পৈশাচিক ● অনুষ্টুপ শেঠ


 

 

দূরে আকাশের গায়ে নন্দাকোটের চূড়াগুলো সবে লাল থেকে কমলা হচ্ছিল।

দেবদারু পাইনের পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে, পাথরের টালি বসানো অসমান চালগুলোর উপর মধুরঙের আলো ছড়িয়ে পড়ছিল। হাওয়া চলছে আজ খুব, বরফিলা ঠান্ডা শরীরের খোলা অংশগুলোয় কামড় বসাচ্ছে।

বাড়ির বাইরের বেঞ্চটায় উবু হয়ে বসে, ধোঁয়া ওঠা চায়ের গ্লাসটা দুহাতের মুঠোয় চেপে ধরে সমস্ত উত্তাপ শুষে নিতে চাইছিলেন রাঘব। পঞ্চান্ন পেরোনোর পর থেকেই শরীরে বয়সের ছাপ টের পান আজকাল, ঠান্ডা বেশি লাগে যেন এখন।

লম্বা চুমুক দিয়ে আয়েসে চোখ বুঁজে এসেছিল। পরক্ষণেই আঁতকে উঠে চোখ খুলতে বাধ্য হলেন। আরেকটু হলে গ্লাসটা হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল।

একটা লোক পায়ের ঠিক সামনে মাটিতে প্রায় আছড়ে পড়েছে এসে। পড়ার আগে থেকেই হাউমাউ করে জড়ানো গলায় যা বলে যাচ্ছে তার কিছুই বুঝলেন না তিনি, তবে লোকটাকে চিনলেন।

সুন্দরলাল।

“আরে উঠে বসে ঠিক করে বল কী বলছিস! কিচ্ছু বুঝছি না তো!”

“জি, আমাকে বাঁচান!”

“কী হয়েছেটা কী? আবার টাকা ধার নিয়েছিলি কারো থেকে? নাকি ঝগড়াঝাঁটি করে এসেছিস শ্বশুরবাড়িতে ফের?”

সুন্দরলাল কিচ্ছু বলে না। মাথা নিচু করে মাটিতে চেয়ে থাকে।

“না বললে কী করব আমি? যা যা, খামোকা সকালবেলা যত উৎপাত!”

ক্যাঁচ্‌ করে আওয়াজ হয় একটা। বেড়ার ওই নিচু দরজাটার কব্জাটা ঝুলে গেছে, একটু ঠুকে দিয়ে তারগুলো ভালো করে পেঁচিয়ে ঠিক করে দিতে হবে কবে থেকে বলছেন ব্রিজেন্দরকে, লাটসাহেবের সময় হলে তো! এই এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠল মনে হয়, হেলেদুলে পিছনদিকে যাচ্ছে এবার দাঁতন করতে।

“জি... ধরে নিয়ে যাবে আমায় সরকার! পায়ে পড়ি আপনার, বাঁচিয়ে দিন এইবারটা!”

এবার একটু ঘাবড়েই গেলেন রাঘব। কী এমন করে এসেছে বুদ্ধুটা?

বুদ্ধুই। রিলকোট গাঁয়ের সবচেয়ে গবেট কে বললে লোকে একবাক্যে বলবে, সুন্দরলাল! তবে সামনে বলবে না কেউ, কারণ ব্যাটাচ্ছেলে এদিকে যেমন গবেট, অন্যদিকে তেমনি গোঁয়ার। চেহারাটাও তেমনি হোঁৎকা বলশালী, মাঝবয়েসী হলেও গায়ের জোর কিছু কম নয়।

“কী হয়েছে বলবি? নইলে দূর হ!”

ধমক খেয়ে একটু যেন ধাতস্থ হয়েছিল সুন্দরলাল। যা বলছিল তার সব এলোমেলো হলেও মানে বোঝা যাচ্ছিল অন্তত। অসংলগ্ন কথাগুলো থেকেই ধীরে ধীরে ব্যাপারটা বুঝতে শুরু করেছিলেন রাঘব। কাল উপরের খেত থেকে কাজ সেরে গাঁয়ে ফিরছিল সুন্দরলাল। ফেরার পথে এই লোকটির সঙ্গে দেখা হয়। পাহাড়িই, তবে এদিকে চেনাজানা কেউ নয়।

সে হতেই পারে, পাকদন্ডিটা পাটোয়ান যাবার পথে অনেক যাত্রী ব্যবহার করে বটে। আশপাশের গ্রামের অনেক লোক মোটামুটি মুখ চেনা হলেও, তাদের দূরের আত্মীয় সবাইকে কী আর চেনা আছে!

তো দুজনে এদিকে কাছাকাছি পৌঁছে একটু বিড়ি খেতে বসেছিল রাস্তার ধারে। তখনই লোকটা নাকি আলটপকা কথা বলতে শুরু করে কিছু।

“কী কথা? তারপর?”

“মরে গেল সাব্‌! একদম বুঝিনি ঐটুকু ঘুষিতেই অমন পট করে মরেই যাবে... এত বকোয়াস করছিল, উলটা সিধা বলছিল, এত গালি দিচ্ছিল গাড়োয়ালীরা নোংরা আর বোকা বলে... মাথা গরম হয়ে গেল সাব্‌! কিন্তু স্রেফ একটা ঘুষিতেই...”

ধড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন রাঘব! বলে কী হতভাগা!

খুন?!

“তক্ষুণি বললি না কেন এসে বেওকুফ?”

“জি দিমাগ ঠিকানা ছিল না সাব্‌! ছুটে পালিয়ে গেছি ঘরে। সারারাত ভয়ে ঘুম হয়নি, এখন মাথায় এল আপনাকে বলতে...”

পা জড়িয়ে ধরল রাঘবের অত বড় লোকটা।

“বাঁচিয়ে দিন সাব্‌! জান বাঁচিয়ে দিন আমার!”

কী করবেন কিছুই ভেবে পাচ্ছিলেন না রাঘব।

“চলুন না তাড়াতাড়ি, আর কেউ চলে আসার আগে...”

“অ্যাঁ? কোথায় যাব?”

“ওই পিছনের রাস্তার ধারটায়...ওখানেই তো পড়ে আছে বডিটা!”

তাঁর গ্রামের সীমানার রাস্তার ধারে লাশ পড়ে আছে! এখনই লোকজন সব কাজে বেরোবে, এক্ষুণি কারো না কারো চোখে পড়ে গেল বলে! এতক্ষণ যে কেউ দেখেনি সেটাই তো আশ্চর্য!

কী করবেন তিনি?

এ কী বিপদে পড়লেন!

মাথা ঘুরতে থাকে রিলকোট গ্রামের এত বছরের বংশানুক্রমিক মুখিয়া রাঘব তেজা বিস্তের।

***

কিন্তু অকুস্থলে যাওয়ার সুযোগ পেলেন না তাঁরা। তার আগেই এসে হাজির হল জুবিন।

ছোকরাকে একদম পছন্দ করেন না তিনি। চুলে ঝুঁটি করা লক্কা মার্কা চেহারা, তেমনিই হাবভাব। হিন্দি সিনেমার পোকা, নিজেকেও হিরো টিরো ভাবে। তাঁর দোস্ত ধর্মেশ নেগির ছোট মেয়ে শিভাঙ্গীর পিছনে ঘুরঘুর করছে বেশ কিছুকাল। তাতে ধর্মেশ খুবই বিরক্ত, মুশকিল হচ্ছে শিভাঙ্গীর দিক থেকেও আগ্রহ আছে বোঝা যাচ্ছে, তাই কিছু করা যাচ্ছে না।

যাই হোক, এখন জুবিনকে দেখে রাঘব নিজের বিরক্তি আর চেপে রাখতে পারলেন না।

“কী চাই? আমি এখন ব্যস্ত আছি, পরে এসো।”

সমস্ত হিরোগিরি নিমেষে উধাও, সটাং পা ধরে ফেলেছে তাঁর জুবিন।

“সাব্‌জি, বড্ড বড় ভুল হয়ে গেছে কাল আমার। আপনি না বাঁচালে মরে যাব!”

