সাবান ● বুম বোস


 

 

(১)

‘দাদা...ও দাদা শুনছেন! চৌরাস্তা এসে গেছে, নামুন।’ ড্রাইভারের ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল আমার। চশমাটা খুলে চোখ দুটো বার কয়েক কচলে নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। ড্রাইভারকে ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে ফুটপাতে নেমে হাঁটতে শুরু করলাম।

অফিস থেকে ফেরার পথে শাটলে ঘুমিয়ে পড়াটা ইদানীং প্রায় নিত্য অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তারপর যদি আবার উইন্ডো সিট হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই।

অফিসে লাস্ট মোমেন্টে একটা প্রসেস মিটিং কন্ডাক্ট করেছিলেন ম্যানেজার, তাই ফিরতে অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু দেরিই হয়েছে আজ। হাঁটতে হাঁটতে পকেট থেকে ফোনটা বের করলাম। ইপ্সিতার তিনটে মিসকল। এইরে, ক্ষেপে বোম হয়ে আছে নিশ্চয়ই। ওর আবার আমার এই বাসে ট্রামে ঘুমিয়ে পড়ার ব্যাপারটা নাকি একদম পছন্দ না। তিনি নাকি কোনোদিন বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, শাটলে কোথাও ঘুমোননি, এমনকি ন্যূনতম ঝিমুনিও নাকি তাঁর আসে না। কারণ জিগ্যেস করলে বলে, রাস্তাঘাটে অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সজাগ থাকতে হয়, তাহলে নাকি বেশিরভাগ অপ্রত্যাশিত বিপদ এড়িয়ে যাওয়া যায়। পাগলিটার কথা ভেবে মনে মনে হাসলাম আমি। তারপর ব্যাগ থেকে ইয়ারফোনটা বের করে কানে গুঁজে ওকে একটা ফোন লাগালাম। বার তিনেক রিং হওয়ার পর ধরলেন তিনি।

 

‘কী ব্যাপার, আজ ও শাটলে ঘুমাচ্ছিলে তাই তো?’

‘ওই আর কি! সারাদিন পর ক্লান্তিতে চোখ লেগে যায়, কান্ট হেল্প।’

‘ওই করো। বাইদাওয়ে পরের মাসে ভাইয়ের জন্মদিন, তুমি তো জানোই। ওইদিন একটা ছোট্ট অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি আমরা। তোমাকেও আসতে হবে। বাবা তোমায় দেখতে চেয়েছেন।’

‘এই রে!’

‘কী হল?’

‘না ভাবছি যদি কিছু গোলমাল করে ফেলি! তোমার বাবা যদি আমায় বাতিলের খাতায় পাঠিয়ে দেন, তখন কী হবে?’

‘তাহলে আর কি, তোমায় ছেড়ে অন্য কারোর গলায় ঝুলে পড়বো।’

‘তবে রে.....!!’ বলেই হেসে উঠলাম দুজনে।

 

আরো কয়েক মিনিট এটাসেটা কথা বলার পর আমাদের ফোনালাপ কিংবা বলা যায় ফোনের মাধ্যমে প্রেমালাপের ইতি ঘটলো। ফোনটা আবার পকেটে চালান করে হাসিহাসি মুখে সামনে তাকাতেই চমকে পিছনে সরে এলাম খানিকটা। একটা অস্বাভাবিক রকমের বেঁটে বুড়ি কেমন যেন খিলখিল করে হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে। পরনে সাদা থান, মাথার চুল সব পাকা। কুঁচকানো গায়ের চামড়া তারস্বরে জানান দিচ্ছে তার বার্ধক্যের কাহিনী। ব্যাপারটা শুনে সাধারণ মনে হলেও, ঘটনার আকস্মিকতায় আমার কিন্তু কয়েক মুহূর্তের জন্য আত্মারাম খাঁচা হয়ে গেছিল। যাইহোক, নিজেকে সামলে নিয়ে আমি বললাম, ‘কী হল দিদা, রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে আছ কেন অমন করে?’

বুড়ি ফোঁকলা দাঁতে হেসে খুব ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘এই সাবান বিক্রি করছি বাবা। সেই বিকেল থেকে বিক্রি করছি, কেউ কিনছে না। তুমি একটা নিলে রাতে একটু চা-পাউরুটি জুটে যায়!’

