Tri-মাত্রিক ● সৌরভ ঘোষ


 

 

যে পৃথিবীর মায়ায় লালিত হয়েছে এই মানব সভ্যতা সেই আদিম, অকৃত্রিম সৃষ্টিকে জানতে মানুষ বারেবারে আশ্রয় নিয়েছে বিজ্ঞানের। আর যে জ্ঞানে সে যুক্তি খুঁজে পায়নি তাকে দিয়েছে অলৌকিকের তকমা। মানুষ দাম্ভিক। তার দম্ভ চিরকাল তার এই স্থূল, জৈবিক আবরণ নিয়ে। এদিকে বয়স ছাড়া এই দেহঘড়ির সময় মাপার যন্ত্র বিকল। কিন্তু মানুষ? সে ঈশ্বরের দানকে প্রশ্ন করে এসেছে সেই আদি-অনন্ত শিশুসময় থেকে। যৌবন পরবর্তী জরাই কি জীবনের শেষ দশা? নাকি সেটা মুক্তির অন্য আরেক মাত্রার নাম? বুদ্ধিমান প্রাণী যুগের পর যুগ খুঁজে চলেছে সেই উত্তর। ঠিক যে কারণে গৌতম বুদ্ধ গৃহত্যাগ করেছিলেন। বড় নির্মম ছিল সেই নীল জ্যোৎস্না।

 

ভারি চোখের পাতা দুটো জোর করে খোলার চেষ্টা করেও যেন খুলতে পারল না সুবিমল। বেয়াদব এক ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে তার সারা শরীর, অবশ, নিশ্চল। ঘরের কোনায় কোনায় আলকাতরার মতো অন্ধকার জেঁকে বসেছে, তবে খুব অস্পষ্ট হলদেটে সবুজ আভা খেলে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। ঝাপসা চোখে যতদূর ঠাহর হচ্ছে এটা কোনো একটা ল্যাবরেটরি। ঘরের চারধারে বিশালাকৃতির, এক মানুষ সমান কাচের বয়াম রয়েছে বেশ অনেকগুলো, আর তার প্রতিটার ভেতরেই রয়েছে কোনো অস্বচ্ছ, ঘোলাটে হলুদ তরল পদার্থ। মাঝে মাঝে বুদবুদ কেটে উঠছে। ঘরের সিলিং আর মেঝে জুড়ে রেডিয়ামের উজ্জ্বল সবুজ আভায় ছোট-বড় আকারের একটাই চিহ্ন এদিক ওদিক ছড়িয়ে রয়েছে। একটা উজ্জ্বল সবুজ বিন্দু, তাকে কেন্দ্র করে উল্টোভাবে আঁকা একটা সমবাহু ত্রিভুজ। প্রথমে একটু অদ্ভুত মনে হলেও পরে বুঝতে কোনো ভুল হয়নি। এই চিহ্ন সুবিমলের চেনা। এই চিহ্নের উল্কি সে আগেও দেখেছে চৈত্র সংক্রান্তিতে কলকাতার চড়কের মেলায়। কিন্তু সেদিনের সেসব যাদু-তামাশা কেমিস্ট্রি অনার্স এক যুক্তিবাদী যুবকের মনকে কোনোভাবেই টলাতে পারেনি। সুবিমল বারবার একই কথা বলেছে ছোটকাকে—

“এসব পাবলিক স্টান্ট! টাকা কামানোর ধান্দা। ওসব ক্ষমতা-টমতা বুজরুকি।”

তবে আজ? আজ সে জানে না কী করণীয়! এই অজ্ঞাত প্রবাসে সে একা।

 

ফিরে দেখা: চড়কের মেলার প্রথম উপলব্ধি

ঘটনাটা প্রথম থেকে শুরু করতে গেলে বছর সাতেক পিছিয়ে যেতে হবে। উত্তর কলকাতার মানিকতলায় একটা ভাড়াবাড়ির বাসিন্দা সুবিমলরা। পরিবার বলতে বাবা, মা আর তার খুব কাছের ছোটকা। সেও ছোটকার খুব আদরের। ছোটকা তাকে ‘বিনু’ বলে ডাকে। দুজনের বয়সের ব্যবধান হরে-গড়ে দশ-বারো বছরের বেশি নয়।

ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভীষণ ভালো সুবিমল, বিশেষত বিজ্ঞান বিভাগে। অন্য বিষয় যে পড়তে একবারেই ভালো লাগে না তা নয়। তবে স্কুলের সিলেবাস যেন বড্ড রসকষহীন। আর যা পড়ানো হয় সেসব সে আগেই ছোটকার মুখ থেকে গল্পের আকারে শুনেছে। কবিতাপাঠ, ঐতিহাসিক গল্প বলার অভিব্যক্তি, নিখুঁত মানচিত্র আঁকার হাত, ছোটকার এইসব গুণগুলোই ছোটবেলায় নকল করার চেষ্টা করত সুবিমল। বয়স বাড়ার সাথেসাথে সেসব নিয়ে জানা, আর তাকে নিজের মত করে গ্রহণ করার ঝোঁক আরও বেড়ে গেল তার।

এই সব গুণের ভেতর ছোটকার আরও যে একটা নেশা ছিল, তা হল মেলায় ঘোরার। সেই তালিকায় কলকাতার বইমেলা থেকে শুরু করে চড়ক বা রাসের মেলার মত ছোট কোনো মেলাই বাদ যেত না। সে অবশ্য একা নয়, ল্যাঙবট হিসেবে সুবিমলও সঙ্গে সঙ্গে ঠিক জুড়ে যেত। প্রত্যেক মেলার ইতিহাস, মেলার বৈশিষ্ট্য ও তার প্রধান আকর্ষণ এসবই ছোটকা চোখ বুজে বলে যেত তার একমাত্র মুগ্ধপ্রায় শ্রোতা ‘বিনু’কে। তবে দুজনের মতভেদের একটাই দেওয়াল ছিল তা হল ‘যুক্তি’। মনের মিল সেখানে শূন্যই ধরা চলে। ছোটকা আধ্যাত্মিক, ঈশ্বরে অন্ধবিশ্বাসী মানুষ। কিন্তু সুবিমল বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে ওঠায় যুক্তি দিয়েই সব কিছু বিচার করতে চায়।

 

ঘটনাটা ঘটলো সেবারের চড়ক-সংক্রান্তির মেলায়। সুবিমলের কলেজে ফাইনাল পরীক্ষার শেষে ছুটির আমেজ, ছোটকাও চড়কের মেলার হুজুগে মাতোয়ারা। উত্তর কলকাতার প্রাচীন, ঐতিহ্যশালী কয়েকটা স্থান যা বর্তমানে হেরিটেজ বলা চলে, তাদের ভেতর বিডন স্ট্রিট সংলগ্ন ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাজার একটা বিশেষ নাম। সেখানকার বহু প্রাচীন চড়ক সংক্রান্তির মেলার নামও রয়েছে কলকাতার ইতিহাসে এক বিশেষ স্থানে। অনেক উঁচু জায়গা থেকে সন্ন্যাসীদের ঝাঁপ, জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে হেঁটে চলা, আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তক্ষুনি বেরিয়ে আসা, এইসব অতিমানবিক কীর্তিকলাপ দেখতে মানুষের ঢল প্রায় উপচে পড়ে মেলা প্রাঙ্গণে।

