দুঃস্বপ্ন ● প্রলয় কুমার নাথ


 

 

(১)

“অমাবস্যার গাঢ় অন্ধকার ঘনিয়েছে চারিদিকে... উত্তর দিক থেকে বইতে শুরু করেছে হাড় হিম করা ঠান্ডা বাতাস। দিগন্ত বিস্তৃত ধুধু বন্যপ্রান্তর এবং দূরে আকাশ ছোঁওয়া বরফে ঢাকা পাহার চুড়ার মাঝে অল্প একটু এবড়ো খেবড়ো পাথুরে জমি। জংলি গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি খাঁচায় যেন বন্দি হয়ে রয়েছি আমি! সামনে জ্বালানো একটি অগ্নিকুণ্ডের ভেতর এক নাগাড়ে কী যেন গুড়োগুড়ো পদার্থ ছুঁড়ে যাচ্ছে একটি অদ্ভুত চেহারার লোক...তার পরনে লাল জোব্বা, মাথার জটাটা পাগড়ির মত পেঁচানো, গলায় নানা পাথরের মালা...কেমন যেন বিকট একটা গন্ধ বেরচ্ছে সেখান থেকে! কোন এক অজানা ভাষায় বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করে চলেছে লোকটা, তার চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে নরকঙ্কাল, বলি দেওয়া পশুদের মৃতদেহ, নানা গাছের শেকড়-বাকড়, কঙ্কালের খুলির ভেতর রাখা কী যেন একটা তরল পদার্থ...”

“তারপর কী হল?”

“তারপর সেই লোকটা আমার পাশের খাঁচাটি থেকে জোর করে বের করে আনলো আরেকটি লোককে... এই দ্বিতীয় লোকটি বোধহয় আমার মতই বন্দি, তার দুই হাত পিঠমোড়া করে শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা! এবার সেই লাল জোব্বা পরা লোকটা দ্বিতীয় লোকটাকে মাটিতে শুইয়ে দিলো... তারপর কী যেন একটা তরল পদার্থ তাকে জোর করে খাইয়ে দিলো! মাটিতে শোয়া লোকটা চিৎকার করতে করতে ছটফট করতে লাগলো... কিছুক্ষণের মধ্যে স্থির হয়ে গেল তার শরীর! হয়তো মারা গেল সে...”

“আচ্ছা, এরপর কী ঘটল?”

“এবার সেই লাল জোব্বা পরা লোকটা মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে শুয়ে পড়লো মৃতদেহটার ওপর... লাশটাকে জাপটে ধরে সে তার মুখ রাখলো মৃতদেহের মুখের ওপর! আকাশে চমকে উঠল বজ্রবিদ্যুৎ... তার আলোতে দেখলাম... দেখলাম যে, লাশটা একটা বিকট গর্জন করে মাটি থেকে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ছে, প্রথম লোকটা তখনো তার মুখে মুখ রেখে তাকে জাপটে ধরে আছে... নীল হয়ে উঠেছে মৃতদেহটির মণিহীন চোখ! সে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে নিজেকে প্রথম লোকটির আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করতে, কিন্তু পারছে না... কিছুতেই পারছে না...”

এতটা বলে রূপক বিস্ফারিত চোখ মেলে হাঁপাতে লাগলো। তার সামনে বসেছিলেন কলকাতার নাম করা সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ অঙ্কুর বর্মণ। একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত বছর তিরিশের যুবক রূপক সাহা এসেছে অঙ্কুর বাবুর চেম্বারে। এতক্ষণ ধরে অঙ্কুর বাবুকে রূপক বলে চলেছিল বেশ কয়েক মাস ধরে মাঝে মাঝে তার রাতে দেখা একই স্বপ্নের কথা, যার মাথামুণ্ডু সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

“ব্যস, এই অবধি দেখেই প্রতিবার আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়, ডাক্তার বাবু... কিন্তু এই একই স্বপ্ন আমি মাঝে মাঝেই কেন দেখছি সেটাই তো বুঝতে পারছি না!”

“দেখুন, এই সব ক্ষেত্রে আমরা ডাক্তারেরা ঘুমের ওষুধ, সিডেটিভ বা ট্রানকুইলাইসার প্রেসক্রাইব করে থাকি... কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে আমি সেটা করতে চাইছি না!” বাঁ-হাত দিয়ে খসখস করে রূপকের সম্বন্ধে সকল তথ্য প্রেসক্রিপশনে লিখতে লিখতে বলে উঠলেন অঙ্কুর বাবু।

“কেন, ডাক্তারবাবু?”

“কারণ বিজ্ঞান অনেক কথা অস্বীকার করলেও, প্যারাসাইকোলজির মতে এই ধরনের স্বপ্নের কিছু অন্তর্নিহিত অর্থ থাকে...আমি চাই আপনি সেই অর্থকেই খুঁজে বার করুন, মিস্টার সাহা!”

“কী ভাবে খুঁজবো আমি সেই অর্থ?”

“এর জন্য আপনাকে আবার এই স্বপ্নটার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হবে। যখনই সেই দৃশ্যগুলি আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে, আপনাকে মনের সমস্ত একাগ্রতা দিয়ে চারিদিক থেকে সংগ্রহ করতে হবে কিছু ক্লু... যেমন ধরুন ওটা কোন স্থান, কোন সময়, কে ওই লোকটি, কাদেরই বা বন্দি করে রাখা হয়েছে ইত্যাদি। এই রহস্য উদ্ঘাটনের রাস্তা এই তথ্যগুলি জানার পরই পাওয়া সম্ভব, মিস্টার সাহা... আর সেটা করতে পারেন একমাত্র আপনিই!”

