নীল পাপড়ি ● রনিন


 

 

খোলা বারান্দা।

ওখানে দাঁড়ালে পাখির চোখের ঔদ্ধত্য পাওয়া যায় না। আতস কাচের ধারালো পর্যবেক্ষণ পাওয়া যায় বরং। ধুলো ধোঁয়া আর ধূসর কদর্যতা। হাভাতে গেরস্থের দীনহীন পাঁচফোড়ন, রাত বিরেতের মত্ত ঝগড়া, প্রতিবেশীর সোমত্ত বৌয়ের সঙ্গে প্রৌঢ়ের চোখাচোখি, কাকভাঙা ভোরে ছেলের পিঠে মায়ের বেলন ভাঙার শব্দ— সব এসে ভিড় করে ওই দুই ফুট বাই চার ফুট ভাসমান জায়গাটাতে। নিজেকে দুঃস্থ দরিদ্রের ঈশ্বর বলে ভ্রম হয়। মনে হয় যেন একরাশ চলমান ছায়াছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছি অনন্তকাল ধরে। হাঁফ ধরে। বিরক্তি জড়ো হয় মনের কোণে। ক্লান্তি ভর করে চোখে। এই বারান্দা আসলে একটা বেড়া। গণ্ডি। সীমানার ওধারে একটা গোটা পৃথিবী। ওই পৃথিবীতে থাকে ‘ওরা’।

আর বারান্দার এধারে, ছোট্ট এক কামরার পলেস্তারা খসা দেয়ালগুলোর মধ্যে থাকি— আমি। একা নয় অবশ্যই। ময়লা জামা কাপড়ে ঢাকা একখানা আলনা আছে আমার। তক্তাপোষের ওপর পাতা বিছানার চাদরখানা কোনো এককালে সাদা ছিল, এখন ‘স্প্যানিশ গ্রে’- সোজা বাংলায় ‘পুঁতিগন্ধময় নোংরা’। আয়নার কাচে মাকড়শার জালের মত ক্ষতের দাগ। ফোন, ট্যাব আর একটা ঢাউস ইজেল আর অনেকগুলো শুকিয়ে যাওয়া রঙের শিশি, টিউব, তুলি। ক্যানভাসে একটা ছবিও আছে। ফুল। আধখেঁচড়া, অর্ধসমাপ্ত। রংটা কবে যেন শুকিয়ে যাওয়া রক্তের মত হয়ে গিয়েছে। এই সবকিছুই আমার। ওহ, আমার নিঃসঙ্গতার কথা তো বলতেই ভুলে গেছিলাম। ওটা যোগ হলেই আমার পরিপূর্ণতা।

তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? বারান্দার ওধারে বাকি দুনিয়া, আর এধারে একলা আমি। উঁহু, হল না। বারান্দার আলসের ওপরে ছোট্ট টবে বসানো ‘ফরগেট-মি-নট’-এর চারাগুলোকে বাদ দিলে চলবে না। আমাদের দুই পৃথিবীর মাঝখানে ওরা জেগে আছে প্রহরীর মত। ওদের কাছ থেকে গোপন সংকেত পাবার অপেক্ষা শুধু তারপরেই একখানা আস্ত ‘মাস্টারপিস’ বানিয়ে ফেলবো এই দমবন্ধ করা ঘরে বসে। অন্তত সেরকমই একটা ধারণা জন্মেছে মনে মনে। কেন জন্মেছে তার উত্তর দিতে পারবো না যদিও।

সবকিছুরই কি আর উত্তর হয় নাকি? এই যেমন ফোন বাজছে এখন। বাজছে না আসলে, একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে। প্রশ্নটা করছেন ‘উত্তরদক্ষিণ’ প্রকাশনীর বিলুদা। “কবে হবে আমার কাজটা?”— এটাই প্রশ্ন। আমি জানি। উত্তর নেই, তাই ফোন তুলছি না। তবু কেন যেন উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে। প্রৌঢ়, হাসিখুশি, দয়ালু মানুষ। সেই সঙ্গে আমার প্রতি সামান্য স্নেহ আর নির্দিষ্ট অনুপাতে মেশানো অনুকম্পা। তাই মাঝে সাঝে ওদের বইয়ের প্রচ্ছদ বানাতে দেন আমাকে। যেগুলোতে তাড়াহুড়ো নেই, একটু অন্যরকমের ছবিটবি যাদের পছন্দ— তাদের বইয়েরই বরাত দেন উনি। এবারেও দিয়েছিলেন। কোনোবার ঝোলাইনি ওনাকে। এবার ঝোলাচ্ছি।

 

“বিলুদা, একদম দুঃখিত... শরীরটা বড় খারাপ ছিল... আজ...”

