ডেড কল ● উইলিয়াম এফ. নোলান ● অনুবাদ: তানভীর মৌসুম


 

 

লেনের মৃত্যুর একমাস পর ফোনটা বেজে উঠল।

মাঝরাত। প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছে। কল রিসিভ করার জন্য ঘুম থেকে উঠতে হল। হেলেন এই সপ্তাহে বাড়িতে নেই। আমি বাড়িতে একা।

‘হ্যালো।’

‘হ্যালো, ফ্র্যাঙ্ক।’

‘কে?’

‘আরে তুমি আমাকে চেনো। আমি লেন। তোমার বন্ধু লেন স্টাইলস।’

শীতল একটা কণ্ঠ। একই সঙ্গে ভরাট এবং গভীর। ফোনের রিসিভারটা কেন যেন অনেক ঠান্ডা মনে হল।

‘লেনার্ড স্টাইলস চার সপ্তাহ আগে মারা গেছে।’

‘সামান্য একটু ভুল করেছ। চার সপ্তাহ, তিন দিন, দুই ঘণ্টা, সাতাশ মিনিট আগে।’

‘আসলে তুমি কে বলো তো?’

শুকনো হাসির মৃদু আওয়াজ শোনা গেল। লেনের সেই নিজস্ব খটখটে শুকনো হাসি! এই হাসির আওয়াজ আগেও অনেকবার শুনেছি।

‘আরে, ভাই! তুমি আমার সবচেয়ে পুরোনো বন্ধু। বিশটা বছর একসঙ্গে কাটালাম! তুমি খুব ভাল করেই জানো আমি কে।’

‘খুবই ফালতু রসিকতা! এসব করে লাভ কী?’

‘কোনো রসিকতা না, ফ্র্যাঙ্ক। তুমি ওখানে, এখনও বেঁচে আছ। আর আমি এখানে, মরে গেছি। কিন্তু দোস্ত, সত্যি বলতে কাজটা করে খুব ভাল লাগছে।’

‘কী... কাজ?’

‘এই যে, আত্মহত্যা করলাম। কারণ... মৃত্যুকে যেমনটা ভেবেছিলাম ঠিক তেমনই। অসম্ভব সুন্দর... ধূসর... কোনো কোলাহল নেই, ঝামেলা নেই... কোনো চাপ নেই।’

‘লেন স্টাইলসের মৃত্যুটা দুর্ঘটনা ছিল। রাস্তার অবস্থাও ছিল খারাপ। ওর গাড়ি...’

‘আমি ইচ্ছে করে লোহার ব্যারিয়ারে গাড়িটা ঠেলে দিই।’ ফোনের অপর প্রান্তে থাকা কণ্ঠটা বলল। ‘পা দিয়ে জোরে পেডাল চেপে ধরি। ব্যারিয়ারের সঙ্গে ধাক্কা লাগার সময় গাড়ির স্পিড ছিল নব্বইয়ের উপরে... ওটা দুর্ঘটনা ছিল না, ফ্র্যাঙ্ক।’ কণ্ঠটা আগের মতই শীতল। কোনো উষ্ণতা নেই। ‘আমি সত্যিই মরতে চেয়েছিলাম। এখন কোনো আফসোস নেই।’

হাসার চেষ্টা করলাম, যাতে গুমোট পরিবেশটা হালকা হয়ে যায়। ফোনের অপর প্রান্তে যেমন হাসির আওয়াজ পেয়েছিলাম। মৃদু, শুকনো হাসি। ‘মরা মানুষ টেলিফোনে কথা বলে না।’

‘আমি আসলে ফোন ব্যবহার করছি না। তোমরা যে ফোনে কথা বলো সেই ফোনের তো দরকার নেই। কিন্তু তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলাটাই সবদিক দিয়ে ভাল মনে হয়েছে। বলতে পারো কথা বলার জন্য “আধ্যাত্মিক বিদ্যুৎ প্রবাহ” ব্যবহার করছি। আমি এক বিচ্ছিন্ন আত্মা। নিজের মহাজাগতিক তরঙ্গ একসঙ্গে করে এই টেলিফোন লাইনের তরঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছি। একদম সহজ কাজ।’