আজ সেখানে দর্শক হিসেবে সুবিমল আর ছোটকাও মশগুল। মেলার মাঝখানে এক বিশাল, লম্বা খুঁটি পোঁতা হয়েছে। তার মাথায়, উঁচুতে আরও দুটো মাঝারি সাইজের খুঁটি ক্রশ চিহ্নের মত ব্যালেন্স করে রাখা হয়েছে, যা প্রায় ঐ লম্বা খুঁটিটাকে কেন্দ্র করে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরতে পারে। অনেকটা ঠিক মেরি-গো-রাউন্ডের মত। আর তার চারকোণার চারদিক থেকে নেমে এসেছে হুক সমেত শক্তপোক্ত মোটা মোটা নারকেল দড়ি। সেই হুক সন্ন্যাসীরা তাদের পিঠ বা পেটের চামড়ার সঙ্গে বিঁধিয়ে শরীরটাকে সম্পূর্ণ শূন্যে ছেড়ে দিয়ে লম্বা খুঁটির চারধারে গোল হয়ে ঘুরছেন। মাঝে মাঝে মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলে উঠছেন “জয়! বাবার জয়” আর শরীরের সঙ্গে বাঁধা লাল কাপড়ের খুঁট থেকে ভিড়ের ভেতর ছড়িয়ে দিচ্ছেন কুচো ফুল, চিড়ে, খই। এইসব দেখতে দেখতে ছোটকা কপালের কাছে দু-হাত জড়ো করে এনে বলল—

“দেখছিস বিনু এই সমস্ত ভাব, ভক্তি কঠোর সাধনার জোর ছাড়া সম্ভবই নয়।”

ভুরু কুঁচকে সুবিমল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো এমন সময় হঠাৎ মেলার সমস্ত খোল-করতাল, খঞ্জনির আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। অর্ধ-নগ্নপ্রায় সন্ন্যাসীদের দলটার মধ্যে থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল—

“হারিৎবাবা আ রহে হ্যায়। হাটো ইঁয়াহা সে!”

 

হারিৎ বাবার আবির্ভাব

একটু অস্বস্তি হল সুবিমলের। সামনের ভিড়টা সরতেই দৃশ্যটা স্পষ্ট হল। এক জটাজুটধারী, অর্ধ-নগ্ন সাধুবাবা ভিড়ের ভেতর থেকে ক্রমশ এগিয়ে আসছেন। তিনি এতটাই লম্বা যে ভিড়ের যেকোনো কোনা থেকে তাঁর মুখ দেখতে পাওয়া সম্ভব। উচ্চতা সাত ফুটের কাছাকাছি। মুখ অবশ্য মিশকালো দাড়ি, গোঁফেই ঢাকা। তবে চোখের ভেতরের কোটরের মণি দুটো উজ্জ্বল, দৃপ্ত। সে দুটো যেন এক অদ্ভুত সবুজাভ দীপ্তিতে জ্বলছে। নাক, কান, ভুরু শরীরের বিভিন্ন অংশে লোহার মাকড়ি চকচক করছে। নগ্ন শরীরের মাঝে মাঝে ধূসর রঙের ছাই-ভস্ম লেগে থাকলেও যেন চামড়া চীরে হাল্কা সবুজাভ আভা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। মুখ ও পেশীর সঙ্গে রেখা ফুটে উঠছে নীলাভ শিরা-উপশিরার। বাবাজির এই গড়ন থেকেই তার নামের উৎপত্তি সেটা বুঝে নিতে অবশ্য অসুবিধে নেই। সংস্কৃতে ‘হরিৎ’ অর্থাৎ সবুজ তার থেকেই এসেছে ‘হারিৎ বাবা’।

শরীরের সর্বত্র ছোট-বড় উল্কিতে ভরা চাঁদ, সূর্য, তারা। যে ব্যাপারটা লক্ষণীয় সেটা বাবাজির পিঠের কারুকার্য। সারা পিঠ জুড়ে আঁকা পদ্মফুলের ওপরে অধিষ্ঠিত এক দেবীমূর্তি, গাঢ় সবুজ গাত্র বর্ণ। গৌতম বুদ্ধের ভঙ্গিমায় নির্নিমেষ, স্নিগ্ধতায় ভরা দুচোখে তির্যকভাবে চেয়ে আছেন। ডান হাতটা বিশ্রামের ভঙ্গিতে ডান পায়ের হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত। বাঁ-হা্তের তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের যোগে আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাতটা উন্মুক্ত, সুউচ্চ বাঁদিকের নগ্ন স্তনটিকে আবৃত করে আছে। কামুকতা আর মৃদু হাসিতে মাখা উজ্জ্বল মুখশ্রী নিয়ে ইনি যেন গৌতম-বুদ্ধেরই নারীরূপ। দেবীর নাভির নীচ থেকে সবুজ সুতোর মত আরও কী আঁকা ছিল ঠিক বোঝা গেল না। কারণ আঁকাটা বাবাজির প্রায় কোমর পর্যন্ত বিস্তৃত। আলো-আঁধারিতে, লোকের ভিড়ে অস্পষ্ট। সেই দেবীমূর্তিকে ঘিরে গোল করে আঁকা অজস্র ছোটছোট ওল্টানো ত্রিভুজ যার কেন্দ্রে একটি করে বিন্দু। এমনকি বাবাজির পেশীবহুল হাতেও আঁকা সেই ওল্টানো ত্রিভুজ আর কেন্দ্রে একটি বিন্দু। শরীর জুড়ে রহস্যময় এই উল্কি কী এক অদ্ভুত গঠনশৈলী সৃষ্টি করেছে।

এবারে তিনি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে কপালে দু-হাত জড়ো করলেন। তারপর জ্বলন্ত কয়লার ওপর খালি পায়ে হাঁটতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু ভক্তির চেয়ে বেশি কী এক অজানা যান্ত্রিকতা লুকিয়ে আছে বাবাজীর হাবে-ভাবে। সেটা সুবিমলের নজর এড়াল না। মেলার লোকে ভক্তি ভরে ছলছল চোখে ‘জয় বাবা’ বলে উঠল, কেউ কেউ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। জ্বলন্ত কয়লায় হাঁটা হয়ে গেলে বাবাজি এগিয়ে যেতে লাগলেন কাঁটা বেছানো পথের মধ্যে দিয়ে এক প্রকান্ড অগ্নিকুণ্ডের দিকে। সবই যেন কেমন একটা নিয়মানুবর্তিতা, একটা প্রিন্সিপ্যাল।

ঠিক এই সময় একটা কাণ্ড ঘটল। হঠাৎ ভিড়ের ভেতর কোথা থেকে এক শীর্ণকায় মহিলা, ময়লা-ছেঁড়া কাপড়ে আছড়ে পড়লেন বাবার পায়ের কাছে। তার কোলে বছর দুয়েকের একটা শিশু। প্রথমে বাবার পা দুটো জড়িয়ে ধরে কাতর কন্ঠে কেঁদে উঠলেন মহিলা। তারপর বললেন—

“দয়া করুন বাবা। আমি এই কাছের বস্তিতে থাকি। আমার ছেলে বিকেলে ঘরের মেঝেতে হামাগুড়ি দিতে গিয়ে হঠাৎ হাত পিছলে পড়ে যায়। মাথার ডান পাশে চোট লাগে। তারপর থেকে ছেলে আমার আর কথা বলছে না...”

