লাল নীল সবুজের মেলা ● রাকেশকুমার দাস


 

 

সে বছর শরৎকালের আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘে মেঘে নোংরা হয়ে যাওয়া নীল আকাশে দেখা গেছিল বিশাল ভিনগ্রহী স্পেস-শিপটা। আধ-মাইল চওড়া একটা লাট্টুর মতো গোলচে একটা জিনিস আকাশে ঘুরছিল। গায়ে কীসব রঙিন আঁকিবুঁকি ছিল। তাই স্পেস-শিপটা যখন ঘুরছিল, পুরো আকাশ জুড়ে লাল, নীল, সবুজ সমস্ত রঙের রামধনুর মতো নানারঙের হিজিবিজি তৈরি হচ্ছিল।

এসব দেখে প্রথমেই বাচ্চারা যেন পাগল হয়ে গেল আনন্দে। ওরা ওদের আঁকার খাতায় রং-পেন্সিল দিয়ে যেমন হিজিবিজি করে ঠিক সেরকমটাই আকাশে দেখতে পেয়ে ভাবল অন্য দেশের বাচ্চারা এসেছে ওদের সঙ্গে খেলা করতে। বড়দের মধ্যে অবশ্য অনেকেই সন্দেহের নজরে দেখল। রামধনু দেখে ভেবেছিল ভিনগ্রহ থেকে সমকামীরা এসেছে রেইনবো প্যারেড করতে। না না, তখনও সমাজে তাদের সমাদর ছিল না এখনকার মত। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমে প্রমাণ না করা অবধি নিরস্ত হল না যে যেহেতু রামধনু আর শরৎকাল একসঙ্গে সমাপতিত হয়েছে, এটি ভগবান রামচন্দ্রের পুষ্পকরথ না হয়ে যায় না, অকালবোধনের বর্ষপূর্তি পালন করতে এসেছেন। বিরোধীরা আবার এটা প্রমাণ করতে তৎপর হয়েছিল যে ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’-এর উচিত হয়নি রাবণের থেকে পুষ্পকরথ কেড়ে নেওয়া। তবে বেশীরভাগ লোকই শুধুমাত্র অপার বিস্ময়ে অবাক হয়ে এই রাজকীয় দৃশ্য দেখেছিল। নেহাত লাল-নীল-সবুজের হিজিবিজি ছিল বলে মানুষ এলিয়েন শিপ জেনেও ততটা ভয় পায়নি, নইলে পৃথিবী আক্রমণের ভয়ে চারদিকে হুলুস্থুলু পড়ে যেত।

ঠিক হুলুস্থুলু কাণ্ড না হলেও, রাষ্ট্রসংঘের সদরদপ্তরে বেশ শোরগোল পড়ে গেল। তবে ওনাদের সব কিছুই আবার রুদ্ধদ্বার কক্ষে সংঘটিত হয়, তাই বাইরের লোক এ ব্যাপারে বেশি জানতে পারে না। সুযোগ এসেছে ঐতিহাসিক ‘ফার্স্ট কনটাক্ট’ এর ঘটনায় সামিল হওয়ার, তার প্রস্তুতি নিতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এসব ক্ষেত্রে সাধারণত আমেরিকার প্রেসিডেন্টেরই দায়িত্ব গ্রহণের কথা। সিনেমায় সেটাই দেখে বেশি অভ্যস্ত আমরা। তবে এ ব্যাপারে চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ইত্যাদি অনেক দেশই আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে জায়গাটা ছেড়ে দিতে নারাজ। দু-দিন ধরে তাদের মধ্যে যখন এ নিয়ে বাদানুবাদ চলছিল, রাষ্ট্রসংঘের বিজ্ঞানীরা মনিটরের দিকে ব্যগ্র হয়ে বসে ছিল সংযোগ স্থাপনের অপেক্ষায়। দু’শো তিপ্পান্ন রকম যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা যোগাযোগ করার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিল ওই মহাকাশযানের সঙ্গে।

ভিনগ্রহীরাই শেষে সমস্ত আশায় জল ঢেলে দেয়। তারা সবিনয়ে জানিয়ে দেয় ‘ফার্স্ট কনটাক্ট’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে তারা একান্তই অপারগ। একটা ভিডিও সম্প্রচারকারী কম্পাঙ্কে একটি হলুদ ইমোজি এসে আকর্ণ হেসে জানায়, “আপনাদের নিমন্ত্রণের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। কিন্তু মাফ করবেন, আমরা এই মুহূর্তে ল্যান্ডিং করতে পারব না। আমরা চলেছি অনেক দূরের রাস্তায়, এখানে উৎসবে দিন কাটানোর মত সময় আমাদের হাতে নেই।”

ওদের প্রতিটি ভিডিও মেসেজে ইংরেজি, চিনা, ফরাসী, স্প্যানিশ ও রুশ ভাষার সাব-টাইটেল দিয়ে পাঠাচ্ছিল। তবে পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করতে না পারার জন্য ওনারা ক্ষমা চেয়ে নেন। বিশেষ করে বাঙালিদের কাছে বারবার ক্ষমা চান। ওনারা বলেন, “আমরা জানি পৃথিবীতে পঞ্চম স্থানে আছে বাংলা ভাষা। কিন্তু আমাদের অনুবাদক যন্ত্রগুলো এখনও যুক্তাক্ষর লেখা ঠিকঠাক শিখে উঠতে পারেনি।”

আরেকটা ব্যাপারে ওনারা ক্ষমা চেয়ে নেন। নিজেদের ছবি না পাঠিয়ে ইমোজি দিয়ে কথা বলার কারণ জিজ্ঞেস করলে ওনারা জানান যে ওনাদের চেহারা এমন যে মানুষের মস্তিষ্ক তাদের চেহারা সহ্য করতে পারবে না। তাই তারা নিজেদের চেহারার বদলে ইমোজি দিয়ে কথাবার্তা চালাচ্ছেন।

“কিন্তু আমাদের যে অনেক কিছু জানার ছিল!” পৃথিবীর রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে সদ্য-নিযুক্ত মুখপাত্র বার্তা পাঠায়।

