অন্তিম ন্যায় ● এরশাদ বাদশা


 

 

এক

নিজের শরীরটা স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ভারী মনে হচ্ছে দীপ্তর। আরাম-আয়েশের ভোগ-বিলাসী জীবনটা হঠাৎ এমনভাবে বদলে যাবে, কখনও কল্পনাও করেনি। অবশ্য তা’ মাত্র তিনমাসের জন্যই, হেসে ভাবল। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে দু’মাস ছাব্বিশ দিন। তবে এই ক’দিনেই জানা হয়ে গেছে মুদ্রার ওপিঠ কীরকম হতে পারে। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!

মুরগি-খোঁয়াড়ের মত ছোট্ট এক কামরায় আরও ছয়জনের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকা। ভ্যাপসা গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যাওয়া! না আছে স্নানের ঠিক, না আছে মনের মতো খাবার-দাবার। বিদেশি মদ তো দূর, একগ্লাস মিনারেল ওয়াটারও সেখানে সোনার হরিণ! প্রতি পাঁচ কামরার জন্য একটা মাত্র টয়লেট। প্রচণ্ড চাপের কারণে সেটার কী অবস্থা সহজেই অনুমেয়। একই অবস্থা বাথরুমেরও। না আছে জলের ঠিকানা, না সাবানের বালাই।

উফফ্! কী বিভীষিকাময় অবস্থা!

অঢেল টাকা ঢেলেছে বলে তা-ও কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল ওদের অবস্থা। তবে জেল তো জেলই। গরাদের পিছনের ওই জীবনটাকে তীব্র ঘৃণা করে ওরা এখন। সবকিছুর বিনিময়ে হলেও ওখানে ফিরতে চায় না। জামিন হচ্ছে না দেখে অস্থির হয়ে উঠেছিল ফারদিন। ভীষণ ঘাবড়ে যাচ্ছিল।

‘দোস্ত, ড্যাডকে বল, এখান থেকে বের না করলে হয় মারা যাব, নয়তো পাগল হয়ে যাব!’

কোটিপতি বাবার আদুরে ছেলে ফারদিনের বাল্যবন্ধু দীপ্ত। মানিকজোড় যাকে বলে। সবকিছুই নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে ওরা। ভাগ্যের ফেরে অবশেষে শেয়ার করতে হল জেলের অন্ধকার কুঠুরিও!

ফারদিনের বাবা আজম শেখ। তাঁর প্রধান ব্যবসা জুয়েলারি। দেশে তো বটেই, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও তাঁর ব্যবসা আছে। আরও বহুবিধ ব্যবসায় হাত প্রসারিত করেছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ধনীদের একজন। প্রশাসনের রথী-মহারথীদের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা আছে তার। একমাত্র পুত্রকে নিজের পালস্ মনে করেন তিনি। ছেলের যে-কোনো চাওয়া পূরণই তাঁর জীবনের এন্টারটেইনমেন্ট।

তুলনায় দীপ্তর পরিবার কোনোক্রমেই গোনায় ধরার মত নয়। তার পিতৃদেব আশিস কুমার গার্মেন্টস-ম্যানেজার। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে এ পদে আসীন হয়েছেন। ম্যানেজার পদবি হস্তগত হয়েছে তা-ও প্রায় আট বছর আগে। আজ এই কোম্পানি তো কাল ওই। থিতু হতে পারছেন না। ফলাফল: অশ্বডিম্ব। না ঘর কা, না ঘাট কা!

দীপ্ত তাঁর বড় ছেলে। দুই কন্যা অনামিকা ও নীহারিকা। মেয়েদের নিয়ে সীমাহীন গর্ব আশিস কুমারের। বড়টা পড়ছে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে। ছোটটা এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। দুজনেই তুখোড় মেধাবী। প্রতিটা এক্সামেই তারা টপার।

বিপরীত চিত্র তাঁর বড় সন্তান দীপ্তর। ছোটবেলা থেকেই ব্যাকবেঞ্চার সে। ধড়ের উপর যে একটা মাথা আছে, এবং সৃষ্টিকর্তা যে সেখানে ঘিলু নামক কোনো বস্তুর সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন, এ সম্পর্কে দারুণ উদাসীন সে। প্রাইমারি লেভেল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়, সবখানেই লবডঙ্কা। ধুঁকে-ধুঁকে কিংবা খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়েই এগিয়েছে তার পাঠ পরিক্রমা। তবে একমাত্র পড়াশোনাতেই তার অধোগতি। বাকি যত অনাচার আছে সবখানেই সে এক নাম্বারে! ইভ টিজিং থেকে শুরু করে ইয়াবা, সবখানেই তার নজিরবিহীন দক্ষতা।

রতনে রতন চেনে! প্রবাদবাক্যটার সার্থকতা প্রমাণ হয় ফারদিন আর দীপ্তকে দেখলে। ছোটবেলা থেকে একই স্কুলে পড়ত ওরা। হৃদ্যতার শুরু তখন থেকেই। বিদ্যান্বেষণে দুজনেরই দারুণ অনীহা। ওই বিষয়ে দুজনেরই মগজে একই জং। বাকি সব কিছুতেও হুবহু মিল দুজনের মধ্যে। নেতিবাচক সব কিছুর প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ। স্বাভাবিকভাবেই একে-অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেল ওরা ছোটবেলা থেকেই।

আজম শেখ পুত্রের বন্ধু হিসেবে দীপ্তকে কখনওই মেনে নিতে পারেননি। মধ্যবিত্ত নামে ছাপোষা শ্রেণীটার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাঁর। পিতার রেখে যাওয়া অঢেল সম্পত্তি পুঁজি করে মাল্টি-মিলিওনিয়ার হয়েছেন। দারিদ্র্য কী জিনিস, কখনওই অনুভব করতে পারেননি। কিন্তু আদরের ধনের মন ভাঙার দুঃসাহস করেননি কখনও। তাই আজম শেখের দৃষ্টিতে ফারদিনের বন্ধু হবার যৎকিঞ্চিৎ যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও টিকে গেল সে।

পিতার সংসারে ভোগ-বিলাসের টিকিটিও না-পাওয়া দীপ্তর কাছে ফারদিন শুধু বন্ধু নয়। আলাদিনের চিরাগ বিশেষ। যেটায় ঘষা দিলে জিন বের হয় না, কিন্তু অর্থের ফুলঝুড়ি ছোটে। ফারদিনের টাকায় নিজের প্রয়োজন মেটায় দীপ্ত। বিনিময়ে উপভোগের নিত্য-নতুন শয়তানি আইডিয়া উপহার দেয় ওকে।

আশিস কুমারের বজ্রমুষ্ঠি ছেলেকে আটকে রাখতে পারেনি। উচ্ছন্নে যাওয়া থেকে ফেরানোর সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। অসহায়ের মত ছেলেকে নেশাখোর বনে যেতে দেখেছেন। মেয়েদের উত্যক্ত করা থেকে শুরু করে মারামারি; অভিযোগের পাহাড় জমতে-জমতে একসময় ওসব গায়ে মাখাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। ছেলে জন্ম দিয়ে কী পাপ করেছেন, মাঝে-মাঝে তাই ভাবেন। রাত-দিন ফারদিনের বাসায় পড়ে থাকে ও। ইচ্ছে হলে কদাচিৎ আসে, নয়তো না। কলেজে পা দেওয়ার আগে হাত খরচের টাকার জন্য ভীষণ বিরক্ত করত। সেটা বন্ধ হয়ে গেছে একেবারে। কী জন্য, সেটা খুব ভাল করেই জানেন তিনি।

পার্টি, মৌজ-মস্তি, মেয়েছেলে এই হল তাদের জীবন। পড়াশোনা মাঝে-মাঝে উঁকি দেয় অনাহুতের মতো। নিত্য-নতুন বারের সন্ধান করা, লেটেস্ট বাইক, মোবাইল কিংবা ফ্যাশন ট্রেণ্ডের খোঁজ বের করা থেকে শুরু করে নতুন শিকারের (গার্লফ্রেন্ড) জন্য ফাঁদ পাতা, সব দীপ্তই করে। ফারদিনের কাজ হল টাকা ঢালা আর মজা লোটা। তাদের কাছে জীবনের গভীর কোনো অর্থ নেই। উপভোগে আকণ্ঠ ডুবে থাকার নামই জীবন দুই বন্ধুর কাছে।

দাঁড়ি-কমা ভুলে ছুটে চলতে গিয়ে কী জঘন্য গাড্ডায় না পড়তে হল! ভাবল দীপ্ত। জেল থেকে তাদের আনার জন্য আজম শেখ মানে দীপ্তর বাবার পিএস গিয়েছিলেন গাড়ি নিয়ে। কিন্তু ওদের বাসা থেকে একটা প্রাণীও যায়নি। এমনিতেই পরিবারের প্রতি খুব একটা টান অনুভব করে না সে। মামলা লড়ার জন্য তার বাবা কোনো লইয়ারও দেননি। ওদের দুজনের জন্য উকিল দিয়েছেন আজম শেখই। আর ভেতরে-ভেতরে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি যে জোরেই খাটিয়েছেন, তা বলাই বাহুল্য। কারাবন্দি অবস্থায় সাহায্য না পাওয়ার কারণেই বাবার প্রতি মনটা বিষিয়ে ছিল দীপ্তর। আজ জেলগেটে কাউকে না-পেয়ে মনে-মনে পরিবার অধ্যায় চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। চুলোয় যাক সব!