কিছুক্ষণ অঙ্কুর বাবুর চশমার কাঁচকে ভেদ করে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দিকে চেয়ে থেকে, দুরুদুরু বুকে তার চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো রূপক। সে কি সত্যিই পারবে এই দুঃস্বপ্নের রহস্যভেদ করতে!

 

(২)

এরপর কেটে গিয়েছে বেশ কিছু দিন। সেদিনও অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছিল রূপক, বিছানায় পড়া মাত্রই সে পাড়ি দিয়েছিল নিদ্রার দেশে। আবার সেই একই স্বপ্ন ভেসে উঠল তার মানস চক্ষুর সম্মুখে... সেই অন্ধকার রাত, সেই বন্যপ্রান্তর, খাঁচার ভেতর আটক কিছু মানুষ, সেই লাল জোব্বা পরিহিত মানুষটির মৃতদেহ নিয়ে অদ্ভুত ব্যবহার... সব একই রকমের চেনা কয়েকটি নারকীয় দৃশ্য। হঠাৎ রূপকের মনে পড়ে গেল অঙ্কুর বাবুর বলা কথাগুলো “আপনাকে মনের সমস্ত একাগ্রতা দিয়ে চারিদিক থেকে সংগ্রহ করতে হবে কিছু ক্লু!” বারবার মাথার মধ্যে এই একই কথা যেন প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো!

সেই সময় মৃতের মুখের ওপর মুখ রেখে ওই অদ্ভুত আচরণটি করে চলেছিল লাল জোব্বাধারী...ঠিক তখনই যেন নিজের মধ্যে এক দানবিক শক্তির উপস্থিতি উপলব্ধি করতে পারলো রূপক। যেভাবেই হোক, আজ তাকে পালাতেই হবে, মুক্তি পেতেই হবে এই দুঃস্বপ্ন থেকে। সে চালাকির সঙ্গে পেছনে থাকা হাতের বাঁধনটি ঘষতে লাগলো খাঁচার একটি ধারালো বাঁশের কঞ্চির গায়ে। একটু চেষ্টা করতেই কেটে গেল দড়িটা। নিজের দুই হাত মুক্ত করে সে সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরলো খাঁচার সামনে থাকা দুটি গাছের ডালকে। দুই হাতের হ্যাঁচকা টানে ভেঙ্গে গেল খাঁচাটির সামনের অংশে থাকা বেশ কিছু ডাল। কোনো মতে নিজেকে খাঁচা থেকে মুক্ত করে সে দৌড়তে লাগলো...রাতের অন্ধকারে সে প্রাণপণে পা চালিয়ে ছুটতে লাগলো যে দিকে তার দুই চোখ যায়!

জঙ্গলের ঝোপঝাড় মাড়িয়ে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো সে। পিপাসায় বুকের ছাতি যেন ফেটে যাচ্ছে। সৌভাগ্যবশত সেই সময় সে শুনতে পেল জল বয়ে যাওয়ার কুলকুল আওয়াজ। তার মানে কাছাকাছি কোথাও একটা নদী আছে! জলের আওয়াজ অনুসরণ করে আবার ছুটতে লাগলো সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেল একটি অজানা নদীর ধারে। নদীর পারে উবু হয়ে বসে, দুহাত ভরে বরফ-গলা জল পান করল সে। কিছুটা জল নিয়ে মুখে জলের ঝাপটা লাগালো সে, তারপর নদীর বুকে নিজের মুখের ছায়ার দিকে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। অবিকল তার প্রতিবিম্ব ভেসে উঠছে নদীর জলে, যেমনটি সে রোজ দেখতে পায় আয়নার দিকে তাকালে। সে ভাবতে লাগলো, যে কীভাবে এতক্ষণ ধরে এই সকল ঘটনা তার সঙ্গেই ঘটে চলেছে! সে তো কখনো ওই বন্যপ্রান্তরে যায়নি, তাহলে এই স্বপ্ন দেখার অর্থ কী?

এবার হঠাৎ স্বপ্নের রূপকের চোখ চলে গেল নিজের হাতের ঘড়ির দিকে! সে পরে আছে একটি স্মার্ট-ওয়াচ...তার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে তার আরও আশ্চর্য হওয়ার পালা! সেখানে তারিখ দেখাচ্ছে ১০.০৮.২০১৯ সময় রাত ১১-১০! আজই তো এই তারিখ, আর এই মুহূর্তের সময়ই তো দেখাচ্ছে ঘড়িতে! কিন্তু আসলে তো সে এই মুহূর্তে কলকাতায়, নিজের ফ্ল্যাটের বিছানায়! তাহলে একই সময় স্বপ্নে দেখা সম্পূর্ণ অন্য ঘটনাগুলি কী করে ঘটে চলেছে তার সঙ্গে! ঠিক এমন সময় নদীর জলের প্রতিবিম্বে সে দেখতে পেল ওই লাল জোব্বাধারী লোকটি সেই মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়েছে তার পেছনে...সে হাতে একটি ভারী গাছের ডাল উঁচিয়ে হিংস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে তার দিকে... আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সে তীব্র গতিতে রূপকের মাথার পেছনে আঘাত করল ডালটি দিয়ে... আর তারপর...

