গোলকধাঁধা ● অর্ঘ্যজিৎ গুহ


 

 

“আসতে পারি কমরেড?” এই বলে হাসি মুখে চেম্বারে মুখ বাড়ালেন ডক্টর সেরগেই গুস্তভ, রুশ সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞ মনোবিদ।

পিছন ফিরে জানলাটার দিকে মুখ করে বসেছিলেন কমরেড ইগর চেভক্সকি, জানলার বাইরে দিয়ে উপকূলটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এই রাতের বেলাতেও, বেশ লাগে ওনার এভাবে তাকিয়ে থাকতে, একটু একটু মেঘ জমছে কি আকাশে?

চেনা গলার আওয়াজ পেয়ে রিভলভিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে সামনে দিকে ফিরলেন, “আসুন কমরেড আসুন, আপনার সেক্রেটারির টেলিগ্রাম পেয়েছি গতকালই।”

আগত বন্ধুকে হাতের ইশারায় বসতে বললেন ইগর চেভক্সকি।

চেয়ারটা টেনে বসলেন সেরগেই গুস্তভ, পরনে সামরিক ডাক্তারের পোশাক, কোথাও একটুও অযত্নের ছাপ নেই, স্তালিনগ্রাড থেকে হাপসালু বিমানঘাঁটি, সেখান থেকে সড়ক পথে প্রায় চার ঘণ্টার যাত্রা। দীর্ঘ পথের ক্লান্তির ছাপ নেই সেভাবে শরীরে কোথাও, মাঝে শুধু কয়েক ঘণ্টার কিভিতাম্মির গোপন আস্তানায় বিশ্রাম।

“বলুন কীভাবে সাহায্য করতে পারি আপনাকে।” শান্ত স্বরে বললেন ডক্টর সেরগেই।

“একটা জার্মান দল ধরা পড়েছে কিছুদিন আগে এক সকালে পুলির নোংরা জলার থেকে। এত সহজে ধরা পড়ল দেখে অবাক হয়েছিলাম, কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করলেই এক অদ্ভুত গল্প শোনাচ্ছে দলের সব্বাই!”

“পাগলামোর কোনো লক্ষণ চোখে পড়েছে আপনাদের?” জানতে চাইলেন সেরগেই।

“সে তো আপনি ভালো বুঝবেন ডক্টর।” ঠোঁটের পাশে চুরুটটা চেপে ধরে বললেন ইগর চেভক্সকি।

“শুধু একটাই কথা, এই দলটার মনে হয় ঠান্ডা সহ্য হচ্ছে না, সেলের বাইরে আগুন জ্বেলে রাখতে হয় এদের, নয়তো চিৎকার চেঁচামেচি করে সারারাত, আপনি দেখুন তো একটু।” চুরুটের ছাইটা ঝাড়তে ঝাড়তে অনুরোধের সুরে বলে ওঠেন ইগর চেভক্সকি।

“সে তো নিশ্চয়ই কমরেড, দেখি ফাইলগুলি দিন একবার চোখ বুলিয়ে নিই।”

টেবিলে রাখা ঘণ্টিটা দু’বার টিপতেই একটা রাশিয়ান যুবক এসে দাঁড়ালো টেবিলের সামনে।

“কমরেড, পুলি থেকে ধরা পড়া নাৎসি জানোয়ারগুলির ফাইলটা দাও তো ডক্টর সেরগেইকে।”

সামরিক অভিবাদন করে হুকুম তালিম বেরিয়ে গেল রুশ যুবকটি।

“এদের স্কোয়াডে একজনকে পাবেন, লোকটা অনেক দিন ধরেই এ দেশে সক্রিয় চর সে আমরা জেনেছি, লোকটা ভীষণ ধূর্ত, দেখুন তো ভাঙতে পারেন নাকি।”

“ঠিক আছে কমরেড, দেখছি আমি।”

ততক্ষণে ফাইল নিয়ে এসে হাজির হয়েছে রুশ যুবকটি।

“ডক্টরকে কাউন্সেলিং রুমটায় নিয়ে যাও কমরেড।”

ফাইলটা হাতে নিতে রুশ যুবকটির সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন সেরগেই গুস্তভ।

***

ঘরে প্রবেশ করল একজন শীর্ণ কিন্তু দীর্ঘদেহী যুবক। বয়স কত হবে তা আন্দাজ করা এক প্রকার কঠিন বটে, তবে ডক্টর সেরগেই বুঝলেন আগত যুবক কোনোমতেই পঁয়ত্রিশ পেরোয়নি, চেহারায় সেভাবে কোনো বিশেষত্ব না থাকলেও চওড়া কাঁধ আর কঠিন চোয়ালই বলে দিচ্ছে যুবকটি জাতে জার্মান।

ডক্টর সেরগেই গুসতভের চেয়ারের উলটো দিকে এসে দাঁড়াল যুবকটি, দু’পাশে দাঁড়ানো রাশিয়ান সেনা দুজনের প্রতি তাচ্ছিল্যটা চোখে পড়ার মতোই!

ওর অনুমতি বা অনুরোধ কোনোটারই অপেক্ষা না করে চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল জার্মান পুরুষটি।

“সহজাত জার্মান ঔদ্ধত্ব!” মনে মনে হাসলেন ডক্টর সেরগেই।

ঘরে প্রবেশ করার পর থেকেই লক্ষ্য করেছেন, আগত জার্মান যুদ্ধবন্দিটির হাবভাব কোনোটাই সে অর্থে চিঠিতে বর্ণিত ‘অস্বাভাবিক’ নয়, বরং শত্রুপক্ষের গুপ্তচরদের হাতে বন্দি হয়েও চরিত্রের কাঠিন্য একফোঁটাও কমেনি।

আলাপ জমানোর জন্যেই একটা সিগারেট এগিয়ে দিলেন সেরগেই, “নিন, আপনি আরাম করে বসুন, এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত অফিসার।”

স্পষ্ট চোখে পড়ল জার্মান পুরুষটির ঠোঁটের কোনায় একটা তাচ্ছিল্যের হাসি এসেও যেন মিলিয়ে গেল! হাতের সিগারেটটা দু’আঙ্গুলে তুলে নিয়ে টেবিলে রাখা লাইটারটা দিয়ে জ্বালিয়ে এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে বলতে শুরু করল, “এভাবে শত্রুর মন জিততে কে শিখিয়েছে? আপনাদের মহান নেতা স্তালিন?”

শেষের শব্দের উচ্চারণে যে তীব্র ঘৃণা আর অবজ্ঞা জড়ানো সেটা কান এড়িয়ে গেল না অভিজ্ঞ রুশ মনোবিদের, যুবকটির ঠান্ডা শীতল শ্লেষগুলি সূচের মত বিঁধল যেন, তবে উনি জানেন কীভাবে চরম শত্রুর গোপন কথা বের করে আনতে হয়, যথাসম্ভব হাসি ফুটিয়ে তুলে বললেন, “যদি বলি এটা এক সেনার প্রতি আরেক সেনার সৌজন্যবোধ, তাতেও কি বিশ্বাস করবেন না?”