পিএসকে দিয়ে ফারদিনই হোটেল রুম বুক করে দিয়েছে। বলেছে, ‘বাড়ি যেতে না-চাইলে ক’টা দিন হোটেলে কাটা। ড্যাড ভেতরে-ভেতরে ফুঁসে আছে তোর উপর। আমার উপর তো চোটপাট দেখাবে না। তবে তোকে হয়তো দু’-চার কথা শুনিয়ে দিতে পারে। তার রাগ একটু পড়ুক। ক’টা দিন হোটেলে থাক। খাওয়া-দাওয়া কর, রেস্ট নে। আমি বাসায় যাই।’

পিএস সাহেবের গাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেছে ওকে বিলাসবহুল হোটেল সিনডারেলার সামনে। রিসেপশনে নাম এবং রেফারেন্স বলতেই বাকি কাজ ভোজবাজির মতো হয়ে গেল। দ্রুত চাবি নিয়ে লিফটে ফিফথ ফ্লোরে উঠে গেল দীপ্ত। রুম নাম্বার ৫০৭। রুম সার্ভিস ছেলেটা ওকে রুম বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল। জানাল, যে-কোনো প্রয়োজনে ইন্টারকমে ডাকলেই ছুটে আসবে সে।

বাথরুমের শাওয়ার যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে দীপ্তকে। সারা গায়ে ময়লা জমে আছে। অনেক সময় নিয়ে স্নান করল ও। গা থেকে যেন ঝেড়ে-মুছে ফেলতে চাইল গত তিনমাসের ময়লা। স্নান জিনিসটা এর আগে কখনওই এতটা উপভোগ করেনি সে।

ঝরঝরে শরীর-মন নিয়ে বাথরুম থেকে যখন বেরোল, চাগিয়ে উঠল খিদে। রুম সার্ভিস ডেকে ইচ্ছেমত পছন্দের খাবার অর্ডার দিল। বিল নিয়ে চিন্তা নেই, ফারদিন বলে দিয়েছে।

উদরপূর্তির পর দু’চোখ জড়িয়ে আসছে ঘুমে। রাতের পর রাত অনিদ্রায় চোখে কালি পড়েছে। চোখের আর দোষ কি? বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই যেন তলিয়ে যেতে লাগল নিদ্রা সরোবরে। এমন সময় সুরেলা শব্দে বেজে উঠল ইন্টারকম। রিংটোনটা খুবই শ্রুতিমধুর। কিন্তু ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় দীপ্তর কানে তা কর্কশই শোনাল। তবুও ধরল সে ফোনটা, ওপাশ থেকে প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই পুরুষ কণ্ঠ বলে উঠল, ‘রুম সার্ভিস স্যার।’

প্রচণ্ড বিরক্তি বোধ করল দীপ্ত। বাজখাঁই গলায় বলে উঠল, ‘কী চাই?’

‘না, মানে বলছিলাম কিছু লাগবে কিনা স্যর?’ ভয়মিশ্রিত কণ্ঠে বলল ছেলেটা।

‘ইডিয়ট! কিছু লাগলে আমি তো ডাকতামই।’

‘ন্, না, মানে স্যর বলছিলাম, কোনো কিছু লাগলে নিঃসঙ্কোচে বলবেন। আমাদের কালেকশনে বেশ ভাল মানের বিদেশি ড্রিঙ্কস আছে। আর স্যর মানে... অন্য কিছুর প্রয়োজন হলেও বলবেন।’ কাঁপা গলায় কথা শেষ করল ছেলেটা।

ইন্টারকম বাজার কারণটা এতক্ষণে ধরতে পারল দীপ্ত। এমন না যে ও এই ধরনের হোটেলগুলোর দুই নম্বরি সার্ভিসগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। বরঞ্চ এ-বিষয়ে বিশেষজ্ঞই বলা যায় ওকে। তবে ফেলে আসা নব্বই দিনের জীবনটা ওকে সাময়িকভাবে বিস্মৃত করে দিয়েছিল এমন একটা শব্দ, যেটা ওর জীবনের মূলমন্ত্র ছিল। আর তা হচ্ছে, উপভোগ। কী যেন বলছিল ছেলেটা? ড্রিঙ্কস আর অন্য কিছু...!

ভেতরের ঘুমন্ত জানোয়ারটা যেন চকিতে জেগে উঠল দীপ্তর। ইঙ্গিতটা ধরতে না-পারার মত উজবুক সে নয়। তবে আজকের রাতটা ওর পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। এন্টারটেইনমেন্ট-এর জন্য শরীরটাও তো ফিট থাকতে হবে, মনে-মনে হাসল ও।

‘বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত, স্যর! আমি...’

‘সমস্যা নেই’, রুম সার্ভিসের কথা কেড়ে নিয়ে বলল দীপ্ত, ‘ওসব পরে হবে। আমি এখন বিশ্রাম করব। কাল দেখা যাবে, কেমন?’ সুর নরম হয়ে গেছে ততক্ষণে ওর।

‘ওকে স্যর! গুড নাইট স্যর, সুইট ড্রিমস!’

ফোন রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল দীপ্ত। অবসাদে প্রায় সাথে-সাথেই চোখ বুজে ফেলল। অবচেতন মনে যদিও দোলা দিয়ে যাচ্ছে মদ আর মেয়েমানুষের শিহরণ। ঠোঁটের আগায় একচিলতে হাসি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে।

 

দুই

হোটেল সিনডারেলা, রুম নাম্বার ৫০৭। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার তৃতীয় দিন আজ দীপ্ত ও ফারদিনের। রুম সার্ভিসের দেয়া ‘তরল’ অফারটা গ্রহণ করেছে দীপ্ত। পছন্দের ড্রিঙ্কসের পসরা সাজিয়ে বসেছে ওরা। প্রাণপ্রিয় বন্ধুকে ডেকে নিতে ভুল করেনি দীপ্ত। বহুদিন পর আবার আকণ্ঠ পান, একলা তো গলা দিয়েই নামবে না! ফারদিন অবশ্য গাইগুঁই করেছিল।

‘কয়েকটা দিন যেতে দে, মাত্রই তো বেরুলাম!’

‘ধুর বেটা! তিনমাসে আমার গলা শুকিয়ে সাহারা মরুভূমি! এ-ঘাটতি পূরণ করতে রোজই তো মদ দিয়ে গোসল করতে হবে। আজ তিনদিন হল নরকবাস শেষ হয়েছে। এতদিনে তো শকওয়েভের ধাক্কাও কেটে যাওয়ার কথা!’

ফারদিনের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা যেন পাখা মেলল। ‘আসছি আমি।’ বলে ফোন কাটল সে।

 

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। রেস্টুরেন্টের মসলাদার চিকেন চপ, সঙ্গে চানাচুর আর হরেক রকম মদের সমাহারে চলছে পানাহার। দুই বন্ধু ফেলে আসা তিক্ত স্মৃতি রোমন্থন করছে আর গিলছে সমানে।

ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই-ছুঁই। ডোরবেল বাজল, সেইসঙ্গে কেতাবি ভাষায় ইনট্রোডাকশন: ‘রুম সার্ভিস, স্যর!’

ছেলেটা রুমে ঢুকতেই তার পিঠ চাপড়ে দিল দীপ্ত।

‘কাজের ছেলে তুমি! দারুণ মাল সাপ্লাই দিয়েছ!’

খুশিতে গদগদ হয়ে উঠল ছেলেটা, ওর হাত কচলানো দেখে দীপ্ত ফারদিনের দিকে তাকাল। ওয়ালেট থেকে হাজার টাকার দুটো নোট বের করে বাড়িয়ে ধরল ফারদিন।

‘নাও, তোমার টিপস!’

