হর্ষ মঞ্জুষা ● দেবদত্তা বন্দ্যোপাধ্যায়

 


 

(১)

ফুলে ফুলে সাজানো রাজঅন্তঃপুরের উদ্যানে বাটি, দোলনায় বসে এক সদ্য কিশোরী। তাকে দোল দিচ্ছে এক কিশোর। আরেক যুবক ধনুর্বাণ নিয়ে ব্যস্ত।

—“যুবরাজ, আমায় ঐ কিংশুক পুষ্পের গুচ্ছ নামিয়ে দেবেন। মালা গাঁথব।” আবদারের সুর কিশোরীর কণ্ঠে, সে যুবরাজের আদরের ভগিনী। তার আবদারে শরযোজনা করে যুবরাজ। সবচেয়ে নিচের শাখাটিতে শর নিক্ষেপ করতেই কয়েকটা কিংশুক খসে পড়ে নিচে।

আবার শর যোজনা করতেই কিশোর হর্ষ বলে ওঠে, “শর নিষ্প্রয়োজন যুবরাজ, আমায় একটা সুযোগ দিন। আমি চেষ্টা করতে চাই।” মাত্র চার বছরের ছোট ভাইকে যথেষ্ট স্নেহ করেন যুবরাজ রাজ‍্যবর্ধন। তাঁর প্রশ্রয়ে কিশোর তরতরিয়ে উঠে যায় কিংশুক বৃক্ষে। বসন্তের শেষে বৃক্ষ সেজে উঠেছে ফুলে ফুলে। ফুলের ভারে শাখাগুলো নুইয়ে রয়েছে। পাতা দেখাই যায় না। খুব জোরে গাছটা ঝাঁকাতে শুরু করে কুমার হর্ষ। টুপটাপ ঝুপঝাপ খসে পড়ে রাঙা কিংশুক। তাদের একমাত্র ভগিনী রাজ‍্যশ্রী ফুলের মাঝে এসে দু’বাহু প্রসারিত করে দাঁড়ায়। কিংশুক তার প্রিয় ফুল। মাথায় গায়ে ঝরে পড়ে ফুল।

ঠিক তক্ষুনি রাজমাতা একটি বালিকাকে নিয়ে উদ্যানে প্রবেশ করেন। বালিকাটি রাজকন্যা রাজ‍্যশ্রীর সমবয়সী, কিন্তু কেমন এক বিষাদ চাদরে জড়ানো, কপোলে শুকনো অশ্রু রেখা, উসকোখুসকো কেশ বিন্যাস। পরনের পোশাক ও অলঙ্কার মহার্ঘ্য হলেও অবিন্যস্ত ও মলিন। কিন্তু অপূর্ব সুন্দরী। কুমার হর্ষ কিংশুক শাখার আড়াল থেকেই লক্ষ্য করছিল বালিকাকে।

—“যুবরাজ, রাজ‍্যশ্রী, এ আমার বাল্য সখীর মেয়ে মঞ্জুষা, আজ থেকে এ মহলেই থাকবে। ওর মাতৃবিয়োগ আগেই হয়েছিল। ওর পিতা শ্রেষ্ঠী সুকোমল এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে চলে গেছেন কদিন আগেই। ধনসম্পদের লোভে আত্মীয়দের বৈরতার বলি হতে বসেছিল মঞ্জুষা। ভ্রাতা ভণ্ডি খবর পেয়ে ওকে উদ্ধার করে এনেছে। রাজকন্যা রাজ‍্যশ্রী, আজ থেকে মঞ্জুষা তোমার সখী। ওকে মহলে নিয়ে যাও। আমি পোশাক ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পাঠিয়ে দিচ্ছি। মঞ্জু এরা তোমার আপনজন।”

রাজমাতার কথায় রাজ‍্যশ্রী মিষ্টি হেসে মঞ্জুষার দিকে এগিয়ে আসে। বালিকা করুণ নয়নে তাকিয়ে থাকে।

অষ্টাদশ বর্ষীয় যুবরাজ রাজকীয়ভাবে বলেন, “আমি এ রাজ্যের যুবরাজ, এখানে কোনো অসুবিধা হলে তুমি আমায় জানাবে। এ মহলে তোমায় স্বাগত জানাই।”

মহারাণী বিদায় নিতেই বৃক্ষ শাখার উপর উঠে বসে কুমার হর্ষ। আবার কেঁপে ওঠে শাখা, আর বেশ কিছু ফুল ঝরে পড়ে মঞ্জুষার গায়ে। গোধূলির শেষ আলো গায়ে মেখে এই প্রথম একটু হেসে ওঠে মঞ্জু। বৃক্ষ থেকে এক লাফে ওর সম্মুখে এসে পড়ে কুমার। একটু চমকে উঠে অবাক বিস্ময়ে ওর দিকে দুটি কাজল কালো চোখ মেলে চায় মঞ্জুষা।

—“এ আমার মধ্যম ভ্রাতা কুমার হর্ষ। আজ থেকে তুমি আমার সখী।” শ্রী এগিয়ে এসে মঞ্জুর হাত ধরে।

হর্ষ একটু হেসে বলে, “স্থানেশ্বর রাজমহলে স্বাগত শ্রেষ্ঠী দুহিতা।”

শ্রী মঞ্জুকে নিয়ে মহলের ভেতর প্রবেশ করে। সেদিকে তাকিয়ে কেন জানি না কুমার হর্ষর মনটা করুণ হয়ে ওঠে।

