বুড়িগঙ্গার বুকে ● সুমন মিশ্র


 

এক

বুড়িগঙ্গার বুকে মন্থর গতিতে এগিয়ে চলেছে একটি জলযান। আলো আঁধারির মিহি আস্তরণের ঘেরাটোপে সেটি অস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। প্রথম দর্শনে কোনো বড় ব্যবসায়ীর বজরা বলে ভুল হতে পারে, কিন্তু একটু ভাল করে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে এই জলযানের পরিচয় অতটা সাধারণ নয়। এটি নবাবি ময়ূরপঙ্খী বজরা, যার উপরে পতপত করে উড়ছে বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাবের বিজয় পতাকা। বিজয় পতাকাই বটে! তবে তা কলঙ্কিত, রক্তাক্ত।

রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। নদীর দুই ধার জঙ্গলাকীর্ণ। সেখান থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসছে শৃগালের ডাক। বিচ্ছিন্ন দু-একটা গ্রাম চোখে পড়ছে কিন্তু সেগুলোকে ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে রাত্রির অবগুণ্ঠন এবং নিদ্রার মাদকতা। বজরার উপর কতিপয় মশালের আলো জ্বলছে। সাধারণত আলোর রোশনাই, সারেঙ্গির সুর, নর্তকীদের নূপুরধ্বনি আর নবাবের সহচরদের উল্লাস ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত করে ভেসে চলাই নবাবি বজরার অলিখিত নিয়ম, কিন্তু আজ এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ঘিরে রেখেছে সেটিকে। নবাবি বজরা এত নিঃশব্দে এগিয়ে চলাটা অত্যন্ত রহস্যময়। কিছু একটা যেন লোকচক্ষুর আড়ালে রাখার চেষ্টা চলছে কিন্তু কী সেটা?

ঘোর বর্ষায় নদীর বুক জলে ফুলে ফেঁপে উঠেছে। গত বেশ কিছুদিন ধরেই আকাশ ঘন মেঘে ঢেকে থাকলেও আজ সন্ধ্যের পর থেকে অদ্ভুত ভাবে তা সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত। আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ যেন আজ নবাব খাজানার কোনো রৌপ্য মুদ্রা, আর তার থেকে বিগলিত জ্যোৎস্না বুড়িগঙ্গাকে আরও মায়াময় করে তুলেছে। ছোট ছোট ঢেউ বজরার গায়ে ধাক্কা খেয়ে সৃষ্টি করছে জলতরঙ্গের সুর। যদিও সেই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করার কোনো হৃদয়বাসনা বজরার সওয়ারিদের নেই। রাজধানী থেকে ফরমান এসেছে দুই বিশেষ বন্দিকে অতি সন্তর্পণে জিঞ্জিরা প্রাসাদের কারাগার থেকে ফেরত নিয়ে আসতে হবে মনসুর গঞ্জের প্রাসাদে। তাঁদের বন্দি অবস্থা নিয়ে ক্রমশ রাজকর্মচারী ও সাধারণ প্রজাদের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধছে।

বাংলার পূর্ববর্তী নবাবের পতনের পর তাঁর পরিবারের বিশিষ্টদের সীমাহীন লাঞ্ছনা ও অত্যাচারের মধ্যে এই জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এই নবাব পরিবার বিগত কয়েক দশক বঙ্গভূমি শাসন করেছেন, তাই সাধারণ মানুষের মনে তাঁদের প্রতি একটা সমবেদনা কাজ করছে। যদিও পরাজিতের পরিণতি যুগ যুগ ধরে এমনই হয়ে এসেছে। তবু বর্তমান নবাব সৈয়দ মীর মহম্মদ জাফর আলী খাঁ বিশ্বাসঘাতকতা করে ক্ষমতা দখলের পর যে ক্রুরতা দেখিয়েছেন তা এককথায় নজিরবিহীন। বিশেষত পূর্ববর্তী বন্দি নবাবের কাটা ছেঁড়া মৃতদেহ নিয়ে ছোটে নবাব মীর সাদেক আলী খাঁর অনুগামীদের পাশবিক নগর পরিভ্রমণ দেখে প্রজারা ভয়ে, বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছে। পূর্ববর্তী নবাব যতই অদক্ষ, অদূরদর্শী হোন না কেন, যতই তাঁর বিরুদ্ধে জনসমাজে অসন্তোষ থাকুক, তবু এত করুণ পরিণতি তাঁর কখনই কাম্য ছিল না।

রাজধানীর অলিতে গলিতে এখন তো এমনও কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে যে জিঞ্জিরা প্রাসাদে পূর্ববর্তী নবাবের পরিবারকে বন্দি করে রাখার খবরটা শুধুই রটনা। তাঁদেরকে সেভাবেই হত্যা করা হয়েছে যেভাবে বর্তমান নবাব মসনদে বসার পর পূর্ববর্তী নবাবকে হত্যা করিয়েছিলেন। যদিও সেই হত্যার কাজটা নবাবের আদেশে নয়, হয়েছিল ছোটে নবাবের ষড়যন্ত্রে। তবু পুত্রের কর্মের দায় এখন পিতার উপরেই চেপেছে। নগরের রাজপথে, গোপন আলোচনায় সর্বত্র এই একই প্রসঙ্গ।

উত্তেজনার বাতাবরণ ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। বৃদ্ধ নবাব ভোগ বিলাসে ডুবে নবাবি উপভোগ করলেও এই সব গুঞ্জন তাঁর কানে পৌঁছেছে। এটুকু তিনি ভালমতোই জানেন যে সামান্যতম অসন্তোষের স্ফুলিঙ্গ কত বড় দাবানলের সৃষ্টি করতে পারে। তাই তিনি চেয়েছিলেন যত শীঘ্র সম্ভব আগের নবাব পরিবারের এই দুই বিশিষ্ট সদস্যাকে রাজধানীতে প্রমাণ হিসাবে ফেরত নিয়ে আসতে। কাজের ভার দেওয়া হয়েছিল ছোটে নবাবকে।

ছোটে নবাবের চিন্তা ভাবনা তাঁর বৃদ্ধ পিতার মতো ভোঁতা নয়। তিনি নৃশংস, নরহত্যায় তাঁর বিশেষ আগ্রহ। বন্দিকে প্রমাণ হিসাবে ফিরিয়ে এনে কী লাভ, তার চেয়ে চিরদিনের মত সরিয়ে দেওয়া হোক পৃথিবী থেকে, বিনষ্ট হোক ভবিষ্যতে প্রজা বিদ্রোহের আশঙ্কা। তাই লোক দেখানো নবাবি ফরমানের সাথে গোপনে এসেছে ছোটে নবাবের হুকুম। শেষ কর বন্দিদের। তবে প্রথাগত ভাবে নয়, তাতে নরহত্যার স্বাদ কোথায়? ছোটে নবাব চান এক বিশেষ উপায়ে বন্দিদের হত্যা করতে।

