ডি এন এ, জিনকাটা কাঁচি আর তিন বিদুষী ● সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

ডি এন এ, জিনকাটা কাঁচি আর তিন বিদুষী
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

 

কাট—ওয়ান

৯৬৮ সালে প্রকাশিত হল একটি সাড়া জাগানো বই— বেরোনো মাত্রই বেস্টসেলার। সাধারণত নোবেল লরিয়েটরা পপুলার সায়েন্সের বই লিখতে চাইতেন না, কারণ তাতে নাকি বিজ্ঞানের সঙ্গে সমঝোতা করতে হত। কিন্তু এই বইটা একটু অন্যরকম। বিশ্বের অন্যতম— হয়তবা বিংশ শতাব্দীর সর্বোতকৃষ্ট আবিষ্কারের একটা জীবন্ত দলিল।

বইটার নাম— “দ্য ডাবল হিলিক্স— আ পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট অফ দ্য ডিসকভারি অফ দ্য স্ট্রাকচার অফ ডি এন এ”।

লেখক— বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন। তিনি স্বয়ং, ফ্রান্সিস ক্রিক এবং মরিস উইলকিনস ১৯৬২ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ডি এন এ-র গঠন আবিষ্কারের জন্য। এই বই সেই আবিষ্কারের উৎকণ্ঠাময় দিনগুলির এক চলচ্ছবি। এই তিন প্রথিতযশা বিজ্ঞানীর কাজের ফিরিস্তির পাশে যেন নিতান্ত অনিচ্ছায় আরও একটা নাম টিমটিম করে উঠে এল— রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন। এক ব্রিটিশ মহিলা বিজ্ঞানী। জেমস ওয়াটসন ওঁর নাম এমনভাবে উল্লেখ করলেন তাঁর বইতে যেন মনে হল উনি সামান্য ল্যাব অ্যাসিটেন্ট ছাড়া আর কিছু ছিলেন না।

রোজালিন্ডের জীবনে এধরনের অবজ্ঞা নতুন কিছু নয়। এই নিয়েই তিনি বড় হয়েছিলেন। শুধুমাত্র মহিলা হওয়ার জন্য বঞ্চনা সহ্য করে গিয়েছেন তিনি সারাজীবন। মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে, ১৯৫৮ সালে দুরারোগ্য ক্যান্সারে মৃত্যু হয় এই বিদুষী বিজ্ঞানীর। তখন তাঁর নাম জানেন মাত্র গুটিকয়েক মানুষ। আর জানেন ওয়াটসন, ক্রিক এবং মরিস-এর মতন বিশেষ কয়েকজন। কিন্তু সত্য চাপা থাকে না— তাকে যতই লুকানোর চেষ্টা হোক না কেন। প্রতিভার বিচ্ছুরণ নিকষ একরাশ কয়লার মধ্যে হীরকখণ্ডের মতো ঠিকই নিজের জাত চিনিয়ে দেয়।

বিংশ শতক। পদার্থবিজ্ঞানে হয়ে চলেছে একের পর এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে আপেক্ষিকতা— ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন থেকে পরমাণু বিদীর্ণ করার অত্যাশ্চর্য সব কাজে বিজ্ঞানীরা মেতে উঠেছেন। বিশ্বের রহস্য ক্রমশ পরিষ্ফুট হচ্ছে বিজ্ঞানের কল্যাণে। কিন্তু তখনও অধরা প্রাণের রহস্য। কেন একটা কোষ বংশবিস্তার করে প্রতিলিপি তৈরী করে, কীভাবে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে জীবের বৈশিষ্ট্য নিখুঁতভাবে সঞ্চারিত হয়, কোষের মধ্যে কি সেই বিশেষ অণু যা কোষের জেনেটিক তথ্য সঞ্চয় করে রাখে? কী সেই বিশেষ অণু যা মানুষের বৈশিষ্ট্য ঠিক করে, মানুষের স্বভাব কীরকম হবে, তার গায়ের রঙ, চুলের রঙ, চোখের মণি কেমন হবে সব ঠিক করে দেয়? তাছাড়া একটাই বংশগতির ধারাতে হঠাৎ হঠাৎ করে নতুন প্রজাতি জন্মায় কী করে? এ ধরনের মিউটেশনের কারণ কী? এসব হাজারও প্রশ্ন বিজ্ঞানীদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। প্রাণ রহস্যের সামনে এ ছিল এক বিপুল প্রাকার যা অতিক্রম করতে পারলে ইতিহাসে অমর হওয়া সম্ভব। তাই বিজ্ঞানীরা মেতে উঠলেন জিনের গঠন নিয়ে নিরন্তর গবেষণায়।

বিজ্ঞানী মেন্ডেলের বংশগতির ধারণার পর কেটে গেছে প্রায় নব্বই বছর। বিজ্ঞানীরা জেনে গেছেন বংশগতির একক হল জিন। তারপরও তাঁরা ধন্দে ছিলেন যে এই জিনের উপাদান কী? প্রোটিন নাকি ডি এন এ?

আসুন একটু সহজ করে বুঝে নিই। নাহলে খেই হারিয়ে ফেলার প্রভূত সম্ভাবনা।

দ্য ডাবল হেলিক্স – ১৯৬৮ এডিশন

আমরা প্রায় সবাই জানি যে মানবদেহ, বা বলা ভালো জীবদেহ একগুচ্ছ কোষের সমষ্টি। যার দেহের আকার যত বড়, তার দেহে কোষের সংখ্যা তত বেশি। তা, সেই কোষের বাইরের অংশে থাকে কোষপর্দা বা মেমব্রেন। তার মধ্যে কোষের মূল হেড অফিস নিউক্লিয়াসটা সাইটোপ্লাজম নামের এক তরলের মধ্যে ভাসমান অবস্থায় থাকে। নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকে ক্রোমোজম— তেইশ জোড়া। মানে ছেচল্লিশটা। এই ক্রোমোজোমের মধ্যে বাইশ জোড়া হল অটোজম আর এক জোড়া সেক্স ক্রোমোজোম। মানে ওই একজোড়াই লিঙ্গ নির্ধারণ করে থাকে। দুটো এক্স (XX) হলেই তিনি মহিলা আর (XY) হলেই তিনি হলেন পুরুষ।

ক্রোমোজোমের গঠনগত উপাদান হল প্রোটিন এবং নিউক্লিক অ্যাসিড। বলা ভালো ডি অক্সি রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড বা ডি এন এ। এই ক্রোমোজোমের মধ্যে থাকে জিন। তাহলে নিয়ম অনুযায়ী সেটার উপাদানেরও হয় প্রোটিন হওয়া উচিত কিংবা ডি এন এ।

