ফ্রম মেক্সিকো উইথ লাভ ● জয়িতা সাহা

ফ্রম মেক্সিকো উইথ লাভ
জয়িতা সাহা

৯৯৭ সাল। ড্রাগযুদ্ধ আর ভূমিকম্প কবলিত মেক্সিকো তখন মাতোয়ারা জাপাতিস্টা মুভমেন্টের আলোড়নে। স্কুল কলেজ সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। ফিলোসফি প্রথম বর্ষের এক ছাত্র ঠিক করলেন এই সুযোগে ইউরোপ একটু ঘুরে আসা যাক। বাবা মা দুজনেই থিয়েটারের মানুষ, তাই অভিনয়ের মঞ্চেই শৈশব কেটেছে, কিন্তু অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। লন্ডনে বার টেন্ডিং করে দিব্যি চলছিল। একদিন শখ করে অডিশন দিতে গেলেন, আর সেন্ট্রাল স্কুল অফ স্পীচ অ্যান্ড ড্রামা-তে প্রথম মেক্সিকান মানুষ হিসেবে পড়াশুনার জন্য দাখিল হলেন গায়েল গার্সিয়া।

দেড় বছর পর পরিচালক আলেহান্দ্রো গঞ্জালেজ ইনারিতুর ফোন। ডেথ ট্রিলজির প্রথম ছবির শ্যুটিং শুরু হবে। গায়েল যেন সেমিস্টার ব্রেকে কাজটা করে ফেলে। দু সপ্তাহ বাড়তি ছুটি নিতে হল আর ইনারিতুর বুদ্ধিতেই কলেজে জানালেন ট্রপিক্যাল অসুখের কারণে এই ছুটি। মিলেনিয়ামের শুরুতে আমাদের সামনে মেক্সিকান সিনেমা নতুন রূপে ধরা দিল। বছর কুড়ির গায়েল ভেবেছিলেন তার প্রথম সিনেমা কেই বা দেখবে তাই ক্যামেরা ক্রু দের কাছ থেকে একটা ডিভিডি চেয়ে নেন পরিবারের জন্য। সেরা বিদেশী ভাষার ছবির জন্য অস্কার নমিনি ‘আমোরেস পেররস’ থেকেই ইনারিতুর জগৎজোড়া খ্যাতির গোড়াপত্তন। ছবির নামের আক্ষরিক অনুবাদ ‘লাভ ইস আ বিচ’। একটা অ্যাক্সিডেন্টের সঙ্গে জড়িয়ে যায় কতগুলো জীবন, তাদের না হওয়া প্রেম, অনিচ্ছাকৃত অপরাধ আর খুব অদ্ভুত ভাবেই কয়েকটি কুকুর। তিনটি পার্ট গল্পের, তাই টারান্টিনোর ‘পাল্প ফিকশন’ মনে পড়তে পারে, কিন্তু মুচমুচে নয়, অনেক বেশি গভীর কাজ, কড়া আর আড়ম্বরহীন, কিন্তু অভিঘাতে মারাত্মক। তবু সব কিছু ছাপিয়ে আমাদের মনে ধরে যায় রাগী, জেদী যুবক অক্টাভিওকে। অবৈধ প্রেমের ফাঁসে সে সব কিছু হারায় আর আমরা পাই এক অন্য ঘরানার অভিনেতা, যার চোখ কথা বলে। অসম্ভব স্ক্রীন প্রেসেন্স কিন্তু ঘষা মাজা করতে হবে, সিনেমা সম্পর্কে পড়াশোনা তো প্রচুর বাকি। আবার পালিশ করে চকচকে করে দিলেও মুশকিল। 

 

 

