রারা হেসে ফেলে। সে ক্রিরিকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘তবে এখানে কোনো ধরণের কোয়ান্টাম জট তৈরি হয়নি।’

‘সব তথ্য ঠিক মতো দেখেছ?’

‘দেখেছি, ক্রিরি।’

শ্রারার কথা শুনে ক্রিরির বুক থেকে যেন বিশাল একটা পাথর নেমে যায়। সে স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলে। তার মানে প্ল্যাটফর্ম থেকে টেবিলের ওপরে হাতঘড়ির চলে আসাটা কোয়ান্টাম ক্লোনিং এর কোনো ঘটনা নয়। সেটা সত্যিই টেলিপোর্টেশান! ক্রিরি হলোগ্রাফিক ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘দারুণ! এসো, বিজ্ঞান কাউন্সিলকে ফোন করি। এখনই! সবাইকে আমাদের আবিষ্কারটার কথা জানাতে হবে।’

শ্রারা দুই হাত তুলে ক্রিরিকে বাধা দিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও! এত ব্যস্ততা কীসের? আগে আরো কিছু পরীক্ষা করে দেখি। দুজনে মিলে খুঁটিনাটি সবকিছু বার বার চেক করে দেখি, তারপরে দেখা যাবে।’

স্ত্রীর কথার সঙ্গে একমত হয়ে ক্রিরি ফোনটা আবার রেখে দেয়। ‘বলো, কী পরীক্ষা?’ জিজ্ঞেস করল ক্রিরি।

‘তুমি কিন্তু বিজ্ঞানী ইবাইজার অনিশ্চয়তার ব্যাপারটা ভুলো না,’ ক্রিরিকে সাবধান করে বলল শ্রারা।

ক্রিরি কেমন যেন একটু দমে যায়। ব্যাপারটা এতক্ষণে আসলে তার মাথায় আসেনি। কৃত্রিমভাবে তৈরি তিন শক্তিমাত্রার বেশি কোনো ওয়ার্মহোলের ব্যাপারে বিজ্ঞানী ইবাইজা সবসময়ই খুঁতখুঁতে ছিলেন।

‘তা অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছ,’ ক্রিরি চিন্তিত মুখে বলল। ‘আমাদের ওয়ার্মহোলটা তো আসলে ইবাইজা সীমার দ্বিগুণ বেশি শক্তিশালী।’

‘সঙ্গে কিন্তু আরো বেশ কিছু জিনিস এসে যোগ হয়েছে,’ শ্রারা বলল।

‘কোনটার কথা বলছ?’

‘ভুলে যেও না যে আমাদের বানানো ওয়ার্মহোলটা বিশেষ কিছু। সাধারণ ওয়ার্মহোলের অভিকর্ষ সবসময় সময় আর স্থান দুইই বাঁকিয়ে ফেলে। আমরা কিন্তু কৃত্রিমভাবে শুধুমাত্র স্থানকে পরিবর্তন হতে দিচ্ছি। সেক্ষেত্রে ইবাইজার দেয়া আপেলের উদাহরণটা সত্য হয়ে যেতে পারে!’

শ্রারা কী বোঝাতে চাইছে সেটা ক্রিরি বুঝতে পেরেছে। বিজ্ঞানী ইবাইজা এইধরনের ওয়ার্মহোলের ক্ষেত্রে কিছুটা অনিশ্চিত ছিলেন। তিনি আপেলের একটা উদাহরণ দিয়ে তার উপপাদ্যে এব্যাপারে কিছুটা আভাস দিয়েছিলেন। এরকম বিশেষ ওয়ার্মহোলের একপাশ দিয়ে যদি একটা আপেল ফেলা হয়, তাহলে অন্যপাশ দিয়ে ঠিকই চোখের পলকে আপেলটা বের হবে। কিন্তু ওয়ার্মহোলের ভেতরে ঠিক কত সময় আপেলটা থাকবে তা নিয়েই তার অনিশ্চয়তা। বিজ্ঞানী ইবাইজার মতে সময়টা অস্বাভাবিক রকমের লম্বা হতে পারে।

‘আপেলটা সেখানে যত সময় ধরেই থাকুক না কেন, আমাদের ক্ষেত্র সমীকরণ মেনে ওয়ার্মহোল বানানোর জন্য পচা আপেল তো আর বেরোবে না,’ টিপ্পনী কেটে বলল ক্রিরি।

‘তা বেরোবে না,’ মাথা ঝাঁকালো শ্রারা। ‘আপেলটা হয়ত একেবারে হারিয়েও যাবে না। পদার্থবিজ্ঞান প্রকৃতির বিরুদ্ধে কাজ করে না। তবে—’

‘তবে কী?’