দেওয়াল গিরিগুলো প্রজ্বলিত হয়ে উঠতেই যুবরাজ বলেন, “পণ্ডিত মশাই আসার সময় হল। কুমার চলো বার মহলে যাই। আজ অর্থশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু হবে।” দুই ভাই বার মহলের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু কুমার হর্ষর মন উড়ে যেতে চায় ভগিনীর মহলে। খুব ইচ্ছা করে মঞ্জুর কথা জানতে, শুনতে। মেয়েটার চোখ দুটোয় রয়েছে এক অমোঘ আকর্ষণ ক্ষমতা।

***

এক পক্ষকাল পরের কথা, যুবরাজ মহারাজের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী মিত্র রাজ্যে গিয়েছেন। কুমার হর্ষ, শ্রী আর মঞ্জুর বিকেলগুলো হেসে খেলে কাটছে। বালিকাটি আপনজন হারানোর বিষাদ ভুলে ওদের সঙ্গে বেশ সহজে মিশে গেছে। ওদের দুজনের আবদারে কুমারকে কখনও ফুল পাড়তে হয়, কখনও দোল দিতে হয় দোলনায়। কখনও খরগোশ ধরে আনতে হয়। অথবা হরিণ শাবকের জন্য কচি ঘাস খুঁজতে হয়।

সেদিন ঝড়ের পর একটা পাখির ছানা বাসা ভেঙ্গে গাছের নিচে পড়ে গেছিল। বেচারা উড়তেও জানে না। তাই দেখে মঞ্জুষার ক্রন্দন আর বন্ধ হয় না। শেষে কুমার ওকে বাসা শুদ্ধু গাছের একটা কোটরে বসিয়ে দিতে মঞ্জুষা শান্ত হয়। কিন্তু তবু ওর চিন্তা, “ছানার মা যদি মরে গিয়ে থাকে ও খাবে কী? কে দেখবে ওকে!”

শেষে রোজ দু’বেলা কুমার ছানাটিকে দেখাশোনার দায়িত্ব গ্ৰহণ করায় ও শান্তি পায়। অবশ্য পরদিন থেকে মঞ্জু নিজেই শস্য দানা, নরম ফল এনে খাওয়াত ছানাকে। উড়তে শেখেনি পাখির ছানা। এক সপ্তাহ ছানাটির যত্নেই কেটে গেল। কিন্তু সেদিন হঠাৎ উদ্যান থেকে মঞ্জুর আতঙ্ক মিশ্রিত চিৎকার শুনে ছুটে এসেছিল কুমার। রাজ‍্যশ্রী রাজমাতার সঙ্গে মন্দিরে গেছিল সেদিন। মঞ্জু পাখির খাবার দিতে এসে দেখে পাখিটি নেই, কয়েকটা রক্তাক্ত পালক ছড়িয়ে রয়েছে কোটরের বাইরে। তাই দেখেই কেঁদে ফেলেছে মেয়েটা।

কুমার হর্ষ এসেই দৃশ্য দেখে বুঝতে পারে এটা কোনো শ্বাপদের কম্ম। কিন্তু ক্রন্দনরত মঞ্জুকে দেখে কুমারের ভেতরটা কেমন আর্দ্র হয়ে ওঠে। ওকে সরোবরের পাশে বসিয়ে কুমার বোঝাবার অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু এগারো বছর বয়সে নিজেই যে স্বজনহারা এবং আশ্রিতা তার সাংসারিক জ্ঞান বোধহয় বয়স আন্দাজে বেড়ে যায়। নিজের নিরাপত্তাহীনতা প্রকট হয়ে ওঠে। কুমার ওর হাত দুটো ধরে বলে, “আমি তো রয়েছি মঞ্জু। তোমায় আমিই রক্ষা করব সারা জীবন।”

অদ্ভুত দৃষ্টিতে দুটি ভেজা কাজল কালো চোখ মেলে তাকায় মঞ্জু। আস্তে আস্তে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে এক রক্তিম আভা, হাত ছাড়িয়ে চকিত হরিণীর ন‍্যয় ছুটে পালায় বড় কৃষ্ণচূড়া বৃক্ষের কাছে।

কী হল বুঝতে পারে না কুমার, উঠে যায় ওর কাছে। ক্রন্দন বন্ধ হলেও একটা দমক রয়ে গেছে, তার জেরে কেঁপে কেঁপে উঠছে মঞ্জু।

ওর দক্ষিণ হস্ত মুঠোয় বন্দি করে কুমার হর্ষ বলে, “আমায় তুমি বিশ্বাস করো না মঞ্জু! ভরসা নেই আমার উপর!”

—“কিন্তু আমার পক্ষীশাবকটি...” আবার চোখ দিয়ে বড় বড় ফোঁটায় নেমে আসে অকাল বর্ষণবারি।

—“এ প্রকৃতির খেলাঘর, খাদ‍্যখাদক সম্পর্ক মঞ্জু। তবে তুমি আর কখনও গৃহহীন হবে না। কথা দিচ্ছি, তোমায় রক্ষা করব আজীবন।”

হয়তো সেদিন খেলার ছলেই কথাগুলো বলেছিল এক চোদ্দ বছরের কিশোর। এগারো বছরের মেয়েটা সেই নিরাপত্তার উষ্ণতা গায়ে মেখেই বিশ্বাস করেছিল কথাগুলো। বিধাতা পুরুষ আড়ালে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসেছিল শুধু।

 

(২)

কেটে গেছে দুটি বছর, স্থানেশ্বরসহ গোটা রাজ্য সেজে উঠেছে নববধূর সাজে। রাজকন্যা রাজ‍্যশ্রীর স্বয়ম্বর সভা। দেশ বিদেশ থেকে রাজপুরুষরা এসেছেন। তেরো বছরের রাজ‍্যশ্রীর রূপ ও গুণের খবর ছড়িয়ে গেছে দূরদূরান্তে। মঞ্জুষা ওকে মনের মতো করে সাজিয়ে দিয়ে একটা কাজলের চিহ্ন এঁকে দেয় কানের পাশে। বলে, “আজ যে কত রাজপুরুষ মদন বাণের ঘায়ে মূর্ছা যাবে...”