কথাগুলো শেষ হল না। বাবাজি মহিলার কোল থেকে বাচ্ছাটার চোয়াল দুটো পাশবিকভাবে এক হাতে ধরে শূন্যে উঠিয়ে নিলেন। তারপর ভুরু দুটো কুঁচকে হুঙ্কার ছাড়তে লাগলেন। তাঁর মাথার শিরাগুলো যেন ফুলে উঠতে লাগল এক সবুজ আভায়। বাবাজীর হাতের লম্বা, সরু আঙুলগুলো সাপের মত আষ্ঠেপৃষ্ঠে পেঁচিয়ে ধরেছে বাচ্চাটার মাথা থেকে গলা অবধি কচি মুখটাকে। কিন্তু সুবিমল যেটা এক ঝলক দেখে চমকে উঠল ওটা কী? বাবাজীর সেই বিকট কুৎসিত মুখ থেকে লম্বা জিভের মত কী একটা খুব দ্রুত বেরিয়ে এসে বিঁধিয়ে দিল বাচ্চাটার কানের পাশে কোথাও। একটা সবুজের ঝলকানি যেন শিশুটার মুখ হয়ে মাথা অবধি খেলে গেলো। আর তারপরেই বাবাজি শিশুটাকে আস্তে আস্তে ফিরিয়ে দিলেন মহিলার কাছে। খুব আস্তে শোনালেও শিশুটা বোধহয় ‘মা’ বলল। মহিলা আবারও লুটিয়ে পড়লেন বাবার পায়ে। চারদিকে জয়ধ্বনি উঠল। বাবাজি হাত দুটোকে আকাশের দিকে তুলে হুঙ্কার ছাড়লেন। যেন মেঘনাদ সহস্র মেঘ ভেদ করে বিজয়ডঙ্কা ঘোষণা করছে। সেই স্বরে এক অদ্ভুত সম্মোহক শক্তি আছে। ভক্তিতে অন্ধ মানুষ না জানুক সুবিমল জানে সেই স্বর কোনো জাগতিক প্রাণীর নয়, সেই শব্দ পৃথিবীর চেয়েও আদিম।

তাঁর গলার স্বর এই শত শত মানবসমুদ্রের মাঝেও কেমন অদ্ভুতরকমের ভারী আর যন্ত্রের মত ঘড়ঘড়ে শোনাল। সুবিমল এরকম অদ্ভুত দানবাকৃতির, এলিয়েন গোছের মানুষ আগে কখনও দেখেছে কিনা মনে করতে পারল না। আর এই সব তন্ত্র-মন্ত্রতে ওর একেবারেই অরুচি। সে খানিকটা হতভম্ব আর বিরক্ত হয়েই ছোটকাকে বলল, “অনেক হয়েছে! বাড়ি যাই চলো।” ছোটকা তখনও প্রণাম করতে ব্যস্ত। সুবিমলের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর অবস্থা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলল, “আচ্ছা চল।”

 

হাঁটা পথে ফিরতে ফিরতে দুজনের মধ্যে বিশেষ কথা হল না। পকেট থেকে দুদিন আগের পেপারকাটিংটা বার করে ছোটকাই প্রথম মুখ খুলল। গত দুদিন ধরে এই ‘হারিৎবাবা’এর আবির্ভাবের রহস্য খবরের কাগজে ছোটকা পড়ছে। তাই দেখতে আসার খুব ইচ্ছে ছিল। বাবাজি কোথা থেকে আবির্ভূত হয়েছেন সে সম্পর্কে অবশ্য কেউ জানে না তবে কলকাতা শহরের চড়কের মেলায় এই প্রথম।

সুবিমল মুচকি হেসে বলল, “উনি কি মানুষ? দেখো কোনো রোবট বানিয়ে হয়তো এইসব বুজরুকি আর পয়সা কামানোর ধান্দা চলছে। তবে বাবাজীর শরীরের উল্কিগুলো কিন্তু সুন্দর।”

সব শুনে ছোটকা জোরে হেসে উঠল, বলল, “তা তোর যখন উল্কিগুলো ভালোই লেগেছে ওগুলোর মানে নিশ্চয়ই বুঝেছিস।” সুবিমল ঘাড় নাড়ল, ‘না’।

ছোটকা বলল—

“বেশ। তোকে হয়তো এর আগে আমি অনেক গল্পেই বলেছি। হিন্দুধর্মের দেবদেবীদের সঙ্গে যে বৌদ্ধধর্মের অনেক দেবদেবীর মিল রয়েছে সেসব তুই জানিস। হিন্দুধর্মের দশমহাবিদ্যার ভেতর দ্বিতীয় স্থানে হলেন দেবী ‘তারা’। ‘তারা’ কথার অর্থ হল শক্তি। সবুজ গাত্র বর্ণের এই দেবী, সংসারে বিঘ্ননাশ করতেই এসেছেন। অন্যদিকে তিব্বতী বৌদ্ধধর্ম অনুসারে বলা হচ্ছে মানুষের কষ্ট দেখে ভগবান বুদ্ধের চোখের জল থেকেই এই দেবীর উৎপত্তি হয়েছে।

আমরাও এই দেবীকে মাতৃশক্তি হিসেবে একই উদ্দেশ্যে পুজো করে থাকি। তবে মূর্তির গঠন আলাদা। কিন্তু তন্ত্র অনুসারে এই দুই মতবাদের উৎসই সমান। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা মনে করে এই মাতৃশক্তি থেকেই মানবজাতির সৃষ্টি। লক্ষ্য করে দেখ তাই মূল ছবিতে দেখানো হয়েছে দেবীর নাভির নীচ থেকে নির্গত অসংখ্য নাড়ি, যা থেকে সৃষ্টি হয়েছে মানুষ। সভ্যতার শ্রেষ্ঠ, উন্নত মানুষ।”

হরিৎ বাবার মুখটা মনে পড়তেই সুবিমল প্রশ্ন করল, “সবুজ মানুষ? মাথা আর মুখটা বাদে আমি তো বেশ হিন্দু ধর্মের ব্রহ্মার সঙ্গে মিল পাচ্ছি। আচ্ছা আর ঐ ত্রিকোণ মত যা আঁকা ছিল ওগুলো কী?”

ছোটকার থেকে সুবিমলের এইসব শুনতে বেশ ভালোই লাগে একটা আগ্রহ তৈরি হয় কিছু সময়ের জন্য। কিন্তু এর সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো ভিত্তি নেই। ছোটকা একটু মুচকি হেসে বলল—

“ঐ চিহ্ন বহু প্রাচীন। বাবাজী যে মাতৃশক্তির উপাসক তাতে সন্দেহ নেই। ঐ চিহ্ন হল সৃষ্টি এবং স্রষ্টার। ত্রিভূজের কেন্দ্রের বিন্দু হলেন স্রষ্টা। এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বর। আর তাকে ঘিরে রয়েছে সৃষ্টি। অর্থাৎ ত্রিভুজের তিনটি বিন্দুর রহস্য হল মানুষের সৃষ্টি রহস্য। মন, দেহ এবং আত্মা, ত্রিমাত্রিক। আবার আমরা এও বলে থাকি সৃষ্টি, স্থিতি, লয়।