টেবিলের উলটো দিক থেকে ভেসে এল শীতল কণ্ঠের উত্তর, “কোনো অনার্য জাতির সৌজন্যবোধের প্রয়োজন নেই, বিশেষ করে কোনো নোংরা কমিউনিস্টের তো একদমই নয়।”

তারপর আরও একটু থেমে হাতের সিগারেটটায় একটা লম্বা টান মেরে ধোঁয়া ছেড়ে বলতে থাকল, “কী জানতে চান বলুন? এত রাতে ডেকে পাঠানোর উদ্দেশ্যই বা কি?”

টেবিলের উলটো দিকে বসা মানুষটার দিকে নিজের শরীরটাকে আরও একটু এগিয়ে এনে বললেন ডক্টর সেরগেই গুস্তভ, “আপনার যে কথাগুলো কেউ বিশ্বাস করছে না, সেই গুলোই শুনতে চাই আমি।”

পাতারেই জেলখানার ছোট্ট স্যতসেতে ‘কাউন্সেলিং’ ঘরটায় যেন নেমে এলো এক অদ্ভুত নীরবতা, আওয়াজ বলতে শুধুই পাখাটার একটা যান্ত্রিক ঘড়ঘড় শব্দ, তাছাড়া আর কোনো শব্দ নেই, পেছনের উপকূল থেকে ভেসে আসা সমুদ্রের আওয়াজ ছোট্ট খুপরি জানলা দিয়ে এসে পৌঁছোয় না সেভাবে এই ঘরে।

দু’জোড়া চোখ শুধু চেয়ে আছে দু’জনের দিকে, একজনের চোখে ইস্পাতের কাঠিন্য, আরেকজনের চোখে আগ্রহী জিজ্ঞাসা।

দুজনের মাঝে সিলিং থেকে ঝুলছে একটা হলদেটে বাল্ব, একটা আলো আঁধারি খেলা করছে যেন দুজনের মধ্যে।

এক জোড়া চোখ নেমে এলো স্বাভাবিক ভাবে, টেবিলে রাখা একটা রাশিয়ান ভাষায় লেখা নেমপ্লেটটার অন্যমনস্ক ভাবে দিকে তাকিয়ে বলে উঠল জার্মান যুবকটি, “আপনি কখনও মৌমাছির চাকে ঢিল মেরেছেন ডক্টর?”

হঠাৎ এরকম একটা উত্তরের জন্যে তৈরি ছিলেন না ডক্টর সেরগেই গুস্তভ, তবে অভিজ্ঞতার জোরে এটুকু বুঝতে পারছেন বন্দি তাঁর জন্যে ‘অনেককিছু’ সাজিয়ে রেখেছেন, শুধু শুধু স্তালিনগ্রাড থেকে ওনাকে অকারণে ডেকে পাঠানো হয়নি জরুরি তলব দিয়ে।

হাতের কলমটা, যেটা তিনি অন্যমনস্কভাবে নাড়ছিলেন এতক্ষণ, সেটা পাশে রেখে দিলেন, মনোবিদ হিসাবে উনি জানেন রোগীর পূর্ণ আস্থা পেতে এই ছোট ছোট কাজগুলোও করা উচিত নয় যাতে রোগীর মনে হয় যে চিকিৎসক তাঁর কথা মন দিয়ে শুনছেন না, আর বিশেষ করে সেই রোগী যদি হয় কোনো সুচতুর জার্মান গুপ্তচর তাহলে তো এইরকম কাজ করাই উচিত নয়।

কলমটা পাশে রেখে বলতে লাগলেন, “আপনি কি বলতে চাইছেন এই বাল্টিক অঞ্চলে রাশিয়ার আক্রমণ করা উচিত হয়নি?”

অনেক দাবাড়ু প্রথম দানেই এমন একটা মোক্ষম চাল চালেন যাতে প্রতিপক্ষ ফাঁদে পড়ে, সেরকমই ডক্টর সেরগেইও জানেন স্নায়ুর যুদ্ধে জয় লাভ করার জন্যে শত্রুর সামনে অনেক সময় নিজেকে ছোট করতে হয়, এতে প্রতিদ্বন্দ্বীর মনে একটা অহংকার ফুটে ওঠে এবং সে নিজেকে মহান প্রমাণ করতে নিজেকে মেলে ধরে নিজেরই শত্রুর সামনে, সামরিক মনোবিজ্ঞানের বই এর এই সূত্রগুলি খুব ভালোভাবেই জানেন অভিজ্ঞ সারগেই!

সেই ভেবেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন উলটো দিকে বসে থাকা আজ থেকে চার মাস আগে ধরা পড়ে যাওয়া জার্মান গুপ্তচরটির দিকে।

জার্মান বন্দিটিও তাকিয়ে আছে ওনার দিকে।

দুজনের মাঝের নীরবতা আর শীতলতা একটু কমার আশায় অপেক্ষা করতে লাগলেন সেরগেই।

হাতের সিগারেটটা শেষ করে পাশের ছাইদানে সিগারেটটা পিষতে পিষতে বলে উঠল জার্মান যুবকটি, “রুশদের মত নিম্ন জাতির মধ্যে এরকম নীতিবোধ আছে বলে তো জানতাম না, আছে জেনে অবাক হচ্ছি!”

অপলকে চেয়ে রইলেন ডক্টর সেরগেই, বন্দির এই শীতলতা তাঁকে অবাক করে না, তবে মনে প্রশ্ন জাগাচ্ছে অনেক। এই যুদ্ধের সময় সারা ইউরোপ ঘুরে বহু সেনা আর গুপ্তচরের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। তবে আজকের বন্দি যেন আলাদা। গলার স্বর স্বাভাবিক রেখেই জিগ্যেস করলেন, “তাহলে আপনি কি বলতে চাইছেন…”

বন্দির নামটা দেখার জন্যে ফাইলের দিকে একবার তাকালেন সেরগেই, উত্তর এল উলটো দিক থেকেই, “ফাইলে নাম পাবেন ‘স্যাকাল’ হিসেবে, ওটা আমার নাম নয় যদিও, আমার নাম লুকাস উলফগ্যাং ভন গথ।”

তারপর থেমে বলে উঠল, “আপনি “স্যাকাল” কথার মানে জানেন ডক্টর?”

মাথা সামনে ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানালেন সেরগেই, “আপনাদের ভাষায় এর অর্থ ‘শিয়াল’, এই নাম নিশ্চয়ই আপনার দক্ষতা দেখেই রাখা হয়েছে তাই নয় কি?”