খুব অল্প কথায়, গুছিয়ে কী হয়েছে বলে দিল জুবিন। কাল রাতে, মানে বেশ বেশি রাতেই শিভাঙ্গীদের বাড়ির পিছনদিকে গেছিল সে। গিয়েই থাকে নাকি, গল্প করতে। তো কাল গিয়ে দেখে কে একটা অচেনা লোক ওবাড়ির দিকে উঁকিঝুঁকি মারছে। আড়াল থেকে দেখে শিভাঙ্গী বসে আছে আলগোছে, কাপড় টাপড় একটু আলগা খোলা, মানে ও ছাড়া আর কেউ তো এত রাতে এদিকে আসার কথা নয়... লোকটা তাই দেখছে।

মাথায় রক্ত চড়ে গেছিল, কোমরে কুকরি গোঁজাও ছিল। রাগের মাথায় গলায় মেরে বসেছিল কোপটা।

গলগল করে রক্ত বেরোতে দেখে হুঁশ আসে। আর কিছু ভেবে না পেয়ে নিথর হয়ে যাওয়া শরীরটা টেনে মাঠের ধারে, রাস্তার বাঁকটার কাছে ফেলে পালিয়ে এসেছিল। আজ ঘুম থেকে উঠে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখেছে মুখিয়াকে সব খুলে বলাই ভালো, তাই ছুটে এসেছে এখন।

মাথা টাথা ঘুরছিল রাঘবের।

একটা খুন নিয়েই চোখে সর্ষেফুল দেখছিলেন, আরো একটা!

উপায় নেই। নিজে গিয়ে দেখা ছাড়া আর উপায় নেই এখন কিছু। তারপর থানায় খবর পাঠাতে হবে, কীভাবে সবদিক সামলানো যায় ভাবতে হবে...

“বাবুজি!”

কখন যে ব্রিজেন্দর এসে পাশে দাঁড়িয়ে আছে এতক্ষণ খেয়ালই করেননি।

“কী?”

“বলছি...”

সাধে কি একমাত্র ছেলে হলেও ব্রিজেন্দরকে দুচোখে দেখতে পারেন না আজকাল!

“আরে জলদি বল। আর জরুরি না হলে পরে বলিস।”

“খুব জরুরি বাবুজি। খুব। ওই রাস্তার বাঁকের কাছে যাচ্ছেন তো?”

“হ্যাঁ, কেন?”

“বলছি, একটু নিচ বরাব্বর মাঠটাও যদি দেখে আসতেন।”

বিরক্ত লাগে রাঘবের। দেখছে এইরকম সমস্যা, এখন ফালতু বকছে যত।

“কী দেখব? কেনই বা দেখব? দেখছিস কাজে যাচ্ছি একটা...”

ছেলের গলাটা নিজের কানেও অচেনা ঠেকে এবার।

“বাবুজি... গলতি আমারও হয়ে গেছিল কাল একটা। মাঠ থেকে আসছি, তখনও বেশ আলো ছিল, ওইখানটায় রাস্তার ধারে একটা অচেনা লোক দেখি বসে বসে টাকা গুনছে। তো… আমার লোভ হয়ে গেছিল বাবুজি, রোগা বুড়ো লোক, ভাবলাম ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে পালালে কিছু করতে পারবে না! তা লোকটার হাতে কী জোর, বুঝিনি… গেঁজেটা নিয়ে কাড়াকাড়ি ঠেলাঠেলি করতে গিয়ে বেকায়দায় লোকটা ওই বাঁকের ঢাল দিয়ে দুম করে পড়ে গেল। পাথরে লাগল না কী জানি, নেমে দেখি ঘাড় মটকে গেছে একদম। ডেড। ভয়ে আর কাউকে বলতে পারিনি। আজ এদের সব কাণ্ড শুনে বলছি... মানে ওখানে গেলে ঐ বডিটাও তো দেখতেই পাবেন...”

এবার ধপ্‌ করে আবার বেঞ্চে বসে পড়েন রাঘব। মুখ দিয়ে আর কথা সরছে না তাঁর।

***

একা যাওয়ার সাহস পাননি এরপর রাঘব। গাঁয়ের আর পাঁচজন মাতব্বর লোককে ডেকে নিয়েছিলেন সঙ্গে। ধর্মেশ নেগি, জনকরাম নেগি, শিউশরণ চন্দ্‌, দীপককুমার রাম। যা হয়, কথাটা ছড়িয়ে গেছিল ততক্ষণে। সাড়া পড়ে গেছিল গ্রাম জুড়ে, এমন ঘটনা কেউ জন্মে শোনেনি। ছেলে বুড়ো মিলিয়ে ওঁদের পিছু পিছু আদ্ধেক গ্রামই চলল পিছনের রাস্তার দিকে।

সবাই-ই সুন্দরলাল, জুবিন আর ব্রিজেন্দরের থেকে দূরত্ব রেখে চলছিল অবশ্য! আলাদা আলাদা একা একা হাঁটছিল তিনজনে, মাথা ঝুলিয়ে।

শেষ অবধি কিন্তু থানা পুলিশ কিছুই করার দরকার পড়ল না।

দরকার পড়বে কী করে? কিছুই তো নেই! সবাই মিলে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তিনটে লাশ দূরস্থান, একটা খুনেরও বিন্দুমাত্র চিহ্ন পেল না।

অথচ তিনজনেই রাস্তার ধারে, ঝাঁকড়া ওক গাছটার নিচের একই পাথরের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বার বার শপথ করে বলছিল ঐখানেই, পাথরের পিছনে বা তার নিচের মাঠেই বডিটা রেখেছিল সে।

তাদের হতভম্ব মুখগুলো দেখে দয়া হচ্ছিল রাঘবের। কিন্তু কী বলবেন তাও ভেবে পাচ্ছিলেন না। তিনি নিজেও তো সমান হতভম্ব!

কিংকর্তব্যবিমূঢ় লোকজন শেষমেশ একে একে চলে গেল। বয়স্করা বেশির ভাগই বলতে বলতে গেল, আজকালকার ছোকরারা বড় বেশি নেশা করছে। নইলে তারাও কি আর দুপাত্তর খায় না? এরকম আজব সব জেগে স্বপ্ন দেখেছে কি তাই বলে!

কমবয়েসীরা কেউ বলল ম্যাজিক, কেউ বলল ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছে, কেউ বলল বাঘ টাঘ আসেনি তো? কেউ আবার বলে বসল মরেনি তার মানে, উঠে চলে গেছে রাত্রে কোনো সময়ে। হতাশও হয়েছিল তাদের অনেকেই, এত উত্তেজনার শেষে কিনা সব ফক্কা!

শেষমেশ কিন্তু সব ফক্কা আর বলা গেল না। পরদিনই আবার সব অন্যরকম হয়ে গেল। এবার আর কাউকে খোঁজাখুঁজিও করতে হয়নি, ঠিক ঐ ওক গাছটারই নিচে, ফাঁকা রাস্তায়, খোলা আকাশের নিচে চিত হয়ে পড়ে ছিল প্রৌঢ় মাঝারি উচ্চতার শরীরটা। চোখ খোলা, বিস্ফারিত দৃষ্টি।

শরীরের সমস্ত ভঙ্গিতে, মুখচোখের প্রতি ইঞ্চিতে খোদাই করা আছে একটাই জিনিস।

আতঙ্ক!

***

কী হয়েছিল সেদিন তারপর?

লাশ টাশ না পেয়ে সবাই যে যার চলে যাচ্ছিল। কিন্তু রাঘবের ধাঁধা কাটছিল না কিছুতেই। তার কথাতেই আরেকটু ভেবে দেখার জন্য মাতব্বররা মন্দিরের সামনে খোলা চত্বরটায় দাঁড়িয়েছিলেন এসে। প্রত্যেকেই বিভ্রান্ত, কিছুটা শঙ্কিতও। গ্রামের এইসব ছেলেদের তাঁরা জন্ম থেকে দেখছেন। বোকা হোক, অলস হোক, গোঁয়ার হোক, এরকম অদ্ভুত মনের ভ্রম বা বিকার হবার মত কাউকে মনে হয়নি কখনও। তাও কিনা একসঙ্গে তিন তিনজনের!