বুড়ির হাতে সাবানের প্যাকেটটা দেখলাম আমি। সাদা কাগজের মত প্যাকেটে মোড়া কোনো এক লোকাল কোম্পানির মাল। কে নেবে এসব ফালতু জিনিস। এ সাবান মাখলে চর্মরোগ এক্কেবারে বাঁধা। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। ‘লাগবে না।’ বলে পাস কাটিয়ে বেরিয়ে এলাম আমি। কিছুদূর যেতেই মনটা কেমন যেন খচখচ করতে শুরু করল। কত জোয়ান লোকজন খেটে না খেয়ে ভিক্ষে করে বেড়ায়, কিন্তু এই বুড়ি এত বয়সেও খেটে দু-পয়সা কামানোর চেষ্টা করছে।

একটা সাবানই তো, নাহয় মাখব না, ফেলে দেব। তবে একটা কিনলে তো আর মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।

ফিরে গেলাম আবার। বুড়ি তখনও সেখানেই দাঁড়িয়ে। আমি পেছন দিয়ে ডাকলাম, ‘ও দিদা, দাও একখান সাবান।’ বুড়ি পেছন ঘুরে তাকাল আমার দিকে। সেই আগের মতই খিলখিল করে হাসছে সে। আমার ডাকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এল আমার দিকে। তারপর একটা সাবান এগিয়ে দিল আমায়।। আমি সেটা হাতে নিয়ে বললাম, ’কত দাম এটা?’

‘দশটাকা বাবা।’

‘দশটাকায় রাতের খাওয়া হবে তোমার? এককাজ করো তুমি বরং দুটো দিয়ে দাও আমায়।’ কথাটা বলতেই আমার ভেতরের দয়ার সাগরে দু-চারটে ঢেউ খেলে গেল।

বুড়ি আমার কথা শুনে কেমন যেন খিঁচিয়ে উঠল। বলল, ‘নাহ, একজনকে একটার বেশি বেচার হুকুম নেই।’

‘কার হুকুম নেই?’ আমি জিগ্যেস করলাম।

‘যার কাছ থেকে এগুলো বেচার বরাত পেয়েছি, তার।’ বলেই বুড়ি আবার ফোকলা দাঁতে হেসে উঠল।

ঘড়িতে সময় দেখলাম, রাত সাড়ে নটা। আমি আর কথা না বাড়িয়ে দশটাকা বুড়ির হাতে দিয়ে সাবানটা ব্যাগে পুরে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।

 

(২)

সেদিনের পর সাবানটার কথা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। আজ অফিস থেকে ফিরে স্নান করতে গিয়ে দেখি সাবান শেষ। মায়ের কাছে আরেকটা সাবান চাইতেই মা বলল সাবান নাকি সব ফুরিয়ে গেছে। আমার মেজাজটা চটকে গেল।

‘এই কথাগুলো তো আগে বলবে নাকি! একটা তো ফোন করতে পারো!’ গজগজ করতে করতে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করতেই হঠাৎ আমার সেই বুড়ির থেকে কেনা সাবানটার কথা মনে পড়লো। আমি টাওয়ালটা গায়ে জড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরলাম। তারপর অফিস ব্যাগ হাতড়ে বের করলাম সাবানটা। সেদিন অন্ধকারে প্যাকেটটা সাদা মনে হলেও, আসলে সেটা হালকা গোলাপি। প্যাকেটের ওপর ছোট ছোট ডেইজি ফুল আঁকা। আমি সাবানটা হাতে নিয়ে আবার বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। প্রথমে একটু ইতস্তত লাগছিল, এটা মাখলে যদি কোনো সাইড এফেক্ট হয়! কিন্তু প্যাকেটটা খুলতেই একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ নাকে এল। গন্ধটা এতটাই সুন্দর যে মনের সমস্ত নেগেটিভিটি এক লহমায় ভ্যানিশ হয়ে গেল। আমি আর কিছু না ভেবে সাবানটা মাখতে শুরু করলাম। লোকাল হলেও সাবানটা বেশ মোলায়েম, তাই সেটা ব্যবহার করতে কোনো অসুবিধেই হল না। মনের সুখে স্নান সেরে বিছানায় গিয়ে বসলাম আমি।