কথাটা বলেই একবার বন্দির দিকে এক ঝলক দেখলেন সেরগেই।

না, শরীরী ভাষায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তন চোখে পড়ল না ওনার, শত্রুর মুখে নিজের প্রচ্ছন্ন প্রশংসা শুনলে অনেকের মধ্যে যে শরীরী ভাষার সূক্ষ্ম বদল হয়, এই বন্দির মধ্যে সেটার কোনো লক্ষণই নেই এখনও অব্দি!

এই না হলে গুপ্তচর! সামনে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও শীতল, স্বাভাবিক!

টেবিলের ওপাশ থেকে ভেসে এলো কণ্ঠস্বর, “আপনি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না ডক্টর, আপনি কি কখনও মৌচাকে ঢিল মেরেছেন?”

প্রশ্নটার পেছনে যে একটা গভীর কারণ আছে সেটা বুঝলেন সেরগেই, তাই অপরপক্ষকেই সুযোগ করে দিতে বললেন, “না, ছোটবেলায় হয়তো মেরে থাকতে পারি, মনে নেই। তবে বড় হয়ে মেরেছি বলে তো মনে হয় না, আপনি বলতে থাকুন লুকাস।”

“আমি বললেই কি আপনি শুনবেন ডক্টর?”

“আপনার কথা শোনার জন্যেই তো আমাকে ডেকে আনা হয়েছে স্তালিনগ্রাড থেকে।”

“গত চার মাস ধরে এই মূর্খগুলি শুধুই হেসেছে আমার কথা শুনে।”

“আমি হাসব না কথা দিচ্ছি, আপনি একদম শুরু থেকে বলতে থাকুন, কিছুই বাদ দেবেন না।”

এই বলে আরও একটা সিগারেট এগিয়ে দিলেন টেবিলের উলটো দিকের মানুষটার দিকে সেরগেই।

লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে বলতে শুরু করল যুদ্ধবন্দিটি, “আজও দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয় ওই সন্ধ্যেটা, কি দেখেছিলাম সেদিন আমরা জানি না ডক্টর!”

উলটোদিকে বসা রুশ মনোবিদের দিকে একবার তাকালেন লুকাস উলফগ্যাং ভন গথ, তিনি নিজেও অভিজ্ঞ গুপ্তচর, শত্রুপক্ষের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শরীরী ভাষার পরিবর্তন দেখেই আঁচ করতে পারেন অনেক কিছু।

না, ডক্টর শুনতে চান মন দিয়েই।

মনে মনে এই ভেবে আশ্বস্ত হয়ে আবার বলা শুরু করল—

“আমাদের দল এস্তনিয়ায় আসে গত বছর, প্ল্যান ছিল লেভেনস্রাউমের উদ্দেশ্য সাধন করা কিন্তু গোপনে।”

তারপর খানিক বিরতি। সিগারেটটায় একটা লম্বা টান দিয়ে আবার বলতে শুরু করল—

“সেই পরিকল্পনামাফিক বিভিন্ন শহরে গুপ্তচরদের আড্ডা বানানো শুরু হয়, বোকা রুশ আর অত্যাধিক আত্মবিশ্বাসী ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দেওয়াটা কোনো ব্যাপারই ছিল না আমাদের কাছে।”

“তারপর?”

“নাৎসি আস্তানা বানানোর জন্য বেছে নেওয়া হল কিছু বিশেষ জায়গা, শহরের মাঝে, জঙ্গলে, জলার মাঝে আর পাহাড়ের উপর, এমন জায়গা যেন সাধারণ মানুষ দেখলেও বুঝতে না পারে।”

সেরগেই এক মনে শুনছিলেন ওর কথা, যদিও এইসব বাল্টিক দেশগুলিতে জার্মানরা কীভাবে কাজ করে তিনি খুব ভালো মতোই জানেন, সে যতই শান্তি চুক্তি সই হোক না কেন, গোপনে দু’পক্ষের কেউই এই দেশগুলির থেকে নজর সরায়নি, বাইরে থেকে দেখলে হয়তো বোঝা যাবে না কিন্তু এনকেভিডি’র তথ্যই বলছে শুধু তালিন আর সংলগ্ন শহর গুলিতেই জার্মান চর আছে প্রায় পঞ্চাশ জন!

ওনার সামনেই বসে আছে তাঁদেরই একজন উচ্চপদস্থ জার্মান অফিসার, যার কথাবার্তা ওর ধরা পড়ার গল্পের মতই রহস্যময়।

মন দিয়ে শুনতে লাগলেন সেরগেই, পাখার এক ঘেয়ে ঘ্যারঘ্যার আওয়াজটা হয়েই চলেছে এই ছোট্ট ঘরটায়!

“বেশ কয়েকটা সেফ হাউস আমরা বানিয়ে ফেলে কাজ চালাতে লাগলাম সব্বার চোখে ধুলো দিয়েই, আজ থেকে ছয় মাস আগে বার্লিন থেকে নতুন আদেশ আসে… মাটির নীচে বাঙ্কার বানাতে হবে… এবারের জায়গা হবে এই দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জলাগুলি…”

একটু থামল লুকাস।

“বলতে থাকুন… কথা দিচ্ছি সব শুনবো...” শান্ত কণ্ঠে আশ্বাস দিলেন সারগেই।

“প্ল্যান ছিল সমস্ত বাঙ্কার বানানো হয়ে গেলে সেগুলোকে যুক্ত করে একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করা হবে… একদম একটা পুরো শহর হবে মাটির নীচেই!”

আবারও একটু থামলেন লুকাস উলফগ্যাং ভন গথ, সিগারেটের ছাইটা ছাইদানে ঝাড়লেন, এক ঝলক ঘরটাতে নজর বুলিয়ে আবার বলা শুরু করলেন, “ততদিনে প্রচুর নাৎসি সেনা, ইঞ্জিনিয়ার আর গুপ্তচর এসে জড়ো হয়েছে এই এস্টনিয়ার বিভিন্ন গোপন ঘাঁটিতে, তাদের নিয়েই শুরু হল মাটির নীচের বাঙ্কার তৈরির কাজ…”

হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা আর্তনাদ ভেসে এল, লুকাস কান খাড়া করে শুনলেন, এই ধরনের আওয়াজ তাঁর চেনা, রোজ রাতেই হয়, কখনও কখনও সারাদিনও শোনা যায় একটানা, এই জেলেরই অন্য কোনো প্রান্ত থেকে হয়তো ভেসে আসছে এই আওয়াজ। লোকের চোখে এটা সামান্য জেল হলেও গোপনে এটা যে এনকেভিডি’র বাল্টিক হেড কোয়ার্টার সেই রিপোর্ট উনিই দিয়েছিলেন বার্লিনকে!

