নিউ বেঙ্গল ● সুমিত বর্ধন


 

না। বেশি ফেনাব না। এই গল্পটা হয়ত আপনি পড়ছেন লোকাল ট্রেনের হ্যাণ্ডেলে ঠেস দিয়ে, স্টেশন এলেই একটু বাদে নেমে পড়তে হবে। কিম্বা হয়ত অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে খেতে খেতে গল্পটায় চোখ বোলাচ্ছেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার বসতে হবে কাজে। অথবা হয়ত আর খানিক বাদেই আপনি কোনো জরুরী দরকারে বাইরে যাবেন। তার মধ্যে যেটুকু পড়া যায় পড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

মানে মোদ্দা কথা, আপনি বা আপনাদের হাতে সময় সীমিত। সাধারণত কাহিনিতে যেভাবে রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা, চরিত্র চিত্রণ কিম্বা পটভূমিকা লেখা হয় সেই সব পড়ার মত আপনার বা আপনাদের এই মুহূর্তে ধৈর্য নেই।

অতএব সোজা কাজের কথায় আসি। এই গল্পটা আপনি বা আপনাদের মতোই কাউকে নিয়ে। কারণ এই গল্পে যা যা ঘটবে সে সব আপনার সঙ্গেও ঘটতে পারে। ঘটবেই তার কোনো গ্যারান্টি নেই, তবে ঘটাটাও অসম্ভব নয়।

এই কাহিনির একটি চরিত্রের নাম ধরা যাক সুশান্ত রায়। ধরে নিন আপনিই সুশান্ত রায়। আপনার বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে, গড়পড়তা বাঙালির মতো চেহারা, এক ঘণ্টা ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে কলকাতায় একটা অফিসে একটা মাঝারি মাইনের চাকরি করতে আসেন। আপনার মা বাপ নেই। ভাই বোনও নেই। আপনাকে দেখতে এমন কিছু স্মার্ট বা হ্যাণ্ডসাম নয় যে কেউ প্রেমে পড়ে আপনাকে বিয়ে করবে আর আপনার উপার্জনও এমন নয় যে কেউ সচ্ছল সংসারের আশায় আপনার সঙ্গে ঘর বাঁধবে। অতএব আপনার স্ত্রীও নেই।

আপনার রোজের রুটিন খুব সাধারণ। আপনি সকালে উঠে মুখ ধুয়ে এক কাপ চা বানান। অবশ্যই লিকার চা, কারণ দুধ আনা, জ্বাল দেওয়া ইত্যাদি ঝামেলার মধ্যে যাওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব নয়। চা খেয়ে, চান করে অফিস যাওয়ার পোষাক পরে আপনি স্টেশনে আসেন। সেখানে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে টোস্ট আর ডিম সেদ্ধ দিয়ে প্রাতরাশ সম্পন্ন করেন। এরপর আপনি ট্রেন ধরে শিয়ালদা আসেন, শিয়ালদা থেকে বাস ধরে অফিস যান। দুপুরবেলা আহারটা আপনি অফিসের ক্যান্টিনে মোটা চালের ভাত, পাতলা ডাল, সবজির ঘ্যাঁট ও এক চিলতে মাছ দিয়ে করেন। বাড়ি ফেরার পথে স্টেশন থেকে রুটি তরকারি কিনে নিয়ে যান, বাড়ি ফিরে একটা সবজি রাঁধেন এবং রুটি সবজি খেতে খেতে টিভি দেখেন। আপনার জীবন এক অর্থে বর্ণহীন, বৈচিত্রহীন এবং নিস্তরঙ্গ।

হ্যাঁ, তবে আপনার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আপনি কোনো ঘটনা ভোলেন না। একদম না। সেটা ছ’বছর পুরোনো হোক বা ছ’ঘণ্টা। গত বছর পাড়ার পুজোর বিচিত্রানুষ্ঠানে কার পর কে গান করেছিল, কিম্বা এক সপ্তাহ আগে স্টেশনে বসে সেনগুপ্তদা কী ম্যাগাজিন পড়ছিলেন, অথবা তিনমাস আগে অফিসের ফাইলটা কার কাছে পাঠানো হয়েছিল আপনাকে কেউ জিজ্ঞাসা করলে আপনি এক সেকেন্ডের মধ্যে বলে দিতে পারেন। অবশ্য এই সব কথা আপনাকে কেউ জিজ্ঞাসা করতে যায় না, এবং আপনিও বলতে যান না। অল্প বয়সের দু-একটা ঘটনায় আপনি হাত পুড়িয়ে শিখেছেন যে মানুষ যা বুঝতে পারে না তাকে ভয় পায়, এবং যাকে ভয় পায় তাকে হিংস্রভাবে দল বেঁধে আক্রমণ করে।

হারানো ডকুমেন্ট খুঁজে দিতে পারেন বলে অফিসে আপনার সামান্য সুনাম আছে। কোনো দরকারি কাগজ খুঁজে না পাওয়া গেলে খুঁজে দেওয়ার জন্যে আপনার ডাক পড়ে, এবং খুঁজে দিলে সেদিন আপনার ভাগ্যে দু-একটা প্রশংসাবাক্য কিম্বা পিঠ চাপড়ানি জোটে। এ ছাড়া এ ক্ষমতা আপনার আজ পর্যন্ত তেমন কোনো কাজে লাগেনি।

গত সাত দিন হল আপনি মোবাইলে একটি মেসেজ পাচ্ছেন। যার মূল বক্তব্য, একটি বিশেষ অ্যাপ ডাউনলোড করে যদি একটা গেম খেলেন, এবং যদি জিততে পারেন, তাহলে আপনি কিছু পুরস্কার পাবেন।

খবরের কাগজ ও টিভির দৌলতে আপনি জানেন যে মোবাইলে এই ধরণের নানা স্ক্যাম হয়। তাছাড়া মোবাইলে গেম খেলাতে আপনার বিন্দুমাত্র ইন্টারেস্ট নেই। অতএব মেসেজগুলো আপনি ডিলিট করে দিয়েছেন। কিন্তু তিনদিন হল আপনি দেখছেন এই গেমের বিজ্ঞাপনের হ্যান্ডবিল শিয়ালদা স্টেশনের কাছে কয়েকটা ল্যাম্পপোস্টের গায়ে সাঁটা। এবং চতুর্থদিন সকালে অফিসের পাড়ায় একটা আধছেঁড়া ফ্লেক্সের ব্যানারেও একই বিজ্ঞাপন দেখেছেন।

কিঞ্চিৎ কৌতূহলী হয়ে একদিন আপনি অফিসে কাজের ফাঁকে গেমটা ডাইউনলোড করলেন। আপনাকে আশ্বস্ত করে অ্যাপটা আপনার ব্যাঙ্কের ডিটেলস, আপনার জন্ম তারিখ বা আপনার ডেবিট কার্ডের পিন, এসব কিছুই জানতে চাইল না। দুপুরবেলা টিফিনটাইমে আপনি গেমটা চালালেন এবং দেখলেন সেটা একটা মেমরি গেম। গেমটা আপনাকে খুব তাড়াতাড়ি পরপর দশটা ফুলের ছবি দেখালো এবং যা যা ফুল দেখেছেন একটা চার্টে সেগুলো ঠিক সেই একই শৃঙ্খলায় পরপর টিক মার্ক দিতে বলল। নির্ভুলভাবে আপনার কাজটা করতে এক সেকেন্ডও লাগল না। গেম এবার আপনাকে দশটার জায়গায় কুড়িটা ফুল দেখালো। আপনি সে খেলাটাও জিতলেন। গেম এবার ধাপে ধাপে বাড়িয়ে বাড়িয়ে ফুলের সংখ্যা একশো অবধি নিয়ে গেল। আপনি অনায়াসে সব কটা জিতলেন।

এরপর মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে বড়বড় অক্ষরে ফুটে উঠল ‘গেম ওভার’, এবং আপনার মেসেজ বক্সে ‘পিং’ শব্দ করে একটা মেসেজ ঢুকল। মেসেজ পড়ে দেখলেন তাতে অফিস পাড়ায় ‘নিউ বেঙ্গল জেনারেল স্টোর্স’ নামক একটি দোকানের নাম ঠিকানা দিয়ে বলা হয়েছে আপনার পুরস্কারটি সেখান থেকে নিয়ে নিতে।

আপনি অফিসের পর নিউ বেঙ্গল জেনারেল স্টোর্সে গেলেন, এবং দুরুদুরু বক্ষে কাউন্টারে বসা লোকটার দিকে আপনার মোবাইলটা বাড়িয়ে ধরলেন। আপনি মনে মনে ভেবেই গিয়েছিলেন যে অ্যাপের মেসেজটি ভুয়ো, এবং হয় আপনি সটান গলাধাক্কা খাবেন আর নয় নানা প্রশ্নে জর্জরিত হবেন।

কিন্তু সে সব কিছুই হল না। কাউন্টারে বসা লোকটা নির্লিপ্ত মুখে কাউন্টারের তলা থেকে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট আপনার হাতে তুলে দিলো। আপনি প্যাকেটের মধ্যে উঁকি মেরে দেখলেন তাতে একটা টুথপেস্ট, একটা সাবান আর একটা ছোট তোয়ালে রয়েছে।

এ সমস্ত এমন কিছু মহার্ঘ বস্তু নয়, কিন্তু জীবনে এই প্রথম কিছু জেতার স্বাদ পেয়ে আপনি একেবারে লাখটাকা জেতার আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।

পরের দিন অফিসে ঢুকেই খেয়াল করলেন আপনি আর একটি মেসেজ পেয়েছেন যাতে বলা হয়েছে আপনি যদি গেমের সেকেন্ড লেভেল খেলতে চান তাহলে আপনাকে অ্যাপটাকে আপডেট করতে হবে। টিফিনের সময় আপনি অ্যাপ আপডেট করলেন, এবং গেমটা চালু করলেন। এবারে গেম আপনাকে আগের দিনের মতই পরপর কয়েকটা ছবি দেখাল, তবে এবারে কেবল ফুল নয়, ফুলের সঙ্গে কিছু বিভিন্ন আকারের পাতার ছবিও দেখাল। তবে তাতে আপনার কোনো অসুবিধে হল না, আপনি খেলাটা জিতলেন। কেবল প্রথম খেলাটা নয়, তার পরের সব কটা খেলা আপনি জিতলেন, এবং দিনের শেষে নিউ বেঙ্গল জেনারেল স্টোর্স থেকে প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে একট শ্যাম্পু, একটা শেভিং ক্রিম আর এক প্যাকেট বিস্কুট নিয়ে দিগ্বিজয়ীর গর্বে বাড়ি ফিরলেন।

