পোকা ● ঋজু গাঙ্গুলী

 


 

“সুলু সাগরের ঝড় নিয়ে কেউ কাব্য-কবিতা লেখেননি। আসলে লেখার জন্য বেঁচে থাকলে তো! আমাদের জাংক যেভাবে খেলনার মতো ওঠানামা করছিল তাতে আমারও মনে হচ্ছিল— অদ্যই শেষ রজনী, থুড়ি দিন। ঠিক কোথায় আছি, এমনকি কত ঘণ্টা ধরে এই ঢেউ আর বৃষ্টির মধ্যে জাহাজ বাঁচানোর চেষ্টা করছি— খেয়াল ছিল না। কুচকুচে কালো মেঘে ঢাকা আকাশের বুক চিরে বিদ্যুতের ঝলক আশপাশ সাদা করে দিচ্ছিল মাঝেমধ্যেই। কিন্তু তাতেও জল ছাড়া কিছুই নজরে পড়ছিল না!

হঠাৎ টঙে ঝুলে থাকা মুস্তাফা’র চিৎকার শুনলাম, ‘ওই যে! ডাঙা!’

হাওয়া, দুলুনি, তুমুল বৃষ্টি, মাল্লাদের আর্তনাদ— সব মিশে একেবারে নারকীয় অবস্থা তৈরি হয়েছিল। তবু, পরেরবার যখন বিদ্যুৎ চমকাল, দূরে একটা জমাট কালচে ছায়া দেখতে পেলাম আমি। মিন— মানে আমাদের মেটও ওটা দেখেছিল। ওর চিৎকার শোনামাত্র ক্যাপ্টেন লুনের হাতে ধরা স্টিয়ারিং ঘুরতে শুরু করল। জাহাজও প্রায় নব্বই ডিগ্রি ঘুরে দ্বীপের দিকে মুখ ফেরাল।

নিজেকে সামলাতে না পেরে আছাড় খেলাম। তারপর একদিকে গড়িয়ে গেলাম। কপালটা ঠিক কীসে লাগল জানি না, তবে চোখের সামনে একরাশ ডেলাপাকানো অন্ধকার নেমে এল তক্ষুনি।

জ্ঞান ফেরার পর বুঝতে পারলাম, একটা নৌকোয় আধশোয়া হয়ে বসে আছি। চারজন মাল্লা দ্রুত হাতে নৌকোটা টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি থেমেছে। আকাশও পরিষ্কার হচ্ছে, তবে দিনের আলোও ফুরিয়ে আসছে।

পেছনদিকে তাকাতে দেখলাম, জাহাজটা একদিকে কাত হয়ে কয়েকটা পাথরের মধ্যে আটকে রয়েছে। একটা দিক একেবারে ভেঙে গেছে। অর্থাৎ দ্বীপের দিকে আসার সময় ওখানে ধাক্কা খেয়েই জবাব দিয়েছে আমাদের জাংক। লুন, ফার্স্ট মেট মিন, আমি, মুস্তাফা আর ওই চারজন মাল্লা— এ-বাদে কাউকে দেখলাম না আশেপাশে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসতেই দ্বীপটা দেখলাম।

লালচে আকাশের নীচে কালচে সবুজ গাছে ঢাকা দ্বীপটা দেখে বেশ ভালো লাগছিল। তবে… একটা ব্যাপারে খটকা লাগল তখনই।

পাখিদের ডাক নয়, বরং একটা অদ্ভুত গুঞ্জন ভেসে আসছিল দ্বীপটা থেকে!”

*

হাতের কাগজগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে আমাদের দিকে তাকালেন শিশিরদা। চটকা ভেঙে কাপে চুমুক দিতে গিয়ে বুঝলাম, কফিটা ঠান্ডা মেরে গেছে। অবশ্য কফির আর দোষ কী?

শিশিরদা আর পিয়াদি’র আলো-ঝলমলে ফ্ল্যাটে বসলেই আমাদের আলোচনার টপিকগুলো, ঝুমা’র ভাষায়, ‘ম্যা…গো!’ টাইপের হয়ে যায়। আজও তাই হয়েছিল।

করোনা এবং অন্যান্য ভাইরাস কোনো দেশ বানিয়ে থাকতে পারে কি না— সেই নিয়ে কথা শুরু করেছিল শৈবাল। কীটপতঙ্গ কীভাবে রোগ ছড়ায় সেটার ব্যাখ্যা দিচ্ছিল দীপা। কথাবার্তা আরও ‘সুস্থ’ দিকে আনার জন্য কী করা উচিত, সেটাই ভাবতে শুরু করেছিলাম। হঠাৎ ঝুমা বলে উঠল, “তাও ভাগ্যিস এইসব কীটপতঙ্গ নিজে ভেবে কিছু করতে পারে না। নইলে আমাদের কী হাল হত ভেবে দেখেছ?”

“ধুর!” আমি হেসে ফেলেছিলাম, “পোকারা আবার নিজে থেকে কিছু করতে পারে নাকি?”

একটা গলা খাকরানির শব্দ শুনে আমরা সবাই ঘুরে তাকিয়েছিলাম। শিশিরদা পাশের দেরাজ খুলে একটা ফোল্ডার বের করে সোজা হয়ে বসেছিলেন। আমাদের কৌতূহলী মুখচোখ দেখে বলেছিলেন, “একটা দিনলিপি শুনবে?”

“কার দিনলিপি?” জানতে চেয়েছিলাম।

“ডক্টর সুবীর দত্ত।” ফোল্ডারটা দুলিয়ে বলেছিলেন শিশিরদা, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে মেডিকেল মিশনের অংশ হয়ে ফিলিপিন্সে গেছিলেন ভদ্রলোক। মার্কিন, ব্রিটিশ বা স্প্যানিশ কলোনিয়ালদের সঙ্গে তাঁর খুব একটা বনিবনা হত না। সেই তুলনায় জেলে, মাঝিমাল্লা, এমনকি জলদস্যুদের সঙ্গেও তাঁর বেশি খাতির ছিল।”

“বাপস!” শৈবাল বলে উঠল, “রীতিমতো ডাকাবুকো ছিলেন তো তাহলে।”

“ঠিক।” সায় দিলেন শিশিরদা, “ভদ্রলোক অকপটে লিখেছেন, ডাক্তারি পড়ে মানুষকে সাহায্য করলেও সুবোধ বালক তিনি কোনোদিনই ছিলেন না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঝামেলা করার ফলে তাঁকে পুয়ের্তো প্রিন্সেসা নামের একটা জায়গায় বদলি করা হয়েছিল। সেখানেই এক চিনা জাংকের ক্যাপ্টেন লুনের সঙ্গে ডক্টর দত্ত’র আলাপ-পরিচয় হয়।”

“কী করত এই লুন?” দীপা জানতে চেয়েছিল।

“কাগজে-কলমে মাছ ধরার জাহাজ চালালেও লুনের আসল কাজটা ছিল বে-আইনি।” শিশিরদা বলেছিলেন, “ওখানকার বিখ্যাত গ্রে পার্ল তোলা আর বিক্রি করাই ছিল ওর ব্যবসা। তেমনই একটা সফরে ও ডক্টর দত্তকে সঙ্গে নিয়ে গেছিল। ছুটি নিয়ে উনিও জাংকে ভেসে পড়েছিলেন। কিন্তু তারপর যা হয়েছিল… সেগুলোই উনি লিখে গেছিলেন এই দিনলিপিতে।”

“এটাও কি অকশন হাউস থেকে জোগাড় করলেন?” আমি জানতে চেয়েছিলাম।

“হুঁ।” মাথা নেড়ে শিশিরদা বলেছিলেন, “সেই সফরের কথাগুলো শুনবে?”

