অভিমন্যু ● সায়ন্তনী পলমল ঘোষ

 


 

ছেলেটা চারিদিকে একবার তাকাল। নাহ, এই মুহূর্তে হাইওয়েতে সে আর তার সোলার সাইকেল ছাড়া আর কোনো দ্বিতীয় ব্যক্তি বা বস্তুর অস্তিত্ব নেই অর্থাৎ তাকে কেউ লক্ষ্য করবে না। দু কিলোমিটার অন্তর নজরদার ক্যামেরা লাগানো আছে কিন্তু তার হিসেব মতো এই জায়গাটা দুদিকের দুটো ক্যামেরার দৃষ্টিসীমার বাইরে।

সাইকেলটা নিয়ে সে হাইওয়ে ছেড়ে পাশের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। জঙ্গল এত ঘন যে সাইকেল নিয়ে কোনোমতেই এগোনো সম্ভব নয়। সে গাছপালা আর ঝোপের আড়ালে সাইকেলটা লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে পিঠের ছোট্ট ব্যাগটা নিয়ে এগিয়ে চলল। এই জঙ্গলে কারুর ঢোকা বারণ কিন্তু নব্য যুবকের টগবগে রক্ত কবেই বা বারণ শোনে। অজানার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করে এই ছেলেটি।

এই ঘন জঙ্গলের মাঝে নাকি তিনটি অনুচ্চ টিলা বা বলা যেতে পারে খুব ছোট তিনটি পাহাড় আছে। তার ইচ্ছে সে ওই পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছবে। সৈনিক পিতার সন্তান হওয়ার সুবাদে ভয় শব্দটা তার কাছে অচেনা আর দুঃসাহস তার রক্তে। জঙ্গলের গাছপালার ফাঁক দিয়ে রাস্তা করে সে এগিয়ে চলল।

 

***

“হোয়াট! তুমি এসব কী বলছ অংশুমান?” বিস্ময়ে ফেটে পড়লেন ডক্টর মনীশ পটেল।

“আমিও প্রথমে আপনার মতোই অবাক হয়েছিলাম স্যার কিন্তু তারপর দেখলাম ওদের সন্দেহই ঠিক। আপনি নিজেও তদন্ত করে দেখতে পারেন।”

“আমি ভাবতেই পারছি না। কতদিন ধরে আমার পেছনে এসব ঘটছে কে জানে! ব্যাপারটা কত বিপজ্জনক বুঝতে পারছ?”

“হ্যাঁ, স্যার। এখন কী করবেন? আমাদের হাতে শক্ত কোনো প্রমাণও নেই ওর বিরুদ্ধে স্টেপ নেওয়ার মতো, কিন্তু ও যে কাজটা করছে সে ব্যাপারে তো আমরা শিওর।”

“চিন্তা করো না অংশুমান। এমনি এমনি আমার মাথার চুলগুলো পাকেনি। ইন্দরের মতো লোকের সঙ্গে কী করতে হবে মনীশ পটেল খুব ভালো করে জানে। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ।” দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন মনীশ পটেল।

 

***

সামনে তাকিয়ে ছেলেটার মুখে হাসি ফুটে উঠল। অবশেষে সে পৌঁছে গেছে টিলাগুলোর পাদদেশে। সূর্য এখন মধ্য গগনে। ঘড়ি বলছে ঠিক দুপুর বারোটা বাজে। ব্যাগ থেকে বোতল বের করে ঢকঢক করে খানিকটা জল খেল সে। তৃষ্ণা নিবারণ করে ব্যাগ থেকে তার ন্যানো ক্যামেরাটা বের করল তার সফল অভিযানের স্মৃতি বন্দি করে রাখার জন্য।

ক্যামেরাটা হাতে নিয়েই চমকে উঠল সে। এতক্ষণ খেয়াল করেনি। এবার চোখে পড়ল মাঝখানের টিলার নীচের দিকে একটা গুহা মুখ। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার গুহা মুখটা একদম পরিষ্কার যা এই গভীর অরণ্যে খুবই অস্বাভাবিক। ব্যাপারটা ছেলেটার মনে কৌতূহল উদ্রেক করল। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল গুহার উদ্দেশে। কিছু কী আছে ওই গুহায়? কোনো রহস্য?

 

***

মাথা নিচু করে নিজের গাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো লোকটা। একবার পেছন ফিরে বড় বড় বিল্ডিং সম্বলিত বিশাল চত্বরটার দিকে তাকাল। সে কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি এরা তার সঙ্গে এরকম করতে পারে। বস্তুত সে কখনও এই গাধাগুলোর কাছে ধরা পড়ে যেতে পারে এটাই ছিল তার কল্পনার অতীত কিন্তু তার বিশ্বাসকে ভুল প্রমাণিত করে এরা তাকে সন্দেহ করেছে এবং তার অজান্তে তার ওপর নজরদারি চালিয়েছে।

নিজের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই কাল হল তার। আরও সাবধান থাকা উচিত ছিল। এই বি গ্রেডের লোকগুলোর সামনে তাকে আজ মাথা নত করতে হল। এরা তার যে ক্ষতি করল তার হিসাব একদিন চোকাতেই হবে এদের। এতদিন যে অর্থ সে বিভিন্ন উপায়ে অর্জন করেছে সেজন্য তার অর্থের অভাব হবে না। তাছাড়া তার প্রতিভাকে লুফে নেবার মত লোকেরও অভাব নেই এই দুনিয়ায়। তার এখন একটাই লক্ষ্য এক ঢিলে দুই পাখী মারা।

 

দশ বছর পর

ঠাকুমার দিকে একবার বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকাল রৌশেনারা। ভিডিও চ্যাটে নিজের কিছু পেটোয়া বান্ধবীর সঙ্গে খেজুরে গল্প জুড়েছেন। নাতনি যে স্কুল থেকে ফিরে এল সেদিকে কোনো লক্ষ্যই নেই। রৌশেনারাদের সপ্তাহে দুদিন বাড়িতে বসেই অনলাইনে ক্লাস হয়। বাকি দিনগুলো স্বশরীরে স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। আজ সে স্কুলে গিয়েছিল। স্কুলে বেশ মজা হয়েছে কিন্তু বাড়িতে ফিরেই মুড অফ হয়ে গেল তার।

“টিফিন সার্ভ করব?” এইচ নাইন সিরিজের হোম হেল্পার রোবট জিট তার কর্তব্য পালন করার জন্য হাজির।

“নাহ।” দুমদুম করে পা ফেলে রৌশেনারা তার নিজের রুমে চলে গেল। স্কুলের জামাকাপড় পরেই নিজের কম্পিউটারটা অন করল। এখন আর মনিটরের প্রয়োজন হয় না। অন করলেই ভার্চুয়াল স্ক্রীন এসে যায়। বিছানায় আধশোয়া হয়ে স্ক্রীনে ফুটে ওঠা লেখাটার দিকে তাকাল সে।

গাঢ় লাল রঙে ফুটে উঠেছে একটা লাইন, “হাউ ডেয়ার ইউ?”

রৌশেনারার চেহারা থেকে বিরক্তি সরে গিয়ে চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। খুশির নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে বসল সে।

 

***

“পিং।” স্মার্ট ট্যাবটা একমনে কম্পিউটারে কাজ করা মানুষটির কানে টোকা দিল। মুখ ঘুরিয়ে ট্যাবের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই লোকটির মুখের হাসি আকর্ণবিস্তৃত হয়ে গেল।

“ডান।” বিশেষ একটি গোপন আইডি থেকে বার্তা এসেছে। পরম তৃপ্তিতে চোখ দুটো একবার বন্ধ করলেন তিনি তারপরে যখন চোখ খুললেন তখন তাঁর চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

 

***

হালকা একটা মিউজিক চালিয়ে দিয়ে চুপচাপ বসে ছিল অভিমন্যু। এখনকার গাড়ি চালাতে বিশেষ কোনো কষ্ট করতে হয় না শুধু সিস্টেমে নিজের গন্তব্যের লোকেশন সেট করে দিলেই হল। অভিমন্যু এখন বাড়ি ফিরছে। তার হঠাৎ মনে হল কিছু কিছু জিনিস কখনও পুরোপুরি বদলায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়ত সঙ্গীতের বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু সংগীতের প্রতি মানুষের ভালোবাসা আজও একইরকম আছে। একটুও বদলায় নি। সেতো সময় পেলেই গান শোনে। তার গানের গলা সেরকম ভালো না হলেও সে বিভিন্ন ধরনের ইন্সট্রুমেন্ট বাজাতে পারে। অন্যেরা তো অভিমন্যুকে দেখে বিস্মিত হয়ই তার নিজেরও মাঝে মাঝেই অবাক লাগে।

তার একই শরীরে যেন দুটো সত্তা। একটা সত্তা সঙ্গীতপ্রেমী, খুব নরম মনের একজন মানুষ যে অন্যের দুঃখ-কষ্টে খুবই বিচলিত হয়ে যায়, পরিবারের প্রতি অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ আর তার দ্বিতীয় সত্তা হল দুর্দমনীয়, অপ্রতিরোধ্য এমন একজন মানুষের যে নিজের কাজের প্রতি তদ্গত প্রাণ। নিজের কর্তব্যের জন্য যে কোনোরকম ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। শত্রুপক্ষের জন্য অভিমন্যু একজন পাষাণ হৃদয় প্রতিপক্ষ যে কোনোরকম দয়া-মায়া করতে অপারগ। এই দ্বিতীয় অভিমন্যু মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়ে উদ্দেশ্যহীন ভাবে। এই বোহেমিয়ান ঘোরাঘুরি থেকে বিভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে সে।

“বিপ বিপ।” অভিমন্যুর হাতের স্মার্ট ব্যান্ডটা ঘুম ভেঙ্গে ডাকাডাকি করছে তাকে।

“স্যার কলিং।” ভীষণ অবাক হয় অভিমন্যু। এক ঘণ্টা আগেই তো সে বেরিয়ে এসেছে অফিস থেকে। অফিস ফেরত এক বন্ধুর কাছে গিয়েছিল সে।

“হ্যালো স্যার।”

“কাম শার্প। ইটস ভেরি আর্জেন্ট।”

“ওকে।”

গাড়িতে প্রয়োজনীয় নির্দেশ সেট করে মাকে একবার জানিয়ে দেয় অভিমন্যু, নাহলে আগেই চিন্তা করতে আরম্ভ করবে, তারপর ফোন করবে তাকে। অনেক অপরিবর্তিত ব্যাপারের মধ্যে এটাও একটা, মায়ের স্নেহ। সভ্যতার আদিকাল থেকে এই 2055 সাল মায়েরা একইরকম আছে। অভিমন্যুর কাছে আপতকালীন ডাক নতুন না হলেও আজ একটু অবাকই লাগছে তার কারণ কিছুক্ষণ আগেই সে বেরিয়ে এসেছে। তখন পর্যন্ত তো সব ঠিকঠাক ছিল।

 

***

“স্যার, রৌশেনারাকে নিয়ে এসেছি।”

“গুড। ওকে এনে যত্ন করে রাখো।”

“বাকিদের কী করব?”

