মৃত্যুমুঠোভাষ ● সোহম গুহ


 

 

১.

লকাতার এই অঞ্চল গ্যাজেটের বিক্রিবাট্টার চাপে সদাই চির ব্যস্ত। সেই কম্পিউটারের পার্টস, মোবাইল, এসি, ফ্যান এবং আরও অনেক কিছুর মাঝে ভিড় ঠেলে এগোচ্ছিল ও, গরমের ঝাঁঝে গলদঘর্ম হয়ে। বর্ষাকাল খাতায়কলমে শুরু হলেও মেঘ বাবাজির দেখা নেই।

পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘাড় মাথা মুছতে গিয়ে পাশের দোকানের শোকেসে নজর পড়ল তানিয়ার। সেকেন্ড-হ্যান্ড দোকানের বুড়োটে সেটগুলোর মাঝে সেটা এক বেমানান একলা সৈনিকের মত তাকে বসে। ভেতরে ঢুকে দোকানদারকে দিয়ে ঝাঁ-চকচকে অ্যানড্রয়েড সেটটা নামাল ও। ফোনটা শুধু দেখতেও না, কাজেও বেশ ভাল; তার উপরে লেটেস্ট অ্যানড্রয়েড ওএস লাগানো। একবার নেড়েঘেঁটে দোকানিকে দাম জিজ্ঞেস করল তানিয়া। ভদ্রলোক কিছুটা আশ্চর্যই হলেন।

“এটা তো লেখা নেই, তাহলে এল কোথা থেকে রে বাবা!” বিড়বিড় করে ক্যাশমেমো কাটলেন তিনি। তানিয়া সেসব দেখেও দেখল না; ওর হাতে তখন নাচছে সাড়ে তিন হাজারের বিনিময়ে পাওয়া ‘দামি’ সেটটা। ওর আনন্দে কাটা শিষ চাঁদনী চকের রাস্তায় হারিয়ে গেলো। কলেজ শুরুর আগে পকেটে একটা যোগাযোগ মাধ্যমের রীতিমতো প্রয়োজন পড়ে গিয়েছিল।

দোকানদারের কথা মনে পড়তে তানিয়ার গালে একটা টোল পড়ল। ব্যস্ত দোকানে এসব ছোটখাটো ভুল অবশ্যম্ভাবী; দাঁওটা সে আজকে ভালই মেরেছে বলতে হবে।

সিমটা পকেটেই ছিল, সামান্য কসরতে তা স্থান পেল মোবাইলে। অন করে তানিয়া দেখল যন্ত্রটায় যথেষ্ট ব্যাটারি মজুদ, ঘাঁটাঘাঁটিতে কোন বাধা নেই।

‘নাঃ, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সড়গড় হয়ে যাবে এটা। এর দাম খুব কম করেও দশ তো হবেই হবে।’

ফোনটার ব্যাককভার অভ্র এবং পুঁতির কারুকাজে সজ্জিত, সম্ভবত এর পূর্বতন মালিক ছিল তারই মত কোন কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। কিন্তু, তাই যদি হয়, তবে সে এই প্রায় নতুন, প্রায় মিন্ট কন্ডিশনে থাকা ফোনটাকে বিক্রি করল কেন?

অভাব? না অন্য কিছুর জন্য?

তানিয়া এই নিয়ে বেশি মাথা ঘামাল না। বৃষ্টি আসছে হঠাৎ আকাশ কালো করে জমা হওয়া মেঘের হাত ধরে। এই আবহাওয়ায় ক্যানিং লোকালের জানলার সিট তার বড় প্রিয়।

তানিয়া এমনিতে আর পাঁচটা মেয়ের থেকে একটু আলাদা। রবীন্দ্রপ্রেমিকা মেয়েটির একমাত্র নেশা বই পড়া। পুরোনো বইয়ের পাতার স্মৃতি এবং নতুন বইয়ের আঠার মাদকীয়তা কি বাস্তবের মানুষে পাওয়া সম্ভব?

বাড়ি যখন সে ঢোকে তখন সেই নিঝুমপুরীতে তার একমাত্র সঙ্গী বৃষ্টির শব্দ। স্নান করে লাইব্রেরির সোফায় একাকি বসে ছিল ও। দ্রুত মন এবং আঙুল পাতা ওলটাচ্ছিল ‘চরিত্রহীন’-এর। পাশে সঙ্গত দিচ্ছিল মৃদু স্বরে হোমসিস্টেমে চলা জগজিৎ সিং, এবং বিকেল থেকে শুরু হওয়া অঝোরধারার মুষলকাল। জানলার শার্সিতে অবিরত আঁকা হচ্ছে তখন কত না জলছবি।

হঠাৎ তানিয়ার মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটল। পাশের টেবিলে কিছু একটা বাজছে; তার সেকেন্ডহ্যান্ড সেটটা, যার সদ্য সক্রিয় হওয়া সিমের নম্বর সে নিজেও প্যাকেট উলটে দেখেনি।

ফোনটা হাতে নিয়ে ও কিছুটা আশ্চর্য হল। কেউ কল করেছে, কিন্তু স্ক্রিনে কোন নাম্বারই ফুটে ওঠেনি। বাক্যব্যয় না করে সেটটা তুলে ও বলল, “হ্যালো?”

ওপাশ থেকে কোন উত্তর এল না, কেবল ভেসে এল এক শোঁশোঁ শব্দ – বহুদূরে উৎপত্তি যেন তার, তেপান্তরের মাঠে ঘাসে ঘাসে ঘষা লেগে যেন তার সৃষ্টি। তানিয়া আরেকবার হ্যালো করায় কটাত করে ফোনটা কেউ কেটে দিল।

“এবার বুঝেছি আগের মালিক কেন এটাকে এত কম দামে বিদায় করেছে। হ্যাঃ, আমিও যেমন বোকা, দাম শুনেই নেচে উঠে ফোনটা কেনা আমার উচিত হয়নি।” স্বগতোক্তি ক্ষোভ আকারে বেরিয়ে পড়ল তানিয়ার গলা বেয়ে। ঘড়িটা আড়চোখে দেখে নিল ও। সাড়ে সাতটা।

“মা আসতে এখনো দুঘণ্টা দেরি!”

আবার সে সবে চরিত্রহীনে মনোনিবেশ করেছে, বিচ্ছিরি শব্দে বেজে উঠল ফোন। আবার সেই নামধামহীন কলার, আবার সেই শোঁশোঁ শব্দ এবং বেখাপ্পাভাবে ফোনটার আবার কেটে যাওয়া ― কোনো কিছুরই ব্যতিক্রম হল না। তিতিবিরক্ত হয়ে কল লগ খুলল তানিয়া। নম্বরের জায়গাটা ফাঁকা, পাশে শুধু কল করার অপশন দেখাচ্ছে। রিংব্যাক করতে কেবল এক যান্ত্রিক স্বর বলে উঠল, “The number you are trying to reach does not exist...”

তানিয়ার ভ্রু এইবার কিঞ্চিৎ কোঁচকাল, “কী হল ব্যাপারটা?” উত্তরটা দিতেই যেন তার মোবাইলে টুং শব্দে একটা এমএমএস ঢুকল। একটা ছবি, তারই ছবি, বিরক্তমুখে ফোন করা অবস্থায় তোলা। ও কেঁপে গিয়ে তাকাল ছবি তোলার দৃষ্টিকোণের দিকে। সেখানে ক্যামেরার বদলে কেবল নিরেট দেওয়াল।

দৌড়ে গিয়ে আঁতিপাঁতি করে দেওয়ালে চিরুনিতল্লাশি চালিয়েও কিছু না পেয়ে তানিয়ার দ্রুত হৃদস্পন্দন দ্রুততর হল মাত্র। চিন্তার ঝড় উঠল সেই সঙ্গে মননে।

‘কেউ কি আমার সঙ্গে প্র্যাক্টিকাল জোক করছে?’