নেটফ্লিক্সে একটা দারুণ ওয়েবসিরিজ চালিয়ে দেখতে শুরু করলাম। এপিসোডগুলো এতটাই ইন্টারেস্টিং যে দেখতে দেখতে সময়ের আর কোনো ধ্যানজ্ঞান থাকলো না আমার। বেশ কয়েকটি এপিসোড দেখার পর হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে দশটা বাজে। সাধারণত রোজ দশটা নাগাদ মা খেতে ডাকে, কিন্তু কই আজ তো ডাকল না। আমি ল্যাপটপটা অফ করে বসার ঘরে গিয়ে দেখি মা টিভি দেখতে দেখতে খাচ্ছে।

‘বাহ, আজ আমায় ছাড়া খেয়ে নিলে বলো? তা তো খাবেই আমি আর কে, হুহ!’ আমি মিছিমিছি রাগ দেখালাম। মা আমায় দেখে বাঁ’হাত মাথায় তুলে বলল, ‘দেখেছিস আমার কাণ্ড! বেমালুম ভুলেই গেছিলাম। আয় আয় বস, খেতে বস।’

আমি যথারীতি একগাল হেসে খাওয়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম। মা টিভিতে স্টার জলসায় একটা সিরিয়াল দেখতে দেখতে আমার জন্য খাবার বাড়ছিল। আমি মা’কে ডেকে বললাম, ‘জানো মা, অফিস থেকে একটা দারুণ অফার পেয়েছি।’

‘কি অফার রে?’ মা আমার দিকে ভাতের থালাটা এগিয়ে দিয়ে জিগ্যেস করল।

আমি খেতে খেতে বললাম, ‘এই বছরের শেষে ইউএস ক্লায়েন্টের জন্য অনসাইট যেতে হবে। প্যাসিডিনায় থেকে ছয়মাস কাজ করতে হবে।’

‘এ তো দারুণ খবর বাবু। তোর কত দিনের ইচ্ছে ছিল বিদেশ যাবি, যাক শেষমেশ সুযোগ এল তবে!’

‘তা ঠিক, কিন্তু আমি ভাবছি যাবো না।’

‘কেন কী হল?’

‘না, তুমি এখানে থাকবে, আমি ওখানে অত দূরে। এক-দু সপ্তাহের ব্যাপার হলে এত ভাবতাম না, কিন্তু ছ’মাস...’ মা আমায় শেষ করতে না দিয়েই বলল, ‘ছমাস এমন কিচ্ছু বেশি সময় না বাবু। সেরম হলে তোর ছোটমাসিকে ডেকে নেব, কিছু দিন এসে থাকবে আমার সঙ্গে। তুই আর ভাবিস না, তোকে বললে, তুই এক্কেবারে হ্যাঁ করে দিস।’ আমি ঘাড় নাড়লাম মায়ের কথায়।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে ব্যালকনিতে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। আমাদের একটা পোষা ময়না আছে। রোজ রাতে যখন ব্যালকনিতে আসি, আমার নাম ধরে ডাকে। তবে আজ সিগারেট প্রায় শেষ হতে যায়, কিন্তু এখনও সে আমায় ডাকল না। ইপ্সিতা আমার উপর মাঝে মধ্যেই অভিমান করে, কিন্তু পাখিটা তো আজ অবধি কখনও এমন করেনি। তবে কি তার এই প্রথমবার আমার প্রতি অভিমান হল! আমি আলতো পায়ে এগিয়ে গেলাম ওর খাঁচাটার দিকে।

‘মিঠু, কি রে আমার ওপর রাগ করেছিস? নাকি তোর শরীর খারাপ? হুম? লঙ্কা খাবি, এ নে...।’ আমি একটা লাল পাকা লঙ্কা এগিয়ে দিলাম ওর ঠোঁটে। সেটা কয়েকবার ঠুকরে খেয়েই সে চিৎকার করে উঠল, ‘ত্রিতান... ত্রিতান... ওই ত্রিতান..!’

