প্রিজম ● অনিন্দ্য রাউত


 

 

৷৷ ১ ৷৷

রজা বন্ধ হতে রেডিও থেকে ভেসে আসা গানটিও, “জীবনে কী পাবো না, ভুলেছি সে ভাবনা…” ধীরে ধীরে স্তব্ধ হয়ে গেল।

চিঠিটা খোলে টমাস। ওর খুব ঘুম পাচ্ছে। চিঠিটা এখন পড়বে ও? না, কাল পড়লেও হয়? চিঠিটা কবে পেয়েছে ও? মনে করতে পারে না কিছুতেই। আসলে মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। এটা কি খিদের জন্য? আজ কার জানি আসার কথা ছিল ওর কাছে! রোজ দরজা খুলে কে যেন আসে, আবছা দেখতে পায় তাকে। বলেছিল খাবার আনবে, এলো না তো! কথা দিয়ে কথা রাখে না কেন মানুষ? কিন্তু কে? কে কথা রাখেনি? খুব মনে করার চেষ্টা করে, কিন্তু মনে পড়ে না। ওর ভেতরটা গুলিয়ে যাচ্ছে আবার। টমাস উঠে দাঁড়ালো। পা-টা টলমল করছে, জোর পাচ্ছে না। কেন? ও কিছু মনে করতে পারে না। ছোট্ট এই ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ও। চারিদিকে তাকায়। একটাই রং দেখতে পায়, কালো। অন্ধকার এই ঘরে জাঁকিয়ে বসেছে, যতই আলো একজোট হয়ে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করুক না কেন, কিছু দূর গিয়েই হারিয়ে যায়। টমাস মেঝেতে শুয়ে পড়ে। ঘরের দরজার দিকে তাকায়। দুই পাল্লার সরু দরজা। দরজার রং আগে কী ছিল জানে না, কিন্তু এখন শ্যাওলা রঙের দেখতে লাগে। দরজায় শিকল তোলা। টমাসই তুলে থাকবে। কারণ ঘরে এখন টমাস ছাড়া আর কেউ নেই। দরজার পাশে দুটো তিনটে চটি আর জুতো অবিন্যস্তভাবে ছড়ানো। টমাস আগে দরজার বাইরেই জুতো রাখতো, কিন্তু দেখেছে চুরি হয়ে যায়। এই ঘরের মালিক ঘরগুলো মেসবাড়ি হিসেবেই বানিয়েছিল। আট ফুট বাই আট ফুট ঘর আর সঙ্গে বাথরুম। টমাসের ঘরে একটা সরু বিছানা, একটা টেবিল-চেয়ার, একটা মাটির কলসি, একটা স্টোভ, কিছু বাসনপত্র, একটা ভাঙা আলনা, টেবিলের উপর কিছু বইপত্তর; ব্যস এটুকুই আছে। ঘরের একমাত্র জানালাটি ঘরের দরজার একদম বিপরীতে।

পেটে খিদেটা চাগাড় দিচ্ছে, ও উঠে দাঁড়ায়, জল খাবে, মা শিখিয়েছিল খিদে পেলে জল খেতে, পেটে গামছা বেঁধে রাখতে, যখন বাড়িতে মা-বাবা-দিদির সঙ্গে থাকতো, তখন এরকম খিদে ভোলানো কত টেকনিক জানা ছিল! মায়ের কথা মনে পড়তেই মনে হল, চিঠিটা মা পাঠিয়েছে কি, যেটা ও নেড়েচেড়ে দেখছিল? প্রয়োজনীয় কিছু লেখা আছে? খুলে দেখবে? কিন্তু ও কোন দরকারে কার কী কাজে আসবে? কাজে এসেছে কি এতদিন? আসলে মা বা দিদির প্রতিটা চিঠিতেই থাকে ওর প্রতি ভীষণ আশা। ও চাকরি করে ওদের পরিবারের হাল ফেরাবে সেই আশা। চিঠির শুরু থেকে শেষ অব্দি প্রতি পদে যেন বোঝানো হয়, টমাসের জন্য ওরা কতটা ত্যাগ করে চলেছে রোজ। ছোট থেকে টমাস দেখেছে দিদি, মা লোকের বাড়ি কাজ করছে। দিদি এখনো বিয়ে করেনি। লোকের বাড়ি গিয়ে কাজ করা ছাড়াও দিদি আচারের ঠেলা নিয়ে বসে স্কুলের সামনে, এছাড়া আজকাল রাতবিরেতেও নাকি বাড়ি ফেরে না, কোনো লোকাল ছাপাখানায় কাজ করে। শুধু যাতে ওর পড়াশোনাতে কোনো বাধা না আসে তাই অক্লান্তভাবে খেটে যায়। সততা, পরিশ্রমের উপর বিশ্বাস রাখা মা এবং দিদি যে আশায় ভর করে টমাসকে প্রায় চিঠি লিখে যায় সেই আশা মিটবে কিনা তা হয়তো ভগবানও জানেন না। আসলে টমাসের পড়াশোনাও তেমন আহামরি কিছু হয়নি। কলেজের প্রথম বছর খুব ভালো শুরু করলেও হঠাৎ করেই তারপর ও হারিয়ে গিয়েছিল। তবে ও নিজে বুঝেছে ও কোনোদিনই দারুণ কিছু ছিলও না। কলেজ পাশের পর যে করে হোক একটা ভালো চাকরি জুটিয়ে নিতে পারবে, এই ভরসা ছিল। কিন্তু টমাস পারেনি, একজন চাকরি দেবে বলে বেশ কিছু টাকা নিয়ে রাখলেও আজকাল তার পাত্তা পায় না টমাস। সেই অফিস নেই, সেই লোকের ফোন নম্বরে কল করলে আর পাওয়া যায় না। কলকাতায় জীবনটা এতটা খারাপ, হতাশায় ডুবে যাবে, টমাস কোনোদিন ভাবেনি। ও ভেবেছিল, নিজের বাড়ি চলে যাবে কিন্তু উপূর্যুপরি মা আর দিদির আশা আকাঙ্ক্ষা সেটি করতে দেয়নি। টমাস থেকে গেছে, বাড়ির পাঠানো টাকায় এই মেসবাড়ির ভাড়া মেটে, ব্যস, বাকিটা জোগাড় করতে ওর দম ফুরিয়ে যায়। চিঠিটা একটা বইয়ের মধ্যে রেখে দেয় ও। ও সব ভুলে যেতে চায়। হতাশা, ব্যর্থতা, খিদে, বিশ্বাসঘাতকতা, দায়িত্ব, প্রত্যাশা সবটা ভুলে যেতে চায়।