‘নাঃ, মাকে এসবের একবিন্দুও বলা যাবে না, ডিভোর্সি মহিলার তাতে কেবল রক্তচাপই বাড়বে।’

তানিয়ার দ্রুত হাত মোবাইলের টাচস্ক্রিনে দ্রুত ডায়াল করল একটা প্রায় মুখস্থ নম্বর। ওপাশে বেস্টফ্রেন্ডের গলা শুনে ধড়ে যেন প্রাণ এল তানিয়ার। দ্রুত বলল, “হ্যালো অনামিকা, বাড়ি আছিস? একটু হেল্প দরকার পড়েছে রে।”

 

২.

“কী ব্যাপার? এরম ঝড়জলের রাতে কী এমন দরকার পড়ল তোর যে আসতেই হল?” ভিজে কাক অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা তানিয়াকে একটা তোয়ালে আর একটা ম্যাক্সি এগিয়ে দিয়ে অনামিকা জিজ্ঞেস করল। জামাকাপড় শুকোতে দিয়ে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ হাতে সমস্ত ঘটনা বান্ধবীকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলল তানিয়া।

“তুই সিওর তো যে কোনো ক্যামেরা ছিল না?” অনামিকা না জিজ্ঞেস করে পারলো না।

“না রে। আমি যেভাবে খুঁজেছি, সেভাবে পিজারো অ্যামাজনে খুঁজলে এল ডোরাডো পেয়ে যেত।”

“বাজে না বকে ফোনটা দে তো!” বলে তানিয়ার হাত থেকে ফোনটা একরকম ছিনিয়েই নিল অনামিকা। কিছুটা ঘেঁটে বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করল, “তুই নিশ্চয়ই উত্তেজনায় ইন্টারনাল মেমারিটা খুলেও দেখিস নি?”

ওর কথার সূত্র ধরতে না পেরে তানিয়া বলল, “হ্যাঁ দেখেছি, একেবারে ফরম্যাট করা। কেন? কিছু পেলি নাকি?”

উত্তরে গ্যালারিটা খুলে ওর মুখের সামনে ধরল অনামিকা। তানিয়ার অনুমান সম্পূর্ণ সঠিক । গ্যালারিতে ভেসে ওঠা এক সদ্য যুবতীর সেলফি তারই প্রমাণ। দ্রুত হাতে স্ক্রোল করল সে; পরপর আসতে লাগলো তার অনেক ফটো। কিছু অন্যের তোলা, কিছু নিজস্বী। ফটোগুলো দেখে বিড়বিড় করে উঠল তানিয়া, “আ...আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। ফোনটা কিনেই একপশলা ঘেঁটেছি আমি, কই তখন কোথায় ছিল এত ফটো? এ কী করে সম্ভব?”

“তানিয়া, তোর চেনাজানাই কেউ করেছে, যে অ্যানড্রয়েডের আগাপাশতলা জানে। কিন্তু তাও!” একটু থম মেরে রইল সে, “তোর ফটোটা কী ভাবে তোলা সম্ভব মাথায় আসছে না।” তানিয়া তখনো ফটোগুলো ঘেঁটে চলছিল একাগ্রচিত্তে। চোখের সামনে যেন চলছে এক স্লাইডশো। মেয়েটার কিছু ফটো তার নিজের, কিছু পরিবারের সাথে আর বাকিগুলো তার এক সমবয়সী ছেলের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে।

প্রেমিক?

হঠাৎ করে পরপর কালো ফটো আসতে শুরু করল প্রতি স্ক্রোলের সাথে; ক্যামেরার লেন্সে হাত রেখে তোলা যেন সেগুলো। তানিয়ার দ্রুত আঙুলটাকে মেয়েটার এক ফটোর সামনে এনে বসালো। ফটোটা দেখে যেন দমবন্ধ হয়ে গেলো তানিয়ার, ফোন সশব্দে আশ্রয় নিল সেন্টার টেবিলে, অস্ফুট গলায় কেবল ও ডাকল, “অনামিকা!”

অনামিকাও স্থির হয়ে গেলো ফটোটা দেখে। মেয়েটা মাটিতে শুয়ে অস্বাভাবিকভাবে। তার কালো একঢাল চুল পিঙ্গল বর্ণ ধারণ করেছে তারই জমাট বাঁধা রক্তে। তার একদিকে হেলানো মাথা সমগ্র দেহের সঙ্গে এক বিকৃত স্থূলকোণ রচনা করেছে। ফটোটা মেয়েটার, তবে তার মৃতদেহের – গোটা মুখে লেপে যার এক প্রচণ্ড ভয়ের চিহ্ন।

কিছুটা ধাতস্থ হয়ে অনামিকার কাঁপা হাত আবার অদম্য কৌতূহলে পরবর্তী ছবি হাঁটকাতে লাগলো। আবার সব কালো পূর্বের মত। টাচস্ক্রিনের উপর হওয়া তার প্রত্যেক অঙ্গুলিসঞ্চালন দুজনের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু কোথায় কী! দুজনের চোখের সামনে খেলা করছে কেবল কালো ফটোর সারি। ঠিক যখন দুজনে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে যাবে, অনামিকার আঙুল থেমে গেলো। ওর পরবর্তী ছবিতে যাওয়ার শক্তি ছিল না।

ফটোটা প্রেমিকটির, তবে তানিয়া যা ভেবেছিল তার বিপরীত। এক গাড়ি দুর্ঘটনায় তার দলা পাকানো দেহ স্থান পেয়েছে দুমড়েমুচড়ে যাওয়া দুটো ট্রাক ইঞ্জিনের মধ্যে। অক্ষত কেবল মাথা, তাতেও ছাপ রেখে গেছে সেই প্রচণ্ড ভয়।

কীসের ভয়?

দুই বান্ধবী যাকে প্রধান সন্দেহভাজন ভাবছিল, তার এরকম মৃত্যু দেখে দুজনে কী বলবে, বা ভাববে বুঝে উঠতে পারছিল না। ছেলেটার ঐ ফটোর পর আবার বেশ কিছু ছবি শুধুই কৃষ্ণচিত্র। তার পরে দুই বন্ধু দেখল এক সদ্য চাকরি পাওয়া যুবতী এবং তার প্রেমিককে। আগুনে ঝলসানো মৃত্যু ছিল মেয়েটার অন্তিম পরিণতি। ছেলেটার জলে আধভাসা মৃতদেহ প্রত্যক্ষ করল দুই বান্ধবীই।

কৌতূহল এবং উত্তেজনা পর্যায়ক্রমিকভাবে দুই বন্ধুকে ছবির পর ছবি, ছবির সেট – যার শুরু কোনো মহিলার নিজস্বী বা পারিবারিক ছবি দিয়ে; যার শেষ দখল করে আছে কেবল মৃত্যু, অস্বাভাবিক মৃত্যু ― প্রচণ্ড ভয় পেয়ে।

বারো; বারোখানা এরূপ মৃত্যুমিছিল তাদের আতঙ্ককে ততক্ষণে বিভীষিকার পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

কম্পিত হাতে ১০০ ডায়াল করতে যাবে তানিয়া, অনামিকা ওর হাত চেপে ধরল। “কী করছিস কি! পুলিশ এলে তোর ফোনে এতগুলো বেওয়ারিশ ছবির ব্যাখ্যা দিতে পারবি তো? দোকানি তো জোর গলায় স্বীকার করবে ফোন মেমারি শূন্য ছিল। আইনের নাগপাশে আটকে নিজেকে নির্দোষ কী করে প্রমাণ করবি তুই? ভাই, টোটালি ফেঁসে যাবি। আর তাছাড়া, আমরা যেভাবে এতক্ষণ ফোন ঘেঁটেছি, আমাদের আঙুলের ছাপের নিচে আসল আততায়ীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট কখন ঢাকা পড়ে গেছে!”