‘সেটাই। মরা মানুষ জ্যান্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলবে। এ আর এমন কী।’

‘আমার কথা বিশ্বাস করছ না। জানতাম এমনটাই হবে। এ কারণেই এখন কিছু কথা বলব। ভাল করে শোনো।’

এরপর আমি সেই শীতল কণ্ঠের সব কথা শুনতে লাগলাম। ঠান্ডা যেন আরও বেড়ে গেল। রিসিভারটা চেপে ধরলাম আরও জোরে। শীতল সেই কণ্ঠ বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে। এমন সব কথা যেগুলো লেন ছাড়া আর কেউ জানত না! দুই দশকের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা। যা লেন আর আমি একসঙ্গে ভাগাভাগি করেছিলাম। একসময় ওর কথা বলা শেষ হল। আমি তখন একটা ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত। ফোনের ওপ্রান্তে যে কথা বলছে সে সত্যিই লেন স্টাইলস!

‘কিন্তু... কীভাবে... আমি এখনও...’

‘মনে করো এই টেলিফোন একটা মিডিয়াম। এই ফোনের লাইনে এমন শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে যা দিয়ে দু’জনের মাঝখানের ফাঁকটুকু পূরণ করতে পেরেছি।’ আবার সেই শুকনো হাসি। ‘টেবিলের দুই পাশে দুই বন্ধু।’

এতক্ষণ ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আসলে ফোনের অপর প্রান্তের কথা শুনে নড়তে চড়তে ভুলে গিয়েছিলাম। এবার ডেস্কের পিছনে গিয়ে বসলাম। পুরো ব্যাপারটা হজম করার চেষ্টা করছি। পাকানো দড়ির মত টানটান হয়ে গেছে দেহের সব পেশি। কালো রিসিভারটা সাঁড়াশির মত চেপে ধরেছি। সময় নিয়ে একটা লম্বা দম নিলাম। শীতের রাতের স্যাঁতস্যাঁতে ভাব আমাকেও স্পর্শ করেছে।

‘ঠিক আছে। ভূতে বিশ্বাস করি না। তোমার জটিল কথাগুলোও মাথার উপর দিয়ে গেল। কিন্তু তুমিই লেন। না মেনে উপায় নেই।’

‘শুনে খুব ভাল লাগল, ফ্র্যাঙ্ক। কারণ আমাদের কথা বলাটা খুবই জরুরী।’ একটু যেন ইতস্তত করল অপর প্রান্তে থাকা লেন। খানিক পর আবার শুনতে পেলাম সেই কণ্ঠ। গলার স্বর নিচু করে ফেলেছে ও। একটুখানি কোমলতা যেন ভর করেছে সেই কণ্ঠস্বরে। ‘দিনকাল খুব খারাপ যাচ্ছে। সবই জানি, দোস্ত।’

‘মানে?’

‘মানে তোমার দিনকাল এখন কেমন যাচ্ছে তার পুরোটাই আমার জানা। তোমাকে সাহায্য করতে চাই। বন্ধু হিসেবে একটা কথাই বলব, আমি সব বুঝি।’

‘আসলে... না... বলতে গেলে...’

‘তোমার মনের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। তাই না?’