এর পর টানা কয়েকদিন ধরে আপনি গেম আপডেট করলেন, গেম জিতলেন এবং হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ ঝুলিয়ে নিত্য নতুন জিনিষ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন।

তবে এক সপ্তাহ চলার পর আপনার এই নতুন রুটিনে কিছুটা ছেদ পড়ল। একদিন গেম জিতে অফিসের পর আপনি নিউ বেঙ্গল জেনারেল স্টোর্সের কাউন্টারে গিয়ে মোবাইলটা দেখালেন। কিন্তু লোকটা আপনাকে প্যাকেট না ধরিয়ে দোকানের পেছন দিকে একটা দরজা দেখিয়ে বলল, “ভেতরে যান।”

দরজার পেছনে একটা ছোট্ট ঘর। ঘরে আর কোনো জানলা দরজা নেই, নোনা ওঠে দেওয়ালে একটা পুরোনো টিউবলাইট টিমটিম করে কোনোমতে আলো দিচ্ছে। একটা স্টিলের টেবিলের পেছনে একজন বসে। বয়েস পঞ্চাশ পঞ্চান্ন হবে, মাথায় হাল্কা টাক, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। আপনি ঢুকতেই ‘বসুন, বসুন’ বলে টেবিলের সামনে পাতা একটা প্লাস্টিকের চেয়ার দেখিয়ে দিলেন।

আপনি চেয়ার টেনে বসলেন। ভদ্রলোক টেবিলের ওপর একটা সোনালী কাগজে মোড়া আর লাল ফিতে দিয়ে বাঁধা বাক্স আপনার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “আমাদের মার্কেটিং ক্যাম্পেনে অংশগ্রহণ করার জন্যে নিউ বেঙ্গল মার্কেটিং এজেন্সীর পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। ক্যাম্পেনের শেষে এই আকর্ষণীয় গিফট হ্যাম্পারটি আপনার হাতে দিতে পেরে আমরা আনন্দিত।”

উপহারটা আপনি নিলেন বটে, কিন্তু ‘শেষ’ শব্দটা আপনার মনের মধ্যে একটু খচখচ করে উঠল। আপনি উপলব্ধি করলেন যে কদিনে গেমটা থেকে আপনি আসলে যা পেয়েছেন তা উপহারের নামে বেলানো কয়েকটা টুকিটাকি গৃহস্থালীর জিনিষ নয়, আপনার বৈচিত্র্যহীন জীবনে নিয়ে আসা এক ঝলক পরিবর্তনের হাওয়া। সুতরাং ‘শেষ’ শব্দটা আপনাকে বেশ কিছুটা মনঃপীড়া দিল।

আপনি আপনার গিফট প্যাক নিয়ে উঠতে যাচ্ছেন, টেবিলের উল্টোদিকে বসা ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করে বললেন, “আমাদের আর একটা ক্যাম্পেন শুরু হতে যাচ্ছে। আপনি কি অংশগ্রহণে ইচ্ছুক?”

আপনি হাতে চাঁদ পেয়ে “হ্যাঁ, হ্যাঁ” বলে বসে পড়লেন। ভদ্রলোক ড্রয়ার খুলে আপনার হাতে একটা কার্ড দিলেন। আপনি পড়ে দেখলেন কার্ডে লেখা আছে ‘তরুণ সমাদ্দার / নিউ বেঙ্গল মার্কেটিং এজেন্সী’।

তরুণ সমাদ্দার টেবিলের ওপর হাতদুটো জড় করে আপনার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, “আমাদের পরের ক্যাম্পেনটাও এক ধরণের গেম, তবে সেটা অনলাইন হবে না, আপনাকে আমাদের সাইটে আসতে হবে।”

আপনি কপাল কুঁচকোলেন। আপনি চেনা গণ্ডির বাইরে বেরোন না। অনলাইন গেম একরকম, আর কোথাও ট্রেন বাসের ভিড় সামলে যাওয়া আর এক কথা।

তরুণ সমাদ্দার হয়ত আপনার মুখ দেখে মনের কথাটা আঁচ করতে পেরেছিলেন, তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হয়ে বললেন, “না, না, আপনাকে একা আসতে হবে না। আপনি কাল দুপুরে এখানে চলে আসুন, এখান থেকে বাস ছাড়বে। অনেকে যাবে।”

‘অনেকে যাবে’ শুনে আপনি একটু আশ্বস্ত হলেন। আপনি একা একা কোথাও গিয়ে ফ্যাসাদে পড়বেন তার সম্ভাবনা কম। তাও আপনি একটু ইতস্তত করে জানতে চাইলেন আপনাকে ঠিক কী করতে হবে।

“ওই আপনি এতদিন যা করছিলেন মোবাইলে, সেই একই জিনিষ। মেমরি গেম। আপনাকে একটা প্রব্লেম সল্ভ করতে হবে। তবে একা নয়, দু-তিনজনে মিলে। আজ আপনি মোবাইলে একটা ভিডিও ক্লিপ পাবেন। যদি আসেন, তাহলে আসার আগে ক্লিপটা দেখে নেবেন।”

আপনি ঘাড় নেড়ে বিদায় নিলেন।

বাড়ি ফিরে আপনি একটু দোটানার মধ্যে রয়েছেন, নিউ বেঙ্গল মার্কেটিং এজেন্সীর ক্যাম্পেনে যাবেন কি যাবেন না ভাবছেন, এমন সময়ে আপনি মেসেজে একটা ভিডিও ক্লিপ পেলেন।

ক্লিপটা আপনি চালিয়ে দেখলেন। সাদা কালো নির্বাক ছবি, শোঁ শোঁ শব্দ ছাড়া আর কোনো আওয়াজ নেই।

ক্লিপের শুরুতে দেখা গেল একটা খালি ঘর, দুটো টেবিল ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। তার মধ্যে একটা টেবিল খালি, আর অন্যটাতে কিছু যন্ত্রাংশ স্তূপাকার করা রয়েছে।

এইবার ক্যামেরার দিকে মুখ করে একজন এসে দাঁড়াল। গায়ে সাদা ল্যাব কোট, মাথায় অল্প টাক, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। লোকটাকে আপনার কেমন চেনা চেনা লাগল, কিন্তু ক্লিপের ভিডিও কোয়ালিটি খুব একটা ভালো নয়, আপনি ঠিক ধরতে পারলেন না।

ক্লিপের লোকটা এবার একটা টেবিলে থেকে একটা করে যন্ত্রাংশ ক্যামেরার সামনে তুলে ধরতে লাগল আর পাশের টেবিলে নিয়ে গিয়ে সেগুলো ঘাটে ঘাটে বসিয়ে জোড়া দিতে লাগল।

একটা টেবিলের সবকটা যন্ত্রাংশ শেষ হয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল অন্য টেবিলে একটা অদ্ভুত দর্শন যন্ত্র দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটা চৌকো বাক্স, তার গায়ে একটা মান্ধাতার আমলের পেটমোটা টিভি স্ক্রিন। স্ক্রিনের চারপাশে অজস্র ডায়াল, সুইচ, আর নব। বাক্সের মাথা থেকে একটা চোঙ সামনের দিকে উঁচিয়ে আছে, তার দুপাশে দুটো আলো। বাক্সের সামনে টাইপরাইটারের মত গোটা দশেক নম্বর বসানো গোল চাবি।

যন্ত্র তৈরি সম্পূর্ণ হতে লোকটা হাতজোড় করে নমস্কার করল, বড়বড় সাদা অক্ষরে ইংরেজিতে ফুটে উঠল ‘কোয়ন্টাম এন্টেগেলমেন্ট কমিউনিকেটর’। এরপর ক্লিপ শেষ হয়ে গেল।

আপনি যাবেন কি যাবেন না তা নিয়ে আপনার মনে যেটুকু দ্বিধা ছিল ভিডিও ক্লিপের অদ্ভুত যন্ত্রটা দেখে সেটা বেমালুম উবে গেল।

পরের দিন টিফিনের সময় অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আপনি নিউ বেঙ্গল জেনারেল স্টোর্সের সামনে থেকে বাসে চড়ে বসলেন।

এই হল এই সুশান্ত রায় অর্থাৎ আপনার কাহিনির প্রথমার্ধ।

 

এইবার আর একজন চরিত্রের কথায় আসি। এই চরিত্রটির নাম ধরা যাক, পূর্বা সেন। আপনার বয়স যদি চৌত্রিশ পঁয়ত্রিশ হয়, আপনি যদি নিঃসন্তান এবং অবিবাহিতা হন তাহলে আপনিই হয়ত পূর্বা সেন। আপনি কর্পোরেট অফিসে উঁচু পদে কাজ করেন, অভিজাত অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন, নিজে ড্রাইভ করে অফিস যান, এবং সপ্তাহান্তে ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে দামী স্কচ খান। ইচ্ছে হলে পুরুষের সঙ্গ করেন বটে, কিন্তু সে সম্পর্ক দু-এক রাতের বেশি, এবং বেডরুমের বাইরে গড়ায় না। সমাজ মেয়েদের যে সমস্ত নিয়মের মধ্যে বাঁধতে চেয়েছে, তার কোনোটারই আপনি তোয়াক্কা করেন না। সুতরাং প্রত্যাশিতভাবেই আপনি নিঃসঙ্গ ও বন্ধুহীন। পুরুষরা আপনার স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গীকে ভয় পায়, মহিলারা আপনাকে দেখে হীনমন্যতায় ভোগে। দুইটি শ্রেণীই আপনাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে। আপনার আত্মীয়স্বজনও আপনাকে এড়িয়ে চলে কারণ তাদের মতে তাদের সমাজে মুখ দেখাতে হয়, এবং, অবশ্যই তাদের মতে, তাদের ছেলে মেয়েদের কাছে আপনি একটি অত্যন্ত খারাপ উদাহরণ।