ত্রিভুজ যদি ঊর্ধ্বমুখী হয় তার মানে হল পিতৃশক্তির উৎস, আর নিম্নমুখী হলে মাতৃশক্তি। যেটা তুই আজকে দেখলি, সেটা মাতৃশক্তি। বিভিন্ন দেশের বহু প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে এর উল্লেখ আছে। কেন তোর ওই ক্রাইস্ট অব সেন্ট জনের গল্পটা মনে নেই? যীশুর ক্রুশবিদ্ধ অবস্থা ভালো করে লক্ষ্য করে দেখিস, ওঁর দুটো হাত ও জড়ো করা পায়ের বিন্দু সংযোগে এক ত্রিভুজ স্থাপন হচ্ছে আর মাথা বা মুখটাকে কেন্দ্রের বিন্দু ধরে নিতে পারিস। অনেকে ভার্জিন মেরীকেই মাতৃশক্তি হিসেবে দেখেন। খ্রিষ্ট ধর্মে তাই তো দুটোভাগ।”

সুবিমলের বেশ ভালো লাগল এই জায়গাটা। ছোটকা ব্যাপারটা অত বিজ্ঞানসম্মতভাবে বোঝাতে না পারলেও সুবিমল কিন্তু বুঝেছে। সত্যিই এক সুন্দর জ্যামিতি লুকিয়ে আছে এর ভেতরে। ছোটকা একটু থেমে বলল, “জরামুক্তি। মানে অনন্ত যৌবন। সবুজ মানেই তো তাই। মৃত্যুঞ্জয়।”

 

সুবিমল এবং গবেষণা

এরপর কেটে গেছে তিনটে বছর। সুবিমল কেমিস্ট্রিতে মাস্টার ডিগ্রী শেষ করেছে সবে। পারিবারিক টানাপোড়েনে চাকরির কথাই তখন সে ভাবছে। বাবার রিটায়ারমেন্টটা না হলে পি.এইচ.ডি.-টা অন্তত করার কথা ভাবা যেত। তার মূল গবেষণার বিষয় তেজস্ক্রিয়তা, অর্থাৎ ইউরেনিয়াম বা রেডিয়ামের মত তেজস্ক্রিয় মৌলের তেজস্ক্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে শুধুমাত্র ক্যান্সার বা যে কোনো মারণব্যাধির হাত থেকে শুধু নিষ্কৃতিই নয়, এমনকি মানুষের শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে আরও শক্তপোক্তভাবে গড়ে তোলা এই তার লক্ষ্য।

বলাই বাহুল্য মাস্টার ডিগ্রীতে সে দুর্দান্ত একটা রেজাল্ট করেছে। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি ডিপার্টমেন্টের সমস্ত প্রোফেসরদের সুনজরে এখন সুবিমল। কমবেশি সবার বাড়িতেই যাতায়াত আছে ওর। প্রোফেসরদের উৎসাহ ও সাহায্য ছাড়া তার আজকের এই সাফল্য সম্ভব ছিল না। তাঁদের সবার মধ্যে ডক্টর প্রণবকান্তি দত্তের অবদান সব থেকে বেশি। প্রণব স্যার বলতে অজ্ঞান সুবিমল। সেও প্রণববাবুর স্নেহধন্য। রিসার্চের বিষয় উৎসাহ দেওয়া থেকে শুরু করে, ল্যাবের কাজ, খুঁটিনাটিতে সুবিমলের সকল পারদর্শিতার পেছনে রয়েছে প্রণববাবুর অক্লান্ত পরিশ্রম। তাই রেজাল্ট হাতে নিয়ে সুবিমল প্রণববাবুকে নমস্কার করতেই, প্রণববাবু ওর মাথায় আশীর্বাদের হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, “আরও বড় হও। তবে যাত্রা এখানেই শেষ নয়। চাকরি-বাকরির কথা কিছু ভাবছিস, না কি সেসব পি.এইচ.ডি এর পরে?”

লজ্জা মেশানো কাঁচুমাচু মুখে চুপ করে রইল সুবিমল। এবারে প্রণববাবু একটু হেসে বললেন, “তোর জন্য আমার কাছে একটা অফার আছে। তোর রেডিও অ্যাক্টিভিটি নিয়ে হিউম্যান ইমিউনোলজির ওপর থিসিসটা বেশ কয়েকটা চেনাজানা ফরেন ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়েছিলাম। তাদের ভেতর অনেকে প্রশংসা করে মেইলের উত্তর দিয়েছেন। যিনি বিশেষ উৎসাহ দেখিয়েছেন তিনি হলেন নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক ইউনিভার্সিটি থেকে প্রোফেসর হ্যামিং। ডক্টর হ্যামিং বহু বছর ধরে এই ফিল্ডে রিসার্চ করে চলেছেন। এমনকি ওঁর একটি রিসার্চ টিমও বর্তমানে ব্লু-বেরী নামক রেডিয়ামের খেলনা প্রস্তুতকারক মার্কিন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। তোকে ওঁরা চান। অফকোর্স উইথ স্কলারশিপ আর টিম ওয়ার্ক থেকে যা অ্যালাউএন্স আসবে। তুই রাজী আছিস?”

সুবিমলের বুকটা আনন্দে ভরে ওঠে, এই প্রস্তাব কি প্রত্যাখ্যান করা যায়! সে জানে বাবা, মা আর তাঁদের থেকেও বেশি ছোটকা, খুব খুশি হবে এই খবরে। সুবিমল প্রসন্ন এক হাসিতে সম্মতি জানায় প্রণববাবুর দিকে চেয়ে।

এরপর কেটে গেছে আরও একটা বছর। ইউনাইটেড স্টেটের দক্ষিণে অবস্থিত নর্থ ক্যারোলিনা। ডিউক ইউনিভার্সিটি তারই একটা ছোট্ট শহর ডারহ্যামে। বেশ স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া এখানকার। বছরের প্রায় বেশিরভাগ দিনটাই বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। ইউনিভার্সিটির কাছেই একটা ছোট অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়ায় নিয়েছে সুবিমল। ইউনিভার্সিটির প্রোজেক্ট, রিসার্চ টিমের আলাদা মিটিং সিডিউল, এসব নিয়ে পুরোপুরি কাজের মধ্যে ব্যস্ত সে। এই এক বছরে অবশ্য অনেক কিছু শিখেওছে, তার থিসিসও এগিয়েছে অনেকদূর।

শুধু ব্লু-বেরী নয় গোটা ইউনাইটেড স্টেটের প্রায় ৭০ শতাংশ খেলনা প্রস্তুতকারক কোম্পানি আছে যারা খেলনার সঙ্গে রেডিয়াম ব্যবহার করে থাকে। অনেকরকম প্রতিরক্ষার পরেও প্রত্যেক বছর সমীক্ষায় গড়ে প্রতিটা কোম্পানির কর্মচারীর শরীর থেকে প্রায় ৩০০ মিলিগ্রাম করে রেডিয়াম পাওয়া যায়। যার ফলে ক্যান্সার বা হাড়ের পচন ও অন্যান্য মারণব্যাধিতে মৃত্যু ঘটছে তাদের।

তাই ইউনাইটেড স্টেটের বেশ কিছু ইউনিভার্সিটির রিসার্চ টিম ভারপ্রাপ্ত হয়েছে এই নিয়ে রিসার্চ চালানোর জন্য। যেমন সুবিমলদের টিমের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন প্রোফেসর হ্যামিং নিজে। ভদ্রলোক ব্যক্তিবিশেষে কর্মঠ এবং বড়ই উদার। সর্বদাই যেন সাহায্যের হাত বাড়িয়েই আছেন। রিসার্চের দলটাকে সবসময়েই উৎসাহ জুগিয়ে যান তিনি।

