মায়াজীবী ● জাকিউল অন্তু


 

 

রাবরই একা থাকতে পছন্দ করি আমি। আমার যা কাজের ধরণ তাতে একা থাকার প্রয়োজনীয়তা আছে। এই যেমন আজকেই একা একা বসে আছি সমুদ্রের তীরে। সাধারণত পরিবার বা সঙ্গীদের নিয়েই মানুষ বেড়াতে যেতে পছন্দ করে কিন্তু একবার সোলো ট্রিপের মজা পেয়ে বসলে সে এই স্বাধীনতার স্বাদ জীবনেও ভুলবে না। একা একা ঘুরতে ঘুরতে সমস্ত জগতকে ভুলে যাওয়া। হতাশ জীবনের কঠোর দায়িত্বগুলো থেকে কিছু মুক্তি তো পাওয়াই যায়। এইজন্য টুরিস্ট আর ট্রাভেলারদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকে। একদল সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়, আরেক দলের সাধারণত কোনো গোছানো অ্যাকাউন্টই থাকে না।

 

অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হল একটু পায়চারি করা যেতে পারে। উঠে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঢেউয়ের গর্জন করে আছড়ে পড়ছে পায়ে। এদিকটায় লোকজন তেমন নেই। হাঁটতে হাঁটতেই পায়ের কাছে পড়লো জিনিসটা। একটা মাঝারী আকৃতির কাছিম। কিছুদিন আগে হলেও আমি এটকে কাছিম বলে চিনতে পারতাম না। কারণ কচ্ছপ আর কাছিমের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য আছে। কাছিম সমুদ্রে থাকে, মাঝেমধ্যে ডাঙায় আসে। কচ্ছপের জন্মই হয় ভূমিতে। কিন্তু কাছিম জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটে সমুদ্রে। শুধু ডিম দিতে এরা বীচে চলে আসে।

কাছিমটা স্বভাবসুলভ আলস্যে রোদ পোহাচ্ছে। পিঠের ওপরের খোলসে মেটে ময়লা জমে আছে। জায়গায় জায়গায় হালকা খাঁজকাটা। আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম। প্রাণীটার মুখের দিকে তাকালাম। আমার দৃষ্টির জবাবেই যেন সে তার গলাটা অতি ধীরে আমার দিকে ফেরাল। তার চোখে কেমন এক প্রশান্তি চোখে পড়লো। এখন যদি ওদের নেস্টিং সিজন চলে তাহলে এই কাছিম হয়তো ডিম দিতে এসেছে অথবা ইতিমধ্যে ডিম দিয়ে বালিতে পুঁতে রেখেছে। সম্ভবত এইজন্যেই ওর চেহারায় একটা কোমল ভাব দেখতে পেলাম। যেন মায়েদের চিরচেনা চেহারা।

মনটা হুট করেই কেমন যেন ভালো হয়ে গেলো। আমি কাছিমটার পাশেই আবার বসলাম। ওর পিঠের শক্ত খোলসে ময়লাগুলো দেখে কেমন অস্বস্তি হচ্ছিলো। মনে পড়লো মানিব্যাগে অপ্রয়োজনীয় ভিজিটিং কার্ড আছে। চাইলে পিঠটা পরিষ্কার করে দেওয়া যাবে। এই কাজ ও কতটা পছন্দ করবে জানি না। কিন্তু আমার যখন একবার মনে হয়েছে তখন আমি কাজটা করেই ছাড়ব। সেটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত হলেও আপত্তি নেই।

আমি কার্ড বের করে পিঠের চারপাশে কোণগুলোতে খাঁজের ময়লাগুলো ঘষতে শুরু করে দিলাম। তখনও কাছিমটা কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। চুপচাপ শুয়ে আছে। যাক। বিরক্ত হয়নি তাহলে। এবার পিঠের মাঝখানে পরিষ্কার করার পালা। সেখানে কেমন যেন শ্যাওলা জাতীয় কিছু জমে আছে। সেই শ্যাওলায় বীচের বালি উড়ে এসে লেগেছে। অনেকটা কাদার মতন মিশ্রণ। ততক্ষণে হাতের কাগজের কার্ড নরম হয়ে এসেছে।

এই ময়লা দূর করতে হলে আরও শক্ত কিছু চাই।

এখন হয়তো আপনারা ভাববেন যে, একটা প্রাণী যে বালিতে আপনমনে বসে ছিল তার পিঠের খোলসের ময়লা পরিষ্কার করা কী এমন ব্যপার যার জন্য এত মরিয়া হচ্ছি আমি।

সত্যি বলতে গেলে আমি হচ্ছি গিয়ে ঐ যেটাকে বলে পারফেকশনিস্ট। খুব গোছানো মানুষ না হলেও যখন যেটা করেছি সেটা নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েই করেছি। তাতে একটা সুবিধা আর একটা অসুবিধা আছে। সুবিধা হল কাজটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুব ভালো হয়। মাঝেমধ্যে মনে হয় কাজটা আরও অনেক ভালো হতে পারত, আমি বোধহয় সেই কাজের যোগ্যই নই। এমনও সময় গেছে যখন ছোটখাটো কাজ যেটার তেমন কোনো গুরুত্বই নেই সেরকম কাজ করতে গিয়ে সামান্য বিফল হওয়ায় নিজেকে খুন করে ফেলতে মন চেয়েছে।

 

ও আপনাদের তো বলাই হয়নি। আমি একজন হরর রাইটার। আমার আসল নামটা আপনাদের জানার দরকার নেই। ছদ্মনাম ‘অমানিশা!’

