ড্রাকুলার অতিথি ● ব্রাম স্টোকার ● অনুবাদ: সুদীপ দেব


 

 

মাদের যাত্রা শুরুর সময়তেও ম্যুনিখের আকাশ ছিল পরিষ্কার। উজ্জ্বল সূর্যালোক আর মনোরম বাতাসে ছিল গ্রীষ্মের আগমনবার্তা।

আমরা রওনা হওয়ার ঠিক আগে আমি যে হোটেলে উঠেছিলাম সেই কোয়াটার জিস্যাঁস-এর মালিক হের ডেলব্রোক তাড়াহুড়ো করে নেমে এগিয়ে এলেন। আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কোচোয়ানকে বললেন, “সন্ধে নামার আগে ফিরে এসো মনে করে। আকাশ পরিষ্কার থাকলেও মাঝে মাঝে উত্তুরে হাওয়ার ঠান্ডা ঝাপটা দিচ্ছে। হঠাৎ ঝড়টড় উঠতে পারে।” এরপর একটু হেসে বললেন, “আমি জানি তোমার দেরি হবে না। কারণ আজকে রাতটার বিশেষত্ব নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার।”

জোহান জোরালোভাবে উত্তর দিল, “ইয়া, মাইন হের।” এরপর মাথার টুপিটা চেপে ধরে গাড়ি ছাড়ল সে। শহরের বাইরে বেরিয়ে আসার পর আমি গাড়ি থামাতে বলে জিজ্ঞেস করলাম, “জোহান, আজকে রাতের বিশেষত্ব কী?”

সে বুকে ক্রস এঁকে জার্মানিতে ছোট্ট উত্তর দিল, “ওয়ালপোর্গিস ন্যাহট্‌।” তারপর সে তার ঘড়িটা বের করল। পুরোনো ফ্যাশনের জার্মান সিলভারের ঘড়ি। ভুরুটুরু কুঁচকে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে অসহিষ্ণুভাবে কাঁধ ঝাঁকাল। বুঝলাম, সময় নষ্ট হচ্ছে বলে সে এভাবেই একটা ইঙ্গিত দিল। আমি তাকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিলাম। একটুও দেরি না করে সে তাড়াতাড়ি গাড়ি হাঁকাল। ঘোড়াগুলো মাঝে-মধ্যেই সন্দেহজনকভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে নাক উঁচিয়ে বাতাসে কিছু শুঁকছে। আমিও চারিদিকটা একবার ভালো করে দেখে নিলাম। রাস্তাঘাট বেশ নির্জন। আমরা যে এলাকা দিয়ে চলেছি সে জায়গাটা বাতাস বয়ে সৃষ্টি হওয়া অসমতল উঁচু-নিচু উপত্যকা। একটা পথ নেমে গিয়েছে পাশের ঢালু জায়গার দিকে। দৃশ্যটা এত সুন্দর লাগল যে জোহান বিরক্ত হবে জেনেও তাকে আরেকবার থামতে বললাম। গাড়ি থামার পর আমি তাকে ওই পথ দিয়ে যেতে বললাম। সে কিছুতেই যেতে রাজি হল না। নানারকম ওজর-আপত্তি তুলে বারবার বুকে ক্রস আঁকতে লাগল। এতে আমি আরও কৌতূহলী হয়ে তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। সেও নাছোড় হয়ে অসংলগ্ন উত্তর দিতে দিতে বারবার ঘড়ি দেখতে লাগল।

শেষপর্যন্ত আমি বললাম, “ঠিক আছে জোহান। তুমি যেতে না চাইলে আমি জোর করব না। আমি একাই ওই পথে হেঁটে যাব। কিন্তু তোমায় বলতে হবে, কেন তুমি যেতে চাইছ না। কারণটা কী?”

সে আমার কথা শুনে ত্বরিতে আসন থেকে নেমে এসে আমার সামনে দু-হাত ছড়িয়ে দাঁড়াল। আমাকে কিছুতেই যেতে দেবে না। জার্মান আর অল্প ইংরেজিতে মিশিয়ে যা বলল তাতে এটুকুই বুঝতে পারলাম যে এমন কিছু ব্যাপার আছে, যাতে সে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছে। থেকে-থেকেই একটা কথা পুনরাবৃত্তি করছে, “ওয়ালপোর্গিস ন্যাহট্‌!”

আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু যার ভাষাটাই ভালোভাবে জানি না তাকে বুঝিয়ে ওঠা ভারী দুঃসাধ্য কাজ। ওর বরং এই সুবিধাটা বেশি, কারণ ও অসংলগ্ন হলেও ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে কথা চালিয়ে যেতে পারে। অবশ্য খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে এখন সে দেশীয় ভাষাতেই বকে চলেছে আর ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। এই সময় ঘোড়াগুলোও সহসা চঞ্চল হয়ে উঠল, আর নাক বাড়িয়ে বাতাসে গন্ধ শুঁকতে লাগল। তাদের ব্যাপারস্যাপার দেখে জোহান ভয়ে পাংশু হয়ে গেল, আর সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে চারদিকে দেখতে লাগল। তারপর হঠাৎ সামনের দিকে লাফিয়ে এসে ঘোড়ার লাগাম ধরে এগিয়ে নিয়ে তাদের প্রায় কুড়ি ফুট দূরে গিয়ে রাখল। আমি এগিয়ে গিয়ে তার কাছে এই আচরণের কারণ জানতে চাইলাম। উত্তরে সে আবার বুকে ক্রশ আঁকল। তারপর গাড়িটা সরিয়ে এনে আমরা যে জায়গাটায় দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে আঙুল তুলে দেখাল। ওই রাস্তার দিকে একটা ক্রশ পোঁতা আছে, সেদিকে নির্দেশ করে প্রথমে জার্মানে তারপর ইংরেজিতে বলল, “যারা নিজেদের হত্যা করে, ওখানে তাদের কবর রয়েছে।”