“এ আবার নতুন কোনো বিমার এল না তো? সেই সাইন ফুলু না কী হচ্ছিল তেমন?” ধর্মেশ নেগি বলেই ফেললেন।

রাঘব কিছু বলার আগেই তাঁর পিছন থেকে গমগমে গলা বেজে উঠল, “না ভাই, না!”

পুরোহিত দীননাথ বালিয়া। এ গ্রামের সবচেয়ে পুরোনো পরিবারের মাথা।

ওদের সব আলোচনাই যে এতক্ষণ নিশ্চুপ পিছনে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন দীননাথ তা বোঝা গেল ওঁর পরের কথা থেকে।

“পাহাড়ে কত অজানা রহস্য আছে জানো তোমরা? এ কোনো বিমারি নয় ভায়া! তোমরা তো জানো না, কত আশ্চর্য যুগ যুগ ধরে লুকিয়ে আছে এই হিমালয়ের বুকে! তোমাদের মত সংসারী লোক এসবের নাগাল পায় না। সাধু মহাত্মারা প্রাণ তুচ্ছ করে ঘোরেন হিমালয়ের পথে পথে, তাঁরা জানেন এসব গোপন কথা। বিপদ, ভায়া, বড় বিপদ!“

“আপনি বুঝেছেন প্রভুজি? বলুন না, কী ব্যাপার হল এটা? আমরা তো ভেবে ভেবে মাথা খারাপ করে ফেলছি!” আকুল হয়ে বলেন ধর্মেশ।

নিঃশব্দে, ম্লান একটা হাসি হাসেন দীননাথ।

“যা হল, তা খুব খারাপ হল জেনে রাখো! গাঁয়ের উপর যে সাংঘাতিক অমঙ্গল নেমে আসতে চলেছে তার হাত থেকে বাঁচা খুব শক্ত!!”

রাঘবের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দীননাথের শেষ কথাগুলো উচ্চারণ হয়েছে কেমন যেন কালের অমোঘ উচ্চারণের মত।

“খুলে বলুন! এভাবে দগ্ধে মারবেন না!”

দীননাথ তাও আরেকটু চুপ করে থাকেন। যেন নিজের মনে গুছিয়ে নিচ্ছেন কীভাবে বলবেন।

“তবে শোনো মন দিয়ে। যে অপদেবতার মায়ায় এই সব ঘটনা ঘটেছে, তার হাতে প্রাণ যাওয়ার চেয়ে জীবন্ত দগ্ধে মারা যাওয়াও সুখের কথা, রাঘব! যার রক্তলোলুপ দৃষ্টি পড়েছে এই গ্রামের দিকে, যে সুযোগসন্ধানী তার ক্ষুধার শিকার খুঁজতে বেছে নিয়েছে এই গ্রামকে, সে যে ভয়ংকরের ভয়ংকর! তার নাম মুখে আনতেও জিভ আটকে যায়, তার করাল থাবার নিচে দাঁড়িয়ে আছি জানলে প্রাণপাখি ডানা ঝাপটায়।”

উচ্চস্বরে আকৃষ্ট হয়ে পায়ে পায়ে আরো বহু লোকই এসে দাঁড়িয়েছিল তাদের ঘিরে। দীননাথের কথা শেষ হতেই তাদের মধ্যে জেগে উঠল আতঙ্কিত ফিসফাস গুঞ্জন, সবাই আরো কাছাকাছি ঘেঁষে এল, অনেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনদিকে আর আশেপাশে দেখে নিল চট করে।

বুকের মধ্যে ভয়ের চোরাস্রোত টের পাচ্ছিলেন রাঘবও। এমনিতে তিনি সাহসী, জেদি পুরুষ, ভীতু অপবাদ কেউ কখনও দিতে পারেনি তাঁর নামে। কিন্তু নিশ্চয় প্রত্যয় ভরা এই কথাগুলো শুনতে শুনতে অসহায়ভাবে তিনি অনুভব করছিলেন, এই অলৌকিক জগতের সামনে কত তুচ্ছ তিনি!

“কে সে? কী নাম সেই অপদেবতার?”

দীননাথের মুখের উপর অন্ধকার নেমে আসে, মুখভঙ্গি হয়ে ওঠে আরো বেদনাদীর্ণ।

“সে নাম মুখে আনতেও কণ্ঠরোধ হয় ভায়া। তবু, বলতে আমাকে হবেই আজ! তবে শোনো। সাধারণ পিশাচ প্রেত নয়, এ গাঁয়ের উপর নজর পড়েছে নৃশংস মায়াবী আইলাচাশ-এর। সে আসলে এক পিশাচ, মহা জাদুগরী পিশাচ। সে যখন যেমন খুশি রূপ ধারণ করতে পারে। লোককে চটিয়ে, ভুলিয়ে সে লোভ দেখায় তাকে আক্রমণ করতে, আক্রমণ করলে সে মরেও যায় চটপট। কিন্তু সে সবই ফাঁকি, সেই তার জাদু— ভয়ে ঘাবড়ে যখন সামনের মানুষটা বিহ্বল বিবশ হয়ে পড়ে, সে তার মনের দখল নিয়ে নেয় সূক্ষ্মভাবে, তারপর তার জালে পড়ে যায় সে লোক। শুধু সে একা নয়, তার আশপাশের সব মানুষ, তার প্রিয়জন সবাই-ই তখন আইলাচাশের খপ্পরে চলে আসে। এভাবেই বুগিয়ালের পিছনে এককালে থাকা তিন তিনটে গ্রাম পুরো খেয়ে শেষ করে দিয়েছিল আইলাচাশ আমার ঠাকুর্দার বাবার আমলে!”

ভিড়ের মধ্যে প্রবল চাঞ্চল্য জেগে ওঠে এ কথায়। বুড়িরা হাহাকার জোড়ে, অনেকে হাঁটু গেড়ে বসে প্রাণভিক্ষা করতে থাকে পুরোহিতের কাছে।

রাঘবের অবিশ্বাস্য লাগছিল। এত ভয়ানক একটা অপদেবতার কথা সে কখনও শোনেনি কেন? জিজ্ঞাসা করেই ফেলল দীননাথকে।

“বড় দুর্দিন না এলে তো ভাই এ নাম শোনার কথা নয় কারো! এর কথা বলা বারণ আমাদের। কারণ, এর নাম করলেই, একে আহ্বান করে ডেকে আনা হয়। তাই বাধ্য না হলে, নিরুপায় না হলে আইলাচাশের কথা বলা যায় না... বলতে নেই...”

“তাহলে... আজ বললেন যে প্রভুজি?”

ধর্মেশ নেগির গলা কাঁপতে থাকে।

“বাধ্য হলাম বলতে গো! তোমরা বুঝছ না, আমার বুক ফেটে যাচ্ছে দুশ্চিন্তায়! না বলে যে আর উপায় নেই আমার! আইলাচাশ করে কী, এইরকম ফাঁদ পেতে এক একটা মৃত্যুর নাটক সাজিয়ে একটু করে মানুষজনের মনের উপর দখল নেয়। পুরো গ্রামের দখল নিতে তার কখনও লাগে সাতদিন, কখনও পনেরোদিন। কিন্তু...”

“কিন্তু?”

উত্তেজনায় রাঘবের গলা ভেঙে যায় একটা শব্দ বলতে গিয়েও।

“কিন্তু... এক রাত্রে তিন তিনবার সফল ফাঁদে ফেলতে পারলে, একদিনেই কার্যসিদ্ধি হয়ে যায় গো রাঘব! আইলাচাশ কালই এখানের পুরোপুরি দখল পেয়ে গেছে, যেকোনো মুহূর্তে তার নিষ্ঠুর থাবার পিষে শেষ হয়ে যাবে গোটা গ্রাম... কেউ বাঁচবে না... কেউ না...”

শনশন করে হাওয়া বয়ে যায় ঘূর্ণি তুলে, দূর পাহাড় থেকে প্রতিধ্বনি ভেসে আসে যেন,

“কেউ না... কেউ না...”

যেন কোনো অশুভসত্ত্বার ভবিষ্যদ্বাণী, যেন সরাসরি প্রেতলোক থেকে উঠে আসা কোনো অভিশাপ!