আকর্ণ বিস্তৃত হাসি উপহার দিল রুম সার্ভিস।

‘এমন দিলদরিয়া গেস্ট বহুদিন পাইনি, অসংখ্য ধন্যবাদ স্যর!’ টাকাগুলো পকেটে ঢুকিয়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়াল। দোরগোড়ায় পৌঁছে কী যেন মনে পড়েছে ভঙ্গিতে আবার ফিরে তাকাল। তারপর হাত দুটো আবার কচলাতে লাগল।

‘কিছু বলবে?’ জিজ্ঞেস করল দীপ্ত।

‘ইয়ে মানে...স্যর...’ ইতস্তত করছে রুম সার্ভিস।

‘নির্দ্বিধায় বল, এত ভয় পাচ্ছ কেন?’ অভয় দিল দীপ্ত।

‘ভাল জিনিস ছিল, স্যর, যদি লাগে তো বলবেন।’ গলার স্বর অপেক্ষাকৃত নিচু এখন রুম সার্ভিসের।

ওর বলার ভঙ্গিতেই দীপ্ত আর ফারদিন যা বোঝার বুঝে নিল। কথাটা কানে যেতেই একে-অন্যের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করল। কেটে গেল কয়েক সেকেণ্ড। বরাবরের মত দীপ্তই আগ বাড়িয়ে কথা বলল।

‘ভাল মানে, কেমন ভাল?’

বাগড়া দিল ফারদিন, ‘দোস্ত, এখনই এসবের প্রয়োজন আছে? বাদ দে না...’

‘ফারদিন, কী হল তোর বল তো? আমরা কি এসব নতুন করছি? মনে হচ্ছে, জেলখানা তোর পুরুষত্ব কেড়ে নিয়েছে!’

দীপ্তর খেদোক্তি যেন ফারদিনের পৌরুষে আঘাত হানল।

‘ঠিক আছে, কথা বল।’ মুখ ব্যাদান করে বলল সে।

বন্ধুর পিঠ চাপড়ে দিল দীপ্ত। মুখে বলল, ‘সাবাশ, বেটা!’ রুম সার্ভিসের ইউনিফর্মে সাঁটানো নেমপ্লেটের দিকে তাকাল দীপ্ত।

‘হ্যাঁ, আনিস, তোমার ভাল জিনিসের বিস্তারিত বিবরণ পেশ করো। তবে চিপ কলগার্ল-টার্ল চলবে না বলে দিলাম।’ কথাটা বলার সময় শয়তানি হাসি খেলল ওর ঠোঁটে।

‘আমার কন্ট্যাক্টে ওসব নেই, স্যর। ফ্রেশ জিনিস সাপ্লাই দিই।’ আনিসের মুখে এখন দালাল-টাইপ হাসি।

‘কী রকম?’ সাগ্রহে বলল দীপ্ত। আড়চোখে দেখল ফারদিনের চোখে-মুখেও ঝিলিক দিয়ে উঠল লোভ। শালা, ভণ্ড! ভেতরে-ভেতরে ফুটছে, মুখে রা নেই! মনে-মনে দোস্তের উদ্দেশে খিস্তি ঝাড়ল দীপ্ত।

‘স্টুডেণ্ট আছে, স্যর, ভার্সিটি পড়ুয়া। তবে রেট একটু বেশি।’ বলল আনিস।

‘মানি ডাজন্’ট ম্যাটার!’ রুম সার্ভিসের কথার পিঠেই কথাটা বলা হল।

হাসি চেপে রাখা মুশকিল হল দীপ্তর পক্ষে। কারণ, কথাটা তার বন্ধুবরের মুখ থেকেই বেরিয়েছে। যে কিনা এতক্ষণ বেশ অনীহাই প্রকাশ করছিল। যেই তাজা মাংসের গন্ধ পেয়েছে, মুখোশের আড়ালে কামোন্মাদের অবয়বটা দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠল। মনে-মনে খুশিই হল দীপ্ত। মুখে বলল, ‘হ্যাঁ, টাকা কোনো সমস্যা নয়। তবে মধুর লোভ দেখিয়ে চিনি খাওয়ালে, ফুটো পয়সাও পাবে না বলে দিলাম।’ ঝানু ব্যবসায়ীর মত সংলাপ ঝাড়ল সে।

‘একটাকাও অ্যাডভান্স লাগবে না, স্যর। কাজ শেষ হবার পর সন্তুষ্ট হলে তবেই পেমেণ্ট দেবেন।’ কথাটা বলার সময় বেশ আত্মবিশ্বাসী মনে হল আনিসকে। চোখ এড়াল না দুই বন্ধুর।

‘তাহলে আর দেরি কীসের? পাঠিয়ে দাও না তোমার ছাত্রীকে। দেখি কেমন টিউশন নেয়া যায় ওর!’ চোখ টিপল দীপ্ত আনিসকে উদ্দেশ্য করে।

হাসল আনিস, বলল, ‘সে তো হোটেলে আসবে না। ওর ডেরায় যেতে হবে, স্যর।’

ভ্রূ কুঁচকে গেল দুই বন্ধুর।

‘কেন, হোটেল রুমে আসতে সমস্যা কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল ফারদিন।

‘সমস্যা ছিল না। এ-ধরনের মেয়েগুলো তো এ-লাইনে পেশাদার না। শেষবার এক খদ্দেরের কাছে হোটেলে গিয়েছিল। আনফরচুনেটলি ওই রাতে রেইড পড়ে হোটেলটায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জানালার কার্নিশ বেয়ে পাশের বিল্ডিঙের ছাদে লাফিয়ে পড়ে কোনোমতে পালিয়ে বেঁচেছিল। ধরা পড়লে তো মান-সম্মান সব চুলোয় যেত! মিডলক্লাস ফ্যামেলির মেয়ে, স্যর, ওদের তো সম্বল ওই একটা জিনিসই। আর তা হল সম্মান, বেঁচে থাকার অক্সিজেন। ওটা খেয়েই বাঁচে। এরপর থেকে মেয়েটা হোটেলে যাওয়া বন্ধ করল।’ একটু দম নিল আনিস, দেখল দুই মনোযোগী শ্রোতা তার দিকেই তাকিয়ে আছে আগ্রহ নিয়ে। ‘এমনিতেই সে খুব কমই খ্যাপ মারে।’ আবার শুরু করল। ‘তার উপর পুলিশি ঝামেলা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা। তাই ইদানীং একেবারে অফ মেরেই গেছে সে।’

‘তাহলে?’ উদগ্রীব ফারদিন ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল। যেন মেয়েটাকে না-হলে চলছে না, বলার ভঙ্গিটা এমনই।

‘ভাবছেন, কেমন করে পাবেন ওকে?’ মৃদু হাসল আনিস। অভয় দেয়ার সুরে বলল, ‘অত ভাবছেন কেন, স্যর, আমি আছি কী করতে? শহরের মধ্যেই ওর ডেরা। এখান থেকে খুব একটা দূরে না।’

‘চলো যাই তবে।’ বলল দীপ্ত। মদের নেশা ছুটে গেছে, তার জায়গা দখল করেছে জৈবিক তাড়না। একই অবস্থা ফারদিনেরও। দীপ্তর প্রস্তাবে সায় দিল সেও, ‘হ্যাঁ, আজই যাব!’

কী যেন ভাবল আনিস। রিস্টওয়াচে সময় দেখে বলল, ‘এখন বাজছে ন’টা। আমার নাইট নেই আজ, ছুটি হবে এগারটায়। আজ যদি যেতেই চান, তাহলে ওর সাথে কথা বলে নিতে হবে।’

‘তো বলো!’’ তাগাদা দিল দীপ্ত।

পকেট থেকে মোবাইল বের করে নাম্বার টিপল আনিস। ওপাশ থেকে সাড়া পেয়ে কথা বলতে শুরু করল। দুই বন্ধু উৎসুক তাকিয়ে রইল ওর দিকে। জানা গেল, মেয়েটার নাম রেবেকা। আনিস ওদেরকে ক্লায়েণ্ট হিসেবে সম্বোধন করছে। খুব অল্প কথায় শেষ হল ওদের আলাপ।

স্মিত হেসে আনিস বলল, ‘বলেছি না, স্যর, আমার কথা ফেলবে না রেবেকা। সে সময় দেবে বলেছে। দুজনের কথা বলাতে অবশ্য একটু আপত্তি জানিয়েছিল। বলেছি, পেমেন্টের জন্য কোনো টেনশন নেই। কী, ঠিক বলেছি না, স্যর?’