“ওদের সরিয়ে ফেলো। রৌশেনারা যেন ওদের দেখা না পায়।”

“আপনি কি ওর সঙ্গে দেখা করবেন?”

“অবশ্যই তবে এখন নয়। যথা সময়ে আমি ওর মুখোমুখি হব।”

“ওকে স্যার।”

 

***

আই এস পি এফ অর্থাৎ ইন্ডিয়ান স্পেশাল প্রোটেকশন ফোর্সের সদর দপ্তরে ঢুকে অভিমন্যু সোজা কমান্ডার ইন চিফ সব্যসাচী মজুমদারের প্রাইভেট কেবিনের উদ্দেশে রওনা হল। নির্দেশ সেরকমই আছে। চেম্বারের দরজায় নিজের কার্ড পাঞ্চ করতেই ভেতরে সব্যসাচীর কাছে অভিমন্যুর উপস্থিতির বার্তা পৌঁছে গেল। সব্যসাচী রিমোটের সাহায্যে দরজা খুলে দিলেন। অভিমন্যু তার ওপরওয়ালাকে অভিবাদন জানাল।

“বসো।” সব্যসাচী কিছুটা যেন অন্যমনস্ক।

“তুমি বোধহয় কিছুটা অবাক হয়েছ এমন জরুরী তলবে, কিন্তু কী করব তোমাকে ছাড়া কাউকে এ ব্যাপারে ভরসা করতে পারছি না।” অভিমন্যু নিঃশব্দে শুনছে কারণ এইমুহূর্তে তার বলার মতো কিছুই নেই। এখন তার শোনার সময়। নিশ্চই গুরুতর কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।

সব্যসাচী একটা বোতাম টিপলেন। বিশাল আকারের একটা ভার্চুয়াল স্ক্রীন দৃশ্যমান হল। সেই স্ক্রীন জুড়ে গোলগাল, শ্যামলা, মাথায় ঝুঁটি বাঁধা মিষ্টি একটি বাচ্চা মেয়ে মুক্তো ঝরিয়ে হাসছে।

“বসুধা আইয়ার। ডটার অফ ডক্টর লক্ষণ আইয়ার।”

স্ক্রীন থেকে বসুধা সরে গিয়ে এল চোখে একরাশ দুষ্টুমি ভরা একটা বাচ্চা ছেলের ছবি।

“জিষ্ণু রায়, সান অফ ডক্টর ছন্দম রায়।”

জিষ্ণুর পরে এল একমাথা কোঁকড়ানো চুল আর গলায় মেডেল ঝোলানো এক সদ্য কিশোরীর ছবি। বয়স বছর তেরোর বেশি হবে না বলেই মনে হল অভিমন্যুর।

“রৌশেনারা কুরেশি। ডটার অফ ডক্টর আরহান কুরেশি।”

অভিমন্যু পরের ছবির অপেক্ষা করতে লাগল। স্যারের চোখ দেখে তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলেছে এখানেই শেষ নয়। আরও আছে।

পরের ছবি দেখে নিজের অজান্তেই অভিমন্যুর ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। এত মন ভালো করা ছবি বোধহয় আর হয় না। মাস সাতেকের দুটো বাচ্চা। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। যেমন মিষ্টি দেখতে তেমনি মিষ্টি অঙ্গভঙ্গি করে ফোকলা দাঁতে ভুবন ভোলানো হাসছে।

“ক্রুশাল ঠাকুর আর ইরা ঠাকুর। টুইনস। গ্র্যান্ড চাইল্ড অফ ডক্টর অংশুমান ঠাকুর।”

স্ক্রীন অফ করে অভিমন্যুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন সব্যসাচী। অভিমন্যুর চোখেও জিজ্ঞাসা।

“এরা কি মিসিং কিংবা অন্য কোনো বিপদ ঘটেছে এদের?”

“হঠাৎ তোমার এই কথা মনে হচ্ছে কেন?”

“এদের তিনজনের বাবা আর দুজনের দাদু ইন্ডিয়ান সায়েন্স অ্যণ্ড রিসার্চ ব্যুরোর টপ মোস্ট সায়েন্টিস্ট। আমি যতদূর জানি আই এস আর বিতে এই পাঁচজন বিজ্ঞানী খুব গুরুত্বপূর্ণ সব গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। অংশুমান ঠাকুর তো এখন ওখানকার ডিরেক্টর। ক্রুশাল আর ইরার বাবা-মা দুজনও বিখ্যাত ডাক্তার। তবে আমার মনে হচ্ছে কানেকশনটা বাবা-মা নয়। ওদের কানেকশন দাদু। আপনি হঠাৎ করে আমাকে আর্জেন্ট কল করে ওদের ছবি দেখাচ্ছেন তার মানে অবশ্যই ওদের সঙ্গে বিপদজনক কিছু ঘটেছে।” আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা শেষ করে অভিমন্যু।

মুখের হাসি চওড়া হল সব্যসাচীর। ভরসার দৃষ্টিতে অভিমন্যুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এইজন্যই আমি তোমাকে এত পছন্দ করি। অন্যদের চেয়ে চিন্তা-ভাবনা, খোঁজখবর সব বিষয়ে সবসময় দুধাপ এগিয়ে থাকো তুমি। অন্য কেউ হলে এখন অনেক কিছু বোঝাতে হত। যাইহোক তুমি তো এই বাচ্চাদের অভিভাবকদের পরিচয় খুব ভালো ভাবেই জানো দেখছি আর তোমার ধারণাই ঠিক এরা প্রত্যেকে মিসিং। সম্ভবত কিডন্যাপড। সম্ভবত বলছি কেন? আয়াম ড্যাম শিওর ওরা কিডন্যাপড।” সব্যসাচী থামলে অভিমন্যু জিজ্ঞেস করল, “এরা কোথা থেকে কিডন্যাপড হয়েছে?

“বিভিন্ন জায়গা থেকে। তোমার জন্যই যত দ্রুত সম্ভব সমস্ত তথ্য আমি এই চিপে একত্রিত করে দিয়েছি। তোমাকে আর কিছু বোঝানোর দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। তুমি তোমার কাজটা খুব ভালো করেই জানো।”

অভিমন্যু মাথা নাড়ল। হঠাৎ করে কিছু মনে পড়ে গেছে এমন ভাবে সব্যসাচী বলে উঠলেন, “একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। এই মিশনটা খুবই গোপনীয়। নির্দেশ আছে মিডিয়া, পাবলিক জানার আগেই বাচ্চাগুলোকে উদ্ধার করে অপরাধীকে ধরতে হবে। এত বড় বড় বিজ্ঞানীদের বাচ্চারা কিডন্যাপ হয়েছে এটা এমনিতেই একটা খারাপ ব্যাপার। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা ভীতি সঞ্চার হবে যে তাহলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায় আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হল এনারা সবাই দেশের স্বার্থ জড়িত এমন সব গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। আমাকে বলা না হলেও আমার ধারণা এঁরা সম্প্রতি খুব গোপনীয় কোনো গবেষণা করছেন। শত্রু কোনো দেশ হয়ত কারুর মাধ্যমে বাচ্চাদের হাতিয়ার বানিয়ে...।”

সব্যসাচী কথা শেষ করার আগেই অভিমন্যু বলে উঠল, “আমি বুঝতে পারছি স্যার। ডোন্ট ওরি বাচ্চারা ঠিক উদ্ধার হবে কেউ কিছু জানতে পারবে না।”

সব্যসাচীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অভিমন্যু দ্রুত নিজের চেম্বারে এল। স্পেশাল প্রোটেকশন ফোর্সের মোস্ট স্পেশাল কপদের একজন হওয়ার সুবাদে অভিমন্যুর একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা সম্বলিত কেবিন আছে।

 

***

এখন সরকার থেকে কঠোর নিয়ম করে দিয়েছে যে প্রতিটি বাচ্চাকে সপ্তাহে অন্তত চার ঘণ্টা প্রকৃতির মাঝে কাটানোর সুযোগ দিতে হবে। এইজন্য অনেক পার্কও তৈরি হয়েছে যেখানে বিভিন্ন ধরনের প্রচুর গাছপালা আছে। বাচ্চাদের খেলাধুলোরও ব্যবস্থা আছে।

বসুধা আর জিষ্ণু একই বয়সী। একসঙ্গে এক স্কুলে পড়ে। বাড়িও কাছাকাছি। দুজনেই গিয়েছিল টিউলিপ নেচার পার্কে। ওদের দুজনকেই নিয়ে গিয়েছিলেন ওদের ঠাকুমারা। স্বাভাবিক ভাবেই যা হয়ে থাকে দেখা হতেই বাচ্চা দুজন খেলতে আরম্ভ করেছে আর দুজন বয়স্ক মানুষ একত্রিত হতেই গল্পে মশগুল হয়ে গেছেন। এরকম অবশ্য ওদের কাছে নতুন কিছু না। প্রায়ই ওঁরা একসঙ্গে পার্কে যান। বসুধা আর জিষ্ণুর প্রিয় খেলা হল হাইড অ্যণ্ড সিক অর্থাৎ লুকোচুরি। পার্কে গাছপালা প্রচুর। তার ফাঁকে ফাঁকেই খেলে বেড়ায় ওরা। আজ দুপুরেও ওরা লুকোচুরি খেলছিল।