১৯২০ সাল থেকে ক্রমাগত বিজ্ঞানীরা মাথা চুলকেছেন এই সমস্যা নিয়ে। প্রোটিনের দিকে পাল্লা ভারি ছিল সমসময়েই, কারণ প্রোটিন জটিল অণু। প্রোটিন কোষের মধ্যে অনেক কাজকর্ম করে— প্রোটিন বিয়োজিত হয়ে শক্তি উৎপন্ন হয়। অতএব সবার নজর প্রোটিনেই টিকে ছিল বহুদিন। উল্টোদিকে ডি এন এ খুব একটা জটিল কিছু নয়। শর্করা, ফসফেট এবং কিছু নিউক্লিওটাইড বেস দিয়ে তৈরী জিনিস। যদিও তার গঠন নিয়ে বিজ্ঞানীরা মোটেই চিন্তিত ছিলেন না। ডি এন এ দুয়োরানীর মতো পড়ে রইল সবার নজরের বাইরে।

১৯৩০ সালে বিজ্ঞানী ওসওয়ার্ল্ড অ্যাভরি একটা পরীক্ষা করলেন। একটা ব্যাকটিরিয়ার থেকে ডি এন এ এর একটা সুতো বের করে অন্য একটি ব্যাকটিরিয়াতে ঢুকিয়ে দেখতে পেলেন যে আগের ব্যাকটিরিয়ার কিছু বৈশিষ্ট্য এই ব্যাকটিরিয়াতে স্থানান্তরিত হয়েছে। প্রোটিন হজম করার উৎসেচক প্রয়োগে ফল না হলেও, ডি এন এ পরিপাক করা উৎসেচক প্রয়োগ করলেই এই সঞ্চারিত বৈশিষ্ট্যগুলো গায়েব হয়ে যাচ্ছে।

পরীক্ষাটা খুবই চমকপ্রদ এবং আশাব্যঞ্জক। ওয়াটসন এবং ক্রিক— যারা কেমব্রিজের ক্যাভেনডিশ ল্যাবরেটরিতে সবেমাত্র যোগ দিয়েছেন ১৯৫০ সালে, এই পরীক্ষার ফলাফল দেখে বেশ উৎসাহিত হয়ে পড়লেন এবং ধরে নিলেন, যে জিনের উপাদান তাহলে প্রোটিন নয়, ডি এন এ।

কিন্তু শুধু ওয়াটসন এবং ক্রিকই যে শুধু এই বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবনা চিন্তা করছিলেন তা নয়, লন্ডনের কিংস কলেজের মরিস উইলকিনসও এই নিয়ে গবেষনা চালাচ্ছিলেন, আর চালাচ্ছিলেন অতলান্তিক পারের আরও এক কিংবদন্তী বৈজ্ঞানিক— লাইনাস পাউলিং।

যাগগে— এবার আসি ডি এন এ -এর গঠন নিয়ে এত উৎসাহের কারণ কী? যে কোনো জটিল যৌগের অণুর গঠন সেই যৌগে তার স্থায়িত্বকে নির্দেশ করে। গঠন জানা গেলে জানা যাবে সেই অণু দেখতে কেমন, তার উপাদানগুলো কীভাবে কোন বন্ড বা বন্ধনীতে সজ্জিত থাকে, তাদেরকে কীভাবে ভাঙা যায় ইত্যাদি। মূল কথা, কোনো অণুর গঠন জানলেই তার বিষয়ে জানাটা সম্পূর্ণ হয়।

লাইনাস পাউলিং জটিল অণুর মডেল বানানোতে একজন কিংবদন্তী বলা চলে। কেবল অংক কষে তিনি বহু জটিল অণুর নিখুঁত মডেল বানিয়ে বিশ্বের বিজ্ঞানীদের শ্রদ্ধা কুড়িয়েছেন। ওয়াটসন এবং ক্রিকের সামনে পাউলিং হয়ে গেলেন একজন বিরাট প্রতিযোগী। কিংস কলেজের মরিস ক্রিকের বিশেষ বন্ধুস্থানীয়। তাছাড়া কেম্ব্রিজ থেকে লন্ডন মাত্র পঁচাত্তর মাইলের রাস্তা। মরিস মাঝে মাঝেই ক্যাভেন্ডিশে চলে আসেন আর উল্টোদিকে কিংসে আড্ডা মারতে যান ক্রিক আর ওয়াটসন।

এর মধ্যেই একদিন মরিস একটা লম্বা ছুটি নিলেন। কানাঘুষো শুনলেন একজন মহিলা অ্যাসিটেন্ট জয়েন করতে চলেছেন কিংস এর এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টে। মরিস তাঁর চ্যালা গসলিং কে ভার দিলেন সেই মহিলাকে কাজকর্ম বোঝানোর এবং নিশ্চিন্তে ছুটিতে চলে গেলেন।

কয়েকদিন পর মরিস ল্যাবে এসে অবাক!! এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফির মেশিনগুলো এত আধুনিকভাবে সাজালো কে? এ তো পাকা হাতের কাজ! ল্যাব এই কদিনেই যথেষ্ট উন্নত হয়ে উঠেছে। এ কি ভানুমতীর খেল নাকি। মনে মনে বেশ খুশিই হলেন মরিস।

কিন্তু তাঁর সেই খুশিয়াল ভাব বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। তিনি অচিরেই জানতে পারলেন যাঁকে তিনি ল্যাব অ্যাসিস্টেন্ট ভাবছিলেন, তাঁর নাম রোজালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন। তিনি কেবল একজন উচ্চশিক্ষিত বিজ্ঞানীই নন, একাধারে করিতকর্মা, একগুঁয়ে, আত্মদর্পে দর্পিত, অসম্ভব ঝকঝকে এক সুন্দরী মহিলা। অন্যদিকে মরিস বেচারা ঝামেলা পছন্দ করেন না। শান্তশিষ্ট বিজ্ঞানী। রোজালিন্ডের সামনে তিনি ফুঁয়ে উড়ে গেলেন— কেবল তর্কে নয়, রোজালিন্ড তাঁকে বারংবার বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হলেন যে এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফিতে রোজালিন্ড একজন অথরিটি। মরিস বুঝলেন রোজালিন্ডের দক্ষতা অনেকক্ষেত্রে তাঁর নিজের থেকেও বেশি। কিন্তু মেনে নিতে পারলেন না, কারণ ডি এন এ এর ওপর কাজে তিনিও যথেষ্ট দূর এগিয়ে গিয়েছেন ততদিনে।

