পাত্রী ● অভিষেক সেনগুপ্ত

 


 

লিলির মুখের দিকে আকুলভাবে তাকাল প্রভাত। মেয়েটা তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে। বেশ লম্বা। ছিপছিপে চেহারা। পাকা গমের মতো গায়ের রঙ। শান্ত সমুদ্রনীল দুটো চোখ আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে ওকে। ছোট্ট কপালে একমুঠো কুচো চুল পড়ে। ভ্রূ দুটো যেন কোনো তিরন্দাজের হাতের ধনুকের মতো। এই বুঝি রিলিজ করবে। তীক্ষ্ণ নাক। পাতলা গোলাপি ঠোঁটের তলায় ঢেউ তোলা চিবুক।

নীচু ঘরের শিলিং থেকে কম পাওয়ারের একটা বাল্ব ঝুলছে। মৃদু দুলুনির জন্য লিলির মুখে আলো আর ছায়ার ঘের। আলো যেন লুকোচুরি খেলছে ওর সঙ্গে। নাভির সামান্য উপরে শেষ হয়েছে গাঢ় নীল রংয়ের ছোট টপটা। নীচু করে পরা মেরুন লো-ওয়েস্ট স্কার্ট। নির্মেদ কোমরের পাতলা ভাঁজ দেখা যাচ্ছে। স্কার্ট আর টপের মাঝে তরল মাখন লেপে দিয়েছে কেউ। কোমরের ওই ফাঁকটুকুতে বাঁ হাতের তালু রেখে তেরছা দাঁড়িয়ে লিলি। মডেলরা যেভাবে দাঁড়ায়। একটা বক্ররেখা ডানদিক-বাঁদিক করতে-করতে মাথা থেকে পা অবধি নেমে গিয়েছে। হাঁটুঝুল স্কার্টের সঙ্গে মানানসই পা ঢাকা কালো হাইহিল জুতো।

প্রতি রাতেই লিলিকে নতুন করে আবিষ্কার করে প্রভাত। আজও তার মনে হল, লিলিকে এর আগে এত সুন্দর কখনও মনে হয়নি। মুগ্ধ চোখ বুলিয়ে আরও একবার দেখল মেয়েটাকে। বোঝার চেষ্টা করল, তার কথাগুলো শুনে লিলি কী ভাবছে? তার কি কষ্ট হচ্ছে? লিলির চোখে চোখ রাখল প্রভাত। নাহ্‌, ওর চোখের হাইওয়েতে ভাবনার ট্রাফিক জ্যাম নেই। যেমন নিশ্চল দাঁড়িয়েছিল, তেমনই আছে। আনমনা। দৃষ্টির সঙ্গে যেন ভাবনাও হারিয়ে গিয়েছে ঘরের বাইরে কোথাও।

প্রভাত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কথাগুলো বলতে তার কষ্টই হয়েছে। সে লিলিকে ভালোবাসে। প্রচণ্ড ভালোবাসে। কিন্তু তার ভালোবাসা বোঝার ক্ষমতা দুনিয়ার কারও যে নেই, সেটা প্রভাত বুঝতে পেরেছে। সে ভেবেছিল, তার পরিবার অন্তত মনের অতলে লুকিয়ে থাকা ডুবোপাহাড়টা খোঁজার চেষ্টা করবে। বাবা, মা, দাদা, বৌদিদের মতো কাছের লোকরাও ছুঁতে পারেনি তাকে। অনুভব করতে পারেনি তার অতল হৃদয়কে। সে সম্ভাবনাও আর নেইও। লিলিকে সবটা বলতেই হত তাকে। কতদিন আর ঠেকিয়ে রাখবে? একদিন না একদিন তো সত্যিটা জানতই মেয়েটা!

স্যাঁতস্যাঁতে ঘুপচি ঘরময় ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য কাপড়ের গাঁঠরি। কোনোটাতে শার্টপ্যান্ট, টি-শার্ট, জিন্স, কোনোটায় মেয়েদের ওয়েস্টার্ন ড্রেস, সালোয়ার কামিজ, টপ, স্কার্ট। এই জামাকাপড় এসেছে লুধিয়ানার কারখানা থেকে। কিছু বাংলাদেশ থেকে। গাঁঠরিগুলো খুলে সে সব ইস্ত্রি করতে হবে প্রভাতকে। রাতভর এই তার কাজ। গড়িয়া সুপারমার্কেটের নামী গারমেন্টস শপের গোডাউন এটা। মার্কেটের পিছন দিকে এমন আরও কয়েকটা গোডাউন আছে। দিনের বেলায় গোডাউন বন্ধ থাকে। লাখলাখ টাকার মাল থাকে এখানে। রাতে প্রভাত ইস্তিরিওয়ালা কাম পাহারাদার।

সোফায় গা এলিয়ে দেওয়ার মতো করে পিঠ ঠেঁকিয়ে একটা কাপড়ের গাঁঠরিতে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে প্রভাত। তার ভেতরে তোলপাড় চলছে। যন্ত্রণার বিস্ফোরণ ঘটছে বুকের বাঁ দিকে।

বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ডান হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে প্রভাত বলল, ‘তুমি কি কষ্ট পেয়েছো লিলি?’ লিলির কাছে এবারও কোনো উত্তর পেল না সে।

প্রভাতের গলা ভারী। জল জমেছে তার উগড়ে দেওয়া শব্দের তলায়। মন খারাপটা মোচড় দিতে দিতে উঠে আসছে ওপরে। আজ না হলে কাল তাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। কিন্তু কী সিদ্ধান্ত নেবে? লিলিকে ছেড়ে থাকার? তার পক্ষে সম্ভব? দ্বিধা আর দ্বন্দ্বের ঢেউ আছড়ে পড়ছে তার চোখের তলায়। ভেঙে যাচ্ছে প্রভাত। মাথা কাজ করছে না।

প্রথমদিনটা মনে পড়ে গেল প্রভাতের। যে দিন সে প্রথম এই গোডাউনের পাহারা দেওয়া আর জামাকাপড় ইস্তিরির চাকরিটা পেয়েছিল। রাত দশটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত ডিউটি। সামান্যই মাইনে। তবে তার জন্য যথেষ্ট। দোকানের পুরোনো কর্মচারী রজতদা গোডাউন খুলে সব বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।