খানিক পরে যখন ঠাকুমারা খোঁজ করেন তখন দুজনের কেউই পার্কে নেই। দুজনের হাতেই লোকেশন ট্র্যাকার ব্যান্ড লাগানো ছিল। ব্যান্ডগুলো পার্কের গাছপালার মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেছে কিন্তু বাচ্চা নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ওই পার্কের এবং পার্ক সংলগ্ন বেশ কিছুটা অঞ্চলের সমস্ত সার্ভিল্যান্স সিস্টেম হ্যাকড হয়ে গিয়েছিল। ফ্লাইং বার্ডস নামে যে ড্রোনগুলো সারা শহরের আকাশ জুড়ে ঘুরে ঘুরে নজরদারি চালায় তারাও ওই অঞ্চলে ঢুকতেই কর্ম ক্ষমতা হারিয়েছে। দুটো ড্রোন ওই সময় ওই এলাকায় ছিল কিন্তু তাদের থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অন্যান্য নজরদারি ব্যবস্থারও একই হাল। কোনো তথ্য নেই যে বাচ্চা দুটোর কী হয়েছে আর ওই ভর দুপুরে পার্কে অন্য লোকজনও ছিল না। আসলে বসুধা আর জিষ্ণুর ওই দিন রেজাল্ট বেরিয়েছিল। দুজনেই খুব ভালো রেজাল্ট করেছে বলে ঠাকুমাদের ঝুলঝুলি করে পার্কে খেলতে এসেছিল। দুই বন্ধু মিলে স্কুলেই প্ল্যান করেছিল পার্কে আসার জন্য।

 

রৌশেনারা কুরেশি একজন নিঃসঙ্গ কিশোরী। রৌশেনারার যখন সাত বছর বয়স তখন থেকে ওর মা সুরিয়া ডিভোর্স না হলেও আলাদা থাকেন। অভিমন্যুর মতে চিরকালীন অপরিবর্তিত কিছু বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হল শাশুড়ি-বউমার তরজা। রৌশেনারার মায়ের চলে যাওয়ার পেছনেও আছে এই কারণ।

ডক্টর আরহান কুরেশি বিজ্ঞানী হিসেবে যতটা সফল। সাংসারিক দিক থেকে ততটাই ব্যর্থ মানুষ। মায়ের অঙ্গুলী হেলনে চলেন আর নিজের কাজের জগতে ডুবে থাকেন। মায়ের পরামর্শে মেয়েকে তার মায়ের কাছে যেতে দেননি, আবার মা-মেয়েকেও বেশি দেখা করতে দেন না। অত্যন্ত অভিমানী প্রকৃতির সুরিয়া আরহানের প্রতি তীব্র অভিমান বশত তার কোনো কাজের প্রতিবাদ করেন নি কিন্তু তার ফল হয়েছে মারাত্মক।

রৌশেনারা একাকীত্বে ভুগতে ভুগতে অনলাইন গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে গেছে। পড়াশোনায় সে খুবই ভালো কিন্তু ইদানীং পড়াশোনাতেও ঘাটতি দেখা যাচ্ছিল। মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ সীমিত। বাবা কাজে ব্যস্ত আর ঠাকুমা নাতনিকে বাড়িতে রাখতে পেরেই নিজের দায়িত্ব সেরেছেন।

রৌশেনারার একমাত্র সঙ্গী তার কম্পিউটার। তার কম্পিউটার থেকেই উদ্ধার করা গেছে এক সূত্র। ইদানীং সে ‘হাউ ডেয়ার ইউ?’ নামে একটি গেম খেলছিল যেখানে তাকে বিভিন্ন রকম টাস্ক দেওয়া হচ্ছিল যেমন রাত্রিবেলা একলা ছাদে একঘণ্টা সময় কাটানো এই ধরনের। তার লাস্ট টাস্ক ছিল একলা শহরের প্রান্তে নদীর ব্রিজের কাছে নির্দিষ্ট জায়গায় আসতে হবে। তারপর থেকেই সে নিখোঁজ। কম্পিউটার ঘেঁটে আর রৌশেনারার বেস্ট ফ্রেন্ডের দেওয়া তথ্য থেকে অভিমন্যুর বুঝতে বাকি থাকে না যে এই গেমটা একটা ফাঁদ রৌশেনারাকে কিডন্যাপ করার জন্য কারণ এই নামে রেজিস্টার্ড কোনো অনলাইন গেমের অস্তিত্ব নেই। বসুধাদের কেসের মত এ ক্ষেত্রেও কিছু সময়ের জন্য ওই এলাকার সার্ভিল্যান্স সিস্টেম হ্যাকড হয়ে গিয়েছিল।

 

ক্রুশাল আর ইরার কেসটা তো একদমই সহজ যেহেতু দুজনেই অবোধ শিশু। বাড়িতে কেউ ছিল না শুধু ওদের গভর্নেস আর এইচ নাইন সিরিজের হোম হেল্পার রোবট প্যাট। ন্যানি ওদের প্র্যামে চড়িয়ে বাগানে ঘুরছিল। তাকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। প্যাট বাড়ির কাজ করছিল। হঠাৎ করেই তার সিস্টেম ডাউন হয়ে যায় আর যথারীতি ওই অঞ্চলের সার্ভিল্যান্স সিস্টেম হ্যাকড হয়ে যায় কিছু সময়ের জন্য।

 

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অভিমন্যু অনেকগুলো তথ্য সংগ্রহ করেছে। বাচ্চাদের বাড়ির লোকজনের সঙ্গেও কথা বলেছে তবে সব কাজই করতে হচ্ছে খুব গোপনে। অভিমন্যু নিশ্চিত এইকাজ এমন কারুর যে এই পাঁচ বিজ্ঞানীর কমন এনিমি কারণ পাঁচটা বাচ্চার মধ্যে একটাই মিল এদের খুব নিকট আত্মীয় ভারতের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানী। এই অদৃশ্য শত্রুকে আগে খুঁজে বের করতে হবে এবং খুব তাড়াতাড়ি। অভিমন্যু চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবতে লাগল।

 

***

রৌশেনারা কাঁচের জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। এই জায়গাটা কোথায় সে জানে না। বেশ নির্জন জায়গা। অন লাইন গেম ‘হাউ ডেয়ার ইউ?’ এর শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে সে। ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী নিজের লোকেশন ট্র্যাকার ব্যান্ড আর ফোন বাড়িতেই রেখে সে নদীর ব্রীজের কাছে এসে পৌঁছেছিল।

এখানে একটা গাড়ি অপেক্ষা করছিল তার জন্য। ড্রাইভারের কথা অনুযায়ী সে গাড়িতে উঠে বসে। একটু দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে ছিল সে, কিন্তু যখনই মনে পড়ল কেউ তাকে ভালোবাসে না, তার কথা ভাবে না তখনই আর কিছু না ভেবে গাড়িতে উঠে বসে সে। বাবা সব সময় কাজে ব্যস্ত। মেয়ের জন্য কোনো সময় নেই তাঁর। ঠাকুমা মানুষটাকে সে একদমই পছন্দ করে না। তাঁরও নাতনির খেয়াল রাখার চেয়ে অন্যান্য ফালতু কাজে উৎসাহ বেশি আর তার মা তিনিও তো বাবার ওপর অভিমান করে মেয়ের কাছে আসেন না। নিজেদের ইগোটাই ওনাদের কাছে বড়। মেয়ের কোনো দাম নেই তাই সেও ঠিক করেছে নিজের ইচ্ছে মত চলবে।

“হাই, সুইট লেডি।” দরজা দিয়ে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন।

“তোমার এখানে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?”

“নাহ।” মিষ্টি হেসে উত্তর দিল রৌশেনারা।

“আচ্ছা আমি ছাড়া আর কোনো পার্টিসিপেন্ট ফাইনাল স্টেপে পৌঁছয়নি?” রৌশেনারা জিগ্যেস করে।

“পৌঁছেছে তো। আরও চারজন আছে।” ঠোঁটের কোণে হাসি এনে বললেন ভদ্রলোক।

“তারা কোথায়?”

“আছে। তাদের টাস্ক দেওয়া হয়েছে। এবার তোমার টাস্কটা বুঝিয়ে দিই। এটাই কিন্তু ফাইনাল টাস্ক। ঠিক মত শেষ করতে পারলে তুমিই উইনার।”

“টাস্কটা কি?” রৌশেনারা আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলে।

 

***

“বলো। অভিমন্যু।” সব্যসাচী সুইচ টিপতেই দেওয়ালের গা থেকে গরম ধোঁয়া ওঠা দার্জিলিং টি শুদ্ধু দুটো কাপ নিয়ে একটা ট্রে বেরিয়ে এল।

“চা খেতে খেতে বলো।”

অভিমন্যু কাপটা নিলেও চুমুক দিল না। সে যথেষ্ট উত্তেজিত অবস্থায় আছে, “স্যার, আমার ধারণা এসবের পেছনে আছে ইন্দ্রজিৎ কুমার।”

সব্যসাচী এক দৃষ্টিতে অভিমন্যুর দিকে তাকিয়ে আছেন। অভিমন্যুর বক্তব্য তিনি শুনতে চান।

একটু থেমে অভিমন্যু আবার শুরু করল, “স্যার, ইন্দ্রজিৎ কুমার একসময় ইন্ডিয়ান সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্চ ব্যুরোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী ছিলেন। হি ইজ আ জিনিয়াস কিন্তু দেশের জন্য কাজ করতে গেলে যতটা নীতিজ্ঞান বা আদর্শ থাকা উচিত সেটা ওনার ছিল না।