“ওহো! সুইসাইড। তাই বলো!” আমার মনে পড়ল এরকম রাস্তার মোড়ে আত্মহননকারীদের সমাধি দেওয়া হয়। কিন্তু ঘোড়াগুলোর এই অস্বাভাবিক আচরণের কারণটা ঠিক বুঝলাম না।

আমাদের কথার মধ্যেই শুনতে পেলাম অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের আর্তনাদ। ঘোড়াগুলো আরও অস্থির হয়ে উঠেছে। জোহান তাদের প্রাণপণে শান্ত করার চেষ্টা করে চলেছে। ভয়ে বিবর্ণ মুখে সে বলল, “নেকড়ের ডাক— কিন্তু এদিকে তো এখন কোনো নেকড়ে নেই।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “নেই? কিন্তু শহরের বাইরেই তো ওগুলো থাকে বলে জানি।”

“অনেক আগে ছিল।” সে বলল, “তাও শেষ-বসন্তে আর গরমের সময় দেখা যেত। বরফ পড়লে নেকড়ের পাত্তা পাওয়া মুশকিল।”

সে যখন ঘোড়াগুলির গায়ে হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এরমধ্যেই কখন যেন আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। সূর্যের আলো ঢাকা পড়ে গেল, আর একটুখানি হিমশীতল হাওয়া নিঃশ্বাস-বাষ্পের মতো আমাদের ছুঁয়ে গেল। যেন চকিত সাবধানবাণী। এরপরেই আবার প্রখর রোদ্দুর ফিরে এল।

জোহান দিগন্তের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, “অনেকদিন পর তুষারঝড় আসছে।” আবার সে তার ঘড়ির দিকে তাকাল। ঘোড়াগুলো অবিশ্রান্তভাবে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে মাটিতে পা ঠুকছে। জোহান আসনে বসে লাগামটা শক্ত করে ধরে গাড়ি ছাড়ার জন্য প্রস্তুত হল।

আমি গাড়িতে না উঠে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

“এই রাস্তাটা কোথায় গিয়েছে বলো।” আমি আঙুল তুলে দেখালাম।

আবার সে বিড়বিড় করে কিছু প্রার্থনা করে বুকে ক্রস এঁকে বলল, “অশুভ।”

“কোনটা অশুভ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“ওই গ্রাম।”

“তাহলে ওদিকে একটা গ্রাম আছে?”

“না, না। কয়েকশো বছর ধরে সেখানে কেউ থাকে না।”

আমার কৌতূহল বেড়ে গেল, “এই যে বললে ওখানে একটা গ্রাম রয়েছে?”

“গ্রাম ছিল।”

“তাহলে কোথায় গেল সে গ্রাম?”

এরপর সে জার্মান আর ইংরেজি মিশিয়ে একটা লম্বা গল্প বলে চলল। সবটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। মোটামুটি যা বুঝলাম তা হল এই, কয়েকশো বছর আগে সেখানে বেশ কিছু লোক মারা যায় আর তাদের কবর দেওয়া হয়। কিন্তু মাটির নীচে থেকে এখনও তাদের আওয়াজ শোনা যায়। কবর খুঁড়ে নারী পুরুষের রক্তাক্ত মুখে প্রাণের চিহ্ন দেখা গিয়েছে। যারা কবর খুঁড়েছিল এসব দেখে তারা অবিলম্বে পালিয়ে যায় অনেক দূরে— যেখানে জীবিত মানুষেরা সত্যিই জীবিত আর মৃতেরা সত্যিকারের মৃত। এই বলে জোহান আবার নিজের বুকে ক্রস আঁকল। শেষের কথাগুলো বলতে বলতে দৃশ্যতই সে ভয়ে কাঁপছিল। তার গল্প যত এগোতে লাগল ক্রমশই সে আরও উত্তেজিত হয়ে পড়ল। যেন সেই কাহিনি তাকে ভর করেছে, শেষের দিকে তার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেল, ঘেমে-নেয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সে এমনভাবে চারিদিকে তাকাতে লাগল যেন এই প্রকাশ্য দিবালোকে অশরীরী আত্মারা এসে তাকে ঘিরে ধরবে।

শেষে আমাকে গাড়িতে উঠতে ইশারা করে সেই একই কথা চিৎকার করে বলে উঠল, “ওয়ালপোর্গিস ন্যাহট্‌!”