টমাসের পেটে খিদেটা আবার মোচড় দেয়, ও সত্যিই অনেককিছু আর মনে রাখতে পারে না খিদের চোটে বা অন্য কোনো কারণে। চেষ্টা করেও যেটা চায়, সেটা মনে পড়ে না। ও উঠে দাঁড়ায়। টলতে টলতে টেবিলের সামনে আসে। আরে, এই তো! টেবিলের উপর যে খাবারের প্যাকেট রাখা। চেয়ারে বসে চটপট প্যাকেট খুলে ফেলে ও। ভেতরে বেশ কিছুটা ভাত, আলুভাজা, ডালের একটা আলাদা প্যাকেট, চচ্চড়ি, দুই পিস মাংস। কোত্থেকে খাবার এলো, কে রেখেছে কিছুই মাথায় আসে না ওর, টমাস গোগ্রাসে গিলতে থাকে, যেরকম পারে। আগে মাংস খায়, তারপর আলুভাজা, ডাল চুমুক মেরে শেষ করে দেয়, ভাত খায় শুকনো। ও কি ভুলে গেছে কীভাবে একজন সাধারণ মানুষ খায়? এরকম সময়ই ভীষণ কোলাহল শুরু হয় কোথাও, অনেক লোক একসঙ্গে যেন অনেকরকম কথা বলছে। পেট ঠান্ডা হতে টমাসের কানেও যায়। খুব চিৎকার-চেঁচামেচি, মনে হচ্ছে নীচে ফুটপাথ থেকে আসছে সব শব্দগুলো। ওর ঘরটা তিনতলায়, ঘরের একমাত্র জানালা দিয়ে শব্দ যেন তীব্র গতিবেগে ঢুকে চলেছে। ওর ইচ্ছে করছে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দেয়।

‘এই জানালাটা আমাদের অন্ধকার জীবনের রূপকথা টমাস, এটা বন্ধ কোরো না।’

টমাস চমকে উঠল, প্রায় চেয়ার থেকে পড়েই যাচ্ছিল। কী হল? কে যেন এই কথাগুলো বলে উঠল। কে বলল? ও তো বলেনি, গলার স্বর খুব চেনা কিন্তু চিনতে পারছে না। মাথাটা ঝাঁকিয়ে ও ভুলে যেতে চাইলো। ভাতে মন দিলো, সবকিছু ভুলে থাকার একমাত্র উপায়। বেঁচে থাকতে গেলে যেটা করতেই হয়, সেটায় মন দেওয়া। এমন সময় কে যেন দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে শুরু করল, এমন হুড়মুড় শব্দ, যেন মনে হল দরজা ভেঙে দেবে। টমাস তবু উঠল না, ও চোয়াল শক্ত করে খেতেই লাগলো, ভাত শেষ করে তবে উঠবে ও। দরজায় ধাক্কা পড়তে লাগলো, ভ্রূক্ষেপ করল না। আশপাশেও বেশ কিছু দরজায় কেউ বা কারা যেন ধাক্কা দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ওর দরজায় ধাক্কা দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল। একটু শান্তি যেন। টমাস খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে একটা পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুললো। কোলাহলটা যেন ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে, এক জায়গায় নেই আর। ও শিকলটা নামিয়ে দরজা খুললো। একজন লোক হন্তদন্ত হয়ে নামতে নামতে ওকে দেখে চিৎকার করে বলল,

“তুমি কী ভাই? কতজন তোমার দরজায় ধাক্কায় দিলো, খুললেই না। নীচে চলো, কেলেঙ্কারি হয়েছে। এই বাড়িতে আর থাকা যাবে না মনে হয়।”

ওর তেমন কোনো বিকার হল না, কৌতূহলও হল না কিছু নিয়েই। দরজাটা বন্ধ করে আবার মেঝেয় শুলো ও। শুতেই ওর মাথায় কী যেন একটা ঝংকার দিয়ে উঠল, একজোড়া চোখ, একজোড়া চোখ ওকে দেখছিল, ও যখন দরজা খুলেছিল, ওর মনে হল এই বিড়ালের মতো চোখটা প্রায় ওকে দেখে। কার চোখ, কোত্থেকে দেখছিল ওকে? কিছু একটা বীভৎস খেয়াল এলো মাথায়। ও তাড়াতাড়ি দরজা খুলে হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো।

 

৷৷ ২ ৷৷

“তমাল, তমাল সেনগুপ্ত, তাই তো?”

চেয়ারের উল্টোদিকে বসা মানুষটা নির্বিকার। প্রদীপ্ত দমে যায় না। ওর যা পেশা, ওকে এসব প্রায় ফেস করতে হয়। ও আবার ডাকলো। তবে অন্য নামে।

“টমাস?”

“হুম, বলুন।”

“তুমি আগে শুনতে পাচ্ছিলে না?”

“পাচ্ছিলাম।”

“তোমায় টমাস বলে কে ডাকতো?”

“ঠিক মনে পড়ে না।”

“আচ্ছা, বাদ দাও। সেদিন কী হয়েছিল মনে আছে?”

“কোনদিন?”

“যেদিন এনার লাশ পাওয়া গেল তোমার ভাড়াবাড়ির ফুটপাথ থেকে।”

টমাস বা তমালের দম বন্ধ হয়ে আসে। সাদা ফুটপাথ রক্তে ভেসে যাচ্ছিল, আর সেই রক্তের উপর উপুড় হয়ে শুয়েছিল একটি মেয়ে। মাথার অবস্থা ছিল বীভৎস, পুরো থেঁতলে গিয়েছিল। কপাল ফেটে চৌচির হয়ে কীসব বেরিয়ে পড়েছিল। তমালের মনে পড়তেই বমি পায়। প্রদীপ্ত সঙ্গে সঙ্গে জল এগিয়ে দেয়, উঠে দাঁড়িয়ে তমালের পিঠে বারবার হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করে। তমাল একটু ঠিক হলে, প্রদীপ্ত আবার কথা বলে।

“ভেবো না ওসব। ওসব তোমায় ভাবতে হবে না। তুমি কাল কোর্টে দোষ স্বীকার করেছো, যে তুমিই এনাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলে। এটা সত্যি? কেন করেছো এরকম?”