হয়তো তাঁরই কোনো জার্মান ভাইয়ের নখ উপড়ে ফেলছে বা উলটো ঝুলিয়ে নীচে কয়লার আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে বা সাঁড়াশি দিয়ে দাঁত টেনে তুলছে এই নোংরা কমিউনিস্টগুলো, তাঁর সঙ্গেই তো এই জেলে এসেছিল আরও ছয় জন, হয়তো তাদেরই কেউ, এই শীতের রাতের ঘন হয়ে আসা বাতাসে ভেসে এসে সেই আওয়াজই ধাক্কা মারছে এখন তাঁর কানে!

বুঝলেন আওয়াজটা উলটোদিকে বসে থাকা ডাক্তারের কানেও গেছে, উনি যেন একটু নড়ে বসলেন, শত্রুর সামনে রুশ ভদ্রতার মুখোশ খুলে যাচ্ছে, এটা মোটেও ভালো কথা নয়।

নজর এড়াতে পিছনের দেওয়ালে টানানো ঘড়িটার দিকে একবার তাকালেন লুকাস, আবার বলতে শুরু করলেন—

“শহরের থেকে আমাদের নজর পড়ল জলাগুলোর দিকে… নিরাপদ বাঙ্কার বানানোর জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত… আমার দায়িত্বে পড়ল দক্ষিণ-পশ্চিমের পুলি গ্রামের কাছের জলা পরিদর্শন আর তথ্য সংগ্রহ করা… দেখলাম কিছু রুশ সেনার ফেলে যাওয়া ঘাঁটি আছে…”

এই বলে আবারও একটু থামলেন লুকাস, শরীরের কোথাও যেন অস্বস্তি হচ্ছে খুব, পিঠটা একটু সোজা করে বসতে গিয়ে দেখল কে জানি কফি দিয়ে গেছে, কখন দিয়েছে খেয়াল করেননি, এক চুমুক নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, “জায়গাটা শ্যাওলা ঘেরা একটা আজব স্যতসেতে জলাভূমি… ভেবে দেখলাম এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না বাঙ্কার বানানোর জন্যে… কাজে লেগে পড়লাম…”

একটা ঝড় মনে হয় উঠেছে উপকূলে, একটা ঠান্ডা বাতাস যেন বারবার এসে ধাক্কা মারছে ঘরটার খুপরি জানলাটায়, এই ঘরে এর আগেও এসেছেন লুকাস পুরো ঘরটায় বাইরের হাওয়া আসার ওইটাই একমাত্র রাস্তা!

***

“আমরা খোঁড়ার কাজ শুরু করে দিলাম… প্রায় দু সপ্তাহ কাজ করার পর… জলার নীচেই বানিয়ে ফেললাম মোটামুটি একটা থাকার জায়গা… প্রাথমিক ভাবে কুড়ি জন অনায়াসেই লুকিয়ে থাকতে পারে অস্থায়ীভাবে সেখানে… তবে কাজ আরও বাকি ছিল আমাদের… সেরকমই একটা দিন বাধল গোলমালটা… এরকমই ঝড় জলের দিন ছিল গত বর্ষার…”

এই প্রথমবার কথার মাঝেই থামালেন সেরগেই। প্রায় চারটে সিগারেট পুড়িয়েছেন এতক্ষনে, হাতে কফির কাপটা তুলে নিয়ে জিগ্যেস করলেন, “কীসের গোলমাল?”

কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, “বেশ কাজ চলছিল জানেন তো… সন্ধ্যের দিকে… দেখলাম স্কুলজ ছুটে আসছে… জানতে চাইলাম কী হয়েছে… তারপরের কথা নিশ্চয়ই আপনারা আমার ডায়েরিতে পড়েইছেন…”

শেষের কথাটা সেরগেইকেই উদ্দেশ্য করে বলল লুকাস।

পাশের দেরাজ থেকে একটা মোটা চামড়ায় বাঁধানো ডায়েরি বের করে টেবিলের উপরে রাখলেন সেরগেই, “আপনি নিশ্চয়ই এটার কথাই বলছেন?”

একটু সামনে ঝুঁকে এসে ডায়েরিটা দেখে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল লুকাস।

ডায়েরিটা খুলে পড়তে লাগলেন সেরগেই, তাতে লেখা আছে—

“আজ আমাদের কী হয়েছে জানি না, দুপুর থেকে কাজ তেমন এগোয়নি বৃষ্টির জন্যেভাবলাম বিকেল আর সন্ধ্যে মিলিয়ে কিছুটা এগিয়ে রাখব কাজসন্ধ্যের দিকে স্কুলজের ডাকে নামলাম বাঙ্কারে…”

“এরপর আর তো কিছু লেখেননি আপনি, যতবারই জানতে চাওয়া হয়েছে কোনো উত্তর দেননি ঠিক ভাবে, কী হয়েছিল সেদিন? আজ বলবেন কি?”

কাপে রাখা কফির শেষটুকু চুমুক দিয়ে শেষ করে বলতে লাগল, “আমরা মৌচাকে ঢিল মেরেছিলাম ডক্টর… যে কথা আপনাকে আজ এসেই জিগ্যেস করেছিলাম… আমরাই ভুল করে সেই কাজটাই করে ফেলেছিলাম সেদিন… তবে এই জিনিস আরও ভয়ানক… আজও বিশ্বাস হয় না সেদিন আমরা কী দেখেছিলাম…”

সেরগেই বুঝলেন এবার কিছু নতুন শুনবেন, সেই আশায় আরও একটু গুছিয়ে নিলেন নিজেকে চেয়ারটাতে।

***

ঘরটায় হাওয়া আসার একটা মাত্রই খুপরি জানলাটা দিয়েই হাওয়া আসছে এখন, শীতল হাওয়া, জানলাত ফাঁক দিয়ে আসছে হাওয়াটা, বাইরে মনে হয় একটা ঝড় উঠেছে!

বলতে শুরু করল লুকাস—

“একটা অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসতে লাগলো বাঙ্কারের বাইরে থেকেই… যেন মাটির কোন গভীর থেকে আসছে শব্দটা… কোনো মানুষ এরকম শব্দ করতে পারে না জানেন তো ডক্টর… কেউ বা কোনো কিছু যেন সদ্য খোঁড়া বাঙ্কারের জল কাদা ভেঙে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে… তবে অনেক গভীর থেকে আসছিল শব্দটা… চাপা কিন্তু স্পষ্ট… শব্দ একটা হচ্ছে ঠিকই… না কোনো জলার ব্যঙ বা পোকামাকড়ের শব্দ ছিল না ওটা ডক্টর… একটা অদ্ভুত শব্দ… মনে হচ্ছে যেন একটা ভারী জিনিস হেঁটে বেড়াচ্ছে মাটির অনেক গভীরে… একটা চাপা শব্দ… কিন্তু পরিষ্কার কানে আসছে আমাদের সবার!”