হীরে চিনতে জহুরীর সময় লাগে না। আলফান্সো কুয়ারন তখন ‘ই তু মামা তাম্বিয়েন’ এর জন্য কাস্টিং করছেন। প্রথম ছবিতে গায়েলের চোখ দেখেই নিজের হুলিও জাপাতাকে উনি খুঁজে পেয়ে যান। সেই সঙ্গে তেনোখ ইতুর্বিদের চরিত্রে দিয়েগো লুনা। গায়েল আর দিয়েগোর আশৈশব বন্ধুত্ব প্রথমবার পর্দাতে। কুয়ারন আর চিত্রপরিচালক লুবেজকির হাত ধরে সিনেমার খুঁটিনাটি শেখা চলেছিল দুজনেরই। দুর্নীতির রাজনীতি আর ড্রাগে জর্জরিত মেক্সিকোর বৈপরীত্যে দায়িত্বহীন, বেপরোয়া, যৌনসর্বস্ব যুবসমাজ। আর আছে ইমানুয়েল লুবেজকির ক্যামেরাতে দেখা অনন্য মেক্সিকো। পাহাড়ি রাস্তার বাঁক ঘেঁষে সূর্য ওঠানো, সমুদ্রের জলে সূর্য ডোবানো কোনোরকম ইয়েলো ফিল্টার ছাড়া মেক্সিকো। দ্বিতীয় ছবিতেও অস্কার নমিনেশন, এবারে সেরা চিত্রনাট্য। ‘ই তু মামা তাম্বিয়েন’ (অ্যান্ড ইওর মাদার টু) কামিং অফ এজ ছবির বাইবেল বলা যেতে পারে। একুশ বছরের গায়েল এই ছবিতে অভিনয় করেননি, নিজের বাস্তবিক সত্তাকেই রীলের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। পরবর্তী বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে গায়েল বলেছেন আজও তার মনে হয় হুলিও জাপাতা কেমন আছে, কোথায় আছে, কী করছে। 

 

 

২০০২ সালে স্বয়ং পোপ ভ্যাটিক্যান থেকে মেক্সিকো সিটি এসেছিলেন আর ঠিক এই সময়েই রিলিজ হয় ‘এল ক্রিমেন দেল পাদ্রে আমারো’। ১৮৭৫ সালের একটি উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে এই ছবি চার্চের সঙ্গে ড্রাগ মাফিয়া আর গেরিলা বাহিনীর যোগ নিয়ে আলোচনা করে। স্বাভবিকভাবেই গোটা দেশ উত্তাল করে সিনেমা সুপারহিট। শান্ত, সৌম্য, মিতভাষী, যুবক পাদ্রীর ভূমিকাতে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটি চরিত্রে কাজ করে গায়েল গার্সিয়া বার্নাল (মায়ের পদবীও ব্যবহার করা শুরু করেছেন ততদিনে) মেক্সিকান ডাস্টিন হফম্যানের তকমা পেয়ে যান।

কিন্তু কেবল মেক্সিকোতে আটকে থাকলে তো চলবে না। তাই এবারে সারা দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে ওয়ালটার সালেসের ছবি ‘দি মোটরসাইকেল ডায়রিজ’ এর শ্যুটিং শুরু হল। এই সিনেমা কেবলমাত্র আর্নেস্তো গেভারার চে হয়ে ওঠার গল্প নয়, দারিদ্র্য কবলিত দক্ষিণ আমেরিকার জনগণের সীমাহীন যন্ত্রণার সাক্ষী হয়ে এক ডাক্তারী ছাত্রের জননেতা হয়ে ওঠার অদ্ভুত উপাখ্যান। সেরা বিদেশী ভাষার ছবি হিসেবে বাফটা আর অসাধারণ মিউজিকের জন্য অস্কার জিতেছিল ২০০৪ এ, প্রথমে সান্ড্যান্স, তারপর কানে প্রিমিয়ার হওয়া এই ছবি। এর আগে ‘ফিদেল’ নামের টেলি ছবিতে চে গুয়েভারার ভূমিকাতে গায়েল অভিনয় করছিলেন। কিন্তু এই ছবিতে ওনার মিনিমাল অ্যাক্টিং ছবির অন্যতম সম্পদ। শান্ত শারীরিক অভিব্যক্তি অথচ অস্থির চোখের চাহনি, নির্নিমেষ কিছু খুঁজে চলেছে। চরিত্র আর ছবির বিষয়বস্তুর ওজনকে ছাপিয়ে কখনোই তিনি বড় হয়ে ওঠার চেষ্টা করেননি, যোগ্য সঙ্গত দিয়ে গেছেন মাত্র। সেরা অভিনেতার বাফটা নমিনেশনও মেলে। সাধারণ দর্শকদের মনে এই ছবির অভিঘাত কতখানি হতে পারে সেই প্রসঙ্গে বলি, চে গুয়েভারার রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্পর্কে কোনোরকম আগ্রহ বা পরিচিতি না থাকা সত্ত্বেও সিনেমা দেখামাত্র আমি ইউনাইটেড নেশনসে ওনার বেশ কিছু বক্তৃতা দেখি। ২০১৭ টরোন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে একটি বক্তৃতাতে গায়েল বলেন দি মোটরসাইকেল ডায়রিজ তাঁর অভিনয় জীবনের সেরা অভিজ্ঞতা।

