ঘরে ফেরার গান ● দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়

 


 

“এ এন টি ওয়ান জিরো নাইন ফোর।”

শ্রান্ত গলায় কোডটা আউড়েই নরম গদিওলা চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল অন্তু। উফ্, আজ ভীষণ ধকল গেছে। এই মুহূর্তে একটা নীলাভ আলো তার সারা শরীরের ওপর খেলে বেড়াচ্ছে। স্ক্যান শেষ হলে নিজের মালিকের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হল ব্রহ্মাণ্ডযান, নড়তে শুরু করল আলতোভাবে। খ্যাঁচ্। মৃদু আওয়াজ শুনে অবসন্ন চোখের পাতা দুটো আস্তে আস্তে খুলল ব্রহ্মাণ্ডযানের একমাত্র যাত্রীটি। একটা লিকলিকে ধাতব হাত সামনের কন্ট্রোল প্যানেল থেকে বেরিয়ে এসে তার মুখের সামনে ধরে আছে দুটো ট্যাবলেট। একটা বেগুনী, একটা ধূসর। হাত বাড়িয়ে ট্যাবলেট দুটো মুখে পুরলো অন্তু। এখন এই দুটোই দরকার ছিল। এত বড় একটা অপারেশনের পর যেমন দুর্বল লাগছে, তেমন খিদেও পেয়েছে। সামনের বিরাট স্বচ্ছ জানালার ওপারটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়েছে স্পেসজেট-টা। তার অবশ্য এখন করণীয় কিছুই নেই। কোড বলা মাত্র তার ব্রেন স্ক্যান করে নিয়েছে স্বয়ংক্রিয় এই যান। এবার শুধু তার পছন্দমতো জায়গায় গিয়ে পৌঁছনোর অপেক্ষা। আপাতত ঘরে ফিরবে, অর্থাৎ তাদের বিশসনে।

পা দুটো সামনে ছড়িয়ে শরীরটা টানটান করল অন্তু। ধূসর ট্যাবলেটটা কাজ শুরু করে দিয়েছে, ক্লান্তিটা যেন কাটছে একটু একটু করে। এই সোলানিস গ্রহের জীবগুলো যে এতটা ভয়ঙ্কর হবে, প্রথমে বোঝা যায়নি। ওইটুকুনি ছোট ছোট পাখির মতো শরীর, তারা আর কীই বা প্রতিরোধ করবে! কিন্তু কমলিকার নির্দেশে ওরা ওদের আকাশে চক্রব্যূহ তৈরী করতেই কীভাবে যেন ওই ছোট্ট শরীরগুলো ফুলে ফেঁপে প্রায় দশগুণ হয়ে উঠল! এরপর যখন প্রচণ্ড বেগে ধারালো ঝুঁটি নিয়ে তাদের আক্রমণ করল ওই দানবাকৃতি প্রাণীগুলো, কিছুক্ষণের জন্য ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছিল ওরা। তবে বরাবরের মতো এবারেও শত্রুকে জব্দ করার বুদ্ধিটা এসেছিল অন্তুরই মাথায়। দলের কয়েকজনের রক্তাক্ত দেহের সংস্পর্শে এসেই যখন নেতিয়ে যাচ্ছিল জীবগুলো, তখন স্পেসজেট থেকে ওয়াটার গান চার্জ করেছিল সে। আর যা ভেবেছিল ঠিক তাই হল! তরলের সংস্পর্শে আসা মাত্র কুঁকড়ে আবার ছোট হয়ে যেতে লাগল তাদের শরীরগুলো। তারপর সেই মাটির ঢেলার মতো দেহগুলোকে পায়ের তলায় চটকে চটকে কাদা বানানোর যে মজা... আহ্! চোখ বন্ধ অবস্থাতেই একটা নৃশংস হাসি ফুটে উঠল অন্তুর মুখে। আপাতত সোলানিস গ্রহ সম্পূর্ণরূপে দখল করা শুধু মাত্র সময়ের অপেক্ষা। তারপর সেখানেও গড়ে উঠবে মানুষের বসতি। মানুষই হবে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র চালক!

আশপাশ দিয়ে সরে যাচ্ছে ছোট ছোট গ্রহাণু, উল্কাপিণ্ড। ওদের দলের বাকিদের জেটগুলো দেখা যাচ্ছে না, হয়ত পেছনে আছে। বিশসনে পৌঁছতে আরো ঘণ্টা দুয়েক লাগবে। ততক্ষণে নাহয় একটু ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। সামনের কন্ট্রোল প্যানেলে ‘স্লিপ মোড’ বোতামটা টিপতেই মৃদু ঘরঘর শব্দে গদিওলা চেয়ারটা পরিণত হল বিছানায়। ভেতরের সমস্ত আলো নিভে গিয়ে ছোট্ট খুপরিটা ভরে উঠেছে একটা মোলায়েম নীল আলোয়। শরীর ছেড়ে দিল অন্তু। ঘুম নেমে আসছে চোখের পাতায়।

 

একটা অদ্ভুত সোনালী আলো। যেন মুঠো মুঠো সোনা কেউ ছড়িয়ে দিয়েছে বাতাসে। নরম কবোষ্ণ আলো, রাজকন্যার একঢাল মখমলে চুলের মতো। সেই সোনালী আলোর ফাঁকে ফাঁকে কোথাও কোথাও উঁকি মারছে সবুজের ছোপ। বড় আরাম লাগছিল তার। দুটো কোমল হাত অতি যত্নে জড়িয়ে ধরেছে তাকে, সুতি শাড়ির ভাঁজ থেকে ভেসে আসছে বুকভরা দুধের গন্ধ। আহ্! প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেয় সে। আলতো ছন্দে তাকে বুকে চেপে ধরে এগিয়ে চলেছে এক নারী। ধীরে ধীরে আবছা রোদের মতো ভেসে ওঠে আরো কয়েকটা অবয়ব...

গং! প্রচণ্ড যান্ত্রিক শব্দে কেঁপে উঠল চারদিক। ধড়মড়িয়ে উঠে বসেছে অন্তু। তার স্পেসজেট-টাকে ধরে কেউ যেন পাগলের মতো ঝাঁকাচ্ছে! কয়েক মুহূর্তের জন্য কেমন ভেবলে গেল। তারপর অবশ ভাবটা কাটিয়ে উঠে গিয়ে কন্ট্রোল প্যানেলে বসতেই শিরদাঁড়াটা হিম হয়ে গেল তার। ডানদিকের উইংটা একদম তুবড়ে গিয়েছে! হয়তো কোনো উল্কার টুকরো ধাক্কা মেরেছে। কিন্তু অবস্টাকল ফাইন্ডারটা কি কাজ করেনি? বেশী কিছু ভাবার সময় পেল না অন্তু। ততক্ষণে প্রবল বেগে এক অজানা মাধ্যাকর্ষণের মধ্যে ঢুকে পড়েছে তার স্পেসজেট, সেই অসীম শক্তির টানে অন্তুকে নিয়ে নামতে থাকল ছেঁড়া ঘুড়ির মতো। প্রাণপণে সুইচ-বোতামগুলো টিপেও কোনো লাভ হল না, লাল আলোর সঙ্কেত ততক্ষণে জানান দিচ্ছে যে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে আছড়ে পড়তে চলেছে ব্রহ্মাণ্ডযান। হতবুদ্ধির মতো বিশাল কালো স্ক্রীনটার দিকে তাকিয়ে রইল অন্তু।

সেখানে তখন আগুনরঙা অক্ষরে ফুটে উঠেছে কয়েকটা শব্দ।

“ওয়েলকাম টু দ্য আর্থ!”

***

একটা রিনরিনে হাসি কাচের গুঁড়োর মতো ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। অনেক চাপা গলার ফিসফিসানি, উল্লাস মাখানো। যেন উৎসব চলছে! ওর মুখের ওপর ঝুঁকে আছে কতগুলো অস্পষ্ট মুখ। ধীরে ধীরে তাদের একজন দু’হাত বাড়িয়ে ধরল তাকে। একরাশ দাড়িগোঁফের জঙ্গলের মধ্যে শান্ত নদীর মতো দুই চোখ। ঠোঁটের মৃদু হাসিটা যেন কতদিনের চেনা! বাকিদের মতোই সেই বলিষ্ঠ শরীরটাকে জড়িয়ে আছে গেরুয়া বসন। আস্তে আস্তে বরাভয়ের মুদ্রা ফুটে উঠল এক হাতে, গম্ভীর নির্ঘোষ কন্ঠে উচ্চারিত হল...