এই যেমন কিছুদিন আগেই আমার একটা গল্প জাতীয় দৈনিকে বের হয়েছিল। আমার প্রতিবেশী গল্পটা পড়েই ছুটে এসে আমায় বললেন আমার দ্বারা গল্প লেখা হবে না। আমি যেন আর কখনোই না লিখি। এসব ছাইপাঁশ পড়লে নাকি পাঠকদের বদহজম হবে। লেখক হয়ে পাঠকদের ওপর এই জুলুম আমার না করাই নাকি ভালো।

ব্যস, আমি কিছুদিনের জন্য হাল ছেড়ে দিলাম। রাইটার্স ব্লক পেয়ে বসল আমাকে। আর কিছুতেই মাথা থেকে কিছু বের হয় না। ঝিম ধরে বসে থাকি ল্যাপটপের সামনে। ক্লান্তিতে যখন চোখ বুজে আসে তখন দেখি একটা অডিটোরিয়ামের দর্শকের চেয়ারে আমাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। স্টেজে একজন মাত্র পারফর্মার। সে আর কেউ নয়। আমার সেই জাজমেন্টাল প্রতিবেশী। সে আমায় মনের আনন্দে অপমান করে চলেছে। সমালোচনার নামে আমায় ব্যক্তিগত আক্রমণ পর্যন্ত করছে। আমি লজ্জায় চেয়ারের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি। আশেপাশে যেন অদৃশ্য সমালোচকের দল বসে আছে। তাদের টিটকারির শব্দ কানে ভেসে আসছে। নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে অযোগ্য মানুষ বলে মনে হচ্ছে।

অথচ পাঠকদের ভোটে এটা ছিল আমার লেখা সবচাইতে ভালো গল্পের মধ্যে একটা। ইউটিউবে একটা অডিওবুক চ্যানেলে গল্পটার অডিও রুপান্তরও হয়েছিল। ভিউ বেশি হওয়ায় রয়্যালটি হিসেবে কিছু টাকাও এসেছিল পকেটে। এমনকী গল্পটার একটা ওয়েব সিরিজ হবার কথা চলছিল। কিন্তু আমি মুষড়ে পড়লাম।

আসলে এটা একটা মানসিক রোগ। সমালোচনা সহ্য না করতে পারার রোগ। আমার সাইক্রিয়াট্রিস্ট জানিয়েছিল বেড়ে ওঠার সময় নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব থেকে সাপোর্ট না পেলে বড় হয়ে মানুষের মনে একটা ক্ষোভ জন্মায়। সে ক্ষোভ কখনো রাগ কখনো হতাশায় রুপান্তরিত হয়। তখন হাজার চেষ্টা করলেও সামাজিক এই চাপ বা পারফরম্যান্স অ্যাংজাইটি থেকে বেরিয়ে আসা যায় না।

অ্যাডাপটিবিলিটি ইজ হার্ড ফর আস মোস্ট অব দ্য টাইম। যারা ভাবে জনপ্রিয়তা মানেই প্রকৃত মানসিক সুখ তারা ভুলের সাগরে সাঁতার কাটছে!

 

খুব বেশি বকে ফেলেছি বোধহয়। আবার ঘটনায় ফিরে আসি।

সী বীচে শক্ত কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। পাথরের টুকরো পাওয়া যায় অহরহ। কিন্তু কাছিমের পিঠ পরিষ্কার করার জন্য আমি গাছের শুকনো ডাল বা বাঁশের কঞ্চি খুঁজছিলাম। যেন কাছিমটা কোনোক্রমেই ব্যথা না পায়। খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেলাম জিনিসটা। একটা ছোট ডাল।

ফিরে এসে দেখি কাছিমের চোখ বন্ধ। আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। এইবার নিজেকে সত্যিই কেমন অপরাধী বলে মনে হতে লাগলো। ওকে কি আবার বিরক্ত করা ঠিক হবে। বেচারী কী ভাববে? অবলা প্রাণী বলে তো ওর সাথে যা ইচ্ছা তাই করতে পারি না। আমি সভ্য মানুষ বলে আমার কাছে ময়লাটা অস্বস্তিকর লাগছে, কিন্তু প্রাণীটা তো ওতেই অভ্যস্ত। আমার সারাক্ষণ জলে বসে থাকতে ভালো লাগবে না বলে তো আর সুযোগ পেলেই জলহস্তিকে ডাঙায় এনে বসিয়ে রাখতে পারি না।

কিন্তু নাহ! পারফেকশনিজমের ভূতটা আর মাথা থেকে গেল না। কাজেই ওর ঘুম ভাঙিয়ে হলেও পিঠের জায়গাটা পরিষ্কার করতে শুরু করলাম। এমনিতেই কাছিম খুব ধীরগতি সম্পন্ন প্রাণী। ও আবার মাথা ঘুরিয়ে পিছনে দিকে আমাকে দেখার চেষ্টা করল। সম্ভবত একটু নড়াচড়ার চেষ্টাও করল। কিন্তু আমাকে বাধা দেবার মতন ইচ্ছা বা সামর্থ্য কোনোটাই চোখে পড়লো না।

পিঠের মাঝখানের খাঁজের ময়লাগুলো পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। চারদিক থেকে বর্গাকার খাঁজগুলো এসে মিলিত হয়েছে খোলসের ঠিক মাঝখানে। আর সেখানে তৈরি হয়েছে একটা অদ্ভুত সুন্দর বৃত্ত। যেন চিরসবুজ মাঠের মাঝখানে একটা সুনীল জলাধার!