তমালের এটা মনে আছে। “আমি আসলে মেয়েটাকে ঠিক চিনতে পারিনি জানেন, সবাই বলছে ও মারা গেছে, কিন্তু কীভাবে মারা গেছে সেটাও জানি না বা জেনে থাকলেও ভুলে গেছি। আমি ভুলে যাই, লোকে বিশ্বাস করছে না। মেয়েটা কে তা ঠিক মনেও পড়ে না। তবে আমি মাঝে মাঝে একটা ছাদে নিজেকে দেখতে পাই, দেখতে পাই যে আমি আর আরেকটা মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই আমি কাল বলে দিয়েছি। আর জানেন, কে যেন আমায় বলেছিল, যতদিন ফাঁসি না হয়, জেলের মধ্যে দুবেলা নিয়ম করে খাবার পাওয়া যায়। এটা কি ঠিক?”

প্রদীপ্ত ভীষণ আশ্চর্য হয়ে যায়। ও জানতো কিছু একটা গোলমাল আছে এই কেসটায় কিন্তু তমালের সিচুয়েশন যে এরকম সেটা ও ভাবতে পারেনি।

প্রদীপ্ত ধাতস্থ হয়ে নিজেকে পুরোপুরি গুছিয়ে নিলো।

“দেখো টমাস, তুমি প্রথমে বারণ করেছিলে যে তুমি চাও না কোনো উকিল তোমার কেস নিক, তাই তোমার পক্ষে কোনো উকিল ছিল না, আর সবার কাছে এটা ওপেন এন্ড শাট কেস। তোমার মনে না থাকলেও এনা তোমার কাছে প্রায়ই যেত। যে ফ্ল্যাটে তুমি ভাড়া থাকো, মেয়েটির লাশ পাওয়া গেছে সেই ফ্ল্যাটের লাগোয়া ফুটপাথ থেকে। ছাদ থেকে তুমি ঠেলে ফেলে দিয়েছো, এরকম হতেই পারে। আর লোকে এটাই ভাবতে চাইছে। কিন্তু তোমার কথাবার্তা শুনে কোর্টের জাজ বুঝেছেন সবটা ঠিক নেই, তাই আমায় অ্যাপয়েন্ট করেছে তোমার হয়ে লড়ার জন্য। তাই তোমার থেকে আমি সাহায্য চাই।”

প্রদীপ্তের কথাগুলো যেন কোনো দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে আসছিল। তমালের মুখচোখে কোনো পরিবর্তন নেই। যেন কোন গহীন জগতে ডুবে সে।

 

প্রদীপ্ত বুঝতে পারে না কীভাবে ও যেগুলো ভেবে রেখেছে সেগুলো তমালকে বোঝাবে। তমালের বলা একটা কথা ওর মনে পড়ে। প্রদীপ্ত বলে ওঠে, “তোমার মা যখন গরম ভাত নামিয়ে তাতে ঘি,নুন আর একটু আলুসেদ্ধ মাখিয়ে তোমায় খাইয়ে দিত, তখন কেমন লাগতো টমাস? ইচ্ছে করে না ওখানে ফিরে যেতে?

তমাল চমকে ওঠে। ভীষণভাবে মাথা নেড়ে ওঠে ও।

“তাহলে আমার কথা মন দিয়ে শোনো তমাল। তুমি একজন খুব ভালো মানুষ। তুমি পড়াশোনায় ভালো, তোমার মা-বাবা-দিদিকে তুমি খুব ভালোবাসো। তারা তোমায় প্রায় চিঠি লেখে। কিন্তু কোনো অভাবের কথা লেখে না আর তারা। তারা লেখে, তারা তোমার মতো ছেলে পেয়ে খুব খুশি। তোমায় কিছু ভাবতে হবে না, তারা নিজেদের মতো খুব ভালো আছে, শুধু তুমি ভালো থাকো। এই দেখো, তোমার বাড়ি থেকে পাওয়া এই চিঠিগুলোতে এসবই লেখা। ধরো। তো বুঝতে পারছো তো, তুমি কোনো খুন করোনি। তুমি নির্দোষ। এটা বারবার নিজেকে বলতে থাকো, যে তুমি নির্দোষ।”

প্রদীপ্ত এক বান্ডিল চিঠি দেয় তমালকে। এই মিথ্যেগুলো বলার দরকার ছিল, প্রদীপ্ত জানে।

কেন জানি তমালের মনটা সেই গরম ভাতের ধোঁয়ায় এখনো আচ্ছন্ন হয়ে আছে। বাষ্প জমে জল হয়ে দেখা দেয় চোখে। তমাল চিঠিগুলো ধরে বসে থাকে। প্রদীপ্ত আবার বলে ওঠে, “টমাস, কাল আমি তোমায় নিয়ে একজনের কাছে যাবো, আমি স্পেশাল পারমিশন করিয়েছি। ঠিক আছে? সব ঠিক হয়ে যাবে, ভেবো না।”

তমাল শুধু বারবার বিড়বিড় করতে থাকে, “আমি নির্দোষ, আমি নির্দোষ।”

 

৷৷ ৩ ৷৷

‘এই জানালাটা আমাদের অন্ধকার জীবনের রূপকথা, টমাস, এটা বন্ধ কোরো না।’

টমাস দেখতে পায় নিজের ঘর। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে জানালার পাশে বিছানায় বসে। মেয়েটির মাথা ছেলেটির কাঁধে রাখা। দুজনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির ছাঁট এসে ঢুকছে জানালা দিয়ে, কিন্তু দুজনের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। দুজনের হাতে, পায়ে বৃষ্টির কুচি জমছে। দুজনে কথা বলছে অনেক, কথাগুলো বৃষ্টির তালের সঙ্গে ওঠানামা করছে, ঐ একটা কথার পর আর কোনো কথাই উদ্ধার করতে পারে না টমাসের কান। এগিয়ে ওদের মুখটা দেখতে যায়, কিন্তু একটু গিয়েই আর এগোতে পারে না ও। তবে এবার অস্ফুটে কথাগুলো কানে আসছে।

“টেরহঃফ, আমাদের জীবন এমন কেন? সূর্যের আলো নেই যেন, কোনো রং নেই, তুমি গুটিগুটি পায়ে চুপিচুপি এই দরজা দিয়ে ঢোকো, কাউকে জানতে দিতে চাও না, আবার চুপিচুপি চলে যাও। আমরা এত লুকিয়ে বাঁচি কেন?”