দশ বছর আগে একটা ব্যাপার ধরা পড়ে যে দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা গবেষণার তথ্য উনি মোটা টাকার বিনিময়ে কোনো একটি বিদেশী কোম্পানিকে বিক্রি করছেন। সম্ভবত আগেও এই ধরনের অপকর্ম উনি করেছেন। আপনাকে আগেই বলেছি স্যার যে উনি একজন জিনিয়াস ছিলেন। এমনভাবে উনি কাজ করতেন যে কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারত না কিন্তু দশ বছর আগে উনি ধরা পড়ে যান। ওনার এই কর্মকাণ্ড প্রথমে যাঁদের নজরে আসে তাঁরা হলেন ডক্টর ছন্দম রায়, ডক্টর লক্ষণ আইয়ার আর ডক্টর আরহান কুরেশি। এঁরা তখন সদ্য কিছু দিন যোগ দিয়েছেন আই এস আর বিতে।

অল্পদিনের মধ্যেই কোনোভাবে এঁরা ইন্দ্রজিতের প্রতি সন্দিহান হয়ে ওঠেন। এঁরা তিনজনেই খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাই একসঙ্গে আলাপ আলোচনা করে ওঁরা স্থির করেন তৎকালীন ডিরেক্টার মনীশ পটেলকে জানানোর আগে সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ডক্টর অংশুমান ঠাকুরকে জানাবেন। সেই মতো কাজ করেন ওঁরা। ডক্টর ঠাকুর ওদের সন্দেহের কথা শুনে নিজে নজরদারি আরম্ভ করেন এবং নিঃসন্দেহ হন। স্বাভাবিক ভাবেই কথাটা উনি ডিরেক্টারকে জানান কিন্তু মুশকিল হয় যে ইন্দ্রজিৎ কাজটা এমন মসৃণভাবে করেছেন যে সব জেনেও ওনার বিরুদ্ধে কোনোও শক্ত প্রমাণ জোগাড় করা যায়নি কিন্তু ওনাকে আর আই এস আর বিতেও রাখা হয়নি।

তৎকালীন ডিরেক্টর মনীশ পটেল বুদ্ধিমান মানুষ তো বটেই সেইসঙ্গে ভীষণ চালাকও ছিলেন। উনি খুব ধূর্ততার সঙ্গে ইন্দ্রজিৎকে বহিষ্কার করেন এবং সে যাতে অন্য কোনো সরকারী প্রতিষ্ঠানে স্থান না পায় তারও ব্যবস্থা করেন। আই এস আর বি থেকে বহিষ্কৃত হবার পর থেকে ইন্দ্রজিতের আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। সে বেমালুম অদৃশ্য হয়ে গেছে। বেঁচে আছে না মারা গেছে সে খবরও কেউ জানে না।

ইন্দ্রজিৎ ব্যাচেলর ছিলেন। পরিবারেও তেমন ঘনিষ্ঠ কেউ নেই ফলে ইন্দ্রজিৎকে ট্রেস করা খুব মুশকিল। আমি এই একজন মাত্র লোককেই পয়েন্ট আউট করতে পারছি যার এনাদের সকলের ওপর রাগ থাকা স্বাভাবিক। মনীশ পটেলের পর ইন্দ্রজিতের ডিরেক্টর হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি ছিল তার বদলে সে বহিষ্কৃত হল আর ডক্টর ঠাকুর ডিরেক্টর হয়ে গেলেন।” একটানা কথা বলে একটু থামলো অভিমন্যু। প্রায় জুড়িয়ে যাওয়া চায়ে এক চুমুক দিল।

“তোমার আন্দাজ যদি ঠিক হয় তাহলে মনীশ পটেলও তো ইন্দ্রজিতের শত্রু। ওনার কোনো...” সব্যসাচী কথা শেষ করার আগেই অভিমন্যু বলে উঠল, “আমি খোঁজ নিয়েছি স্যার। মনীশ পটেল গত সপ্তাহে মারা গেছেন। গত এক বছর ধরে খুবই অসুস্থ ছিলেন। মানুষটাই যখন নেই তখন আর কার ওপর প্রতিশোধ নেবে। আর একটা ব্যাপার স্যার যেভাবে ইন্টালিজেন্টলি সার্ভিল্যান্স সিস্টেম হ্যাক করা হয়েছে, কিডন্যাপিং এর ব্যাপারগুলো ঘটানো হয়েছে তার থেকে এটা পরিষ্কার যে খুব উন্নত মস্তিষ্ক আছে এর পেছনে। শুধু তাই নয় স্যার আমি আর আমাদের টেক সেলের চীফ অফিসার অনীক মিলে ডার্ক ওয়েব থেকে ওই হ্যাকারকে আইডেন্টিফাই করতে পেরেছি । মেঘনাদ 02 হল তার পরিচয়।”

“মেঘনাদ!”

“হ্যাঁ স্যার। মেঘের আড়াল থেকে লড়াই করত মেঘনাদ ওরফে ইন্দ্রজিৎ। আপনার মহাকাব্য পড়া আছে স্যার?”

“হুম। রামায়ণের রেফারেন্স দিচ্ছ তুমি বুঝতে পারছি। রাবণের ছেলে ছিল ইন্দ্রজিৎ ওরফে মেঘনাদ।”

“আরেকটা কথা স্যার ওই যে 02। ইন্দ্রজিৎ কুমারের জন্ম 2002 সালে।”

“আই থিংক ইউ আর রাইট কিন্তু একটা জিনিস এখনও পরিষ্কার নয় যে লোকটা চাইছে কি? আই ডিটা দেখে মনে হচ্ছে ও চাইছে সবাই বুঝুক যে এই কাজের পেছনের মাথাটা ওর। বাচ্চা গুলোকে কিডন্যাপ করে এই চার বিজ্ঞানীকে শাস্তি দিতে চাইছে বুঝতে পারছি কিন্তু বাচ্চা গুলোকে নিয়ে গেল কোথায়?”

“স্যার, আমি ওনার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তাতে মনে হচ্ছে বড় কোনো ভয়ঙ্কর প্ল্যান আছে ওনার। সেটা ঘটাবার পর আত্মপ্রকাশ করবেন।”

“কিন্তু সেই সুযোগ ওকে দেওয়া যাবে না তাছাড়া ইন্দ্রজিৎই যে আছে এসবের পেছনে তারও কোনো গ্যারান্টি নেই। পুরোটাই তোমার আন্দাজ।”

অভিমন্যু চুপ করে থাকল। স্যার যাই বলুন সে প্রায় একশ শতাংশ নিশ্চিত যে এসবের পেছনে ইন্দ্রজিৎই আছে।

 

***

ডোম আকৃতির ঘরটায় প্রবেশ করল রৌশেনারা। গেম জেতার থেকে আর মাত্র একধাপ দূরে দাঁড়িয়ে আছে সে। ঘরটায় ছোট্ট একটা ফাইবারের খাট আর একটা ছোট টেবিল। টেবিলের ওপর একটা ঘড়ি রাখা আছে। টেবিলের ওপর ঘড়ি ছাড়াও একটা কালো রঙের বক্সের মত যন্ত্র রাখা আছে। যন্ত্রটায় দুটো সুইচ একটা লাল আরেকটা সাদা। তাকে প্রথমে লাল সুইচটা টিপতে হবে তারপর খাটের ওপর ট্রেতে রাখা একটা সিরিঞ্জ নিজের ডান হাতে পুশ করতে হবে।

এত সোজা টাস্ক শুনে সে একটু অবাকই হয়েছিল কারণ এখন তো অটোমেটিক সিরিঞ্জ ব্যবহার হয়। তাতে কোনো ব্যথাও অনুভব হয় না আর পুশ করাও কোনো ব্যাপার না। তখন তাকে জানানো হয় যে ডোমের কাছাকাছি নির্দিষ্ট একটা পয়েন্ট থেকে যাত্রা শুরু করে মাত্র এক মিনিটের মধ্যে তাকে সব কাজ শেষ করতে হবে। এটা যেহেতু ছোটদের গেম তাই খুব শক্ত কাজ দেওয়া হবে না কিন্তু টাইমটা ফ্যাক্টর হবে এখানে।

রৌশেনারা খুব দ্রুত কালো বক্সটার লাল সুইচটা টিপে দিল তারপর ছুটতে ছুটতে খাটের কাছে গিয়ে নিজের শরীরে ইনজেকশন পুশ করে দিল। এবার সে নিশ্চিন্ত। এক মিনিট হতে এখনও দশ সেকেন্ড বাকি। সে জিতে গেছে কিন্তু তার মাথাটা এরকম করছে কেন? চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে কেন? খাটের ওপর এলিয়ে পড়ল রৌশেনারার শরীরটা সে জানতেও পারল না যে এই ডোমের অন্য কুঠুরিতে তারই মতো আরও চারজন অবোধ শিশু ঘুমিয়ে আছে।

 

***

অভিমন্যু দ্রুত পদক্ষেপে সব্যসাচীর কেবিনে প্রবেশ করল। স্যার জরুরী তলব করেছেন তাকে।

ঢুকেই দেখল তার আগে থেকেই আরও চারজন সেখানে উপস্থিত। এঁদের সঙ্গে চাক্ষুষ আলাপ না থাকলেও এঁদের প্রত্যেককেই সে চেনে। হলোগ্রাফিক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এঁদের সঙ্গে কথাও বলেছে সে।

“অভিমন্যু, আশা করি এঁদেরকে তুমি চিনতে পারছ।”

অভিমন্যু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

“আর আপনারাও তো আমার এই অফিসারটিকে চেনেন। ওর সঙ্গে কথা বলেছেন তাই আর আলাপ পরিচয় পর্বে না গিয়ে মূল বিষয়ে চলে আসি।” অভিমন্যুর দিকে ঘুরলেন সব্যসাচী।

“অভিমন্যু, তোমার ধারণাই ঠিক। এসবের পেছনে আছে ইন্দ্রজিৎ কুমার। আজ ডক্টর ঠাকুরের কাছে একটি ভিডিও বার্তা এসেছে। আগে ভিডিওটা তুমি দেখ।”

ইন্দ্রজিৎ ফর্সা, পাতলা চেহারার একজন মানুষ। দেখলে মনে হবে এনাকে স্কুল শিক্ষকের ভূমিকায় মানাবে ভালো কিন্তু চোখ দুটোর দিকে তাকালেই যে কেউ বুঝতে পারবে যে চেহারা দেখে এনাকে বিচার করা মস্ত ভুল। ঈষৎ বাদামী আভার অত্যুৎজ্বল চোখ দুটোয় বুদ্ধি আর শয়তানী যেন পালা করে চমক দিচ্ছে।