অফিসের বাইরে আপনার সামাজিক জীবন বলতে যেহেতু বিশেষ কিছু নেই, আপনি বই পড়েন। আপনাকে বইপোকা বললে কম বলা হয়, বরং বই-দাবানল বললে হয়ত আপনার সঠিক মূল্যায়ন হয়। কারণ কাগজে আগুন ধরার গতিতে আপনি বই পড়েন। এই বইয়ের নেশায় আপনার অ্যাপার্টমেন্টটি একটি লাইব্রেরি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং আজকাল স্থান সঙ্কুলানের অভাব দেখা দেওয়াতে আপনি বাধ্য হয়ে ইবুকের দিকে ঝুঁকেছেন।

এই বই পড়ার নেশার বাইরে আপনার একটি বিশেষ ক্ষমতা আছে। আপনি যে বই যতদিন আগেই পড়ে থাকুন না কেন, আপনি তার কিছুই ভোলেন না। কোনো বই থেকে উদ্ধৃতি দিলে আপনি বইয়ের নাম, বইয়ের লেখক, বিষয়বস্তু এমনকি কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত একেবারে হুবহু বলে দিতে পারেন।

এই বইয়ের নেশা থেকেই আপনার এই কাহিনীতে পদক্ষেপ। যেহেতু আপনি মুড়ি মুড়কির মত বই কিনে থাকেন তাই আপনি সময় পেলেই বেশ কয়েকটা অনলাইন বুক রিভিউ সাইটে ঘোরাফেরা করে থাকেন। এইরকম কয়েকটা সাইটে আপনি দিনকয়েক ধরে একটা বিজ্ঞাপন দেখতে শুরু করলেন, যার মর্ম হল যে যদি আপনি নিউ-বেঙ্গল-বুকস ডট ইন সাইটে গিয়ে একটি বই বিষয়ক গেম খেলেন তাহলে আপনি জিতলে অ্যামাজন কিন্ডলের জন্য বই কেনার ডিসকাউন্ট পাবেন।

আপনি প্রথমে কিছুটা দ্বিধায় ছিলেন, কারণ আপনার আগের অভিজ্ঞতা হল যে সাধারণত এই ধরণের ডিসকাউন্টে যে বইগুলো পাওয়া যায় সেগুলো একেবারে রদ্দি।

কিন্তু তিন চারদিন ধরে পরপর একই বিজ্ঞাপন দেখে, শেষ পর্যন্ত, ‘দেখাই যাক না’ গোছের একটা মনোভাব নিয়ে আপনি নিউ-বেঙ্গল-বুকস ডট ইন নামক সাইটটাতে রেজিস্টার করলেন।

সাইট আপনার নাম, ইমেল ইত্যাদি নেওয়ার পর আপনাকে আপনার পছন্দের দশটা বইয়ের নাম দিতে বলল। আপনি বইয়ের নাম দেওয়ার পর আপনাকে কুড়িটা উদ্ধৃতি দেখাল, এবং কোন বই থেকে কোন উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে জানতে চাইল। আপনি অনায়াসে উত্তর দিলেন। এরপর আপনার কাছে আরো দশটা বইয়ের নাম চাওয়া হল এবং কুড়িটা বই থেকে চল্লিশটা উদ্ধৃতি তুলে দিয়ে এবারও আপনার কাছে বইয়ের নাম জানতে চাওয়া হল। তাচ্ছিল্য ভরে আপনি এটাও করে ফেললেন। এইভাবে তিন চার দফায় বইয়ের নাম আর উদ্ধৃতির সংখ্যা বাড়ানো হল, এবং আপনিই প্রত্যেকবারই সাফল্যের সঙ্গে একশো শতাংশ ঠিক উত্তর দিলেন।

বার পাঁচেক খেলার পর স্ক্রীনে বড়বড় অক্ষরে ফুটে উঠল ‘ইউ উইন!’ এবং এরপর আপনি একটি ইমেল পেলেন। ইমেলে কিন্ডল বইয়ের একটি তালিকা, যার থেকে আপনি যে কোনো একটি কুড়ি পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে পেতে পারেন, এবং তার সঙ্গে ডিস্কাউন্ট কোড। আপনি চমৎকৃত হয়ে দেখলেন যে যা যা বই লিস্টে রয়েছে তার কোনোটাই খাজা নয়, বরং সাম্প্রতিক বেস্টসেলার। আপনি দেরি না করে চটপট কুড়ি পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে আপনার পছন্দের বইটা আমাজন থেকে কিনে ফেললেন।

পরেরদিন আপনি আবার একটা ই-মেল পেলেন, যাতে জানতে চাওয়া হয়েছে আপনি গেমের দ্বিতীয় লেভেল খেলতে ইচ্ছুক কিনা। তার সঙ্গে সাইটের লিংক।

আপনি আগের দিনের বইয়ের লিস্টে অনেক ভালো ভালো বই দেখেছেন, যার মধ্যে মাত্র একটাই আপনার হস্তগত হয়েছে, সুতরাং আপনি এক সেকেন্ডও নষ্ট না করে লিংকে ক্লিক করে দিলেন।

এবারের সাইটে খেলা কিছুটা শক্ত করে দিল। উদ্ধৃতির বদলে বই থেকে অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে তার মধ্যে কোথায় ভুল আছে দেখাতে বলল। আপনার পক্ষে কাজটা জলভাত, আপনি কয়েক মিনিটের মধ্যে ভুলগুলো সব খুঁটিয়ে বের করে ফেললেন। এবং উত্তরোত্তর খেলাটা শক্ত হতে থাকলেও আপনি খেলতেই থাকলেন এবং জিততেই থাকলেন যতক্ষণ না আগের দিনের মত স্ক্রিনে বড়বড় অক্ষরে ‘ইউ উইন!’ ফুটে উঠল। এবারেও আপনিও ইমেলে বইয়ের তালিকা পেলেন এবং তিরিশ পার্সেন্ট ছাড়ে বই কেনার ডিসকাউন্ট কোড।

এরপর বেশ কিছুদিন ধরে আপনি নিউ-বেঙ্গল-বুকস ডট ইন সাইটে গিয়ে গেম খেললেন এবং সস্তায় বই কিনলেন। গেমের কাঠিন্য প্রতিদিন বাড়ল এবং সমানুপাতিক হারে বাড়ল ডিসকাউন্টের মাত্রা।

তার পর এল গেমের শেষ দিন। সেদিন আপনি গেম শেষ করে ভাবছেন গেম সাইট আপনাকে কত ডিসকাউন্ট দেবে, কারণ তার আগের দিনই আপনি নব্বই পার্সেন্ট ডিসকাউন্টে বই কিনেছেন। কিন্তু সেদিনে ইমেলে কোনো ডিসকাউন্ট কোড এল না। তার বদলে ইমেলে আপনি যা পড়লেন তার মর্মার্থ হল যে এই শেষ লেভেল জেতার পুরষ্কার হিসেবে আপনাকে নিউ-বেঙ্গল-বুকস ডট ইন সাইট কিন্ডল বইয়ের ডিসকাউন্টের বদলে এক সেট হার্ডকভার বই দিতে চায়, এবং সেটা আপনাকে সাইটের মার্কেটিং অফিস থেকে নিয়ে যেতে হবে। ইমেলের শেষে বই নেওয়ার ঠিকানা দেওয়া রয়েছে, ‘নিউ বেঙ্গল ডিজিট্যাল মার্কেটিং, স্যাফায়ার টেকনো পার্ক’।

বইয়ের নাম দেখে আপনার চোখ কপালে উঠল, যা তা বই নয়, ফোলিও সোসাইটির প্রকাশিত কনান ডয়েল রচনাবলী, দামের কথা বাদ দিলেও, প্রায় দুষ্প্রাপ্য এডিশন।

এরপর গুগল ম্যাপে ঠিকানাটা চেক করলেন, দেখলেন স্যাফায়ার টেকনো পার্ক আপনার বাড়ি থেকে বেশি দূর নয়। খুব জোর ছ-সাত কিলোমিটার হবে।

ভালো কাজে আপনি দেরি করা পছন্দ করেন না। সুতরাং পরের দিন অফিস ফেরৎ সোজা স্যাফায়ার টেকনো পার্কের দশতলায় নিউ বেঙ্গল ডিজিট্যাল মার্কেটিঙের ঝকঝকে অফিসে গিয়ে হাজির হলেন। রিসেপশনের সুবেশা তরুণীটিকে আপনার মোবাইলে ইমেলটা দেখাতেই আপনাকে সঙ্গে করে কাচের দেওয়ালে ঘেরা কনফারেন্স রুমে বসিয়ে দিল। এক মিনিটের মাথায় অফিস বয় আপনার সামনে গরম কফি এবং কুকিজের প্লেট নামিয়ে দিয়ে গেল, এবং তিন মিনিটের মাথায় “সরি টু কিপ ইউ ওয়েটিং ম্যাডাম” বলতে বলতে একটা সুদৃশ্য কাগজের ব্যাগ হাতে একজন ঘরে ঢুকলেন।

আপনি দেখলেন ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশ পঞ্চান্ন হবে, মাথায় অল্প টাক, পরনে ম্যানেজারের মতো ফিটফাট ধোপদুরস্ত পোষাক, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। ঘরে ঢুকে আপনার দিকে ব্যাগটা বাড়িয়ে ধরে তিনি বললেন, “নমস্কার ম্যাডাম। আমি তরুণ সমাদ্দার। আমাদের ওয়েব মার্কেটিং ইভেন্টে পার্টিসিপেট করার জন্য আপনাকে নিউ বেঙ্গল ডিজিট্যাল মার্কেটিঙের তরফ থেকে অনেক ধন্যবাদ। এই রইল আপনার লাস্ট গেমের প্রাইজ।”

আপনি তরুণ সমাদ্দারের হাত থেকে ব্যগটা নিলেন বটে, কিন্তু ‘লাস্ট গেম’ কথাটা আপনার মনের মধ্যে একটু খচখচ করতে লাগলো। আপনি হঠাৎ অনুধাবন করলেন যে গেমটা আপনি বইয়ের ওপর ডিসকাউন্টের জন্যে খেলছিলেন না। কারণ আপনি যা রোজগার করেন তাতে ওই কটা পয়সা বাঁচানোর আপনার কোনো তাগিদ নেই। ছুরির কাছে যেমন শান পাথর, আপনার কাছে গেমটাও ছিল তেমনই। অর্থাৎ নিজের ক্ষমতাতে ধার দেওয়ার একটা সুযোগ। গেমটা শেষ হয়ে যাওয়াতে আপনার পুরষ্কার পাওয়ার তৃপ্তির মধ্যেও কেমন একটা অতৃপ্তি খোঁচা দিতে লাগল।

আপনি পুরষ্কারের ব্যাগটা নিয়ে উঠয়ে যাচ্ছেন, তরুণ সমাদ্দার একটু ইতস্তত করে বললেন, “ম্যাডাম, আমাদের আর একটা মার্কেটিং ইভেন্ট শুরু হতে যাচ্ছে। আপনি কি পার্টিসিপেট করতে ইচ্ছুক?”