মেয়েটা হাসে। “টমাস, আমাদের যে শূন্যতায় পরিচয়, আমাদের যে অভাবে পরিচয়, আমাদের যে একে অপরের মনখারাপে পরিচয়। আলো, রং, খোলামেলা জীবন, ওগুলো তো আমরা নই টমাস। যখন বাইরের সাম্রাজ্যবাদী শত্রু চারিদিকে বোমা ফেলবে, আমরা সহজেই লুকিয়ে যেতে পারবো, অন্যরা কিন্তু পারবে না। সেদিন দেখবে, আমরা ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই, চারিদিকে শুধু লাশের মিছিল দেখা যাবে, তারপর কালের নিয়মে একদিন যুদ্ধ শেষ হবে। আমরা বেরোবো সেদিন টমাস। আমরা রাস্তায় বেরিয়ে এতদিনে আমাদের প্রতি হওয়া সমস্ত অন্যায়, আমাদের প্রতি হওয়া অবিচারের বিরুদ্ধে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করব, প্রকৃতি, সূর্যের আলো সাক্ষী থাকবে আমাদের স্বাধীনতার, আমাদের ভালোবাসার। যা কাউকে জানতে দিতে নেই এখন, সেদিন গোটা পৃথিবী জানবে, জানবে আমরা এক। নীল আকাশের নিচে শুধু আমরা দৌড়াবো। এই পৃথিবী সেদিন আমাদের চিনবে। আমরা আবার নতুন সভ্যতা গড়বো টমাস। আর সেই সভ্যতায় কোনো অন্যায়, গ্লানি, ক্ষুধা, ছলনা, বর্বরতা থাকবে না। আমরা তো শুধু একটু নিজেদের মতো বাঁচতে চেয়েছি টমাস, কিন্তু অন্যরা এতকিছু চাপিয়ে দিয়ে গেছে, যাচ্ছে, যে আমরা আর বাঁচতেই পারি না, মরে যাচ্ছি, মরে গেছি। কিন্তু সেদিন আমরা বাঁচবো। তাই অপেক্ষা করো, অপেক্ষা।”

টমাস দেখলো ছেলেটা উঠে দাঁড়িয়েছে। জানালার শিকে নিজের মুখটা চেপে ধরলো। যেন জানালা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে।

“ইসবশেহ, নিজের ইচ্ছেমতো আমরা কি কিছুই পারি না?”

টমাস বুঝতে পারে কোনোভাবেই ছেলেটা মেয়েটাকে কী নামে ডাকছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। জিবেরিশ কিছু শোনাচ্ছে। নামটা টমাস অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারছে না।

মেয়েটা উত্তর দেওয়ার আগেই ছেলেটা আবার বলে উঠল, “হদ্যধড, আমি কি তোমায় ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছি? তোমার মাথাটা ঐভাবে ফেটে চৌচির হয়ে গেল কি আমার জন্য? কিন্তু আমি তো নির্দোষ। আমি সত্যিই নির্দোষ।”

এবার মেয়েটি হেসে ওঠে খুব জোরে। হাসতেই থাকে। টমাস আর ছেলেটার দুজনেরই খুব রাগ হয়ে যায় মেয়েটার ওপর। মেয়েটা খুব কষ্ট করে হাসি থামিয়ে হাসির দমকেই বলে ওঠে, “আমায় কী করে মারবে টমাস? আমায় তো তুমি দুবছর আগেই গলা টিপে মেরে ফেলেছো। আমি যা করেছিলাম সেটাই প্রাপ্য ছিল, তোমায় ঠকিয়ে আমি অন্য একজনের সঙ্গে চলে যেতে চেয়েছিলাম, তাই তুমি… “

মেয়েটা ছেলেটার হাত ধরে বলে, “ঠিক করেছিলে টমাস, ঠিক করেছিলে। সেদিন না মারলে আমরা এক হতাম কী করে?”

মেয়েটা কিছুক্ষণের জন্য থেমে আবার বলে, “ছাদে যাবে টমাস?”

ছেলেটি ঘাড় নাড়ে, “না, তুমি যাও।”

দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর মেয়েটা দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। টমাস অনেক চেষ্টা করেও দুজনের মুখ দেখতে পায় না।

 

“এই, এই ওঠ, ওঠ। কোর্টে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। শালা আজব ছ্যাঁচড়া, শুধু ঘুমায়, খিদে পেলে খাও আর নাহলে সারাদিন ঘুমাও। এ শালা কাউকে মারতেই পারে না, আমিই বলে দিচ্ছি, ওসব কেসের কী দরকার?”

কনস্টেবলের হাঁকডাকে তমাল ধড়মড় করে উঠে বসে।

 

৷৷ ৪ ৷৷

“মহামান্য আদালত, সব তথ্যপ্রমাণ, সাক্ষীর বয়ান আপনার সামনে। বাদী পক্ষের উকিল কিছু বলতে চান না বলে জানিয়েছেন, এবার সবটাই আপনার হাতে। তবে তার আগে আপনার অনুমতি নিয়ে ব্যাপারটির উপর সত্যের আশ্রয় নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।”

“অনুমতি আছে, বলুন।”

“এতক্ষণে আপনারা সবাই জেনেছেন তমালের একইসঙ্গে ডিম্যানশিয়া, স্কিৎজোফ্রিনিয়ার টেন্ডেন্সি আছে। এমনকী যে ডক্টর ওকে পরীক্ষা করেছেন তিনি বলেছেন হয়তো অচিরেই স্প্লিট পারসোনালিটি ডিসঅর্ডারও দেখা যাবে। ডিডাকশনে প্রচুর ভুল হয় তমালের। ওকে যে কেউ চাইলে কিছু বিশ্বাস করাতে পারে। ডক্টর এরকম পরীক্ষা করেছেন, এবং তমাল সেটাকেই বিশ্বাসযোগ্য ভাবে এখন। আপনি ওকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”

জাজসাহেব তমালকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার নাম কী?”

তমাল উত্তর দিল। “আমার নাম তমাল, কাল ডাক্তারবাবু বলেছেন। মনে হচ্ছে এটাই আমার নাম।”

“তাহলে টমাস?”

তমাল এড়িয়ে গেল। উল্টে বলল, “টমাস একটা মেয়েকে দুই বছর আগে গলা টিপে খুন করেছিল, আমি আজ দেখেছি।”

জাজসাহেবের আর কোনো সন্দেহ রইলো না। “প্রদীপ্তবাবু, আপনি কন্টিনিউ করুন। আমি কিছুটা বুঝতে পারছি।”

প্রদীপ্ত তমালের দিকে তাকিয়ে বলেন, “না, তুমি করোনি। করলে বলো, সেই ডেডবডি কোথায়? তুমি আজ পুলিশ স্টেশনে ছিলে। তুমি সেখানে বসে স্বপ্ন বা হ্যালুসিনেট করতে পারো, কিন্তু সেটা যে সত্যি তার কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।”

তমাল চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রদীপ্ত একটু ইম্পালসিভ হয়ে পড়েছিল। নিজেকে শান্ত করে ও আবার জাজের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করে।