কিছুক্ষণ ভেবে ভেবে আবার মুখ খুলল অনামিকা, “তুই এক কাজ কর, যে দোকান থেকে কিনেছিস, সেখানে ফোন কর। সবে আটটা বাজে। দোকান নিশ্চয়ই খোলা।”

দোকানীর সঙ্গে তানিয়ার কথোপকথন অনামিকার মাথা আরও ঘুলিয়ে দিল। দোকানদার জোর গলায় স্বীকার করলেন যে তানিয়া না দেখালে তিনিও ঐ ফোনের অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হতেন না। এমনকি, তাঁর খাতাতেও কোনো এন্ট্রি নেই ঐ ফোন দোকানে আসার। যেন, শূন্য থেকে ওটা উদয় হয়েছিল, কেবল তানিয়ার জন্য!

 

৩.

ফোনে দেখে সন্দেহটা মাথায় পেরেক ঠুকছিল অনামিকার, তাই আর থাকতে না পেরে সব ফটো ফোন থেকে কম্পিউটারে ট্রান্সফার করল ও। ফোল্ডারে সব এসে যেতেই অবিশ্বাসে ঠোঁটে তালু ঠেকল ওর। হ্যাঁ, সেট; ১২ টা সেট, প্রত্যেকটি একটা নির্দিষ্ট সজ্জারীতি মেনে এসেছে-গেছে। ৪০৮টা ছবি, যার ২৮০টিই .png এক্সটেনশনের কৃষ্ণচিত্র। বাকি ‘ছবি’ ছবিগুলো .jpeg এক্সটেনশনের।

কৃষ্ণচিত্রগুলোকে আলাদা একটা ফোল্ডারে ট্রান্সফার করে আসল ছবিগুলোতে মন দিল ও। একটা ধারা সজ্জিত প্রত্যেকটি সেট। সেট শুরু এক নিজস্বী দিয়ে, যেন সেটি ঐ সজ্জারীতির উপক্রমণিকা। ১১ নং ফটো অবধি তার ও তার পরিবারের ছবি। ১২ থেকে ২৪ তার ব্যক্তিগত জীবনের। ২৪ নং ছবি তার এবং তার প্রেমাস্পদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা এক নিবিড় চুম্বন, যার অন্ত ঘটেছে সর্বশেষ ছবি দুটোয় তার এবং তার প্রেমাস্পদের ভয়ংকর মৃত্যুতে। যেন, সৃষ্টি-স্থিতি- প্রলয়, একই চিত্রছকের বারোটি পুনর্কথন।

সর্বশেষ সেটের যুগলের মহিলার মুখ তানিয়ার খুবই পরিচিত লাগলো। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকার পর বিদ্যুৎচমকের মত নামটা ভেসে উঠল ওর মনে। বহ্নিশিখা মিত্র, প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব ― যার অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর হেডলাইন করেছিল পেজ থ্রিতে। সুস্থ-স্বাভাবিক ভদ্রমহিলা মারা গেছিলেন হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে। বিস্ফোরিত চোখে নিদর্শন ছিল প্রচণ্ড ভয়ের। একই সঙ্গে আরেকটা খবরও মনে পড়ল ওর, তার স্বামীর মৃতদেহ বাথরুমে আবিষ্কারের ফলাও খবর স্থান পেয়েছে আজকের কাগজে। দ্রুত ছবির properties ক্লিক করল অনামিকা। স্ক্রিনে ভেসে ওঠা সংখ্যা দেখে ধপ করে বসে পড়ল চেয়ারে। মৃত্যুর দিন এবং ছবি তোলার দিন একই!

মানসিকভাবে ভেঙে পড়া তানিয়াকে কোনক্রমে ঠেলেঠুলে বাড়ি পাঠিয়ে অনামিকা ফটোগুলো নিয়ে আবার বসলো। ছবিগুলোর তারিখ মিলিয়ে এক বাংলা দৈনিকের অনলাইন আর্কাইভ ঘেঁটে বাকিদের নাম এবং বিশদ বিবরণ বের করল সে। প্রত্যেকেই মৃত ― আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনায়। অনেকেরই দেহ মাংসপিণ্ডে পর্যবসিত হলেও মাথা তাদের আশ্চর্যজনকভাবে অক্ষত, এক অসম্ভব ভয়ের নিদর্শন নিয়ে।

অনামিকা নখ কামড়াল, ‘হত্যাকারীকে দেখেই কি...? একটা লোক কী রকম দেখতে হলে তার সামনের জনের মনে এমন বিভীষিকার জন্ম দিতে সক্ষম হয়?’

কালো হয়ে থাকা ছবিগুলো এতক্ষণ অনামিকা দেখেনি, এবার খুলল সে ফোল্ডারটা। প্রথম ছবিতে ক্লিক করতে যাবে, কী একটা দেখে অনামিকা তার চোখ একেবারে স্ক্রিনের সামনে ঠেসে ধরল। কৃষ্ণচিত্রগুলো আদপেই সম্পূর্ণ কালো নয়, হাল্কা ধূসর। অনেক ছবিতে স্থানে স্থানে হাল্কা ছাই রঙের দাগ আছে - এতই হাল্কা যে না নজর করলে বোঝাই যাবে না। ছবিগুলো দেখে ওর কেমন যেন সন্দেহ হল। ২৮০টি ছবিকে তাদের সজ্জারীতি অনুসারে ১২টি সেটে পরপর সাজিয়ে যে ছবির কোলাজ তৈরি হল, তা আরেকটি ছবি, কোলাজের গোটা দেহ জুড়ে আঁকিবুঁকি ওর কাছে হয়তো অর্থহীনই হত যদি না ‘ক’ অক্ষরটাকে সে চিনতে পারতো।

মোগলমারির বৌদ্ধবিহারে পুনরায় খননকাজ শুরু হতে ইতিহাসের ছাত্রী অনামিকা সেই সদ্যলব্ধ অজানার আকর্ষণ এড়াতে পারেনি। আরকিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার স্বেচ্ছাসেবক হয়ে কিছুদিন কাজ করেছিল ইতিহাসের উপর থেকে সময়ের ধুলো পরিষ্কার করার। বাঙলার ইতিহাসের এই প্রায় অজানা অংশের কথা সে ভুলতে পারেনি। ইতিহাসের সেই অধ্যায়ে বাঙালীরা বৌদ্ধ, ভারতের বাকি অংশের মত তারাও বিহারে জ্ঞান চর্চায় মগ্ন। সিন্ধুর তীরের আরবদের প্রতি তাদের নজর দেওয়ার সময় কই?

ছবিটাতে দাগ কেটেছে যে লিপি তা খরষ্টির অপভ্রংশ। ধীরে ধীরে আবার প্রায় বাংলা নামটা পড়ল সে, তারপর দৌড়ে গিয়ে টেনে নামাল রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’। নির্দিষ্ট লাইনে তার আঙুল এমনিই আটকে গেল। বিশ্বকবির সতর্কবাণী লেখা আছে ছাপার অক্ষরে, “…তাকে দেখলে মনে হবে আকাশের আলো ― তার সমস্ত জট আষাঢ়ের নবীন মেঘের মধ্যে জড়িয়ে গেছে।” কবির বর্ণনার সাথে কৃষ্ণচিত্রগুলির ভীষণ মিল। আকাশের আলো হয় না, সে দিনে সূর্য এবং রাতে জ্যোতিষ্কের আলোয় আলোকিত। আর ছবিরগুলোর রঙ যে সত্যিই আষাঢ়ের নবীন মেঘের মত, গাঢ় ধূসর।

বাঙালীরা প্রাচীন কালে বিভিন্ন দেবদেবীর পুজো করত, তন্ত্রের সাথে বৌদ্ধধর্ম মিশে জন্ম দিয়েছিল বজ্রযানের। তারই একজন পূজ্য দেবী একজটা। অর্ধসহস্রাব্দ পেরিয়ে গেলেও তার এখনো ভক্তের অভাব ঘটেনি।

 

৪.