“তোর শরীরের নিকুচি করেছে... জলদি শেষ কর নইলে... মালিক তোকে আর আমাকে দুজনকেই বাটাম-পেটা করবে বলেছে—”

“সত্যি বলছি... হয়ে যাবে... তুমি চিন্তা কোরো না।”

“ওখানেই আমার চিন্তা... প্রতিবার এত ঘ্যান ঘ্যান করে ডিটেল চেয়ে ফোন করিস... এবারে একদম মড়ার মত চুপ? সেখানেই তো সন্দেহ হচ্ছে... তুই ছবিটা ধরেছিস তো আসলে? নাকি ল্যাজে খেলাচ্ছিস আমাকে?”

“ব্যাকগ্রাউন্ড হয়ে গেছে... রাফ স্কেচও প্রায় শেষ... কালার-স্কিম নিয়ে একটু পরীক্ষা...”

“পাঠা—”

“না, না... আলুসেদ্ধ-ভাত খেয়েছি আজ...”

“ওরে পাঁঠা নয়... পাঠা... তোর স্কেচটা পাঠা... বুঝলি গাধা—”

“ইয়ে... মানে... এখনও সেরকম আর কি...”

“দেখলি? কেমন তোর গুল ধরে ফেললাম? শোন, তোকে ঠিক দুটো দিন দিলাম... এর মধ্যে যদি কাজ না পেয়েছি... তবে বাড়িতে লোক পাঠিয়ে উদুম...”

“চিন্তা কোরো না বিলুদা, হয়ে যাবে...”

“মাপ মনে আছে তো? ছয় বই নয়, স্পাইন আড়াই ইঞ্চি—”

“পাঠিয়েছিলে তো... মনে আছে...”

এবার একটু শান্তি। অনেকখানি বকে বিলুদা ক্লান্ত বোধহয়।

“শোন হাবুল, পরীক্ষিত রায়-এর বই করার সুযোগ সবাই পায় না বুঝলি? ভদ্রলোক যা লেখেন তাই বেস্টসেলার। এতদিন কিশোরদের নিয়ে লিখেছেন— এইবার প্রথম প্রেমের উপন্যাস। দারুণ সুযোগ তোর। একটা ভালো ছবি তুলে দে তো সবাইকে... একটা মেয়ের মুখের ছবিই তো চেয়েছেন ভদ্রলোক... একটা সাদামাটা মুখ... তোর কাছে তো ওসব নস্যি... ‘তুলসীমঞ্চ’ বইটার জন্য কী জটিল একখানা জ্যামিতিক নক্সা এঁকেছিলি... আমি ভেবেছিলুম মালিক আমায় এই মারে তো সেই মারে... মালিকও নাক সিঁটকেছিল... তবু বই হয়ে বেরোবার পর তোর কভারটা কীরকম প্রশংসা পেল বল তো? এবারেরটা তো একদম জলভাত তোর কাছে—”

“সহজ বলেই কঠিন কিন্তু...”

“ঠিক আছে কাজটা হলে দু’শো টাকা এক্সট্রা দেব তোকে, হবে তো?”

“হয়ে যাবে... আগের এক্সট্রাগুলোও পাইনি... বাড়িভাড়ার টাকাটা...”

ফোন রেখে দিয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকলাম নিঝুম হয়ে। সাদা রঙের স্ক্রিনটা ফাঁকা পড়ে আছে গত এক সপ্তাহ ধরে। ওটাকে মাত্র একটা মুখ দিয়ে ভর্তি করতে হবে। ‘সহজ কাজ’। কিন্তু তবুও কাজটা হচ্ছে না। হয়ে উঠছে না। সাদা স্ক্রিনটা ভরে উঠছে না কিছুতেই।

মেঘের ডাকে চিন্তা ভাঙলো। পুব দিক থেকে ভিজে হাওয়ার স্রোতটা আমার রান্নাঘরের জানলা দিয়ে ঢুকে শোয়ার ঘরের সবকিছুকে আলতো ছুঁয়ে বারান্দার দরজা দিয়ে ছুটে পালালো। সঙ্গে নিয়ে এলো সেদ্ধ আলু আর পোড়া ভাতের গন্ধটাও। ক্ষিদে মরে গেছে। প্রায়ই হয় এরকম। ঘড়িতে একটা বাজে। তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ছুট দিলাম, একটা বাটিতে আলু আর ভাত মেখে ঘর ছেড়ে সিঁড়িতে পা রাখলাম। মেঘের অন্ধকারে সিঁড়ির কাছটা কেমন যেন অচেনা ঠেকছে আজ। দুটো তলা পেরিয়ে নিচের দরজায় এসে দাঁড়ালাম।

সামনের সরু গলিটা ফাঁকা আজ। কেউ নেই। অভিমান? তাই হবে বোধহয়। খোঁড়া হলেও ওর আত্মমর্যাদার অভাব নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফিরে আসছিলাম।

“উফ—”

মাথাটা ঘোরাতেই দেখতে পেলাম ওকে। কখন যেন অসুস্থ রুগ্ন শরীরটাকে টেনে এনেছে আমার সামনে। পিছনের পা’দুটো মাটির সঙ্গে ঘষ্টানি খাচ্ছে। কিন্তু দু’চোখে আশ্চর্য ঝকমকানি। না ও মরবে না। এত তাড়াতাড়ি নয়, নিশ্চয়। দরজার পাশে বাটি রাখতেই ‘মুলো’ ঝাঁপিয়ে পড়লো দুপুরের পেটপুজো সারতে। আমার অযত্নের গ্রাস, ওর পরম প্রাপ্তি। মনের কোণে কোথাও যেন ওর জন্য হিংসা হয়। কোথায় পায় এমন প্রাণশক্তি? এমন ভালোবাসা? জীবনের প্রতি?