“সিচুয়েশন আপনার সামনে স্যার, ডাক্তারের রিপোর্টও আপনাকে দিয়েছি। উনি ক্লিয়ারলি বলেছেন, এই অবস্থায় তমালের কোনো কথাই বিশ্বাসযোগ্য নয়, তাই আগেরদিন কোর্টে দাঁড়িয়ে দোষ স্বীকার করাটা ফাইনাল ডিসিশন হতে পারে না। এইবার আসি, এনার কথায়। এনা পেশায় ছিলেন একজন এসকর্ট। খুব সম্ভবত কলেজে পড়ার সময় এনার সঙ্গে তমালের পরিচয়। তখন থেকে হয়তো একটা সম্পর্ক হয়েছিল, তমালের কলেজের বিভিন্ন ক্লাসমেটদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তমাল দেখতে সুন্দর এবং অনেকটা প্রখ্যাত হলিউড অভিনেতা সিলিয়ান মারফির মতো দেখতে বলে তাঁর বিখ্যাত চরিত্রের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তমালকে টমাস বলে ডাকা হতো। কে নাম দিয়েছিল, তা জানতে পারিনি। আমাদের অনুমান, কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের পরই এনা তমালকে ডিচ করে। বাড়ির ভীষণ এক্সপেক্টেশনে ছেলেটা এমনিতেই নুইয়ে থাকতো, আর এই ঘটনায় তমাল ভীষণ ভেঙে যায়। সিভিয়ার ডিপ্রেশনে যায়, যেটাকে আমরা বলি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার, কিন্তু কোনো ট্রিটমেন্টই হয়নি। তমাল পড়াশুনো হোক, সাধারণ জীবনযাপন করা সবকিছুতে পিছিয়ে পড়ে, এদিকে মা-দিদির কাছ থেকে নিয়মিত চিঠি আসতো, কীরকম ও পড়াশুনো করছে, চাকরি কবে পাবে এসব নিয়ে। কেউ ওকে জিজ্ঞেস করতো না ও কেমন আছে। মুখচোরা আর এই ডিপ্রেসড থাকার কারণে সেরকম কোনো বন্ধুও ওর পাশে থাকেনি সেই সময়। এইসময়ই হয়তো কোনোভাবে ওর ডিম্যানশিয়াও গ্রো করে, দীর্ঘদিন একা থাকা আর একটা ঘরে বন্দি থাকার ফলে। কলেজে গেলে ওর এনার কথা মনে পড়তো, তাই কলেজে যাওয়া বন্ধ করল, যে কয়জন ওকে দেখতে পেতো, বেশিরভাগ কলেজের ক্লাসমেট, তারা ওকে টমাস বলেই ডাকতো। তাই হয়তো ও ধীরে ধীরে নিজের নামটাও ভুলে গিয়েছিল। এই অল্প বয়সে ডিম্যানশিয়া কারোর গ্রো করে না সাধারণত, কিন্তু স্ট্রেস, ডিপ্রেশন, ট্রমা এটাকে ত্বরান্বিত করেছিল। ও কলেজের পড়াশুনো কমপ্লিট করতে পারেনি, শেষের দিকে মা-দিদির চিঠি এলে ও খুলতোও না, ওর ফোনটা কবে ও সুইচ অফ করে কোথায় ফেলে রেখেছে সেটাও কেউ জানে না। একসময় হয়তো চাকরির চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেখানেও ও প্রতারিত। এটা ছিল তমালের লাস্ট আড়াই বছরের লাইফ।”

“তাহলে এনা, এনা ওর ছাদ থেকে কীভাবে পড়ে মারা যায়?” জাজ প্রশ্ন করেন।

“বলছি স্যার। যতদূর মনে হয় ছোটবেলা থেকেই অনাথ এবং এই শহরে প্রায় একা একা বড় হয়ে ওঠা এনার একটা গিলটি ফিলিং ছিল, এভাবে তমালের বিশ্বাস ভাঙার ফলে। তমালের একা, নির্লিপ্ত জীবনের খবরও নিশ্চয়ই ও পেয়েছিল। তাই এই আড়াই বছরের মধ্যে কোনো একটা সময় তমালের ঠিকানায় ও আবার আসে। যেহেতু তমাল কোনোদিন ঠিকানা পাল্টায়নি, তাই এনার অসুবিধা হয়নি। সমস্যা হয়, এনা তমালকে যখন আবিষ্কার করে, তখন তমাল এনাকেও সেভাবে চিনতে পারেনি। হয়তো আবছা মনে পড়তো। এতটা খারাপ অবস্থা এনা কল্পনা করতে পারেনি। এনা দেখলো তমাল খিদে, বেঁচে থাকলে কীভাবে খাবার জোগাড় করবে, শুধু সেগুলো নিয়ে কনসার্নড। খিদে পাওয়াটা খুব ন্যাচারাল ব্যাপার, আর খুব তীব্র অনুভূতি, যদি সঠিক সময়ে খাবার পাওয়া না যায়। তাই খিদেটুকু ছাড়া তমালের আর কিছুই সেভাবে মনে পড়তো না। এনা তমালের খাবারের জোগান দিতে লাগলো। এনার যেহেতু এই শহরে কেউ নেই, অনাথ একজন, তাই ও তমালের অসহায়তা বুঝেছিল। কিন্তু এনা নিজের দুঃখ, কষ্ট, একাকিত্ব ভুলতে উইড মানে কিছু নিষিদ্ধ গাঁজার সেবন করতো, এনার ফ্ল্যাট থেকে সেসব পাওয়া গেছে, আমার বিশ্বাস তমালকেও মাঝে মাঝে সেসব খাওয়াতো। তমালের সিচুয়েশন আরো খারাপ হয়। এনা এত কাছে থাকলেও তমাল সামান্য ভালো ফিল করতো না। হয়তো ঐদিন এনা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছাদে গিয়েছিল। ঐ বাড়ির অন্য বাসিন্দা বিজনবাবু এনাকে ছাদে একাই উঠতে দেখেছিলেন। তিনি আজ বয়ান দিয়েছেন। ছাদে দুজন রয়েছে, এরকমও কেউ দেখতে পায়নি। উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা ঘনশ্যামবাবু বলেছেন, ছাদে একজন মেয়েকে গানের তালে নাচার অঙ্গভঙ্গি করতে দেখেছেন। হয়তো এনা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছাদে যায়, এবং নাচতে নাচতে পা স্লিপ কেটে বা হ্যালুসিনেট করে ছাদ থেকে পড়ে যায়। আমি যা কিছুই বললাম, তা সারকামস্ট্যান্স, সাক্ষীর বয়ান, তমালের পাস্ট আড়াই বছরের লাইফ সম্পর্কে কিছুটা শুনে, দেখে, অনুমান করে বললাম। ঠিক এমনটাই ঘটেছে তা আমি বলতে পারি না, তবে খণ্ডন করার খুব একটা জোরও দেখি না। অন্য কেউ চাইলে এই কেস রিওপেন করতে পারে। আমি সবটা আপনার সামনে রাখলাম। তবে আমার অনুরোধ, শুধু তমালের স্বীকারোক্তি আর ওর ফ্ল্যাটের ভাড়াবাড়ির তলা থেকে এনার দেহ পাওয়া গেছে বলেই কোনো ডিসিশন নেবেন না। ওর ঠিক চিকিৎসা হলে আর ও রিহ্যাবে থাকলে একটা নতুন জীবন পেতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস। আমিই সেই ব্যবস্থা করব। একটা ছেলে চিরকাল অন্যদের চাপে থেকে শেষ হতে পারে না। হি উইল ফাইন্ড ট্রু কেয়ার এগেইন।”