সব টিমের থেকে সুবিমলদের কাজটা একটু অন্যরকম, মূল কাজটা লাইপোফুশ্চিন নিয়ে। লাইপোফুশ্চিন হল হলুদ ও খয়েরী রঙের এক প্রকার দানা সদৃশ পদার্থ, যা মানবদেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ যেমন পাকস্থলির, কিডনির আবরণে, বিশেষত মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রে থাকা লিপিড প্রোটিনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে। সেইখানের সমস্ত মৃত ও জীর্ণ কোষগুলোকে ধ্বংস করে সেই অঙ্গকে রক্ষা করে। শরীরে লাইপোফুশ্চিনের উৎপাদন ক্ষমতা দেখে সেই প্রত্যঙ্গের বয়সকাল নির্ণয় করা সম্ভব। সুবিমলদের কাজ হল তেজস্ক্রিয় পদার্থের বিকিরণে এই লাইপোফুশ্চিনে থাকা খনিজ, জৈবিক অ্যাসিড ও কার্বন এইসবের অনুপাত থেকে ক্যান্সার বা অন্যান্য মারণ রোগের প্রবণতা নির্ণয় করা।

এত কাজের ফাঁকেও সুযোগ পেলেই উইকেন্ডগুলোয় বেরিয়ে পড়ে সে। কেপ হ্যাটেরাসের লাইট হাউজ, শারলটের মত ঐতিহাসিক জায়গা, অ্যাশভিলের মত আর্টিস্টিক জায়গার কথা সে একসময় অনেক শুনেছিল ছোটকার কাছে। এখন ছুঁয়ে দেখার পালা। আজকাল ছোটকার কথা খুব মনে পড়ে তার। মা-বাবার সঙ্গে যদিও কথা হয় মাঝে মধ্যে। তবে খানিকটা মিথ্যের আশ্রয় সুবিমলকে নিতেই হয়। কারণ বাড়ির কেউই এখনও ট্রিনিটির কথা জানে না। সুবিমলের সঙ্গে ঘুরতে ট্রিনিটিও আসে মাঝে মধ্যে।

ট্রিনিটি সিয়াং, বছর ছাব্বিশের এক জাপানী তরুণী। সেও ডিউক ইউনিভার্সিটিতে সুবিমলের সহপাঠী এবং রিসার্চের কাজে সহকর্মী বলা যেতে পারে। মা আমেরিকান আর বাবা জাপানিজ হওয়ায় ট্রিনিটির দেহের বাঁধুনি ও মুখের গঠন বাঁধাধরা জাপানিজ নারীদের গঠনের থেকে একটু আলাদা। চোখদুটো টানা তবে যথেষ্ট চওড়া, টিকালো নাক। উচ্চতায়ও যথেষ্ঠ লম্বা। পাতলা পাপড়ির মত দুটো ঠোঁট যেন সর্বদাই তৃষ্ণার্ত। সুবিমল আর ট্রিনিটি আপাতত বন্ধু। সুবিমলের দুর্বলতার কথাটা সে বিগত ৬ মাস যাবৎ বুঝতে পারলেও, মনে মনে সেও বোধহয় ব্যাপারটা উপভোগ করে। আর সুবিমলও কখনও সামনাসামনি কিছু বলেনি।

 

তবে এই ৬ মাসের মধ্যে আজ এতদিনে সুবিমলের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। আজ কলেজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় সে মনস্থির করেই নিয়েছে ট্রিনিটিকে সব জানাবে।

ফেরার পথে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকদূর এগিয়ে গেল। ট্রিনিটি একবার মৃদু হেসে আড় চোখে সুবিমলকে প্রশ্ন করল, “বাড়ি ফিরবে না?” সুবিমল হাল্কা হাসিতে দুদিকে ঘাড় নাড়ল। তারপর সে জানালো ট্রিনিটিকে বাড়ি অবধি এগিয়ে দিয়েই ফিরে আসবে আবার। ট্রিনিটি বারণ করলেও আজ সে বারণ শুনলো না সুবিমল। ট্রিনিটির বাড়ি অবধি এই প্রথম এল সে।

 

সুবিমল এবং ট্রিনিটি

ট্রিনিটির বাড়িটা একতলা। আগাগোড়া পুরোটাই জাপানিজ রীতিনীতিতে বানানো। রাস্তার পাশে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে কয়েকধাপ উঠলেই সামনে পড়বে একটা কাঠের স্লাইডিং দরজা। সেটা পেরলেই ড্রয়িং রুম আর তার সঙ্গে লাগোয়া আরও তিনটে ঘর সঙ্গে সেই একই কাঠের স্লাইডিং দরজা। মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত সবেতেই কাঠের ওপর বেশ সুন্দর কারুকাজ করা সমস্তটা জুড়ে। জাপানী বেশ কিছু লোককথা আঁকা প্রায় সবকটা দেওয়ালে। জায়গাটাও বেশ শান্ত। মনেই হয় না শহরেরই ভেতরের কোনো জায়গা। যদিও এক অদ্ভুত গা ছমছমে নিস্তব্ধতা রয়েছে চারপাশে।

ট্রিনিটি এই বাড়িতে একাই থাকে শুনে প্রথমে একটু অবাকই হয়েছিল সুবিমল। মা বাবা নাকি থাকে সাউথ ক্যারোলিনার দিকটায় সেখানে সে উইকেন্ডে মাঝে-মাঝে যায়। সত্যি মেয়েটার সাহস আছে! মনে মনে ভাবল সুবিমল। বাড়ির ভেতরটায় ঢুকতে প্রথমটা ইতস্ততই করছিল সে। ট্রিনিটিই জোর করে হাত ধরে নিয়ে আসল। দেওয়ালে আঁকা লোককথাগুলো মোহিত হয়ে দেখছিল সুবিমল।

ট্রিনিটি পাশের একটা ঘরে ঢুকেছিল বোধহয় চেঞ্জ করতে। এই ফাঁকে দেওয়ালের আঁকাগুলোর থেকে চোখ সরিয়েই মনে মনে প্রস্তুতি নিল সুবিমল। যা যা বলবে ভেবেছিল আরও একবার ঝালিয়ে নিল বিড়বিড় করে। মুখচোরা প্রেমিকদের রিভিশনের দরকার হয় বৈকি। নার্ভাস সে, এখানেও বোধহয় ছোটকার থাকার দরকার ছিল।

ট্রিনিটি এবারে ঘরে ঢুকল। তবে ওর দৃষ্টিভঙ্গি যেন একবারে অন্যরকম। সবই জানে সে এরকম একটা ভাব। ঠোঁটের কোণে এক তাচ্ছিল্যের হাসি। সুবিমলের দিকে এগিয়ে এল আসতে আসতে। কপালের ঘাম মুছে, এলোমেলো চুল ঠিক করে সুবিমল কিছু বলতে যাচ্ছিল। ট্রিনিটি তাড়াতাড়ি করে ডানহাতটা আলতোভাবে ধরল সুবিমলের মুখের ওপর। তারপর হাতটা আস্তে আস্তে সরিয়ে নিজের পাতলা তৃষ্ণার্ত ঠোঁট দুটো যোগ করল সুবিমলের ঠোঁটের সঙ্গে। সুবিমল চোখ বুজল। দুহাত দিয়ে ট্রিনিটির বাঁকা কোমরটাকে জাপটে ধরে আরও কাছে টেনে আনল নিজের।

 