“শুনব!” প্রায় একসঙ্গে বলে উঠেছিলাম আমরা সবাই। শিশিরদাও দিনলিপিটা নিজের মতো করে বলতে শুরু করেছিলেন— যা এতক্ষণ ওপরে লিখেছি।

একটু হাত-পা ছড়িয়ে নিলাম আমরা। পিয়াদি হুংকার দিলেন, “আধঘণ্টার মধ্যে গপ্পো শেষ করো। তারপরেই ডিনার সার্ভ করব।”

“গপ্পো নয়।” কঁকিয়ে উঠলেন শিশিরদা, “সত্যি ঘটনা।”

“অই হল।” পিয়াদি উঠে গেলেন। আমাদের উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকতে দেখে আবার বলতে শুরু করলেন শিশিরদা।

*

“সূর্যের শেষ আলোটুকু আকাশ থেকে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আমরা নিজেদের যতটা সম্ভব গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। এইরকম একটা দ্বীপে খুব বড় আকারের কোনো হিংস্র জন্তুর থাকার সম্ভাবনা খুবই কম— এটা আমরা জানতাম। তবে এও সত্যি যে সুলু সাগরের নানা দ্বীপ নিয়ে বহু কথা নাবিকেরা বলে থাকে। তাদের সবগুলো যে মাতালের প্রলাপ বা পাগলামি নয়— এটা তাদের চিকিৎসা করতে গিয়েই দেখেছি। তাই ডাঙায় পৌঁছোনোর পর মুস্তাফা আর বাকিরা যখন খাবার আর অন্য রসদ জড়ো করছিল, লুন আর আমি তখন বেলাভূমির দু’প্রান্তে সরে গিয়ে চারদিকে নজর রাখছিলাম। আমাদের লক্ষ্য ছিল এই শিবিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

সব সামলে, সবচেয়ে কাছের গাছপালা কেটে মোটামুটি একটা মাথা-গোঁজার ঠাঁই বানানো হতে-হতে রাত নেমে গেল। অবশেষে সাগরপারে আগুন জ্বেলে টিনের মাংস আর শুকনো মাছ দিয়ে রাতের খাওয়া সারতে বসলাম আমরা। মাথার ওপর অজস্র তারায় ভরা নির্মেঘ আকাশ, মুস্তাফার গলায় একটা গুনগুনে সুর, মিনের হেঁড়ে গলার হাসি— সব মিলিয়ে ভালোই লাগার কথা। তবু আমি অস্বস্তিটা কিছুতেই ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। লুন হঠাৎ বলে উঠল, ‘ব্যাপারটা খেয়াল করেছ ডাক্তার?’

এইবার আমি অস্বস্তির কারণটা বুঝতে পারলাম।

এই পুরো সময়টায় আমরা জঙ্গলের গাছে হাওয়ার সরসর শব্দ, সমুদ্রের গর্জন, আর নিজেদের গলার শব্দ ছাড়া কোনো পাখির ডাক বা বাঁদরের হুপহাপ শুনিনি। তার বদলে শুধু কানে এসেছে একটা অদ্ভুত গুঞ্জন— হাজারটা ভোমরা অনেক দূরে একসঙ্গে ঘুরপাক খেলে যেমন হবে, তেমন।

‘কেউ আমাদের দেখছে।’ সিরিয়াস হয়ে বলল মিন, ‘আমি এতক্ষণ এই নিয়ে কিছু বলিনি। কিন্তু দ্বীপে পা দেওয়ার আগে থেকেই আমার মনে হচ্ছিল, কেউ বা কারা যেন আমাদের ওপর নজর রাখছে। আমি অনেকভাবে দেখার চেষ্টা করেছি জঙ্গলের মধ্যে কেউ লুকিয়ে আছে কি না। কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনি।’

লুনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা পাইরেটদের কোনো বেস নয় তো? এই তল্লাটে মার্কিন আর ব্রিটিশ নেভির নজর এড়াতে অনেক জলদস্যুই তো এইরকম দ্বীপগুলোতে নিজেদের ঘাঁটি বানায়। তেমন কোথাও এসে পড়েছি নাকি আমরা?’

‘তেমন কোথাও এলে আমাদের দফা এতক্ষণে রফা হয়ে যেত ডাক্তার।’ লুনের মুখে একপেশে হাসিটা ফিরে এল, ‘না। এখানে অন্য কোনো গোলমাল আছে। তবে আপাতত আমাদের কাজ হবে ক’টা দিন টিকে থাকা। পরিষ্কার আকাশে আমাদের জ্বালানো আগুন স্মোক সিগনালের কাজ করবে। যদি কোনো নেভি বা এক্সাইজের নৌকো হয়, তাহলে জাহাজডুবি হয়েছে— এই বলে সাহায্য চাইব। আমাদেরই মতো দু’নম্বরি কারবারের লোক হলে সেফ প্যাসেজ কিনে নেব। সেটুকু মালমশলা আছে আমার সঙ্গে।’

গ্রে পার্ল! আমার খেয়াল হল, মেরিন কোরের কিছু অসাধু সৈনিকের কাছ থেকে লুন সেই জিনিস বাগিয়েছে বটে। বুকের ভেতরটা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল। জাংক ডোবার ফলে জলই যাদের কবর হল, তাদের বাড়ির লোকেরা কি এর ভাগ পাবে? জানি না।

‘আজ রাতে আমাদের সবার একসঙ্গে ঘুমোনো চলবে না।’ লুন বলছিল, ‘রোস্টার বানাও মিন। পালা করে দু’জনের একটা গ্রুপ অস্ত্র নিয়ে নজর রাখবে। কাল সকালে দেখব কী করা যায়।’

 

ক্লান্তি আর অস্বস্তির যুদ্ধ চলছিল আমার ভেতরে। বাইরে জ্বলা আগুনের আভা আর দু’জন মাল্লার লম্বা ছায়া দেখতে-দেখতে কখন যে চোখ লেগে গেছিল, বুঝতে পারিনি। হঠাৎ একটা ক্ষীণ আর্তনাদ ভেসে এল ঘুমের চাদর ভেদ করে। চোখ খুলে এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, আমি যেন জলেই ভেসে আছি। মনে হল, আমার পিঠের নীচে বালিটা যেন জলের মতোই নড়েচড়ে উঠছে। একলাফে সোজা হতেই দুটো জিনিস খেয়াল হল। প্রথমত, আমার অনুভূতিটা স্বপ্ন ছিল কারণ পায়ের নীচে বালি আর পাথর একেবারে স্বাভাবিক ঠেলছিল। দ্বিতীয়ত, আর্তনাদটা স্বপ্ন ছিল না— কারণ বাইরে আগুনটা নিভে এলেও একটা জটলা আর রাগ-কান্না মেশানো কয়েকটা গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।

হুড়মুড়িয়ে বাইরে এলাম। পুবদিকটা ফরসা হয়ে আসছিল তখন। ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া আর গোলাপি আকাশ কানের কাছে ‘আয় ঘুম!’ বলছিল। একরকম জোর করেই আমি এগিয়ে গেলাম সামনের জটলার দিকে।

একজন মাল্লা মাটিতে পড়ে হাউমাউ করে কিছু বলছিল। লুন যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল তাতে মনে হল, লুনের ঘুষি বা থাপ্পড় খেয়েই বেচারি মাটিতে পড়ে গেছে। লুন আবার লোকটাকে মারতে গেছিল। মিন বা অন্যদের সাহস না থাকলেও আমি লুনের হাত ধরে একটানে ওকে সরিয়ে আনলাম। তারপর গলার আওয়াজ যতটা সম্ভব উঁচুতে তুলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে?’

প্রথমে কেউ কিছু বলল না। তারপর মিন বলে উঠল, ‘পো, মানে সুঙের সঙ্গে যে পাহারা দিচ্ছিল, হারিয়ে গেছে।’

‘হারিয়ে গেছে!’ কথাটা এতই অপ্রত্যাশিত ছিল যে আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল, ‘তার মানে?’

‘তার মানে,’ ক্লান্ত গলায় মিন বলল, ‘পো আর সুং দু’দিক থেকে আমাদের ক্যাম্পের ওপর নজর রাখছিল। কিন্তু একটু আগে হঠাৎ সুং দেখে, জঙ্গল যেখানে পাতলা হয়ে গেছে সেদিকের একটা পাথরের পাশে দাঁড়িয়ে পো হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকছে। সুং অবাক হয়ে গেছিল, কারণ ওদের দু’জনের কাজ ছিল দুটো আলাদা দিক থেকে নজর রাখা। পো ওইদিকে, তাও আবার অতটা দূরে কখন গেল— সেই ভেবে সুঙের চিন্তা হয়। ও চিৎকার করে পো-কে ক্যাম্পে ফিরে আসতে বলেছিল। তখন...’

‘তখন?’ আমার মুখ থেকে প্রশ্নটা ঠিকরে বেরোল।

‘তখন আমার এই মাল্লাটি বেহেড হয়ে গেছিল ডাক্তার।’ গর্জে উঠল লুন, ‘সে দেখেছিল— পো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল!’

