সাইরেন ● পরাগ ভূঞ্যা


 

 

‘আজ আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে। বিকেলবেলায় বজ্রবিদ্যুৎ সহ ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা...’

“ভাই রেডিওতে কেউ নিউজ শোনে? একটু পরে কি শ্যামা সংগীত চালাবি? ধুর তখন থেকে খালি তোর মান্ধাতা আমলের রুচি, জাস্ট নিতে পারছি না। বিট বালা গান লাগা। আছে, না ব্লুটুথ অন করব?” গাড়ির পেছন থেকে শঙ্খ বলে ওঠে।

মনীষ আর তর্ক এগোয় না, স্টিয়ারিং ধরে সামনে নজর দেয়। গেট টুগেদার মাটি করতে চায় না। শঙ্খ একটু বেশি পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা জিনিস পছন্দ করে। কলেজ থেকেই ভূত চেপেছে, এখনও যায়নি। এখন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার হয়ে বাপের টাকায় খায়। সঙ্গে প্রমিলাকে জুটিয়েছে। গান্ধর্ব মতে বিবাহ সম্পন্ন বউ। যদিও এর আগে টিনা, বুলবুল, অয়ন্তিকা ছিল। লিভ ইন ওর কাছে জলভাত।

পেছনের সিটে প্রমিলা আবার নাকি সুরে গান গেয়ে মনীষকে টন্ট্ করার চেষ্টা করে। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতন চলন্ত গাড়িতে সিগারেট ধরিয়ে ফেলে শঙ্খ।

সমস্ত রাগ হজম করে মনীষ ব্লুটুথ অন করে। তারপর বলপূর্বক অ্যাক্সেলেটরে চাপ দেয়। গাড়ি ফাঁকা রাস্তায় দুরন্ত গতিতে এগিয়ে যায়।

পাশে বসে থাকা অনির্বাণ মনীষকে কিছু একটা বলতে গিয়েও পরিস্থিতি বুঝে মুখে কুলুপ এঁটে বসে, বাঁদিকে সরে সরে যাওয়া ইউক্যালিপটাস গাছের ফাঁকে চেয়ে থাকে। দূরে নিঃসঙ্গ জলাভূমি। তাতে আলপথের ছক কাটা। সূর্য পশ্চিমে পাড়ি দিয়েছে। উত্তরের ঘন মেঘ ধীরে ধীরে প্রসার বাড়াচ্ছে। হয়তো একটু পরে বাজ পড়বে, বৃষ্টি নামবে।

পেছন থেকে আবার শঙ্খ আওয়াজ দেয়, “মনীষ তোর মনীষার কী হল? কলেজ পাস আউট হওয়ার পরও প্রেম ছিল? না লাখপতি বর জুটিয়ে তোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে?" বলেই একটু ফিক করে হেসে নেয় শঙ্খ।

মনীষ উত্তর দেয় না।

অনির্বাণ প্রতিবাদ করে, “ভাই পুরোনো লেবু চটকে কিছু লাভ আছে? সে তো তোর কলেজের বান্ধবী টিনাও তোকে ল্যাং মেরে পালিয়ে গেছে।”

টিনার নাম শুনে প্রমিলার যেন সম্বিৎ ফিরল।

―শঙ্খ ডার্লিং... তোমার টিনা নামে তো কোন এক্স ছিল না। এটা কোথা থেকে উদয় হল?

―না মানে অয়ন্তিকার ডাকনাম টিনা ছিল।

“আচ্ছা তাই!” প্রমিলা লাস্যময়ী কণ্ঠে বলে ওঠে, “তুমি কি জানো শঙ্খ তুমি মিথ্যে কথা একদম বলতে পারো না?”