“ডক্টর অংশুমান ঠাকুর কেমন আছেন? আপনার লেজ তিনটে কেমন আছে? আমার না আপনাদের মুখগুলো দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। কতদিন দেখিনি। আপনার প্রিয় বস তো মহাকাশে যাত্রা করলেন কিছুদিন আগে। আমার খুব আফসোস হচ্ছে জানেন তো একটু আগে যদি তৈরি হতে পারতাম তাহলে ওনাকেও আমার কাজকর্মের ঝলক দেখাতে পারতাম। যাইহোক আপনারা তো আছেন। লেটস সি ডক্টর ঠাকুর। হিয়ার ইজ আ সারপ্রাইজ ফর ইউ।”

এরপর স্ক্রীনে যা ফুটে উঠল দেখে ভ্রূ কুঁচকে গেল অভিমন্যুর। প্রথমে দেখা গেল একটা ডোম আকৃতির ঘর আর তারপরেই স্ক্রীনে ফুটে উঠল রৌশেনারা, বসুধা, জিষ্ণু, ক্রুশাল আর ইরার অচৈতন্য দেহ। ব্যাক গ্রাউন্ডে শোনা যাচ্ছে ইন্দ্রজিতের কন্ঠস্বর। তার কথাগুলো একমনে শুনছিল অভিমন্যু।

“আশা করি মনে আছে ডক্টর ঠাকুর। আপনার আর আমার ড্রীম প্রজেক্ট, ট্রিগারিং লেজার ডিভাইস যা আমাদের স্বপ্নেই রয়ে গিয়েছিল। অবশ্য আমি আমার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছি। একদম আমরা যেরকম ভেবে ছিলাম অবিকল সেইরকম। এক বিদেশী রাষ্ট্রর সঙ্গে ডিলও হয়ে গেছে। ওদেরকে ডিজাইনটা বিক্রি করার আগে ভাবলাম আপনাদের ওপর একটা স্যাম্পল ট্রায়াল দিই। আমার পুরো প্ল্যানটা আপনাদের পরিষ্কার করে বলি যাতে আপনাদের কোনোওও অসুবিধা না হয়।

রৌশেনারা, বসুধা আর জিষ্ণুর শরীরে ইনজেক্ট করার হয়েছে নার্কটর্পিড 10। পুওর ডক্টর কুরেশি, বউ পালিয়েছে আর মেয়ে আমার ফাঁদে পড়ে নিজেই নিজের শরীরে ড্রাগ ইনজেক্ট করেছে আর তার আগে নিজের হাতে করে ট্রিগারিং ডিভাইসটা অন করেছে। নার্কটর্পিডের এফেক্ট কি আপনি অন্তত খুব ভালো করেই জানেন ডক্টর ঠাকুর। উইথদিন সেভেনটি টু আওয়ারর্স আ্যন্টিডোট না পড়লে...। জাস্ট ফিনিশ। চিন্তা নেই, আপনার একদম কচি কচি নাতি-নাতনির শরীরে অত স্ট্রং ড্রাগস দিইনি। সাধারণ ইন্ডলেন্ট টাইপ ওষুধ দিয়েছি। চব্বিশ ঘণ্টা ঘুমোবে তারপর জেগে ওঠে ওই খিদেয় একটু কান্নাকাটি করবে। এই আর কি। শেষে কাঁদতে কাঁদতে...।”

বাচ্চাদের ছবি সরে গিয়ে আবার ফুটে উঠল ইন্দ্রজিৎএর মুখ। চোখ দুটো রাগে, ঘৃণায় দপদপ করছে, “আই এস আর বির চার মহান বিজ্ঞানী, একদিন আমার জীবনটা আপনারা নরক বানিয়ে দিয়েছিলেন। আপনাদের জন্য আজ আমাকে লুকিয়ে নিজের রিসার্চের কাজ করতে হচ্ছে। কোথাও আমার জায়গা নেই অথচ আয়াম বেটার দ‍্যান অল অফ ইউ। এটা খুব ভালো করে জানেন আপনারা। আজ দ‍্য জিনিয়াস ইন্দ্রজিৎ কুমার আপনাদের ওপেন চ্যালেঞ্জ দিচ্ছে বাঁচান আপনাদের বাচ্চাদের। ওরা কোথায় আছে সব তথ্য দিয়ে দিচ্ছি। যান দেখুন আমার নতুন আবিষ্কার। আর কথা দিচ্ছি আপনাদের হেরে যাওয়ার খবরটা আমি দায়িত্ব সহকারে সারা বিশ্ব জুড়ে টেলিকাস্ট করব। হা হা হা।” স্ক্রীনটা কালো হয়ে গেল।

 

রৌশেনারা ‘হাউ ডেয়ার ইউ?’ গেমের টাস্ক হিসেবে নিজেই নিজের শরীরে সিরিঞ্জ পুশ করেছে আর বাকি বাচ্চাদের ইন্দ্রজিৎ বা ওনার কোনো সঙ্গী অজ্ঞান করেছে এটা বুঝতে পারছি কিন্তু ওর বাকি কথাগুলো খুব একটা পরিষ্কার নয় আমাদের কাছে। কিছুটা বুঝলাম আবার পুরোটা বুঝলাম না এরকম ব্যাপার। আমাদের একটু ডিটেলসে বলুন। ওই নতুন লেজার রের ব্যাপারটা...।” সব্যসাচী চারজন বিজ্ঞানীর উদ্দেশ্যে বললেন।

“আমি বলছি।” বিধ্বস্ত অংশুমান ঠাকুর বললেন।

সব্যসাচী আর অভিমন্যু উৎকর্ন হল।

অংশুমান শুরু করলেন, “আজ থেকে প্রায় বছর বারো আগে যখন ইন্দ্রজিৎ আই এস আর বিতেই ছিল, আমি আর ইন্দ্রজিৎ একটা এমনই ডিভাইস তৈরীর পরিকল্পনা করেছিলাম। ব্যাপারটা আমাদের ব্যক্তিগত পরিকল্পনার স্তরেই ছিল। আপনারা দেখলেন তো ওই ডোম আকৃতির ঘরটার বাইরের দেওয়ালে ওভাল শেপের সিলভার কালারে বেশ কয়েকটি ডিভাইস লাগানো আছে। এই ডিভাইসগুলোর ট্রিগারিং রিমোট আছে ঘরের মধ্যে।

ওর কথা থেকে যেটা বুঝলাম সেটা হল ও রৌশেনারাকে কোনোভাবে ইনফ্লুয়েন্স করেছে যার ফলে রৌশেনারা ওই ঘরের মধ্যে ঢুকে ট্রিগারিং রিমোটটা অন করে দিয়েছে ফলে এখন যেটা ঘটছে সেটা হল ওই সিলভার কালারের ডিভাইসগুলো থেকে প্রাণঘাতী লেজার রশ্মি বেরিয়ে পুরো ডোমটাকে চক্রাকারে ঘিরে রেখেছে।

সেইসময় আমি আর ইন্দ্রজিৎ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিল্ডিংগুলোকে এইভাবে প্রোটেকশন দেওয়া যায় নাকি সে বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করেছিলাম। আমাদের ভাবনার উদেশ্য ছিল কোনোরকম বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে বিল্ডিংগুলোকে রক্ষা করা।

দুঃখের বিষয় আমি আর এ নিয়ে পরবর্তী স্তরে এগোইনি। অন্য গবেষণায় ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু যা বুঝছি ইন্দ্রজিৎ আই আর এস বি থেকে বিতাড়িত হবার পর এই নিয়ে গোপনে গবেষণা চালিয়ে গেছে এবং সফলও হয়েছে। ও মানুষ হিসেবে অসৎ হলেও ওর প্রতিভাকে আমি আজও সম্মান করি।”

“আপনার কথা মতো ওই ঘরটার চারিদিক ঘিরে রয়েছে লেজার রশ্মির বলয়।”

“হুম, প্রাণঘাতী লেজার রশ্মি আর এই রশ্মি ভেদ করে কারুর ভেতরে যাওয়া সম্ভব নয় আর বাইরে থেকেও ওই ডিভাইসগুলোকে কোনোমতে কন্ট্রোল করা সম্ভব নয়। যতক্ষণ না ঘরের ভেতর থেকে কেউ ওই ট্রিগারিং রিমোটটা অফ করছে ততক্ষণ বাইরের কেউ ভেতরে ঢুকতে গেলে বা ভেতরের কেউ বাইরে আসতে গেলে তার মৃত্যু অনিবার্য।” অংশুমান থামলেন।

“আমরা যদি ইন্দ্রজিৎ কুমারকে ট্রেস করতে পারি তাহলে...।”

সব্যসাচী কথা শেষ করতে পারলেন না তার আগেই অংশুমান বাধা দিয়ে বললেন, “কোনো লাভ নেই। যদি ইন্দ্রজিৎ সত্যি কথা বলে থাকে যে আমরা যেরকম পরিকল্পনা করেছিলাম ও অবিকল সেই জিনিস আবিষ্কার করেছে তাহলে ওরও সাধ্য নেই। ডোমের ভেতরে লাগানো ক্যামেরাগুলো ও কন্ট্রোল করছে ঠিকই কিন্তু ট্রিগারিং রিমোটটা বাইরে থেকে কোনোভাবেই কন্ট্রোল করা সম্ভব নয়।” অসহায় কণ্ঠে বললেন অংশুমান।

হঠাৎ একটা ফোঁপানির আওয়াজে চমকে উঠলেন সকলে। দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠেছেন আরহান কুরেশি, “আমার ভুলেই আজ আমার মেয়েটা...।” বাকিদের চোখেও জলবিন্দু। অভিমন্যুর মনে হল এইমুহূর্তে এঁরা কেউ আর নামজাদা বিজ্ঞানী নন শুধুই অসহায় পিতা কিংবা দাদু। ওঁদের সব হারানো মুখগুলো দেখে অভিমন্যুর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। কোনো কি উপায় নেই বাচ্চা গুলোকে বাঁচানোর?