আমার ইংরেজ রক্ত গরম হয়ে উঠল। আমি অবিচল দাঁড়িয়ে থেকে বললাম, “তুমি ভয় পাচ্ছ জোহান। বাড়ি চলে যাও, আমি একাই ফিরব। হাঁটতে আমার ভালোই লাগবে।” গাড়ির দরজাটা খোলাই ছিল। আমি আসনের উপর থেকে আমার ওক কাঠের লাঠিটা তুলে নিলাম— আমার অবসরের সঙ্গী এই লাঠি— তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। ম্যুনিখের দিকে লাঠি তুলে দেখিয়ে বললাম, “বাড়ি যাও জোহান। ইংরেজ ওয়ালপোর্গিস ন্যাহট্‌কে ডরায় না।”

ঘোড়াগুলো এখন চূড়ান্ত অস্থির হয়ে উঠেছে, তাদের ধরে রাখার চেষ্টা করতে করতে জোহান মিনতি করে বলতে লাগল যেন এমন বোকামো না করি। বেচারাকে দেখে কষ্ট হচ্ছে, সে আন্তরিকভাবেই আমার ভালো চাইছে, কিন্তু এসব দেখে আমার বরং হাসিই পাচ্ছে। চরম উৎকণ্ঠায় সে এখন শুধু দেশজ জার্মান ভাষাতেই কথা বলছে, ইংরেজির নামগন্ধ নেই। ওর খেয়াল নেই যে, এই ভাষার এক বর্ণও আমার বোধগম্য হচ্ছে না। একসময় বিরক্ত হয়ে বলে উঠলাম, “বাড়ি যাও!” বলেই আমি পিছন ফিরে তেমাথার মোড় থেকে উপত্যকার দিকের রাস্তায় হাঁটা দিলাম।

হতাশ হয়ে জোহান ম্যুনিখের দিকে গাড়ি ঘোরাল। আমি লাঠিতে ভর দিয়ে একবার তার দিকে ফিরে দেখলাম। সে ধীরে ধীরে সেই রাস্তা ধরে ফিরে চলেছে। সহসা পাহাড়ের মাথায় এক শীর্ণকায় লম্বা লোকের আবির্ভাব হল। অনেক দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, সেই লোকটা কাছাকাছি আসতেই ঘোড়াগুলো পা ছুঁড়ে লাফিয়ে আর্তনাদ করে উঠল। জোহান আর তাদের ধরে রাখতে পারল না। ঘোড়াগুলো পাগলের মতো তিরবেগে ছুটতে লাগল। তারা চোখের আড়ালে চলে যেতে আমি আগন্তুকের দিকে চোখ ফেরালাম। কিন্তু সেই লোকটাও আর নেই, চলে গিয়েছে।

জোহান যে উপত্যকার দিকে যেতে নিষেধ করেছিল, এবার আমি নিশ্চিন্তমনে সেদিকেই হাঁটা লাগালাম। তার এই আপত্তির বিন্দুমাত্র যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। কত সময় ধরে কতটা পথ হেঁটে এলাম খেয়াল নেই, কিন্তু কোনো বাড়িঘর বা মানুষজন চোখে পড়ল না। খুব নির্জন পরিত্যক্ত জায়গা। রাস্তার একটা বাঁক ঘুরে এতক্ষণ যা দেখিনি তাই চোখে পড়ল। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কাঠের টুকরো। বুঝতে পারলাম, এই জায়গাটা তার নির্জনতার জন্যই অবচেতনে আমাকে মুগ্ধ করেছিল।

আমি বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসে চারিদিকটা চেয়ে দেখতে লাগলাম। এতটা হেঁটে আসার পরও কিন্তু বেশ ঠান্ডা লাগছে। আমার চারপাশ থেকে কেমন একটা ফিসফিস শব্দও ভেসে আসছে। মাথার উপর থেকেও গর্জন শুনতে পেলাম। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে কালো মেঘপুঞ্জ দ্রুত গতিতে ধেয়ে এসে পুরো আকাশটা ছেয়ে ফেলছে। এইরকম ঘন কালো মেঘের স্তম্ভ হল ঝড়ের পূর্বাভাস। এতটা হেঁটে আসার পর বসার ফলেই মনে হয় শীত শীত লাগছে। উঠে আবার হাঁটা লাগালাম।

এবার যে জায়গাটা দিয়ে চলেছি সেটা ছবির মতো সুন্দর। চোখ আটকে যাওয়ার মতো বিশেষ কোনো দ্রষ্টব্য না থাকলেও সর্বত্রই সৌন্দর্যের ছাপ রয়েছে। সময়ের খেয়াল ছিল না, গোধূলির আলো কমে এলে মনে পড়ল এবার বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পাব তো? বাতাস বেশ ঠান্ডা, মাথার উপর মেঘ আরও জমাট বেঁধে এসেছে। দূর থেকে মেঘের গর্জন ভেসে আসছে, আর তার মাঝেই শোনা যাচ্ছে সেই রহস্যময় কান্নার আওয়াজ— ড্রাইভারের ভাষায় যা কিনা নেকড়ের ডাক। সহসা একটু ইতস্তত করলাম। শুনেছিলাম এখানে একটা পরিত্যক্ত গ্রাম রয়েছে। তাই আবার হাঁটা লাগালাম, কিন্তু একসময় চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা একটা খোলা প্রান্তরে এসে উপস্থিত হলাম। পাহাড়ের দিক থেকে গাছের সারি ঢালু হয়ে নেমে এসেছে। এখানে সেখানে ঝোপঝাড় আর গর্ত। রাস্তাটা কিছুটা দূরে বেঁকে গিয়ে এরকমই একটা ঘন ঝোপের পিছনে হারিয়ে গিয়েছে।