“আহা তোমরা আবার কেন শুধু শুধু ঝগড়া করছ? টিনা শুধু শঙ্খ নয় আমার আর মনীষের গোটা সি এস ডিপার্টমেন্টের ক্রাশ ছিল। অয়ন্তিকাই শঙ্খের প্ৰথম প্রেম। আর তুমি দ্বিতীয়। মানে তুমি হলে শঙ্খের অদ্বিতীয়া।” বলেই মুচকি হাসল অনির্বাণ।

স্টিয়ারিং হাতে মনীষ চিমটি কাটে, “ওরম মনে হয়।”

পুরো ব্যাপারটা হজম করতে শঙ্খ সিগারেট ধরাতে যায়। অনির্বাণ ওকে বলে, “জানালা খুলে খা।”

বেশ রাগ হয় শঙ্খের। সে কাচ নামিয়ে জানালার কাছে গিয়ে লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাতে যায়, আর প্রায় সেই মুহূর্তেই বাঁদিকের আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে। খুব কাছেই পড়েছে। শঙ্খ বেসামাল হয়ে যায়। হাত থেকে লাইটার জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়।

―গাড়ি থামা মনীষ। লাইটার পড়ে গেছে। ওই একটাই লাইটার সম্বল।

একরাশ বিরক্তি নিয়ে মনীষ গাড়ি থামায়। শঙ্খ গাড়ি থেকে নামতে যাবে ঠিক তখনই―

‘আজ আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে। বিকেলবেলায় বজ্রবিদ্যুৎ সহ ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা...’

না... শব্দের উৎস গাড়ির মিউজিক সিস্টেম নয়; আসছে বাইরে থেকে। শুনলে মনে হবে কারখানার সাইরেন বাজছে। খাপছাড়া, নয়েজ-ভর্তি। তবে অপ্রতিরোধ্য মাদকতা বজায় ছিল তাতে।

গাড়ির ভেতরের চারজন নিশ্চুপ। স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সামনের দিকে। গাড়ির হেড লাইট গিয়ে পড়েছে ফাঁকা রাস্তায়। ঠিক তার মাঝখানে একজোড়া গাছের সরু কাণ্ড উদয় হয়েছে। সহজাত ধূসর রং নয়, কেমন একটা বিদঘুটে লালচে কালো রঙের। তার ওপর নীচের দিকে রাজ্যের কাদা লেগে, জল ঝরে পড়ছে। যেন কেউ সদ্য জলাভূমি থেকে দুটো গাছ উপড়ে বসিয়ে দিয়ে গেছে।

প্রমিলার উত্তেজনার বাঁধ ভেঙ্গে যায়।

পেছন থেকে প্রমিলার চিৎকার শুনে স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে থাকে মনীষ। তারপর ব্যাক গিয়ারে গাড়ি ঘোরানোর প্রস্তুতি নেওয়ার আগে সামনে নজর বুলিয়ে নেয়। চমকে ওঠে মনীষ। ওটা কোনো গাছের কাণ্ড নয়... চামড়াবিহীন শুকিয়ে যাওয়া মাংসপেশি সমেত দুটো পা... এবং ওটা অস্থির, জীবন্ত।

শব্দটা আবার হয়। এবার যেন একই ট্র্যাক, একে অন্যের ওপর ওভারল্যাপ হলে যেরম শোনাবে, কিছুটা সেই রকম। মনীষের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে প্রাণপণে উল্টোদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়ি পেছনে নিতে ব্যস্ত।

অন্যদিকে লম্বা লম্বা পা ফেলে অবয়বটা গাড়িটির পিছু নিয়েছে। ওটা এতটাই লম্বা যে গাড়ির ভেতর থেকে কেবলমাত্র পা জোড়া ছাড়া আর কিছু দেখা সম্ভব নয়।

কিন্তু কৌতূহল বড়ই নাছোড়বান্দা।

অনুসন্ধিৎসু অনির্বাণ উইন্ডস্ক্রিনের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করে। তারপর চমকে গিয়ে সিটে গা এলিয়ে দেয়।

অবয়বটা লম্বা লম্বা পা ফেলে গাড়ির পেছনে ধাওয়া করেছে। ওর গতির কাছে একটু পরেই মনীষদের আত্মসমর্পণ করতে হবে।

আবার সশব্দে বাজ পড়ে। পেছন থেকে শঙ্খের ভীতগ্রস্থ কণ্ঠ, “সাইরেন হেড...”

মনীষ বুঝতে পারল, তার হাত স্টিয়ারিংয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে...

