ডাইরি অভ অ্যান অ্যাসকান: আ মার্ক ওয়াটনি শর্ট স্টোরি ● অ্যান্ডি উইয়্যার ● অনুবাদ: তানজিরুল ইসলাম

 


 

১৩ই নভেম্বর

 

হা ঈশ্বর! সত্যিই? হা ঈশ্বর!

হা...

ঈশ্বর...

অসম্ভব... আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার নামটা বোর্ডে এসেছে। হাজার হাজার আবেদনকারী মহাকাশচারীর মধ্য থেকে ওরা আমাকেও বাছাই করেছে। অগুনতি শারীরিক ও মানসিক পরীক্ষা করেছিল ওরা। সীমাহীন সব প্রি-ট্রেইনিং কোর্সও ছিল।

কিন্তু এত কিছুর পরও ওরা আমাকে বাছাই করেছে!

তাহলে আমি এবার একরকম বাঁধা পড়ে গেলাম। চুক্তিটা চূড়ান্ত। আমি এখন এরিস-থ্রি এর মূল ক্রুদের একজন।

আমি মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছি।

হা ঈশ্বর! আমি মঙ্গল গ্রহে যাচ্ছি!

তালিকার অন্য নামগুলো চিনতে পারছি না, যদিও আমি অনেক অ্যাসকানকে চিনি। আমরা একসাথে ঘুরে ফিরে এই নির্বাচন প্রক্রিয়াটা নিয়ে কত হা-হুতাশ করেছি। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ নেই। হাজার হাজার প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ছয়জনকে বাছাই করা হয়েছে। এদের কারো সঙ্গেই আমার আগে দেখা হয়নি।

ওদের তালিকা অনুযায়ী অন্যান্যদের নাম লুইস, মার্টিনেজ, জোহানসেন, ভোগেল আর বেক। স্বাভাবিকভাবেই আরেকটা নাম আছে ওখানে: ওয়াটনি! তালিকায় এভাবেই আমার নামটা লেখা। আমি মঙ্গলে যাচ্ছি!

এ মিশনে আমার দায়িত্ব মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারের। তার মানে যাত্রাকালে আমাকে বিভিন্ন খারাপ জিনিসপাতি সারাতে হবে। আর বৈজ্ঞানিক হিসেবে আমাকে দেওয়া হয়েছে বোটানিস্টের দায়িত্ব। মঙ্গলের মাটিতে আমাকে উদ্ভিদ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চালাতে হবে।

মঙ্গল, চিন্তা করো না। অচিরেই তোমার বুকে সবুজ গাছ জন্ম নিচ্ছে! এটা আমি আক্ষরিক অর্থেই বলছি। গ্রহটার বয়স সাড়ে চার বিলিয়ন বছর (যতটুকু আমরা জানি), আর কখনো এর বুকে কোনো কিছু জন্মায়নি। এরিস-ওয়ান আর টু কোনো উদ্ভিদ-বিষয়ক এক্সপেরিমেন্ট করেনি। তবে এবার আমাকে সেটা করতে হবে। আশা করছি, আমি সত্যি সত্যিই বের করতে পারব, লাল গ্রহটায় কীভাবে উদ্ভিদ জন্মানো যেতে পারে।

ওরা ওদের ল্যান্ডিং সিরিয়ালটা এখনো ঘোষণা করেনি। তবে ওরা যদি ওদের এলোমেলো স্টাইল অনুসরণ করে, তাহলে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার স্পেসশিপ থেকে পাঁচ নম্বরে নামবে। মোটের ওপর, আমি হব মঙ্গলে পা রাখা সতেরো নম্বর ব্যাক্তি!

স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে গ্রহটায় যেতে কয়েক মাস লাগবে। তারপর মঙ্গলের মাটিতে আমরা কাটাব ৩১ সোল (মঙ্গলের দিন)। ফিরে আসার সময় আরো কয়েক মাস। একবার নিশ্বাস ফেলারও সময় নেই। বেশ ব্যস্ত সময় যাবে।

ইশ, মঙ্গলের মাটিতে যদি আরো কিছু সময় থাকা যেতো! সমস্যা নেই, এবারের মতো ৩১ সোলই চলবে।

আমি মঙ্গলে যাচ্ছি!

 

৮ই জুন

 

মিসড অরবিট সিনারিও!