দূরে কোথাও বাজ পড়লো। বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টির দানাগুলো হামলে পড়লো আমাদের এঁদো গলিতে। মুলোর তাতে কিছুই এসে যায় না। ভিজতে ভিজতেই জিভ চালায় ও। ঠান্ডা হাওয়ার তোড়ে আমিও ভিজি। অকারণে।

 

“আচ্ছা, এটাই কি ‘হিমগিরি’?”

কথাটা কোথা থেকে এলো ভাবতেই যেই না মাথা ঘুরিয়েছি ওমনি বুকের মধ্যেটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। আমার ঠিক পিছনেই কখন যেন একজন মহিলা এসে দাঁড়িয়েছেন। কীভাবে এবং কখন, কে জানে? প্রশ্নটি সেই যুবতীরই।

“আসলে কোথাও লেখা নেই তো...” মেয়েটি মাথার চুলে হাত বুলিয়ে স্মার্ট হবার চেষ্টা করল একটুখানি।

“লিখলেও কি কেউ বিশ্বাস করতো? বাড়িটার চেহারাখানা দেখছেন তো—” আমি বললাম।

উত্তর শুনে মেয়েটি হাসে। কুর্তার নিচটা জলে ভিজেছে। হলুদ সবুজে মাখামাখি জামাখানাও এখানে ওখানে লেপ্টে আছে। ঘাড় অব্দি ছোট করে ছাটা চুলগুলোয় বৃষ্টির কুচি।

“একজনকে খুঁজছিলাম, একটু বলবেন কোন তলায় থাকে?” চারপেয়ে প্রাণীটার খাওয়া শেষ। খালি বাটি নিয়ে ফিরতি পথ ধরতে গিয়ে প্রশ্নটায় আবার ধাক্কা খেলাম।

“বলুন কাকে চাই?”

“অনীক ঘোষাল—”

“উনি তিনতলায় থাকেন—”

“ওহ, ধন্যবাদ।”

মেয়েটি দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে উপরের দিকে ছুটলো। আমি দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। তারপর ধীরেসুস্থে হাঁটা লাগালাম। ঘরের দরজার সামনে পৌঁছে আবার দেখলাম মেয়েটিকে।

“উনি তো নেই, এদিকে দরজা হাট করে খোলা—”

“আসলে ঘরে কিছুই তো নেই তাই তালা দেবার প্রয়োজন হয়নি—”

“ওহ, আপনিই অনীকবাবু?”

“সবাই ডাকে হাবুল বা হাবলা বলে। আসল নামটা এত কম ব্যবহার হয়েছে যে মাঝেমধ্যেই ভুলেই যাই।”

“ও, আপনার আসল নামটা কিন্তু অনেকেই জানে। এমনকি পরীক্ষিতের খুব ইচ্ছে ছিল ওর এই উপন্যাসটার জন্য আপনিই তুলি ধরুন।”

“ইয়ে... মানে... বিলুদা তো বলল—”

মেয়েটি হাসলো, “বিলুদাকে তো চেনেন। উনি নিশ্চয় নিজেই ক্রেডিট নিয়েছেন?”

“ক্রেডিটের কী আছে, আসলে কেউ যে আমাকে দিয়ে কভার বানাবে বলে প্রকাশককে জোর করবেন এরকমটা ভাবিনি কোনোদিন,” একটু থেমে মেয়েটাকে ঘরে বসার আহ্বান জানালাম, “আর তাছাড়া, তুলি ধরার দিন আর নেই। এখন সব ছবিই ডিজিট্যাল—”

“এটা কী ফুল?” মেয়েটা ক্যানভাসের দিকে তর্জনী তুলে দাঁড়িয়েছে। আমি লজ্জা পেলাম।

“ওটা ‘লাল ফুল’—”

“বাহ্, খাসা নাম। খানিকটা জবা, খানিকটা নীলকণ্ঠ, খানিকটা—”

“স্থলপদ্ম—”

“সব কিছুর জগাখিচুড়ি? মাথা কাজ করছিল না?”

“কী করে বুঝলেন?”