 

 

গন্তব্য: ইউরোপ। এবারে পরিচালক খোদ পেদ্রো আলমোদোভার। ইতিমধ্যে গায়েল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এবং ফেস্টিভ্যাল ফেভারিট হয়ে গেছেন। মোটরসাইকেল ডায়রিজে আমাজনের জঙ্গল অধ্যুষিত এলাকাতে শ্যুটিং করে পায়ে ইনফেকশন বেঁধেছে আর এই ছবিতে ট্রান্সজেন্ডার যৌনকর্মীর ভূমিকাতে দরকার কমপ্লিট লেগ ওয়াক্সিং। গায়েল শরণাপন্ন হলেন ফ্রেন্ড কাম ফিলোসফার কুয়ারন সাহেবের আর তাঁর পরামর্শতেই লন্ডনের কোনো এক বিখ্যাত সালোনে মেকওভার হয়ে পর্দাতে আত্মপ্রকাশ হল ‘জাহারার’। আলমোদোভার বললেন আমার ছবির নায়িকা জুলিয়া রবার্টসের মতই সুন্দরী। নারী পুরুষের দ্বৈত চরিত্রে গায়েলের অভিনয় দেখার জন্যই ‘লা মালা এডুকেশন’ (ব্যাড এডুকেশন) দেখে ফেলা যায়। তার সঙ্গে রহস্য, খুন, ফিল্ম উইদিন ফিল্ম একদম সিগনেচার আলমোদোভার।

পরবর্তী ছবি ব্রিটিশ পরিচালক জেমস্ মার্শের ‘দি কিং’। অজানা পিতৃ পরিচয়ের সন্ধানে মানসিক সমস্যায় জর্জরিত এক নেভির অফিসার। এলভিস ভালদেরেস এর চরিত্রে গায়েলের ছক ভাঙ্গা অভিনয় ফিল্ম সমালোচকদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। ঠান্ডা মাথার খুনিও নয়, অবিবেচক অপরাধীও নয়, দুইয়ের মাঝামাঝি এক নিস্তরঙ্গ চরিত্র। 

একের পর এক চ্যালেঞ্জিং রোল শুধু করে চলেছেন, কিন্তু মন মোহিনী হাসিতে রোম্যান্টিক হিরো হিসেবে সেইভাবে আত্মপ্রকাশ হয়নি। তাই এইবারে গাঁটছড়া বাঁধলেন পরিচালক মিশেল গন্দ্রির সঙ্গে। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকে স্টেফান আর স্টেফানি, কিন্তু তাদের মধ্যে একটুও প্রেম হতে পারে না, কারণ স্টেফান স্বপ্ন আর সত্যির মধ্যে তফাৎ করতে ভুলে যায়, ওর মনেই থাকে না কখন ও ঘুমিয়ে পড়ে আর কখন ঘুম থেকে জাগে। ‘সায়েন্স অফ স্লীপ’ (২০০৬) সিনেমাতে প্রেম আর জাদুবাস্তবতা মিলে মিশে একাকার হয়েছে। স্টেফানের ছেলেমানুষী, একগুয়েমি, একাকীত্ব, প্রেমিক হওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা এই সবকিছুই অব্যর্থভাবে পর্দাতে ফুটিয়ে তুলেছেন গায়েল আর যোগ্য সঙ্গত শার্লট গেইন্সবেরগের। এত ভালো প্রেমের ছবি আজকাল চট করে দেখতে পাই না।

