স্বস্তি পেলেন বিজয়কেতন ● ধূপছায়া মজুমদার


 

(১)

ছোটগোবিন্দপুরের প্রাক্তন জমিদারবাড়ি ‘নন্দন কানন’-এর বর্তমান গৃহকর্তা হলেন বিজয়কেতন রায়। নাম শুনে মনে হতেই পারে ভদ্রলোকের প্রতাপে চোরে পুলিশে চায়ের দোকানে একমাথা হয়ে আড্ডা মারে। কিন্তু না, সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। সে ছিল বিজয়কেতনের বাবা অরূপরতন রায়ের আমলে, স্বর্ণযুগে। এ গাঁয়ে তখন চোর ছিল বাড়ন্ত, পাশের গাঁয়ের কোনো চোর যদি রাতের আঁধারে জায়গা ঠাহর করতে না পেরে গাঁয়ের কারও উঠোন থেকে বালতি তুলে ফেলতো, তবে পরেরদিন সক্কাল সক্কাল অনুশোচনায় জর্জরিত হয়ে থানায় গিয়ে বালতি সমর্পণ করে আসতো। একসময় ভাবা হয়েছিল পুলিশের পক্ষ থেকে অরূপরতনকে কোনো অনারারি পোস্ট দেওয়া হবে, নানান ডিপার্টমেন্টাল গেরোয় সে আর হয়নি। তা সেসবই এখন ইতিহাস।

এখন চোর পুলিশের প্রকাশ্য হৃদ্যতা কদাচ দেখা গেলেও তার কারণ অবশ্যই গূঢ়তর কিছু, বিজয়কেতন নন, সেটা নিশ্চিত। বিজয়কেতনের সম্বল কেবল পিতৃদত্ত নামটি আর পৈতৃক অট্টালিকাটি। তাও যে এই প্রোমোটারির রাজত্বে এই বাড়ি এখনও টিকে আছে তার নব্বইভাগ কৃতিত্ব প্রাপ্য বিজয়কেতনের পিসিমার। নাগাড়ে বারব্রত, নিরম্বু উপবাস ইত্যাদি করার ফলে পিসিমার চেহারায় একখানা মহামহিম ঔজ্জ্বল্যের সৃষ্টি হয়েছে। নিন্দুকে বলে অবশ্য, ওটা ঔজ্জ্বল্য নয়, অ্যানিমিয়ার কারণে গায়ের রং ফ্যাটফেটে হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন, কিন্তু পিসিমা তা মানতে নারাজ। তাঁর মতে এ হল সংসারের কল্যাণার্থে ক্রমাগত কৃচ্ছসাধনের ফল! তবে বিজয়কেতন এবিষয়ে ভুলেও মতামত দেন না। কী করে দেবেন? চানের পর পিসিমা চুল আঁচড়ে না দিলে তাঁর সিঁথি এলোমেলো হয়ে থাকে, জুতো পালিশের কাজটা দিনুকে দিয়ে করাবেন, নাকি শামুয়াকে দিয়ে, পিসিমা বলে না দিলে সেটাও বুঝতে পারেন না। তিনি আর কেমন করে পিসিমার মুখের ওপরে কথা বলবেন! তাছাড়া বিজয়কেতন পিসিমাকে ভয়ানক ভয় পান। তাঁর বাপঠাকুর্দাও পেতেন, সেই ভয়ই জিনবাহিত হয়ে তাঁর মধ্যে আরও ডালপালা ছড়িয়েছে। ‘পিসিমা আসছেন’ এই দুটো শব্দ কানে গেলে এখনও সেই ছোটবেলার মতোই বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটে, হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। পরের ঘরের মেয়ে এসে পিসিমার মুখে মুখে কথা বলে পাছে অনর্থ বাঁধায়, সেই ভয়ে বিজয়কেতনের আর বিয়েই করা হল না। পিসিমা একসময় “বিজু বাবা তুই বউ না আনলে আমি কাশী চলে যাব” বলে থ্রেট দিতেন ঠিকই, তবে কেন জানি না, সে থ্রেটের দাপট তেমন ছিল না। আর সত্যি বলতে কী, পিসিমা উদ্যোগ না নিলে বিজয়কেতনের একার পক্ষে উদ্যম করে বউ খুঁজে আনা অসম্ভব। তাই আপাতত বিজয়কেতন ধান, সব্জি আর মাছের হিসেবপত্র, আর নিজের শখটখ নিয়েই পিসিমার তত্ত্বাবধানে দিব্যি আছেন।