 

দুই

রিসার্চ ফ্যাসিলিটি নয়, বরং দুর্গ বলা ভালো। টপ-ক্লাস সিকিউরিটি, আগ্নেয়াস্ত্রের প্রাচুর্য, শ’খানেক নিরাপত্তারক্ষী― কী নেই! দুর্গই বটে, যার বেতাজ বাদশা হল সুমিত দত্ত।

কনফারেন্স রুমে বসে সুমিতকে দেখে বেশ রাগ হয়।

“প্রোজেক্ট সাইরেন কি আশার আলো দেখবে? আমার অর্গানাইজেশন জলের মতন টাকা ঢালতে পারবে না। কোনো জবাব আছে সুমিতবাবু!” টেবিলের ওপর চাপ্পড় মেরে প্রশ্নটা ছুঁড়লাম। সুমিত দত্ত খুব শক্তিশালী ও বেপরোয়া হয়ে যাচ্ছে। ওকে থামাতেই হবে।

কনফারেন্স রুমে পিন ড্রপ সাইলেন্স।

উল্টোদিকে সুমিত দত্ত নির্বিকার। হাতের ইশারায় সামনে বসে থাকা প্রতাপকে প্রোজেক্টর অন করতে বলে। তারপর খুব ধীরে ধীরে বলে ওঠে,

―বুঝলেন মি. গুহ। যে যত বড়ই ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হয়ে যাক না দিনের শেষে প্রোডাক্ট বিক্রি না হলে কিস্যু হয় না। আর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসার ইতিহাসে আবিষ্কারই আসল ভূমিকা নিয়েছে। কাজেই দ্বিতীয়বার মিষ্টতা বজায় রেখে কথা বলবেন। টুয়েন্টি পার্সেন্ট শেয়ার আমারও আছে। ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে ছেলেখেলা করব না।

কথায় এর সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না। একই প্রশ্নের তিনটে উত্তর দিতে ওস্তাদ। ঘুণপোকার মতন কোম্পানিটা শেষ করছে। বেশ রাগের স্বরে বলি,

―কিন্তু দিনের পর দিন কোনো রিপোর্ট না এলে কী করে হবে!

“আপনাকে রিপোর্ট দিতে আমি অক্ষম। ক্ষমা করবেন।” মোলায়েম সুরে কথাটা বলেই সুমিত দত্ত বেশ দৃঢ় কণ্ঠে আদেশ দিলো, “প্রতাপ!”

প্রতাপ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। প্রোজেক্টর স্ক্রিনের কাছে গিয়ে তোতাপাখির বুলি আওড়াতে লাগলো,

―“বায়ো ওয়েপন হিসেবে মারণ ভাইরাস বিগত কয়েক বছরে খুব একটা সুবিধে করতে পারেনি। মূলত নিয়ন্ত্রণহীন বলে, ভিক্টিম যে কেউ হতে পারে। তার ওপর অ্যান্টিডোট বিক্রির ধাপ্পাবাজিও খুব একটা সুদূর প্রসারী হয়নি। লেজার ওয়েপন নিয়ে আমাদের গবেষণা বেশ জোর কদমে এগোচ্ছে। কিন্তু এছাড়া বিশেষ কী আমরা ক্লায়েন্টদের দিতে পারি? মানুষের আদিমতম ভয় হল, অজানার ভয়। যুদ্ধক্ষেত্রেও ভয় বরাবর তুরুপের তাস হয়ে আসছে। সেই নিয়ে আমাদের ছোট্ট প্রয়াস, ‘প্রোজেক্ট সাইরেন’। এই প্ৰথম যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের সহাবস্থান হচ্ছে। বিশেষ ধরনের ন্যানো-রোবটস্ ইনজেক্ট করা হবে। যারা তিনটে কাজ করবে। প্রথমত সোলজারকে সুপার হিউম্যান বানাবে, পরিবর্তে ভিক্টিম আক্রমণাত্মক হবে। প্রি ফ্রন্টাল কর্টেক্সের ক্রিয়া প্রায় লোপ পাবে। মোর অফ জম্বির মতন বিহ্যাব করবে।

দ্বিতীয়ত, গোটা শরীর জুড়ে ন্যানোবটস্ একটা আভ্যন্তরীণ শিল্ড তৈরি করবে। এছাড়াও বুলেট লাগলে তার আশেপাশে একটা শিল্ড বানিয়ে ব্লাড পয়জনিং কমিয়ে দেবে। উল্টোদিকে সেল রিপ্রোডাকশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি তো আছেই। সাধারণ মেডি-কিট হলেই বুলেট সরানো যাবে। তবে স্নাইপার, গ্রেনেড বা রকেট প্রপেলড গ্রেনেড হানিকারক।