সেই ঘোরে কেটে গেলো কত সময় তা ওর খেয়াল নেই। ঘোর যখন কাটল তখন অনেকটাই সময় পার হয়ে গেছে। বিকেল প্রায় গড়িয়ে গেছে। কিন্তু হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস দেখে চমকে উঠল সুবিমল। ট্রিনিটির ঠোঁট থেকে থুতনির কাছ অবধি সবুজ রঙের কী একটা লেগে। আর ওর জিভ?! এত সরু, এত ছুঁচল! এ মানুষের জিভ হতেই পারে না। জিভটা লম্বা হওয়ায় সেটা যেন বাইরে বেরিয়ে ঝুলে পড়েছে মুখের থেকে।

ট্রিনিটির মুখে লেগে থাকা সবুজ তরলটা হাত দিয়ে মুছতে গেল সুবিমল। কিন্তু শরীরটা যেন হঠাৎ টলে উঠল তার। এক অজানা ক্লান্তিতে ভারী হয়ে এল সারা শরীর। ভীষণ এক আশ্চর্য ঘুমে নেমে আসছে চোখের দুটো পাতা। ঝাপসা চোখে দেখল সুবিমল... ট্রিনিটি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মুখের হাসিটা যেন আরও ক্রূর হয়ে উঠছে সময়ের সঙ্গে, চোখে উজ্জ্বল সবুজের দীপ্তি। কিন্তু টানা চোখ দুটোয় এক প্রশান্তির ছাপ, পড়ন্ত বিকেলের হাল্কা রোদ্দুর মুখে এসে পড়েছে ট্রিনিটির। মুখ থেকে এক সবুজাভ আভা ছড়িয়ে পড়ছে। এই মুখ তার ভীষণ চেনা। ঠিক এরকমই... হ্যাঁ এরকমই অনেকটা কোথায় যেন দেখেছে সে। মনে পড়েছে সেই চড়কের মেলায়, বাবাজির উল্কি। কথা জড়িয়ে গেলো সুবিমলের মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এল, “তা-আ-আ-আ-র”।

 

এই অবস্থায় সে কতক্ষণ ছিল জানা নেই। জোর করে চোখ খোলার চেষ্টা করল এবারে। একটা বিশাল বড় ঘরের ভেতর সে শুয়ে আছে, সম্ভবত ল্যাবরেটরি। ঘরের কোণায় কোণায় অন্ধকার জেঁকে বসেছে। ঘরের মেঝে আর সিলিং সেই উল্টো ত্রিকোণ চিহ্নে ভরা।

চড়কের মেলা ফেরত ছোটকার বর্ণনা মনে পড়ল সুবিমলের। নাহ্! এখানে আর এক মুহূর্ত না। ঘুম কাটাতে সে দুহাত দিয়ে চোখ দুটো ভালো করে রগড়ে নিল। গায়ের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল এবার। ঘরটা সম্ভবত মাটির নিচে কারণ সিলিঙের ওপরে অনেক দূর থেকে গাড়ি চলে যাওয়ার আওয়াজ এল স্পষ্ট।

পকেটের মোবাইলটা থেকে এবারে সে ফ্ল্যাশলাইটটা অন করল। চারদিকের নিস্তব্ধ অন্ধকার আর কাঁচের বয়ামগুলো যেন ওকে ওৎ পেতে দেখছে। প্রকৃতির কী এক অজানা রহস্য দানা বেঁধে আছে এই পাতালঘরের কৃষ্ণ গহ্বরে। আসতে আসতে ফ্ল্যাশ লাইটটা হাতে নিয়ে বয়ামগুলোর দিকে এগিয়ে গেল সে। আগে খেয়াল হয়নি, বয়ামগুলো এক একটা ক্রায়োটিউব। ঘরের মেঝে, বয়ামের আশেপাশে অবিন্যস্তভাবে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফাইল, খাতার সাদা পাতা। তাতে তীরচিহ্ন দিয়ে কিসব লেখা, কিছু যৌগের ফর্মুলা আঁকা আর কিছু রাসায়নিক সমীকরণ। কয়েকটা জায়গায় ছড়িয়ে আছে বড় সাইজের হিউম্যান অ্যানাটমি চার্ট ও মানবদেহের কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দানবাকৃতির ছবি। তার বিশেষ বিশেষ অংশে মার্কার পেনে মার্ক করে কিসব লেখা অন্ধকারে ঠিক বোঝা গেল না।

ঘরের একদম বাঁদিকের কোণে একটা ছোট কম্পিউটার স্ক্রিন নজরে পড়ল। এতক্ষণ লক্ষ্যই করেনি সুবিমল। এরই আলোতে ঘরে একটা সবুজ আভার রেশ রয়েছে তা এবার পরিষ্কার হল। তবে এই কম্পিউটারের মনোক্রম মনিটর বর্তমানে বিরল। মনোক্রম কারণ, এটার স্ক্রিন একরঙা উজ্জ্বল সবুজ, ফসফর স্ক্রিন। ৮০ এর দশকের মাঝামাঝিতে খুব প্রচলিত হলেও এরপর বিশ্বব্যাপী এর উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।

কম্পিউটারটার সামনে গিয়ে কীবোর্ডে এলোপাথাড়ি কতকগুলো বাটন টিপল সুবিমল। বিশেষ কিছু লাভ হল না শুধু ‘কোঁক – কোঁক’ দু-তিনবার আওয়াজ হল। স্ক্রিনটা যেরকম সবুজ সেরকমই রইল। হাতের ফ্ল্যাশলাইটটা নিয়ে এবারে পড়ে থাকা খাতার পাতা আর ফাইলগুলোর দিকে এগিয়ে গেল সে। ওই ছড়িয়ে থাকা স্তূপের ভেতর থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে ফ্ল্যাশলাইটটা তার ওপর ফেলল। খাতার পাতায় লাইপোফিউশ্চিনের উৎপত্তির সমীকরণ ও জটিল গঠন প্রণালী আঁকা রয়েছে। কিন্তু পাতার শেষ অবধি পড়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল সুবিমলের।

 

মানবদেহের লিপিড প্রোটিনের সঙ্গে অন্যান্য জৈবিক কণার জারণের ফলে উৎপত্তি হয় লাইপোফুশ্চিনের। এই ব্যাপারটাকে আরেকটু বর্ধিত করা হচ্ছে এখানে। রেডিয়াম-২২৮, এই আইসোটোপটার আশ্চর্যভাবে একটা পরিমাপক তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহার করা হয়েছে এই সমীকরণে। লাইপোফুশ্চিন তৈরি হওয়ার ঠিক প্রাগ মুহূর্তে এই তেজস্ক্রিয়তা দিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে মলিকিউলার বন্ডগুলোকে। যা তৈরি করছে কার্বন ও হাইড্রোজেন সংযোগে ত্রিভুজাকৃতির এক নতুন গঠন। যার কেন্দ্রে ভারসাম্য রক্ষ্যার্থে রয়েছে অক্সিজেন, অর্থাৎ ‘O’। সেই ত্রিভুজ চিহ্নের কেন্দ্রবিন্দু। এই যৌগ আবার সঙ্গে সঙ্গে জৈবিক অণুর সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে উৎপাদন করছে লাইপোফুশ্চিনের। আগের চেয়ে আরও দ্রুতগতিতে। তবে তার রঙ আর হলদেটে খয়েরি নেই। সেটা ধারণ করেছে এক বিশেষ সবুজাভ রঙ।

এ যে অবিশ্বাস্য, অসম্ভব! সুবিমল এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে হাতে ধরা খোলা পাতার দিকে। এর মানে শরীরের যেকোনো ক্ষয় বা ক্ষত এই পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

 