এবার আসা যাক বিজয়কেতনের শখের কথায়। লোকের তো কতরকমের শখ থাকে। ঝিনুক জমানো, দেশলাইবাক্স জমানো, বিখ্যাত লোকজনের সই জমানো। বিজয়কেতনের আবাল্য শখ স্বপ্ন জমানো। ওঁদের ছোটবেলায় কায়দাকেতার ডায়রি পাওয়া যেতো না, বা পাওয়া গেলেও পিসিমার চোখ এড়িয়ে ওসব জিনিস বাড়িতে আনা যেতো না, চেষ্টাই করেননি কোনোদিন। কেজিদরে বিক্রি হওয়া দিস্তা কাগজ সেলাই করে তিনি স্বপ্ন জমানোর ডায়রি বানাতেন। তারপর তাতে সন তারিখের হিসেব মেপে স্বপ্ন লিখে রাখতেন। রোজকার হেঁজিপেঁজি স্বপ্ন, যেমন, সত্যেনকে সাইকেল রেসে হারালেন বলে মৃগাঙ্কর বাবা বিজয়কে নোবেলের মতো দেখতে একটা মেডেল পরিয়ে দিলেন, কিংবা দীনুগয়লার কালীগাইয়ের তাড়া খেয়ে বিজয় ঝাঁপ দিলেন পানায় ভরা মেঠোপুকুরে, এমন স্বপ্নও থাকতো ডায়রিতে। আবার বেশ ‘হটকে’ স্বপ্ন, যেগুলো শুরু হতে না হতেই হটকেকের মতো হুশ করে শেষ হয়ে যেতো, যেমন বিজয়কেতন আর সিন্দবাদের নতুন অভিযান, বা মারাদোনা আর বিজয় বিশ্বকাপের ফাইনালে জেতালেন ভারতকে, এমন স্বপ্নও লিখে ফেলতেন মন দিয়ে। ডিটেলে মনে না থাকলে সামান্য জল মেশাতেন, তবে প্রতিটা স্বপ্নেরই লাস্ট পার্টগুলো হতো নির্জলা সত্যি। সত্যি বলতে কী, আজ অব্দি যত স্বপ্ন বিজয়কেতন দেখেছেন, সবক’টাই শেষ হয়েছে পিসিমা দিয়ে। সাইকেল রেসের স্বপ্নের শেষে মৃগাঙ্কর বাবার দেওয়া নোবেল দেখে পিসিমা খোঁপা নাড়িয়ে বলছেন, “এ তামার ঢিপির চে চাট্টি দিস্তে খাতা কিনে দিতে পারতো তো মিরগেলের বাপ!” মৃগাঙ্ককে পিসিমা সত্যিই মিরগেল বলেন বরাবর, এটা স্বপ্ন নয়। মারাদোনার স্বপ্নে ভারতীয় ফুটবলদলের হাতে কাপ তুলে দিয়েছিলেন পিসিমা, আর মারাদোনার দিকে চোখ তুলে চেয়ে খোঁপা নাড়িয়ে শুধিয়েছিলেন, “এতদিন কোথায় ছিলে বাছা?”

 

ধান ভানতে শিবের গীত কেন? আছে, কারণ আছে। ওই যে ছোটবেলা থেকে জমানো ডায়রিগুলো, ওগুলোকে বিজয়কেতন বেজায় গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখেন, শুদ্ধুমাত্র পিসিমার ভয়ে। প্রথমত, সেকালের বাচ্চা বিজয়ের এমন উদ্ভট শখের কথা জানতে পেলে একালের আধবুড়ো বিজয়কেও মহিলা পর্যুদস্ত করে ছাড়বেন, দ্বিতীয়ত, এত বছর ধরে জমানো হাজারো স্বপ্নের একটাতেও তিনি খোঁপা নাড়ানো দজ্জাল পিসিমা ছাড়া অন্য কোনো রোল প্লে করেননি, একথা জানতে পেলে বুড়িমানুষ মনে বড় দাগা পাবেন, এই বয়সে সেটা আর দিতে চান না বিজয়। কিন্তু হলে হবে কী, যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধে হয়!

 

(২)

দুর্গাপুজোর মাসদুয়েক আগে, পিসিমার বায়নার ধাক্কায় বাড়ি রং করানো হবে ঠিক হল। পিসিমা বলছিলেন আজ প্রায় বছর দুই ধরে, বাড়ি রং হয়েছিল সেই পনেরো বছর আগে, বিজয়কেতনের ছোট বোন জয়মালার বিয়ের সময়। তারপর থেকে এই দেওয়ালে শ্যাওলা, ওই দেওয়ালে রোদের খরতাপ, এসব জমতেই থাকছে, আর রংও ফিকে হতেই থাকছে। পিসিমা প্রথমটায় ভালমুখে বলছিলেন, বিজয়ও ‘এবার না, পরের বছর,’ ‘রঙয়ের দাম কমুক, মিস্তিরির মজুরি কমুক’ বলে পাশ কাটাচ্ছিলেন। খরচাটা সমস্যা নয়, সমস্যা হল উদ্যোগ করে বাড়ি রং করানোর হ্যাপা নিজের কাঁধে নিয়ে ব্যাপারটাকে পার করা। বিজয়কেতনের ধাতে ওসব নেই। পনেরো বছর আগে বাবা ছিলেন, পিসিমা আরও শক্তসমর্থ ছিলেন, বিজয়ের গায়ে আঁচটি লাগেনি। তবে এবছর আর বিজয় এড়াতে পারলেন না, পিসিমা একদিন চেপে ধরলেন।

“হ্যাঁ রে বিজু, কোন দেশে রংয়ের দাম, মজুরি বছর বছর কমতে থাকে আমায় বলবি? দুবচ্ছর ধরে বুড়িটা বলে আসছে, রংটা করা, কথা কানে নেওয়ার নামই নেই? একদিন পট করে মরেটরে গেলে আমার ছেরাদ্দে বাড়ি রং করিও হ্যাঁ?”