স্তম্ভিত হয়ে শুনলাম, বালিতে পড়ে সুং কান্না-মেশানো গলায় বলছে, ‘সত্যি বলছি ক্যাপ্টেন! পো... গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে বাতাসে মিশে গেছে।’

কেউ কোনো কথা বলছিল না। হয়তো সে-জন্যই হাওয়া আর জলের শব্দ ছাপিয়ে আমি আবার শুনতে পেলাম সেই অদ্ভুত গুঞ্জনধ্বনি।”

*

“তোমরা খেতে আসবে? নাকি...?”

পিয়াদি’র হুমকিটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই আমরা সবাই হুড়মুড়িয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোলাম। প্লেটে জিনিসপত্র জমা হতেই ঝুমা জিজ্ঞেস করল, “এই সুবীর দত্তের কী হয়েছিল?”

“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ফিলিপিন্স বেশ কিছুদিনের জন্য জাপানের অধীনে চলে যায়। তখন সেখানকার ব্রিটিশ নাগরিকদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়েছিল। ডক্টর দত্তের অবস্থাও খারাপ হতে পারত। কিন্তু এই মানুষটি মচকাননি। শত সমস্যার মধ্যেই মনের জোর দিয়ে, এমনকি রীতিমতো গায়ের জোর দিয়ে ওখানকার লোকের চিকিৎসা করেছিলেন সুবীর। তার কিছুদিন পর ‘চন্দ্র বোস’ নামের এক বাঙালির কথা ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা এশিয়া-প্যাসিফিক বেল্টে। হয়তো তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার বশেই জাপানের তরফে মিলিটারি বা শাসকেরা সুবীর দত্তের ওপর কোনো অত্যাচার করেননি।”

“উনি দেশে ফিরতে পেরেছিলেন?” শৈবাল জিজ্ঞেস করল।

“নাহ!” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শিশিরদা, “যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মার্কিন বিমানবাহিনী ক্রমাগত বোমাবর্ষণ করেছিল ওখানকার ছোট-ছোট দ্বীপগুলোয়। জাপানিরা ওগুলোকেই একেবারে মরণকামড় দিয়ে ধরে রেখেছিল তো। তেমনই একটা জায়গায় খাঁড়ির ধারে ওঁর ছোট্ট ডাক্তারখানা ছিল। বোমার ঘায়ে সেটা উড়ে গেছিল।”

“তাহলে এই দিনলিপি...?”

“যুদ্ধের পর মেডিকেল মিশনের অবশিষ্ট সদস্যরা দেশে ফিরে এসেছিলেন।” আমার দিকে তাকিয়ে বললেন শিশিরদা, “তাঁদের মাধ্যমেই ফিরে এসেছিল এই দিনলিপি, নানা ট্রপিক্যাল ডিজিজ নিয়ে সুবীর দত্তের পর্যবেক্ষণ, আর কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র। দাঙ্গায় ওঁর পরিবারের কেউ বেঁচে ছিল না বলে সেগুলো ওঁর এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বন্ধু কাম সহকর্মীর সঙ্গে বো-ব্যারাকেই ঠাঁই পেয়েছিল। এবার, এতদিনে, সেগুলো অকশন হাউজে পৌঁছেছে।”

“ওই দ্বীপে...?” পিয়াদি’র ঠান্ডা চোখ দেখে ঢোঁক গিলে প্রশ্নটা গিলে ফেললাম। শিশিরদা অভয় দিলেন, “খাওয়ার পর বাকিটা বলছি।”

খাওয়া শেষ করে আমরা আবার নিজের-নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। মুখে পান গুঁজে শিশিরদা আবার বলতে শুরু করলেন।

*

“আলো স্পষ্ট হওয়ার পর আমি নিজেই সুঙের সঙ্গে কথা বললাম। মিনের সঙ্গে ওই জায়গাটাও ভালো করে দেখলাম, যেখান থেকে পো গায়েব হয়েছে। জায়গাটার কোনো বিশেষত্ব নেই। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, ওখানে বালিতে কারও পায়ের দাগও দেখলাম না। কাপড় আর কাঠকুটো দিয়ে মাথা-গোঁজার মতো যে আশ্রয়টা আমাদের জন্য বানানো হয়েছিল, তার আশপাশ খুঁটিয়ে দেখলাম। সেখানেও ওদের দু’জনের চক্কর দেওয়ার চিহ্ন ছাড়া কিছুই পাইনি। জঙ্গলের ভেতরটা আমরা তখনও দেখার সাহস পাইনি। তবু সবকিছু দেখে আমার যে কথাটা মনে হচ্ছিল, সেটাই মুস্তাফা একবার বিড়বিড় করল চাঁটগাইয়া ভাষায়— ‘হিসসাদার আরও একজন কমল তাহলে!’

লুনের দলের লোকজন মারকুটে হলেও এতটা কাটথ্রোট বলে আমার কখনও মনে হয়নি। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে মিন বলল, ‘দু’জনকে খাবারের জল জোগাড়ে যেতে হবে। তুমি যাবে, ডাক্তার?’

বললাম, ‘যাব।’

আসলে আমার আশঙ্কা হচ্ছিল, অজানা-অচেনা জায়গার কোনো ফল বা অন্য কিছু খেয়ে হওয়া বিষক্রিয়ার ফলে পো অসুস্থ হয়েছে, সুংও ভুল দেখেছে। অন্তত খাওয়ার জলটা পরিষ্কার হলে আমরা এই ক’টা দিন চালিয়ে দিতে পারব।

 

দিয়েগো নামের এক মাল্লা আমার সঙ্গী হল। কয়েকটা বড় পাত্র আর বন্দুক নিয়ে আমরা দ্বীপের উত্তরদিক লক্ষ্য করে এগোলাম— যেখানে জঙ্গলের বড় গাছগুলোর মধ্যে একটা ফাঁক দেখে মনে হয়েছিল, পাহাড় থেকে নেমে আসা কোনো ঝর্ণা ওখানে থাকতেও পারে।

হাতে ঘড়ি ছিল না। তা সত্ত্বেও বেশ বুঝতে পারছিলাম, গোলমাল শুধু আমাদের ওই শিবিরে নয়— গোটা দ্বীপেই আছে। নইলে জঙ্গলের ধার বরাবর হেঁটেও ওই ঝর্ণার মুখে পৌঁছোতে এতটা সময় লাগার কথা নয়। আমি আর দিয়েগো হেঁটে চলছিলাম যেন অনন্তকাল ধরে! দিনেদুপুরে মরীচিকা দেখার অবস্থা হয়নি আমাদের। অথচ ক্রমাগত মনে হচ্ছিল, ঝর্ণার কুলুকুলু শব্দ আর ওই ফাঁকা জায়গাটা আমাদের কাছে এসেও যেন দূরে সরে যাচ্ছে! শেষ অবধি আমরা যখন সমুদ্র আর সরু নদী বা ঝর্ণার সঙ্গমে এলাম, তখন সূর্য মাথার ঠিক ওপরে পৌঁছে গেছে। আমি কিছু বলার আগেই দিয়েগো প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল মিঠে জলের টানে। পিপাসায় আমারও গলা-বুক ফেটে যাচ্ছিল। তবু নিজেকে সামলে রাখলাম একটাই কারণে।

ওই জল খেয়ে দিয়েগো’র কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় কি না— সেটা আমি বুঝতে চাইছিলাম।

দিয়েগোকে বারবার জিজ্ঞেস করে বুঝলাম, ও তেমন কিছু টের পাচ্ছে না। নিজেও কিছুটা জল খেলাম। পাহাড়ের মধ্য দিয়ে বয়ে আসা জলের সামান্য কষাটে স্বাদ ছাড়া জলটা মিষ্টিই লাগল। তৃষ্ণা মিটিয়ে, সঙ্গে আনা পাত্রগুলো জল দিয়ে ভরে ছায়ায় বসলাম একটু জিরিয়ে নিতে।

ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া সরু, পায়ে-হাঁটা পথটা তখনই আমার নজরে পড়ল।

দিয়েগো আমার মুখ দেখেই বুঝেছিল, তখনই আমি জঙ্গলে ঢুকতে চাইছি। সে বলে উঠল, ‘না ডাক্তার। এখন নয়। আমাদের ফিরতে হবে।’

কথাটায় যুক্তি ছিল। খালি হাতে যেখানে আসতেই আমাদের এতটা সময় লেগেছিল, সেখান থেকে ভারী পাত্রগুলো নিয়ে ক্যাম্পে পৌঁছোতে সন্ধে হয়ে যাবে। আমরা সশস্ত্র হলেও অন্ধকারে ওই দ্বীপে ঠিক কী ধরনের বিপদ দেখা দেবে— সেটা বুঝতে পারছিলাম না। তাই আমিও মালপত্র কাঁধে, আর বন্দুকটা হাতে নিয়ে ক্যাম্পের দিকে এগোলাম দিয়েগো’র পিছু-পিছু।

ঠিক কেন যে পিছনে ফিরেছিলাম— জানি না। হয়তো যাওয়ার আগে সেদিনের মতো শেষবারের জন্য আমি রাস্তাটাকে একবার দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেদিকে তাকাতেই আমি স্পষ্ট দেখলাম, গাছের ছায়ার মধ্যে রাস্তাটায় দাঁড়িয়ে লুন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে!