একটা চাবি হাতে দিয়ে রজতদা বলেছিল, ‘এই ডুপ্লিকেট চাবিটা তোর কাছেই রাখিস। সকালে কাজ শেষ করে গোডাউন বন্ধ করে নিজের মতো চলে যাস।’

রজতদা চলে যাওয়ার পর গোডাউনের দরজা বন্ধ করে এইরকমই একটা গাঁঠরির ওপর আয়েস করে বসেছিল সে। তখনই দেখতে পেয়েছিল মেয়েটাকে। প্রথমে সে একটু অবাক হয়েছিল। কোত্থেকে এল মেয়েটা? কিন্তু মেয়েটার অপার্থিব রূপ তার সমস্ত পার্থিব প্রশ্ন কেড়ে নিয়েছিল। কোনো মেয়ে যে এত সুন্দর হতে পারে, জানা ছিল না তার। মনে হয়েছিল, উজ্জ্বল সোনালি আলোর বৃত্তের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রভাত। আকাশ থেকে খসে পড়ছে অসংখ্য তারা। একঝাঁক সাদা পাখি উড়ে যাচ্ছে ঘুপচি নীচু ঘরটার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। আর সেই আলোকবৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা পরী! রূপকথার দুনিয়া যেন! সে বিস্মিত হয়েছিল। থমকে গিয়েছিল। আটকে পড়েছিল ঘোরের মধ্যে। লিলিকে বোধহয় ওইদিনই ভালোবেসে ফেলেছিল সে। তারপর অনেক অনেকগুলো রাত কাটিয়েছে লিলির সঙ্গে। মুগ্ধতা থেকেই তো প্রেমের জন্ম! প্রভাতের জন্ম, বড় হওয়া দমদমের বস্তিতে। তার সামান্য লেখাপড়া দিয়ে অনেক কিছুই বুঝতে পারে না। কিন্তু মনের আকুলতা? অমোঘ টানের ঘূর্ণাবর্ত বোঝার জন্য কি কোনো শিক্ষার দরকার পড়ে?

শুরুর দিকে একটু জড়তা ছিল প্রভাতের। লিলি সেটা কাটিয়ে দিয়েছিল। নাকি সময় তাকে সড়গড় করে দিয়েছিল? সব দ্বিধা সরিয়ে রেখে প্রভাত একদিন মনের কথা বলেছিল লিলিকে। ওর ঠোঁটে সবসময় একচিলতে হাসি দেখতে পায় প্রভাত। সময় সময় সেটা বদলে যায়। যে দিন থেমে থেমে, আটকে যেতে যেতে মাথা নীচু করে সে বলেছিল, ‘লিলি আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি!’ সে দিনও একচিলতে হাসি ছিল লিলির ঠোঁটে। ভালোলাগার হাসি। প্রশ্রয়ের হাসি। হ্যাঁ সূচক মৃদু নরম হাসি। সেদিন যেন নীলচে আলো জ্বলছিল ওর চোখের কোণে। আজ লিলির হাসিটা কষ্টে মাখামাখি।

চোখে জল আসছে প্রভাতের। প্রভাত নোনতা গলায় বলল, ‘বিশ্বাস করো, আমি জানতাম না। ওরা একবারও আমাকে বলেনি। সত্যিই আমি জানতাম না।’

অনেকবার প্রভাতের মনে হয়েছে, লিলিকে নিয়ে কোথাও চলে যাবে। অনেক দূরে কোথাও। অন্য একটা শহরে। যেখানে তাকে কেউ চেনে না। লিলিকেও চিনবে না। তারা সংসার পাতবে। হ্যাঁ, বিয়েই করবে ভেবেছিল লিলিকে। কিন্তু কোথায় যাবে? এই কলকাতা শহরের বাইরে সে কখনও যায়নি। আঠাশটা শীত কেটে গিয়েছে কলকাতাতে। তার থেকেও বড় কথা, লিলির কাছে এই ব্যাপারে কখনও সদুত্তর পায়নি। যতবার প্রসঙ্গ তুলেছে, চুপ করে থেকেছে লিলি। যেন নির্বাক একটা পুতুল! যার মধ্যে কোনো প্রাণ নেই। তরঙ্গ নেই স্বপ্নের। প্রভাত এগোতে পারেনি। সে ভেবেছিল, অপেক্ষা করতে হবে। লিলির উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন। মেয়েটা নিশ্চয়ই একদিন শব্দ খুঁজে খুঁজে একটা পূর্ণবাক্য তুলে ধরবে তার সামনে— ‘প্রভাত, বিয়ে করবে আমাকে?’ সেই রাতটার জন্য অপেক্ষা করেছে সে। প্রভাত জানত না, অপেক্ষার এই সেতুটা কোনোদিন পারই করা হবে না তার। লিলিকে একা রেখেই ফিরে যেতে তাকে।

আজ সন্ধেয় বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় দাদা ডেকেছিল তাকে। প্রবালও শ্যামবাজারের একটা দোকানে কাজ করে। সে-ই ভাইয়ের জন্য এই কাজটা জুটিয়ে দিয়েছিল। বেকার ভাইয়ের চাকরি জোটাতে পারলে তারই সুবিধা। এত বড় সংসারটা একা টানতে হবে না।

প্রবাল বলেছিল, ‘শোন, কাল বিকেলটা ফাঁকা রাখিস। একজনের বাড়ি নিয়ে যাব তোকে।’

প্রভাত কথা কম বলে। সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়েছিল।

প্রবাল মুচকি হেসে বলেছিল, ‘তোর জন্য পাত্রী দেখতে যাব কাল।’

পাত্রী? মানে তার বিয়ের কথা বলছে দাদা? সে হোঁচট খেয়েছিল।

প্রবাল বলেছিল, ‘মেয়েটা কালো হলেও ভালো দেখতে। সুন্দরী বউ পাবি, আর কী চাই!’

আর কী চাই, মানে? সে কী চায়, ওরা জানে না? মুখ ফুটে সব বলতে হবে? কই তাকে তো কখনও বলতে হয়নি, মাসের অর্ধেক মাইনে বাবার হাতে তুলে দিতে হয়? কখনও বলতে হয়নি, ভাইপো-ভাইঝিদের জন্য মাঝেমাঝে চকোলেট-মিষ্টি এটা-ওটা আনতে? মাসের অন্তত একটা রবিবার বাড়ির জন্য মাংস কিনতে? তা হলে এরা বুঝবে না কেন? কেন প্রবালকেই সব বুঝিয়ে বলতে হবে? শব্দহীন মানুষ মানেই কি বোধহীন? কথা দিয়েও তো অনেক কিছু বোঝানো যায় না! কই লিলিকে তো কোনোদিন মুখ ফুটে বলতে হয়নি, সে তাকে ভালোবাসে কিনা? প্রভাত নিজেই বুঝতে পেরেছে! তা হলে তার বাবা-মা, দাদা-বৌদি পারবে না কেন?