—“তুইও তো আমার সঙ্গে আজকেই স্বয়ম্বরা হতে পারতিস সখী। পিতা মহারাজ তোকেও দান করতে চেয়েছিল।”

লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে দ্বাদশ বর্ষীয়া মঞ্জুষা, বলে, “তুই আগে যা শ্বশুর গৃহে। আমি কদিন রাজমাতার কোল জুড়ে আদর খাই আগে।”

—“ও, আমার অবর্তমানে এই তবে তোর পরিকল্পনা, দুষ্টু।” দুই সখী দুজনকে জড়িয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।

বাহুপাশ ছাড়িয়ে রাজ‍্যশ্রী বলে, “তবে তোকে এ মহলে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা আমি শীঘ্রই করছি। রাজামাতাকে তোদের কথা...”

ওর কথার মাঝেই মঞ্জু বলে, “এই দেখ, তোর কিংশুক পুষ্পর বরমাল্যটাই তো আনিনি এখনও। আমি এখনি নিয়ে আনছি দাঁড়া।”

কোনোরকমে পালিয়ে আসে উদ্যানে। শ্রীর কাছ থেকে লুকোতে পারেনি ওর দুর্বলতা। কিন্তু মনে ভয়, এ স্বপ্ন কি কখনও সত্যি হবে!

বসন্ত পঞ্চমী, শীত সবে বিদায় নিয়েছে আর্যাবত থেকে। আবার কিংশুকের শাখায় শাখায় রঙের খেলা শুরু হয়েছে। সখীরা সেখানে বসেই মালা গাঁথছিল। একটি মালা বেছে নিয়ে মহলে প্রবেশের মুখেই দেখা হয় কুমার হর্ষর সঙ্গে। কুমার আদরের ভগিনীর স্বয়ম্বর সভা নিয়ে খুব ব্যস্ত।

মঞ্জুকে দেখেই দু’চোখে কৌতুক মাখিয়ে কুমার বলে, “মালা হাতে সুন্দরীও কি আজ স্বয়ম্বরা হতে চলল?”

—“কুমারের কি তাই ইচ্ছা?” মুচকি হেসে বলল মঞ্জু।

—“আমার ইচ্ছার খবর আর কে রাখে। এখন সকলই দেবীর ইচ্ছায়।”

—“আমি এক আশ্রিতা কন্যা, মহারাজের দয়ায়...” কুমারের হাত মঞ্জুর ঠোঁটে। দু’চোখে নিষেধ।

—“কতবার মানা করব যে এসব কথা আর বলবে না। এ মহল তোমার।” ছদ্ম গাম্ভীর্যে বলে ওঠে কুমার।

—“কি জানি, কুমার তো আমায় স্বয়ম্বরা করে তাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত।” করুণ মুখে বলে ওঠে মঞ্জু।

—“স্বয়ম্বরা তো স্ব-ইচ্ছায় হতে হয়, জোর করে করা যায় কি?” মঞ্জুর পথ আটকে দাঁড়ায় কুমার।

—“সব ইচ্ছা কি পূরণ হয় কুমার? আমার ইচ্ছাগুলো কেমন যেন ডানা মেলে উড়ে যায়। ধরাই দেয় না।” উদাস হয়ে যায় মঞ্জুষা।

—“মালা রয়েছে তোমার হাতে, রাজপুরুষরা এসে উপস্থিত। ইচ্ছাকে ডানা মেলতে দিলেও বশ করার এই তো সুযোগ।” মৃদু হেসে কুমার বলে।

রক্তিম আভায় রাঙিয়ে ওঠে মঞ্জুষার কপোল। বলে, “ভয় পাই, আমি এক অনাথা, রাজপুরুষ কি আমায় গ্ৰহণ করবে?”

—“আবার... তুমি জানো না তোমায় পেতে ইচ্ছুক কত রাজপুরুষ। তুমি অনন্যা।”

পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকা কুমারের কণ্ঠে হাতের মালা পরিয়ে দিয়েই মঞ্জুষা বলে, “তবে তাই হোক।”

হতচকিত কুমার কিছু বলার আগেই মঞ্জুষা উদ্যানের দিকে দৃষ্টিপথের বাইরে চলে যায়।

***

অলিন্দ প্রাকারে কয়েকটি পদশব্দে কুমার একটি বড় স্তম্ভের আড়ালে দাঁড়িয়ে যায়। যুবরাজ ও দুজন রক্ষী চলেছেন উদ্যানের পথে। এখন ওদিকে গেলেও আর মঞ্জুষার দর্শন মিলবে না হয়ত। কিন্তু দ্বিতলের একটি গবাক্ষ থেকে দৃশ্যটি দেখতে পেয়েছিলেন রাজমাতা। কিঞ্চিত ভ্রূকুটি করে ঠোঁট কামড়ে তিনি চিন্তামগ্ন হন।