“আসলে পুলুকেও ওরকম করতে দেখতাম কিনা। এলেমেলো কথা সাজাতো, উল্টোপাল্টা সংলাপ, যাচ্ছেতাই সব দৃশ্য। যখন মন লাগতো না কাজে ওভাবেই নাকি মনোযোগ ফেরাতো ও—”

“তা বেশ, কিন্তু পুলু কে?”

“পরীক্ষিত, ওর ডাক নাম ছিল ‘পুলু’। আপনার যেমন হাবুল—”

“ও... ছিল?...”

“ওই আর কি, যদ্দিন কথাবার্তা হত ওকে ওই নামেই ডাকতাম—”

“আর এখন?”

“আলাপ নেই বহুদিন, তাই—”

“আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করতে ভুলে গেছিলাম,” আমি বারান্দার ফোঁকর দিয়ে কালো মেঘে ঢাকা আকাশটাকে এক বার চোখ বুলিয়ে দেখে নিয়ে সুইচে আঙ্গুল বোলাই, “আপনার পরিচয়?”

আলোটা হঠাৎ করে ঘরটাকে একটা নাটকের স্টেজ বানিয়ে ফেলে। আমি অস্বস্তিতে পড়ে যাই। মেয়েটাও। আলোর ঔজ্জ্বল্যে নাকি মেয়েটার রূপের ছটায়?

“উল্কা গোস্বামী, আমি আসলে পরীক্ষিতের একজন গুণমুগ্ধ পাঠিকা—”

উল্কাই বটে। আগুনের ফুলকিও। ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যেই বাজ পড়ল কোথাও। আমার এক কামরার ঘরেই নাকি?

“ও, আচ্ছা। কিন্তু আমার সঙ্গে—”

“আসলে...”

“আসলে?”

“কীভাবে বলি?”

“আমি জল আনছি, আপনি ততক্ষণ ভাবুন একটু—”

“আমার তো তেষ্টা পায়নি—”

“আমার পেয়েছে—”

“ও—”

 

রান্নাঘর থেকে ফিরে দেখলাম ঘর ফাঁকা। একটু খারাপ লাগলো। একটু না, বেশ খানিকটা। আমার কথা বলার ছিরি দেখেই বোধহয় মেয়েটা পালিয়েছে। যদিও একটা হালকা সুগন্ধ এখনও বাতাসে ভাসছে।

“আসলে, আমি ওর উপন্যাসটা সম্পর্কে জানতে চাইছিলাম—” কথাগুলো ভেসে এলো বারান্দা থেকে। মেয়েটা যায়নি।

“সেটা তো ওনাকে জিজ্ঞাসা করলেই বলতে পারতেন—”

“সে সুযোগ নেই বলেই এইভাবে আসা—” মাথায় এখন এলেমেলো চিন্তার খেলা বলেই আর প্রশ্ন করলাম না। সব উত্তরে আমার কাজই বা কী?

“ভিতরে এসে বসতে পারেন—”

উল্কা ঘরে এসে বসলো। আমার তক্তাপোশটায়। ‘স্প্যানিশ গ্রে’— কথাটা মনে পড়তেই লজ্জা পেলাম।

“কী নিয়ে লিখছে পুলু একটু বলতে পারবেন?”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কী ভাগ্য লেখকদের! ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে একজন মহিলা মরিয়া হয়ে খুঁজছেন প্রিয় লেখকের প্রচ্ছদশিল্পীকে। শুধু এটুকু জানতে যে, বইয়ের বিষয়টা ঠিক কী নিয়ে। ঈর্ষা ছাড়া আর কোনো অনুভূতি কাজ করছিল না।

ভাঙা মোড়াটা আলনার পাশ থেকে বার করে বসলাম। মুখে কথা যোগাচ্ছিল না, তবুও কিছু একটা বলতে মুখ খুললাম।

“দুঃখের ব্যাপার, আমি পাণ্ডুলিপি না পড়েই ছবি আঁকি। সুতরাং—”

“কী বললেন? পাণ্ডুলিপি না পড়েই আপনি ছবি আঁকেন? বিশ্বাস করি না। পাণ্ডুলিপি না পড়েই কি ‘অর্থহীন’-এর ওই সবুজ মাঠখানা কভারে বসিয়েছিলেন? অথবা যদি ধরি ‘রক্তবিলাস’-এর ওই বাল্ব-টার কথা, যার কোনো ফিলামেন্টই নেই?”

“হ্যাঁ, সত্যিই আমি পাণ্ডুলিপি পড়ি না। তবে লেখক অথবা লেখিকার নোট নিই। তাঁর চিন্তাভাবনাগুলো বোঝার চেষ্টা করি। তারপর যা মাথায় আসে তাইই আঁকি—”

“তা পুলু কী নোট দিয়েছিল আপনাকে?” মেয়েটা নাছোড়বান্দা। আমি অসহায়। খাটের ওপরে ট্যাবের দিকে তর্জনী তুলে দেখাই, “বিলুদা ফোনে বলেছিল, আমি লিখে নিয়েছিলাম। কাগজটা ওটার নিচে আছে—”

“আমি দেখলে আপত্তি নেই তো?”