প্রবালের কথা শুনে লিলির মুখটা ভেসে উঠেছিল প্রভাতের চোখের সামনে। একজোড়া নীরব চোখ। দু’কূল ছাপিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর মতো। যার কিনারায় তার স্বপ্নবন্দর। হঠাৎ যেন অপ্রত্যাশিত জলোচ্ছ্বাস ঢুকে পড়েছিল তার মনোরাজ্যে। প্রভাত ভেসে যাচ্ছিল খড়কুটোর মতো।

প্রবাল বলেছিল, ‘কী রে? কিছু বলবি?’

প্রভাত দু’পাশে মাথা নেড়েছিল। কী বলবে সে? যারা কিছু বোঝে না, তাদের কী বলবে? সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। হাঁটতে শুরু করেছিল গড়িয়া মার্কেটের দিকে। গোডাউনে তার ডিউটির সময় এখনও হয়নি। কিন্তু লিলির সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাকে জানাতে হবে তার অপারগতার কথা। আর কাল গিয়ে মালিককে জানিয়ে আসবে, চাকরিটা সে আর করবে না।

প্রভাত মুখ তুলে তাকাল লিলির দিকে। কম পাওয়ারের বাল্বের আলো পড়েছে তার মুখে। চোখ দুটো চকচক করছে। লিলি কি কাঁদছে?

 

একমাত্র প্রান্ত-বিকেলেরই বোধহয় পা রাখার অনুমতি আছে এই ঘরে। আলোর কিছু শেষ রেখা খেলে বেড়াচ্ছে সিমেন্টের খড়খড়ে মেঝেতে। ঢুকে পড়ছে চৌকির তলায়। কিছু ছড়িয়ে পড়ছে দেওয়ালে, বিছানার চাদরে। বিকেলের শেষ আলোয় তাপ থাকে না। থাকে শুধু গাঢ় রঙ। যেতে যেতে সমস্তটাই বিলিয়ে দিয়ে যেতে চায়। পশ্চিমের জানলা থেকে তীর্যক রশ্মি যতটুকু ঢেলেছে তার রঙ, তাতে ঘরটা লালচে আভায় ভরে গিয়েছে।

এই নরম, লাল আলোয় রিঙ্কিকে দেখল প্রভাত। ফাইবারের একটা বড় ট্রে হাতে রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। নীল রংয়ের শাড়ি পরেছে। নাকি বেগুনি? ঠাউর করতে পারল না প্রভাত। ঘরটা হঠাৎই অন্ধকার মনে হল তার। একটা টিউব লাইট আছে। ওটা জ্বালিয়ে দিতে বলবে? ভেবে লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিল প্রভাত। তবু সে বুঝতে পারল, রিঙ্কি এগিয়ে আসছে তার দিকে। এক পা-এক পা করে। রিঙ্কির হার্টবিটের সঙ্গে তালেতালে নাচছে ট্রে-তে থাকা কাপ-ডিশগুলো।

যে ঘরটায় প্রভাত বসে, সেটা বেশ ছোট। গায়ে হেলে পড়া প্লাস্টারহীন চারটে দেওয়াল। অ্যাসবেস্টরের চাল থেকে গরম লাভা নামে। অবাঞ্ছিত তাপ ঠেকাতে চায়ের পেটি আর কার্টুন দিয়ে তৈরি নীচু ফলস্‌ শিলিং। দেওয়ালের ঝুলন্ত র‍্যাকে টিভি। তার পাশে হুকে ঝুলছে ঘোলাটে আয়না। শিবদুর্গার ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার। দরজার পাশে, সুইচবোর্ড থেকে মোবাইল চার্জারের তার ঝুলছে। ঘরটা ভীষণ ছোট কিন্তু পরিচ্ছন্ন, গোছানো। বস্তির ঘর এমনই হয়। না হলে এইটুকু ঘরে কি আর এতগুলো জীবন বয়ে যেতে পারে!

হাওড়ার বস্তিতে প্রভাতরা এসেছে পাঁচজন। বাবা-মা, দাদা-বৌদি আর সে। বর্ষাকালে বোধহয় জল ঢোকে ঘরে। ইঁট দিয়ে কোমর সমান উঁচু করা চৌকি। তাতে বসেছে মা ও বৌদি। দাদা আর বাবার সঙ্গে প্লাস্টিকের চেয়ারে প্রভাত। এই ঘরটা এই মুহূর্তে বস্তির আকর্ষণের কেন্দ্র। ঘরে ব্যস্ততা। বাইরে কৌতুহল। ফিসফাস, গুনগুন শোনা যাচ্ছে। বস্তিতে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকে। কিন্তু জন্ম-মৃত্যু-বিবাহে এরা এক হয়ে যায়। ঘরের লোকেদের মতো সারা বস্তি যেন টেনশনের প্রহর গুনছে!

প্রভাতদের সামনে কাঠের টেবল। ফুল আঁকা সস্তার টেবলক্লথ পাতা। রিঙ্কি খুব ধীরে চায়ের ট্রেটা রাখল টেবলের ওপর। কাপ-ডিস-প্লেট সামান্য নড়েচড়ে জলতরঙ্গের মতো অনুরণন ছড়াল। রিঙ্কির নিঃশ্বাসও অনুভব করল প্রভাত। তবু মুখ নামিয়ে বসে রইল সে। রিঙ্কি ট্রে থেকে পাঁচটা চায়ের কাপ, মিষ্টি, সিঙ্গারা, জিলিপি দিয়ে যত্ন করে প্লেট সাজিয়ে দিল।

‘আমাদের এখানে নব ময়রার সিঙ্গারা খুব বিখ্যাত। জিলিপিটাও ওর দোকানের। খেয়ে নিন। ঠান্ডা হয়ে যাবে।’ গদগদ বিনয়ী পুরুষালি কন্ঠস্বর ভেসে এল। রিঙ্কির বাবা বলেছেন কথাগুলো, মুখ না তুলেই বুঝতে পারল প্রভাত।