রাত কাটলেও শ্রাবণধারা এক ফোঁটাও কমেনি; ‘মুষলকালের’ ক্ষান্তি নেই। রাতভোর বৃষ্টিতে ক্যানিং শহর পরিণত হয়েছে দ্বিতীয় ভেনিসে। তিমিমাছের পিঠের মত একমাত্র জেগে থাকা ক্যানিং-বাসন্তী রোডে বহুক্ষণ পরপর বৃষ্টি চিরে হুসহুস করে চলে যাচ্ছে কেবল দু-একটা গাড়ি। এক বিনিদ্র রাত কাটিয়েছে অনামিকা কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে; আরক্ত চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে প্রত্যেকটা ছবিকে। প্রত্যেক মৃত্যুর এক সাদৃশ্য তার চোখে পড়েছে, অক্ষত মাথা বাদ দিয়েও; প্রত্যেক হত্যালীলার পেছনে যেন দাঁড়িয়ে এক অতি অস্পষ্ট মূর্তি। তার ছায়া পড়েছে প্রথমের পৃথা-শুভদীপ যুগল থেকে সর্বশেষ বহ্নিশিখা-প্রদোষের বিস্ফারিত মণির দেওয়ালে।

এই ধারাবাহিক উপস্থিতি একটাই কথা বলে, সেই মূর্তিই হত্যাকারী। প্রায় ঝাপসা মূর্তির বেশভূষা, চোখমুখ কিছুই বোঝা না গেলেও অবয়ব একটা কথাই বলছে। কী যেন এক ভীষণতা লুকিয়ে ঐ মূর্তিতে। মাথার উপরটা বিকৃত, কিছুটা ঠেলে উঠেছে উপরের দিকে। তার সঙ্গে মেডুসারই যেন সবথেকে বেশি মিল। উত্তেজনায় কথা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অনামিকার, বিড়বিড় করে বেরোল কোনোক্রমে কেবল একটাই কথা, “এই একবিংশ শতাব্দীতে এ কী করে সম্ভব?”

সারারাত আতঙ্কে না ঘুমিয়ে তানিয়া সকাল বেলা ঘুমিয়ে পড়েছিল। শেষ বিকেলে আড়মোড়া ভেঙে ফোনের উপস্থিতি যখন সে প্রায় ভুলতে বসেছে, তখনই বিচ্ছিরি রিংটোনে তার বুক ধড়ফড় করে উঠল। আবার সেই নাম্বারহীন কলার। কাঁপাকাঁপা হাতে সে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে প্রথমবার কেউ কথা বলে উঠল, বিজাতীয় ভাষায়। গলা তার শান্ত। শৈত্য বিরাজ করছে সেই গলায়। কথা না বুঝতে পারলেও তানিয়ার শিরদাঁড়া বেয়ে এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো। ফোনটা কেটে গেলেও সেটটা কানে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল ও বেশ কিছুক্ষণ। ওপাশের গলা যেন ছিল যেন কোনো মৃত মানুষের গলা। ঘোর লেগেছিল তার মনে, বুদ্ধিবৃত্তি ঘোলাটে হয়ে এসেছিল, তাই হয়তো কলিং বেলের আওয়াজে চমকে উঠল তানিয়া।

ছাতাটা ছাড়া জুতোর পাশে রেখে অনামিকা জিজ্ঞেস করল, “ফোন এসেছিল আর?” উত্তরে যন্ত্রের মত ঘাড় নাড়ল তানিয়া। সব শুনে ভীষণ গম্ভীর হয়ে চেয়ার টেনে বসলো অনামিকা, “আমি সব ফটো দেখে একটা অনুমানে এসেছি।” নখ কামড়ে তানিয়ার দিকে তাকাল ও, তারপর আস্তে আস্তে বলল ওর আশঙ্কা, “এগুলো সিরিয়াল কিলিং নয়, বলি।”

ঝটকার জন্য তানিয়া প্রস্তুত ছিল না একেবারেই। কথা আটকে গেলো ওর জিভে, “ক...কিন্তু তা উৎসর্গ করা হচ্ছে কার প্রতি? আর সে বা ত...তারা আমার পেছনেই কেন পড়েছে?”

“জানি না,” কালো ছবিগুলোর কথা সম্পূর্ণ চেপে গেলো অনামিকা, “তবে এটুকু বুঝেছি যে কী হিসেবে করা হয়েছে। বারো জনের প্রথম চারটে যুগলের মধ্যে মিল কোথায় বল তো?”

“আমি কী করে জানব?”

বান্ধবীর ভয়ার্ত মুখচোখ একবার দেখে নিল অনামিকা, “নিউজ রিপোর্ট অনুযায়ী তারা প্রত্যেকেই কমবয়সী আর রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান। তার মানে কী জানিস? সম্ভবত প্রত্যেকেই ভার্জিন।”

“তাতে কী প্রমাণিত হয়?”

“কিছুই হয়ত প্রমাণিত হয় না। কিন্তু কুমার-কুমারি বলির প্রথা অনেক প্রাচীন। দেবতার উদ্দেশে বলির প্রথা মানব সভ্যতা সৃষ্টিরও আগে থেকে প্রচলিত। কিন্তু, এখনই কেন?”

“তুই কি আমাকে ভয় পাওয়ানোর জন্য এগুলো বলছিস?”

তানিয়ার কথার উত্তর দিল না অনামিকা, বরং বলল, “জার্মান বিশপ থেইটনারের বিবরণ থেকে জানা যায় ভাইকিংরা প্রতি নয় বছর অন্তর জিল্যান্ডের লেয্রে নামক স্থানে তাদের রক্তপিপাসু দেবতা ওডিনকে তুষ্ট করার জন্য নিরানব্বই জন মানুষকে তাঁর পায়ের তলায় বলি দিত। ট্রেল্লেবর্গের কেল্লার নিচেও এরকম নিদর্শন পাওয়া গেছে। প্রাচীন মিশরে এক প্রায়-মানুষ ভগবান ছিল মানুষের সত্তার পথপ্রদর্শক। আমাদের এখানে...”

“তুই চুপ করবি? আমার এবার খুব ভয় করছে। তুই যুগল থেকে ভগবানে চলে গেলি কেন?” তানিয়া না বলে পারল না।

“বলছি,” বলে নিজের ফোনে খবরের কাগজের হেডলাইনগুলো তানিয়াকে দেখাল অনামিকা, “এই দেখ। মিলটা চোখে পড়েছে?”

“হ্যাঁ! প্রত্যেক মৃত্যুর খবরের ছবিতে দলীয় পতাকার অনাবশ্যক উপস্থিতি।”

“এলিমেন্টারি মাই ডিয়ার ওয়াটসন। পরবর্তী চার যুগল সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে যুক্ত ছিল। এর মানে কি জানিস? তরুণ রক্তে রাজনীতি কারা করে? যারা বিপ্লব চায়। যারা আমাদের দেশের মরচে ধরা অবস্থার উপর বিরক্ত। তারাই তো বিপ্লবী! তাদের পরের শেষ চার জোড়ার শরীরের থেকে তাদের কল্পনাশীল মস্তিষ্ক কাজ করত বেশি। সেই সৃষ্টির বিস্ফোরণ ঘটেছে বইমেলার স্টলে, সিনেমার পর্দায়, লোকমুখে ফেরা মানুষের গানে এবং থিয়েটারের মঞ্চে। তাঁরা যে সৃষ্টিশীল, তাঁরা যে শিল্পী!”