সেদিকে তাকিয়ে আছি, এমন সময় দমকা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল আর তুষারপাত শুরু হল। মনে পড়ল যে আমি মাইলের পর মাইল জনশূন্য প্রান্তর পিছনে ফেলে এসেছি। সামনে একটা কাঠের স্তূপের নীচে আশ্রয় নেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলাম। ক্রমশই আকাশ আরও অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল আর সেই সঙ্গে বাড়তে লাগল বরফ পড়ার তীব্রতা। দেখতে দেখতে আমার চারপাশে সাদা বরফের চাদরে ছেয়ে গেল। রাস্তার চিহ্নটুকুও আর আলাদা করে চেনার উপায় রইল না। খানিক বাদেই পায়ের নীচে শক্ত জমির বদলে ঘাস আর শ্যাওলার স্পর্শে বুঝতে পারলাম আমি পথ হারিয়েছি। বাতাসের বেগ আরও বেড়েছে, যেন সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমার উপর। আমি তার মধ্যেই হন্যে হয়ে ছুট লাগালাম। এত পরিশ্রমের পরেও ঠান্ডায় হাড়ে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে। এত জোরে বরফ পড়ছে যে চোখের পাতা খোলা রাখাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। থেকে-থেকেই আকাশ চিরে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছে। সেই আলোতে দেখতে পেলাম সামনে ঘন বরফে ছাওয়া ইউ আর সাইপ্রাস গাছের সারি।

তাড়াতাড়ি সেই গাছের নীচে আশ্রয় নিলাম। জায়গাটা বেশ নির্জন। মাথার অনেক উপর থেকে বাতাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। নিকষ কালো ঝড় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে রাতের আঁধারের সঙ্গে। একসময় ঝড়ের প্রকোপ কমে এল। এখন শুধু দমকা ঝড়ো হাওয়া বয়ে চলেছে। ঠিক এই মুহূর্তেই আরও নানারকম শব্দের সঙ্গে মিশে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল সেই নেকড়ের আর্তনাদ।

মাঝে-মধ্যে মেঘের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ছিটকে এসে পড়ছিল। সেই আলোতে দেখলাম, আমি ইউ আর সাইপ্রাস গাছের জঙ্গলের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। তুষারপাত থেমে গেছে। আমি জঙ্গলের আশ্রয় থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে চারিদিকটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলাম। মনে হল যে সব ভগ্নস্তূপ পেরিয়ে এসেছি তার মধ্যে একটা এমন বাড়ি নিশ্চয়ই থাকবে, ভাঙাচোরা হলেও যার মধ্যে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও আশ্রয় নিতে পারব। ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে নিচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এমনই একটা বাড়ি দেখতে পেলাম— একটা আশার আলো। সাইপ্রাস গাছের মধ্যে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে বাড়িটার দিকে। ঠিক এই সময়তেই মেঘ এসে আবার চাঁদকে আড়াল করে দিল। অন্ধকারের মধ্যে আমি পথটা পেরিয়ে এলাম। ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপুনি লাগছে, কিন্তু আশ্রয়ের আশায় অন্ধের মতো আমি এগিয়ে চললাম।

চারিদিক এতটাই নিস্তব্ধ যে আমি থমকে দাঁড়ালাম। ঝড় থামার পর প্রকৃতির সেই অস্বাভাবিক নৈশব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমার হৃদস্পন্দনও যেন থেমে গেল। সেই মুহূর্তে মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারল চাঁদ, সেই আলোয় দেখতে পেলাম আমি একটা গোরস্থানের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, আমার সামনে বিরাট একটা চৌকো মর্মর সৌধ। ঠিক যেমন আশপাশে মাটিতে জমে থাকা বরফের রঙ, তেমনি ধবধব করছে সাদা। চাঁদের আলো আর দমকা বাতাসের সঙ্গে দূর থেকে ভেসে এল সমবেত কুকুর আর নেকড়ের অভিশপ্ত ডাক। ভয়ের একটা হিমেল স্রোত আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। স্থানু হয়ে গেলাম। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে শ্বেতপাথরের সমাধি, ঝড়ো হাওয়ার দাপট ফিরে ফিরে আসছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি সেদিকে এগিয়ে চললাম। আমাকে জানতে হবে এমন একটা জায়গায় এমন একটা স্থাপত্য নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে কেন। চারপাশে ঘুরে এলাম ডোরিক তোরণের সামনে। জার্মানে লেখা রয়েছে:

 

COUNTESS DOLINGEN OF GRATZ

IN STYRIA

SOUGHT AND FOUND DEATH

1801

(কাউন্টেস ডলিঙেন অফ গাৎজ/স্টিইরিয়ায়/অনুসন্ধান করে মৃত উদ্ধার করা হয়/ ১৮০১)

 

সমাধির একদম উপরে মার্বেলের কয়েকটা বড় বড় চাঙর ভেদ করে উঠেছে একটা ইস্পাতের বর্শা বা শূল। পিছনদিকে গিয়ে দেখতে পেলাম বড় বড় রাশিয়ান অক্ষরে খোদাই করে লেখা রয়েছে:

মৃতেরা দ্রুত ভ্রমণ করে

পুরো ব্যাপারটাতেই এমন একটা অস্বাভাবিক গা ছমছমে আবহ জড়িয়ে আছে যে প্রথমবারের জন্য আমার মনে হল জোহানের কথা শুনলেই ভালো করতাম। আরও একটা কথা মনে পড়ায় ভীষণভাবে নাড়া খেয়ে গেলাম, আজ ওয়ালপোর্গিস রাত!