বলা বাহুল্য, শাসানিতে কাজ হল। পিসিমার শ্রাদ্ধে বাড়ি রং হচ্ছে, ভাবতেই বিজয়কেতনের হাত পা এলিয়ে পড়তে চাইল। পিসিমা না থাকলে তাঁর শ্রাদ্ধশান্তির জোগাড়, বাড়ি রংয়ের ঝামেলা সব তো ওঁকেই পোহাতে হবে! তার চেয়ে বরং পিসিমা মোটামুটি সমর্থ থাকতে থাকতেই বিজয় সন্ন্যাসী হয়ে যাবেন। সেটাই শ্রেষ্ঠ উপায়। কিন্তু সন্ন্যাসী হতে গেলেও তো লোটা কমণ্ডুল গুছিয়ে নিয়ে বেরোতে হয়, বেরিয়ে সেসব সামলেসুমলে রাখতে হয়। বিজয় কি পারবেন অতকিছু একা একা? থাকগে, এবারেই বাড়ি রং করিয়ে ফেলাটা ভাল। পিসিমা আছেন, চিন্তা নেই।

ভাবনাচিন্তা করে তিনদিনে তিন রংমিস্তরিকে ডাকা হল। সোমবারে এল ওসমান, মঙ্গলবারে কাঁদন, আর বুধবারে অনঙ্গ জোসেফ মণ্ডল।

কাঁধ ছাপানো চুলের ঢাল, খোঁপা করে তুলে রাখে ফকিরপাড়ার ওসমান, সারাদিন তার বাহারের কেশদাম ঢেকে রাখে বউয়ের পুরোনো ওড়নার একফালি দিয়ে, রং ধুলোবালি লেগে যাওয়ার ভয়ে। বাড়ি বাড়ি রং করার কাজে লাগলে এই তার প্রথম কাজ, এখন কাজ না থাকলেও সারাদিন তাইই করে।

বলে, “চুলগুলোরও তো অব্যেস বলে কিছু আছে নাকি? দু’দিন ঢাকা, দু’দিন ছাড়া, ঘামবে কি ঘামবে না বুঝে উঠতে পারবে না ত! তার চে এই ভাল।”

কাজের শেষে বাড়ি ফিরে গা ধুয়ে এলোচুল মেলে দিয়ে বাড়ির পাশের গাছতলায় ওসমান বসে একখানা তারের বাজনা নিয়ে। নাম জানে না যন্তরটার, ভবরামপুরের মেলায় জলের দরে পেয়ে গিয়েছিল। আওয়াজখানা ভারি মিঠে, বসে খানিকক্ষণ বাজালে ওসমানের মনে হয় রং করার বাড়িদের বাবুদের খ্যাঁকানি, ছেলের ইস্কুলের নতুন জুতো কিনে দিতে না পারার ব্যর্থতা এসব বুঝি কোনো অন্য জগতের কথা! ওসমানের জগতে তখন সত্যি কেবল সে আর তার ওই তারের বাজনা। বউ যখন রাতের খাবার বেড়ে ডাকতে আসে, তখন তার ধ্যান ভাঙে। বউ তার বেজায় ধর্মভীরু মানুষ, মা-ঠাকুমাদের সব টোটকা তাবিজ চিরকাল মেনে এসেছে। কিন্তু সেও বুঝতে পারে না সন্ধেরাতে পুরুষমানুষ এলোচুলে গাছতলায় বসে থাকলে সংসারের মঙ্গল হয়, নাকি অমঙ্গল! মেয়েদের এসব ব্যাপারে বিধিনিষেধ জানা বিষয়, পুরুষদের ক্ষেত্রে বিধান কী, কে জানে? বউ রাগতে গিয়েও থমকে যায়, মানুষটাকে তখন কেমন ফকির দরবেশদের মতো দেখতে লাগে। ঢিপঢিপ বুকে বউ তখন ওসমানের গায়ে হাত রেখে তাকে সংসারে ফিরিয়ে আনে।

তা, সেই আধাফকির রংমিস্তিরি ওসমান এসেই পিসিমাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে ফেলল। তারপর বলল, “মাসিমা আমি কিন্তু মন্দিরের দেয়ালটা ধরব না।”

“কেন ওসমান? ওখানেই তো জাফরিগুলো আছে। ওগুলোয় তোমার মতো করে তো কেউ হাত লাগাতে পারবে না। সেবারে কে এক ছোঁড়াকে লাগিয়ে পালালে তুমি, সে এক্কেবারে জাফরির চচ্চড়ি করে রেখেছিল।”

“মন্দির যে ওখানে! আমি...”

“থাক থাক বাছা, আর ব্যাখ্যানা করে কাজ নেই। যার কাজ তারে ছাড়া অন্য কারে দিলে বুকে ব্যথা বই আর কিছু যে হওয়ার নয়, সে আমার ঠাকুরও জানেন, তোমার ঠাকুরও জানেন। অন্যান্য জায়গার জন্যে দর দিয়ে যাও, না পোষালে অন্য লোক দেখব। মন্দির তুমি করছ, আসছে সোমবার থেকে ঘষাঘষিতে লেগে যাও, আমি ব্যবস্থা করে রাখব।”

তারপর খানিকক্ষণ দর কষাকষি চলল পিসিমা আর ওসমানের মধ্যে। বিজয়কেতন শুনছিলেন আর আশ্চর্য হচ্ছিলেন। পিসিমা তো বাড়ির বাইরে আদপেই বেরোন না, রঙয়ের দর, মিস্তিরিদের মজুরি এসব নিয়ে এত গভীর জ্ঞান তাঁর হল কী করে! অবশ্য দেখা আর শোনাই সার! শিখতে তো এই জন্মে পারবেন না, পিসিমার এই ব্যক্তিত্বের ছিটেফোঁটাও তাঁর মধ্যে নেই। তেমন তেমন কর্পোরেট কোম্পানিরা পিসিমার খোঁজ পেলে মাথায় করে রাখবে বোধহয়!