একটা বিকট চিৎকার করে ঘুম ভেঙ্গে গেল রূপকের! সে চোখ খুলে দেখলো, যে শুয়ে আছে তার বেডরুমের বিছানায়। তার চিৎকার শুনে শশব্যস্ত হয়ে জলের গ্লাস এগিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তার পরিবারের একমাত্র সদস্য, তার বিধবা মা। গ্লাস থেকে বেশ কিছুটা জল খেলো রূপক। বাকি রাতে আর ঘুম এলো না তার। সকাল হতেই সে ছুটে গেল অঙ্কুর বাবুর চেম্বারে।

 

(৩)

আজ মায়ের সঙ্গে অঙ্কুর বাবুর চেম্বারে এসেছে রূপক। রূপকের সমস্ত কথা ঠান্ডা মাথায় শুনলেন অঙ্কুর বাবু। তারপর বলতে লাগলেন, “গুড মিস্টার সাহা, আপনি আপনার স্বপ্ন হাতড়ে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ক্লু জোগাড় করতে সফল হয়েছেন... প্রথমত, আপনার স্বপ্নে যে ব্যাক্তির সঙ্গে সমস্ত ঘটনা ঘটছে তার চেহারা আপনার মত, হতে পারে সেটা আপনি নিজেই!”

বিহ্বল চোখে অঙ্কুর বাবুর দিকে চেয়ে রইলো রূপক। তিনি আবার বলে চললেন, “কিন্তু আপনার দ্বিতীয় ক্লুটি এই বিষয়টিকে অস্বীকার করছে। যে সময় ঘটনাগুলি ঘটছে, ঘড়িতে দেখা তারিখ এবং সময় বলছে সেটাই বর্তমান মুহূর্ত। তাহলে এগুলো যে আপনার কোনো পূর্বজীবনের স্মৃতি, তা কিন্তু নয়!”

“আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন, ডাক্তারবাবু?”

অঙ্কুর বাবুর কপালে দেখা দিলো চিন্তার ভাঁজ। তিনি বলে উঠলেন, “এখান থেকে একটা বিষয় তো প্রমাণিত যে স্বপ্নের সমস্ত ঘটনা ঘটছে বর্তমান সময়েই, এবং তা ঘটছে আপনার মত চেহারার কোনো ব্যক্তির সঙ্গেই। আপনি হয়তো ভাবছেন সেটা আপনি নিজে, কিন্তু আসলে সে সম্পূর্ণ অন্য এক ব্যাক্তি!”

“আমার মত দেখতে অথচ আমি নই...”

“আপনার কি কোন যমজ ভাই আছে... মানে আইডেনটিকাল টুইন?”

“কই না তো...”

কথাগুলি বলার পরেই হঠাৎ রূপকের চোখ চলে গেল তার মায়ের দিকে। একটি চাপা উত্তেজনা যেন খেলা করছে প্রৌঢ়ার চোখেমুখে। যেন বহুদিনের কোনো অব্যক্ত কথা আজও লুকোতে চাইছেন তিনি। কিন্তু রূপকের কৌতূহলের সামনে ধরা পড়ে গেলেন তিনি। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে তিনি অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলছেন, ডাক্তারবাবু… এটা আজ থেকে তিরিশ বছর আগেকার কথা যা এখনো তুই জানিস না, বাবা… সেই সময় তুই একা আমার কোলে আসিসনি… তোর সঙ্গে এসেছিল তোর ভাই, কারণ যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছিলাম আমি!”

“কী বলছো তুমি, মা!”

“হ্যাঁ বাবা, আমি এবং তোর বাবার অফিসের এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর স্ত্রী প্রসব বেদনা নিয়ে একই সঙ্গে ভর্তি হয়েছিলাম হাসপাতালে। আমি জন্ম দিয়েছিলাম যমজ সন্তানের। কিন্তু ভগবানের কী বিচার দেখ, সেই মহিলা জন্ম দিলেন একটি মৃত সন্তানের। সন্তানকে হারিয়ে উন্মাদের মত অবস্থা হল তোর বাবার বন্ধুর স্ত্রীর। তখনই সেই বন্ধু হাত জোড় করে তোর বাবার কাছে রাখলেন একটি অনুরোধ… তিনি গোপনে দত্ত্বক নিতে চান আমাদের একটি সন্তানকে। তার মুখের দিকে চেয়ে তোর বাবা ফেলতে পারলো না তার কথা!”

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো রূপক। কিছুক্ষণ পর সাময়িক নীরবতা ভঙ্গ করলেন অঙ্কুর বাবু, “এই বার সমস্ত বিষয়টা জলের মত পরিষ্কার হয়ে উঠেছে আমার সামনে। যমজ সন্তানদের মধ্যে মাঝে মাঝে একটি বিশেষ অতি-প্রাকৃত ক্ষমতার নিদর্শন পাওয়া যায়। প্যারাসাইকোলজির ভাষায় একে বলা হয় ‘টেলিপ্যাথি!’ এর সাহায্যে কোনো একটি যমজ সন্তান কিছু মুহূর্তে যা দেখছে বা উপলব্ধি করছে, তা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে ওপর যমজ সন্তানটির কাছে, যদিও বা এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আমার পক্ষে দেওয়া অসম্ভব। আপনার ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে, মিস্টার সাহা!”