রোজালিন্ড আর মরিস আলাদা আলাদা ভাবে কাজ করতে শুরু করলেন। একসঙ্গে করলে হয়ত রোজালিন্ডের কপালে এতটাও অবজ্ঞা জুটত না, কিন্তু আত্মমর্যাদা বোধ তাঁর ছিল প্রবল। হয়তবা এই পুরুষশাসিত সমাজে নিজের জায়গা নিজে আদায় করে নিতে নিতেই তাঁর মানসিকতাটাই এরকম হয়ে গিয়েছিল।

এক্সরে ক্রিস্টালোগ্রাফি জিনিসটা একটু সহজ করে বলি। কোনো অণুর গঠন যেভাবে আমরা রসায়ন বইতে দেখি, সেগুলো তো আর সেইভাবে দৃশ্যমান হয় না! কারণ তাদের চোখে দেখার মত মেশিন তখন বেরোয়নি। তাই অণুর গঠন জানতে গেলে তার ক্রিস্টালের মধ্যে দিয়ে এক্সরে চালনা করতে হয়। সেই এক্সরে অণুর মধ্যে থাকা প্রতিটি পরমাণুর দ্বারা বিচ্ছুরিত হয়ে পেছনের রাখা একটা প্লেটের ওপর পড়ে। সেই প্লেটের ওপর সৃষ্টি হওয়া বিচ্ছুরণ রেখাচিত্রের অবস্থান দেখে জটিল গাণিতিক নিয়মে প্রতিটা পরমাণুর অবস্থান একটার সাপেক্ষে আরেকটা বের করতে হয়। অণু যত জটিল, তার ওপর কাজও তত কঠিন ও সময় সাপেক্ষ।

যদিও ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরির অধ্যক্ষ স্যার লরেন্স ব্র্যাগ এই ব্যাপারে একজন নোবেল লরিয়েট, তবুও সেই আমলে ক্রিস্টালোগ্রাফির সবেমাত্র হাতেখড়ি হয়েছে। যন্ত্রপাতি বড়ই প্রাচীন এবং তা দিয়ে ভালো বিচ্ছুরণ চিত্র বের করা রীতিমত কালঘাম ছোটানো কাজ। ওসব ছেনি হাতুড়ি মার্কা যন্ত্র নিয়ে ডি এন এ-র মত জটিল অণুর গঠন বের করা চাট্টিখানি কথা নয়! তাই ক্যাভেন্ডিশ এর অধ্যক্ষ এত ঝামেলার মধ্যে গেলেন না। তিনি জানতেন কিংস কলেজের লোকজন ডি এন এ এর ক্রিস্টালোগ্রাফি নিয়ে কাজ করছে, তিনি আর সংখ্যা বাড়িয়ে কী করবেন।

এভাবেই অস্পষ্ট ক্রিস্টালোগ্রাফি, জটিল গাণিতিক ফর্মুলার পিণ্ডি উদ্ধার এবং বিভিন্ন গবেষণা পড়ে নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন গবেষকেরা। মাথায় ছিল মূর্তিমান লাইনাস পাউলিঙের ভয়! ভদ্রলোক বিশ্রীরকম প্রতিভাবান। কখন কী করে বসেন তার ঠিক আছে? ডি এন এ-র গঠন যে হিলিকাল বা প্যাঁচানো সেটা ওয়াটসন একদিন কিংস কলেজে গিয়ে রোজালিন্ড এর বক্তৃতা শুনে বুঝে নিলেন। রোজালিন্ডের তোলা কিছু মন্দের ভালো এক্সরে বিচ্ছুরণ ম্যাপ দেখে আন্দাজও করে নিলেন কিছুটা। তারপর ফিরে এসে ক্রিকের সঙ্গে আলোচনা করে কিছুটা তাড়াহুড়োতেই একটা মডেল প্রস্তাব করলেন। ট্রিপল হিলিকাল মডেল।

এঁদের তৈরী মডেলটার তিনটে শর্করা ফসফেট তন্ত্রী রইল প্যাঁচের ভেতর দিকে এবং নিউক্লিওটাইড বেসগুলো— অর্থাৎ অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, থিয়ামিন আর সাইটোসিন ডালপালার মতো ছড়িয়ে রইল বাইরের দিকে। ওয়াটসন আর ক্রিক মডেল দেখে সন্তুষ্ট হলেন। নিউক্লওটাইড বেসগুলো হিলিক্সের ভেতরে থাকলে তো দেখাই যাবে না, তাহলে তারা অন্য অণুর সঙ্গে জোড় বাঁধবে কী করে! তাই হিসেব করে দেখতে গেলে মডেলটা বেশ যুক্তিপূর্ণ মনে হল তাঁদের কাছে।

কিংস থেকে মডেল সরেজমিনে দেখতে ক্যাভেন্ডিশে এলেন রোজালিন্ড। কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে মডেলটি মন দিয়ে দেখলেন এবং মুচকি হেসে সোজা বাতিলের খাতায় ফেলে দিলেন। আসলে আগেরদিন ওয়াটসন রোজালিন্ডের বক্তৃতা শুনেছিলেন ঠিকই, কিন্তু কিছু দরকারী মাপজোক মনে রাখতে পারেননি। তাতেই বিপত্তি। রোজলিন্ড সবার সামনে, বিশেষত ওদের অধ্যক্ষের সামনেই ওয়াটসন আর ক্রিককে খেলো করায়, অপমানিত স্যার ব্র্যাগ দুই বিজ্ঞানীকে পত্রপাঠ ডি এন এর মডেল বের করার কাজ থেকে অব্যাহতি দিলেন।

ওয়াটসন আর ক্রিক হতোদ্যম হলেন না। এসব বাধাবিপত্তি তো আসতেই থাকে। গোপনে গোপনে গবেষণা চালিয়ে গেলেন। মাঝে মধ্যেই কিংস এ গিয়ে হয় রোজালিন্ড না হয় মরিসের কাজ দেখতে যেতেন।

কিন্তু কাজের কাজ হত অন্যরকম ভাবে। রোজালিন্ড এর গবেষণা এবং ক্রিস্টালোগ্রাফির ছবিগুলো গোপনে মরিস পাচার করতে থাকেন ওয়াটসন এবং ক্রিক কে। রোজালিন্ড নিজের কাজে প্রতিদিনই উন্নতি করছিলেন তাই ক্রমশ ছবিগুলো আরও পরিষ্কার হচ্ছিল। ওয়াটসন, ক্রিক আর মরিস গভীর মনোযোগে অনুসরণ করছিলেন রোজালিন্ডের কাজ— অবশ্যই তাঁর অলক্ষ্যে।