আমি এতটাই অবাক হলাম যে কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারলাম না। এখন বলে বোঝাতে পারব না, তবে সেই মুহূর্তে আমার শুধু মনে হচ্ছিল— লুনের ডাকে আমায় সাড়া দিতেই হবে! অথচ একটা অন্যরকম অনুভূতিও আমার ভেতরে কাজ করছিল। শুধু যে লুনের পক্ষে ওইসময় ওখানে থাকা অসম্ভব—তাই নয়। লুনের শরীরটাও পুরোপুরি স্পষ্ট লাগছিল না! মনে হচ্ছিল, যেন সবুজ অন্ধকারের মধ্যে অজস্র দানা একত্র হয়ে রয়েছে ওর গায়ে— যার ফলে ওর শরীরের বাইরের রেখাটা কেমন যেন ভেঙে-ভেঙে যাচ্ছিল।

আর... আমি আবার সেই গুঞ্জনধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলাম!

‘ডাক্তার!’ দিয়েগো’র ডাক শুনে চমকে আবার পিছনে ফিরলাম, ‘কী দেখছ? পা চালাও। ক্যাম্পে জল কিন্তু সকালেই ফুরিয়ে এসেছিল।’

‘কিন্তু লুন যে ওখানে...!’ বলে আমি ওকে রাস্তাটা দেখানোর জন্য ঘুরলাম। দেখলাম, রাস্তায় কেউ নেই। শুধু ছায়ার মধ্যে অনেকগুলো চলমান বিন্দু আর তাদের ডানার ভনভন শব্দ তখনও রয়ে গেছে।

হাঁ করে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। কী দেখলাম— সেটা তাও বুঝতে না পেরে আবার পিছনে ফিরলাম। তারপর মাথা নিচু করে হাঁটা লাগালাম দ্বীপের অন্য প্রান্তে— আমাদের ক্যাম্পের উদ্দেশে।

বুঝতে পারছিলাম, সলিল-সমাধি থেকে বাঁচলেও আমরা একটা অন্যরকম ফাঁদে পড়েছি!

 

জলভরা ভারী পাত্রগুলো নিয়ে ফিরতে সময় লাগছিল। তবু আমরা দু’জন যত দ্রুত সম্ভব ক্যাম্পের দিকে এগোচ্ছিলাম। সূর্য ঢলে পড়ছিল পশ্চিমে। সমুদ্রের গর্জন, হাওয়ার শনশন, কমলা আকাশ— এ-সব দেখে অন্যসময় মনটা খুশিয়াল হত। কিন্তু পাখির ডাকের অভাব বুঝিয়ে দিচ্ছিল, আমরা যেখানে আছি সেই জায়গাটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। ঠিক কী ধরনের বিপদ আসতে পারে— তা আন্দাজ করতে পারছিলাম না৷ মন বলছিল, আমরা সবাই খাদ্যে বিষক্রিয়া বা দ্বীপের বাতাসে কিছু একটার উপস্থিতির ফলে হ্যালুসিনেট করছি। যেহেতু এখানে আসার পর আমরা সঙ্গে আনা টিনের খাবার আর জল ছাড়া কিছুই খাইনি, তাই বিষক্রিয়ার ব্যাপারটা বাতিল করতে হল। আমি আর এই মাল্লা ঝর্ণার জল খেয়েছি বটে, কিন্তু আমার একারই কেন এই ‘দৃষ্টিভ্রম’ হল?

তলিয়ে ভাবতে পারছিলাম না৷ পাহাড় আর জঙ্গলের দিক থেকে আসা ওই অদ্ভুত গুঞ্জন আমার মাথার মধ্যে সব এলোমেলো করে দিচ্ছিল। চুপচাপ হাঁটতে-হাঁটতে যখন ক্যাম্পের কাছে এসে পড়েছি, তখন আকাশের একটা দিক গাঢ় বেগুনি থেকে কালোই হয়ে এসেছে। একটু হলেও স্বস্তিবোধ করছিলাম। মনে-মনে ভাবছিলাম, আজ মুস্তাফা’র সঙ্গে গলা মিলিয়ে একটা বাংলা গানই শোনাব সঙ্গীদের। এই অদ্ভুত দ্বীপে অন্তত নিজেদের ভেতরে পরিবেশটাকে হালকা না করলে আরও বড় বিপদ হতে পারে।

তখনই গুলির আওয়াজ পেলাম।

আমি আর দিয়েগো মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলাম। পরক্ষণেই আমরা জলের পাত্রগুলো বালির ওপর রেখে প্রাণপণে দৌড়োলাম ক্যাম্পের দিকে। আওয়াজটা ওখান থেকেই এসেছিল।

 

বালিয়াড়ি ওখানে কাস্তের মতো করে বেঁকে গেছিল। বাঁক পেরোনোর আগে হঠাৎ খেয়াল হল, ক্যাম্পের এই মুহূর্তে কী অবস্থা— তা আমরা জানি না। হঠাৎ আমাদের দেখে কেউ গুলি চালিয়ে দিলে মহাবিপদ। দিয়েগোও বোধহয় তেমন কিছু আশঙ্কা করে নিজের দৌড় থামিয়ে আনছিল। ইশারায় কথাবার্তা সেরে ঠিক করলাম, একজন একটু উঁচু জায়গায় আড়াল খুঁজে ক্যাম্পের দিকে লক্ষ রাখবে। অন্যজন তখন আওয়াজ-টাওয়াজ তুলে ক্যাম্পের দিকে এগোবার ভান করবে। তাই করা হল। ক্র‍্যাক শট না হলেও বন্দুকের ব্যাপারে আমার নিশানা অনেকের চেয়ে ভালো। সেটা জানত বলেই বালিয়াড়ির ওপর আমি পজিশন নিলাম। নীচে দিয়েগো চিৎকার করে লুন আর মিনের নাম নিতে-নিতে এগোনোর ভান করল।

আবার দুটো গুলির শব্দ পেলাম— প্রায় একইসঙ্গে। মুখ বাড়িয়ে দেখলাম, মার্কোজ নামের একজন মাল্লা মাটিতে পড়ে আছে। তার হাত থেকে একটু দূরে ছিটকে গেছে একটা বন্দুক। ওর উপুড় হয়ে পড়ে থাকার ভঙ্গিটাই বলে দিচ্ছিল, ডাক্তার হিসেবে আমি লোকটার জন্য আর কিছু করতে পারব না। চট করে বাঁদিকে তাকিয়ে বুঝলাম, আমার সঙ্গীটি ঠিক আছে। মাথা নামিয়েই শুনলাম মিনের গলা, ‘তোমরা বেরিয়ে আসতে পার। আর ভয় নেই।’ দেখতেও পেলাম, একটু দূরে বালির মধ্যে গেঁথে রাখা আমাদের নৌকোটার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে মিন আর মুস্তাফা।

আরেকটু দূরে, যেখানে জঙ্গল সমুদ্রের খুব কাছে এসে পড়েছে, সেখান থেকেও তখন বেরিয়ে এল লুন। লুনের অবস্থান দেখে মনে হল, উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মাল্লাটির ওই অবস্থার জন্য ওর হাতের বন্দুকটাই দায়ী।

আমি তাও বেরোতে পারছিলাম না। দিয়েগোও রাইফেল হাতে একেবারে তৈরি হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, অবিশ্বাস আর সন্দেহের বিষবাতাস আমাদের ওপর চেপে বসেছে। হঠাৎ বুঝলাম, বাতাস একেবারে থেমে গেছে। সমুদ্রও যেন পিছিয়ে যাচ্ছে দূরে। জঙ্গল আর পাহাড় থেকে আসা সেই ঝিম-ধরানো গুঞ্জন ছাড়া আর কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছি না।