যাক মান ভাঙলো তবে। মিঠুর খাঁচায় আলতো দোলা দিয়ে আনমনেই হেসে উঠলাম আমি।

 

(৩)

ইদানীং অফিসে আমার সঙ্গে সবাই কেমন একটা অদ্ভুত ব্যবহার করছে। কোনো একটা বিশেষ কারণে আমায় সবাই একটু এড়িয়ে চলছে। এমনকি অফিসে আমার সব চেয়ে কাছের যে, সেই অমিতদা অবধি আমার সঙ্গে কেমন যেন মেপে মেপে কথা বলছে।

দিনে বেশ কয়েকবার আমি আর অমিতদা নিচে গিয়ে সিগারেট খেতাম, এখন দেখি অমিতদা অন্য ছেলেপুলেদের সঙ্গে সিগারেট খেতে যায়, আমায় আর ডাকে না।

বেশ কিছুদিন ভাবার পর আমি বুঝেছি যে, যেহেতু কোম্পানি থেকে আমায় ইউএসএ পাঠাচ্ছে তাই বাকিরা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কিন্তু এতে আমার দোষটা কোথায়! আমি পরিশ্রম করেছি, তাই তার ফল পাচ্ছি। আমি তো আর কারোর পেছনে ছুরি মারিনি, নিজের যোগ্যতায় সবটা অর্জন করেছি। তাতে যদি কারোর অসুবিধে হয় সেটা তার কনসার্ন, আমার নয়। তাই আমিও ভেবেছি যে আমিও কারোর সঙ্গে আর যেচে কথা বলবো না, যার ইচ্ছে হবে সে কথা বলবে, নয়তো বলবে না। তাতে আমার কিচ্ছু এসে যায় না।

এভাবেই বেশ চলছিল, তবে আজ অফিসে যা হল তাতে আমার বহুদিনের ইচ্ছে-স্বপ্ন সব এক ঝটকায় ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। দুপুরে লাঞ্চ সেরে এসে ডেস্কে বসে কাজ করছি, হঠাৎ রাহুল রায়চৌধুরী মানে আমাদের প্রসেস ম্যানেজার ফ্লোরে এলেন। তিনি এসে ঘোষণা করলে এ বছর ইয়ার এন্ডে কোম্পানির তরফ থেকে অন সাইট যাচ্ছে সৌমলেন্দু ঘোষ। সৌমলেন্দু আমারই কলিগ। আমাদের ডেসিগনেশন এক হলেও আমি ওর চেয়ে সিনিয়র। তাছাড়া আমার পারফর্মেন্স ওর চেয়ে অনেক ভালো। শুধু ও কেন, গোটা ফ্লোরে আমার মত এফিসিয়েন্ট এমপ্লয়ি আর কজন আছে তা সন্দেহ।

বিগত তিন মাস ধরে ক্রমাগত আমায় বলা হল যে আমিই নাকি অন সাইট যাচ্ছি এবার, আমিই নাকি সবচেয়ে যোগ্য আর আজ এই ডিসিশন! মাথাটা আমার ভীষণ গরম হয়ে গেল। আমি শিফট শেষ হওয়ার পর সোজা ম্যানেজারের কেবিনে গেলাম। গিয়ে জিগ্যেস করলাম কেন আমায় এতদিন ধরে আশা দেখিয়ে আজ এভাবে আশাহত করা হল কেন? আমার কথায় রাহুল স্যার হাঁ করে কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘আরে তৃষান তোমার নামটাই তো সাবমিট করব ভেবেছিলাম, কিন্তু কেন জানি না, সাবমিট করার সময় তোমার কথা মনেই পড়ল না। মনে হল সৌমলেন্দুই বেশি এফিসিয়েন্টলি কাজটা করতে পারবে এবার। প্লিজ ডোন্ট ফিল ব্যাড, নেক্সট ইয়ার তোমাকেই পাঠাবো।’ বলেই রাহুল স্যার আবার নিজের ল্যাপটপে ডুবে গেলেন।

হঠাৎ করে সবার এই অবহেলা আমি আর নিতে পারছিলাম না। কী করেছি আমি যে আমায় এভাবে ট্রিট করবে সবাই। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। অফিস থেকে বেরিয়ে সামনের দোকান থেকে একটা সিগারেট কিনে ধরালাম। পকেট থেকে ফোনটা বের করে ইপ্সিতাকে ফোন করলাম একটা। দুবার রিং হতেই রিসিভ করল ও।

 

‘হ্যালো ইপ্সু।’

‘কে বলছেন?’