ত্রিমাত্রিক! ছোটকার কথা কানে বেজে উঠল ‘সৃষ্টি, স্থিতি, লয়’। হাত দুটো কেমন ঠান্ডা হয়ে এল সুবিমলের। সে কাগজের স্তূপে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিভিন্ন কাগজে শুধু শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের, স্নায়ুতন্ত্রের ছবি আর লাইপোফুশ্চিনকে নানান জৈবিক গঠনে দেখার প্রচেষ্টা।

পাশেই পড়ে ছিল একটা লালচে ধুলোমাখা ফাইল। ওটাও টেনে তুলল সুবিমল। প্রথম ছবিটা তার চেনা। তার ছোটকার বর্ণনায়, আর বাবাজীর উল্কিতে আঁকা বৌদ্ধদের সেই দেবী। ওঁর নাভি থেকে বেরিয়ে এসেছে একগুচ্ছ নাড়ি তার সঙ্গে লেগে এদিক ওদিকে ছড়িয়ে রয়েছে মানুষ। সবুজ মানুষ! কী এক অদ্ভুত সৌন্দর্য রয়েছে এই ছবিতে।

তার ঠিক পরেই পাতা উল্টে হাড় হিম হয়ে এল সুবিমলের। সে এই কথা আগে কখনও চিন্তাই করেনি। সেখানে আঁকা দেবীর পরিবর্তে সেই সবুজ স্ক্রিনওয়ালা কম্পিউটার, তার একটি শাখা যুক্ত হয়েছে একটি বিশাল সিলিন্ডারে। তার গায়ে ব্র্যাকেট দিয়ে লেখা (২২৮ + লিপিড = এক্স-লাইপোফুশ্চিন) সেই সিলিন্ডার যুক্ত হয়েছে একটি বিশাল আকৃতির বয়ামে পাইপের মাধ্যমে। যার ভেতর রয়েছে অ্যামিনো অ্যাসিড ও আরও কিছু জৈবিক অ্যাসিডের মিশ্রণ। সেই পড থেকে অনেকগুলো পাইপ গিয়ে মিশেছে বিভিন্ন বয়াম বা পডে। সেখানে ডি.এন.এ সংরক্ষণ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়েছে। সৃষ্টি হবে সভ্যতার শ্রেষ্ঠ মানুষ।

সবুজ মানুষ!

তার মানে ওই পাইপগুলোই হল দেবীর নাভি থেকে বেরিয়ে আসা নাড়ি। আর ওই সবুজ কম্পিউটারটা...? আর ভাবতে পারছে না সুবিমল। ঘামে ভিজে যাচ্ছে সারা শরীর।

 

এবারে ফ্ল্যাশলাইট হাতে ধীরে ধীরে ঘরে রাখা ক্রায়োটিউবগুলোর দিকে এগিয়ে গেল সে। প্রথম বয়ামটার ভেতর যা আছে সেটা তখনও আবছা বোঝা যাচ্ছে। সেটা ভ্রূণ অবস্থায় রয়েছে, সুপ্ত। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সেই বিকৃত মাংসপিন্ডটা। স্বাভাবিক ভ্রূণের চেয়ে আকৃতিতে বেশ বড়। ত্বকে সবুজের আভা।

পরের বয়ামে যেটা আছে সেটা ঠিক ভ্রূণ নয়। এটার বেশ বৃদ্ধি ঘটেছে, হাত ও পায়ের গঠন সুস্পষ্ট। এইভাবে বয়ামের পর বয়াম এগিয়ে চলল সুবিমল। বুঝতে ভুল নেই প্রতিটা জন্মের স্তর অনুযায়ী বয়ামগুলো রাখা হয়েছে। সর্বশেষ যে বয়াম সেটায় হলুদ তরল পদার্থ এতটাই গাঢ়, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

বয়ামের আরও কাছে মুখটা নিয়ে গেলো ও। হঠাৎ এক বিশাল, বিকট সবুজাভ হাত ধাক্কা মারল বয়ামের কাঁচের দেওয়ালে। ভয়ে আঁতকে উঠল সুবিমল। পরক্ষণেই কিসের একটা খুট্ খুট্ শব্দ হল। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে কেউ নীচে নামছে। সুবিমল তাড়াতাড়ি বয়ামের পাশে অন্ধকার দিকটায় সরে গেল।

ছায়াটা আসতে আসতে স্পষ্ট হল, ট্রিনিটি। চোখে সবুজের দীপ্তি জ্বলজ্বল করছে। শরীর থেকে অন্ধকারের মধ্যেও সবুজের আভা ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। ট্রিনিটিকে এই অবস্থায় আগে কখনও দেখেনি সুবিমল। তবে কি এরা নিজেদের আকার, আকৃতি বর্ণ বদলে ফেলতে সক্ষম? বুঝতে পারে না সুবিমল। বহুকাল আগে কোনো এক কল্পবিজ্ঞানের গল্পে শেপ-সিফটারদের কথা পড়েছিল সুবিমল।

দৃঢ় পদক্ষেপে সুবিমলের দিকেই এগিয়ে আসছে ট্রিনিটি, মুখে এক তৃপ্তির হাসির রেখা। অন্ধকারেও কি সে দেখতে পাচ্ছে? হাত দুটো দুবার পরস্পরের সঙ্গে ঘষল সুবিমল, একটা ঠান্ডা কাঁপুনি দিচ্ছে তার শরীরে। স্ত্রীদেহের উচ্চতা অনুপাতে ট্রিনিটির দীর্ঘকায় শরীর দেখে বুঝতে বাকি নেই সেও এই টিউবের ভেতর থেকে পূর্ণতা প্রাপ্ত এক মানুষ। সে এখন সুবিমলের খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

সুবিমলের মুখের কাছে মুখ এনে, চোখে চোখ রেখে একবার তাকাল ট্রিনিটি। মুখের থেকে লকলকে লম্বা জিভটা বার করে একবার ছুঁয়ে দিল সুবিমলের মুখটা। তারপর মৃদু হেসে মুখ ফিরিয়ে কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে সে এগিয়ে গেলো আসতে আসতে।

যেতে যেতে বলে চলল সে—

“এই প্রাচীন পৃথিবীর সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে তারা। সাধারণ মানুষের মধ্যেই মিশে আছে তাদের সত্তা। দৈহিক, মানসিকভাবে মানুষ দুর্বল। খুঁটিহীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ভিত্তিহীন সমাজব্যাবস্থায় সভ্যতা কোনোদিন উন্নত হতে পারে না। আর ঠিক সেই কারণে তারা পৃথিবীর কাছে প্রয়োজনীয়, প্রকৃতির কাছে প্রয়োজনীয়, মানুষ নয়। তাদের সংখ্যা বৃদ্ধিতেই এই সবুজ নীল গ্রহের মঙ্গল। তাদের চাই সুবিমলদের মত টাটকা, তেজিয়ান শরীর।

কম্পিউটার স্ক্রিনের পাশে দাঁড়িয়ে ট্রিনিটি আবারও ঘুরে তাকাল সুবিমলের দিকে, ঠোঁটের কোণায় এখনও সেই হাসি। সুবিমল পাথরের মত দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে দেখে যাচ্ছে ট্রিনিটিকে। এবারে কম্পিউটারের দিকে ফিরে, ঝুঁকে পড়ে ট্রিনিটি মন্ত্র উচ্চারণের ঢঙে কি বিড়বিড় করল। আর সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটারের উজ্জ্বল সবুজ স্ক্রিনে ফুটে উঠল সেই উল্টনো ত্রিভুজ চিহ্ন মাঝখানে একটা গাঢ় সবুজের বৃত্ত।