কী হচ্ছে এখানে? ব্যাপারটা বোধগম্য না হলেও আমি চিৎকার করে বললাম, ‘মুস্তাফাকে পাঠাও। জলের পাত্রগুলো নিয়ে যেতে সুবিধা হবে।’

মন বলছিল, এই রক্তাক্ত আর দুর্বোধ্য নাটকের মানে বুঝে বেঁচে থাকতে গেলে ওই ছেলেটাকে আমার দরকার হবে। একটু পরে মুস্তাফা ভয়ে-ভয়ে বালিয়াড়ির এ’পাশে মুখ বাড়াল। কথা না বাড়িয়ে আমি ওকে ইশারায় সঙ্গে আসতে বললাম। দিয়েগোও সঙ্গে আসতে চাইছিল, কিন্তু আমি ওকে আটকালাম। ইশারায় বোঝালাম, পেছন থেকে দুই সশস্ত্র দুশমন, সে তারা পাগল হোক বা স্রেফ লোভী বা শয়তান, হামলা করলে আমরা একেবারে ‘সিটিং ডাক’ হয়ে পড়ব। দিয়েগো আমার যুক্তি বুঝে বন্দুক হাতে বালিয়াড়ির ওপর রইল। আমি আর মুস্তাফা জলের পাত্রগুলো নিতে এগোলাম।

‘কী হয়েছিল ক্যাম্পে?’ আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম। মুস্তাফা যা বলল তা শুনে আমার মাথা একেবারেই গুলিয়ে গেল।

 

স্মোক-সিগনালের জন্য কাঠ জোগাড় করার দরকার ছিল। লুন সুং-কে বলেছিল, ও যেন জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কেটে আনে। রাতের ঘটনার পর সুং একা যেতে চাইছিল না। তখন মিন বলেছিল, ও সুং-এর সঙ্গে যাবে রাইফেল নিয়ে। মনের মতো শুকনো কাঠ খুঁজতে-খুঁজতে ওরা দু’জন জঙ্গলের একেবারে গভীরে চলে গেছিল। সেখানে ওরা একটা ভাঙা মন্দির দেখেছিল।

‘মন্দির!’ আমি অবাক হয়ে গেলাম। পূর্ব এশিয়ার বহু দ্বীপেই যে ভারতবর্ষের উজ্জ্বল ইতিহাস আর সংস্কৃতির ছাপ আজও রয়ে গেছে— এটা আমি জানি। কিন্তু সুলু সাগরের এই দ্বীপে মন্দির কে বানিয়েছিল?

মুস্তাফা মাথা নেড়ে বলল, ‘মিন তাই বলেছে। ওর ভুল হবে না। ও অনেক মন্দির দেখেছে। এটা কালচে-সবুজ পাথর দিয়ে বানানো— সারা গায়ে অজস্র নকশা। এইরকম ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত মন্দিরেও এমন সব মূর্তি পাওয়া যায়, যেগুলো বেচলে ভালো পয়সা আসে। কাঠ ছেড়ে, বরং ওইরকম মূর্তির সন্ধানে ওরা দু’জন মন্দিরে ঢুকেছিল।’

‘তারপর?’

‘মন্দিরের মধ্যে দিনের বেলাতেও ঘন অন্ধকার ছিল। যা পেল তাই দিয়েই একটা মশাল বানিয়ে ওরা ভেতরটা দেখার জন্য ঘোরাঘুরি করছিল। সুং পেছনে ছিল। তখনই মিন শুনতে পেল, সুং কাকে যেন ‘আসছি।’ বলে মন্দির থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর ও আর ফিরে আসেনি!’

‘মানে?’ আমি সত্যিই অবাক হলাম, ‘মিন-কে ওভাবে মন্দিরে ছেড়ে সুং বেরিয়ে গেল?’

‘হ্যাঁ।’ মুস্তাফা বলল, ‘মিন বলছিল, মন্দিরের মধ্যে কোনো মূর্তি-টুর্তি ছিল না। তবে দেওয়ালে অনেক নকশা ছিল। ওর খুব অস্বস্তি লাগছিল বলে ও একটু পরেই মন্দির থেকে বেরিয়ে এসেছিল। এদিকে সুং যেখানেই যাক না কেন, ও তাকে ফেলে যেতে পারছিল না। অনেকক্ষণ ওর জন্য অপেক্ষা করেছিল মিন। আলো কমে আসছে বুঝে ডাকাডাকিও করেছিল। শেষে একরকম বাধ্য হয়ে ও একা, কয়েকটা ছোটখাটো গাছের ডালপালা কেটে ক্যাম্পে ফিরে এসেছিল।’

‘শুধু ‘আসছি’ বলে একেবারে চলে গেল!’ আমার অবাক ভাবটা কমেনি, ‘ওকে কি কেউ ডেকেছিল?’

মুস্তাফা ঢোঁক গিলল। বুঝলাম, ওর ভেতরে একটা যুদ্ধ চলছে। কথাটা ও আমাকে বলবে, না চুপ করে থাকবে— সেই নিয়ে ও কতক্ষণ ভাবত, কে জানে। খোলাখুলি বললাম, ‘সত্যিটা জানার ওপর আমাদের বাঁচা-মরা নির্ভর করছে। তাই কিছু দেখে থাকলে আমাকে বলো।’

‘ক্যাপ্টেন ওকে ডেকে থাকতে পারে।’ গলার আওয়াজটা একেবারে খাদে নামিয়ে বলল মুস্তাফা, ‘আমি জানি, লুন জঙ্গলে ঢুকেছিল।’

আমার মাথার মধ্যে একটা আশঙ্কার মেঘ হঠাৎই একেবারে ঘোর কালো হয়ে উঠল। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এটা কাউকে বলেছিলে?’

মুস্তাফা সজোরে মাথা নাড়ল। কিন্তু ওকে ঢোঁক গিলতে দেখে বুঝলাম, ওর আরও কিছু বলার আছে। ততক্ষণে আমরা বালিয়াড়ির ওই বাঁকটার কাছে এসে পড়েছিলাম। দিয়েগো ওপর থেকে নেমে এসে নিচু গলায় বলল, ‘ক্যাপ্টেন আর মেট তো একে অপরকে একেবারে মাপছে। মনে হচ্ছে, সুযোগ পেলেই ওরা অন্যজনকে শেষ করে দেবে।’

মুস্তাফা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। তারপর বলল, ‘আমরা কেউ বেঁচে ফিরব না এখান থেকে।’

আমি ওকে একটু সামলে নেওয়ার সময় দিলাম। তারপর বললাম, ‘ক্যাপ্টেন আর মেট নিজেদের দিকে তাকিয়ে থাকুক। তুমি বলো তো, আমরা আসার একটু আগে কী হয়েছিল এখানে?’

জল-টল খেয়ে নিজেকে সামলে নিল মুস্তাফা। তারপর চোখ মুছে বলল, ‘আমি আর হাও— মানে যে মাল্লা এখন মরে পড়ে আছে — নৌকোটা পরিষ্কার করে রাখছিলাম। আমাদের দু’জনেরই মনে হয়েছিল, খুব কম সময়ের নোটিশে দ্বীপ ছেড়ে পালানোর দরকার হতে পারে।’

‘এক মিনিট!’ দিয়েগো বলে উঠল, ‘লুন তখন কোথায় ছিল?’

‘ক্যাপ্টেন তো প্রথমে সাগরপারেই ছিল।’ বলল মুস্তাফা, ‘আমাদের সঙ্গে যা রসদ আছে, তাই দিয়ে ক’দিন চালানো যাবে— সেই হিসেব করছিল। আমার মনে হয়, কীভাবে এই দ্বীপ ছেড়ে পালানো যায়, সেটাও ও ভাবছিল। নইলে হাওয়ার মুখ আর সূর্যের ওঠানামা এত খুঁটিয়ে দেখছিল কেন? ও নির্ঘাত জোয়ার এলেই পালানোর তাল করেছিল!’