আপনি কপাল কুঁচকে জানতে চাইলেন, “কী ধরণের ইভেন্ট? যে রকম গেম খেললাম সেই রকম?”

টেবিলের ওপর দু’হাত জড় করে রেখে তরুণ সমাদ্দার বললেন, “না, ম্যাডাম। এটা অনলাইন গেম নয়, প্রব্লেম সলভিং টিম ইভেন্ট। তবে ওই অনলাইন গেমের মতোই স্মৃতিশক্তি নির্ভর।

‘প্রব্লেম সলভিং’, ‘স্মৃতিশক্তি’ এই সব শব্দ শুনে আপনার ইন্টারেস্ট আবার চাগিয়ে উঠল। ইভেন্ট থেকে আপনার কী লাভ হবে, আপনি কী পাবেন সে সব কথা জানতে চাইলেন না। কেবল জিজ্ঞাসা করলেন ইভেন্ট কবে হবে, এবং এই অফিসেই হবে কিনা।

“না ম্যাডাম” সামান্য হাত কচলে জবাব দিলেন তরুণ সমাদ্দার, “এই অফিসে জায়গা নেই। শহরতলীতে আমাদের আর একটা ফেসিলিটি আছে, ইভেন্ট সেখানেই। ইভেন্ট পরশু হবে, দুটো নাগাদ বিল্ডিঙের সামনে যদি দাঁড়ান আমাদের বাস আপনাকে পিকআপ করে নেবে। আর ম্যাডাম, আজকে আপনি মেলে একটা ডকুমেন্ট পাবেন। যদি ইভেন্টে যোগ দিতে আসেন তাহলে ডকুমেন্টটা একবার পড়ে নেবেন।”

আপনি যাবেন কি যাবেন না ভাবতে ভাবতে কিছুটা দোটানার মধ্যেই বাড়ি গেলেন।

রাত্রের দিকে আপনি নিউ বেঙ্গল ডিজিট্যাল মার্কেটিঙের কাছ থেকে একটা ইমেল পেলেন। মেলের সঙ্গে অ্যাটাচ করা একটা পিডিএফ ডকুমেন্ট।

ডকুমেন্ট খুলে দেখলেন তার মাথায় বড়বড় অক্ষরে লেখা ‘কোয়ন্টাম এন্টেগেলমেন্ট কমিউনিকেটর’। নিচে একটা অদ্ভুত দর্শন যন্ত্রের ছবি। একটা চৌকোণা বাক্সের গায়ে একটা মান্ধাতার আমলের পেটমোটা টিভি স্ক্রিন বসানো। তাকে ঘিরে অজস্র ডায়াল, সুইচ, আর নব। স্ক্রিনের ওপরে বাক্সের মাথা থেকে একটা চোঙ সামনের দিকে বেরিয়ে আছে। চোঙের দু’পাশে এক সারি আলো বসানো। বাক্সের সামনে টাইপরাইটারের মত খান দশেক গোল চাবি।

ছবিতে সেই সব ডায়াল, সুইচ, আর নবের পাশে পাশে এক দুই করে নম্বর দেওয়া, আর ছবির নিচে আবার এক দুই নম্বরের পাশে পাশে কিছু নম্বর আর অন, অফ, ইত্যাদি লেখা। একবার চোখ বুলিয়েই আপনি বুঝলেন যন্ত্রের নিচে নম্বরের পাশে যা লেখা আছে তা ওই যন্ত্রের সেটিং।

কোয়ন্টাম এন্টেগেলমেন্ট কমিউনিকেটর কাকে বলে সে সম্বন্ধে আপনার বিন্দু বিসর্গ ধারণা নেই। কিন্তু ছবিটা দেখে আপনার কৌতূহল চরমে উঠল, এবং আপনার নিউ বেঙ্গল ডিজিট্যাল মার্কেটিঙের টিম ইভেন্টে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে যেটুকু দ্বিধা ছিল কেটে গেল।

দিন দুয়েক বাদে আপনি দুপুর দুটো নাগাদ স্যাফায়ার টেকনো পার্কের সামনে থেকে ‘নিউ বেঙ্গল’ লেখা একটা বাসে চড়ে বসলেন।

এই হল আপনার অর্থাৎ পূর্বা সেনের কাহিনির প্রথমার্ধ।

 

এই গল্পের তৃতীয় চরিত্রের নাম যূথিকা দাস। আপনার বয়স যদি পঁয়ষট্টি থেকে সত্তরের মধ্যে হয়, আপনি যদি বছর কয়েক আগে আপনার স্বামীকে হারিয়ে থাকেন, এবং আপনার ছেলেমেয়েরা যদি বিদেশে বসবাসকারী হয়, তাহলে আপনিই হয়ত যূথিকা দাস।

আপনি অত্যন্ত হাসিখুশী মিশুকে স্বভাবের মানুষ, পাড়ায় আপনি কারোর মাসিমা, কারোর কাকিমা, কারোর দিদা। আপনি লোকের বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন, পাড়ার মহিলাদের নিয়ে আপনি দুঃস্থ বাচ্ছাদের জন্যে একটা কল্যাণ সমিতি চালান, আপনাকে সবাই একডাকে চেনে। বর্তমানে আপনি সংসারে একা বটে, কিন্তু নিঃসঙ্গ নন। বসুধৈব কুটুম্বকম প্রবাদটি আপনার প্রতিটি কাজে প্রতিফলিত হয়।

কিন্তু আপনার এই সহজ, অনাড়ম্বর জীবনের পেছনে যে একটা ক্ষুরধার গাণিতিক মেধা লুকিয়ে আছে সেটা কেউ জানে না। জানে না, কারণ আপনি আপনার এই ক্ষমতার কথা চিরকাল সযত্নে সবার কাছে লুকিয়ে এসেছেন, কাউকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেননি।

এর পেছনে একটা ইতিহাস আছে। আপনার বাবা মা দু’জনেই ছিলেন অত্যন্ত খ্যাতনামা বৈজ্ঞানিক। তাঁদের জীবনের কেন্দ্র ছিল তাঁদের গবেষণা। তাঁদের রিসার্চ, সেমিনার, বিদেশ ভ্রমণের বাইরে সন্তানদের তাঁরা সময় দিতে পারতেন সামান্যই। সুতরাং ছোটবেলায় আপনি এবং আপনার ভাই মানুষ হন কাজের লোকের কাছে। এ নিয়ে আপনার ছোটবেলায় বাবা-মার প্রতি একটা ক্ষোভ ছিলই। কিন্তু তারপর আর একটা দুর্ঘটনা ঘটে। আপনার ভাই গুরুতর অসুস্থ হয়ে মারা যায়, এবং মারা যায় একা, কারণ সে সময়ে আপনার বাবা মা দু’জনেই বিদেশে ছিলেন।

এরপর থেকেই বাবা মার প্রতি আপনার ক্ষোভ তীব্র তিক্ততায় পরিণত হয়, এবং আপনি ঠিক তাঁদের উলটো পথে পথ হাঁটা শুরু করেন। বিদ্যা, যশ, খ্যাতির চাইতে আপনার কাছে সাংসারিক সুখের মূল্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আপনার মেধার জোরে চাইলেই একজন উঁচুমানের গণিতজ্ঞ হয়ে উঠতে পারতেন, কিন্তু তার বদলে আপনি বেছে নিলেন একটি অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত জীবন। আপনি নিজে যা থেকে ছিলেন বঞ্চিত, সেই সাংসারিক সুখ বিলোলেন দু’হাত ভরে।

কিন্তু কালের নিয়মে আপনার জীবনযাত্রায় কিছুটা ছেদ পড়ল। আপনার সন্তানেরা কেরিয়ারের সন্ধানে বিদেশে পাড়ি দিল। কিছুদিন বাদে হার্ট অ্যাটাকে আপনি আপনার জীবনসঙ্গীকেও হারালেন। যে সংসারকে দিয়ে আপনি নিজেকে এতদিন সংজ্ঞায়িত করে এসেছেন, সেটিই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ল। আপনার সন্তানেরা আপনাকে ভালবাসে, আপনার খোঁজ রাখে বটে, কিন্তু আপনি জানেন কালের নিয়মেই আপনি তাদের জীবনের কেন্দ্র থেকে সরে গেছেন।

অতীত নিয়ে আপনার কোনো ক্ষোভ নেই। আপনি অফুরন্ত ভালোবাসা বিলিয়েছেন, এবং অফুরন্ত ভালবাসা পেয়েছেন। কিন্তু আপনি জানেন সময়ের নিয়মে সব কিছুই একদিন ফুরিয়ে যায়। আপনার সংসারও তার ব্যতিক্রম নয়। জীবনের বাকি এক চতুর্থাংশে আপনি কী করবেন, সে নিয়ে আপনি মাঝে মধ্যে চিন্তা করেন।

এই কাহিনিতে আপনার প্রবেশ একটি ছোট বাচ্ছা মেয়ের হাত ধরে। কল্যাণ সমিতিতে যে সব বাচ্ছাদের আপনি এবং আপনার প্রতিবেশীনীরা পড়িয়ে থাকেন তাদেরই একজন একদিন আপনার কাছে একটা প্যামফ্লেট নিয়ে এল। খবরের কাগজের ভাঁজের ভেতর নাকি রাখা ছিল।

আপনি দেখলেন সস্তা গোলাপী কাগজে ছাপা একটা বিজ্ঞাপন। ওপরে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘অঙ্কের ধাঁধা’। তার নিচে আর একটু ছোট অক্ষরে লেখা ‘পুরস্কার - এক প্যাকেট এক্লেয়ার্স চকলেট’। একদম তলায় বিজ্ঞাপনদাতার নাম - ‘নিউ বেঙ্গল ডিস্ট্রিবিউটার্স’। তার নিচে ঠিকানা ও ফোন নম্বর।