 

পরের দু’দিনও এভাবেই দরদস্তুর করে কাটলো। কাঁদন মিস্তিরি খুব ভাল, হাতের টানের তুলনা নেই তার, আজকাল যেসব ছবি আঁকা রঙিন দেওয়ালের চল হয়েছে, সে তাতে মাস্টার। ঘরের ভেতর রং করার সব বরাতই তার মোটামুটি বাঁধা থাকে। কিন্তু কাঁদনের আবার একটু হাতটানের স্বভাব আছে। বসার ঘরের দেওয়ালে নকশা আঁকার বরাত পেয়েছে হয়তো, রং শেষ করে পয়সাকড়ি মিটিয়ে মিস্তিরিদের দলকে বাড়ি পাঠানোর পর দেখা গেল কোণার তাকের পেছনের সারিতে বসা মাটির বরবউ হাপিস। বা, জলের কুঁজোর ওপর উপুড় করে রাখা ফুলকাটা গেলাসটা হাওয়া, তার বদলে সেখানে আছে কাঁদনের দাদুর চা খাওয়ার ফাটা একখানা গেলাস। এমন অভিজ্ঞতা ছোটগোবিন্দপুরের অনেকেরই হয়েছে। অতি উচ্চমানের মিস্তিরি সে, আর তার সরিয়ে ফেলা জিনিসপত্র কোনোটাই খুব দামী হয় না, আজ অব্দি সে কোনো বাড়ি থেকে টাকাপয়সা সোনাদানা জামা জুতো কিচ্ছুটি নেয়নি। হাতটানের নেশা তার। গাঁয়ের ছেলে বলে সবাই মায়াই করে, ধীরে ধীরে লোকে জেনেছে এটা একধরনের অসুখই বলা চলে, তাই আর কেউ কাঁদনকে কিছু বলে না, কেবল নিজেরা সাবধানে থাকে।

কাঁদন দরাদরি করে কথাবার্তা বলে চলে যাওয়ার পর পিসিমা বললেন, “বিজু, তোকে সেই লালপেড়ে হাতপাখাটা বুনে দিয়েছিলাম না? ওটা রং করার ক’দিন বসার ঘরে এনে রাখবি। চোখের সামনে কিছু একটা ফেলে রাখলে হয়তো অন্য দিকে নজর যাবে না ছোঁড়ার। হাতপাখাটা কাজের জিনিসও, কাঁদনের মা বউয়ের কাজে লাগবে।”

“আমার কাজে লাগে না ওটা?”

“পড়ে পড়ে ঝুল জমছে, দেখেছি। কাজে লাগলে বানিয়ে দেবখন আরেকটা। যার বেশি কাজে লাগে তাকে দিতে হয়। এতখানি বয়স হল বাপ, আর কবে শিখবি?”

পিসিমার মুখঝামটায় মিইয়ে যান বিজয়কেতন, পরক্ষণেই নিজেকে ধিক্কার দেন, ঠিকই তো, এতখানি বয়স হল, আর কবে শিখবেন? পায়ে পায়ে নিজের ঘরের দিকে এগোন, হাতপাখা ঝেড়েঝুড়ে কাঁদনের হাতের কাছে রাখবেন ব’লে।

 

বুধবারে এল অনঙ্গ জোসেফ মণ্ডল। নাম জিজ্ঞেস করলে সে এভাবেই বলে, এবং অনঙ্গজোসেফ বলে না ডাকলে সে সাড়া দেয় না। নামের ব্যাপারে সে খুবই স্পর্শকাতর। সত্যি বলতে কী, ছোটগোবিন্দপুরের তাবড় রংমিস্তিরিদের মধ্যে এই অনঙ্গজোসেফই সবচেয়ে জাত্যাভিমানী, সবচেয়ে ব্যক্তিত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে দামী মিস্তিরি। চুপি চুপি বলে রাখি, বিজয়কেতনের একে খুব ভাল লাগে। ব্যক্তিত্ব ব্যপারটা বিজয়ের মতে তাঁর নিজের মধ্যে একটু কম আছে, (নিন্দুকদের মতে, প্রায় নেইই) তাই আশেপাশের যত ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষজনকে তিনি খুব ভালবাসেন। পিসিমা, অনঙ্গজোসেফ, জমাদার বীরেন, অন্নপূর্ণা ভাণ্ডারের মালিক খোকন সাহা, সবাই এই দলে পড়েন।

যাইহোক, অনঙ্গজোসেফের কথাটা ছোট করে বলে নিই। সে রঙের কাজ শেখার সঙ্গে সঙ্গে কাঠের কাজও শিখেছিল। চার্চের ইস্কুলে এসব সবাইকেই শেখানো হয়। তারপর নানা ঘাটের জল খেয়ে অনঙ্গজোসেফ এখন রংমিস্তিরির পাশাপাশি কাঠমিস্তিরিও বটে। মডিউলার কিচেন, সিঁড়ির রেলিং, বাহারি সদর দরজা, সবেতে সে ওস্তাদ। আধুনিক বাড়ি সাজাতে বাকি দুজনের চেয়ে তার চাহিদা বেশি, তাই তার জাত্যাভিমানও বেশি। রংমিস্তিরি আর কাঠমিস্তিরি, দুইয়েরই কৌলিন্য বজায় রাখতে সে বদ্ধপরিকর। নিজেকে সে মিস্তিরি বলে না, বলে 'আটিস', নিজের নাম ছাপানো রাইটিং প্যাড সঙ্গে নিয়ে ঘোরে, দর বলো রসিদ বলো, সব ওই কাগজেই লেখা হয়। এসব ঠাটবাট বজায় রাখতে হলে রেট না বাড়ালে চলবে কেন? লোকে আড়ালে বলাবলি করে, এই অঞ্চলেও ইদানীং ফ্ল্যাটবাড়ির কালচার শুরু হয়েছে বলেই অনঙ্গজোসেফের এত দবদবা। আগের কাল হলে আর তাকে করে খেতে হতো না এতবেশি ঠাটবাট দেখিয়ে!