‘আলবত ঠিক বলেছ, দোস্ত!’ দ্রুত বলে উঠল ফারদিন। চকিতে সম্বোধন পাল্টে যাওয়ায় খুব একটা ভাবান্তর ঘটল না আনিসের। দুই কামোন্মাদ প্রয়োজনে ওকে এখন ড্যাডি বলতেও দ্বিধা করবে না, জানে সে। এমন মক্কেলদের ও ভাল করেই চেনে। বলল, ‘আমার মোবাইল নাম্বারটা রাখুন, স্যর। ছুটি হয়ে গেলে আমি একা বের হয়ে যাব। আপনারা সাথে-সাথে বেরোবেন না। রিসেপশনে কেউ যেন বুঝতে না-পারে, আপনাদের সাথে আমার কোনো সংশ্রব আছে। না হলে চাকরিটা হারাতে হবে আমাকে। টেকনিক্যাল মোড়ে যাত্রী ছাউনির সামনে থেকে আমাকে পিক করবেন। ওখান থেকে আমিই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব আপনাদের।’

‘সত্যি বলতে কী, আমার তর সইছে না, দোস্ত!’ হেসে বলল ফারদিন। ‘তোমাকে বলতে বাধা নেই, গত নব্বই দিনে নারীদেহের ঘ্রাণ কী জিনিস তাই ভুলতে বসেছি। আর যে বর্ণনা তুমি দিলে...’ ইচ্ছে করেই কথাটা অসম্পূর্ণ রাখল সে।

দু’পা এগিয়ে এসে আনিসের কাঁধে হাত রাখল দীপ্ত। কণ্ঠে মধু ঢেলে বলল, ‘তোমার স্টকে বাবা (ইয়াবা) আছে তো?’

একগাল হাসিতে ভরে উঠল আনিসের সুশ্রী মুখ।

‘পারফেক্ট কন্টাক্টে আছেন, স্যর! নিশ্চিন্ত থাকুন, বাবা পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ আছে।’

‘জিনিয়াস তুমি ম্যান! সবকিছুই তোমার নখদর্পণে!’ সোল্লাসে বলে উঠল দীপ্ত!

‘তাহলে, স্যর, ওই কথাই রইল। আপনারা বেরিয়ে কল দেবেন। এখন যেতে হবে আমাকে।’ দোরগোড়ায় পৌঁছে থমকে যেতে হল ওকে ফারদিনের ডাক শুনে।

‘দোস্ত, একটা কথা শুনে যাও।’

‘জি, বলুন, স্যর।’

‘রেবেকার কোনো ছবি আছে তোমার কাছে? জাস্ট এক নজর দেখব, বুঝতেই পারছ!’ লাজুক হাসি ফারদিনের ঠোঁটে।

‘এখন থেকে অল্প সময়ের মধ্যে তো জলজ্যান্ত রেবেকাই আপনার বাহুলগ্না হবে, স্যর! তবুও যখন বলেই ফেলেছেন, কী আর করা!’

হেসে মোবাইল বের করে গ্যালারি থেকে ছবি বের করে বাড়িয়ে ধরল ওদের দিকে।

‘দেখুন, স্যর।’

মোবাইলের চওড়া ডিসপ্লেতে নীল রঙের শিফন শাড়ি পরা যে-মেয়েকে দেখা যাচ্ছে, তাকে হাজারও মেয়ের ভিড় থেকে নিমেষেই আলাদা করা যাবে। লম্বা-ছিপছিপে শরীরের গড়ন। দেহের কোথাও বাড়তি চর্বি নেই। স্লিভলেস ব্লাউজ তার ভরাট ঊর্ধ্বাঙ্গ কোনোরকমে বেঁধে রেখেছে। অনাবৃত সুগভীর নাভিতে তার রাজ্যের রহস্য। অপরূপ সুন্দর মুখটা যেন সুনিপুণ ভাবে বসিয়ে দেয়া হয়েছে ক্ষুরধার শরীরের উপর।

জীবনে বহু নারীর সংস্পর্শে এসেছে দুই বন্ধু। কিন্তু হাতে ধরা ছবির মেয়েটির সৌন্দর্য স্রেফ বোবা বানিয়ে দিয়েছে ওদের। মুখ হাঁ হয়ে গেল। অস্ফুটে দু’জনের কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে এল একটা শব্দ, ‘ওয়াও!’

 

তিন

প্ল্যান মোতাবেক টেকনিক্যাল মোড় থেকে ফারদিনের গাড়ি তুলে নিল আনিসকে। ড্রাইভ করছে ফারদিনই। পাশের সিটে বসেছে দীপ্ত। ব্যাকসিটে গিয়ে বসল আনিস।

‘বলো, দোস্ত, রেবেকার পথ কোন দিকে?’

পরক্ষণেই নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠল হো-হো করে। বাকি দুজনও যোগ দিল তার সঙ্গে।

‘হাইওয়েতে উঠে সোজা যেতে থাকুন, স্যর। অক্সিজেন মোড় থেকে হাতের বাঁ পাশ ধরে কিছুদূর গেলেই রেবেকার ডেরা।’ পথ বাতলে দিল আনিস।

টর্নেডোর গতিতে ল্যাণ্ডক্রুজার ছুটিয়ে চোখের পলকেই গন্তব্যস্থানে নিয়ে গেল ফারদিন। ড্রাইভিঙে সে বরাবরই লা-জওয়াব। তার উপর রেবেকার সান্নিধ্য লাভের ব্যাকুলতায় ফুটছে টগবগ করে। যেটুকু সময় লাগার কথা গন্তব্যে পৌঁছনোর জন্য, তার তিনভাগের একভাগ সময়েই পৌঁছে গেল ওরা।

বাড়িটা অক্সিজেন-খাগড়াছড়ি হাইওয়েতেই। একতলা ভবন, নিঃসঙ্গ। আশপাশের বসত-বাড়ির অবস্থান বেশ দূরত্বে। ছিমছাম, কোলাহল মুক্ত পরিবেশ।

গাড়ি থেকে নেমে দরজা খুলে দুই বন্ধুকে আহ্বান জানাল আনিস।

‘আসুন, স্যর।’

সদর দরজা খোলাই ছিল। আনিসের পিছু নিয়ে ভেতরে ঢুকল ওরা। ড্রইংরুমে বসানো হল ওদের। এক সেট সোফা, একপাশে ডাইনিং টেবিল আর অন্যপাশে ডাবল সাইজের একটা খাট। এই হল ড্রয়িংরুমের স্ট্যাটাস।

‘বসুন, স্যর, আমি রেবেকাকে ডেকে দিই।’

অন্দরমহলে চলে গেল আনিস। অভিসার প্রত্যাশী দুই বন্ধুর দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা শুরু হল। স্থায়ী হল মিনিট পাঁচেক। ফিরে এল আনিস, সঙ্গে নিয়ে এল রূপ কারিগরের নিজ হাতে তৈরি এক অপূর্ব সৃষ্টিকে।

ছবিতে দেখা সেই মোহময়ীর চেয়ে নিদেনপক্ষে দশগুণ বেশি সুন্দরী সামনে দাঁড়ানো অপ্সরা। ঢিলে-ঢালা একটা টি-শার্ট আর অফ-হোয়াইট জিন্স পরনে। দিঘল কালো চুলগুলো কায়দা করে খোঁপা বানিয়ে বেঁধে নিয়েছে ক্লিপের সাহচর্যে। সোনালি রঙের নাকফুলটা অন্য মাত্রার সৌন্দর্য এনে দিয়েছে ওর অনিন্দ্য সুন্দর চেহারায়।

স্থান-কাল-পাত্র ভুলে নিশীথে পাওয়া মানুষের মত ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল দুই বন্ধু।

আনিসই মর্ত্যে ফেরাল ওদের।

‘বলেছিলাম না, স্যর, আমি ফ্রেশ জিনিসের কারবার করি!’ দুই বন্ধুর ঘোরলাগা দৃষ্টি উপভোগ করছে সে। ‘এই হল রেবেকা, অ্যাণ্ড নাউ, শি ইজ ইওরস!’ হেসে বলল সে।

এগিয়ে এসে মুখোমুখি সোফায় বাঁ-পায়ের উপর ডান পা তুলে মোহনীয় ভঙ্গিতে বসল। স্টিচ জিনসের কাপড় ভেদ করে দৃশ্যমান হল ওর মাংসল ঊরু। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলা ঢোক গিলে ভেজানোর ব্যর্থ প্রয়াস চালাল দুই বন্ধু।

‘সো, আই ডোণ্ট ওয়ানা বি কাবাব মে হাড্ডি!’ হাসছে আনিস। ‘কাল হোটেলেই দেখা হবে আবার, গেলাম আমি।’ বেরিয়ে যাবার সময় চোখ মটকাল দুই বন্ধুর উদ্দেশে। বলল, ‘হ্যাভ এক্সট্রিম ফান, স্যর!’