ভুক্ ভুক্ ভুক্!

চোখের পাতা দুটো একটু ফাঁক করল অন্তু। ওর মুখের ওপর ঝুলে আছে একটা সরু লম্বাটে মুখ, লালামাখা ঝোলা জিভ বুলিয়ে ক্রমশ ভিজিয়ে দিচ্ছে তার গাল। উফ্, কী অসহ্য! উঠে বসতে গিয়ে চাপা গলায় আর্তনাদ ছিটকে এল গলা থেকে! তার এমন আকস্মিক সচলতায় চমকে গিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়িয়েছে চতুষ্পদ প্রাণীটা। গোল গোল দুটো চোখে একদৃষ্টে দেখছে তাকে আর ক্রমাগত নেড়ে চলেছে তার ওপর দিকে বাঁকানো লেজটা। বিরক্তি ভরা দৃষ্টিতে তাকে দেখল অন্তু। এই জীবটাকে বোধহয় কুকুর বলে। তাদের বিশসনের সেন্ট্রাল হলে অনেক মেমরি স্টিক আছে মানুষের এই ফেলে যাওয়া গ্রহের ব্যাপারে। সেখানেই এইরকম জন্তুগুলোকে দেখেছে সে। ওর দিক থেকে নজর ঘুরিয়ে জখম পা-টার দিকে তাকাল। মারাত্মক যন্ত্রণা হচ্ছে হাড়ের ভেতর। ভেঙে গেল কি? একটু দূরেই কাত হয়ে পড়ে আছে তার স্পেসজেট-টা। মাটিতে আছড়ে পড়ার আগের মুহূর্তে ভাগ্যিস এমার্জেন্সি ডাইভস্যুটটা কাজ করল! তবে দেরী হয়ে গেছিল অনেকটাই, প্রাণে বাঁচলেও ডান পা-টায় ভালোই চোট লেগেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘরে ফিরতে হবে। বিশসনের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এই আঘাত তেমন কিছুই নয়। কিন্তু স্পেসজেট-টা...

ক্ষীণ কুঁই কুঁই শব্দে ঘাড় ঘোরালো অন্তু। ফের এসে জুটেছে কুকুরটা। আহ্লাদি ভঙ্গিতে লেজ নেড়ে নেড়ে শুঁকে চলেছে তাকে। মাথার ভেতরে চড়াং করে রক্ত গরম হয়ে গেল! তাদের বিশসনে এই সমস্ত অবাঞ্ছিত প্রাণীদের কোনো জায়গা নেই। মানুষ এখন পুরোপুরি স্বনির্ভর, উন্নতমানের যন্ত্ররা তাদের সাহায্য করে। এই রকম এক একটা অদরকারী জীব বেঁচে থাকা মানেই জল, অক্সিজেন, খাদ্য সবজায়গায় ভাগ বসাবে। তাই পূর্বপুরুষদের মতো আর ভুল করেনি তারা, বিশসনে এখন শুধু মাত্র মানুষেরই বাস। খর চোখে জানোয়ারটাকে মেপে নিল অন্তু। প্রতি মুহূর্তে তার ভাগের অক্সিজেন ব্যবহার করে চলেছে। একে সরিয়ে দিতেই হবে! তাড়াতাড়ি পকেট হাতড়ে খুঁজতে থাকল লেজারগানটা। নাহ্, নেই! কোথাও ছিটকে পড়েছে বোধহয়। নিষ্ফল আক্রোশে একটা পাথর তুলে নিয়ে ছুঁড়ল। লেজারগানটা হাতে থাকলে এক সেকেন্ডে ছাই করে দিত কুকুরটাকে!

ছোট্ট লাফে সরে গেল লোমশ প্রাণীটা। চোখে একরাশ অবিশ্বাস। তারপর গিয়ে লুকোলো একটা বড় পাথরের আড়ালে।

অবসন্নভাবে ধুলোর ওপর মাথা রাখল অন্তু। তেষ্টায় গলা কাঠ হয়ে আছে। চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল লম্বা নিরীহ মুখটা আবার উঁকি দিল পাথরের আড়াল থেকে। আশ্চর্য! এখনও সমানে দুলছে ওর লেজটা। এটা কীসের সঙ্কেত? শুকনো ঠোঁট চাটল অন্তু। কুকুরটা বেরিয়ে এসেছে পাথরের পেছন থেকে, তবে কাছে আসছে না। কেমন যেন একটা অস্থিরতা ওর মধ্যে। বারবার একটা নির্দিষ্ট দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। কিছু কি বলতে চাইছে? এতক্ষণে চারদিকে তাকাল অন্তু। প্রায় তিনদিক ঘেরা বিশাল পাহাড়, গায়ে রুক্ষ জংলা ছোপ। সে পড়ে আছে মাঝখানের একটা পাথুরে জায়গায়। কুকুরটা যেদিকে যাচ্ছে সেখান থেকে শুরু হয়েছে একটা ঘন জঙ্গল। ও কি ওখানে যাওয়ার ইঙ্গিত করছে? অসহায়ের মতো ঠোঁট কামড়ে ধরল। পিপাসায় বুকের ভেতরটা অব্দি ফুটিফাটা হয়ে যাচ্ছে। এরকম ভাবে আর কিছুক্ষণ পড়ে থাকলে নিশ্চয় জলের অভাবেই মারা যাবে। ওদিকে গেলে কি কিছু পাওয়া যাবে? বাম পায়ের ওপর ভর দিয়ে আস্তে আস্তে দাঁড়ালো। কিছুটা দূরেই পড়ে আছে একটা শুকনো ডাল। দেখে বেশ শক্তপোক্তই মনে হচ্ছে। ওকে উঠে দাঁড়াতে দেখেই হঠাৎ যেন উল্লাসে চকচক করে উঠল কুকুরটার চোখ দুটো! আকাশের দিকে মুখ তুলে ডেকে উঠল, “ভৌঔঔ!” তারপর আলতো পায়ে ছুটে গেল জঙ্গলের দিকে।

শুকনো ডালটা বাগিয়ে ধরে পেছন পেছন কোনোমতে শরীরটা টেনে নিয়ে চলল অন্তু। বিরাট বিরাট আকাশছোঁয়া গাছ প্রায় ঢেকে ফেলেছে আকাশটাকে। নীচে ঘন ঝোপঝাড়, কোথাও কোথাও বুকসমান উঁচু ঘাসজঙ্গল। এই তাহলে পৃথিবী? কিন্তু বিশসনের ‘আর্থ মিউজিয়াম’-এ দেখা ডকুমেন্টারিগুলোর সঙ্গে তো মিলছে না কিছুই! এই কিছুদিন আগেও গেছিল সে, চলমান দেওয়ালগুলোতে দেখানো হচ্ছিল কীভাবে যুদ্ধ, দূষণ, মারণরোগের ফলে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছিল পৃথিবী। তাই হাজার খানেক বছর আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মানবজাতিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে অন্য একটি অনুকূল পরিবেশের গ্রহে, যার নাম ‘বিশসন’। কিন্তু বাদ সাধল কিছু বোকা লোক। তারা তাদের সাধের পৃথিবী ছেড়ে যাবে না কিছুতেই। তাই শেষমেশ ওই পাগলগুলোকে এখানে ফেলে রেখেই বাকিদের নিয়ে বিশসনে পাড়ি দিয়েছিল স্পেসশিপ। তাদের তো এতদিনে কবেই মরে হেজে যাওয়ার কথা। তাহলে এই কুকুরটা এলো কোত্থেকে? কাঁটা ঝোপের খোঁচায় ছিঁড়ে যাচ্ছে চামড়া, হাত-পা চুলকোচ্ছে অনবরত। হিংস্র দৃষ্টিতে সামনে লাফাতে লাফাতে চলা কুকুরটার দিকে তাকাল। একবার একটু জলের খোঁজ পেয়ে যাক, তারপর স্পেসজেট-টাকে সারিয়ে নিয়ে এই বজ্জাত জায়গাটা ছেড়ে ঘরে ফিরবে ও। কিন্তু আর কতদূর? এই হতচ্ছাড়া প্রাণীটা কোথায় নিয়ে চলেছে তাকে? সেখানে গেলে আদৌ জলের খোঁজ পাবে তো? পায়ের যন্ত্রণাটা বাড়ছে ধীরে ধীরে, যেন অসাড় হয়ে আসছে কোমর থেকে নীচের দিকটা। আর পারছে না। খোঁড়াতে খোঁড়াতে দাঁড়িয়ে পড়ল অন্তু। চারপাশের মাটি যেন দুলছে, আস্তে আস্তে চোখের ওপর নেমে আসছে একটা কালো পর্দা। দাঁড়িয়ে পড়েছে কুকুরটাও। খানিকটা এগিয়ে এসে শুঁকছে তাকে, তারপর কী যেন দেখে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে গেল অন্য দিকে। টলে পড়ে যেতে যেতে অন্তুর কানে এল একটা অদ্ভুত খসখসে কণ্ঠস্বর, “এ আবার কাকে নিয়ে এলি দুলি?”