এই মুখপাত্র নির্বাচনেও গত দু-দিনে কম তর্কবিতর্ক হয়নি। আমেরিকার দাবি ছিল সব চেয়ে বেশী, আজ পর্যন্ত যত ফার্স্ট কনটাক্টের ঘটনা হয়েছে প্রায় নব্বই শতাংশ তারাই সামলেছে। তা সে সিনেমা হলেই বা কি। চিনাদের দাবি ছিল তারা সবচেয়ে বেশী জনসংখ্যার দেশ। আর সায়েন্স ফিকশনেও তারা খুব দুর্বল নয়। সায়েন্স ফিকশনের কথা উঠতেই আবার রাশিয়া তেড়ে উঠল। তাদের দাবিও হেলাফেলা করা গেল না, হাজার হোক ভূ-খণ্ডের সবচেয়ে বেশী জমিজায়গা তাদের দেশেরই দখলে, আর সায়েন্স ফিকশনও তাদের অবদান কিছু কম নেই। ওদিকে ইথিওপিয়া আর তানজানিয়ার রাষ্ট্র-প্রতিনিধিরা নিজেরা একচোট মারামারি করেনিল। তানজানিয়ার ভদ্রলোক জিতে গেল তার বিশাল বপুর জন্য। সেও আবেদন রাখল যে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রযুক্তিগত-ভাবে উন্নত ‘ওয়াকান্ডা’ তাদের দেশেই অবস্থিত ছিল (এ নিয়ে ইথিওপিয়া আর তানজানিয়ার মধ্যে বিরোধ থাকলেও একটু আগেই তানজানিয়া সেই বিবাদে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করেছে)। আর্থার সি. ক্লার্কের স্মৃতিকে সম্মান দেওয়ার জন্য শ্রীলঙ্কাও একটা ক্ষীণ আবেদন রেখেছিল। যাই হোক, যুক্তি দিয়ে যখন কিছু ঠিক করা গেল না, তখন ভোটাভুটির আশ্রয় নেওয়া হল। ভোটে বিশাল ব্যবধানে মালটা জিতে গেল। মালটা দ্বীপরাষ্ট্রের মহিলা প্রতিনিধি তন্বী সুন্দরী অ্যাজালিয়া ডি. গালিয়া’র ভাগ্যেই শিকে ছিঁড়ল শেষ পর্যন্ত।

অবশ্য এই নির্বাচিত মুখপাত্র মহিলা বা সুন্দরী হওয়াতে ভিনগ্রহীদের কিছুই এল গেল না। ওনার সদ্য-প্রকাশিত প্রতিভাও খুব কাজে আসবে বলে মনে হল না। মূলত বিভিন্ন দেশের হোমরাচোমরা কূটনীতিক প্রতিনিধিদের কথাবার্তা যাচ্ছিল রাষ্ট্রসংঘের বিজ্ঞানী ও প্রতিরক্ষা দপ্তরে, তারা সেই কথাগুলোর মধ্যে যুক্তি ও সঠিক তথ্য ঢুকিয়ে সেটাকে কিছুটা অর্থবহ করে তুলে সেগুলোকে রাষ্ট্রসংঘের মনস্তত্ত্ববিদ ও ভাষাবিদদের কাছে পাঠাচ্ছিল। তারা আবার সেগুলোকে সভ্যতার মানদণ্ডে মেপে, সুচারুভাবে শব্দচয়ন করে সাজিয়ে মুখপাত্রের কম্পিউটারে পাঠাচ্ছিল। তাই মুখপাত্রর কাজ ছিল শুধু কম্পিউটার স্ক্রিনে আসা বাক্যগুলিকে ভিনগ্রহীদের বলে পাঠানো, এর বাইরে আর কিছু নয়।

“আপনারা কী জানতে চান বলুন। আমরা চেষ্টা করব আপনাদের প্রশ্নের সদুত্তর দিতে।” ভিনগ্রহী বক্তা জানাল।

মিস গালিয়া চটজলদি মনিটরের দিকে তাকিয়েই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল, “আপনারা কতগুলি বুদ্ধিমান প্রাণীর খোঁজ পেয়েছেন?”

“আপনাদের গ্রহের ডলফিনদের ধরে সাড়ে তিয়াত্তরটা। মানুষকে যোগ করলে সাড়ে চুয়াত্তরটা হবে।” সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যুত্তর এল।

উত্তর শুনে হয়ত অন্দরমহলে গণ-ভিরমির একটা সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল। তাই পরের প্রশ্ন এল বেশ কিছুক্ষণ পর।

“এই সমস্ত বুদ্ধিমান প্রাণীদের সঙ্গে আপনাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক কীরকম?” মুখপাত্র ভদ্রমহিলা প্রশ্ন পাঠান।

“আমরা সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে বিশ্বাসী। তাছাড়াও আমরা দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতায় পারস্পরিক লাভজনক বাণিজ্যচুক্তিতে আবদ্ধ।” চটজলদি জবাব আসে। “তবে হ্যাঁ, মাঝে মধ্যে যে কোনো সশস্ত্র বিরোধ হয় না তা নয়। তবে আমরা কট্টর শান্তিবাদী। যুদ্ধটুদ্ধ করা আমরা সভ্যতার পরিপন্থী মনে করি।”

সবার স্বস্তির নিঃশ্বাস একসঙ্গে পড়ায় অন্দরমহলে একটা ছোটখাটো দমকা হাওয়া বয়ে গেল শব্দ করে। নাহ্‌! আক্রমণ করছে না তাহলে এরা।

“আমরা কীভাবে সেই সব বুদ্ধিমান প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি?”

“কঠোর পরিশ্রম করুন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যান। যুদ্ধে নয়, শান্তিতে বিশ্বাস রাখুন। আর নক্ষত্র পরিভ্রমণের উপায় বের করে ফেলুন।” ভিনগ্রহের উপদেশ এল।

কিছুক্ষণ পর পরের প্রশ্ন এল, “আমরা অভ্যন্তরীণ অনেক সমস্যায় জর্জরিত। সে সব সমাধানের ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য পাওয়ার কি কোনো আশা রাখতে পারি?”

“খুবই সংকটে ফেললেন দেখছি।” ভিনগ্রহী বক্তা একটু দোনামনা করে বললেন, “কাউকে এমনিতে সাহায্য করাকে আমরা সমর্থন করি না। এতে তাদের ক্ষতি বই কোনো উপকার হয় না বলেই আমরা মনে করি। এতে তারা বহিরাগত সাহায্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরে। অন্য উন্নততর গ্রহ থেকে আসা বিনিয়োগ, বাণিজ্যিক ঋণ, আর্থিক সাহায্য ইত্যাদির আশায় বসে থাকায় তাদের নিজেদের অগ্রগতির সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ হয়ে পড়ে। তার পরিবর্তে আমরা বরং কিছু উচ্চ-প্রযুক্তির জিনিস বিক্রি করতে পারি আপনাদের। বিনিময়ে আপনারা কিছু ভারি ধাতু এবং শিল্পকলা দিতে পারেন। ভেবে দেখুন— তবে বেশি দেরি করবেন না। আমাদের হাতে একেবারেই সময় নেই।”