তা, অনঙ্গজোসেফের সঙ্গে পিসিমার কথাবার্তায় বিজয়কেতন বুঝলেন, কীকরে জানি না পিসিমা আজকাল বেশ আধুনিক হয়ে উঠেছেন। সাবেক রান্নাঘরের ঝুলকালি মাখা আঁধার ঘুচিয়ে সেখানে মডিউলার কিচেন বানানোর ব্যবস্থা করছেন। প্রথমটায় তো শুনে বিজয়কেতন হাঁ! অনঙ্গজোসেফও ঘাবড়ে গিয়েছিল, পেশাদারী দক্ষতায় নিজেকে সামলে নিলো। যাইহোক, সবশেষে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ালো, বাড়ির বাইরের দেওয়াল আর মন্দির রং করবে ওসমান, বাড়ির ভেতরটা করবে কাঁদন, পাঁচিল আর রান্নাঘর করবে অনঙ্গজোসেফ। দু’দিন যাবে ঘরদোর গোছাতে, আসবাব সরাতে, তারপর তিনজন দলবল নিয়ে বাড়ি মাতিয়ে রাখবে, মাসখানেকের ধাক্কা আর কী!

“বিজু তোর ঘরের জিনিসপত্র সব আমি দাঁড়িয়ে থেকে সরা করাবো, তুই এপাশ ওপাশ করিস না কিছু, খুঁজে পাবি না পরে।”

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধে হয়!

 

(৩)

প্রথমটায় বিজয়কেতন ঢক করে ঘাড়টা নেড়েই ফেলেছিলেন, পিসিমার গলা শুনলেই যেটা রিফ্লেক্সের বশে হয়ে যায় তাঁর। কিন্তু পরক্ষণেই খেয়াল হল, এই না তো, তাঁর ঘরের চার্জ পিসিমাকে দেওয়া যাবে না। আগেরবার রঙের সময় জয়ির বিয়ে নিয়ে সাতকাজে পিসিমা ব্যস্ত ছিলেন, তাঁর চোখকে ফাঁকি দিয়ে স্বপ্নখাতার খাজানা লুকিয়ে রাখতে বেগ পেতে হয়নি, তারও আগে যখন যখন দরকার হয়েছে মৃগাঙ্কের বাড়িতে পাচার করেছেন তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তি, কিন্তু মৃগাঙ্ক গাঁয়ে থাকে না বহুকাল, এবার কী করে বাঁচাবেন খাতাগুলোকে?

“ইয়ে, পিসিমা, তোমার কোমরের ব্যথাটা এখন চাগাড় দিলে মুশকিল না? তুমি ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ওসব গোছগাছ করলে কাজ শুরুর সময়টায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। তোমার আমার দুটো ঘরই আমি দেখে নেব, কোত্থেকে কী সরিয়ে কোথায় রাখা হল একটা খাতায় টুকে রাখব, লিখে রাখলে তো আর ভুলে গেলে অসুবিধে নেই!”

“না, একদম না। আমার ঘরের কোনো জিনিসে তুমি হাত দেবে না। তুমি কেন, কেউই দেবে না হাত। ওঘর আমি নিজে গোছাবো।”

পিসিমা এমন তেড়ে উঠলেন যে বিজয়ের নিজেরও গলা চড়ে গেল।

“তাহলে আমিও আমার ঘর নিজে গোছাব। তুমি কেন, কেউই হাত দেবে না।”

অন্য সময় হলে বিজয়ের আস্পদ্দা দেখে পিসিমার ব্লাডপ্রেশার ভয়ানক বেড়ে যেতো হয়তো, নিজে কাশীবাসী হওয়া, কিংবা সাধের ভাইপোর সঙ্গে সম্পক্কো ত্যাগ করার কথা বলতে বসতেন, কিন্তু এখন কী জানি কোন দুর্বোধ্য কারণে বারতিনেক আঙুলের কড় গুনে ছাদের দিকে চোখ তুলে কী হিসেব কষে গলা ঝেড়ে বলে উঠলেন,

“বেশ, লায়েক হয়েছ যখন, নিজের সবকিছু নিজেই বুঝে গুছিয়ে নাও, আমি আমার ঘর সামলাই। ভালোই, একটা হ্যাপা নামল ঘাড় থেকে। কই রে বিনি, রান্নাবাড়া হবে আজ? নাকি উপোস সবার? যেদিকে তাকাবো না সেদিকেই হাট বসিয়ে রেখে দেবে। সাবালক হয়েছে সব!”

বলে খুরখুর করে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা লাগালেন, ভাইপোর দিকে ফিরেও তাকালেন না। বিজয়কেতনের মনটা একটু খুঁতখুঁত করতে লাগল, বয়স্ক মানুষটাকে মুখের ওপর ওভাবে বলাটা কি ঠিক হল? কিন্তু খাতার বাক্স লুকোতে হলে এছাড়া আর উপায়ও ছিল না। আপাতত নিশ্চিন্ত, খাতাদের ফাঁড়া এযাত্রায় আর নেই বলেই মনে হচ্ছে।

কিন্তু বাক্সটা লুকোবেন কোথায়? তাঁর ঘরে বড় ট্রাঙ্কের একেবারে ভেতরদিক করে বাক্সটা রাখা থাকে, ওপরে তাঁর ইস্কুল কলেজের মার্কশিট আর পুরোনো খবরের কাগজ ঢেকে রাখা থাকে। সেই ট্রাঙ্কসুদ্ধু সরিয়ে ফেলা যায়, কিন্তু হুটোপাটির সময় কেউ যদি অন্য ট্রাঙ্ক ভেবে তাঁর ট্রাঙ্কটা খুলে ফেলে? বাক্সটা কীসের বুঝতে পেরে পিসিমার কানে কথাটা তুলে দেয়? তখন কী হবে?