চৌকি এই ঘরের প্রায় সমস্ত জায়গা খেয়ে ফেলেছে। যে টুকু ছিল, দখল করে নিয়েছে তিনটে চেয়ার। রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আরও তিন-চারজন। এই বাড়ির সদস্য হবে হয়তো। প্রভাত মুখ তুলে তাকাল। সে আবার দেখতে পেল রিঙ্কিকে। রান্নাঘরের দরজার সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে মেয়েটা। বিকেলের অন্তিম আলো যেন ঘন হয়ে এল হঠাৎ করে। ফুরিয়ে যেতে যেতে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দিল লাল আবির। আর তাতেই প্রভাত দেখল, কুড়ি-একুশ বছরের মেয়েটাকে। শ্যামলা, রোগাটে চেহারা। গাঢ় নীল শাড়ির জন্য তাকে আরও বেশি কালো দেখাচ্ছে। মুখটা মিষ্টি। সারল্যে ভরা দুটো বড়বড় চোখ। কাজল পরেছে? নাকি চোখের পাতা ওই রকমই ছায়াঘেরা? বুঝতে পারল না। এটুকু বুঝল, রিঙ্কির চোখের পাতা ঘনঘন কাঁপছে। প্রভাত মুখ নামিয়ে নিল।

‘কী রে পছন্দ হয়েছে রিঙ্কিকে?’ প্রভাতকে জিজ্ঞেস করল প্রবাল।

মেয়েটা দেখতে ভালোই। কিন্তু ভালো খারাপের কিছু কি বোঝা যায় নাকি আগে থেকে? তাছাড়া, তার পছন্দ-অপছন্দ কি জানতে চেয়েছে কেউ? প্রবালের প্রশ্নটা যে লোক দেখানো, সে খুব ভালো করে জানে। প্রভাত উত্তর না দিয়ে টেবল থেকে চায়ের কাপ তুলে নিল। একটা চুমুক দিয়ে চুপ করে বসে থাকল।

রিঙ্কির বাবার দিকে তাকিয়ে প্রবাল বলল, ‘আমার ভাই বলে বলছি না, ও বড় লাজুক। আমরা যা বলব, খুশি মনে মেনে নেবে।’

রিঙ্কির বাবা গদগদ হয়ে বললেন, ‘সে তো বটেই। আমরাও তাই মনে করি। ছেলেমেয়েদের জন্য বাবা-মায়েরা সঠিক সিদ্ধান্তই নেন!’

রিঙ্কির বাবা লুঙ্গির ওপর একটা সাদা ফতুয়া পরেছেন। এই বিকেলেও তিনি ঘেমে গিয়েছেন। বোধহয় টেনশনে। তিনি থেমে আবার বললেন, ‘মেয়ে আমার খুব শান্ত। পড়াশোনাও জানে। আপনাদের পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নিতে অসুবিধা হবে না।’

বস্তির ঘরে শিক্ষা-অশিক্ষা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তবু দিনকাল পাল্টাচ্ছে। বস্তির ছেলেমেয়েরাও এখন স্কুলে যায়। পড়াশোনা জানা বউ বাড়িতে থাকলে, পাড়া প্রতিবেশির কাছে কদর বেড়ে যায়।

প্রবাল ঠেলা দিল প্রভাতকে। প্রভাত মাথা নীচু করেই বসে থাকল। এই তার এক সমস্যা। মনে যা চলে, কোনো দিনই মুখ ফুটে বলে উঠতে পারে না। আজও তাকে সঙ্গ দিচ্ছে না তার গলা, জিভ।

রিঙ্কির বাবাও হেসে বললেন, ‘মেয়ের জন্য যতটুকু পারব, দেবো। সব বাবাই সেটা করে। আর প্রভাত, তোমাকে বাবা নতুন মোবাইল আর মোটরসাইকেল দেব।’

প্রভাতের বাবা হারাধন আড়চোখে একবার তাকালেন স্ত্রী পারুল ও বড়ছেলে প্রবালের বউ শিমূলের দিকে। সন্তুষ্টির ছায়া দেখতে পেলেন দু’জনের মুখে। বছর পাঁচেক আগে প্রবালের বিয়ের সময় নগদ যৌতুক দিয়েছিল শিমূলের বাবা। সেটা দিয়ে দমদমের বস্তির দু’কামরার ঘরটা সারিয়ে নিয়েছিলেন। রিঙ্কির বাবা মেয়ের সুখের জন্য নিশ্চয় কিছু নগদও দেবেন। সে কথা না হয় পরে বলে নেবেন। তবে, প্রবালের একটা মোটরসাইকেলের সখ অনেকদিনের। বস্তিতেও আজকাল ছেলেছোকড়ারা হুঁশহাস মোটরসাইকেল চালিয়ে বেড়ায়। হারাধন তাকিয়ে দেখলেন, রিঙ্কির বাবার কথা শুনে প্রবাল খুশিতে ডগমগ করছে। ভাইয়ের জিনিস মানে তো তারই!

প্রভাতের দিকে একবার তাকালেন হারাধন। সে একমনে চা খেয়ে যাচ্ছে। যেন ঘরে থেকেও নেই! ছোট ছেলেটা বরাবরই এমন। চুপচাপ। তাও ঘরের লোকেদের সঙ্গে দু-চার কথা বলে। বাইরের লোক দেখলে যেন আরও বেশি গুটিয়ে যায়। তাঁর মতো হয়েছে ছেলেটা। রিঙ্কির সঙ্গে প্রভাতের মানিয়ে নিতে অসুবিধা হবে না। পারুলের সঙ্গে এতদিন ঘর করার অভিজ্ঞতা থেকে হারাধন জানেন, মেয়েরা ফাঁকা শ্লেটই পছন্দ করে।

হারাধন গলা খ্যাঁকাড়ি দিয়ে বললেন, ‘দীপকবাবু, আপনি যা ভালো বোঝেন, করবেন।’

একটু থামলেন হারাধন। ‘তবে’, ঘরে যেন নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। দরজায় উঁকি মারা মুখগুলোও এই মুহূর্তে পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছে।