গলার কিংশুক মালাটি খুলে দ্রুত নিজের কক্ষে ফিরে যায় কুমার। চন্দন কাষ্ঠের একটি কারুকার্য মণ্ডিত আধারে মালাটিকে রেখে দ্রুত চলে যায় স্বয়ম্বর সভায়। রাজপুরুষরা প্রায় সবাই সভায় উপস্থিত। এসে পৌঁছে গেছেন মৌখরী রাজ গ্ৰহবর্মা, কাশ্মীর নরেশ, গুর্জরের রাজা। তাদের সঙ্গে সঙ্গে আলাপরত যুবরাজ। দাক্ষিণাত্য থেকেও কয়েকজন রাজপুরুষ এসেছেন। কলিঙ্গ ও পূর্বদেশীয় অনেক সামন্ত রাজাও উপস্থিত। সবার কুশল বিনিময় ব্যস্ত হয়ে পড়ে কুমার। মহারাজ এসে আসন গ্ৰহণ করতেই সবাই তটস্থ হয়ে ওঠে।

একটু পরেই রাজ‍্যশ্রীকে নিয়ে মঞ্জুষা এবং আরও তিন সখী প্রবেশ করে সভায়। মহামন্ত্রী মহারাজের অনুমতি নিয়ে একে একে রাজন‍্যবর্গের পরিচয় দিতে শুরু করলেন। রাজমাতা ও অন্যান্য রমণীগণ দ্বিতলে চিকের আড়াল থেকে সভার দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করে উৎকণ্ঠার প্রহর গুনতে ব্যস্ত। কাকে যে রাজ‍্যশ্রী বরণ করবে কে জানে। রাজমাতার মনে তখন আরেক ধন্ধ চলছে।

একে একে পরিচয় দিতে দিতে মালবরাজ দেবগুপ্তর পরিচয় পর্ব শুরু হল। কিন্তু পুষ‍্যাভূতি মহারাজ প্রভাকরবর্ধনের শত্রু রাজা দেবগুপ্ত যে বিনা আমন্ত্রণে সভায় আসবে কেউ ভাবেইনি। রাজ‍্যশ্রী এ বৈরতার কথা শুনেছিল। মহারাজ যথেষ্ট বিরক্ত দেবগুপ্তকে নিয়ে।

কিন্তু রাজকন্যার দৃষ্টি খুঁজে চলছে একজনকেই। মাস ছয়েক আগে প্রয়াগের ঘাটে যে রাজপুরুষ তার হৃদয় হরণ করেছিল, যার কথা ভেবে এ স্বয়ম্বরের আয়োজন... মৌখরী রাজ গ্ৰহবর্মা..।

মৌখরীরাজের প্রশস্তি শুরু হতেই মালা হাতে রাজ‍্যশ্রী এগিয়ে গেলো সেদিকে। সবার সামনে মাল্যদান করে মৌখরীরাজকে বরণ করে নিতেই সখীরা পুষ্পবৃষ্টি শুরু করল।

কিন্তু প্রবল অপমানিত দেবগুপ্ত হঠাৎ সভার মাঝে চিৎকার করে গ্ৰহবর্মাকে দন্ধযুদ্ধে আহ্বান করলেন।

মহারাজ বাধ্য হলেন হস্তক্ষেপ করতে। তিনি রুষ্ট স্বরে বললেন, “এ কোনো যুদ্ধের ময়দান নয়। এক স্বয়ম্বর সভা, কন্যা নিজে নিজের জীবন সঙ্গী বেছে নিয়েছে। সুতরাং সভা সমাপ্ত। এবার বিবাহ অনুষ্ঠান শুরু হবে। আমন্ত্রিত রাজন্যবর্গ স্বয়ম্বরের নিয়ম জেনেই সভায় এসেছিলেন। এখন সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে বিবাহে উপস্থিত থেকে নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করে আনন্দ যজ্ঞে অংশ নিতে। বিনা নিমন্ত্রণেও যারা এসেছেন সবাই আজ স্থানেশ্বরের অতিথি। বৈরতা ভুলে আজ সবাই আনন্দ অনুষ্ঠানে মেতে উঠুক এটাই কাম্য। অন‍্যথায় তারা ফিরে যেতে পারেন।”

মালবরাজ দেবগুপ্ত এভাবে অপমানিত হয়ে সভা ত্যাগ করলেন। বদলার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলেই চলেছে মনের ভেতর। প্রতিহিংসা চেপেই রওনা দিলেন মিত্র গৌড়েশ্বরের রাজ্যে।

সারম্বরে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে বিবাহানুষ্ঠান মিটতেই বিদায়ের পালা। অশ্রুসিক্ত শ্রী সখী মঞ্জুকে জড়িয়ে কেঁদেই চলেছে। কিশোরী কন্যাকে শ্বশুর গৃহে পাঠাতে বুক ফেটে যাচ্ছে মহারাজের। রাজমাতা ভেবে রেখেছিলেন পরবর্তী পদক্ষেপ।

শ্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি বললেন, “মঞ্জু কিছুদিন শ্রীর সঙ্গে ওর শ্বশুরালয় ঘুরেই আসুক। এতে শ্রীরও ভালো লাগবে। মঞ্জুরও মন খারাপ হবে না।” মনে মনে বললেন এভাবেই কিছুদিন অন্তত দূরে সরিয়ে দেওয়া যাবে দুজনকে।

যুবরাজ ও মহারাজ বেশ খুশি হলেন এ প্রস্তাবে। রাজ‍্যশ্রীর গত দু বছরের ছায়া সঙ্গী মঞ্জু যদি সঙ্গে যায় সবাই নিশ্চিন্ত। মৌখরীরাজ সাদরে শ্যালিকাকে আহ্বান জানালেন নিজের রাজ্যে।

শুধু কুমার হর্ষর বুকের ভেতর এক ব্যথার ঢেউ কেমন আছড়ে পড়ল। অতিকষ্টে সে মনকে প্রবোধ দিল কয়েকটা মাসের মধ্যেই সে মঞ্জুকে ফিরিয়ে আনবে এ মহলে। অবশেষে প্রচুর দাস দাসী সৈন্য সামন্ত এবং উপঢৌকনসহ মৌখরীরাজ নববধূ সহযোগে কনৌজ প্রত্যাবর্তন করলেন।