এবার আসি মজার বিষয়ে। কোনো কারণে সোলজার যুদ্ধক্ষেত্রে যদি মারা যায় কিংবা তাদের কোনো অঙ্গহানি হয়, মৃতদেহ নিজেই অথবা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া অঙ্গ, ন্যানোবটসের সাহায্যে গতিবিধি করতে পারবে। যদিও এটার ফিজিক্যাল ইমপ্যাক্ট সেরকম নেই। কারণ কখনই একটা কাটা হাত ট্রিগার টিপতে পারবে না। ন্যানোবটস্ একটা নির্দিষ্ট অ্যালগোরিদম মেনেই কাজ করে। তবে শত্রু শিবিরে প্যানিক তৈরি করার জন্য যথেষ্ট।”

“কিন্তু কবে হবে প্রতাপ? এই একই ডেমো এই নিয়ে দুইবার দেখালে!” ওকে মাঝপথে থামিয়ে আবার ধমকে উঠলাম। এরা কুমিরছানা আর শেয়াল পণ্ডিতের গল্প শুরু করেছে। একই প্রেজেন্টেশন এদিক-ওদিক করে চালাচ্ছে।

―কাজ চলছে স্যার! খুব শীঘ্রই আমাদের ন্যানোবটস্ তৈরি করে ফেলবো।

―মাই ফুট। আমি এই প্রোজেক্টে আর এক পয়সাও লাগাবো না। শুনুন সুমিতবাবু আমি একসপ্তাহ সময় দিচ্ছি। পজিটিভ কিছু নিয়ে আসুন নইলে আপনি আর আপনার এই যাত্রাপার্টির ইতি এখানেই টানবো।

―উঁহু! এত ধৈর্যহীন হলে চলে মি. গুহ? কে বলেছে ন্যানোবটস তৈরি হয়নি? প্রতাপ―

প্রতাপ কখন সামনে থেকে আমার পেছনে এসে পড়েছে খেয়াল করিনি। সেই সুযোগে সুমিত দত্ত পকেট থেকে বের করে একটা ভেলভেট কেস। সাইজে অনেকটা দামি পেন রাখার বাক্সের মতন।

―সবুরে মেওয়া ফলে মি. গুহ। আপনি এতই উতলা হচ্ছেন যখন আপনিই হন তাহলে গিনিপিগ―

পেছন থেকে আমাকে প্রতাপ জাপটে ধরে। প্রতাপ এক্স-মিলিটারি। এখনও নিয়মিত জিম করে। ওর পেশিবহুল হাতের শক্ত বাঁধুনি এত সহজে শিথিল হবে না। আমি কই মাছের মতন ছটপট করতে থাকি।

উল্টোদিকে বাক্স খুলে হারামজাদা সুমিত হাতে নিয়ে ফেলেছে ইনজেক্ট গান। মুখে বিজয়ীর হাসি।

“চ্যারিটি বিগিন্স অ্যাট হোম মি: গুহ।” বলেই আমার হাতে সূচ ফুটিয়ে দেয় সুমিত দত্ত। একটা ঠান্ডা শিরশিরে ভাব রক্তে মিশে যায়, হাত হয়ে মাথায় গিয়ে ধাক্কা দেয়। শরীরটা টলমলিয়ে ওঠে। তারপর শুরু হয় প্রচণ্ড মাথাব্যথা। প্রতাপ আরো চেপে ধরে।

সুমিত দত্তর ভাষণের এম পি থ্রি চলতে থাকে, “সম্প্রতি ভিক্টিমদের মধ্যে অন্য উপসর্গ দেখা দিচ্ছে গুহবাবু। ন্যানোবটসের দল অ্যানাটমির ওপর প্রভাব ফেলছে। দেখি আপনি জিরাফ হয়ে উঁচু গাছের পাতা খেতে পারেন কিনা?”