রিঙ্কির বাবা দীপক উৎকন্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছেন হারাধনের দিকে। একবার ঢোঁক গিললেন তিনি। হারাধনের রিঙ্কিকে পছন্দ হয়েছে। মেয়েটার মধ্যে একটা বাচ্চা-বাচ্চা ব্যাপার আছে। তাঁর ইচ্ছেও করছে ‘হ্যাঁ’ বলে দিতে। কিন্তু পারুল শিবপুর আসার পথে পরিষ্কার বলেছে, ‘তুমি আগ বাড়িয়ে কোনো কথা বলবে না। ছেলের বিয়ে বলে কথা। দেনাপাওনা ঠিকঠাক হলে তবেই না নতুন সম্পর্ক।’ পারুলকে সমঝে বুঝে চলেন হারাধন। পারুলের বৈষয়িক জ্ঞান তাঁর চেয়ে অনেক বেশি।

পারুলের দিকে একঝলক তাকিয়ে পাকধরা গালে হাত বুলিয়ে হেসে হারাধন বললেন, ‘রিঙ্কিকে আমাদের ভালো লেগেছে। তবে বিয়ের ব্যাপার তো, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে একটু আলোচনা না করে… বুঝতেই পারছেন। কাল পরশুর মধ্যে জানিয়ে দেব।’

 

হাওড়ার শিবপুর থেকে গড়িয়া যেতে ঘণ্টাখানেক লাগে। অফিস ফেরত জ্যামটা সন্ধেয় একটু বেশি হয়। প্রভাতের গড়িয়া মোড়ে নামতে নামতে প্রায় রাত ন’টা বেজে গেল। তা হোক গে। এখনও সুপারমার্কেটটা খোলাই থাকে। মালিক বিজন দত্তও থাকেন। সারাদিনের দিনের বিক্রির হিসেব করেন এই সময়টা। বিজনবাবুর সঙ্গে দেখা করে প্রভাত বলবে, কাল থেকে সে আর আসবে না। আজকের রাতটাই শেষ রাত। মাসের মাঝখানে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য তার ওপর রাগ করবেন বিজনবাবু। হয়তো মাইনে কাটবেন। নাও দিতে পারেন। কিন্তু সে অপারগ। আর নিতে পারছে না। নিয়ম ভেঙে বেরিয়ে আসার স্বপ্ন দেখা একরকম, আর সেটা পূরণ করা আর একরকম। প্রভাত অনেক চেষ্টা করেও পায়ের তলায় দাঁড়ানোর মতো শক্ত মাটি পায়নি। তাকে দুনিয়ার নিয়মই মেনে নিতে হবে। লিলির কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে প্রভাতকে। রিঙ্কিকে দেখতে যাওয়ার সময় তার প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছিল। লিলির জন্য কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেনি কিছু। বললেও কী লাভ হত? ওর কথা মেনে নিত বাবা-মা-দাদা? সে জানে, লিলির কথা শুনলে তাকে পাগলই বলবে ওরা। লিলির মতো মেয়েদের এই সমাজ শুধু ব্যবহার করতে জানে। তাদের প্রাপ্য সম্মান কখনও দেয় না। আজ রাতে শেষবার দেখা হবে লিলির সঙ্গে। প্রভাত জানে, লিলির চোখে চোখ রাখতে পারবে না সে। অপরাধী মনে হবে নিজেকে। মনে হবে, দুনিয়ার ভয়ে সে-ই পালিয়ে গেল। তবু, বাঁধনহারা হওয়ার আগেই টেনে ধরতে হবে তার মনের লাগাম। থামতে তাকে হবেই।

গড়িয়া মোড় থেকে বাঁ দিকে টার্ন নিলে ডানহাতে সুপারমার্কেট। অনেক রাত পর্যন্ত জায়গাটা জমজমাটই থাকে। অটোস্ট্যান্ডের থিকথিকে ভিড় দেখা যায়। কিন্তু আজ খাঁখাঁ করছে জায়গাটা। মোড়ের মাথায় পুলিশের ব্যারিকেড দেখতে পেল প্রভাত। দূরে পুলিশের ভিড়। আরও দূরে বেশ কয়েকটা দমকলের গাড়ি দেখতে পেল সে। ওয়াটার ব্রাউজার থেকে মোটা, বিশাল পাইপ দিয়ে জল ঢালছে দমকম কর্মীরা। প্রভাত অবাক হয়ে দেখল, সুপারমার্কেটটাকে ঘিরে রয়েছে লেলিহান সোনালি আলোর বন্যা। দাউদাউ করে জ্বলছে মার্কেটটা! মাথার ওপর কালচে ধোঁয়ার কুণ্ডলি। পোড়া গন্ধ ভাসছে বাতাসে। সে হতভম্ভ হয়ে গেল। পা আটকে গেল রাস্তায়। সুপারমার্কেটে আগুন লাগল কী করে?

অগুনতি মানুষ ছোটাছুটি করছে এদিক-ওদিক। চিৎকারে ভরে রয়েছে জায়গাটা। তার আশপাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে লোকজন। বালতি, বোতল, হাঁড়িতে যে যেভাবে পারছে ভরে নিয়ে আসছে জল। প্রভাত ভড়কে গেল। সে বুঝে উঠতে পারল না কী করবে। সুপারমার্কেটের একটা অংশ অনেকদিন ধরেই ভাঙাচোরা পড়ে রয়েছে। ওখানেই বিজনবাবুর গোডাউন। আগুন যেন সে দিকটাই গ্রাস করেছে বেশি করে। লিলি! মনে পড়তেই ব্যারিকেড টপকে দৌড়তে শুরু করল প্রভাত। আগুনটা ক্রমশ বড় হয়ে আসছে তার সামনে। তাপ বাড়ছে। ক্রমশ লাল হয়ে যাচ্ছে প্রভাত। পিছন থেকে একসঙ্গে অনেকের চিৎকার শুনতে পেল সে। তবু দৌড়ে যাচ্ছে প্রভাত। লিলি কি এখন গোডাউনে? আগুন লাগার সময় কি কেউ খেয়াল করেছে ওকে? কেউ কি গোডাউনের গেটটা খুলে দিয়েছিল ওর জন্য?