শ্রারা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ক্রিরিকে কিছু বলতে গিয়েও সে থেমে যায়। ইবাইজা মেশিন নিয়ে ক্রিরি অনেক বেশি আশাবাদী। তার থেকেও অনেক বেশি আশাবাদী।

‘কিছু না,’ মাথা নেড়ে বলল শ্রারা।

‘তুমি মনে করছ ওয়ার্মহোলের মাঝের রাস্তাটাতে কিছু ঘটবে? কী ঘটবে?’

‘অনেক কিছুই ঘটতে পারে। আমি জানি না, ক্রিরি,’ মাথা নেড়ে বলল শ্রারা। ‘কেউই জানে না। আমি শুধু জানি আমাদের ক্ষেত্র সমীকরণগুলো বিজ্ঞানী ইবাইজার ধারণাগুলোর ওপরে ভিত্তি করে সমাধান করা। সেক্ষেত্রে তার অনিশ্চয়তার সূত্রকে একেবারে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি না।’

‘ঠিক আছে,’ ক্রিরি বলল। ‘এসো, আমরা তাহলে বরং আরো বেশ কিছু জিনিস টেলিপোর্ট করে দেখি।’

এরপরে তারা দুজনে টুকটাক আরো বেশ কিছু জড় পদার্থ টেলিপোর্ট করে দেখল। প্রতিবারই সবকিছু নিখুঁতভাবে ক্যাপসুলের ভেতরের প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরের টেবিলটিতে চলে যেতে থাকে। ইবাইজার অনিশ্চয়তার কারণে জিনিসগুলো যদি ওয়ার্মহোলে অনেক লম্বা সময় থেকেও থাকে, সেটা জিনিসগুলোর ওপরে কোনো প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হচ্ছে না।

মনিটরের সামনে বসে শ্রারা বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সব কিছু পরীক্ষা করতে থাকে কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে কী না।

‘তুমি এখনো মনে করছো যে জিনিসগুলো ওয়ার্মহোল দিয়ে অন্য কোনো জগতে চলে যাচ্ছে?’ ক্রিরি জিজ্ঞেস করল।

ক্রিরির কথাতে শ্রারা রেগে গেল। ক্রিরি পুরো ব্যাপারটাকে এত তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে কেন? শ্রারার গাল দুটো গরম হয়ে লাল হয়ে গেল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু সে কথা একবারও বলিনি। আর ব্যাপারটা ঘটছে না বলে যে ব্যাপারটা ঘটবে না তার নিশ্চয়তা তুমি দিতে পারবে?’

‘নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারবে না,’ শ্রাগ করে বলল ক্রিরি। ‘প্রায় এক ডজন জিনিস দিয়ে আমরা পরীক্ষা করলাম। ওয়ার্মহোলের মাঝের পথটার ব্যাপারে আমরা আর কতগুলো পরীক্ষা করলে নিশ্চিত হতে পারব?’

শ্রারা কোনো কথা বলে না। তার কাছে দেবার মতো কোনো যুক্তি নেই।

‘আচ্ছা,’ ক্রিরি বলল। ‘এবার জীবকোষ নিয়ে একটা পরীক্ষা করলে কেমন হয়?’ তার চোখে মুখে স্পষ্ট আগ্রহের ছাপ।

‘বলো তুমি, কী টেলিপোর্ট করবে?’

‘চলো আমাদের মধ্যে থেকে কাউকে টেলিপোর্ট করে দেখি।’

শ্রারা প্রথমে ভাবল ক্রিরি মনে হয় তার সঙ্গে ঠাট্টা করছে। কিন্তু ক্রিরির মুখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল যে তার জীবনসঙ্গী সত্যি সত্যি এখন মানুষ টেলিপোর্ট করার পরীক্ষাটি করে দেখতে আগ্রহী। শ্রারা জিজ্ঞেস করল, ‘এখন?’

‘কেন নয়?’

‘আমার মতে মানুষ টেলিপোর্টের পরীক্ষাটা একটু বেশিই তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে,’ উদ্বিগ্ন গলায় শ্রারা বলল।

স্ত্রীকে চিন্তিত হতে দেখে ক্রিরি হেসে ফেলে। সে বলল, ‘আচ্ছা, ইবাইজা মেশিন কাদের আবিষ্কার?’