 

 

অভিনয় জগতে অভূতপূর্ব সাফল্য পেলেও ব্যক্তি হিসেবে গায়েল গার্সিয়া বার্নাল কেমন তা জানতে হলে আবার মেক্সিকোতে ফিরে যেতে হবে। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই বন্ধু দিয়েগো লুনার সঙ্গে মিলে মেক্সিকো সিটিতে প্রতিষ্ঠা করেন কানানা ফিল্মস। ব্যতিক্রমী, স্বাধীন কনটেন্টকে মেক্সিকান টেলিভিশনে আনার প্রচেষ্টায়। মেক্সিকান মানুষদের যুগে যুগে আমেরিকাতে পারি দেওয়ার ঘটনা আর তার সঙ্গে জড়িত কোটি কোটি দুর্ঘটনা নিয়ে গায়েল তার কথায় এবং কাজে সব সময় সোচ্চার হয়েছেন। সিনেমা আর রাজনীতিকে তিনি কোনোদিন আলাদা করে দেখেননি। ২০০৬ সালে আলেহান্দ্রো গঞ্জালেস ইনারিতুর ‘ব্যাবেল’ ছবিতে অতি স্বল্প দৈর্ঘ্যের এক প্রান্তিক মেক্সিকান চরিত্রে অভিনয় করে আমেরিকান গভর্নমেন্টের মেক্সিকোর উপর একুশে আইন রাজনীতির চিত্র সারা পৃথিবীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। নিজের নির্দেশনার সূচনা করেন ২০০৭-এ ‘ডেফিসিট’ ছবি দিয়ে। মেক্সিকান মাইগ্রেন্ট মুভমেন্টের উপর ডকুমেন্টারি ছবি করেন ‘হু ইজ দায়ানি ক্রিস্টাল’। গোটা মেক্সিকো জুড়ে ভ্রাম্যমান ডকুমেন্টারি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আম্বুলানতের সূত্রপাত করেন বন্ধু দিয়েগোর সঙ্গে ২০০৫ সালে। ডকুমেন্টারির মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তন আনার স্বপ্ন দেখেন গায়েল। এই কথা একাধিক বক্তৃতাতে বলেছেন।

চমকপ্রদ সব চরিত্র আর ভার্সটালিটি গায়েল গার্সিয়া বার্নালের সিগনেচার মার্ক বলা যেতে পারে। ২০০৮ এ কার্লোস কুয়ারনের পরিচালনায় আর আলফানসো কুয়ারনের প্রযোজনায় গায়েল আর দিয়েগো আবার একসঙ্গে পর্দায় আসেন। ছবির নাম ‘রুদো ই কুর্সি’। আদতে স্যাটায়ার এই সিনেমায় মেক্সিকান ক্লাব ফুটবলের দুর্নীতি আর বেটিং জগতের চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল ডার্ক কমেডির মধ্যে দিয়ে। ওই বছরই পরিচালক ফার্নান্দো মিরেলেসের নির্দেশনায় দুনিয়াব্যাপী অতিমারী বিষয়ক ‘ব্লাইন্ডনেস’ ছবিতে খল চরিত্রে অভিনয় করে গায়েল প্রশংসিত হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে সুইডিশ পরিচালক লুকাস মুডিসনের শিশুর লালন পালনে বাবা মায়ের ভূমিকা এবং দায়বদ্ধতা নিয়ে বিতর্কিত ছবি ‘ম্যামথ’-এ মিশেল উইলিয়ামসের বিপরীতে অভিনয় করেন। 