উঠে গিয়ে দরজা বন্ধ করল রেবেকা। কণ্ঠে সুরের ঝঙ্কার তুলে বলল, ‘এভাবে ঝিম মেরে আছেন কেন? কী খাবেন বলুন। চা-কফি অথবা... সলিড কিছু?’ শেষের কথাটা বলার সময় মোহনীয় ভঙ্গিতে ভ্রূ নাচাল। দীপ্ত ও ফারদিন কিছু বলতে চাইল। থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘জানি, আনিস বলেছে আমাকে। আপনারা যা-পছন্দ করেন, তা আমার স্টকেও আছে, রাখতে হয়। রাশান ভদকা, অরিজিনাল। নিয়ে আসছি এক্ষুণি।’ বলে ভেতরে চলে গেল রেবেকা।

চেপে রাখা নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল দুই বন্ধু।

‘ট্রাস্ট মি, দোস্ত, আমার জীবনের সেরা মাল এই রেবেকা!’ উত্তেজনায় কাঁপছে দীপ্ত।

‘শালা, তোর আর আমার জীবন তো একই। যখন থেকে মেয়েদের শরীর ঘাঁটতে শুরু করেছি, তুই শালাই তো আগে-আগে পথ দেখিয়েছিস!’ কপট রাগ দেখিয়ে বলল ফারদিন।

হাসল দীপ্ত, বলল, ‘ঠিক আছে দোস্ত, কারেকশন করছি। আমাদের জীবনের সেরা মাল এই রেবেকা।’

ট্রেতে গ্লাস আর ভদকার বোতল হাতে ফিরল রেবেকা। পরিবেশন করল নিজ হাতে। নিজের জন্যও নিল।

‘চিয়ার্স!’ বলে তিনজনই চুমুক দিল গ্লাসে।

‘চলুন, পরিচিত হয়ে নেয়া যাক,’ মিষ্টি হেসে বলল রেবেকা। ‘আমি রেবেকা নাজনীন। বিবিএ পড়ছি, অ্যাকাউণ্টিং।’

নিজেদের পরিচয় দিল দুই বন্ধু। এটা-সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ কথা-বার্তা চলল। ফাঁকে চলতে লাগল মদপান। কিছুক্ষণ পরই চোখ ঢুলুঢুল হয়ে উঠল দুই বন্ধুর। কথা জড়িয়ে আসতে লাগল। এক সময় দুজনেই ঢলে পড়ল গভীর ঘুমে। কাছে গিয়ে নেড়ে-চেড়ে ওদের পরীক্ষা করল রেবেকা। নিশ্চিত হয়ে হাতে নিল মোবাইল। ডায়াল করল কাঙ্খিত নাম্বারে।

‘পাখি ঘুমিয়েছে, চলে এসো!’

 

চার

চোখে-মুখে জলের জোর ঝাপটায় ঘুম ভাঙল দীপ্ত ও ফারদিনের। নিজেদের আবিষ্কার করল গাছের সঙ্গে পিছমোড়া হাতবাঁধা অবস্থায়। মুখে স্কচ টেপ লাগানো। পিটপিট করে চোখ মেলতেই বিস্ময়ে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল ওদের। ঘোলাটে দৃষ্টির সামনে গহীন অরণ্য। রাতের আঁধারকে রহস্যময় করে তুলেছে শুকনো ঝরাপাতা আর কাঠ-পাতার সাহায্যে জ্বালানো আগুনটা। কিছু দূরে কাঁচা রাস্তার উপর ওদের ল্যাণ্ডক্রুজার পার্ক করা। আগুনের ওপাশে দুজন মানুষ। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে ঠিকমত ঠাউর করা যাচ্ছে না কারা ওরা। তবে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। কাছে এসে দাঁড়াতেই সদ্য পরিচিত দুটি মুখ দেখতে পেল ওরা।

রেবেকা আর আনিস!

ঝট করে ভয়ের একটা ঠান্ডা শিরশিরে অনুভূতি শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল দুই বন্ধুর। জঙ্গলে কেন নিয়ে আসা হয়েছে ওদের? মদের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছিল নিশ্চয়ই! গভীর ঘুমে এখনও জড়িয়ে আসতে চাইছে চোখ।

কেন? কী উদ্দেশে রাতের আঁধারে এভাবে তুলে আনা হয়েছে ওদের? প্রশ্নটা করার জন্য চিৎকার করা শুরু করল দুই বন্ধু। তবে স্কচ টেপের বন্ধনীর ভেতর তা শুধু গোঙানির আওয়াজই হল।

‘ওয়েলকাম টু দ্য জাঙ্গল, লুজার্স!’ আনিসের কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠস্বর, যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছে সেই আওয়াজ।

‘পাবে, সব প্রশ্নেরই উত্তর পেয়ে যাবে।’ পুনরায় শুরু করল আনিস। ‘হয়তো ভাবছ, কোটিপতি বাবার আদরের ধনকে কিডন্যাপ করার একটাই উদ্দেশ্য, টাকা।’ যেন হঠাৎ মনে পড়েছে, এই ভঙ্গিতে বলল, ‘ও হ্যাঁ, আপাতত তোমাদের মুখের বাঁধন খুলে দেয়া যায়। অনেক কথা-বার্তা আছে। মুখে তালা লাগিয়ে রেখে তো আলাপ হয় না!’

এগিয়ে গিয়ে দুজনের মুখের বাঁধন খুলে দিল সে। সাথে-সাথে অশ্রাব্য খিস্তি-খেউরের তোড়ে ভেসে যেতে লাগল। মানিকজোড়ের জিহ্বার ধার যেন সামুরাই তলোয়ারকে হার মানাবে!

‘স্টপ! স্টপ ইউ ব্লাডি স্কাউনড্রেলস!’ নিজেও গাল পেড়ে থামানোর চেষ্টা করল ওদের। ব্যর্থ হয়ে মেজাজ খিঁচড়ে গেল ওর। ডান পা তুলে সজোরে দু’বার লাথি চালাল দুজনের চোয়াল বরাবর। দীপ্তর ঠোঁট ফেটে রক্ত বেরিয়ে এল। ফারদিনের চোখের নিচে আঘাতটা লাগল। মুহূর্তে ফুলে গিয়ে কালচে দাগ বসে গেল ওখানটায়। কাজ হল ভোজবাজির মতো। জোঁকের মুখে নুন পড়লে যে অবস্থা হয়, ঠিক সেইভাবে মিইয়ে গেল দুই বন্ধু। বুঝতে পারল, কঠিন চিজের পাল্লায় পড়েছে!

নির্বিকার ভঙ্গিতে বুকের উপর দু’হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে রেবেকা। চোখের সামনে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলো যেন খুবই স্বাভাবিক।

‘দেরি করে লাভ নেই, নিবিড়। বেজন্মা দুটোর হিল্লে করে ফেলতে হবে।’ ঠান্ডা গলায় বলল সে।

‘কে তোমরা? ওকে নিবিড় নামে ডাকছ কেন? ওর নাম তো আনিস! হিল্লে করবে মানে? কী করতে চাও আমাদের?’ ভয়ার্ত গলায় বলল ফারদিন। ‘দেখ, টাকা-পয়সা যত চাও দেব। ড্যাডিকে একটা ফোন দিলেই হবে। তোমাদের ডিমাণ্ড পূরণ হয়ে যাবে। আ... আমাদের ছেড়ে দাও।’ কণ্ঠে আকুতি ফুটল ওর। ‘একটু পানি দাও! খুব পিপাসা লেগেছে!’

বোতল থেকে কী যেন ঢালল রেবেকা। ঠিকমত ঠাউর করতে পারল না দুই বন্ধু। তবে মুখের কাছে নিয়ে ধরতেই টের পেল জিনিসটা কী। তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল দুজনেই। ‘শালা, তোর কাছে মদ চেয়েছে কে?’ ফুঁসে উঠে বলল দীপ্ত।

‘খেয়ে নাও, পিপাসা মেটাও। রিফিউজ করলে এটাও পাবে না।’ নির্লিপ্ত গলায় বলল নিবিড়। বাধ্য হয়েই রেবেকার হাতেই মদ খেল ওরা। পাশার দান উল্টে যাওয়া বোধকরি একেই বলে। কিছুক্ষণ আগে এই রেবেকার হাত থেকেই মদের গ্লাস নেবার সময় পুলক অনুভব করছিল ওরা। আর এখন প্রিয় জিনিসটা খাচ্ছে নেহাত বাধ্য হয়েই।

‘তোমার ড্যাডির টাকার অভাব নেই, মিস্টার ফারহান।’ বলল রেবেকা। ‘তুমি যেখানেই পা ফেল, সেখানেই পচা ক্ষতের সৃষ্টি হয়। আর তোমার বাপ টাকা ছিটিয়ে সেই ক্ষত ঢেকে দেয়। তোমার বাপ চিন্তা করে ক্ষত ঢাকার, কিন্তু চিরতরে সারানোর কথা একবারও ভাবে না। যদি ভাবত, তোমার আর তোমার শঠ, চরিত্রহীন বন্ধুর কারণে কোনো সাধারণ মানুষের জীবন নরকে পরিণত হত না!’ কণ্ঠস্বর কোমল অথচ কঠিন রেবেকার।