আমি যেন দৌড়চ্ছি কাছিমের পিঠের খাঁজগুলো ধরে। ওগুলো যেন গভীর নালায় পরিণত হয়ে গেছে। পেছল পথে বার বার ছিটকে পড়ে যেতে হচ্ছে। পায়ের আঙ্গুল ভূমিতে গেঁথে দিতে ইচ্ছা করছে স্বাভাবিকভাবে দৌড়ানোর জন্য। কিন্তু আমি পারছি না। কারণ পায়ের তলায় শক্ত খোলসের মেঝে। আমি কীভাবে একটা মিনিয়েচার মানবে পরিণত হয়েছি জানি না। শুধু মাথায় একটা ব্যাপার ঘুরছে। আমাকে ঐ বৃত্তের কাছে যে কোনো মূল্যে পৌঁছতে হবে। জগতের সমস্ত রহস্যের জাল যেন ভেদ করা যাবে সেই বৃত্তে পৌঁছলেই। এমনিতেই পিচ্ছিল পথ তার ওপর কাছিমটা যেন একবার নড়েচড়ে বসল। আমি শক্ত দেয়ালে ধাক্কা খেলাম আবার। মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে ডান চোখের ওপর। কিন্তু আমার ভ্রূক্ষেপ নেই!

আচমকা অলীক কল্পনার জগত থেকে বের হয়ে এলাম এক পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের ওপর একটা তীব্র আঘাতের কারণে। ভালোভাবে তাকিয়ে দেখি শান্ত, নিরীহ প্রাণীটা আমার পায়ের বুড়ো আঙ্গুল প্রাণপণে কামড়ে ধরেছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে। এই নরমশরম প্রাণীটা এরকম আচম্বিতে আক্রমণ করে বসতে পারে সেটা আমার চিন্তার বাইরে ছিল। কী অমানুষিক শক্ত চোয়াল কাছিমটার। ওর দাঁতের দুই দাঁতের সারির মাঝে পড়ে আমার বুড়ো আঙ্গুল পিষে যাচ্ছে। অবর্ণনীয় ব্যথায় আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি যেন দেখলাম কাছিমের পিঠের সেই বৃত্তাকার দাগের কাছাকাছি পৌঁছেছি আমি। সেখানটায় জল নেই, আছে অপার্থিব আলোর ফোয়ারা। এই আলোর কোনো নির্দিষ্ট রঙ আছে কিনা আমার জানা নেই। আমি এই রঙ চিনি না। ধীরে ধীরে বৃত্তটা বড় হচ্ছে। গ্রাস করে নিচ্ছে আমাকে। যেন অসীম কোন কুয়োর গহ্বরে ডুবে যাচ্ছি আমি।

আমার চারদিক শুধু কাছিমের মাথা ভেসে বেড়াচ্ছে। শুধু মাথা! বাকি শরীরের কোনো অস্তিত্ব নেই। সেই মাথা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি ওগুলো আমার রক্ত! কারণ প্রত্যেকের মুখের ভেতরেই আমার দেহের কোনো না কোন অংশ ঝুলছে! আমি হতভম্বের মতন তাকিয়ে রইলাম! পুরো কুয়ো জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একটা হুমহাম শব্দ। সেই অশ্রুত শব্দগুলো ধীরে ধীরে একটা অচেনা ভাষার বাক্যে রুপান্তরিত হল

‘ইগস ভেনোমাস স্পিটা

তামাস বারান্যিয়া

ইনকাস কাসমুথ রা লেহ

হেয়া কা মান নায়ারলাথোটেপ’

এরকম ভাষা বা শব্দ আমি জীবনে শুনিনি। যেন ভীনগ্রহবাসীর উচ্চারিত মন্ত্র এগুলো। এর মানে কী?

আমি অনন্তকাল ধরে সেই গহ্বরের দিকে ক্রমাগত পড়েই চলেছি। তলায় আছড়ে পড়লে থেঁতলে যাবে আমার দেহ!

এ কী অনাসৃষ্টি !

তীব্র ব্যথায় হ্যালুসিনেট করে মানুষ। শরীরের সাপের বিষ ঢুকলেও এমন হয়। কাছিমের শরীরে কি বিষ থাকে? এরকম কথা কি এর আগে কেউ শুনেছে?

এমন সময় কানের একটা মানুষের গলা ভেসে এলো।

“গলা কেটে ফেলেন। কাছিমের কামড় বড় শক্ত কামড়, এরা ভয় পেলে আমৃত্যু কামড়ে পড়ে থাকবে। তার চেয়ে মেরে ফেলাই ভালো।”

প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কার গলা কাটার কথা বলছে লোকটা?