সেরগেই খেয়াল করলেন বক্তার কণ্ঠস্বরের ওঠানামাটা খুব খাঁটি। মিথ্যেকে জোর গলায় বা কাঁধ সামনে ঝুঁকিয়ে সত্যি করার চেষ্টা করছে না এই জার্মান যুবকটি। তিনি কিছুই বললেন না, কিন্তু খেয়াল করতে লাগলেন বক্তা টেবিলে অন্যমনস্ক ভাবে দু হাত জড়ো করে আঙ্গুল ঘষছে। ইঙ্গিত খুব পরিষ্কারবক্তার নিজের মনেও সন্দেহ আছে ওর কথা হয়তো শ্রোতা মন দিয়ে শুনছে নাতাই একটু নার্ভাসও কি?... নাকি ঘটনাটাই?...

ওঁর চিন্তায় ছেদ পড়ল, উলটোদিকে বসে থাকা যুবক আবার বলতে শুরু করেছে—

“আমরা দলে ছিলাম ষোল জন, সকলেই দক্ষ সাহসী যোদ্ধা, আমি নিজে গুপ্তচরের কাজ করলেও আগে আমি নিজেও সেনাদলেই ছিলাম রাইফেল-ম্যান হিসেবে… তবে এখানকার স্কোয়াড লিডার ছিল স্কুলজ… ছিল বলছি কারণ সেদিনের পর থেকে কোনো খোঁজ আমরা পাইনি ওর… আপনাকে কি বোর করছি ডক্টর?”

শেষের প্রশ্নটা করে আবার একটু থামল লুকাস।

ডক্টর সেরগেই ঘাড় নেড়ে ওকে বলতে বললেন।

“বাঙ্কারে নামার আগে গোলা-গুলি একবার দেখে নিলাম… জানি না কী আছে মাটির নীচে… সতর্ক থাকতে দোষ কি?... হতেই পারে আমাদের নজর এড়িয়ে আপানদের কিছু রুশ সেনা হয়তো ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছে মাটির তলায়… একে একে নেমে এলাম আমরা জনা দশেক… বাইরে পাহারায় রাখলাম বাকিদের… মাটির নীচে আওয়াজটা যেন আরও তীব্র… আরো স্পষ্ট… খুব বুঝলাম বাঙ্কারের শেষে যে সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কাজ আমরা সবে চালু করেছিলাম ওখান থেকেই আসছে শব্দটা… ডায়মন ফ্ল্যাশলাইট৭.১ নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম আমরা কয়েকজন… স্কুলজের আর আমার হাতে ছিল একটা করে এমপি৪০ সাব মেসিনগান৭.২… বাকি সাত জনের সবার হাতে কারবাইনার ৯৮৭.৩ আর রোমেলের হাতে একটা ফ্লেমেনওয়েরফার ৩৫৭.৪ আর মিউলারের হাতে একটা পেঞ্জারফাউস্ট৭.৫… সুড়ঙ্গের শেষে যেই লুকিয়ে থাকুক… বাঁচা খুব মুস্কিল…”

একসঙ্গে অনেকটা কথা বলে একটু যেন হাঁপিয়ে উঠল লুকাস, একটু থামল, হাত ঘষে নিলে বেশ কয়েকবার।

খুপচি জানলাটা দিয়ে ঠান্ডা বাতাসটা যেন সূচ ফোটাচ্ছে দুজনের গায়েই, নেহাত কথায় বাধা পড়ে তাই সেরগেই নিজে আগ বাড়িয়ে থামাননি ওকে!

টেবিলে রাখা ঘণ্টিটা বাজালেন দু’বার, দরজা খুলে টেবিলের কাছে এসে সামরিক অভিবাধন জানাল একজন রুশ সেনা।

“ডাকছিলেন কমরেড?”

“একটু ব্রাণ্ডির ব্যবস্থা করতে পারবেন কমরেড?”

“নিশ্চয়ই।”

রুশ সেনাটি বিদায় নিল, সেরগেই আরও একটা সিগারেট নিজে ধরিয়ে এগিয়ে দিলেন লুকাসের দিকে, লুকাস বলে চলল—

“আলো নিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা সুড়ঙ্গর শেষের দিকে… পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সদ্য বানানো বাঙ্কারের পুরোটা… নিচের দিকটা জল কাদায় ভরে রয়েছে… আমাদের ভারী বুটের চাপে একটা ছপ ছপ শব্দ হচ্ছে ফাঁকা বাঙ্কারটায়… কিন্তু সেসব ছাপিয়েও সেই আগের শব্দটা আরও আরও যেন কাছে চলে আসতে লাগলো প্রতি মুহূর্তে… কাছে খুব কাছে হচ্ছে যেন আওয়াজটা… একটা কিছু চলে ফিরে বেড়াচ্ছে বাঙ্কারটায়… একটা ভারী কিছু… কিন্তু চোখে পড়ছে না… অদৃশ্য জিনিসটা যেন প্রতি প্রতি মুহূর্তে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকেই… বেশ বুঝতে পারলাম আমরা… সঙ্গে যোগ হয়েছে একটা ঠান্ডা বাতাস… যদিও সেটা তেমন নতুন কিছু নয় এইসব জলা জায়গায়… তবুও মনে হচ্ছিল কেউ যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে নতুন খোঁড়া বাঙ্কারটার ভিতরে… শীতল হাওয়াটা বারবার এসে আঘাত করতে লাগলো আমাদের শরীরে…”

ঘরের দরজায় দু’বার টোকা পড়ল।

“আসুন কমরেড,” বললেন সেরগেই। যদিও একটু বিরক্তই হলেন, এভাবে কাউন্সেলিং এর সময় বাধা একদম ভালো লাগে না ওঁর।

টেবিলে একটা ব্রাণ্ডির বোতল আর দুটো গ্লাস রাখল রুশ সেনাটা, যাওয়ার সময় একবার আড়চোখে ঘৃণাভরে দেখল লুকাসকে, তারপর সেরগেই এর দিকে ফিরল, ইশারাটা বুঝলেন ডক্টর—

একটা নোংরা নাৎসি কুকুরের সঙ্গে এত সময় কাটানোর কি দরকার ডক্টর?

সেরগেই ইশারা করে ওকে যেতে বললেন।

কোনোকিছুর তোয়াক্কা না করেই টেবিল থেকে বোতলটা তুলে নিয়ে গ্লাসে ঢালতে লাগল লুকাস, সেরগেইকে অফার না করেই নিজেই ঢক ঢক করে খেয়ে নিলেন অনেকটা সেই ঝাঁজালো তরল।

বন্দির মধ্যে কি মানসিক অসুস্থতা ফুটে উঠছে? আচরণের তারতম্য ঘটছে যেন খুব দ্রুত, আগের সেই শীতলতা বা অহংকার একটু যেন টাল খেয়েছে?