জীবনে এই মিসড অরবিট সিনারিওর চেয়ে বেশি আর অন্য কিছুকে ঘৃণা করব না।

আমাকে ও আমার অন্যান্য ক্রুমেটকে বাছাই করা হয়েছে, কারণ সাইক্রিয়াটিস্টরা বলেছেন, আমরা একসাথে কাজ করতে পারব। ওনারা অবশ্য ঠিকই বলেছেন। আমরা একসঙ্গে অনেক ভয়াবহ ট্রেনিংয়ের মধ্য দিয়ে গেছি। এরপর একসাথে চলাফেরা, ঘুমহীন অবস্থায় কাটানো কিংবা এরকম আরো অনেক টানাপোড়েন―আমরা যেন একসাথে বিশাল একটা যুদ্ধ করেছি। ব্যাপারটা আমাদের মাঝে সখ্যতা বাড়িয়েছে। এমনকী প্রয়োজন হলে আমরা একে অন্যের জন্য জানও দিয়ে দিতে পারব।

তবে ঈশ্বরের দিব্যি, এই ব্যাপারটার পর কয়েকদিনের মধ্যে ওদের কেউ যদি আমার সামনে পড়ে তো তার ‌‍টুঁটিই চেপে ধরব।

মিসড অরবিট সিনারিও এমন একটা ঘটনা, যেটা হার্মেসে ফিরে আসার সময় ঘটতে পারে। হার্মেস আমাদের মূল মহাকাশযান। কক্ষপথে আবর্তন করবে। মঙ্গলের মাটি থেকে আবার কক্ষপথে ফিরে আসার সময় আমাদের ম্যাভে (মঙ্গল অবতরণ যান) করে আসতে হবে। ম্যাভ ছাড়ার সময় অনেক কিছু ভুল হয়ে যেতে পারে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, আমরা যে কক্ষপথের উদ্দেশে ম্যাভ ছাড়ব, তার চেয়ে একটু নিচু কক্ষপথে থেমে যাওয়া। আর এটাকেই বলা হয় মিসড অরবিট সিনারিও।

সেটা যদি ঘটে, তাহলে আমাদের ম্যাভের ভেতরে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া কিছু করার থাকবে না। নাসা থেকে রিমোট কন্ট্রোল করে হার্মেসকে আমাদের কাছে নিয়ে আসার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে সমস্যা হচ্ছে, হার্মেস চলে আয়ন ইঞ্জিনে। আয়ন ইঞ্জিনগুলো শক্তিশালী পয়েন্ট থ্রাস্ট না দিয়ে মৃদু সমত্বরণ দেয়। যার মানে দাঁড়ায়, আমাদের কাছে আসার জন্য মহাকাশযানটার অনেক সময় লাগবে।

এই সম্ভাবনাটির জন্য তৈরি হতেই তিনদিন ধরে আমাদের ম্যাভে বসে প্র‍্যাকটিস করে নিতে হয়েছে আমরা তখন কী কী করব। তিন তিনটা দিন! কারণ, আমাদের কাছে আসতে হার্মেসের মোট তিনটা দিন লাগবে।

তেমন কিছু মনে হচ্ছে না, তাই না? মাত্র তিনদিন ম্যাভটায়? আমরা তো এই মিশনের জন্য প্রায় এক বছর একটা মহাকাশযানের আঁটসাঁট জায়গায় কাটাবো। তিনদিনে আর এমন কী সমস্যা?

আচ্ছা, ব্যাপারটা আপনাকে বুঝিয়ে বলছি।

ম্যাভটাকে ডিজাইন করা হয়েছে আমাদেরকে মঙ্গলের কক্ষপথ থেকে মঙ্গলের মাটিতে নিয়ে গিয়ে আবার ফিরিয়ে আনার জন্য। আর যেতে বা আসতে মাত্র তেইশ মিনিট করে সময় লাগবে। এজন্য প্রত্যেক নভোচারীর কম্পার্টমেন্ট খুব ছোট। ব্যাপারটা আসলে মিনিভ্যানে করে ভ্রমণ করার মতোই; মাত্র ছয়টা সিট আর কিছু কন্ট্রোল প্যানেল।