 

গন্তব্য: চিলি। চিলিয়ান পরিচালক পাবলো লারাইন সমসাময়িক পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম সেরা। অভিনব বিষয় নির্বাচন আর সহজ ভঙ্গিতে কঠিন গল্প বলার মুন্সিয়ানা উনার প্রতিটি কাজেই আছে। পাবলোর সঙ্গে গায়েল প্রথম কাজ করেন ২০১২ সালে ‘নো’ ছবিতে। ১৯৮৬ তে সমগ্র চিলি একনায়ক পিনোচেকে উৎখাত করতে যে বিপ্লবের জোয়ার নিয়ে এসেছিল তা নিয়েই এই ছবির গল্প। গায়েলের চরিত্র বাস্তবিক দুজন সংবাদ মাধ্যমের মানুষের উপর ভিত্তি করে লেখা যারা নো ক্যাম্পেইনের বিজ্ঞপ্তি লেখার কাজে সক্রিয় ভাবে জড়িত ছিলেন। ‘নো’ সেরা বিদেশী ভাষার ছবি হিসেবে অস্কার নমিনেশন আদায় করেছিল। কিন্তু কোনো বিশেষ পুরস্কারে এই ছবির সাফল্য মাপা যায় না। রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের এই নজিরবিহীন প্রতিবাদের গল্প কতখানি জরুরী, আমাদের সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সেই কথা প্রতিনিয়ত মনে করায়। গায়েল একজন সংবেদনশীল নাগরিক আর একজন দায়িত্বশীল পিতার টানাপোড়েনকে যেভাবে পর্দাতে তুলে ধরেছেন তার জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়।

পাবলো লারাইনের সঙ্গে গায়েলের পরবর্তী কাজ ২০১৬ সালে। ছবির নাম ‘নেরুদা’। কমিউনিজম বিরোধী চিলি সরকারের সঙ্গে প্রবাদপ্রতিম কবি পাবলো নেরুদার নিরলস সংঘাত। কবি অথবা তার রঙিন উন্নাসিক জীবন ছবির মূল বিষয় নয়। কবির পিছু ধাওয়া করে এক পুলিশ অফিসার এদেশ থেকে এদেশ ছুটে চলেছে। কিন্তু ছবি যত এগোয় তত আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় এই অনুসন্ধান নেরুদার জন্যে নয়, বরং সেই অফিসারের নিজের অস্তিত্বের খোঁজে। গোয়েন্দা অফিসারের ভূমিকায় গায়েল কখনো কড়া, কখনো ধূর্ত, কখনো অসহায়, আবার কখনোবা বেজায় নিষ্কর্মা। ওপরচালাকির আবরণে নিজের টালমাটাল পায়ের জমিটুকু শক্ত করতে সে চাইছে, কারণ সেও কবির কল্পনার ফসল, নিমেষে তার ছুটি হয়ে যাওয়া কে আটকায়! কান চলচ্চিত্র উৎসব প্রিমিয়ারে নিও নয়ার এই ছবি স্টাইলাইজেশন আর ননলিনিয়ার স্টোরি টেলিংয়ের জন্য প্রশংসিত হয়েছিল।

 

 

২০১৯-এ এই অভিনেতা পরিচালক জুটি আবার পর্দায় ফেরেন ‘এমা’ ছবির হাত ধরে। চিলির স্ট্রিট ডান্সিং কমিউনিটির ব্যাকগ্রাউন্ডে এই ছবি এক চমকপ্রদ গল্প বলে। এই সিনেমায় বিখ্যাত স্প্যানিশ পরিচালক আলমদোভারের গল্প বলার স্টাইলের সঙ্গে আমি মিল পেয়েছি। আলো আর রঙের দুরন্ত ব্যবহার শুধু নয়, নিকোলাস জারের অনবদ্য সঙ্গীত এই সিনেমার অন্যতম সম্পদ। মুখ্য ভূমিকায় মারিয়ানা দি গিলেরমো থাকলেও একজন আত্মক্ষয়কারী নিঃশেষিত শিল্পী তথা অপদার্থ স্বামীর চরিত্রে গায়েল নিজের ছাপ রেখে যান।