কখন যেন একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছেছে তারা। এখানে জঙ্গলের ঘনত্ব কম। খানিক দূরে দূরে দাঁড়িয়ে গাছগুলো, তার গোড়ায় ঝোপঝাড় তেমন নেই। তেমনি দুটো গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে একখানা মেটে বাড়ি। একটা পাকানো চেহারার লোক এগিয়ে আসছে তার দিকে। উর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, নিম্নাঙ্গে জড়ানো একটা কাপড়। ঘোলাটে চোখে কোনোমতে বিড়বিড় করে ‘জল’ শব্দটা উচ্চারণ করতে পারল অন্তু। তারপর অচেতনতার অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে শেষ মুহূর্তে দেখতে পেল তার দিকে এগিয়ে আসছে একটা হাত।

অদ্ভুত এক উল্কি আঁকা সেই হাতের পাতায়।

***

—“কী খোকা? কেমন লাগছে এখন?”

ঘাড় ঘোরালো অন্তু। বেশ কিছুক্ষণ আগে ঘুম ভেঙেছে তার। আর চোখ মেলতেই এমন একটা ব্যাপার হল, যে এতক্ষণ সেদিকে তাকিয়েই হাঁ করে বসেছিল সে। জানালাটা পেরিয়ে কিছুদূর গেলেই শুরু হয়েছে খাদ। আর সেই খাদের নীচের উপত্যকাটার শেষপ্রান্তে অলস ভঙ্গিতে শুয়ে আছে দুটো পাহাড়। এই তো খানিক আগেও কেমন কালচে ছাই রঙা ছিল আকাশ। তারপর দেখতে দেখতে সেই আকাশের রঙ হয়ে গেল ছানা কাটা জলের মতো। তাতে একে একে মিশল গোলাপি, হলুদ, সোনালী। আর তার কিছুক্ষণ পর পাহাড় দুটোর মাঝখান থেকে টুক করে উঁকি মারল একটা ছোট্ট লাল বলের টুকরো। সেই থেকে তন্ময় হয়ে বসে আছে সে। সেই আধখানা বল এখন আস্তে আস্তে পুরোপুরি ভেসে উঠেছে আকাশের বুকে। কী সুন্দর তার রঙ! এমন সুন্দর রঙের কোলাজ সে কোনোদিন দেখেনি। তবে আপাতত লোকটাকে ভালো করে জরিপ করল অন্তু। সেই খালি গা, আর হাঁটু অব্দি তোলা কাপড়। সঙ্গে মাথায় কাঁচাপাকা ঝাঁকড়া চুল, মুখে বিজবিজে দাড়ি। মুখে কেমন একটা গ্যালগেলে হাসি। ভুরু কুঁচকে গেল অন্তুর। গলায় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বলল, “আমার নাম খোকা নয়।”

—“হেঁ হেঁ, সে হতে পারে। তবে তুমি আমার কাছে খোকাই। আমার বয়স কত জানো?"

—“কত?”

—“সে মেলা বয়স। আমারও কি ছাই মনে আছে? তা খোকা এখন শরীরটা ভালো তো?”

—“আমার নাম অন্তক।” প্রায় ধমকে উঠল অন্তু।

থমকে গেল লোকটা। জুলজুল করে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল তার দিকে। তারপর ফিসফিস করে গোপন কথা জানানোর ভঙ্গিতে বলে উঠল, “অন্তক! অন্তক তো হলেন সাক্ষাৎ বিষ্ণু, যিনি সমস্ত অধর্মের অন্ত করেন!”

বিরক্তিতে ঠোঁট মুচড়ে উঠল অন্তু। বিষ্ণু মানে ওই হিন্দু পুরাণের দেবতা? এই পুরোনো পৃথিবীতে নাকি মানুষ ঠাকুর-দেবতা নিয়ে খুব মাতামাতি করত। তাদের বিশসনে এসবের ঝামেলা নেই। কিন্তু এই লোকটা কে? এখানে কী করছে?

—“আমি তো এখানেই থাকি বাপু। আসলে আমি নয়, আমরা। তোমরা তো যুদ্ধ-টুদ্ধ করে তারপর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে অন্য জায়গায়, আমরা আর কোথায় যেতাম বলো দিকিনি?” বিছানার একপাশে জুত করে বসল লোকটা, “তোমরা চলে যেতে কী হল জানো? সব ঝলসে যাওয়া মাটি বছরের পর বছর ধরে ধীরে ধীরে নরম হল, কচি চারাগাছ মাথা তুলল সেখানে। বাতাসের যত ময়লা ধোঁয়া থিতিয়ে গিয়ে মিলিয়ে গেল একসময়। নদীতে আবার টলটল করল জল, পাখি জীবজন্তু একে একে সব ফিরে এল ছানাপোনাদের নিয়ে। আমাদের পৃথিবী আবার ফিরে পাচ্ছে তার আদিম রূপ। বুঝলে কিনা?”

স্তম্ভিত হয়ে গেল অন্তু। এই লোকটা কি মাথার ভেতরটা পড়তে জানে! সুপারহিউম্যানদের ওপর এরকম একটা টেস্টিং তাদের বিশসনের ল্যাবে চলছে বটে, কিন্তু...

তাকে আর বেশী কিছু ভাবার সময় দিল না লোকটা। খপ করে ওর ডান পা-টা ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, “নাহ্, ব্যথা বেদনা তো সেরে গেছে মনে হয়। এইবার ওঠো দিকিনি চট করে, খানকতক কাঠকুটো কেটে নিয়ে এসো। বেলা বেড়ে গেলে আবার রোদ্দুরের তাতে মাথা যন্ত্রণা করবে। শরীরটা এখনো দুর্বল কিনা!” শেষের বাক্যটায় সহানুভূতি ঝরে পড়ল গলায়।

সেসব অবশ্য ধরা পড়ল না অন্তুর কানে। প্রায় তেড়ে উঠে বলল, “কাঠ কাটতে যাবো মানে?”

—“যাব্বাবা! কাঠ না কাটলে জ্বালানি হবে কীভাবে?” চোখ গোল গোল করল লোকটা, “আর জ্বালানি না পেলে খাবেটাই বা কী?” তারপর আবার সেই গ্যালগেলে হাসিটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “হেঁ হেঁ, এখানে কেউ তোমাকে বসে বসে খাওয়াবে না। বুঝলে কিনা? নিজেরটা নিজেই জোগাড় করতে হবে।”

তারপরে হাতে একটা অদ্ভুত ধরনের যন্ত্র ধরিয়ে দিয়ে তাকে কুঁড়েঘরটা থেকে প্রায় বেরই করে দিয়েছে লোকটা। সঙ্গে অবশ্য দিয়েছে একটা সাদা ঘোড়া, কারণ “শরীরটা এখনো দুর্বল কিনা!” মাথার ভেতরে আগুন জ্বললেও কিচ্ছু করতে পারেনি অন্তু। এই অজানা জায়গায় এসে একা একা খাবারের জোগাড় করবে কী করে? সেই যে কুকুরটার পেছন পেছন চলে এল, স্পেসজেট-টা কোথায় পড়ে রইল কে জানে! তবে একবার ওর ভাঙা গাড়িটা খুঁজে পেলে আর সেখান থেকে ফুড পিলগুলো হস্তগত করতে পারলেই কেল্লাফতে। তখন ওই খেঁকুড়ে বুড়োকে বুঝিয়ে দেবে সে কী জিনিস!