আমার বিপদের সুযোগ নিতে আসেনি তো কেউ। সঙ্গে অবশ্য দামী কিছুই নেই। কিন্তু দিনেদুপুরে কে আমাকে মারতে চাইবে?

আমি ওভারডোজড নেশাগ্রস্তের মতন ছটফট করছি। আমার বুড়ো আঙ্গুলটা যেন মাখনের মতন গলে গিয়েছে। ব্যথার তীব্রতা বাড়তে থাকলে একটা সময় আর যে জায়গায় ব্যথা থাকে যে জায়গায় টের পাওয়া যায় না। ব্যথা মাথায় চড়ে বসে। তারপর সাময়িক বোধবুদ্ধি লোপ পাইয়ে দেয়। রক্তক্ষরণ বেশি হলে মুখের ভেতরেও একটা নোনতা স্বাদ পাওয়া যায়।

জ্ঞান হারানোর আগমূহুর্তে শুনলাম, “কী ভয়ানক প্রাণীরে বাবা। জবাই করার আগে ছাড়লোই না।”

জ্ঞান ফিরতেই চমকে উঠলাম। চোখের সামনে স্টেইলনেস স্টিলের ট্রে-তে হাঁ করা কাছিমের মাথাটা চোখে পড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে এখনও জীবন্ত ওটা। সময় পেলে আবার আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি আঙ্গুল সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো।

একজন অপরিচিত ব্যক্তি আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। সম্ভবত ডাক্তার। আমি মনে মনে খুঁজতে লাগলাম সেই লোকটাকে যে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।

“সাবধানে নড়বেন কিন্তু। আপনার পায়ের আঙ্গুল কোনোমতে সেলাই করে জোড়া লাগানো হয়েছে।” লোকটা চিন্তিতমুখে বলল।

“আমি কি আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবো?”

“সেটা তো বলা যাচ্ছে না। বেশ সময় লাগবে। কাছিমটা তার সর্বোচ্চ শক্তি কাজে লাগিয়েছে। ওরা রেগে গেলে বা ভয় পেলে সাধারণত এভাবে কামড়ায়। আপনি ওখানে কী করছিলেন বলুন তো?”

আমি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললাম—

“আমাকে এখানে কে নিয়ে এসেছে?”

“আমি নিজেই নিয়ে এসেছি।” চোখের চশমাটা খুলে শার্টের একটা অংশ দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন তিনি। “আপনাকে তো আনতেই হতো। আমাকে যেভাবে বলা হল তাতে আর না গিয়ে পারলাম না।”

“বলা হল মানে? কে বলল? আমার সাথে যে অমন দুর্ঘটনা ঘটবে সেটা কি কেউ আগে থেকে জানতো নাকি?” চমকে উঠে বললাম আমি।

“উঁহু, নড়তে নিষেধ করেছি আপনাকে। কয়েকটা দিন খুব কষ্ট হবে আপনার। ড্যামেজ রিকভারী করতে সময় লাগবে। নইলে পারমানেন্ট ডিসপ্লেসড। আপনার পায়ের আঙ্গুলের ডিস্টাল ফ্যালাঙস অর্থাৎ বুড়ো আঙ্গুলের মাঝের অংশ ভেঙে গেছে।

আপনার সাথে এরকম হবে এই খবরটা দিয়েছে সাবের।

সে জানত। তার সাথে যা হয়েছিল সেটা যেমন জানতো মইনুল। আর মইনুলের যা হবে সেটা জানতাম আমি। ডাক্তার বিজন পাল।”

“আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না ডক্টর। সাবের আর মইনুল কে? আমার এই অবস্থার সাথে তারা কীভাবে জড়িত?”

“রাত গভীর হলে সব এমনিতেই জানতে পারবেন। আপাতত বিশ্রাম নিন। আর তো মাত্র কটা ঘণ্টা বাকি। হাইমে যোগ দিতে হবে তো?”

বলে তিনি গম্ভীর হয়ে পাশের টেবিলে রাখা একটা এক্স-রে শীট নিয়ে লাইটের সামনে ধরলেন। পায়ের পাতার হাড় দেখতে পাচ্ছি। আমি ডাক্তারি জানি না কিন্তু এক্স-রেটা যে আমার পায়ের তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আমি মনে প্রশ্ন নিয়েই বসে রইলাম। কীসের হাইমের কথা বলছে লোকটা? আর কটা দিন মানে? আমি কি এই যাত্রায় মারা যাব? পায়ের জখম ভালোভাবে না সারলে হয়তো জায়গাটা পচে যেতে পারে। পায়ের কিছু অংশ কেটে বাদ দিতে হলেও অবাক হবার কিছু নেই। কিন্তু তাই বলে মারা যাবো? এরকম একা? একটা অচেনা হাসপাতালে অপরিচিত লোকের মাঝে!

মনের ভেতর একটা হাহাকার জন্মাল!