 

 

গায়েল গার্সিয়া বার্নাল নিজের কেরিয়ারে একের পর এক বিতর্কিত বিষয় নিয়েই ছবি করে গেছেন। জুটেছে ‘ইন্টেলিজেন্ট ওমেন্স হার্ট থ্রব’ এই তকমাও। বিশ্ব জোড়া ভক্তকুল থাকলেও হলিউডের মূল ধারার ছবির ছাতায় ওনাকে আশ্রয় নিতে দেখা যায়নি। ওনার ছবি নির্বাচন থেকে এইটুকু স্পষ্ট উনি কেবলমাত্র ব্যতিক্রমী বা ভিন্নধারার কাজেই আগ্রহী।

ইরানিয়ান সাংবাদিক মাজিয়ার বাহারির ইরানে অন্যায় ভাবেআটক ও অত্যাচারের গল্প নিয়ে ২০১৪ সালে মুক্তি পায় ‘রোজ ওয়াটার’ । সংবাদমাধ্যমের বিখ্যাত নাম জন স্টুয়ার্ট প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি পরিচালনা করেন। মাজিয়ারের ভূমিকায় গায়েল। নিজের স্টারডম ভেঙে একজন অদম্য জার্নালিস্ট এর চরিত্রে মিশে গিয়ে অভিনয়, কখনো ভীরু কখনো বেপরোয়া।

২০১৫ সালে জোনাস কুয়ারনের পরিচালনায় মেক্সিকান মাইগ্রেন্ট মুভমেন্টের গম্ভীর বিষয়কে কেন্দ্র করে থ্রিলার ছবি ‘দেসিয়ার্তো’ তে গায়েলকে মুখ্য ভূমিকায় দেখা যায়।

 

একজন গর্বিত নাগরিক হিসেবে মেক্সিকোর সংস্কৃতি আর শিল্প প্রচারে গায়েল কখনো পিছপা হননি। তাই ডিজনি যখন প্রথম বার অল মেক্সিকান কাস্ট অ্যান্ড ক্রু নিয়ে প্রজেক্ট শুরু করে তাতে গায়েল মুখ্য ভূমিকায় থাকবেন এতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। মেক্সিকোর ডে অফ ডেড সংস্কৃতিকে উপজীব্য করে ২০১৭ সালে অ্যানিমেশন ছবির জগতে এক প্রকার বিপ্লব আনে ‘কোকো’। হেক্টরের ভূমিকায় গায়েল আমাদের হাসালেন, কাঁদালেন, গান শোনালেন। অনবদ্য সব গান, দুর্দান্ত আর্টওয়ার্ক শুধু নয়, এক জমজমাট গল্প নিয়ে এই সিনেমা ছোটদের জন্য বানানো হলেও ছোট বড় নির্বিশেষে সকলের মন জয় করে নেয়। সেরা অ্যানিমেশন ছবির অস্কার ছাড়াও কালজয়ী গান ‘রিমেম্বার মী’ এনে দ্যায় সেরা সঙ্গীত আর সেরা গানের অস্কার। 

 

 

২০১৯ এ নিজের দ্বিতীয় পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছবি পরিচালনা করেন ‘চিকুয়ারতেস’। টরোন্টো এবং সাংহাই ফেস্টিভালে প্রদর্শিত এই ছবি মেক্সিকোর প্রান্তিক যুবসমাজের গল্প। এই বছরই নব্বই দশকের মায়ামিতে অ্যান্টি কাস্ত্রো টেররিস্ট মুভমেন্টের উপর কিউবার ছবি ‘ওয়াস্প নেটওয়ার্কে’ একটি ছোট অথচ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে গায়েলকে দেখা যায়।

 