‘তারপর?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। আকাশের শরীর থেকে শেষ আলোটুকু তখন খুব তাড়াতাড়ি ঝরে পড়ছিল সমুদ্রের বুকে। টের পাচ্ছিলাম, হাওয়া তখনও স্থির, কিন্তু জল-স্থল-অন্তরীক্ষ জুড়ে আবার উঠতে শুরু করেছে সেই গুঞ্জনধ্বনি।

‘হঠাৎ দেখলাম, জঙ্গলের দিকে ঘুরে লুন হাত নেড়ে কাকে যেন ইশারা করছে। আমি আর হাও অবাক হলাম। জঙ্গলের মধ্যে গাছের ছায়ায় অন্ধকার হয়ে থাকা ওই জায়গাটায় আমরা কাউকে দেখতে পাইনি।’

মুস্তাফা’র শেষ কথাটা কাঁপা শোনাল। ঝর্ণার কাছে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেটা মনে পড়ে গেল বলে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাউকে দেখনি? তাহলে কি অন্য কিছু দেখেছিলে?’

ছোকরা আবার কাঁদতে শুরু করল। কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, ‘দেখেছিলাম। বোধহয় হাও-ও দেখেছিল।’

‘কী?’ আমি আর দিয়েগো সমস্বরে জানতে চাইলাম।

‘ওখানে বাতাসটা ভনভন করে কাঁপছিল।’ হেঁচকি তুলে বলল মুস্তাফা, ‘খুব গরম হলে বাতাস ওর’ম কাঁপে। বা... অনেক পোকা একসঙ্গে ভনভন করলেও মনে হয়।’

‘পোকা?’ দিয়েগো চোখ কপালে তুলল, ‘লুন পোকা দেখতে গেছিল?’

‘না-না!’ মুস্তাফা’র চোখের সাদা অংশটা ওই প্রায়ান্ধকার সৈকতে ভারি অদ্ভুত দেখাচ্ছিল, ‘আমার মনে হয়েছিল, ওই ভনভন করা বাতাস... বা পোকাগুলো জুড়ে গিয়ে একটা মানুষের আদল নিয়েছে।’

‘কার?’ উত্তরটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। পো, সুং— এরা মাত্র একজনের ডাকেই সাড়া দিয়ে নিজের অবস্থান ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকতে সাহস পাবে। মুস্তাফা’র ফিসফিস করে বলা উত্তর আমার ধারণাকেই সমর্থন জানাল— ‘ক্যাপ্টেন লুন!’

‘তারপর কী হল?’ আমি অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম। না, শুধু অধৈর্য নয়— আমি আসলে ভয় পাচ্ছিলাম। লুন-কে আমি যতটা চিনি তাতে তাকে এইরকম খুনি বলে মনে হয়নি। ভেতরে-ভেতরে দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম এই ভেবে যে মানুষ চিনতে এত বড় ভুল করলাম কীভাবে?

‘লুন কখন জঙ্গল থেকে বেরোল— আমি বা হাও দেখিনি।’ মুস্তাফা বলছিল, ‘তবে একটু আগে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে মিন যখন আমাদের ডাকাডাকি করছিল, তখন ও সেখানে এসেছিল। কেন জানি না, মনে হয়েছিল, যেন সুঙের ওই ‘হারিয়ে যাওয়ার’ কথা শুনে লুন খুব একটা অবাক হয়নি। তাতেই বিপদ হল!’

‘হাও!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল দিয়েগো, ‘এখানে আসার পর থেকেই ও খুব ভয় পেয়ে গেছিল। নির্ঘাত ও নিজেকে সামলাতে পারেনি।’

‘ঠিক তাই।’ বলল মুস্তাফা, ‘ও হঠাৎ লুন-কে শাসাতে শুরু করল। বলতে লাগল, লুন জেনেবুঝে সবাইকে এই দ্বীপে নিয়ে এসেছে টিটেনাসে মারবে বলে!’

‘টিটেনাস!’ আমি চমকে উঠলাম, ‘মানে বিষক্রিয়া টাইপের কিছুর কথা বলছিল নাকি হাও?’

‘জানি না।’ হতাশভাবে মাথা নাড়ল মুস্তাফা, ‘হাও এই কথা বলার পর ও আর লুন— দু’জনেই এত গরম হয়ে গেল যে আমি আর মিন ওদের সামলাতেই পারছিলাম না। তার মধ্যে হাও হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে একটা রাইফেল তুলে আমাদের শাসাতে লাগল। প্রাণের ভয়ে আমি আর মিন নৌকোর আড়ালে লুকোলাম। লুন দৌড়োল জঙ্গলের দিকে। হাও ওর দিকে তাক করে গুলি চালিয়েছিল, তবে লাগাতে পারেনি। তারপরেই তো তোমরা এলে।’

‘হাও তো আমাদের দিকেও গুলি চালিয়েছিল।’ মাথা নেড়ে বলল দিয়েগো।

‘তেষ্টা আর ভয় ওর মাথা খারাপ করে দিয়েছিল।’ আমি বললাম, ‘ও যখন এই বালির স্তূপের দিকে ঘুরেছিল, তখনই লুন ওকে গুলি করেছিল।’

‘এখন আমরা কী করব?’ মুস্তাফা আবার ফোঁপাতে শুরু করল।

‘আজ রাত্তিরটা আমাদের খুব সাবধানে কাটাতে হবে।’ আমি বললাম, ‘এই দ্বীপে যতক্ষণ আছি, কেউ কাউকে সেভাবে বিশ্বাস করতে পারব বলে মনে হয় না। সতর্ক থাকাটা তাই বড্ড জরুরি।’

আমরা তিনজন জল আর অস্ত্র ভাগাভাগি করে ক্যাম্পের দিকে এগোলাম।

*

“সুলু সাগর মানে তো অনেকটা দূর।” শৈবাল খুঁতখুঁত করছিল, “ফিলিপিন্সে ভারতীয় উপনিবেশ জাতীয় কিছু কখনও হয়েছে বলেও তো শুনিনি।”

“মন্দির মানেই যে ভারতীয় হবে, তার কোনো মানে নেই।” দীপা বলল, “মাজাপহিত সাম্রাজ্য ভারতীয় ছিল না। ওটা কিন্তু নিউ গিনি অবধি মোট আটানব্বইটা দেশ বা রাজ্য জুড়ে ছিল। চিনের মিং বংশের হয়ে অ্যাডমিরাল ঝেং হে ওই এলাকায় নৌ-অভিযান চালিয়েছিলেন। ভারতের হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রভাব কমানোর জন্য তিনি ওই অঞ্চলে ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছিলেন। নইলে আমরা গোটা দক্ষিণ-পূর্ব আর পূর্ব এশিয়াতেই হিন্দু-বৌদ্ধ সংস্কৃতি পেতাম। ওই সভ্যতার অবশেষ শুধু বালিদ্বীপে সীমাবদ্ধ থাকত না।”

দীপা’র জ্ঞানের বহর দেখে, বা আরও সঠিকভাবে বললে শৈবালকে চুপ করে যেতে দেখে প্রচুর আনন্দ পেলাম। ঝুমা অবশ্য ও-সব নিয়ে মাথা ঘামায়নি। ও বলল, “তারপর কী হল? বলুন না শিশিরদা!”

*

‘আর কতবার বলব?’ লুনের পাথুরে গলাতেও ক্লান্তির ছোঁয়া লেগেছিল, ‘আমি ওই মন্দিরের কাছে যাইনি। জঙ্গলে ঢুকেছিলাম ছায়ায় বসব বলে— ব্যস, এটুকুই।’

‘তোমাকে কেউ ডাকেনি?’ মুস্তাফা’র বলা কথাটা মনে ছিল আমার, ‘পো, সুং— এদের তো কেউ ডেকেছিল।’

‘সেটা অন্য কেউ বলেছে।’ আগুনের আভায় লুনের চোখে একটা শয়তানি ভাব দেখছিলাম, ‘মিন বলেছে, কেউ সুং-কে ডেকেছিল। সুং-ও হয়তো কারও কথা শুনে ও-সব বলছিল। এমন কেউ হয়তো ওদের এইসব বলতে বলেছিল, যে আমার দল, আমার কাছে রাখা গ্রে পার্ল— সব হাতাতে চায়। তুমিই বলো না ডাক্তার, এরকম ব্যাখ্যাও তো দেওয়া যায়, তাই না?’

মিনের নাকের পাটা ফুলে উঠল। সভয়ে দেখলাম, লুন আর মিন— দু’জনেই রাইফেলের বাঁটে হাত রেখেছে। একরকম চেঁচিয়ে বললাম, ‘তোমরা মাথা ঠান্ডা করে একটু ভাববে? অন্তত আমাকে ভাবতে দেবে?’