সারাদিন আর লোকটাকে নানা প্রশ্ন করেও কোনোরকম উত্তর পেলাম না। যেন হুট করেই বোবা হয়ে গেছেন উনি। শুধু মাঝেমধ্যে ওষুধপত্র নিয়ে ইশারায় আমায় খেতে বলেন। একবার সিরিঞ্জ নিয়ে এসে কী যেন তরল ইনজেক্ট করে দিয়ে গেলেন হাতে। সেটা সত্যিই ওষুধ কিনা তাতে আমার খটকা থেকে গেলো।

 

যথা নিয়মে রাত হল। আমি কিন্তু এতক্ষণে বিজন ডাক্তার ছাড়া আর কাউকে দেখিনি। মইনুল বা সাবের কেউ আসেনি। এমনকি কোনো নার্সকেও দেখলাম না। সরকারী বা বেসরকারী যে ধরনের ক্লিনিকই হোক একজন ওয়ার্ডবয় বা নার্স তো চোখে পড়ার কথা।

এবার আমার মন সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠতে লাগলো। বীচে আমার অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে এরা অপহরণ করেনি তো? হয়তো অর্গান পাচারকারী গ্যাং। রাতে সুযোগ বুঝে আমার হৃদপিণ্ড, কিডনি, চোখ কেটে বার করে নেবে। আমি তো আহত পা নিয়ে পালাতেও পারব না। কাজেই ওদের হাতে সারারাত সময় আছে।

রাত গভীর হতেই বিজন আমার ঘরে ঢুকল। পেছনে আরও দুটো লোক। এরাই হয়তো সাবের আর মইনুল। একজনের ডান হাত কনুই পর্যন্ত কাটা। আরেকজনের বাম গালের চোয়ালে বিশ্রী ক্ষত। অদ্ভুত ব্যপার হল তিনজনেরই খালি গা। নিম্নাংশে ধুতির মত কিছু পরনে। এদের দেখে প্রথম যে কথাটা মনে হল সেটা হল ‘ডোম!’

যারা সস্তা নেশা করে মানবদেহ কাঁটাছেঁড়া করে। সহজ কথায় পোস্ট মর্টেম।

শেষমেশ আমার ধারণাই কি সত্যি হতে চলেছে। আমাকে মারার ষড়যন্ত্রই কি চলছে ওদের মনে!

ওরা আমার দুপাশে এসে চেয়ার টেনে বসলো। তিনজনেরই দৃষ্টি আমার ওপর নিবদ্ধ। যেন পরখ করে নিতে চাইছে কিছু।

বিজন চশমাটা নাকের ডগায় ঠেলে দিয়ে বললেন—

“অনেক প্রশ্ন জমে আছে আপনার মনে জানি। আমি হাইম শুরুর আগে আপনাকে সব জানিয়ে দেবো। অতৃপ্ত আত্মা দিয়ে হাইম হয় না।”

আপনি যেমন বীচে ঘুরতে এসেছিলেন তেমনি আমিও গিয়েছিলাম সেদিন। মানবসমাজ সমুদ্রকে ইদানীং একটা ভাগাড়ে রুপান্তরিত করে ফেলছে সেটা নিশ্চয়ই আপনি জানেন? তীরে যেমন মাঝেমধ্যে কাছিম, তারামাছ, শামুক ঝিনুক এসব ভেসে আসে তেমনি প্লাস্টিকের বোতলও ভেসে আসে।

কখনো প্লাস্টিকে আটকে মরে যাওয়া ছোটখাটো প্রাণী। আমি যেদিন তীরে হাওয়া খেতে গিয়েছিলাম সেদিন কিন্তু এগুলোর কোনটাই ভেসে এল না। এলো শ্যাওলাধরা একটা চামড়ার পাত। অনেকটা শক্ত কাগজের মতন। ঢেউয়ের তোড়ে এসে বারবার আমার পায়ে ধাক্কা খাচ্ছিলো। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেটা হাতে তুলে নিলাম। তাতে নানান কারুকার্যের সঙ্গে কিছু প্রাণীর মূর্তি খোদাই করা। এই ধরণের প্রাণী পৃথিবীতে কোথাও আছে বলে তো আমার জানা নেই। সেই চামড়াটাও যেন কোনো প্রাণীর গা থেকে খুলে এসেছে।

আর তারপর থেকেই দেখলাম চামড়ার ঠিক মাঝে কয়েকটা অজানা ভাষায় লেখা বাক্য। এই ভাষা আমি চিনি না। কোনোদিন পড়িওনি। কিন্তু খানিক মনোযোগ দেবার পর যেন ভাষাটা আমার মনের ভেতরেই অর্থবহ হয়ে উঠতে লাগলো। সেখানে লেখা ছিল

“ইগস ভেনোমাস স্পিটা...” বিজনের কথা শেষ হবার আগেই আমি আপনমনে বলে চললাম—

“...তামাস বারান্যিয়া

ইনকাস কাসমুথ রা লেহ

হেয়া কা মান নায়ারালথোটেপ!”