আপনি জানেন সাধারণত এই সব সস্তা কাগজে ছাপা বিজ্ঞাপনগুলো ভুয়ো হয়। পুরস্কার কিছুই দেয় না, উল্টে নানা অছিলায় টাকা চায়। কিন্তু বাচ্ছাটা ওই ‘পুরস্কার - এক প্যাকেট এক্লেয়ার্স চকলেট’ দেখেই কাগজটা আপনার কাছে নিয়ে এসেছে, আপনি তার ‘দিদা, এটা একটু করে দেবে’ উপরোধটা এড়াতে পারলেন না। অঙ্কের ধাঁধাগুলোর সমাধান কাগজটাতেই লিখলেন, তারপর কাগজের উল্টোপিঠে দেওয়া ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী মোবাইলে কাগজটার ছবি তুলে ছবি আর কল্যাণ সমিতির ঠিকানা নিউ বেঙ্গল ডিস্ট্রিবিউটার্সের নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপ করে দিলেন।

আপনি কিছু পাবেন আশা করেননি, কিন্তু আপনাকে আশ্চর্য করে দিয়ে দিন দুয়েক বাদে ক্যুরিয়ারে সত্যিই এক প্যাকেট এক্লেয়ার্স চকলেট এলো। কল্যাণ সমিতির বাচ্ছাগুলো সেদিন আনন্দ করে চকলেট খেলো।

নিউ বেঙ্গল ডিস্ট্রিবিউটার্স থেকে দিনদুয়েক বাদে আপনার আছে একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ এলো। মেসেজে জানানো হয়েছে নিউ বেঙ্গল ডিস্ট্রিবিউটার্স হোয়াটসঅ্যাপে একটা অঙ্কের গেম অর্গানাইজ করছে। এবং জানতে চাওয়া হয়েছে আপনি খেলতে ইচ্ছুক কিনা। বিজেতাদের জন্যে কিছু পুরস্কার থাকবে।

কয়েকদিন আগে বাচ্ছাদের মুখের খুশির চেহারাটা আপনার মনে আছে, সুতরাং আপনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ‘ইয়েস’ লিখে মেসেজ করে দিলেন।

তৎক্ষণাৎ আপনি আর একটা মেসেজ পেলেন। মেসেজে দুটো নয় অঙ্কের সংখ্যাকে গুণ করতে বলা হয়েছে এবং সময় ধার্য করে দেওয়া হয়েছে পাঁচ সেকেন্ড। আপনার গুণটা করে উত্তরটা ফেরৎ মেসেজ করতে তার অর্ধেক সময় লাগল।

সঙ্গে সঙ্গে আপনি আরো দুটো নম্বর পেলেন মেসেজে গুণ করার জন্যে। এবং তার উত্তর দেওয়ার পর আরো দুটো।

বার পাঁচেক এইরকম উত্তর দেওয়ার পর আপনি মেসেজ পেলেন, ‘আপনি জিতেছেন। আপনার পুরস্কার দু-একদিনের মধ্যেই পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’

এবং সত্যিই দিন দুয়েকের মাথায় কল্যাণ সমিতির ঠিকানায় ক্যুরিয়ারে দু-বোতল হরলিক্স এসে হাজির হল।

এর কয়েকদিন বাদে আপনি আবার মেসেজ পেলেন, এবং সময় ধরে ধরে বেশ কিছু শক্ত অঙ্কের উত্তর দিলেন। আপনার জেতার দুদিনের মাথায় ক্যুরিয়ারে এসে হাজির হল এক বাক্স চানাচুরের প্যাকেট।

প্রায় মাসখানেক ধরে চলল এই ব্যাপার। অঙ্কের প্রব্লেম বড় বড় গুণ ভাগ থেকে জ্যামিতি, আলজেব্রা, নাম্বার থিওরী সব কিছুই একবার করে ছুঁয়ে গেল।

টানা তিন মাস এই অঙ্কের খেলা এবং উপহারের পরম্পরা চলার পর, শেষ খেলাটির অন্তে আর ক্যুরিয়ারে কিছু এল না। তার বদলে এক বিকেলবেলা কল্যাণ সমিতি থেকে একটা বাচ্ছা এসে খবর দিল যে আপনার সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছে।

আপনি গিয়ে দেখলেন কল্যাণ সমিতির ঘরে এক ভদ্রলোক প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে রয়েছেন। বছর পঞ্চাশেক বয়স হবে, মাথায় অল্প টাক, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, মলিন জামাকাপড়, ক্লান্ত চেহারা। চেয়ারের পাশে একটা বোঝাই করা ক্যানভাসের ব্যাগ।

আপনাকে দেখে ভদ্রলোক শশব্যস্তে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে ব্যাগটা দেখিয়ে বললেন, “নমস্কার ম্যাডাম, আমি নিউ বেঙ্গল ডিস্ট্রিবিউটার্সের তরুণ সমাদ্দার। এই পুরস্কারটা পৌঁছতে এলাম।”

আপনি তরুণ সমাদ্দারকে, ‘সে হবে, আপনি বসুন তো’ বলে বসালেন, পাখা চালানো হয়নি কেন বলে কাউকে একটা মৃদু ধমক দিলেন, নিজের হাতে জগ থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে খাওয়ালেন, তারপর একটা চেয়ারে বসে জানতে চাইলেন, ক্যুরিয়ারে জিনিষ না পাঠিয়ে তিনি নিজে কেন এসেছেন।

“আসলে ম্যাডাম এত বড় ব্যাগ ক্যুরিয়ারে পাঠানো সমস্যা। আমাদের ক্যাম্পেনটা শেষ হয়ে গেল তো, তাই লাস্ট পুরস্কারটা একটু বেশি।”

‘লাস্ট’ শব্দটা আপনার মনের মধ্যে একটু খচখচ করে উঠল। আপনি উপলব্ধি করলেন যে হোয়াটসঅ্যাপে খেলাটা আপনি শুধু বাচ্ছাদের মুখ চেয়েই খেলছিলেন না। আপনার জীবনের অবশিষ্ট অংশটুকু নিয়ে আপনি কী করতে চান সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। খেলাটা শেষ হয়ে গেল শুনে আপনি মনে একটু ব্যাথা পেলেন। তবে সেটা মনের মধ্যেই চেপে রেখে, ‘এত সব কী দরকার ছিল’ বললেন, এত ভারি ব্যাগ বয়ে আনতে কষ্ট হয়েছে কিনা তরুণ সমাদ্দারের কাছ থেকে জানতে চাইলেন, এবং পাশের দোকান থেকে চা আনিয়ে খাওয়ালেন।

তরুণ সমাদ্দার চা খেয়ে উঠতে উঠতে একটু ইতস্তত করে বললেন, “ম্যাডাম, যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আমার একটা প্রস্তাব ছিল। সামনের সপ্তাহে আমাদের কোম্পানি একটা ইভেন্টের আয়োজন করছে। সেখানেও নানা ধাঁধাঁর খেলা থাকবে। অনেকে খেলতে আসবে। আপনি যদি আসতে পারেন তাহলে ভালো হয়।”

আপনি গতানুগতিকভাবে, ‘আমি বুড়ো মানুষ, একা কোথায় যাব’ ইত্যাদি বলার চেষ্টা করতেই, তরুণ সমাদ্দার একেবারে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, “আরে না না, আপনাকে একা আসতে হবে না। আমাদের বাসের ব্যবস্থা আছে। আপনি এই কেলাবের সামনে দাঁড়াবেন, আমাদের বাস এসে আপনাকে তুলে নিয়ে যাবে।”

আপনি বেশি চিন্তা করলেন না। কিছু হোক আর না হোক, কয়েকটা নতুন মানুষের সঙ্গে তো আলাপ হবে, এই ভেবে সঙ্গে সঙ্গেই হ্যাঁ বলে দিলেন।

তরুণ সমাদ্দার যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, “আমি তাহলে আপনাকে তারিখ আর সময় হোয়াটসঅ্যাপে জানিয়ে দেব।”

‘দেখেশুনে যেও’ বলে আপনি তরুণ সমাদ্দারকে বিদায় দিলেন, এবং প্রায় এক সপ্তাহ বাদে এক পড়ন্ত বিকেলে বাড়ির কাছে থেকে ‘নিউ বেঙ্গল’ লেখা বাসে চড়ে বসলেন।

এই হল আপনার অর্থাৎ যূথিকা দাসের কাহিনির প্রথমার্ধ।

 

আপনাদের সবার কাহিনির প্রথমার্ধ শেষ। এবার দ্বিতীয়ার্ধে আসি।

সুশান্ত, আপনি যখন নিউ বেঙ্গল জেনারেল স্টোর্সের সামনে থেকে বাসে চড়লেন, তখন বাস প্রায় খালি। দু-একজন এদিকে ওদিক বসে আছে কেবল। আপনি একেবারে পেছনের সিটে একটা জানলার ধারে গিয়ে বসলেন। আপনার মনে আবার একা যাওয়ার ভয়টা একবার খোঁচা দিয়ে উঠল।

তবে বাস চলতে আরম্ভ করল, আর পথেও নানা লোক উঠতে আরম্ভ করল। আপনারও কোথাও একা একা গিয়ে ফ্যাসাদে পড়ার ভয়টা চলে গেল। একদম শেষে একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা উঠে আপনার পাশে এসে বসলেন। এর পর বাস আর থামল না, হুহু করে হাইওয়ে ধরে চলতে শুরু করল।

বাস ক্রমে শহরের সীমানা ছাড়িয়ে বাইরের দিকে এসে পড়ল। এখানে বাড়িগুলো দূরে দূরে, গাছ-গাছালি বেশি, মাঝে মধ্যে দু-একটা খালি মাঠ। আপনি বাইরের শোভা দেখতে দেখতে জানালা দিয়ে আসা হাওয়া খেয়ে দু-একবার খুকখুক করে কাশলেন।

পাশে বসে থাকা বয়স্ক ভদ্রমহিলা, “কাশি হচ্ছে জানলাটা বন্ধ করে দাও না! এখন সীজন চেঞ্জের সময় একটুতে ঠান্ডা লেগে যায়।” বলে ব্যাগ থেকে একটা ভিক্সের লজেন্স বের করে বাড়িয়ে ধরলেন। “এই নাও এটা মুখে রেখে নাও।”