‘আমরা কি আজ রাতটা নৌকোয় কাটাব?’ কাতরকণ্ঠে বলল দিয়েগো, ‘এখানে সব কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। হাওয়া থেমে গেছে। সমুদ্র সরে গেছে দূরে। কোনো আওয়াজ নেই... শুধু ওই ভনভন ছাড়া! আমার ভালো লাগছে না একদম।’

ভনভন!

আমি মিনের দিকে ঘুরে বললাম, ‘ওই মন্দিরে তুমি কী দেখেছিলে?’

‘মন্দিরটা...’ শুকনো ঠোঁট চেটে নিল মিন, ‘ফাঁকা। মানে অনেক দ্বীপেই আমি এমন পরিত্যক্ত মন্দির দেখেছি, যেখান থেকে দেবতার মূর্তি তুলে বেচে দিয়েছে এই লাইনের লোকজন। কিন্তু এখানে কোনো বেদি বা ফাউন্ডেশনও দেখিনি।’

‘তাহলে ওখানে কী ছিল?’ মুস্তাফা জিজ্ঞেস করল, ‘মেঝে বা দেওয়ালে কোনো নকশা ছিল?’

বাংলার ছেলে হিসেবে মুস্তাফা জানত, লুঠপাটের শিকার বা অন্যভাবে অপবিত্র হয়ে যাওয়া মন্দির থেকে অনেকসময় মূর্তি সরিয়ে নেওয়া হয়। তার বদলে সেখানে নানারকম নকশা বা ‘যন্ত্র’ এঁকে পুজো-আচ্চা করেন কোনো-কোনো সাধক।

‘নকশা!’ একটু চমকে উঠল মিন, ‘দেওয়াল তো নকশা দিয়েই ভর্তি ছিল একেবারে। তবে সেগুলো... নড়ছিল।’

‘মানে!’ আমরা সবাই, এমনকি লুন-ও বলে উঠল।

‘মশালের আলো খুব একটা জোরালো ছিল না।’ থেমে-থেমে বলছিল মিন ‘তাতেও বেশ বুঝতে পারছিলাম, একটু আগে দেওয়ালে নকশাগুলো যেমন ছিল, পরে তেমন থাকছিল না। মনে হচ্ছিল, হাতে ধরা আলোটা অন্যদিকে ঘুরলেই সরসর করে একটা আওয়াজ তুলে নকশাগুলো যেন বদলে যাচ্ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, অসংখ্য চোখ মেলে কারা যেন আমাকে দেখছে! এত অস্বস্তি... ভয় হচ্ছিল যে আমি মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম।’

আমরা কেউ কিছু বলতে পারছিলাম না। হঠাৎ লুন সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি ওই মন্দিরটা একবার দেখতে চাই।’

সবাই হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। লুন ভ্রূক্ষেপ করল না। একইরকম ঠান্ডা, কেঠো ভঙ্গিতে বলল, ‘জল এখন যতই পিছিয়ে যাক, ভোরের আগে জোয়ার আসবেই। তখন আমাদের ভেসে পড়তে হবে। তার আগে আমি ওই মন্দিরে গিয়ে ব্যাপারটা ভালোভাবে দেখব।’

‘কী দেখার আছে আর?’ হতাশ গলায় বললাম, ‘আমরা সবাই হয় ভুল দেখছি, নয় ভুল শুনছি। মনে হয়, যে ঝর্ণা থেকে আমি আর দিয়েগো জল এনেছিলাম, তার উৎসের কাছে ভলক্যানিক রক বা ওইরকম কিছু আছে। তার বিষক্রিয়া থেকেই এই দ্বীপের সমস্ত পশুপাখি মারা পড়েছে। এখন আমরাও তার পাল্লায় পড়েছি।’

‘হতে পারে।’ একগুঁয়ের মতো করে বলল লুন, ‘কিন্তু আমার দু’জন মাল্লার কী হয়েছে— সেটা না বুঝে আমি কোথাও যাচ্ছি না। ওদের যে গায়েব করেছে, তার বুদ্ধি আছে। এই দ্বীপে এখনও অবধি আমরা একমাত্র যে জিনিসটার সঙ্গে বুদ্ধি বা কৌশলের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছি, তা হল ওই মন্দির। ওটা ভালোভাবে দেখা দরকার। তাছাড়া, আমরা এর মধ্যেই প্রায় সব হারিয়েছি। পরের সফরের আগে টাকাপয়সা জমাতে গেলে ওই মন্দিরের গায়ে যে নকশা-কাটা পাথর আছে— সেটাই বেচতে হবে আমাদের।’

‘গ্রে পার্ল তো আছে।’ মুস্তাফা বলে ফেলল। লুন মাথা নাড়ল। কম্পমান শিখার সামনে মাথা নিচু করে বসা লুনের রোগা, ফর্সা, দীর্ঘনাসা চেহারাটা দেখে আমার হঠাৎ মনে হল, যেন কতশত বছরের পুরোনো চামড়া টানটান করে জড়ানো রয়েছে একটা শরীরের ওপর। সেভাবে বসেই ও মোজার ভাঁজ থেকে বের করে আনল একটা ছোট্ট থলি। সেটার মুখ খুলে ও নিজের হাতের তেলোয় ঢালল... মাত্র চারটে বাদামি রঙের মুক্তো!

‘এই দিয়ে আমাদের কী হবে, মিন?’ লুনের গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ল, ‘পাওনাদারদের হিসেব মিটিয়ে যা থাকবে তাই দিয়ে নতুন করে একটা জাংক জোগাড় করাই তো কঠিন হবে।’

আমরা সবাই আগুনের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম কিছুক্ষণ। খিদে পাচ্ছিল না। জলের থলি আর রাইফেল— এই দুটো জিনিস শুধু আমরা কেউ হাতছাড়া করছিলাম না। লুনের যুক্তিটা ফেলে দিতে পারছিলাম না। এদিকে অন্ধকার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে, ওই ভনভনানি শুনতে-শুনতে এগোনোর কথা ভাবতেই শিউরে উঠছিলাম। হঠাৎ মনে পড়ল, ঝর্ণার কাছে আমি পায়ে-চলা একটা পথ দেখেছিলাম— যেটার শেষে মন্দিরটা থাকাই স্বাভাবিক।

কথাটা ওদের বলতেই লুন লাফিয়ে উঠল। দেখলাম, লোভে হোক বা ভয়ে— দিয়েগো, এমনকি মিনও লুনের কথাটা মেনে নিল। ঠিক হল, ওরা তিনজন প্রথমে ঝর্ণার কাছে, তারপর সেখান থেকে মন্দিরে যাবে। বন্দুক তো বটেই, সঙ্গে আগুন জ্বালানোর মতো মালমশলা নিয়েও এগোবে ওরা।

সমুদ্রের তীরে থাকব শুধু আমি আর মুস্তাফা।

জোয়ার আসার উপক্রম হলে আকাশের দিকে গুলি ছুড়ে সংকেত দিতে বলা হল আমাকে। এও বলা হল, তেমন হলে আমরা দু’জন যেন নৌকোটা ভাসিয়ে ওই পাথুরে জায়গাটা পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।

‘তুমি লোভী নও ডাক্তার।’ লুনের গলাটা বরফের চেয়েও ঠান্ডা শুনিয়েছিল, ‘অ্যাডভেঞ্চার করতে এসে তুমিও আমাদের সঙ্গে মরলে ভালো হবে না। বরং বেঁচে থেকো। গরিব-দুঃখীদের পাশে থেকো।’

আমি কিছু বলতে পারিনি। মিন আর দিয়েগো’র দিকে তাকিয়ে বুঝেছিলাম, লোভ আর একটা মরিয়া ভাব ওদের মধ্যে ছড়িয়ে গেছে আগুনের মতো। মাথা নেড়ে লুনের কথায় সায় দিয়েছিলাম। আর হ্যাঁ, ওরা অন্ধকারে মিলিয়ে গেলে বালি খুঁড়েই হাও-কে কবর দিয়েছিলাম।

তারপর শুরু হয়েছিল আমাদের প্রতীক্ষা।

 

দূরে সমুদ্রের গর্জন আর কাছে বাতাসে সেই গুঞ্জন শুনতে-শুনতে একটা তন্দ্রালু ভাব এসেছিল। মুস্তাফা’র ধাক্কায় চটকা ভেঙে দেখলাম, পুবদিকের আকাশ পাতলা হয়ে আসছে। সমুদ্রও আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে— জোরে, আরও জোরে!