“তার সঙ্গে আমার এই ইউনিক জোক আর এই ফালতু লিস্টে এন্ট্রি কী ভাবে হচ্ছে?”

অনামিকা উত্তর দিতে গিয়েও থমকে গেল; অনিচ্ছুক উত্তরটা দিতেই যেন বেজে উঠল তানিয়ার ফোন, আবার। একটা এমএমএস ঢুকেছে। যদিও এমএমএস বলার চেয়ে তাকে হৃদকম্প বলাই বেশি ভালো। ফটোটা তার এবং অনামিকার ― তাদের নিষিদ্ধ প্রেমের এক অতি ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের, যার ছবি তাদের কেউ কোনোদিনই তোলেনি!

ওষ্ঠাধরের সঙ্গে ওষ্ঠাধরের মিলনের ছবি দেখে তানিয়া মাটিতে বসে পড়ল। অনামিকা না বলে দিলেও সে বিলক্ষণ বুঝেছে তাদের কোন শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কেউ না জানলেও চিত্রগ্রাহক জানে তাদের নিষিদ্ধ প্রেমের কথা। তারা যে প্রেমাস্পদ!

“ওরা জানে অনি, ওরা সব জানে!”

অনামিকা চুপ করে ছিল। তানিয়ার মত আতঙ্ক নয়, তাকে গ্রাস করেছে অসীম কৌতূহল। তাই জন্যই হয়তো স্বার্থপরের মত তানিয়াকে ‘টাটা’ বলে ও বাইরে বেরিয়ে এল। ব্যাপারটা জোক থেকে অলৌকিক পেরিয়ে আরও অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। তাকে নিজের সন্দেহ নিরসন করতেই হবে, জানতেই হবে তাকে ঐ অবয়বের মালিক কে। হ্যাঁ, তারা ভালবাসে একে অপরকে, কিন্তু সমকামিতা এখনো মধ্যবিত্ত সমাজে মাওরি ট্যাবুর চেয়ে কম কিছু না। তাই তারা তাদের নিষিদ্ধ অদমিত প্রেমকে রূপ দিয়েছে তানিয়ার নিঃসঙ্গ বাড়িতে, সাক্ষী থেকেছে বন্ধ ঘরে তাদের ভারী নিঃশ্বাস এবং বিছানার অবিন্যস্ত চাদর।

বাড়ি ফিরে বিশেষ সফটওয়্যার এবং গ্রাফিক্স কার্ডের সাহায্যে সবথেকে পরিষ্কার অবয়ব ক্রপ করে আপস্কেলে বসাল অনামিকা। প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ হওয়ায় ও বিছানায় ঠেস দিয়ে বসল। তানিয়ার কথা চিন্তা করতে করতে তার চোখের পাতা কখন যে নেমে এসেছে সে নিজেও জানে না।

পিং।

অনামিকা চোখ খুলল কম্পিউটারের নোটিফিকেশনের শব্দে। স্কাইপ আপনা থেকেই খুলে গেছে তার স্ক্রিনে। কেউ মেসেজ করেছে। গোটা গোটা অক্ষরে কেউ টাইপ করেছে, “উত্তম, কন্যা। তোমার আগে বলিপ্রদত্ত কেউই দেবীর আসল নাম খুঁজে বের করতে পারেনি। তোমার এই কর্ম তোমাকে এক যুগসন্ধিক্ষণে এনে দাঁড় করিয়েছে।"

লাফিয়ে উঠে দ্রুত টাইপ করল অনামিকা।, “কে তুই?”

উত্তর এল ও সেন্ড বাটনে ক্লিকের পরেই। যেন ওপারের মানুষটা জানত সে কী জিগ্যেস করবে। “আমি দেবীর চরণে থাকা পুরোহিত। সামান্য সেবক। এই ক্ষমতা তো তুমি পেতে পারো। দেবীকে জ্ঞান দিয়ে তুষ্ট করার সাহস সেই অতীশের পরে বাহ্যিকজগতের তুমিই তো করেছ।"

“আমি বুঝলাম না।"

“অবলোকিতেশ্বরের আশীর্বাদপ্রাপ্ত ২১ জন তারার সবথেকে ক্ষমতাধর তারা হলেন ইনি ― মহাচীনতারা; একজটা। দেবতারা অমর হতে পারেন, কিন্তু তাদেরও খাদ্যের প্রয়োজন।”

“খাদ্য?”

“যাজন কাকে বলে জানো?”

“হ্যাঁ। যজ্ঞ।”

“যজ্ঞকে উৎসর্গ কেন বলে?”

অনামিকা কেবল একটা জিজ্ঞাসাচিহ্ন পাঠাল। উত্তর জানা নেই তার।

“মা, যজ্ঞের সময় তুমি কিছু না কিছু চাও দেবতার কাছ থেকে। প্রতিদানে তোমাকেও কিছু না কিছু দিতে হয়।"

অনামিকা অজান্তেই মাথা নাড়ল। অশ্বমেধে রাজার সর্বসেরা ঘোড়াকে বলি দিতে হত, রাজসূয় যজ্ঞে রাজা সম্রাট হতেন পরাজিত রাজাদের স্বাধীনতার মূল্যে। নিছক দান বলে সত্যিই কিছু হয় না। ঋষিরাও দেবতার থেকে বর কিনতেন তাদের জীবনঘড়ির ব্যয়িত সময়ের পরিবর্তে। ধীর লয়ে টাইপ করল, “আপনার কী চাই একজটার কাছ থেকে যে আপনি নিরপরাধ মানুষগুলোকে মারছেন?”

“:D… আমি মারছি? আমার সেই বল কোথায়? দেবীর দরকার, দেবী মারছেন। ওনার ভক্তের অভাব নেই। আমি পথপ্রদর্শক মাত্র।”

“বিনয় রাখুন। ফোন এবং তানিয়ার সঙ্গে আপনার কী সম্পর্ক?”

“সময়ের বুড়িসুতো আসলে মাকড়শার জালের মত, যাদের ভাগ্য বহ্নিপতঙ্গের মত, তারা ঠিক জড়িয়ে পড়ে। তোমরা সবাই সৃষ্টির বিরুদ্ধাচারণ করেছ। দেবীর চোখে তাই তোমরাই সুযোগ্য।” অনামিকা লেখাটা পড়ে ঢোঁক গিলল। কপালে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মোগলমারিতে শশীসেনের ঢিপি খোঁড়ার সময় তারা একজটা দেবীর একটা পাথরে খোদাই করা কাজ পেয়েছিল। সেই গ্রানাইটের উপরে বানানো কাজের মধ্যমণি রতিক্রিয়ারত দুই নারী। যজ্ঞের আগুন জ্বলছে তাদের নিচে প্রস্ফুটিত পদ্মের মত। তাদের ঘিরে স্তবে ব্যস্ত বারো জন যুগল। সেই নারী ও পুরুষের কারুর কোষবদ্ধ অসি, কারুর পাশে রাখা ভূর্জপত্র। সেই রমণ যুগলের একজন একজটা, এবং তাকে আঁকড়ে ধরে সঙ্গমরত কৃষ্ণতারা। অনামিকার স্যার বুঝিয়ে বলেছিল ওকে, ইলোরার গুহাচিত্র দেখিয়ে। সঙ্গম সেই ভাস্কর্যের শক্তির উৎসস্থল, যে শক্তি নষ্ট হবে না নতুন প্রাণ সঞ্চারে।

ঠোঁট চাটল অনামিকা। ওই পাশের মানুষটি ওই নামটা না নিলে অতীশ দীপঙ্কর কীভাবে হিমালয় পেরিয়েছিলেন প্রায় ষাট বছর বয়েসে ও জানতেও পারত না। তিনি দেবতার প্রসাদ পেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবর্তে তাকে নিজের কি বলি দিতে হয়েছিল?