চলতে চলতে বুড়ি গঙ্গার ঠিক মাঝখানে হঠাৎ থেমে গেল সেই বজরা।

 

দুই

বজরার পাটাতনের উপর একটা কাঠের খুঁটির সাথে শক্ত করে শেকল দিয়ে বাঁধা রয়েছে এক বন্দিনী। শেকলের ভারে তাঁর নড়াচড়ার ক্ষমতাও নেই। বন্দিনী বিগত যৌবনা। এককালে তাঁর রূপের সমকক্ষ নবাবি খানদানে খুব কমই ছিল। আর হবে নাই বা কেন। নবাব মির্জা মহম্মদ আলীর কনিষ্ঠা কন্যা বলে কথা।

তবে সে সব যেন কোনো সুদূর অতীতের ধুলি ধূসরিত স্মৃতিকথা। কখনও নবাবের কন্যা, কখনও নবাবের মাতার চরিত্র পালন করা সেই নারীর সাথে জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত এই বন্দিনীর মিল পাওয়া সত্যি প্রায় অসম্ভব। তাঁর পরনে মসলিনের তৈরি বস্ত্র। যদিও তা অত্যন্ত পুরাতন ও মলিন। জায়গায় জায়গায় সেটা ছিঁড়ে গেছে। তাঁর মাথার চুল উসকো খুসকো। হাতে পায়ে নানান জায়গায় রক্ত জমাট বাঁধা কালো দাগ। কপালে ও হাতের দগদগে ক্ষত চিহ্নগুলো প্রমাণ দিচ্ছে যে বাংলায় আফশার বংশের হাত থেকে ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর এই দু-তিন বছর তাঁকে কত লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে। দীর্ঘ দিন আধপেটা খেয়ে, কারাগারের ক্ষুদ্র কক্ষের এক কোনে পড়ে থেকে তাঁর চলার ক্ষমতাই প্রায় নেই। এমনকি কারাগার থেকে বজরায় নিয়ে আসার সময় অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছিলেন বলে বন্দিনীকে দু-চার ঘা চাবুকের আঘাতও সইতে হয়েছে।

বন্দিনী পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে বসে আছেন। তাঁর মুখে চাঁদের হালকা আলো এসে পড়ছে। তিনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আকাশে নক্ষত্রদের দিকে। হয়ত সেই নক্ষত্রদের মাঝেই খুঁজতে চেষ্টা করছেন তাঁর হতভাগ্য পুত্রকে, বাংলার পূর্ববর্তী নবাব মির্জা মহম্মদকে।

সেই সময় আর এক বন্দিনীকে দুজন সৈন্য টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলো বজরার পাটাতনের উপর। তাঁর অবস্থাও প্রথম জনের মতো করুন। তবে এই বন্দিনীর বয়েস প্রথম জনের থেকেও বেশী।

শেকলের ঝনঝন শব্দ ছাপিয়ে যাচ্ছে তাঁর কর্কশ চিৎকার, “ছেড়ে দে, ছেড়ে দে আমায়। নরকের কীট সব। জানিস আমি কে? তোদের ওই বুড়ো নবাব একসময় আমার পদলেহন করত। ওই সাদা শেয়ালগুলোর সেনাপতি রবার্ট আমার অনুগ্রহ পাবে বলে হাপিত্যেস করে বসে থাকত। মরবে, মরবে, সবকটা বেইমান মরবে। এই বাংলার মসনদ আমার আব্বার ছিল। ওই মসনদে শুধু আমার অধিকার। কী ভেবেছিস মেহেরুন্নিসা বেগম না থাকলে ওই একমুঠো সৈন্য নিয়ে নবাবকে হারানো যেত? ছাড়, ছাড় বলছি আমাকে।”

বন্দিনীর কথা সৈন্যদুটোর উপর কোনো রকম প্রভাব ফেলল না। তাঁকে প্রথম বন্দিনীর পাশে একপ্রকার ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেল তারা।

প্রথম বন্দিনী এক ঝলক দেখে নিল মেহেরুন্নিসা বেগমকে। এক মুহূর্তের জন্য যেন তাঁর ভুরুতে ভাঁজ পড়ল। তারপর আবার সেই আগের মতো তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে নিয়েই মেহেরুন্নিসার চোখ পড়েছে প্রথম বন্দিনীর উপর, “কে? আমিনা? আমার ছোটি বেহেন আমিনা! কতদিন পর তোকে দেখলাম! রাজধানী থেকে যেদিন রাতের অন্ধকারে আমাদের এই নরকে পাঠানো হয়েছিল সেদিনই শেষ দেখা হয়েছিল তোর সাথে। ভাবিনি আর কোনোদিন তোকে দেখতে পাব। খোদাতাল্লার মেহেরবানি যে এই নরক যন্ত্রণার মাঝেও তোর দেখা পেলাম। ভয় নেই বেহেন, আমার মন বলছে খুব তাড়াতাড়িই এই যন্ত্রণার অবসান হবে, আর কোনো কষ্টই থাকবে না আমাদের।”

আমিনা বেগম কোনো উত্তর দিলেন না। পাথরের মূর্তির মতো বসে আছেন তিনি।

“আমিনা? দিদির সাথে কথা বলবি না বেহেন?” আবারও কোনো উত্তর নেই।

মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসছে জলের ছলছল শব্দ। কখনও কখনও কর্ণগোচর হচ্ছে রাতজাগা পাখির ডাক। এছাড়া সমগ্র চরাচর নিস্তব্ধ। কালো মেঘ ক্ষণিকের জন্য চাঁদকে ঢেকে দিল। মেহেরুন্নিসা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু বলতে পারলেন না। শুধু ঠোঁটটুকু কেঁপে উঠল।

 

তিন

হুহু করে জোলো হাওয়া বইছে। আবার কি বৃষ্টি নামবে? আমিনা বেগমের শরীর মন আজ ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। একটু বিশ্রামের ভীষণ প্রয়োজন। কিন্তু বিশ্রাম তিনি করবেন কীভাবে? মন যে অশান্ত হয়ে আছে। খোদাতাল্লার প্রতি তার মনে তীব্র অভিমান জাগছে। এত অত্যাচার, এত অসম্মান তো তিনি এতদিন মুখ বুজে মেনে নিয়েছিলেন। মেনে নিয়েছিলেন পুত্রের করুণ পরিণতি। আমৃত্যু এই যন্ত্রণাবিদ্ধ জীবনকে তিনি নিজের ভবিতব্য হিসাবেই স্বীকার করেছিলেন। তাহলে কেন আজ এতদিন পরে আবার সেই মানুষটার মুখোমুখি হতে হল যাকে তিনি এই পৃথিবীতে সবথেকে বেশি ঘেন্না করেন? আল্লা কি তার জীবনে আর একদিনের জন্যেও শান্তি লিখে রাখেননি?