***

সারা গ্রাম থমথম করছে নিশ্চুপ। কোনো বাচ্চা কেঁদে উঠলেও ত্বরিতে তার মুখ চাপা দিচ্ছে তার মা। কানে কানে পুরোহিতের বলা কথা রটে গেছে, সবাই জেনে গেছে এক মায়াবী প্রেতের বলি হিসেবে নির্দিষ্ট হয়েছে এই গ্রাম। দিনের আলো ফুটলেই হয়তো সারি সারি ঘর খালি করে পিঠে বোঁচকা নিয়ে নেমে যাবে অনেকেই।

কিন্তু তার আগে রাতটা তো কাটুক নির্বিঘ্নে!

হাওয়া চলছে আজ, মাতালের মত এলোমেলো জোরালো হাওয়া। আগুন জ্বালিয়েও শীতকে বশ মানানো যাচ্ছে না। অস্বাভাবিক সব আওয়াজ ভেসে আসছে দূরের চূড়াগুলো থেকে। এসব কীসের ইঙ্গিত?

গ্রামের সব বাড়ির লোকজন ভয়ে কুঁকড়ে, একসঙ্গে জড়ো হয়ে বসে রাত কাটাচ্ছে। কোথাও কোনো নড়াচড়া নেই, কথাবার্তা নেই আজ— শুধু মন্দির বাদে।

সেখানে বন্ধ দরজার পিছনে চলছে চরম ব্যস্ততা। রাঘব, ব্রিজেন্দর, শিউশরণ, ধর্মেশ, জানকীরাম ও আরো কয়েকজন ছোট কুঠরির মেঝেতে গোল হয়ে বসে আছেন। তাঁদের সামনে, তাঁদের দিকে ফিরে আসন করে বসেছেন দীননাথ, তাঁর সামনে হোমকুণ্ড, ফুল পাতা দিয়ে সাজানো,গঙ্গাজলের ঘড়া, কোষাকুশি, চামর ইত্যাদি। রাখা নামের জোগাড়ে ছেলেটা পাশে বসে প্রদীপের সলতে উস্কোচ্ছে, ধুনোর গুঁড়ো ঢালছে।

শেষ চেষ্টা করে দেখতে চলেছেন দীননাথ। যদিও এই পিশাচের হাত থেকে কেউ কখনও রক্ষা পায়নি বলেই শুনেছেন, তবু এই মারক যজ্ঞ তাঁর জানা আছে যখন, করে দেখবেন কী হয়। মাতব্বরদের এটা খুলে বলে, তাঁদের সবার জনে জনে অনুমতি নিয়ে তবেই যজ্ঞ শুরু করেছেন তিনি। কাজ হলে ভালো, নইলে কপাল!

রাঘবের চোখে সাধারণ পূজার চেয়ে খুব আলাদা কিছু লাগছিল না এতক্ষণ। কিন্তু এইবার দীননাথ তাঁর পাশে রাখা ঝুলি থেকে যা বার করলেন তাতে ঘরশুদ্ধু সবার মত তিনিও আঁতকে উঠলেন।

হাড়। সাদা সাদা হাড়। মানুষের।

মাথার খুলি।

সেই হাড়ের সারি আর খুলিটা কুণ্ডের মধ্যে বসিয়ে দিয়ে কাঠে আগুন ধরালেন দীননাথ।

ঘরের দেওয়ালে লোকদের ছায়া কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকল। গমগমে গলায় অবোধ্য মন্ত্র বলে যাচ্ছেন দীননাথ আর সারা ঘরে কুষিতে জল তুলে ছিটিয়ে দিচ্ছেন। কী জানি কী ফেলল এবার ধুনোয় ছেলেটা, তীব্র গন্ধের ঝাঁঝে চোখে জল এসে গেল রাঘবের। সারা ঘর ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, তার মধ্যে দাউ দাউ করে যজ্ঞের আগুন জ্বলছে, লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে এক একটা লকলকে শিখা, পাগলের মত মাথা ঝাঁকাচ্ছেন দীননাথ, লম্বা সাদা চুল নেচে উঠছে...

দেওয়ালে ছায়ার মধ্যে ও কী দেখতে পাচ্ছেন রাঘব? ছায়াই তো? এত নিখুঁত এক মানুষের মূর্তি হল কী করে? হাত তুলে ধরেছে সে, সেই হাতে একটা কুঠার নাকি?

মুখ তুলে সরাসরি রাঘবের দিকেই তাকাল সে ছায়ামূর্তি, মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠল তার, সেই সঙ্গে ধক করে ফুটে উঠল দুটো লাল, চুনির মত উজ্জ্বল চোখ।

“ওঠো।”

আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন রাঘব, বাহ্যজ্ঞানহীন হয়ে দেওয়ালের সেই চোখে চোখ রেখে বসে ছিলেন, দীননাথের ডাকে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন।

খুব স্নেহের গলায় দীননাথ বললেন,

“রাঘব, তুমি এ গ্রামের মুখিয়া। তাই তোমাকেই যেতে হবে ভাই আমার সঙ্গে।”

“কোথায়?”

একটু অসহিষ্ণু হন কি দীননাথ? গলা কিন্তু তেমনই নরম, স্নেহার্দ্র থাকে।

“এই যজ্ঞশক্তি ধারণ করে, আমাদের গ্রামের জন্য আজ একজনকে চরম ঝুঁকি নিতে হবে ভাই। এই-ই প্রক্রিয়া। তাকে যেখানে মন্ত্রের বন্ধন দিয়ে বসিয়ে আসব সেখানে ঠায় বসে থেকে সারারাত জেগে গ্রাম পাহারা দিতে হবে। পারবে, রাঘব?”

“একা?”

“একদম একা। সেটাই নিয়ম। পারবে না?”

দীননাথের গলায় অনুনয় বেজে ওঠে। বাকি সবাই উদগ্রীব হয়ে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে আছে।

কিন্তু, মানুষের প্রাণ তো! ভয় জিনিসটা বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে যায়। গলা শুকিয়ে আসে, রাঘব জবাব খুঁজে পান না।

দীননাথের মুখে করুণ হাসি ফুটে ওঠে, গলায় স্পষ্ট কাতরতা।

“পারবে, বলো? বলো, মুখিয়া?”

“আমি গেলে হয়?”

ব্রিজেন্দর উঠে দাঁড়িয়েছে।

দীননাথ তার দিকে একটু বিরক্ত চোখে তাকায়।

“জওয়ানদের আজকাল একদম বুঝসমঝ নেই, না? দেখছ তো তোমার বাবার সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে। মধ্যে তোমায় কে কথা বলতে বলেছে?”

ভয়ের চেয়েও বিরক্তি কখনও কখনও বেশি হয়ে যায়। পিঠ টান করে রাঘব বলেন—

“যাব, অবশ্যই আমি যাব। আমার গ্রাম, আমি মুখিয়া। যেতে তো আমাকেই হবে!”

“সাব্বাশ! চলো তবে। আচ্ছা, ব্রিজেন্দর, তুমিও চলো ঐ মশালটা হাতে নিয়ে, আর এই ঝোলাটা কাঁধে নাও, আমার লাগবে। রাখা, এই ঘরে ধুনো দেওয়া একটুর জন্যও বন্ধ না হয় যেন, আর আগুনটা সমানে দেখবি।”

বেরিয়ে যাবার আগে ঘুরে দাঁড়ান দীননাথ আবার।

“আমি ফিরে না আসা অবধি কেউ এ ঘর থেকে বেরোবে না। খবরদার! পিশাচ গ্রামের আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এক পা-ও কেউ এই ঘরের বাইরে রাখলে তার জানের দায় আমার নয়, মনে থাকে যেন।”

বেরোবার আগে রাঘবও একবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন।

দেওয়ালের যেখানে একটু আগে সেই লাল চোখ দুটো দেখছিলেন, সেখানে এখনও মৃদু লালচে আভা দেখা যাচ্ছে। তাঁর চোখ পড়তেই ধক করে আবার জ্বলে উঠল যেন!

***

এই গ্রাম তাঁর আজন্মের চেনা গ্রাম! ভাবতে পারছিলেন না রাঘব। এত নিশ্চুপ, এত অন্ধকারে ঢাকা। কখনও এমন দেখেননি। জীবনে কখনও না!