‘এত হেঁয়ালি না-করে নিজেদের পরিচয় দাও! বলো কী ক্ষতি করেছি তোমাদের? এর আগে কক্ষনো তোমাদের দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।’ কর্কশ গলায় বলে উঠল দীপ্ত। নিচের ফেটে যাওয়া ঠোঁট থেকে এখনও চুঁইয়ে-চুঁইয়ে রক্ত ঝরছে। ভেতরে-ভেতরে ভয়ে কুঁকড়ে গেলেও অচেনা আততায়ীর সামনে তা প্রকাশ করতে চায় না। ও এখনও ভালভাবেই বিশ্বাস করে, এটা জাস্ট মানি ম্যাটার। দুই কিডন্যাপার ঠিকই টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেবে।

‘এতই যখন পরিচয় জানার শখ, তাহলে বলি: মারিয়া রোজারিও নামে কোনো মেয়ের কথা মনে আছে তোমাদের?’ কথাটা বলার সময় নিবিড়ের চোখ দুটো সেঁটে রইল দুই বন্ধুর উপর। যেরকম আশা করেছিল, ঠিক সেরকমই প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করল। নামটা কানে যেতেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল দুজনেই। পাশাপাশি গাছের সঙ্গে পিছমোড়া বাঁধা অবস্থায় চকিতে একবার নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল ওরা।

‘হুম, বোঝা যাচ্ছে খুব ভালভাবেই মনে আছে। অবশ্য এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবার কথাও নয়। কারণ, এর আগে যত মেয়ের জীবন নিয়ে খেলেছ, তাদের কারও জন্যেই তোমাদের চোদ্দশিকের পিছনে যেতে হয়নি। মারিয়া নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও তোমাদের শাস্তি চেয়েছিল। আর দেশের প্রচলিত আইন তার জীবনের মূল্য চুকিয়েছে মাত্র নব্বই দিনের বিনিময়ে।’ কথা বলে চলেছে নিবিড়। আর অনিন্দ্যসুন্দর চোখ দুটোয় চরম ঘৃণা নিয়ে অভিযুক্তদের দিকে তাকিয়ে আছে রেবেকা।

‘কলেজ পড়ুয়া একটা মেয়ে। সহজ, সরল আর সুন্দর।’ খেই ধরল আবার নিবিড়। ‘জীবনকে সবেমাত্র উপভোগ করতে শুরু করেছে। মানুষকে খুব সহজে বিশ্বাস করার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই তার কাল হল। প্রতি রোববারে মেয়েটা চার্চে যেত। বন্ধুদের সাথে নির্জলা আড্ডায় মেতে থাকত। বইয়ের প্রতি ছিল অগাধ ভালবাসা। বাসার ড্রয়িংরুমে ওর শেলফে বইয়ের বহর দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না, মারিয়ার বয়স বিশের কোঠায়।

‘দিঘির জলের মতো স্বচ্ছ মনের মেয়েটির উপর কোন্ কুক্ষণে তোমাদের মতো শকুনের নজর পড়ে গেল! তোমাদের বন্ধুত্বের ছলনায় প্রলুব্ধ হল সে। হবে না-ই বা কেন, মাত্র তিনমাসে ওর পছন্দ-অপছন্দ, ওর ভাললাগা নিয়ে স্টাডি করেছ তোমরা। বিশেষ করে ওই জানোয়ারটা (দীপ্তর দিকে ইঙ্গিত করে)।

‘তোমাদের বন্ধুত্বের প্রস্তাবে রাজি না হবার কোনো কারণ চোখে পড়েনি ওর। পড়ার কথাও নয়। মুখোশের আড়ালে তোমাদের ভয়ঙ্কর কদর্য চেহারা ও দেখতে পায়নি। ওর ভাবনার চৌহদ্দির মধ্যে শুধু বিশ্বাস আর মানুষের প্রতি মমত্ববোধই ছিল। এই পৃথিবীর মানুষের নোংরা রূপ আগে দেখেনি সে।

‘জন্মদিনের সেলিব্রেশনের কথা বলে তোমরা ওকে হোটেলে নিয়ে গেলে। সরল বিশ্বাসে তোমাদের ফাঁদে পা দিল সে। বিলাসবহুল হোটেলের নির্জন কক্ষে তোমাদের হাতে ধ্বংস হল ওর মান-সম্মান, বিশ্বাস আর সম্ভ্রম। সারাটা রাত দুই মানুষরূপী পশুর হাতে নিষ্পেষিত হল কোমল, কচি ও সরল একটি মেয়ের সবকিছুই। হোটেলে ঢোকার আগেও যে মেয়েটি পৃথিবীর সবচে’ সুখী মানুষের একজন ছিল, ট্যাক্সিতে করে বাসায় যাওয়ার সময় তা কেবলই অতীত। যাবার সময় সে শুধু একটা হুমকিই সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল: রাতে যা-যা ঘটেছে, সব ক্যামেরায় ধারণ করা আছে। মুখ খুললেই ভাইরাল।

‘পরিবারের কাছে গোপন থাকেনি তা। সারা রাত মেয়ের হদিস পাবার চেষ্টায় থানা-পুলিশ পর্যন্ত দৌড়-ঝাঁপ করেছেন। সকালে বিধ্বস্ত মেয়ের গগনবিদারী কান্না দেখে বোঝার বাকি রইল না কিছুই। দিশেহারা মা এমন ভয়াবহ সঙ্কটে পড়ে অন্য আর দশজন মায়ের মতই হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ভুল করে বসলেন। মেয়ের গা থেকে কলঙ্ক মোছার চেষ্টা হিসেবে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জল ঢাললেন। এতে করে কলঙ্ক তো মুছলই না, উল্টো নষ্ট হল ধর্ষণের এভিডেন্স।

‘মিডিয়ায় চাউর হল খবর। মুখরোচক সংবাদে ভরে গেল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। একদল বিকৃতমস্তিষ্ক মানুষের হাতে দ্বিতীয়বার ধর্ষিত হল মারিয়া। এখানেই শেষ নয়। থানায় মামলা হবার পর, আইনের বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে গিয়ে বারবার তাকে বলতে হল, কী ঘটেছে, কী হয়েছে। ভরা আদালতে শুনানিতে তার কাছে সবিস্তারে জানতে চাওয়া হল, আসলেই ওই রাতে কী ঘটেছিল।

‘এভাবে বারবার ধর্ষিত হল। তোমাদের কাছে, সমাজের কাছে এবং প্রশাসনের কাছে। ছোট্ট মেয়েটির নিঃশেষ হয়ে যাবার জন্যে হোটেলের ওই কালরাত্রিই যথেষ্ট ছিল। তার উপর পদে-পদে জুটল লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। সইতে পারল না বেচারি।’

এ পর্যায়ে গলা ধরে এল নিবিড়ের। টলমল করতে থাকা চোখ দুটো ভরে উঠল বেদনামিশ্রিত লোনাজলে। বিস্ময়ে পাথর বনে যাওয়া দুই রেপিস্ট দেখল কাঁদছে রেবেকাও। তবে সেই কান্না উভয়ের মুখের অঙ্গভঙ্গিতে কোনোপ্রকার ছাপ ফেলছে না। চোখের কোল বেয়ে পানিই ঝরছে শুধু, আর দৃষ্টিতে মিশে আছে অদ্ভুত এক জিঘাংসা। লক্ষ্য করে ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল ফারদিন ও দীপ্তর। নিবিড়ের ঠান্ডা গলায় বলে চলা বয়ানভঙ্গি কেন যেন ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে ওদের মনে।

‘সুইসাইড করার আগে পুরো ঘটনা লিখে যায় সে। স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় শাস্তি দাবি করে তাদের যারা ওর সম্ভ্রমহানি করেছে। নাম, পরিচয়, বৃত্তান্ত সবই সুইসাইড নোটে লিপিবদ্ধ করে যায়। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার আগে তার মনের গহীন কোণে হয়তো ক্ষীণ আশা ছিল, নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাবে ধর্ষকদের। ধন্য আশা কুহকিনী! ধিক্ এই নষ্ট সমাজের ততোধিক নষ্ট এই সিস্টেমকে! যেটা অত্যাচারিতদের সহায় হবার বদলে মাথার ছায়া হয়ে দাঁড়ায় নিপীড়কদের!’