ওরা আমার মুখ নিঃসৃত বাক্য শুনে তৃপ্তির হাসি হাসলো। দলে লোক পাওয়ার হাসি। খানিক আশান্বিত খানিক বিষণ্ণ হাসির এক অদ্ভুত মিশ্রণ চোখে পড়লো।

বিজন বললেন, “এই তো লাইনে চলে এসেছেন। আমি সেদিন এই নিরর্থক শব্দগুলোর মানে না বুঝলেও এখন বুঝি। সময় হলে আপনিও বুঝবেন।”

বলে উল্টো দিকে ঘুরে তার পিঠটা আমায় দেখালেন। পিঠে চামড়ার একটা আলাদা পরত। সেখানে তার সেই চামড়ার পাত যেন সেটে দেয়া হয়েছে।

আমি তাকিয়ে দেখেই চমকে উঠলাম। কারণ আপাত দৃষ্টিতে ওটা একটা চামড়ার পোস্টার মনে হলেও এক ঝলকে আমার মনে হল আমি যেমন অজ্ঞান হবার আগে কাছিমের পিঠের খাঁজকাটা জায়গাগুলোয় হারিয়ে যাচ্ছিলাম ঠিক তেমন একটা চৌম্বক আকর্ষণ আছে ঐ লেখাগুলোয়। আমায় যেন শুষে নিতে চাইছে লেখাগুলো।

ডাক্তার আবার কথা বললেন—

“সাবের তোমার সাথে কি ঘটেছিল বলো না।”

কেমন একটা কৌতুকের হাসি ডাক্তারের মুখে। যেন সাবেরের সঙ্গে ভালো কিছুই ঘটেছে। অথচ আমার মন বলছে কোনো অদ্ভুত ঘটনার সাক্ষী সাবের। ওর কাটা হাতের ব্যান্ডেজের জায়গাটা রক্ত জমে লাল হয়ে আছে। সাম্প্রতিক ক্ষত! কিন্তু ওর মুখে কোনো বিকৃতি নেই। কোনো আক্ষেপও চোখে পড়ছে না। অথচ আমি জ্ঞান ফেরার পর থেকেই ভাবছি আমার জীবনে স্বাভাবিক অবস্থা আর ফিরে আসবে কিনা।

সাবের বলতে শুরু করল—

“আর কি বলবো ভাই। সেদিন বীচে ঘুরতে গেছি ঠিক আপনারই মতন। একা। বিজন ডাক্তার পেয়েছিলের চামড়ার পাত আর আপনি খেলেন কাছিমের কামড়! কিন্তু আমার ঘটনা অল্প আলাদা।

সেদিন আকাশের মেঘ গর্জন করে উঠতেই কিছুক্ষণের মধ্যে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো।

বৃষ্টির দিনে একটা ব্যপার হয় জানেন? খেয়াল করলে দেখবেন বৃষ্টির সময় সমুদ্রের তীরে একটা সাময়িক বিপদ সংকেত দেখানো হয়। সবাইকে জল থেকে উঠে পড়তে বলা হয়। কারণ তখন সামুদ্রিক হিংস্র প্রানীরা তীরের দিকে চলে আসে। কথিত আছে যে তারা নাকি মানুষ পেলে টেনেও নিয়ে যায়। অথচ একবার ভাবুন বৃষ্টির সময় কী অপার্থিব সুন্দর হয়ে ওঠে সমুদ্র। আমি যেখানে বসে ছিলাম সেই জায়গাটা নির্জন। কাজেই আমায় বাধা দেবার মতন কেউ ছিল না। বুকে সাহসেরও অভাব নেই। বৃষ্টি বাড়ার সাথে সাথে ঢেউয়ের তোড় বাড়ছে দেখে উল্টো তীর থেকে একটু গভীরে যেতে মন চাইল। মনে হল যত বিশাল ঢেউ তত সুবিধা। চাইলেই ভেতরের দিকে যেতে পারব না আমি। আমাকে ঢেউয়ের ধাক্কায় তীরে ফিরতেই হবে।

আর এই ফালতু রোমাঞ্চের নেশাই আমায় পঙ্গু করে দিলো। বেশ খানিকক্ষণ বৃষ্টি থাকায় আমি তীরেই কাছের জলেও অনেকক্ষণ ভিজলাম। যখন উঠতে যাবো তখন মনে হল আমার বড় কিছু একটা ভেসে আসছে। আর পরক্ষণেই দেখলাম ধারালো দাঁতের ফলা এসে বিঁধলো আমার এই ডান হাতে। তারপর কিছু বুঝে উঠার আগেই ছিঁড়ে নিয়ে গেলো হাতটা। একটা হাঙর!

রক্তে ভেসে গেলো নোনা জল। কিন্তু কেন জানি আমি ব্যথা পাচ্ছি না। মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব হলে নাকি মানুষ সাময়িকভাবে ব্যথার অভাবে ভোগে।

আমারও হয়তো তাই হয়েছে।কিন্তু তার সাথে আমার চলৎশক্তি কমে গেছে। আমি কিছু সময় সম্ভবত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম ঐ জায়গায়। এরপর আবার হামলা হল। তবে এবার কামড় নয়। ধাক্কা!

ব্যর্থ আক্রমণ করেছে আরও একটা হাঙর। এরা অনেকদূর থেকে রক্তের গন্ধ পায়। একদম ঝাঁক বেঁধে এসেছে ওরা। আমি শরীরের সমস্ত শক্তি এক করে এগিয়ে গেলাম তীরে। তারপর ধপ করে পরে আপনার মতই অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরে আসার পর বিজন ডাক্তারের মুখটা দেখলাম।”

সাবেরের কথা শেষ হল। সচরাচর এসব ঘটনার পর দীর্ঘশ্বাসের সূত্রপাত হয়। কিন্তু সাবেরের মুখে হাসি। যেন সে মোক্ষম কিছু হাসিল করে ফেলেছে।

ডাক্তার আবার মুখ খুললেন। ভেবেছিলাম এবার হয়তো মইনুল ওর মুখের ক্ষতের কথা বলবে। কিন্তু তার বদলে ডাক্তার নিজেই বললেন—

“কথা বলতে গেলে তোমার কষ্ট হবে। তাই না মইনুল? গালের রগ যেভাবে ছিঁড়েছে, তুমি যে এই যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছো তাই তো অনেক!”