‘মন তো একটু আধটু খারাপ থাকেই।’

‘সেজন্য তোমাকে দোষ দিই না। মন খারাপের সঙ্গত কারণ আছে। একটা কারণ না। তার থেকে অনেক বেশি। এই যে তুমি টাকা পয়সার কঠিন সমস্যায় আছ।’

‘ওটা ব্যাপার না। কয়েকদিন পর বেতন বাড়বে আশা করি। শেনডর্ফ তো কথা দিয়েছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বেতন বাড়াবে।’

‘তোমার এই বেতন আর বাড়বে না, ফ্র্যাঙ্ক। আমি জানি। শেনডর্ফ মিথ্যা বলছে। এই এখন, ঠিক এই মুহূর্তে, ও কোম্পানির জন্য নতুন লোক খুঁজছে। যে তোমার জায়গা দখল করবে। তোমাকে বরখাস্ত করবে ওই হতচ্ছাড়া শেনডর্ফ।’

‘আমাকে কেন যেন দেখতেই পারে না ও... অফিসে প্রথম যেদিন পা রাখলাম সেদিন থেকেই ওর সঙ্গে কোনো বনিবনা নেই।’

‘আর তোমার বউ... ওর সঙ্গে এখন তো শুধু কথা কাটাকাটিই হয়। শেনডর্ফের মত বউয়ের সঙ্গেও তোমার কোনো বনিবনা নেই। এগুলো স্রেফ প্যাটার্ন, ফ্র্যাঙ্ক। তোমার দাম্পত্য জীবন শেষ হয়ে গেছে। হেলেন কয়েকদিন পর তোমাকে ডিভোর্স দেবে। আরেকজনের সঙ্গে ওর অনেকদিনের সম্পর্ক।’

‘যাহ, শালা! কে ও? হারামজাদার নাম কী?’

‘তুমি চেনো না ওকে। চিনলেও কোনো কিছু বদলাত না। তোমার করার কিছু নেই। হেলেন তোমাকে আর ভালোবাসে না। কিছুই অবশিষ্ট নেই তোমাদের সম্পর্কে। মন খারাপ কোরো না। লোকজনের সঙ্গে এমন হয়।’

‘আমরা... গত বছর থেকে দূরে সরতে থাকি। জানি না কেন এমন হল। ভাবতেও পারিনি ও...’

‘তারপর জ্যানের কথাই ধরো। ও আবার শুরু করেছে, ফ্র্যাঙ্ক। অবস্থা এখন আগের চেয়েও খারাপ। অনেক খারাপ।’

লেন কীসের ব্যাপারে বলছে বুঝতে পারছি। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ নেই আমার। সারা গা কাঁপছে।’

জ্যান আমার বড় মেয়ে। এ বছর উনিশে পা দিল। গত তিন বছর ধরে মাদকাসক্ত ও। কিন্তু কথা দিয়েছিল আর নেশাটেশা করবে না।

‘জ্যানের ব্যাপারে আর কী জানো? বলো? বলো!’

‘আগের চেয়ে অনেক ভয়ংকর নেশায় জড়িয়ে গেছে ও, ফ্র্যাঙ্ক। খুবই বাজে অবস্থা। আর কখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে না ও।’

‘মানে? এসব কী বলছ!’

‘বলছি ওর জীবন শেষ হয়ে গেছে। তোমার ভূমিকা আরও জটিল করে তুলেছে পরিস্থিতি। ও তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আর কখনও ওর কাছে যেতে পারবে না। জ্যান ওর বাবাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে... সবকিছুর জন্য নিজের বাবাকে দায়ী করে ও।’

‘বললেই হল? ও আবোলতাবোল বলবে আর আমি মেনে নেব? ওর জন্য আমার পক্ষে যা যা করা সম্ভব সব করেছি।’

‘কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিল না, ফ্র্যাঙ্ক। সেটা তুমিও জানো, আমিও জানি। আর কখনও জ্যানের সঙ্গে দেখা হবে না তোমার।’

নিঃসঙ্গতা, বিষণ্ণতা হঠাৎ আমার উপর এসে ভর করল। সবকিছু অর্থহীন মনে হচ্ছে। বিকল হয়ে যেতে চাইছে দেহের সব কলকব্জা। ঠিকমত শ্বাস নিতে পারছি না।