আপনার সবচেয়ে প্রিয় পাঁচজন মানুষকে সাথে নিয়ে একটা মিনিভ্যানে বসে থাকুন তিনদিন। এটা কিন্তু ভ্রমণ নয়। একই জায়গায় স্থির হয়ে থাকবেন। ভ্যান থেকে নামতে পারবেন না। বাথরুম যাবার দরকার? একটা ব্যাগ হাতে নেবেন আর বাকিদের বলবেন অন্যদিকে তাকাতে। ঘুম পাচ্ছে? আশা করছি, আপনার পাশে কোনো নাক ডাকা জার্মান লোক থাকবে না। কারোর সঙ্গে হালকা কথাবার্তা বলতে চান? না, তাও পারবেন না। অবশ্য বোঝাতে পারব না, কেন। কিন্তু পারবেন না।

শীঘ্রই সবকিছু আপনার সহ্যের বাইরে চলে যাবে। যে কেউ যাই বলুক না কেন, আপনি জ্বলে উঠবেন।

প্র্যাকটিসের এই তিনদিনেও আমরা সবাই পেশাদারি আচরণ করেছি, কিন্তু এটা শেষ হতে হতে সবাই ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসতে শুরু করেছে। খোলাখুলিই বলছি, আমি রীতিমত অবাক যে, আমাদের মধ্যে কোনো হাতাহাতি হয়নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা সব ঠিকঠাক শেষ করতে পেরেছি।

এখন আমরা আলাদা আলাদা আছি। আমাদের সবাই এখন একাকীত্ব উপভোগ করছে। এই উইকেন্ডে আমাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আমি এরিস ওয়ান এর মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার ক্যারেন রডকে কল দিলাম। মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, মিসড অরবিট সিনারিওর প্র্যাকটিস তিনি কীভাবে সামলেছেন। তিনি রাগে গজগজ করে উঠলেন। আমাকে বললেন তাঁদেরকেও এটা করতে হয়েছিল। খুব খারাপ, জঘন্য একটা ব্যাপার। আমি তখন মনের মধ্যে একটু বল পেলাম। অবশ্য এর মধ্য থেকে একটা ব্যাপার হুট করে আমার মাথায় চলে এলো: লুইসের প্রতি আমার আগে যতটুকু শ্রদ্ধা ছিল, এখন তার চেয়ে শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেছে।

লুইস আমাদের কমান্ডার। স্বাভাবিকভাবেই তার ওপর অনেক দায়িত্ব। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এটা দেখা যে, ক্রুর সদস্যরা নিজেদের মধ্যে মানিয়ে নিতে পারছে কিনা। প্র‍্যাকটিসের পুরোটা সময় সে আমাদের সবার মতোই থেকে থেকে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। খুশি খুশি ভান ধরার কোনো চেষ্টা করেনি। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে নিজের পেশাদারিত্ব আর নেতৃত্ব দেবার সময় অবস্থানটা ঠিকই ধরে রেখেছে। আবার, ক্রুর সদস্যদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধলে সে কোনো পক্ষ নেয়নি। তার পরিবর্তে সবাইকেই বকে দিয়েছে। সূক্ষ্মভাবে দেখলে, সে নিজেকে আমাদের সামনে প্রতীয়মান সমস্যা হিসেবে উপস্থাপন করে আমাদের তুচ্ছ তর্কাতর্কির অবসান টেনেছে। আর ব্যাপারটা কাজও করেছে! তার কাছে অবশ্য এটাই প্রত্যাশিত। লোকটা যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীতে ছিল। তার জানা আছে কীভাবে অল্প সময়ে মানুষকে সামলে নিতে হয়।

আমার মনে হয় আমরা এখন আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। পরস্পরের ভালো-খারাপ, সবকিছু জানি। সে থেকেই কথাটা বলছি। এমনকী একসাথে মিসড অরবিট সিনারিওর মতো অবস্থাও পার করেছি আমরা। সেটা তো আর যেমন তেমন কিছু নয়!

তেমন বিশেষ কিছু নয়, আমি এই উইকেন্ডে কিছু খবরের ওয়েবসাইট ঘাঁটছিলাম। পৃথিবী ছাড়ার দিন যত কাছে আসছে, ততই আমাদের খবর বেশি বেশি উঠে আসছে। এখন যদি কোনো ভিডিওতে আমার কোনো ক্রুমেটকে দেখে ফেলি, তাহলে হয়তো সোজা মনিটরেই ঘুসি বসিয়ে দেবো। শালার মিসড অরবিট সিনারিও! ব্যাপারটা অনেকদিন ভোগাবে।

 

৬ই জুলাই

 