নিবিড়ের চোখ ঠিকরে বেরুচ্ছে অনল। চোখ পড়তেই রক্ত হিম হয়ে গেল দুই ধর্ষকের। পুড়ে ছাই হবার শঙ্কায় থরথর কাঁপতে শুরু করল ওরা।

কচি শরীরের লোভেই মারিয়াকে ফাঁদে ফেলেছিল ওরা। তবে মেয়েটা যে আত্মহত্যা করে বসবে, এটা কল্পনাতেও ছিল না। মারিয়ার পরিবার সম্পর্কে খুব একটা জানার সুযোগ হয়নি ওদের। অবশ্য জানার যে খুব আগ্রহ ছিল, তা-ও না। শুধু জানত, ওর বাবা-মা ছিল। কিন্তু এই দুজনের সঙ্গে মারিয়ার সম্পর্ক কী?

‘কে তোমরা? উদ্দেশ্য কী তোমাদের?’ প্রশ্নটা বেরিয়ে এল দীপ্তর মুখ দিয়ে। হাতের বাঁধন খোলার জন্য ছটফট করছে সে।

‘হুম, আমাদের পরিচয় খোলসা করার সময়ও হয়ে গেছে।’ শীতল, জলদগম্ভীর স্বরে বলল নিবিড়। রেবেকার দিকে তাকাল, দেখল নিভু নিভু আগুনটার উপর শুকনো পাতা আর কাঠ ফেলছে সে। কাছে কোথাও ভয়াল, অপার্থিব সুরে ডেকে উঠল শিয়াল। ঝিঁঝিঁ পোকার ক্রমাগত ডাকে রাতের নিস্তব্ধতা যেন জমাট বেঁধে চলেছে।

নীরবতা ভেঙে আবার শুরু করল নিবিড়।

‘মারিয়া তার সবকিছুই শেয়ার করত একজনের সাথে। বিশ্বাস করত তাকে অন্ধের মত। স্বপ্ন দেখত তাকে নিয়ে। তাকে তোমাদের কথাও বলেছিল সে। পরিচয় করিয়ে দেয়ার অভিপ্রায় ছিল। তাদের সম্পর্কটা ছিল বিশ্বাসের, মর্যাদার, পবিত্রতার আর... ভালবাসার। কিন্তু যে কঠিন সময়ে ভালাবাসার মানুষকে পাশে পাবার কথা ছিল বেচারির, সেই কঠিন সময়েই কাপুরুষের মতো পিঠটান দিল সে। গিরগিটির মত রঙ বদলাল। ধর্ষণের কলঙ্কের চেয়েও যেটা বেশি কষ্ট দিল তাকে।

‘তোমরা দু’জন ওকে জানে মেরেছ, আর তার কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিয়েছে সেই মানুষটির অবহেলা। বেঁচে থাকার কোনো অর্থই খুঁজে পাচ্ছিল না বেচারি।’ একটু থামল নিবিড়, ধরা গলায়, প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে বলল পরের কথাটা: ‘আর আমিই হলাম হতভাগ্য সেই কাউয়ার্ড!’

দু’ফোঁটা অশ্রুজল টপ করে ঝরে পড়ল সবুজ ঘাসের গালিচায়। মিশে গেল মৃত্তিকার সঙ্গে। সেই নোনা জলে মিশে আছে হারাবার বেদনা, অক্ষমতার গ্লানি আর অনুতাপ।

ওকে এভাবে কাঁদতে দেখে এগোনোর জন্যে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে যেতে হল রেবেকাকে।

‘আমি ঠিক আছি।’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল নিবিড়। শার্টের হাতায় চোখ মুছে নিয়ে বলল, ‘মারিয়ার মৃত্যুর পর আমি আক্ষরিক অর্থেই জীবন্মৃত হয়ে গেছি। ওর কোমল চেহারাটা তাড়া করে ফিরছে আমাকে। চোখ বন্ধ করলেই ওকে দেখতে পাই। সুন্দর, মায়াবি মুখটা কোনো কথা না-বলেই অনেক কথা বলে যায় আমাকে। সে কী চায় খুব ভাল করেই বুঝতে পারি। এ-ও বুঝতে পারি, ওর চাওয়া পুরণ না-হওয়া অবধি না তার আত্মা শান্তি পাবে, না আমি শান্তিতে থাকতে পারব।’

‘মারিয়ার মৃত্যুর পর এই দেশটার উপরই চরম অনীহা এসে যায় তার বাবার।’ এবার কথা বলছে রেবেকা। ‘এক মুহূর্তও এখানে থাকতে মনকে মানাতে পারছিলেন না তিনি। তার এক ভাই থাকেন ভারতের গোয়ায়। ব্যবসা-পাতির বেশ পসার ঘটিয়েছেন ওখানটায়। ভাইকে বহু বছর ধরে পীড়াপীড়ি করেও রাজি করাতে পারেননি ওখানে যাবার জন্যে। মারিয়ার মৃত্যুর পর এখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে পাকাপাকিভাবেই চলে গেলেন স্ত্রীকে সাথে নিয়ে। তবে রেখে যেতে বাধ্য হলেন তার বড় মেয়েকে। পড়াশোনার জন্যে যে কিনা হোস্টেলে থাকছে। বিবিএ ফাইনাল এক্সামের বাকি ছিল চারমাস। এর মাঝে তার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় এক শর্তেই পরীক্ষার জন্যে মেয়েকে ছাড়তে রাজি হলেন। আর তা হল, পরীক্ষা শেষ হওয়া মাত্রই গোয়ার পথে রওনা হতে হবে।’ দম নিল খানিকটা রেবেকা, তারপর সরাল আরেক রহেস্যর পরদা: ‘মারিয়ার সে-বড় বোনের নাম রেবেকা, রেবেকা রোজারিও!’

ততক্ষণে ডাঙায় তোলা মাছের মতো খাবি খাচ্ছে দুই ধর্ষক। কিডন্যাপারদের পরিচয় তাদের এতটাই ধাক্কা দিয়ে গেল, যেটা হজম করা বেশ দুঃসাধ্যই হয়ে দাঁড়াল তাদের জন্য।

আনিসুল ইসলাম নিবিড়, আনিসের পুরো নাম। সিনডারেলা হোটেলে চাকরি করছে বছরখানেকের বেশি। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে এমবিএ করছিল। চাকরিটা নিয়েছিল মারিয়ার জন্যেই। নিজের আর মারিয়ার পড়াশোনা, ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স, বিয়ে। এসব নিয়ে স্বপ্ন বুনছিল ওরা। খুবই সাধারণ এবং সরল সে-স্বপ্নগুলো। কিন্তু ভেঙে চুর হয়ে গেছে নোংরা দুই শ্বাপদের হিংস্র থাবায়।

মারিয়ার আত্মহত্যার জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না নিবিড়। একটু সাহস আর অপার ভালবাসায় বুকে জড়িয়ে নিলে নিশ্চয়ই মেয়েটা লড়াই করে বাঁচার চেষ্টা করত। কিন্তু নিবিড়ের কাছ থেকে উল্টোটাই পেল বেচারি।

দিনের-পর-দিন, রাতের-পর-রাত মানসিক অশান্তিতে কাটতে থাকে নিবিড়ের। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়, যে-করেই হোক, মারিয়ার অপরাধীদের সমুচিত শাস্তি পেতে হবে। আইনের ফাঁক গলে অপরাধীরা যে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছে, সে-খবর আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল। রেবেকা তাকে চিনত প্রথম থেকেই। তবে মারিয়ার সঙ্গে তার প্রেমের কথা জানত না। সব খুলে বলে বেবেকাকে সে। জানায়, প্রায়শ্চিত্ত না করতে পারলে সে এমনিতেই মরে যাবে। যা করার সেই করবে, রেবেকা তাকে সহযোগিতা করবে শুধু। রেবেকাও সবকিছুর বিনিময়ে হলেও বোনের ধর্ষকদের শাস্তি চেয়েছিল মনে-প্রাণে। অর্থ আর প্রতিপত্তির জোরে যখন দুই অপরাধী জেল থেকে ছাড়া পেল, ভীষণ মুষড়ে পড়েছিল ও। বাবা-মা থাকলে কখনওই নিবিড়ের প্রস্তাবে রাজি হবার সুযোগ পেতনা সে। তবে ওই দুই বেজন্মাকে দেশের প্রচলিত আইন শাস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ভীষণ ক্ষোভ থেকেই নিবিড়ের সঙ্গে যোগ দেয় প্রতিশোধের মিশনে।

রেবেকাকে টোপ বানানোর প্ল্যানটা তখনই নিবিড়ের মাথায় আসে যখন জানতে পারে আজম শেখের ছেলে ফারদিনের দোসর দীপ্ত সিনডারেলা হোটেলেই থাকতে আসছে। এর পরের ঘটনাগুলো তাদের প্ল্যান মোতাবেকই ঘটেছে। নারীমাংস লোভী দুই নরপিশাচের জন্য ওই একটা মারণাস্ত্রই অব্যর্থ ছিল।

 