মনে মনে ভাবলেন সেরগেই, চুপচাপ লক্ষ্য করছিলেন বেশ কিছুক্ষণ ধরেই, বাধা দেন নি, উনি পুরোটা নিজের চোখে দেখতে চান, শুনতে চান।

পরপর দু গ্লাস ব্রাণ্ডি গলায় ঢেলে একটু যেন শান্ত হল লুকাস, আবার বলতে লাগলো—

“…হ্যাঁ কী যেন বলছিলাম? ...হুম মনে পড়েছে… সুড়ঙ্গের একদম শেষের দিকে চলে এসেছিলাম আমরা… আচ্ছা ডক্টর আপনি কখনও শয়তানকে দেখেছেন নিজের চোখে?”

সেরগেই বলতে যাচ্ছিলেন, “সেরকম একজন এই কিছুদিন আগেই ইউরোপে ক্ষমতায় এসেছে সশরীরে… একটা বদ্ধ উন্মাদ… সাক্ষাৎ শয়তান!”

মুখে শুধু বললেন, “না, দেখিনি, আপনি দেখেছিলেন সেদিন?”

“হুম ডক্টর… তবে শুধু আমি নই… আমরা সবাই দেখেছিলাম… স্কুলজের টর্চটা হঠাৎ করে পড়ল সুড়ঙ্গের শেষের দিকটায়...আলোয় কিছু একটা যেন ঝলসে উঠল… বুঝলাম ওগুলি চোখ… দু’টো নয়… এক সঙ্গে অনেক অনেকগুলো চোখ প্রাণীটার সারা শরীর জুড়ে… যেন গিলে খেতে আসছে আমাদের… উফফ কী ভয়ানক… আজও মনে পড়লে শিউরে উঠি… একটা জন্তু… রোমেল চালিয়ে দিল ফ্লেমেনওয়েরফারটা… সেই আলোতেই দেখলাম প্রথমবার… প্রাণীটা এই জগতের ছিল না ডক্টর বিশ্বাস করুন! একটা অদ্ভুত মাংসপিণ্ডের মত যেন… চারদিক দিয়ে বেরিয়ে আছে কয়েকটা পা… অনেকটা ঠিক মাকড়শার মতো… আর সেই চোখগুলো… উফফ কী সাঙ্ঘাতিক ডক্টর… কী সাঙ্ঘাতিক… ফ্লেমেনওয়েরফার তাপেই হোক বা আলোতে বুনো শুয়োরের আকারের প্রাণীটা যেন দৌড়ে পালালো… একটা গগনভেদী আর্তনাদ করে… একটা তীক্ষ্ণ বাঁশির মতো সেই চিৎকার…”

সেরগেই দেখলেন লুকাসের হাত কাঁপছে এবং সেটা খুব খাঁটি মনে হল ওঁর চোখে।

লুকাস বলে চলল—

“আমাদের জেদ চেপে গেল ডক্টর… সবচেয়ে বেশী হল কৌতূহল… জানি না প্রাণীটা কী ছিল… হয়তো সুড়ঙ্গের আলো আঁধারিতে কোনো বুনো শুয়োরই দেখেছিলাম আমরা… পিছু নিলাম… যাই হোক হাতে যখন অস্ত্র আছে ভয় নেই… প্রাণীটা যেন জল কাদা পেরিয়ে যেতে লাগলো দ্রুত… আমরাও শব্দটার পিছু নিলাম… এরপরের কথাগুলি কি আপনি বিশ্বাস করবেন ডক্টর?”

সেরগেই এর দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে একটু থামল লুকাস।

সেরগেই এক চুমুক ব্রাণ্ডি মুখে দিয়ে বললেন, “আপনি বলুন লুকাস, আমি শুনছি।”

“শব্দটার পিছু নিয়ে নিয়ে এসে পৌঁছলাম একটা জায়গায়… বড় অদ্ভুত জায়গাটা… দেখলাম চারিদিকে অসংখ্য সুড়ঙ্গের মুখ খুলে গেছে… অসংখ্য… বিশ্বাস করুন ডক্টর… সেগুলি আমাদের খোঁড়া নয়… অতি কষ্টে আমরা একটা মুখ খুঁড়তে পেরেছিলাম… কিন্তু ওই জায়গাটায় এসে দেখলাম বহু বহু সংখ্যায় কেউ বা কারা যেন সুড়ঙ্গ খুঁড়ে রেখেছে… জেদ চেপে গেল ডক্টর… একটা জেদ… এর শেষ দেখে ছাড়বো… প্রতি দলে দু-তিন করে ভাগ হয়ে গেলাম… ঠিক করলাম ঘড়ি দেখে ঠিক পনেরো মিনিট পর এখানেই দেখা করব… আমার সঙ্গে নিলাম মিউলার আর জিমারম্যানকে… একটা জিনিস খেয়াল করলাম সুড়ঙ্গের ওই অংশটাকে যেন একটা ভয়ানক শীতলতা ঘিরে ধরেছে… আর একটা একটানা সেই আওয়াজটা… জল কাদা পেরিয়ে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে প্রাণীটা এখনও… গতি কমে এসেছে… কিন্তু চলছে ওটা… একটা সুড়ঙ্গ মুখে প্রবেশ করলাম… আওয়াজটা যেন দ্রুত গতিতে আমাদের থেকে দূরে সরে যেতে লাগল… বুঝলাম প্রাণীটা ভীতু… আমাদের ভয়ে পালাচ্ছে… আমরাও ছুটলাম তিনজন… টর্চের আলোয় সুড়ঙ্গের দেওয়ালটা ভেসে উঠতে লাগলো চোখের সামনে… জল কাদা গলে গলে পড়ে এক অদ্ভুত নক্সা তৈরি হয়েছে যেন দেওয়ালে… কেউ যেন কিছু লিখে রেখে গেছে… আর একটানা জল কাদায় ছপছপ শব্দ… কানে এলো সামনের সেই আওয়াজটা… যেন ঝিমিয়ে এসেছে… পা টিপে টিপে চলতে লাগলাম… ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় আরও একবার স্পষ্ট দেখলাম… সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় একটু ঝুঁকে থেমে আছে… কানের পাশে একটা ধাতব শব্দ পেলাম… বুঝলাম সঙ্গের কেউ একজন গুলি ভরছে কারবাইনারে… হাত দিয়ে বাধা দিতে গেলাম… কিন্তু না পারলাম না… মিউলার গুলি ছুড়ল মাত্র কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণীটার দিকে… একটা কানফাটা শব্দে সুড়ঙ্গটা কেঁপে উঠল… কিন্তু প্রাণীটা? ...না, নেই, আবার সেই শব্দটা কানে এলো... জল কাদা পেরিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে জন্তুটা… আবার আমরা পিছু নিলাম ডক্টর… আবার… আবার!”