বড় দিদি!! সকলের ক্ষেত্রে শব্দটা কত ভালবাসার স্মৃতি মাখা, কত আপন হয়। আমিনা বেগম শুনেছিলেন বড় দিদিরা তাঁদের ছোটবোনকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করেন, ছোট বোনের সুখের জন্য নিজেরা ত্যাগ স্বীকার করেন। হ্যাঁ, আমিনা বেগম এগুলো শুনেছেন, চোখে দেখেননি। মেহেরুন্নিসা বেগমের মত দিদি থাকলে কারও শত্রুর প্রয়োজন হয় না। সাক্ষাৎ যেন কালনাগিনী। আজ তো কারও জানতে বাকি নেই যে মেহেরুন্নিসা বেগমের জন্যই আব্বাজানের সাধের নবাবির এই চরম পরিণতি হল।

ক্ষমতার লোভে মেহেরুন্নিসা বেগম কোনোদিনই আমিনা বেগমের বড়দিদি হয়ে উঠতে পারেননি। হয়ত যেখানে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা সেখানে মানবিক সম্পর্কগুলোর এই চিরন্তন পরিণতিই ঘটে। সন্তান তার পিতার বিরুদ্ধে, ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে, দিদি তার বোনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের হিংস্র জাল বোনে। এটাই কি সমস্ত রাজশক্তির ভবিতব্য?

একটা সময় ছিল, নবাব অন্তঃপুরে খাস দাসিরা ছাড়া আর কেউ নবাব মাতা আমিনা বেগমের সেবার সুযোগ পেত না, আর সেখানে আজ ওই সামান্য সৈন্যগুলো চোর ডাকাতের মত তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। অত্যাচারের প্রতিবাদ করলে নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা তামাসা করে আর বলে নবাবি গেলেও বেগমের নবাবি চাল যায়েনি। কারাগারের অন্ধ কক্ষে প্রতিনিয়ত জনাব জৈনউদ্দীন আহম্মদের হতভাগ্য বেগমের আত্মাভিমান জর্জরিত হয়ে চলেছে এবং এই সবকিছুর জন্য দায়ী শুধুমাত্র তাঁর বড় দিদি। এইসবের পরও হয়ত নিয়তিকে স্বীকার করেই বাকি জীবনটা তিনি কাটিয়ে দিতেন, কিন্তু যখন কথায় কথায় কারারক্ষীরা তাঁর ছেলের শেষ পরিণতি, তার কাতর প্রাণভিক্ষা নিয়ে রঙ্গ তামাসা করে তখন এক মায়ের মন কিছুতেই আর ক্ষমাশীল থাকতে পারে না। তাঁর প্রাণের নির্যাসটুকু নিংড়ে শুধুমাত্র তাঁর বড়দিদির জন্য অভিশাপ নির্গত হয়।

 

মেহেরুন্নিসা বেগম ভাবলেন একবার আমিনা বেগমের কাঁধে হাত রাখবেন। আজ যে সুযোগ এসেছে তাঁর সামনে তাকে তিনি নষ্ট হতে দিতে পারেন না। যে তীব্র বিবেক দংশনে তিনি প্রতিনিয়ত মৃত্যুর কামনা করেন সেটা তাঁর ছোট বোনকে না জানিয়ে যে তাঁর মুক্তি হবে না।

কিন্তু ছোটবোনের কাঁধে হাত রাখতে গিয়ে কেঁপে উঠল তাঁর হাত। কী বলবেন? যদি শুধু পাপের জন্য ক্ষমা চান সেটা কি সত্যিই বিশ্বাসযোগ্য হবে?

 

ভাবলেও অবাক লাগে, নোয়াজিশ খাঁর বেগম তিনি, মণি মুক্তার স্তূপের উপরেই চিরকাল জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর অঢেল সম্পত্তির সামনে জগৎ শেঠও মাথা নত করত। তাঁর সামান্য অনুগ্রহ ফকিরকেও আমির বানিয়ে দিতে পারত। আর আজ...।

কারাগার কি মানুষের চিন্তার গতিপথকে রুদ্ধ করে দেয়! কেন হাজার এলোমেলো স্মৃতি মনের মাঝে জট পাকাচ্ছে! ভাল মন্দ সব একাকার হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে যাচ্ছে কত পুরোনো কথা।

ঢাকা থেকে রাজধানীতে চলে আসা হবে বলে জনাব নোয়াজিশ যখন মনস্থ করেছিলেন, তখন মেহেরুন্নিসা বেগমের ভীষণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। রাজধানীতে তো তাকে কেবল নবাবের বড় বেটি হিসাবে সবাই চেনে, কিন্তু ঢাকায় তিনিই সব। সকলের বেগম সাহেবা। জনাব তখন তাঁর মন ভোলানোর জন্য একটা হীরের হার এনে দিয়েছিলেন। তাতে লাখ টাকার মণি মুক্তো, আর মাঝে জ্বল জ্বল করছিল এক অমুল্য হীরে। সেই গয়না দেখে তিনি খুব খুশি হলেও এমন ভান করেছিলেন যে এসব দিয়ে তাকে ভোলানো যাবে না। তখন জনাব বলেছিলেন, তাহলে বলো বেগম কী দিলে তোমার মন পাব।

ভাবতে ভাবতে মেহেরুন্নিসা বেগমের ঠোঁটের কোণে দেখা দিল বিষাদ সিক্ত হাসির ছোঁয়া, চোখে মুখে সেই কোন্ অতীতের দাম্পত্য খুনসুটির আমোদ।

কী উত্তর তিনি দিয়েছিলেন তা এতদিন পরেও তাঁর পরিষ্কার মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, জনাব আপনার পুরোনো মহলে ঢাকার বেগম সাহেবা থাকবে কেন? আমার নতুন প্রাসাদ চাই। শুনে জনাব খুব হেসেছিলেন, বলেছিলেন, তাই হবে বেগম কিন্তু কেমন প্রাসাদ আপনার পছন্দ তা যদি এই বান্দাকে বলেন তাহলে বড় মেহেরবানি হয়।

মেহেরুন্নিসা বেগম শুধু বলেছিলেন, সেই মহল যেন জন্নতের মত সুন্দর হয়। জন্নত!! সত্যি জন্নতের মত সুন্দর প্রাসাদ তিনি তৈরি করালেন। বিশাল প্রবেশদ্বার অতিক্রম করে বাঁ হাতে প্রার্থনা মসজিদকে রেখে এগিয়ে গেলেই সামনে পড়ত অপরূপ এক বাগিচা। তার তিন দিক ঝিল পরিবেষ্টিত। বাগিচার শেষ প্রান্তে সেই সুরম্য প্রাসাদ। গৌড়ের ভগ্নস্তূপ থেকে বাছাই করা কারুকার্য মণ্ডিত প্রস্তর খণ্ড দিয়ে তৈরি সেটি। প্রাসাদের পিছনে সুবিস্তৃত সোপান ধাপে ধাপে নেমে গেছে ঝিলের জলে। সেখানে রাজহংসের দল জলকেলি করত। আবার সেই জলেই মুক্তোর চাষও চলত। অমন মনোরম পরিবেশ, অমন সুন্দর মহলে বিলাস বৈভবের মাঝে জীবন কাটানো এই বেগম-নোয়াজিশ আজ অন্ধকার পুতি গন্ধময় কারাকক্ষে ফকির হয়ে বেঁচে আছে এর চেয়ে বড় শাস্তি তাঁর আর কী হতে পারত?