 

৷৷ ৫ ৷৷

“স্যার, আমি ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে একবার আমার ঐ ঘরে যেতে চাই।”

“টমাস, সেটা রিস্ক হয়ে যাবে। তোমার যা জিনিসপত্র আছে, আমি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।”

“না স্যার, আমি নিজে একবার যেতে চাই, তারপর আপনি যেখানে বলবেন, যাবো। আপনি আমার খাবারের ভার নিয়েছেন, আমি আপনার সব কথা শুনবো।”

প্রদীপ্ত ঘাড় নাড়ে। “ঠিক আছে, তবে আমি নিচে দাঁড়িয়ে থাকবো, আর তোমার বেশি সময় লাগলে আমি কিন্তু আমি উপরে এসে তোমার ঘরে ঢুকে যাবো।”

তমাল হেসে ফেলে। “ঠিক আছে স্যার।”

প্রদীপ্ত ওকে ড্রাইভ করে নিয়ে যায় ঐ ফুটপাথ লাগোয়া বাড়ির কাছে। এই ফুটপাথেই পড়েছিল এনার দেহ। তমাল গাড়ি থেকে নেমে একবারও ফুটপাথের দিকে তাকায় না, বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে।

 

৷৷ ৬ ৷৷

তমাল তিনতলায় উঠে দাঁড়ায় একটু। উল্টোদিকের দরজা খোলা। একজন লোক দাঁড়িয়ে করিডরে। লোকটির মুখে হাসি। লোকটি এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বলল, “রিহ্যাবে গিয়ে তুমি ঠিক হয়ে যাবে। তুমি এখানেও যতদিন খুশি থাকতে পারো। ভাড়া লাগবে না।”

এই লোকটাকে তমাল সেদিন কোর্টে দেখেছিল। নামটা… দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও। মনে পড়ে না। ওর কিছু মনে পড়ে না। ও নিজের ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে। দরজা বন্ধ করে। ও শেষবারের মতো এসেছে সব গুছিয়ে নিতে। এই ঘর কি ওর থেকে সব কেড়ে নিয়েছে? না, জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতিগুলো এই ঘরের আনাচেকানাচে ছুঁয়ে থাকে ওকে? এক এক করে যখন সব গুছিয়ে নিতে থাকে, তখন যেন আরো বেশি করে এই ঘর ওকে টানতে থাকে, যেন ছেড়ে গেলে সব হারিয়ে ফেলবে ও। কী ফেলে রাখে যাবে ও এখানে? ও আবার তাকিয়ে তাকিয়ে সবটা দেখে কিন্তু জড় বস্তু ছাড়া কিছু খুঁজে পায় না।

এমনসময় দরজায় কে ধাক্কা দেয় জোরে জোরে। প্রদীপ্তদা? কিন্তু এখনো তো কুড়ি মিনিট হয়নি। ও দরজাটা খোলে। আর একজন লোক হুড়মুড়িয়ে ঢোকে ঘরে।

 

“মাইরি গুরু, কী খেল দেখালে? ভেবেছিলাম ওইদিনই সব সাল্টে নেব, কিন্তু তুমি দরজাই খুললে না। তারপর যখন লোকে লোকারণ্য তখন তুমি বেরোলে। তখন আর কী করে সামনে আসি! যাইহোক, তোমার টাকাটা কখন নেবে বলো!"

তমাল হকচকিয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, “তুমি কে? আর কীসের টাকা?”

“গুরু, আমার নাম তুমি জানো, মনে পড়ছে না ঠিক আছে, মনে করতে হবে না।”

লোকটা এবার একটু কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “গুরু, দেওয়ালেরও কান আছে। শোনো, তুমি, আমি, উকিল আর জাজ মিলে এই প্ল্যান করেছি। ঐ এসকর্ট গার্ল এনাকে মারবো বলে। ওর অনেক টাকা, আমরা নেব বলে। মালটা এককালে তোমায় লেঙ্গি দিয়েছিল, তোমার পড়াশোনা, চাকরি শেষ করে দিয়েছিল, তাই তো এতদিন ভেবে এই রিভেঞ্জ। হাহাহাহা।”

“ওকে ছাদ থেকে তাহলে আমি…?”

“না গুরু, তুমি হবে কেন, আমি ফেলেছি। তোমায় ফাঁসাবো কেন? কিন্তু তুমি সব ভুলে গিয়ে পুলিশের কাছে নিজে গিয়ে দোষ স্বীকার করে নিলে, ব্যস, কেস! ভাগ্যিস উকিল আমাদের লোক।”

“প্রদীপ্তদা তোমার লোক?”

“হ্যাঁ, আবার কী! ঐ তো এই ফ্ল্যাটের বিজনবাবু আর উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের একটা লোককে মিথ্যা সাক্ষী হিসেবে হাত করে।"

তমাল বুঝতে পারে কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছে। ও ঘামতে থাকে। প্রদীপ্তদা অপেক্ষা করছে, কই এসব তো বলেনি। ও চিৎকার করে বলে, “তুমি মিথ্যে। আমি কাউকে মারতে পারি না, আমি নির্দোষ। কীসের জন্য আমি এসব করেছি? কীসের জন্য?”

“খিদে গুরু, আমাদের খিদে। আমার-তোমার সবার খুব খিদে পায় যে। ওই এনার সমস্ত টাকা হাতিয়ে নিলে ফিউচার ফ্যান্টাস্টিক। তোমার বাড়ি থেকে শুধু চাকরির জন্য প্রেশার দিচ্ছে, টাকা পাঠানোও বন্ধ করে দিয়েছে। কিছু তো করতে হবে খিদে মেটাতে হলে। তারপর ঐ এনা মাগী আসতো, তোমায় শুধু নেশা করানোর চেষ্টা করতো। এত টাকা থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা করানোর চেষ্টা করেনি। তাই তুমি আমার কাছে এলে খিদের চোটে, আর দুজনে মিলে প্ল্যান বানালাম। এখন উকিল তোমার চিকিৎসা করাবে। আর তুমি ঠিক হয়ে যাবে।”

তমাল মাথা ধরে বসে পড়ে, ও বুঝতে পারছে না কী সত্যি। “মা-দিদি, কেমন আছে?”