১৯৫২ সালের মে মাসে রোজালিন্ডের গভীর অধ্যবসায় এবং পরীক্ষামূলক কাজে তাঁর অদ্ভুত বুৎপত্তির ফল মিল। ডি এন এ এর বি-ফর্ম বা দেহকোষে ডি এন এ যেভাবে থাকে, তার একটা নিখুঁত ছবি তুলতে সক্ষম হন তিনি। ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেওয়া এই ছবিটির নাম— ফটো ফিফটিওয়ান (Photo 51). রোজালিন্ড ফটোটি তাঁর ফাইলে রেখে বাকি কাজে মনোযোগ দেন।

Photo - 51

ওদিকে ১৯৫৩ সালের জানুয়ারীতে ওয়াটসন আর ক্রিক খবর পান যে লাইনাস পাউলিং গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে চলেছেন, এবং তাতে নাকি তিনি ডি এন এ-এর গঠন বের করেই ফেলেছেন! উৎকণ্ঠিত ওয়াটসন ভাবেন তীরে এসে তরী হয়ত ডুবল। তিনি দ্রুত কোনোমতে পাউলিং-এর গবেষণার খসড়াটা জোগাড় করতে সক্ষম হন। তবে পেপারের কিছুটা পড়েই তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়েন। পাউলিং ট্রিপল হিলিকাল মডেল প্রস্তাব করছেন। বেশ বুঝতে পারেন, তাঁরা বছরখানেক আগে যে ভুলটা করে রোজালিন্ডের ঠাট্টা হজম করেছিলেন, সেই একই ভুল পাউলিংও করেছেন। তাহলে হাতে এখনও সময় আছে!

ওয়াটসন সোজা লন্ডনের কিংস এ চলে এলেন। দেখা করলেন রোজালিন্ডের সঙ্গে। পাউলিং এর ব্যাপারটা জানালেন যদিও রোজালিন্ড খুব একটা পাত্তা দিলেন বলে মনে হল না। ওয়াটসন সেদিন এমনিতেই বিধ্বস্ত হয়েছিলেন। রোজালিন্ডের ঘর থেকে বেরিয়ে তিনি গেলেন মরিসের ঘরে। ওয়াটসনকে বসতে বলে মরিস বের করলেন সেই বিখ্যাত ফটো-৫১! রাখলেন ওয়াটসনের সামনে!

যে লোকটা মরুভূমিতে একফোঁটা জলের জন্য হাহাকার করে মরছে, তার সামনে যেন রেখে দেওয়া হলো একটা ঝরণা! ছবিটা দেখে ওয়াটসনের হৃদপিণ্ড উত্তেজনায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। তিনি চকিতে বুঝে গেলেন যে ডি এন এ এর গঠন হিলিকাল বা প্যাঁচানো তো বটেই কিন্তু ট্রিপল না— ডাবল হিলিক্স। অর্থাৎ তন্তু মাত্র দুটো। এই তন্তু আর কিছুই না— শর্করা ফসফেটগুলো পেঁচিয়ে রয়েছে। গ্রাফের ওপর রোজালিন্ডের লিখে রাখা মাপ এবার তিনি লিখে নিতে ভুললেন না। ক্যাভেন্ডিশে ফিরে ক্রিক আর ওয়াটসন ঝাঁপিয়ে পড়লেন মডেল বানাতে। স্যার ব্র্যাগকে অতিকষ্টে রাজি করালেন ডি এন এ-র ওপর কাজ শুরু করার জন্য। তারপর লেগে পড়লেন কাজে।

রোজালিন্ডের ডি এন এ-র সিমেট্রি বা সামঞ্জস্যের ওপর কাজ দেখে ক্রিক বুঝতে পেরেছিলেন ডি এন এ-র মূল গঠনটা তাঁদের করা আগের মডেলের ঠিক উলটো। এর শর্করা ফসফেটের মেরুদন্ডগুলো রয়েছে বাইরের দিকে— আর বেসগুলো ভেতরে একে অপরের সঙ্গে জুড়ে। কিন্তু একটা জায়গায় ধন্দ দেখা দিল।

প্রথমে দুই বিজ্ঞানী অ্যাডেনিনের সঙ্গে অ্যাডেনিন, গুয়ানিনের সঙ্গে গুয়ানিন এভাবে জুড়ছিলেন। কিন্তু ক্যাভেন্ডিশেরই আরও এক গবেষক ওঁদের জানালেন বেস ওভাবে জোড়ে না। তাছাড়া এর আগে আরউইন চার্গফ নামে এক বিজ্ঞানী, মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণিদের দেহে এই বেসগুলোর উপস্থিতির অনুপাত মেপেছিলেন। তিনি দেখেছিলেন যে অ্যাডেনিন আর থিয়ামিনের অনুপাত এবং গুয়ানিন আর সাইটোসিনের অনুপাত প্রায় সব প্রাণীদেহে এক। যদিও চার্গফ তখনও জানতেন না যে এই অনুপাতের বিশেষত্ব কী! কিন্তু ব্যাপারটা এতদিনে কাজে লাগল। ওয়াটসন আর ক্রিক এবার বেসগুলোকে এইভাবেই জুড়লেন। অ্যাডেনিনের সঙ্গে থিয়ামিন আর গুয়ানিনের সঙ্গে সাইটোসিন। জোড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা গেল যে তাঁরা পেয়ে গিয়েছেন বিশ্বের সবথেকে আকাঙ্ক্ষিত মডেল। বড় বেসের পাশে ছোট বেস— এইভাবে সাজানোর পর এই গঠন যেন নিজেই ব্যাখ্যা দিয়ে দিল কীভাবে তথ্যভান্ডার মজুত থাকে একটা ডি এন এ এর মধ্যে। এই বেসগুলোকে কেটে ফেলা যায়, জোড়া যায়— আর এই বেসগুলোই কোডের মত তথ্য জমা রাখে।

কী তথ্য?