“প্রকাশনীর আপত্তি থাকতে পারে, আমার নেই—”

মেয়েটি কাগজ বের করে উৎসুক হয়ে চোখ বোলালো তাতে। নিজের লেখা নোটটা শুনতে পেলাম ওর মুখে। অস্বস্তি আরও বাড়লো।

“ফ্রন্ট কভার জুড়ে থাকবে একটি মুখ... মেয়ের... যুবতীর... বয়েস কত... এই ধরলাম বাইশ কি চব্বিশ... মুখটা কেমন... সহজ... সরল... হাসিখুশি... কিন্তু একটু আলগা বিষণ্ণতা ছেয়ে আছে... চোখ... চোখ... চোখ দুটো শান্ত... গম্ভীর... আবার শান্ত মানে মরা মানুষের মত নয়... চঞ্চল... ছটফটে... কন্ট্রাডিক্টরি... সুন্দরী... সুন্দরী তো বটেই... ছবিটা কিন্তু বোকা বোকা পোর্ট্রেট টাইপের নয়... একটু অন্যরকম... অন্যরকম বলতে... একটু রূপকধর্মী... অবশ্য একেবারে উত্তরাধুনিক বকচ্ছপ নয়... মিনিংফুল... একটু... একটু আটপৌরে আবার একটু আধুনিক... মানে সবরকম মিলিয়ে মিশিয়ে... ধুর শালা... জ্বালিয়ে মারলে...”

“শেষ দিকটা বিলুদা কোনো কর্মচারীকে বলছিলেন, আমি ভুল করে টুকে নিয়েছিলাম—”

“আঁকলেন?”

“না, হয়ে ওঠেনি এখনও।”

“ওদিকে শুনলাম বই বেরোচ্ছে দিন দশেকের মাথায়?”

“আমিও শুনেছি—”

“পারবেন আঁকতে?”

“বোধহয় না—”

“পুলুদা কিন্তু অনেক আশা করে আছেন বইটার ওপর। এটা ওর লেখা প্রেমের উপন্যাস। বোধহয় এটা ওর জীবনের একটা সেরা লেখা হয়ে থাকবে। মাস্টারপিস। আপনাদের ভাষায়।”

“জানেন কীভাবে মানুষ ‘মাস্টারপিস’-এর জন্ম দেন? জানলে বলবেন তো আমায়, আমারও অনেক দিনের সাধ কিনা—”

মেয়েটা আমার দিকে তাকায়। ‘শান্ত কিন্তু ছটফটে’ মণিদুটো কয়েকবার নাচে। আমার মাথায় একখানা রেখা জন্মায়।

“আমি সাধারণ পাঠিকা। ওসবের জ্ঞান নেই খুব একটা। তবে পুলুদা আগে খুব বলতেন, সব সেরা সৃষ্টির গোড়ায় থাকে একটা ভীষণ রকমের ট্র্যাজেডি—”

“হ্যাঁ সবাই সেটাই বলে অবশ্য...”

“আপনার নেই না?”

“কী বলুন তো?”

“ট্র্যাজেডি?”

ঠোঁট কামড়ে ভাবি। অনাথ হয়ে যাওয়া, সারাজীবন দারিদ্র মাথায় বয়ে বেড়ানো, একটাও বন্ধু না থাকা, বাড়িওলার কাছে প্রতিদিন ভাড়ার জন্য গাল খাওয়া— কোনোটাকেই কি ট্র্যাজেডি বলা যায়? বলা যায় না হয়তো, কারণ আমি এখনও একটা ‘মাস্টারপিস’ আঁকিনি।

 

“উঁহু...”

“তাতেও কিছু এসে যায় না অনীকবাবু। আমাদের সবাইকেই যে কালজয়ী শিল্পী হতে হবে তার কি কোনো মানে আছে? কেউ কেউ শুধুই ভালো শিল্পী হলেও তো চলে, তাই না?”

সত্যিই কি চলে? উত্তর জানা নেই বলে চুপ করে থাকি। ভাবি।

“আমাদের সবার জীবনে দুঃখকষ্ট আছে। কিন্তু কজন সেই ব্যথাগুলোকে নিজের শিল্পের মিউজ বানাতে পেরেছে বলুন তো?”

তর্ক করার জায়গা নেই। আসলে ভাষা নেই। দিনভর যে বুক ভারী করা বিষন্নতার মধ্যে কাটাই সেখানে কথার বড্ড অভাব। তাই অনভ্যাসের দায়ে আলাপ জমে না। আগে কোনোদিন এ নিয়ে মাথা ঠুকিনি, আজ সত্যি সত্যি দেয়াল খুঁজলাম।

“আপনি তো সৃজনশীল মানুষ, এই যে একলা থাকার অভ্যাস, এই যে আপনার একাকিত্বে ডুবে থাকার ইচ্ছে— সত্যি করে বলুন তো এটাই আপনার শক্তি নয় কি?”