“কী বলছেন আপনি, ডাক্তারবাবু!”

“ইয়েস রূপক বাবু, এখন আপনার করণীয় হল অতি সত্ত্বর খোঁজ নেওয়া যে আপনার সেই ভাই এই মুহূর্তে কোথায় আছেন, কোন অবস্থায় আছেন… কারণ বাস্তবে আপনার স্বপ্নে দেখা সেই বিপদজনক পরিস্থিতির শিকার কিন্তু আপনি হচ্ছেন না… হচ্ছেন আপনার যমজ ভাই!”

এই কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো রূপক, সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো তার মা এবং অঙ্কুর বাবুর দিকে!

 

(৪)

মায়ের কাছ থেকে রূপক জেনেছে যে তার স্বর্গীয় বাবার সেই বন্ধুর নাম হল অচিন্ত্য সেনগুপ্ত। রূপকের যমজ ভাইকে দত্তক নেওয়ার পরই তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতা ছেড়ে দিল্লিতে চলে যান, যাতে ব্যাপারটা সকলের মধ্যে জানাজানি না হয়। সেখানে তিনি নতুন চাকরি নেন। রূপকের অজান্তে এরপরও বেশ কিছুদিন ধরে তার বাবার সঙ্গে অচিন্ত্য বাবুর যোগাযোগ ছিল। সেই সুবাদে রূপকের মায়ের কাছে আছে অচিন্ত্য বাবুর দিল্লির ঠিকানাটা। ফ্লাইট থেকে দিল্লিতে নেমে রুদ্ধশ্বাসে সেখানেই ছুটে আসে রূপক। বাড়ির দরজায় বেল বাজানোর কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দিলেন এক সৌম্যদর্শন প্রৌঢ় ব্যক্তি। তিনি যেন চমকে উঠলেন রূপককে দেখে, তারপর হঠাৎ তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন, “সোহম… সোহম তুই এসেছিস বাবা… কোথায় চলে গিয়েছিলিস এতদিন ধরে তোর এই বুড়ো বাপকে ফেলে!”

রূপক বুঝতে পারলো, যে তাহলে তার যমজ ভাইয়ের নাম হল সোহম। আর ইনিই হলেন অচিন্ত্য বাবু, যিনি তাকে দেখে সোহম মনে করছেন! রূপক লক্ষ্য করল যে এই বয়স্ক মানুষটির ডান পাটি পঙ্গু, তাই তাঁকে ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির ভেতরে ঢুকে অচিন্ত্য বাবুকে এখানে আসার সমস্ত কারণ জানালো রূপক। নিজের ভুল বুঝতে পেরে মুখে শোকের ছায়া নেমে এলো অচিন্ত্যবাবুর, তিনি অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলেন, “তাহলে তুমি সোহম নও!”

“না কাকাবাবু, তবে আমি কিন্তু সোহমের খোঁজেই এসেছি… কোথায় আছে সে এখন?”

হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন অচিন্ত্য বাবু, “বিগত পাঁচ মাস ধরে সে নিরুদ্দেশ, বাবা… আমি থানা পুলিশ করেও তার কোনো হদিস পাচ্ছি না!”

“সে কী! আপনি সব কিছু খুলে বলুন, কাকাবাবু… কীভাবে নিরুদ্দেশ হল সে?”

“জানি না, বাবা…কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। সোহম দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস নিয়ে এম.এ পাশ করেছিল। তারপর ওখানেই প্রাচীন তিব্বতী ধর্ম নিয়ে গবেষণা করছিল। একদিন বাড়িতে এসে বলল যে গবেষণার কিছু কাজ করার জন্য ওকে তিব্বতে যেতে হবে। কয়েকমাস আগেই তার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে। কিছুদিন ধরে নিয়মিত আমার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ ছিল তার, কিন্তু তারপর থেকে ওকে ফোনে আর পাওয়া গেল না। দিনের পর দিন যেতে লাগলো, ওকে ফোন করলেই বলতো ‘নট রিচেবল!’ আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর আমি বাড়িতে একা মানুষ… ভয় পেয়ে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। কিন্তু তারাও কিছু করতে পারলো না, শুধু জানালো যে সোহমের মোবাইল টাওয়ার থেকে তার সর্বশেষ লোকেশন পাওয়া গিয়েছে তিব্বতের ‘লুনাং’ নামক একটি বনাঞ্চল থেকে! তবে সেখানে খোঁজ নিয়েও পাওয়া যায়নি সোহমকে!”

“তিব্বতের ‘লুনাং’ ফরেস্ট”, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল রূপক, “যেভাবেই হোক বাঁচাতেই হবে আমায় সোহমকে!” এই বলে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অচিন্ত্য বাবুর বাড়ি থেকে বিদায় নিলো রূপক। সে একটি ট্যাক্সি ধরে আবার ছুটে চললো এয়ারপোর্টের দিকে। রাস্তায় তার মনে হচ্ছিলো যেন একটি কালো রঙের মোটর গাড়ি বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাদের পিছু নিয়েছে। তবে বিষয়টির দিকে তেমন গুরুত্ব দিলো না রূপক।

 

(৫)