‘আমার কথাগুলো একটু মন দিয়ে শোনো, দোস্ত। অবস্থা দিনদিন এর চেয়ে আরও বেশি খারাপ হবে। সামনের দিনগুলোয় ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমি সব জানি। জেনেশুনেই বলছি কথাগুলো। যখন বেঁচে ছিলাম তখন আমিও তোমার মতো নরকের মধ্যে দিয়ে গেছি।’

‘আমি... আবার নতুন করে... সব শুরু করব। ছেড়ে দেব এই শহর। নিউ ইয়র্কে গিয়ে আমার ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করব।’

‘সেই ভাই তার জীবনে মোটেও তোমাকে চায় না। সেখানে তুমি সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত। ভাইয়ের কাছে গেলে এলিয়েনের মত অবস্থা হবে তোমার। সে কিন্তু কখনওই তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে না। ঠিক বলেছি?’

‘করে না ঠিকই যোগাযোগ... কিন্তু তার মানে তো এই না...’

‘গত ক্রিসমাসে একটা কার্ডও পাঠায়নি। কখনও চিঠি লেখেনি। আজ পর্যন্ত একটা কলও দেয়নি। নিজের জীবনে ও তোমাকে দেখতে চায় না, ফ্র্যাঙ্ক। বিশ্বাস করো।’

আর তারপর আরও অনেক কিছু বলতে লাগল ও... বলল মাঝবয়সের কথা... এ সময়ে চাইলেও নতুন করে সব শুরু করা যায় না... বলল রোগ-শোকের কথা। হতাশা... একাকীত্ব... প্রত্যাখ্যান... কিছুই বাদ দিল না লেন। আমার ভিতরে থাকা অন্ধকার তখন জমাট বাঁধতে শুরু করেছে।

‘এই সব কিছুর শুধু একটা সমাধান আছে, ফ্র্যাঙ্ক। শুধু একটা। তবে সমাধানটা খুবই বাস্তবসম্মত। তোমার ডেস্কের ভিতর একটা পিস্তল আছে। ওটাকে কাজে লাগাও, ফ্র্যাঙ্ক! পিস্তলটা কাজে লাগাও!’

‘আমি... আমি পারব না।’

‘কিন্তু কেন পারবে না? আর কোন পথটা খোলা সামনে? সব সমস্যার সমাধান তোমার ডেস্কের ভিতর। ডেস্কের ভিতর থেকে পিস্তলটা বের করো। আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্য। আমাদের এখানে একা থাকার কোনো সুযোগ নেই। আগের সেই পুরানো দিনগুলোর মত হয়ে যাবে সব... দুই বন্ধু একসঙ্গে থাকব। মৃত্যু অসম্ভব সুন্দর একটা ব্যাপার, ফ্র্যাঙ্ক। মানুষের জীবন যে কত জঘন্য তা আমার জানা হয়ে গেছে। মৃত্যুর মত এত সুন্দর স্নিগ্ধতা ছেড়ে মানুষ বেঁচে থাকতে চায় কেন তাই বুঝি না। পিস্তলটা নাও, ফ্র্যাঙ্ক। ডেস্কের ভিতর পিস্তল। পিস্তল মানেই সমাধান। পিস্তল! ওটাকে কাজে লাগাও, ফ্র্যাঙ্ক। পৃথিবীতে এই একটা জিনিসই তোমাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে।’

***

আমার মৃত্যুর পর চার মাস পেরিয়ে গেছে। লেনের কথাই ঠিক। এখানে শুধু শান্তি আর শান্তি। সবই সুন্দর এখানে। কোনো চাপ নেই, দুশ্চিন্তা নেই। ধূসর, স্নিগ্ধ, নির্জন, চমৎকার।

জানি আপনি খুব অশান্তির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। মজার ব্যাপার হল এই অশান্তি কখনওই কমবে না। অবস্থা দিনদিন আরও খারাপ হবে।

আপনার ফোন বাজছে না?

জলদি কলটা রিসিভ করুন!

আমাদের কথা বলা দরকার!