একটু থামল লুকাস। সেরগেই খেয়াল করলেন বন্দির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।

“জানলাটা একটু বন্ধ করে দেবেন ডক্টর? খুব শীত করছে আমার।”

সেরগেইকে উদ্দেশ্য করে বলল লুকাস। ডক্টর খেয়াল করলেন কপালে ঘাম জমা হলেও হাত ঘষছে বন্দি। এ যেন এক অদ্ভুত মানসিক অস্থিরতা, মনের ভেতরের চেপে রাখা আতঙ্ক বাইরে আসতে চাইছে বন্দির, অতি কষ্টে নিজের ইস্পাত কঠিন জার্মান মানসিকতা দিয়ে সেটা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও বাঁধ ভাঙছে আস্তে আস্তে।

নিজেই উঠে গিয়ে খুপরি জানলাটা বন্ধ করে দিতে গেলেন ডক্টর সেরগেই, তবে আজকের ঝড়টা যেন একটু অন্যরকম, জানলার কাছে আসতেই হাড় অব্দি কেঁপে গেল ডক্টর সেরগেইএর। ঘরে একটা ফ্যান চলছে যদিও কারণ এই ঘরটা এই দুর্গের মত জেলটার এতটাই কোনার দিকে যে কোনো হাওয়াই চলাচল করে না এখানে, তাই শীতকালেও পাখাটা চালিয়ে রাখতে হয়।

সত্যি এই শীতের রাতে এরকম ঝড় জলের কী দরকার? ফেরার সময় ভাবলেন সেরগেই।

হলদে হয়ে আসা আলোটায় বন্দির মুখটা আবছা চোখে পড়ল সেরগেই-এর, কোটরগত চোখ, শুকিয়ে যাওয়া গাল, উসকো খুসকো চুল!

আচ্ছা লোকটা কি সত্যিই পাগল নাকি ওদের ধোঁকা দিতে একটা আজগুবি গল্প সাজাচ্ছে? চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে ভাবলেন সেরগেই।

“আপনি বলুন, আমি শুনছি।”

“ধন্যবাদ ডক্টর, আমরা আবার পিছু নিলাম… আবার… এর শেষ দেখেই ছাড়বো ঠিক করলাম আমরা… ছুটে চললাম তিনজন… হঠাৎ একটা শব্দ কানে এলো আমাদের… থেমে গেলাম…”

“কীসের শব্দ?”

“গুলির শব্দ ডক্টর গুলির… কেউ একটা কাছেই এমপি৪০টা থেকে গুলি ছুঁড়ছে… অনেক রাউন্ড গুলি চলল… সুড়ঙ্গের প্রতিটা দিক থেকে আওয়াজটা আসতে লাগলো ডক্টর… ঠিক ধরা গেল না… তারপর একটা কান ফাটা আর্তনাদ… কেউ যেন চিৎকার করে উঠল… শব্দটা যেন দূর থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো… কাউকে যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ… মৃত্যু যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে করতে বাঁচতে চাইছে সে… আবার অন্ধের মত দৌড়াতে লাগলাম তিনজন… জল কাদা পেরিয়ে… তারপর… তারপর…”

আবার থামল লুকাস, সেরগেই খেয়াল করলেন লুকাসের হাত ঘেমে উঠেছে, চোখ লাল হয়ে এসেছে, কাঁধ ঝুকে পড়েছে অনেকটা।

“আপনি আস্তে আস্তে বলুন লুকাস।”

একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল, তারপর বলা শুরু করল হাত দুটো ঘষে নিয়ে!

এখনও কি ঠান্ডা লাগছে ওর? ভাবলেন সেরগেই।

লুকাস বলে চলল—

“একটা মুখ থেকে আরেকটা সুড়ঙ্গ মুখের সামনে এসে পড়লাম আমরা… সামনে দেখলাম আরও দুটো সুড়ঙ্গমুখ… জানি না এগুলি কারা খুঁড়ে রেখেছে… তাও ঢুকে পড়লাম মিলারকে নিয়ে… জিমারম্যনকে বাইরে রাখলাম… সেই ছুটে চলার শব্দটা আবার কানে আসছে… প্রাণীটা সামনেই আছে… তখনও দূর থেকে কানে আসছে সেই মৃত্যু চীৎকার… ক্ষীণ তবুও স্পষ্ট… প্রাণীটা আমাদের আসার খবর পেয়েছে যেন… আবার ছুটছে… আমারাও পিছু নিলাম… কিছু বুঝে ওঠার আগেই এসে পৌঁছালাম আরও একটা সুড়ঙ্গ মুখের কাছে… বুঝলাম আমরা এক অসীম গোলকধাঁধার মধ্যে দিয়ে ফেঁসে আছি… পালানোর পথ নেই আর… হাঁপিয়ে গিয়ে সুড়ঙ্গের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসে পড়লাম… আমাদের সামনে তখন চারটে সুড়ঙ্গপথ… জানি না কোথায় এর শেষ...একটা শব্দ কানে এলো...পায়ে চলার নয়… কোনো কিছু কাদার মধ্যে দিয়ে বুক ঘষে ঘষে চলছে যেন… একটা চাপা গোঙানি কানে এলো… উঠে দাঁড়িয়ে ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালালাম আবার… জানি নিস্তার নেই… তবুও… দেখলাম একটা শরীর পড়ে আছে… কাদায় জলে চেনার উপায় নেই… বুকে ঘষে ঘষে এগিয়ে যাচ্ছে… ছুটে গেলাম ওর কাছে… দেখলাম… দেখলাম… আমাদের রাইফেল ম্যান ওয়েবার…”

গলা শুকিয়ে আসছে বুঝতে পারলেন সেরগেই, জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন, একসঙ্গে অনেকটা জল খেয়ে আবার বলতে লাগল লুকাস—