 

(৩)

নিজ কক্ষে শুষ্ক কিংশুকের মাল্য সহযোগেই দিন কাটে কুমার হর্ষর। বসন্ত সমাপনে চারপাশ রুক্ষ হয়ে ওঠে। ভূর্জপত্রে আঁচড় কেটে সে পদ্য লেখে। ধীরে ধীরে গ্ৰীষ্ম বিদায় নেয়। কাব্য পাঠ করে সময় ব্যয় করে কুমার। বর্ষায় নব বারিধারায় সিক্ত হয়ে ওঠে প্রকৃতি। মেঘের গর্জনে, ছাতিম ফুলের গন্ধে ময়ূর নেচে ওঠে। কটা দিন যেন যুগের সমান। কুমার দিন গোনে।

ওদিকে কন্যা দানের পর থেকেই স্থানেশ্বর নরেশের স্বাস্থ্য ভগ্নপ্রায়। যুবরাজ রাজ‍্যবর্ধনের উপর সব দায়িত্ব অর্পণ করে তিনি বিশ্রাম নিতে ইচ্ছুক। রাজমাতাও বিষণ্ণ। কুমার হর্ষ পিতাকে এভাবে দেখে চিন্তিত। একেক সময় মনে হয় মঞ্জু মহলে থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। দু’একবার ভেবেছে যুবরাজকে জানিয়ে মঞ্জুকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু চক্ষুলজ্জায় বলে উঠতে পারেনি কিছুই। ভগিনী আসবে মহারাজার খবর পেয়ে, এলে নিশ্চয় মঞ্জু ফিরে আসবে। মহারাজার ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন।

সেদিন রাতে একটি স্বপ্ন দেখে আচমকা মন আরও বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে কুমারের। ও দেখেছে রক্তাক্ত মঞ্জু কারাগারে বন্দি, সে বারবার কুমারকে ডাকছে উদ্ধারের জন্য। ভোর রাতের এ স্বপ্নে মনটা কেমন তিতকুটে হয়ে ওঠে। এ আবার কেমনতর স্বপ্ন।

কদিন ধরেই ভারি বর্ষণে সবাই চিন্তিত। হঠাৎ রাজসভায় গুপ্তচর মারফত খবর আসে কনৌজ আক্রমণ করেছে মালবরাজ দেবগুপ্ত। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে শশাঙ্ক। যুবরাজ এদিকে মহারাজকে নিয়ে চিন্তিত। কনৌজ রাজ গ্ৰহবর্মাকে সাহায্য করাও আশু কর্তব্য। মাতুল ভণ্ডির সঙ্গে পরামর্শে বসে যুবরাজ রাজ‍্যবর্ধন। কুমার হর্ষ যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক, কিন্তু যুদ্ধ পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা নেই তার। তাই যুবরাজ নিজেই দশহাজার সৈন্য নিয়ে এগিয়ে যান। কুমার হর্ষ রইল রাজমহল ও মহারাজের নিরাপত্তার দায়িত্বে। কিন্তু সে বারবার যেতে চেয়েছিল যুদ্ধে। কে জানে ভগিনী রাজ‍্যশ্রী আর মঞ্জুষা কী অবস্থায় রয়েছে। রাতের বেলায় শুষ্ক কিংশুকের মালা হাতে অর্ধচন্দ্রর দিকে চেয়ে দূতের প্রতীক্ষায় প্রহর গোনে কুমার হর্ষ। এক বিশাল কালো মেঘ এসে ঢেকে দেয় স্থানেশ্বরের আকাশ।

পরদিন প্রভাতে দূত মর্মান্তিক দুঃসংবাদ নিয়ে এসে পৌঁছায়। দেবগুপ্তর হাতে নিহত হয়েছেন গ্ৰহবর্মা। রাজ‍্যশ্রীকে বন্দি করেছে মালবরাজ। অন্দরমহল থেকে ওঠে ভেসে আসে ক্রন্দন ধ্বনি। দাসী নিয়ে আসে আরেক দুঃসংবাদ। মহারাজ জামাতার খবর পেয়েই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ওদিকে রাজ‍্যবর্ধন প্রবল পরাক্রমে ছুটে চলেছে মালবরাজকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে। আদরের ভগিনী রাজ‍্যশ্রীকে উদ্ধার না করা অবধি শান্তি নেই তার মনে।

দূতের কাছে মঞ্জুষার কোনো খবর নেই। উৎকণ্ঠার প্রহর গুনে চলে কুমার হর্ষ। ওদিকে মহারাণী যশোমতী স্ব-ইচ্ছায় চললেন সহমরণে। ইহজাগতিক সকল চাওয়া পাওয়া তাঁর শেষ হয়েছে। একাকী কুমার কেমন বিহ্বল হয়ে যায়।

আরও দুদিন অতিক্রান্ত। কুমার হর্ষ একলা মহলের প্রাকারে দাঁড়িয়ে দুশ্চিন্তার প্রহর গোনে। আস্তে আস্তে দুর্যোগের মেঘ কেটে যায়। মাতুল ভণ্ডি দূত মারফত খবর পাঠিয়েছে দেবগুপ্তকে সম্মুখ সমরে হত্যা করে যুবরাজ ভগ্নীপতি হত্যার শোধ নিয়েছেন। এবার কনৌজ পুনরুদ্ধার করে রাজ‍্যশ্রীকে নিয়েই তিনি ফিরবেন। মহারাজের প্রয়াণে যুবরাজ শোক প্রকাশেরও সময় পাননি সেভাবে। কিন্তু মঞ্জুষার কোনো খবর আসে না।