—“আহ্!” একটা চাপা আর্তনাদ ছিটকে এল অন্তুর মুখ থেকে। লাফাতে লাফাতে এগিয়ে চলেছে ঘোড়াটা, আর ঝাঁকুনির চোটে তার শরীরের সব হাড় খুলে যাওয়ার জোগাড়! জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ঘোড়াটাকে দেখতে দেখতে নিজেকে সামলালো অন্তু। এইসব প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারের অভ্যেস নেই তার। বিশসনে নিজস্ব স্পেসজেট ব্যবহার করেই ঘুরে বেড়ায় সবাই। তার ওপর আবার কাঠ কাটার জন্য এইসব যন্ত্রপাতি! হাতের যন্ত্রটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল সে। ঠিক এটারই একটা ট্যাটু করা আছে লোকটার হাতে। সত্যিই আদিম যুগে এইসব জিনিস দিয়ে লোকে কাঠ কাটত, জ্বালানী বানিয়ে সেই আগুনে রান্না করত, মুভিতে দেখেছে। কিন্তু এইসব ব্যবহার করে সে নিজে কী করে কাঠ কাটবে? ওদের ওখানে তো সবসময় রোবোহ্যান্ড থাকে যেকোনো কাজ করে দেওয়ার জন্য...

চিন্তায় ছেদ পড়ল। দাঁড়িয়ে পড়েছে ঘোড়াটা। এতক্ষণ দুলকি চালে সামনে সামনে হাঁটছিল দুলি, এখন তাকে ঘিরে ছোট ছোট লাফ দিচ্ছে। এটাই বোধহয় কাঠ কাটার জায়গা, নামতে হবে। তেতো মুখে কোনোমতে ঝুলতে ঝুলতে ঘোড়া থেকে নামল অন্তু। জায়গাটা পাহাড়ের বেশ খানিকটা উঁচুতে। এখানে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে মোটা কাষ্ঠল গাছ। খানিক দূরে একটা ঠক ঠক শব্দ হচ্ছে। অন্য কেউ কাঠ কাটছে বোধহয়। বেরোনোর আগে অনেক জ্ঞান দিয়েছে লোকটা, এও বলেছে যে ওরা কোনো প্রয়োজনে একটা গাছ কাটলে নাকি আবার একটা গাছ লাগায়। তাই সে যেন কাঠ কেটে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে, তারপর তারা যাবে গাছের চারা লাগাতে। যত্তসব! একটা লম্বা গাছের সামনে গিয়ে চারপাশটা জরিপ করতে লাগল অন্তু। এটা একটু সরু, সহজেই কাটতে পারবে বোধহয়। মরিয়া হয়ে আনাড়ি হাতে মাথার ওপর তুলল যন্ত্র টা। শরীরের সব শক্তি দিয়ে কোপ মারতে যেতেই এক ঝটকায় হাত থেকে ছিটকে পড়ল যন্ত্র, আর সে গড়িয়ে গেল মাটিতে!

তাড়াতাড়ি ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল অন্তু। দুলি তীরবেগে ছুটে গেছে যন্ত্রটার দিকে। ঘোড়াটা কেমন যেন ফরফর শব্দ করছে। হাসছে নাকি? ব্রহ্মতালু অব্দি জ্বলে গেল অন্তুর। আচ্ছা, গাছ না কেটে এই বেয়াদব দুটোর মাথা কেটে নিলে কেমন হয়? আজ অব্দি কোনো গ্রহের কোনো প্রাণী দাঁড়াতে পারেনি মানুষের সামনে, আর সে কিনা বিশসনের অন্যতম সেরা যোদ্ধা হয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছে এই সামান্য জানোয়ারগুলোর কাছে! দাঁতে দাঁত ঘষে অন্যদিকে মুখ ঘোরালো। নাহ্, এই জানোয়ার দুটো ছাড়া ওই কুঁড়েটায় ফেরা যাবে না। আর তার স্পেসজেট-টাও...

হঠাৎ সামনের দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল অন্তুর। ঘন সবুজ ঘাসের বুক চিরে একটা কালো হিলহিলে শরীর এগিয়ে আসছে তার দিকে। সাপ! হ্যাঁ, এই জিনিসটা তো সাপই! এক ছোবল দিয়েই মানুষকে ঘায়েল করতে পারে! একটা পাগলা ঘন্টি বেজে উঠল মাথার মধ্যে। দেরী করা চলবে না, এক্ষুণি নিকেষ করতে হবে এটাকে! হাত মুঠো করে এদিক ওদিক তাকাল অন্তু। একটা কিছু চাই। চারদিকে শুধু বিশালাকৃতি গাছ আর ঘন ঝোপ, পাথরের টুকরোও চোখে পড়ছে না। কাঠ কাটার যন্ত্রটা ছিটকে পড়েছে দূরে... এদিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে পিচ্ছিল শরীরটা... সম্মোহিতের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রথমবারের জন্য বুঝতে পারল অন্তু, কৃত্রিম অস্ত্র ছাড়া সে কতটা অসহায়! অনুভব করল আরো একটা জিনিস। ভয় নামের একটা শক্ত জমাট বাঁধা অনুভূতি তখন তার তলপেট থেকে উঠে আসছে গুমগুম শব্দে, শিরদাঁড়ার ওপর দিয়ে নাচতে নাচতে নেমে যাচ্ছে আতঙ্ক নামের ঠান্ডা জলের স্রোত। পা দুটো যেন কেউ গেঁথে ফেলেছে মাটির সঙ্গে, একচুলও নড়তে পারছে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো বড় হচ্ছে চকচকে মাংসল ফিতেটা, আরো কাছে এসে পড়েছে। দুর্বল হাঁটুতে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল অন্তু, একটা বুকফাটা চিৎকার বেরিয়ে এল গলা থেকে। সে দেখতে পাচ্ছে তার মৃত্যুকে, আর মাত্র কয়েক মুহূর্ত...

এমন সময় ঘটে গেল একটা অভাবনীয় ঘটনা। কোথা থেকে ঘাউ ঘাউ হুঙ্কার দিতে দিতে ছুটে এল দুলি! দাঁত বের করে প্রবল আক্রোশে তেড়ে গেল সাপটার দিকে। ওদিকে অন্তুকে ঘিরে ফেলেছে একটা সাদা শরীর, কখন যেন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ঘোড়াটা। এক মুহূর্ত থমকে গিয়েই দিক পরিবর্তন করে দুলির দিকে ঘুরে গেল সাপটা, অগ্রসর হতে থাকল দ্বিগুণ বেগে। হিংস্র ভঙ্গিতে দৌড়তে থাকল দুলি, সাপটাও যেন তাড়া করল উন্মত্তের মতো! এইভাবে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর একলাফে একটা উঁচু পাথরের চাঁইয়ের ওপর উঠে পড়ল দুলি। সম্ভবত আর তার হদিশ না পেয়ে পাথরের পাশ দিয়ে সরসর করে চলে গেল হিলহিলে শরীরটা।

অমনি কোথা থেকে যেন ভেসে এল একটা বাজখাঁই আওয়াজ, “সাব্বাস দুলি!”

ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অন্তু। একটা গাছের পেছন থেকে হাততালি দিতে দিতে এগিয়ে আসছে খেঁকুড়ে লোকটা। অবাক হয়ে তাকে দেখতে দেখতে হঠাৎ রাগে চিড়বিড় করে উঠল অন্তুর শরীর। চিৎকার করে বলল, “অ্যাই! তুমি এতক্ষণ এখানে মজা দেখছিলে?”

থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। ওদিকে অন্তু চেঁচিয়েই চলেছে, “তুমি মেরে ফেলতে পারলে না ওটাকে?”

—“মেরে ফেলব! কেন?” লোকটা যেন বেভুল চোখে তাকাল ওর দিকে।

—“কেন মানে কী!” আবার তেড়ে উঠেছে অন্তু, “কী হবে ওগুলোকে বাঁচিয়ে রেখে? যতসব হিংস্র বিষাক্ত জিনিস! তোমাদের জল বাতাস সবকিছুতে এরা ভাগ তো বসাচ্ছেই, উল্টে ক্ষতি করা ছাড়া কোনো কাজে লাগে না। তোমরা বোকা না পাগল, অ্যাঁ? তোমাদের জায়গা এরা দখল করছে বুঝতে পারছ না? এই জন্যই! এইজন্যই সবাই চলে গেছে এই গ্রহ ছেড়ে, আর তোমরা পড়ে আছো মরার জন্য!”