আপনি হতভম্ব হয়ে নিজের অজান্তেই জানালা বন্ধ করলেন এবং ভিক্সের লজেন্স মুখে পুরলেন। একবার আপনার ধুম জ্বর হয়েছিল, সাইকেল রিক্সা চেপে টলতে টলতে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে এসেছিলেন, কেউ আপনার খোঁজ নেয়নি। কোনো সম্পূর্ণ অজানা লোক আপনার সামান্য কাশিতে চিন্তিত হতে পারে এটা আপনার ধারণার গণ্ডির সম্পূর্ণ বাইরে ছিল। আপনার কেমন পাশের অচেনা মানুষটাকে চেনা চেনা মনে হতে লাগল।

প্রায় একঘণ্টা চলার পর বাস একটা কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া কম্পাউন্ডের সামনে এসে থামল। ততক্ষণে প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে, পশ্চিম আকাশের লাল রঙ গাঢ় হয়ে উঠেছে। আপনি জানালা ফাঁক করে দেখলেন কম্পাউন্ডের ভেতর একটা লম্বা উঁচু শেড, তার গায়ে বড়বড় অক্ষরে লেখা ‘নিউ বেঙ্গল লজিস্টিক্স হাব’।

বাস থেকে নেমে আপনি সবার সঙ্গে শেডের দিকে পা বাড়ালেন। শেডে ঢোকার দরজায় তরুণ সমাদ্দার হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। তাঁর হাতে একটা কাচের বাটিতে ছোট ছোট কাগজের টুকরো। “আসুন, আসুন, ওয়েলকাম। একটা নম্বর নিন, একটা নম্বর নিন” বলে সবাইকে তিনি আপ্যায়ন করছেন।

সবার দেখাদেখি আপনিও একটা কাগজ নিয়ে ভেতরে গেলেন। দরজার অন্যদিকে একটা লম্বা ঘর, সেখানে সারি সারি প্লাস্টিকের চেয়ার পাতা। রঙিন কাগজ আর বেলুন দিয়ে ঘর সাজানো। ঘরের এক প্রান্তের দেওয়ালে রঙিন কাগজ দিয়ে ইংরেজিতে ‘ওয়েলকাম’ লেখা, তার সামনে স্ট্যাণ্ডে একটা মাইক বসানো। আর এক পাশের দেওয়ালের গায়ে লম্বা টেবিল পাতা। তার ওপর চা, কেক, পেস্ট্রি, বিস্কুট ইত্যাদি সাজানো।

সবাই ঘরে ঢোকার পর তরুণ সমাদ্দার এসে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন, মাইক অন করে দু-একবার ফুঁ দিলেন, হ্যালো হ্যালো বললেন, তারপর মাইকের আওয়াজে সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “নমস্কার। ওয়েলকাম। নিউ বেঙ্গল গ্রুপের পক্ষ থেকে আপনাদের এই ইভেন্টে আসার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। এটা টিম ইভেন্ট। এক একটা টিমে তিনজন করে আছে। আপনাদের হাতের কাগজে টিম নম্বর দেওয়া আছে, আপনারা নম্বর দেখে টিম মেম্বারদের খুঁজে নিন, তারপর চা খান। আপনাদের চা খাওয়া হয়ে গেলে ইভেন্টের খেলা আর তার নিয়ম কানুন বুঝিয়ে দেওয়া হবে।”

আপনি হাতের কাগজ দেখলেন ছয় লেখা আছে। এবার কীভাবে টিমের বাকিদের খুঁজবেন ভাবছেন, আপনার মুস্কিল আসান করে দিয়ে বাসে আপনার পাশে বসা বৃদ্ধা মহিলা “এই দেখি দেখি তোমার নম্বর কত?” বলেই নিজের নম্বরটা মিলিয়ে নিয়েই, “আরে আমারও তো ছয়, তাহলে তো আমরা একই টিমে” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।

আপনার মনে হল ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল, একটা মস্ত দায়িত্ব আপনার ঘাড় থেকে নেমে গেল।

ভদ্রমহিলা আপনার দিকে তাকিয়ে বললেন, “একই টিমে যখন, আগে পরিচয়টা সেরে নিই। আমার নাম যূথিকা দাস। তুমি আমাকে যূথিকা মাসিমা বলতে পার। তোমার নাম কী?”

আপনি নাম বললেন। যূথিকা মাসিমা, “চলো চা খাই। আর আমাদের টিমের আর একজনকেও খুঁজে বের করতে হবে।” বলে চায়ের টেবিলের দিকে হাঁটা দিলেন। আপনিও অনুগত সৈনিকের মতো তাঁর পেছন পেছন চললেন।

পূর্বা, এবার আসি আপনার কথায়। আপনি হাতে এক কাপ চা নিয়ে শেডের ভেতরের অনাড়ম্বর সাজসজ্জা আর জমায়েত হওয়া লোকগুলোকে দেখে মনে মনে ভাবছেন এতটা দূর এসে আপনি খামোখা সময় নষ্ট করলেন কিনা, এমন সময়ে দেখলেন “ছ নম্বর কার? ছ নম্বর কার?” বলতে বলতে একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা গটগটিয়ে এগিয়ে আসছেন, আর তাঁর পেছনে পেছনে একজন নিরীহ গোবেচারা চেহারার লোক হেঁটে আসছে।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও আপনি নিজের হাতে ধরা কাগজের নম্বরটা দেখে নিয়ে হাতটা সামান্য তুললেন। ভদ্রমহিলা আপনার কাছে এগিয়ে এসে বললেন “আমি যূথিকা দাস। তুমি আমাকে যূথিকা মাসিমা বলতে পার। আর এই হল সুশান্ত। তোমার নাম কী?”

আপনি নাম বললেন। কিন্তু আপনার বিরক্তি কাটল না। একজন বৃদ্ধা আর একজন গোবেচারা মানুষকে আপনার টিমে দিয়ে কী প্রব্লেম সলভিং গেম হবে আপনি তা ভেবে কূলকিনারা পেলেন না। শহর হলে আপনি কোনো একটা অজুহাত দিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে কেটে পড়তেন, কিন্তু এই শহরতলীর পাণ্ডববর্জ্জিত অঞ্চলে আপনি কার্যত বন্দি।

বিরক্তি ঢাকতে আপনি চায়ের কাপে হাল্কা চুমুক দিচ্ছেন, যূথিকা মাসিমা আপনার প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “এ কী! শুধু চা খাচ্ছ কেন? কেক পেস্ট্রি কিছু নাও!”

আপনি নিরাসক্ত গলায় এড়ানোর চেষ্টা করলেন, “না, ন্‌ আমার লাগবে না।”

“লাগবে না কেন?” যূথিকা মাসিমা আপনার কথা উড়িয়ে দিলেন। “কখন খেয়েছিলে? অনেক্ষণ আগে বোধহয়? মুখটা তো শুকনো লাগছে! নাও নাও!” বলে নিজেই আপনার প্লেটে একটা কেক তুলে দিলেন।

আপনি প্রতিবাদ করলেন না। বা ঠিক করে বলতে গেলে আপনি প্রতিবাদ করতে পারলেন না। আপনি কখন খেয়েছেন, বা আদৌ খেয়েছেন কিনা, শেষ কবে কে কখন আপনাকে জিজ্ঞাসা করেছে, আপনার মনে পড়ে না। যূথিকা মাসিমার ‘কখন খেয়েছিলে?’ কথাটা আপনার মনের এমন জায়গায় স্পর্শ করল যে আপনার চোখের কোনটা চিকচিক করে উঠল। চা খাওয়ার অছিলায় আপনি আবার চায়ের কাপে মুখ ঢাকলেন।

আপনার চা কেক পর্ব যখন সমাধা হল ততক্ষণে আপনার বিরক্তিটা পুরোটাই উধাও হয়ে গেছে। আপনিও সুশান্তর মতো যূথিকা মাসিমার সঙ্গে এসে তাঁর পাশে চেয়ারে বসে পড়লেন।

সবাই চেয়ারে এসে বসার পর তরুণ সমাদ্দার আবার মাইকের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মাইকে বার দুয়েক ফুঁ আর হ্যালো হ্যালো বলে বলা শুরু করলেন।

“আপনাদের সবাইকে আর একবার ওয়েলকাম। আমাদের ইভেন্ট এবার শুরু হতে যাচ্ছে। আমাদের ইভেন্টে দুটো রাউন্ড। প্রথম রাউন্ডে কোয়ালিফাই করলে, তবে দ্বিতীয় রাউন্ড খেলার সুযোগ হবে। আগে প্রথম রাউন্ড খেলার নিয়ম বলে দিই। আপনাদের পেছনে দেখুন একটা দরজা আছে।”

আপনি এবং ঘরের সবাই পেছন ফিরে দেখলেন তরুণ সমাদ্দার যেখানে দাঁড়িয়ে, ঠিক তার উল্টোদিকে একটা দরজা আছে।

“আপনারা ওই দরজা দিয়ে বেরোলে একটা করিডোর পাবেন। করিডোরের বাঁদিকে এক সারি দরজা আছে। দরজার মাথায় নম্বর দেওয়া আছে, আপনার টিমের যা নম্বর সেই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকবেন। আপনার ঢোকার পর দরজা ঠিক সাড়ে ছটায় বন্ধ হয়ে যাবে, ভেতর থেকে আর খুলবে না। আপনাদের যে প্রব্লেম সল্ভ করতে হবে সেটা ঘরের মধ্যে রাখা আছে। আপনাদের আধঘণ্টা সময় দেওয়া হবে। তার মধ্যে প্রব্লেম সল্ভ করতে পারলে দরজা আপনা থেকে খুলে যাবে। যদি না পারেন তাহলে পঁয়ত্রিশের মিনিটের মাথায় দরজা খুলবে।”

এরপর হঠাৎ মাইকটা বিশ্রী একটা চিঁচিঁ শব্দ করে ওঠায় তরুণ সমাদ্দারকে দু’মিনিট থামতে হল। মাইক বিশ্রাম নিলে তিনি ফের হ্যালো হ্যালো বলে নিয়ে বলা শুরু করলেন।