হর্ষ গোপনে গুপ্তচর পাঠিয়েছিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত কনৌজে। পরদিন সে খবর নিয়ে আসে যুদ্ধ বিধ্বস্ত কনৌজ এক মৃত্যুপুরী। সম্মান বাঁচাতে বেশির ভাগ পুরনারীরা জহরব্রত পালন করেছে। কিছু নারী ধর্ষিতা, কিছু বন্দি। বঙ্গ নরেশ গৌড়াধিপ শশাঙ্ক এগিয়ে এসেছেন বন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে। বিধ্বস্ত কনৌজে চলেছে এক নরযজ্ঞ।

কুমার হর্ষ বুঝতে পারে না কী করনীয়। মাত্র ষোল বছরের সদ্য পিতৃহারা কিশোর যেদিকে তাকায় সেদিকেই অন্ধকার। তবে যুবরাজের উপর তার অগাধ ভরসা। যুবরাজ পারবেন সঠিক জবাব দিতে। প্রবল পরাক্রমি গৌড়াধিপকে দমন করার ক্ষমতা তার রয়েছে।

পরদিন বিকেলে রক্তাক্ত অবস্থায় এক দূত এসে উপস্থিত হয় রাজদরবারে। সে জানায় গৌড়াধিপের আমন্ত্রণে যুবরাজ মাত্র দুজন অমাত্যসহ তাঁদের শিবিরে সন্ধি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছলনার সঙ্গে তাদের হত্যা করা হয়েছে। গৌড়াধিপ শশাঙ্ক বিশাল সেনা নিয়ে এগিয়ে আসছেন। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় কুমারের। ভগিনী কোথায় কী অবস্থায় রয়েছে কে জানে। সেনা সাজিয়ে নিয়ে কনৌজ অভিমুখে যাত্রা করে কুমার হর্ষবর্ধন। পথিমধ্যে দেখা হয় মাতুল ভণ্ডির সঙ্গে। সে খবর পেয়েছে রাজ‍্যশ্রী কয়েকজন সহচরীসহ বিন্ধ্যপর্বতের অরণ্যে পালিয়ে গেছে। মঞ্জুষার কোনো খবর নেই। হর্ষ সেনাসহ মাতুল ভণ্ডিকে শশাঙ্কর সঙ্গে যুদ্ধে পাঠিয়ে নিজে কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচরসহ বিন্ধ্যপর্বত সংলগ্ন অরণ্যে প্রবেশ করে।

কিন্তু এই সুবিশাল অরণ্যে কি কাউকে এভাবে খোঁজা যায়! নানারকম শ্বাপদ ছাড়াও রয়েছে কিছু আদিবাসী অরণ্যচর গোষ্ঠী।

তবে অরণ্যের ভেতর বেশ কিছু বৌদ্ধাশ্রম রয়েছে। কিছু গুহায় বৌদ্ধ ভিক্ষুর বৌদ্ধের অর্চনা বন্দনা করে চলেছে। শৈব উপাসক হর্ষবর্ধন অরণ্যের ভেতর তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ায় রাজ‍্যশ্রীকে। একমাত্র রাজ‍্যশ্রী জানে মঞ্জুষার কথা। হয়তো মঞ্জু ওর সঙ্গেই রয়েছে গভীর অরণ্যে।

 

(৪)

অবশেষে এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাহায্যে এক বৌদ্ধ সংঘের ভেতর খুঁজে পায় বোনের দুই সহচরীকে। তাদের কাছে খবর পেয়ে ছুটে যায় কুমার নদীতীরে। রাজ‍্যশ্রী তখন অরণ্যের ভেতর নদীতীরে এক বিশাল চিতা সাজিয়ে তাতে প্রবেশ করতে চলেছে। মাত্র কয়েকদিনে কী অবস্থা হয়েছে আদরের শ্রীর! অবশেষে অনেক বুঝিয়ে শ্রীকে নিয়ে কনৌজ প্রত্যাবর্তন করে কুমার হর্ষ। কথা দেয় ভ্রাতৃহত‍্যা ও রাজ‍্যশ্রীর এ অপমানের প্রতিশোধ সে নেবেই। কিন্তু মঞ্জুষার কথা জিজ্ঞেস করতে পারে না কুমার।

ভণ্ডির আক্রমণে ততদিনে পিছু হটেছেন গৌড়াধিপ। মন্ত্রীদের অনুরোধে এবং রাজ‍্যশ্রীর ইচ্ছায় কনৌজের সিংহাসনে রাজ্যাভিষেক হয় কুমার হর্ষবর্ধনের। স্থানেশ্বর ও কনৌজসহ এক বিশাল সাম্রাজ্যের সম্রাট হর্ষবর্ধন, কিন্তু মনে আনন্দ নেই। মঞ্জুষার কোনো খবর এখনও তিনি পাননি।

সেদিন বৈকালে শ্রীকে প্রাসাদ সংলগ্ন বৌদ্ধ চৈত্যে প্রদীপ প্রজ্বলনরত দেখে এগিয়ে আসে সম্রাট হর্ষবর্ধন। মৌখরীরাজ গ্ৰহবর্মা ছিলেন বৌদ্ধ উপাসক ছিলেন। এক শ্রমণা হয়ে বৌদ্ধের সেবা করেই সে কাটাতে চায় বাকি জীবন। তবে এখনও দীক্ষা হয়নি ওর।