—“আমাদের জায়গা?” খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল লোকটা। “সে আবার কী গো! আমাদের একার জায়গা নাকি! এই যে বড় বড় গাছ, তার কোটরে বাসা বাঁধা পোকা, ডালে বসা পাখি... ওই যে ঘাসফড়িং, কাদা জলের গর্তের পাশে ব্যাঙটা, ওই সাপটা, দুলি, আমার এই রাজু... এদের সবারই তো জায়গা!” ঘোড়াটার গলায় হাত বোলাতে বোলাতে পরম তৃপ্তিতে বলে চলল লোকটা, “আমাদের সবার একটাই মা। এই পৃথিবী। এখানে আমরা মিলেমিশে একসাথে থাকি, খাই দাই বাজনা বাজাই! আসলে জানো তো...” ওর খুব কাছে এগিয়ে এল লোকটা। তারপর চোখে চোখ রেখে গাঢ় স্বরে বলে উঠল, “এই বাতাস, এই জল, এই মাটি, এই আকাশ যতখানি আমার, ঠিক ততখানি ওদেরও। এমনকি তোমারও। একে কী বলে জানো? ভালোবাসা। বুঝলে কিনা?”

কী এক অদ্ভুত মায়া ছিল লোকটার গলায়, কিছু বলে উঠতে পারল না বিশসনের অন্যতম সেরা যোদ্ধা। এতদিনের সবকিছু, সব হিসেব নিকেশ যেন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মাথা নীচু করল অন্তু। ওর পিঠে হাত রাখল লোকটা, নরম গলায় বলল, “চলো, ঘরে যাই। কাল সকালে আবার আসব কাঠ কাটতে। আস্তে আস্তে ঠিক শিখে যাবে। এখন চলো।”

তাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে দিয়ে “চল রাজু” বলে ঠেলা দিল লোকটা। পাশে দাঁড়িয়ে দুলি তখনও লেজ নাড়ছে। অন্তুর মুখের দিকে স্নিগ্ধ ভঙ্গিতে চেয়ে বলল, “এই দুলি, রাজু, এদেরকেও তো মারতে চেয়েছিলে তুমি। ওরা কি বোঝেনি ভেবেছ? খুব বুঝেছে! তাও ছেড়ে যায়নি তোমাকে। নিজের জীবন বিপন্ন করেছে তোমার জন্য। কেন?”

এই “কেন?” শব্দটা যেন সটান গিয়ে ধাক্কা মারল অন্তুর ভেতরে। সে অবাক হয়ে দেখল তার বুকে শুরু হয়েছে যেন একটা অন্যরকম কাঁপুনি। একদম অচেনা। তাকিয়ে দেখল চলতে শুরু করেছে রাজু, সামনে সামনে দুলিকে নিয়ে হাঁটছে লোকটা আর আপন মনেই বিড়বিড় করতে শুরু করেছে, “তোমরা তো বুঝলেই না কথাগুলো! অভিমান করে চলে গেলে। শুধু কি আমি আমি করলে হয়? মায়ের অসুখ করলে ছেলেকে তার সেবা করতে হয় তো নাকি! আমরা ক’জন এখনও লড়ে যাচ্ছি... কী করব, আমাদের এই পৃথিবীতেই বাঁচা ছাড়া তো উপায় নেই...”

অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল অন্তু। একটা সোনালী আলোয় ভরে আছে চারদিক, তার মাঝে সবুজ বনানী তৈরী করেছে চোখজুড়োনো পরিবেশ। ঠিক তার স্বপ্নের মতো। পথের পাশেই একটা নীচু ডালে টুই টুই করে ডাকছে একটা ছোট্ট পাখি, মাথায় লাল ঝুঁটি। সেদিকে তাকিয়ে থাকল একদৃষ্টে। ডাকটা আর অসহ্য লাগছে না তার।

***

—“এনি ট্রেস?”

—“নাহ্। নট টিল নাও!” হতাশ গলায় আর্মচেয়ারে হেলান দিল কমলিকা ওরফে কলি-৩৫২।

ঘরের অন্য প্রান্তের অন্ধকার কোণাটা থেকে ভেসে এল একটা অধৈর্য গলা, “আর কত দিন? একটা বাচ্চা ছেলেকে খুঁজে বের করতে এত সময় লাগছে কেন?”

বিব্রত ভাবে অন্যদিকে মুখ ঘোরালো কলি। ছেলেটা যে অন্তক! অন্য কেউ হলে যে চিন্তার এত কারণ ছিল না সেটা ওই অন্ধকারময় মহাশক্তিমান সুপার রোবোকিং-ও জানে। দুহাতে রগটা টিপে ধরে বলল, “চেষ্টা তো চালাচ্ছি। কিন্তু কোনোভাবেই...”

—“তাহলে এত মেহনত করে তোমাদের বানিয়েছে কেন আমার রোবোটরা!” ধমকে উঠল যান্ত্রিক গলা, “যদি একটা মানুষের বাচ্চাকেই না সামলাতে পারবে!”

চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল কলির। মাথা নীচু করে নখ খুঁটতে লাগল। শুধু সে কেন, কলি সিরিজের কোনো সুপারউওম্যানই আজ অব্দি বাগে আনতে পারেনি ছেলেটাকে। চিন্তা করার, ভালোমন্দ বিচার করার একটা অদ্ভুত স্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে ছেলেটার। আর সবথেকে আশ্চর্যের হল ওর নৃশংসতা! যেকোনো জীবিত প্রাণীকে মুহূর্তের মধ্যে মেরে ফেলতে কোনো কারণ লাগে না অন্তকের। ওর এই নৃশংসতা বিশসনের আর্মি রেজিমেন্টের অন্যতম সম্পদ।

—“গোটা প্ল্যানেটের প্রত্যেকটা মানুষকে নিজেদের কন্ট্রোলে এনেছি, শুধুমাত্র ওই বেয়াদব ছোঁড়াটাকে ছাড়া। এত পরিমাণ নেগেটিভ এনার্জি ওর ভেতর, যদি ঠিক ডিরেকশনে চালানো যেত তাহলে কী হত চিন্তা করতে পারছ! আমার এতগুলো যন্ত্র দিনের পর দিন ল্যাবে মাথা গুঁজে মানুষের মিউটেশন করে তোমাদের মতো সুপারহিউম্যান বানাচ্ছে কি বসে বসে নখ খোঁটার জন্য?” গর্জে উঠল খনখনে আওয়াজ, “ছিয়ানব্বই ঘণ্টা! মানে বিশসনে একটা গোটা দিন কেটে গেল, এখনও বুঝতে অব্দি পারলে না ছেলেটা কোথায় আছে!”

তটস্থ হয়ে উঠল কলি। কলি-প্রাইমের মেজাজ বড় ভয়ঙ্কর! একদিন বুদ্ধিমান মানবজাতিই এই কলি-প্রাইমকে বানিয়ে তার হাতে গ্রহ পরিচালনার ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিল, কারণ যোগ্য নেতার তখন বড় অভাব ছিল। কিন্তু সেই কলি-প্রাইমই যে তারপর নিজের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছে সৈন্যদল, টেস্টটিউব বেবিদের মিউটেশনের ফলে তৈরী করেছে তাদের মতো সুপারহিউম্যানদের, তা সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে। কারণ তারা এটাও জানে না যে তাদের চিন্তাশক্তির জগতেও থাবা বসিয়েছে কলি-প্রাইম, হারিয়ে গেছে তাদের স্বাধীন চিন্তাশক্তি! তারা নিজেদের মতো খুশি আছে দৈনন্দিন জীবনে, বিনোদনে। একমাত্র অন্তক ছাড়া!

“আপনি চিন্তা করবেন না প্রাইম, ওকে আমরা খুব শিগগিরই খুঁজে...” বলতে বলতে থমকে গেল কলি। দেওয়াল জোড়া হলোগ্রাফিক স্ক্রীন থেকে তীক্ষ্ণ শব্দে ভেসে আসছে সঙ্কেত। লাল আলো সন্ধান দিচ্ছে এ এন টি ওয়ান জিরো নাইন ফোর এর।

কোঅর্ডিনেটসগুলো দেখে চমকে উঠল কলি!

কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা। তারপর ঘরের অন্য প্রান্ত থেকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল যান্ত্রিক স্বর, “ছলে বলে কৌশলে যেভাবেই হোক ফিরিয়ে আনো অন্তক-কে!”