‘আমাদের।’

‘তাহলে? তুমি নিজেই যদি নিজের আবিষ্কারের ওপরে ভরসা করতে না পারো, বিজ্ঞান কাউন্সিল কীভাবে ভরসা করবে?’

শ্রারা ইতস্তত করে বলল, ‘না না, ব্যাপারটা আসলে ঠিক তা নয়।’

ক্রিরি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শ্রারা দিকে তাকিয়ে থাকে।

শ্রারা বলতে থাকে, ‘আসলে মানুষের দেহ জটিল একটা জীবকোষ। ইবাইজা মেশিন সেটার ওপরে কীভাবে কাজ করবে আমরা তো সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি, তাই না?’

ক্রিরি এগিয়ে এসে শ্রারার হাত দুটো ধরলো। ‘ঠিক আছে। প্রথমে তাহলে আমরা ছোট একটা জীবকোষ টেলিপোর্ট করার চেষ্টা করে দেখলে কেমন হয়?’

কথাটা শেষ করেই ক্রিরি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

‘কী হল?’ শ্রারা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে ক্রিরি বলল, ‘এক মিনিট দাঁড়াও। আসছি।’

ক্রিরি এক দৌড়ে পাশের ঘরে গেল। সেখানে একটা লোহার খাঁচার ভেতরে সাদা রঙের একটা গিনিপিগ। হুইলের ওপরে দৌড়ানো শেষে এখন গমের দানার ওপরে বসে সেটা হাঁপাচ্ছে। ক্রিরি শান্তহাতে খাঁচা থেকে গিনিপিগটাকে বের করে আনলো। এরপর হাঁপাতে হাঁপাতে তাদের গবেষণাগারটাতে ফিরে এল।

‘চলো,’ শ্রারাকে হাত দিয়ে টেনে তুলে ক্রিরি বলল। ‘আমাদের পোষা গিনিপিগটাকে প্রথমে টেলিপোর্ট করার চেষ্টা করে দেখি।’

‘শেষমেষ ওকে দিয়েই পরীক্ষাটা করতে হবে তোমার?’ ক্রিরির কাণ্ড দেখে শ্রারা যেন প্রমাদ গুনলো।

শ্রারা যে কেন এমন করছ সেটা কিছুতেই ক্রিরি বুঝতে পারে না। ক্রিরি অনুযোগের সুরে বলল, ‘আবার কী হল?’

অবশ্য শ্রারা নিজেও ব্যাপারটা ধরতে পারছে না। তার মনে এক ধরণের অজানা আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু কেন দিচ্ছে সে জানে না। কম্পিউটারের তথ্য অনুযায়ী সব কিছু একদম এত নিখুঁত! হয়ত সেই ব্যাপারটাই তাকে ভাবিয়ে তুলছে। অবচেতন মনে সে ইবাইজা মেশিনকে নিয়ে এক ধরণের সন্দেহ করতে থাকে।

শ্রারা আমতা আমতা করে বলল, ‘না মানে, গিনিপিগটার ওপরে আমার অনেক মায়া জন্মে গেছে। এতটা দিন ধরে ও আমাদের সঙ্গে আছে—’

জোরে শব্দ করে হেসে ওঠে ক্রিরি। সে বলল, ‘জীবকোষ দিয়ে প্রাথমিক একটা পরীক্ষা করার মতো আমাদের হাতে তো আর কিছু নেই, শ্রারা।’

শ্রারা কোনো পাল্টা যুক্তি খুঁজে পাচ্ছে না। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে ক্রিরিকে তাদের গিনিপিগটিকে নিয়ে পরীক্ষা করার জন্য মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেয়।

শ্রারা গিনিপিগটার মাথায় আলতভাবে হাত বুলিয়ে ক্যাপসুলের দরজা খুলে ভেতরের প্ল্যাটফর্মে রাখলো। ক্রিরি ক্যাপসুলের দরজাটা বন্ধ করে একটা ছোট লিভার টেনে দেয়। এরপর, একটা ডায়াল ঘুরিয়ে দিতেই ক্যাপসুলটা থেকে এক ধরণের মৃদু গুঞ্জন হতে থাকে। কিছু সময় যাবার পরে গুঞ্জনটি হঠাৎ বেড়ে গিয়ে ক্যাপসুলটি থেমে থেমে কাঁপতে থাকে। কাঁপুনির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে চারপাশে হতে থাকা শব্দের পরিমাণ। ক্যাপসুলের ওপরের দিকে লাগানো এন্টেনা দুটো থেকে মিনিট দুয়েক পরে নীল রঙের একটি তড়িৎ স্ফুলিঙ্গ বের হতে থাকে। বেশ খানিকক্ষণ ধরে ক্যাপসুলটি ভয়ঙ্করভাবে কেঁপে বন্ধ হয়ে গিয়ে ‘হিস হিস’ করে এক ধরণের শব্দ করতে থাকে। সব শেষে গোটা ঘর সাদা রঙের একটি ধোঁয়াতে ঢেকে যায়।