প্রাসাদ সংলগ্ন নদীর ঘাটে গিয়ে বসে দুজনে। কিছুক্ষণ ঢেউ ভাঙা গড়া দেখে হর্ষবর্ধন বলে, “দুঃখের ইতিহাস ভুলে যাওয়াই শ্রেয়। তবু কিছু কিছু কথা জানতে মন চায়।”

রাজ‍্যশ্রীর দৃষ্টি স্থির। ও বলে, “বৌদ্ধ শ্রমণার মনে দ্বেষ থাকতে নেই। হিংসা প্রতিশোধ এসব ভুলতে চাই। কিন্তু পারছি না কুমার। সেই রাতে আমায় কারাগার পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল মঞ্জু। অদ্ভুত জেদি ছিল মেয়েটা। আমি চরম সর্বনাশের হাত থেকে বেঁচেছিলাম মঞ্জুর জন্য। দেবগুপ্ত আমায় ভোগ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল। আমার বদলে মঞ্জু আমার পোশাকে সেজে দেবগুপ্তর শিবিরে গেছিল সে রাতে। শুনেছি ও লুকিয়ে খঞ্জর নিয়ে গেছিল নরাধমটাকে শেষ করবে বলে। তবে নিজের সম্মান বাঁচাতে পেরেছিল কিনা ও তা জানি না। জানি না ও জীবিত আছে কি না। পরদিন যুবরাজ রাজ‍্যবর্ধনের হাতে দেবগুপ্ত নিহত হয়। কিন্তু মঞ্জুষার কোনো খবর আর আমি পাইনি।”

দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে হর্ষর দু’চোখ দিয়ে। সে যে কথা দিয়েছিল রক্ষা করবে সারাজীবন। সেই পক্ষীশাবক বনবিড়ালের আক্রমণে যেভাবে প্রাণ হারিয়েছিল...

—“সম্রাটের চোখে জল! কোথায় গেলো পুষ‍্যাভূতি নরেশের সেই তেজ? এত বড় সাম্রাজ্যের সিংহাসনে বসে সম্রাট কি তার দেওয়া কথা ভুলে গেছেন।” কে যেন বলে উঠল কানে কানে। তাঁর অন্তর থেকে কি তবে ভেসে এলো এ বার্তা।

—“মঞ্জু যদি জীবিত থাকে তবে তাকে খুঁজে বের করবই। সসম্মানে স্ত্রীর মর্যাদায় ফিরিয়ে আনব। মঞ্জু যে স্ব-ইচ্ছায় স্বয়ম্বরা হয়েছিল।” আকাশের অর্ধচন্দ্রকে সাক্ষী রেখে বলেন সম্রাট।

পরদিন থেকেই গোপনে মঞ্জুষার খোঁজ শুরু হল। কনৌজের প্রতিটা গৃহে, প্রতিটা গ্ৰামে গুপ্তচর প্রেরণ করলেন সম্রাট। কিন্তু কোথায় মঞ্জু! কোথাও কোনো খবর নেই।

এরমধ্যে দেবগুপ্তর শিবিরের এক পাহারাদার আর এক চিকিৎসকের খোঁজ পাওয়া গেল। পাহারাদার জানাল লাঞ্ছনার চরম মুহূর্তে সেই নারী খঞ্জরে বিদ্ধ করেছিল দেবগুপ্তকে। চিকিৎসক জানালেন তিনি চিকিৎসা করেছিলেন দেবগুপ্তর, আঘাত বেশ গভীর ছিল। সে নারী শিবিরে অগ্নিসংযোগ করে পালিয়ে গেছিল। চিকিৎসক আরও জানালেন সেই আঘাতের কারণেই দেবগুপ্ত দুর্বল ছিলেন এবং পরদিন নিহত হয়েছিলেন রাজ‍্যবর্ধনের হাতে।

মঞ্জুষার জন্য ব্যকুল হয়ে ওঠে সম্রাটের হৃদয়। মঞ্জু যখন পালাতে সক্ষম হয়েছে সে জীবিত রয়েছে। এখন ভ্রাতৃহত‍্যার প্রতিশোধ নিতে প্রথম কর্তব্য শশাঙ্ককে উচিত শিক্ষা প্রদান। ইতিমধ্যে খবর এসেছে শশাঙ্ক বৌদ্ধমঠগুলো ধ্বংস করছে নির্বিচারে। বোধিবৃক্ষ ধ্বংস করতে প্রচেষ্ট হয়েছে। বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে সম্রাট হর্ষবর্ধন এগিয়ে যান। কামরূপ নরেশ উত্তর দিক থেকে বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের হাত। মগধ ও পাটলিপুত্র সহজেই জয় করেন সম্রাট হর্ষবর্ধন। কোণঠাসা শশাঙ্ক পিছু হঠতে বাধ্য হন।

ইতিমধ্যে হর্ষবর্ধন গ্ৰহন করেছেন বৌদ্ধধর্ম। মনে প্রাণে এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছে এই ধর্মাচরণে। প্রতিশোধ স্পৃহা, হিংসা এসব বিদায় নিচ্ছে মন থেকে। কিন্তু মঞ্জুর খোঁজ বন্ধ হয়নি, আশেপাশের রাজ্যেও গুপ্তচর নিয়োগ করেছেন তিনি।