“আপনারা যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রব্লেম সল্ভ করতে পারেন, তাহলে দ্বিতীয় রাউন্ডের জন্যে দরজা দিয়ে বেরিয়ে বাঁদিকে চলে যাবেন। আর যদি নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যায়, তাহলে দরজা থেকে বেরিয়ে আবার এই ঘরে চলে আসবেন, আপনাদের পৌঁছে দেওয়ার জন্যে বাস রেডি থাকবে।”

“আর যারা দ্বিতীয় রাউন্ড খেলবে তারা কী করে ফিরবে?” কে একজন প্রশ্ন করল। দু-একজন চাপা স্বরে হেসে উঠল।

“চিন্তা করবেন না, চিন্তা করবেন না” দু’হাত তুলে আশ্বস্ত করলেন তরুণ সমাদ্দার, “আপনাদেরও ফেরার ব্যবস্থা করা আছে। এবার চলুন, পেছন দিকে যাওয়া যাক।”

যূথিকা মাসিমার পেছন পেছন আপনি আর সুশান্ত পেছনের দরজা দিয়ে করিডোরে এলেন, তারপর বাঁদিকের দরজার সারি থেকে নম্বর মিলিয়ে ছ নম্বর ঘরে ঢুকলেন।

আপনাদের পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে একটা খট করে আওয়াজ হল। আপনি বুঝতে পারলেন দরজা লক হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দরজার মাথায় একটা লাল আলো জ্বলে উঠল।

আপনি ঘরের ভেতর তাকিয়ে দেখলেন ঘরে আসবাব বলতে দুটো টেবিল। তার একটা খালি, অন্যটার ওপর কিছু যন্ত্রাংশ জড় করা। আপনি কী করবেন বুঝতে না পেরে যূথিকা মাসিমার মুখের দিকে তাকালেন, দেখলেন তিনিও কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছেন।

তবে গোবেচারা সুশান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন এই প্রথম তার মুখে একটা হাল্কা হাসি ফুটে উঠেছে।

হাসিটা যূথিকা মাসিমারও চোখ এড়ায়নি, তিনি চোখ ছোট করে সুশান্তর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী করতে হবে তুমি জান?”

সুশান্ত ঘাড় নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, ওই পার্টসগুলো জোড়া দিয়ে একটা যন্ত্র বানাতে হবে। আমি কাল যন্ত্র জোড়া দেওয়ার একটা ভিডিও দেখেছি।”

‘কেবল একটা ভিডিও দেখেই কি একটা যন্ত্র জোড়া দেওয়া সম্ভব?’ এই প্রশ্নটা আপনি করার সুযোগ পেলেন না। সুশান্ত যন্ত্রাংশগুলো খালি টেবিলে তুলে নিয়ে গিয়ে একটার পর একটা জোড়া দিতে লাগল। এবং আপনার হতভম্ব দৃষ্টির সামনে পার্টসগুলো জোড়া লাগতে লাগতেই আপনি বুঝতে পারলেন যে যন্ত্রটা গড়ে উঠতে যাচ্ছে সেটার ছবি আপনি দু’দিন আগে পিডিএফ ডকুমেন্টে দেখেছেন। যার ওপরে লেখা ছিল কোয়ন্টাম এন্টেগেলমেন্ট কমিউনিকেটর।

আপনার মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা চিন্তা খেলে গেল। আপনি বুঝতে পারলেন নিউ বেঙ্গলের এই ইভেন্ট কোনো সাধারণ ম্যানেজমেন্ট গেম নয়। আপাত দৃষ্টিতে বোঝা না গেলেও এই ইভেন্টে যাদের নিয়ে আসা হয়েছে তারা সবাই কোনো না কোনো বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। আপনি যেমন কোনো কিছু পড়লে ভোলেন না, সুশান্তও তেমনি কোনো কিছু দেখলে ভোলে না। আর যূথিকা মাসিমা? তাঁরও কোনো ক্ষমতা আছে, যেটা পরে প্রকাশ পাবে। আপনাদের তিনজনের ক্ষমতার সার্থক প্রয়োগ হলেই তবেই দরজাটা নির্ধারিত সময়ের আগে খুলবে, আর আপনারা কোয়ালিফাই হয়ে সেকেন্ড রাউন্ডে যাবেন।

মিনিট দশেকের মধ্যেই সুশান্ত যন্ত্রটা জোড়া দিয়ে ফেলল। ঠিক আপনার দেখা ডকুমেন্টের ছবির মতো। একটা চৌকো বাক্সের গায়ে একটা মান্ধাতার আমলের পেটমোটা টিভি স্ক্রিন বসানো। তার চার পাশে অজস্র ডায়াল, সুইচ, আর নব। স্ক্রিনের ওপরে বাক্সের মাথা থেকে একটা চোঙ সামনের দিকে বেরিয়ে আছে, তার দু’পাশে দুটো আলো বসানো। বাক্সের সামনে টাইপরাইটারের মত দশটা গোল গোল চাবি, তাতে শূন্য থেকে নয় অবধি লেখা।

এবার আপনার পালা। আপনি দেখতে পেলেন যূথিকা মাসিমা আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।

আপনি যন্ত্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, দুদিন আগে দেখা ডকুমেন্টের ছবিটা মনে করে নিলেন, তারপর চটপট নব, সুইচ আর ডায়ালে হাত লাগিয়ে সেগুলো সেট করতে লাগলেন। বেশিক্ষণ লাগল না, মিনিট সাতেকের মধ্যে আপনি শেষ সুইচটা অন করে দিলেন।

কয়েক সেকেণ্ড কিচ্ছু হল না। তারপর এক এক করে মিটারের কাঁটাগুলো যেন প্রাণ পেয়ে কাঁপতে শুরু করল, মান্ধাতার আমলের টিভি স্ক্রিনটা সবুজ রঙে আলকিত হয়ে উঠল, আর চোঙের দুপাশে দুটো লাল রঙের আলো জ্বলে উঠল।

আপনি আর সুশান্ত দুজনেই যূথিকা মাসিমার দিকে তাকালেন, যেন তিনি এবার বলে দেবেন এরপর কী করতে হবে।

যূথিকা, এবার আপনার কথা বলি। অঙ্কে আপনার মেধা অতুলনীয় বটে, কিন্তু এছাড়াও আপনার আরো একটা ক্ষমতা আছে, যার সঙ্গে মস্তিষ্কের চাইতে হৃদয়ের সম্পর্ক বেশি। আপনার টিমে সুশান্ত আর পূর্বাকে পেয়েই আপনার বুঝতে বেশি দেরি হয়নি যে দু’জনেই বড় একা। কিন্তু মেশিন জোড়া দিয়ে তাকে সেট করার আগে অবধি আপনি টেরও পাননি যে দু’জনেই মানসিক দক্ষতায় আপনার সমকক্ষ। চিরকাল নিজের মেধাকে সাবধানে চাপা দিয়ে সমাজে-মেশা আপনার মনে হল এই প্রথম আপনি কারোর সংস্পর্শে এসেছেন যাদের সামনে আপনার নিজেকে লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন নেই।

আপনি দেখলেন মেশিন সেট করার পর পূর্বা আর সুশান্ত আপনার দিকে প্রত্যাশার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ও দৃষ্টি আপনার চেনা। যখন আপনি সংসারের কেন্দ্রে ছিলেন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে আপনার নিকটজনেরা ওইভাবেই আপনার দিকে তাকিয়ে থাকত।

আপনি যন্ত্রটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন এরপর আপনাকে কী করতে হবে, যন্ত্রের চোঙ থেকে একটা শোঁশোঁ আওয়াজ বেরিয়ে এল, এবং তারপরেই শোনা গেল একটা খসখসে কন্ঠস্বর, “টেস্টিং। হ্যালো হ্যালো। শোনা যাচ্ছে?”

আপনি চোঙের কাছে মুখ নিয়ে বললেন “হ্যাঁ বলুন।”

উলটো দিক থেকে উত্তর এল, “প্রশ্ন স্ক্রিনে দেখুন। উত্তর টাইপ করুন। এই সিরিজের চতুর্থ সংখ্যা কী?”

মান্ধাতার আমলের সবুজ স্ক্রিনে ফুটে উঠল পরপর তিনটে সংখ্যা - ৬, ২৮, ৪৯৬।

আপনি একটা তাচ্ছিল্যের ফুঃ আওয়াজ করে টাইপরাইটারের চাবি টিপে স্ক্রিনে লিখলেন ৮১২৮।

তারপর পূর্বা আর সুশান্ত অবাক হয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে নিজেই বুঝিয়ে দিলেন। “পারফেক্ট নাম্বার। সংখ্যাটাকে যে যে সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যায় সেগুলোকে যোগ করলে ফের সংখ্যাটা পাওয়া যায়। যেমন ছয়কে ১, ২, আর ৩ দিয়ে ভাগ করা যায়। আবার ১,২,৩ একসঙ্গে যোগ করলে ছয় হয়। আঠাশকে ১, ২, ৪, ৭, আর ১৪ দিয়ে ভাগ করা যায়, আবার ওই সংখ্যাগুলো একসঙ্গে যোগ করলেও আঠাশ হয়। বাকি দুটোও তাই।”

চোঙের মধ্যে থেকে আওয়াজ এল, “কারেক্ট।” তারপর একটা ক্ষণিক গোঁগোঁ আওয়াজ করে চোঙের পাশের একটা লাল আলো সবুজ হয়ে গেল।

চোঙ থেকে আবার খসখসে কণ্ঠস্বর এল, “এই সিরিজের পরবর্তী সংখ্যা কী?”