শরীর শিথিল হয়ে পড়ে ক্রমশ। বমিবমি পায়।

আমার অবস্থা বুঝে প্রতাপ বাঁধুনি আলগা করে। সেই সুযোগে টেবিলে ওপর ডান পা তুলে পুরো শরীর দিয়ে পেছনে ঠেলা মারি। প্রতাপ ভারসাম্য হারিয়ে আমাকে নিয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। আমার মাথাটা ওর থুতনিতে গিয়ে লাগে।

কোনোক্রমে হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে বেরোনোর দরজার কাছে গিয়ে আটকে পড়ি। পেছন থেকে প্রতাপ পা ধরে টেনে আছে। ওদিকে, সুমিত ফোনে― “সিকিউরিটি! উই হ্যাভ ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন হিয়ার।”

উফফ্! মাথার মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা, খুলির চারপাশ মারাত্মকভাবে গ্রাস করে চলছে, যেকোনো মুহূর্তে মাথা ফেটে চৌচির হয়ে ঘিলু মেঝেতে গড়াগড়ি খাবে। ভেঙে পড়লে চলবে না। যে করে হোক এখান থেকে বেরোতেই হবে।

সজোরে লাথি কষিয়ে দিই প্রতাপের মুখে। লোকটা ছিটকে টেবিলের পায়ায় গিয়ে ধাক্কা খায়।

টলতে টলতে দরজা দিয়ে বেরিয়ে, দৌড় লাগাই লিফ্টের দিকে। এলোমেলো পা ফেলছি। আমি কি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি! পেছনে একপাল সিকিউরিটি তাড়া করছে । লিফটে ঢুকেই এলিভেটর বাটনগুলো দেখে আরো মাথা ঘুরে যায়। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না, যেন জীবনে প্রথমবার দেখছি!

―“স্যার প্লিজ স্যারেন্ডার!” কানের কাছে কেউ জোর করে চিৎকার করে ওঠে।

আমার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। ভীষণ ঘামতে থাকি। কোন বাটন টিপে পার্কিং ফ্লোরে যাব বুঝে উঠতে পারছি না। আমি কি পাগল হয়ে গেছি!

“ফায়ার!” সুমিত দত্তর গলা পেলাম।

তারপর রাইফেলের জোরালো শব্দ সব কিছুকে ছাপিয়ে গেল। ছিটকে পেছনে লিফ্টের দেওয়ালে গিয়ে আটকে গেলাম। ডানদিকে কাঁধে শক্ত চাপ অনুভূত হয়। পরক্ষণে মনে হল ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে কাঁধে কেউ সজোরে আঘাত হেনেছে। এরপর কয়েক সেকেন্ডের জন্য কানের কাছে কয়েকশ’ মৌমাছি গুঞ্জন করতে থাকে।

তীব্র ব্যথায় আমার সম্বিত ফেরে। চেয়ে দেখি লিফটের দরজার প্রায় কাছে এসে পড়েছে তিনজন বন্দুকধারী, তাদের মাঝে সুমিত দত্ত।

কোনোক্রমে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বাটন টিপে লিফ্টের মেঝেতে বসে পড়ি। লিফ্ট ক্রমশ নীচে নামতে থাকে।

নাগরদোলা তীব্র গতিতে নীচে নেমে এলে যেরকম অনুভূতি হয় ঠিক সেরকম লাগছিল। হঠাৎ―

লিফ্টের আলোগুলো নিভে, জ্বলে উঠল অজস্র তারা। অন্তহীন মহাশূন্য, আমি পিছলে পড়ছি ক্রমাগত। কে টানছে আমায়? নিচের দিকে চেয়ে দেখতেই হৃদপিণ্ডটা পিছিয়ে এসে পাঁজরে ধড়াস ধড়াস বাড়ি মারে। নক্ষত্র খচিত মহাকাশের বুকে এক কৃষ্ণকায় গহ্বর ক্রমাগত বাড়ছে। শুষে নিচ্ছে আশেপাশের সব আলোকবিন্দু। কিন্তু ওটা ফাঁপা নয়―ওটা জীবন্ত! অতিকায় কালো কুচকুচে সাপের দল, রমণ ক্রীড়ায় মেতেছে। খুব কাছে চলে এসেছি― ওই তো সাদা করাতের মতন দৈত্যাকার দাঁতগুলো― আমার কাঁধে বসে যাচ্ছে― হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে থমকে যায় সব কিছু।

হুস শব্দ করে লিফ্টের দরজা খুলে যায়।

আমি কি হ্যালুসিনেট করছি! হামাগুড়ি দিতে দিতে শরীরটা টেনে হিঁচড়ে নিজের গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে থাকি। কাঁধ বেয়ে রক্তের ধারা নেমে এসে সমান্তরালে আনাড়ি হাতের লাল আলপনা এঁকে যাচ্ছে।