“আগে ভেবে দেখিনি—”

“পারলে ভেবে দেখবেন প্লিজ,” মেয়েটি হাসে, তারপর একটু নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে গম্ভীর হয়, “পুলুর বইটা যদি বাজারে সাফল্য না পায় তাহলে ওর ভেঙে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। অন্তর্মুখী মানুষদের নিয়ে এই এক ঝামেলা—”

ওর দৃষ্টি আমার মুখের দিকে তাক করা আছে, ধারালো তরবারির মত। আমি অসহায়ভাবে এদিক ওদিকে চোখ ফিরিয়ে কথা খুঁজি, “আমার নিজের কোন ধারণাই নেই বইটার বিষয় নিয়ে। বিলুদা বলেছিলেন ‘প্রেমের গল্প’— যদিও সেটা বিশেষ কিছুই ব্যাখ্যা করে না।”

“ওর দৃষ্টিতে দেখা ওর নিজের জীবনেরই প্রেমের গল্প। আগে যখন প্রতিদিন কথা হত, তখন অনেকবার এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের আলোচনা হত। আসলে—”

মেয়েটির মুখটা লাল হয়ে যায় একটু। একটু সময় নিয়ে সে আবার কথোপকথনে ফেরে।

“ওর একজন ‘মিউজ’ ছিল। মানে যাকে বলে ‘অনুপ্রেরণা’— যার সঙ্গে পরিচয় হওয়াতে ওর কাগজে কলমে ভাবপ্রকাশের সাহস জোটে প্রথম। মেয়েটি ওকে আরও লিখতে বলত। ওর লেখার খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করত। যেমন হয় আর কি। পিকাসোর যেমন ডোরা মার ছিলেন, ঠিক তেমনি। যিনি এককালে বলেছিলেন “After Picasso, only God”— ব্যাপারটা বোঝাতে পারলাম?”

“কিছুটা—”

“পুলু তাদের সম্পর্কটা নিয়ে একটা গল্প লিখতে চেয়েছিল। উপন্যাস। প্রেমের। মেয়েটি রাজি হয়নি। লোকলজ্জার ভয় ছিল, তাছাড়া পরিচিত মহলে নানা রকমের বিচ্ছিরি গুজব ছড়াবার আতঙ্ক।”

“মিউজ— তিনি যদি মহিলা হয়ে থাকেন তবে কি বিবাহিতা ছিলেন?”

“না। আসল পুলু যেটাকে প্রেম ভাবতে শুরু করেছিল সেটা বোধহয় কোনোদিন আদৌ বন্ধুত্বের গণ্ডি পেরিয়ে অন্য কিছুই ছিল না। অন্তত মেয়েটির দিক থেকে। হয়ত শুধু ওর লেখাটাকে পছন্দ করতেন বলেই পুলুকে উৎসাহিত করেছিলেন, অনুপ্রাণিত করেছিলেন। হয়ত শুধু সেই কারণেই একটা মিথ্যে সম্পর্কের বাঁধন গড়ছে জেনেও চুপ করে থেকেছিলেন—”

“বুঝলাম—”

মেয়েটির মুখে এখনও অস্বস্তির ছাপ দেখা যাচ্ছে। আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করি ব্যাপারটা নিয়ে। আর তখনিই মাথায় আসে প্রশ্নটা।

“তাহলে আজ হঠাৎ লেখক বইটি প্রকাশ করছেন যে? ভদ্রমহিলার কোনো আপত্তি নেই এতে?”

উল্কা বারান্দার দিকে মুখ ঘুরিয়েছিল। হাওয়ার দোলায় আমার কচি ‘ফরগেট-মি-নট’-এর চারাগুলো সেখানে মাথা দুলিয়ে নাচছে। বৃষ্টির ছাঁট এসে ঢুকছে ঘরের মধ্যে।

“নাহ, আপত্তি নেই আর। থাকা উচিতও নয়। তাই না?”

“সেটাই তো জানতে চাইছি, আজ হঠাৎ কী এমন হল যে ভদ্রমহিলা রাজি হয়ে গেলেন?”

না, এই অবধারিত প্রশ্নটা করিনি। অপেক্ষা করছিলাম। ভেবেছিলাম উল্কা এর উত্তর দিয়ে দেবে। কিন্তু সে তখন চুপ।

“এবার উঠি,” উল্কা ঝটপট উঠে পড়লো খাট ছেড়ে, “অনেক বিরক্ত করলাম আপনাকে। দুঃখিত।”

“আরে না না এ আর এমন কী!” অথবা “ধূর, আমার তো বেশ ভালোই লাগলো—” নাহলে নিদেনপক্ষে “আবার আসবেন কিন্তু—” এরকম কিছু একটা বলতে পারতাম হয়তো। কিন্তু তার বদলে একটা বোকা বোকা নমস্কার করলাম প্রত্যুত্তরে। ওই যে বললাম, অভ্যাস নেই।

দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে আমার একলা ঘরের অতিথি হাসল একবার, আমি তাকে বলতে শুনলাম, “আমি জানি আপনি এবারও দারুণ কাজ করবেন। কী করবেন তো?”