চেনা পথ গুলিয়ে যাচ্ছে। ঘোরের মধ্যে হেঁটে যাচ্ছেন যেন তাঁরা, সবার আগে ব্রিজেন্দরের হাতে মশাল উঁচু করে ধরা, তার পরে দীননাথ, শেষে তিনি। মশালের আলো তাঁর পা অবধি পৌঁছচ্ছে না। কী হয়েছে আজ তাঁর? এটা কি ভূপেনের ঘর? এটা সুন্দরলালের, নাকি লালুয়ার? সব একরকম লাগছে, সব অচেনা লাগছে।

মরা চাঁদের আলো আজ। গাছগুলো কালো, নীলচে কালো। গাছ, নাকি বর্শা সারি সারি? আঃ কীসব উলটোপালটা ভাবছেন!

বড় জোরে হাঁটছে ওরা। তাল রাখতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। পা পড়ছে পাথরে বেকায়দায়, ব্যথা লাগছে। বুকে দম পাচ্ছেন না কেন? এত বুড়ো কবে হয়ে গেলেন তিনি!

ঐ তো দাঁড়িয়েছে ওরা। রাস্তায় এসে গেছেন কীভাবে বুঝলেন না তো! সেই বাঁক। সেই ওক গাছটা, বড় পাথর। হ্যাঁ, এখানেই যখন সেই আইলাচাশ শিকার ধরেছিল, এখানেই তাহলে তার সঙ্গে মুলাকাত হওয়ার কথা।

মুলাকাত।

মানে মুখোমুখি? কে হবে, তিনি?

অনিচ্ছাতেও আপাদমস্তক কেঁপে ওঠেন রাঘব আরেকবার।

ওফ, দেখে ফেলল না তো ব্রিজেন্দর!

“এদিকে এসো মুখিয়া।”

দীননাথের ডাকে রাঘবের ঘোর কাটে। মনে কেমন একটা ভরসা আসে। বড় বড় পা ফেলে শেষ দূরত্বটূকু পেরিয়ে আসেন রাঘব। গম্ভীর গলায় বলেন—

“কে ডরপোক? বলুন কী করতে হবে।”

পাথরটার পাশে মাটিতে কাঠি দিয়ে দাগ কেটেছেন দীননাথ ইতিমধ্যে। সেটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেন—

“বসে পড়ো এইদিকে মুখ করে।”

রাঘব বসলে বসতে দেখেন ঝুলি থেকে নানা রকম শিশি বার করে চারদিকে ছিটিয়ে দিচ্ছেন দীননাথ। একটা শিশি তাঁর সামনে খুলে বললেন—

“শেষ কাজটা। এটা এক ঢোঁকে খেয়ে নাও, শরীর বন্ধন করবে, কেউ ছুঁতে পারবে না।”

অপূর্ব মিষ্টি গন্ধ, ঝাঁঝালো স্বাদ। ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন রাঘব।

“এবার চোখ বন্ধ করো। বন্ধ করে রাখবে সারারাত। সকালে আমরা সবাই মিলে এসে না ডাকা অবধি, সূর্য উঠেছে টের না পাওয়া অবধি, এমনকী আমার গলা পেলেও চোখ খুলবে না। মনে রেখো যেকোনো চেহারা ধারণ করা, সব রকম গলার স্বর নকল করা এই পিশাচের বাঁ হাতের খেল।”

চোখ বন্ধ করেন রাঘব। ঘাড় হেলিয়ে সায় দেন, যে বুঝেছেন।

“আসি, রাঘব? কোনো চিন্তা নেই ভাই, বন্ধন দেওয়া আছে আমার। আসি।”

পায়ের আওয়াজ দূরে চলে যাচ্ছে টের পেলেন রাঘব। আস্তে আস্তে সে আওয়াজ মিলিয়েও গেল। তারপর সব চুপ।

নিঃশব্দ।

একটা পাতা নড়ার আওয়াজও নেই গাছটায়। বসে থাকতে থাকতে সারা শরীরে আলস্য নেমে আসছে, মনে হচ্ছে এখানেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। জোর করে ঝাঁকুনি দেন নিজেকে একটা— এই আসনে বসে থাকতে হবে, এলিয়ে পড়লে চলবে না।

কতক্ষণ এভাবে বসে আছেন রাঘব? সময়ের হিসেব নেই। রাত আর কত বাকি?

বহু, বহু দূরে একটা পাখির ডানা ঝাপটানো শোনা গেল না?

ভোর হচ্ছে নাকি তবে?

আবারও। পাখির ডানা?

তাই তো? নাকি কেউ গায়ের চাদর সামলালো?

ওটা কী?

জল পড়ছে কোথাও?

নাকি, কেউ পা টিপে টিপে আসছে?

চোখ খোলার প্রবল লোভ সামলালেন রাঘব।

এই তো হবে। এই তো পিশাচের সঙ্গে লড়াই। মন শক্ত রাখতে হবে তাঁকে।

সুন্দরলাল বা ব্রিজেন্দরের মত সহজ শিকার নন তিনি। তিনি মুখিয়া। তিনি বুদ্ধিমান, সাহসী মানুষ। এসব প্রলোভনে পা দেবেন না তিনি।

পুরোহিত তো বলেছে, একবার তাঁর কাছে হেরে গেলে, গ্রাম ছেড়ে পালাবে পিশাচ। পরাজয় তার সহ্য হয় না।

আওয়াজটা খুব কাছে হল এবার।

কেউ আছে। আর মনের ভুল নয়, খুব কাছে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে।

দেওয়ালের সেই ছায়াটা বন্ধ চোখের সামনে ভেসে উঠল রাঘবের। হিংস্র, হাতে উদ্যত কুঠার, লাল চোখ জ্বলছে।

সে কাছে আসছে। আরো কাছে। আরো।

গণ্ডি পেরিয়ে গেছে এবার নির্ঘাত। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবেন এমন দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে সে এখন, টের পাচ্ছেন রাঘব। তার গায়ের উত্তাপ, তার নড়াচড়ার কম্পন, তার বুকভরা হিংসার জ্বালা।

“চোখ খুলবে না।”

বৃথা গেল দীননাথের সাবধানবাণী।

নিঃসীম আতঙ্কে মাথা ফাঁকা হয়ে গেল রাঘবের। আত্মরক্ষাপ্রবৃত্তি প্রবলতর হল। আসন ফেলে, চোখ খুলে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।

বিস্ফারিত চোখে দেখলেন, সামনে দাঁড়িয়ে এক বলবান জোয়ান চেহারা, হিংস্র, হাতে উদ্যত অস্ত্র, চোখ জ্বলছে।

একটা চাপাগলায় গালি।

পৃথিবী দুলছে রাঘবের সামনে, দম নিতে পারছেন না কেন আর?

সেই উদ্যত হাত তখন সবলে আছড়ে পড়েছে তাঁর মাথায়।

জ্ঞান লোপ হওয়ার আগে শেষ যে কথাটা রাঘবের মনে ভেসে উঠেছিল, তা হল, আইলাচাশ সত্যিই হুবহু চেনা মানুষের চেহারা, গলা নকল করতে পারে বটে!

লুটিয়ে পড়া রাঘবের শরীরের উপর ঝুঁকে পড়ে অন্ধকার ছায়াটা অনেকক্ষণ ধরে কী যে দেখল তা সে-ই জানে। তারপর, হাতের জিনিসটা মাটিতে ফেলে দিয়ে পিছন ফিরে গ্রামের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে হাসতে লাগল সে।

এক কি দু মুহূর্ত। তারপরই তাকে আর ধারেকাছে দেখা গেল না। যেন বা শূন্যেই মিলিয়ে গেল সে।

***

ইন্সপেক্টর অরুণ রাওয়াত নির্বাকভাবে তার সামনে দাঁড়ানো প্রৌঢ় পুরোহিতকে দেখছিল। দীর্ঘ সবল চেহারা, মুখে দাড়িগোঁফ কাঁচাপাকা মেশানো। চুল পুরোই সাদা, ঝুঁটি বাঁধা।

“আইলাচাশকে কাটানো যায় না বাবা। সব চেষ্টা তো করলাম যথাসাধ্য, সারারাত ধরে যজ্ঞ, দু দুবার গ্রাম বন্ধন প্রক্রিয়া... যত মন্ত্র জানি সব প্রয়োগ করেছিলাম বেটা... আমার সাধ্যে কুলোল না...”