বিজ্ঞানী দম্পতি অবাক হয়ে দেখল যে তাদের আদরের পোষা গিনিপিগটি এখন বাইরের টেবিলটার ওপরে বসে আছে।

নিজেদের সৃষ্টির কার্যকারিতায় আনন্দে আত্মহারা হয়ে ক্রিরি শ্রারাকে জড়িয়ে ধরে। ক্রিরি হাসিমুখে বলল, ‘বলেছিলাম না সব কিছু ঠিক থাকবে?’

শ্রারা কিছু বলল না। সে তার মুখটিকে গম্ভীর করে রাখে। শ্রারা খুব ভাল করেই জানে যে ক্রিরি এর পরে কী করতে চাইবে। ক্রিরি তার আশঙ্কাটাকে সত্যি করে দিয়ে বলল, ‘তুমি আমাকে আর বাধা দিও না, আমাকে পরীক্ষাটা করেই দেখতে হবে।’

শ্রারা কিছু না বলে মাথা নিচু করে থাকে।

ক্রিরি বলতে থাকে, ‘আমি এবারে নিজেকে টেলিপোর্ট করে দেখতে চাই। আমি নিশ্চিত ইবাইজা মেশিন একটা গিনিপিগকে টেলিপোর্ট করতে পারলে একজন মানুষকেও টেলিপোর্ট করতে পারবে।’

মানুষকে সফলভাবে টেলিপোর্ট করার উদ্দেশ্যেই তাদের এই আবিষ্কার। কিন্তু তাই বলে নিজেদের কাউকে দিয়ে এই পরীক্ষাটা করে দেখতে হবে? ব্যাপারটি শ্রারার মোটেই ভাল লাগছে না। ক্রিরি নিজেই ছয় শক্তিমাত্রার একটি ওয়ার্মহোলে সশরীরে ঢুকে পড়ুক, শ্রারা সেটা মানতে পারছে না। জিনিস জগতের স্বাভাবিক অনেক নিয়ম তিন শক্তিমাত্রার ওয়ার্মহোলেই ঠিকমতো কাজ করতে চায় না। ব্যাপারটা বিপদজনক হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে শ্রারাকে ভাবাচ্ছে বিজ্ঞানী ইবাইজার অনিশ্চয়তার সূত্র। শ্রারা কিছু না বলে চুপ করে থাকে।

ক্রিরি শ্রারার কাঁধে তাঁর হাত রেখে বলল, ‘আচ্ছা, কাউকে না কাউকে দিয়ে তো এটা একদিন আমাদের পরীক্ষা করে দেখতেই হতো, তাই না?’

শ্রারা ক্রিরিকে অনুরোধ করে বলল, ‘আজকে না হয় থাকুক? আমরা পরে একটা সময় না হয় অন্য কাউকে দিয়ে পরীক্ষাটা করে দেখি?’

‘কে তোমার জন্য এই পরীক্ষাতে অংশ নিতে যাবে?’

শ্রারা ভেবে বলল, ‘ভবঘুরে কাউকে দিয়ে পরীক্ষাটা করালে? শুনেছি যে ভাল টাকা-পয়সা দিলে এরকম পরীক্ষা করার জন্য নাকি অনেক ভবঘুরে পাওয়া যায়।’

ক্রিরি নিজেও জানে যে ওয়ার্মহোলে ঢুকে পড়াটা তার জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু তার বিজ্ঞানী মন পরীক্ষাটি করে দেখার জন্য ছটফট করতে থাকে। সে ওয়ার্মহোলের ভেতরের জগতটাকে নিজের চোখে দেখতে চায়। সে শ্রারাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমাদের ক্ষেত্র সমীকরণে কোনো ভুল থাকলে এতক্ষণে সেটা ধরা পড়ত। তুমি দেখবে, আমি চোখের পলকে টেবিলটার আশে পাশে টেলিপোর্ট হয়ে চলে যাব।’