‘কে মানে? আমি গো আমি। আমি তৃষান, আমার নাম্বারটাকি ডিলিট করে দিলে নাকি?’ মাথাটা এবার আরো গরম হয়ে গেল আমার।

‘ও তুমি। তোমার নাম্বারটা বোধহয় কোনোভাবে হাতটাত লেগে ডিলিট হয়ে গেছে। আনসেভড নাম্বার দেখেই অমন বললাম। প্লিজ সোনা রাগ কোরো না।’

‘হুম।’

‘কিছু হয়েছে তোমার? মুডটা অফ লাগছে?’

‘না তেমন কিছু না। একদিন দেখা করবে? তোমায় খুব মিস করছি।’

‘এই সপ্তাহে তো হবে না জানোই। কলেজের স্টুডেন্টদের সঙ্গে এক্সকারসানে যাচ্ছি। আমি ফিরে এসে সিওর দেখা করব। প্রমিস।’

‘আচ্ছা রাখছি।’ ফোনটা রেখে দিলাম আমি। ভীষণ একা লাগছে আজ। মনে হচ্ছে যেন কেউ নেই আমার। অনুপম রায় যেন বার বার কানের কাছে গেয়ে যাচ্ছেন, ‘একবার বল নেই, তোর কেউ নেই, কেউ নেই.......’

আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে যে, ‘নাহ, আমার সবাই আছে, মা আছে, প্রেমিকা আছে, বন্ধুরা আছে, সবাই আছে।’

 

(৪)

পরিচিতদের কাছে অবহেলাটা আজকাল বেশ অভ্যেস হয়ে গেছে। আমিও তাই নিজের মতই থাকি। দিনের বেশির ভাগ সময় অপরিচিতদের মাঝেই কাটাই। অফিস থেকে বেরিয়ে কখনও কোনো বার, কখনও সিনেমা হল, কখনও আবার কোনো শপিংমলেই কাটিয়ে দিই অবসর সময়টুকু।

এখন আবার অফিস বেরনোর আগে জগিং করা শুরু করেছি। পাড়ার মাঠে কয়েক পাক দৌড়াদৌড়ি করে, কয়েকজন বেপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলে, বাড়ি ফিরে স্নানটান সেরে অফিস যাই।

ইদানীং সকালের খাবারটা বেশিরভাগ দিনই বাইরে খেতে হয়। মা তো আমার জন্য রান্নাও করে না। বললেই বলে ভুলে গেছি। বয়স হচ্ছে তো, বোধহয় স্মৃতিভ্রম হচ্ছে।

 

আজ জগিং সেরে ফিরে বাথরুমে ঢুকলাম স্নান করতে। সাবান মাখতে গিয়ে দেখি সাবানটা প্রায় শেষ; ছোট্ট হয়ে গেছে একদম। সেটাই হাতে নিয়ে মাখতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি সাবানটা হাতের মধ্যেই গলে ভ্যানিশ হয়ে গেল। লোকাল মাল হয়েও অনেকদিন চলল।

স্নান সেরে বেরিয়ে রেডি হয়ে অফিস বেরিয়ে গেলাম।। বেরনোর আগে মাকে প্রণাম করার সময় দেখলাম মায়ের চোখদুটো কেমন যেন উদাসীন। মাথায় হাত রাখতেও ভুলে গেল আজ। আমি বেরিয়ে পড়লাম। ভাবছি অফিস থেকে কদিন ছুটি নেব। মাকে ভালো একটা ডাক্তার দেখাবো, তারপর মাকে নিয়ে কদিন কোথাও একটা ঘুরে আসবো। একটু হাওয়া বদল হলে হয়তো আবার সবটা ফ্রেশ করে শুরু করতে পারবো।

 

অফিসে আজ দিনটা ভালোই কাটলো। ফুরফুরে মেজাজে কাজ করলাম। মাঝে মধ্যে নিচে গিয়ে অন্য প্রসেসের ছেলেপুলেদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে চা সিগারেট খেলাম। তারপর অফিস শেষে শাটলে চড়ে রওনা দিলাম বাড়ির পথে।

পাড়ায় ঢুকে গোটা পাঁচেক সিন্থল সাবান কিনে ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়লাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠে বেল বাজাতেই দরজা খুলল মা। আমি ভেতরে ঢুকলাম। মা দেখি তখনও দরজা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে।