ওপাশের জন তখনও টাইপ করে যাচ্ছে। “দেবীর বরে আমি দিব্যদৃষ্টিপ্রাপ্ত এবং এই মনস্পটে দেখা চিত্রকে আমি ডিজিটাল করতে পারি। ওই ফোনের যাবতীয় ছবি আমারই অবদান। আমি দেখেছি তোমাদের সঙ্গম, উত্তেজিত হয়েছি, আবার সম্বরণও করেছি নিজেকে। কেন জানো? তোমাদের একজনের ভবিষ্যৎ এক মহৎ উদ্দেশে নিহিত।”

“কী বলতে চাইছেন আপনি?”

“না বোঝালে তোমাকে হবে না। উদাহরণ দিই। ১৯৭০র দশকে বাংলা দেশের মুক্তিযুদ্ধের দরুন বহু ভক্তের মৃত্যুর হয়। এর ফলে দেবীর শক্তি কমে আসতে থাকে। চোদ্দ বছর পর দেবীর প্রাক্তন পুরোহিত আমার বাসায় এসে যখন আমাকে এক পুণ্য কাজ করার নির্দেশ দেন তখন আমি তরুণ, এবং লোভ কিছুটা তখনো আমার মধ্যে বর্তমান। আমার সেই খুঁত মুছে দেওয়ার জন্য আমার নবজন্মের প্রয়োজন ছিল। নিজের তাগিদে এবং দেবীর তৃষ্ণা মেটাতে আমায় ২৫ মানুষের রক্তে শরীর রাঙাতে হয়। কিছু উৎসর্গ আমি করি বম্বেতে, আর বাদবাকি কলকাতায়। ফুটপাথবাসীকে আহূতি দেওয়া ছিল তুলনামূলকভাবে সহজ এবারের থেকে।”

আরও ঘেমে উঠল অনামিকা। সংখ্যাটা এবারের সঙ্গে একেবারে এক। আগেরবারের ২৫ জন, এবারের বারো জন যুগল – ২৪। একজন এখনো বাকি। আর সাল? কম্পিত আঙুলে টাইপ করল, “আপনিই কি…”

“দৈনিকগুলো চমৎকার নাম দিয়েছিল বটে আমার ― স্টোনম্যান।”

স্ক্রিনের সামনে থেকে প্রায় ছিটকে উঠে গেল অনামিকা। না, এবার সত্যিই ভয় পেয়ছে সে। না, সে মরতে চায় না এভাবে, এই মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষটার হাতে। লোকটা এভাবে এতগুলো মানুষকে মেরেছে এবং সেটাকে কীভাবে নির্বিকারচিত্তে বলছেও! তখনো থামেনি স্ক্রিনের লেখা, “পৌত্তলিকতার উৎস জানো?”

কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাগ থেকে নিজের মোবাইলটা বের করল ও। নাম্বার টাইপ করতে যাবে ― ফোনের টাওয়ার নেই। হয়তো ঝড়জলের জন্য হয়েছে, বলে নিজেকে প্রবোধ দেবে, দেখে স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে আরও কিছু বাক্য। “সিগন্যাল আমি মন্ত্রবলে ব্লক করে দিয়েছি। পুলিশ যাতে তোমার আমার কথাবার্তায় না বাধা দেয়, সেটাও তো দেখতে হবে।” শঙ্কিত হয়ে প্রথমবার কম্পিউটারের নেটওয়ার্ক আইকনের দিকে তাকাল ও। অনামিকার এতক্ষণ খেয়াল ছিল না যে সে ইন্টারনেটের তার খুলে রেখেছিল।

তাহলে স্কাইপে চ্যাটগুলো ঢুকছে কীভাবে?

কম্পিউটারের বিষয়ে অতি সামান্যই জানে অনামিকা, কিন্তু তাও সে জানে এই অসম্ভব সম্ভব হওয়ার না। তাহলে কি সত্যিই অলৌকিক কিছু কাজ করছে? সত্যিই কি একটা লোক তাকে মিথ্যা ভয় দেখাচ্ছে না? ওপাশে তখন টাইপ হয়ে এল, “যদি ভয় দেখানোর উদ্দেশ্য থাকতো তাহলে আমি অনায়াসে তোমার বাড়ি অন্ধকার করে দিতাম, নয়তো দেবী নিজেই আবির্ভূত হতেন। দেখবে?”

এটা ভিডিও ক্লিপ এল অনামিকার স্ক্রিনে। থাম্বনেলে জেগে আছে বহ্নিশিখার মুখ। দোনামোনা করে অবশেষে সেটা খুলল অনামিকা।

অত্যন্ত বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ভেসে উঠল স্ক্রিনে। দেওয়াল জোড়া আয়নার সামনে বসে মেকআপ করছিলেন বহ্নিশিখা মিত্র। ক্যামেরার কোণ থেকে দেখা যাচ্ছে বাথরুমে দাঁত মাজছে তাঁর স্বামী। পাশের জানলা হাতছানি দিয়ে ডাকছে দূরের ইএম বাইপাসকে। “ওগো, শোন,” দুল খুলতে খুলতে বহ্নিশিখা বললেন, “আজমলবাবুকে বোলো আমার পারিশ্রমিক আরও বাড়াতে। নাহলে ওই ভাঁটের স্ক্রিপ্ট পড়ে আমি সং সেজে স্টেজে নামবো না।” ভদ্রমহিলা অপূর্ব সুন্দরী, ভদ্রলোক ততটাই মিয়ানো। উনি বললেন, “ইয়ে, মানে দেখছি, কী করি...”

“চিরকাল ন্যালাই রয়ে গেলে। কথাবার্তা চালাও। নাকি এবারো টাকা বাড়াতে আমায় কাপড় তুলতে হবে?”

ভদ্রলোকের কাছ থেকে থেকে কোনো উত্তর না আসায় ক্যামেরা ঘুরল তাঁর দিকে। বাথরুমে লোকটা নেই আর। চকিতে আবার বহ্নিশিখার দিকে ক্যামেরা ফিরতেই দেখা গেল ভদ্রলোক ক্যামেরা গার্ড করে দাঁড়িয়ে। তাঁর খোলা পিঠে ফুলে উঠেছে নীল নীল শিরা। বহ্নিশিখার কী হচ্ছে অনামিকা দেখতে পেল না, কেবল শুনতে পেল তাঁর গোঁগোঁ শব্দ। কিন্তু না, ভদ্রলোক কিচ্ছু করেননি। কেবল গিয়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁর স্ত্রীর সামনে। ভদ্রলোক সরে যেতে অনামিকা দেখল বহ্নিশিখা নিশ্চল হয়ে পড়ে আছেন টেবিলের সামনে, তাঁর কাত হয়ে যাওয়া ঘাড় এবং বিস্ফারিত চোখ বলে দিচ্ছে সেই দেহে আর প্রাণ নেই। নিজের স্বামীকে দেখে কেন এত ভয় পেলেন ভদ্রমহিলা? অনামিকা একটা আন্দাজ পেয়েছে। সরে যাওয়ার আগে যেন হঠাৎ ক্যামেরার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচকিত হয়ে এক পলকেরও অল্প সময়ের জন্য পিছন ফিরেছিলেন ভদ্রলোক। ফ্রিজ করে ফ্রেমটা বারবার দেখেও একটা আবছা মুখাবয়ব ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায়নি অনামিকা। সেই একটি ফ্রেমে উজ্জ্বল কেবল ভদ্রলোকের চোখ। ওইরকম লাল সবুজ চেরামণির চোখ গিরগিটির হয়। মানুষের না।

স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটা লেখা, “দেবীর শক্তিতে শক্তিমান হয়েছিল বলেই ভদ্রলোক আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরেছিলেন।”

“আপনি এবার নিজে এই কাজগুলো করলেন না কেন? কেন এক নিরপরাধ মানুষের...” তুই থেকে আপনি কখন হয়ে গেছে অনামিকা জানেও না।

“যা জানো না তা নিয়ে বাদানুবাদ মূর্খতার লক্ষণ মা। এবারে দেবীর আদেশ আসেনি আমার উপরে এই কর্ম সম্পাদন করার। আমি চালক মাত্র। যাত্রী কোথায় নামবেন সেটা তাঁর উপর নির্ভর করে।”

“কী বলছেন আপনি?”