মিস গালিয়ার মনিটরে একের পর এক প্রশ্ন আসতে লাগল। প্রত্যেক সেকেন্ডে নতুন প্রশ্ন আসছিল আগের প্রশ্নটাকে নাকচ করে। যেমন, “কী জিনিস আছে দেখি?” , “ভগবান কি আছেন?”, “ভারি ধাতু বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছেন?”, “জীবনের অর্থ কী?”, “ডলফিনরা কি সত্যিই বুদ্ধিমান?”, “দানিকেনের মতবাদ কি ঠিক?”, “কী জিনিস আছে দেখি?”, “টাইম ট্রাভেল সম্ভব?”... ইত্যাদি।

“কই কী জিনিস আছে দেখি আপনাদের?” মানবজাতির প্রতিনিধি মিস গালিয়া গলা খাঁকড়িয়ে এই প্রশ্নটাই করলেন ভিনগ্রহী বক্তাকে।

“প্রচুর জিনিস আছে। আর প্রতিটাই চমৎকার। দাঁড়ান আপনাদের দেখাই।” বলে ইমোজি গায়েব হয়ে গেল স্ক্রিন থেকে। তার বদলে স্ক্রিনে দেখা গেল একটি অত্যাধুনিক স্পেস শাটল।

“ছোট কিন্তু দারুণ কাজের। এগ্‌র্‌-দের প্রযুক্তিতে বানানো। একটি নক্ষত্র পরিবারের মধ্যে আরামে যাতায়াতের জন্য এর জুড়ি মেলা ভার। সেকেন্ডে পাঁচ হাজার কিলোমিটার গতিবেগ তোলার ক্ষমতা আছে এর। তার সঙ্গে আছে উল্কা ও নানারকম ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা। মাত্র এক ডজনের মতো রয়েছে এই স্পেস শাটল। তাই কোম্পানি আপনাদের অফার দিচ্ছে আর আধ ঘণ্টার মধ্যে যদি বুক করেন তাহলে আপনারা পেয়ে যাবেন বারোটি শাটল রাখার জন্য একটি পোর্টেবল শাটল হ্যাঙ্গার একদম ফ্রি। শুধু তাই নয়, কোম্পানি আপনাদের দিচ্ছে পৃথিবীর প্রধান বারোটি ভাষায়, হ্যাঁ হ্যাঁ বাংলাতেও থাকবে, অনুবাদ করা ব্যবহারবিধি।” উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল ভিনগ্রহী।

“বিনিময়ে কী দিতে হবে?”

“একেকটি শাটলের দাম হিসেবে আপনাদের দিতে হবে... চল্লিশ টন সোনা, চার টন প্ল্যাটিনাম এবং আড়াই টন প্লুটোনিয়াম। কোম্পানি আপনাকে আরও অফার দিচ্ছে, যদি বারোটা শাটল একবারে কিনে নেন তাহলে মোট দামে বিশাল ছাড় দিয়ে সর্বশেষ দাম ধার্য করছে চারশ টন সোনা, চল্লিশ টন প্ল্যাটিনাম এবং পঁচিশ টন প্লুটোনিয়াম। শুধু তাই নয়, সঙ্গে বারো ঘণ্টার পাইলটিং কোর্সের ভিডিও একদম ফ্রি।”

অন্দরমহলে হঠাৎ কিছু শুশ্রূষাকারী দলের ডাক পড়ল, কয়েকজন প্রতিনিধি একটু বুকে অস্বস্তি বোধ করছেন।

কিছুক্ষণ পরে, আমেরিকার প্রতিনিধি বুকের বাম দিকটা হাত দিয়ে চেপে রেখে উঠে দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত দিয়ে বলল, “বলুন আমেরিকা বারোটাই কিনে নেবে!” বলেই ধপাস করে বসে পড়ল কপালের ঘাম মুছতে মুছতে।

মুখপাত্র ভদ্রমহিলা একটু অস্বস্তি ভরেই আমেরিকার সিদ্ধান্ত জানাল।

“অভিনন্দন, আশা করি আপনারা এই জিনিসের গুণগত মান দেখে সন্তুষ্ট হবেন।” ভিনগ্রহী বক্তা বিনয়ের সঙ্গে জানাল। “আমাদের দয়া করে জানান আমরা কোথায় এই শাটলগুলো পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করব, আর কোথা থেকে আমাদের প্রাপ্য ধাতুগুলি সংগ্রহ করব। কো-অর্ডিনেটসগুলো জানাবেন।”

আমেরিকার প্রতিনিধি সঙ্গে সঙ্গে তাদের মিলিটারি বেস এর কো-অর্ডিনেট জানিয়ে দিল। অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের ঈর্ষান্বিত দৃষ্টি দেখে হয়ত একটু সুস্থ বোধ করলেন ভদ্রলোক। কোথায় যেন একটা ফোন করে তারপর জানিয়ে দিল, ওদের বলে দাও ফোর্ট নক্স থেকে ওরা সব ধাতু পেয়ে যাবে। অন্যরা যদিও এভাবে গোপন সেনাশিবিরের ঠিকানা প্রকাশ করে দেওয়ার প্রতিবাদ করতে গেছিল, কিন্তু কেউ তেমন তাদের প্রতিবাদে গুরুত্ব দিল না। কারণ ততক্ষণে আরেকটি ছবি স্ক্রিনে এসে গেছে।

“আমাদের কাছে আন্তর্নক্ষত্র পরিবহণের জন্যেও চমৎকার যান রয়েছে। স্ক্রিনে এখন যেটা দেখতে পাচ্ছেন সেটাই, এটি একটি উপনিবেশকারী মহাকাশযান। এটি প্রযুক্তিতে সেরা রাহ্‌গ-হারদের তৈরি। এটির বিশেষত্ব হল যে এটি আপেক্ষিকতাবাদের সূত্রকে লঙ্ঘন করতে পারে। চল্লিশ আলোকবর্ষ দূরত্বের মধ্যে যেকোনো জায়গায় এটি যেতে সক্ষম, একেকবারে এক হাজার যাত্রী নিয়ে। আমাদের কাছে একটি মাত্রই অবশিষ্ট আছে। এর মূল্য পড়বে চারশো টন সোনা, তিনশো টন প্ল্যাটিনাম আর অন্তত একশো টন আকরিক হিরে...”