তিনি হাত রাখলেন আমিনা বেগমের কাঁধে।

 

চার

আমিনা বেগম চমকে তাকিয়েছেন। তিনি নিজের ক্লান্ত মনোজগতে একটু শান্তি খুঁজছিলেন। এই অতর্কিত স্পর্শে তাঁর চিন্তাজাল ছিন্ন হয়েছে।

“আমায় ক্ষমা করবি না আমিনা? আর কতকাল এই বোঝা বয়ে বেড়াব। আমি কি কম শাস্তি পেয়েছি কিছু! এই বেঁচে থাকার চেয়ে মরণ যে অনেক ভাল। বোন, চুপ করে আছিস কেন? কিছু তো বল।” মেহেরুন্নিসা বেগম কাতর কন্ঠে বললেন।

আমিনা বেগমের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। “তুমি তোমার লোভের শাস্তি পেয়েছ দিদি, কিন্তু আমার এই পরিণতি কেন? কে এর জন্য দায়ী? আল্লা জানেন কোনোদিন আমি তোমার কোনো ক্ষতি চাইনি, তাহলে তুমি কেন আমার সাথে এই বেইমানি করলে!” আমিনা বেগমের কণ্ঠ ক্রমশ শীতলতর হয়ে উঠেছে।

মেহেরুন্নিসা বেগম এককালে নবাবির লোভে যা যা করেছিলেন তাতে তাঁর কোনো বিবেক দংশন ছিল না। যদি নবাবি পেয়ে যেতেন তাহলে হয়ত ভবিষ্যতেও কোনো আত্মগ্লানি তাকে স্পর্শ করত না। কিন্তু ভাগ্য বড়ই নির্দয়। এতকাল কারাগারে অন্ধকার তাঁর মধ্যে যেটুকু বিবেক যাতনার জন্ম দিয়েছিল তা একান্তই নবাব পরিবারে ঘটে যাওয়া ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য নিজের পাপবোধ থেকে। কিন্তু তিনি যে উদ্দেশ্য নিয়ে ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করেছিলেন তা এখনও তাঁর কাছে সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত। তাই আমিনা বেগমের আকস্মিক শব্দবাণ তাঁর বুকে চাবুকের মত আছড়ে পড়ল। তিনি নিজেকে সামলাতে পারলেন না।

“বেইমানি?” গর্জে উঠলেন বেগম-নোয়াজিশ। কণ্ঠে যেন সেই পুরোনো আগুন, যে আগুনের আঁচ পেত একসময় রাজধানীর সকলে, কাশিমবাজার থেকে ফোর্ট উইলিয়াম যে আগুনের আঁচ বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করত।

“বেইমানি কাকে বলছিস আমিনা? নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াইকে বেইমানি করা বলে না। বাংলার মসনদ আমার আব্বাজানের ছিল। আর তাঁর বড় বেটি হিসাবে সেই মসনদে আমার অধিকার সবচেয়ে বেশী ছিল। ভেবেছিলাম আব্বাজান জনাব নোয়াজিশের হাতে দেবেন মসনদ। তাঁর পর আমার এক্রাম বসবে নবাবের গদিতে। ক্ষমতার যে সুখ তুই চিরকাল ভোগ করলি সেটা আসলে আমার ভাগে থাকার কথা ছিল।”

আমিনা বেগম মৌনই থাকলেন, কিছু বলার ইচ্ছাও তাঁর নেই। কিন্তু মেহেরুন্নিসা বেগম বলেই চললেন, “এই সবের জন্য একমাত্র দায়ী কে জানিস? তোর মির্জা। একটা কাকতালীয় ঘটনার জন্য সারা জীবন ওই লম্পটটাকে আব্বাজান মাথায় করে রাখলেন। মির্জা জন্মানোর পর আব্বা বিহারের নায়েব নজিম হলেন, আর তাঁর ধারণা জন্মাল যে তোর মির্জা সৌভাগ্যের প্রতীক! কী ভীমরতি যে তাঁর হয়েছিল। এমনকি তোর ছেলের নামটাও রাখলেন নিজের নামে! প্রতি ক্ষেত্রে তিনি মির্জাকেই সব দিয়ে এসেছেন। সুরাসক্ত, লম্পট একটা ছেলেকে শাসন না করে শুধুই আসকারা দিয়ে গেছেন। আমার এক্রামের শাদি হল। এক মাস রাজধানী আলোর রোশনাই, সানাইয়ের সুর, আর শাহি দাওয়াতে ডুবে থাকল। হিংসায় জ্বলে তুই আর মির্জা আব্বার কান ভারী করলি। আর আব্বা কী করলেন, না তোর মির্জার শাদি আরও বড় করে করালেন। পুরো বর্ষাকাল জুড়ে দাওয়াত দিলেন প্রজাদের। আমার নতুন প্রাসাদ দেখে রাজধানীর লোকেরা ধন্য ধন্য করছে। আর তোর মির্জা কী করল? আব্বাকে বলে নিজের জন্য অমনি একটা প্রাসাদ মনসুর গঞ্জে তৈরি করাল। সত্যিটা হল তুই আর তোর মির্জা শুধু মেহেরুন্নিসা বেগমের প্রতিপত্তিকে হিংসা করেই এসেছিস। আমার সাথে প্রতিযোগিতার জন্য আব্বাকে নিজের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছিস। জানিস, রাজধানীতে যাকে আমি সবচেয়ে ঘৃণা করতাম সে হল তোর ছেলে মির্জা। উফ, ওই কুটিল মুখটা দেখলেই আমার সারা শরীর যেন জ্বলে যেত। এই সবের মাঝেও জনাব নোয়াজিশকেই নবাব বানানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু আমার নসিবটাই খারাপ। আমার এক্রাম হঠাৎ বসন্ত রোগে ভুগে চলে গেল। কলিজা ছিল ও আমাদের। জনাব শোকটা সামলাতে পারলেন না। কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নিজের মনে বিড়বিড় করতেন। এক্রামের কবরের পাশে বসে কাঁদতেন। তারপর তিনিও চলে গেলেন। শেষ নিদ্রায় শায়িত হলেন এক্রামেরই পাশে। আর সেই সুযোগ তোরা মা আর ছেলে কাজে লাগালি। আব্বাকে বশ করে ছিনিয়ে নিলি মসনদ।”

একনাগাড়ে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে থামলেন মেহেরুন্নিসা বেগম। উত্তেজনায় শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমিনা বেগম কোনো কথাই বলছেন না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন।

নিজেকে সামলে নিতে কিছু মুহূর্ত লাগল মেহেরিন্নিসা বেগমের। কিন্তু তাঁর এত কিছু বলার পরেও আমিনা বেগম চুপ করে আছেন দেখে তাঁর ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি হল। কিছু মুহূর্ত আগে তিনি ক্ষমা চাইতে যাচ্ছিলেন সেকথা এখন তিনি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছেন।

“আমিনা... আমিনা? কী হল চুপ করে আছিস কেন? অস্বীকার করতে পারিস একটা কথাও?”