খুব বেশি দূর যেতে হয়নি। আমার গতিশীলতা যে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে অস্বীকার করতে পারবো না। গাড়ি সামনে, চাবি পকেটেই ছিল। উল্টোদিকে পায়ের শব্দ গমগম করছে পার্কিং এরিয়া। ওরা এসে পড়েছে। এত সহজে গিনিপিগকে হাতছাড়া করবে না।

আলতো করে দরজা টেনে নিজেকে গাড়ি বন্দি করলাম। বুলেট প্রুফ কাচ রয়েছে। এখন নিরাপদ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ব্যাক ভিউ মিররে চোখ যায়। সুমিত দত্তর দলবল হন্যে হয়ে এগিয়ে আসছে এদিকেই। প্রতাপের হাতে বাজুকা। বুলেটে কাজ দেবে না জেনেই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে।

চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সামনে তাকাতেই একটা শর্টকাট রাস্তা মনে পড়ল। এখান থেকে বেরোলেই লন তারপর শোভাবর্ধনকারী ছোট সরোবর আর ওটা পেরলেই ইমার্জেন্সি গেট। সেখানে সিকিউরিটি তেমন বেশি থাকে না। হাতের স্টিয়ারিং কোথায় ঘোরাবো মাঝেমধ্যেই কূলকিনারা পাচ্ছি না। বোধশক্তি ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। কাঁধের যন্ত্রণা আর টের পাচ্ছি না। শুধু মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে কতগুলো কীট, আর তাদের নোংরা অভিসন্ধি। কিন্তু থামলে চলবে না।

পার্কিং এরিয়া থেকে ডানদিকে বাঁক নিতে গিয়ে দুজন অস্ত্রধারী নজরে এলো। দুজনকেই গাড়ি চাপা দিলাম। রাস্তা ছেড়ে লনে গাড়ি উঠল। আবার ডানদিকে মোড় নিয়ে সরোবরের সমান্তরালে গাড়ি ছোটালাম। আকাশে ঘন-মেঘ জমেছে, তারই প্রতিফলন সরোবরের জলে। আর মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যবধান, তারপরই মুক্তি।

প্রথমে নজরে এলো একটা সাইরেন পোল। সেখানে বহাল তবিয়তে সম্প্রসারিত হয়ে চলছে : ‘কংভিক্ট এস্ক্যাপড্, সিল অল দ্য গেটস্।’ অদূরে ইমার্জেন্সি গেট। কিন্তু, আশার বিপরীতে সেখানে জমা হয়েছে অনেক সিকিউরিটি। পেছন থেকে ক্রমাগত বুলেট ধেয়ে এসে পেছনের কাচের দফারফা করছে। হঠাৎ গাড়ির পেছনে একটা ছোটখাটো বিস্ফোরণ হল। বাজুকার কামাল!

নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারলাম সাইরেন পোলে। সামনে ছিটকে গিয়ে মাথাটা গাড়ির উইন্ডস্কিনে ধাক্কা মারে। যেন অজস্র ছুরি আমার ত্বক ভেদ করে হাড়ে প্রবেশ করছে। জিভটা ভিজে যায়, মুখে রক্তের স্বাদ অনুভব।

তীব্র ঝাঁকুনিসহ দিকভ্রষ্ট হয়ে গাড়ি গিয়ে পড়লো সরোবরে।

আবার সেই তলিয়ে যাওয়ার ভয় ঘিরে ধরল। গাড়ির ভেতরে অবাধে জল ঢুকছে। আমার মাথার ধড়ফড়ানি সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।

সলিল সমাধি ভবিতব্য।

কিন্তু আগে একটু নিঃশ্বাস নিতে চাই। দেহের প্রতিটি কোষ অক্সিজেনের জন্য চিৎকার করছে। সর্বশক্তি দিয়ে উইন্ডস্ক্রিনে ঘুষি মারতে থাকি। বুলেট প্রুফ কাচ। এত সহজে কি ভাঙে! কিন্তু না, সারা শরীর জুড়ে যে অতিমানবিক শক্তির আভাস পাচ্ছি―অস্বীকার করা যায় না। থামলে চলবে না। রাগ এবং ভয়, দুটোই একসঙ্গে কাজ করছে আমার মধ্যে। দুই হাত মুঠো করে এলোপাথাড়ি ঘুষি চালাতে থাকি।