একজন ভালো অভিনেতা হলেই একজন ভালো কমিক অভিনেতা হওয়া যায় না এই কথা সবাই জানেন। কমেডিতে টাইমিং শেষ কথা। আমাদের সুপরিচিত বহু শিল্পী আছেন যাদের আমরা গুরু গম্ভীর ছবিতে অসামান্য অভিনয় করতে দেখেছি কিন্তু হাসির রোলে সেইরকম সফলভাবে দেখিনি। এই একটা জায়গাতে গায়েল গার্সিয়া বার্নাল ম্যাজিক করে ফেলেছেন। নিজের গোটা ফিল্মোগ্রাফি জুড়ে উনি সিরিয়াস ভিন্ন ধারার ছবি করেছেন কিন্তু সেই তিনিই যখন ছোটপর্দায় পা রাখলেন এক প্রকার কামাল করে দিলেন। বর্তমান যুগ টিভির যুগ। তাই টিভির গল্প দিয়েই লেখা শেষ করব। ২০১৩ সালে অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওর জন্য রোমান কপোলা, জ্যাসন শোয়ার্টজম্যান আর পল ওয়েইটজ একটি কমেডি ড্রামা টিভি সিরিজ লিখলেন। ওবোইস্ট ব্লেয়ার টিন্ডেলের লেখা বইয়ের উপর আধারিত ‘মোজার্ট ইন দি জাঙ্গাল’ তরুণ বাজনাদার হেইলির জীবনের আর অর্কেস্ট্রা কন্ডাক্টর রডরিগোর সঙ্গে তার সম্পর্কের উত্থান পতনের গল্প। কমেডি এখন হাসির আঙিনা ছাড়িয়ে মজার আড়ালে জীবনের কথা বলে তাই এই সিরিজেও আমরা পেয়েছি শিল্পীদের কঠিন জীবনসংগ্রাম থেকে অর্কেস্ট্রা নিয়ে কর্পোরেট রাজনীতি আর এই সবের মাঝখানে দমকা বাতাসের মতন এক প্রেমের গল্প। রডরিগো ডি সুজার ভূমিকায় গায়েল এবং সিরিজের নামকরণ স্বার্থক করে সে সত্যিই এক উদ্ভ্রান্ত জিনিয়াস যে নিজের পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে একেবারেই সচেতন নয়। মিউজিক রডরিগোর জীবনের শেষ কথা। মোজার্ট, বাখ, বেঠোভেনের সঙ্গে কল্পনায় অবাধ ওঠাবসা। জগৎ সংসারে উদাসীন তার একাধিক কার্যকলাপে রাগ হলেও আমরা রাগ করতে পারি না। শিশু সুলভ সততা আর অমলিন হাসিতে রডরিগোর চরিত্রকে গায়েল সোনালী রোদের মত রঙিন করে পর্দায় তুলে ধরেছেন। সেরা কমেডির অভিনেতা হিসেবে ২০১৬ সালে গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার জিতেছেন। রডরিগোর চরিত্র গায়েল নিজের আর্টিস্ট সত্ত্বাকে বাস্তবের আড়াল সরিয়ে নগ্ন করতে পারার স্বাধীনতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

 

 

সর্বনাশী এই লকডাউনের বছরে রডরিগোর হাত ধরেই গায়েলের সঙ্গে আমার আলাপ। তারপর একের পর এক ছবি দেখে মুগ্ধতা বেড়েছে বই কমেনি। সেইরকমই এক মুঠো ছবির হদিশ দিলাম। এই বছর অস্কার বিজয়ী পরিচালক বং জুন হো বলেছিলেন সাবটাইটেলের দু ইঞ্চির বেড়া টপকাতে পারলে সিনেমার বহু অচেনা জগৎ আমাদের হাতের নাগালে এসে পড়বে। তাই এই লকডাউনের পুজোতে নানান দেশের সিনেমা একটু চেখেই দেখুন না! বড় স্টার তো আমরা অনেক দেখেছি, একজন নিখাদ অভিনেতার কাজ নেহাত মন্দ লাগবে না।