“এসব তোমার কল্পনা বিলাস দিদি।” আমিনা বেগম দূরমনস্ক গলায় বললেন, “আমি যদি সত্যি তোমায় হিংসাই করতাম তাহলে যেদিন মির্জা তোমার প্রাসাদে সৈন্য পাঠাল তোমায় অবরুদ্ধ করতে সেদিন কেন তাঁকে বলেছিলাম যে তোমায় বন্দি না করে যেন সসম্মানে নবাব–অন্তঃপুরে নিয়ে আসতে। তুমি মির্জাকে মসনদ থেকে সরিয়ে দেবে বলে চক্রান্ত শুরু করেছ সে কথা জেনেও আমি তোমার ক্ষতি চাইনি দিদি। মনসুর গঞ্জে যে কদিন ছিলে একদিনও কি এমন গিয়েছিল যেদিন তুমি বন্দিনীর মত ছিলে? তুমি আসলে চিরকাল আমায় ভুলই বুঝে এসেছ দিদি। তুমি ক্ষমতার লোভে নিজের ছোট বোনকেও প্রতিযোগী বানিয়ে দিলে। তবে এখন দেখছি আমিও তোমায় ভুলই বুঝেছিলাম। মির্জা যদি সেদিন সত্যি তোমাকে বন্দি করত তাহলে আজ হয়ত আমার বেটার এই পরিণতি হত না।” আমিনা বেগমের গলায় চাপা কান্নার বোঝা।

“হ্যাঁ। সেদিন আমিনা বেগম আমায় দয়া দেখিয়েছিলেন বটে। তবে সেটাও একটা ছলনা ছিল মাত্র। আমার সব সম্পত্তি দখল করে কী ভেবেছিলিস? মেহেরুন্নিসার হাতে আর অর্থ নেই, ক্ষমতা নেই, সে আর কিবা করবে। তার চেয়ে দয়া দেখাই, লোকে বলবে আমিনা বেগমের মত মানুষ হয় না। সাপও মরল লাঠিও ভাঙল না। শত্রুর বিষদাঁত উপড়ে নিলাম অথচ নিজের দিদিকে নিঃস্ব করার চক্রান্তের কলঙ্কও গায়ে লাগল না।”

“কারাগারের অন্ধকার তোমার চিন্তাকে গ্রাস করেছে। তুমি উন্মাদ হয়ে গিয়েছ।”

“উন্মাদ? হ্যাঁ হ্যাঁ আমি উন্মাদ। যেদিন আব্বা ওই লম্পটটাকে উত্তরাধিকারী বানিয়েছিলেন, যেদিন তোর মির্জা আমার প্রাসাদ লুণ্ঠন করিয়েছিল, যেদিন আমার এক্রাম আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেই প্রতিটা মুহূর্তে আমি কখনও ক্রোধে, কখনো অপমানে, কখনো পুত্রশোকে একটু একটু করে উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম। হায় আল্লা, তুমি কী পাষাণ হয়ে গিয়েছিলে। আজ যদি আমার এক্রাম বেঁচে থাকত, তাহলে জনাব নোয়াজিশও আমার পাশে থাকতেন। ভাগ্যের পাল্লা আমার দিকেই ঝুঁকে থাকত। দেখতাম কার এত হিম্মত যে আমার সামনে মাথা উঁচু করে কথা বলে।”

“এক্রাম!! খুব ভালবাসতে না তুমি এক্রামকে? এক্রাম চলে যাওয়ায় আমি কি দুঃখ পাইনি দিদি? এক্রাম তো আমারই ছেলে ছিল। তাকে জন্ম তো আমিই দিয়েছিলাম। আমার বুক কি ফাটেনি তার মৃত মুখটা দেখে? আমি কি কাঁদিনি ওর কথা ভেবে?” আমিনা বেগমের গলা ধরে আসছে।

“খবরদার আমিনা!! এক্রাম শুধু আমার ছেলে ছিল। শুধু আমার। আমি তার মা ছিলাম। কেউ সেই জায়গা আমার থেকে কেড়ে নিতে পারবে না।”

আমিনা বেগম নিজেকে সামলে নিলেন। চোখের জল মুছে নিয়ে বললেন, “কেড়ে নিতে তো চাইছি না! তোমার মনে আমার আর আমার মির্জার জন্য শুধুই বিষ ছিল তাই না? তোমার এই ছোটি বেহেন শুধু তোমার প্রাপ্যটুকু কেড়ে নিয়েছে আজীবন তাইতো? নিজেকে নিজেই প্রশ্ন কর একবার যে এক্রামের মা কে? আব্বার অনুরোধে যে দান আমি তোমার কোলে দিয়েছিলাম, তাতে আমার স্বার্থ কী ছিল? আমি তো শুধু চেয়েছিলাম তুমিও মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব কর। আর প্রতিদানে তুমি আমায় কী দিয়েছ দিদি? তাকে তো তুমি ধরে রাখতে পারলে না, উপরন্তু মির্জাকেও...”

বলতে বলতে ভেঙ্গে পড়েছেন আমিনা বেগম।

অঝোরে কেঁদে চলেছেন তিনি। তাঁর হাহাকার মেশানো কান্না মিলিয়ে যাচ্ছে বুড়ি-গঙ্গার আকাশে বাতাসে।

 

পাঁচ

মেহেরুন্নিসা বেগম অনেকক্ষণ আর কিছু বলতে পারলেন না। ছোট বোনের বুক ফাটা কান্না তাঁর ভিতরে জমে থাকা ক্ষোভের তীব্র স্রোতকে প্রতিহত করেছে কিছু মুহূর্তের জন্যে।