আমেরিকার প্রতিনিধি ভদ্রলোক চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল স্ক্রিনের দিকে, মন্ত্রমুগ্ধের মত বলে উঠল, “এটাও আমরা নেব।”

“…সঙ্গে অন্তত এক হাজার বছরের পুরোনো লোকশিল্পের নিদর্শন আশি টন।” ভিনগ্রহী বক্তা একটু থেমে হয়ত পৃথিবী থেকে যাওয়া কোনো বার্তা দেখলেন। তারপর বললেন, “মাফ করবেন, আপনাদের দেশে সম্ভবত প্রাচীন শিল্পের নিদর্শন এত পাওয়া যাবে না।”

কিছুক্ষণ পর ভিনগ্রহী বক্তা যোগ করলেন, “আমাদের কোম্পানি আপনাদের জন্য দারুণ এক অফার দিচ্ছে। যদি ১৫মিনিটের মধ্যে আপনারা এটি বুক করে নেন তাহলে আমাদের কোম্পানির তরফ থেকে থাকছে একটি শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দারুণ প্রযুক্তি এবং একটি অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ প্রযুক্তি একদম বিনামূল্যে। সঙ্গে উপহার পাচ্ছেন একটি গাইডবই যাতে চল্লিশ আলোকবর্ষের মধ্যে থাকা উপনিবেশ গঠনযোগ্য এবং বুদ্ধিমান-প্রাণী অনধ্যুষিত গ্রহগুলির সম্পূর্ণ খবরাখবর। সঙ্গে পৃথিবীর প্রধান বারোটা ভাষায় অনুদিত...”

“পিপল্‌স রিপাবলিক অফ চায়না এই মহাকাশযানটা কিনে নেবে!” বিজয়ীর হাসি হেসে ঘোষণা করল চিনের কূটনীতিক। ভিনগ্রহীরা এবার আর কোনো আপত্তি জানাল না।

“পরিবহন-যানের সম্ভার শেষ হয়ে যাওয়ায় আমরা দুঃখিত, কিন্তু আমাদের কাছে অন্যান্য অনেক বিস্ময়কর জিনিস রয়েছে। আপনারা চাইলে দেখাতে পারি। এই দেখুন, এটি হল অরেলিয়ানদের বানানো সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্য-সংশ্লেষক যন্ত্র। যেকোনো কার্বন-ভিত্তিক জীবদেহের উপযোগী খাদ্য বানাতে পারে এটা। একবার চার্জ দিলেই একশো বছর অনায়াসে একটানা কাজ করে যেতে পারে। পাচ্ছেন একেবারে জলের দরে। প্রতিটার দাম ষাট টন দুশো-বছরের পুরোনো শিল্পকলা।”

বেশ কিছুক্ষণ তর্কবিতর্কের পর ঠিক হল এটা আমেরিকা, চিন আর ব্রিটেন ভাগাভাগি করে দাম দিয়ে কিনে নেবে। ফ্রান্স বরাবর খাবারদাবার নিয়ে নাক উঁচু, তারা নিজেদের খাদ্যাভ্যাসের ঐতিহ্য এইভাবে জলাঞ্জলি দিতে চাইল না। রাশিয়া অপেক্ষা করে রইল, পরে যদি কিছু দাঁও মারা যায়।

পরের প্রোডাক্টটা আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমেরিকা, চিন আর ব্রিটেন আগের বুকিংটা নাকচ করে দেওয়ার জন্য হইচই শুরু করে দিল। কারণ পরের প্রোডাক্টটা ছিল স্বয়ংক্রিয় আয়ুবর্ধক যন্ত্র। এটি যেকোনো মানুষের আয়ু একেবারে একশো বছর বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। রাশিয়া তীর্থের কাকের মত একেবারে ছোঁ মেরে প্রোডাক্টটি করায়ত্ত করে নেয়। এটি কিনতে না পেরে উত্তেজিত কিছু কূটনীতিক রীতিমতো মারমুখী মেজাজে তেড়ে যান রুশ প্রতিনিধির দিকে। শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তারক্ষীদের দ্রুত হস্ত ও পদক্ষেপে উত্তেজনা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে, রুশ ভদ্রলোক আহত হতে হতে বেঁচে যান। এমনকি ভিনগ্রহী বক্তাও সবিনয়ে মেজাজ শান্ত রাখার এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার সুফলের উপর ছোট একটি ভাষণ দিতে শুরু করে দেয়।

এই গোলমালের মধ্যে মিস গালিয়া নিজের থেকে প্রথম একটি কথা পাঠাল ভিনগ্রহীদের, “এর সঙ্গে কোনো অফার নেই?”

প্রতিশ্রুতি রক্ষার করার সুফল নিয়ে বলতে বলতে ভিনগ্রহী কিছুক্ষণের জন্য যেন থমকে গেল। তারপর বলে উঠল, “সম্মানীয় ক্রেতার প্রতি আমাদের কোম্পানির তরফ থেকে থাকছে একটি ছোট উপহার। আয়ুবর্ধক যন্ত্রের সঙ্গে একটি স্বয়ংক্রিয় কনভেয়ার বেল্ট পাচ্ছেন একদম ফ্রি। এটি ব্যবহার করে প্রতি ঘণ্টায় এক হাজার জনকে পরিসেবা দেওয়া সম্ভব হবে।”

ঘটনার ঘনঘটা সামলে মিস গালিয়া ধীরে ধীরে নিজেকে যেন ফিরে পাচ্ছিল। স্ক্রিনে নির্দেশের অপেক্ষা না করেই বলে উঠল, “শুধু কনভেয়ার বেল্ট? আর কিছু অফার নেই? অ্যামেরিকা, চিন তো কত কিছু ফ্রিতে পেল। ”

বক্তা একটু সময় নিয়ে তারপর বার্তা পাঠাল, “ক্রেতা দেশের ভৌগলিক অবস্থান মনে রেখে আমরা ওনাদের জন্য আরেকটি উপহারের ব্যবস্থা করছি, তা হল শৈত্য-প্রতিরোধী ভিনগ্রহী কলা। অত্যন্ত কম তাপমাত্রাতেও এই কলার ফলন হয় এবং এর উপকারের কথা তো সারা মহাবিশ্ব জানে।”

মিস গালিয়া অতঃপর কিভাবে এই প্রোডাক্টগুলো পাওয়া যাবে সে বিষয়ে খোঁজখবর করা শুরু করলেন। ভদ্রমহিলা তার সহজাত প্রতিভা ব্যবহার করে ভিনগ্রহীদের দিয়েই বিভিন্ন দেশে জিনিসগুলো পৌঁছে দেওয়ার এবং সেখান থেকে তাদের প্রাপ্য মূল্যগুলোকেও সংগ্রহ করার ব্যবস্থা পাকা করে নিলেন।