প্রভাত আরও গতি বাড়াল। যেন পাশবিক শক্তি ভর করেছে তার ওপর। সমস্ত ভয়-আশঙ্কা তাকে ছুটিয়ে নিয়ে চলল আগুনঘেরা গোডাউনের দিকে। গোডাউনের ভেতরটা একবার দেখতেই হবে তাকে। পিছন থেকে কে যেন হ্যাঁচকা টানে চেপে ধরল তার জামার কলার। প্রভাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল। পারল না। বেশ কয়েকটা হাত ধরে ফেলেছে তাকে। লেলিহান শিখার আন্দোলন চলছে তার সামনে। তার চোখের মণিতে লালচে আগুনের উশৃঙ্খলা। সে আবার হ্যাচকা টান দিল। ছাড়িয়ে নিতে চাইল নিজেকে। লিলিকে বাঁচাতেই হবে। প্রভাত আঙুল তুলে দেখাল জ্বলন্ত গোডাউনটার দিকে। এলোমেলো গলায় বোঝানোর চেষ্টা করল, লিলি রয়েছে ওখানে! একদলা কান্না ছিটকে বেরিয়ে এল তার গলা থেকে। যে হাতগুলো আঁকড়ে ধরেছে প্রভাতকে, তারা টেনে রাস্তায় বসিয়ে দিল। উপচে পড়া চোখ নিয়ে প্রভাত দেখল, আগুন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। তাণ্ডব চালাচ্ছে সুপারমার্কেট জুড়ে। দাবানলের মতো ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে আশপাশের বাড়িতে। যেন পুরো অঞ্চলটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। দমকলের অনেকগুলো গাড়িও নিয়ন্ত্রণে করতে পারছে না পাশবিক আগুনকে। রোঁয়াওঠা তুলোর মতো ছাই উড়ছে বাতাসে। প্রভাত ক্রমশ ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। লিলির মুখটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। রাস্তায় শুয়ে অঝোরে কেঁদে ফেলল প্রভাত।

 

‘পভাত, অ পভাত!’

দূর থেকে ছেঁড়াছেঁড়া শব্দ শুনতে পাচ্ছে প্রভাত। কেউ ডাকছে তাকে। মা সকালবেলায় এই রকমভাবে ডাকে। কিন্তু মা এখানে আসবে কী করে? আচ্ছা, আগুন কি একবার জ্বললে আর নেভে না? যে আগুন গতকাল রাত থেকে দেখতে পাচ্ছে, সেটাও কি নিভবে না? এখনও একইরকম তাপ ঢেলে যাচ্ছে কেন? প্রভাত চোখ খোলার চেষ্টা করল। ঘষাকাচের মতো একটা খোলা জানলা ভেসে উঠল তার সামনে। সেই জানলার বাইরে আগুন জ্বলছে! ধড়ফড় করে উঠে প্রভাত দেখতে পেল, সে নিজের বিছানায় শুয়ে রয়েছে। তা হলে কি স্বপ্ন দেখছিল? গড়িয়া সুপারমার্কেটে আগুন ধরেনি?

‘বলি অ পভাত, আর কতক্ষণ ঘুমোবি বাবা? বারোটা বাজে যে রে! ওট বাবা, ওট!’

প্রভাত উঠে বসল বিছানায়। সে স্বপ্ন দেখেনি। মনে পড়ে গেল সবটা। শিবপুর থেকে তার গড়িয়া পৌঁছনো। আগুন ধরে যাওয়া সুপারমার্কেট। তার ছুটে যাওয়া। লিলির কথা।

‘বলি, কাল সারারাত তো মুখে কিচু তুলিস নাই। পিত্তি পড়বে যে! মুখহাত ধুয়ে কিচু খেয়ে নে বাবা!’

জানলা দিয়ে ভেসে আসা মায়ের গলার আওয়াজ শুনতে পেল প্রভাত। পূবদিকের জানলার বাইরে বস্তির টাইমকলটা। আর সব ঘরের বউরা এইসময় জল ধরা, কাপড়কাচা, বাসনমাজার কাজ করে। তার মা পারুলও এখন ঘরের কাজে ব্যস্ত। বস্তির ঘরে কেউ বারোটা পর্যন্ত ঘুমোয় না। সকালে গড়িয়া থেকে ফিরে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাত জাগার ধকলের থেকেও বেশি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ছিল। বস্তির অধিকাংশ পুরুষরা এখন যে যার মতো কাজেকর্মে গিয়েছে। দুপুরে খাওয়ার সময় ফিরবে। ছেলেমেয়েরা গিয়েছে আশপাশের স্কুলে। কিছু বয়স্ক পুরুষ আর কচিকাঁচারা আছে। এই সময়টা একান্তভাবে বস্তির মেয়েদের। টাইমকলে ভিড় উপচে পড়ে। জানলা দিয়ে পাক খেতে খেতে ভেসে এল মেয়েলি গল্প। পারুল কলতলায় আসা পাড়ার বউদের গড়িয়া সুপারমার্কেটে লাগা ভয়ঙ্কর আগুনের কথা বলছে। বিছানায় বসেও নিজেকে অসহায় লাগল প্রভাতের।

আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ভোররাত হয়ে গিয়েছিল। একসঙ্গে কুড়িটা ওয়াটার ব্রাউজার নিয়ে আপদকালীন পরিস্থিতিতে কাজ করছিলেন দমকলকর্মীরা। তাদের সঙ্গে এলাকার সমস্ত লোক নেমে পড়েছিল আগুন নেভাতে। প্রথমে আশপাশের আবাসনে ছড়িয়ে পড়া আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। জলের অসংখ্য বিন্দু, কণা, তরঙ্গ, ঢেউ দীর্ঘ সময় নিরবিচ্ছিন্নভাবে ঘিরেছিল এলাকাটাকে। ভোর হয়ে গিয়েছিল আগুন নেভাতে। সুপারমার্কেটের উল্টোদিকে একটা অস্থায়ী ক্যাম্পে বসে এসব দেখেছিল প্রভাত। সর্বগ্রাসী আগুন যে মার্কেটটাকে পুরোপুরি না খেয়ে থামবে না, বুঝতে পেরেছিল প্রভাত। তবু সে অপেক্ষা করেছিল। লিলির খোঁজ তাকে নিতেই হবে। মেয়েটা কাল গোডাউনে ছিল না কি না, সে নিশ্চিত নয়। একটু রাতের দিকে আগুনটা নিয়ন্ত্রণে আসার পর রজতদাকে দেখতে পেয়েছিল প্রভাত। রজতদা বলেছিল, এমন আচমকা আগুন লেগেছিল যে, কিছুই টের পাওয়া যায়নি। গোডাউনে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মাল ছিল। সব পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে।

‘আর লিলি? ও কি কাল রাতে ছিল গোডাউনে?’ সে চরম উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল রজতদাকে?