 

***

একরাশ দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে বসে আসছেন সব্যসাচী। তাঁর মনে ক্ষীণ একটা আশা ছিল যে হয়ত ভয় দেখানোর জন্য ইন্দ্রজিৎ মিথ্যে কথা বলছে তাই একটা সুপার এম সিরিজের রোবটকে ওই ডোমের মধ্যে পাঠানোর চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ডোমের বাইরে একটা নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের মধ্যে প্রবেশ করতেই অদৃশ্য লেজারের আক্রমণে রোবটটা সম্পূর্ণ গলে দুমড়ে মুচড়ে যায়। একটা সিগন্যালের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকালেন সব্যসাচী। অভিমন্যু কার্ড পাঞ্চ করেছে। রিমোট হাতে নিলেন সব্যসাচী।

“এসো অভিমন্যু।” নিরুৎসাহ কণ্ঠে বললেন সব্যসাচী।

“স্যার, যে কম্পিউটার থেকে সার্ভিল্যান্স সিস্টেম হ্যাক করা হয়েছিল তার লোকেশন ট্র্যাক করে ফেলেছিল অনিক। একটা একশ তলা এপার্টমেন্টের একদম ওপরের ফ্লোরে থাকত বিমান নামের ছেলেটি। ওখানে অপারেশন চালিয়ে ইন্দ্রজিতের সহকারী ওই বিমানকে গ্রেপ্তার করে এনেছি স্যার। ছেলেটি কম্পিউটার জিনিয়াস কিন্তু ওই ইন্দ্রজিতের মতো অর্থলোভী। ওকে একটু চাপ দিতেই কিডন্যাপিং-এ কারা সাহায্য করেছিল তাদের নাম বলে দিয়েছে। ইন্দ্রজিতের হয়ে বিমানই ওদের হায়ার করেছিল। সুপার কপ অতুল টিম নিয়ে বেরিয়ে গেছে তাদের ধরতে কিন্তু মুশকিল হল স্যার বিমান কিছুতেই ইন্দ্রজিতের সন্ধান দিচ্ছে না। আমি নিশ্চিত ইন্দ্রজিতের গোপন আস্তানার খোঁজ ওর কাছ থেকে আমি বের করবই।” উৎসাহ নিয়ে বলল অভিমন্যু।

“গুড।” সব্যসাচী বিশেষ উৎসাহিত হলেন না। এই কেসের ব্যাপারে তিনি অভিমন্যুকে পূর্ণ ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন। ইন্দ্রজিতের সাহায্যকারীকে গ্রেফতার করে নিঃসন্দেহে খুব ভালো কাজ করেছে কিন্তু সব্যসাচীর মাথায় ঘুরছে বাচ্চাগুলোর কথা। পাঁচটা বাচ্চা এভাবে বেঘোরে প্রাণ দেবে?

“স্যার।” অভিমন্যুর ডাকে সম্বিৎ ফিরল সব্যসাচীর।

“চব্বিশ ঘণ্টা হতে আর কয়েক ঘণ্টা বাকি অভিমন্যু। ইন্দ্রজিতের কথা মতো এরপর ক্রুশাল আর ইরা জেগে উঠবে। দুটো অবোধ শিশু ক্ষুধার তাড়নায় কাঁদতে কাঁদতে শেষ পর্যন্ত হয়ত...। ওই লেজারের চক্রব্যূহ‍ে প্রবেশ করার কি কোনো উপায় নেই?”

চমকে উঠল অভিমন্যু।

“চক্রব্যূহ, চক্রব্যূহ।” নিজের মনেই বিড়বিড় করল দুবার।

চক্রব্যূহ কথাটা তার মাথায় আঘাত করছে। কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল তারপর হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠল।

“স্যার, আপনার সুপার সনিক কারটা কিছু সময়ের জন্য আমাকে ব্যবহার করতে দেবেন প্লিজ। খুব দ্রুত কাজ করতে হবে আমাকে।” অভিমন্যু রীতিমতো উত্তেজিত।

“ঠিক আছে নাও কিন্তু কী ব্যাপার?”

“আমার ওপর ভরসা করেন স্যার?”

“তোমাকে আমি কতটা ভরসা করি সেটা নতুন করে বলার কিছু নেই। আমার মনে হচ্ছে তুমি কোনো প্ল্যান করছ?”

“কোনো রাস্তা যখন নেই তখন ভাগ্যের ওপর আর ভগবানের ওপর ভরসা করছি। একটা জুয়া খেলতে যাচ্ছি স্যার। তবে আপনাকে আমার ওপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে হবে। কোনো প্রশ্ন করা চলবে না আর আমি এই অপারেশন চক্রব্যূহের ব্যাপারে কোনো স্টেপ নিতে যাচ্ছি এটা যেন তৃতীয় কোনো ব্যক্তি না জানতে পারে।” সম্মতির অপেক্ষায় অভিমন্যু।

“ওকে, ডান।”

 

***

সুপারসনিক কারটা কয়েকটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে নেমে এল অভিমন্যু। এক সময় মানুষ প্রকৃতির ওপর নির্মম অত্যাচার শুরু করেছিল কিন্তু প্রকৃতি যখন প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করে তখন মানুষের ধ্যানভঙ্গ হয়। নিজেদের ভুল সংশোধন করে তারা। তাই আজও এই গভীর অরণ্যগুলোর অস্তিত্ব বজায় আছে।

দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে সে কিন্তু লতাপাতায় পা জড়িয়ে যাচ্ছে অনেক সময়। অবশ্য প্রয়োজনীয় সমস্ত যন্ত্রপাতি আর অস্ত্র সে সঙ্গে এনেছে। এই গভীর জঙ্গলে হিংস্র পশুদের বাস। লম্বা দণ্ডের মত ইলেকট্রিক কাটারটা দিয়ে পথ পরিষ্কার করতে করতে এগিয়ে চলেছে অভিমন্যু। মাঝে মাঝেই হাতের ব্যান্ডটায় চোখ রাখছে। খুব উন্নত মানের কম্পাস লাগানো আছে ওতে। অভিমন্যুর গন্তব্য সোজা উত্তরে।

অনেক পুরোনো প্রায় জং লাগা স্মৃতির ওপর নির্ভর করে প্রায় মিনিট পঞ্চাশ বুনো লতা আর ঝোপঝাড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করার পর মুখে হাসি ফুটল অভিমন্যুর। সঠিক গন্তব্যে পৌঁছেছে সে। অনুচ্চ ছোট ছোট তিনটি শৈলরাজি হাত ধরাধরি করে অবস্থান করছে এই জঙ্গলের গভীরে। এই জঙ্গলের ত্রিমাত্রিক ম্যাপে এই পাহাড় তিনটের অস্তিত্ব থাকলেও এর গভীরে যে রহস্য লুকিয়ে আছে তার সন্ধান কেউ জানে না।

এই অরণ্যভূমি ইন্ডিপেন্ডেন্ট রিজার্ভ ফরেস্টের তালিকাভুক্ত অর্থাৎ এখানে যথেচ্ছ ভাবে কেউ যেমন প্রবেশ করবে না তেমনি সাধারণ রিজার্ভ ফরেস্টের মত সরকারী নজরদারি বা ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজনেরও যাতায়াত থাকবে না। এই অরণ্য সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছে মতো থাকবে।

মানুষ যখন প্রকৃতির মূল্য বুঝতে পারে তখন পৃথিবীর সব দেশেই বেশ কিছু প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজের মতো থাকতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মানুষ বুঝতে পেরেছিল নাহলে অচিরেই এই মানব সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। এখানে আইনত প্রবেশ নিষিদ্ধ। কম বয়সে নিষিদ্ধ বস্তুর ওপর আকর্ষণটা একটু বেশিই থাকে। কলেজে পড়ার সময় স্বভাব দুরন্ত এবং দুঃসাহসী অভিমন্যু একবার একলা লুকিয়ে এই জঙ্গলের গভীরে ঢুকেছিল আর তখনই এক চরম বিস্ময়ের মুখোমুখি হয়ে ছিল সে।

 

***

ইন্দ্রজিৎ আজ পরম তৃপ্ত। যে চারটে শয়তানের জন্য তাঁকে গর্তে মুখ লুকিয়ে বেড়াতে হচ্ছে আজ তারা পরাজিত, বিধ্বস্ত। ইন্দ্রজিৎ চাইলে সেইসময় বিদেশে চলে যেতে পারতেন কিন্তু ইচ্ছে করেই যাননি। তিনি চেয়েছিলেন ওদের বুকের ওপর বসে ওদের শেষ করবেন। তাঁর মত জিনিয়াসের ফান্ডিংয়ের অভাব কখনও হয় না তাই তো গোপনে এই বিশাল ল্যাব বানিয়ে নিজের লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন।

আজ ওদের প্রত্যেকের হৃদপিণ্ডটাই তাঁর হাতের মুঠোয়। অবশ্য তাঁর মুঠো তিনি খুলে দিয়েছেন। ওরা এখন চক্রব্যূহে বন্দি। মহাভারতের চক্রব্যূহে অভিমন্যু নামে একজন নাকি প্রবেশ করতে জানত, বেরোনোর পথ জানত না। ইন্দ্রজিতের চক্রব্যূহেও অনেকটা একই রকম ঘটনা ঘটেছে। রৌশেনারা নিজের হাতে চক্রব্যূহ চালু করেছে কিন্তু বেরোনোর পথ জানে না। অবশ্য বেরোনোর অবস্থাও ইন্দ্রজিৎ রাখেননি। ইন্দ্রজিতের চক্রব্যূহ দুর্ভেদ্য। কারুর সাধ্য নেই এই চক্রব্যূহ ভেদ করার।

 

***

প্রায় অন্ধকার গুহা মুখে দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল অভিমন্যু। সে জানে না তার এখানে আসার উদেশ্য সফল হবে না বিফল। চোখের সামনে বাচ্চাগুলোর ছবি ফুটে উঠল। গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ল অভিমন্যু। কিছুটা এগিয়ে গেল সে। টর্চের আলোয় সামনের ছোট্ট চাতালটা আলোকিত হয়ে উঠেছে। টাটকা বুনো ফুলগুলো দেখে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল অভিমন্যুর। এর মানে সে এখানেই আছে এখনও।