আমি মাথা দোলালাম। “ছাতা নেই, এই বৃষ্টির মধ্যে—” নিজের মুখেই কথাটা এত বিস্বাদ লাগলো যে থামতে বাধ্য হলাম।

মেয়েটা সিঁড়ির দিকে পা ফেলতে গিয়ে বলে উঠল, “জানেন কি, ‘ডিপ্রেশন’ একটা অসুখ। ওটাকে সারাতে ‘মিউজ’ বা ‘একাকিত্ব’ কেউ-ই সাহায্য করে না। একমাত্র ডাক্তার ছাড়া—”

চলে গেল সে। আমি দরজা বন্ধ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। সামনের ভিজতে থাকা এঁদো গলিটায় চোখ রাখলাম। ভেবেছিলাম বৃষ্টি দেখছি, কিন্তু বুঝলাম মেয়েটাকে খুঁজছি। আমরা সবাই কাউকে না কাউকে খুঁজি, তাই না? অথচ গলিটা ফাঁকা। এতটা ঝড়জলের মধ্যেও পথটা মরুভূমির মত নির্জন। বুকের কোণায় একটু ব্যথা রিনরিন করে ওঠে। সেই সঙ্গে একটা চিন্তা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। ‘ডিপ্রেশন’ নিয়ে ওর কথাটা কি আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা?

 

কান টানলে মাথা আসে। একটা প্রশ্ন জাগলে আরও অনেকে এসে হাজির হয়। এত কিছুর মধ্যে পড়ে আমার চিন্তাভাবনাগুলো আরও জড়িয়ে যায়। মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিয়ে চিন্তাসূত্রগুলোকে ঝেড়ে ফেললাম। হাতের কাজটা সারা বাকি এখনও। আর তাছাড়া আমার মনের ক্যানভাসে তখন একটার পর একটা রেখা ফুটে উঠছে। নিজেরাই। ওদের সাজিয়ে গুছিয়ে শূন্য স্ক্রিনে ধরতে হবে। তবেই ‘কাজ’-টা শেষ হবে।

এরপর যে ঠিক কী হয়েছিল জানি না। তবে এটুকু মনে আছে, ট্যাবের শেষ প্রান্তে চার্জারের কর্ড গুঁজে যুদ্ধে নেমে পড়েছিলাম। যুদ্ধের থেকে তপস্যাই বলা ভালো। বারবার আঁকছিলাম, মুছছিলাম, রং দিচ্ছিলাম, ব্লেন্ড করছিলাম, শ্যাডো দিচ্ছিলাম, রং পাল্টাচ্ছিলাম আর রাগ করছিলাম। নিজের ওপর। নিজের অক্ষমতার ওপর। তারপরেও এঁকে যাচ্ছিলাম।

দ্বিতীয় দিন সকালে ঘুম ভাঙলো ফোনের রিঙে।

“সাড়ে সতেরোবার কল করলাম হারামজাদা—”

বিলুদা। ‘সাড়ে’ কথাটার আর তাৎপর্য জিজ্ঞাসা করার সাহস হল না।

“ছবিটা পছন্দ হয়নি?”

“না!”

“ও—”

স্বভাবতই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।

“ইউ ক্যান ডু বেটার—” বিলুদা থেমে গেল কিছুক্ষণ, “আর হ্যাঁ, লেখক মশায় তোর ফোন নাম্বার চেয়েছেন, আজ সকালেই তোকে ফোন করবেন জানিয়েছেন। বুঝলি?”

“তুমি বললে আবার সবকিছু পাল্টে নতুন করে।”

ফোনটা কেটে গেল।

ঘুমচোখে আর একরাশ ভয় নিয়ে রান্নাঘরে গেলাম। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। দুধ আর চিনি, দুটোই নেই। তাই লিকার চা বানাতে শুরু করলাম। কিন্তু ঢালবো কিসে? কাপটাই যে খুঁজে পাচ্ছি না। মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। খাবার বাটিতে চা ঢেলে সুপের মত চুমুক দিলাম। মুখ বেঁকে গেল বিস্বাদে। আর সঙ্গে সঙ্গেই ফোনটা বাজলো। আবার।

“অনীকবাবু?”

“বলছি—”

“ধন্যবাদ—”

“আপনি দেখেছেন কভারটা?”

“ওটা অবান্তর প্রশ্ন। যেটা জানতে চাইছিলাম, সেটা হল— কেমন করে আঁকলেন মুখটা?”