এতক্ষণ চুপ করে ছিল দুই বন্ধু। হঠাৎ খিস্তি-খেউর শুরু করল দীপ্ত। সঙ্গে হুমকি-ধামকি। রিস্টওয়াচে সময় দেখল নিবিড়। রাত বাজে দুটো। রেবেকাকে ইশারা করল। পাশে রাখা ব্যাগ থেকে স্কচটেপ বের করে ওদের মুখ পুনরায় আটকে দিল রেবেকা। এবার সর্বশক্তি দিয়ে হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা চালাল ওরা। তবে নিবিড় আর রেবেকা কোনো ঝুঁকি নেয়নি। তাই সে-চেষ্টা বিফলেই গেল দীপ্ত ও ফারদিনের।

খুব ধীরে, শীতল গলায় কথা বলে উঠল নিবিড়।

‘তোমরা যেমন আমার মারিয়াকে নিয়ে স্টাডি করেছ, আমিও তোমাদের কৃতকর্মের আদ্যোপান্ত জেনেছি। অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছ দু’জন মিলে। বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতেও জারি থাকবে তোমাদের এই নোংরা সেক্স ট্রিপ।

‘চাইলে তোমাদের জবানবন্দি নিতে পারি। কবুল করাতে পারি তোমাদের অপরাধ। কিন্তু সব প্রমাণাদি হাজির করার পরও তোমাদের টিকিটিও কেউ ছুঁতে পারবেনা। তোমরা খালাস পাবে, মুক্ত বাতাসে বের হয়েই আবার কোনো নিরপরাধ মেয়েকে শিকার বানাবে। আবার কোনো মারিয়া লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সইতে না-পেরে ঢলে পড়বে মৃত্যুর কোলে। আবার কোনো নিবিড়কে বয়ে বেড়াতে হবে অক্ষমতার গ্লানি। প্রতিশোধের অনল বুকে নিয়ে নির্ঘুম রাত কাটাতে হবে। তার চেয়ে...’ কথার মাঝে খানিক বিরতি নিল সে। তারপর দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘এই দেশের মাটি থেকে দুটো বেজন্মা কমে গেলেই সবার জন্যেই মঙ্গল!’

চোখ খুলে যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে দুই বন্ধুর। ক্রমাগত গোঙানির আওয়াজ বেরুচ্ছে টেপ দিয়ে আটকানো মুখ থেকে। ব্যাগ থেকে রুমাল আর ক্লোরোফর্ম বের করল রেবেকা। পরিমাণ মত ঢালল তা’ রুমালে। তারপর বন্দি দুজনের নাকের সামনে ধরতেই নিস্তেজ হয়ে পড়ল দুই বন্ধু। এক-এক করে দুজনকেই কাঁধের উপর নিয়ে ল্যাণ্ডক্রুজারে তুলল নিবিড়। ফারদিনকে বসাল ড্রাইভিং সিটের পাশে। দেখে বোঝা গেল গায়ে প্রচণ্ড শক্তি আছে ওর। একটু জিরিয়ে রেবেকাকে সঙ্গে নিয়ে এখানে অবস্থানের সব চিহ্ন মুছে ফেলল সযত্নে। তারপর যে-রাস্তা ধরে জঙ্গলে ঢুকেছিল, সেপথেই ল্যাণ্ডক্রুজার ছোটাল হাইওয়ের উদ্দেশে।

 

পাঁচ

রাত তিনটা বেজে দশ। হাইওয়ের ছোট্ট একটা ব্রিজ। তার নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে গভীর খাল। ব্রিজটার রেলিং নেই। ল্যাণ্ডক্রুজারের নাকটা খাল বরাবর রেখে দাঁড় করার নিবিড়। সড়কে গাড়ির আনাগোনা শূন্যের কোঠায়। তবু নিশ্চিত হবার জন্যে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। তারপর ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে রেবেকার সাহায্যে ফারদিনের অচেতন দেহটা ওখানটায় বসাল। দু’জনের বাঁধন খুলে দিয়েছে আগেই। ব্যাকসিটে দীপ্তকে রেখে গাড়ি থেকে নামল রেবেকা। মদের বোতল, ইয়াবার প্যাকেট আর কয়েকটা কন্ডোমসহ একটা ব্যাগ সীটের উপর রাখল। ভাল করে গাড়িতে খুঁজে দেখল কোনো ক্লু রেখে যাচ্ছে কিনা। ওদের দু’জনের হাতেই গ্লাভস পরা। হাতের ছাপ রেখে যেতে চায় না।

নামার আগে অটো ডোর লক করে দিল রেবেকা। পিছনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক কদম পিছনে সরে গিয়ে দাঁড়াল সে। একহাতে ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে ইগনিশন কী ঢুকিয়ে গাড়ি স্টার্ট করল নিবিড়। অটো গিয়ার ‘ডি’তে ঠেলে দিয়েই ঝট করে দরজা বন্ধ করে সরে গেল। ঝাঁকি দিয়ে গাড়িটা লাফিয়ে পড়ল খালে। ঝুপ করে শব্দটা রাতের নীরবতাকে ধাক্কা দিয়ে গেল।

দ্রুত পা চালিয়ে হাইওয়ে ধরে হাঁটতে লাগল নিবিড় ও রেবেকা। মোবাইলে কথা বলছে নিবিড়। একশ মিটারের মত পথ অতিক্রম করতেই ওদের পাশে এসে ব্রেক কষে দাঁড়াল একটা মালটানা পিকআপ।

‘ওঠো, ভাইগ্না!’ জানালা দিয়ে মুখ বের করে বলল চালক। সঙ্গে-সঙ্গেই গাড়িতে উঠে পড়ল ওরা। ড্রাইভারের পাশে বসার যা দেরি, তুমুল গতিতে পিকআপ ছুটতে শুরু করল। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে লাগল চালক চক্রধন ত্রিপুরার জবান। ভাঙা-ভাঙা বাংলায় বলল, ‘ইস রে! সুকিয়ে মুখটা কিমুন হয়ে গেছে আমার বাইগ্নার!’ বলেই ড্যাশবোর্ডে রাখা বিস্কুট আর কোকের বোতল বের করে দিল। ‘বইন কেমন আছে? কাজ-কাম কিমুন চলতাছে?’ দিয়ে শুরু। ননস্টপ চলতে লাগল তার বাক্যালাপ। নিবিড় শুধু তার কথার জবাব দিয়ে গেল।

খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে বাড়ি চক্রধনের। সাত মাস আগে চট্টগ্রাম মেডিকেলে এসছিল মরণাপন্ন শিশুকন্যাকে সাথে করে। ফেসবুকে ব্লাড ডোনারদের গ্রুপের সক্রিয় সদস্য নিবিড়। মেডিকেলে গিয়েছিল এক মুমূর্ষ রোগীকে রক্ত দেয়ার জন্য। কপর্দকহীন চক্রধন তার ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুকন্যার চিকিৎসার জন্য দিশেহারা অবস্থায় মেডিকেলের ফ্লোরে চক্কর কাটছে তখন। নিবিড়ের চোখে পড়ে ব্যাপারটা। সে বুঝতে পারে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ওই ছিন্নমূল মানুষটি আসলে বুঝতেই পারছে না তার করণীয় কী।

সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় নিবিড়। রক্তের সংস্থান করা থেকে শুরু করে ঔষধ কেনা, সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। প্লেটলেট কমে যাওয়ায় প্রচুর রক্ত দিতে হয়েছিল মেয়েটিকে। সেইসঙ্গে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগির তরল খাবারের সঠিক ব্যবস্থা। ডাক্তারদের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে নিজেই সবকিছু করে সে। মৃতপ্রায় মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠে। সারাজীবনের জন্যে চক্রধন আর তার বউয়ের মমতার আঁচলে বাঁধা পড়ে নিবিড়। যদি কখনও প্রয়োজন হয়, তাহলে শুধু একবার বললেই হবে। জান হাজির করে দেবে চক্রধন। ছলছল চোখে সুস্থ মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় নিবিড়ের সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করে মানুষটা।

অক্সিজেন রোডে বাসাটার খোঁজ বের করেছে চক্রধনই। বাড়ির মালিক সপরিবারে সৌদি আরবে থাকেন। মাস্টার কীর সাহায্যে বাড়িটাতে ঢুকে কাজ উদ্ধার করতে বেগ পেতে হয়নি কোনো। দীপ্ত ও ফারদিনের মৃত্যুকে রোড অ্যাক্সিডেণ্টে রূপ দেওয়ার জন্য যা করার করেছে ওরা। ভোররাতে খাগড়াছড়ি রোড ধরে চক্রধনের গাড়িতে করে চট্টগ্রাম শহরের দিকে এগিয়ে চলেছে ওরা। গন্তব্য: শাহ আমানত বিমানবন্দর।