“আপনি কোথায়? কোথায় আপনি?” জোর গলায় ডাকলো অভিমন্যু।

“কে? কে এখানে?” জলদ গম্ভীর সেই কন্ঠস্বরে কেঁপে উঠল সমগ্র গুহা। কণ্ঠস্বরের মালিক এখনও আড়ালে।

“আমি অভিমন্যু।” অভিমন্যুর কণ্ঠস্বরেও তীব্র গাম্ভীর্য। সে জানে তার এই নামটার অভিঘাত অনেক। এই নামের জন্যই সে জানতে পেরেছিল এক বিস্ময়কর রহস্য। তার নামটাই পর্বতে ধ্বস নামিয়েছিল।

“কে? কে তুমি?” এবার যেন কণ্ঠস্বরের তীব্রতা কিছুটা কম।

“আমি অভিমন্যু। অনেক বছর আগে আমি একবার এসেছিলাম এখানে। হয়ত আপনি ভুলে গেছেন।”

“না, তোমায় আমি ভুলিনি কিন্তু তুমি আবার এসেছ কেন? তুমি কথা দিয়েছিলে আমার অস্তিত্ব গোপন রাখবে আর কোনো দিন এই অরণ্য ভূমে পদার্পণ করবে না।” গর্জে উঠল সে।

“আমি আপনার সাহায্যপ্রার্থী।” জোর গলায় বলল অভিমন্যু।

“আমার সাহায্যপ্রার্থী!” গুহাভ‍্যন্তর থেকে বেরিয়ে এলেন দীর্ঘকায় মানুষটি।

“হ্যাঁ। আমি বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনাকে আমাকে সাহায্য করতেই হবে।” অপর প্রান্তে দাঁড়ানো মানুষটির জ্বলজ্বলে চোখ দুটোয় চোখ রেখে বলল অভিমন্যু।

“তুমি কি ব্যঙ্গ করছ আমায়?” গর্জন করে উঠলেন মানুষটি।

“না, আমি সত্যিই আপনার সাহায্যপ্রার্থী। এই পৃথিবীতে এইমুহূর্তে একমাত্র আপনিই পারেন আমাকে সাহায্য করতে। আপনাকে আমাকে সাহায্য করতেই হবে।” দৃঢ় কণ্ঠে বলল অভিমন্যু।

“আমি তোমায় সাহায্য করব কেন? তোমার মত সামান্য একটা মানুষ আমায় আদেশ করছে! আমাকে!” ক্রদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন মানুষটি।

“এখনও এত অহংকার! অহংকারই মানুষের পতনের কারণ হয় এটা নিশ্চই ভুলে যাননি আপনি? যে পাপের শাস্তি আপনি ভোগ করছেন ঈশ্বর হয়ত তা কিছুটা লাঘব করার সুযোগ দিয়েছে আপনাকে।”

“কী বললে?”

অভিমন্যুর বুকের মধ্যে আত্মবিশ্বাসটা যেন একটু পোক্ত হল। সে বোধহয় পাথরে ফাটল ধরাতে পেরেছে।

“বলছি।”

 

***

“হ্যালো, স্যার।”

“বলো অভিমন্যু। তুমি কোথায়?” উত্তেজিত কন্ঠ সব্যসাচীর।

“স্যার, আমি কোথায় জানতে চাইবেন না। আমি যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। আজ রাত বারোটায় আমি অপারেশন চক্রব্যূহ শুরু করব। একটা চান্স নিচ্ছি স্যার বাচ্চাগুলোকে বাঁচানোর। ওই সময় ওই এলাকার সমস্ত সার্ভিল্যান্স সিস্টেম হ্যাক করতে হবে এবং ওই ডোমের ভেতর ইন্দ্রজিৎ সেসব ক্যামেরা লাগিয়ে রেখেছে সেগুলো জ্যাম করতে হবে।”

“কী বলছ কী তুমি?”

“হ্যাঁ, স্যার। আমি যে ওখানে অপারেশনে যাচ্ছি কাকপক্ষীতেও যেন না টের পায়। এ বিষয়ে আর কোনো প্রশ্ন করবেন না স্যার। আপনি কথা দিয়েছিলেন।”

“সে তো বুঝলাম কিন্তু তুমি যে কাজগুলো বললে সেগুলো করতে হলে তো আমাকে অন্তত আমাদের টেক সেলের অফিসিয়ালদের জানাতেই হবে।”

“না স্যার। বাচ্চাগুলোকে বাঁচাতে হলে এই গোপনীয়তা রক্ষা করতেই হবে কাউকে জানানো চলবে না।”

“কিন্তু তাহলে...।”

“স্যার, এই কাজগুলো করবে ইন্ডিয়ার মোস্ট এফিসিয়েন্ট এথিক্যাল হ্যাকার মিস্টার সব্যসাচী মজুমদার। আপনার এই পরিচয়টা আমি ভুলিনি স্যার।”

“আমি!”

“হ্যাঁ, স্যার। আপনিই পারবেন। আর বাকি যে কথাগুলো বলছি মন দিয়ে শুনুন।”

অভিমন্যুর সঙ্গে আরও কিছু কথাবার্তার পর সব্যসাচী চিন্তায় পড়ে গেলেন, ছেলেটা কী করতে চাইছে?

 

***

চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার, তার মধ্যে শুধু ডোমটার মধ্যে মৃদু আলো জ্বলছে। শহর থেকে দূরে একদম ফাঁকা নির্জন একটা জায়গায় এই ডোমটা তৈরি করেছেন ইন্দ্রজিৎ। অবশ্য সরকারী হিসেবে এটার মালিক ওই বিমান নামের ছেলেটি। এই জায়গাটা তার নামেই কেনা। আশেপাশে কোনো লোকালয় নেই। এই রাতের আঁধারে অভিমন্যু আর সঙ্গী মানুষটি ছাড়া এ চরাচরে তৃতীয় কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। সেটা অভিমন্যুর পক্ষে খুবই ভালো হয়েছে, কারণ এই মানুষটিকে সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে তাঁর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ গোপন থাকবে।

“আমি আর এগোতে পারবো না। আপনি এগিয়ে যান। জানি এই অসুস্থ শরীরে আপনাকে খুব কষ্ট দিচ্ছি কিন্তু উপায় নেই। আমার বিশ্বাস আপনিই পারবেন ওই নিষ্পাপ শিশুগুলোর প্রাণ রক্ষা করতে।”

দীর্ঘকায় মানুষটি অভিমন্যুর দিকে একবার তাকালেন, তারপর এগিয়ে গেলেন নির্দ্বিধায়। তিনি জানেন সামনে এক ভয়ানক চক্রব্যূহ মৃত্যুর চাদর বিছিয়ে অপেক্ষা করছে কিন্তু তিনি ভাবলেশহীন।

 

***

নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যে পৌঁছতেই প্রাণঘাতী লেজার রশ্মি নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইল মানুষটিকে। যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে যাচ্ছেন তিনি। সারা শরীরে যেন হাজার সূর্যের উত্তাপ। জ্বলে যাচ্ছে সমস্ত শরীর কিন্তু তার মধ্যেও যন্ত্রণা কাতর অবস্থায় তিনি পৌঁছে গেলেন ডোমের ভেতরে। অত্যাশ্চর্যভাবে লেজার রশ্মির বলয় তাঁর প্রাণ হরণ করতে অসমর্থ হল।

ডোমের ভেতর ঢুকে তিনি দেখলেন রাজকন্যার মত একটি কিশোরী লুটিয়ে পড়ে আছে খাটের ওপর আর পাশের কক্ষ থেকে ভেসে আসছে দুটি ক্রন্দনরত শিশুর আওয়াজ। অভিমন্যু তাঁকে কিছু চলচ্ছবি দেখিয়েছিল। অনেক কিছু বুঝিয়েছিল। বেশি খুঁজতে হল না তাঁকে, কালো রঙের বস্তুটার দিকে অতি সহজেই নজর পড়ল তাঁর। এর বোতাম টিপতে হবে।

চোখ বন্ধ করে একবার ঈশ্বরের নাম নিলেন তিনি, তারপর একটা বোতাম টিপে দিলেন। কিন্তু ঠিক বোতামটাই টিপেছেন তো? বন্ধ হয়েছে তো ওই প্রাণঘাতী রশ্মি? আবার বাইরে এলেন মানুষটি। এবার কোনোরকম কষ্টদায়ক অনুভূতি ব্যতীতই তিনি পৌঁছে গেলেন অভিমন্যুর কাছে। একরাশ শ্মশ্রু-গুম্ফ-সম্বলিত মুখ মণ্ডলে মৃদু হাসি।

“বোধহয় আমি পেরেছি। বেরিয়ে আসার সময় কোনোরকম যন্ত্রণা অনুভব করিনি।”

“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি গিয়ে আমার গাড়িতে উঠে বসুন। ভয় নেই দরজা লাগিয়ে দিলে কেউ আপনাকে দেখতে পাবে না।”

মানুষটি মুখে কিছু বললেন না শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

 

***

ইন্দ্রজিৎ পাগলের মতো ছটফট করছেন। ডোমের মধ্যেকার ক্যামেরাগুলো বন্ধ হয়ে গেল কী করে! স্ক্রীন জুড়ে গাঢ় অন্ধকার। এরকম তো হওয়ার কথা নয়। ইন্দ্রজিতের সন্দেহ হচ্ছে কেউ ক্যামেরাগুলো জ্যাম করেছে কিন্তু কে করবে? করে লাভটাই বা কী হবে? ক্যামেরা জ্যাম করে তো কেউ ডোমে ঢুকতে পারবে না। তাহলে কী হল ব্যাপারটা! চিন্তা হচ্ছে তাঁর, শুধু তাই নয় তাঁর সহকারী বিমানের সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ করতে পারছেন না বেশ কিছু সময় ধরে। চমকে উঠলেন ইন্দ্রজিৎ। স্ক্রীনে আবার ছবি ফুটে উঠেছে। এ কী! ডোমের মধ্যে লম্বা ফর্সা পেশীবহুল চেহারার একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা গ্রিক দেবতাদের মত দেহের গড়ন। ক্যামেরার দিকে মুখ করে হাসছে ছেলেটি। ব্যঙ্গের হাসি।