লক্ষ লক্ষ মানুষ মনে করে, ওয়ালপোর্গিস রাত হল সেই রাত, যখন শয়তানেরা বাইরে বেরিয়ে আসে— যখন কফিনের ঢাকনা খুলে কবর থেকে উঠে আসে মৃত মানুষের দল, আর হেঁটে-চলে বেড়ায়। যখন জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে সমস্ত অশুভ শক্তিরা উল্লাসে মেতে ওঠে। আমার গাড়ির চালক এখানে আসতেই ভয় পেয়েছিল। এই সেই শতাব্দীপ্রাচীন অভিশপ্ত গ্রাম, যেখানে আত্মহননকারীদের সমাধি রয়েছে। এমন এক জায়গায় এখন আমি সম্পূর্ণ একা— নিঃসঙ্গ। ঝড়ের মধ্যে বরফে আচ্ছাদিত হয়ে ঠান্ডায় কাঁপছি। আমার সমস্ত শিক্ষাদীক্ষা, দর্শন যেন ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। সর্বশক্তি সঞ্চয় করে চেষ্টা করলাম যাতে আকস্মিক কোনো ভয়ে অজ্ঞান না হয়ে যাই।

তারপরেই এক ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ল আমার উপর। মাটি এমনভাবে কাঁপতে লাগল যেন হাজার হাজার ঘোড়া ছুটে চলেছে একসঙ্গে। এবার আর বরফ নয়, ঝড় তার হিমেল ডানায় বয়ে আনল ভয়ানক শিলাবৃষ্টি। এত প্রবল সেই শিলাবৃষ্টি যে সেই গর্জনে মনে হতে লাগল যেন লক্ষ লক্ষ দামামা বাজছে একযোগে। সাইপ্রাস গাছগুলোর পাতা ভেদ করে শিলাখণ্ড নেমে আসছে। ছুটে একটা গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম গাছের পাতার আচ্ছাদন এবার আর আশ্রয় দিতে পারবে না। এখন ভরসা একমাত্র সেই মর্মরসৌধের ডোরিক তোরণটি। সেখানে বিশাল ব্রোঞ্জের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে শিলাবৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেলাম। আমার আশপাশে অবিশ্রান্ত শিলাবর্ষণ চলতে লাগল।

দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ানোর ফলে সেটা ভিতরদিকে অল্প ফাঁক হয়ে গেল। এই নির্দয় দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে কবরের আশ্রয় বরং ভালো। দরজা ঠেলে সবে ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছি এমন সময় আকাশের প্রান্ত থেকে প্রান্ত চিরে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠল। দিগন্ত উদ্ভাসিত করা সেই আলোয় দেখতে পেলাম অপরূপ সুন্দরী এক মহিলা কফিনের উপর শুয়ে আছে। তার গালদুটি সুডৌল, ওষ্ঠ রক্তবর্ণ। বজ্রপাতের সঙ্গে সঙ্গে আমি ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এলাম, যেন কোনো দানব আমাকে টেনে ঝড়ের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল। পুরো ব্যাপারটা এমন আকস্মিকভাবে ঘটল যে আমার শারীরিক বা মানসিক কোনো যন্ত্রণার অনুভুতি কাজ করল না। দেখলাম আমার শায়িত শরীরের উপরে শিলা ঝরে পড়ছে। একইসঙ্গে এমন মনে হল যে আমি আর একা নই। আমি সৌধটার দিকে তাকালাম। সেই মুহূর্তে আবার চোখ ঝলসানো বিদ্যুৎ চমকে উঠল। সৌধটার মাথায় যে শূল আটকানো ছিল ঠিক তার উপরেই বজ্রপাত হল, বাজের অভিঘাতে শ্বেতপাথর ফেটে আগুন জ্বলে উঠল। মৃত মহিলাটি ক্ষণিকের জন্য যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল। তার আর্তনাদ মেঘের গর্জনে চাপা পড়ে গেল। অনেকগুলো ভয়ংকর শব্দের মিলিত ধ্বনি শেষবারের মতো আমার কানে এল। তারপরেই আবার সেই দানবের হাত আমাকে টেনে নিয়ে চলল। আমার শরীরে শিলাবর্ষণ হচ্ছে, বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছে নেকড়েদের সম্মিলিত গর্জনে। শেষ যে দৃশ্য আমার মনে আছে, একটা অস্পষ্ট, সাদা, চলন্ত পিণ্ড— যেন সমস্ত কবর থেকে উঠে এসেছে অশরীরী প্রেতাত্মারা, সাদা মেঘপুঞ্জের মতো ঘিরে ধরে তারা ক্রমশই আমার কাছে, আরও কাছে এগিয়ে আসছে।

 