আজ রাতটাই হয়তো পৃথিবীতে আমার শেষ রাত। অন্তত একটা লম্বা সময়ের জন্য পৃথিবীতে শেষ রাত তো বটেই। আমরা কাল রওনা দিচ্ছি। কর্তৃপক্ষ আমাকে আজ রাতে ঠিক মতো ঘুমিয়ে নিতে বলেছে।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

তবে ঘুমের ওষুধ খাওয়া যাবে না। ওরা চায় না, রকেট ওড়ার সময় আমাদের কারো স্নায়ুতে কোনো ড্রাগের প্রভাব থাকুক। বিশেষ করে ঘুম ঘুম ভাব আনা কোনো কিছু তো নয়ই।

ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করে একটু অন্যদিকে মন সরাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু জানেন কী, কাল রকেট ছাড়ার দিন বলে সবাই এখন এটা নিয়েই আলোচনা করছে। মন সরাবার কোনো উপায় খুঁজে পেলাম না।

আমি এখন উড্ডয়ন কেন্দ্রের বাঙ্করুমে আছি। নাসা কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা চায় না। ওরা চায় না আমরা কেউ আজ মদ-টদ খেয়ে মাতাল হই, বা কেউ হুট করে আহত হয়ে যাই, কিংবা শেষমুহূর্তে প্রেসের লোকজনের সাথে কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ি। তাই আমাদের গত তিনদিন যাবৎ সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা হয়েছে। মিশনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়া চলছে।

আমি সিঙ্গেল মানুষ, আমার মনে হয় ব্যাপারটা আমার জন্য খুব একটা খারাপ নয়। তবে লুইস আর ভোগেলের জন্য ব্যাপারটা ভিন্ন। ওদের জন্য আমার বেশ খারাপ লাগে। বেচারীরা নিজেদের স্বামীদের প্রায় এক সপ্তাহ আগে বিদায় জানিয়ে এসেছে। আর মার্টিনেজের জন্য আমার একটু বেশিই খারাপ লাগে। লোকটার স্ত্রী ও দেড় বছর বয়সের একটা বাচ্চা রয়েছে। ওদের কারো সঙ্গেই দেখা করতে পারছে না।

মিশনটা বেশ দীর্ঘ সময়ের। মঙ্গলে যেতে ১২৪ দিন, মঙ্গলের মাটিতে ৩১ দিন, এরপর বাড়ি ফিরে আসতে আবার ২৪১ দিন। ৩৯৬ দিন মোট। এক বছরেরও বেশি সময়। আমার অন্তত একবার করে বছরের ছুটিগুলো পাওয়া হবে না। এমনকি থ্যাংক্সগিভিং অনুষ্ঠানের সময়টাতেও আমরা মঙ্গলের মাটিতে থাকব। অবশ্য এই দিনটার জন্যে নাসা আমাদের বিশেষ কিছু খাবার বরাদ্দ করেছে। সময়টা উদযাপন করার জন্য কাজের বাইরে ছুটিও মঞ্জুর করেছে তিনঘণ্টার।

আমরা তখন বেঁচে থাকলে ছুটিটা পাব।

ভেবেছিলাম পৃথিবী ছাড়ার এই আগ মুহূর্তে এসে আমি ভয় পাব। কিন্তু আমি ভয়ের ব্যাপারটা অতিক্রম করে গেছি। অজানা কোনো অনুভূতির উপত্যকায় বিচরণ করে বেড়াচ্ছি যেন। খানিক উদ্বিগ্ন হয়ে আছি, তবে তার চেয়ে অধৈর্য হয়ে পড়েছি বেশি।

জানি না মিশনটা সফল হবে কিনা। এমনকী এটাও জানি না যে, বেঁচে ফিরতে পারব কিনা। কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত: মিশনটা হচ্ছে। ব্যাপারটা শুধুমাত্র পরিকল্পনায় নেই আর। বুস্টারে জ্বালানি ভরা হয়েছে। জ্বালানি ভরা হয়েছে হার্মেসেও, সেটা আমাদের জন্য পৃথিবীর কক্ষপথে অপেক্ষা করছে। এই মিশনের জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিসপত্র ইতোমধ্যেই মঙ্গলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যবহারের জন্যেও প্রস্তুত।

মানে সবকিছুই প্রস্তুত। শুধু আমি ছাড়া।

তাহলে... এবার আমিও প্রস্তুত হয়ে নিই।