অদ্ভুত চোখে রজতদা তাকিয়েছিল প্রভাতের দিকে। ‘লিলি কে? কার কথা জানতে চাইছো প্রভাত?’

ঝোঁকের মাথায় প্রশ্নটা করে বসেছিল ঠিকই, পরমুহূর্তে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল প্রভাত।

‘তোমার সঙ্গে গোডাউনে রাতে কেউ থাকত নাকি?’

রজতদার প্রশ্ন শুনে সে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লোকটার অবাক চাউনিকে এড়াতে পারেনি। প্রভাত কোনোরকমে বলেছিল, ‘গোডাউনের পিছনের দিকে একটা ভিখিরি পরিবার থাকে। ওদের বাচ্চা মেয়েটার নাম লিলি। ওর কী হল, রজতদা?’

রজতদা যে বিশ্বাস করেনি তার কথা, প্রভাত বুঝতে পেরেছিল। তবে, আর কথা বাড়ায়নি। উঠে গিয়েছিল প্রভাতের পাশ থেকে। প্রভাত হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। লিলির কথা জানতে পারলে লোকে তাকে পাগল বলবে। প্রভাত অস্থায়ী ক্যাম্পটা থেকে উঠে গড়িয়ামোড়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। আগুনের খোলা আঁচল তখন আর হাওয়ায় উড়ছিল না। কালচে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছি রাস্তা দিয়ে। তখনই দেখা হয়েছিল সুকুমারের সঙ্গে। সেও তারই মতো একটা গোডাউনে পাহারাদার কাম ইস্তিরিওয়ালা। প্রভাত পায়ে পায়ে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

প্রভাতের ভেঙে পড়া শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে সুকুমার বলেছিল, ‘কী কাণ্ড হয়ে গেল বলো তো, বস!’

তারপর প্রভাতের গা-ঘেঁষে নীচু গলায় সুকুমার বলেছিল, ‘আগুনটা লাগানো হয়েছে, বুঝলে? বাজার সমিতির লোকজনই আগুনটা লাগিয়েছে!’

প্রভাতের বিশ্বাস হয়নি। আগুন লাগানো হয়েছে? আগুন লাগিয়ে বাজার সমিতির কী লাভ? সে অবাক চোখে তাকিয়েছিল সুকুমারের দিকে।

সুকুমার মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘ভেতরের খবর বলছি, সুপারমার্কেটটার হাল খারাপ ছিল। তুমিও তো দেখেছো, ভেঙেচুরে পড়ছিল। এতবড় মার্কেট সারানোর খরচ দোকানদাররা দিতে চাইছিল না। তাই আগুনটা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন তো ভোটের সময়। বিরোধীদের চাপে পড়ে মার্কেটটা আবার নতুন করে বানিয়ে দেবে সরকার। আর দোকানদারদেরও তো ক্ষতি নেই। ইন্সিওরেন্স করানোই আছে। দু’দিক থেকে টাকা কামাবে ওরা। মরব আমরা।’

মানুষ এত নিষ্ঠুর আর এত লোভী হতে পারে? এতগুলো দোকান! মালিকরা না হয় ইন্সিওরেন্স থেকে টাকা পেয়ে যাবে। কিন্তু দোকানের কর্মচারিদের কী হবে? কী ভাবে এতগুলো লোকের সংসার? মাসতিনেকের মধ্যে মার্কেট তৈরি হওয়া মুখের কথা নয়। ছ’মাস কিংবা একবছরও লাগতে পারে। আরও হাবিজাবি অনেক কিছু বলছিল সুকুমার। প্রভাতের মনটা তেতো হয়ে গিয়েছিল। সে সরে এসেছিল সুকুমারের কাছ থেকে। তার কিছু ভালো লাগছিল না।

তখন গড়িয়ার আকাশের অন্ধকার কেটে যাচ্ছিল। ভোর হচ্ছিল। আগুনও প্রায় নিভে এসেছে। মার্কেটের পিছন দিয়ে গোডাউনের দিকে চলে গিয়েছিল সে। আগুনে দগ্ধ গোডাউনগুলো দেখতে পেয়েছিল প্রভাত। কাঠামোটুকু নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কালিঝুলিমাখা কতগুলো ঘুপচি ঘর। মাথার ছাদ ভেঙে পড়েছে। দরজা-জানলা পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে। প্রভাত যে গোডাউনে কাজ করত, সেটাকে আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে কাঠ, লোহার, ছেঁড়া-পোড়া কাপড়ের টুকরো। সে যে গোডাউনে কাজ করত, তার ধ্বংসাবশেষের দিকে কয়েক পা এগিয়ে নিথর হয়ে গিয়েছিল। একটা আংটি। আগুন তাকে হজম করতে পারেনি। শুধু সোনালি রংটা পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছে। প্রভাত নীচু হয়ে আংটিটা তুলতেই চিনতে পেরেছিল। লিলিকে এটা দিয়েছিল সে। সস্তার ইমিটেশনের আংটিটা গড়িয়ার ফুটপাথ থেকে কিনেছিল। আংটিটা মুঠোয় ধরে নীরবে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল প্রভাত। লিলি নেই। থাকলে তার দেওয়া এই আংটিটা অবহেলায় পড়ে থাকত না রাস্তায়। হয়তো বিধ্বংসী আগুন তাকেও একটু একটু করে খেয়েছে। বাঁচার আকাঙ্খায় ছটফট করেছে মেয়েটা। কিন্তু লেলিহান শিখা চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছিল তাকে। একটা সময় হয়তো তার পাকা গমের মতো শরীর, পিঠ ছাপিয়ে নেমে আসা কালচে চুলের ঢল, সমুদ্রনীল একজোড়া চোখ হার মেনেছিল আগুনের বীভৎসতার কাছে।

ডুকরে কেঁদে উঠল প্রভাত। কাউকে ভালোবাসা মানে তো, শেষ পর্যন্ত তার পাশে থাকা। যে মুহূর্তগুলোতে সে অসহায় এবং একা, সেই মুহূর্তগুলোতে তাকে সঙ্গ দেওয়া। লিলি আগুনে পুড়ে গেল, অথচ সে কিছুই করতে পারল না। তার মতো দুর্ভাগা প্রেমিক এই দুনিয়ায় আর নেই বোধহয়। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে চেয়ারে ঝোলানো নোংরা প্যান্টের পকেট থেকে আংটিটা বের করল প্রভাত। এখনও ওটা থেকে পোড়া গন্ধ বেরোচ্ছে। নাকি, লিলির শেষ নিঃশ্বাস? আগুনে তলিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে এইটুকুই কি আংটিটাতে মিশিয়ে দিয়েছিল? নিজেকে পাপবিদ্ধ মনে হল প্রভাতের। একমাত্র চোখের জলেই হতে পারে তার প্রায়শ্চিত্ত। দু’হাতে মুখ ঢেকে অঝোরে কেঁদে ফেলল প্রভাত।

‘কী রে প্রভাত, কাঁদছিস কেন?’