“আইলাচাশ!! এরকম কিছু তো জন্মে শুনিনি! আমিও তো এদিকের পাহাড়েই জীবন কাটিয়েছি।”

ব্যগ্র ভাবে তাঁর দিকে আরেক পা এগিয়ে এসে দীননাথ পুরোহিত গলা নামিয়ে বলেন—

“বলা বারণ বেটা! এ জিনিস বলা বারণ তো কাউকে! শুধু এরকম বিপদ হলে তবেই মুখ খুলতে অনুমতি আছে আমাদের। বুঝলে?”

তার দিকে ঝুঁকে পড়ে লোকটা কথাটা বলার সময়। হালকা দুর্গন্ধ পায় অরুণ, তাকিয়ে দেখে দাঁতগুলো হলদেটে, ছ্যাতলা পড়া। কোঁচকানো চোখ দুটোয় বুদ্ধি এবং বেদনার ছাপ।

ভাগ্যের ফের ছাড়া আর কী বা বলা যায় একে! অরুণের সকালে বেরোতে আর পনেরো মিনিট দেরি হলেও, ব্যাপারটা তার চোখে পড়ত না। সে তো যাচ্ছিল এই রাস্তা ধরে আরো দেড় ঘণ্টা দূরে হানাশী গ্রামে, একজন লোককে খুঁজতে। রাস্তায় ভিড় দেখে নেমে পড়ে দেখে এই কাণ্ড।

লোকগুলো তখন সৎকারের ব্যবস্থা শুরু করে দিয়েছিল। সাদা কাপড় চাপিয়ে, লাশ তুলে সরিয়ে এনে পুরো অকুস্থল বরবাদ করে রেখেছিল একদম। অরুণ দুই ধমকে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে নিজের কন্সটেবলদের দাঁড় করিয়েছে বডির পাশে।

এমনিতে হয়তো একঝলক দেখে বেরিয়েই যেত, কিন্তু তার অভিজ্ঞ চোখে জড়ো হওয়া লোকেদের হাবভাবে কেমন যেন অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েছিল। তাই জীপ থামিয়ে মুখ বাড়িয়ে খোঁজ নিতে গেছিল। অ্যাক্সিডেন্ট শুনলেও হয়তো অত গা করত না, কিন্তু লোকগুলো সমস্বরে তার প্রশ্নের জবাবে ক্রমাগত ‘আইলাচাশনে মার দিয়া’ বলতে থাকায় সে ব্যাপারটা খুঁটিয়ে দেখবে বলে নেমেই পড়েছিল।

তারপর এই পুরোহিত এগিয়ে এসে সব কেমন গুলিয়ে দিল।

জেদ চেপে যায় অরুণের।

না, এর শেষ দেখেই ছাড়বে সে। মৃতদেহটার উপর মাছির ঝাঁক জড়ো হচ্ছে, ওটাকে গাড়িতে তুলে নেবার নির্দেশ দেয় সে হাত নেড়ে।

লোকটার ছেলেটা এতক্ষণ পাশে ঝুম হয়ে বসে ছিল। এইবার সে নড়েচড়ে উঠল, কাঁদবে নাকি? খুব অস্বস্তি হয় দামড়া জোয়ান লোক কান্নাকাটি করলে।

বদলে, সে ভারি ভাঙা গলায় অনুরোধ করে, “ছেঁড়াকাটা করবেন না স্যার, দোহাই স্যার...”

পাত্তা দিত না অরুণ, পুরোহিত পাশ থেকে গম্ভীর গলায় বলল, “ও আজই দাহ করতে হবে। পিশাচের হাতে মরেছে, সে মড়া আরো বাসি হলে গ্রামের আরো কী অকল্যাণ হয় কে জানে...ওতে আপনারা হাত দেবেন না।”

অরুণ বিব্রত হয়ে পড়ছিল। এসব সংস্কার পুরো অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। অথচ খটকাটাও যাচ্ছে না। ঘটনাচক্রে সে নিজে শুধু এদিকেরই ছেলে তাই নয়, তার বাবা মা দুদিকেরই সবাই হিমালয়ের এই অঞ্চলেই জীবনভর থেকেছে। এমন একটা সম্পূর্ণ অজানা গল্প বিশ্বাস করতে তার বাধছিল।

কিন্তু, গ্রামের অকল্যাণ শুনেই চারদিকের লোকজন যেমন রুখে দাঁড়ানোর মত ঘিরে এল, তাতে জোর করে নিয়ে যাওয়া কতটা নিরাপদ হবে বুঝছিল না সে।

***

রাব্বি দারবালের মত ড্রাইভার কপাল করে পাওয়া যায়। ঝড়ের মত পাহাড়ি বাঁকে জীপ ছুটছিল। হ্যান্ডল আঁকড়ে বসে বসে অরুণ সেটাই ভাবছিল। শুধু অসামান্য দক্ষতায় পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাতে পারেন তাই নয়, রাব্বির ঠান্ডা মাথা আর উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ করতে সে বাধ্য।

“পিশাচের দৃষ্টি পড়েছে নাকি! এখন লাশ না নিয়ে নিজেদের নিয়ে ভাবো ভাই! এখন এত বেলা হয়ে গেছে, শোধন করে টরে লাশ দাহ করতে তো দিন ফুরিয়ে যাবে, তারপর রাতে? আবার পিশাচ আসলে? আবার দাহ শেষ না করে পালালেও তো পাপ লাগবে! তার চেয়ে বলো তো আমরা একদল সেপাই পাঠিয়ে দিই, গ্রাম পাহারা দেবে রাত্রে।”

এক কথায় ভিড়ের মন ঘুরে গেল।

“কাল ভোরে বডি পৌঁছে দেব, বুঝলেন না? আপনি পুজো শোধন যা করার করে, দুপুর দুপুর কাজ মিটিয়ে সবাই মিলে নিচে নেমে যান এখন কদিন।”

পুরো পরিস্থিতি তখন রাব্বির দখলে।

লোকটার ছেলেটা ঠ্যাটামি করছিল, কিন্তু পুরোহিতই এবার ধমক দিয়ে বোঝাল তাকে।

“সবার ভালো ভাবতে হবে, খালি নিজের কথা ভাবলে হবে!”

বডি জীপের পিছনে ম্যানেজ করে তুলে, দুজন কনস্টেবলকে গ্রামেই চৌকি রেখে চলে এসেছে এখন তারা। সোজা নেমে যাবে মুন্সিয়ারির ডাক্তারবাবুর কাছে। পুরোহিত লোকটি সম্ভবত বিরক্ত হয়েছিল, কিন্তু ওরা আসার আগে মন্দিরটা দেখে প্রণাম করে আসতে গেছিল, তখন, হয়তো অভ্যাসবশেই ওর হাতে শালপাতা মোড়া নির্মাল্য ফুল তুলে দিয়েছিলেন তিনি।

মুখে বলেছিলেন, “বড় সাবধানে থেকো বেটা আজ রাত। তুমি আইলাচাশের শিকার তুলে নিয়ে যাচ্ছ... আমার মন বড় কু ডাকছে তোমার জন্য। এটা রাখবে সঙ্গে সারাক্ষণ।”

ভক্তিভরে সযত্নে সে আশীর্বাদ নিয়েছিল অরুণ। পুলিশ হতে পারে, তা বলে দেবদ্বিজে ভক্তি থাকবে না কেন!