উল্টোদিক থেকে বলল, “দারুণ আছে গুরু। এবার তুমি টাকা পাঠাতে পারবে।” তমাল উঠে দাঁড়ালো। ও তাড়াতাড়ি করে টেবিলে রাখা সমস্ত বই উল্টোতে লাগলো। ওর কিছু মনে পড়েছে। সেই খামবন্ধ চিঠিটা কোথায়? হাতড়াতে হাতড়াতে পেয়ে গেল। খাম খুললো ও। দেখে ভেতরে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা আর একটা চিঠি। মা-দিদি এত টাকা পাঠিয়েছে কেন?

চিঠিটা খুললো ও।

 

আমার তমাল,

 

তোর দিদিকে আর বাঁচাতে পারলাম না,

কিছু বর্বর জন্তু ছাপাখানায় ছিঁড়ে খেয়েছে। পুলিশে ধরেছে ওদের কিন্তু তোর দিদি আর বাঁচলো না। তোর বাবাও এটা শুনে বাঁচলো না। কিছু লিখতে পারছি না তোকে আর। কষ্ট হচ্ছে বাবা, চোখের জল বাঁধ মানছে না। জানিস খুব করে আমরা সবাই বাঁচতে চেয়েছিলাম, তোকে দেখতাম আমাদের সব দারিদ্র্য ঘুঁচে যাওয়ার একমাত্র আশা, হয়তো খুব বেশি চেয়ে ফেলেছিলাম, এতটা চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হয়নি, তাই হয়তো অতটা ভালো করতে পারলি না, তবে আর কিছু চাই না। তুই যেমন পারিস, তেমন থাক বাবা। তবে বেঁচে থাকিস, যেটা আমরা পারলাম না। যতদিন ভগবান টেনে না নেয়, ততদিন থাকিস। ভগবানকে রোজ ডেকে গেছি, কিন্তু আজ আর কিছু চাইছি না তাঁর থেকে। তাঁকেও বলেছি, তিনি যেন ভালো থাকেন। অবশ্য আমাদের মতো মানুষদের ভগবান থাকে না। শুধু আমাদের পরিশ্রম থাকে। পঞ্চাশ হাজার টাকা পাঠালাম। এটুকু জমাতে পেরেছিলাম। তোর থাক। আমি আসি। পরের জন্ম থাকলে যেন তুই আর মিলিই আমার ছেলেমেয়ে হোস। আমাদের একটা ভালো জীবন হোক।

 

ইতি,

মা

 

মানে? মা নেই? দিদি নেই? বাবা নেই? ওর আর কেউ নেই? চিঠিটা হাতের মুঠোয় পাকিয়ে বসে পড়ে ধুপ করে, পারছে না ও বসে থাকতেও। মাথা ঘুরছে ভীষণ।

“গুরু কী হল?”

লোকটা হাত থেকে পড়ে যাওয়া পাকানো চিঠিটা হাতে তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করল। “গুরু, আমি বুঝতে পারছি তোমার অবস্থা, যে কারণে আমরা মারলাম এনাকে, সেটার দরকার ছিল না। তুমি চিঠিটা যদি একটু আগে খুলে পড়তে, তাহলে… যাইহোক, যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। প্লিজ ঠিক থাকো। তবে একটা কথা, তোমার ভাগের টাকাটা কী করব যদি একটু বলে দাও।"

তমালের শিরাদুটো দপদপ করে ওঠে। ও বুঝতে পারছে ওর মাথা আবার ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। কাকে বিশ্বাস করবে ও? কার কথায় ভরসা রাখবে? ওর নিজেরই যে কিছু ঠিক করে মনে পড়ে না। চাপা রোষ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে শিরায় শিরায়। কাটা কাটা ভাবে ও বলে, “তোমার নাম কী?”

“গুরু, নাম জেনে…”

“নাম কী তোমার?”

“গধড়ঝস।”

আবার সেই জিবেরিশ। ও চিৎকার করে ওঠে। “ঠিক করে নামটা বলো।”

লোকটা চুপ থাকে। কেউ দরজায় এখন ধাক্কা দিচ্ছে। লোকটার দিকে তাকায়। লোকটার মুখে কেমন ভয়। তমাল আর ভাবে না। ও দরজা খুলে দেয়। দেখে সেই চেনা চোখ, বিড়ালের চোখের মতো।

 

৷৷ ৭ ৷৷

“এই ঘরে আমায় ছাড়া কাউকে দেখতে পাচ্ছ?” হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করে তমাল। ও শক্ত করে ছেলেটার হাত ধরে আছে। ছেলেটাকে কেন জানি খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। ছেলেটার মুখের কোনো ভাব পরিবর্তন হয় না। খুব শান্তস্বরে বলে, “না, তুমি ছাড়া আর কেউ নেই।”

তমাল মাথা ঝুঁকিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। ও দেখতে চায় না মাথা তুলে অন্যরকম কিছু। ও ঐভাবে থেকেই আবার প্রশ্ন করে, “জানালা দিয়ে একটু দেখবে, নিচে কোনো গাড়ি দাঁড় করানো আছে নাকি?”

ছেলেটা হাত ছাড়িয়ে জানালার কাছে যায়। ফিরে আসে। “না, কোনো গাড়ি নেই।”

একই অবস্থায় থেকে তমাল আবার জিজ্ঞেস করে, “ঘরে কোনো খামে পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে কিনা একটু খুঁজে দেখবে? বা কোনো খাম, চিঠি মেঝে বা টেবিলের উপর ছড়িয়ে আছে?”

ছেলেটা ঘরে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। বলে, “না, সব গোছানো। কোথাও টাকা বা কিছু ছড়ানো নেই।”

তমাল বেশ কিছুটা শান্ত হয়ে গিয়েছে। “তুমি আমায় চেনো, তাই না?”

“হ্যাঁ, চিনবো না কেন?”

“আমি কি সেদিন গেছিলাম ছাদে? তুমি জানো কিছু?”