‘আরে কী দেখছো ওভাবে?’ আমি জুতো খুলতে খুলতে বললাম। মা দেখি আমার কথায় পাত্তাই দিল না। দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এদিক ওদিক দেখে আবার ভেতরে ঢুকে পড়ল।

‘কী দেখছিলে বলো তো?’ আমি জিগ্যেস করলাম আবার। কিন্তু কোথায় কী। মা আমার কথা পাত্তাই দিল না, সোজা গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখতে লাগল। আমার এবার মাথাটা গরম হয়ে গেল। সোজা গিয়ে মায়ের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার বলো তো? তখন থেকে ডাকছি সারা দিচ্ছ না।’ মা তবুও নির্বাক। আমি এবার একটু ভয় পেয়ে গেলাম। মার কী কিছু হয়ে গেল নাকি, কেমন যেন নিষ্পলক তাকিয়ে আছে, যেন আমায় দেখতেই পাচ্ছে না। আমি মাকে ধরে একবার ঝাঁকাতে গেলাম, আর তখনই আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। আমি মাকে ছুঁতেই পারলাম না। যতবার মাকে ছুঁতে চাইছি ততবার হাত দুটো মাকে ভেদ করে চলে যাচ্ছে।

মাথা বনবন করে ঘুরছে আমার। আমি কি পাগল হয়ে গেলাম, নাকি আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি! নিজের গালে উন্মাদের মত ঠাস ঠাস চড় মারলাম কয়েকটা। চেষ্টা করলাম নিজের ঘুম ভাঙাতে; কিন্তু ঘুম ভাঙবে কী করে! আমি যে জেগেই আছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি জেগেই আছি, আমি বেঁচে আছি। তাও আমায় আমার জন্মদাত্রী মা দেখতে পাচ্ছে না, আমি মাকে ছুঁতে পারছি না। কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। তড়িঘড়ি পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফোন করলাম ইপ্সিতাকে।

 

‘হ্যালো ইপ্সু?’

‘কে বলছেন?’

‘আমি, আমি তৃষান। চিনতে পারছো না আমায়?’

‘কে তৃষান। আপনি বোধহয় রং নাম্বার ডায়েল করেছেন। আপনি ঠিক কত নাম্বার চাইছেন বলুন তো?’

‘আমি ঠিক এই নাম্বারটাই চাইছি মিস ইপ্সিতা বাসু। আশুতোষ কলেজে জুলজির প্রফেসর তুমি। এক্সকারসানে গেছ, আমি জানি। তা বলে কি নিজের ভালোবাসাকে ভুলে যেতে হয়?’

‘আপনি আমার সম্পর্কে এত খবর জানলেন কি করে? স্টক করছেন আমায়?’

‘ওরে হতভাগি আমি তৃষান সেনগুপ্ত তোর প্রেমিক। আমাদের তিন বছরের সম্পর্ক। আমরা বিয়ে করব। তোর ভাইয়ের জন্মদিনে আমার তোর বাবার সঙ্গে দেখা করার কথা, তুই কি সব ভুলে গেছিস?’

জবাব এলো না ওপার থেকে। ফোন কেটে গেছে। কিংবা বলা যায় কেটে দেওয়া হয়েছে। হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল আমার। ওটা আর তুললাম না। কী হবে ওটা দিয়ে, কাকেই বা ফোন করব! পাগলের মত বিড়বিড় করতে করতেই টলমল পায়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম আমি। তারপর টলতে টলতে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।

 