খুব সোজা। প্রোটিন পরিপাকের তথ্য। যেকোনো কোষ কীভাবে কাজ করবে, কীভাবে বিভাজিত হয়ে প্রতিলিপি বানাবে তার পুরোটাই নির্ভর করে কোষের মধ্যে কীভাবে, কতটা প্রোটিন বিয়োজিত হয়ে শক্তি উৎপন্ন করতে পারছে তার ওপর। আর এই প্রোটিন বিয়োজনের পুরো রেসিপিটাই লেখা থাকে ডি এন এ-এর এই ডাবল হিলিকাল মডেলের কোডে— কোষ তার ক্রোমোজমের মধ্যে থাকা এই ডি এন এ থেকেই প্রোটিন ভেঙে শক্তি উৎপাদনের নির্দেশ পায়। এই কোড বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয় এক দেহ থেকে আর এক দেহে, আর বৈশিষ্ট্যগুলোও সেইসঙ্গে নেমে আসে উত্তরাধিকার সূত্রে। ডি এন এ কপি করার সময় যদি কোনো গণ্ডগোল হয়, বা কোনো বেস ঠিকভাবে কপি না হয়, তাহলে প্রকৃতির নিয়মানুসারে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেখানে নতুন লাইন যুক্ত হয়, মানে নতুন কোড তৈরী হয়। আর তারই ফল মিউটেশন।

ওয়াটসন – ক্রিক এবং তাঁদের মডেল

এত চমৎকার একটা অণু এবং তা গঠনগত সারল্য বিজ্ঞানীদের চমৎকৃত করল। জীবনের স্থায়িত্ব থেকে শুরু করে, বংশগতি, অভিযোজন, মিউটেশন সবার ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে এই মডেলের মধ্যেই। এর থেকে শক্তিশালী মডেল বোধহয় দুনিয়ায় আর দুটো নেই। সাধে কি বিজ্ঞানীরা এত গোঁ নিয়ে এর পেছনে দিবারাত্র পড়েছিলেন? এই মডেলের মধ্যে দিয়ে প্রকৃতি যেন নিজেকে উন্মুক্ত করে দিলেন মানুষের কাছে। জীববিজ্ঞানীদের সামনে নতুন নতুন সম্ভাবনার সিংহদুয়ার খুলে যেতে লাগল।

এই বিরাট আবিষ্কারে রোজালিন্ডের ভূমিকা কতটুকু? যথেষ্ট! রোজালিন্ড না থাকলে এই আবিষ্কার হতই না। তিন বিজ্ঞানী গোপনে রোজালিন্ডের গবেষণা পড়েই এগিয়েছিলেন, তাঁর অজান্তে। বরং রোজালিন্ডকে প্রতিটা অণুর অবস্থান বুঝতে নিরন্তর গাণিতিক সহায়তা নিতে হয়েছিল। ওদিকে ওয়াটসন আর ক্রিক ফটো-৫১ দেখে একটা মোটামুটি গণনা করে এগিয়েছিলেন মডেল তৈরীতে।

১৯৫৩ সালের এপ্রিলে “নেচার” পত্রিকায় পেপার বেরোলো তিন বিজ্ঞানীর। ততদিনে রোজালিন্ডও পৌঁছেছেন একই সিদ্ধান্তে। তাঁর পেপারও ছাপা হলো। তবে ওয়াটসন, ক্রিক মরিসের পেপার রইল প্রথমে আর রোজালিন্ডের নীচে। এমনভাবে, যেন তিন বিজ্ঞানীর আবিষ্কৃত মডেলকেই সমর্থন জানাচ্ছে তাঁর পেপার! অর্থাৎ রোজালিণ্ডের কাজ পড়ে বাকিরা এগোননি, বাকিদের মডেল দেখেই রোজালিন্ড উৎসাহিত হয়েছেন! রোজালিন্ড দেখলেন সবই। কিন্তু বুঝতে পারলেন না যে তাঁর আইডিয়া, কাজ গোপনে অনুসরণ করেই মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।

একে তো কিংস কলেজে তাঁর আপন বলে কেউ ছিল না। পুরুষ অধ্যুষিত কলেজে একমাত্র মহিলা বিজ্ঞানী হিসাবে তাঁকে সবাই একঘরে করেছিল, তারওপর ল্যাবের ডেপুটি ডিরেক্টর মরিস উইলকিনসের সঙ্গে ঝামেলা রোজালিন্ডের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। তিনি কিংস ছেড়ে দিলেন এবং চলে গেলেন লন্ডনেরই স্বল্পপরিচিত বার্কবেক কলেজে।

বার্কবেকে গিয়ে রোজালিন্ড আবার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এবার তাঁর নজর গেল ভাইরাসের দিকে। টোবাকো মোজেইক ভাইরাস একধরনের ফসলের ক্ষতিকারক ভাইরাস। সেটার ক্রিস্টাল ফর্ম নিয়ে ক্রিস্টালোগ্রাফির মাধ্যমে তিনি তার গঠন বের করলেন এবং পরে পোলিও ভাইরাস নিয়েও একই কাজ চালু করলেন। ১৯৫৬ সালে তাঁর জরায়ুতে ক্যান্সার ধরা পড়ল। ডাক্তাররা আন্দাজ করলেন এক্স রে নিয়ে অতিরিক্ত নাড়াচাড়ার ফলই এই ক্যান্সারের কারণ। ১৯৫৭ তে তিনি ল্যাবে ফিরে এলেন এবং দ্বিগুণ গতিতে কাজ শুরু করলেন পোলিও ভাইরাস এবং ভাইরাসের গঠন বের করার জন্য। কিন্তু শেষরক্ষা হল না— ১৯৫৮ সালে মাত্র আটত্রিশ বছর বয়সে মারা গেলেন এই মহান বিজ্ঞানী।

ফ্র্যাঙ্কলিন রোজালিন্ড – জীবনের ব্যস্ততম সময়ে

১৯৬২ ডি এন এ এর গঠন আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কার পেলেন তিন বিজ্ঞানী। রোজালিন্ডের নাম উঠেই এল না কোথাও। এড়িয়ে যাওয়া হল সযত্নে। তবে ১৯৮২ সালে রোজালিন্ডের ভাইরাসের ওপর কাজের জন্য স্বীকৃতি এল তাঁরই সহকর্মী অ্যারন ক্লাগকে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করে। অ্যারন অন্তত বাকি তিন বিজ্ঞানীর মত অতটা কৃতঘ্ন ছিলেন না। “নেচার” এ প্রকাশিত হওয়া তাঁর পেপারটি তিনি রোজালিন্ডকে উৎসর্গ করেছিলেন।