পুত্র শোকের সেই দগদগে ঘায়ে আজ আবার খোঁচা লেগেছে। এই ব্যথা শুধু অপর এক পুত্রহারা মায়ের পক্ষেই হয়ত কিছুটা বোঝা সম্ভব। মেহেরুন্নিসা বেগম কি বুঝলেন সেই ব্যথা! তিনি ঘষটে ঘষটে এগিয়ে এলেন আমিনা বেগমের পাশে। আবার তাঁর হাতটা রাখলেন আমিনার কাঁধে, কণ্ঠ খানিক তরল করে বললেন, “বিশ্বাস কর আমিনা। আমি মির্জাকে মারতে চাইনি। হ্যাঁ তোর মির্জার উপর আমার একটা প্রচণ্ড আক্রোশ ছিল। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম শুধু নিজের মসনদ ফেরত পেতে। ভেবেছিলাম সিংহাসনে বসব আমি। তোর মির্জাকে তার ঔদ্ধত্যের উচিত শিক্ষা দেব। বন্দি করব তাকে। বাংলা বিহার উড়িষ্যার সর্বেসর্বা মেহেরুন্নিসা বেগমের হুকুমের গোলাম বানিয়ে রাখব। বিশ্বাস কর এমন পরিণতি যে হবে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। ওই সফেদ শেয়ালগুলো, আর ওই বুড়ো সেনাপতি, যারা তোর মির্জাকে ঘেন্না করত, ভেবেছিলাম তাদের হাত করে আমার অধিকার ফেরত পাব। মির্জা আমার সম্পত্তি লুঠের আগে যেটুকু গোপনে সরিয়েছিলাম সেটাই উজাড় করেছিলাম ওদের সাহায্য করতে। কিন্তু সেটা যে আসলে একটা ফাঁদ ছিল তা আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি। ওরা আমায় খালি ব্যবহার করেছে। মিথ্যে মসনদের স্বপ্ন দেখিয়ে কাজ হাসিল করেছে।”

আমিনা বেগমের কানে যেন এসব কথা ঢুকছেই না। কান্নায় প্রায় অবরুদ্ধ তাঁর কণ্ঠস্বর। তার মধ্যেই কোনোমতে বলে চলেছেন, “মির্জা রাজধানী থেকে রাতের অন্ধকারে পালাল। চোখে একরাশ আগুন দেখেছিলাম সেদিন। বলেছিল আম্মি আমি ফিরবই, সব কটা নেমকহারামকে শেষ করব। নবাবের আত্মাভিমানে ঘা দিয়েছিল ওই পরাজয়। ততক্ষণে সবাই এক এক করে সরে গেছে ওর পাশ থেকে। সাথে গেল শুধু লুৎফা। সাচ্চা হীরে আমাদের লুৎফা। জান দিয়ে ভালোবাসতো আমার বেটাকে। ঊন্মৎজহুরা তখন লুৎফার কোলে ঘুমিয়ে কাদা, জানেও না কী অন্ধকারে ডুবতে চলেছে তার ভবিষ্যৎ।

তারপর একদিন খবর পেলাম ধরা পড়েছে মির্জা। বুক কেঁপে উঠল আমার। কী হবে, কী করবে ওরা মির্জার সাথে? কেঁদেছিলাম সেদিন ভীষণ। আল্লার কাছে বারবার চেয়েছিলাম যেন ওরা আমার বেটাকে প্রাণে না মারে। পরের দিন তখন মধ্যাহ্ন হয়নি। মহলের বাইরে হঠাৎ একটা হইচই শুনতে পেলাম। সাথে হাতির ডাক। আমার এক দাসী এসে বলল যে একটা হাতির পীঠে একটা কাটা ছেঁড়া লাশ নিয়ে কিছু সৈন্য রাজধানীর রাস্তায় ঘুরছে। তাদের কাছে নাকি হুকুম আছে হাতিটাকে এই বেগম মহলের কাছে দাঁড় করাতে যাতে নজরবন্দি নবাব মাতা লাশটি দেখতে পায়। সৈন্যরা নাকি লাশটা মূল ফটকের সামনেই ফেলে রেখেছে।

হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। ছুঁড়ে ফেলেছিল ওরা মৃতদেহটাকে হাতির পিঠ থেকে। বুকটা কেঁপে উঠেছিল। বুঝতে পারছিলাম কী হয়েছে, তবু মনকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। টলতে টলতে বেরিয়ে এলাম অন্দরমহল থেকে। দেখি... আমার মির্জার রক্তাক্ত... বিকৃত... নিষ্প্রাণ দেহটা পড়ে আছে!

হায় আল্লা। তুমি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারলে। যে চিরকাল রাজধানীর সবচেয়ে দামী মসলিন পরে এসেছে তার ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা সুতো পর্যন্ত ছিল না। ছিল অজস্র আঘাতের দাগ। ক্ষতবিক্ষত করেছিল ওরা আমার সিরাজকে। কত কষ্ট দিয়ে হত্যা করেছিল কে জানে। সুপুরুষ মুখটাকে এতটাই বিকৃত করে দিয়েছিল যে মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। আমার সিরাজকে বুকে জড়িয়ে আর কথা বলতে পারিনি। কেঁদেছিলাম... শুধু কেঁদেছিলাম।” আবারও একরাশ কান্না ঠেলে বেরিয়ে এলো আমিনা বেগমের বুক থেকে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে নিস্তেজ হয়ে পরলেন। বোনকে জড়িয়ে আছে তার দিদি। অনুতাপ কি স্পর্শ করল বেগম-নোয়াজিশের প্রস্তর কঠিন হৃদয়! হতে পারে। তাঁর চোখ দিয়েও অঝোরে জল ঝরছে।

“আমি আর এই শোক সামলাতে পারছি না দিদি। তোমায় দেখলে বারবার আমার সিরাজের ক্ষতবিক্ষত মুখটা আমার মনে পড়ে যাচ্ছে। আল্লা যেন সদয় হন। মুর্শিদাবাদের কারাগারে আমাদের যেন এত দূরের কক্ষে রাখা হয় যে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের দেখা না হয়।” আমিনা বেগম ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন।

“মুর্শিদাবাদ? তোর কী মনে হয় বেহেন আমরা কোথায় চলেছি?”

আমিনা বেগমের চোখে ঘোলাটে বিষ্ময়।

“বেগম-আলিবর্দি, সিরাজের বেগম লুৎফা, তাঁদের কন্যা ঊন্মৎজহুরা-সহ সব বন্দি এখনও জিঞ্জিরায় রয়েছে। তাহলে হঠাৎ নবাব আলিবর্দীর দুই কন্যাকে মুর্শিদাবাদে নেওয়া হচ্ছে কেন?”

“মানে?”

“মৃত্যু আসন্ন বেহেন। আমি মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। তুই পাচ্ছিস না আমিনা? আজ এই শেষ মুহূর্তে একটাই কথা বলব। একদম দিল থেকে বলব। আমি অনুতপ্ত। বড়রা ছোটদের ভুল ক্ষমা করে আর আজ আমি, তোর দিদি, তোর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করছি। নিজের পাপের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করছি। জানি এ পাপের ক্ষমা আমার নসিবে নেই। তাও...” ঘসেটি বেগম আবার জড়িয়ে ধরেছেন আমিনাকে। আজ অনুতাপ আর হাহাকারে আলোড়িত হচ্ছে বুড়িগঙ্গার আকাশ বাতাস।

হঠাৎ কিছু পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। ক্রমশ সেগুলো স্পষ্টতর হচ্ছে। বজরার ভিতর থেকে কিছু সৈন্য পাটাতনের উপর উঠে আসল। সঙ্গে তাদের নেতা বখর খাঁ। সে যেন সাক্ষাৎ যমদূত। চোখদুটো জ্বল জ্বল করছে মৃত্যুর নেশায়।