‘লাসা বনগান’ এয়ারপোর্টে নেমে এই প্রথম তিব্বতের মাটিতে পা রাখলো রূপক। সেখান থেকে অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে ট্যাক্সি নিয়ে ‘নিংচি কাউন্টি’-তে আসতে লাগে বেশ কয়েক ঘণ্টা। এখানকার ‘লুনাং টাউন’-এই অবস্থিত ‘লুনাং ফরেস্ট’। চারিদিকে বরফ-ঢাকা পাহাড় চুড়া এবং তার নিচে ঘন সবুজ পাইন গাছের বন। কোথাও বা সমতল ভূমিতে সবুজ ঘাসের মাঝে ফুটে আছে নানা নাম না জানা বন্য পাহাড়ি ফুল। ছোট ছোট জনবসতি এবং জলাশয়ও চোখে পড়ে কিছু জায়গায়। তবে সেদিকে কোন হুঁশ নেই রূপকের, তার মনে নানা প্রশ্নের ঝড়! এই বনেই কি সে খুঁজে পেতে সফল হবে সোহমকে? সে এখনো বেঁচে আছে তো? কেন আটকে রাখা হয়েছে তাকে এখানে? ওই জোব্বাধারী লোকটিই বা কে? মৃতদেহ নিয়ে তার ওই অদ্ভুত আচরণের কারণ কি?

লুনাং টাউনে এসে স্থানীয় একটি হোটেলে চেক-ইন করল রূপক। হোটেলের ম্যানেজার অসমীয়া ছেলে, নাম হেমন্ত বড়ুয়া। ছেলেটির রূপকের মতই বয়স এবং সে বেশ মিশুকে। রূপককে হোটেলে ঢুকতে দেখেই সে হাসিমুখে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলে উঠল, “আরে আসুন আসুন সোহম বাবু, আমার খুব ভালো লাগছে যে আপনি আবার এই হোটেলেই উঠলেন…তা যাইহোক, আপনি আগেরবার কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গিয়েছিলেন? আপনার খোঁজে এখানে পুলিশ এসেছিল… সে কী হয়রানি!”

চমকে উঠল রূপক, তার মানে কাকতালীয় ভাবে সোহমও এখানে এসে এই হোটেলেই উঠেছিল! রূপক সংক্ষেপে নিজের পরিচয় দিলে হেমন্ত বুঝতে পারলো নিজের ভুল। রুমের চাবিটা হাতে পেয়ে রূপক হেমন্তকে বলল, “একটু আসতে পারবেন আমার রুমে, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল…”

কিছুক্ষনের মধ্যেই রূপকের রুমে এলো হেমন্ত। রূপক তাকে এখানে আসার সমস্ত কারণ ব্যাখ্যা করলে, কেমন যেন একটা চাপা আতঙ্কে কালো হয়ে গেল হেমন্তের সদাহাস্য মুখ। এবার রূপক তাকে বলে উঠল, “সোহম যখন এখানে এসেছিল, তখন অপনার সঙ্গে তার কি কথাবার্তা হয়েছিল?”

“তিনি বলেছিলেন যে তিনি তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের তন্ত্র-মন্ত্রের কিছু বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন, সেই কাজেই এসেছেন এখানে… তবে…”

“তবে কী?”

“তিনি বলেছিলেন যে এই বিষয় নিয়ে কাজ করার তার নিজস্ব ইচ্ছা ছিল না, তার বাবা অচিন্ত্য বাবুই নাকি তাকে বারবার এই বিষয় নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দেন। পরিবারের হাল ধরতে অচিন্ত্য বাবু বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি, কিন্তু তিব্বতি তন্ত্র-মন্ত্রের ওপর নাকি তার বরাবর খুব কৌতূহল। তাই তিনি চাইতেন তার ছেলে এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করুক!”

“যাহ বাবা, এই কথা তো অচিন্ত্যবাবু আমাকে আগে বলেননি!”

“মিস্টার সাহা, আমি অনেক দিন ধরে তিব্বতে আছি। এখানকার নানা লোককথা আমি জানি। তাই আপনি স্বপ্নে যে দৃশ্যগুলো দেখেছেন… কিছুটা হলেও সেই বিষয়টা আমি চিনতে পেরেছি!”

“কী সেটা? চুপ করে থাকবেন না, বলুন…”

“তিব্বতি বৌদ্ধ তান্ত্রিক বা ‘নাগাগস্পা’-দের মধ্যে প্রচলিত আছে একটি ভয়ানক তন্ত্র সাধনা যাকে বলা হয় ‘রোলাং’ (Rolang). এই প্রক্রিয়ায় অমাবস্যার রাতে তাদের জোগাড় করতে হয় একটি মৃতদেহ। যদি তারা তা না করতে পারে, তাহলে কখনো কখনো জ্যান্ত মানুষকেও ধুতুরার বিষ খাইয়ে হত্যা করে। এরপর শুরু হয় তাদের তন্ত্রক্রিয়া। তান্ত্রিকটি মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে মৃতদেহটার ওপর শুয়ে পড়ে, তার মুখে নিজের মুখ ঠেকিয়ে রাখে। এই সময় অশরীরী শক্তি প্রবেশ করে লাশটির মধ্যে, সে ধীরে ধীরে মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পরে। নীল হয়ে ওঠে তার দুটি চোখ, সে হয়ে ওঠে ‘রোলাং’ নামক এক তিব্বতি জম্বি!”

“মাই গুডনেস!”