এই অব্দি ভেবে বিজয়কেতন ঘেমে উঠলেন, তাঁর হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল, হাতের তেলো ঘামছে, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ! মনে পড়ল ক’দিন আগেই শুনেছেন এসবই ভয়ানক উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার লক্ষণ। এসব বেশি হলে ব্যাপারখানা সিরিয়াস, শরীরে মনে ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি হতে পারে। এইধরনের পরিস্থিতিতে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করতে হয়, উদ্বেগের মূল কারণ খুঁজে বের করতে হয়। বিজয়কেতনও সেই চেষ্টাই করতে লাগলেন।

প্রথমে মনে হল তাঁর উদ্বেগের মূল কারণ পিসিমা। উঠতে বসতে পান থেকে চুন খসলেই পিসিমার দাবড়ানি শুনে এসেছেন চিরকাল, মনে চিরস্থায়ী ভয় বাসা গেড়েছে বোধহয়। পরক্ষণেই মনে হল, পিসিমা কি শুধুই দাবড়ানি দেন? নিত্যপুজোর কলা বাতাসা বলো, বা জন্মাষ্টমী পুজোর প্রথম মালপোয়া আর তালের বড়া, পয়লা বোশেখের সকালে ফুলকো লুচি, মকরে নলেন গুড়ের পায়েসের প্রথম বাটিটা, এসব তো বিজয়ের হাতে পিসিমাই তুলে দেন বরাবর! সেকথা ভুললে চলবে?

তবে কি উদ্বেগের কারণ ওই স্বপ্ন জমানো খাতাগুলোই? ওগুলোকে দূর করে দিলেই কি তাঁর থেকে থেকেই বুক ধড়ফড়ানির স্বভাবটা বদলাবে? কিন্তু অমন একখানা আনকমন শখ, ছোট্টবেলা থেকে লালন করে আসছেন, হুট করে তাকে বিসর্জন দেওয়া যায় নাকি?

আবারো ভাবতে থাকেন বিজয়কেতন। পিসিমা আর শখের মাঝে দোটানায় পড়ে নাজেহাল হতে থাকেন মাঝবয়সী মানুষটা। মাঝে একবার মনে হল, ধুত্তোর, নিকুচি করেছে এসব গেরোর, সব বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে পড়লেই হয় লোটাকম্বল নিয়ে। কিন্তু, ওই, পথে বেরিয়ে সব যে নিজেকেই গুনেগেঁথে রাখতে হবে! সেসব যদি বিজয় পারতেনই, তাহলে কি আর বেরিয়ে পড়তে অ্যাদ্দিন দেরি করতেন? আসলে বিজয় নিজেকে বড্ড ভয় পান, নিজের দায়িত্ব নিতে ভয় পান। ওই ভয়টাই যত নষ্টের গোড়া, যাবতীয় উৎকণ্ঠার কারণ।

ব্যস, সিঁড়িভাঙা সরলের উত্তর পূর্ণ সংখ্যায় পাওয়ার মতো একটা তৃপ্তি পেলেন বিজয়কেতন তাঁর উদ্বেগের মূল কারণটাকে খুঁজে পেয়ে। এবার সেটাকে বস্তাবন্দি করে বিসর্জন দিয়ে আসবেন। ভাগ্যিস এই অ্যানালিসিসটা করতে বসেছিলেন নিজেকে নিয়ে, তাই তো নাটের গুরু ভয়কে ধরা গেল! এবার আরও যেক’টা বছর বাঁচবেন, ভয় ব্যাটার মুখে নুড়ো জ্বেলে দিয়ে আরামে বাঁচবেন। মা কী একটা গান গাইতেন না? হ্যাঁ, মনে পড়েছে।

“আমি ভয় করব না ভয় করব না”।

এটাই হবে তাঁর জপমন্ত্র। সত্যি, ওই মায়ের এমন ভীতু ছেলে তিনি! অবশ্য মা-ও পিসিমাকে অল্প ভয় পেতেন। কিন্তু তিনি পাবেন না। অকারণে ভয় তিনি পিসিমা কেন, কাউকেই পাবেন না। তাঁর স্বপ্ন জমানোর ডায়রি তিনি যেখানে ইচ্ছে রাখবেন, পিসিমা বা অন্য কারও নজরে পড়লে সহর্ষে জানাবেন, হ্যাঁ, স্বপ্ন জমানো তাঁর শখ। কোনোকালে যদি চাকরির দরখাস্ত করতে হয়, তাতে লিখবেন, স্বপ্ন জমানো তাঁর হবি। এ ভেরি আনকমন হবি। এরকম নানাবিধ সংকল্প করে জপমন্ত্রখানা গুনগুন করতে করতে দৃঢ়চিত্তে বিজয়কেতন তাঁর ঘরের জিনিসপত্র গোছগাছ শুরু করলেন।

 

(৪)