“মহান নবাব আলিবর্দির কন্যা ঘসেটি বেগম এবং আমিনা বেগমকে বান্দা বখর খাঁ কুর্ণিশ জানায়। আপনাদের এই অবস্থা আমাকে যে কী পীড়া দেয় তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। বিশেষত নবাব সিরাজদ্দৌলার নিদারুন পরিণতির কথা মনে পরলেই নবাব মাতা আমিনা বেগমের জন্য ...” বখর খাঁ কথা শেষ করতে পারল না, আমিনা বেগম দৃঢ় স্বরে বললেন, “এই কুমিরের কান্নার কোনো প্রয়োজন নেই বখর। এত রাতে তুমি নিশ্চয়ই আমাদের জন্য দুঃখে তোমার বুক ফেটে যাওয়ার গল্প শোনাতে আসনি। আসল কথা বল।”

বখর খাঁ হেসে উঠল। কী ভীষণ সে হাসি, “বেগমের তেজ এখনও অটুট দেখছি। তবে বুদ্ধিমানরা সাধারণত বখর খাঁর সামনে চুপ করেই থাকে। অবশ্য আপনাদের বংশের সবাই একটু ভোঁতা বুদ্ধির। নবাব সিরাজও তো তাই ছিলেন ঔদ্ধত্যে টইটম্বুর, অথচ স্বল্পবুদ্ধি। অমন নবাব মরবে না তো কে মরবে? তারপর ওই যে বাঁদীটা, কী যেন নাম? হ্যাঁ, লুৎফাউন্নিসা। ভালবাসার স্ত্রী। হা হা, সেও কি কম বোকা! কোথায় ছোটে নবাবের নিকাহের প্রস্তাব মেনে নিয়ে নবাব অন্তঃপুরে মাথা গুঁজবে তা না সিরাজ, আমার সিরাজ বলে কেঁদে কেটে কারাগারে পচে মরছে...”

“ছোটে নবাব?” ঘসেটি বেগমের গলায় ক্লান্ত জিজ্ঞাসা।

“ছোটে নবাব মীর সাদেক আলী খাঁ।”

“মিরন!! ওই শেয়ালটা কবে আবার ছোটে নবাব হল।” ঘসেটি বেগমের চোখে বিদ্রুপ।

“চুপ বেয়াদপ।” বখর খাঁ গর্জে উঠেছে। সপাটে এক লাথি চালাল ঘসেটি বেগমের দিকে। ঘসেটি বেগম সেই আঘাতে কিছুটা ছিটকে গেলেন।

নিজেকে সামলে বখর খাঁ আমিনা বেগমের দিকে তাকাল। চোখে মুখে পৈশাচিক হাসি, “সে যাই হোক। এক নবাবের বেগম আরেক নবাবের অন্তঃপুরে থাকবে, কি থাকবে না, ওসব জেনে এই বান্দা কী করবে? নেহাত ওই মেয়েটার রূপ নবাবজাদার দিল জিতে নিয়েছে। ছোটে নবাব তাই সম্মতির অপেক্ষায় রয়েছেন। নয়ত কবেই তো জোর করে শাদি করে নিতেন... হা হা হা। দেখা যাক কতদিন সে নিজের জিদ ধরে রাখে।”

আমিনা বেগম কোনো উত্তর দিলেন না। এমন হাজারো অপমানজনক কথা তাঁকে গত কয়েক বছরে শুনতে হয়েছে। কী আর বলবেন এই জল্লাদটাকে! ভালবাসা কাকে বলে তা বোঝার ক্ষমতা অন্তত বখর খাঁর নেই। তবু লুৎফার সম্পর্কে এমন কুরুচিকর কথা তাঁকে খুব বিচলিত করে। তিনি জানেন লুৎফা খাঁটি সোনা। সেই কোন্ ছোট বয়েস থেকে লুৎফা বেগম মহলে কাজ করত। কী রূপ, যেন কোহিনুর হীরে। সিরাজ এমনি এমনি তো আর তাকে ভালবাসেনি।

আজও তাঁর মনে আছে সেইদিনটা। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন। হীরাঝিল মুখরিত ছিল সেই ঘোর বর্ষার নূপুর ধ্বনিতে। হঠাৎ সিরাজ এলো বেগম মহলে। গত কয়েক দিন ধরে সে ঘন ঘন যাতায়াত করছিল বেগম মহলে। এই ব্যাপারটা সিরাজের স্বভাববিরুদ্ধ। সাধারণত কালে অকালে সৌভাগ্যক্রমে তাঁর দেখা মিলত। গণ্ডগোল কিছু একটা আছে সেটা আমিনা বেগম বুঝেছিলেন কিন্তু কী সেটা, তা অনুমান করতে পারেননি। সেদিন পারলেন।

সিরাজ এসে বসল আমিনা বেগমের পায়ের কাছে। লুৎফা তখন আমিনা বেগমের সেবা করছিল। সিরাজের সাথে লুৎফার একবার দৃষ্টি বিনিময় হল। লজ্জায় লুৎফার গণ্ডদেশ রক্তিম হয়ে উঠল। সেই দৃষ্টি আমিনা বেগমের নজর এড়ায়নি। সিরাজের এই চাহনি তাঁর মায়ের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। আমোদ প্রমোদে মত্ত সুরাসক্ত ঘোলাটে দৃষ্টির পরিবর্তে সিরাজের চোখে সেদিন তিনি এক কোমল মনের প্রতিচ্ছবি দেখেছিলেন।

সিরাজ সেদিন বলেছিল, “দাদাজান আমায় সব দিয়েছেন, কিন্তু আজ আমি আমার আম্মির থেকে একটা জিনিস চাইব, কথা দাও দেবে।” কথা তিনি রেখেছিলেন, লুৎফাকে সিরাজের মনের অন্তঃমহলে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন। লুৎফাও সিরাজের সেই ভালবাসার দাম দিয়েছিল। সবসময় তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে বিপদে আপদে পাশে থেকেছে সিরাজের। পলাশীর পর বাকিদের মত ঢাকায় না পালিয়ে সিরাজের সঙ্গে অনিশ্চিতের দিকে যাত্রা করেছিল সে।

এমনকি পরে মিরন যখন নিকাহের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিল, তখন লুৎফা মুখের ওপর জানিয়েছিল যে হাতির পিঠে চড়ে চিরকাল সে অভ্যস্ত, তাই গাধার পিঠে চড়ার কোনো ইচ্ছে তার নেই। এত সাহস ওইটুকু মেয়েটা কী করে সেদিন পেয়েছিল? শুধুই অকৃত্রিম ভালবাসা? আমিনা বেগম জানেন লুৎফা তাঁর স্বামীর হত্যাকারীর বেগম হওয়ার থেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা বেশী শ্রেয় মনে করবে। তবে সেকথা বখরের মত জল্লাদকে বোঝাতে যাওয়া সময়ের অপব্যয় মাত্র।