“না, তুমি যাওনি ছাদে, এই ঘর আর উল্টোদিকের ঐ ঘর ছাড়া কোথাও তুমি লাস্ট তিন চার বছর যাওনি।”

তমালের ভিতরটা যেন আরো শান্ত হয়ে যাচ্ছে। ও জিজ্ঞেস করে চলে ওর যা যা মনে আছে।

“এনা নামে কাউকে চেনো?”

“হ্যাঁ, তোমার কলেজ লাইফের ভালোবাসা, চিট করেছিল তোমায়। তুমি খুব রিভেঞ্জ নিতে চাইতে, চাইতে এনার কিছু খারাপ হোক, কিন্তু কিছু করোনি তুমি। তবে সে বেঁচে আছে, এনা নামে কেউ মারা যায়নি। ওগুলো সব তোমার কল্পনা, তোমার মনে সৃষ্ট হওয়া রহস্য।"

তমাল খুশি হয়ে ওঠে, “মা-বাবা-দিদিও বেঁচে আছে তাই না?”

এই প্রথম ছেলেটি দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়, মাথা নামিয়ে নেয়।

“না, তোমার কলেজ শেষের পর যখন চাকরি খুঁজছিলে, ঐ সময় তোমার পুরো পরিবার আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়, অভাব আর মানসিক, শারীরিক অত্যাচারের ফলে। শোক আর শকটা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছিল তোমার।”

ছেলেটি এবার উল্টে তমালের হাত ধরে ফেলে।

“তবে তুমি একা ছিলে না তমালদা, সেসময় দিদি তোমার জীবনে আসে, একই ডাক্তারের কাছে তোমরা চিকিৎসাধীন ছিলে। দিদি আর আমিও সেইসময় মা-বাবাকে হারাই দুর্ঘটনায়। দিদি ঠিক হয়ে গিয়েছিল অল্প দিনে, কিন্তু তুমি পারোনি। দিদি তখন তোমার সঙ্গে থাকা শুরু করে। কষ্টের মধ্যে দিয়ে দুজনের জীবনে যে ভালোবাসা আসে, তা কী করে নষ্ট হবে? দিদি ছিল, দিদি এখনো আছে। তুমি মাঝে কিছু বছর ঠিক ছিলে, চাকরিও করেছো। কিন্তু পরিবারের মৃত্যু শোক নাকি বারবার ফিরে আসে তোমার মনে, আর তুমি আবার ফিরে যাও সেই কলেজ লাইফের শেষের সময়টায়, তোমার একান্ত কষ্টের সময়টায়। ওখান থেকে শুরু করো। ডাক্তার তাই বলেছে। তুমি হ্যালুসিনেট করো, সব ভুলে যাও, কল্পনা করতে থাকো, ডিসঅর্ডারগুলো প্রকট হয়ে ওঠে। তবে তুমি ঠিকও হয়ে যাও তমালদা, ঠিকও হয়ে যাও আবার কিছুদিনে, ঠিক হয়ে যাও।”

তমাল আর পারে না, মনের ভিতর তৈরি হওয়া এত অনুভূতির সঙ্গে লড়তে। স্মৃতি, কল্পনা, স্বপ্ন মিলেমিশে বাস্তবটাকে ভুলিয়ে দিতে পারে কীভাবে? কোনটা সত্যি? কে বলছে সত্যি? কোনটা ঠিক? ও কেঁদে ফেলে।

“আমি রিহ্যাবে যাবো, নীচে প্রদীপ্তবাবু দাঁড়িয়ে আছেন। আমি যাই, আমি ঠিক হয়ে যাবো। আমি নির্দোষ।”

“রিহ্যাবে তুমি ছিলে তমালদা। তবে তুমি পারোনি, নিজেকে বারবার আঘাত করতে, মরতে চাইতে। দিদির সঙ্গে তো তাও বেঁচে আছো, আমাদের দুজনের ভয় হয়। দিদি চায় না আর তোমায় রিহ্যাবে পাঠাতে। যখন তোমার আবার ট্রমা শুরু হয় হঠাৎ হঠাৎ, তুমি চিনতে ভুল করো, তখন তুমি ভীষণ জেদ করো যাতে একা থাকতে পারো। আমাদের উপায় থাকে না, তবে চোখে চোখে রাখি। দিদি তোমার জন্য আলাদা খাবার রেখে যায় তোমার ঐ দিনগুলোতে, যখন তুমি কাউকে চিনতে পারো না। আমি জানি আমি এখন বলছি, কিন্তু তুমি আবার সব ভুলে যাবে। কিন্তু আমি আবারও বলছি, তুমি ঠিক হয়ে যাবে তমালদা। বিশ্বাস রাখো। হয়তো এবার রিহ্যাবে গিয়ে ঠিক হয়ে যাবে। দিদিও কাছাকাছি থাকবে।”

চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছে তমালের। “কী করে বুঝবো তুমি সত্যি বলছো? আমি এখনও যে হ্যালুসিনেট করছি না কী করে বুঝবো?”

“আমার সঙ্গে এসো।”

 

ওরা ঐ ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে উল্টোদিকের খোলা দরজার ভেতরে ঢোকে। এই ঘরটা কী বড়, তমাল অবাক হয়! পুরোপুরি অচেনা ঠেকে না ওর। হল পেরিয়ে একটা জানালা দেখা যাচ্ছে, সেখানে একটি মেয়ে বসে, জানালার বাইরে বৃষ্টি দেখছে।

“জামাইবাবু, আমার নাম কী?”

মেয়েটি উঠে দাঁড়ায়। পেছন ফিরে দ্রুত ওর কাছে আসতে থাকে। অন্ধকার পেরিয়ে আলোয় পড়ে স্পষ্ট হয় মেয়েটির মুখ আর সঙ্গে সঙ্গেই অনেক দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে যায় তমালের চোখে। এই মেয়েটিই, এই মেয়েটির মুখই মনের ভেতর থাকা বিভিন্ন কোলাজের ফাঁকা দৃশ্যে নিজের জায়গা করে নেয়।

“জামাইবাবু, আমার নাম কী?”

মন্ত্রের মতো তমালও জিজ্ঞেস করে, “তোমার নাম কী?”

মেয়েটি একদম কাছে চলে এসেছে। কী শান্ত, স্নিগ্ধ হাসি।

তমাল শুনতে পায় ছেলেটি বলছে, “আমি প্রদীপ্ত, আর এই হচ্ছে আমার দিদি আর তোমার স্ত্রী, নাম রূপকথা।”

রূপকথা আলতো করে তমালের হাত ধরে। জানালার দিকে এগোয় রূপকথা, সঙ্গে তমালও।

তমালের খেয়াল হয় রেডিওতে একটি গান চলছে,

“পুরানো সেই দিনের কথা, ভুলবি কী রে…”