* * *

ধীরে ধীরে চেতনা অস্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠল, আর তারপরেই এক প্রাণান্ত ভয় আমাকে চেপে ধরল। কিছুক্ষণের জন্য কিছুই মনে করতে পারছিলাম না, তারপর ধীরে ধীরে সব মনে পড়ল। অসহ্য যন্ত্রণায় পা নাড়াতে পারছি না। মনে হল যেন অসাড় হয়ে গিয়েছে। ঘাড়ের পিছন দিকে একটা হিমশীতল স্পর্শ টের পেলাম। ক্রমশই সেটা আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নীচে নেমে আসছে। আমার কানদুটোও পায়ের মতো ব্যাথায় নিঃসাড় হয়ে গিয়েছে। শুধু বুকের কাছে একটা উষ্ণ অনুভূতি বেশ আরাম দিচ্ছে। মনে হচ্ছে সবটাই যেন এক দুঃস্বপ্ন। বুকের উপরে ভারি কিছু একটা চেপে বসেছে, তাই নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।

এইভাবে অর্ধচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। সেটা কেটে যাওয়ার পর খুব সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর একটা গা গুলনো ভাব এল। সমুদ্রযাত্রার প্রথম অবস্থায় যেমন হয় তেমনটা। কোনো কিছুর থেকে— জানি না ঠিক কীসের থেকে— নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার এক অদম্য ইচ্ছে জাগল। এক সীমাহীন নিস্তব্ধতা আমায় গ্রাস করেছে যেন। যেন সারা পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়েছে অথবা মরে গেছে— শুধু যেন আমার কাছে বসে থাকা কতগুলো জন্তুর মৃদু নিঃশ্বাসের শব্দ সেই নিস্তব্ধতায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। আমার গলার কাছে একটা খড়খড়ে অনুভূতি হল। তারপরেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমার হৃদপিণ্ডটা ভয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল, আর মাথায় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। একটা প্রকাণ্ড জানোয়ার আমার উপরে শুয়ে আমার গলাটা চাটছে। আমি ভয়ে স্থানু হয়ে গেলাম। আমার সহজাত প্রবৃত্তি আমায় চুপ করে পড়ে থাকতে বলল। কিন্তু জন্তুটা বোধহয় আমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন টের পেয়েছে। তাই সে তার মাথাটা তুলল। চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখলাম আমার উপর এক দৈত্যাকার নেকড়ের দুটো বড় বড় চোখ জ্বলজ্বল করছে। লাল মুখের ভিতর চকচক করছে ধারালো সাদা দাঁত। তার জান্তব গরম নিঃশ্বাস এসে পড়ছে আমার উপর।

আবার খানিকক্ষণ কিছু মনে ছিল না। একটা গোঙানির শব্দে জ্ঞান ফিরল। তারপরেই আবার এক তীক্ষ্ণ চিৎকার। ক্রমাগত চলতেই লাগল। মনে হল যেন অনেক দূর থেকে অনেকে মিলে বলছে, “আরে! আরে!” সাবধানে মাথাটা অল্প তুলে যেদিক থেকে আওয়াজটা আসছে সেদিকে দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু গোরস্থানটা আমার দৃষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল। নেকড়েটা এখনও সেই অদ্ভুত ভঙ্গীতে ডেকে চলেছে। তার উজ্জ্বল লাল দুটি অক্ষিগোলক ঘুরে গেল সাইপ্রাস ঝাড়ের দিকে। ওইদিক থেকেই আওয়াজটা আসছে। কণ্ঠস্বরগুলি এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে নেকড়েটা আরও জোরে বীভৎসভাবে ডেকে উঠল। আমি ভয়ে চুপ করে কাঠ হয়ে পড়ে রইলাম। আমার চারিদিকে গাঢ় অন্ধকারের সঙ্গে জড়ানো সাদা চাদরের মধ্যে দিয়ে একটা লাল আলো ফুটে উঠতে দেখলাম। হঠাৎ গাছের আড়াল থেকে একদল অশ্বারোহী আলো নিয়ে বেরিয়ে এল। নেকড়েটা আমার বুকের উপর থেকে উঠে গোরস্থানের দিকে চলে গেল। অশ্বারোহী বাহিনী যে সেনাদল, তা তাদের টুপি আর সামরিক পোষাক দেখে বুঝলাম। তাদের মধ্যে একজন নিজের কারবাইন তুলে তাক করল। তার এক সঙ্গী হাত তুলে তাকে বাধা দিল আর শুনতে পেলাম আমার মাথার উপর দিয়ে বুলেটটা শব্দ করে বেরিয়ে গেল। ওই লোকটা নিশ্চয়ই আমার শরীরটাকে নেকড়ে বলে ভুল করেছিল। আরেকজন জানোয়ারটাকে পালাতে দেখে গুলি চালাল। তারপর টগবগ শব্দ শুনতে পেলাম— একদল আমার দিকে এগিয়ে এল, আর-একদল তুষারাবৃত সাইপ্রাস বনের দিকে নেকড়েটাকে ধাওয়া করে গেল।

তারা আমার কাছে এগিয়ে আসতে আমি উঠতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু শরীরে আর বল ছিল না। দেখতে পেলাম, তারা আমার চারপাশে এসে ঘিরে দাঁড়াল। দু-তিনজন সেনা ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে আমার পাশে হাঁটু মুড়ে বসল। একজন আমার মাথাটা তুলে ধরে বুকের উপর হাত রাখল।