“কেউ যেন ওকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে… বেচারা সুযোগই পায়নি কিছু করার… একটা পা কেউ যেন হাঁটুর নীচ থেকে টেনে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে… শরীরটা কোলের কাছে নিলাম আমি আর মিলার… কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল… হঠাৎ চোখে মুখে কেমন যেন একটা আতঙ্ক ফুটে উঠল… কিছু বলতে গিয়েও আমাদের চুপ করতে ইশারা করল… কান পেতে শুনতে শুনতে লাগলাম… আসছে কিছু একটা… খুব আস্তে আস্তে… তবে শব্দগুলি জোরালো হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে… কিন্তু খেয়াল করলাম শব্দ একটা নয়… প্রতিটা সুড়ঙ্গমুখ থেকে এগিয়ে আসছে শব্দগুলো… জল কাদায় ছপছপ শব্দটা যেন আমাদের সম্মোহিত করে দিয়েছিল… আমাদের পা’গুলো কেউ যেন আটকে ধরে রেখেছিল… প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে শব্দটা… ছপ ছপ… ছপ ছপ… এগিয়ে আসছে… এক না একাধিক… সেই যেমন মৌমাছির চাকে পাথর ছুঁড়লে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি ধেয়ে আসে… আসছে… ওই পশুগুলো আসছে… হাতে এমপি৪০টা তুলে নিলাম… একটা চেষ্টা... একটা শেষ চেষ্টা করতেই হবে… একটা প্রাণী বেরিয়ে এলো সেই গোলকধাঁধার সামনের একটা সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে… সারা শরীরের শত শত চোখ দিয়ে যেন গিলে থেকে চাইছে আমাদের… ফ্ল্যাশলাইটটার আলো ফেলতেই দেখলাম মৃত্যুর সবজে রং যেন ছড়িয়ে পড়ছে প্রাণীটার শরীর থেকে… শব্দগুলো আসছে এখন পেছন থেকে… ছপ ছপ… ছপ ছপ… শব্দগুলো আসছে… বুঝতে পারছি হায়েনার মত চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে আমাদের এই প্রাণীগুলো… একটা চাপা গর্জন কানে আসছে… নরকের ওই প্রাণীগুলির থেকেই যেন আসছে সেই ডাক… কাউকে যেন ডাকছে ওরা… বা শিকারের আনন্দে হাসছে হয়তো… একসঙ্গে গর্জে উঠল আমার আর মিলারের বন্দুক… প্রতি ঝলকানিতে দেখলাম… ধেয়ে আসছে প্রাণীগুলো… পচা মাংস খসে পড়ে হাড় বেরিয়ে গেছে প্রাণীগুলির পা থেকে… তবুও ধেয়ে আসছে… কোনো তাড়াহুড়ো নেই… মাঝে মাঝে চোখগুলো ঝলসে উঠছে গুলির আলোতে… ঠান্ডা হাওয়ার ধাক্কা এসে লাগতে লাগলো আমাদের শরীরটায়… নরকের পশুগুলোর মৃত্যু শীতল নিঃশ্বাস ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের শরীর… বারবার… বারবার… প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে শব্দগুলো… জল কাদা ভেঙ্গে এগিয়ে আসার শব্দ… ছপ ছপ… ছপ ছপ”

সেরগেই দেখলেন লুকাস মাথা নিচু করে ফেলেছে, দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছে নিজেকে।

এখনও কি শীত করছে ওর? মনে মনে ভাবেন সেরগেই।

“পাখাটা বন্ধ করে দেবেন ডক্টর?”

টেবিল থেকে মাথা তুলে বলে ওঠে লুকাস, মুখটা কাগজের মত সাদা, চোখের রং অদ্ভুত রকমের লাল, ওকে চমকে দিয়ে বলে উঠল লুকাস আবার—

“আমায় পাগল ভাবছেন তাই না ডক্টর? ...কিন্তু আমার আজকাল খুব ঠান্ডা লাগে… খুব… এই জেলখানার ঘরগুলি যেন গিলে খেতে আসে আমায়… আপনারা এত ঠান্ডায় থাকেন কি করে ডক্ট… র?”

স্পষ্ট কানে এলো লুকাসের গলার অদ্ভুত পরিবর্তন, গলাটা কাঁপছে, লুকাস ঠান্ডায় হাতটা টেবিলের নীচে লুকিয়ে রেখেছিল এতক্ষণ।

ঘরটার মধ্যে একটা চাপা দুর্গন্ধ নাকে এলো সেরগেই-এর, তবে আশ্চর্য হলেন না, এই জেলের অনেক সেলেই বহু জার্মান মরে পচে আছে আজ বহুদিন, পরে একসঙ্গে জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলা হবে ওদের, তাতে সময় আর তেল দুটোই বাঁচে।

“দেখুন তো ডক… টর… সেদিন থেকেই ঠান্ডা লাগলে এরকম হচ্ছে আমার…”

নিজের হাতটা টেবিলের উপর তুলে রাখল লুকাস।

হলদে আলোটায় একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলেন সেরগেই, আলোটার গরমে কিছু একটা যেন নড়ে উঠল হাতের চামড়ার নীচে, চামড়াটা অদ্ভুত রকমের ফ্যাকাসে, যেন কেউ রক্ত চুষে নিয়েছে শরীরের, এতটা ফ্যাকাসে তো ছিল না এতক্ষণ!

কৌতূহলবশত আঙ্গুল দিলেন একবার সেরগেই…

***

নিজের ঘরে বসে ওনার ছোট রেডিও ট্রান্সমিটারটায় কাউন্সেলিং রুমের কথাগুলি শুনছিলেন কমরেড ইগর চেভক্সকি, এ জিনিসটা বড় কাজের ওর।

“ধুস, সেই একঘেয়ে গল্পই শুনিয়ে যাচ্ছে নাৎসি কুকুরটা!”

বিরক্তি ভরে দম দেওয়া গ্রামোফোনটা চালাবেন বলে উঠে দাঁড়ালেন, এরকম ঝড় জলের শীতের রাতে ‘পেশ্নিয়া ও রডিন’ উফফ, এর মজাই আলদা!

মস্কোর সন্ধ্যেগুলি মনে পড়ে গেল ওর, রোজ দিনের শেষে এই গান কানে না গেলে ঘুম আসে না।

হঠাৎ ট্রান্সমিটারটায় একটা একটানা একটা ঘড়ঘড় শব্দ কানে এলো, বিরক্তি ভরে হালকা আওয়াজটা বাড়াতেই স্পষ্ট কানে এলো শব্দটা।

একজনের আর্তনাদ, কেউ যেন মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করছে ঘরটাতে, কিন্তু এই গলার আওয়াজ ওর চেনা, আজ সন্ধ্যেতেই শুনেছেন এই গলা!

পাথরের মেঝেতে কিছু একটা ঠকঠক শব্দ করে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে ওই ঘরটাতে আর… না, আর শোনা গেল না সেই গোঙানিটা… আওয়াজটা কমে আসছে… তারপর সব শান্ত… শুধু ঘরটায় হয়ে চলেছে সেই শব্দটা!

কিছু একটা চলে ফিরে বেড়াচ্ছে ঘরটাতে, ভারী কিছু তবে মানুষ নয় এটুকু বুঝলেন কমরেড ইগর চেভক্সকি!

 

তথ্যসূত্র:

১. হাপসালু বিমানঘাঁটি

২. পুলির জলা

৩. পাতারেই জেলখানা

৪. Schakal: জার্মান শব্দ অর্থ খেঁকশিয়াল

৫. লেভেন্স্রাউম

৬. এন কে ভি ডি

৭.১ ডায়মন ফ্লাশলাইট

৭.২ এম পি ৪০

৭.৩ কারবাইনার ৯৮ কে

৭.৪ ফ্লেমেনওয়েরফার

৭.৫ পেঞ্জারফাউস্ট

৮. পেশ্নিয়ারডিন