প্রবালের বিস্ময়াবিষ্ট গলা শুনে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করল প্রভাত। দু’হাতের চেটোয় চোখের জল মুছে মুখ তুলে তাকাল দাদার দিকে। দুপুরের খাওয়ার জন্য বাড়ি ফিরেছে সে।

প্রবাল হেসে বলল, ‘কাঁদছিস কী রে বোকা? তোর তো এখন ভালো সময়!’

প্রভাতের চোখ এখনও ঝাপসা করে রেখেছে বিন্দু বিন্দু নোনাজল। তবু সে অবাক চোখে তাকাল প্রবালের দিকে।

একটা কাগজ মেলে ধরতে ধরতে প্রবাল বলল, ‘দ্যাখ, দ্যাখ কাগজের প্রথম পাতায় তোর ছবি বেরিয়েছে।’

সজল চোখে প্রবালের মেলে ধরা কাগজটা দেখল প্রভাত। একটি দৈনিক কাগজের প্রথম পাতায় আগুনের ঘেরাটোপে বসে থাকা এক যুবককে দেখা যাচ্ছে। ভেঙে পড়া, বিধ্বস্ত চেহারা। উথলে ওঠা আগুনের মাঝে রাস্তায় বসে কাঁদছে সে। বড় করুণ মুখটা। যেন ওই আগুন তার সব কেড়ে নিয়েছে!

‘তোর ছবি ছাপাই শুধু নয়, শোন, আর কী লিখেছে? যত কর্মী আছে, সুপারমার্কেট তৈরি না হওয়া পর্যন্ত তাদের মাসমাইনে সরকার দেবে। সেই সঙ্গে পঞ্চাশহাজার টাকার ক্ষতিপূরণ। কান্নায় ভেঙে পড়া তোর এই ছবিটা না দেখলে কি নেতাদের মন ভিজত, অ্যাঁ?’

একটু থেমে গলা নামিয়ে প্রবাল আবার বলল, ‘কী রে, এবার তা হলে রিঙ্কির বাবাকে হ্যাঁ বলে দিই। ওরাও পঞ্চাশহাজার টাকা নগদ দেবে। তার মানে, সরকারের পঞ্চাশ আর রিঙ্কিদের পঞ্চাশ— একলাখ টাকা! কপাল করে জন্মেছিস, ভাই!’

প্রবালের কথা শুনতে পেল না প্রভাত। সে ডান হাতের মুঠোয় ধরে রাখা আংটিটাকে সজোরে চেপে ধরল। ছলছলে চোখে বলল, ‘দাদা, লিলি আর নেই রে?’

প্রবালের খুশিভাবটা মুহূর্তে যেন উড়ে গেল। ‘লিলি! লিলি কে?’

প্রভাত শুনতে পেল না প্রবালের কথা। সে বিড়বিড় করে বলে উঠল, ‘মার্কেটে আগুন লাগার পর লিলিও আগুনে পুড়ে গিয়েছে।’

প্রবাল থমকে গেল। রিঙ্কির বাবা বাইক দেবে বলেছে। পঞ্চাশহাজার টাকা নগদ আসবে। জীবনে সুখের খোঁজ বড় একটা পাওয়া যায় না। যখন আসছে, তখন হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলার বান্দা প্রবাল নয়।

প্রভাতকে দু’হাতে ঝাঁকিয়ে চাপা হিশহিশে গলায় প্রবাল বলল, ‘লিলি কে? বল, লিলি কে?’

‘দাদা, লিলি গোডাউনে থাকত।’

প্রভাতকে ছেড়ে কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে রইল প্রবাল। ‘গোডাউনে থাকত মানে? ওখানে তুই মেয়েমানুষ নিয়ে তুলেছিলিস?’

‘না দাদা, লিলি অন্যদের মতো নয়। লিলি...’

‘তা হলে কী রকম?’ চিৎকার করে উঠেও নিজেকে সামলে নিল প্রবাল। হিশহিশ করে বলল, ‘লিলি কি পুতুল? ম্যানিকুইন? আবার পাগলামী শুরু করেছিস?’

প্রভাতের কাঁধে হাত রেখে প্রবাল চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আমাদের সুখের সময় আসছে! ওরা বাইক দেবে, নতুন মোবাইল দেবে। ও দুটো আমার চাই। তোর কোনো রকম বাঁদরামো সহ্য করব না। বিয়েটা হয়ে যাক। তার পর তোকে আবার পাগলাখানায় ভরে দিয়ে আসব।’

প্রবাল ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল প্রভাত। মুঠো খুলে সে দেখল আগুনের গ্রাসে কালচে হয়ে যাওয়া আংটিটা। চোখের নীরব জলের ফোঁটায় ধুইয়ে দিল আংটিটা। লিলি পুতুল বলে এত সহজে প্রবাল তাকে ‘পাগল’ বলতে পারল। রিঙ্কি হলে পারত?

রিঙ্কি নামটা মনের মধ্যে বেজে উঠল প্রভাতের। সে পর্দা সরিয়ে প্রবালের ঘরে ঢুকে বলল, ‘দাদা, রিঙ্কির বাবাকে বলে দিস, আমি রাজি!’

প্রভাতের উপর একঝলক চোখ বুলিয়ে নিল প্রবাল। তারপর হেসে বলল, ‘এই তো ভালো ছেলের মতো সব বুঝেছিস। আমি আজই ওদের জানিয়ে দেব যে, রিঙ্কিকে তোর পছন্দ।’

মাথা নীচু করে নিঃশব্দে হাসল প্রভাত। প্রবাল বুঝল না, প্রভাতের হাসির তলায় আগুন জ্বলছে। এই আগুন চট করে নেভে না!