খুব শিগ্‌গিরি ফ্রান্স কিনে ফেলল দশ হাজার মানুষ ধরে এরকম একটি স্পেস স্টেশন। জার্মানরা বেশ ভাল দর পেল কারখানা-প্রতিলিপিকারী প্রযুক্তিটা কিনে ফেলার জন্য। এটা দিয়ে তারা একটি কারখানা বানিয়ে তার যত খুশি প্রতিলিপি বানিয়ে নিতে পারবে। প্রাকৃতিক-দুর্যোগ-নিয়ন্ত্রক যন্ত্রটির জন্যে হয়ত জাপান একটু বেশীই মরিয়া হয়ে ছিল। তাই ঐ যন্ত্র কিনতে চাওয়া অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের তৎক্ষণাৎ ঘুষবৎ উপহার-সামগ্রী দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের নিরস্ত করে। উত্তর কোরিয়া কেনে একটি অদ্ভুত ব্যাকটেরিয়া যা নিউক্লিয়ার রিয়াক্টরের ভিতর বংশবিস্তার করে এবং সমস্ত বিকিরণকে শুষে নিয়ে পানযোগ্য মদ তৈরি করতে পারে। এছাড়াও অন্যান্য চমকপ্রদ জিনিসপত্রও বিক্রি হয়ে গেল বিভিন্ন দেশের কাছে, যেমন ময়লা-নিরোধক কাপড়, সুষুপ্তি-শিক্ষণ যন্ত্র, ঘ্রাণ-অভিধান ইত্যাদি।

পরের দিকে সমস্ত দেশের মূল্যবান ধাতু ও লোকশিল্পের যোগান কমে যাওয়ায় দয়াপরবশ হয়ে ভিনগ্রহীরা অন্যান্য পার্থিব দ্রব্য বা প্রযুক্তি বিনিময়েও রাজি হয়ে যায়। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল— ইউক্যালিপটাস পাতা, দুধ থেকে দই পাতার ব্যাকটেরিয়া, পুরোনো মডেলের মোটরবাইক ইত্যাদি।

অন্দরমহলের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বিশৃঙ্খল হতে শুরু করল। যারা ভাল দাঁও মেরেছে তারা বুক ফুলিয়ে জাহির করতে লাগল, এবং ক্রমাগত তাদের দেশে ফোন করতে লাগল। যারা তেমন কিছু কিনে উঠতে পারেনি তারাও ফোন করছিল, তবে তারা মূলত তাদের ওপরওয়ালার থেকে বকুনিই খাচ্ছিল। ভারতের প্রতিনিধি এদের কোনো দলেই ছিল না। যিনি প্রতিনিধি ছিলেন তিনি নিজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিশেষ সড়গড় না হওয়ায় উপযুক্ত লোক হিসেবে তিনি দেশের সর্বোচ্চ শাসকমন্ডলীর কোনো মন্ত্রীকে ফোন করে বিস্তারিত জানাতে থাকেন। সেই মন্ত্রী আবার বিজ্ঞান উপদেষ্টামন্ত্রকের প্রধানকে ফোন করে জানান সব। সেই প্রধান আবার একজন বিজ্ঞানীকে ফোন করে পরামর্শ নেন, এবং সব কথা মন্ত্রীকে জানান। মন্ত্রীমশাই আবার ফোন করে রাষ্ট্রসংঘে কর্মরত প্রতিনিধিকে জানান। ফলে ভিনগ্রহীদের বিক্রিবাটার একদম শেষ পর্যায়ে অন্যান্য প্রতিনিধিরা ফোন করে গর্ব করছিল বা বকুনি খাচ্ছিল তখন ভারতীয় প্রতিনিধি আসলে খাদ্য-সংশ্লেষক যন্ত্রটি কেনার অনুমতি লাভ করছিল ফোনে। যাই হোক, এই হইচই এর মধ্যেই ইজরায়েল অবিক্রীত সমস্ত জিনিস কিলোদরে কিনে নেয়। ভিনগ্রহীরাও দরাজ হৃদয়ে তাদের বিনামূল্যে টাক-প্রতিষেধক ওষুধের ফর্মুলা উপহার দেয়।

শেষপর্যন্ত সব জিনিস বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর ভিনগ্রহীরা শেষ বার্তা পাঠায়, “আমাদের বাৎসরিক সেল এই ভাবে সফল করে তোলার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। ত্রিশ মিনিট পর থেকে আমরা বিক্রিত দ্রব্য নির্দিষ্ট জায়গায় পাঠানো শুরু করব, আপনারাও দয়া করে আমাদের প্রাপ্য মূল্য প্রস্তুত করে রাখবেন। এখন আমাদের বিদায় জানাতেই হবে। আমরা সুদূরের পানে চলেছি, আমাদের হাতে একদমই সময় নেই বলতে গেলে। বিদায় পৃথিবী। আবার দেখা হবে আশা করি।”

আবেগে ছলছল চোখে মুখপাত্র শেষ প্রশ্ন পাঠাল, “ভগবান কি নেই?”

“জানি না, জানলে অবশ্যই বলতাম।” এইটুকু বার্তা আসার পর সম্প্রচার বন্ধ হয়ে গেল।

প্রতিটি দেশের প্রতিনিধিরা তখন পুরো ব্যাপারটা যে কী হয়ে গেল সেটা বুঝে উঠতে ঘেমে নেয়ে অস্থির। কেউই কিছু বলতে সাহস পাচ্ছিল না। একমাত্র ইজরায়েলি ভদ্রলোক বলে উঠল স্টার ওয়ার্স স্টাইলে, “আই হ্যাভ এ ব্যাড ফিলিং অ্যাবাউট দিস।”

আকাশের গায়ে মহাকাশযানের গা থেকে সৃষ্টি হওয়া অপার্থিব রামধনুর ইকড়ি-মিকড়ি থেকে একটি রশ্মি বিনির্গত হতে দেখা যায়। সেই রশ্মি বরাবর কিছু কালো কালো বিন্দু পৃথিবীর বুকে নেমে আসতে থাকে। ক্রমশ দেখা যায় সেগুলো সদ্য-কেনা অত্যাধুনিক জিনিসপত্র। একই রশ্মির মধ্য দিয়ে তারা সোনা ইত্যাদি ধাতু, শিল্পকলা সব টেনে নেয়। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সব আদানপ্রদান সম্পন্ন হলে ধীরে ধীরে মহাকাশযান ছোট হতে থাকে। ধীরে ধীরে সেটিও অসীম মহাকাশে বিলীন হয়ে যায়।