“সে যাই হোক। ওসব ভেবে এই বান্দার কী কাজ। তার থেকে বরং যে হুকুম পালনের জন্য এতদূর আসা, সেইটা পালন করি।” বখরের কর্কশ স্বরে আমিনা বেগমের চিন্তাজাল ছিন্ন হল। ঘসেটি বেগমও নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে বসেছিলেন।

বখর খাঁ বলে চলল, “ছোটে নবাব মিরনের নির্দেশে আজ আপনাদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি চান আপনাদের হত্যা করে আমি যেন তাঁর শত্রু সংখ্যা কিছুটা হ্রাস করি। তবে হত্যার পদ্ধতি ছোটে নবাব নিজেই বলে দিয়েছেন। অস্ত্রের আঘাতে নয়। এই বুড়িগঙ্গার জলে ডুবিয়ে মারা হবে আপনাদের। শেকলে বেঁধে বজরা থেকে নামানো হবে মাঝ নদীতে। প্রথমে ডুবিয়েই তুলে নেওয়া হবে যাতে প্রাণটা বেরোতে গিয়েও বেরোতে না পারে। এভাবে বার চারেক করার পর একেবারে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখা হবে যাতে আপনাদের মৃত্যু ঘটে। অভিনব পদ্ধতি তাই না? হা হা হা।”

“বখর আমার কথা শোন। কী হবে আমাদের দুজনকে হত্যা করে? আমার মতিঝিলের বেশ কিছু গুপ্ত কক্ষে এখনও প্রচুর ধনরত্ন লুকিয়ে রাখা আছে। আমি ছাড়া কেউ তা কোনোদিন খুঁজে পাবে না। সব হদিশ তোমায় বলে দেব। তোমার কোনো অভাব আর থাকবে না। ছেড়ে দাও আমাদের। কে জানতে আসছে যে সত্যি আমরা মরেছি কিনা। আমরা না হয় কোনো এক অজানা গ্রামে লুকিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেব। দয়া কর বখর।” কাতর কণ্ঠে জীবন ভিক্ষা চাইলেন ঘসেটি বেগম। মৃত্যু ভয়ে কেঁদে ফেলেছেন তিনি।

“লোভনীয় প্রস্তাব সন্দেহ নেই। তবে ছোটে নবাবের হাজারটা চোখ, জালিয়াতি করে পার পাব না। আর গুপ্তকক্ষ? ছোটে নবাব মতিঝিল আর হীরাঝিলে যে হারে গুপ্ত রত্নাগারের খোঁজে তল্লাশি চালাচ্ছেন, সে সব আর কদিনই বা গুপ্ত থাকবে।”

“আমিনা, মৃত্যু তাহলে সামনে দাঁড়িয়ে বেহেন?” ঘসেটি বেগম কেঁদেই চলেছেন।

“নবাব আলিবর্দির কন্যাদের চোখে মৃত্যুভয় কি শোভা পায়? চোখের জল মুছে ফেল দিদি।” আমিনা বেগম শান্ত গলায় বললেন, “তোমার চোখের জল আদতে এই জল্লাদদের মনোরঞ্জনের উপাদান জোগাচ্ছে।” তারপর বখরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না বখর। আমি খুশি যে আমার সিরাজের সাথে খুব শীঘ্রই আমার দেখা হবে। তুমি তোমার মালিকের হুকুম পালন করো, কিন্তু তার আগে আমি শেষবারের জন্য কালমা পড়তে চাই। ব্যবস্থা করা যাবে?”

“হুকুম নেই।”

“তোমার থেকে এটাই প্রত্যাশিত ছিল।” আমিনা বেগমের কণ্ঠে তীব্র শ্লেষ। তারপর চোখ বন্ধ করে বললেন, “আল্লা, তোমার কাছে কিছুই গোপন নেই। তুমি জানো আমার সুখের সংসার কে শেষ করে দিয়েছে, কে আমার ছেলেকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। মিরনের কোনো অনিষ্ট আমি কোনোদিনই করিনি, তবু সে আমার মাতৃসত্ত্বায় বারবার আঘাত করে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করেছে। এই মায়ের কান্না, হাহাকার যদি তোমার কাছে পৌঁছোয় তাহলে যেন সেই নরাধম শাস্তি পায়। তোমার বজ্র যেন মিরনের ওপর তার পাপের শাস্তি হিসাবে আঘাত হানে।”

“এই কে আছিস বেগম সাহেবাদের পায়ে ভারী পাথরের টুকরোগুলো বেঁধে দে। শেকল দিয়ে ভাল করে বেঁধে ফেল দুজনকে।”

সৈন্যরা বখরের কথা মত কাজ করল। তারপর টানতে টানতে বন্দিদের নিয়ে গেল বজরার ধারে। সেখান থেকে ধীরে ধীরে দুই বন্দিকে নামিয়ে দেওয়া হল বুড়িগঙ্গার জলে। মৃত্যুর শীতলতায়।

 

পরিশিষ্ট

কাকতালীয় হলেও একথা সত্যি যে এর কিছুকাল পর বজ্রাঘাতে মিরনের মৃত্যু ঘটে। সেটা আমিনা বেগমের অভিশাপের ফল নাকি নেহাতই দুর্ঘটনা সে সম্পর্কে পাঠক তাঁর নিজস্ব মতামত গ্রহণ করতে পারেন।

গল্পে কিছু নাম ব্যবহার করা হয়েছে যেগুলি চরিত্র বা স্থানের প্রচলিত নাম নয়।

মনসুর গঞ্জের প্রাসাদ = সিরাজের হীরাঝিল প্রাসাদ।

নবাব মির্জা মহম্মদ আলী = নবাব আলিবর্দী।

মেহেরুন্নিসা বেগম = ঘসেটি বেগম।

নবাব মির্জা মহম্মদ = নবাব সিরাজদ্দৌলা। নবাব আলিবর্দী তাঁর সৌভাগ্যের প্রতীক প্রিয় নাতির নাম নিজের নামেই রাখেন, যদিও সিরাজদ্দৌলা নামটি বেশি পরিচিত।

এক্রাম = এক্রামদ্দৌলা। সিরাজদ্দৌলার ছোট ভাই। ঘসেটি বেগম এবং নোয়াজিশ খাঁ নিঃসন্তান ছিলেন। এক্রামদ্দৌলাকে তাঁরা দত্তক নেন।

নবাব সৈয়দ মীর মহম্মদ জাফর আলী খাঁ = মীরজাফর।

ছোটে নবাব মীর সাদেক আলী খাঁ = মীরজাফর পুত্র মিরন।

একথা জানিয়ে রাখা ভালো যে এই গল্পটা ইতিহাসনির্ভর কাহিনী হলেও সম্পূর্ণ ইতিহাস নয়। গল্পে উল্লিখিত অনেক ঘটনাই ঐতিহাসিক সত্য হলেও সেই ঘটনাগুলোকে কল্পনার সুতোয় বাঁধা হয়েছে।