শ্রারা তার স্বামীর এই নাছোড়বান্দা স্বভাবটির সঙ্গে খুব ভালভাবেই পরিচিত। ক্রিরি যখন একবার মনস্থির করে ফেলেছে, তখন সে নিজেকে টেলিপোর্ট করার পরীক্ষাটি করেই তবে ছাড়বে। অনিচ্ছাস্বত্তেও শ্রারা রাজি হয়ে যায়। সে ক্রিরির উষ্ণ হাতটি কিছুক্ষণের জন্য নিজের হাতের ভেতরে নিয়ে ধরে রাখে। এরপরে সে কন্ট্রোল ডেকের পর্যবেক্ষণ মনিটরে তথ্যগুলো শেষবারের মতো যাচাই করে দেখে।

ক্রিরি মেইনফ্রেম কম্পিউটারে বুট সিকোয়েন্স লোড করে দিলো। তারপর শ্রারার গালে আলতো করে চুমু দিয়ে সে ক্যাপসুলটার দরজা খুলে ফেলল। ভেতরে ভেতরে সে টান টান উত্তেজনা অনুভব করতে থাকে। ওয়ার্মহোলের ভেতরে সে কী দেখবে! নিজেকে কোনোভাবে শান্ত করে সে ক্যাপসুলের ভেতরে ঢুকলো। ধীর পায়ে গিয়ে প্ল্যাটফর্মের উপরে দাঁড়াল।

নিয়মমতো ক্যাপসুলের দরজা বন্ধ করে দেয় শ্রারা। এরপরে ছোট লিভারটি টেনে ইবাইজা মেশিনের ডায়ালটি ঘুরিয়ে দেয়। ক্যাপসুলটি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মৃদু গুঞ্জন তুলে কাঁপতে থাকে। কিছুক্ষণের ভেতরে সেই শব্দটা যথেষ্ট পরিমাণে বেড়ে যায়। ওপরের এন্টেনা দুটো থেকে নীল রঙের স্ফুলিঙ্গ বের হবার পরে ক্যাপসুলটা আরো দ্রুত গতিতে কিছু সময় কেঁপে থেমে যায়।

ইবাইজা মেশিন থেকে কিছুক্ষণ ‘হিস হিস’ করে একটা শব্দ হবার পরে গোটা ঘর সাদা রঙের একটা ধোঁয়াতে ঢেকে যায়।

 

লাল রঙের তাজা রক্তে গোটা ঘরটি ভেসে যেতে থাকে। ক্যাপসুলের বাইরে টেবিলের পাশে পড়ে আছে ক্রিরির গলে যেতে থাকা মৃতদেহের অংশ বিশেষ। বলতে গেলে ক্রিরির শরীরের বাম পাশটা একেবারেই নেই। কেউ যেন অনেক যত্ন করে দীর্ঘ সময় নিয়ে কুরে কুরে ওপাশটাকে খেয়ে ফেলেছে। যেটুকু অবশেষ আছে, সেটুকুতে চটচটে আঠালো জেলির মতো কিছু একটা লাগানো। ক্রিরির শরীরের ভেতরের অংশগুলো ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকে তার নিথর দেহটি থেকে। ক্রিরিকে বলতে না পারা আশঙ্কাটার কথা মনে পড়ে গেল শ্রারার। ওয়ার্মহোলের ভেতরের জগতে অন্য কেউ কামড় বসিয়ে যদি আপেলটাকে ফিরিয়ে দেয়?

দৃশ্যটি যেমন বীভৎস, তেমনি ভয়ঙ্কর। এমন একটি দৃশ্য দেখার পরে নিজেকে আর সামলাতে পারে না শ্রারা। সে নিজের অজান্তে মুখ দিয়ে গোঙ্গানির মতো একটা আওয়াজ করতে থাকে। আতঙ্কে তার পেটে মোচড় দিয়ে উঠতে থাকে। একটা সময় সে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে মাথা নিচু করে বমি করতে থাকে। সামনে পড়ে থাকা ক্রিরির অর্ধগলিত মৃতদেহটির দিকে তাকিয়ে শ্রারা তার দুই হাত কানে চেপে ধরে। অমানুষিক আতঙ্কে একটা চিৎকার করে ওঠে সে।

***

অলস ভঙ্গিতে নিজেকে টানতে টানতে থলথলে কদাকার প্রাণীটি তার ফেলে যাওয়া মড়িটার কাছে ফিরে এসে অবাক হয়ে যায়। সেখানে তার ফেলে যাওয়া শিকারের বাকি অংশটা আর নেই!