“ভালো খবর, বন্ধুরা!” সে চিৎকার করে বলল, “বুক এখনও ধুকপুক করছে।”

আমার গলায় খানিকটা ব্রান্ডি ঢেলে দেওয়া হল। এতে খানিকটা বল পেলাম। ভালো করে চোখ মেলে চারপাশটা দেখলাম। গাছগুলোর মধ্যে আলো-ছায়া ঘোরাফেরা করছে। শুনলাম, দূরে কয়েকজন একে অপরকে ডাকাডাকি করছে। তারপর ভীত-সন্ত্রস্তভাবে সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে কবরখানা থেকে ছুটে বেরিয়ে এল। সবার চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। কাছাকাছি আসার পর আমার চারপাশে যারা বসেছিল তাদের একজন ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, “ওটাকে খুঁজে পেলে?”

জবাবে সবাই একযোগে বলে উঠল, “না! না! তাড়াতাড়ি চলে এসো। জলদি! এখানে আর এক মুহূর্ত না। আর আজ রাতে তো একদমই নয়!”

“ব্যাপার কী?” সবাই নানাভাবে জিজ্ঞেস করতে লাগল। যেরকম অসংলগ্নভাবে উত্তরগুলো আসতে লাগল তাতে একটা ব্যাপার বোঝা গেল যে ওই লোকগুলো সবাই একসঙ্গে এমন একটা কিছু দেখেছে যাতে আতঙ্কে, ভয়ে, গুছিয়ে কথা বলতে পর্যন্ত পারছে না।

একজন অতিকষ্টে বলতে পারল, “ওটা... ওটা কী... সত্যি!”

“নেকড়ে... কিন্তু নেকড়ে নয়!” আরেকজন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল।

“পবিত্র বুলেট ছাড়া ওটাকে মারা যাবে না।” তৃতীয়জন কিছুটা স্বাভাবিকভাবে বলল।

“আজকে রাতের জন্য যথেষ্ট হয়েছে। সত্যিই অনেক কাজ করে ফেলেছি।” চতুর্থজন বলল।

“ভাঙা মার্বেলের উপর রক্তের চিহ্ন দেখলাম।” আরেকজন একটু থেমে বলল, “বাজ পড়ে নিশ্চয়ই তা আসেনি। আর উনি— উনি ঠিক আছেন তো? ওঁর গলাটা দেখো! দেখো বন্ধুরা, নেকড়েটা ওঁর বুকের ওপর বসে ওঁর রক্ত গরম রেখেছিল।”

অফিসার আমার গলার কাছটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, “উনি ঠিক আছেন। চামড়ায় ফুটো নেই। কিন্তু এর মানে কী? ওই নেকড়েটা চিৎকার না করলে তো আমরা এঁকে খুঁজেই পেতাম না।”

“সেটার কী হল?” আমার মাথাটা যিনি ধরে রেখেছিলেন তিনি জিজ্ঞেস করলেন। এঁকে অতটা ভয় পেয়েছে বলে মনে হল না, কারণ তাঁর হাতে কাঁপুনির কোনো লক্ষণ নেই। তাঁর কাঁধে দেখলাম ছোট অফিসারের শেভরন রয়েছে।

একজন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে চারিদিকে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিয়ে ফ্যাকাসে মুখে বলল, “সেটা ঘরে চলে গেছে। এখানে ওর শোওয়ার জন্য অনেক কবর আছে। চলে এসো বন্ধুরা... জলদি! এই অভিশপ্ত জায়গা অবিলম্বে ত্যাগ করা উচিত।”

অফিসারটি আমাকে তুলে বসালেন। তারপর তাঁর আদেশে কয়েকজন মিলে আমাকে তুলে একটা ঘোড়ার পিঠে চাপাল। তিনি আমার পিছনে বসে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে রইলেন। তারপর তিনি এগোতে নির্দেশ দিলেন। সাইপ্রাস বনের থেকে মুখ ঘুরিয়ে আমরা সামরিক ছন্দে এগিয়ে চললাম।

আমার জিভ এখনও অসাড় হয়ে আছে, তাই কথা বলতে পারছি না। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তারপর আমার যা মনে পড়ে, দু-পাশে দুই জওয়ানের কাঁধে ভর দিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি। দিনের আলো ফুটে উঠেছে। তেরছা সূর্যরশ্মি বরফে বিচ্ছুরিত হয়ে পথটাকে রক্তে রাঙা বলে মনে হচ্ছে। অফিসারটি তাঁর লোকেদের ঘটনাটা যেমন দেখেছে তা বলতে নিষেধ করে দিলেন। শুধু বলতে বললেন যে, তারা এক ইংরেজ আগন্তুককে দেখতে পায়। একটা বড় কুকুর তাঁকে পাহারা দিচ্ছিল।

“কুকুর! ওটা কুকুর নাকি?” ভয় পাওয়া লোকেদের মধ্যে একজন বলে উঠল, “আমি কি নেকড়ে চিনি না?”

তরুণ অফিসারটি শান্তভাবে বললেন, “আমি বলছি, ওটা কুকুর।”

“কুকুর!” লোকটা একই কথা পুনরাবৃত্তি করল, দিনের আলোর সঙ্গে সঙ্গে তার হারানো সাহস ফিরে এসেছে, আমার দিকে দেখিয়ে সে বলল, “ওঁর গলার দিকে দেখুন। এটাকেও কি কুকুরের কাজ বলবেন স্যার?”