***

—“আটানব্বই, নিরানব্বই, একশো।”

হাঁফাতে হাঁফাতে ঘাসের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল অন্তু। ওপাশে আরেকজন তখনো ডনবৈঠক করেই চলেছে, “একশো এক, একশো দুই...” একশো পঞ্চাশ শেষ করে সেও শুয়ে পড়ল অন্তুর পাশে। “কাল আরো বাড়াব।” লজ্জা লজ্জা মুখে বলে উঠল অন্তু। মৃদু হাসি ভেসে এল উল্টো দিক থেকে।

খোলা আকাশের দিকে মুখ তুলল। যতদূর চোখ যায় ঘন নীল উজ্জ্বল আকাশ, তাতে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘ। বুকভরে শ্বাস টানল অন্তু। আহ্, কী সতেজ বাতাসটা! এই নীল আকাশ, ওই সবুজ পাহাড়... এদের দিকে কিছুক্ষণ তাকালেই মনটা ভালো হয়ে যায়। কেটে যায় সব ক্লান্তি। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকল সে। তারপর উঠে বসতেই কোথা থেকে দুলি ছুটে এল লেজ নাড়তে নাড়তে। পিঠে হাত বুলিয়ে দিল অন্তু। এখন এই লেজ নাড়াটার মানে জানে ও। “কী হে দুলি বাবু! খুব তো আদর খাওয়া হচ্ছে দেখছি!” কখন যেন উঠে গেছে লোকটা, হাতে একটা মেলানো কলাপাতা নিয়ে কুঁড়ে থেকে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এল। নিজের নাম শুনেই হোক, কিংবা খাবারের গন্ধে, দুলি ছুটে গেছে তড়িঘড়ি করে। মুখ ডুবিয়ে দিল কলাপাতায় ছড়ানো ভাতের মণ্ডে। “তারপর? কেমন লাগল ডনবৈঠক করে?” অন্তুর সামনে বাবু হয়ে বসল লোকটা।

সামান্য হাসল অন্তু। “ভালোই। ওখানে তো এসব করে অভ্যেস নেই, দরকারও পড়ে না। ওয়ারে গেলে মেশিন দিয়েই সবকিছু কন্ট্রোল করা যায়, গায়ের জোর লাগে না।”

—“আচ্ছা, তোমরা এত যুদ্ধ-টুদ্ধ কেন করো বলোতো বাপু! এখানে তো যুদ্ধ করে করে পৃথিবীটা ধ্বংস করে গেলে, আবার ওখানে কীসের যুদ্ধ?” কৌতূহলী গলা ভেসে এল।

—“না, মানে...” কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল অন্তু, “আমরা মূলত অন্য যে গ্রহগুলোতে প্রাণ আছে, বা মানুষের বসবাসযোগ্য অনুকূল পরিবেশ আছে, সেই গ্রহগুলো দখল করি। কমলিকা বলে একসময় পৃথিবীর মতোই বিশসনও হয়ত ছাড়তে হবে আমাদের, তাই মানবজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করে রাখা হচ্ছে। কারণ মানুষই হল ব্রহ্মাণ্ডের শ্রেষ্ঠ জীব।”

যেন ভীষণ মজার কথা শুনেছে এমনভাবে কিছুক্ষণ খ্যা খ্যা করে হেসে গড়াগড়ি খেল লোকটা। তারপর বলল, “কমলিকা-টা কে? তোমার গুরু?”

—“গুরু নয়। ও আমাদের আর্মির চিফ। ওর অনেক ক্ষমতা। এরকম অনেকগুলো আর্মি আছে আমাদের, সব্বার একটা করে কমলিকা আছে।” বিশসনের কথা বলতে আর ভালো লাগছিল না অন্তুর। কথা ঘুরিয়ে বলল, “তোমার নামটা তো বললে না? কী নামে ডাকব তোমাকে?”

- “আমার আবার নাম!” আবার হাসছে লোকটা। তরল গলায় বলল, “আমি বাপু পাগল ছাগল লোক। রাম-শ্যাম-যদু-মধু কিছু একটা নাম বসিয়ে নিলেই হয়!”

—“আচ্ছা...” এবার হেসে ফেলেছে অন্তুও, “প্রথম নামটাই রাখলাম তবে। রাম।”

—“তাই সই!”

—“আচ্ছা রাম, আমি তো পুরোনো ইতিহাসে পড়েছি পৃথিবী একেবারে একটা মৃত গ্রহে পরিণত হয়েছিল। তাহলে আবার এইরকম গাছপালা, নদী, এত পশুপাখি... এসব হল কীভাবে?”

—“ওই যে বলেছিলাম! মানুষ চলে গেল বলে!” ঘসঘস করে দাড়ি চুলকোল রাম, “যুদ্ধ-দূষণ-প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব শেষ হয়ে গেলেও কোথাও হয়ত বেঁচেছিল একটা ছোট্ট চারাগাছ। কোথাও হয়ত মুখ লুকিয়ে ছিল একটা প্রজাপতির লার্ভা। এভাবেই সেই একটা প্রাণ থেকে ধীরে ধীরে জন্ম নিল হাজার প্রাণ। গাছেরা ডেকে আনল বৃষ্টিকে, বৃষ্টি ফল দিল, ফুল ফোটাল। এইভাবেই সব চলছে।” বলতে বলতে উঠে পড়ল রাম, “তুমি বসো, আমি চাট্টি দানাপানির ব্যবস্থা করি গে।”

আপনমনে ঘাসের ওপর হাত বোলালো অন্তু। একটু দূরেই এক ঝোপ থেকে অন্য ঝোপে উড়ে বেড়াচ্ছে একটা হলদে প্রজাপতি, দুলি লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছে তার সঙ্গে। সবকিছু কত সুন্দর, কত নির্মল! হঠাৎ গলার ভেতরটায় দলা পাকিয়ে উঠল অন্তুর। এই গ্রহ তো তারও হতে পারত! যদি মানুষে মানুষে যুদ্ধ না হত, মানুষ স্বার্থপরের মতো ব্যবহার না করত গাছপালা জীবজন্তুকে, তাহলে আজ হয়ত এটাই হত তার ঠিকানা, তার ঘর! বিশসনে মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর বাঁচার অধিকার নেই, একমাত্র প্রয়োজনীয় কয়েকটা জীব ছাড়া আর কিছুই নেই ওখানে। কিন্তু ওখানে কি আছে এই নরম ঘাসে শুয়ে থাকার আনন্দ, দুলি আর রাজুর সঙ্গে খেলার মজা, কিংবা ঝরণা থেকে জল খাওয়ার শান্তি? কী আছে তার ওখানে? কে আছে? বিশসনের আর পাঁচটা বাচ্চার মতোই জন্মের পর থেকেই হারিয়ে গেছে তার জৈবিক মা-বাবার নাম, শিশু প্রতিপালন কেন্দ্রে বড় হওয়ার পর দক্ষতা অনুযায়ী তাকে তৈরী করা হয়েছে যোদ্ধা হিসেবে। কত যান্ত্রিক সে জীবন! ভালোবাসা, সহমর্মিতা এসব শব্দ ওখানে ভিনগ্রহীদের মতোই নিষিদ্ধ। আর এখানে? ওই লোকটা, রাম... ওকে কেন এত আপন, এত কাছের মনে হয় তার? ও কি তার খুব চেনা কেউ? গতকালই পুরাণের, পুনর্জন্মের গল্প শোনাচ্ছিল রাম। তবে ও কি তার কোনো জন্মের কেউ ছিল? দু হাত ছড়িয়ে আবার ঘাসের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল অন্তু। হয়তো এটাই তার ঘর। তাই ঘরের কথা মনে করতেই ওর স্পেসজেট ওকে এনে ফেলেছে এখানে। আর ফিরতে চায় না সে। এই কাঠুরের জীবন, এই প্রকৃতির কোল এসব ফেলে আর যেতে পারবে না কোনোদিন। বড় মায়া এখানে, বড় মায়া!