***

দিনের আলো যত ঢলছিল, পুলিশ পাহারার উপর ভরসাও চলে যাচ্ছিল গ্রামবাসীদের। তাই ঘন রাত্রে যখন সমস্ত গ্রাম আগের দিনের মতই নিশ্চুপ, ছমছমে হয়ে গেল, আর পুলিশ দুজনকে দেখা গেল মন্দিরের চাতালে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে, তখন দীননাথ পুরোহিত একটুও অবাক হলেন না।

তাঁকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়িয়েছিল দুজন। ইঙ্গিতে বসতে বলে ভিতরে যেতে গিয়েও থমকে গেলেন তিনি।

বয়স হলেও চোখ এখনও বাজপাখির মত ধারালো তাঁর। পিছনের গাছটার আড়ালে ছায়ামূর্তির সরে যাওয়াটা তাঁর চোখ এড়াতে পারেনি।

ইতিকর্তব্য ঠিক করতে বেশিক্ষণ লাগেনি তাঁর।

“আমি আরেকটা মন্ত্রপড়া দিয়ে আসতে ভুলে গেলাম ভাই! ঘুরে আসছি, এই যাব আর আসব। “

“জি, সঙ্গে আসব?”

“না না, এ কাজ একা করতে হয়। তোমরা দুজন ভিতরে গিয়ে বোসো না, আগুন আছে, ঠান্ডা কম লাগবে।”

বলার যা দেরি। হুপ করে লাফ মেরে ভিতরে যাওয়া দেখে হাসিই পেয়ে গেল দীননাথের। এরা নাকি গ্রাম রক্ষা করবে!

পিছনদিকে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না এখন। সামনের দিকে সহজ পায়ে এগিয়ে গেলেন তিনি, ঘুরে ফিরে আসবেন কিছু দূর থেকে।

***

অন্ধকার। মুড়ি দেওয়া লোকেদের চোখমুখ দেখা যায় না। কিন্তু গলা চেনা যায়।

এ গ্রামের সবার গলা চেনেন দীননাথ।

“এবার? যদি?”

“কী যদি! কিচ্ছু হবে না। সব ভালোয় ভালোয় মিটে যাবে।”

“পুলিশ তো টের পেল...”

“ধুর। না বললে কী জানবে!”

“গাঁও খালি হয়ে গেলে...”

“আরে কে কদিন বাইরে থাকবে। কিছু হল না দেখে সব ফিরে আসবে। নর্মাল হয়ে যাবে আবার।”

“কিন্তু পুলিশ...”

“দূর তোর পুলিশ! দেখছিস তো দুই মক্কেলকে। ও অফিসারের একটু বেশি ইয়ে... চুপ থাক। কিছু হবে না।”

“তাহলে...”

“হ্যাঁ। চুপ থাক। কালই মিটে যাবে। কাগজপত্তর সব সামলে রেখেছি, একটু এদিক শান্ত হলেই ওদিকের সব গুছিয়ে ফেলব। তোদেরও হিল্লে করে দেব। মুখ বন্ধ করে থাক, ব্যস।”

ওরা চলে যাওয়ার পরেও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন দীননাথ। কপালে ভ্রূকূটি। তারপর ধীর পায়ে ফিরে এলেন মন্দিরের দিকে।

***

ওরা অনেকক্ষণ পৌঁছে গেছিল গ্রামের কাছাকাছি। ছায়ায় পার্ক করা সকালে পাঠানো জীপটার পাশে এখন আসা জীপের ভিতরে বসে অরুণ অপেক্ষা করছিল উপযুক্ত সময়ের।

ঐ যে সবাই ফিরে আসছে এবার, সারি বেঁধে।

পুরোহিত সবার আগে, সঙ্গে লোকটার ছেলেটা।

জীপ থেকে নেমে বড় বড় পায়ে এগিয়ে গেল অরুণ।

“আপনি, আবার? কী চাই?”

ছেলেটিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে পুরোহিতকে বলল অরুণ—

“সেদিন যজ্ঞ কোথায় করেছিলেন?”

“মন্দিরে, আবার কোথায়! কেন?”

“দেখব। চলুন।”

সারিটা এতক্ষণে ছত্রখান হয়ে গেছে। সবাই এক পা দু পা পিছে হটে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।

“এই, তুমিও চলো।”

ছেলেটার উদ্ভ্রান্ত চোখমুখ, পুরোহিতের কড়া চোখের ইশারা, কোনোটাই চোখ এড়াল না অরুণের।

মন্দিরের মেঝে বড় বড় চৌকো পাথরের। যেমন হয়। যজ্ঞের ছাই দাগ রয়েছে মাঝে এক জায়গায়।একটা দরজা ছাড়া জানলাবিহীন বন্ধ ঘর। উপরে ছোট ঘুলঘুলি দুটো।

কল্পনায় সেদিন কী হয়েছিল ভাবার চেষ্টা করছিল অরুণ। এই ঘর। যজ্ঞের মাঝে এরা ঘর থেকে বেরোল। বাবা, ছেলে আর পুরোহিত।

বাবা ফেরেনি আর। বাকি দুজন কে কখন ফিরেছিল?

এই জরুরি প্রশ্নটা সেদিন সে করতে ভুলে গেছিল। আজ আর ভুল হবে না।

“সেদিন আপনারা একসঙ্গেই ফিরেছিলেন কি?”

দীননাথ, সামান্য ইতস্তত করেন উত্তর দেবার আগে।

“প্রায়। একটু আগে পরে। আমি আগে এলাম, ব্রিজেন্দর পিছিয়ে পড়ছিল, আমার এসে বাকি কাজ শেষ করার তাড়া ছিল। ওকে জলদি আসতে বলে আমি এগিয়ে এসেছিলাম।”

অরুণ ব্রিজেন্দরের দিকে তাকায়।

“পিছিয়ে পড়ছিলি কেন? কী করছিলি?”

দৃশ্যত কেঁপে গেল ব্রিজেন্দর। দেখতে দেখতে মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।

“আমিও তো তক্ষুনি এলাম ... জি... পিসাব লেগেছিল তাই একটু...”

“তাই ঐ রাস্তা অবধি ফিরে যেতে হল? পাথরটা আগে থেকেই তুলে সরিয়ে রেখে এসেছিলি, না?”

দীননাথ ঘাড় ঘুরিয়ে এদিকে চেয়ে আছেন। ছেলেটা ঠকঠক করে কাঁপছে এবার।

“তাই তো? ফিরতে অনেক সময় নিয়েছিল তো সেদিন?”

মাপা, স্থির গলায় উত্তর এল—

“হ্যাঁ। অনেক। আমি ভাবছিলাম কী হল। ভেবেছিলাম একটু পিছনেই আছে, তাও চিন্তা হচ্ছিল। খুঁজতে পাঠাব রাখাকে, এসে গেল। হাঁপাচ্ছিল। অত গা করিনি তখন।”

ব্রিজেন্দর কেমন একটা ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলে, “সময় কই? একটুই তো... আপনি এমন বলছেন কেন এখন...”

স্থির চোখে ছেলেটাকে দেখে অরুণ। মাথায় দ্রুত আরো কিছু হিসাব মেলায়।

না, পোস্ট মর্টেমে কিছু বিশেষ পাওয়া যায়নি। পেটে কিঞ্চিৎ বেশি পরিমাণ আফিম ছাড়া। সে এদিকের লোকের জলভাত, তা দিয়ে খুব যে কিছু বলা যায় তা নয়।

কিন্তু লটারি লেগে গেল চেনা উকিল মিশ্রজীকে দিয়ে খোঁজখবর করাতেই। মুন্সিয়ারিতে অমন প্রাইম লোকেশনে হোটেলের মালিকানা। কেনা হয়েছিল বাবা ছেলে দুজনের নামেই। ছ মাস আগে ছেলের নাম বাদ দিয়ে খালি বাবার নামে নতুন করে রেজিস্টার হয়েছে সে হোটেল। একই সময়ে আরো একটা দোকান কেনা হয়েছে বাজারে, সেও শুধুই বাবার নামে।

ছেলে একমাত্তর কিন্তু। ওয়ারিশ সেই। ব্যাপারটা খেয়াল করার মত দৃষ্টিকটু।

তারপর, জানা গেল ছেলের নামে বাজারে দেনার পরিমাণটাও কিছু কম নয়। মিশ্রজীর চেনা শেঠের কাছেই ধার আছে বড় অঙ্কের।

হিসাবটা সোজা হয়ে গেছিল তখনই।

কিন্তু, তারপরেও একটা বড় প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।

দীননাথের চোখ তাঁকে মাপছে বুঝতে পারে অরুণ।

ঝুঁকিটা নিয়েই নেয় সে।

“টাকায় বিকাও হলেন, দীননাথজি? কত দিয়ে কিনে নিল এই হোটেলের মালিক, আপনাকে?”