“হ্যাঁ রূপক বাবু, এখানেই শেষ নয়। এরপর ‘রোলাং’-টি ছটফট করতে থাকে, নিজেকে মুক্ত করতে চায় তান্ত্রিকের আলিঙ্গন থেকে। কিন্তু তবুও সেই তান্ত্রিক নিজের সর্বশক্তি দিয়ে জাপটে ধরে থাকে ‘রোলাং’-কে, নিজের মুখ ঠেকিয়ে রাখে জম্বিটির মুখের সঙ্গে। তান্ত্রিকের মন্ত্রোচ্চারণের আওয়াজ শুনে ‘রোলাং’ বাধ্য হয় নিজের মুখের ভেতর থেকে জিভটা বার করতে। সেটাই হল মাহেন্দ্রক্ষণ… আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে তান্ত্রিক নিজের দাঁত দিয়ে কামড়ে জম্বিটির জিভটি ছিন্ন করে দেয় তার মুখ থেকে। আর তখনই মৃত্যু হয় ‘রোলাং’-এর!”

“কিন্তু যদি জিভ কেটে দেওয়ার আগে ওই তান্ত্রিকের আলিঙ্গন থেকে কোনোভাবে ছাড়া পেয়ে যায় জম্বিটি…”

“তাহলেই সর্বনাশ! সে হত্যা করবে তান্ত্রিকটিকে! তারপর চারিদিকে নিজের ইচ্ছামত ঘুরে বেড়াবে। এদের শরীরের জয়েন্টগুলো তেমন কাজ করে না, তাই এরা নিচু হতে পারে না। অদ্ভুত যন্ত্রের মত চলাফেরা করে। সেই জন্য তিব্বতের বেশিরভাগ গ্রামের বাড়িগুলোর দরজা হয় খুব নিচু, যাতে এই জম্বি মানুষের বাসস্থানে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু কোনো মানুষকে সামনে পেলে এরা হয় তাকে হত্যা করে, বা নিজের দুই হাত দিয়ে তার কপালে স্পর্শ করে, আর তাতে ওই মানুষটিও হয়ে ওঠে তার মতই এক ‘রোলাং’!”

“কিন্তু কোন উদ্দেশ্যে করা হয় এই ভয়ানক সাধনা?”

“মনে করা হয় ওই জম্বির জিভে থাকে চমৎকার ঐশ্বরিক ক্ষমতা। নানা অসাধ্য সাধন করা যায় ওই বস্তুটি দিয়ে… যেমন ধরুন অনেক দিন ধরে কোনো মুমূর্ষু পঙ্গু লোককেও এমন সাতটি জিভের স্পর্শে সম্পূর্ণ সুস্থ করে নবজীবন দেওয়া সম্ভব!”

সেই মুহূর্তে রূপকের মনে পড়লো অচিন্ত্য বাবুর কথা। তারও তো একটা পা পঙ্গু! আর তিনিই সোহমকে ঠেলে দিয়েছেন এই গবেষণা করার জন্য! তার মানে কি এই সবের সঙ্গে অচিন্ত্য বাবুই কোনো ভাবে জড়িয়ে আছেন! রূপক আবার জিজ্ঞাসা করল,

“আচ্ছা, সোহমকে ছাড়া এখান থেকে আর অন্য কারোর নিখোঁজ হওয়ার কোনো খবর পেয়েছেন আপনি?”

“হ্যাঁ মিস্টার সাহা, তাকে ছাড়াও কয়েক মাসের মধ্যে আরো ছয় জন পর্যটক নিখোঁজ হয়েছেন ওই বনে গিয়ে… কিন্তু এখনো পুলিশ তাদের কোনো ট্রেস পায়নি!”

একটি জরুরি ফোন এসে যাওয়ায় রূপকের ঘর থেকে চলে গেল হেমন্ত। রূপক ভাবতে লাগলো, অর্থাৎ এই সাতজনকে অপহরণ করে বন্দি করেছে কোনো তান্ত্রিক, আর প্রতি অমাবস্যার রাতে তাদের একে একে ‘রোলাং’-এ পরিণত করে তাদের জিভ সংগ্রহ করছে সে! সে কি এইসব করছে অচিন্ত্য বাবুর নির্দেশে? হয়তো সেই জন্যই সোহমকে মৃত্যুমুখে পাঠিয়ে দিয়েছেন অচিন্ত্য বাবু! তার পক্ষে সেটা করা খুব অস্বাভাবিকও নয়, কারণ সোহম তো আর তার নিজের সন্তান নয়!

রুমের রেলিংয়ে এসে দাঁড়ালো রূপক। বেশ রাত হয়ে গিয়েছে এখন, আজও অমাবস্যা। পলকের মধ্যে রূপকের মনে পড়ে গেল, যে আজ অবধি সে ওই স্বপ্নগুলো দেখেছে শুধুমাত্র অমাবস্যার রাতেই, আর এখনো অবধি পাঁচ বার সে এমন স্বপ্ন দেখছে! তার মানে আজ হল ষষ্ঠ বন্দিকে ‘রোলাং’-এ পরিণত করার পালা, এবং হতেই পারে যে সেই হল তার ভাই সোহম!