বোঝাই গেল— রোজালিন্ড দু দুটো নোবেল থেকে বঞ্চিত হলেন। দুটোই কেড়ে নিল তাঁর জীবন। ক্ষণজন্মা এই প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর কপালে স্বীকৃতিটুকুও জোটেনি তাঁর জীবদ্দশায়। একটা বিরাট সময় তিনি জনমানসে অদৃশ্য হয়ে রইলেন— কেবল ১৯৬৮ সালে ওয়াটসনের বই বেরোনোর পর জানা গেল ‘রোজি’ নামের এক নাক উঁচু মহিলা কিছু কাজ করেছিলেন ডি এন এ- এর ওপর। ব্যাস এতটুকুই।

টাইম ম্যাগাজিনের কভারে রোজালিন্ড

 

কাট - টু

৭ই অক্টোবর, ২০২০ সাল। সকাল সকাল দুনিয়া জানতে পারল এই ডি এন এ-র ওপর একটা প্রায় অসম্ভব কাজকে সম্ভব করার জন্য নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন দুই মহিলা বিজ্ঞানী। একজন আমেরিকার জেনিফার দোদনা এবং অন্যজন ফ্রান্সের ইমানুয়েল কার্পেন্থিয়ের। কী কাজ? জানতে গেলে চলুন চট করে একটু অন্যরকম দুনিয়া থেকে ঘুরে আসি।

তার নাম কল্পবিজ্ঞানের দুনিয়া।

আপনারা নিশ্চই “জুরাসিক পার্ক” সিনেমাটি এবং ওই সিরিজের তৎপরবর্তী সিনেমাগুলো দেখেছেন। এটাও জানেন সিনেমটি মাইকেল ক্রিকটনের “দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড” ওপর ভিত্তি করেই বানানো। জিন ইঞ্জিয়ারিং এর ওপর অন্যতম চমকপ্রদ সায়েন্স ফিকশন লেখা। ডাইনোসর যুগের এক মশা এক পেট ডাইনো রক্ত গিলে গাছের গায়ে বসেছিল বুঝিবা বিশ্রাম নিতে। কিন্তু গাছের কাণ্ড নিঃসৃত রসে চাপা পড়ে তার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটে। প্রকৃতির আজব খেয়ালে সেই মশার অবিকৃত দেহ হস্তগত হয় কিছু জিনিয়াস বায়ো ইঞ্জিনিয়ারের— তারা সেই ডাইনো রক্ত পরিপাটিভাবে নিষ্কাশন করে জিন ইঞ্জিনারিং এর কারিকুরিতে জন্ম দেয় প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরদের— যা নিয়ে ঘটে চলে একের পর এক বিপত্তি।

এ তো গেল ফ্যান্টাসির কথা। কিন্তু একথা সত্যি যে ডি এন এ এর মডেল আবিষ্কারের পর জীববিজ্ঞানীদের সামনে যে বিপুল সম্ভাবনার জগত খুলে গিয়েছিল, তার মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য হল এই জিনোম ইঞ্জিনিয়ারিং এর সূচনা। ১৯৬০ থেকেই বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন উদ্ভিদকোষে রেডিয়েশন প্রয়োগ করে মিউটেশন করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। যদি সমাপতনে কোনো জেনেটিক কোড বদলে গিয়ে একটা বিশেষ ভ্যারাইটির উদ্ভিদের প্রজাতি তৈরী করা যায়। এ ছিল একেবারেই সম্ভাবনার খেলা। একদমই কিছু হয়নি বলা যাবে না— তবে খুব একটা উল্লেখযোগ্য কিছু না।

১৯৭১ সালে পল বার্গ নামে এক বিজ্ঞানী দুটো আলাদা আলাদা উৎস থেকে ডি এন এ কে পৃথক করেন এবং সংযুক্ত করেন একটি সম্পূর্ণ নতুন কোষের মধ্যে। কাজটা করার পর তিনি নিজেই যথেষ্ট ভয় পেয়ে যান। ব্যাপারটা তাঁর অনেকটা খোদার ওপর খোদকারি ধরনের মনে হয়। এই কাজটার ভবিষ্যৎ নিয়ে, বিশেষত মানুষের ওপর এর সুদূরপ্রসারী ফল ভেবে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়েন। তাঁরই উদ্যোগে মোটামুটি ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত জিন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ওপর আর কোনো কাজ হয়নি। ১৯৭৫ সালে ক্যালিফোর্নিয়াতে একটা অ্যাসিলোমার কনফারেন্স হয় এবং পল বার্গ তাতে পৌরহিত্য করেন। এক’শ চল্লিশের ওপর বিজ্ঞানী, ডাক্তার এবং আইনিজীবী মিলে জিন এডিটিং-এর কিছু নিয়ম বলবত করেন। যার প্রথমটাই ছিল যে এই জিন এডিটিং ‘মানুষের ক্ষতি হয়’ এমন কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। মানে বায়োওয়েপন বা বিষ ইত্যাদি তৈরীতে এই অগ্রগতিকে কাজে লাগানো যাবে না।

এরপর জিন এডিটিং এর কাজ আবার শুরু হয়। ১৯৯৪ সাল নাগাদ একটা জিন মডিফায়েড টমেটো বাজারে চলে আসে— যার গালভরা নাম ছিল ‘ফ্লেভার সেভার টম্যাটো’, সেগুলো সাধারণ বাজারচলতি টমেটোর থেকে চলতও বেশিদিন। এছাড়াও পরবর্তীকালে জিন এডিটিং-এর সাহায্যে গ্রোথ হরমোন, ইনসুলিন ইত্যাদির আবিষ্কার হয়েছে। প্রাণীজগতের ওপরেও এই জিন ইঞ্জিনিয়ারিং ফলশ্রুতি হিসাবে জন্মেছে মাংসল শুয়োর, পালকহীন মুরগী, দ্রুত জন্মানো স্যামন মাছ ইত্যাদি। এমনকি বিজ্ঞানীরা ম্যালেরিয়ার মশার ওপরও জিন এডিটিং এর কাজ চালাচ্ছেন যাতে সেগুলো এবং তার বংশধরেরা ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহন করতেই না পারে। কিন্তু এই এডিটিং তো আর ডক্যুমেন্ট এডিটিং এর কাজ নয়! কাজটা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ, জটিল এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঠিক হবার সম্ভাবনাও বেশ কম। ডি এন এ-র ঠিক কোন জায়গাটা কাটতে হবে, ঠিক ওখানেই অন্য কোড জুড়বে কী করে— ইত্যাদি নিয়ে জিন ইঞ্জিনিয়ারিং একটা গালভরা নাম আর ব্যয়সাপেক্ষ কাজ হিসাবেই বেশ কিছুটা সময় জুড়ে বিজ্ঞানী মহলে পরিচিতি লাভ করে।