ফাটকাটা লেগে গেল। দীননাথ মুখ খোলার আগেই ব্রিজেন্দর চেঁচিয়ে উঠল, “মালিক? মালিক? তবে যে বললেন হোটেল উইলে আপনার নামে লিখে দিয়েছে বাবা... আমি এক পয়সাও পাব না আপনি কিছু ব্যবস্থা না করলে...?”

দীননাথ তীব্র গলায় “ফালতু কথা, ফালতু কথা... আমি এসবের কিচ্ছু জানি না” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। ব্রিজেন্দর বিস্ফারিত চোখে দীননাথের দিকে চেয়ে ছিল, কথা শেষ হওয়া মাত্র খ্যাপা কুকুরের মত লাফিয়ে পড়ল পুরোহিতের উপর।

তবে কিছু করতে পারল না। অরুণ সতর্ক ছিল, “খবরদার” চীৎকার করে জাপটে ধরে ফেলল তাকে।

তখনই, কথামত মন্দিরের দরজা ঠেলে ঢুকল চারজন কন্সটেবল, নতুন দুজন যারা আজ এসেছে অরুণের সঙ্গে, আর পুরোনো দুজন যারা ছিল কাল। সেই সঙ্গে গ্রামের আরো দুজন মাতব্বর। শিউশরণ নেগী আর জনকরাম চন্দ।

“কাল কথায় কথায় যা শুনেও খেয়াল করিনি, আজ সকালে তা মনে এল। পুরোহিত কাল তাঁর সব চেষ্টার কথা বলার সময়ে বলেছিলেন দু-দুবার গ্রাম বন্ধন করেছেন... তার মানে তিনি একবার নয়, মন্দির থেকে আসলে দুবার বেরিয়েছিলেন যজ্ঞ চলাকালীন। কী, তাই তো?”

মাথা হেলিয়ে সায় দেন জনকরাম। শিউশরণ বলেন, “উনি আসলে গ্রাম বন্ধন বলেনওনি, আগুন নিয়ে আরতি করতে করতে বললেন প্রদক্ষিণ করে আসতে হবে, আমরা যেন বসে থাকি একাসনে। এখন মনে পড়ছে জানেন, মন্দির প্রদক্ষিণ করতে যত সময় লাগার কথা তার চেয়ে বেশ দেরি করেই ফিরেছিলেন, হাঁফিয়েও গেছিলেন। তখন ব্যাপারটা কিছুই মনে হয়নি... পূজার কাজ তো, কত কী করতে হয়...”

ব্রিজেন্দরের থেকে বাকি কথা বার করে নিতে এরপর আর বেশি বেগ পেতে হল না। ভেঙেই পড়েছিল ছেলেটা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, সে শুধু হুকুম তামিল করতেই অভ্যস্ত। পুতুলনাচের সুতো ধরা ছিল পুরোহিত দীননাথ বালিয়ার হাতে। লোভটা সম্ভবত যতটা টাকার, ততটাই ক্ষমতা-প্রতিপত্তির। ব্রিজেন্দরকে বোঝানো হয়েছিল তাঁকে সব দিক দিয়ে বঞ্চিত করা হচ্ছে, লোকটার ব্যবস্থা করলে দীননাথ নিজে হোটেলের মালিক হয়ে আধা ওর নামে করে দেবেন, তাছাড়া গ্রামের মুখিয়াও সে-ই হবে, সেও এক বড় ইজ্জতের ব্যাপার। নইলে, রাঘবের যা মতিগতি, ওকে কোনদিন না ত্যাজ্য করে আর কাউকে মুখিয়া করে যায়!

হতভাগা ছেলেটা লেখাপড়া কিছু শিখে থাকলেও, ফুর্তি করে করে সব ভুলে গেছে। কাপজপত্র যে নিজে খুলে দেখবে, সেটা মাথায়ও আসেনি তার। যা শুনেছে তাই বিশ্বাস করে নিয়েছে। বাবা যে তাকে অপছন্দ করে, এ তো নতুন কথা নয়!

দীননাথ লোকটার স্টিলের নার্ভ বলতে হবে, এর পরেও সে সমানে সবকিছু অস্বীকার করে যাচ্ছিল। ব্রিজেন্দরকে মিথ্যুক বলে গালিগালাজও করছিল।

কিন্তু অরুণের একটা কথায় জোঁকের মুখে নুন পড়ল।

“কাল আমায় আশীর্বাদী ফুল পাতার মোড়কটা দিতে গিয়েই ভুলটা করে ফেলেছেন ঠাকুরমশাই। আমি ওটা অতি সতর্ক ভাবে ধরেছিলাম যাতে আপনার আঙুলের ছাপ অক্ষত থাকে। কেন, তা এখন বলতে পারব না, পুলিশি অভ্যাসই হয়তো। কিন্তু যে পাথর দিয়ে পিশাচ সেজে রাঘবের মাথা ফাটিয়েছিলেন, তার সঙ্গে যে ছাপগুলো মিলে গেল! ঐ পাথরটাও যে আমরা খুঁজে তুলে নিয়ে গেছি দেখেননি হয়তো? ওই আরেক ভুল আপনার, পাথরটা অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে ফেললে এত সহজে পেয়ে যেতাম না। ফেললেন তো ফেললেন, দশ হাতের মধ্যেই ফেললেন! পুলিশের চোখ মশাই, শুকনো হলেও রক্তের দাগ চোখে পড়ে। অবশ্য আপনি পুলিশ আসবে সেটাই তো আশা করেননি, তাই না!”

এইবার দীননাথের মুখ নীরক্ত ফ্যাকাশে হয়ে মাথা ঝুঁকে গেল, মুখ দিয়ে আর টুঁ শব্দটিও বেরোল না। দুজনকে হাতকড়া লাগিয়ে জিপে তোলার পর, বাকি দুই মক্কেলকে, মানে সুন্দরলাল আর জুবিনকে ধরে এনে বেঁধে গাড়িতে তুলে ফেলতে খুব বেশি সময় লাগল না। এদের দেখেই ভয়ে ভেঙে পড়ে দোষ স্বীকারও করে নিল দুজনে।

একটা বানানো গল্প বলে মুখিয়াকে ভয় দেখাতে হবে, শুধু এটুকুই বলেছিল নাকি তাদের ব্রিজেন্দর। টাকা দিয়েছিল, ওরাও মজাক ভেবে করে দিয়েছিল। এরকম খুনখারাপি হবে জানলে তারা হারগিজ এর মধ্যে জড়াত না। তারপর ভয়ে যখন কাঁটা হয়ে গেছে, কাল রাত্রে পুরোহিত নিজে ওদের বার বার করে আশ্বাস দিয়েছিলেন কিচ্ছু হবে না, তিনি আছেন। সবার হিল্লে হয়ে যাবে হোটেলের কাগজপত্রের কাজ মিটে গেলেই।

বলতে গিয়ে দুজনেই যে রেটে চেঁচামেচি গালাগালি করতে লাগল, তাতে কোর্টে সাক্ষীর অভাব হবে না, বুঝে গেল অরুণ।

সূর্য ঢলে এসেছে। নরম কমলা রোদে মায়াময় দেখাচ্ছে নিচের উপত্যকা। জীপে উঠে বসার আগে ঘুরে একবার সাধারণ, গরীব আর বোকাসোকা মানুষে ভরা ছোট্ট গ্রামটার দিকে তাকাল অরুণ। মনটা ভার হয়ে উঠছিল তার।

আইলাচাশ গল্পকথা হতে পারে, কিন্তু এই গ্রাম এক ক্ষমতালোভী পিশাচের খপ্পরে পড়েছিল, সত্যিই! রাঘব মুখিয়ার বলি চড়ে গেল সেই পিশাচের লোভের পায়ে।

কে বলে পিশাচ অপ্রাকৃত জীব! সে তো যেকোনো সময়ে যেকোনো চেহারা নিয়েই আমাদের আশপাশে ঘুরে বেড়াতে পারে, তাই না?