এক খণ্ডমুহূর্তের পর ভেসে এল, “পৌত্তলিকতা কী অর্থ জানো তুমি?”

“মানুষ উপাসনার জন্য যখন কোন মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে...”

“ঠিক। প্রাণপ্রতিষ্ঠা। তার জন্য মূর্তির দরকার আমাদের কোনোকালেই ছিল না।” এটা পড়ে প্রবাদটা মনে পড়ল অনামিকার। ‘মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর বিরাজ করেন।’

“তার মানে, আপনি বলছেন...”

“হ্যাঁ। ওনার শরীরে নিজের কর্মসম্পাদনের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন দেবী। কাজ সম্পন্ন হওয়ার পরে নিজের অংশ করে নিয়েছিলেন তাকেও।” যুগলমৃত্যুর ঘটনাপ্রবাহ কিছুটা পরিষ্কার হল এবার অনামিকার কাছে।

“তো আমার কাছে কী চান?”

“তুমি আর তোমার বান্ধবী উভয়েই ২৫ নম্বর হওয়ার সমান ভাগীদার। কিন্তু তোমার মস্তিষ্ক তোমার জন্য একটা পথ খুলে দিয়েছে, তোমাদের ভাষায় যাকে বলে লাইফলাইন। তুমিই ঠিক করবে তোমাদের মধ্যে কাকে দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হবে।”

“আর যে বেঁচে যাবে?”

“সে হবে অমিত শক্তির ধারক। দীর্ঘ ত্রিশ বছর আমি দেবীর আধার হয়ে আছি। কিন্তু আমার বয়স হচ্ছে। শরীরকে ভাঙছে সময়। তাই নতুন আধারের প্রয়োজন। তাজা আধার।”

“আর সেটা আমি অথবা তানিয়া?”

“দেবীর তাই ইচ্ছা।”

বেশীক্ষণ ভাবল না অনামিকা। প্রেমিকার থেকে নিজের জীবন অনেক দামি তার কাছে। না, সে স্বার্থপর নয়। নিজের জীবনের চিন্তা করা স্বার্থপরতা নয়। “আমি রাজি।”

“আমার মতো তুমিও এটা বলবে আমি জানতাম। চোখ বন্ধ করে কড়ে আঙুল যেকোনো একটা ইউএসবি পোর্টের উপর রাখ। ঝটকা আসবে। তৈরি থেকো। মনে রাখবে শক্তির হস্তান্তরের সময় বিঘ্ন ঘটলে আমরা দুজনেই ভ্রষ্ট হব। হাত সরিয়ো না তাই।”

চোখ বন্ধ করার জন্যই হয়তো বৈদ্যুতিক ঝটকাটা ভালই টের পেল অনামিকা। মুহূর্তের মধ্যে ও যেন তলিয়ে গেল এক অতল গহ্বরের ভেতরে। ভয় পেয়ে চোখ খুলে দেখল সে বসে আছে এক তেপান্তরের মাঠের মধ্যে, গায়ে তার বাঘছাল ছাড়া আর কিছু নেই। মাঠের মাঝে ধুনি জ্বলছে, সেই ধুনির চারপাশে গোল করে বসে অনেক মানুষ। আগুনের আলোয় রাঙা তাদের মুখ। সবাইকেই চিনতে পারলো সে। তানিয়ার মোবাইলে ছবি হয়ে উপস্থিত ছিল সবাই। ধীরপদে অনামিকা তাদের মধ্যে প্রবেশ করতেই বাতাস শিরশির করে বলে গেল, “দেবী একজটার জয় হোক।” মাঠের অন্ধকারে কে যেন হেসে উঠল। সেটা কি কোন মানুষ, নাকি শকুনের বাচ্ছার ডাক? দিগন্তে ওঠা ভাঙা চাঁদকে এক বিশাল বটগাছ তার ঝুরি দিয়ে প্রায় ঢেকে ফেলেছে।

অনামিকা তাদের মাঝে গিয়ে বসতে মাঠের খোয়া নড়ে উঠল কীসের পদশব্দে। জন্তুটা ভারী, লঘুপদ। অনামিকা সচকিত হয়ে তাকাল। বট গাছটা নড়ে উঠেছে, কীসে যেন ঝাঁকাচ্ছে সেটাকে ধরে। তার প্রত্যেক নড়ার সাথে সাথে তাল মিলিয়ে কেঁপে উঠছে মাটি। গাছের হাঁটার ক্ষমতা ছিল না কোনো কালে। চাঁদের সামান্য আলোয় কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে গাছটার নিচের আঁধার। একটা হাড়িকাঠের পাশের বেদিতে কেউ বসে রক্তবস্ত্রে। সেই আলোছায়ায় দেখা যাচ্ছে তার অত্যন্ত কুৎসিত মুখোশ। সেই মুখোশের নিচ থেকে বেরনো ঝুরিগুলো আসলে শুঁড়। একজটার উন্মুক্ত জটা।

অনামিকা সেই আগুনের সামনে থেকে পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু বাকিরা তাকে ততক্ষণে আঁকড়ে ধরেছে। জ্ঞান হারানোর আগে ও কেবল বুঝতে পারলো ওই পায়ের শব্দ ধীরেধীরে তার কাছে এগিয়ে আসছে।

অনামিকার জ্ঞান ফিরল স্টেশনের পাশের খেলার মাঠে, গোবরের গন্ধে। ধড়মড় করে উঠে বসে শুনল প্রথম ট্রেনের ভোঁ। আলো তখনও ফোটেনি, কানের কাছে পিনপিন করছে মশা। ও নিজের শরীরে হাত বুলিয়ে বুঝল ও বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছে রাত পোশাকেই। আশ্চর্য হল যখন বুঝতে পারলো ওর হাতে রবারের গ্লাভস আর সেই সঙ্গে ঘাড় ও কনুইয়ের নিচের অংশটা জ্বলছে। ওর নিজের বাড়ি এখান থেকে বেশ দূরে। ভয় পেয়ে গ্লাভসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটা লাগাল ও। তানিয়ার বাড়ির এত কাছে ও করছে কী? কীভাবে এল এখানে এই চিন্তায় মাথাকে বিপর্যস্ত করে শেষে বেল টিপল তানিয়ার বাড়ির। ঘুমচোখে তানিয়ার মা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে, তোদের সময় জ্ঞান কবে হবে? একী ভূত সেজে এসেছিস?”