মুহূর্তের মধ্যে বুঝে গেলাম, শুধু জোয়ার নয়। অন্য কিছু ঘটতে চলেছে এই দ্বীপে। ওই অবস্থাতেও মনে হল, লুনের আদেশ অলঙ্ঘ্য।

আকাশের দিকে রাইফেল উঁচিয়ে গুলি করলাম— পরপর দু’বার। নিস্তব্ধ দ্বীপে শব্দটা যে বহুদূর অবধি পৌঁছোবেই— এ-ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। এবার অন্য কাজে মন দিলাম। নৌকোটাকে শক্ত অথচ মোটামুটি মসৃণ বালির ওপর তৈরিই রেখেছিলাম। মুস্তাফাই দেখাল, কীভাবে নৌকোটা ঠেলতে হবে। আমি ওর কথামতো হাত লাগালাম। কোনাকুনি এগিয়ে নৌকোটা জলের মধ্যে ঠেলে দিয়েই আমরা সেটাকে জাপটে ধরে ভেসে পড়লাম।

নোনাজলে হাবুডুবু খেতে-খেতেও নৌকোর গায়ে বাঁধা দড়ি ছাড়িনি আমরা। একটু পর জলের গর্জনের মুখ বদলাল। আমরা মাথা তুলে দেখলাম, সূর্য উঠছে। তীর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে আমাদের নৌকো। আর...

তীরে দাঁড়িয়ে, লাফিয়ে, হাত-পা নেড়ে আমাদের ডাকছে লুন— একা!

‘নৌকো ঘোরাতে হবে!’ আমি চিৎকার করে বললাম মুস্তাফাকে, ‘ওকে ফেলে যেতে পারব না আমরা।’

একগুঁয়ে ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল মুস্তাফা। আমার হঠাৎ ভীষণ রাগ হল— অসহ্য, হিংস্র রাগ! মুস্তাফাকে একটা ঘুষি মারব বলে হাত মুঠো করে দেখলাম... ছেলেটা কাঁদছে! নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁড় বের করে একাই প্রাণপণে চেষ্টা করতে থাকলাম তীরের দিকে যাওয়ার। লুনও তখন জল ঠেলে আমাদের দিকে আসছিল।

লুন যখন নৌকোর পাশেই এসে পড়েছে, তখন মুস্তাফা কেমন যেন কুঁকড়ে গেল। আমি ওকে বললাম, ‘হাত বাড়িয়ে লুন-কে তোলো!’

মুস্তাফা ইতস্ততভাবে হাত বাড়াল। তারপর... ঠিক কী হল, বুঝলাম না। মনে হল, লুনের শরীরটা ভেঙে গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে গেল। টাল সামলাতে না পেরে জলে পড়ে গেল মুস্তাফা। আমি চিৎকার করে উঠলাম। একটা বিরাট ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকোটা তখনই আবার সোজা হল, তারপর হু-হু করে ছুটে চলল সমুদ্রের দিকে।

আমি দেখলাম, ভোরের বাতাস আর জলের ছাঁট চোখের সামনে জমাট বেঁধে একটা রোগা, লম্বা মানুষের চেহারা তৈরি করল। সেই চেহারায় ফুটে উঠল একটা ধারালো নাক আর দুটো কুচকুচে কালো চোখ।

লুন আমার দিকে তাকিয়ে হাসল।

*

“তারপর?” প্রশ্নটা করতে গিয়ে বুঝলাম, গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছিল ততক্ষণে।

“মার্কিন নেভি-র একটা পেট্রল শিপ নৌকোটাকে খুঁজে পেয়েছিল।” বললেন শিশিরদা, “খিদে-তেষ্টায় ডক্টর দত্ত’র অবস্থা তখন শোচনীয়। ঠিক কতদিন উনি বেহুঁশ হয়ে নৌকোয় ভাসছিলেন— সেটাও ওঁর খেয়াল ছিল না।”

“আর লুন?” ঝুমা জিজ্ঞেস করল, “তার কী হয়েছিল?”

“নৌকোয় আর কেউ ছিল না।” শিশিরদা বললেন, “ডক্টর দত্তের কথাকে নেভি খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। আসলে নেভির মানচিত্র অনুযায়ী সুলু সাগরের ওইরকম জায়গায় কোনো দ্বীপই ছিল না। পুরো ব্যাপারটাকেই জাহাজডুবির পর জলে ভাসতে-ভাসতে খিদে, তেষ্টা, রোদের প্রকোপ— এর ফলে হওয়া হ্যালুসিনেশন বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সুবীরও এই নিয়ে জোরাজুরি করেননি। নিজের কাজের জায়গায় ফিরে আসার পর উনি স্রেফ ডাক্তারিতে মন দিয়েছিলেন।”

“ওই ভনভন আওয়াজটা কীসের ছিল?” দীপা সোজা হয়ে বসে জানতে চাইল, “পোকার?”

“টিথোনাস!” কথাটা বলে উত্তেজনার বশে শৈবাল নিজের হাতের তেলোয় একটা ঘুষি মেরে আর্তনাদ করে উঠল। তারপর সামলে নিয়ে বলল, “ওই... কী যেন নাম... হাও! ও ‘টিটেনাস’ বললেও আসলে ‘টিথোনাস’ বলতে চেয়েছিল।”

দীপা মাথা নেড়ে সায় দিল। আমি আর ঝুমা মুখ-চাওয়াচাওয়ি করে একসঙ্গে বললাম, “টিথোনাস?”

“গ্রিক কিংবদন্তি অনুযায়ী সিকাডা— মানে ঝিঁঝি জাতীয় পোকাদের দেবতা।” দীপা বলল, “আমাদের কিংবদন্তিতে যেমন আছেন ঊষা, গ্রিকদের তেমন আছেন ইও। তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন এক নশ্বর— টিথোনাস। বিনিময়ে তিনি সামান্য দৈবশক্তি আর অমরত্ব পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা তাঁর কাছে এসেছিল অভিশাপ হয়ে।”

“কেন?” আমি বললাম, “অমরত্ব অভিশাপ হবে কেন?”

“কারণ,” শৈবাল একটা বড় শ্বাস নিয়ে বলল, “টিথোনাস অমরত্ব পেয়েছিলেন। কিন্তু চিরযৌবন পাননি।”

এক মুহূর্তের জন্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা লম্বা, ফর্সা, দীর্ঘনাসা হাড়সর্বস্ব শরীর— যা সুবীর দত্তের অবচেতনেও ধরা দিয়েছিল।

“লুন!” আমি রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠলাম, “তাহলে ওই নিয়ে গেছিল বাকিদের ওই দ্বীপে। কিন্তু কেন? মারবে বলে? তাতে ওর তো কোনো লাভ হত না।”

“সব দেবতা বলি চায়।” বাইরের ঝিমঝিম করা রাতের দিকে চেয়ে বললেন শিশিরদা, “অমরত্ব তো এমনি-এমনি রাখা যায় না। তার জন্য দাম দিতে হয়। হয়তো ওই দেবতা এখনও তেমন বলি খুঁজে বেড়াচ্ছে।”

“সে আবার কী!” পিয়াদি বললেন, “তুমি কী বলতে চাইছ?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিশিরদা বললেন, “এই ফোল্ডারটা কেনার সন্ধ্যায় অকশন হাউজে আমি একজনকে দেখেছিলাম। মানুষটি লম্বা, ফর্সা, ভীষণ রোগা। কুঁচকানো চোখ, চওড়া কপাল, টিকালো নাক— এগুলো দেখে বুঝতে পারিনি, কোন দেশের লোক সে, বা তার বয়স কত। আমার লোকটাকে মনে আছে একটাই কারণে। এই ফোল্ডারটা আমি হস্তগত করার পর কেউই আমার দিকে সেভাবে তাকিয়েও দেখেনি। কিন্তু লোকটা দেখেছিল। আমার চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসেছিল লোকটা।”

 

ফিনাইল আর মপ রাখার কোণ থেকে একটা ঝিঁঝি ডেকে উঠল তখনই। আমরা আলো-জ্বলা ঘরেও কণ্টকিত হয়ে বসে রইলাম।