“না, আমি কিছুতেই এইভাবে মৃত্যুমুখে এগোতে দেবো না আমার ভাইকে, কিছুতেই না!” অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল রূপক।

 

(৬)

ঘাড়ের পেছনে এখনো বেশ ব্যথা আছে সোহমের। পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সেদিন ওই ‘নাগাগস্পা’-র হাতে গাছের ডালের আঘাতটি খাওয়ার পর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সে। পরের দিন বিকালের দিকে চৈতন্য ফিরে সে আবার নিজেকে খাঁচার ভেতরে খুঁজে পেল। সেই কত মাস আগে জঙ্গলের ভেতর পথ হারিয়ে ফেলেছিল সে, পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল একটি গাছের ছায়ার নিচে। তারপর যখন ঘুম ভাঙ্গলো, সে বুঝতে পারলো যে একটা পাহাড়ের সুড়ঙ্গের মধ্যে তাদেরকে বন্দি করে রাখা হয়েছে! তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে মোবাইল ফোনটা। দিনে একবার করে খাবার দেওয়া হত তাদের... ঝলসানো মাংস এবং কয়েকটি জংলি ফলমূল। এই সব মুখে তুলতেই বমি পেয়ে যেত সোহমের, দিনের পর দিন এই অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে জড়সড় হয়ে খাঁচার ভেতর জীবন কাটানো যেন অসহনীয় হয়ে উঠেছিল তার কাছে। সে আর আরেকজন বন্দি আপাতত জীবিত আছে। তবে আজ বোধহয় আবার অমাবস্যার রাত! তাদেরকে দুজনকে খাঁচা সমেত আবার ওই সাধনার স্থলে নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছে এই দলের বেশ কিছু ‘নাগাগস্পা’! তাহলে কি আজ সোহমের পালা, নাকি তার সঙ্গেই আটক অপর বন্দিটির!

সৌভাগ্যবশত এই যাত্রায় রক্ষা পেল সোহম। ‘রোলাং’-এ পরিণত করার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে অপর বন্দিটিকে। তাকে জোর করে ধুতুরার বিষ খাইয়ে ইতিমধ্যেই হত্যা করা হয়েছে! সেই মৃতদেহের সাহায্যে তন্ত্রমতে জাগিয়ে তোলা হয়েছে সেই ভয়ানক জম্বিকে! তার মুখে মুখ রেখে তাকে জাপটে ধরেছিল সেই তান্ত্রিক, অপেক্ষা করছিল কোন সময়ে জম্বিটির মুখ থেকে তার জিভটি ছিন্ন করতে পারবে! খাঁচার ভেতর বসে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে সেই দিকেই তাকিয়ে ছিল সোহম।

কিন্তু এ কী! এ কী দেখছে সে! অবিকল সোহমের দেখতে একটি যুবক যেন ছুটে এলো তান্ত্রিকের কাছে। তার হাতে একটি লম্বা গাছের ডাল। সে সেটা দিয়ে সটান আঘাত করল তান্ত্রিকের মাথায়। একটি তীব্র চিৎকার করে সচকিত হয়ে জম্বিটির মুখ থেকে মুখ সরিয়ে পেছন ঘুরে তাকাল তান্ত্রিকটি। সেই মুহূর্তে রূপক ছুটে পালিয়ে গেল সেই স্থান থেকে, লুকিয়ে পড়লো অনতিদূরে থাকা ঝোপের ভেতর। স্বপ্নে দেখা ‘লুনাং’ ফরেস্টের এই জায়গাটি খুঁজে বার করতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি রূপকের। তখনই তান্ত্রিকটি বুঝতে পারলো কতবড় ভুল করে ফেলেছে সে ‘রোলাং’-এর মুখ থেকে নিজের মুখ সরিয়ে! জম্বিটি এখন যে তার আয়ত্তের বাইরে! সে নিজের দুই হাত দিয়ে চেপে ধরলো তান্ত্রিকটির মুণ্ডুটিকে, তারপর এক ঝটকায় সেটাকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দিলো পেছনে! সঙ্গে সঙ্গে মুখ দিয়ে রক্ত বার হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হল তান্ত্রিকটি।

ওদিকে ততক্ষণে রূপক এসে খাঁচার দরজা খুলে মুক্তি দিয়েছে সোহমকে। খুলে দিয়েছে তার হাতের বাঁধন। ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের দিকে বাঁ-হাতে পিস্তল উঁচিয়ে পাশের ঝোপঝাড় ভেঙ্গে এগিয়ে এলো এক পুরুষের ছায়া মূর্তি। তাকে দেখে অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল রূপক, “ডাঃ অঙ্কুর বর্মণ!... তার মানে আপনি আছেন এই সবের পেছনে!”

পৈশাচিক কণ্ঠে দাঁতে দাঁত ঘষে বলে উঠলেন অঙ্কুর বাবু, “দেরি হয়ে গেল...আমার একটু দেরি করে আসার জন্য তোদের কারণে মরতে হল ওই তান্ত্রিককে! কিন্তু সাতটা ‘রোলাং’-এর জিভ যে আমায় পেতেই হবে, সেটা না পেলে আমি কীভাবে ঠিক করব আমার আজন্ম প্যারালাইসিস হয়ে থাকা ডান হাতের পাতাটাকে!”