সারা বাড়ির যেখানে যা জিনিসপত্র সরানোর, সব সারা হয়েছে, ড্রেসিংটেবিল আলমারির আয়না সব চাদর দিয়ে ঢাকা হয়েছে, যেখানে যত দেওয়াল-আলমারির তাক খালি করে ট্রাঙ্কবোঝাই করা হয়েছে। দোতলার ঝুলবারান্দার এক কোণে মালপত্র বোঝাই ট্রাঙ্কগুলোকে সব সারে সারে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। হুট করে কিছু দরকার হলে যাতে সব ট্রাঙ্ক হাঁটকাতে না হয়, তার জন্য পিসিমা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবকটা ট্রাঙ্কের গায়ে ঘরের নাম লেখা কাগজ সাঁটিয়েছেন। ঘর হিসেব করে সেই মতো ট্রাঙ্ক খুঁজে নামিয়ে খুললেই হবে। পিসিমার ব্যবস্থাপনা দেখলে মাঝেমধ্যে মনে হয়, দিব্যি একখানা মাঝারি মাপের কোম্পানি চালানোর ক্ষমতা রাখেন ভদ্রমহিলা। অবশ্য এই সংসার, ধানজমি, পুকুর সব্জিক্ষেত ফলবাগানের আয় ব্যয়ের হিসেব সামলানোর যে কর্মকাণ্ড তাঁর ঠ্যালায় চলে, সে কি কোনো ছোটখাটো কোম্পানির চেয়ে কম নাকি?

 

আজ সকালে ঘুম ভেঙে থেকে বিজয়কেতনের মাথাটা ভার হয়ে আছে। ঘুম হয়েছে, অথচ মনে হচ্ছে শুতে পেলে আরও ঘণ্টাদুয়েক স্বপ্ন দেখে কাটিয়ে দিতে পারবেন। পারছেন না কেবল চক্ষুলজ্জার খাতিরে। বুড়ি মানুষ সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াচ্ছেন, আর তিনি একজন সমর্থ মাঝবয়সী মানুষ সারাদিন ঘুমিয়ে কাটাবেন, ব্যাপারটা দেখতেও খারাপ লাগে তো! স্বপ্নের ব্যাপারে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল, আরে, একটু আগে দুর্দান্ত একটা স্বপ্ন দেখেছেন যে! প্রথমভাগটা দেখে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, জলটল খেয়ে ঘুমিয়ে বাকিটা দেখেছেন। হাসবেন না, এরকম হয়। আমার হয়, আমার ভাগ্নীর হয়, বিজয়কেতনেরও হয়। কিছু কিছু স্বপ্ন সিরিয়ালের মতো এপিসোডে দেখা যায় দিব্যি। কী কী স্বপ্নের সিরিয়াল হবে, সেটা অবশ্য আগে থেকে আঁচ করা যায় না।

যাকগে, যা বলছিলাম। বিজয়কেতন প্রথম পর্বে দেখলেন ওসমান, কাঁদন, অনঙ্গজোসেফ, তিনি আর জমাদার বীরেন এক টিমে খেলছেন, ফুটবল, বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা ফুটবল ম্যাচ চলছে। অপোনেন্ট টিমে সব অচেনা লোক। স্বপ্নে অচেনা লোককে কীভাবে দেখা যায় জানা নেই। রাস্তাঘাটে দেখা অচেনা মুখগুলোই কি স্বপ্নে জনতার দৃশ্যে অভিনয় করে? কে জানে! যাইহোক, স্বপ্নে ফিরি আবার। ম্যাচের রেফারি আর কেউ নন, পিসিমা। বিজয়কেতন দিনকয়েক আগে কণিকা বর্মনদের কথা পড়ছিলেন কোথাও, তাই হয়তো পিসিমাকে রেফারির রোলে দেখেছেন। সে ম্যাচ তো ওঁরাই জিতলেন, এবং তাতে পিসিমার কোনো পক্ষপাতিত্ব ছিল না। এরপর এল স্বপ্নের দ্বিতীয় ভাগ। তাতে দেখলেন, ম্যাচের পর জামার ঘামটাম নিংড়ে সাফসুতরো হয়ে তাঁরা গেছেন এক সাহিত্যসভায়। বেশ বড়সড় সাহিত্যসভা, তাতে প্রধান অতিথি পিসিমা, বিশেষ অতিথি বিজয়কেতন। পিসিমার আত্মজীবনী আর তাঁর স্বপ্নপঞ্জী প্রকাশিত হবে সেই সভায়, পিসি ভাইপো স্টেজ আলো করে বসে আছেন, থ্রিলিং ব্যাপার।

এই পর্যন্ত দেখেই ঘুমটা ভেঙে গেছে। বইগুলোর মলাট কেমন দেখতে, কোন পাবলিশার, কত দাম রেখেছে, কিছুই দেখা হল না। স্বপ্নে হলেও, নিজেদের বই তো বটে, এই বেসিক ইনফরমেশন না জানলে কী করে চলে? একটা খিঁচড়ানো মেজাজ নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন বিজয়কেতন। এখনই লিখে রাখলে ভাল হতো, পরে ভুলে গেলে মুশকিল। যদি পরে কখনও থার্ড এপিসোড দেখেন, জুড়ে দেবেন। হিসেবটিসেব করে একখানা ট্রাঙ্ক নামালেন, এটাতেই আছে বোধহয় এখনকার ডায়রিটা।

 