নাম না জানা একটা সাদা ফুলের গাছ ফুল ঝরাচ্ছিল অন্তুর ওপরে। বড় বড় সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে অন্তু দেখতেও পেল না একটা কালো ফুটকি ক্রমশ বড় হচ্ছে আকাশের বুকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শোঁ শোঁ শব্দে প্রচণ্ড ঝড় উঠল গাছের পাতায় পাতায়! উঠে দাঁড়িয়েছে অন্তু। অবাক হয়ে বেরিয়ে এসেছে রাম, দুলিও খেলা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। পাখির ছিঁড়ে যাওয়া পালকের মতো ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে একটা পটলাকৃতি বস্তু, মাটির কিছুটা ওপরে এসে হঠাৎ যেন স্থির হয়ে তারপর মাটি ছুঁল আস্তে আস্তে। কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা, তারপরেই ঝড়াং করে সরে গেল দরজা। বাইরে বেরিয়ে এল একজোড়া পা।

বিস্ফারিত চোখে বাকিরা তাকিয়ে থাকলেও চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল অন্তুর। এমন কিছু একটার আশঙ্কা যে সে করেনি তা নয়! বিস্মিত দৃষ্টিতে চারদিক দেখতে দেখতে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে এল কলি-৩৫২ ওরফে কমলিকা। অন্তুর দিকে ভুরু নাচিয়ে বলল, “হাই বাডি! তুমি ল্যান্ড করার আর গ্রহ পেলে না!” তারপর আশেপাশের পরিবেশের দিকে ইশারা করে কাঁধ ঝাঁকাল, “তবে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। আর্থ হ্যাজ রিকভারড আ লট! এটা আমাদের ক্যালকুলেশনের বাইরেই ছিল!”

দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে ছিল অন্তু। কমলিকার কথা শেষ হলে মোলায়েম অথচ দৃঢ় গলায় বলল, “দেখা হয়ে গেছে তো? এবার চলে যাও। আর এসো না এদিকে।”

—“চলে যাও মানে! আরে তোমাকেই তো নিতে এসেছি মাই লাভ!” দু'হাত বাড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল কমলিকা।

আস্তে আস্তে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল অন্তু। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, “আমি যাবো না।”

—“যাবে না! বিশসনে ফিরবে না তুমি! হোয়াই?” এবার অবাক হয়েছে কমলিকা।

—“আমার ইচ্ছে।” সংক্ষিপ্ততম উত্তর এল।

হঠাৎ খ্যাক খ্যাক করে বেয়াড়ার মতো হেসে উঠল রাম। লাফিয়ে উঠে হাততালি দিয়ে বলল, “ওরে দুলি, অন্তুবাবু তো এখানেই থাকবে রে! কী মজা!”

বাঁকা দৃষ্টিতে তাকে দেখল কমলিকা। তারপর অন্তুর দিকে ঘুরে খরখর করে বলল, “হোয়াট দ্য হেল ইজ গোইং অন! তুমি কি আমার সঙ্গে মজা করছ অন্তক! তুমি বিশসনে ফিরবে না? নিজের প্ল্যানেটে ফিরবে না?”

—“এটাই আমার প্ল্যানেট, আমার জগৎ।” শান্ত স্বরে বলল অন্তু।

—“কিন্তু যেতে তো তোমাকে হবেই।” কমলিকার মুখের হালকা হাসিটা আস্তে আস্তে মুছে গিয়ে তার জায়গায় উঠে আসছিল একটা হিংস্র বিষাক্ত অভিব্যক্তি। এই মুখটা অন্তু চেনে। এর আগে অন্যান্য অনেক গ্রহ ধ্বংস করার সময়, সেই অধিবাসীদের নৃশংস ভাবে হত্যা করার খেলায় এই অভিব্যক্তিটা উঠে আসতে দেখেছে কমলিকার মুখে। তাই এর পরে কী ঘটতে চলেছে যেন মানসচক্ষে দেখতে পেল সে। কিন্তু ধারণা ছিল না বাকীদের। তাই এরপরে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলোর সামনে স্রেফ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রইল বাকীরা।

অন্তুকে ছেড়ে এবার বাকী প্রাণীগুলোর দিকে ঘুরে গেল কমলিকা ওরফে কলি-৩৫২। আস্তে আস্তে তার শরীরের প্রত্যেকটা কোণ মুড়ে যেতে লাগল হীরের পাতে! তার শরীরের সমস্ত রক্ত মজ্জা অস্থি যেন স্তরে স্তরে পরিবর্তিত হতে থাকল কঠিনতম পদার্থে, আর আঙুলের ফাঁক দিয়ে বাইরে উন্মুক্ত হল চকচকে ধারালো হীরের ফলা! হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রামের দিকে ততক্ষণে দৌড়তে শুরু করেছে অন্তু, কারণ রামের বিবশ দৃষ্টির সামনে তারই শরীরের দিকে ছুটে আসছে একঝাঁক তীক্ষ্ণ হীরকফলা! শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে রামকে এক বিশাল ধাক্কা মেরে নিজে এসে পড়ল ফলাগুলোর সামনে।

দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করল অন্তু। এই শেষ। মুক্তি এই ঘৃণ্য জীবন থেকে। আজ শেষ পর্যন্ত নিজের ঘরে ফিরবে সে। খোলা আকাশের নীচে নরম মাটির কোলে আজ নিশ্চিন্তে ডুব দেবে চিরঘুমে।

—“কেঁউ!”

মর্মান্তিক এক আর্তনাদে চোখ খুলে তাকাল। আর সেই সঙ্গে এক বুকফাটা হাহাকার ছিটকে এল তার গলা দিয়েও!

সবার অলক্ষ্যে কখন যেন ছুটে এসেছে দুলি। অন্তুকে আড়াল করে ধারালো ফলাগুলোর সামনে ঝাঁপ দিল সেই মনুষ্যেতর জীব, যে এর আগেও নিজের জীবন বাজি রেখেছিল তার নতুন বন্ধুর জন্য। তীক্ষ্ণ পাতে মুহূর্তে ফালাফালা হয়ে গেল তার নরম শরীরটা, খেলনার ভাঙা টুকরোর মতো ছড়িয়ে পড়ল অন্তুর কোলে!

কী যেন হয়ে গেল অন্তুর ভেতর। রাগ, ভয়, আনন্দ ইত্যাদি অনুভূতির ভিড়ে জীবনে এই প্রথমবার তার বুকে গিয়ে ধাক্কা মারল বেদনা। একটা সামান্য প্রাণী, যাকে কিছুদিন আগেও হত্যা করার কথা ভেবেছিল সে, আজ তার রক্তাক্ত মৃতদেহ কোলের ওপর লুটিয়ে থাকতে দেখে কষ্টে যন্ত্রণায় ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যেতে থাকল তার বুকের ভেতরটা। উষ্ণ নোনতা জলের ধারা প্রথমবারের জন্য তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল, বুঝিয়ে দিতে থাকল কেউ যেন তার আপন ছিল। আর আজ তাকে ছিনিয়ে নেওয়া হল তার থেকে। দুলির শরীরটা বুকে জড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে ডুকরে কেঁদে উঠল অন্তু।

এদিকে কলি ততক্ষণে মেতে উঠেছে তার ধ্বংসলীলায়। তার শরীর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছিটকে বেরোচ্ছে ধারালো ফলা, ছিন্নভিন্ন করে ঝরা পাতার মতো মাটির ওপর খসিয়ে দিচ্ছে বনের সমস্ত গাছপালা পশু পাখিকে! তাদের কানফাটা আর্তনাদে কেঁপে উঠছে পাহাড়। অবশ হয়ে বসে থাকা অন্তুর কানে একসময় আঘাত করল সেই সম্মিলিত হাহাকার। চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়াল সে। এই দানবের মারণযজ্ঞ যেভাবেই হোক থামাতে হবে তাকে! যে ভয়ঙ্কর রাক্ষসের জন্ম দিয়েছে তারা, আজ সেই জীবকে নিশ্চিহ্ন করার দায়িত্বও তাদেরই ওপরে। নির্ভীক পায়ে গিয়ে কলির সামনে দাঁড়াল অন্তু।

তার দিকে ঘুরল কলি। এই প্রথমবারের জন্য বিশসনের সেরা মানব যোদ্ধার মুখোমুখি দাঁড়াল বিশসনের সবচেয়ে শক্তিশালী অতিমানবী। সুপারউওম্যানদের গ্রুপের সর্বশ্রেষ্ঠ এই কলি-৩৫২, যে নিজের শরীরকে পরিণত করতে পারে কঠিনতম পদার্থ হীরেতে। যার ধ্বংস নেই, বরং জন্ম হয়েছে ধ্বংস করার জন্য। আজ তার সামনে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র ভাবে শুধু একবুক সাহস নিয়ে দাঁড়িয়েছে অন্তু। তার দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ছুঁড়ে দিল কলি, “শখ মিটেছে? নাকি আরো লড়াই চাও?”