তারপর কম্পিউটারের লাগোয়া অন্ধকার জায়গাটা থেকে একটা খোলা পাইপের মত তার হাতে তুলে নিল ট্রিনিটি।

সুবিমল প্রথমে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেও আসতে আসতে সংজ্ঞা ফিরল। আড় চোখে একবার ও দুপাশে তাকাল। ওর ডানপাশে আরও হাত তিনেক এগোলে রয়েছে একটা ক্রায়োটিউব। তার ঠিক পাশেই হেলান দিয়ে দাঁড় করানো দুটো সিলিন্ডার, গায়ে লেখা ‘এল-নাইট্রোজেন’। লিকুইড নাইট্রোজেনের প্রয়োজন বুঝে নিতে অসুবিধে হল না সুবিমলের। বয়ামের ভেতরে থাকা শরীরগুলো পূর্ণতা পেলে, বিশালাকৃতি শরীরের মৃতকোষযুক্ত চামড়াকে শীতল করে এর সাহায্যে দূরীভূত করা হয়। আর সুবিমলের বাঁদিকে প্রায় হাত দশ এগোলেই ওপরে উঠে যাওয়ার সিঁড়ি।

কম্পিউটার স্ক্রিনের দিক থেকে কী এক অদ্ভুত ছন্দ মেশানো সুরে শব্দ ভেসে আসছে। যেন কোনো অতি প্রাচীন বৌদ্ধ সঙ্গীতের সুরের মূর্ছনা। কী এক সম্মোহনী শক্তি আছে সেই শব্দগুচ্ছে, কী অদ্ভুত সুর। আর স্ক্রিনের ত্রিভুজটা দপ্ দপ্ করে উঠছে সেই ছন্দে। সবুজ আভার জ্যোতি যেন মন্ত্রমুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। ঠিক যেন একটা অলীক হৃৎপিণ্ড।

শরীরটা আবার ক্রমশ অবশ লাগছে সুবিমলের। একটা ঘোরের মত। কিন্তু তার মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেলো তৎক্ষণাৎ। মনের জোরে কোনোরকমে ডানদিকে লাফিয়ে একটা সিলিন্ডার তুলে নিল সে। মরিয়া হয়ে সিলিন্ডারের মুখের দিকটা ট্রিনিটির দিক করে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটার প্যাঁচ খুলে গড়িয়ে দিল। আর আরেকটা সিলিন্ডার দুহাতে করে তুলে ধরে ট্রিনিটি আর কম্পিউটারটা যেদিকে আছে সেইদিকেই আছাড় মারার ভঙ্গিতে ছুঁড়ে দিল অন্ধকারে। এরপর কোনোদিকে না তাকিয়ে বাঁদিকের সিঁড়ির দিকে দৌড়ে গেল।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সুবিমল দেখল, ঘরের মেঝে তখন লিকুইড নাইট্রোজেনের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। ট্রিনিটির কোমর অবধি এক শক্ত সবুজাভ বরফের আচ্ছাদন উঠে এসেছে। সে কিন্তু এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে সুবিমলকে। তার চোখ দুটো ঘোলাটে। জিভটা একটা লম্বা শুঁড়ের মত বেরিয়ে এসেছে। যেন কোনো ক্ষুধার্ত অক্টোপাস ছটফট করছে সেই অন্ধকারে। সে চেয়ে আছে, নিস্পলক তার দৃষ্টি। সদ্য গড়ে ওঠা মোমের স্ট্যাচুর মত স্থির সে। তার ঠোঁটের কোণে এক অতৃপ্তির দ্যোতনা লেগে আছে।

 

সুবিমলের বুকটা একটুর জন্য ফাঁকা লাগল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল সে। সিলিন্ডারের আঘাতে কম্পিউটারটা বন্ধ হয়ে একদিকে কাত হয়ে পড়েছে। মাঝে মাঝে ওই ত্রিভুজ আকৃতির চিহ্ন জ্বলে উঠেই নিভে যাচ্ছে। এতক্ষণে সুবিমল লক্ষ করল ভালো করে, কম্পিউটারের মনিটরের সঙ্গে যুক্ত থাকা অসংখ্য সবুজ তার, স্নায়ুতন্ত্রের মতই মনিটারের সঙ্গে উপড়ে এসেছে যেন। ঠিক ধর থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দিলে যেমনটা হয়। ঘরটা আস্তে আস্তে লিকুইড নাইট্রোজেনের ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে।

সুবিমল কোনোরকমে দৌড়োতে দৌড়োতে সেই অন্ধ পাতাল ছেড়ে কখন রাস্তায় নেমে এসেছে খেয়াল করেনি। ঠিক যতটা প্রাণশক্তি থাকা দরকার সব নিয়ে আরও জোরে দৌড়ানোর চেষ্টা করল সে। কিন্তু শরীর যেন সে অনুরোধ শুনল না, জ্ঞান হারাল সুবিমল। এরপর আর কিছু মনে নেই, চারদিকে অন্ধকার নেমে এল।

 

ডক্টর হ্যামিঙের উপকার

হঠাৎ ট্রিনিটির ছবি ভেসে উঠল চোখের সামনে। সে খিলখিল করে হেসে যেন বলছে ‘মুক্তি চাই না...?’ ভয় চেঁচিয়ে উঠে চোখ খুলল সুবিমল।

সামনে ডক্টর হ্যামিং দাঁড়িয়ে। এটা একটা নার্সিংহোমের বেড। উনি সুবিমলের হাত দুটো ধরে আশ্বস্ত করলেন। সুবিমল কিছু বলার আগেই উনি বললেন আজ সকালে কলেজ যাওয়ার সময় রাস্তার ওপর চেনা কাউকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকতে দেখেই ডক্টর হ্যামিং এর সন্দেহ হয়। কাছে গিয়ে দেখেন সে আর কেউ নয়, সুবিমল। তক্ষুনি উনি সুবিমলের বাড়িতে খবর দিয়ে গাড়ি করে নার্সিংহোমে নিয়ে আসেন। বাড়ির সবাইও চিন্তিত ওর ব্যাপারে। এখন ওর জ্ঞান ফেরায় ডক্টর হ্যামিং একটু ভরসা পেয়েছেন।

ডক্টর হ্যামিং সুবিমলের সামনে থেকে সরে বেডের পাশে রাখা চেয়ারটা টেনে বসেন। গত রাতের ঘটে যাওয়া সমস্ত ঘটনা জানতে চান সুবিমলের থেকে। ঠিক এমন সময় পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল সুবিমলের। বাবার ফোন, ভিডিও কল। মা, ছোটকাকা চিন্তায় অস্থির। মা তো রীতিমত মন্দিরে পুজো দিয়ে লাল সুতোয় বাঁধা তাগা নিয়ে এসেছেন। যেন মোবাইল স্ক্রিনেই ঠেকিয়ে নমস্কার করালে বাঁচেন।

হাসি পেল সুবিমলের। পাশে ডক্টর হ্যামিংও ফোনের দিকে চেয়ে হাসছেন। কিন্তু ডক্টর হ্যামিঙের দিক থেকে চোখ সরল না সুবিমলের। ডক্টর হ্যামিঙের ঘাড়ের কাছে ওটা কীসের চিহ্ন? একটা ওল্টানো ত্রিভুজের কেন্দ্রে একটা ছোট্ট বিন্দু!