রাগে-ক্ষোভে-দুঃখে প্রাণীটির চোখে একেবারে পানি এসে যায়। কত অপেক্ষার পরেই না সে শিকারটাকে ধরেছিল! কত শত বছর ধরে সে অন্ধকার সুড়ঙ্গটার পাশের ঝোপে খাবারের লোভে ওঁত পেতে বসে ছিল! সুড়ঙ্গটা দিয়ে একের পর এক জিনিস আসছিল। ভেবেছিল খাবার। কিন্তু প্রাণীটি দেখল তার সবগুলোই খাবার অযোগ্য। একটা সময় হতাশ হয়ে গিয়েছিল সে।

ঠিক সেই মুহূর্তে ঈশ্বর যেন তার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। সুড়ঙ্গটা দিয়ে বের হয়ে এলো একটা দুই পায়ের প্রাণী। ঘ্রাণ শক্তি থলথলে প্রাণীটিকে কোনোদিনও হতাশ করেনি। এবারও করার কোনো প্রশ্ন নেই। দুই পায়ের প্রাণীটি যে খেতে দারুণ সুস্বাদু হবে তা সে দূর থেকে গন্ধ শুঁকেই বেশ বুঝতে পেরেছিল। আর প্রাণীটা আকারেও বেশ বড় ছিল। ওটাকে শিকার করতে পারলে অনেক দিন আর তাকে খাবার নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হতো না।

অন্যান্য সময়ের মতোই সে খুব সাবধানে একটা লাফ দেয়। দুই পায়ের প্রাণীটার মাথার ওপরে চেপে বসে। এরপর সেখানে বসেই তার নিজের গা থেকে চটচটে আঠালো জেলিটাকে ছেড়ে দেয়। চটচটে এই জেলিটা দারুণ কাজের— এটার প্রভাবে তার শিকার যেমন চোখের পলকে মারা পড়ে আবার সেটার পচনটাও অনেক ধীরে হয়ে যায়। সে তখন তার শিকারটাকে রসিয়ে রসিয়ে, একটু একটু করে খেতে পারে।

কিন্তু, বিপত্তিটা বাধলো এর পরেই! বছর দশেক ধরে দুই পায়ের প্রাণীটার মাত্র অর্ধেকটা খেয়ে সে একটু বিশ্রাম নিতে গিয়েছিল। বিশ্রাম থেকে এখন ফিরে এসে দেখে যে বাকি অংশটা উধাও হয়ে গেছে!

আশেপাশে সতর্ক চোখ বুলিয়ে ফেলে থলথলে প্রাণীটি। কোনো ধাঙ্গড় না তো? ভাবল প্রাণীটি। হয়ত তার অনুপস্থিতিতে সুযোগ বুঝে মড়িতে এসে খাবারটা নিয়ে গেছে! কিন্তু দূর-দূরান্ত পর্যন্ত একটা ধাঙ্গড়ও চোখে পড়ল না তার।

মেজাজ খারাপ করে সে আবার নিজেকে টেনে নিয়ে চলে যায় অন্ধকার সুড়ঙ্গটার কাছে। ওখানের একটা ঝোপের আড়ালে সে শিকারের আশায় আবার লুকিয়ে পড়ে।

তপ্ত দুপুরে দুই বছর অপেক্ষা করতে করতে হালকা বুজে আসে থলথলে কদাকার প্রাণীটির প্রায় শ’ খানেক চোখ।

 

সি-৬ শ্রেণীর ওয়ার্মহোল, যার ব্যবহার স্বাভাবিক পদার্থবিজ্ঞানের ব্যাখ্যাতীত (কাল্পনিক)।

কৃত্রিম অভিকর্ষ তৈরি করার যন্ত্র (কাল্পনিক)।

দুইটি ভিন্ন স্থানকালের ক্ষুদ্র সুড়ঙ্গপথ বা “শর্টকাট”, ওয়ার্মহোল স্থান এবং সময় উভয়কেই বাঁকিয়ে ফেলতে সক্ষম (তাত্ত্বিক)।

যে প্রক্রিয়ায় কণার কোয়ান্টাম অবস্থার কোনো পরিবর্তন না করে অবিকল একটি নকল তৈরি করা হয়।

যে তত্ত্বের সাহায্যে একটি স্থানের কণার অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে আরেকটি স্থানের কণার অবস্থার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা হয়। এটি কোয়ান্টাম টেলিপোর্টেশনের মূল তত্ত্ব হিসাবে বিবেচিত।