বলে মুচকি হাসলো ডাক্তার। ভরসা দেবার হাসি নয়। কেমন নির্দয় একটা হাসি।

মইনুল ভ্রূ তুলে সায় দিলো।

ডাক্তার ওর কাহিনী শুরু করল—

“মইনুল সমুদ্রে গিয়েছিল মাছ ধরতে। ও স্থানীয় মাঝি। সী বীচ দিয়ে নামার কোনো সুযোগ নেই। একটা নির্দিষ্ট ঘাট আছে মাছ ধরার জন্য। সেখান থেকে একটা নদী পেরিয়ে সমুদ্রে ঢুকতে হয়। মাছ ধরা শেষে ফিরে আসার দিন যখন ঘাটে এসে পৌঁছবে তার কিছুক্ষণ আগে ওর জালে আঁটকে থাকা কাঁকড়ার মতন কিছু একটা। ভালোভাবে দেখতে যাওয়ার সময় ঘটে কান্ডটা। ওরা সমুদ্রের যতটা গভীরে গিয়েছিল সেদিকে জালে কাঁকড়া ওঠা খুব রেয়ার। তবুও সমুদ্রে এটা হওয়াটা একেবারে অসম্ভব নয়। মইনুল মুখটা জালের দিকে এগিয়ে দিতেই প্রাণীটা ঝাপিয়ে পড়ে ওর মুখের ওপর। অ্যাসিডিক কিছু একটা মুখের ওপর ছুঁড়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে যায় সমুদ্রে।

মইনুলকে নিয়ে আসা হয় আমার এই ক্লিনিকে।”

আমি এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে ডাক্তারের কথা শুনছিলাম। আমাদের চারজনের জীবনের সঙ্গে এর কোথাও না কোথাও একটা যোগসূত্র আছে।

ডাক্তারের পাওয়া চামড়ার পিঠে সেঁটে যাওয়া সেই মন্ত্র যার উচ্চারণ আমার মুখ থেকেও হয়েছে, সাবেরের ওপর হাঙরের আক্রমণ, মইনুলের ওপর অচেনা প্রাণীর আক্রমণ আর সবশেষে আমার ওপর কাছিমের আক্রমণ সব কেমন একসূত্রে গাঁথা মনে হয়।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কী সে রহস্য যার জন্য কোনো না কোনো উপায়ে শারীরিক বিকৃতি ঘটেছে আমাদের?

ডাক্তার এবার আমার দিকে তাকালেন কিন্তু কিছু বললেন না। সাবের আর মইনুলের মাথাটাও ঘুরে গেলো আমার দিকে। ঘরের বাতি ধীরে ধীরে নিভে আসছে না আমার দৃষ্টিশক্তি কমে যাচ্ছে জানি না। তবে আমরা কেউই আর সম্ভবত ঘরটাতে নেই। মিশে যাচ্ছি বাতাসে বা অন্য কোনো জগতে। আমাদের চোখ খোলা না বন্ধ জানি না। তবে দৃষ্টিপথে কোন বাধা নেই। এ দৃশ্য দেখার জন্য চোখের কোনো দরকার নেই। আমি বিজন আর সাবেরের কন্ঠ শুনেছি। মইনুল তো মুখই খুলতে পারেনি। তবুও বুঝলাম আমরা সম্মিলিত কন্ঠে মন্ত্র পাঠ করে চলেছি। কারুর মুখ নড়ছে না ঠিকই কিন্ত মনের ভেতর থেকে একটা গুঞ্জন দেহের বাইরে ছাপিয়ে বের হচ্ছে। একে একে সেই কাছিমের পিঠের ওপরে খাঁজকাটা দাগ, পিঠের মাঝখানের সেই কূয়োর মতন গর্ত চোখে পড়লো, বিজনের পিঠে কীভাবে চামড়ায় বাঁধানো মন্ত্রটা গেঁথে গেলো তাও দেখলাম। সাবেরকে দেখলাম নৃশংস হাঙরের আক্রমণের শিকার হতে! মইনুলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া অজ্ঞাত প্রাণীটাকেও দেখলাম।

চারপাশে উচ্চারিত হচ্ছ মন্ত্র। এটাই কি বিজনের বলা সেই হাইম? কোনো মহাজাগতিক মন্ত্র! সময়ের কোন অশুভ চক্রের মধ্যে এসে পড়েছি আমরা?

“ইগস ভেনোমাস স্পিটা

তামাস বারান্যিয়া

ইনকাস কাসমুথ রা লেহ

হেয়া কা মান নায়ারলাথোটেপ!”

হ্যাঁ! আমি বুঝতে পারছি সব। আমরা কেন এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছি সব টের পাচ্ছি। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে মন্ত্রের মানে।

সাপেদের দেবতা ইগস এর বিষ ছড়িয়ে পড়বে

ধ্বংস হবে তুচ্ছ সৌরজগত

রা’ লেহ এর দুর্গ থেকে বেরিয়ে আসবে ওরা

সবশেষে জেগে উঠবে নায়ালরাথোটেপ!