সবুরে নয়, চেষ্টায় মেওয়া ফলে। মোচড়ানো উইন্ডস্কিন সহ ডুবন্ত গাড়িটাকে পেছনে ফেলে ব্যাঙের মতন সাঁতরে ওপরে উঠতে থাকি। ফুসফুসে জল ঢুকেছে। আর দম আটকে রাখতে পারছি না। একটু প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই।

ওপরে উঠেই হাতের কাছে খড়কুটোকে আগলে রেখে মুখ হাঁ করে শ্বাস নিতে থাকি। একটু ধাতস্থ হলে সম্বিৎ ফিরে পাই। ঝোড়ো বাতাস বইছে। ঘনকালো মেঘের ঘনঘটা। দূরে কোথাও সশব্দে বাজ পড়েছে। সরোবরের ধারে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে বন্দুকধারীর দল। একটু পরেই হয় আমার ভবলীলা শেষ করবে নতুবা পোষা কুকুরের মতন চেন দিয়ে বেঁধে রাখবে। খড়কুটো ভেবে যেটাকে আগলে ধরেছিলাম সেটা হতভাগা সাইরেন পোলটা। ভাঙেনি তবে মচকেছে, গাড়ির আঘাতে কলাগাছের মতন লুটিয়ে পড়েছে সরোবরের জলে। ত্রিভুজাকৃতি দুইখানা উল্টোমুখী সাইরেন, জলে ডুবে বোবা।

শেষ পর্যন্ত আমার কী হবে এই ভাবনা ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হতে লাগলো। হঠাৎ আকাশ চিরে সাদা আলোর স্ফুলিঙ্গ নেমে এসে আমাকে স্পর্শ করল। সব কিছু কেমন স্লো মোশনে চলছিল। শরীরে জুড়ে কয়েক হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলে গেল। মনে হচ্ছে কেউ চুল্লিতে জ্যান্ত ঢুকিয়ে দিয়েছে। পুরো শরীর অসাড় হয়ে, চোখের সামনে কালো যবনিকা নামতে দেখলাম। নিজেকে কেমন ভারশূন্য লাগছিল আর ঠিক তখনই কান ফাটানো বজ্রনাদ―

সিকিউরিটিদের গুঞ্জন আর শুনতে পাচ্ছি না, না পারছি দেখতে। এটুকু বুঝলাম বাজ পড়ে চিরতরে অন্ধ ও বধির হয়ে গেছি। মনে হচ্ছে আবার জলে তলিয়ে যাচ্ছি। সাঁতরাতে সাঁতরাতে জলের ঘষা খেয়ে শরীরের চামড়াগুলো খসে যাচ্ছে ক্রমশ। এ ব্যথা সহ্যাতীত। এক টনের দুটো বস্তা কানের দুপাশে কেউ ঝুলিয়ে দিয়েছে।

কী ঘটছে? ঐ ন্যানোবটসরা কী কোনো কিছুর সঙ্গে আমাকে ফিউজ করে ফেলেছে? চিৎকার করে উঠলাম, জানি না আদপেই ওটা কেউ শুনতে পেয়েছে কিনা, হয়তো কথাগুলো থেকে গেল আমার মাথার ভেতরেই। এক চুলও নাড়াতে পারছি না আমার ঠোঁট। জল ছেড়ে ডাঙ্গায় নেমেছি। অন্ধের মতন এলোমেলো পা ফেলছি। পায়ে কিছু একটা ঠেকল, আমার ধারণা রিসার্চ ফ্যাসিলিটির প্রাচীর। একটা লাফ দিয়ে প্রাচীর টপকে ছুটে চললাম অজানা অন্ধকারে। সেখানে তারা নেই। তবে সাপের মতন কুণ্ডলী পাকানো তিমিররাশি খেলা করছে। তরল অন্ধকার তার পুরু চটচটে অংশ দিয়ে ধুয়ে ফেলছে আমার সর্বাঙ্গ। যেন মহাবিশ্ব এখনও শুরু হয়নি, বা সম্ভবত কখনও হয়নি। অন্ধকারে আমি বুঝতে পারি যে জীবন, মৃত্যু, যন্ত্রণা― কোনো কিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আমার খালি পা জোড়া জানান দিচ্ছে যে নিচের জমিটি এখনও আছে, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটছি। শরীরে সুতোর কোনো অস্তিত্ব নেই। না বেঁচে রয়েছে চামড়া। কেউ সযত্নে ছাল ছাড়িয়ে নিয়েছে। বিক্ষিপ্ত বৃষ্টির শীতল ফোঁটাগুলো মাংসপেশিগুলোকে ধুইয়ে দেয়। গায়ে জ্বলন বাড়িয়ে তুলছে কয়েকগুণ। আমি নিঃসঙ্গ পথিক। তবে আপাতত আমার কাছে যা কিছু আছে তা হল এই তারাহীন মহাকাশ, এমনকি আজ রাতে চাঁদও জ্বলবে না।