“ডক্টর ইন্দ্রজিৎ কুমার, এই ডিভাইসটা নাকি আপনি কাকে বিক্রি টিক্রি করবেন ভাবছেন? এটা নাকি আপনার ট্রায়াল ছিল! খুবই দুঃখের বিষয় আপনার গবেষণা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বাচ্চাদের তো আপনি ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন। তারা কেউ ট্রিগারিং রিমোট অফ করেনি অথচ দেখুন আমি দিব্যি ঢুকে পড়েছি ভেতরে। আর অল্প সময়ের মধ্যে আরও লোকজন চলে আসবে। বাচ্চাদের হসপিটালে নিয়ে যাবে। সময় মতো আ্যন্টিডোটও দিয়ে দেওয়া হবে। বাচ্চারা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। আপনার আর প্রতিশোধও নেওয়া হল না।

এই দেখুন না ডক্টর ঠাকুরের নাতি-নাতনির জন্য দুধের বোতল নিয়ে এসেছি আমি। ওদের কান্নাও এক্ষুনি থেমে যাবে। সত্যিই আপনার কথা ভেবে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এরকম একজন জিনিয়াস হয়ে জন্মালেন কিন্তু নিজের দোষে আজ লুকিয়ে চুরিয়ে বেড়াচ্ছেন। একটা জিনিস আবিষ্কার করলেন কিন্তু সে গবেষণাও যে ব্যর্থ নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন। যাদের জন্য আপনার এই অবস্থা তাদের ওপরও প্রতিশোধ নেওয়া হল না। ভেরি স্যাড। অ্যট দ্য এন্ড অফ দ্য ডে ইউ আর আ বিগ লুজার।”

অভিমন্যুর কথাগুলো যেন উত্তপ্ত শলাকার মত বিঁধছে ইন্দ্রজিতের শরীরে। সে হতভম্ব, সে বিস্মিত। এ কী করে সম্ভব! লেজার রশ্মির ওই চক্রব্যূহ ভেদ করা যে অসম্ভব! কিন্তু ওই ছেলেটা কে? ও ঢুকলো কী করে? তাহলে কি ওই ছেলেটাই ঠিক বলছে ফাঁক রয়ে গেছে তাঁর আবিষ্কারে? ওরা বাইরে থেকে ট্রিগারিং রিমোট অফ করার উপায় বের করে ফেলেছে!

কী করবেন তাহলে তিনি? তিনি যে বিদেশী রাষ্ট্রের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে ওই গবেষণায় ঢেলেছেন তারা অতি ভয়ানক । তারা তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর নজর রেখেছে। ওরা যদি জানতে পারে তাঁর গবেষণা ব্যর্থ হয়েছে তাঁকে শেষ করে দেবে। মাথাটা দপদপ করছে ইন্দ্রজিতের। তাঁর এত দিনের সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ!

 

***

“তোমরা তাড়াতাড়ি ওদের হসপিটালে নিয়ে যাও।”

“ওকে স্যার।” অভিমন্যুর নির্দেশ মেনে ওর ব্যাকআপ টিম বাচ্চাদের বের করে নিয়ে যায়। সব্যসাচীর নির্দেশ অনুযায়ী কেউ কোনো প্রশ্ন করে না অভিমন্যুকে। অভিমন্যুই সব্যসাচীকে অনুরোধ করেছিল ব্যাকআপ টিম তৈরী রাখতে যারা এখানে আসার আগে পর্যন্ত জানত না কী কাজের জন্য তৈরি হয়ে আছে তারা। কয়েকজন বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে গেল আর বাকিরা রইল ডোম পাহারা দেওয়ার জন্য। সুপার সনিক কারটা একটু দূরেই রেখেছিল অভিমন্যু। গাড়িতে উঠে বসল সে।

“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি না থাকলে আজ বাচ্চাগুলো বাঁচত না।” প্রত্যুত্তরে অপর মানুষটি মুখে কিছু বললেন না শুধু তাঁর দু চোখ বেয়ে অবিরাম অশ্রুপাত হতে লাগল। অভিমন্যুও আর কিছু বলল না। সেই অরণ্য ভূমির উদ্দেশ্যে গাড়ি ছুটিয়ে দিল। রাতের অন্ধকারে রহস্যময় মানুষটি আবার মনুষ্য সমাজ থেকে দূরে গভীর অরণ্যে হারিয়ে যাবেন।

 

***

“আমরা দেরী করে ফেললাম অভিমন্যু।” সামনের চেয়ারে কাত হয়ে পড়ে থাকা ইন্দ্রজিতের নিথর দেহটার দিকে তাকিয়ে বললেন সব্যসাচী। বিমানকে জেরা করে ইন্দ্রজিতের গোপন ল্যাবের সন্ধান পাওয়ার পর তিনি নিজেই অপারেশন টিমের নেতৃত্ব দেন। পুরো ল্যাবের কোথাও ইন্দ্রজিতকে খুঁজে না পেয়ে যখন প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছেন তখন আন্ডার গ্রাউন্ডে এক গোপন চেম্বারের হদিশ পান। দশ বছর ধরে লুকিয়ে থাকা ইন্দ্রজিৎ গোপনেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন। প্রতিশোধ নিতে না পারার জ্বালা নাকি নিজের গবেষণার ব্যর্থতা নাকি সেই বিদেশী রাষ্ট্রের চাপ কীসের জন্য এত বড় পদক্ষেপ নিলেন ইন্দ্রজিৎ, তা চিরকাল অজানাই থেকে যাবে।

“দেরী হয়নি স্যার। ঠিক সময়েই পৌঁছেছি আমরা। ইন্দ্রজিতের মত জিনিয়াসকে ল্যাবেই মানায়। জেলের কুঠুরিতে নয়। অসৎ হলেও অসামান্য প্রতিভা ছিল লোকটার।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল অভিমন্যু।

“তুমি কিন্তু আমাকে বলোনি কী করে ওই ডোমে ঢুকেছিলে। ট্রিগারিং রিমোটটা কী করে বন্ধ করেছিলে? এদিকে বলছ ইন্দ্রজিতের গবেষণা পুরো সফল।” সব্যসাচী অভিমন্যুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।

“আবারও বলছি স্যার ইন্দ্রজিৎএর ওই চক্রব্যূহ সত্যিই দুর্ভেদ্য কিন্তু আমি কী করে ভেদ করেছি সেই রহস্য জানতে চাইবেন না। বিজ্ঞানের বাইরেও প্রকৃতিতে অনেক বিস্ময়কর রহস্য থাকে।”

একটা লম্বা শ্বাস ফেলে অভিমন্যু মনে মনে ভাবল, সত্যিই পৃথিবীর সব রহস্যের সন্ধান মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। বোধহয় সত্যিই কোনো অদৃশ্য শক্তি আছে যা অলক্ষ্যে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে । সেই শক্তিই হয়ত চেয়েছিল বাচ্চাদের প্রাণ রক্ষা করতে নাহলে দশ বছর আগে অভিমন্যু সেই মানুষটির দেখা কেন পেয়েছিল? সেই মানুষটি কী করে অভিমন্যুর ভাষা বুঝল? তার ভাষায় কথা বলল? এও তো চরম বিস্ময়কর!

 

কিছু দৃশ্যের কোলাজ

পার্কে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে ছুটে ছুটে খেলে বেড়াচ্ছে বসুধা আর জিষ্ণু। তাদের ঠাকুমারা হাত নেড়ে নেড়ে গল্পে মত্ত।

 

ক্রুশাল আর ইরা একটা টেডি বিয়ার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে আর খিলখিল করে হাসছে।

 

রৌশেনারা তার বাবা-মার সঙ্গে সমুদ্রে বেড়াতে এসেছে। সে ঢেউয়ের তালে লাফাচ্ছে। আরহান আজ বহু বছর পর সুরিয়ার কাছে সরে এসে তার হাতটা তালুবন্দি করলেন।

 

সেই রহস্যময় মানুষটি

শিবলিঙ্গের সামনে বুনো ফুলের অর্ঘ্য অর্পণ করে হাহাকার করে উঠলেন দীর্ঘকায় মানুষটি। সারা শরীরে হাজার হাজার বছরের জরা আর ব্যাধির যন্ত্রণা। কপালের ক্ষতটায় একবার হাত দিলেন মানুষটি। আজ তিনি মণিহারা, শৌর্য, বীর্যহীন।

“হে মহাদেব, আপনি কি আমার আরাধনায় আজও তুষ্ট হবেন না?” অসহায় আর্তি তাঁর।

“হে, বাসুদেব, আমি মহাগুরু দ্রোণের পুত্র, মহাবীর আমি কিন্তু মৃত্যুর কাছে আমি পরাজিত। আমার আহ্বানে মৃত্যু সাড়া দেয় না। আমি জানি আমি পাপী। আমি পাঞ্চালীর মাতৃক্রোড় শূন্য করেছি, আমি উত্তরা-অভিমন্যুর সন্তানকে হত্যা করতে চেয়েছি। আমার সেই পাপের ভার কি আজও লাঘব হয়নি বাসুদেব? এই জরা, ব্যাধিগ্রস্থ শরীরের ভার বইতে যে বড় কষ্ট বাসুদেব। আপনার লীলা বিচিত্র। আমার এই অভিশপ্ত জীবনই আজ পাঁচটি শিশুর প্রাণ রক্ষা করেছে। ওই ছেলেটি অভিমন্যু নাম নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে। আবার আমার পাপের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আমাকে। প্রতি মুহূর্তে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছি আমি। বীর অশ্বথামা, আপনার ক্ষমাপ্রার্থী। হে বাসুদেব কৃষ্ণ, আপনার এই অমরত্বের অভিশাপ আপনি ফিরিয়ে নিন । দয়া করুন বাসুদেব। দয়া দয়া দয়া...।”