কোনো উত্তর না দিয়ে প্রচণ্ড রাগে পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা বিরাট পাথর ছুঁড়ে মারল অন্তু! তুলোর বলের মতোই কলির গায়ে লেগে একপাশে গড়িয়ে পড়ল পাথরটা।

হিসহিসিয়ে উঠল কলি, “বোকা মানুষ! মরো তবে।”

সূর্যের আলোয় যেন ঝলসে উঠল কলির হীরের শরীর! সেই প্রতিফলনে চোখ ধাঁধিয়ে গেল অন্তুর। দ্বিগুণ বেগে তার শরীর থেকে নির্গত হতে থাকল আগুনের মতো তপ্ত ফলা, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে লাগল কচিঘাস। প্রায়ান্ধ চোখে দু'পা পেছোতে যেতেই হোঁচট খেয়ে একটা বিশাল পাথরের পেছনে গড়িয়ে পড়ল অন্তু, বাহু ঘেঁষে বেরিয়ে গেল একটা ফলা। চামড়া কেটে রক্ত পড়ছে দরদর করে। আর বোধহয় বাঁচার আশা নেই!

ঠিক সেই সময় তার ভীত কাঁধের ওপর এসে পড়ল একটা হাত। সজল চোখে সেই হাতের ওপর হাত রাখল অন্তু, ধরা গলায় বলল, “সব শেষ হয়ে গেল, রাম! আজ আমার জন্য তোমাদেরও মরতে হবে!”

যেন বহুদূর থেকে ভেসে এল একটা জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর, “কিচ্ছু হবে না। এই নাও।”

রামের গলার স্বরে চমকে পেছনে তাকাল অন্তু। কোথায় সেই কালো সিড়িঙ্গে শরীরটা! তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন একজন গৌরবর্ণ দীর্ঘদেহী ব্রাক্ষ্মণ! ধবধবে সাদা পৈতের গাছা শোভা পাচ্ছে তাঁর চওড়া বুকে, হাওয়ায় উড়ছে সাদা চুল দাড়ি। গেরুয়াবসন পরিহিত শরীরে প্রকট হয়ে উঠেছে পুরুষ্টু মাংসপেশী! কলির আক্রমণের সামনে তার ধাক্কায় পড়ে যাওয়ার ফলে কপালের একপাশে তৈরী হয়েছে সামান্য ক্ষত, কিন্তু কী অদ্ভুত এক দীপ্তি খেলা করছে হাস্যময় মুখটাতে! সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে রইল অন্তু, শুধু জড়ানো গলায় বলতে পারল, “তুমি... আ-আপনি কে?”

—“সেটা জানার সময় এখন নয়,” মেঘমল্লারের মতো বেজে উঠল সেই স্বর, “এটা তোমার লড়াই, তোমাকেই শেষ করতে হবে।” বলতে বলতে তার দিকে হাতের পাতা মেলে দিলেন সেই সৌম্যকান্তি ঋষি। আর অন্তুর বিস্ফারিত চোখের সামনে ঘটে গেল এক অদ্ভুত জাদু! হাতের পাতায় আঁকা সেই তিন ইঞ্চির উল্কিটা হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠতে লাগল, পরিণত হল এক তিনফুট লম্বা কুঠারে! সূর্যের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল তার ধারালো ফলা। বিস্ময়ের চরমসীমায় পৌঁছে তখন প্রায় বাকরুদ্ধ অন্তু, কাঁপা কাঁপা হাতে কোনোমতে তুলে নিল কুঠারটা। তারপর অস্ফুট স্বরে বলল, “কিন্তু এতে কি ছেদ করা সম্ভব ওই হীরের বর্ম...?”

—“সম্ভব...” ভরসা দিলেন সেই যোগী পুরুষ। তাঁর মর্মভেদী চোখ রাখলেন অন্তুর চোখে, আর দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “মাতৃরক্ত লেগে যে কুঠারে, তার থেকে অভিশপ্ত আর কী হতে পারে? অনেক পাপের বোঝা এর ওপর, তাকে লাঘব করো তুমি। যাও, এগিয়ে যাও।”

ওদিকে দীর্ঘক্ষণের তির বর্ষণে যেন কিছুটা ক্লান্তই হয়ে পড়েছিল কলি, তবুও বিরাম ছিল না তাণ্ডবলীলায়। তছনছ করে দেওয়া বিস্তীর্ণ উপত্যকার দিকে তাকিয়ে যেন উল্লাসে চকচক করছিল তার হীরের দুই চোখ! তাই বুঝতেও পারল না কুঠার হাতে তার দিকে এগিয়ে আসা যোদ্ধার উপস্থিতি। যতক্ষণে বুঝল ততক্ষণে অনেকটাই কাছে এসে গেছে অন্তু। তাকে দেখামাত্র একটা করুণার হাসি ছুঁড়ে দিয়ে উদ্যত ফলা তার দিকে নিশানা করল কলি।

কিন্তু সে ফলা আর বিদ্ধ করতে পারল না অন্তুকে। তার আগেই প্রচণ্ড এক লাফে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তার মাথায় কুঠারের কোপ বসিয়ে দিল অন্তু!

অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ওপরের দিকে তাকাল কলি। কুঠারের ধারালো ফলা গেঁথে গেছে তার খুলির মাঝ বরাবর। ফেটে চুরমার হয়ে গেছে শক্তিশালী হীরকবর্ম, তার জায়গায় মাংস ভেদ করে নেমে আসছে গরম রক্তের স্রোত। কাটা কলাগাছের মতো তার প্রাণহীন দেহটা মাটিতে আছড়ে পড়ার সময়ও আকাশের দিকে মেলা থাকল তার ঠিকরে আসা দুই চোখ।

মাথা তুলল অন্তু। চারদিকে যেন শ্মশানের নীরবতা। স্তূপের মতো ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে গাছপালা পশুপাখির লাশ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল সে। একটা পর্দা যেন আজ উঠে গেছে চোখের সামনে থেকে। এই প্রাণহীন শূন্য প্রান্তরে সে একা, তবু যেন একা নয়। সে দেখতে পাচ্ছে না রামকে, কিন্তু তার মাথার ভেতরে যেন বেজে চলেছে সেই খসখসে অপার্থিব কণ্ঠস্বরটা, “ভালোবাসার মায়া বড় কঠিন মায়া হে! এই শস্যশ্যামলা ধরিত্রীকে যে তুমি ভালোবেসে ফেলেছ অন্তুবাবু! এখন তোমার সামনে অনেক কাজ, বুঝলে কিনা! ফিরে যাও তোমার ওই কৃত্রিম আশ্রয়ে, কল্কি হয়ে আরো একবার তোমার মানুষদের মুক্ত করো কলির কারাগার থেকে। সবার মন থেকে মুছে দাও সমস্ত অন্যায়, অধর্ম, তারপর আবার ফিরে এসো এই পৃথিবীতে। মানুষের মতো মানুষ হয়ে। মা ধরণী যে অপেক্ষা করছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানের জন্য!”

স্পেসজেটে বসে একটা মৃদু হাসি ফুটে উঠল অন্তুর মুখে। এখন সে জানে তার ওই স্বপ্নের মানে কী। জানে ওই চন্দনসুরভিত গেরুয়াবসনধারীই বা কে। মায়াবী চোখে বসুন্ধরা কে উপভোগ করতে করতে কন্ট্রোল প্যানেলের ওপর ‘বিশসন’-এর বোতামটা টিপে দিল এক অন্য অন্তক।

অনেক দূরে তখন পাহাড়ের এক গুহার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন বৃদ্ধ। অস্তগামী সূর্যের কমলা আভায় দেখা যাচ্ছে একটা কালো বিন্দু, কাজলের টিপের মতো ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে আকাশের কপাল থেকে। একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন সেদিকে। মায়ার খেলা শেষ। আবার ধীরে ধীরে প্রস্তরীভূত হতে শুরু করেছে তাঁর শরীর। এখন অনন্ত অপেক্ষা। যুগে যুগে এভাবেই যে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছে তাঁর শিষ্যের জন্য। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন গুহার ভেতর। পর পর সাজানো ছ’টা বেদীর ওপর ধ্যানস্থ ছয় প্রস্তরীভূত মূর্তি, যাদের নেই ক্ষয়, নেই মৃত্যু। আর তাঁর সতীর্থদের পাশেই অপেক্ষা করে আছে সপ্তম বেদীটা, তাঁর জন্য। স্মিত মুখে অনন্ত কালসাগরে ধ্যানস্থ হলেন বৃদ্ধ। এভাবে মানুষের জন্যই যে বাঁচতে হবে তাঁদের।

তাঁরা যে চিরঞ্জীবী।