মুহূর্তের মধ্যে রূপকের মনে পড়ে গেল অঙ্কুর বাবুর বাঁ-হাতে প্রেসক্রিপশন লেখার কথা! ওদিকে অঙ্কুর বাবু উন্মাদের মত চিৎকার করে বলেই চললেন, “যেদিন থেকে জানতে পারলাম যে তুই স্বপ্নে তোর ভাই-এর দেখা দৃশ্যগুলো দেখতে পাচ্ছিস, সেদিন থেকে বুঝেছিলাম যে তোকে এমনই ছেড়ে দেওয়া উচিৎ হবে না। তাহলে বাইরের লোকের কাছে ফাঁস হয়ে যেতে পারে আমার পয়সা দিয়ে করানো এই তন্ত্র সাধনার কথা। তাই তোর মনে ভাইয়ের চিন্তা ঢুকিয়ে তোকে এখানে আসতে বাধ্য করলাম, যাতে এখানে সকলের অলক্ষ্যে তোদেরকে শেষ করতে পারি। সেই মত তোর পেছনে লোক লাগিয়ে নজর রাখতে শুরু করলাম... কিন্তু আজ যে এখানে আসতে বড্ড দেরি হয়ে গেল আমার, যাইহোক এবার তোদের দুজনকে আমার হাত থেকে কে বাঁচাবে বল?”

রূপকের মনে পড়লো, তার মানে অঙ্কুর বাবুর লাগানো লোকই সেদিন তার পিছু নিয়েছিল! তিনি পিস্তল উঁচিয়ে ছুটে আসছেন তাদের দুই ভাইয়ের দিকে! তিনি প্রথমে সোহমকে লক্ষ্য করে গুলি চালালেন, কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গুলিটি লাগলো তার পায়ে। যন্ত্রণায় চিৎকার করে জঙ্গলের মাটিতে পড়ে গেল সোহম। ঠিক তখনই অঙ্কুর বাবুর সামনে চলে এসেছে সেই জম্বিটি। নিজেকে বাঁচানোর জন্য অঙ্কুর বাবুর গুলি ছুঁড়লেন তার দিকে, কিন্তু তাতে কোন লাভ হল না! মুহূর্তের মধ্যে ওই তান্ত্রিকের মতই অঙ্কুর বাবুর মুণ্ডুটিও পেছনে ঘুরিয়ে তাকে হত্যা করল ‘রোলাং’!

ধীরে ধীরে জম্বিটি এগিয়ে এলো জঙ্গলের মাটিতে পড়ে থাকা সোহমের দিকে। কিন্তু নিচু হতে না পারার জন্য তার কোন ক্ষতি করতে পারলো না সে। এবার সে এগিয়ে এলো অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা রূপককে হত্যা করার জন্য। কিন্তু যে মুহূর্তে নিজের দুই হাত দিয়ে সে স্পর্শ করতে যাবে রূপককে, সেই মুহূর্তেই কে যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছুটে এলো পেছনের ঝোপের ভেতর থেকে। তারপর নিজের সর্বশক্তি দিয়ে পেছন থেকে জাপটে ধরলো জম্বিটির উন্মত্ত বাহুদুটিকে। বিস্ময়ের পারদ চড়া মুহূর্তে রূপক বলে উঠল, “অচিন্ত্য বাবু! আপনি এখানে!”

“তোমাকে সোহমের খোঁজে লাগতে দেখে আমি যেন শান্তি পাচ্ছিলাম না, বাবা... তিব্বতি তন্ত্র-মন্ত্র নিয়ে সত্যিই খুব কৌতূহল ছিল আমার। মনে হল, সেই ইচ্ছাটা সোহমের ওপর চাপিয়ে আমার এক ছেলেকে তো হারিয়েইছি, এখন আরেকজনকে যে কিছুতেই হারাতে পারবো না! তাই তোমার পেছনে পেছনে এই খোঁড়া পা নিয়েও গোপনে এখানে চলে এলাম আমি...নাও, আর দেরি করো না বাবা, তুমি নিশ্চয় জানো কি ভাবে এই দানবকে পরাস্ত করতে হবে!”, জম্বিটির গায়ের জোরের সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে পরিশ্রান্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন অচিন্ত্য বাবু।

ঠিক সেই মুহূর্তে রূপক করে উঠল একটি বীভৎস কাজ! নিজের দুই হাতের হ্যাঁচকা টানে সে খুলে ফেললো জম্বিটির মুখের চোয়াল! তারপর সে মুখ দিয়ে স্পর্শ করল দানবের মুখটিকে, এবং মুহূর্তের মধ্যে নিজের দাঁতের কামড়ে ছিন্ন করে দিলো ‘রোলাং’-এর জিভ। একটি বিকট চিৎকার করে নিচে পড়ে গেল জম্বিটি, কিছুক্ষণ ছটফট করতে করতে ক্রমে নিথর হয়ে গেল তার শরীর!

এরপর কেটে গিয়েছে একটি মাস। পায়ের চিকিৎসা করে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছে সোহম। একত্রে মিলিত হয়েছেন রূপক, সোহম, তাদের মা এবং অচিন্ত্য বাবু। সেই রাত্রেই ওই তান্ত্রিকের সংগ্রহ থেকে বাকি পাঁচটা ‘রোলাং’-এর জিভ এনে ষষ্ঠ জিভটির সঙ্গে আগুনে পুড়িয়ে ফেলেছিল তারা।

তারা জানে, যে প্রকৃতি যাকে যেমন করেছে, মানুষের তেমন থেকেই সন্তুষ্ট হওয়া উচিৎ। অতি-প্রাকৃত উপায়ে কিছু আয়ত্ত করতে গেলে তা কখনই কারোর জন্য মঙ্গলময় হয় না।