১৯৮৭ সাল নাগাদ কয়েকজন বিজ্ঞানী ই-কোলাই ব্যাকটিরিয়াকে নিয়ে কাজ করছিলেন। সেই ব্যাক্টিরিয়ার কোষের ডি এন এ তে ওঁরা কিছু অদ্ভুত জিনিস দেখতে পান। জিনিসটার নাম দেওয়া হয় ক্রিসপার (CRISPR)— বড় করে বললে (Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeats)। জম্পেশ নাম বটে একপিস। এটা কী বস্তু? জানতে হলে আরও একটু বিজ্ঞান জানা প্রয়োজন।

আমাদের ছোটবেলার বিজ্ঞান বইতে আমরা ব্যাকটিরিও ফাজের নাম পড়েছি— যারা হামেহাল ব্যাকটিরিয়াকে আক্রমণ করে তাদের নিকেশ করে। এটাও জানি যে আমরা নিজেরা যেমন ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হই, তেমনই যে কোনো জীবন্ত প্রাণই ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয় বা হতে পারে। ব্যাকটিরিয়া প্রাণীজগতের আদিপুরুষ— আর তার কোষের গঠন বেশ সরল। তাকে নিয়ে কাজ করা সুবিধে। তাই বিজ্ঞানীরা কিছু খোঁজাখুঁজি করতে হলে প্রথমে ব্যাকটিরিয়াকেই পাকড়াও করে থাকেন। প্রতিদিনই ব্যাকটিরিয়া জগতের প্রায় চল্লিশ শতাংশ বাসিন্দা ভাইরাসের আক্রমণে মারা যায়।

ভাইরাসের এই বিধ্বংসী কাজের মোডাস অপারেন্ডি কিন্তু একটাই। ব্যাকটিরিয়ার কোষের ওপর চড়াও হয়ে টুক করে নিজের জেনেটিক কোড প্রবেশ করিয়ে দেওয়া। এবার সেই জেনেটিক কোড ব্যাকটিরিয়ার জেনেটিক কোডের কান ধরে তাকে অকেজো করে দিয়ে কোষকে নিজেই নির্দেশ দিতে থাকে আরও ভাইরাস তৈরীর। নতুন বসের কথা অনুযায়ী কোষ কাজ করতে থাকে— তারপর এক পঙ্গপাল ভাইরাস মিলে ব্যাকটিরিয়ার কোষকে ধ্বংস করে বেরিয়ে আসে ঋষিদের পেট চিরে বেরিয়ে আসা বাতাপি নামের অসুরের মত।

কিন্তু তাই বলে ব্যাকটিরিয়ার কি প্রতিরোধ ক্ষমতা বলে কিছুই নেই? আছে। তবে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিছু করে উঠতে পারে না। কিন্তু যারা পারে, মানে বেঁচে বর্তে যায়, তারা তাদের ডি এন এ-র মধ্যে একটা বিশেষ কোড লিখে জমিয়ে রাখে। মানে সহজ কথায় বলতে গেলে মৃত ভাইরাসের ডি এন এ কোডের একটা কপি নিজের ডি এন এ-তে লিখে নেয়। মানে শত্রুর অস্ত্রেই শত্রুকে ঘায়েল করার ব্যবস্থা পাকা করে রাখে। কী অদ্ভুত প্রাকৃতিক পদ্ধতি, তাই না?

বিজ্ঞানীরা প্রথমে ই-কোলাই এর ডি এন এ সিকোয়েন্সে এই নতুন ধরণের কোড দেখে অবাক হয়েছিলেন কারণ এই কোডগুলো ব্যাকটিরিয়ার নিজস্ব ডি এন এ-র সঙ্গে মিলছিল না। আর এই কোডগুলো মোটেই সক্রিয় নয়— অর্থাৎ ব্যাকটিরিয়ার কোষকে এরা কোনো নির্দেশ পাঠায় না! বিজ্ঞানীরা এর নামকরণ করেন ক্রিসপার। কিন্তু এই ক্রিসপার নিয়ে কাজ করার সময় পরে তাঁরা দেখতে পান, আরে!! এই জেনেটিক কোডের সঙ্গে তো ভাইরাসের জেনেটিক কোডের অদ্ভুত মিল!! তারপর থেকে ব্যাপারটা একটা সিরিয়াস গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

যাগগে— এবার দেখা যাক এই ক্রিসপার কেমনভাবে কাজ করে। ধরা যাক, একটা ক্রিসপারওয়ালা ব্যাকটিরিয়াকে আবার ভাইরাস চেপে ধরল— অর্থাৎ, ব্যাকটিরিয়ার ডি এন এ-তে প্রবেশ করাতে চাইল নিজের জেনেটিক কোড। সেই সময়ে ব্যাকটিরিয়ার ওই ক্রিসপার ডি এন এ থেকে একটা আর এন এ তন্ত্রী বেরিয়ে আসে। ডি এন এ-র নির্দেশ কোষের বিভিন্ন স্থানে বহন করে নিয়ে যায় যে অণু, তারই নাম আর এন এ। এই আর এন এ তন্ত্রী ব্যাকটিরিয়ার দেহকোষের একটা বিশেষ প্রোটিনের সঙ্গে জুড়ে যায়- যার নাম ক্যাস ৯ (Cas 9)। যেহেতু এই প্রোটিন কেবলমাত্র ক্রিসপারের সঙ্গেই কাজ করে, তাই একে ক্রিসপার সংযুক্ত প্রোটিন বা CRISPR associated Protein (Cas 9) বলা হয়ে থাকে। এবার এই প্রোটিন সমেত আর এন এ ব্যাকটিরিয়ার কোষে অ্যান্টিভাইরাসের মত স্ক্যানিং করা শুরু করে।

ক্রিসপার ক্যাস ৯ – যেভাবে ডি এন এ কাটে

এই বিশেষ প্রোটিনের কাজ হল তার নিজের মধ্যে থাকা আর এন এ-তে যে কোড আছে, সেই কোডের সঙ্গে কোষের মধ্যে থাকা আর কোনো জেনেটিক কোড মিলছে কিনা তা খতিয়ে দেখা। স্ক্যানিং করতে করতে সে সদ্য বহিরাগত ভাইরাসের কোড খুঁজে পায়। সে বুঝতে পারে যে ভাইরাসের কোড একদম খাপে খাপ মিলেছে। তৎক্ষণাৎ ক্যাস ৯ ওই ভাইরাসের ডি এন এ-র সেই মিলে যাওয়া অংশটুকুকেই কাঁচির মত ক্যাঁচ করে কেটে উড়িয়ে দেয়। ব্যস— ভাইরাস ফিনিশ! তার জারিজুরি খতম!