যন্ত্রের স্ক্রিনটা মুছে গিয়ে আবার কয়েকটা সংখ্যা পর পর ফুটে উঠল - ৭০, ৭২, ৮০, ৮১।

আপনি কয়েক সেকেন্ড সংখ্যাগুলো দেখলেন, তারপর টাইপ করলেন ৮৪। পূর্বা আর সুশান্তর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, “এগুলো হর্ষদ নাম্বার। প্রতিটি নম্বর যে সংখ্যা দিয়ে গড়া, সেগুলোর যোগফল দিয়ে নম্বরটাকে ভাগ করা যায়। যেমন বাহাত্তরের সাত আর দুই যোগ করলে পাওয়া যায় নয়, আবার নয় দিয়ে বাহাত্তরকে আরামসে ভাগ করা যায়।”

চোঙে থেকে আওয়াজ এলো, “কারেক্ট।” তারপর ফের সামান্য গোঁগোঁ আওয়াজ করে আর একটা লাল আলো সবুজ হয়ে গেল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজার মাথার লাল আলোটা নিভে গেল, এবং একটা ধাতব শব্দ জানান দিল যে দরজার লক খুলে গেছে।

আপনি পূর্বা আর সুশান্তকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে করিডোরের বাঁদিকে হাঁটা দিলেন।

করিডোরের শেষে কয়েকটা দরজা পেরোতে হল। শেষের দরজাটা ঠেলে আপনি একটু আশ্চর্য হলেন। দরজার অন্যদিকে একটা ছোটখাট সিনেমা হল। একদিকে স্ক্রিন। অন্যদিকে ঢালু হয়ে উঠে গেছে চেয়ারের সারি। আপনার টিমই বোধহয় সবচাইতে আগে পৌঁছেছে। হলটা মোটামুটি খালি।

যূথিকা, পূর্বা আর সুশান্ত, এবার আপনাদের তিনজনের কথা বলি।

আপনারা ছোটখাট সিনেমা হলটাতে বসার পর আস্তে আস্তে লোকে আসতে আরম্ভ করল। মিনিট দশেক বাদে তরুণ সমাদ্দার এসে ঢুকলেন, তাঁর পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে গেল, দরজার মাথায় লাল আলো জ্বলে উঠল। আপনারা দেখলেন যারা বাসে এসেছিল তাঁদের মধ্যে মাত্র অর্ধেক সিনেমা হলে বসে। অর্থাৎ বাকি অর্ধেক দ্বিতীয় রাউন্ডের জন্যে কোয়ালিফাই করতে পারেনি।

তরুণ সমাদ্দারের হাতে একটা ওয়্যারলেস মাইক। তিনি মাইকে বার কয়েক ফুঁ দিয়ে, হ্যালো হ্যালো বলে বললেন, “আপনারা যাঁরা কোয়ালিফাই করেছেন তাঁদের সেকেন্ড রাউন্ডে নিউ বেঙ্গল মুভিজের তরফ থেকে স্বাগত জানাই। এখন আপনারা একটা সিনেমা দেখবেন। সেকেন্ড রাউণ্ডে কী করতে হবে আপনাদের সিনেমার পর জানানো হবে।”

এরপর মাইক একটু চিঁ চিঁ করাতে তরুণ সমাদ্দারকে আবার বার দুয়েক হ্যালো হ্যালো করে নিয়ে বাকিটা বলতে হল।

“এই হলটি বিশেষভাবে নির্মিত। একে আমরা বলি রিয়েলিটি সিনেমা। সিনেমা চলার সময়ে আপনি নানা রকম ঝাঁকুনি টের পাবেন, কখনো চেয়ার একদিকে হেলে যাবে। আপনাদের চেয়ারের হ্যাণ্ডেল দুটো সামনের দিকে টেনে নেবেন, তাহলে পড়ার ভয় থাকবে না।”

তরুণ সমাদ্দার বসে পড়লেন, হলের আলো নিভে এল, সামনের স্ক্রিনে আলো পড়ে সিনেমা শুরু হল। প্রথমেই আপনারা দেখলেন বড় বড় কাচের জানালা বসানো একটা প্লেনের ককপিটের মত ঘর, জানালার নিচে থরে থরে সুইচ, মিটার আর ডায়াল সাজানো। জানালার বাইরে ঝাপসা অন্ধকার।

গোঁগোঁ আওয়াজ করে কোথায় একটা ইঞ্জিন চালু হল, ককপিটের যন্ত্রগুলোর পেছনে সব আলো জ্বলে উঠল, তারপর মনে হল ককপিটটা নিচের দিকে নামছে। রিয়েলিটি সিনেমার দৌলতে আপনার নিচে নামার অনুভূতিটা বেশ টের পেলেন।

কিছুক্ষণ নিচে নামার পর মনে হল ককপিটটা ওপরের দিকে উঠছে, আপনারাও চেয়ারে বসেই বেশ টের পেলেন ওপরে ওঠার গতি।

এবার স্ক্রিনের দৃশ্য পালটে গেল। যেন আপনারা ককপিটের জানলা দিয়ে বাইরে দেখছেন, এবং যাতে বসে আছেন সেটা পৃথিবীর মাটি ছেড়ে ওপরদিকে উঠছে। সিনেমায় আপনারা মজে গেছেন, যেন সত্যিই কিছুতে চড়ে বসেছেন।

উঠতে উঠতে ককপিটের বাইরের দৃশ্য আবার পালটে গেল, এবার অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে বলের মতো নীল সাদা গোল পৃথিবী।

হঠাৎ একটা ঝলকানি দিয়ে স্ক্রিন সাদা হয়ে গেল। ছবি যখন ফিরে এল, তখন সিনেমায় ককপিটের বাইরের ছবিটা কিছুটা পালটে গেছে। নিচে নীল সাদা পৃথিবীর বদলে অন্য একটা সবুজ সাদা গোলক ভাসছে।

রিয়েলিটি সিনেমার দৌলতে আবার মনে হল ককপিটটা নিচের দিকে নামছে। মেঘের আস্তরণের মধ্যে দিয়ে নামার সময়ে ককপিটের জানলার বাইরে দেখতে পেলেন নিচে একটা অদ্ভুত ধরণের শহর, কিন্তু ভাল করে দেখার আগেই ককপিটের জানলা ঝাপসা হয়ে গেল। এরপর ইঞ্জিনের গোঁগোঁ আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেল, স্ক্রীনের ওপর ‘নিউ বেঙ্গল মুভিজ’ কথাটা ফুটে উঠে স্ক্রিন সাদা হয়ে গেল।

একটা বিপ বিপ আওয়াজ হল আর হলের আলোগুলো সব এক এক করে জ্বলে উঠল। সামনের সারি থেকে ওয়্যারলেস মাইক হাতে তরুণ সমাদ্দার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনারা আবার করিডোর দিয়ে প্রথম যেখানে এসেছিলেন সেই মিটিং রুমে গিয়ে বসুন। আমি আসছি।”

আপনারা এক এক করে বেরিয়ে এলেন। মিটিং রুমটা দেখলেন এর মধ্যে সাফসুতরো করা হয়ে গেছে। বেলুন আর রঙিন কাগজ সব পরিষ্কার, খাবার টেবিলটাও নেই। খালি স্ট্যাণ্ডের মাইকটাই যা এক জায়গায় রয়েছে।

তরুণ সমাদ্দার এসে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে নিয়মমাফিক ফুঁ দিয়ে আর হ্যালো হ্যালো বলে বললেন, “আপনারা যাঁরা এ ঘরে রয়েছেন, তাঁরা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন যে আপনারা কেউ সাধারণ নন, আপনাদের সবারই কিছু না কিছু বিশেষ ক্ষমতা আছে। বিভিন্ন উপায়ে আমরা তাই আপনাদের বেছে নিয়েছি। তবে আপনাদের বেছে নেওয়ার পেছনে আরও একটা কারণ আছে। আপনাদের প্রত্যেকেরই কোনো পিছুটান নেই।”

পেছনে থেকে বাধা দিয়ে কে প্রশ্ন করল, “সে তো বুঝলাম। কিন্তু সেকেন্ড রাউন্ড খেলার কী হল?”

দুঃখী দুঃখী মুখ করে তরুণ সমাদ্দার বললেন, “সেকেন্ড রাউন্ড বলে কিছু নেই। ওটা আপনাদের ভুলিয়ে রাখার জন্যে বলা। তার জন্যে আমি দুঃখিত এবং আপনাদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। এবারে এদিকে আসুন।”

মাইক ছেড়ে দিয়ে তরুণ সমাদ্দার বাইরে যাওয়ার দরজাটা খুলে দিলেন। আপনারা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন বাইরে ঝকঝক করছে দিনের আলো। আপনারা যখন এসেছিলেন তখন তো সবে সন্ধে। এত তাড়াতাড়ি এতটা সময় কেটে গেল কী করে?

বাইরের দিকে হাত বাড়িয়ে তরুণ সমাদ্দার বললেন “নিউ বেঙ্গলে আপনাদের স্বাগত। নিউ বেঙ্গল সেটেলমেন্টের তরফ থেকে আমরা চাইব যে এখন থেকে আপনারা এখানেই থেকে যান। তবে যদি ফেরৎ চলে যেতে চান, তাহলে আধঘণ্টার মধ্যে সিনেমা হলে গিয়ে বসে পড়বেন। অবশ্য সেক্ষেত্রে", তরুণ সমাদ্দার আবার দুঃখী দুঃখী মুখ করলেন, “আপনাদের এই জায়গাটার কথা কিছুই মনে থাকবে না। আর আপনারা এখানে দ্বিতীয়বার আসার সুযোগও পাবেন না।”

তরুণ সমাদ্দার কী বলছে বুঝতে না পেরে আপনারা দরজা দিয়ে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। এবং দাঁড়িয়েই বুঝলেন আপনারা আর পৃথিবীর বুকে নেই। আপনাদের মাথার ওপরে ঝকঝকে আকাশটাই যা চেনা চেনা, বাকি সব আলাদা। গাছপালাগুলো বিচিত্র ধরণের, আশেপাশে চরে বেড়াচ্ছে রামধনুর মতো রঙিন কিছু অদ্ভুত দর্শন ছ’পেয়ে জীব, মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পালতোলা রঙিন যান।

আর দূরে আকাশের গায়ে দেখা যাচ্ছে একটা অদ্ভুত শহর, তার রুপোলী মিনার আর সোনালী গম্বুজ থেকে ছড়িয়ে যাচ্ছে আলো।

দু’দিকে দু’হাত ছড়িয়ে দিলেন তরুণ সমাদ্দার, “নিউ বেঙ্গল। সাধারণ মানুষের চাইতে মেধা ক্ষমতা যাদের অনেক বেশী, তাদের নিজের মতো করে নতুন জীবন শুরু করার সুযোগ। আপনাদের নিজের পূর্ণতাকে অর্জন করার অনুকুল এক অনন্য জগৎ।”

বাকি সবার সঙ্গে আপনারাও হাঁটা দিলেন দিগন্তের আলোমাখা শহরটার দিকে। ফিরে যাওয়ার কথা আপনাদের মনেও এল না।