***

দিন-কয়েক পরে ক্রেমলিনে একটি গোপন উচ্চস্তরীয় বৈঠক হয়। এতে উচ্চবর্গীয় রুশ শাসকমন্ডলী ছাড়াও ফেডারাল সিকিউরিটি সার্ভিসের এজেন্টরা উপস্থিত ছিল। আর ছিল রাশিয়ায় সদ্য-গঠিত বহির্বিশ্ব প্রযুক্তি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান। আমেরিকায় গুপ্তচর হিসেবে যিনি কাজ করেন তিনি চৌদ্দপুরুষের শপথ নিয়ে জানায় যে সে যে ছবি নিয়ে এসেছে তা একশো শতাংশ সঠিক। “এই যে দেখছেন মহাকাশযান যেটা আমেরিকা কিনেছে। ছবিটা ঝাপসা হলেও এটা প্রমাণ করে দেওয়া যায় সমস্ত মহাকাশযানটা ছফুটের বেশী নয়। এটা যদি এগ্‌র্‌-দের বানানো হয়ে থাকে তাহলে হলফ করে বলতে পারি এগ্‌র্‌-রা বিড়ালের বাচ্চার থেকে সাইজে মোটেই বড় হবে না।”

“তার মানে? আমেরিকানরা এটাতে ঢুকতেই পারবে না?” রুশ-প্রধান যেন একটু খুশী হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

“ঢুকতে তো পারবেই না, এটাকে খুলে ভেতরকার যন্ত্রপাতি নাড়াঘাঁটাও করতে পারবে না। এটাকে খুললে নাকি নিজের থেকেই বিস্ফোরণ হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। এই যে রাশিয়ান ভাষার ম্যানুয়ালটা ওরা ফেলে দিয়েছিল, আবর্জনার স্তূপ ঘেঁটে যোগাড় করেছি।”

“ব্র্যাভো কমরেড! আর চিনের এজেন্ট? আপনার কাছে কী খবর আছে?”

চিনের এজেন্ট মুখ কাঁচুমাচু করে জানালো, “চিনের উপনিবেশকারী মহাকাশযানটা আমেরিকার মত ছোট নয়। প্রায় তিনশো মিটার লম্বা। আমি নিজে তথ্য যাচাই করেছি। এমনকি এটা আপেক্ষিকতাবাদকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারে। তবে ওদেরও একটা সমস্যা আছে। আপেক্ষিকতাবাদ অনুসারে যানটি যখন আলোর গতি লাভ করবে, তখন যানের ভিতরে সময় অপেক্ষাকৃত ধীরে চলবে। অর্থাৎ যানের ভিতরে যদি আপনি দশ দিন কাটান তাহলে পৃথিবীতে এসে হয়ত দেখবেন এখানে এক দশক বা এক শতক কেটে গেছে। আমি যা খবর পেয়েছি এই যানটি ঠিক এই নিয়মটিকেই তুড়ি মেরে ভেঙে ফেলতে পারে। এই যান হয়ত পৃথিবীর দশদিনে অন্য নক্ষত্রের গ্রহে পোঁছে যেতে পারে কিন্তু সেটা যানের ভেতরে হাজার বছর মনে হবে। চিনারা তবুও চেষ্টা করেছিল অভিযান শুরু করার, কিন্তু কোনভাবেই হাজার বছরের উপযুক্ত খাবার ও অন্যান্য দরকারি জিনিস নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। একবারে দশ বছরের বেশি খাবার দাবার নিয়ে যাওয়ার জায়গা নেই।”

“তাহলে চিনও এটা ব্যবহার করতে পারছে না। আচ্ছা ওরা তো খাদ্য-সংশ্লেষক যন্ত্রটাও কিনেছিল। নাহ্‌ ওদের বুদ্ধি আছে দেখছি। মহাকাশযানে ওটা নিয়ে নিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।”

“সেটা কি ওরা আর ভাবে নি ভেবেছেন? ওই যন্ত্রের তৈরি খাবার খেয়ে ওখানকার শুয়োরগুলোও বমি করে ফেলেছে। সেই ইস্তক মানুষ দেখলেই তাড়া করে যাচ্ছে শুনলাম।”

“বটে? বেশ বেশ...” বলে কী যেন ভাবলেন রুশ-প্রধান। খুব চিন্তিত হয়ে দ্রুত কতগুলো ফোন করে নেন।

ফোন করা শেষ হলেও কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে। তারপর ধীরস্বরে খবরগুলো এজেন্টদের জানান তিনি, “জার্মান কারখানা প্রতিলিপি করার যন্ত্রটি মূলত থ্রিডি প্রিন্টিং করছে, অর্থাৎ সেক্ষেত্রে প্রতিলিপি করা কারখানার বেশিরভাগ যন্ত্রই কোন কাজ করবে না, শুধু দেখতে একরকম হবে। ফ্রান্সের স্পেস স্টেশন এখনও স্থাপন করা হয় নি, তবে খবর যা পেলাম তাতে দেখা যাচ্ছে স্পেস-স্টেশনে স্বাভাবিক উষ্ণতাই পাঁচ হাজার সেলসিয়াসের কাছাকাছি হয়ে যাচ্ছে। জাপানের যন্ত্রটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ কমাতে গিয়ে একটি দ্বীপকে মোটামুটি নির্জীব মরুভূমিতে রূপান্তরিত করে ফেলার উপক্রম করেছিল”।

সবাই আনন্দিত হতে গিয়েও কোন এক অজানা কারণে আনন্দিত হতে পারছিল না। সবাই চুপ করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছিল।

তিন নম্বর এজেন্ট নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠল, “কোরিয়ানরা কিন্তু ভাল লাভ করেছে। ওদের পারমাণবিক চুল্লি থেকে ভালই মদ তৈরি হচ্ছে। তবে ওদের চুল্লি তে আগেও খুব বেশি শক্তি উৎপাদন হত না, এই নতুন ব্যাকটেরিয়া ঢোকানোর ফলে শক্তি উৎপাদন প্রায় শূন্যের কাছাকাছি হয়ে গেছে। তাই আপাতত রিয়াক্টরটিকে ওরা মদ বানানোর কাজেই ব্যবহার করছে। তবে এই পারমানবিক মদের দাম কত হবে আর সেই মদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কিছু হবে কি না সেটা এখনও ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। আমার স্পাই সেই মদ নিজে খেয়ে রিপোর্ট দিয়েছে। বলছে এমনি খেতে মন্দ না। তবে দেহের যেসব অঙ্গ উত্থিত থাকার প্রয়োজন সেগুলি নিমীলিত থাকছে, আর যেগুলো নিমীলিত থাকার প্রয়োজন সেগুলো উত্থিত থাকছে। এই যে আমি ছবিও তুলে নিয়ে এসেছি তার। মাটিতে পড়ে আছে বেচারা, হাত পা তুলতে পারছে না। আর চুলগুলো দেখুন একদম খাড়া খাড়া হয়ে গেছে।”

“বাহ তোফা।” ছবি দেখে হাসবেন না কাঁদবেন ভেবে পেলেন না রুশ প্রধান। কিছুক্ষণ চুপ থেকে যে প্রশ্নটা করতে ভয় পাচ্ছিলেন সেটাই করে ফেললেন। “আমাদের বহির্বিশ্ব প্রযুক্তি গবেষণা কেন্দ্রের খবর কী? আমাদের আয়ুবর্ধক যন্ত্র কেমন কাজ করছে?”

গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান গলা খাঁকড়িয়ে বলল, “এখনও ঠিকঠাক ভাবে পরীক্ষা করা হয়নি। পরীক্ষার জন্য কিছু সত্তর আশি বছর বয়েসী লোককে আমার যন্ত্রে ঢুকিয়েছিলাম। কিন্তু দেখা গেল যন্ত্রের ব্যবস্থা অনুসারে লোকের বয়েস অন্তত একশো বছর হতে হবে। এখন একশো ছয় বছর বয়েসী একজনকে পাওয়া গেছিল, তাকে ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে।”

“কাজ হয়েছে?” উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল শাসক প্রধান।

“হ্যাঁ। কাজ হয়েছে। তবে ঠিক যেমন ভেবেছিলাম পরিণাম ঠিক সেরকমটা হয়নি। দৈহিক ও মানসিকভাবে সেই লোক এখন প্রায় ছয় বছর বয়েসী বাচ্চার মতো হয়ে গেছে।”

“হোয়াট? আর আমাদের কলা?”

“পোঁতা হয়ে গেছে স্যার। সাইবেরিয়ার প্রবল ঠান্ডাতেও সেই গাছ বেঁচে আছে। অসাধারণ জিনিস বটে। আমাদের বৈজ্ঞানিকরা আজই হিসেব করে জানিয়েছে কুড়ি পঁচিশ বছর পর সেগুলোতে কলা ফলবে।”

রুশ-প্রধানের দাঁতটা অজান্তেই কিড়মিড় করে উঠছিল। অনেক কসরত করে সেই কিড়মিড় করা দাঁত তিনি অন্যান্যদের থেকে আড়াল রাখার চেষ্টা করছিলেন। হাজার হোক এই উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে তা শোভা পায় না।

“সব বুঝলাম, কিন্তু আমার মাথায় এটা ঢুকছে না যে পৃথিবী থেকে মোটরবাইক নিয়ে গিয়ে কী করবে তারা?”

 

এই প্রশ্নের উত্তর বৈঠকের কেউই দেওয়ার সাহস করল না। কারণ সে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারত একমাত্র ঐ ভিনগ্রহী, যিনি এখন অন্য একটি গ্রহের সামনে তার বিপণী-যান নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন। তিনি এখন সেখানকার জলাজমিতে বাস করা ‘মেডুসা’সদৃশ কিছু সরীসৃপদের নতুন একটি প্রোডাক্ট দেখাচ্ছেন।

“এই ব্যক্তিগত পরিবহন ব্যবহার করে আপনারা রুক্ষ জমি, ছোটখাটো পাহাড় ইত্যাদি পরিভ্রমণ করতে পারবেন। এটি চালাতে কোনো চার্জ দিতে লাগে না বাইরে থেকে, এবং এটি পরিবেশ-বান্ধব— কোনোরকম তেজস্ক্রিয় বিকিরণও করে না। যদি তিরিশ মিনিটের মধ্যে বুকিং করেন তাহলে কোম্পানি...”

অসাধারণ এই প্রযুক্তি দেখে মেডুসাদের চোখগুলিও চকচক করে উঠছিল আন্দাজ করা যায়।

***

সদ্যবিবাহিত মানস মাইতি যখন পুজোর ছুটিতে কলকাতা ফিরছিল তখন একদিকে যেমন প্রায় পাঁচবছর পর বাড়ি ফেরার আনন্দে মশগুল ছিল, তেমনই বুকটা হাহাকার করে উঠছিল তার সুন্দরী তন্বী মাল্টিজ স্ত্রী’র বিরহে। রূপে গুণে অসামান্য তার স্ত্রী, অল্প ক’দিনেই এমন বশ করে ফেলেছে যে চার দিনের জন্যেও ফেলে আসতে মন চাইছে না। ভারতীয় দূতাবাসে আলাপ প্রায় আট মাস আগে, দু’মাস হল তাদের বিয়ে হয়েছে। স্ত্রীও তার বাঙালি স্বামীর সারল্যে মুগ্ধ। তাই স্ত্রীকে মালটায় ছেড়ে আসার সময় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাদের বিদায়-চুম্বনদৃশ্য আন্তর্জালে ভাইরাল হয়— সামাজিক মাধ্যমে বহু বিবাহিত নারী ও পুরুষের চোখে জল এনে দিয়েছিল সেই দৃশ্য।

ষষ্ঠীর দিন কলকাতা বিমানবন্দর থেকে বেরোতেই চারদিনে রামধনু রঙের ফেস্টুন, বেলুন দেখে হতবাক মানস। ক্যাব-চালককে কী ব্যাপার জিজ্ঞেস করতে জানাল, “আজ তো এলিয়েন উৎসবের শেষ দিন, আপনি কি এখানে অনেকদিন পর এলেন?”

ক্যাব-চালকের কথায় জানা গেল, গতবছর এইসময়ে এলিয়েন শিপ এসেছিল। সেই এলিয়েন আগমনকে পালন করতে রাজ্য সরকার প্রতিবছর চারদিনব্যাপি এই এলিয়েন উৎসব আয়োজন করার প্রকল্প নিয়েছে। রামধনু-রঙা পতাকা, বেলুন নিয়ে প্রভাতফেরী, মহাকাশযান থিমের প্যান্ডেলে বিচিত্রানুষ্ঠান, বসে এলিয়েন আঁকো প্রতিযোগিতা ইত্যাদি সারা শহর জুড়ে চলছে। প্রথম দিনটিকে এলিয়েনের ‘রামধনুযানে আগমন’ হিসেবে গণ্য করা হয়। তার পরের দিন ‘মহানালোচনা’ দিবস, এই দিন সামাজিক ও জন-মাধ্যমে এলিয়েন-আগমনের সুফল নিয়ে নানা আলোচনা করেন বিদ্বৎজনরা। তৃতীয় দিন ‘মহাকেনাবেচা’ দিবস, এই দিনটাই সবচেয়ে আনন্দের দিন। রাস্তাঘাটে, সামাজিক ও জন-মাধ্যমে, আন্তর্জালিক দোকানে বিশাল এক কেনাবেচার উৎসব হয়। এই সময়ে কেনাবেচায় প্রচুর ছাড় ও বিনামূল্যে উপহার টুপহারও পাওয়া যায়। শেষদিন হল এলিয়েনের ‘রামধনুযানে গমন’ দিবস। এই দিন নাচগান করতে করতে সবাই মিছিল করে বিড়লা তারামণ্ডল যায় এবং ‘আবার এসো ফিরে’ গানটি সমবেতকণ্ঠে গাওয়া হয়।