বাইরে তখন সদ্য আলো ফুটেছে, কাকিমার ঘরের আয়নায় নিজেকে দেখে অনামিকা সত্যিই চমকে গেল। সে কি যুদ্ধ করে এসেছে? ঘাড় ও হাতে আঁচড়ের দাগ, বগলের নিচের কাপড় ছিঁড়ে গেছে চাপে। স্বপ্নটার কথা মনে পরে গেল অনামিকার। কাঁপা গলায় বলল, “কাকিমা, ও ঘরে আছে?”

“হ্যাঁ, ঘুমাচ্ছে। লাটবেগমের তো আবার বেলা দশটা না বাজলে চোখ খোলে না।”

“একটু দেখা করতে পারি?” অনামিকার নাকে একটা অন্যধরণের গন্ধ আসছে। মুরগির দোকানের পাশ দিয়ে গেলে সে এরকম গন্ধ পায়। আর তার সঙ্গে একটা হাল্কা দুম-ধুপ দুম-ধুপ ছন্দ মেলানো শব্দ। কাকিমার দিক থেকে আসছে সেই শব্দটা। বিষয়টা মাথায় আসতেই মাথা নাড়ল অনামিকা। হৃদস্পন্দন শোনার মত তীক্ষ্ণ কান নয় তার। ওই গন্ধটা আগে তাকে অস্বস্তিতে ফেললেও এখন সেটাই তার খুব ভালো লাগছিল। ওটা ভেসে আসছিল তানিয়ার বন্ধ দরজার পেছন থেকে। টোকা দিয়ে অনামিকা বলল, “এই তানি, খোল দরজা।”

বেশ কয়েকবার ডাকাডাকিতেও ঘরের দরজা বন্ধই রইল। অনামিকার ডাকাডাকিতে নিচ থেকে তানিয়ার মাও চলে এলেন। অনেক ডাকাডাকিতেও সে যখন দরজা খুলল না, তখন দুজনের কপালেই ঘাম দেখা দিল।

“দরজা ভাঙতে হবে,” দুশ্চিন্তাগ্রস্ত গলায় বলল অনামিকা।

“মেয়েটার কিছু হয়ে গেল না তো?”

“সেটা জানতেই তো দরজা ভাঙা প্রয়োজনীয় কাকিমা,” কাকিমার শঙ্কা ভরা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল সে।

দুজনের যুগপৎ গায়ের জোরে মরাত করে ভেঙে গেল হাল্কা প্লাইউডের দরজাটা। ভেতরের দৃশ্য দেখে তানিয়ার মা ওখানেই খাটের পায়া ধরে বসে পড়লেন। তাঁর চোখ তখন কেবল প্রতিচ্ছবিহীন দুই অক্ষিগোলক ― শূন্যতা বিরাজ করছে সেখানে।

গোটা ঘরে যেন ঝড় বয়ে গেছে প্রচণ্ড; ভাঙা আসবাবের টুকরো ছত্রাকার হয়ে ছড়িয়ে গোটা ঘরে। সেই ‘কার্থেজের’ মাঝে ফ্যানের হুকে লাগানো ফাঁসে নিশ্চল হয়ে জমি থেকে বারো ফুট উচ্চতায় ঝুলছে তানিয়ার শূন্যে ভাসমান দেহ। কাছাকাছি না আছে কোনো টুল বা অন্যকিছু। যেন অমানবিক উচ্চতার কিছুতে ওকে যত্ন করে ঝুলিয়ে রেখে রেখে গেছে। প্রিয়দর্শিনী মুখে তার কেবল ফুটে রয়েছে বিষম আতঙ্কের চিহ্ন। কাকিমা সেই ঝড় টের পাননি নিচের ঘরে থেকেও।

ওই স্বপ্ন তার এভাবে সত্যি হল! দেয়াল ধরে কোনোক্রমে নিজেকে সামলাল অনামিকা। স্থানু হয়ে বসে থাকা কাকিমার দিকে তাকিয়ে দুবার মাথা ঝাঁকাল ও। মন একে সত্যি মানতে চাইছে না, কিন্তু চোখ তো সেই যুক্তি মানে না!

এক লুপ্ত সংস্কৃতির অভুক্ত ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গিত হয়েছে তানিয়া। তিনি গুপ্তজ্ঞানের দেবী, শক্তির প্রতিমূর্তি, নির্বাণদাত্রী। গৌড়বঙ্গে তাঁর আবির্ভাব, তাঁরই আশীর্বাদে এখানের বিহারে জ্ঞানের বিকাশ। সেই উত্থানের গল্পের শেষ বক্তিয়ার খিলজির হাতে। বৌদ্ধবিহারের পুঁথি জ্বলেছিল দিনের পর দিন। লাখের পর লাখ। দেবীর রোষ ঝরে পড়েছিল পরবর্তী বছরগুলোর অনাবৃষ্টি হয়ে। খরষ্টিতে লেখা তাঁর নামের উপর পড়েছে তাই বিস্মৃতি এবং কালের আস্তরণ।

মহাচীনতারা। একজটী। নীলতারা।

অনামিকা দেখল কাকিমা শোকে অজ্ঞান হয়ে গেছেন। ওর মাথায় এল ফোনটার কথা। কিন্তু এই ধ্বংসস্তূপে তা কই?

মানুষ বড়ই স্বার্থপর। তার প্রেমিকা গেছে তো গেছে, কিন্তু ঐ ফোনের গ্যালারির শেষ ফটোটা মুছে ফেলাই তার এখন এক ও প্রাথমিক কর্তব্য।

ওর মনের কথা পড়েই যেন ফোনটা এক ভাঙা টেবিলল্যাম্পের পেছন থেকে বেজে উঠল। একটা এমএমএস এসেছে। একটা ফটো, তানিয়ার ঝুলন্ত দেহের ফটো। চাঁদের আলো ঢুকছে জানলা বেয়ে, সেই আলোর প্রেক্ষাপটে চিত্রগ্রাহকের ছায়া দেয়ালে পড়েছে বটের ঝুরির মত তার চুল নেমেছে নিচে, কিন্তু তার মুখের ছায়া? সে যে অনামিকার নিজের মত! ও ঝুলন্ত তানিয়ার দিকে তাকাল, তার নখের নিচে জমেছে ছেঁড়া চামড়া। ওর নখের সঙ্গে অনামিকার আঁচরের দাগের খুব মিল। ২৫ জনকে আহুতি দেওয়া সমাপ্ত হয়েছে। দেবী আবার শক্তি সঞ্চয় করেছেন। তার জন্যই এ সম্ভব হয়েছে। নিজের প্রেমিকার মৃত্যুর জন্য অনামিকাই দায়ী।

দুঃখের বদলে আশঙ্কা গ্রাস করল তাকে। না, স্বার্থপর নয় সে। একজটা দেবী তার মাধ্যমে নিজের কাজ শেষ করেছেন। কিন্তু পুলিশ আসবে, ওই নখের থেকে স্যাম্পেল সংগ্রহ করলেই জানতে পারবে কে হত্যাকারী। শঙ্কার উদয় হতে অনামিকা বুঝল তার ঘাড় ও হাতের জ্বালার দ্রুত নিরাময় হচ্ছে। কনুই উল্টে দেখল। আঁচড়ের চিহ্নমাত্র নেই। উপরে তানিয়ার নখের ভেতরও হঠাৎ পরিষ্কার। ওর হাতের ওই মোবাইল টুং করে বেজে উঠল। একটা এসএমএসএম ঢুকেছে।

“দেবী শক্তির প্রতীক। আর, শক্তি অবিনশ্বর, তার স্থানান্তর ঘটে মাত্র। তোমার কাজে দেবী সম্ভবত খুশি। আমি দেখতে পাচ্ছি উনি তোমাকে ইতিমধ্যেই সাহায্য করেছেন। পৃথিবীর সংহারকরূপে তোমার বিজয়যাত্রা সাফল্যমণ্ডিত হোক।”