ঘুম যখন ভাঙল তখন রাত সাড়ে নটা বাজে। বিছানা থেকে উঠে চারিদিকে ফোনটা খুঁজতে গিয়ে মনে পড়লো যে সেটা ডাইনিং রুমেই ফেলে এসেছি। ঘর থেকে বেরিয়েই ফোনটা পেয়ে গেলাম। দেখলাম মা টেবিলে বসে রাতের খাবার খাচ্ছে। খুব ইচ্ছে করল বলতে যে ‘মা খেতে দাও’ কিন্তু তা বলে আর লাভ নেই। যাইহোক, মনটা এখন কিঞ্চিৎ শান্ত হয়েছে। আমি রান্না ঘরে গিয়ে ফ্রিজ খুলে কয়েকটা পাউরুটি আর মিষ্টি বের করে খেলাম। তারপর ঠান্ডা মাথায় ভাবতে চেষ্টা করলাম যে এতদিন আমার সঙ্গে ঠিক কী কী ঘটেছে, এবং কেন ঘটেছে। বেশিক্ষণ ভাবতে হল না। কারণ সেই শয়তানি বুড়ি আর তার শয়তানি সাবানের কথা আমার মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ে গেল। ওই সাবানটাই যত নষ্টের গোড়া। যবে থেকে ওই সাবানটা মেখেছি তবে থেকেই আমার সঙ্গে এসব হচ্ছে। আমি এক ছুট্টে আমার ঘরে গিয়ে বাথরুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। তারপর পাগলের মত সাবানের প্যাকেটটা খুঁজতে লাগলাম। কোথাও না পেয়ে বাথরুমের ডাস্টবিন হাতরাতে শুরু করলাম। শেষমেশ প্যাকেটটা ওই ডাস্টবিনের মধ্যেই পেলাম। ওটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলাম যে কোনো ব্র‍্যান্ডের নাম বা ঠিকানা কিছু পাওয়া যায় কিনা।

কিন্তু সেগুড়ে বালি। একটা অক্ষরও লেখা নেই কোথাও। আমি এবার প্যাকেটটা মাঝখান দিয়ে ছিঁড়ে ভেতরটায় দেখলাম। র‍্যাপারের ভেতরে খুব ছোট ছোট করে কিছু একটা লেখা আছে। আমি লেখাটাকে চোখের খুব কাছে নিয়ে এসে পড়লাম।

“পরিচিতদের মাঝে পরিচিতি ফিরে পেতে, এই সাবান তেরোজন অপরিচিত ব্যক্তিকে বিক্রি করতে হবে।

তবে মনে থাকে যেন, একজনকে একটি করেই সাবান বিক্রি করা যাবে।”

লেখাটা পড়া শেষ হতেই সেটি ভোজবাজির মত মিলিয়ে গেল নিমেষে। তবে আমার সঙ্গে ইদানীং যা যা ঘটেছে তারপর আর কোনো কিছুই আমায় অবাক করে না। আমি সাবানের প্যাকেটটা পকেটে পুরে ছুট্টে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা অটোস্যান্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। অটোস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখি তখনও খান দুয়েক অটো রয়েছে স্ট্যান্ডে। আমি গিয়ে বসতেই স্টার্ট দিয়ে দিলেন অটোওয়ালা। বুঝলাম অনেকক্ষণ ধরেই প্যাসেঞ্জার নেই। পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলাম রাত দশটা বেজে কুড়ি।

অটো থেকে যখন চৌরাস্তার মোরে নামলাম তখন ঘড়িতে পাক্কা সাড়ে দশটা বাজে। আমি ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে বুড়িটা সাবান বেচছিল সেখানে পৌঁছে যথারীতি হতাশই হলাম। দোকানপাট সব বন্ধ, বুড়িরও কোনো পাত্তা নেই। বুঝলাম যে রাত হওয়ায় বুড়ি বাড়ি চলে গেছে। কাল ওকে ধরতে হবে যে করেই হোক। এত অবধি মনস্থির করে আমিও ফিরেই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা গুমটি দোকানের পায়ার কাছে একটা ব্যাগ দেখে থমকে দাঁড়ালাম আমি। কী মনে হল ব্যাগের ভেতরটা দেখলাম। আর দেখেই ঠোঁটে লম্বা হাসি খেলে গেল আমার। ব্যাগে রয়েছে এক বান্ডিল প্যাকেটে মোড়া সেই সর্বনেশে সাবান। গুনে দেখলাম তেরোটাই রয়েছে। আমি প্যাকেট ছিঁড়ে এক পিস বার করে এদিক ওদিক তাকালাম। দেখলাম সামনেই একটা মহিলা হেঁটে আসছেন। আমি ছুট্টে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। হঠাৎ আমায় সামনে দেখে কেমন যেন চমকে গেলেন মহিলা।

‘কী চাই? অমন রাস্তা আটকে দাঁড়ালেন কেন?’

আমি একগাল হেসে বললাম, ‘দিদি খুব ভালো সাবান আছে। লোকাল জিনিস কিন্তু দারুণ গন্ধ। একটা নিয়ে দেখুন না প্লিজ, খুব সুন্দর গন্ধ। একবার নিলে বারবার নিতে ইচ্ছে করবে।’