নায়ালরাথোটেপ! প্রাচীন দেবতা সে। এক হাজারেরও বেশি রূপ তার। সে মানুষকে পাগল করে দিতে পারে।

আর আজ বিজন ডাক্তার হল সেই বহুরূপের একটা অংশ।

কান বলে কোনো অঙ্গের অস্তিত্ব আছে কিনা তাও জানি না। কিন্তু শোনার অনূভূতিতে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

 

নিজেদের ভুলের কারণে সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহে তাঁরা নিজেদের অচেতন করে বন্দি করে রেখেছিলেন।

কিন্তু সৌরজগত ধ্বংস হয়ে যাবে দেবতাদের শরীর নিঃসৃত বিষের প্রভাবে। ধীরে ধীরে তাঁরা সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহের বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাবেন। কিন্তু বন্দিত্বের বাজে স্বাদকে নষ্ট করে দিতে তাঁরা একের পর এক গ্রহকে নষ্ট করে দেবে। তৈরি হবে তাঁদের আলাদা সৌরজগত। তাতে থাকবে অগুনতি গ্রহ।

নায়ালরাথোটেপ তাঁর দেহের আকার পরিবর্তন করতে পারেন। বস্তুত সমুদ্রে যত দেবতা আছেন তাঁরা তন্দ্রাগ্রস্ত। তাঁদের শরীরের চামড়ায় রয়েছে অসংখ্য মন্ত্রলিখিত উল্কি। সেই উল্কিযুক্ত চামড়া যখন বহুবছর পর পর খসে পড়ে তা থেকে জন্ম নেন অসংখ্য অপদেবতা। তাঁরা বিভিন্ন বেশে ভেসে আসে তীরে।

আমার কাছে এসেছিল কাছিমের বেশে, সাবেরের কাছে হাঙর আর মইনুলের কাছে কাঁকড়ার মতন এক প্রাণীর বেশে।

চামড়ার একটা অংশ এসে লেগে গেছে ডাক্তার বিজনের গায়ে।

আর তার ভেতর থেকেই জেগে উঠেছিল দেবতা নায়ারলাথোটেপ!

ক্লিনিকের রুমে এক বাটি ছুরি কাঁচির জঞ্জালের ওপর বসে আছি আমরা। আমাদের সামনে যে বসে আছে তাকে আর বিজন ডাক্তার নামে চেনা যায় না।

তার দেহে অসংখ্য চোখের উৎপত্তি হয়েছে। শরীর থেকে হাত পা ঝুলে পড়ছে এমনভাবে যেন তার ভেতরে কোনোদিন কোনো হাড়ের অস্থিপিঞ্জর ছিল না। কালো কুচকুচে শরীরটা দেখলে মনে হয় সেগুলোর ভেতর থেকে অসংখ্য আলোর বঁড়শি এসে বিঁধে যাচ্ছে চোখের পাতায়। মাছকে যেমন হ্যাঁচকা টানে জল থেকে তীরে আনা হয় অনেকটা সেরকমভাবে পুরো শরীর আকর্ষিত হচ্ছে ওর দেহের ভেতর। কালো কুচকুচে দেহে সাদা সাদা ফুটি ফুটি দাগ। যেন কালো চামড়ায় ফাটল ধরেছে। সেই দাগগুলি কী সেটা বুঝতে পেরেই আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেলো। ওগুলো আসলে নক্ষত্র!

নায়ারলাথোটেপ ধারণ করেছে একটা গোটা সৌরজগত। সে এখন মহাকাশের রূপ নিয়েছে। কিন্তু সেই সৌরজগতের গ্রহগুলোর ভেতরেও প্রাণের বিস্তার আছে। আমাদের সৌরজগতে শুধু পৃথীবীতে মানব বসবাস করতে পারে। কিন্তু নায়ারলাথোটেপ যে জগতকে বহন করে চলেছে তাতে প্রত্যেকটা গ্রহতে মানুষের বসবাস। সবাইকে দেখতে পাচ্ছি আমি। যেন ক্ষণে ক্ষণে ডুব দিচ্ছি সেই জগতে। তারপর আবার ফিরে আসছি। বঁড়শীতে মাছ গেঁথে নেওয়ার মতন আমায় নিয়ে যেন খেলা চলছে।

তবে আমি বুঝে গেছি কী ঘটেছে। আমরা নরকের কথা শুনে এসেছি ছোটবেলা থেকেই। এই ইলিউশনের দেবতার ভেতরে যেন নরকের বাস। সেগুলোতেই মৃত পাপী আত্মারা শাস্তি পাচ্ছে।

আমার সামনে ছুরিকাঁচির জঞ্জাল।

আচ্ছা ওগুলো আমার গলায় না চালিয়ে বসে আছি কেন?

আমাকে তো ঐ নরকে যেতে হবে? আমার শাস্তির প্রয়োজন! মহাজাগতিক মুক্তির প্রয়োজন। ছুরি দিয়ে গলার ওপর একটা রক্তাক্ত হাসি এঁকে দেবার প্রয়োজন!