স্বভাবতই আমি গলায় হাত বুলোলাম, আর ছোঁয়ামাত্র যন্ত্রণায় কাতরে উঠলাম। সবাই আমার দিকে ফিরে তাকাল। কেউ কেউ ঘোড়া থেকে নেমে এগিয়ে এল। আবার তাদের উদ্দেশে তরুণ অফিসারটি ঠান্ডা স্বরে বললেন, “আমি বলছি, কুকুর। অন্য কিছু বললে সবাই আমাদের কথা শুনে হাসবে।”

তারপর আমি এক জওয়ানের পিছনে ঘোড়ায় উঠে ম্যুনিখের শহরতলির রাস্তা দিয়ে রওনা দিলাম। একটু পরে একটা গাড়ি পাওয়া গেল। আমি তাতে উঠে হোটেল কোয়াটার জিস্যাঁস-এর উদ্দেশে চললাম। তরুণ অফিসারটি আমার সঙ্গে রইলেন। আর একজন সেনা ঘোড়ায় চড়ে আমাদের পিছন পিছন চলল। বাকিরা সবাই ব্যারাকে ফিরে গেল।

হের ডেলব্রোক যেন আমাদের পথ চেয়েই বসে ছিলেন। আমরা পৌঁছনোমাত্র হন্তদন্ত হয়ে নেমে এগিয়ে এলেন। আমার হাতদুটো ধরে উনি আমাকে ভিতরে নিয়ে চললেন। অফিসারটি আমায় স্যালুট ঠুকে বিদায় নিতে চাইলে আমি তাঁকে আমার সঙ্গে ঘরে আসতে অনুরোধ করলাম। এক গ্লাস ওয়াইন পেশ করে আমাকে উদ্ধার করার জন্য তাঁকে আর তাঁর দলবলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানালাম। তিনি নির্বিকারভাবে বললেন তিনি শুধু নিজের কর্তব্য পালন করেছেন, বরং ধন্যবাদ প্রাপ্য হের ডেলব্রোকের, কারণ তিনিই সময়মতো অনুসন্ধান করার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। এই কথায় হোটেলের মালিক মৃদু হাসলেন। এরপর অফিসার বিদায় নিলেন।

“কিন্তু হের ডেলব্রোক,” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কেন আর কীভাবে ওই সেনাদের আমায় খোঁজার জন্য পাঠালেন?”

যেন কিছুই করেননি এমন ভঙ্গীতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে উনি বললেন, “আমার ভাগ্য ভালো, যে রেজিমেন্টের কাছে আমি কিছু স্বেচ্ছাসেবক চেয়েছিলাম তার কম্যান্ডার সেটা মঞ্জুর করেছিলেন।”

“কিন্তু আমি যে হারিয়ে গেছি সেটাই বা জানলেন কী করে?” আমি জিজ্ঞেস করালাম।

“ড্রাইভার তার ভাঙা গাড়িটা নিয়ে ফিরে এল, ঘোড়াগুলো সব পালিয়ে গেছে। খুব বিধ্বস্ত লাগছিল ওকে।”

“নিশ্চয়ই এই কারণে আপনি সেনাদের সার্চ পার্টি পাঠাননি?”

“তা নয়, কোচোয়ান ফিরে আসার আগেই আপনি যে বোয়ারের অতিথি, তাঁর টেলিগ্রাম পেয়েছিলাম।” এই বলে তিনি পকেট থেকে একটি টেলিগ্রাম বের করে আমার হাতে দিলেন। আমি পড়লামঃ

 

বিস্ত্রিজ,

আমার অতিথি সম্পর্কে সাবধান— তাঁর সুরক্ষা আমার কাছে সবথেকে মূল্যবান। তাঁর কিছু হলে, তিনি হারিয়ে গেলে, তাঁকে খোঁজার জন্য সবরকম ব্যবস্থা করবেন। তাঁর সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন। তিনি একজন ইংরেজ, তাই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। বরফ আর নেকড়ে এবং রাত খুবই বিপজ্জনক। তাঁর ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা দেখলে এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করবেন না। আপনার সর্বাঙ্গীণ কুশল কামনা করি।

ড্রাকুলা।

 

টেলিগ্রামটা হাতে নিয়ে আমার মাথা ঘুরতে লাগল, হোটেলের মালিক না ধরলে হয়তো পড়েই যেতাম। এ কী রহস্যময় আর অকল্পনীয় ব্যাপার! আমার সমগ্র অস্তিত্ব যেন এক প্রবল বিপরীতধর্মী শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগল। এক অস্পষ্ট অনুভূতি যেন আমাকে অবশ করে ফেলতে লাগল। নিশ্চয়ই কোনো রহস্যময় রক্ষাকবচ আমাকে ঘিরে ছিল। নয়তো অনেক দূরের এক দেশ থেকে তুষারের ছোবল আর নেকড়ের কামড় থেকে আমাকে রক্ষা করার জন্য একেবারে সঠিক সময়ে এমন এক বার্তা এসে পৌঁছল কী করে!

(মূল গল্প: ড্রাকুলা’স গেস্ট)