হয়তো বিশ্রীভাবে ঝুঁকে দৌড়চ্ছি, নয়তো হাতগুলো প্রসারিত হয়ে মাটি ছুঁচ্ছে। আমার শরীর কোন এক মন্ত্রবলে দীর্ঘায়ত হয়েছে। গাছে উঁচু ডালগুলো মুখে-ঘাড়ে-বুকে লাগছে, থামিয়ে দিচ্ছে চলার গতি।

এগিয়ে চলতে হবে। থামলে চলবে না।

জল কাদা মাড়িয়ে বোধহয় জঙ্গল অতিক্রম করে উন্মুখ জলাভূমি পেরিয়ে এগোচ্ছি। জলে পা ফেলছি। অনুভব হচ্ছে নরম কাদা-মাটি। কিন্তু কেন এগোচ্ছি? আমি কে? কেন? কী হয়েছে আমার সাথে?

‘আজ আকাশ অংশত মেঘলা থাকবে। বিকেলবেলায় বজ্র বিদ্যুৎ সহ ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা...’

শুনে থমকে দাঁড়ালাম। আমি চাই এই ঘন কালো অন্ধকার মুছে গিয়ে ভোরের প্ৰথম রোদের কণা এসে আমায় চুম্বন করুক এবং চঞ্চল হৃদয়কে বুঝিয়ে দিক আমি নিঃসঙ্গ নই, বাঁক পেরলেই আমার জন্য আলোকময় উজ্জ্বল পৃথিবী অপেক্ষা করছে। সবই অলীক কল্পনা। চিৎকার করতে ইচ্ছে হল। নিজের কাছে শব্দ নেই। রোবটের মতন সদ্য শোনা কথাগুলিই পুনরাবৃত্তি করলাম। বোধহয় কেউ শুনেছে... কেউ কি শুনছে? আবার চিৎকার করলাম।

কোনো উত্তর নেই।

জলাভূমি ছেড়ে এখন পিচ রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি। সেই রাস্তা ধরে দ্রুত এগোতে লাগলাম। একটা মেয়ের আর্ত চিৎকার কানে এলো। এই তো আমার শ্রবণ শক্তি ফিরে এসেছে। নাকি এটাও আমার কল্পনা মাত্র। কুছ পরোয়া নেই, সেই শব্দের উৎস লক্ষ করে এগিয়ে চললাম।

চলতে চলতে আদপে ঠোঁট বলে কি কিছু বেঁচে আছে? হাত দিয়ে নিজের মুখটা অনুভব করতে চাইলাম। একজোড়া উল্টোমুখি সাইরেন হাতে এসে ঠেকল। আমি ভয় পেয়ে দৌড়তে লাগলাম।

আবার সশব্দে বাজ পড়ে। নীচ থেকে কেউ ভয় পেয়ে বলে ওঠে― “সাইরেন হেড...”

 

লেখকের কথা: ২০১৮ সালে, কানাডিয়ান আর্টিস্ট, ট্রেভর হেন্ডারসন ‘সাইরেন হেড’ তৈরি করেন। আরবান লেজেন্ডের তালিকার নতুন সংযোজন। মাথার পরিবর্তে সাইরেন, প্রায় চল্লিশ ফুট লম্বা, রেডিও সম্প্রসারণ থেকে মানুষের কণ্ঠ অবিকল নকল করতে পারে। বেশ কয়েকটি ভিডিও গেমে সাইরেন হেডের আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু কোনো নেপথ্য কাহিনী নেই। নিজের মতন করে নেপথ্যে-কাহিনী নির্মাণ করতে গিয়েই এই গল্পটি লেখা হয়ে যায়।