এসব শুনতে শুনতে অতি ভদ্র ও তার চেয়েও বেশি সরল সাদাসিধে মানসের মুখ থেকে কয়েকটি কুকথা বেড়িয়ে পড়েছিল এলিয়েনদের উদ্দেশ্যে, সৌভাগ্যবশত তা ক্যাব-চালকের কানে পৌঁছায়নি। উচ্চপদস্থ কূটনীতিক হওয়ার দরুন মানস জানে গতবছর এই ‘সেল’-এর পরিণাম কী হয়েছিল। অন্য লোকের তুলনায় হয়ত একটু বেশীই জানে, কারণ তার বিবাহিতা স্ত্রী মালটিজ সুন্দরী অ্যাজালিয়া ডি. গালিয়ার মাধ্যমেই সমস্ত বার্তা আদানপ্রদান হয়েছিল। বিশাল মিছিল, স্পেস-শিপ বেলুন, এলিয়েন-সাজা মানুষ, লাল-নীল-সবুজ রামধনু-পতাকা— এসব কাটিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল তাদের গাড়ি।

বাড়ি ফিরেই একরাশ হাসি-কান্না, আদর, ‘কত রোগা হয়ে গেছিস’, হালকা বকুনি, পাঁঠার মাংস, রসগোল্লা সামলে যখন একটু একা হল মানস তখন প্রায় রাত হয়ে গেছে। ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বার করতে করতে বউয়ের জন্য মন-কেমন শুরু হল। কাজে ব্যস্ত, এখন ফোন করা যাবে না ভেবে টিভিটা চালিয়ে বসল মানস। টিভিতেও একই জিনিস, বিড়লা তারামণ্ডল থেকে লাইভ দেখাচ্ছে। মন্ত্রী ও সেলিব্রিটিরা গান গাইছে। মহাকাশযানের আকারের বেলুন উড়ছে। ব্যাগ থেকে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গেই একটা ছোট্ট যন্ত্র বেরল। আসার আগে স্ত্রী তাকে উপহার দিয়েছে। জিনিসটা খুবই চমকপ্রদ, মহাবিশ্বের প্রায় আটচল্লিশ হাজার ভাষার অনুবাদক যন্ত্র। মুশকিল হল এই যে এতে যুক্তাক্ষর বিশিষ্ট কোন ভাষা নেই, অর্থাৎ কোনো ভারতীয় ভাষা এতে কাজ করবে না। মানস ভাবল একবার যাচাই করে দেখা যাক। রাশিয়ান একটি চ্যানেল খুলে যন্ত্রটি ধরে বসল, দিব্যি কাজ করছে। টিভির আওয়াজ শুনে সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করে স্ক্রিনে দেখিয়ে দিচ্ছে। রাশিয়ান খবর থেকে জানতে পারল ওরা ভারতকে যুদ্ধবিমান বিক্রি করতে পেরে বিশেষ গর্বিত। চাইনিজ চ্যানেল খুলে পরিষ্কার বুঝতে পারল কমিউনিস্ট সরকারের সাফল্যের খতিয়ান। একটি স্প্যানিশ চ্যানেলে চলছিল টেলি-শপিং, ভুঁড়ি কমানোর যন্ত্র। “আপনি যদি এক ঘণ্টার মধ্যে বুকিং করেন তাহলে আপনার জন্য থাকছে একটি গ্রীন টি বানানোর সরঞ্জাম, ইন্ডিয়ান রুটি বানানোর যন্ত্র, একটি...” ইত্যাদি ইত্যাদি। মানস ক্লান্ত হয়ে দ্রুত চ্যানেল সার্ফ করে যাচ্ছিল।

হঠাৎ কী একটা নজরে পড়ায় মানস আবার দুই-তিনটে চ্যানেল পিছিয়ে এসে কী একটা দেখতে লাগল। আর ঐ অনুবাদক যন্ত্রটা ধরে এদিক ওদিক করে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছিল।

এর পর আর বউকে ফোন না করে থাকতে পারল না মানস।

“সুইটহার্ট, তুমি বললে বিশ্বাস করবে না কি হয়েছে এক্ষুনি।”

“কী হয়েছে? তুমি ঠিকঠাক পৌঁছেছ?”

“আরে হ্যাঁ আমি ঠিক আছি। সবাই এখানে তোমাকে আনতে পারিনি বলে রাগ করছে। যাক গে, তোমার মনে আছে তুমি আমাকে একটা যন্ত্র দিয়েছিলে? সেই যে এলিয়েন তোমাকে উপহার দিয়েছিল যেটা?”

“নিজে থেকে দেয়নি, আমি কায়দা করে আদায় করেছিলাম।”

“হ্যাঁ যাই হোক, সেটা আজ টিভি চালিয়ে যাচাই করছিলাম।”

“হ্যাঁ আমি দেখেছিলাম ওটা ঠিকঠাকই কাজ করে।”

“কোনোদিন অ্যানিম্যাল প্ল্যানেট খুলে টেস্ট করেছিলে?”

“না, কেন?”

“বললাম না, বিশ্বাস করবে না! স্পষ্ট দেখলাম যন্ত্রটায় ডলফিনের ভাষা ইংরেজিতে অনুবাদ হচ্ছে!”

“সে কী? সত্যি?”

“একদম! এই এক্ষুনি দেখলাম জাপানের কোন পার্কে তিনটে ডলফিন নাচ-গান করছে, হাসছে।”

“গান করছে?”

“হ্যাঁ, তাহলে আর বলছি কি! গানের কথাটা অনেকটা এইরকম “ধন্য ধন্য হে মহান মানবসন্তান, মোদের থেকে আধকাঠি বেশি বুদ্ধিমান।” এই দুলাইন গেয়েই খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছে ডলফিনগুলো!”

 

[সের্গেই লুকিয়ানেঙ্কোর ‘ইফ ইউ অ্যাক্ট নাও’ গল্পের অনুসরণে লেখা। এটি বিশ্বস্ত অনুবাদ নয়। কিছু অংশ পরিবর্তন করে, কিছু বাদ দিয়ে, কিছু যোগ করে ‘লাল নীল সবুজের মেলা’ তৈরি হয়েছে।]