এই পর্যন্ত ঠিক ছিল— মানে ব্যাপারটা প্রাকৃতিক ভাবে সংঘটিত হচ্ছিল। কিন্তু মানুষের চিন্তাভাবনা তো শুধু পর্যবেক্ষণেই থেকে থাকে না। এই দুই বিজ্ঞানী ভাবলেন— ভালোরে ভালো। এ তো বেড়ে মজা। এত চমৎকার প্রাকৃতিক কাঁচিকে ছাড়ি কেন? দেখাই যাক না— একে আমাদের নির্দেশে চালানো যায় কিনা। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বছরের পর বছর অক্লান্ত গবেষণার পর ২০১২ সাল নাগাদ ওঁরা জানালেন এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের কথা। এই কাঁচিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় কৃত্রিমভাবে। মানে এই ক্যাস ৯ কে আমরা নিজেদের ইচ্ছেমত নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। কেবল এই প্রোটিনের সঙ্গে জুড়ে দিতে হবে একটা গাইড আর এন এ। এই আর এন এ ক্রিসপার ক্যাস ৯ কে কোষের মধ্যে লক্ষ লক্ষ ডি এন এ-র ভিড়ে খুঁজে খুঁজে ঠিক যে অংশে নিয়ে যাবে, ঠিক সেইখানে গিয়ে— একদম কোড ম্যাচ করিয়ে ক্রিসপার সেই অদরকারী বা ক্ষতিকর ডি এন এ-র অংশটুকুকে কেটে উড়িয়ে দেবে। জ্যান্ত কোষে ক্রিসপার কেবল হইহই করে কাজ করতে পারে তাই নয়, বিশেষ বিশেষ ডি এন এ-কেও নিষ্ক্রিয় সক্রিয় করতে পারে। অর্থাৎ যে কোনো কোষেই এই কাজে ক্রিসপারকে ব্যবহার করা যেতে পারে।

সোজা কথায় এতদিনের জেনেটিক ইঞ্জিয়ারিং এর প্রচেষ্টা যদি একটা বিশাল জটিল মানচিত্র হয়, তাহলে সেখানে ক্রিসপার হল একটা জি পি এস মেশিন।

যদি ডি এন এ-এর গঠন জিন ইঞ্জিনিয়ারিং এর জন্ম দিতে পারে, তাহলে এই প্রোগ্রামেবেল ক্রিসপারের আবিষ্কার মানবসভ্যতাকে চিরকালের জন্য বদলে দিতে পারে। যদিও এটা এখন খুবই প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগলবন্দিতে আমরা অচিরেই হয়ত প্রচুর কল্পবিজ্ঞান ধারণাকে বাস্তবায়িত হতে দেখতে পাব। ক্যান্সার এবং অন্যান্য জেনেটিক রোগের নির্মূল করা তো আছেই, নতুন প্রজাতি তৈরী, জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বাচ্চা ইত্যাদিও এখন বেশ সম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। ২০১৬ সালে চীনের এক বিজ্ঞানী দাবী করে বসেন যে তিনি নাকি একটি ভ্রুণের ওপর এই ক্রিসপারের প্রয়োগ করে জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বাচ্চার জন্ম নিশ্চিত করেছেন। যদিও পরবর্তীকালে প্রবল প্রতিরোধের মুখে তিনি চুপ করে যান, কিন্তু এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে ক্রিসপারের প্রয়োগ সুদূরপ্রসারী হতে চলেছে।

ক্রিসপার আবিষ্কারের পর জিন এডিটিং এর খরচ প্রায় ৯৯% কমে গেছে। এর জন্য স্পেশাল ল্যাবও লাগবে না। যে কেউ, যখন ইচ্ছে জিন এডিটিং করতে পারবে। গুঁজে দিতে পারবে তার মনোমতো জেনেটিক কোড, যে কোনো দেহকোষে। ফলাফল সব সময় যে ভালো হবে তার তো মানে নেই!! কিন্তু পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য একবিংশ শতকের এই আবিষ্কারই যথেষ্ট।

 

জেনিফার দোদনা এবং ইমানুয়েল কার্পেন্টিয়ের দুজনেই ভীষণ উচ্চশিক্ষিত বিজ্ঞানী। একটা বিশাল সময় জুড়ে বিজ্ঞানে যে ধরনের লিঙ্গ অসাম্য মহিলারা সহ্য করে এসেছিলেন, অসাধারণ প্রতিভা থাকা সত্ত্বেও, হয়ত নোবেল কমিটি সেই প্রতিভাকেই এতদিন পর সম্মাননা দিলেন। রোজালিন্ডের হাত ধরে মানুষের প্রাণচেতনায় যে রহস্যের উন্মোচন হয়েছিল, এই দুই মহিলা বিজ্ঞানী তাকে এক ধাক্কায় এগিয়ে দিলেন কয়েক দশক। হয়ত বা কয়েক শতাব্দী।

জেনিফার ও ইমানুয়েল – এক ফ্রেমে

একসময় কেবল মহিলা বলে পাত্তা পেতেন না বিজ্ঞানীদের উচ্চমহলে, সেই মহিলারাই আজ শাসন করছেন ম্যাক্স প্ল্যাংক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনফেকশন বায়োলজি বিভাগ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম পদ। এঁদের মধ্যে আরও একটা মিল রয়েছে— এঁরা প্রত্যেকেই সুন্দরী। তাই সুন্দরী নারী মানেই তিনি ‘গবেট’ হবেন, বিজ্ঞান থেকে শতহস্ত দূরে থাকবেন, এই অত্যন্ত অদ্ভুত ধারণার মুখে সপাটে চপেটাঘাত করেছেন এঁরা প্রত্যেকেই।

নারীর দেহ থেকেই জন্ম হয় নতুন প্রাণের। সেই নারীদের হাত ধরেই প্রাণের রহস্য উন্মোচিত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। কে জানে, বিশ্বের প্রাণসৃষ্টির রহস্যও হয়তবা প্রাণদাত্রী নারীদের হাত দিয়েই আসবে অদূর ভবিষ্যতে।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের ফাঁকা আস্ফালনের বিরূদ্ধে এ যেন এক নির্মম প্রত্যুত্তর।