“এই হয়ে গেল আর কি। আপনি বললে অবশ্যই আমি পাল্টে দিতে পারি, যদি আপনার খারাপ লেগে থাকে—”

“ভুল করছেন। আমি আসলে অবাক হয়েছি। আপনি তো গল্পটাই পড়েননি। মেয়েটির বর্ণনা তো আপনার জানার কথা নয়। অথচ, ধুলো ধুলো সোনার রেণুর মত মিলিয়ে যাওয়া মুখের প্রতিটা ডিটেইলিং আমার খুব চেনা—”

“আমারও—” বলতে পারতাম, বলিনি। ধরা পড়ে যাবার ভয়ে।

“আচ্ছা, আপনি জানতে চান না কেন প্রচ্ছদটা নিয়ে এমন পাগলামি করছিলাম? কেন এরকম একটা গল্প লিখলাম?”

“আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার ভেবেই জিজ্ঞাসা করিনি। তবে কৌতূহল কিছুটা হয়েছিল তো বটেই।”

“আমি একজনকে চিনতাম। কলেজ থেকে। সুন্দরী, হাসিখুশি, মিশুকে। আমি চিরকালই মুখচোরা, আত্মমুখী, লাজুক। তা সত্ত্বেও বন্ধুত্ব হয়েছিল। আমার লেখাগুলোকে জোর করে পাবলিশারের কাছে পাঠানো থেকে শুরু করে আমার প্রতিটি বক্তব্যকে জহুরির মত চেখে সমালোচনা করে সে আমাকে ভরিয়ে রেখেছিল। ভাবতে শুরু করেছিলাম, প্রেম এসেছে জীবনে। আমার আর ওর গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। রাজি হয়নি। আমারও লেখা হয়ে ওঠেনি। ইচ্ছেটা যদিও রয়ে গেছিল—”

গল্পটা জানা। তাই মন্তব্য করিনি। শুধু ভাবছিলাম। লেখকের গোপন ভক্ত সমস্ত গল্প আমাকে জানিয়ে গিয়েছে— সে তথ্য কি ফাঁস করব এবার? ভাবছিলাম, তাই আর বলাও হল না।

“গল্পটা তাহলে এখন বলার প্রয়োজন মনে করলেন কেন? কোনো নির্দিষ্ট কারণে?”

“আমার কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল প্রথমে। নিজেও লেখালিখি করতো, খুব চেষ্টা চালাচ্ছিল ওর কাজগুলোকে নিয়ে একটা সংকলন করার। বইপাড়ার বিখ্যাত এক প্রকাশক আশ্বাসও দিয়েছিলেন বইটা ছাপাবার। আমাদের সবার থেকে নিজেকে আলাদা করে ও দিনরাত নিজের লেখা নিয়েই থাকতে শুরু করেছিল। কাজটা শেষও করেছিল। কিন্তু প্রকাশক কথা রাখেননি।”

“তারপর?”

“তারপর ডিপ্রেশন, আগেও ছিল— অবশ্য এমন প্রকটভাবে নয় হয়তো। মানসিক স্বাস্থ্য শেষ হয়ে গিয়েছিল একদম। ১৯শে মে, ২০১৪— মেয়েটা চলে গেল। পাণ্ডুলিপিটাকেও পুড়িয়ে দিয়েছিল অসহায় রাগে—”

‘চলে গেল’— তুখোড় লেখক শব্দের আড়ালে মৃত্যুর বীভৎসতা লুকোলেন। আমার মাথায় এলো আত্মহত্যার সম্ভাবনা। যেটা আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত শব্দ নয় হয়তো। একটা উত্তর পেলাম। আরেকটার অপেক্ষায় ছিলাম।

“আপনি যদি কিছু না মনে করেন, তাহলে আপনার বান্ধবীর নাম জানতে পারি?” স্বভাববিরুদ্ধ প্রশ্ন, কিন্তু বুকের মধ্যে হাঁপরের শব্দ বলে দিচ্ছিল আমি ঠিক কতটা কৌতূহলী।

 

বিখ্যাত লেখক একটুও দ্বিধায় না ভুগে নামটি বললেন। অনুরোধ করতেও ভুললেন না, আমি যেন গোপনীয়তা বজায় রাখি। তিনি চান না এই নিয়ে অযথা আলোচনা হোক। কিছু বলার সামর্থ্য ছিল না। খাটের ওপরে বসে পড়েছিলাম আমি। চোখের সামনে ভাসছিল বৃষ্টিভেজা শূন্য গলিপথটা। নিঃস্ব, রিক্ত, নির্জন। খেয়াল করিনি ফোনটা কখন কেটে গেছে আমার অলক্ষ্যে। চোখ গেল বারান্দায়। সেখানে সবুজ চারা গাছে নীলচে ফুলগুলো দুলছে। সংকেত। স্বীকার করার। ‘মাস্টারপিস’ সৃষ্টি করার। সুস্থ হবার।

যে সংকেত উল্কা গোস্বামী কোনোদিন পায়নি।