বৈশালী ও মগধের নিকট নালন্দা পরিদর্শন করে ফিরছিলেন সম্রাট। একশো গ্ৰাম মঠাধ্যক্ষের চরণে অর্পণ করে এক গভীর প্রশান্তি অনুভব করছেন তিনি। এই গ্ৰামগুলির খাজনার অর্থে চলবে আবাসিকদের পঠন পাঠন। এছাড়াও সম্রাট সাহায্য করবেন সর্বদা। রাতে স্কন্ধাবার স্থাপিত হয়েছিল গঙ্গার ধারে পাটলিপুত্রের কিছু দূরে। পাশেই রয়েছে একটি বৌদ্ধ সংঘ। তবে এ সংঘ শ্রমণা পরিচালিত। বৌদ্ধ ভিক্ষুণীদের এ সংঘ বহু পুরাতন, থেরী শোভা মঠাধ্যক্ষা। সম্রাট পরদিন প্রভাতে সংঘ দর্শন করবেন ভেবেছেন।

প্রভাতে পুণ্য সলিলা গঙ্গার ঘাটে সূর্য প্রণামের সময় তিনজন ভিক্ষুণীকে দেখেতে পান মহারাজ। মুণ্ডিত মস্তক চীবর পরিহিতা ভিক্ষুণীদের মধ্যে একজন খুব অল্প বয়স্ক। অথচ বয়স জনিত চপলতা বা চঞ্চলতার কোনো লক্ষণ নেই তার ভেতর। দূর থেকে সম্রাট লক্ষ্য করেন ভিক্ষুণীদের। সম্রাটের সৈন্য সামন্ত লোক লস্কর দেখেই বোধহয় ভিক্ষুণীরা শীঘ্র ফিরে গেল সংঘে। কিন্তু সম্রাটের মনে একটা কৌতূহল রয়ে গেল। সর্বকনিষ্ঠা ভিক্ষুণী একবার মাত্র ফিরে তাকিয়েছিল সম্রাটের দিকে। কিন্তু সেই কাজল কালো চোখ দুটি সম্রাট এ জীবনে ভুলবেন কী করে!

বিহ্বল সম্রাট ভিক্ষুণীদের পিছু পিছু সংঘে পৌঁছলেন, সংঘ প্রধান ভিক্ষুণী এগিয়ে এলেন। সম্রাট সম্মান জ্ঞাপন পূর্বক সংঘ প্রধানাকে জানালেন তিন ভিক্ষুণীর কথা। প্রধান ভিক্ষুণী সম্রাটকে আম্রকাননে আসন গ্ৰহন করতে বলে সংঘের ভেতর প্রবেশ করলেন।

কিন্তু সম্রাট উৎকণ্ঠা ধরে রাখতে অপারগ। প্রতিটা মুহূর্তে মনে হচ্ছে তাঁর আশঙ্কা সত্যি হবে তো! একাধিক বৎসর অতিক্রান্ত, সর্বদা মঞ্জুষার চিন্তায় মগ্ন তিনি কি কিছু ভুল দেখলেন! একটু পরে এক বয়স্ক ভিক্ষুণী কিছু ফল মধু ও দুগ্ধ নিয়ে এলেন সম্রাটের জন্য। কিন্তু ব্যকুল সম্রাট আর ধৈর্য রাখতে অপারগ।

অবশেষে মঠাধ্যক্ষা ফিরে এলেন।

সম্রাট ওঁকে একা দেখে বিস্মিত হয়ে বললেন, “সে কোথায়? আপনি বলেননি আমার আগমনের কথা?”

—“তিষ্ঠ রাজন। আপনি যার দর্শন অভিলাষী সে এখানে নেই। আত্মারা যেমন দেহ ত্যাগ করে সে তার পূর্বজীবন ত্যাগ করেছে। সব কিছু ভুলে সে এখন প্রব্রজ্যা। বুদ্ধের চরণে শরণ নিয়ে ভিক্ষুণী হয়েই কাটাতে চায় এ জীবন। আপনি সম্রাট, সে আপনার মঙ্গল কামনা করেছে। কিন্তু গৃহীদের সঙ্গে দেখা সে করবে না।”

—“শুধু একবার... একটি বার...” কাতর অনুরোধ ঝরে পড়ে সম্রাটের কণ্ঠে।

—“রাজন, বুদ্ধের চরণে যে চির শান্তির খোঁজ পেয়েছে তাকে ওখানেই থাকতে দিন। বিনয় ও পাতিমোক্ষ খুব অল্প সময়ে সম্পূর্ণ অধিগত করে সে আরও বড় লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। তাকে বিচ্যুত করবেন না।”

সম্রাটের মনে পড়ে ছোটবেলার কথা, সেই কিশোরী চঞ্চলা মেয়েটি আজ প্রব্রজ্যা লাভ করে চিরশান্তির সন্ধান পেয়েছে। ধীরে ধীরে সংঘের বাইরে বেরিয়ে আসেন সম্রাট। মঞ্জুর এই এক ঝলক দর্শনে এক গভীর শান্তি লাভ করেছেন তিনি। এত বড় সাম্রাজ্যের মহানায়ক হর্ষবর্ধন মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন গৃহী হবেন না আর তিনি, বৌদ্ধের উপাসনায় কাটিয়ে দেবেন এ জীবন। মঞ্জু যেদিন স্ব-ইচ্ছা স্বয়ম্বরা হয়েছিল বিবাহ তো সেদিনই হয়ে গেছিল। তাই আর সেভাবে সংসারে প্রবেশ করবেন না কখনও। প্রজা প্রতিপালন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার এই হবে জীবনের লক্ষ্য। মঞ্জুর মতো তিনিও বুদ্ধের পায়ে অর্পণ করবেন নিজেকে।

সংঘের ভেতর থেকে ভেসে আসে এক পবিত্র মন্ত্র পাঠ—

‘বৌদ্ধং শরণ‌ং গচ্ছামি

ধম্মং শরণং গচ্ছামি

সংঘং শরণং গচ্ছামি...’