ট্রাঙ্কের ডালা খুলে নাড়াচাড়া করে নিজের খাতাগুলো পেলেন না বটে, কিন্তু অল্প চেনা হাতের লেখার কিছু খাতা পেলেন, কয়েকটা একটু হলদেটে, দেখে মনে হয় পুরোনো, আর একটা নতুন খাতা। কার খাতা এগুলো? জয়মালার? তারও লেখার শখ ছিল নাকি? সাত আটটা খাতা হবে সব মিলিয়ে, সব পড়ার সময় নেই, নতুনটায় চোখ বুলিয়ে বিজয়কেতনের চোখ কপালে উঠল। কী কাণ্ড, এ যে পিসিমা! পড়ে মনে হচ্ছে আত্মজীবনী ধরনেরই কিছু লিখছেন। আজই স্বপ্ন দেখলেন, আর আজকেই এই আবিষ্কার! তাঁদের বাড়িতে ডাইনোসরের ফসিল পাওয়া গেছে, কিংবা ভিনগ্রহীরা ছোটগোবিন্দপুরে ক্যাম্প করতে আসছে, এসব শুনলেও বোধহয় এত আশ্চর্য হতেন না বিজয়কেতন। পিসিমা এত বছর ধরে সবার চোখের আড়ালে নিজের কথা লিখে আসছেন, কেউ জানতেও পারেনি! অবশ্য তিনিও তো ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন জমিয়ে আসছেন, কাউকে জানতে দিয়েছেন কি? আমরা বোধহয় ততটুকুই জানতে পারি, যতটুকু আমাদের জানানো হয়। আর সত্যি কথা বলতে কী, নিত্য প্রয়োজনের বাইরে পিসিমার সঙ্গে বিজয়কেতন কথা বলেনই বা কতটুকু? একসময় পিসিমা খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতেন, বিজয়ের আবছা মনে পড়ে, কোনো কোনো সন্ধেয় ঠাকুর্দা বাড়ি না থাকলে পিসিমা বাঁশি বাজাতে বসতেন। মেয়ে বাঁশি বাজাবে ব্যাটাছেলেদের মতো, ঠাকুর্দার পছন্দ ছিল না একেবারেই। ওতে নাকি বুকের দোষ হয়। কলজেয় দম আছে তো শাঁখে ফুঁ দিক, এক ফুঁয়ে গাঁয়ের এপারওপার এক করে দিক মেয়ে, খুব ভাল, বাঁশি বাজানো কি মেয়েছেলের কাজ? ব্যস, পিসিমার শখ বাক্সবন্দি হয়ে গেল।

গত দশ বছরে কি বিজয়কেতন একবারও পিসিমার পাশে বসে তাঁর পুরোনো শখগুলো নিয়ে কথা বলেছেন? নতুন কোনো শখের কথা জানতে চেয়েছেন? নাহ্, মনে পড়ল না। নিয়েই গেছেন কেবল তিনি, দেওয়ার কথা কখনোই খেয়াল হয়নি।

 

ভয় ব্যাটাকে তেপান্তরে পাঠানোর সংকল্পের পাশাপাশি আরও কতগুলো লক্ষ্য স্থির করে ফেললেন বিজয়কেতন। রোজ সন্ধেয় পিসিমার কাছে একটু বসবেন, নাহয় দুটো বকুনিই খাবেন, তাও বসবেন। আর, একজন সৎ ভাল প্রকাশককে খুঁজে বের করবেন, পিসিমার আত্মজীবনী ছেপে বইয়ের আকারে বের করার জন্য। তিনি এসব ব্যাপারে কিছুই জানেন না, আর হিসেবপত্তরের ব্যাপারেও খুব বেশ চোখকান খোলা রেখে চলতে পারেন না। বই ছাপাতে তাঁর বিজু অহেতুক এককাঁড়ি টাকা খরচা করছে শুনলে পিসিমা বই ছাপাতে দেবেনই না! কিন্তু এমন লেখাকে কি বেশিদিন চোখের আড়ালে রাখা উচিত? অতীতে রেখে আসা সময়ের গল্প, এ যে সোনার খনি!

পিসিমার বইয়ের কথা ভাবতেই মনে পড়ে, স্বপ্নটায় ‘স্বপ্নপঞ্জী’র কথাও ছিল যে! লজ্জার মাথা খেয়ে নিজের বই করার কথাটাও প্রকাশককে বলবেন কি? আহা, স্বপ্নে পাবলিশারের নামটা অন্তত যদি দেখা যেতো! ট্রাঙ্কের পাহাড়ে বসে বসে বেশ আমেজ এসেছিল এসব ভাবতে ভাবতে, চমকে উঠলেন পিসিমার গলার আওয়াজে। নিচের উঠোনে দাঁড়িয়ে হাঁক পাড়ছেন,

“ও বিজু, এখন ঘুম ভাঙবে? নাকি একেবারে দুপুরে উঠে ভাতের পাতেই বসবি? থাক, লুচিটুচি আর তোমার খেয়ে কাজ নেই!”

“আ… আসছি পিসিমা!”

 

টানাটানি করে কোনোমতে ট্রাঙ্কগুলো সাজিয়ে রাখতে লাগলেন বিজয়কেতন। যেতে দেরি দেখে পিসিমা ওপরে এসে যদি দেখেন তাঁর লুকিয়ে রাখা খাতা ভাইপো পড়ছে বসে বসে, তক্ষুনি বোধহয় বিজয়কে কান ধরে ওঠবোস করাবেন। দৃশ্যটা কল্পনা করে ভয়ে ঘেমে যেতে যেতেও বিজয়কেতনের মুখে স্বস্তির হাসি ফুটে ওঠে। পিসিমা নিজেই যখন এতকাল ধরে লিখছেন, তখন নিশ্চয়ই আর ভাইপোর স্বপ্ন জমানোর শখের কথা জেনে কুরুক্ষেত্র করবেন না! যাক, যা হয় সব ভালোর জন্যই হয়।